নবাবী বুদ্ধি

নবাবী বুদ্ধি

প্রথম পরিচ্ছেদ 

আষাঢ় মাসের প্রথম, গ্রীষ্ম অনুগ্রহ করিয়া আমাদিগকে পরিত্যাগ করিবার বাসনা করিলেও কার্য্যে কিন্তু তাহা পরিণত করিতে পারেন নাই। জ্যৈষ্ঠ মাস আমাদিগকে পরিত্যাগ করিতে না করিতেই বর্ষার শুভাগমন হইয়াছে, ও গ্রীষ্মের সহিত বর্ষার সম্মিলন হওয়ায় স্বভাবের একরূপ নব ভাব উদয় হইয়াছে। প্রখর রৌদ্রের তেজে অস্থির হইয়া পবন দেব কোন স্থানে গমন করিয়া লুক্কায়িত ভাবে সময় অতিবাহিত করিতেছেন। মানবগণ গাত্র দাহের সহিত কেবল জল জল করিতেছে, বোধ হইতেছে এরূপ ভয়ানক গ্রীষ্ম অধিকক্ষণ আর কেহই সহ্য করিতে পারিবেন না। এইরূপে কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হইতে না হইতে পবন দেব কোথা হইতে বহির্গত হইয়া ধূলা খেলার সহিত দ্রুতবেগে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ধূলিরাশি উড়াইতে উড়াইতে সকলের নাকে, মুখে, চক্ষে, ধুলিরাশি সজোরে প্রক্ষেপ করিতে করিতে জলদ রাজের সম্মুখীন হইলেন। জলদ রাজ পবন দেবের সেই প্রচণ্ড মূর্ত্তি দেখিয়া অতিশয় ভীত হইলেন ও দ্রুতগতি তাঁহার সৈন্য সামন্ত-জলরাশিকে লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিতে লাগিলেন। জলদ রাজের শুভাগমন দেখিয়া সকলেই ভাবিয়াছিল বৃষ্টিপাতে বসুধা পূর্ণ হইয়া যাইবে। কিন্তু কার্য্যে তাহার কিছুই হইল না, বৃষ্টি পতনের পরিবর্তে সকলের বাড়ী-ঘর, দ্রব্যসামগ্রী, বিছানাপত্র আহারীয় পানীয় রাস্তার ধূলায় পূর্ণ হইয়া গেল। 

এইরূপে কিয়ৎক্ষণ অতীত হইবার পর পবন দেব যখন দেখিলেন যে তাঁহার ভয়ে ভীত হইয়া জলদ রাজ আপনার সৈন্য সামন্তগণের সহিত পলায়ন করিয়াছেন, তখন তিনিও সাম্য মূর্ত্তি অবলম্বন করিলেন। যে সকল জলদকুল পলায়ন করিবার কালীন দূর হইতে দেখিতে পাইলেন যে পবনরাজ সাম্য মূর্ত্তি ধারণ করিয়াছেন, তাঁহারা আর পলায়ন করিলেন না বর্ষণ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন কিন্তু সজোরে বর্ষণ করিবার ক্ষমতা তাঁহাদিগের সেই সময় না থাকায় তাঁহারা ‘টিপি’ ধরিলেন। টিপি টিপি বর্ষণ করিতে লাগিলেন সত্য কিন্তু দুই চারি ঘণ্টার মধ্যে তাহার আর নিবৃত্তি হইল না। 

এইরূপে কখন প্রবল রৌদ্র কখনও প্রবল বর্ষা কখনও প্রবল গ্রীষ্ম ও কখনও বা টিপি টিপি বৃষ্টি হইয়া দিনের পর দিন অতিবাহিত হইতে লাগিল। 

আষাঢ় মাসে সন্ধ্যার পূর্ব্বে ভয়ানক গ্রীষ্মের জ্বালায় অস্থির হইয়া জনৈক ডিটেকটিভ কর্ম্মচারীকে কোন সরকারী কার্য্যের উপলক্ষে পশ্চিমাভিমুখে গমন করিবার সময় একটি ক্ষুদ্র রেলওয়ে ষ্টেসনে তাঁহাকে অবতরণ করিতে হইল। সেই স্থান হইতে গ্রাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড বা বানারসের রাস্তা বহিয়া কয়েক ক্রোশ গমন করিয়া পরিশেষে মাঠের রাস্তা অবলম্বন পূর্ব্বক আরও কয়েক ক্রোশ গমন করিবার পর তিনি তাঁহার গন্তব্য গ্রামে গমন করিতে পারিবেন। সেই ষ্টেসনে এক্কা গাড়ি বা অপর কোনপ্রকারের যান পাইবার সুবিধা না থাকায় স্টেসন হইতে সেই গ্রাম পর্যন্ত পদব্রজে গমন ভিন্ন আর কোন উপায়ই ছিল না। 

কর্ম্মচারী গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া পূর্ব্ব বর্ণিত পথ অবলম্বন করিয়া গমন করিতে লাগিলেন। তাহার সঙ্গে কেবল একজন মাত্র অনুচর ছিল ও স্টেসন হইতে একটি কুলি লইয়াছিলেন সেই তাহাদিগের দ্রব্যাদি বহন করিয়া লইয়া যাইতেছিল। 

কর্ম্মচারী প্রায় সদা সৰ্ব্বদাই কলিকাতায় থাকিতেন। কোন স্থানে যাতায়াত করিতে হইলে প্রায়ই হাঁটিতে হইত না, যেস্থানে খুঁজিতেন সেই স্থানেই গাড়ি পাইতেন। একেবারে অধিক রাস্তা হাঁটিতে হইলে তাঁহার বিশেষরূপ কষ্ট হইত। সুতরাং এই রাস্তা হাঁটিয়া যাইতে তাঁহার বিশেষরূপ কষ্ট হইতে লাগিল সত্য, কিন্তু কি করেন যাইতেই হইবে, সুতরাং তাহার সাধ্যমত তিনি চলিতে লাগিলেন। 

দুই এক ক্রোশ গমন করিতে না করিতে সন্ধ্যা হইল, তখন অনন্যোপায় হইয়া সেই রাস্তার পার্শ্বস্থিত একখানি দোকানে তাঁহাকে আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইল। 

কর্ম্মচারীর সহিত যে অনুচর গমন করিতেছিল, সে সরকারী কার্য্যে যেরূপ পারদর্শী গৃহস্থের ও নিজের কার্য্যেও সেইরূপ পারদর্শী ছিল। সে সেই দোকানে উপস্থিত হইবামাত্রই আপনাদিগের থাকিবার স্থান স্থির করিয়া লইয়া পরিশেষে আহারাদির বন্দোবস্ত করিল। সেই দোকানে যাহা কিছু পাওয়া গেল তদ্ব্যতীত অপরাপর আবশ্যকীয় দ্রব্য সমস্ত অপর স্থান হইতে সংগ্রহ করিয়া নিজেই আহারীয় প্রস্তুত করিল। কর্ম্মচারী ও সেই কুলি তাহার প্রস্তুত আহারীয় আহার করিয়া সেই দোকানেই শয়ন করিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। অনুচরটিও আহারাদি করিয়া তাঁহার নিকট শয়ন করিল। 

তাঁহারা যে কার্য্যের নিমিত্ত গমন করিতেছিলেন, তাহা গবর্ণমেন্টের নিজের ও অতিশয় গোপনীয় কার্য্য সুতরাং তাঁহারা যে কে, কি কার্য্যের নিমিত্ত কোথায় যাইতেছেন তাহার পরিচয় কাহারও নিকট দিবার উপায় ছিল না সুতরাং এ পর্যন্ত তাঁহাদিগের পরিচয় কেহই জানিত না, কেহ কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলে উপস্থিত মত মিথ্যা কথা বলিয়া তাহাদিগের কথার উত্তর প্রদান করা হইত। যে দোকানে তাঁহারা রাত্রি যাপন করিতেছিলেন, সেই দোকানদার বা তাহার নিকটবর্ত্তী কোন দোকানদার জানিত না যে তাঁহারা কে ও কোথায় যাইতেছেন। যে কুলি তাঁহাদিগের সহিত গমন করিতেছিল সেও ইহার বিন্দুবিসর্গ জানিত না। 

যে দোকানে তাঁহারা রাত্রি যাপন করিতেছিলেন তাহার সন্নিকটে আরও দুইখানি দোকান ছিল। রাত্রি হইবার সঙ্গে সঙ্গে তাহারা দোকান বন্ধ করিয়া আপনাপন বাড়ীতে গমন করিল। যাহার দোকানে তাঁহারা আশ্রয় লইয়াছিলেন, সেও তাঁহাদিগকে তাহার দোকানে রাখিয়া আপন গৃহে গমন করিল। ওই সকল দোকানের নিকটবর্ত্তী স্থানে একখানি ক্ষুদ্র গ্রাম ছিল, ওই দোকানদারদিগের বাড়ী ওই গ্রামে সুতরাং তাহারা দোকান বন্ধ করিয়া ওই গ্রামে আপনাপন বাড়ীতেই রাত্রি যাপন করিত। দোকানদারগণ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার পর সেই স্থানে আর কাহাকেও দৃষ্টি গোচর হইল না। রাত্রি অন্ধকার, মধ্যে মধ্যে মেঘগর্জ্জন করিতেছিল ও থাকিয়া থাকিয়া টিপি টিপি বৃষ্টিও পড়িতেছিল। সেই নিৰ্জ্জন স্থানে কর্ম্মচারী কেবলমাত্র তাঁহার একজন অনুচরের সহিত রাত্রি অতিবাহিত করিতেছিলেন। নানারূপ চিন্তায় অনেক রাত্রি পর্যন্ত কর্ম্মচারীর নিদ্রা আসিল না কিন্তু পরিশেষে তিনি নিদ্রিত হইয়া পড়িলেন। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

যে দোকানে কর্ম্মচারী তাঁহার অনুচর ও একটি কুলির সহিত আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন রাত্রি প্রায় এক প্রহর থাকিতে তিনি সেই দোকান পরিত্যাগ করিলেন। অত রাত্রি থাকিতে তাঁহাদিগের সেস্থান পরিত্যাগ করিবার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু রাত্রি দ্বিপ্রহরের পর বৃষ্টি ছাড়িয়া আকাশ পরিষ্কার হওয়ায় তাঁহারা রাত্রি বুঝিতে না পারিয়া এক প্রহর রাত্রি থাকিতেই তাঁহাদিগের গন্তব্য স্থানাভিমুখে প্রস্থান করিয়াছিলেন। 

তাঁহারা সেই স্থান পরিত্যাগ করিয়া যাইবার কিয়ৎক্ষণ পরেই ওই দোকানে ডাকাইত পড়িল। প্রায় দশ পনরজন লোক লাঠি ও প্রজ্বলিত মসাল হস্তে আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। যে দোকানে কর্মচারী আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন প্রথমেই প্রজ্বলিত মসাল হস্তে কয়েকজন সেই দোকানের মধ্যে প্রবেশ করিল, অবশিষ্ট সকলে – কেহ বা মসাল হস্তে কেহ বা লাঠি খেলিয়া সেই দোকানের সম্মুখে ভ্রমণ করিতে লাগিল; সেই সময় সেই স্থানে অপর লোকজন কেহই ছিল না সুতরাং ওই ডাকাইতদল কোনরূপ প্রতিবন্ধক পাইল না। তাহারা অনায়াসেই ওই দোকানে ডাকাইতি করিয়া যাহা কিছু পাইল তাহা সংগ্রহ করিয়া অপর দোকানে প্রবেশ করিল, সেই দোকান লুণ্ঠন করিয়া তৃতীয় দোকানে প্রবিষ্ট হইল। এইরূপে ওই তিনখানি দোকান লুণ্ঠন করিয়া যাহা কিছু প্রাপ্ত হইল তাহা লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। যাইবার সময় দোকান তিনখানিতেই অগ্নি প্রদান করিয়া গেল, তাহাদিগের যাইবার সঙ্গে সঙ্গেই দোকান তিনখানি ভস্মে পরিণত হইল। ডাকাইতগণ যখন ডাকাইতি করিতেছিল সেই সময় একজন চৌকিদার চৌকি দিবার নিমিত্ত গ্রাম হইতে বাহির হইয়া আসিতেছিল, সে সমস্ত অবস্থা দেখিতে পায়, কিন্তু ডাকাইতদিগের ভয়ে সে কোন কথা না বলিয়া নিকটবর্ত্তী একটি জঙ্গলের মধ্যে গিয়া লুকায়, ও সেই স্থান হইতে সমস্ত অবস্থা দেখিতে পায়। 

ডাকাইতগণ ডাকাইতি করিয়া ও দোকান কয়খানিতে অগ্নি প্রদান করিয়া প্রস্থান করিবার পর সে সেই জঙ্গল হইতে বাহির হয় ও লোকজন ডাকাডাকি আরম্ভ করে। দোকান ঘরগুলি পুড়িতে দেখিয়া, সেই নিকটবর্ত্তী গ্রাম হইতে লোকজন বাহির হয় ও সেই স্থানে উপস্থিত হইতে হইতে দোকান তিনখানি ভস্মে পরিণত হইয়া যায়। চৌকিদার যাহা যাহা দেখিয়াছিল তাহার সমস্তই তাহাদিগকে কহে কেবল সে যে নিকটবর্ত্তী জঙ্গলের ভিতর লুকাইয়া ছিল সেই কথা গোপন করিয়া নিজের বাহাদুরি প্রকাশ করিতে কিছুমাত্র ত্রুটি করে না। চৌকিদার এইরূপ কহে যে যখন সে দেখিতে পায় যে ডাকাইতগণ ডাকাইতি করিতেছে, তখন সে একাই তাহদিগের প্রতিবন্ধক জন্মাইবার বিশেষরূপ চেষ্টা করে, তাহারই প্রতিবন্ধকাচরণের নিমিত্ত উহারা কোন দোকান হইতে কোন দ্রব্য গ্রহণ করিতে সমর্থ হয় না, ও তাহাকে প্রহার করিবার নিমিত্তও বিশেষরূপ চেষ্টা করে কিন্তু সে লাঠি খেলায় নিপুণ থাকায় তাহাতেও কৃতকাৰ্য্য হইতে পারে না, পরিশেষে উহারা নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া দোকান তিনখানিতে আগুন দিয়া দ্রুতপদে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে। পলায়ন করিবার সময় চৌকিদারও তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ অনেক দূর পর্যন্ত গমন করিয়াছিল কিন্তু কাহাকেও ধৃত করিতে সমর্থ হয় না। চৌকিদার আরও বলিয়াছিল যে, সে দুই চারিজন ডাকাইতকে এরূপ সজোরে লাঠি মারিয়াছিল যে, তাহার বিশ্বাস তাহারা নিশ্চয়ই বিশেষ রূপ আঘাতিত হইয়াছে। বলা বাহুল্য চৌকিদার এইরূপে তাহার যে বাহাদুরি প্রকাশ করিয়াছিল তাহার একটি কথাও সত্য নহে সমস্তই সেই ভীরু চৌকিদারের স্বকপোলকল্পিত গল্পমাত্র। 

পরদিবস প্রত্যূষে সেই চৌকিদার থানায় গিয়া এই সংবাদ প্রদান করিল, বলা বাহুল্য সে সেই গ্রামের লোকদিগের নিকট যেরূপ নিজের বাহাদুরি বর্ণন করিয়াছিল থানায় দারোগা সাহেবের নিকট সেইরূপ নিজের বাহাদুরি বর্ণন করিতেও কিছুমাত্র সঙ্কোচিত হইল না। সংবাদ পাইবামাত্র দারোগা সাহেব ঘটনা স্থলে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সকলের দোকান পুড়িয়া গিয়াছিল সুতরাং তাহারা বলিতে পারিল না যে তাহাদিগের কোন দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে কি না। 

