1 of 2

নবাবগঞ্জের সমাধি

নবাবগঞ্জের সমাধি

হাওয়া বদলাতে গিয়েছিলুম হাজারিবাগে।

হাওয়া নিশ্চয়ই বদলাল, মন কিন্তু বদলাল না। বাসা পেয়েছিলুম শহরের ভেতরে। সেখানে কিছু কিছু গাছপালা থাকলে কী হয়, সেই ধুলো-ভরা রাজপথের-পর-রাজপথ, দু-ধারে বাড়ির-পর-বাড়ি, আপিস-আদালত, হাট-বাজার, পানের দোকান, মোটর, বাস, রিকশা, লোকের ভিড়, হট্টগোল। যেন কলকাতার ক্ষুদ্র সংস্করণ! কাজের খাতিরে সব করা যায়, কিন্তু শখ করে এক শহর ছেড়ে আর এক শহরে আসার মানে হয় না।

বন্ধুবর বিপিনচন্দ্র হাজারিবাগের ভক্ত। এখানে আগেও বার দুয়েক ঢুঁ মেরে গিয়েছে। বললে, ‘মা ভৈঃ! এখনি হাল ছাড়বার দরকার নেই। বৈকালে আমার সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়ো।’

‘ধুলো ভক্ষণের জন্যে?’

‘উঁহু।’

‘তবে?’

‘সত্যিকার হাজারিবাগ দেখবার জন্যে।’

‘দশ-বারো মাইল পথ হাঁটলে অনেক কিছুই দেখতে পাওয়া যাবে জানি। কিন্তু আমি অতখানি কষ্ট স্বীকার করতে রাজি নই।’

‘মাইল তিন হাঁটতে পারবে?’

‘খুব পারব। সে তো কলকাতার এ-পাড়া ও-পাড়া!’

‘তবে প্রস্তুত থেকো। আমি ঠিক সময়ে আসব।’

বৈকালে বিপিনের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লুম। সে মিথ্যা বলেনি। মাইল খানেক অগ্রসর হওয়ার পরেই দৃশ্য পরিবর্তন আরম্ভ হল। তারপর যত এগুই তত বেশি মুগ্ধ হয়ে যাই।

আরও কিছুদূর পদচালনা করে দাঁড়িয়ে পড়ে বিপিন প্রশ্ন করলে, ‘এখন কেমন লাগছে?’

‘চমৎকার! অপূর্ব!’

অভিভূত না-হয়ে উপায় নেই। দিকে দিকে নতোন্নত প্রান্তর, তার ওপর দিয়ে কোথায় হারিয়ে যায় বিহ্বল দৃষ্টি। মাঝে মাঝে সৌন্দর্য সৃষ্টি করছে অরণ্যের শ্যামল ছন্দ। কল্পনার রহস্যবিচিত্র দুর্গের মতো দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের-পর-পাহাড়। অনাদৃত নীলাকাশের সমগ্রতা এসে প্রবেশ করে দুই নয়নের অন্তঃপুরে। যেন ছবির জগৎ।

একখানা বড়ো পাথরের ওপরে বসে পড়ে বললুম, ‘হ্যাঁ, এই হচ্ছে সত্যিকার হাজারিবাগ! আজ প্রতিপদ। অন্ধকারের ভয় নেই, এইখানে কিছুক্ষণ বসে থাকলে ক্ষতি হবে না।’

‘ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।’

‘মানে?’

‘এটা হচ্ছে আষাঢ় মাস। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ।’

তাকিয়ে দেখলুম। আকাশের এক প্রান্ত জুড়ে দেখা যাচ্ছে কাজলকালো মেঘ।

বিপিন বললে, ‘কালো মেঘ। ওর সাথী বোধ হয় ঝড়।’

‘মেঘ তো এখনও অনেক দূরে!’

