নবীনের প্রতিশোধ – রাজেশ বসু
মা বললেন, ‘শোন বাবা, খুদকুঁড়ো যা আছে দিনমান হয়ে যাবে। কালের ভাবনা কাল দেখব।’
মা-র কথায় কান দিল না নবীন। ক-দিন ধরে ওই খাবারই তো খাচ্ছে সে। আলুসেদ্ধও থাকে না রোজ। খালি নুন আর লঙ্কা। গলা দিয়ে নামতে চায় না। নেতাই সামন্ত শহরের বাবুদের বন দেখাতে এনেছেন। তাদের কেউ আস্ত মৌচাক চান। দিতে পারলে মোটা ইনাম। কথাটা শোনা ইস্তক বুকে মাদল বাজছে নবীনের। বেরিয়ে পড়েছে ডিঙি নিয়ে। কিছু রোজগার তো হবে। কদ্দিন আর আধপেটা খেয়ে থাকা যায়!
নিতাই সামন্ত বলছিল, ‘সাহেব খুব দরাজ। দু-চার টাকা নাকি কিছুই না। এক হাতে চাক দিবি, অন্য হাতে টাকা। কোনও গরমিল নেই।’
বুকের ভিতরটা ঢিপঢিপ করছিল নবীনের। টাকাটা হাতে এলে প্রথমেই আস্ত মুরগি কিনবে হাট থেকে। সঙ্গে পেঁয়াজ রসুন আলু শুকনো লঙ্কা আর মিনিকিট চাল। মাকে বলবে কষে রান্না করতে। ঝাল-ঝাল করে। পেটভরে একদম গলা পর্যন্ত খাবে নবীন। ভাবতেই জিভে জল এসে গিয়েছিল। মনে-মনে নিতাই সামন্তকে ধন্যবাদ দিয়েছিল। যদিও হোঁদল কুতকুত লোকটাকে মোটেই পছন্দ করে না সে। বনবিভাগে কাজ করে বলে যেন মাথা কিনে নিয়েছে। ভাবগতিকও সুবিধের না। যেমন ঘ্যাড়ঘেড়ে গলার স্বর, তেমনি শিয়ালের মতো দৃষ্টি। কী মতলবে ঘোরে কে জানে! বায়নাটা নিতাই সামন্ত অন্য কাউকেও দিতে পারত। বরাত ভালো নবীনের। এখন কাজটুকু সঠিক করতে পারলে হয়।
বনবিবিকে প্রণাম করে সকাল-সকাল তাই বেরিয়ে পড়েছে নবীন। মা একটু রাগল বটে, কী করা যাবে। একেবারে মুরগি নিয়ে ফিরে রাগ জল করে দেবে। একাই বেরিয়েছে ডিঙি নিয়ে। গন্তব্য কাদাখালির চর। গেঁওয়া বাইন পশুড় গর্জনে ভরতি মহাঘন জঙ্গল সেখানে। ক-দিন আগেই বাইনগাছে চড়ে ইয়া বড়ো একখানা টুসটুসে মৌচাক দেখেছে সে সেখানে। লক্ষ্য সেটাই। সুবিধে হচ্ছে, জল থেকে খুব বেশি পথ না। মক্ষির ঝাঁকও একটু যেন কম। চাকটাও খুব বেশি উঁচুতে না। নাগালের মধ্যেই। মুশকিল শুধু একটাই। হেঁতালের বড়ো বাড়বাড়ন্ত জায়গাটায়। দক্ষিণরায়ের বাহন ঘাপটি দিয়ে থাকলেই চিত্তির!
চিন্তাটা হতেই বুকটা গুড়গুড়িয়ে উঠল নবীনের। বিশ বছরের জোয়ান শরীরটা কঠিন হয়ে এল। ভয় যেমন হল চাপা একটা ক্রোধও তুষের আগুনের মতো ভুসভুসিয়ে উঠল। বাবার মুখখানা ভেসে উঠল চোখে। আজ থেকে সাত বচ্ছর আগে এমনি একটি দিনে দক্ষিণরায়ের বাহন টেনে নিয়ে গিয়েছিল বাবাকে। বাবা ছিল বাউলি। সেই সোঁদরবনের গহিনে গিয়ে আর ফিরল না সে। সাত বছর আগের কথা হলে কী হবে, ভীষণ সে দিনটা আজও চোখের সামনে ভাসে নবীনের।
আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছিল খুব। সকালটাও ছিল এমনি থমথমে। থেকে-থেকে দমকা হাওয়া। মার মনে কু-গেয়েছিল। মানা করেছিল বেরোতে। কিন্তু অমন বারণ শুনলে চলে না। বিশেষ করে যারা সোঁদরবনে থাকে।
শালতি চেপে তিনজন গিয়েছিল জঙ্গলে। নবীনও ছিল সঙ্গে। তেরো বছর বয়স তখন তার। বাবারা নামলেও সে নামেনি। রতনকাকার সঙ্গে সে থেকে গিয়েছিল শালতিতে। মুড়ি-বাতাসা খেতে খেতে খালের দু-পাশে বিস্তৃত বনের শোভা দেখছিল সে। পাখির কলকাকলি। চিতল হরিণের টিউ-টিউ ডাক। বাতাসে ভেসে আসা বুনোফুলের গন্ধ।
এমন সময় ভীষণ রকম চেঁচামেচির শব্দে সংবিৎ ফেরে। বাবারা ছুটে আসছে শালতির দিকে। ব্যাপারটা কী বোঝার আগেই রতনকাকা অসাধারণ দক্ষতায় শালতি ভিড়িয়ে দিল তীরে। বাবার আগে ছিল নুরচাচা। সে লাফ দিয়ে উঠতে-না-উঠতেই ঘটনাটা ঘটল। একদম ভোজবাজির মতো বিশাল একটা বাঘ এসে পড়ল কোত্থেকে। কিছু বোঝার আগেই বাবার পিছনের পায়ে কামড় বসিয়ে দিল সে। শালতিটা ডান হাতে ধরে ফেলেছিল বাবা। শুরু হল বাঘে-মানুষে প্রবল যুদ্ধ। বইঠা, কুড়ুল, খুন্তি, থালা-বাটি হাতের কাছে যা ছিল দমাদ্দম পড়তে শুরু করল বাঘের উপর। কিন্তু কী মরিয়া বাঘটা! কিছুতেই শিকার ছাড়বে না।
শেষপর্যন্ত অবশ্য নবীনরাই জিতল। নুরচাচার কুড়ুলের একটি মোক্ষম কোপ গিয়ে পড়ল বাঘের বাঁ-কানের উপর। ভয়ানক আর্তনাদ করে বাঘটা ছেড়ে দিয়েছিল বাবাকে। কিন্তু রণে ভঙ্গ দেওয়ার আগে বিরাশিসিক্কার একটি থাবা ছুড়েছিল সে। শালতিতে উঠতে পারলেও সেই থাবাতেই গুরুতর জখম হয় বাবা। পাঁজর বেরিয়ে এসেছিল তার। ফিনকি দিয়ে কী রক্ত! হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বাবাকে আর বাঁচানো যায়নি। ক্ষত বিষিয়ে উঠে তিনদিনের মাথায় চলে গিয়েছিল সে। বাঘটাকে ভোলেনি নবীন। জঙ্গলে গেলেই চোখ-কান খোলা রাখে সে। তক্কে-তক্কে থাকে। কোনোদিন যদি কানকাটা জানোয়ারটাকে বাগে পায় সে। শোধ নেবে বাবার মৃত্যুর! লোকে শুনে হাসে। বাঘের উপর বদলা! কী যে ভাবিস নবীন তুই। আসলে মনে-মনে সেও জানে ব্যাপারটা সম্ভব নয় হয়তো। কিন্তু, তবুও আশা ছাড়ে না। দা, বল্লম, কুড়ুল, এমনকী, ধারালো ছুরিকাঁচিও সঙ্গে নিয়ে ঘোরে সে। তবে আজ তার সঙ্গে বিশেষ অস্ত্র নেই। মৌচাকের চিন্তায় ভুলেছে সব। কেবলমাত্র কাঁচিখানাই সঙ্গে আছে। তেমন বিপদে পড়লে সত্যি মুশকিল। অবশ্য বড়ো-হাত কাঁচি। ছুরির মতোও ব্যবহার করা যায়।
ডান দিক বাঁ-দিক করে কাদাখালির জঙ্গলে পৌঁছোতে একটু বেলাই করে ফেলল সে। যদিও রোদের তেজ তো নেই-ই। বরং আকাশটা থম হয়ে আছে কেমন। গুড়গুড় শব্দও উঠছে থেকে থেকে। একটু চিন্তিত হল নবীন। অসময়ে ঝড়বাদল না-হয়।
গন্তব্যে পৌঁছে ডিঙি ভেড়াল নবীন। গামছা দিয়ে কোমরে বেঁধে নিল কাঁচিটা। নরম এঁটেল মাটিতে বাঁশের খোঁট ঠুসে ডিঙিটা বাঁধল রশি দিয়ে। খেয়াল হল, মুখোশ নিতে ভুলেছে। বাঘকে বোকা বানাতে মউলি বা কাঠুরেরা বাঘের মুখ আঁকা মুখোশ পরে নেয়। একটা পিছনে। না:, বড়ো তাড়াহুড়ো করেছে সে। ধোঁয়ার সরঞ্জামও আনেনি। অবশ্য এটা সে সব-সময় সঙ্গে রাখে না। আসলে মৌমাছি হটাতে ধোঁয়া লাগে না নবীনের। দেখবার মতো হাতের কাজ তার। অদ্ভুত দক্ষতায় কেবল আঙুল দিয়েই একটা-একটা করে মৌমাছি সরিয়ে চাক পরিষ্কার করতে পারে সে। এ কাজে দরকার অটল ধৈর্যের। আর নিবিড় নিষ্ঠার। বনবিবির দয়ায় নবীন তা অর্জন করেছে।
খালের এধারে হলদে-সবুজ হেঁতালের বন। এর মধ্যেই মউলিদের পায়ে-চলা শুঁড়িপথ। পথের মুখে এসে একটু থমকাল নবীন। কোমরের কাঁচিতে ডান হাতটা রাখল একটু। একলা মানুষখেকোদের ডেরায় ঢুকছে! বুক ঢিপঢিপ একটু করবে বই কী। তা ছাড়া আবহাওয়াটা সুবিধের নয়। দমকা বাতাস বইছে খুব। আকাশটাও গোলমেলে। না:! মনকে বোঝাল নবীন। ভয় পেলে চলে না। মৌচাকটা তার চাই। অত টাকা। বিনা কষ্টে কেষ্ট মেলে নাকি!
কিন্তু কপাল তার সত্যিই মন্দ আজ। চাকটা কোথায় ঠিক নজর করেছিল মনে করতে পারল না সে। ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল বেমক্কা। তবুও গাছে চড়ল নবীন। মগডালে উঠে যদি চাকটা নজরে আসে কোথাও। কিন্তু চাক সে দেখতে তো পেলই না, বরং গুড়ুম করে আচমকা এমন একটা আওয়াজ হল। চমকে গিয়ে পড়েই যাচ্ছিল গাছ থেকে, পরক্ষণেই টিটি-ট্যাঁট্যাঁ করে কোত্থেকে সব পাখির দল চেঁচিয়ে উঠে উড়তে শুরু করে দিল মাথার উপর।
বুকটা ধপ করে উঠল নবীনের। এই আওয়াজ সে চেনে। বন্দুকের গুলির আওয়াজ। বনরক্ষীরা মাঝে-মধ্যে গুলিটুলি ছোড়ে বটে, কিন্তু কেন জানি তার মন অন্য কথা বলছিল। নিতাই সামন্তর কাজ না তো! শহুরে বাবুদের নিয়ে ঘোরা মানেই যত সমস্ত কুকর্ম করা। পাখি শিকার। হরিণ শিকার। কে জানে আরও কত কী!
কী মনে করে তরতরিয়ে গাছ থেকে নেমে পড়ল নবীন। হড়কে-হড়কে কাদামাটি পেরিয়ে বাঁশের খোঁট তুলে নিল মাটি থেকে। চাক উপড়ে কাজ নেই আর তার। নিতাই সামন্তর মতো লোকের সঙ্গে কোনওরকম কারবারে যাবে না সে।
ইচ্ছে ছিল বগনাখালির দিকে যাওয়ার। সেখানে এক দঙ্গল কাঁঠালগাছ দেখে এসেছে সে। কাঠাঁল হয়েছে কিছু। গুঁড়ি থেকে মগডাল পর্যন্ত ঝুড়ি-ঝুড়ি ফল। পাকতে দেরি আছে। সব এঁচড়। দু-চারটে ছিঁড়তে পারলে অন্তত ক-টা দিনের চিন্তা থাকে না। মাংসের মতোই রান্না হবে।
কিন্তু আজ বুঝি উপরওয়ালার সবেতেই আপত্তি। বৃষ্টির বেগ ক্রমশই বেড়ে চলেছে। ডিঙি বাইবে কী, নজরই চলে না যে। সব ঝাপসা। ডিঙির মধ্যিখানে দু-হাত মতো ছই করে নিয়েছিল নবীন। মাঝনদীতে ডিঙি রেখে সেই ছইয়ের ভিতর গুটিসুটি বসে রইল সে।
একটানা বৃষ্টি দেখতে-দেখতে একসময় বুঝি ঝিম এসে গিয়েছিল তার। নৌকোটা হঠাৎ জোর দুলে ওঠায় চোখ খুলল সে। কে যেন চড়ে বসেছে ডিঙিতে। প্রথমবার ঠাহর করতে পারল না নবীন। কিন্তু পরক্ষণেই আরোহীকে চিনতে পেরে হৃৎপিন্ডটা এক লাফে গলায় উঠে এল তার।
কী ভয়ংকর দৃশ্য! এ কী দেখছে সে! বারকয়েক চোখ কচলে নিল নবীন। ক-হাত তফাতের প্রাণীটিকে চিনতেও কোনো অসুবিধে হয় না। খোদ দক্ষিণরায়ের বাহন, সোঁদরবনের ত্রাস!
কিন্তু সত্যি ত্রাস কী? বাঘটার আচরণে সেরকম কিছু দেখছে না কিন্তু নবীন। বরং বড়ো ক্লান্ত, শ্রান্ত লাগছে যেন জীবটিকে। গলায় বনরক্ষীদের যন্তর দেওয়া মালা লাগানো। মানে বাঘটিকে ধরা হয়েছিল কখনও। মালা না-কলার কী যেন বলে, ঝুলিয়ে দিয়েছে নিতাই সামন্তরা। এতে নাকি বাঘের গতিবিধি ঠাহর করা যায়। কলারের একটা দিক কিছুটা ছিঁড়ে গিয়েছে। বাঘটাই হয়তো গাছেটাছে ঘষে কলারটা খোলার চেষ্টা করেছিল। নবীনের মন হল, জিনিসটা অকেজো হয়ে গেলেই ভালো। কারো নজরদারির মধ্যে স্বাধীনভাবে থাকা যায় নাকি!
বাঘটা হামাগুড়ি দিয়ে সোজা ছইয়ের দিকে এগিয়ে এল এবার। পেল্লায় চেহারা। শীর্ণ হলে কী হবে, আকারে তো কম না। অন্তত দশ-বারো হাত তো হবেই। দেহের ভারে নৌকো যা দুলছে, ডুবে না যায়! নবীন টের পেল তার হাঁটু দুটো কাঁপছে থরথর করে। বনবিবিকে স্মরণ করল সে। বাঘের চোখে সেও চেয়ে রইল অপলক।
শেষে ধীরে-ধীরে গলুইয়ের দিকে পিছোতে লাগল নবীন। পায়ে কীসের ধাতব স্পর্শ? কাঁচিটা। একটু হলেও মনে বল পেল সে। বাঘের চোখ থেকে চোখ না-সরিয়ে একটু ঝুঁকে কাঁচিটা উঠিয়ে নিল হাতে। আর ঠিক তখনই লক্ষ করল, বাঘটার বাঁ-দিকের কানের কিছুটা অংশ নেই। কাটা। আরও বড়ো কথা, বাঘটার পিঠেও একটা ক্ষতচিহ্ন। এটা কিন্তু কানের মতো পুরোনো নয়, বরং রক্ত পড়ছে চুঁইয়ে।
কিন্তু সে যা হোক, বাঘের কান কাটা দেখে নবীনের গোটা শরীরটা কামারশালার আগুনের মতো জ্বলে উঠল হঠাৎ। এই সেই বাঘ নয়তো? সাত বচ্ছর আগে যে তার বাবার জীবনটা ছিনিয়ে নিয়েছিল!
এই দিনটির জন্যে কতদিন অপেক্ষা করে থেকেছে নবীন। বনবিবির কী অদ্ভুত মতি! মানুষখেকো জন্তুটি আজ তারই ডিঙি নৌকোয় নিজের থেকে উঠে এসেছে! আহত হয়ে তার কাছেই আশ্রয়প্রার্থী!
গলুইয়ে বসে পড়ল নবীন। বৃষ্টি একটু ধরেছে। লালচে হয়ে আছে আকাশ। ডিঙিটা আপন খেয়ালে চলেছে ভাসতে ভাসতে। দূরে খালটার বাঁকে মনে হল নিতাই সামন্তর ভুটভুটি। বুকটা একটু দুরদুরিয়ে উঠল নবীনের। সত্যি বলতে বনের এ প্রান্তে আসার অনুমতি তারও নেই। বনরক্ষীরা দেখলেই জরিমানা চাইবে। জরিমানা মানে নগদ টাকা। যা থাকে কপালে, সাহসে ভর করে বইঠা ধরল নবীন। চোখের পলকে সামনে বাঁকটায় ঢুকিয়ে ফেলল ডিঙিটাকে। এদিক দিয়ে ঘুরপথ আছে। ভুটভুটি আসতে পারবে না। আটকে যাবে চড়ায়।
কিন্তু তার অনুমান কিছুটা হলেও ভুল। একটুক্ষণের মধ্যেই ভুটভুটিটা বাঁকের মুখে চলে এল। ঢুকল না অবশ্য। কিন্তু নবীন স্পষ্ট শুনল নিতাই সামন্ত চিৎকার করে কীসব বলছে যেন। মনে হল, তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা। আশ্চর্য হল নবীন। তার নৌকোয় যে বাঘ আছে, সে কথাই যেন বলছে নিতাই সামন্ত। কিন্তু বুঝল কী করে? দূরবিন চোখে দিয়ে?
বাঘটার দিকে তাকাল নবীন। কী অবাক দৃশ্য! চুপটি করে বসে আছে হাঁটু ভেঙে। কয়েক হাত তফাতে আস্ত একটা মানুষ দেখেও মন নেই শিকারে। জিভ বের করে পিঠের ক্ষতটা চাটার চেষ্টা করছে।
হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মতো খেয়াল হল নবীনের। ওই যন্ত্র না-কলটার জন্যেই নিতাই সামন্তরা বাঘকে ঠাহর করতে পারছে না তো? বলা যায় না। বন্দুকের গুলির যে আওয়াজ সে শুনেছিল, হতে পারে সেটা ওই ভুটভুটির বাবুরাই করেছে। এবং এও হতে পারে, বাঘটা ওদের গুলিতেই আহত হয়েছে!
সর্বনাশ! কথাটা সে শুনেছিল বটে। বনরক্ষীদেরই একদল টাকার লোভে নানান কুকর্ম করছে। বন কেটে ফেলছে। বাঘের গলার সর্বনেশে ওই মালাটাই যত নষ্টের মূল। ওটা দিয়েই বাঘের হদিশ অনায়াসে টের পেয়ে যাচ্ছে বদমাশগুলো। পরিশ্রম কমে যাচ্ছে চোরাশিকারিদের।
কী অন্যায়! কী অন্যায়! এভাবে বাঘগুলোকে মেরে ফেলছে এরা! ছি: ছি:! আসলে এইসব লোকগুলোর জন্যেই বাঘ এমন আচরণ করছে। মানুষের দিকে নজর দিচ্ছে। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত স্কুলে পড়েছে নবীন। মাস্টারমশাই বলতেন, ইচ্ছেমতো বন কেটে ফেলছে মানুষ। বাঘের খাবারের রসদে টান পড়ছে। থাকার জায়গার অভাব ঘটছে। এমনকী, প্রয়োজনমতো মিষ্টি জলও নাকি সে পাচ্ছে না। লবণজলে ভরে যাচ্ছে চারদিক। ঠিক কথা। চিন্তা করল নবীন। বাঘের আর দোষ কী! তা ছাড়া সত্যি বলতে সে নিজেই তো আস্ত মুরগি কিনে খাওয়ার স্বপ্ন দেখেছে। সেও তো প্রাণীহত্যা। মানুষ বলে দোষ নেই তাতে?
কী মনে করে তিরবেগে বইঠা বেয়ে আরও দূরে সরে এল নবীন। এ জঙ্গল সে চেনে তার হাতের চেটোর মতো। এনালা-ওনালা করে ভুটভুটির নজরের আড়ালে চলে এল সে।
দক্ষিণরায়ের বাহন চার-পা গুটিয়ে মা ষষ্টির বাহনের মতোই বসেছিল একদম। নবীনকে দেখল পিটপিট করে। ইচ্ছে করলেই বাঘটা থাবা বসাতে পারে তার মুখে। কিংবা কামড়ে ধরতে পারে তার গলা। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটল না। বাঘটা দুলতে লাগল একটু-একটু। যা থাকে কপালে, নবীন এক ঝটকায় গলার কলারটা কেটে ফেলল কাঁচি দিয়ে।
বাঘটা কী বুঝল কে জানে। কয়েক মুহূর্ত বসে থাকল তেমনি। খসে-পড়া কলারটার দিকে তাকাল একটু। লেজটা উঁচু করল। আড়মোড়া ভাঙল। তারপর একেবারে ইচ্ছে নেই এমনি ভাব করে উঠে দাঁড়াল আস্তে-আস্তে। তারপর বাধ্য কুকুরের মতো গুটিগুটি পায়ে নেমে পড়ল নৌকো থেকে। ধীরে-ধীরে ঢুকে পড়ল সবুজ গাছের ভিড়ে। কলারটা পায়ে জড়িয়ে গিয়েছিল। খুলে গিয়ে কাদার মধ্যেই পড়ে থাকল।
নবীন আর দেরি করল না। সব শক্তি এক করে ডিঙি ঘুরিয়ে ফেলল সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়ল বড়ো খালে। আশ্চর্য! সেখানে তখনও নিতাই সামন্তর ভুটভুটি দাঁড়িয়ে আছে ইঞ্জিন বন্ধ করে। রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বাবুরা সব। একজনের হাতে বন্দুকও রেয়েছে যেন।
নবীনের ইচ্ছে হল লোকগুলোর কুকীর্তির কথা বলে প্রতিবাদ করতে হলে জায়গামতো করবে। বলল, ‘তা ঠিক বলেছ বটে। তবে সে তো পালিয়েছে।’
‘কোথায়?’ ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল নিতাই সামন্ত।
‘কেন তোমরা জানো না?’ পালটা প্রশ্ন করল নবীন। হাত দেখিয়ে বলল, ‘ওই দিকে গিয়েছে।’
‘সে কী? ও তো সামসেরপুরের দিক। ও-পথে বাংলাদেশ পড়ে। ভারত না। ঢোকা ঠিক নয়। সীমানা বাঁধা।’
‘জানি তো,’ বলল নবীন, ‘কিন্তু বাঘটা তো জানে না। ওর কাছে সবই জঙ্গল। বাধা নেই কোনো।’
আর কথা না। ডিঙি ছেড়ে দিল নবীন। আজ তার মনে খুব সুখ। জীবন নেওয়ার চাইতে জীবন বাঁচানোয় যে এত আনন্দ আছে জানত না সে!