যাহার দোকানে ডিটেকটিভ কর্ম্মচারী তাঁহার অনুচর ও কুলির সহিত আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন, সেই দোকানদার তাঁহাদিগের কথা দারোগা সাহেবকে কহিল। কিন্তু তাঁহারা যে কে কোথা হইতে আসিয়াছেন বা কোথায় গমন করিবেন তাহার কিছুই বলিতে পারিল না। যেরূপ অবস্থায় তাঁহারা আসিয়াছিলেন যেরূপ অবস্থায় আহারাদি করিয়া সেই দোকানের ভিতর শয়ন করিয়াছিলেন তাহার সমস্ত অবস্থা সে দারোগা সাহেবের নিকট কহিল, আরও কহিল, রাত্রিতে সে যখন তাহার দোকান হইতে বাড়ী যায় সেই সময় সে তাঁহাদিগকে দোকানের ভিতর শয়ন করিয়া থাকিতে দেখিয়া যায় ও দোকানে আগুন লাগার পর আসিয়া আর তাঁহাদিগকে দেখিতে পায় না। তাঁহারা ওই দোকানের মধ্যে পুড়িয়া মরিয়াছেন কি বাহির হইয়া গিয়াছেন তাহার কিছুই সে বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই। দোকানীর কথা শুনিয়া দারোগা সাহেব একটু চিন্তিত হইলেন। মনে করিলেন, ওই তিন ব্যক্তি হয়তো দোকানের মধ্যে পুড়িয়া মরিয়া গিয়াছে। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া লোকজন সংগ্রহ করিয়া তিনি ওই দোকানের মধ্যে উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করিলেন, যে সকল দ্রব্য পুড়িয়া একেবারে ছাই হইয়া গিয়াছিল, সে সকল দ্রব্য অৰ্দ্ধ দগ্ধ অবস্থায় সেই দোকানের ভিতরই ছিল, তাহার সমস্তই ক্রমে তিনি বাহিরে রাস্তার উপর আনিয়া ফেলাইতে লাগিলেন, এইরূপে ক্ৰমে সেই স্থান একেবারে পরিষ্কার হইয়া গেল, কিন্তু তাহার মধ্যে মনুষ্যের দগ্ধাবশেষ বা তাহার কোনরূপ নিদর্শন প্রাপ্ত হইলেন না। 

এই অবস্থা দেখিয়া দারোগা সাহেবের মনে নানা রূপ চিন্তা আসিয়া উদয় হইতে লাগিল, তাঁহার প্রথম চিত্তা ওই তিন ব্যক্তি কে? তাহারা যদি প্রকৃতই পথিক হইত তাহা হইলে যেরূপ সময়ে গৃহ দাহ হইয়াছে, তাহার পূর্ব্বে তাহারা কখনই ওই স্থান পরিত্যাগ করিত না। আর গৃহ দাহের সময়েই যদি তাহারা ওই স্থান পরিত্যাগ করিয়া থাকে তাহা হইলে ডাকাইতগণের মসালের আলোকে, বা গৃহ দাহের প্রজ্বলিত অগ্নিতে, সেই জনমানব শূন্য স্থানে চৌকিদার নিশ্চয়ই তাহাদিগকে দেখিতে পাইত। সুতরাং ওই সময়ে তাহারা ওই স্থান পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছে বলিয়া বোধ হয় না। তবে কি তাহারা ডাকাইত দলের লোক? ডাকাইতি করিবার মানসে পথিকের ভাণ করিয়া তবে কি তাহারা অগ্রেই এই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল, এই স্থানের সমস্ত অবস্থা উত্তমরূপ জানিয়া লইয়া, পরিশেষে তাহাদিগের দলের অপর লোকগুলি আসিয়া উপস্থিত হইলে, সকলে মিলিয়া এই ডাকাইতি করিয়া চলিয়া গিয়াছে? অবস্থা দেখিয়া ইহাই যুক্তি যুক্ত বলিয়া বোধ হইতেছে। দারোগা সাহেব মুসলমান ছিলেন কোন নবাবের বংশোদ্ভব বলিয়া তিনি সকলের নিকট আত্ম পরিচয় প্রদান করিতেন, ও তিনি যে নবাবী বুদ্ধি ধারণ করিয়া থাকেন এই অহঙ্কার তিনি তাঁহার মনে রাখিতেন, সুতরাং তিনি তাঁহার সেই নবাবী বুদ্ধির উপর নির্ভর করিয়া এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলেন। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

দুই তিন দিবস দারোগা সাহেব সেই তিনজন পথিকের অনেক অনুসন্ধান করিলেন, চৌকিদারদিগের দ্বারায় চারিদিকের সংবাদ গ্রহণ করিলেন, কিন্তু কোন স্থানেই তাহাদিগের কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হইলেন না। চৌকিদারগণ মনে করিলে উহাদিগের সন্ধান অনায়াসেই পাইতে পারিত, কারণ তিনজন লোক একত্রে এক স্থান দিয়া দিবাভাগে গমন করিয়াছে। অনেক লোক তাহাদিগকে গমন করিতে দেখিয়াছে, এরূপ অবস্থায় গ্রামের চৌকিদারগণ যে কেন এই সংবাদ সংগ্রহ করিতে সমর্থ হয় নাই, তাহা পাঠকগণ অবগত হইতে না পারিলেও লেখক কিন্তু অবগত আছেন, কারণ তিনি অনেক সময়ে বাধ্য হইয়া তাহাদিগের উপর কোন কোন কার্য্যের ভার দিয়া সেই কার্য্য তাহাদিগের দ্বারা সমাপন করাইতে অনেক সময়েই কৃতকাৰ্য্য হইতে পারেন নাই। একটু মনে করিলে যে কার্য্য তাহারা অনায়াসেই সম্পন্ন করিতে পারিত, সেই কার্য্য পরিশেষে লেখককে নিজে সম্পন্ন করিতে হইয়াছে। 

পল্লিগ্রামের পাঠকগণ তাঁহাদিগের গ্রামের চৌকিদারদিগের অবস্থা বিশেষরূপেই অবগত আছেন সুতরাং তাহারা যেরূপ ভাবে তাহাদিগের কর্তব্য কার্য্য সমাপন করিয়া থাকে, তাহা তাঁহাদিগের নিকট বর্ণন করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই, তবে কলিকাতার পাঠকগণের নিমিত্ত আমাকে কেবল এইমাত্র বলিতে হইতেছে যে, আজকাল পল্লিগ্রামে ডাকাইতির সংখ্যা দিন দিন এত বাড়িয়া যাইতেছে কেন, তাহার কারণ তাঁহারা কখনও কি অনুসন্ধান করিয়াছেন? যদি না করিয়া থাকেন তাহা হইলে একটু অনুসন্ধান করিলেই তাঁহারা অবগত হইতে পারিবেন যে, চৌকিদারদিগের সহিত আজ কাল কেবল বেতন লইবার সম্পর্ক। গ্রামে কোন নূতন লোক আসিল কি না, গ্রামের ভিতর কোন লোক কোনরূপ চুরি ডাকাইতি করিবার কোনরূপ বন্দোবস্ত বা ষড়যন্ত্র করিতেছে কি না, অপহৃত দ্রব্য গ্রামের কোন স্থানে আসিতেছে কি না, সেই সমস্তর দিকে তাহাদিগের একেবারেই দৃষ্টি নাই ও দেখিবার সময়ও নাই; তাহারা সর্ব্বদাই নিজের চাষ আবাদ লইয়া ব্যস্ত থাকে, সমস্ত দিবস প্রায় মাঠেই তাহাদিগকে অতিবাহিত করিতে হয়। সমস্ত দিবস পরিশ্রম করিয়া সন্ধ্যার পর ও সময় সময় অধিক রাত্রিতে বাড়ী আসিয়া আহারাদি করিবার পর, তাহারা অতিশয় ক্লান্ত হইয়া শয়ন করে; সুতরাং রাত্রিকালে বাহির হইয়া গ্রামের মধ্যে চৌকি দেওয়ার কথাটা প্রায় তাহাদিগের বিছানার উপর হইতে হয়। আর যাহাদিগের নিতান্ত কর্তব্য জ্ঞান আছে বা যাহারা জানিতে পারে যে, কোন পুলিস-কৰ্ম্মচারী সেই রাত্রিতে সেই গ্রামে রোঁদে আসিবে, তাহা হইলে সে তাহার নিদ্রাভঙ্গ হইবার পর একবার অনেক কষ্টে শয্যা পরিত্যাগ করিয়া কখনও কখনও ঘরের বাহির হইয়া থাকে। সুতরাং গ্রামের সংবাদ তাহারা কিরূপে প্রাপ্ত হইতে পারিবে! সপ্তাহের মধ্যে তাহারা যে দিবস থানায় হাজিরা দিবার নিমিত্ত গমন করিয়া থাকে, সেইদিবস তাহারা সেই স্থানে গিয়া গ্রামের অবস্থা তাহারা যে উত্তমরূপে অবগত আছে তাহার ভাণ করিয়া থাকে। থানায় নিয়মিতরূপ তাহাদিগকে অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হইয়া থাকে। গ্রামের স্বাস্থ্য কেমন, গ্রামের ফসলের অবস্থা কেমন, গ্রামের মধ্যে কোনরূপ ঘটনা ঘটিয়াছে কি না, ভিন্ন স্থানের কোন লোক গ্রামের মধ্যে আসিয়াছে কি না, গ্রামের জন্ম মৃত্যু কি কি হইয়াছে। চোর বদমায়েসগণ কি কি কার্য্য করিয়াছে, তাহারা প্রত্যহ রাত্রিতে বাড়ীতে হাজির ছিল কি না, অপর স্থান হইতে কোন লোকজন তাহাদিগের নিকট আসা যাওয়া করিয়াছে কি না, সরকার বাহাদুরের বিপক্ষে কোন ব্যক্তি কোনরূপ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে কিনা, গুলি, বারুদ প্রভৃতি কেহ কোনরূপে সংগ্রহ করিতেছে কি না, কোন স্থানে কোনরূপ সভা সমিতি স্থাপিত হইয়াছে কি না, প্রভৃতি নানারূপ প্রশ্ন তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করা হয়, কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, তাহারা এই সকল বিষয়ের সংবাদ কিছুমাত্র অবগত না থাকিলেও অনায়াসে তাহার উত্তর প্রদান করিয়া থাকে। ইহাদিগের কথার উপর নির্ভর করিয়া গবর্ণমেন্টে নানারূপ সংবাদ প্রদান করা হইয়া থাকে ও দেশের শাসনের দিকে দৃষ্টিপাত করা হইয়া থাকে। গবর্ণমেন্ট মনে করেন যে ইহাদিগের দ্বারা তাঁহারা দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্ত সংবাদ প্রাপ্ত হন। সংবাদ যে পাইয়া থাকেন, সে সম্বন্ধে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই, কিন্তু সেই সকল সংবাদ অধিকাংশই চৌকিদার প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীর কর্ম্মচারিগণের কপোল কল্পিত মাত্র। সে যাহা হউক চৌকিদারগণ যদি তাহাদিগের কর্তব্য কর্ম্ম সুচারুরূপে সম্পন্ন করিত তাহা হইলে পল্লিগ্রামে ডাকাইতির সংখ্যা কখনই এতদূর বর্দ্ধিত হইত না। সে যাহা হউক স্থানীয় চৌকিদারগণের মধ্যে কেহই বলিতে পারিল না, ওই তিনজন লোক কোন্ দিকে গমন করিয়াছে। 

দারোগা সাহেব যখন দেখিলেন যে ওই তিনজন লোকের কেহই কোনরূপ সন্ধান দিতে পারিল না, তখন তাঁহার মনে যে ধারণা হইয়াছিল তাহার পরিবর্তন হইতে আরম্ভ হইল; তখন তিনি মনে করিলেন ওই দোকানদার যে বলিতেছে তাহার দোকানে তিনজন অপরিচিত লোক আসিয়াছিল কিন্তু ওই কয়েকজন দোকানদার ভিন্ন এ কথা ত আর কেহ বলিতেছে না। উহারা যে সত্য কথা বলিতেছে তাহার প্রমাণ কি? তিন তিনজন অপরিচিত লোক যখন তাহার দোকানে রহিল তখন কোন্ সাহসের উপর নির্ভর করিয়া সে দোকান পরিত্যাগ পূৰ্ব্বক আপন বাড়ীতে গমন করিল; সে নিশ্চয়ই ইহা জানিত যে উহারা মনে করিলে রাত্রিতে তাহার দোকানের সমস্ত দ্রব্য অপহরণ করিয়া লইয়া যাইতে পারে। এরূপ অবস্থায় কোন দোকানদার অপরিচিত লোকের হস্তে তাহার যথা সৰ্ব্বস্ব অর্পণ করিয়া কখনই স্থির থাকিতে পারে না। 

এখন দারোগা সাহেবের মনে হইল ওই দোকানদার যাহা বলিতেছে তাহা মিথ্যা। কোন লোক তাহার দোকানে আইসে নাই বা কোন লোক রাত্রিকালে সেই স্থানে ছিল না। উহাদিগের দোকানে কোনরূপ ডাকাইতি হয় নাই। তাহাদিগের গ্রামের চৌকিদারকে দিয়া মিথ্যা কথা বলা হইয়াছে, উহারা দোকানে বিশেষরূপ লাভ করিতে পারে না; মহাজনদিগের নিকট হইতে দেনায় মাল আনিয়া ওই অর্থ আত্মসাৎ করিয়াছে। এখন মহাজনদিগকে ফাঁকি দিবার মানসে কয়েকজন দোকানদার এক পরামর্শ হইয়া তাহাদিগের ভগ্ন ঘরে অগ্নি প্রদান করিয়া, এখন সকলকে বলিতেছে যে ডাকাইতগণ তাহাদিগের দোকানে ডাকাইতি করিয়া দোকানের দ্রব্যাদি অপহরণ করিয়া, পরিশেষে দোকান ঘরে অগ্নি প্রদান করিয়া চলিয়া গিয়াছে। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া দারোগা সাহেব এখন তাহারই অনুসন্ধান আরম্ভ করিলেন কোন্ দোকানদারের মহাজন কে, তাঁহাদিগের নিকট কাহার কত টাকা দেনা। ও অপরাপর লোকদিগের নিকটই বা তাহাদিগের কোন দেনা আছে কি না, এখন তাহারই অনুসন্ধান আরম্ভ করিলেন। দোকানে পূৰ্ব্বদিবস কি কি দ্রব্য মজুত ছিল তাহারও সংবাদ সংগ্রহ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন; দোকানদারগণ তাহাদিগের বাক্সে যে সকল নগত টাকা ও অলঙ্কার আদি ছিল বলিয়াছিল, তাহা তিনি বিশ্বাস করিলেন না। ডাকাইতি মোকদ্দমা যে সম্পূর্ণ মিথ্যা তাহারই প্রমাণ করিবার নিমিত্ত দারোগা সাহেব তখন তাহারই চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তাঁহার নবাবী বুদ্ধিতে যাহা উদয় হইল, এখন তিনি তাহারই উপর নির্ভর করিয়া চলিতে লাগিলেন। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