‘আমাদের বাসাও তো পাশে নয়। আর একদিন এখান এলে চলবে। আজ উঠে পড়ো।’

বিপিনের অনুমান ঠিক। খুব তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে আমরা যখন শহরের প্রান্তে এসে পড়লুম, প্রায় গোটা আকাশটাই তখন মেঘাচ্ছন্ন এবং গাছে গাছে ঝোড়ো হাওয়ার একটানা চিৎকার। গায়ে পড়ল জলের কয়েকটা বড়ো বড়ো ফোঁটা। বাসা তখনও বেশ খানিকটা দূরে।

কিন্তু বৃষ্টিকে বোধ হয় ফাঁকি দিতে পারবে না— জলের ফোঁটা বেড়ে উঠল।

হঠাৎ মোড় ফিরে একটা গলির ভিতরে ঢুকে বিপিন ছুটতে ছুটতে বললে, ‘এদিকে এসো।’

একটা প্রশস্ত, জীর্ণ দ্বারপথের পর খানিকটা জঙ্গলময় জমি। আলো-আঁধারের মধ্যে দেখা গেল, চারদিকে কতকগুলো দোদুল্যমান বড়ো বড়ো গাছ এবং তাদেরই মাঝখানে সার-গাঁথা খিলানওয়ালা বাড়ি এবং তারই ওপরে মস্ত একটা সুডৌল গম্বুজ।

ভাঙা সিঁড়ির ধাপ। একটা খিলানের তলা দিয়ে দালানে গিয়ে উঠলুম।

শুধালুম, ‘কী এটা? মসজিদ নাকি? শেষটা বিপদে পড়ব না তো?’

‘ভয় নেই। এ হচ্ছে নবাবগঞ্জের সমাধি ভবন। কার সমাধি জানি না, কিন্তু এখানে কেউ থাকে না।’

কৌতূহলী হয়ে টর্চের এবং তখনও যেটুকু দিনের আলোর আভাস ছিল তার সাহায্যে দেখলুম, এ হচ্ছে বহুকালের প্রাচীন সমাধিপুরী। মলিন দেওয়ালগুলো যত্নের অভাবে কালের অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত হলেও এখনও এখানে-ওখানে রয়েছে সূক্ষ্ম ও সুন্দর নক্সার চিহ্ন। প্রচুর অর্থব্যয় করে সব দিকের মাপজোক ও ছন্দ বজায় রেখে শ্রেষ্ঠ কারিগর দিয়ে যে এই সমাধি মন্দির গড়ানো হয়েছে, সে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই। আর এ-সমাধি যে কোনো নবাব বা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির, তাও আন্দাজ করা কঠিন নয়।

দালানের পরে দেওয়ালের গায়ে একটা কুলুপ দেওয়া দরজা— মূল সমাধিকক্ষের ভিতরে যাওয়ার পথ। চারধারে বোধকরি জাফরি-কাটা শ্বেতপাথরেরই পর্দা বা জানালা। পর্দায় জাফরির ছিদ্রগুলো কে বা কারা কাদামাটি দিয়ে বন্ধ করবার চেষ্টা করেছে, যেন বাইরের কৌতূহলী চক্ষুকে বাধা দেওয়ার জন্যেই।

কোনো কোনো পর্দার ওপর থেকে কাদামাটির প্রলেপ আবার খসে পড়েছে। একটা পর্দার ছিদ্রের ওপরে টর্চ রেখে ভেতরে দৃষ্টি চালনা করলুম। ভালো করে দেখতে না পেলেও খানিকটা আন্দাজ করতে পারলুম।

মাঝারি আকারের ঘর। মাঝখানে কক্ষতলে একটা সমাধি-বেদি। বাকি সবটা জুড়ে শূন্যতা যেন থমথম করছে। কেবল এখানে-ওখানে নীচে অন্ধকার ফুঁড়ে কতকগুলো আলোর ফিনকি জ্বলছে আর নিবছে, জ্বলছে আর নিবছে। ঠিক যেন জোনাকি। পর্দার ছ্যাঁদার ভেতর দিয়ে কতকগুলো জোনাকি কি ঘরের ভিতরে গিয়ে ঢুকেছে?

সেই মৃত্যুপুরীর অন্ধকারে জীবনের এই দীপ্তি অস্বাভাবিক বলে মনে হল।

বাইরে আকাশ যেন বলছে, ভেঙে পড়ি।

দিনান্তের শেষ আলোটুকু করেছে নিবিড় তিমিরের কোলে আত্মসমর্পণ। থেকে থেকে জেগে উঠছে কেবল লকলকে বিদ্যুতের ক্ষণস্থায়ী জ্যোতির্ময় জিহ্বা এবং সঙ্গে-সঙ্গে ক্রুদ্ধ বজ্রের জগৎ-জাগানো যুদ্ধ-ধ্রুপদ। হু-হু-হু-হু ঝড়ের প্রচণ্ড তাড়নায় সমাধি-ভবনের আশপাশকার মস্ত মস্ত পুরোনো গাছগুলো ঠিক যেন উন্মত্ত অতিকায় জীবের মতো ছটফট ছটফট করতে করতে কোলাহল করছে, ভয়াবহ কোলাহল!

আর ঝরছে হুড়হুড় করে অবিশ্রান্ত জল ঝমঝম ঝমঝম ঝমঝম— সৃষ্টি ভাসাতে চায় যেন প্রলয়-প্লাবনে। এমন বিষম বৃষ্টি জীবনে দেখিনি— এ হচ্ছে একেবারে অভাবিত!

এক ঘণ্টা কেটে গেল, দু-ঘণ্টা যায় যায়। তবু বৃষ্টি থামল না, তার জোরও কমল না। শব্দ শুনেই বুঝলুম, নীচেকার জমি ডুবিয়ে কলকল করে ছুটছে যেন বন্যার প্রবাহ! বড়ো রাস্তা খুব কাছেই। কিন্তু সেখানে মানুষের একটুও সাড়া নেই। কিংবা আমরা যেন মানুষের পৃথিবীর বাইরে এসে পড়েছি!

দুজনে দুই খিলানের মাঝখানকার দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে বসেছি, তবু কনকনে দমকা বাতাসের সঙ্গে বরফের ঠান্ডা জলের ঝাপটা এসে হাড়ের ভেতরটা পর্যন্ত অসাড় করে দিচ্ছে।

ঠকঠক করে কাঁপতে-কাঁপতে বললুম, ‘বিপিন, এমন করে আর কতক্ষণ কাটবে?’

কোনো সাড়া পেলুম না। বিপিন ঘুমিয়ে পড়ল নাকি? জোরে ডাকলুম, ‘বিপিন!’

‘উঁ?’

‘রাস্তা এখন নদী। বাড়ি যাবে কেমন করে?’

‘হুঁ।’

‘হুঁ কী হে? যা বলছি শুনছ?’

‘আমি এখন কিছুই শুনছি না। আমি এখন ভাবছি।’

‘ভাবছ? কী ভাবছ?’

‘জাফরি-কাটা পর্দার ফাঁকগুলো কাদামাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে কেন?’

‘এই নিয়ে আবার ভাবনা কীসের? এর তো সোজা উত্তর হচ্ছে, বাইরের লোকের ঘরের ভেতরে তাকানো নিষেধ।’

বিপিন উত্তেজিত স্বরে বললে, ‘কেন নিষেধ? আর কেই-বা নিষেধ করে? এ হচ্ছে পোড়ো সমাধি। এর মালিক নেই। আর থাকলেও নিষেধ করবে কেন? ঘরের ভেতরে আছে তো খালি একটা গোর। ভারতের কত দেশে কত বড়ো বড়ো নবাব-বাদশার গোর দেখে এসেছি, কোথাও কেউ নিষেধ করেনি, আর এই বেওয়ারিশ সমাধি-বাড়িতেই বা নিষেধ থাকবে কেন? ভেবে দেখো, যখন এই জাফরি-কাটা পরদাগুলো বসানো হয়েছিল, তখন এই নিষেধ ছিল না, কিন্তু এখন—’

আমি বাধা দিয়ে বললুম, ‘কী পাগলের মতো বকছ?’

‘না, আমি পাগলের মতো বকছি না।’

‘তবে তুমি কী বলতে চাও?’

‘এর মধ্যে কোনো রহস্য আছে।’

‘কী রহস্য?’

‘অপার্থিব রহস্য!’

‘বিপিন, তুমি কি অমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছ?’

‘মোটেই নয়।’

‘তবে তোমার কথার মানে কী?’

‘মানে-টানের কথা এখন রেখে দাও। কিন্তু এইমাত্র এখান দিয়ে কে চলে গেল!’

‘কেউ চলে যায়নি।’

‘আলবত গিয়েছে! অন্ধকারে তুমি দেখতে পাওনি।’

‘তুমি দেখলে কেমন করে?’

‘আমিও দেখিনি। আমি পায়ের শব্দ শুনেছি।’

‘পায়ের শব্দ আমিও শুনতে পেলুম না কেন?’

‘তুমি অন্যমনস্ক ছিলে।’

‘যাও, যাও, বাজে বোকো না।’

বিপিন তার টর্চটা জ্বেলে দালানের মেঝের ওপরে উপুড় করে ধরলে। প্রায় এক ইঞ্চি পুরু ধুলোর ওপরে রয়েছে একটা পদচিহ্ন।

বিপিন বললে, ‘দেখো।’

আমি হেসে উঠে বললুম, ‘দেখব আবার কী? তুমি নিজেই বলছ এটা বেওয়ারিশ বাড়ি। বাইরের কত লোক এখানে আনাগোনা করে, কে তার হিসাব রাখে? আমরা আসবার আগেই ওই পদচিহ্নটা যে ওখানে ছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।’

বিপিন মাথা নেড়ে বললে, ‘না, না, এ হচ্ছে একেবারে টাটকা পায়ের দাগ। ওই দেখো একটা-একটা করে আরও কতগুলো পায়ের দাগ সোজা চলে গিয়েছে। সব দাগ টাটকা। আরও কোনো কোনো বিশেষত্ব লক্ষ করেছ কি?’

বিরক্ত হয়ে বললুম, ‘মাপ করো ভাই, আমি তোমার মতো পদচিহ্ন-বিশারদ নই, কোনো বিশেষত্বই লক্ষ করিনি।’

বিপিন নিজের মনেই বলে চলল, ‘প্রত্যেকটাই হচ্ছে ডান পায়ের দাগ। মানুষ তো এক পায়ে হাঁটে না! কিন্তু এখানে বাঁ-পায়ের দাগ একটাও নেই। এ থেকে কী বুঝতে হবে? যে এখান দিয়ে গিয়েছে তার পা আছে একটিমাত্র! কিন্তু এই একঠেঙো লোকটা কেনই-বা এখানে এসেছিল, আর গেলই-বা কোথায়? আর কেই-বা সে? মানুষ? না আর কিছু?’

বিপিনটা বলে কী? তার কল্পনাশক্তি যে এতটা প্রবল, আগে তা জানতুম না।

আচম্বিতে খুব জোরে একটা শব্দ হল। কে যেন কোথায় সবলে একটা দরজার ওপরে ধাক্কা মারলে!

বিপিন আঁতকে উঠে বললে, ‘ওই শোনো! কে ভিতরকার ঘরের দরজা খুলছে!’

ঝড়ের গর্জন কমেছে বটে, কিন্তু বড়ো বড়ো গাছগুলোর পাতায় পাতায় তখনও শোনা যাচ্ছে তার শ্রান্ত দীর্ঘশ্বাস। ঝুপঝুপ ঝুপঝুপ করে তখনও ঝরছে বৃষ্টি এবং গড়গড় গড়গড় করে বাজ তখনও ধমক দিচ্ছে মেঘলোকের কোনো অদৃশ্য শত্রুকে।

জাফরি-কাটা পাথুরে পর্দার ফাঁকে ফাঁকে দেখা গেল সন্দেহজনক আলোর চঞ্চলতা!

ও আবার কী? বিস্মিত হয়ে উঠলুম। পর্দার ছিদ্রে চক্ষু সংলগ্ন করে দেখলুম, ঘরের ভেতরে অসম্ভবরকম বেড়ে উঠেছে জোনাকির ঝাঁক! পুঞ্জে পুঞ্জে তারা ঘুরছে-ফিরছে উঠছে-নামছে— সারা ঘরখানা জুড়ে চলেছে আশ্চর্য এক আগুন জ্বালানোর এবং আগুন নেবানোর খেলা! জোনাকিরা সংখ্যায় কত হবে? হাজার হাজার? না তারও চেয়ে বেশি? এত জোনাকি বাহির ছেড়ে ভেতরে এসে জুটল কেন? ঝড়-বৃষ্টির ভয়ে?

ওপাশের দালানে হঠাৎ আর একটা শব্দ শুনলুম— ধুপধুপ ধুপধুপ… পদধ্বনি?

শব্দ হচ্ছে তালে-তালে-তালে। কিন্তু প্রত্যেক তালের দুই মাত্রার মধ্যে একটা করে মাত্রা যেন ফাঁক থেকে যাচ্ছে। দুই পা ফেলে চললে প্রত্যেক শব্দের মাঝখানে আর একটা করে শব্দ শোনা যেত! এ যেন কেউ এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে আসছে!

বিপিন প্রায় কান্না-ভরা কণ্ঠে বলে উঠল, ‘কে আসে? ও কে আসে?’

ভয় বড়ো সংক্রামক। এতক্ষণ পরে আমারও বুক ঢিপ ঢিপ না-করে পারলে না। কোনো একপদ লোকের পায়ের শব্দ শোনবার জন্যে প্রস্তুত ছিলুম না— এই পোড়ো সমাধিবাড়িতে, এই ভীষণ দুর্যোগের রাত্রে!

তড়াক করে লাফ মেরে উঠে দাঁড়িয়ে বিপিন উদভ্রান্ত স্বরে বললে, ‘ওই সে আসছে— এদিকেই আসছে— আমাদের দিকেই আসছে!’

ধুপ-ধুপ-ধুপ-ধুপ…

যে আসছে তাকে দেখতে কেমনধারা? তার চেহারা কি আমাদের মতো?

হঠাৎ দালানের ভেতরে উড়ে এল ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি! ওপরে-নীচে ডাইনে-বামে ঘুরে ঘুরে জ্বলে আর নিবে, জ্বলে আর নিবে উড়তে লাগল। যেন জীবন্ত অন্ধকারের হাজার হাজার চক্ষু একবার খুলছে একবার বন্ধ হচ্ছে।

ধুপ-ধুপ… শব্দ খুব কাছে!

‘বাবা গো!’ বলে চিৎকার করে উঠেই বিপিন দালানের ওপর থেকে বাইরের দিকে লাফ মারলে!

যেদিকে পদশব্দ হচ্ছিল সেইদিকের নিরন্ধ্র অন্ধকারের মধ্যে সভয়ে একবার দৃষ্টিনিক্ষেপ করে আমিও বিপিনের পন্থা অনুসরণ করলুম।

তখনও শান্ত হয়নি বৃষ্টিস্নাত কালো রাত্রি! তখনও মৌন হয়নি বজ্রের কণ্ঠ।

কেমন করে বাসায় ফিরলুম সে কথা না বলাই ভালো।

বৃষ্টি থেমেছে। মেঘ ভেদ করে রোদের একটি সোনালি রেখা এসে পড়েছে আমাদের সকালের চায়ের টেবিলে।

বললুম, ‘বিপিন, কাল মিছেই আমরা ভয় পেয়েছিলুম।’

‘তাই নাকি? বেশ, পায়ের দাগ সম্বন্ধে তোমার মতই না হয় মানলুম। কিন্তু অমন সময়ে গোরস্থানের দরজা খুললে কে?’

‘দরজা কেউ খোলেনি, দরজায় কেউ ধাক্কা মেরেছিল। হয়তো তোমার আমার মতোই কোনো অসহায় পথিক দুর্যোগের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্যে ওখানে আশ্রয় নিতে এসেছিল। ধাক্কা মেরে দরজাটা বন্ধ দেখে মাথা গোঁজবার ঠাঁই খুঁজে বেড়াচ্ছিল।’

বিপিন ব্যঙ্গের স্বরে বললে, ‘তারও কি একটা পা নেই!’

‘স্থান-কালের মহিমায় আমাদের মাথা গুলিয়ে গিয়েছিল। হয়তো কারুর হাতের মোটা লাঠির শব্দকেই আমরা পায়ের শব্দ বলে ভুল করেছিলুম।’

‘তাই যদি তোমার বিশ্বাস, তাহলে আজকের রাতটা তুমি আবার ওখানে গিয়ে কাটিয়ে আসতে পারো?’

‘পাগল? গোরস্থান কি জ্যান্ত ভদ্রলোকের রাত কাটাবার জায়গা?’

বিপিন ঠোঁট টিপে একটুখানি হাসলে, আর কিছু বললে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *