আগে যাত্রার আসরে আমরা সারারাত কাটাতুম, এখন সে সময়টা কাটছে থিয়েটারে। শিক্ষিত বাঙালি যাত্রাকে এখন একরকম ‘বয়কট’ করছে বললেই চলে এবং দেশের অগণ্য শখের ও পেশাদার থিয়েটারগুলোর আওতায় পড়ে যাত্রার দল দিনে দিনে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। যাত্রার অধিকারীরা এখন তাই থিয়েটারের নকল করে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছেন। একেলে ‘থিয়েট্রিকাল যাত্রা পার্টি’গুলিই তার প্রমাণ। এতে যাত্রার ঢং বদলে গেছে, অভিনয়ের ধরন বদলে গেছে, গানের সুর বদলে গেছে এবং প্রায়ই কলকাতার প্রকাশ্য রঙ্গালয়৯.১ ভাড়া নিয়ে এসব যাত্রার অভিনয় হয়। আসলে এগুলো না যাত্রা, না থিয়েটার।
ছেলেবেলায় আমরা বারোয়ারিতলায় ও পূজাবাড়িতে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে যাত্রা দেখতুম। সে যে কী কষ্টকর ব্যাপার, এখনও বেশ মনে পড়ে। পাশ্চাত্য সভ্যতায় একটা ছাড়াছাড়ি নির্লিপ্ত ভাব আছে— সভায় ও আসরে সেখানে প্রত্যেকের জন্যই স্বতন্ত্র আসন না হলে চলে না। কিন্তু প্রাচ্য সভ্যতার মধ্যে সর্বত্রই গায়েপড়া ভাবটাই প্রধান হয়ে আছে। বাড়িতে একান্নবর্তী পরিবার সর্বদাই সমস্ত অনৈক্যের সমস্যাকে প্রাণপণে সমাধানের চেষ্টায় বিব্রত এবং বাইরেও সভায় ও আসরে সকলেই একাসনে পরস্পরের সঙ্গে গলাগলি করে উপবিষ্ট। কোন ব্যবস্থা উপকারী, আমি তা নিয়ে এখানে নাড়াচাড়া করতে রাজি নই, কিন্তু স্মরণ আছে, গ্রীষ্মকালে যাত্রার আসরে আমাদের কী অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতে হত। গুমোট করা রাত্রে সংকীর্ণ স্থানের মধ্যে বিপুল জনতা জড়ো হয়েছে, দর দর ঘামে আমরা আপাদমস্তক ভিজে উঠছি, মাথার ওপর ‘ফ্যান’ তখন কল্পনাতীত, কোনোদিকে একচুল নড়বার উপায় নেই— কারণ ডাইনে বাঁয়ে সামনে পিছনে লোকের পর লোক আমাদের যেন প্রাণপণে চেপে ধরে আছে, অনেকের গায়ে বিষম দুর্গন্ধ, অনেকে কনুইয়ের গুঁতো মারছে এবং অনেকে আরও যে কত কী করছে তা মনে পড়লে আজও শিউরে উঠি। এরই মধ্যে ‘নিতুই নিতুই রাজবাড়ি ফুল যোগাই কেমন করে’ বলে বিদ্যাসুন্দরের৯.২ মালিনী না-কামানো খোঁচা দাড়ি-গোঁফঅলা মুখে, কখনো হিজড়ের মতো হাততালি দিতে দিতে, কখনো হাঁটুর কাপড় একটুখানি তুলে ধরে ও কালো কালো কর্কশ পা বার করে ঘুরে ফিরে নেচে যায়, বিদ্যার মা এসে নাকি সুরে কান্না ধরে, রাজা ও কোটাল গর্জন করে তড়পাতে থাকে, রুক্ষ পরচুল-পরা পিলে মোটা কৃষ্ণবর্ণ ছোঁড়াগুলো সখী সেজে অস্বাভাবিক স্বরে গান গেয়ে কানের পোকা তাড়িয়ে দিয়ে যায়, উকিলের সাজে জুড়ির দল চারকোণে দাঁড়িয়ে, যেন কাল্পনিক শত্রুর সঙ্গে মুষ্টিযুদ্ধ করার ভঙ্গিতে ভীম বিক্রমে বাহু সঞ্চালন করে ও বুক চমকানো মুখভঙ্গির সঙ্গে পাঁঠার ডাকের মতো গিটকিরি দিয়ে তান ছেড়ে তানসেনের আদ্যশ্রাদ্ধে প্রবৃত্ত হয়।
ঝাড়লন্ঠনের ম্লান আলোতে অস্পষ্টভাবে এইসব দৃশ্য আমার শেষরাত পর্যন্ত ঠায় বসে বসে নিষ্পলক নেত্রে দেখতে দেখতে বাহবা দিতে ছাড়তুম না। তারপর যাত্রা ভেঙে যেত এবং আমাদের অনেকেই আর জুতো খুঁজে পেতুম না। যখন দেহে-মনে নিস্তেজ হয়ে বাড়িতে ফিরতুম, তখন বোধ হত যেন সারারাত্রব্যাপী মল্লযুদ্ধ করে আসছি। যাত্রা যে খাঁটি দেশি আমি তা জানি, কিন্তু আমাদের বাল্যকালে যা দেখেছি তাতে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, সেটি একটি মারাত্মক স্বদেশি ব্যাপার। এবং হয়তো এই জন্যেই বিনামূল্যের যাত্রা ছেড়ে লোকে এখন ট্যাঁকের টাকা খরচ করেও থিয়েটার দেখতেই বেশি ভালোবাসে।
রাতের কলকাতায় থিয়েটার একটি প্রধান দ্রষ্টব্য স্থান। কলকাতার বাসিন্দাদের মধ্যে থিয়েটারের ভক্ত অগুনতি। এখানে এলে আমাদের জাতীয় বিশেষত্বগুলি চোখ ও কানের সামনে অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সাহেবদের দেখাদেখি বাঙালিরা এদেশে থিয়েটারের পত্তন করে বটে, কিন্তু বিলাতি থিয়েটারের অধিকাংশ গুণই বাংলা রঙ্গালয়ে দেখা যায় না। বিলাতের কথা ধরি না, কিন্তু আমাদের এই কলকাতারই বিলাতি থিয়েটারগুলিতে (ধরুন, এম্পায়ার থিয়েটার৯.৩) গেলে চোখ যেন জুড়িয়ে যায়। চারতলা প্রকাণ্ড বাড়ি, নীচে থেকে তিনতলার সিঁড়ি পর্যন্ত আগাগোড়া মার্বেলে বাঁধানো। কোথাও অতিরিক্ত কারুকার্য রসবোধকে আহত করে না, অথচ এক সরল, মার্জিত সৌন্দর্য মনকে মুগ্ধ করে। অত বড়ো বাড়ি, নিত্য কত লোক আসা-যাওয়া করছে, তবু সমস্তটাই এতটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন যে, অনুবীক্ষণের সাহায্যেও হয়তো ধুলো-জঞ্জালের কণা আবিষ্কার করা অসম্ভব হবে। এর তুলনায় বাঙালিরা যে বাড়িগুলিতে রাত্রির পর রাত্রি যাপন করে, তাদের অবস্থা যে কী শোচনীয়, সে কথা পরে যথাস্থানে বলার চেষ্টা করব।