ডিটেক্‌টিভ কৰ্ম্মচারী অনুচরের সহিত সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া প্রায় ক্রোশাবধি গমন করিবার পর, ওই গৃহ দাহের অগ্নি তাঁহার নয়ন গোচর হইল, কিন্তু তিনি সেই সময় কিছুমাত্র বুঝিতে পারিলেন না, যে দোকানে তাঁহারা রাত্রির কিয়দংশ অতিবাহিত করিয়াছিলেন সেই দোকানে ডাকাইতি হইয়াছে, ও তাহাদিগের কর্তৃকই ওই সকল গৃহ ভস্মে পরিণত হইতেছে। কিন্তু তিনি যে কার্য্যে গমন করিয়াছিলেন, সেই কার্য্যে নিযুক্ত থাকিবার সময় ক্রমে, তিনি ওই ডাকাইতি ও ওই গৃহদাহের অবস্থা অবগত হইতে পারিয়াছিলেন। তিনি যে কার্য্যে ওই প্রদেশে গমন করিয়াছিলেন সেই কার্য্য সমাপন করিতে সেই স্থানে তাঁহার প্রায় পনর দিবস অতিবাহিত করিতে হয়। তিনি আপন কাৰ্য সমাপন করিয়া এক দিবস অপরাহ্ণে তাঁহার অনুচরের সহিত সেই স্থান পরিত্যাগ করেন। কয়েক ক্রোশ গমন করিবার পরই রাত্রি হইয়া পড়ে, সুতরাং রাত্রি অতিবাহিত করিবার নিমিত্ত তাঁহাকে কোন স্থানের অনুসন্ধান করিতে হয়। 

নিকটবর্তী একখানি গ্রামে জনৈক বেনিয়ার বাস ছিল তাঁহার অবস্থা নিকটবর্ত্তী স্থানের ব্যক্তিগণের অপেক্ষা একটু ভাল ছিল, ও তাহার বাড়ী ঘরের অবস্থাও নিতান্ত মন্দ ছিল না। কৰ্ম্মচারী অনন্যোপায় হইয়া সেই রাত্রির জন্য তাহারই বাড়ীতে গিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। প্রায় পনর দিবস কাল সেই প্রদেশে অতিবাহিত করায়, ওই সকল স্থানের অনেক অবস্থা তিনি অবগত হইতে পারিয়াছিলেন। জানিতে পারিয়াছিলেন ওই প্রদেশের জমীদার কেও কোথায় থাকেন, ও তাঁহার কর্ম্মচারিগণ তখন সেই সকল স্থানে আগমন করেন কি না। 

এই সকল বিষয় অবগত হইতে পারিয়া তাঁহার সেই স্থানে পরিচয় দিবার বিশেষ সুবিধা হইয়াছিল। তিনি সেই বেনিয়ার বাড়ীতে গমন করিয়া, জমীদারের কর্মচারী বলিয়া তাহার নিকট আপনাদিগের পরিচয় প্রদান করিলেন, ও কহিলেন, জমীদারের কোন কার্য্য উপলক্ষে তাঁহার সেই প্রদেশে আগমন করিয়াছিলেন, কার্য্য শেষ করিয়া এখন তাঁহারা প্রত্যাগমন করিতেছেন। এইরূপ পরিচয় দিয়া তাঁহারা সেই স্থানে রাত্রি অতিবাহিত করিবার ইচ্ছা করিলেন। 

যাঁহার বাড়ীতে তাঁহারা আগমন করিয়াছিলেন তিনি বিশেষ যত্নের সহিত তাঁহাদিগের থাকিবার স্থান নির্দ্দেশ করিয়া দিলেন, ও উপস্থিত মত যেরূপ হইতে পারে, সেইরূপ আহারাদিরও বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন। কর্মচারী তাঁহার অনুচরের সহিত আহারাদি সমাপন করিয়া, যে ঘরে তাঁহাদিগের থাকিবার স্থান নির্দিষ্ট হইয়াছিল, সেই স্থানে সেই রাত্রির জন্য শয়ন করিলেন। 

যাঁহার বাড়ীতে তাঁহারা আতিথ্য নিয়াছিলেন, যে পর্য্যন্ত তাঁহারা নিদ্রিত না হইলেন সেই পর্যন্ত তিনি তাঁহাদিগের নিকট উপবেশন করিয়া নানারূপ কথাবার্তায় তাঁহাদিগের মনস্তুষ্টি করিতে লাগিলেন। 

তাঁহার সহিত নানারূপ কথাবার্তায় কৰ্ম্মচারী অবগত হইতে পারিলেন যে, ওই প্রদেশে সেই সময় ডাকাইতির ভয়ানক উপদ্রব হইয়াছে, এমন কোন সপ্তাহ প্রায়ই অতিবাহিত হয় না যে কোন না কোন গ্রামে ডাকাইতি না হয়। এই প্রদেশে এক বৎসরের মধ্যে যতগুলি ডাকাইতি হইয়াছে, পুলিস তাহার একটিরও কিনারা করিতে সমর্থ হয় নাই। ডাকাইতির সংবাদ পাইবামাত্র, থানা হইতে দারোগা সাহেব সেই স্থানে উপস্থিত হন, দুই চারি দিন সেই স্থানে অবস্থিতি করিয়া পরিশেষে আপন থানায় প্রস্থান করেন। এই সকল ডাকাইতি মোকদ্দমার যাহাতে কোনরূপে কিনারা হয় তাহার নিমিত্ত তিনি প্রাণপণে যত্ন করিয়া থাকেন, কিন্তু তাঁহার অদৃষ্ট ক্রমেই হউক, বা যাহাদিগের বাড়ীতে ডাকাইতি হয়, তাহাদিগের ভাগ্য দোষেই হউক ওই সকল ডাকাইতির একটিও কিনারা হয় না। 

পরিশেষে যাহাতে কোনরূপ নিজের চাকরি বজায় রাখিতে পারেন, তাহার দিকে তাহাকে কার্যেই দৃষ্টি রাখিতে হয়। কোনটি বা মিথ্যা, কোনটি ডাকাইতি নহে ডাকাইতির উৎযোগ বা কোনটি বা ডাকাইতি নহে, কেবল চুরি–কারণ পাঁচজন বা তাহার অধিক লোক যে ওই কার্য্যে নিযুক্ত ছিল সে সম্বন্ধে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। কোনটি বা সত্য কিন্তু বিশেষ চেষ্টা করিয়াও এ পর্যন্ত তাহার কোনরূপ কিনারা হয় নাই। এইরূপ নানা প্রকারে উপরওয়ালাকে বুঝাইয়া দারোগা সাহেব কোন গতিকে দিন অতিবাহিত করিতেছিলেন। 

কর্মচারী তাঁহার আশ্রয়দাতার নিকট যাহা শুনিলেন, তাহা তিনি সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করিলেন, কারণ সেই প্রদেশে তাঁহার সেই সামান্য দিবস অতিবাহিত করিবার কালীন যে দোকানে তিনি কিয়ৎক্ষণ অবস্থিতি করিয়াছিলেন সেই দোকানে যে ডাকাইতি হইয়া গিয়াছিল তাহা তিনি পূর্ব্বেই অবগত হইতে পারিয়াছিলেন। 

সেই সময়ে সেই বেনিয়া কর্তৃক এইরূপ ডাকাইতির কথা উল্লেখ হওয়ায়, কর্ম্মচারীর সহিত তাঁহার যে সকল কথা হইয়াছিল তাহার কিয়দংশ এই স্থানে প্রদত্ত হইল। 

কৰ্ম্ম। আজ কাল যত ডাকাইতি হইতেছে, ইহার পূর্ব্বে সেইরূপ ডাকাইতি হইত না? 

বেনিয়া। না। 

কৰ্ম্ম। কত দিবস হইতে ডাকাইতি বাড়িয়া গিয়াছে? 

বেনিয়া। প্রায় এক বৎসর হইতে। 

কৰ্ম্ম। ইহার কারণ কি? 

বেনিয়া। বিশেষ কারণ কিছুই দেখিতে পাইতেছি না, তবে গত দুই বৎসর হইতে এ দেশে ভালরূপ ফসল জন্মায় নাই, দ্রব্যসামগ্রী অতিশয় দুর্মূল্য হইয়া পড়িয়াছে, দরিদ্র লোকের বিশেষরূপ অন্ন কষ্ট হইয়াছে, এই সকল কারণেই বোধ হয় ডাকাইতির সংখ্যা বাড়িয়া গিয়াছে। 

কৰ্ম্ম। সম্ভব। ডাকাইতগণ প্রায়ই কি রূপের দ্রব্য সকল অপহরণ করিয়া থাকে? 

বেনিয়া। টাকা কড়ি অলঙ্কারপত্র প্রভৃতি যাহা পায় তাহাই লইয়া যায়, তদ্ব্যতীত চাউল, গম, ছোলা, মটর প্রভৃতি যে সকল শস্য পায় তাহাও লইয়া যায়। 

কৰ্ম্ম। কিরূপ লোকের বাড়ীতে উহারা প্রায়ই ডাকাইতি করিয়া থাকে? 

বেনিয়া। বেনিয়া বা মুদির দোকানের দিকেই উহাদিগের লক্ষ্য অধিক।

কৰ্ম্ম। দোকান ব্যতীত অপর কোন স্থানে কি উহারা ডাকাইতি করে না? 

বেনিয়া। করে বৈ কি। উহাদিগের ভয়ে আমরা এক রাত্রিও নিশ্চিন্ত ভাবে নিদ্রা যাইতে পারি না। 

কৰ্ম্ম। আপনারা এই স্থানের বাসিন্দা, আপনারা যেরূপ সংবাদ প্রাপ্ত হন অপর আর কেহই সেরূপ পায় না। আপনার বিবেচনায় এই সকল ডাকাইতি কাহাদিগের দ্বারা সম্পন্ন হইয়া থাকে? 

বেনিয়া। কোন ভদ্রলোকের দ্বারা এ কার্য্য হয় না, ছোটলোকদিগের দ্বারাই এই কাৰ্য্য হইয়া থাকে। কিন্তু ওই সকল ব্যক্তি যে কাহারা তাহা আমরা এ পর্যন্ত স্থির করিয়া উঠিতে পারি নাই। ভিন্ন ভিন্ন গ্রামের ভিন্ন ভিন্ন বদমায়েসদিগের দ্বারা যে এই কাৰ্য্য হইয়া থাকে, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। 

কৰ্ম্ম। ডাকাইতি করিবার সময় উহারা কখন আগ্নেয় অস্ত্র ব্যবহার করিয়া থাকে কি? 

বেনিয়া। এ পর্যন্ত কখনও আগ্নেয় অস্ত্র ব্যবহার করার কথা শুনি নাই। 

কৰ্ম্ম। তবে উহারা কি অস্ত্র ব্যবহার করিয়া থাকে? 

বেনিয়া। লাঠি ও মসাল। 

কৰ্ম্ম। এ পর্যন্ত কোন ডাকাইতিতে কোন লোক ধৃত হয় নাই? 

বেনিয়া। কেহ যে কখন ধরা পড়িয়াছে, তাহা আমি এ পর্য্যন্ত শুনি নাই। 

কৰ্ম্ম। পুলিস-কর্মচারিগণ এই সকল ডাকাইতি নিবারণের নিমিত্ত কি উপায় অবলম্বন করিয়াছেন? 

বেনিয়া। তাঁহারা যে কি উপায় অবলম্বন করিয়াছেন তাহা আমরা অবগত নহি। ডাকাইতি হইয়া গেলে তাঁহারা ঘটনাস্থলে আসিয়া উপস্থিত হন ও দুই তিন দিবস অনুসন্ধানের পর সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিয়া থাকেন, ইহাই ত দেখিতে পাই, ডাকাইতি নিবারণের নিমিত্ত ভিতরে ভিতরে যদি কোনরূপ বন্দোবস্ত করিয়া থাকেন তাহা আমরা অবগত নহি। 

সেই বেনিয়ার সহিত এইরূপে কর্ম্মচারীর নানারূপ কথা হইতে হইতে ক্রমে রাত্রি অধিক হইয়া পড়িল। বেনিয়া শয়ন করিবার নিমিত্ত তাঁহার নিকট হইতে প্রস্থান করিল, কৰ্ম্মচারীও বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

কর্ম্মচারী ও তাঁহার অনুচর ক্রমে নিদ্রিত হইয়া পড়িলেন। তাঁহারা যে সেই স্থানে কতকক্ষণ নিদ্রাসুখ অনুভব করিয়াছিলেন তাহা তাঁহারা বলিতে পারেন না, একটি ভয়ানক গোলযোগে হঠাৎ তাঁহাদিগের নিদ্রা ভঙ্গ হইল। চক্ষু উন্মীলন করিয়া দেখিলেন যে সকল বিষয়ের আলোচনা করিবার পর তাঁহারা নিদ্রিত হইয়া পড়িয়াছিলেন, এখন তাহাই তাঁহাদের সম্মুখে ঘটিতেছে। সেই বেনিয়ার বাড়ীতেই ডাকাইত পড়িয়াছে, তাহারই যথা সর্ব্বস্ব অপহৃত হইবার উপক্রম হইয়াছে। বাড়ীর সম্মুখে প্রজ্বলিত মসাল হস্তে ডাকাইতগণ ভীষণ চীৎকারের সহিত এদিক-ওদিক ছুটিতেছে, কেহবা বাড়ীর দরজা ভাঙ্গিয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশের চেষ্টা করিতেছে, কেহবা লাঠি লইয়া বাড়ীর চতুর্দিকেও পথের উপর বিকট চীৎকারের সহিত ঘাঁটি দিতেছে। গ্রামের লোকজন একত্রিত হইয়া ডাকাইতগণের হস্ত হইতে সেই বেনিয়ার ধন সম্পত্তি, ও তাহাদিগের জীবন রক্ষার নিমিত্ত সেইদিকে আসিবার চেষ্টা করিতেছে কিন্তু ওই ঘাঁটিরক্ষকদিগের প্রতিবন্ধকাচরণে কেহই অগ্রসর হইতে পারিতেছে না। 

কর্ম্মচারী ও তাঁহার অনুচর বাহিরের যে ঘরে শয়ন করিয়াছিলেন, সেই ঘর হইত এই অবস্থা দৃষ্টি করিয়া, সেই সময় কি কৰ্ত্তব্য তাহা হঠাৎ স্থির করিয়া উঠিতে পারিলেন না, মনে করিলেন তাঁহারা জমীদারের কর্মচারী পরিচয়ে সেই স্থানে অবস্থিতি করিলেও তাহারা পুলিস-কৰ্ম্মচারী। এই ডাকাইত ধরিবার নিমিত্ত তাঁহার নিযুক্ত না হইলেও যখন তাঁহাদিগের সম্মুখে এইরূপ ভয়ানক ডাকাইতি হইতেছে তখন তাহার প্রতিবিধানের চেষ্টা না করিয়াই বা কিরূপে তাঁহারা সেই স্থানে স্থিরভাবে বসিয়া থাকিতে পারেন! 

একবার মনে করিলেন তাঁহারা ওই ডাকাইত দলের সম্মুখীন হইয়া এই ডাকাইতির প্রতিবন্ধকাচরণের চেষ্টা করেন; যদি কৃতকার্য হইতে পারেন ভালই নতুবা ইহাতে তাঁহাদিগের কর্ত্তব্য কর্ম্মের কিছুমাত্র ত্রুটী হইবে না। কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভাবিলেন, ডাকাইতগণ সংখ্যায় অধিক, আর তাঁহারা কেবলমাত্র দুইজন, এরূপ অবস্থায় যদি তাঁহারা উহাদিগের সম্মুখীন হন, তাহা হইলে উহাদিগকে ধৃত করা বা উহাদিগকে ওই কার্য হইতে নিবৃত্তি করা কোন ক্রমেই তাঁহাদিগের সাধ্যয়িত হইবে না। বিশেষ তাঁহাদিগকেই বিশেষরূপে পরাজিত বা আঘাতিত হইবার সম্ভাবনা অধিক, তাহাদিগকে ওই ডাকাইতগণ ধৃত না করিয়া তাহাদিগের পথ পরিষ্কার না করিবে তাহাই বা কে বলিতে পারে। 

মনে মনে এইরূপ উপস্থিত মত নানারূপ চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইলে তাঁহারা বিশেষ কোনরূপ মীমাংসায় আসিয়া উপনীত হইতে পারিলেন না। বিশেষ সেইরূপ অবস্থায় কোনরূপ চিন্তা করিয়া কার্য্যে হস্তার্পণ করিবার সময়ও ছিল না। 

যে ঘরে কর্মচারীদ্বয় শয়ন করিয়াছিলেন সেই ঘরে একটি প্রদীপ জ্বলিতেছিল কর্মচারী সেই আলোটি নির্বাপিত করিয়ে চুপে চুপে তাঁহার অনুচরকে কহিলেন, মরিতে প্রস্তুত হও, তোমার লাঠিগাছাটি লইয়া আত্মরক্ষার নিমিত্ত প্রস্তুত হইয়া থাক, আমার রিভলভারটি যত দিবস পর্য্যন্ত আমার নিকট আছে তাহার মধ্যে সে কখনও মানব রক্ত পান করে নাই, আজ দেখি তাহার সেই লালসা আছে কি না। এই বলিয়া কৰ্ম্মচারী সেই অন্ধকারের ভিতর তাঁহার ব্যাগটি খুলিয়া তাহার মধ্য হইতে একটি ছয় নালা রিভলভার বাহির করিয়া তাহাতে ছয়টি গুলি ভরিয়া ঠিক করিয়া লইলেন। 

সরকারী কার্য্য উপলক্ষ্যে কৰ্ম্মচারীকে সময় সময় প্রায়ই বিদেশে গমন করিতে হইত সুতরাং আত্মরক্ষার নিমিত্ত একটি ছয় নালা রিভলভার ও এক বাক্স কারট্রিজ বা গুলি তিনি সর্ব্বদা আপনার সঙ্গে রাখিতেন। ইহার দ্বারা তিনি সময় সময় অনেক উপকারও পাইতেন; দস্যু তস্করের হস্তে কখনও পতিত না হইলেও হিংস্র জন্তুর হস্তে তাঁহাকে অনেক সময় পতিত হইতে হইত কিন্তু রিভলভারের আওয়াজ শুনিলে আর তাহারা সেই স্থানে দাঁড়াইত না। সময় সময় তিনি উহার দ্বারা বিশেষরূপ উপকার প্রাপ্ত হইতেন বলিয়া ভিন্ন স্থানে গমন করিবার সময় তিনি কখনই উহা ছাড়িতেন না। যে ব্যাগের ভিতর তাঁহার আবশ্যকীয় কাগজপত্র ও টাকাকড়ি থাকিত, উহা তিনি তাহার ভিতরই রাখিয়া দিতেন, ও যেস্থানে গমন করিতেন ব্যাগটিও নিজহস্তে বহন করিয়া লইয়া যাইতেন। এবারও ওই ব্যাগটি তাঁহার সঙ্গে ছিল সুতরাং রিভলভারটি ও গুলির বাক্সটিও উহার ভিতর ছিল। 

দেখিতে দেখিতে ডাকাইত দলের কতকগুলি লোক সেই বেনিয়ার সদর দরজা ভাঙ্গিয়া তাহার বাড়ীর ভিতর প্রজ্বলিত মসাল হস্তে প্রবেশ করিল। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ীর স্ত্রীলোক ও বালক-বালিকাদিগের আত্মনাদ সকলের কর্ণ বধির করিয়া তুলিতে লাগিল। 

এই অবস্থা দর্শন ও আত্মনাদ শ্রবণ করিয়া কৰ্ম্মচারী আর কাল বিলম্ব করিলেন না। সেই গুলি ভরা রিভলভার ও গুলির বাক্সটি হস্তে করিয়া তিনি তাঁহার শয়ন ঘর হইতে বহির্গত হইলেন, বলা বাহুল্য তাঁহার সেই পরিচারকও লাঠি হস্তে তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ বাহিরে আসিল। 

যে সকল ডাকাইত লাঠি লইয়া সেই স্থানে পাহারা দিতেছিল তাহাদিগের মধ্যে এক ব্যক্তি কর্মচারী ও তাঁহার অনুচরকে দেখিতে পাইয়া তাঁহাদিগকে আক্রমণ করিবার নিমিত্ত সেই দিকে ধাববান হইল। কর্ম্মচারীর তখন ভাল মন্দ বিবেচনা করিবার ক্ষমতা ছিল না, এইরূপ অবস্থায় তাঁহার কি করা কর্তব্য চিন্তা না করিয়াই, তাঁহার দিকে লাঠি হস্তে অগ্রবর্তী সেই ডাকাইতকে লক্ষ্য করিয়া একটি গুলি ছুড়িলেন। প্রবল শব্দের সহিত সেই গুলি সেই ডাকাইতের অঙ্গভেদ করিয়া তাহাকে সেই স্থানে পাতিত করিল। সেই ডাকাইতের হস্তস্থিত বংশদণ্ড সেই স্থানের এক দিকে পড়িয়া গেল, সেও সেই স্থান হইতে আর উঠিতে পারিল না। 

এই অবস্থা দেখিয়া আর একজন ডাকাইত পুনরায় সেইদিকে অগ্রগামী হইল, দেখিতে দেখিতে পুনরায় আগ্নেয় অস্ত্রের ভীষণ শব্দ সকলের কর্ণে প্রবিষ্ট হইল, সেই ডাকাইতও তাহার হস্তস্থিত বংশদণ্ডের সহিত সেই স্থানের মৃত্তিকা আশ্রয় করিল। 

গ্রামের যে সকল লোক ডাকাইতি নিবারণ মানসে সমবেত হইয়া দূরে অপেক্ষা করিতেছিল, অথচ ডাকাইতগণের প্রবল লাঠির জোরে অগ্রসর হইতে পারিতেছিল না, তাহারা আগ্নেয় অস্ত্রের শব্দ শুনিয়া ভাবিল এবার ডাকাইতগণ ডাকাইতি করিবার সময় আগ্নেয় অস্ত্র ব্যবহার করিতেছে, সুতরাং নিকটবর্ত্তী কোন স্থানে দণ্ডায়মান হওয়া আর কোনরূপেই কর্তব্য নহে। এই ভাবিয়া সকলেই সেই স্থান হইতে দ্রুতবেগে প্রস্থান করিল। 

ডাকাইতগণ যখন বুঝিতে পারিল তাহাদিগের উপর আগ্নেয় অস্ত্র ব্যবহার হইতে যখন আরম্ভ হইয়াছে, তখন সেই স্থানে আর ডাকাইতি করা কোনরূপেই কৰ্ত্তব্য নহে। তাহারা যতক্ষণ সেই স্থানে থাকিবে ততক্ষণই তাহাদিগের দলের লোকহানি হইবার সম্ভাবনা। 

ডাকাইতগণ এইরূপ ভাবিয়া কেমন একটি শব্দ করিয়া উঠিল, সেই শব্দের সঙ্গে সঙ্গে একটি ভয়ঙ্কর চীৎকার ধ্বনি গগন ভেদ করিয়া, গ্রামের গৃহে গৃহে বৃক্ষে বৃক্ষে প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। যে সময় দুইটি ডাকাইত আগ্নেয় অস্ত্ৰে আহত হইয়া সেই স্থানে পতিত হইয়াছিল, তাহার অতি অল্পমাত্র পূৰ্ব্বে ডাকাইতগণ সেই বেনিয়ার বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল, কিন্তু তখন পর্য্যন্ত তাহারা কোন দ্রব্য অপহরণ করিতে সমর্থ হইয়াছিল না। যে সময় সেই ডাকাইতগণের সেই ভয়ানক শব্দ উত্থিত হয় সেই সময় বাড়ীর ভিতর হইতে সমস্ত ডাকাইতগণ বাহিরে আসিয়া উপস্থিত হয় ও সেই আহত ডাকাইতদিগকে উঠাইয়া লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার চেষ্টা করে। 

কর্ম্মচারী এই অবস্থা দৃষ্টে তাঁহার হস্তস্থিত রিভলভারের অবশিষ্ট চারিটি গুলি তাহাদিগের উপর প্রয়োগ করিলেন। ডাকাইতগণ আর তিলার্দ্ধ সেই স্থানে অপেক্ষা না করিয়া দ্রুতবেগে সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া গেল। কৰ্ম্মচারীও ক্ষিপ্রহস্তে তাঁহার রিভলভারে আর ছয়টি গুলি পুরিয়া ওই ডাকাইতদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন, কিন্তু কাহার উপর লক্ষ্য করিয়া তিনি গুলি প্রয়োগ করিতে সমর্থ হইলেন না, কারণ সেই বাড়ী হইতে বহির্গত হইবার সময় তাহারা তাহাদিগের হস্তস্থিত প্রজ্বলিত মসাল সকল সেই বাড়ীর সম্মুখে পরিত্যাগ করিয়া অন্ধকারের আশ্রয় লইয়া সেই স্থান হইতে পলায়ন করিতে আরম্ভ করে। কর্ম্মচারী যে পর্যন্ত বুঝিতে পারিলেন তাঁহার গুলি ডাকাইতগণকে আঘাতিত করিতে সমর্থ হইবে সেই পৰ্য্যন্ত তিনি সেইদিকে গুলি প্রয়োগ করিতে ক্ষান্ত হইলেন না। ওই ছয়টি গুলিও এইরূপে শেষ হইয়া গেলে তিনি আপন স্থানে প্রত্যাগমন করিলেন ও দুইটি প্রজ্বলিত মসাল উঠাইয়া লইয়া তাঁহার অনুচরের সহিত সেই স্থান পরীক্ষা করিতে আরম্ভ করিলেন। ডাকাইতগণ প্রস্থান করিয়াছে জানিতে পারিয়া সেই পাড়ার লোকগণ দুই একজন করিয়া সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিলেন। 

কর্ম্মচারী ও তাঁহার অনুচর তাহাদিগের নিকট অপরিচিত ছিলেন, অথচ তাঁহাদিগের হস্তে মসাল দেখিয়া প্রথমতঃ তাঁহাদিগকে ডাকাইত বলিয়া তাহাদিগের মনে সন্দেহ হইল, কিন্তু পরিশেষে তাঁহাদিগের নিকট অবস্থা অবগত হইয়া, তাহাদিগের সাহস হইল, ও তাঁহাদিগকে সঙ্গে লইয়া পাড়ার দুই চারিজন লোক সেই বেনিয়ার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া, তাহাদিগকে আশ্বাস প্রদান পূৰ্ব্বক কহিল “আজ কোন ভয় নাই ডাকাইতগণ প্রস্থান করিয়াছে।” 

উহাদিগকে দেখিয়া বেনিয়ার সাহস হইল, বাড়ীর স্ত্রীলোকগণের অনুসন্ধান করিল, ও কহিল তোমরা কে কোথায় আছ বাহির হও, আর ভয় নাই ডাকাইতগণ প্রস্থান করিয়াছে। 

বাড়ীর স্ত্রীলোকগণ ভয়ে অতিশয় ভীতা হইয়া, যে যেস্থানে সুবিধা পাইয়াছিল সে সেই স্থানে গিয়া লুকাইয়াছিল, তাহারা বেনিয়ার কথা শুনিয়া একে একে বাহিরে আসিল। 

বেনিয়া পরিশেষে তাহার ঘরের অবস্থা উত্তমরূপে দেখিল, দেখিল ডাকাইতগণ তাহার বাক্স পেট্রা সকল ভাঙ্গিবার চেষ্টা করিয়াছিল, কোনটি বা ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছিল, কিন্তু বিশেষ মূল্যবান কোন দ্রব্য তাহারা গ্রহণ করে নাই। 

ডাকাইতগণ, বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার সময় সেই বেনিয়া তাহার ঘর পরিত্যাগ করিয়া একটি খালি ঘরের ভিতর গিয়া লুকাইয়াছিল, সুতরাং ডাকাইতগণ ডাকাইতি করিতে আসিয়া, ডাকাইতি না করিয়া যে কেন প্রস্থান করিয়াছে তাহার কিছুমাত্র সে অবগত ছিল না, পরিশেষে সমস্ত অবস্থা শুনিয়া জানিতে পারিল যে তাহার বাড়ীতে সেই রাত্রিতে যাঁহারা অতিথি হইয়া আগমন করিয়াছিলেন তাঁহারাই তাহাকে আজ এই ভয়ানক বিপদ হইতে পরিত্রাণ করিয়াছেন, তাঁহাদিগের নিমিত্তই তাহার কোন দ্রব্য অপহৃত হয় নাই, নতুবা আজ তাহার যথা সৰ্ব্বস্ব অপহৃত হইত ও তাহাকে পথের ভিকারী হইয়া পরিবারবর্গের সহিত অন্ন কষ্ট সহ্য করিতে হইত। 

সেই আগন্তুকদ্বয় তাহাদিগকে এই বিপদ হইতে উদ্ধার করিয়াছেন ইহা জানিতে পারিয়া তাহারা সপরিবারে আসিয়া উহাদিগের পদযুগল জড়াইয়া ধরিল। কৰ্ম্মচারীদ্বয় মিষ্ট কথায় উহাদিগকে শান্ত করিয়া বাহিরে আগমন করিলেন, সেই বেনিয়া ও প্রতিবেশী কয়েকজনও তাঁহার সহিত বাহির হইয়া আসিল; সকলে বাহিরে আসিলে কৰ্ম্মচারী তাহাদিগকে কহিলেন, তিনি ডাকাইতদিগের উপর এক এক করিয়া ক্রমে বারটি গুলি মারিয়াছেন, তাঁহার সমস্ত গুলিই যে একেবারে নিষ্ফল হইয়াছে তাহা তাঁহার বোধ হয় না, বিশেষ দুই জনকে আহত হইয়া ধরাশায়ী হইতে তিনি নিজ চক্ষে দেখিয়াছেন কিন্তু এখন আর তাহাদিগকে দেখিতে পাইতেছেন না, বোধ হয় উহাদিগের দলস্থিত ব্যক্তিগণ উহাদিগকে স্থানান্তরিত করিয়াছে। এরূপ অবস্থায় নিকটবর্ত্তী স্থান সকল এখন উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়ে দেখা কর্তব্য। কারণ যদি উহাদিগের কাহাকেও পাওয়া যায় তাহা হইলে সকলেই জানিতে পারিবেন কাহাদিগের দ্বারা এই সকল ডাকাইতি হইতেছে, ও ভবিষ্যতে এই সকল ডাকাইতি একেবারেই বন্ধ হইয়া যাইবে। 

কর্মচারীর কথা শুনিয়া সকলেই ডাকাইতদিগের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইল, কেহবা প্রজ্বলিত মসাল উঠাইয়া লইল, কেহ বা লণ্ঠন বাহির করিয়া আনিল, কেহবা অন্ধকারেই চলিল, এইরূপ সকলে সেই বাড়ীর ভিতর ও বাহিরে প্রথমতঃ অনুসন্ধান করিল কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পাইল না। যে স্থানে দুই ব্যক্তি আহত হইয়া পড়িয়া গিয়াছিল, সেই স্থানে বা তাহার নিকটবর্ত্তী কোন স্থানে কাহাকেও দেখিতে পাওয়া গেল না, পরিশেষে বাড়ীর বাহিরে ও যেদিক দিয়া ডাকাইতগণ প্রস্থান করিয়াছিল, সেই দিকে অনুসন্ধান করিবার সময় এক ব্যক্তি চীৎকার করিয়া উঠিল ও কহিল ওই স্থানে কি একটি পড়িয়া রহিয়াছে। এই কথা শুনিবামাত্র এক ব্যক্তি একটি মসাল হস্তে সেইদিকে ছুটিল ও দেখিল এক ব্যক্তি গুলির আঘাতে আহত হইয়া সেই স্থানে পড়িয়া রহিয়াছে, তাহার উরুদেশে বিষম আঘাত পাওয়ায় তাহার চলিবার ক্ষমতা নাই। উহাকে দেখিয়া কেহই চিনিতে পারিল না, সে কে, বা কোথায় থাকে জিজ্ঞাসা করায় সে কোন কথার উত্তর প্রদান না করিয়া কেবল ইঙ্গিত দ্বারা জলপান করিতে চাহিল, কর্ম্মচারী সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত হইয়াছিলেন, তিনি একজনকে জল আনিতে কহিলেন। সে এক ঘটি জল আনিলে তাহা হইতে কিছু তাহার মুখে চক্ষে ও মস্তকে প্রদান করিয়া অবশিষ্ট তাহাকে পান করিতে দিলেন। জলপানে সে একটু সুস্থ হইল, কিন্তু তাহার চলিবার ক্ষমতা ছিল না। কর্মচারী তখন কয়েকজন লোকের সাহায্যে তাহাকে সেই স্থান হইতে উঠাইয়া সেই বেনিয়ার বাড়ীর সম্মুখে লইয়া গেলেন ও সেই স্থানে তাহাকে মৃত্তিকার উপর রাখিয়া দিলেন। ক্ষতস্থান পরীক্ষা করিয়া তাঁহার অনুমান হইল যে উহার ঊরুদেশের হাড় ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। 

যেস্থানে ওই আহত ব্যক্তিকে পাওয়া গিয়াছিল তাহার কিছুদূর অন্তরে একটি সামান্য জঙ্গলের ভিতর হইতে একটি গোলযোগ উত্থিত হইল। কৰ্ম্মচারী ওই গোলযোগ শুনিয়া সেই স্থানে গমন করিলেন, দেখিলেন সেই স্থানেও এক ব্যক্তি পড়িয়া রহিয়াছে, কিন্তু উহার মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইতেছে না, বা উহার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কোন স্থানও নড়িতেছে না। তিনি উহার নিকট গিয়া উহাকে উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন, দেখিলেন একটি গুলি উহার বক্ষঃস্থল ভেদ করিয়া বাহির হইয়া গিয়াছে, ও অতি অল্প পূর্ব্বেই তাহার প্রাণবায়ুও তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে। ওই মৃতদেহ যে স্থানে পড়িয়াছিল, সেই স্থানেই ও সেই অবস্থাতেই উহা পরিত্যাগ করিয়া কৰ্ম্মচারী সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলেন ও নিজের থাকিবার স্থানের দিকে আগমন করিতে লাগিলেন। 

পথিমধ্যে শুনিতে পাইলেন আরও দুই ব্যক্তি আহত হইয়া পলায়ন করিবার চেষ্টা করিতেছিল কিন্তু পলাইতে পারে নাই তাহারাও ধৃত হইয়াছে। 

এই সংবাদ পাইবামাত্র যেদিকে উহারা ধৃত হইয়াছে সেইদিকে তিনি দ্রুতপদে গমন করিতে লাগিলেন, কিছুদূর গমন করিবার পরই তিনি দেখিতে পাইলেন গ্রামের কতকগুলি লোক একত্রিত হইয়া ওই ব্যক্তিকে বহন করিয়া আনয়ন করিতেছে। তাহাদিগকে দেখিয়া কৰ্ম্মচারী বুঝিতে পারিলেন যে উহারাও বিশেষরূপে আহত হইয়াছে, দ্রুতবেগে পলায়ন করিবার ক্ষমতা উহাদিগের নাই। উহাদিগকেও তিনি তাঁহার থাকিবার স্থানের নিকটবর্ত্তী স্থানে, যেখানে আর এক ব্যক্তিকে পূর্ব্বে রাখিয়া দিয়াছিলেন সেই স্থানে রাখিয়া দিলেন। 

উহারা ডাকাইত, ডাকাইতি করিতে আসিয়া আহত হইয়াছে, সুতরাং এখন যাহাতে তাহারা বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুমুখে পতিত না হয় তাহার দিকে দৃষ্টি রাখা এখন সকলেরই কর্তব্য। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া কৰ্ম্মচারী সেই বেনিয়াকে জিজ্ঞাসা করিলেন এ গ্রামে কোন ডাক্তার আছে কি? 

বেনিয়া। না মহাশয়, এ গ্রামে কোন ডাক্তার নাই। 

কৰ্ম্ম। নিকটবর্ত্তী কোন গ্রামে আছে? 

বেনিয়া। নিকটবর্ত্তী কোন গ্রামে, এমন কি দশ ক্রোশের মধ্যে যে ডাক্তার আছে তাহা আমরা জ্ঞাত নহি। 

কৰ্ম্ম। এই স্থান হইতে থানা কতদূর? 

বেনিয়া। প্রায় পাঁচ ক্রোশ হইবে। 

কৰ্ম্ম। এখানে ঘোড়া পাওয়া যায়? 

বেনিয়া। এখানে অনেকেরই ঘোড়া আছে। 

কৰ্ম্ম। তাহা হইলে এক কার্য্য কর, একজন বুদ্ধিমান লোককে এখনই ঘোড়া সোয়ারে থানায় পাঠাইয়া দেও। সে সেই স্থানে গিয়া এই সকল কথা দারোগা সাহেবকে বলে, তাঁহারা আসিয়া যেরূপ ভাল বিবেচনা হয় করিবেন। 

বেনিয়া। আমি এখনই ইহার বন্দোবস্ত করিতেছি। 

কৰ্ম্ম। এ গ্রামে কি চৌকিদার নাই? 

বেনিয়া। আছে বৈ কি? 

কৰ্ম্ম। গ্রামে এত গোলযোগ উপস্থিত হইয়াছে। ডাকাইতি খুন জখম হইয়া গিয়াছে গ্রামস্থ সমস্ত লোক একত্রিত হইয়াছে কিন্তু কই চৌকিদারকে ত দেখিতে পাইতেছি না। 

বেনিয়া। আমরাও তাহাকে দেখিতে পাই নাই। বোধ হয় সে গ্রামে নাই, স্থানান্তরে গমন করিয়া থাকিবে। 

কৰ্ম্ম। এরূপ অবস্থায় কোনক্রমেই আর কাল বিলম্ব করা যাইতে পারে না, যত শীগ্র পারেন, দ্রুতগামী অশ্বারোহণ করাইয়া কোন ব্যক্তিকে থানায় পাঠাইয়া দিন। 

বেনিয়া। আমি এখনই তাহার বন্দোবস্ত করিতেছি। 

এই বলিয়া সেই বেনিয়া থানায় সংবাদ পাঠাইয়া দিবার বন্দোবস্ত করিতে লাগিলেন। 

যে সময় এই ডাকাইতি হইতে আরম্ভ হয় সেই সময় রাত্রি অধিক ছিল না, ও এই সকল গোলযোগে রাত্রি প্রভাত হইয়া গেল। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

প্রভাত হইতে না হইতেই সেই বেনিয়া তাহার একটি দ্রুতগামী অশ্বে একটি লোককে থানায় পাঠাইয়া দিলেন দারোগা সাহেব থানাতেই উপস্থিত ছিলেন। কেবলমাত্র তিনি নিদ্রা হইতে গাত্রোত্থান করিয়া বাহিরে আসিয়া বসিয়াছেন, এরূপ সময়ে সেই অশ্বারোহী গিয়া তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইল। তাহাকে দ্রুতবেগে তাঁহার নিকট আসিতে দেখিয়া তিনি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, এত প্রত্যূষে তুমি অশ্বারোহণে কোথা হইতে আসিতেছ? 

আগন্তুক। আমাদিগের গ্রাম হইতে। 

দারো। তোমাদিগের গ্রাম কোথায়? 

আগ। এখান হইতে প্রায় পাঁচ ক্রোশ হইবে। 

দারো। এখানে কাহার নিকট আসিয়াছ? 

আগ। আপনার নিকট। 

দারো। আমার নিকট কেন, গ্রামে কোনরূপ ঘটনা ঘটিয়াছে নাকি? 

আগ। বিশেষ ঘটনা না ঘটিলে এত প্রত্যূষে আপনাকে বিরক্ত করিতে আসিব কেন? 

দারো। কি ঘটনা ঘটিয়াছে? 

আগ। ডাকাইতি, খুন, জখম। 

দারো। কাহার বাড়ীতে ডাকাইতি হইয়াছে? 

আগ। বেনিয়ার বাড়ীতে। 

দারো। ওই বেনিয়াই কি হত হইয়াছে? 

আগ। না। 

দারো। তবে কে হত হইয়াছে? 

আগ। একজন ডাকাইত। 

দারো। জখম হইয়াছে কে? 

আগ। ডাকাইতেরা। 

দারো। কয়জন ডাকাইত জখম হইয়াছে? 

আগ। তিন জন ত আমি দেখিয়াছি। 

দারো। কে উহাদিগকে হত ও আহত করিয়াছে? 

আগ। দুইজন লোক, তাহাদিগকে আমরা চিনি না।

দারো। কিরূপে উহাদিগকে হত ও আহত করিয়াছে?

আগ। গুলি মারিয়া। 

দারো। উহারা বন্দুক পাইল কোথা? 

আগ। তাহা আমি বলিতে পারি না। 

দারো। তাহারা এখন কোথায়? 

আগ। আমাদিগের গ্রামেই আছে। 

দারো। উহারা পলাইয়া যাইবে না ত, উহাদিগকে চৌকিদারের জিম্বা করিয়া দেওয়া হইয়াছে কি? 

আগ। চৌকিদারকে এ পর্যন্ত দেখিতে পাওয়া যায় নাই। আর তাহারা পলাইবার লোক বলিয়া বোধ হয় না।

দারো। যে ব্যক্তিকে মারিয়া ফেলা হইয়াছে তাহার মৃতদেহ এখন কোথায়? 

আগ। সেই গ্রামের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র জঙ্গলের মধ্যে পড়িয়া আছে। 

দারো। আর যাহারা জখম হইয়াছে তাহারা কোথায়? 

আগ। সেই বেনিয়ার বাড়ীর সম্মুখেই আছে। 

দারো। উহারা কাহারা? 

আগ। তাহা আমি জানি না, উহাদিগকে ইতিপূর্ব্বে আর কখনও দেখি নাই। 

দারো। যে বেনিয়ার বাড়ীতে ডাকাইত পড়িয়াছিল তাহার কোন দ্রব্য অপহৃত হইয়াছ কি? 

আগ। তাহা আমি বলিতে পারি না। 

দারো। উহার বাড়ীর কেহ হত বা আহত হয়েছে? 

আগ। না। 

দারো। গ্রামের আর কোন ব্যক্তি হত বা আহত হয় নাই? 

আগ। আমি গ্রামের কাহাকেও হত বা আহত হইতে দেখি নাই। 

ওই আগন্তুকের নিকট এই সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া তিনি তাঁহার অধীনস্থ একজন কর্মচারীকে ডাকিলেন, ও তিনি যাহা কিছু অবগত হইতে পারিয়াছিলেন তাহা তাঁদের অল্প কথায় বলিয়া, কয়েকজন কনেষ্টবল সঙ্গে লইয়া দ্রুতপদে সেই গ্রামে গমন করিতে আদেশ করিলেন। নিজেও যত শীঘ্র পারেন প্রস্তুত হইয়া তাঁহার ঘোড়ায় আরোহণ করিয়া সেই সংবাদদাতার সহিত ঘটনাস্থলে গমন করিলেন। 

দারোগা সাহেব ঘটনাস্থলে উপনীত হইয়াই দেখিলেন, যে বেনিয়ার বাড়ীতে ডাকাইত পড়িয়াছিল, সেই বেনিয়া তাঁহার পরিচিত। তিনি প্রথমেই সেই বেনিয়াকে জিজ্ঞাসা করিলেন “যে দুই ব্যক্তি এই সকল হত্যা ও জখম করিয়াছে, তাহারা কোথায়?” 

কর্ম্মচারী সেই সময় সেই স্থানেই উপস্থিত ছিলেন, তিনি দারোগা সাহেবের প্রথম কথা শুনিয়া ও তাঁহাকে দেখিয়াই বুঝিতে পারিলেন তিনি কিরূপের কর্ম্মচারী, আরও বুঝিতে পারিলেন ইহার দ্বারা এই মোকদ্দমার সুচারুরূপে অনুসন্ধান হইবার আশা কম। মনে এইরূপ ভাবিয়া তিনি কহিলেন “আমরা এই স্থানেই উপস্থিত আছি, আমরাই উহাদিগকে হত ও আহত করিয়াছি।” 

দারো। তোমরা হত্যা করিয়া স্থিরভাবে বসিয়া আছ। তোমাদের মনে কোনরূপ ভয় ডর নাই। তোমরা বুঝিতে পারিয়াছ কি যে তোমরা কি ভয়ানক কার্য্য করিয়াছ। 

কৰ্ম্ম। আপনি কি বলেন যে, এই স্থানে স্থির ভাবে বসিয়া ন থাকিয়া এই স্থান হইতে পলায়ন করাই আমাদিগের কৰ্ত্তব্য ছিল; যাহা হউক আমরা আমাদের কর্তব্য বুঝিতে পারি নাই বলিয়াই এই স্থানে বসিয়া আছি! আমরা বেশ বুঝিতে পারিয়াছি যে আমরা কিরূপ ভয়ানক কার্য্য করিয়াছি। যখন এক কার্য্য করিয়া ফেলিয়াছি তখন আর ভয় করিয়া কি করিব? 

দারো। আপনারা কাহারা? 

কৰ্ম্ম। আমাদিগের পরিচয় লইবার আপনি যথেষ্ট সময় পাইবেন। এখন তিন তিনজন লোক সাংঘাতিকরূপে আহত হইয়া আপনার সম্মুখে পড়িয়া রহিয়াছে, অগ্রে তাহাদিগের জীবন রক্ষার উপায় করুন, তাহার পর আমাদিগের পরিচয় গ্রহণ করিবেন। 

বেনিয়া। ইহারা আমাদিগের এই প্রদেশের জমীদারদের কৰ্ম্মচারী। 

দারো। ইহারা বড় জমীদারের লোক তাই আমার কথার উত্তর প্রদান করিতে অবমাননা বোধ করিতেছে। আমি 

শুনিয়াছি এ দেশের জমীদারের বাসস্থান কলিকাতায়, তিনি রাজা বলিয়া সকলের নিকট পরিচিত। 

কৰ্ম্ম। আমার রাজারই চাকর। 

দারো। তাঁহার অনেক অর্থ আছে? 

কৰ্ম্ম। অনেক অর্থ ও অনেক রাজ্য আছে। 

দারো। তোমাদিগের বাঁচাইবার জন্য তিনি অনেক অর্থ ব্যয় করিতে পারিবেন। 

কৰ্ম্ম। আমার কার্য্যের নিমিত্ত তাঁহারা অর্থ ব্যয় করিবেন কেন? তাঁহারা কিছু আমাকে খুন করিতে বলিয়া দেন নাই। 

দারো। তোমরা যে বন্দুক দিয়া এই সকল নরহত্যা করিয়াছ, সেই বন্দুক কোথায়? 

কৰ্ম্ম। আমাদিগের নিকট কোন বন্দুক নাই। 

দারো। তবে কি দিয়া ইহাদিগকে হত ও আহত করিয়াছ? 

কৰ্ম্ম। রিভলভার দিয়া। 

দারো। তাহা কোথায়? 

কৰ্ম্ম। আমার নিকট আছে। 

দারো। উহা আমি চাই।

কৰ্ম্ম। লইবেন। 

দারো। এখনই দেও। 

কৰ্ম্ম। রিভলভারের জন্য আপনি এত ব্যস্ত হইতেছেন কেন? আমি এই স্থানেই আছি, রিভলভারও আমার নিকট আছে। আপনার যখন ইচ্ছা হয় তখনই উহা লইতে পারেন। এখন আপনার অগ্রে দেখিবার কাৰ্য্য অনেক আছে, সেইগুলি অগ্রে দেখা আপনার কৰ্ত্তব্য। 

দারো। আমার কর্তব্য আমি নিজে অবগত আছি, তাহা তোমার বলিবার কিছুমাত্র আবশ্যক নাই। 

কৰ্ম্ম। বোধ হয় কিছু আবশ্যক আছে। 

দারোগা সাহেব থানা হইতে আসিবার কালীন তাঁহার অধীনস্থ যে কর্ম্মচারীকে এই স্থানে আগমন করিতে বলিয়া আসিয়াছিলেন তিনি কয়েকজন কনেষ্টবলের সহিত সেই সময় সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, দারোগা সাহেব সেই থানার ভারপ্রাপ্ত সবইনস্পেক্টার, আর তাঁহার অধীনস্থ সেই কর্ম্মচারী ওই থানার একজন পুরাতন হেড কনেষ্টবল। দারোগা সাহেব তাঁহার থানার প্রধান কর্ম্মচারী হইলেও তিনি যত দিবস হইতে পুলিস বিভাগে কর্ম্ম করিতেছেন, ওই হেড কনেষ্টবল তাহার অনেক বৎসর পূর্ব্ব হইতে এই বিভাগে নিযুক্ত আছেন। 

দারোগা সাহেবের সহিত সেই কৰ্ম্মচারীর যেরূপ ভাবে কথা হইতেছিল, তাহা তিনি একটু দূর হইতে সমস্ত শুনিতেছিলেন। দারোগা সাহেবের কথা শুনিয়া তিনিও মনে মনে একটু অসন্তুষ্ট হইলেন ও কহিলেন “ইহার সহিত এখন বাগবিতণ্ডার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। ইনি যখন এই স্থানে উপস্থিত আছেন তখন সময়মত ইহাকে সমস্ত কথা জিজ্ঞাসা করা যাইতে পারিবে। অগ্রে জখমিদিগকে দেখিয়া তাহাদিগের বন্দোবস্ত করা আমাদিগের আবশ্যক, তদ্ব্যতীত উহারা কাহারা, ও উহাদিগের সহিত আর কোন্ কোন্ ব্যক্তি ডাকাইতি করিতে আসিয়াছিল তাহাও উহাদিগের নিকট হইতে অগ্রেই জানিয়া লওয়া আবশ্যক। কারণ যদি উহারা মরিয়া যায়, তাহা হইলে কোন কথা জানিতে পারা যাইবে না। এখন উহাদিগের নিকট হইতে ডাকাইতগণের নাম পাইলে তাহাদিগকে ধরিবার চেষ্টা করা যাইতে পারিবে ও তাহাদিগের নিকট হইতে অপরাপর ডাকাইতির মালও পাওয়া যাইতে পারে। আমাদিগের থানার এলাকায় এতগুলি ডাকাইতি হইয়া গিয়াছে তাহার একটিরও এ পর্য্যন্ত কিনারা হয় নাই বা কাহাদিগের দ্বারায় যে এই সকল ডাকাইতি হইতেছে তাহাও এ পর্যন্ত জানিতে পারা যায় নাই। যদি এবার একটু সুযোগ পাইয়াছেন, তাহা হইলে সেই সুযোগ নষ্ট আর করিবেন না। 

হেড কনেষ্টবলের কথা শুনিয়া দারোগা সাহেব তাঁহার উপর একটু রাগ ভাব প্রকাশ করিয়া কহিলেন “তোমার যদি এরূপ বুদ্ধিই না হইবে তাহা হইলে তোমার এরূপ অবস্থা ঘটিবে কেন? তোমার বুদ্ধির দোষেই মরিবার সময় পৰ্য্যন্ত তোমাকে হেড কনেষ্টবলি করিতে হইবে। ইহাতেও কি তোমার কিছুমাত্র লজ্জা নাই। 

হেড কঃ। তাহাতে আমার কিছুমাত্র দুঃখ নাই। আপনার মত দারোগাগিরি অপেক্ষা আমার হেড় কনেষ্টবলের কাৰ্য্যই ভাল। আমি যাহা বলিলাম তাহা যদি আপনি অন্যায় বিবেচনা করেন, তাহা হইলে আমি আর কোন কথা বলিব না, কেবল আপনি যাহা আদেশ করিবেন তাহাই প্রতিপালন করিব মাত্র। 

দারো। তুমি জান এই ব্যক্তি কি অপরাধ করিয়াছে? 

হেড কঃ। জানি। 

দারো। কি অপরধ করিয়াছে? 

হেড কঃ। আমর বিবেচনায় ইনি কোন অপরাধ করেন নাই। ডাকাইত দলকে হত ও আহত করিয়া খুব ভাল কার্য্যই করিয়াছেন, সরকার বাহাদুর যদি ইহার ঠিক অবস্থা জানিতে পারেন, তাহা হইলে ইহাদিগকে উত্তমরূপ পারিতোষিক প্রদান করিবেন। 

দারো। হত্যা করিলে লোকে যেরূপ পারিতোষিক পাইয়া থাকে ইহারাও সেইরূপ পারিতোষিক পাইবে।

হেড কঃ। ইহাদিগকেও সেইরূপ পারিতোষিক প্রদান করিবেন। 

এই বলিয়া সেই হেড কনেষ্টবল একটু দূরে গিয়া উপবেশন করিল। 

দারোগা সাহেব তাহাকে দূরে গিয়া উপবেশন করিতে দেখিয়া কহিলেন “তুমি কি বিশেষ ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছ যে দূরে গিয়া উপবেশন করিলে? 

হেড কঃ। আমি কোন কার্য্যের আদেশ পাই নাই, যেরূপ আদেশ পাইব সেইরূপ কার্য্য করিব। যে পর্য্যন্ত কোন আদেশ না পাই সেই পৰ্য্যন্ত বসিয়া থাকিব না তো কি করিব। 

দারো। এই দুই ব্যক্তির উপর খুনি মোকদ্দমা দায়ের করিতে হইবে। 

হেড কঃ। করুন। 

দারো। উহাদিগকে গ্রেপ্তার করিতে হইবে। 

হেড কঃ। উঁহারা নিকটেই বসিয়া আছেন, গ্রেপ্তার করুন। 

দারো। আমি উহাদিগকে গ্রেপ্তার করিলাম ও উহাদিগকে তোমার পাহারায় দিলাম। 

হেড কঃ। ভালুই। 

দারো। উহাদিগকে দস্তুর মতো হেঁপাজাতে লও। 

হেড কঃ। যখন আপনি বলিলেন উহাদিগকে গ্রেপ্তার করিয়া আমার জিম্বায় দিলেন, তখন ইঁহাদিগকে হেঁপাজাতে রাখা হইয়াছে। ইঁহারা যখন আমার জিম্বায় আছেন, আমি যেরূপ বিবেচনা করিব ইঁহাদিগকে রাখিয়া দিব; বাঁধিয়া রাখিতে হয়, বদ্ধ করিয়া রাখিতে হয় বা যেরূপেই রাখিতে হয়, আমার বিবেচনামত আমি সেইরূপই করিব। আমার পাহারা হইতে ইঁহারা পলায়ন করেন, তাহা হইলে এখন আমিই তাহার জন্য দায়ী। সে সম্বন্ধে আপনাকে আর কিছুই দেখিতে হইবে না আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। 

এই বলিয়া সেই হেড কনেষ্টবল যেস্থানে বসিয়া ছিলেন, সেই স্থান হইতে উঠিয়া উহাদিগের নিকট গিয়া উপবেশন করিলেন, ও দারোগা সাহেবকে কহিলেন “আপনি যে এখন কি কার্য্য করিতেছেন তাহা বুঝিতে পারিতেছেন না, কিন্তু পরিশেষে ইহার ফলভোগ করিবেন।” 

দারো। আমি তোমার নিকট আইন শিক্ষা করিতে এখানে আসি নাই। 

হেড কঃ। তাহা আমি বলিতেছি না। 

দারো। তবে কি বলিতেছ? 

হেড কঃ। আপনি যাঁহাদিগকে গ্রেপ্তার করিয়া কয়েদ করিলেন, তাঁহাদিগের কোন পরিচয় লইয়াছেন কি?

দারো। উহারা জমীদারের গোমস্তা। 

হেড কঃ। তাহা আমার বোধ হয় না। 

দারো। তোমার কি বোধ হয়? 

হেড কঃ। আমার বোধ হয় ইহারা কোন রাজ কর্মচারী হইবেন। বোধ হয় আপনার অপেক্ষা উচ্চপদস্থ কৰ্ম্মচারী।

দারো। ইহা তোমার কিরূপে বোধ হইতেছে? 

হেড কঃ। উচ্চপদস্থ রাজ কর্ম্মচারী না হইলে এরূপ ভাবে সাহসের উপর নির্ভর করিয়া ডাকাইত দলের মধ্যে প্রবেশ করিতে বা তাহাদিগকে গুলি করিতে অপর কাহারও সাহসে কুলায় না। বিশেষ উনি আপনাকে যে কয়েকটি কথা বলিয়াছেন তাহা উচ্চপদস্থ কর্ম্মচারীর মুখ ভিন্ন কখনই বহির্গত হইতে পারে না। 

দারো। আমি তোমার ন্যায় ভয় পাইবার লোক নহি, তুমি আমার আদেশ প্রতিপালন করিবে কি না? 

হেড কঃ। আদেশ প্রতিপালন করিয়াছি ও করিব। 

দারো। যদি তুমি আমার আদেশ প্রতিপালন করিতে তাহা হইলে তুমি ইহাদিগকে ঠিকমত হেঁপাজাতে লইতে।

হেড কঃ। আমি ত বলিয়াছি যে আমি ইঁহাদিগকে হেঁপাজাতে লইয়াছি। ইঁহারা আমার হস্ত হইতে পলাইয়া যায় তাহার জন্য আমিই দায়ী। এখানে হাতকড়ি নাই যে আমি ইঁহাদিগের হাতে হাতকড়ি লাগাইয়া দিব বা হাজতগৃহ নাই যে আমি তাহার ভিতর ইঁহাদিগকে বদ্ধ করিয়া রাখিব? 

দারো। এখানে একটু দড়ীও পাওয়া যাবে না যে তুমি উহাদিগকে বাঁধিয়া রাখিতে পার না? 

হেড কঃ। ইঁহারা ভদ্রলোক, ইঁহারা পলাইবার লোক নহেন। যদি পলায়ন করাই ইহাদিগের ইচ্ছা ছিল তাহা হইলে আপনার আসিবার পূর্ব্বেই ইঁহারা পলায়ন করিতেন। 

দারো। তোমাকে লইয়া কার্য্য করা আমার পোষাইবে না, তুমি এখান হইতে এখনই চলিয়া যও। গোফুর খাঁ কনেষ্টবল তুমি ইহাদিগকে দস্তুর মত পাহারায় লও। 

দারোগা সাহেবের কথা শুনিয়া সেই হেড কনেষ্টবল আর কোন কথা না বলিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। তাঁহাকে চলিয়া যাইতে দেখিয়া দারোগা সাহেব তাঁহাকে পুনরায় ডাকিলেন, কিন্তু সেই হেড কনেষ্টবল আর ফিরিলেন না। গোফুর খাঁ কনেষ্টবল আসিয়া সেই কৰ্ম্মচারী ও তাঁহার অনুচরকে নিজ জিম্বায় গ্রহণ করিয়া, একগাছি দড়ীর দ্বারা তাঁহাদিগকে উত্তমরূপে বন্ধন পূৰ্ব্বক সেই স্থান হইতে লইয়া গেল। কৰ্ম্মচারীও তাঁহার অনুচর কোনরূপ আপত্য না করিয়া অম্লান বদনে সমস্তই সহ্য করিলেন। 

দারোগা সাহেবের এইরূপ ব্যবহার দেখিয়া গ্রামের যে সকল লোক সেই স্থানে উপস্থিত ছিল, তাহারা নিতান্ত মন্মাহত হইয়া, সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। বেনিয়াও সেই স্থান হইতে গাত্রোত্থান করিয়া ধীরে ধীরে আপনার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। দারোগা সাহেব, তাঁহার কয়েকজন কনেষ্টবল, সেই কৰ্ম্মচারী ও তাঁহার অনুচর এবং গ্রামের ছোট ছোট কতকগুলি বালক বালিকা সেই স্থানে রহিল। 

দারোগা সাহেব ওই রিভলভারটি পাইবার জন্য অতিশয় ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন, কিন্তু উহা যে কোথায় আছে তাহা তিনি এ পর্যন্ত জানিতেন না, সুতরাং বেনিয়ার বাড়ী অনুসন্ধান করিয়া দেখিবার নিমিত্ত তিনি প্রস্তুত হইলেন। খানাতল্লাসি করিবার সময় সাক্ষীর প্রয়োজন হয়, সুতরাং সেই কার্য্যের নিমিত্ত তিনি গ্রামের লোকদিগকে ডাকাইতে লাগিলেন, কিন্তু কোন ব্যক্তি তাঁহার নিকট আসিল না, তখন তিনি অতিশয় রাগান্বিত হইয়া কনেষ্টবলগণকে আদেশ প্রদান করিলেন যে, গ্রামের মধ্যে যে কোন পুরুষ মানুষকে তাহারা দেখিতে পাইবে, তাহাদিগকে ধরিয়া তাঁহার নিকট আনয়ন কর। 

গোফুর খাঁ ব্যতীত সকলেই দারোগা সাহেবের আদেশ প্রতিপালনের নিমিত্ত সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল, কিন্তু দুই তিন ঘণ্টার মধ্যে আর কেহই সেই স্থানে প্রত্যাগমন করিল না। 

সেই সময় দারোগা সাহেব সেই কৰ্ম্মচারীকে জিজ্ঞাসা করিলেন “তোমার নাম কি?” 

কৰ্ম্ম। আমি আপনাকে কোন কথা বলিতে পারিব না। 

দারো। তুমি জান যে আমার কথার তুমি উত্তর দিতে বাধ্য। 

কৰ্ম্ম। আমি আসামী। আমি আপনার কোন কথার উত্তর দিতে বাধ্য নহি? 

দারো। তোমার রিভলভার কোথায়? 

কৰ্ম্ম। আমি আপনাকে তাহা বলিতে চাহি না। 

দারো। তোমাদিগের অদৃষ্টে বিস্তর দুঃখ আছে। 

কৰ্ম্ম। অদৃষ্টের দুঃখ যাহা আছে, তাহা হইবেই, তাহা খণ্ডন করিতে কে পারে। 

কর্মচারীর এই কথা শুনিয়া দারোগা সাহেব তাঁহার কনেষ্টবলগণের প্রত্যাগমনের প্রত্যাশায় সেই স্থানে বসিয়া রহিলেন। প্রায় তিন ঘণ্টা কাল অতিবাহিত হইয়া গেল, কেহই ফিরিয়া আসিল না, সেই বেনিয়াও আর বাড়ী হইতে বহির্গত হইল না, তাহাকে বার বার ডাকায় বাড়ীর ভিতর হইতে স্ত্রীলোকগণ কহিল “তিনি বাড়ীতে নাই, বাড়ী হইতে বাহির হইয়া গিয়াছেন।” 

এরূপ অবস্থায় কি কৰ্ত্তব্য তাহার কিছুই দারোগা সাহেব স্থির করিতে না পারিয়া বাহিরের ঘরগুলির ভিতর তিনি নিজেই দেখিতে লাগিলেন। যে ঘরে কর্ম্মচারী সেই রাত্রিতে অবস্থিত করিয়াছিলেন সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া তিনি সেই কর্ম্মচারীর ব্যাগ প্রভৃতি যাহা কিছু ছিল তাহা দেখিতে পাইলেন, উহা বাহিরে আনিয়া ব্যাগ খুলিয়া তাহার মধ্যে কি আছে, তাহা দেখিতে আরম্ভ করিলেন। যখন তিনি ওই ব্যাগ দেখিতে নিযুক্ত সেই সময় দারোগা সাহেবের ঊর্দ্ধতন কৰ্ম্মচারী-ডিবিজনের ইনস্পেক্‌টার সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি যে হঠাৎ কেন সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, তাহার কিছুই দারোগা সাহেব সেই সময় বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না। কারণ এই ঘটনার সংবাদ এ পর্যন্ত তিনি তাঁহার কোন ঊর্দ্ধতন কর্ম্মচারীর নিকট প্রদান করেন নাই। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

দারোগা সাহেবের নিকট হইতে বিদায় লইয়া হেডকনেষ্টবল তাঁহার থানার দিকে গমন করিবার কালীন, পথিমধ্যে ডিবিজানের ইনস্পেক্‌টারের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয়। ইনস্পেক্টার সেই সময় অপর কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে সেইদিক দিয়া অন্য স্থানে গমন করিতেছিলেন। হেড কনেষ্টবল তাঁহাকে দেখিয়াই তাঁহার নিকট গমন করিলেন ও যেস্থানে যেরূপ ভাবে ডাকাইতি করিতে আসিয়া ডাকাইতগণ, দুইজন ভদ্রলোক কর্তৃক পরাজিত হয় ও যেরূপে তাহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ হত ও আহত হয় তাহার সমস্ত অবস্থা তাহাকে কহিলেন। আহত ডাকাইতগণ যেরূপ ভাবে এখন পর্যন্ত পড়িয়া রহিয়াছে, ও যেরূপ ভাবে দারোগা সাহেব সেই দুইজন ভদ্রলোককে লইয়া পীড়াপীড়ি করিতেছেন, তাহার সমস্ত অবস্থা তিনি তাঁহাকে কহিলেন। হেড কনেষ্টবলের কথা শুনিয়া ইনস্পেক্‌টার সাহেব তাঁহাকে সঙ্গে লইয়া সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। 

ইনস্পেক্‌টার সাহেবও পশ্চিম দেশীয় একজন মুসলমান, তিনি বহুদিবস হইতে পুলিস বিভাগে কর্ম্ম করিতেছেন, সামান্য কনেষ্টবলের কার্য্যে প্রথমতঃ নিযুক্ত হইয়া নিজের বুদ্ধি ও কার্য্যে তৎপরতার গুণে ক্রমে ক্রমে তিনি উন্নত পদে আরোহণ করিয়াছেন ও গত পাঁচ বৎসর হইতে তিনি ডিবিজনের ইনস্পেক্টারের কাৰ্য্যে নিযুক্ত আছেন। 

হঠাৎ ইনস্পেক্‌টার সাহেবকে সেই স্থানে উপস্থিত হইতে দেখিয়া দারোগা সাহেব অতিশয় বিস্মিত হইলেন। ইনস্পেক্‌টার সাহেব তাঁহাকে দেখিয়া কহিলেন “আমি শুনিয়াছি এই বাড়ীতে ডাকাইতি করিতে আসিয়া কতকগুলি লোক হত ও আহত হইয়াছে, তাহারা কোথায়?” 

উত্তরে দারোগা সাহেব কহিলেন “তাহারা বাহিরে আছে এই বলিয়া তিনি ইনস্পেক্টরের সঙ্গে সেই দিকে গমন করিলেন। যেস্থানে ওই সকল আহত ব্যক্তি পড়িয়াছিল সেই স্থানে গিয়া দেখিলেন কেবলমাত্র দুইজন ভিন্ন আর কেহই নাই, তাহাদিগের উপর কোন পাহারা নাই বা গ্রামের লোকজনও কেহ সেই স্থানে নাই। উহাদিগের নিকট গিয়া দেখিলেন এক ব্যক্তির জীবন বায়ু বহির্গত হইয়াছে আর একজন অজ্ঞান অবস্থায় সেই স্থান পড়িয়া আছে। উহাদিগের এই অবস্থা দেখিয়া ইনস্পেক্টার সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনি যখন এই স্থানে আসিয়া ছিলেন সেই সময় এই ব্যক্তি জীবিত ছিল কি না?”

দারো। জীবিত ছিল কিন্তু সেই সময় উহার প্রায় শেষ অবস্থা হইয়া আসিয়াছিল। 

ইনস। ইহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিল কি? 

দারো। জিজ্ঞাস করিয়াছিলাম কিন্তু সেই সময় তাহার কোন কথার উত্তর প্রদান করিবার ক্ষমতা ছিল না। ইনস। এই ব্যক্তি কি বলিয়াছিল। 

দারো। ইহাকে জিজ্ঞাস করিবার সময় আমি এ পর্য্যন্ত পাই নাই। 

ইনস। আমি শুনিয়াছি তিন ব্যক্তি আহত হইয়া ধৃত হইয়াছিল আর এক ব্যক্তি কই? 

দারো। তাহাকে তো দেখিতে পাইতেছি না। 

ইনস। উহাদিগের উপর কাহারও পাহারা নাই কেন? 

দারো। ইহাদিগের উপর আমার হেড কনেষ্টবলের পাহারা দিয়াছিলাম কিন্তু কই কাহাকে এখানে দেখিতে পাইতেছি না। 

হেডকনেষ্টবল যে ইনস্পেক্‌টারের সহিত ফিরিয়া আসিয়াছিল তাহা দারোগা সাহেব জানিতেন না। সে একটু দূরে ছিল দারোগা সাহেবের কথা শুনিয়া সে সম্মুখে আসিল ও কহিল আপনি উপরিতন কর্মচারীর নিকট মিথ্যা কথা কহিবেন না। আপনি কিরূপে বলিলেন যে উহাদিগের উপর আমার পাহারা ছিল। যে কারণে আপনি আমাকে এই স্থান হইতে তাড়াইয়া দিয়াছিলেন, তাহা বলিতেছেন না কেন? 

ইনস। যে ব্যক্তি হত হইয়াছে, তাহার মৃতদেহ কোথায়? 

দারো। আমি এখন পর্য্যন্ত সেই স্থানে যাইবার সময় পাই নাই। 

ইনস্। প্রায় ছয়ঘণ্টা হইল তুমি ঘটনাস্থলে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছ, ইহার মধ্যে যে সকল নিতান্ত আবশ্যকীয় বিষয় অগ্রে দেখা কত্তব্য, তাহাই দেখিবার তোমার এ পর্যন্ত সময় হয় নাই! তুমি যে হত্যাকারীদ্বয়কে ধৃত করিয়াছ শুনিয়াছি সেই হত্যাকারীদ্বয় কোথায়, চল দেখি তাহাদিগকে একবার দেখিয়া আসি। 

এই বলিয়া ইনস্পেক্‌টার সাহেব দারোগা সাহেবের সহিত সেই ধৃত আসামীদ্বয়কে দেখিবার নিমিত্ত গমন করিলেন। দেখিলেন একজন কনেষ্টবল উহাদিগকে উত্তমরূপে বাধিয়া রাখিয়া দিয়াছে। তাঁহাদিগকে দেখিবামাত্র ইনস্পেক্‌টার সেই কৰ্ম্মচারীকে চিনিতে পারিলেন। কোন সরকারী কার্য্য উপলক্ষে একবার তাঁহাকে কলিকাতায় আসিতে হইয়াছিল, ও ওই কর্ম্মচারীর সাহায্যে তিনি তাঁহার সেই কার্য্য উদ্ধার করিতে সমর্থ হন। ওই কর্মচারীকে দেখিয়া তিনি দারোগা সাহেবকে কহিলেন “ইনিই তোমার হত্যাকারী আসামী। তুমি জান যে ইনি আমা অপেক্ষাও উচ্চপদস্থ পুলিস-কৰ্ম্মচারী। ইনি হত্যাকারী নহেন, ইনি ইঁহার কর্তব্য কার্য্য করিয়াছেন, আর তুমি যে কার্য্য করিয়াছ তাহার নিমিত্ত তোমার জেলে যাওয়া কৰ্ত্তব্য।” এই বলিয়া তিনি স্বহস্তে তাঁহাদিগের বন্ধন মোচন করিয়া দিলেন, ও সেই কনেষ্টবলকে কহিলেন “তুমি ইঁহাদিগকে এরূপ ভাবে বন্ধন করিয়া রাখিয়াছ কেন?” 

উত্তরে সেই কনেষ্টবল কহিল “আমি কোন অন্যায় কার্য্য করি নাই, দারোগা সাহেবের আদেশ প্রতিপালন করিয়াছি মাত্র।” 

কনেষ্টবলের কথা শুনিয়া দারোগা সাহেব কহিলেন “আমি ইঁহাদিগকে বাঁধিয়া রাখিতে আদেশ করি নাই, আমি কেবল ইঁহাদিগের উপর নজর রাখিতে কহিয়াছি।” 

দারোগা সাহেবের কথা শুনিয়া সেই কনেষ্টবল অতিশয় রাগভরে কহিল “যাঁহাদের আদেশ আমাদিগকে সৰ্ব্বদা প্রতিপালন করিতে হয়, তাঁহার যদি এরূপ মিথ্যা কথা কহেন তাহা হইলে, আমরা কোনরূপেই কার্য্য করিতে পারি না। জমাদার সাহেব ইঁহার কথামত ইঁহাদিগকে বন্ধন করেন নাই বলিয়াই, তিনি এই স্থান হইতে তাড়িত হন। তাহার পরে আমার উপর যেরূপ আদেশ প্রদত্ত হয় আমি তাহাই প্রতিপালন করি। আমি মিথ্যা কথা কহিতেছি কি দারোগা সাহেব মিথ্যা কথা কহিতেছেন তাহা জমাদার সাহেবকে ও এই আসামীদ্বয়কে জিজ্ঞাসা করিলেই আপনি ঠিক জানিতে পারিবেন।” 

ইনস্পেক্‌টার সাহেব এই সমস্ত অবস্থা দেখিয়া দারোগা সাহেবের উপর অতিশয় অসন্তুষ্ট হইলেন, কিন্তু তিনি তাঁহাকে প্রকাশরূপে আর কোন কথা না বলিয়া এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের ভার নিজেই গ্রহণ করিলেন। 

এই ঘটনার অবস্থা সংক্ষেপে লিখয়া একখানি পত্র তাঁহার ঊর্দ্ধতন ইংরাজ কৰ্ম্মচারীর নিকট, একজন কনেষ্টবলের দ্বারা প্রেরণ করিলেন। তাঁহাকে ঘটনাস্থলে একবার আসিবার নিমিত্ত বিশেষরূপে অনুরোধও করিলেন। কনেষ্টবল একটি দ্রুতগামী অশ্বে আরোহণ করিয়া ওই পত্র লইয়া গমন করিল। 

ইনস্পেক্‌টার সাহেব অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াই কয়েকজন কাহার ও একখানি ডুলির যোগাড় করিয়া, ডাকাইতদিগের মধ্যে যে ব্যক্তি এখনও মরে নাই অথচ মৃত্যুমুখে শয়ন করিয়াছে তাহাকে একজন কনেষ্টবলের জিম্বায় সদরের হাসপাতালে পাঠাইয়া দিলেন। ওই কনেষ্টবলের উপর আদেশ থাকিল ওই ব্যক্তি মরুক বা বাঁচুক দ্বিতীয় আদেশ পর্যন্ত সে যেন উহার পাহারায় নিযুক্ত থাকে। 

ইনস্পেক্টার সাহেব অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইবামাত্র গ্রামের লোক সকল ক্রমে আসিয়া তাঁহার নিকট উপস্থিত হইতে লাগিল। তিনি তাহাদিগকে মিষ্ট কথায় তুষ্ট করিয়া যে আহত ডাকাইতটি পলায়ন করিয়াছিল তাহার অনুসন্ধান করিতে কহিলেন, নিজেই সেই কর্ম্মচারী ও তাঁহার অনুচরকে সঙ্গে লইয়া তাহার অনুসন্ধানে বাহির হইলেন, কিন্তু তাহাদিগের সেই স্থান হইতে অধিক দূরে গমন করিতে হইল না। গ্রামের একজন লোক আসিয়া সংবাদ প্রদান করিল যে, যে আহত ব্যক্তি এই স্থান হইতে প্রস্থান করিয়াছিল সে নিকটবর্ত্তী একটি জঙ্গলের মধ্যে লুকাইয়াছিল; গ্রামের লোকেরা তাহাকে সেই স্থানে ধরিয়াছে ও আপনার নিকট আনিতেছে। 

দেখিতে দেখিতে গ্রামের কয়েকজন লোক সেই আহত ডাকাইতকে আনিয়া সেই স্থানে উপস্থিত করিল। 

ইনস্পেক্‌টার সাহেব দেখিলেন তাহারও অবস্থা এখন ভাল নহে, তাহার বাঁচিবার আশাও কম। তাহাকে তিনি দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিলেন কিন্তু তাহার নিকট হইতে বিশেষ কিছুই জানিতে পারিলেন না। সে সমস্ত কথার উত্তর প্রদান করিল কিন্তু সেই সময় তাহার কথায় এরূপ জড়তা হইয়া গিয়াছিল যে তাহার কোন কথা ভাল রূপ বুঝিয়া উঠিতে পারা গেল না। 

একখানি ডুলি ও কয়েকজন কাহারের দ্বারা একজন কনেষ্টবলের জিম্বায় তিনি সেই আহত ডাকাইতকেও হাসপাতালে পাঠাইয়া দিলেন। যে দুইটি ডাকাইত হত হইয়াছিল তাহাদিগের মৃতদেহ এক স্থানে রাখিয়া গ্রামস্থ সমস্ত লোককে দেখাইলেন কিন্তু কেহই উহাদিগকে চিনিতে পারিল না। 

সেই মৃতদেহ সম্বন্ধে সেই সময়ের পর আবশ্যকীয় বিষয় সকল যাহা কৰ্ত্তব্য, তাহা সমাপন করিয়া ওই মৃতদেহ দুইটি একজন কনেষ্টবলের জিম্বায় সদরের ডাক্তারের দ্বারা পরীক্ষিত হইবার নিমিত্ত সদরে পাঠাইয়া দিলেন। 

এইরূপে সেই সময়ের আবশ্যকীয় কার্য্য সকল সমাপন করিয়া তিনি সেই কর্ম্মচারীর সাহায্যে, ওই ডাকাইতি যে সকল লোকের দ্বারা হইয়াছিল তাহাদিগের যদি কোনরূপ সন্ধান করিতে পারেন, তাহার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিরূপ অবস্থায় সেই কৰ্ম্মচারীদ্বয় সেই স্থানে আগমন করিয়াছিলেন, কিরূপ অবস্থায় তাঁহারা ডাকাইতদিগের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইয়া তাহাদিগকে ডাকাইতি করিতে নিবৃত্তি করেন ও কিরূপে তিনি তিনজনকে আহত ও একজনকে হত করেন, তাহার আনুপূর্বিক অবস্থা তিনি সেই কর্ম্মচারীদ্বয়ের নিকট হইতে অবগত হইয়া তাঁহাদিগের সাহসের বিশেষ প্রশংসা করিলেন ও দারোগা সাহেব তাঁহাদিগের উপর যেরূপ ব্যবহার করিয়াছিলেন, তাহার নিমিত্ত বিশেষরূপে দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। দারোগা সাহেবের এখন কোন কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিবার ক্ষমতা না থাকিলেও তিনি সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন। 

ইনস্পেক্টার সাহেব দারোগা সাহেবকে কহিলেন “আপনি যদি বৃথা ছয় ঘণ্টা সময় নষ্ট না করিয়া নিজের কার্য্য করিতেন তাহা হইলে ওই জখমিগণের নিকট হইতে ডাকাইতগণের নাম ও বাসস্থান অবগত হইতে পারিতেন, কিন্তু তাহা দূরে থাকুক, সময় থাকিতে আপনি তাহাদিগের নিজের নাম ও বাসস্থান পৰ্য্যন্ত জানিয়া লন নাই। এখন বলুন দেখি কিরূপ উপায়ে এখন উহা জানা যাইতে পারে?” 

দারো। আমি সময় পাই নাই বলিয়া ওই সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারি নাই। 

ইঃপঃ। যে আহত ডাকাইত এই স্থান হইতে পলায়ন করিয়াছিল তাহাকে যদি পুনরায় পাওয়া না যাইত তাহা হইলে কি হইত বলুন দেখি? 

দারো। তাহা হইলে আমাদিগকে বিপদে পড়িতে হইত। 

ইঃপেঃ। এখনও যে কোনরূপ বিপদে পড়িতে হইবে না তাহাই বা কে বলিতে পারে। 

এই বলিয়া ইনস্পেক্‌টার সাহেব দারোগা সাহেবকে তাঁহার নিকট আসিতে নিষেধ করিয়া সেই কৰ্ম্মচারী ও তাঁহার অনুচরকে সঙ্গে লইয়া বাড়ীর বাহির হইয়া গেলেন ও একটি নিভৃতস্থানে উপবেশন করিয়া কি উপায় অবলম্বনে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করা যায়, ও কিরূপ উপায়েই বা ডাকাইতগণকে ধরিতে পারা যায়, তাহার পরামর্শ করিতে লাগিলেন। 

কৰ্ম্ম। উপায় ছিল, কিন্তু যখন আমরা খুনি মোকদ্দমার আসামী হইয়া ধৃত হইয়াছি তখন আর কোন উপায় নাই, কারণ এখন আপনারা আমাদিগের নিকট কোনরূপ সাহায্য পাইতে পারেন না। আমরা এখন খুনি মোকদ্দমার আসামী, এখন আপন আপন প্রাণ রক্ষা করিবার চেষ্টা দেখিব না আপনাদিগের সাহায্য করিব? 

ইঃপেঃ। দারোগা সাহেবের ব্যবহারের কথা ভুলিয়া যান, তিনি যেরূপ কার্য্য করিয়াছেন আশা করি যে, তিনি তাহার উপযুক্ত সাজা পাইবেন। 

কৰ্ম্ম। তাঁহার ব্যবহার সম্বন্ধে আমি কোন কথা মনে করিতেছি না, কিন্তু যখন আমি একবার ধৃত হইয়া আবদ্ধ হইয়াছি, তখন আমাকে ছাড়িয়া দেওয়ার ক্ষমতা আপনার নাই, আপনার ঊর্দ্ধতন কর্মচারীরও নাই, সে ক্ষমতা আছে কেবল মাজিষ্ট্রেট সাহেবের, তিনি যদি আমাকে এই মোকদ্দমা হইতে অব্যাহতি দেন, ও আমাকে আপনার সাহায্য করিতে আদেশ করেন, তখন দেখিব এই ডাকাইত দলের সমস্ত লোক ধৃত হয় কি না। যখন আমার সম্মুখে ডাকাইতি হইয়াছে, যখন আমা কর্তৃক উহাদিগের দলের কেহ হত ও কেহ কেহ বা আহত হইয়াছে, তখন আমি আপনার দারোগা সাহেবের ন্যায় চুপ করিয়া বসিয়া থাকি নাই, আমার বুদ্ধিতে যেটুকু আসিয়াছে সেটুকু আমি করিয়া রাখিয়াছি। তদ্ব্যতীত আমার বারটি গুলি ক্ষয় হইয়াছে, তাহার মধ্যে কেবল চারিটি মাত্র গুলির কার্য্য দেখিতে পাইতেছি, কিন্তু আমার বিশ্বাস অনুসন্ধান করিলে আরও দুই চারিজন আমার গুলিতে হত বা আহত পাওয়া যাইতে পারে। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

দুইজন প্রধান পুলিস-কর্মচারীর মধ্যে যখন এইরূপ কথা হইতেছিল সেই সময় সন্ধ্যা অতীত হইয়া গিয়াছিল। সেই সময় একজন কনেষ্টবল দ্রুতপদে তাঁহাদিগের নিকট আগমন করিয়া সংবাদ দিল যে, পুলিস সাহেব আসিয়াছেন, এই সংবাদ পাইবামাত্র তাঁহারা সেই স্থান হইতে গাত্রোত্থান করিয়া সেই প্রধান ইংরাজ পুলিস-কর্ম্মচারীর নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন। 

ইনস্পেক্‌টার সাহেব সেই স্থানের সমস্ত অবস্থা তাঁহাকে দেখাইলেন, ও এ পর্য্যন্ত যাহা যাহা ঘটিয়াছিল তাহার সমস্ত বিষয় একে একে তাঁহার নিকট বিবৃত করিলেন। ডিটেকটিভ কর্মচারীর পরিচয় প্রদান করিয়া দারোগা সাহেব তাঁহার সহিত যেরূপ ব্যবহার করিয়াছিলেন এবং যেরূপ তাচ্ছিল্যতার সহিত এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান আরম্ভ করিয়াছিলেন তাহার সমস্ত তাঁহাকে কহিলেন ও ওই ডাকাইত দলগুলির অনুসন্ধান করিয়া তাহাদিগকে ধৃত করা সম্বন্ধে সেই কৰ্ম্মচারী তাঁহাকে যাহা বলিয়াছিলেন, তাহাও তাঁহাকে কহিলেন। স্থূল কথায় যাহা কিছু এ পৰ্য্যন্ত ইনস্পেক্টার সাহেব অবগত হইয়াছিলেন তাহার সমস্তই তিনি সেই ইংরাজ কৰ্ম্মচারীকে কহিলেন। ইংরাজ কৰ্ম্মচারী সমস্ত বিষয় শুনিয়া সেই কৰ্ম্মচারীকে নিজের নিকট ডাকিয়া তাঁহার সাহস ও উপস্থিত বুদ্ধির নিমিত্ত তাঁহাকে বিশেষরূপ ধন্যবাদ প্রদান করিলেন, ও পরিশেষে কহিলেন “দারোগ সাহেব নিতান্ত আহাম্মকি করিয়া যদিও আপনাকে গ্রেপ্তার করিয়াছেন তথাপি আপনাকে কোন আদালতে গমন করিতে হইবে না, সে সম্বন্ধে যাহা করিতে হয় তাহা আমি করিব। আপনার কলিকাতার প্রধান কর্ম্মচারীকে আমি সমস্ত অবস্থা লিখিয়া ও আপনাকে এই ডাকাইতি মোকদ্দমার অনুসন্ধানে আমি নিযুক্ত করিয়াছি, তাহাও লিখিয়া তাঁহার অনুমতি আনাইয়া আপনার নিকট পাঠাইয়া দিব, এবং গভর্নমেন্টও যাহাতে আপনার সাহস ও উপস্থিত বুদ্ধির বিষয় অবগত হইতে পারেন আমি তাহাও দেখিব। এখন আপনি ইনস্পেক্‌টার সাহেবকে সঙ্গে লইয়া এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করুন। আপনার যে কোনরূপ সাহায্যের আবশ্যক হইবে ইনি আপনাকে সেইরূপ সাহায্যেই প্রদান করিবেন।” কর্মচারীকে এইরূপ বলিয়া ও দারোগা সাহেবকে তাঁহার কার্য হইতে সসপেণ্ড করিয়া তিনি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। 

ইংরাজ কৰ্ম্মচারী সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার পর, ইনস্পেক্‌টার সাহেব সেই কৰ্ম্মচারীকে কহিলেন “ এখন আমাকে কি করিতে হইবে বলুন।” 

কৰ্ম্ম। কিছুই করিতে হইবে না, আমি সমস্তই ঠিক করিয়া রাখিয়াছি আপনি এক স্থানে বসিয়াই সমস্ত ঠিক করিয়া লইতে পারিবেন। 

ইনস। আপনি কিরূপ ঠিক করিয়া রাখিয়াছেন তাহা জানিতে পারি কি? 

কৰ্ম্ম। কেন পারিবেন না, আপনার দারোগা সাহেব এই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইবার পূর্ব্বেই, আমি জখমিগণের নিকট হইতে ওই মৃত ব্যক্তির নাম ও তাহার বাসস্থান, জখমিগণের নাম ও বাসস্থান, ও অপর যে সকল ব্যক্তি এই ডাকাইতি করিতে আসিয়াছিল ও যে সকল ব্যক্তি এই ডাকাইত দলভুক্ত অথচ এই ডাকাইতি করিতে আইসে নাই, তাহাদিগের প্রত্যেকের নাম ঠিকানা আমি লিখিয়া রাখিয়াছি। তদ্ভিন্ন ইতিপূর্ব্বে তাহারা যে যে গ্রামে ডাকাইতি করিয়াছে, ও যে যে স্থানে তাহারা অপহৃত অলঙ্কার প্রভৃতি বিক্রয় করিয়াছে, তাহাও আমি তাহাদিগের নিকট হইতে জানিয়া লইয়া লিখিয়া রাখিয়াছি, এখন সেই সমস্ত লোকদিগকে ধৃত ও চোরা মাল সকলের পুনরুদ্ধার করিতে পারিলেই আপনাদিগের অনেক ডাকাইতি মোকদ্দমার কিনারা হইয়া যাইবে। 

এই বলিয়া যে কাগজে এই সমস্ত তিনি লিখিয়া রাখিয়াছিলেন, সেই কাগজখানি তিনি ইনস্পেক্টারের হাতে প্রদান করিলেন, ইনস্পেক্টার সাহেব দেখিলেন, বাস্তবিকই তিনি সমস্তই ঠিক করিয়া রাখিয়াছেন, এখন একটু পরিশ্রম করিলে অনেক কার্য্য উদ্ধার হইয়া যাইবে। 

কর্ম্মচারীর সহিত পরামর্শ করিয়া ইনস্পেক্‌টার সাহেব অপরাপর থানা হইতে আর যতগুলি কৰ্ম্মচারী আনাইতে পারিলেন আনাইয়া, এক একজন ডাকাইতকে ধৃত করিবার জন্য এক একজন কর্ম্মচারীকে নিযুক্ত করিলেন, সকলেই এক সময় এক স্থান হইতে বহির্গত হইয়া নিজ নিজ কৰ্ত্তব্য কৰ্ম্ম সাধনে গমন করিলেন। বলা বাহুল্য এইরূপ উপায়ে প্রায় এক সময়ে সমস্ত ডাকাইতের দল ধৃত হইল। প্রত্যেক কর্ম্মচারী যেমন তাঁহার নির্দিষ্ট লোককে ধৃত করিলেন অমনি তাহার বাড়ী ঘর প্রভৃতির খানাতল্লাসি করিলেন ও অনেকের নিকট হইতে অনেক স্থানের ডাকাইতি মোকদ্দমার কিছু কিছু অপহৃত দ্রব্য প্রাপ্ত হইলেন। 

এইরূপ উপায়ে ক্রমে পঁচিশজন ডাকাইত ধৃত হইল, দশটি ডাকাইতি মোকদ্দমার মাল বাহির হইল। বলা বাহুল্য সেই প্রদেশে আসিবার কালীন কর্ম্মচারী যে দোকানে রাত্রির কিয়দংশ যাপন করিয়া ছিলেন ও যে দোকানে ও তাহার পার্শ্ববর্তী দোকানে ডাকাইতি হইয়াছিল তাহারও কোন কোন ডাকাইতের নিকট হইতে পাওয়া গেল। 

দারোগা সাহেব এখন জানিতে পারিলেন, কোন ব্যক্তি সেই দোকানে রাত্রির কিয়দংশ অতিবাহিত করিয়া চলিয়া গিয়াছিলেন, ও তিনি যেরূপ অনুমান করিয়া উহাদিগকে ডাকাইত দলের লোক স্থির করিয়াছিলেন এখন বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার সেই অনুমান কতদূর সত্য! 

যে সকল ডাকাইত ধৃত হইয়াছিল তাহার মধ্যে আরও তিনজন ডাকাইতকে গুলির আঘাতে আহত অবস্থায় পাওয়া যায়। 

যে দুইটি আহত ডাকাইত হাসপাতালে ছিল, তাহারা ক্রমে ভাল হইয়া উঠিল, ও সমস্ত কথা স্বীকার করিল। যে দুইটি ডাকাইত মরিয়া গিয়াছিল, তাহাদিগের গ্রামের লোক তাহাদিগকে সনাক্ত করিল। তাহারা কে, কি কার্য্য করিত তাহাও সমস্ত বাহির হইয়া পড়িল। 

ডাকাইত দলের সমস্ত লোকদিগের সম্বন্ধে বিশেষরূপ অনুসন্ধান করা হইল, উহাদিগের মধ্যে অনেকেই ডাকাইতি ও চুরি মোকদ্দমায় পূৰ্ব্বে সাজা পাইয়াছিল। 

বিচারে এই ডাকাইত দলের একজনও অব্যাহতি পাইল না, তাহাদিগের মধ্যে অনেকেই চির নির্বাসিত হইল, কেহ কেহ বা দীর্ঘকালের জন্য কারাগারে প্রেরিত হইল। 

গবর্ণমেণ্ট হইতে কর্ম্মচারী বিশেষরূপ সুখ্যাতি লাভ করিলেন এবং তাঁহার ও তাঁহার অনুচরের বেতনও বৃদ্ধি হইল। 

ইনস্পেক্টার সাহেবের পদোন্নতি হইল। 

দারোগা সাহেবকে চির দিবসের নিমিত্ত সরকারী কার্য্য হইতে অপসারিত হইতে হইল, আর সেই হেড কনেষ্টবলের পদোন্নতি হইল, তিনি সেই থানাতেই দারোগাগিরি করিয়া তিন বৎসর পরে অবসর গ্রহণ করিলেন। 

সম্পূর্ণ 

[ ভাদ্র, ১৩১৮ (?) ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *