নবাব আমির আলি খান বাহাদুর
আত্মজীবনী ‘আমীর নামাহ’য় নবাব লিখেছেন, তাঁর পূর্ব-পুরুষ, বাগদাদের কাজী, সৈয়দ নুহ্ দেশত্যাগ করে দিল্লী চলে আসেন; দিল্লীতেই তিনি সপরিবারে বাস করতে থাকেন । নবাব আমির আলি তাঁরই অধস্তন নবম পুরুষ । বিপুল পান্ডিত্যের জন্য কাজী নুকে বাদশাহী সরকার বহু খেতাব ও প্রচুর ভূসম্পত্তি দান করেন । তাঁর পুত্র সৈয়দ আবু বক্ বিশেষ ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন, তাঁকে শেইখ্-উল্-মুশায়েখ্ বলা হত; বাদশাহ ও অভিজাতবর্গেরা তাঁকেও প্রচুর ভূসম্পত্তি দান করেছিলেন। তাঁর পুত্র মুল্লাহ্শাহ্ নূর মুহম্মদ দিল্লী ছেড়ে বিহারে চলে আসেন। তাঁর প্রপৌত্র মুহম্মদ রফি পাটনা জেলার বাঢ়ে কাজী সৈয়দ মুহম্মদ মাত্র কন্যাকে বিবাহ করেন । এই বাঢ়ই পরিবারটি বাসস্থান হয়ে যায়। বাংলার নবাব নাজিম এঁদের প্রচুর ধনসম্পদ দান করেন; তারপর ইংরেজগণ বিজয়ী হবার পর, পরিবারটি বহুভাবে ইংরেজ সরকারের সেবা করেন; ফলে এঁরা অল্পকালের মধ্যেই বিশিষ্ট ধনী হয়ে ওঠেন; মুহম্মদ রফির পুত্র ওয়ারিস আলিও প্রচুর সম্পত্তি অর্জন করেন; তাঁর পুত্র আসুদ্দীন আহ্মদ ওরফে আলি আদ; ইনি ইংরেজ সরকারের অধীনে বহু উচ্চপদে চাকুরী করেন । লর্ড লেকের মারাঠা-বিরোধী অভিযানের সময় ইনি কয়েকটি রণক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন । তিনি উত্তরপশ্চিম প্রদেশের কয়েকটি জেলায় তসিলদাররূপে চাকুরী করে অবসরকালীন জীবন কাটান বাঢ়ে ।
এঁরই পুত্র নবাব আমীর আলি । আমীর আলি জন্মগ্রহণ করেন ১৮১০ খ্রীস্টাব্দের ১০ মার্চ । ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি কলা, বিজ্ঞান এবং আরবী ও ফার্সী ভাষা শিক্ষা করেন । ১৮৩২-এ পাটনা সিভিল আদালতে তিনি একটি চাকুরী লাভ করেন। পরে অযোধ্যার রাজা নাসিরুদ্দীন হায়দারের দূতের সহকারী হিসাবে তিনি বেন্টিঙ্কের শাসনকালে কলকাতা চলে আসেন; এই চাকুরী করার সময় তিনি উক্ত রাজা ও ইংরেজ সরকারের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে ওঠেন । রাজার মৃত্যুর পর ১৮৩৭ এ তিনি পুনরায় সরকারী চাকুরীতে প্রত্যাবর্তন করেন । ১৮৩৮এ তিনি প্রেসিডেন্সি কলকাতার স্পেশাল কমিশনারের আদালতে ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপরিন্টেন্ডেন্ট নিযুক্ত হন; ত্রুটিপূর্ণ মালিকানার বা দলিলহীন সকল লাখেরাজ সম্পত্তি ইংরেজ সরকারে বাজেয়াপ্ত করার পক্ষে ওকালতি করা ছিল তাঁর কাজ । এই আদালতেই তিনি ১৮৫৪এ সরকারী উকিল নিযুক্ত হন । ১৮৫৫ সালে এই আদালত ও পুরাতন সদর আদালত মিলিত হবার সময় পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সরকারী চাকুরী করা-কালে তিনি বরাবরই বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছিলেন ও আইনে গভীর জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছিলেন । আচরণে ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র, মার্জিত । আর ইংরেজ সরকারের প্রতি আনুগত্য ছিল তাঁর প্রায় পুরুষানুক্রমিক বৈশিষ্ট্য এবং বংশের মধ্যে ইংরেজভক্তিতে এই নবাবই শ্রেষ্ঠ ছিলেন ।
১৮৫৭-য় পাটনা বিদ্রোহের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে; অন্তত ইংরেজ সরকারের ধারণা হয়েছিল তাই; সদর আদালতের অন্যতম জজ মিঃ ই এ স্যামুয়েলসকে পাটনা বিভাগের কমিশনার করে পাঠান হল; পাটনায় তখন ধর্মান্ধ মুসলমানের সংখ্যা বিপুল । কমিশনারের ব্যক্তিগত সহকারীরূপে প্রেরিত হলেন আমীর আলি; স্থানীয় প্রধান প্রধান ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে তাঁর পরিচয় এবং তাঁর ব্যক্তিগত প্রভাব ইংরেজ সরকারকে এই মহাসঙ্কট থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে ৷
সে সময় সদর আদালতে ওকালতি করে তিনি মাসে তিন থেকে চার হাজার টাকা রোজগার করতেন । সেই উপার্জন ত্যাগ করে এই পদ-গ্রহণের দ্বারাই প্রমাণিত হয়, তাঁর রাজভক্তি কতখানি বাস্তব ছিল । তিনি লিখেছেন, ‘সরকার আমার জন্য একটা মাসিক বেতনেরও (মাসিক ৭০০ টাকা) ব্যবস্থা করেছিলেন; কিন্তু আমি এক পয়সাও গ্রহণ করি নি; ওকালতির স্বাধীনতাও ছেড়েছিলাম, তার কারণ, আমার মনে হয়েছিল যে, ঐ ভাবেই আমি সরকারের সর্বোত্তম সেবা করতে পারব…..আর আমার যা-কিছু যোগ্যতা, সে সবই এই ইংরেজ সরকারের অধীনে কাজ করেই আমি অর্জন করেছি ।’ অর্থ-সর্বস্ব সে-যুগে এমন নিঃস্বার্থ রাজভক্তি সত্যিই দুর্লভ । সিপাহী বিদ্রোহের সময় তাঁর রাজভক্তি ও সেবার কথা পার্লামেন্টেও আলোচিত হয় । সরকার তাঁকে সম্মানিত ও করেন । নবাব কলকাতার অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট এবং জাস্টিস অফ দি পীস ছিলেন । তাঁকে ২৪ পরগণারও অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট করা হয় । বঙ্গীয় আইন পরিষদের সভ্য পদে মনোনীত করেও তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করা হয় এবং পরবর্তীকালে তাঁকে ‘আজীবন’ খান বাহাদুর পদবীতে ভূষিত করা হয় । ১৮৬৭ তে অযোধ্যার প্রাক্তন রাজার বিষয়-সম্পত্তি পরিচালনার জন্য তাঁকে (পরিচালক) নিয়োগ করা হয়। রাজার কাছে (কোম্পানির) দাবী ছিল ৫৬ লক্ষ টাকার মতো বিপুল পরিমাণ অর্থ; তাঁরই একান্ত চেষ্টায় এই দাবীর পরিমাণ কমে দাঁড়ায় সাত লক্ষ টাকায়; অতীব দক্ষতার সঙ্গে তিনি একটি আপস মীমাংসারও ব্যবস্থা করেন; তাঁর শর্ত অনুযায়ী স্থির হয় যে, উক্ত পরিমাণ অর্থও এককালে আদায় দিতে হবে না । মাসিক সাত হাজার টাকার কিস্তি স্থিরীকৃত হয়; এও স্থির হয় যে, প্রাক্তন রাজাকে কোনরূপ সুদ দিতে হবে না। যে দক্ষতা ও সাফল্যের সঙ্গে তিনি অযোধ্যার প্রাক্তন রাজার বিষয়-সম্পত্তির জটিল সমস্যার সুব্যবস্থা করেছিলেন, তার জন্য বাংলার নবাব নাজিমের ঋণের সুব্যবস্থা করবার জন্যও তিনি অন্যতম কমিশনাররূপে নিযুক্ত হন । এ কাজটিও তিনি গভীর বিচারবুদ্ধি ও দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেন । তাঁর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে লর্ড নর্থব্রুক তাঁকে ‘নবাব’ উপাধিতে ভূষিত করেন; উপাধির সঙ্গে যথোপযুক্ত খেলাও দান করা হয়। ১৮৭৫র ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলার তদানীন্তন ছোট লাট স্যার রিচার্ড টেম্পল বেলডেভিয়ারে উপাধি দান উপলক্ষে একটি বিশেষ ‘দরবার’ আহ্বান করে তাঁর অভিভাষণে বলেন–
‘অদ্য সন্ধ্যায় এখানে উপস্থিত ভদ্রমহোদয়গণের নিকট নবাব আমীর আলি খান বাহাদুর অপরিচিত নন। তাঁর মার্জিত আচরণ ও চমৎকার ব্যবহারের জন্য তিনি সর্বজনশ্রদ্ধেয় । সদর দেওয়ানী আদালতের ব্যবহার-জীবীরূপে তিনি সর্বদাই বিচারকদের আস্থা ও শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছেন, অন্যান্য ব্যবহারজীবীর নিকট ছিলেন আদর্শস্থানীয় । (সিপাহী) বিদ্রোহের সময় তাঁর উৎসাহ উদ্দীপনা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে (এই স্থানে ছোটলাটবাহাদুর মিঃ স্যামুয়েলসের লিখিত প্রশংসাসূচক প্রতিবেদনটি পাঠ করেন)। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে অযোধ্যার রাজা তাঁকে তাঁর বিষয়সম্পত্তির বন্দোবস্ত করবার জন্য নিয়োগ করেন; রাজার বিষয়সম্পত্তি সম্পর্কিত পরিস্থিতি তখন অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থায় ছিল । তাঁর (নবাবের) সুব্যবস্থাপনার কথা সকলেরই পরিজ্ঞাত এবং এজন্য সকলের সবিশেষ প্রশংসাও তিনি অর্জন করেছেন । মুর্শিদাবাদের নবাব নাজিমের বিষয় সম্পত্তির ব্যবস্থাপনাকারী আয়োগের (কমিশনের) অন্যতম সদস্যরূপে তাঁর নিয়োগ যথোপযুক্ত হয়েছিল এবং এতদপেক্ষা সুনির্বাচন আর হতে পারত না । এমন সম্মানজনকভাবে তিনি তাঁর কতর্ব্যকর্ম সম্পন্ন করেন যে, মহামান্য বড়লাটও তাঁর কাজ সমর্থন করেন এবং এই জন্য তাঁর এই সাফল্য বিবেচনা করেই তাঁকে মহামান্য বড়লাট বাহাদুর মুসলমানগণের নিকট সর্বাপেক্ষা কাঙ্ক্ষিত নবাব পদবীতে ভূষিত করেন । আমরা আশা করব যে, তিনি দীর্ঘজীবী হয়ে এই সম্মাননা ভোগ করবেন ।’
প্রয়াত নবাব ছিলেন ফার্সী ভাষায় কৃতবিদ্য–ঐ ভাষায় খুব ভালভাবে লিখতে ও বলতে পারতেন উর্দুতেও তাঁর পারদর্শিতা ছিল উল্লেখযোগ্য, আর তার সঙ্গে আইনে গভীর জ্ঞান ও প্রায় সর্বজনীন জনপ্রিয়তার জন্য সদর দেওয়ানী আদালতের আইনজীবীরূপে তিনি সবিশেষ সাফল্য লাভ করেন। এই আদালতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে ছিন্ন হয় হাইকোর্ট স্থাপিত হবার কিছু পরে। বিশেষভাবে সরকারের উচ্চপদাধিকারী ব্যক্তিবর্গ তাঁকে খুব পছন্দ করতেন । কলকাতাতেই তিনি সাধারণত থাকতেন; তাই তিনি ছিলেন সর্বতোভাবেই কলকাতার এবং পাটনা জেলারও মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি । আগেই বলেছি তাঁর পরিবারবর্গ থাকতেন পাটনা জেলায় । মহৎহৃদয়, মিষ্টভাষী, কাছে গেলে কাউকে কখনও রূঢ় কথা শুনতে হয়নি । তিনি তিন পুত্র রেখে যান–বড় হুগলী ইমামবাড়ার মওয়ালী মওলভী আশ্রাফুদ্দীন আহ্মদ, মধ্যম আলউদ্দীন আহ্মদ এবং কনিষ্ঠ বর্তমানে অক্সফোর্ডের বেলিবল কলেজে পাঠরত আহসান উদ্দীন আহ্মদ ।
নবাব ফার্সী ভাষায় কয়েকখানি পুস্তক রচনা করেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বইগুলি হল : ১. আমীর-নামাহ্ (ভারতে ইংরেজ শাসনের ইতিহাস); ২. ওয়াজির- নামাহ্ (অযোধ্যা রাজবংশের ইতিহাস), এবং ৩. বেয়ানিং-নামাহ্ (ভারতে লর্ড নর্থব্রুকের শাসনকালের ইতিহাস)। লিটন-নামাহ্ (বিগত বড়লাটের শাসনকালের ইতিহাস) নামে আর একখানি পুস্তক তিনি লিখতে আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু শেষ করে যেতে পারেন নি । তিনি কলকাতার জাতীয় মুসলমান সভার সভাপতি ও অন্যান্য বহু (এবং এই শহরের জনগণ পরিচালিত বহু) প্রতিষ্ঠানের সভ্য ছিলেন । মৃত্যুর পূর্বে তিনি তুরস্কের সুলতান কর্তৃক ‘কম্প্যানিয়ন অফ দি অর্ডার অফ ওসমানলি’ পদবীদ্বারা সম্মানিত হন ।