বিলাতি রঙ্গমঞ্চের ভিতর থেকেও কোথাও দীনতা-দারিদ্র্যের এতটুকু চিহ্ন বাইরে উঁকি মারে না। চারিদিকে কলাসৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা নিয়ে সানন্দে রাত্রিযাপনের জন্যেই দর্শকরা এখানে এসে টাকা খরচ করে এবং বিলাতি রঙ্গালয়ের স্বত্বাধিকারীরাও সেটা বুঝে সাচ্চা টাকার বদলে ঝুটো মাল দেয় না। এখানকার দৃশ্যপটে কাঁচাহাতের তুলির টান, ছেলে-ভুলানো বাজে রঙের বাহার, অসাময়িকতা, অস্বাভাবিকতা বা অসামঞ্জস্য একেবারেই নেই। কিন্তু বাংলা রঙ্গমঞ্চের দিকে তাকালেই দেখা যাবে, ছাদের ওপর থেকে কুৎসিত কাঠের বা বাঁশের ‘ফ্রেম’ দড়াদড়ি ও ছেঁড়াখোড়া ন্যাকরা উঁকিঝুঁকি মারছে, পার্শ্ব-পটের (wings) সঙ্গে সামনের দৃশ্যপটের মিল নেই, নতুন দৃশ্যপটের সঙ্গে মান্ধাতার আমলে আঁকা, রং-জ্বলে যাওয়া, ছিন্নবিচ্ছিন্ন দৃশ্যপটও গুঁজে দেওয়া হয়েছে, রঙ্গমঞ্চের তলায় উলঙ্গ, ধুলোভরা কাঠের তক্তাগুলো দেখা যাচ্ছে এবং অভিনেতাদের পোশাকেও ঠিক এমনই সব ত্রুটিবিচ্যুতি।
অভিনয়েও দেশি-বিলাতিতে এমনি তফাত। কলকাতার সাহেবদের রঙ্গালয়ে সাধারণত যারা অভিনয় করে, বিলাতের নট-সমাজে তারা নগণ্য বললেও চলে। কিন্তু এই নগণ্য অভিনেতারাও আমাদের অগ্রগণ্য অভিনেতাদের অধিকাংশেরই গুরুস্থানীয় হতে পারে। তারা বিলাতে নগণ্য বটে, কিন্তু নাটকীয় রস জমাবার জন্য তারাও যতটা সাধনা করে, বাঙালি অভিনেতারা স্বপ্নেও বোধ হয় তা করে না। অন্তত তাদের ও আমাদের অভিনয় দেখলে এই সন্দেহই মনে স্থান পায়। সম্পূর্ণতা ও অসম্পূর্ণতা, পাকা ও কাঁচা, প্রস্তুত ও অপ্রস্তুতের মধ্যেও তফাত ঠিক ততখানিই। এর প্রথম কারণ বিলাতি নটরা প্রথমে অভিনয় বিদ্যালয়ে শিক্ষিত হয়, তারপর বহুদিন রঙ্গালয়ে উমেদারি করে অভিজ্ঞতা লাভের পরে তবেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়ে অবতীর্ণ হবার সুযোগ পায়। আমাদের দেশে অভিনেতারা যেন জন্ম-অভিনেতা, তাদের আর শিক্ষার দরকার নেই। দ্বিতীয় কারণ দেশি রঙ্গালয়ে, রিহাসালের পরমায়ু এত অল্প যে নিখুঁত অভিনয় হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। আমি জানি, মাত্র দুই তিন দিনের ‘রিহার্সালে’র পরেই অনেক নাটক প্রকাশ্যভাবে অভিনীত হয়েছে। কিন্তু এসব কথা এখন থাক, কারণ আমরা এখানে রঙ্গালয়ের সমালোচনা করতে বসিনি। বাঙালি দর্শকরা রাত জেগে পয়সা নষ্ট করে কী লোক ঠকানো ব্যাপার দেখতে যায় সেইটেই বোঝাবার জন্য প্রসঙ্গসূত্রে দু-একটা ইঙ্গিত দিলুম মাত্র।
আমাদের রঙ্গালয় অনেক ফন্দিবাজ ছোকরার মা-বাপ ঠকানোর উপায় করে দেয়। ছোকরারা প্রথম প্রথম যখন উড়তে শেখে, তখন ‘থিয়েটার দেখতে যাচ্ছি’ বলে গণিকালয়ে যায়। অনেকে কোন গতিকে থিয়েটারের ‘প্রোগ্রাম’ সংগ্রহ করে রাখে। বাপ-মা সন্দেহ প্রকাশ করলে নিজেদের কথার সত্যতা প্রমাণিত করবার জন্যে, তারা সেই ‘প্রোগ্রাম’ দাখিল করে। বেশি রাতে বাড়ি ফিরলেও একমাত্র দোহাই হয়— ‘থিয়েটারে গিয়েছিলুম।’ অধিকাংশ মা-বাপ এমনই সুবোধ যে, সেই দোহাই শুনেই তুষ্ট হয়। আসলে তাঁদের উচিত স্পষ্টভাষায় বলে দেওয়া যে, অভিভাবকের সঙ্গে ছাড়া ছেলেরা মোটেই থিয়েটার দেখতে যেতে পাবে না। তাহলেই এরা জব্দ হবে। এই প্রথম অবস্থায় যুবকরা ভীরু থাকে। এসময়ে বাধা দিলেই অনেকের স্বভাব শুধরানোর সময় থাকে। পরে গণিকালয়ে যাওয়ায় অভ্যস্ত হলে তাদের বুক জ্বলে যায়। তখন তাদের আর ফিরিয়ে আনা অসম্ভব।
অনেকে মেয়েদের রক্ষী হয়ে থিয়েটার দেখতে আসে। মেয়েদের ওপরে পাঠিয়ে তারা থিয়েটার থেকে সরে পড়ে। তারপর বাইরে বাইরে ফুর্তিতে খানিকক্ষণ কাটিয়ে, পালা শেষ হবার কিছু আগে তারা আবার থিয়েটারে ফিরে এসে মেয়েদের নিয়ে বাড়ি যায়। অথচ ইতিমধ্যে ভিতরে ভিতরে কী কাণ্ডটাই যে হয়ে গেল, সেটা কারোর জানবার সাধ্য থাকে না কিন্তু সময়ে সময়ে এই অতি-চালাকেরাও হাতেনাতে ধরা পড়ে যায়। থিয়েটার ভেঙে গেল, সব মেয়ে একে একে নেমে গেল, কিন্তু এক বাড়ির মেয়েরা হয়তো চুপ করে বসে বসে তখনও অপেক্ষা করছেন। কারণ কর্তার দেখা নেই। ক্রমে রাত গভীরতর হল, মেয়েরাও ভয়ে কান্না শুরু করলেন। কর্তা হয়তো তখন কোথাও বসে নিশ্চিন্তপ্রাণে খেমটা নাচ উপভোগ করছেন। হয়তো ইয়ারদের অনুরোধ না এড়াতে পেরে দু-পাত্র টেনে সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। তারপর হঠাৎ ঘড়িতে রাত তিনটের ঘা শুনে তখন তাঁর সাড় হয়…
অত্যন্ত অনিচ্ছার সঙ্গেই আর একটি ব্যাপারেরও উল্লেখ করতে বাধ্য হচ্ছি। রাত্রির কলঙ্ক কাহিনি সর্বত্রই রেখে-ঢেকে বলতে গেলে আমাদের বই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। …সকলে মনে রাখবেন, নীচের গল্পটির আগাগোড়া সত্য, কেবলমাত্র নায়ক-নায়িকার নাম দুটি কাল্পনিক।
অমলা বিধবা, রূপসি, যুবতী— একেলে উপন্যাসে আদর্শ নায়িকা হবার মতো কোনো গুণেই সে বঞ্চিত নয়।
যুবতী-বিধবার জীবন এদেশে ‘ট্র্যাজেডি’ বলেই শুনি। অমলার জীবনও তাই হতে পারত, পাশের বাড়ির যতীশচন্দ্র কিন্তু অমলাকে সে চরম দুর্ভাগ্য থেকে রক্ষা করলে, অবশ্য পরম গোপনে। কথাটা বোধ হয়, আর ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে না।
অমলা যে ঘরে শোয়, তার পাশেই একটি খুব সরু গলি। তার পরেই যতীশের বাড়ি। দু-জনের রোজই দেখা হয়— দুই ঘরের দুই জানলা থেকে। কিন্তু ওই পর্যন্ত। অমলার বাড়ির লোক বড়ো সজাগ, প্রেমের কদর বোঝে না।
কিন্তু বাড়ির লোকদের চেয়ে মদনঠাকুরের বুদ্ধি ও শক্তি ঢের বেশি। তাঁর মহিমায় দুর্ভেদ্য কাঁটা বনেও সকলের অগোচরে রাস্তা তৈরি হয়। অতএব—
একটি সুতোয় বেঁধে যতীশ একদিন অমলার ঘরে একখানা চিঠি ঝুলিয়ে দিলে— উপরের ছাদ থেকে। অমলা তা পড়লে। চিঠিতে কী ছিল, জানি না। অমলা কিন্তু চিঠি পড়ে, একটু হেসে, ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দিলে— আচ্ছা।
অমলার বাড়ির লোকেরা প্রায়ই থিয়েটার দেখতে যায়— পাসে, কি টিকিট কিনে, বলতে পারি না। চিঠি পাবার পরদিনেই অমলা থিয়েটার দেখতে গেল— দেওরের সঙ্গে একলা। তার দেওরও থিয়েটারের একান্ত ভক্ত। তার সঙ্গে প্রায়ই সে একলা থিয়েটার দেখতে যায়— সব দিন বাড়ির আর সকলের যাওয়া হয়ে ওঠে না। …অমলাকে উপরে পাঠিয়ে অমলার দেওর টিকিট কিনে ভিতরে ঢুকল।
থিয়েটারের পালা শুরু হয়েছে, এমন সময়ে ঝি এসে অমলাকে বলল, ‘অমুক রাস্তার অমুকবাবু তোমাকে ডাকচেন।’ ঝি অমলার দেওরের নাম করলে।
অমলা নেমে এসে দেখে, রাস্তায় একখানা গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে— ভিতরে যতীশ। বিনা বাক্যব্যয়ে সে গাড়িতে এসে উঠল। …ঘণ্টা দুই নানা রাস্তায় ঘুরে গাড়ি আবার থিয়েটারের দরজায় এসে দাঁড়াল। অমলা আবার থিয়েটারে উপরে গিয়ে উঠল।…
থিয়েটারে এই ধরনের আরও অনেক ঘটনা যে ঘটে না, এমন কথা জোর করে কে বলতে পারে? আমরা আরও অনেক কানাঘুষো শুনেছি, কিন্তু তার সত্যতা সম্বন্ধে শপথ করতে পারব না বলে, এখানে আর সেগুলির উল্লেখ করলুম না। এসব ব্যাপারের সঙ্গে থিয়েটারের ঝিয়েরা জড়িত থাকে কি না, বলতে পারি না। অন্তত তার কোনো প্রমাণ পাইনি।
এমন সব ব্যভিচারের জন্যে থিয়েটারকেও দায়ী করা সংগত নয়। থিয়েটার উঠিয়ে দিলেও এ পাপের অভিনয় বন্ধ হবে না, অন্য পথে আত্মপ্রকাশ করবে মাত্র।…
রঙ্গালয় হচ্ছে ললিতকলার ত্রিবেণী-সঙ্গম, সাহিত্য, সংগীত ও চিত্রকলার মধ্যে উপভোগ্য যা কিছু, রঙ্গালয়ে তারই একত্র সমাবেশ থাকবার কথা। চোখ, কান ও মন এখানে এসে মোহিত না হয়ে আহত হলে বুঝবে, রঙ্গালয় তার আদর্শ বজায় রাখতে পারেনি। কিন্তু বাংলা থিয়েটারে গেলে চোখ, কান আর মনের অবস্থা যে কীরকম হয়, এইবারে সেইটিই দেখা যাক।
প্রথমত বাংলা থিয়েটারের বাহিরের দৃশ্য। কলামন্দিরের বাহিরটা জমকালো হওয়া উচিত এবং আমাদের রঙ্গালয়ের মালিকরাও সে কথা বোঝেন। স্টার ও অধুনা লুপ্ত মিনার্ভা প্রভৃতি থিয়েটারগুলিতে তাই স্থাপত্য সৌন্দর্য প্রকাশের চেষ্টা হয়েছিল। স্টার থিয়েটার সত্যসত্যই কলকাতার মধ্যে একটি দেখতে চমৎকার বাড়িও মালিকদের রসবোধের অভাবে এবং সওদাগরি বুদ্ধির প্রভাবে আমাদের দৃষ্টিকে যারপরনাই আহত করে। থিয়েটারের গায়ে বা সীমানার মধ্যে পান বিড়ির কুৎসিত দোকান বাঁধতে দেওয়া হয় কেন? সামান্য গোটাকয়েক টাকা ভাড়ার জন্যে, এত যত্ন, পরিশ্রম ও অর্থব্যয়ে প্রস্তুত প্রাসাদোপম অট্টালিকাগুলির শ্রী-সৌন্দর্যকে মলিন করা অন্যায়, অতি মাড়োয়ারির পক্ষে এ কাজ সাজে, কিন্তু ললিতকলায় আধুনিক ভারতের শ্রেষ্ঠ জাতি বাঙালির পক্ষে এটা অমার্জনীয় অপরাধ।
তারপর বাংলা থিয়েটারের ভিতর অংশ। এখানকার সর্বপ্রধান বিশেষত্ব, ধুলো, ময়লা, জঞ্জাল, কালি-ঝুল, পানের পিক ও অসহ দুর্গন্ধ। আশেপাশে, নীচে-উপরে যেখানে চোখ পড়ে, সেইখানেই মালিকের অবহেলা ও একটা-না-একটা দাগ দেখা যায়ই যায়। দেয়ালে, ছাদে, রঙ্গমঞ্চের সামনে দেয়াল নকশা বা ‘ফ্রেস্কো’ থাকে এবং সেগুলো আঁকতেও খরচ বড়ো কম হয় না— কিন্তু তার পটুয়ারা আসে বোধ হয় বড়োবাজার থেকে কারণ তার মধ্যে কলানিপুণতা ও একটা নির্দিষ্ট ভঙ্গি বা ‘স্টাইল’ কোথাও নজরে পড়ে না। তাতে রঙের পরে রঙের ছোপ আছে, হরেকরকমের লতা-পাতা-ফুল আছে, ডানা-ছড়ানো পরি ও নগ্ন নারীর মূর্তি আছে এবং আরও ঢের হিজিবিজি আছে কিন্তু তাদের আদর্শ যে কী, তা বোঝবার কোনো উপায় নেই। কোথাও দেখি অজন্তার আদর্শ আবার কোথাও দেখি মিশরীয় বা মোগল বা বিলাতি বা শিল্পীর নিজস্ব ‘আদর্শহীন’ আদর্শ। হাটখোলার দর্শকরা হয়তো ভালো-মন্দ না বুঝে আর্টের এই নীরব প্রলাপের দিকে অবাক বিস্ময়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু বাংলা থিয়েটারের দর্শক তো খালি হাটখোলা থেকে আসে না। তাদের রুচিকে যে এখানে গলা টিপে বধ করা হয়! দুঃখের কথা বলব কী, শিক্ষিত ও রসজ্ঞদের দ্বারা চালিত সমস্ত থিয়েটারেই আমাদের কথার প্রমাণ আছে অজস্র। থিয়েটারে ঢুকলে শিক্ষিতদেরও রুচি এমনই বিগড়ে যায় নাকি?
বাংলা থিয়েটারের আর এক বিশেষত্ব— দর্শকদের গোলমাল। এত গোলমাল ‘নতুন বাজারে’ও হয় না। অভিনয়ের সময়েও মাঝে মাঝে দর্শকরা এমনই চ্যাঁচাতে থাকে যে, অভিনয় বন্ধ করতে হয়। প্রত্যেক অঙ্কের পরে বিশ্রামের সময়ে সেই গোলযোগ আবার অশ্রান্তভাবে ত্রিগুণ বর্ধিত হয়ে কর্ণকে বধির করে দেয়। কর্ত,পক্ষরা থিয়েটারের পানওয়ালাদের ঢুকতে দেন যে কোন আক্কেলে, তা তাঁরাই জানেন। সে এক বিষম আপদ, তারা ক্রমাগত গায়ের উপর দিয়ে সকলের পা মাড়িয়ে ছুটোছুটি করবে, ‘পান-সিগারেট’ বলে হুংকার দেবে এবং রগ ঘেঁষে সোডার বোতল রেখে দুমদুম করে খুলবে। কী অস্বস্তি। অধিকাংশ থিয়েটারেই ‘কনসার্ট’৯.৪ নামে যে নিষ্ঠুর ব্যাপারটি আছে, তাকেও যান্ত্রিক কোলাহল ছাড়া আর কিছু বলা চলে না। কানের কাছ ঢাকের বাদ্যিও বোধ হয় এর চেয়ে মিষ্টি। এসবের তুলনায় সাহেবি থিয়েটারগুলি শান্তির স্বর্গ বললেও চলে। সেখানকার দর্শকরাও ভদ্র এবং ঐকতান বাদনও একটি উপভোগ্য ব্যাপার।
তারপর আসনের বন্দোবস্ত। সাহেবি থিয়েটারের মতো এখানে মাঝখান দিয়ে আসা-যাওয়ার পথ বা প্রত্যেক দুই সার আসনের মাঝখানে যথাসম্ভব ব্যবধান নেই। ফলে একজন লোক গেলে বা এলে এক সারের সমস্ত লোকের অবস্থা হয়ে ওঠে ভীষণ শোচনীয়। (এখন কিন্তু আসনের অবস্থা ঢের উন্নত হয়েছে)। তার ওপরে প্রত্যেক আসনই এতদূর নোংরা, কদর্য ও ছারপোকাভরা যে, হঠযোগের অভ্যাস না থাকলে নিশ্চিন্ত প্রাণে বসে বসে দীর্ঘকাল ধরে অভিনয়ের রস উপভোগ করা একান্ত অসম্ভব।
এই ভয়ানক জায়গায় গিয়ে আমরা রাত্রির পর রাত্রি ধরে যখন অভিনয় দেখতে কসুর করি না, তখন আমরা যে, প্রথম শ্রেণির নাট্যপ্রিয় জাতি, তাতে আর সন্দেহ কি? এমন দিন গেছে, যখন বেলা দুটো থেকে শুরু করে পরদিনের সূর্যোদয় পর্যন্ত অভিনয় হয়েছে এবং তা দেখেও আমাদের পৈত্রিক প্রাণ দস্তুরমতো জীবিত আছে। বিলাতি আইনে আত্মহত্যা দণ্ডনীয় অপরাধ। কাজেই আইনানুসারে এখন নিয়ম হয়েছে যে, এমন সাংঘাতিক অভিনয় দেখে বাঙালিরা আর আত্মহত্যা করতে পারবে না। রাত একটার পরে অভিনয় এখন নিষিদ্ধ। কিন্তু সে আইন যে মানা হয়, তা বলতে পারি না। সরকার এজন্যে ইনস্পেকটর নিযুক্ত করেছেন বটে, কিন্তু বাংলা থিয়েটারে অভিনয়ের উৎসাহ এখনও প্রায় রাত আড়াইটে তিনটের আগে শান্ত হয় না। এর মানে কী? তারপর, বাঙালি দর্শকদেরও মতিগতি এখনও এইদিকেই ঝুঁকে আছে। তাই থিয়েটারের কর্তৃপক্ষও পালা পার্বণে বা বিশেষ অনুমতি নিয়ে যখনই সুবিধা পান, সারারাত্রব্যাপী অভিনয়ের আয়োজন করেন, এবং দর্শকরাও অমনি কাতারে কাতারে থিয়েটারের দিকে সবেগে ধাবিত হন।
অভিনয়কালে বাংলা থিয়েটারের সাধারণ দৃশ্য কম-বেশি পরিমাণে এইরকম—
দর্শকদের শ্রবণকে আশ্বস্ত করে কনসার্ট থামল। আজ একখানি ঐতিহাসিক নাটকের অভিনয়। পালা শুরু হবার কথা সন্ধ্যা সাতটায়, কিন্তু বেজেছে আটটা। হয়তো আরও দেরি হত, কিন্তু পিট ও গ্যালারির দর্শকদের ঘন ঘন শিস ও হাততালিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে কর্তৃপক্ষ শেষটা যবনিকা তুলতে বাধ্য হলেন। প্রথম দৃশ্যের প্রথমেই দেখা গেল, বিশ-পঁচিশটি সখী— বয়স দশ থেকে পঞ্চাশ বা তাতোধিক বৎসর পর্যন্ত নানা ভঙ্গিতে শুয়ে বসে বা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সকলের মুখ রঙে ও পাউডারে অসম্ভবরূপে লাল ও সাদা, হাত-পাও তাই। কিন্তু প্রত্যেকের মাথার পেছনদিকে খোঁপার তলায় ঘাড়ের ওপর থেকে আসল রং দেখা যাচ্ছে— কারণ আরশিতে চোখে পড়ে না বলে সেখানটা আর ‘পেন্ট’ করা হয়নি। সখীদের মধ্যে অধিকাংশই হয় লিকলিকে রোগা, নয় থপথপে মোটা— একজনেরও মুখশ্রী ও গড়ন ভালো নয়, বেশির ভাগেরই চোখ বসা ও কুতকুতে, নাক খ্যাঁদা ও গাল ভিতরপানে ঢোকা। নেপথ্য থেকে বাঁশি, পিয়ানো, হারমোনিয়াম ও তবলা বাজল, সঙ্গে সঙ্গে এই ‘লাইট’ ও ‘হেভিওয়েটে’র দল প্রাণপণে, না-দেশি না-বিলাতি নাচ ও গান শুরু করে দিলে, তাদের দাপাদাপি লাফালাফির চোটে ‘স্টেজে’র উপর থেকে যুগান্তরের পুঞ্জীভূত ধূলারাশি জেগে উঠে, হু হু করে উড়ে প্রথম কয়েক সারের দর্শকদিগকে ভীষণ বিক্রমে আক্রমণ করলে, দর্শকরা হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো করে হেঁচে ও খক খক করে কেশে নাকের ছ্যাঁদায় খুব জোরে রুমাল বা কোঁচার খুঁট চেপে রইল। নেচে-গেয়ে বেদম হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে সঙ্গীরা চলে যেতে উদ্যত হল, পিছনের দর্শকরা অমনি তারস্বরে চেঁচিয়ে এবং হাততালি দিয়ে বলে উঠল— ‘এঙ্কোর! এঙ্কোর!’৯.৫ কিন্তু সামনে থেকে ধূলিধূসরিত দর্শকরা বলতে লাগল— ‘নো মোর! নো মোর!’ খানিকক্ষণ ধরে ‘এঙ্কোরে’ ও ‘নো মোরে’ এমনই প্রবল যুদ্ধ চলল— ততক্ষণে একটু হাঁপ ছেড়ে জিরিয়ে নিয়ে সখীরা আবার রঙ্গমঞ্চের ওপরে আবির্ভূত হয়ে নৃত্যগীতের পুনরাভিনয় করে গেল। এই নাচগানের সময় গ্যালারির ভিতর থেকে অশ্লীল বা হাস্যোদ্দীপক কতরকমের শব্দই যে আসতে লাগল তার সব আর বলবার নয়, গোটাকতক নমুনা দিচ্ছি মাত্র— ‘ব্বা-ব্বা-ব্বা-ব্বা-ব্বা-ব্বা-ব্বা-ব্বা-ব্বা!’ —’লে হালুয়া’ —’মরে যাই, মরে যাই’ —’ও হোঃ হোঃ!’ — ‘প্রাণ যে যায় রে বাপ!’— ‘যাস নে ভাই, আমাদেরও নিয়ে যা!’ প্রভৃতি।
রঙ্গালয়ের একেবারে প্রথম সারে কতগুলি লক্কা-পায়রার মানবীয় সংস্করণের মতো ছোকরা বসে আছে। তাদের অধিকাংশেরই মাথার নীচের দিকের চুল খুব সম্ভব ক্রপের ক্ষুর দিয়ে কামানো এবং সামনের দিকে ঝুঁটিওয়ালা টেড়ি— একেবারে দাগি চেহারার লক্ষণ। তাদের শ্বাসপ্রশ্বাসে ভুর ভুর করে ‘মধু’র গন্ধ বেরুচ্ছে এবং কারো চুড়িদার পাঞ্জাবির পকেট থেকে ‘ফ্লাস্কে’র মুখ উঁকি মারছে। তাদের প্রত্যেকেই প্রত্যেকের দৃষ্টি এক-একটি বিশেষ নর্তকীর ভাবভঙ্গির দিকে আবদ্ধ, নর্তকীরাও প্রায় প্রত্যেকেই নাচতে নাচতে এক-একটি বিশেষ লক্কা-পায়রার দিকে বারংবার অর্থপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মুচকে মুচকে হাসছে। —বুঝতে দেরি লাগে না যে, এরা পরস্পরের পরিচিত। থিয়েটার ভাঙলেই স্থানান্তরে গিয়ে এদের পরিচয় ঘনিষ্ঠতর হবে।
উপরে ‘বক্স’, সেখানকার দৃশ্যও বিচিত্র। কোনো বক্সে একদল বাবু বসে আছেন। তাঁদের কেউ কেউ ‘গার্ড’-কে ডেকে, তার হাতে দুটো-একটা টাকা গুঁজে দিয়ে চুপিচুপি খোঁজ নিচ্ছেন, অমুক অমুক সখীর ঠিকানা কী, তারা বাঁধা আছে কি না প্রভৃতি। একটি চশমা-পরা ছাগলদাড়ি বাবু মোটেই থিয়েটার দেখছেন না, তিনি একদৃষ্টিতে তিনতলার মেয়েদের আসনের দিকে তাকিয়ে সমানে ধ্যানস্থ হয়ে আছেন।
পরের ‘বক্সে’ একদল মাড়োয়ারি কলকাতার একটি সেরা ও বিখ্যাত ‘সৌন্দর্য’কে নিয়ে বসে, অনেক শখের বাঙালিবাবুর হিংসা ও বিরাগ ভরা দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। কেউ কেউ উচ্চস্বরে তাদের শুনিয়ে দিতেও ত্রুটি করছে না যে, ‘এই ব্যাটা ছাতুখোর মেড়োদের উৎপাতে সেরা সেরা বিবি লোপাট হয়ে গেল দেখছি!’ সে গালাগালি শুনেও মাড়োয়ারিরা কিছুমাত্র বিরক্তির ভাব প্রকাশ করছে না, বরং গর্বপূর্ণ অবহেলার হাসি হাসছে।
তারপরের বিছানাওয়ালা ‘বক্সে’ দুই বাবু, দুই বিবি। এক বাবু অত্যধিক সুধাপান করে বিবির কোলে মাথা রেখে কাত হয়েছেন, বিবি তাঁর মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। দ্বিতীয় বাবু এক গেলাস মদ নিয়ে দ্বিতীয় বিবিকে কাকুতিমিনতি করছেন।
বিবি হাত দিয়ে বাবুর গেলাস-ধরা হাত সরিয়ে বলছেন, ‘মর মুখপোড়া! এই বাজারে বসে সকলের সামনে মদ খাব কী রে?’
বাবু বলছেন, ‘খাবিনি? তাহলে আমি আত্মহত্যা করব।’
ঠিক তার পরের ‘বক্সে’ই চারজন ভদ্রমহিলা পাশেই মাতাল দেখে আর এইসব কথা শুনে ভয়ে এক-গা ঘেমে, একেবারে আড়ষ্ট হয়ে আছেন।
ইতিমধ্যে নূরজাহান ও শের খাঁ প্রেমালাপ করতে করতে রঙ্গমঞ্চের উপরে এসে আবির্ভূত হলেন। নূরজাহানের চেহারা দেখেই থিয়েটারশুদ্ধ লোক প্রকাশ্যে তারস্বরে একটা নিরাশা-ভরা অব্যক্ত ধ্বনি করে উঠল। সত্য, নিরাশ হবার কথাই বটে। এই কি সেই পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, অতুলনীয়া সুন্দরী নূরজাহানের মূর্তি? গড়ের মাঠের চেয়ে সামান্য ছোটো কপাল, টিয়াপাখির মতো নাক, দুই গণ্ডের মাংস নিম্নদিকে লম্বিত, আকর্ণবিশ্রান্ত বদন-বিবর, ভাঁজ-করা চিবুক, দোদুল্যমান ভুঁড়ি, নরহস্তিনীর মতো দেহ— কী ভয়ানক, নূরজাহানের ‘ক্যারিকেচার’ও যে এর চেয়ে দেখতে সুন্দর। রঙ্গালয়ের কর্ত,পক্ষের অপূর্ব সৌন্দর্য-জ্ঞান ও আশ্চর্য সাহসকে ধন্যবাদ। গ্যালারির একজন দর্শক তো আর থাকতে না পেরে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘এ নূরজাহানের ঠিকানা কী বাবা। মসজিদ বাড়ি স্ট্রিটের শ্যাওড়াতলা?’
চিফ গার্ড ‘এইও। চোপ’ বলে একলাফে দাঁড়িয়ে ওঠে, গ্যালারির চারিদিকে তীক্ষ্নদৃষ্টিপাত করে বারংবার বলতে লাগল, ‘কে বললে এ কথা? কে বললে এ কথা?’
কিন্তু আর সমস্ত দর্শকের হাস্য ও ব্যঙ্গ ধ্বনির মধ্যে চিফ গার্ডের কণ্ঠস্বর অসহায়ভাবে কোথায় তলিয়ে গেল।
ইতিমধ্যে একজন দর্শক একমুখ পান নিয়ে হ্যাঁচ্চো করে প্রচণ্ড এক হাঁচি হাঁচলে— সঙ্গেসঙ্গে তার সামনের দর্শকের মাথা, ঘাড়, চাদর ও জামা পান-সুপারিতে ও পানের পিকে বিচিত্র হয়ে গেল। নিজের অবস্থার দিকে খানিকক্ষণ স্তম্ভিত নেত্রে নীরব তাকিয়ে থেকে, দ্বিতীয় দর্শক তড়াক করে লাফিয়ে উঠে চেঁচিয়ে বললে, ‘এটা কী হল শুনি?’
১ম দর্শক। (গম্ভীরভাবে মুখ মুছতে মুছতে) হেঁচে ফেলেচি, কী আর হবে?
২য় দর্শক। (সক্রোধে) কী হবে, দেখবে রাস্কেল?
১ম দর্শক। (দাঁড়িয়ে) কী, মুখ সামলে কথা কও বলচি।
২য় দর্শক। তুমি হাঁচি সামলাতে পারলে না, আর আমি মুখ সামলে কথা কইব, স্টুপিড?
১ম দর্শক। (ঘুসি পাকিয়ে) ফের গালাগাল?
২য় দর্শক। (১ম দর্শকের মুখে হঠাৎ এক ঘুসি মেরে) ড্যাম, শুয়োর, গাধা।
গার্ডেরা ছুটে এসে দু-জনকেই ধরে বাইরে টেনে নিয়ে গেল— সেখান থেকে তাদের অশ্রান্ত হুংকার শোনা যেতে লাগল।
এতক্ষণ পরে অভিনয়ের প্রথম সুযোগ পেয়ে শের খাঁয়ের সঙ্গে নূরজাহান প্রেমালাপ শুরু করলেন। কিন্তু দু-চারটে কথা বলতে না বলতেই উপরের মেয়েদের আসন থেকে কার কোলের শিশু বিশ্রি তীক্ষ্ন স্বরে ট্যাঁ করে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল।
নীচে থেকে পুরুষ-দর্শকরা সচিৎকারে বলতে লাগল, ‘ওগো, ছেলে থামাও, ছেলে থামাও।’
নূরজাহান ও শের খাঁ হতাশভাবে উপরদিকে চেয়ে, বোবা কাঠের পুতুলের মতন রঙ্গমঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে রইলেন।
শিশুর কান্না ক্রমেই উঁচু পর্দায় উঠতে লাগল। নীচে থেকেই শোনা গেল, আর একটি মেয়ে বিরক্ত স্বরে বললে, ‘এ তো ভালো জ্বালা রে বাপু। ছেলেকে থামাও না গো।’
ছেলের মা বললে, ‘আমি কি ছেলেকে চিমটি কেটে কাঁদাচ্ছি? থামচে না, কী করব বল বাছা।’
‘কী আর করবে, বাইরে গিয়ে থামিয়ে এসো।’
‘ইস, বাইরে বেরিয়ে যাব। কেন, আমি কি টাকা দিয়ে থিয়েটারে আসিনি?’
তারপরেই মেয়েলি ঝগড়ার পালা আরম্ভ। সঙ্গেসঙ্গে ওদিকেও আবার এক নতুন ব্যাপার। একটা ‘বক্সে’-র দর্শকদের সর্বাঙ্গে মেয়েদের আসনের তলা থেকে খানিকটা সন্দেহকর দুর্গন্ধ জল ছড় ছড় করে পড়তে লাগল— নিশ্চয় আর এক শিশুর কীর্তি। সেখানেও আর এক নতুন গোলমালের সৃষ্টি। …অতঃপর থিয়েটারের অভিনয় হতে থাকল দর্শকদের আসনের দিকে এবং দর্শকে পরিণত হলেন শের খাঁ ও নূরজাহান।’…
আসুন, ইতিমধ্যে আমরা একবার রঙ্গমঞ্চের অন্দরে উঁকি মেরে আসি। বাইরের অধিকাংশ দর্শকের কাছেই রঙ্গমঞ্চের অন্দর হচ্ছে রহস্যময় স্বর্গপুরীর মতো— যেখানে দলে দলে উর্বশী, মেনকা, রম্ভা বিচরণ করছেন। এ স্বর্গের মধ্যে একবার প্রবেশের অধিকার পেলে অনেকেই বোধ হয় আনন্দের আবেগে পাগল হয়ে যেতে পারে। আসুন, আজ আমি আপনাদের সেই দুর্লভ সৌভাগ্য দান করব।
কিন্তু ভিতরে ঢুকলে অনেকেরই সুখস্বপ্ন বাস্তবের কঠোর আঘাতে একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে, এ কথা আগে থাকতেই বলে রাখা ভালো।
অধিকাংশ রঙ্গমঞ্চের ভিতরে পা দিলেই প্রথমে দৃষ্টিকে আহত করবে, একটা অত্যন্ত বিশৃঙ্খল গুদাম ঘরের মতো নীরস, নিরানন্দ দৃশ্য। এখানে পাশাপাশি অগণ্য দৃশ্যহীন দৃশ্যপট সাজানো রয়েছে, ওখানে রাশি রাশি দড়াদড়ি ঝুলছে, কোথাও গাদা গাদা ন্যাকড়া, পোশাক স্তুপীকৃত হয়ে আছে, কোথাও হরেকরকম টুকিটাকি জিনিসের উপর দিয়ে ধেড়ে ধেড়ে ইঁদুর ছুটোছুটি করছে। চারদিকেই একান্ত সংকীর্ণ অলিগলি, তারই মধ্যে দলে দলে লোক এ-ওকে ধাক্কা মেরে আসছে আর যাচ্ছে, মুক্ত আলো আর বাতাসের সেখানে প্রবেশ নিষেধ— দু-মিনিট দাঁড়ালেই যেন দম বন্ধ হয়ে আসে, তার উপরে সিগারেট, তামাক, রং, শিরীষের আঠা, ঘর্মাক্ত পোশাক ও স্যাঁৎ-স্যাঁতানির একটা মিশ্র দুর্গন্ধে গা যেন বমি বমি করতে থাকে। রঙ্গমঞ্চের নেপথ্যে মোটেই স্বর্গের আভাস পাওয়া যায় না।
আশপাশে ছোটো ছোটো কুঠুরি, সেগুলি ‘স্বর্গে’র অপেক্ষাকৃত উচ্চশ্রেণির বাসিন্দাদের জন্য। আর একদিকে দুটো বড়ো ঘর। তাদের মধ্যে আলনা ও দড়িতে নানারঙের অগুনতি পোশাক পরিচ্ছদ ঝুলছে। প্রত্যেক ঘরের দেয়ালের গায়ে এক-একখানা বড়ো আয়না। ঘরের ভিতর বহু ব্যবহারে বার্নিশহীন কতকগুলো টেবিল। তাদের উপরে রং, রঙের পাত্র, আরশি, চিরুনি, বুরুশ, পাউডার, রুজ, ভুরু টানবার কালির ‘স্টিক’, পরচুলো, কৃত্রিম দাড়ি-গোঁফ, আধপোড়া সিগারেট, খাবারের টুকরো, জলের গেলাস ও কানা-ভাঙা চায়ের পেয়ালা প্রভৃতি হরেকরকম জিনিস এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে পড়ে আছে, এদিকে-ওদিকে খানকয়েক টুল বা পিছন-ভাঙা চেয়ার, ঘরের মেঝেতে দেশি-বিলাতি নানান রকম জুতো, ঘরের কোণে অনেকগুলো কৃত্রিম বর্শা, লাঠি, বন্দুক বা তরোয়াল— কোনোটাই চকচকে নয়, দেয়ালে টাঙানো ঢাল ও পিতলের ঘুঙুর এমনই কত আর নাম করব। এ-দুটো ঘর হচ্ছে সাধারণ সাজঘর— একটা পুরুষদের ও একটা স্ত্রীলোকদের জন্য।
রঙ্গমঞ্চের একপাশে খানিকটা অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত জায়গা, সেখানেও কতগুলো ভাঙা চেয়ার ও বেঞ্চি সাজানো রয়েছে। তার উপরে বসে আছে কয়েক জন পুরুষ ও নারী, অধিকাংশেরই মুখে রং মাখা ও পরনে নানা ধরনের সাজসজ্জা। মাঝখানে একখানা ইজিচেয়ারে থিয়েটারের ম্যানেজার অর্ধশায়িত অবস্থায় গড়গড়ার নল মুখে দিয়ে গম্ভীর মুখে তামাক টানছেন। একপাশে মেঝেতে বসে একজন অভিনেতা নগ্নদেহে কেবলমাত্র ইজের পরে, থিয়েটারের বাঁধা নাপিতের কাছে দাড়ি কামাচ্ছে। এটি হচ্ছে ম্যানেজারের সভা। এ সভায় সর্বদাই চক্রান্ত চলছে, একে অপরের নামে লাগাচ্ছে এবং সভাপতির নামে চাটুবাদ হচ্ছে। থিয়েটারের মতো নীচতা, হীনতা ও ষড়যন্ত্রের স্থান বাংলাদেশে খুব কমই আছে। এবং এখানকার জীবগুলি যে কত সহজে ও অকারণে সত্যের অপলাপ করতে পারে তা দেখলে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়।…
রঙ্গমঞ্চের উপর থেকে নূরজাহান বিরক্ত মুখে ফিরে এসে বললেন, ‘আজকের অডিয়েন্স বড়ো খারাপ। খালি গোলমাল করচে, আমাকে ”ক্ল্যাপ” দিলে না।’
বেঞ্চির উপরে মিস কিরণ বসে একহাতে ঠোঙা নিয়ে, ডান হাতে করে একখানা হিঙের কচুরি খাচ্ছিল। সে ‘নূরজাহান’-এর চেয়ে সুন্দরী এবং তার অত্যন্ত ইচ্ছা ছিল যে, নূরজাহানের ভূমিকাটি নিয়ে সে অবতীর্ণ হবে। কিন্তু ম্যানেজারের পক্ষপাতিতায় তার সে আশায় ছাই পড়েছে। ‘নূরজাহান’ যে আজ রঙ্গমঞ্চে গিয়ে সুখ্যাতি পায়নি, মিস কিরণ এতে ভারি খুশি হয়েছে। এখন নূরজাহানের নিরাশার কথা শুনে ও বিরক্তির ভাব দেখে সে মুখ টিপে টিপে হাসতে লাগল।
নট-নটীর উপরে ম্যানেজারের প্রভুত্ব যে কী প্রচণ্ড, বাইরের লোক সে খবর রাখে না। ম্যানেজারের ইচ্ছা এখানে নেপোলিয়নের হুকুমের মতো অবাধ। তিনি খুশি থাকলে অযোগ্যও ‘পার্ট’ পাবে, তিনি চটলে যোগ্যের যোগ্যতাও কোনো কাজে লাগবে না। ম্যানেজাররা প্রায়ই তাঁদের প্রভুত্বের অসদব্যবহার করে থাকেন। আমি জনৈক ভূতপূর্ব ম্যানেজারকে জানি, অন্তত একবারও যাঁর শয্যাসঙ্গিনী না হলে কোনো অভিনেত্রীর ‘পার্ট’ পাবার আশা থাকত না। এরকম আরও কত লোক থিয়েটারে আছে, কে তা জানে?
‘নূরজাহান’ও হয়তো এমনি কোনো গুপ্ত উপায়ে জনসাধারণের সামনে আবির্ভূত হবার সুযোগ পেয়েছে। তাই মিস কিরণের হাসি আর নূরজাহানের সহ্য হল না, রেগে গস গস করতে করতে সে সাজঘরের ভিতরে গিয়ে ঢুকল এবং একখানা চেয়ারের উপর গিয়ে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললে।
ওদিকে এককোণে ওই যে স্ত্রীলোকটি আরশির সামনে বসে, মুখে রং মাখবার উপক্রম করছে, ওকে চেনেন কি? ওর কোকিলের মতো রং, টাকপড়া মাথা, বসন্তের ছররা-মারা মুখ ও বাঁখারির মতো হাত-পা দেখে শিউরে উঠবেন না— কারণ ও হচ্ছে সেই ‘কোকিলকণ্ঠী পরমাসুন্দরী’ গায়িকা বিনোদিনী৯.৬, শহুরে বাবুরা ও মাড়োয়ারির দল যার বাড়ির ঠিকানা পাবার জন্য লালায়িত হয়ে আছে। একটু সবুর করুন, তাহলেই দেখবেন সাজঘরের অপূর্ব মহিমায় ওর চেহারা তিলোত্তমার মতোই শোভনীয় হয়ে উঠেছে।
থিয়েটারি সৌন্দর্যমাত্রই এই জাতীয়। নিখুঁত রূপ এখানে তো নেই-ই, এমনকী চলনসই সুন্দরী পর্যন্ত এখানে থাকে না— থাকতে পারে না। কারণ রঙ্গমঞ্চের উপরে কালেভদ্রে একজন রূপসির আবির্ভাব ঘটলেই দর্শকদের মধ্যে থেকে নিশ্চিন্তরূপে তার রূপের পূজারি কাপ্তেন একাধিক সংখ্যায় আত্মপ্রকাশ করে এবং দু-দিন পরেই সে রূপসির আর কোনো পাত্তা পাওয়া যায় না। খোঁজ নিলে জানা যাবে, সে এখন অমুক বাবুর ‘বাঁধা’, আর থিয়েটার করবে না। কাজেই এই রঙ্গ-বিশ্বের প্রাকৃতিক দৃশ্য, ঘর-বাড়ি-শহর, সাজ-পোশাক ও আসবাব-পত্তরের মতো মানুষগুলির সৌন্দর্য ও একান্ত কৃত্রিম এবং রঙ্গমঞ্চ ছাড়া ত্রিভুবনের আর কোথাও তাদের সার্থকতা নেই। অতএব যাঁরা সন্দেহ করেন যে এই তথাকথিত স্বর্গের মধ্যে যথার্থই উর্বশী, মেনকা, রম্ভা প্রভৃতি বাসা বেঁধে আছেন, আমি শপথ করে বলতে পারি, তাঁদের সন্দেহ সম্পূর্ণ অমূলক।
একদল সখী নাচতে নাচতে ‘উইংসে’র ভিতর দিয়ে রঙ্গমঞ্চের প্রকাশ্য অংশের দিকে যাচ্ছে। ‘উইংসে’র ভিতরেই একটি লোক বসে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে এবং প্রত্যেক সখী যেই তার কাছ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, সে অমনি মৃদুস্বরে তার সঙ্গে রসিকতা করে নিচ্ছে।
হাস্যরসাবতার মোনাবাবু আর একজোড়া ‘উইংসে’র মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটি হৃষ্টপুষ্ট রূপসির সঙ্গে চুপিচুপি কথা কইছেন, তার নাম ‘বোঁচাখুকি’। এই বোঁচাখুকির উপরে মোনাবাবুর সুনজর অনেক দিন থেকেই আছে, কিন্তু বোঁচাখুকি কিছুতেই তাকে আমল দিতে রাজি নয়। সৌভাগ্যক্রমে আজকের নাটকে মোনাবাবু পেয়েছেন স্বামীর ও বোঁচাখুকি পেয়েছে স্ত্রী-র ভূমিকা। মোনাবাবু তাই আজ বোঁচাখুকিকে নির্জনে টেনে নিয়ে বোঝাতে প্রবৃত্ত হয়েছেন যে, তোমাতে আমাতে আজ এই যে সম্পর্ক হল, এবার থেকে এই সম্পর্কই যেন বরাবর বজায় থাকে।
বোঁচাখুকি চোখ মটকে বললে, ‘আ মরে যাই। আমার কাছে কেন, বাজারে কি দড়ি-কলসি জোটে না?…’
আর এক প্রান্তে একদল যুবক— অধিকাংশেরই চেহারা অগাখেকো বগাখেকো— বসে দাঁড়িয়ে কয়েক জন সমান চেহারার পাঁচ দশ পনেরো টাকা মাইনের সখীর সঙ্গে গোপনে হাসি-মশকরা করছে, ম্যানেজারের নজর তাদের উপরে আছে কি না। এরা হচ্ছে ‘অ্যাপ্রেন্টিস’-এর দল।
এরা মাইনে পায় না, অনেকের পাবার আশাও নেই। রঙ্গমঞ্চের নির্বাক জনতার দৃশ্যে কিংবা রণক্ষেত্রের কাটা-সৈনিকের ভূমিকায় এরা আবির্ভূত হয়— পেটে এদের বোমা মারলেও ‘ক’ অক্ষর নির্গত হওয়া অসম্ভব। মাইনে না পেলেও, সখীদের সঙ্গে লুকিয়ে ফষ্টিনষ্টি করবার নিষিদ্ধ অধিকার পেয়েই এই জীবগুলি তুষ্ট হয়ে থাকে— যদিও এদের অবস্থা এখানে অত্যন্ত শোচনীয়, কারণ এখানকার টিকটিকিগুলো পর্যন্ত এদের উপরে চোখ রাঙিয়ে তম্বি করতে ছাড়ে না।
রঙ্গমঞ্চের ভিতরের ‘ফোটো’ আমরা দিলুম এ দেখে কি আপনাদের স্বর্গ বলে ভ্রম হচ্ছে? এখানে বলবার কথা আরও অনেক আছে, কিন্তু আপাতত এই নমুনা দেখেই সকলে তুষ্ট থাকুন।
বাইরে, রঙ্গালয়ের দর্শকরা তখন দীর্ঘকাল চিৎকার ও গোলমাল করে শ্রান্ত ও স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। রঙ্গমঞ্চের উপরে নূরজাহান, জাহাঙ্গীর ও সভাসদরা বারংবার আনাগোনা করছেন, কিন্তু কেউ আর কিছুমাত্র আপত্তি বা উৎসাহ প্রকাশ করছে না। কোনো কোনো দর্শক চেয়ারে বসে আছে বটে, কিন্তু তার নাসিকা সংগীত যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এক-একজন ঘুমন্ত দর্শকের মাথা তার পার্শ্ববর্তী দর্শকের কাঁধের উপর লুটিয়ে আছে। পাশের দর্শক বিরক্ত হয়ে যত বেশি সরে যাচ্ছে, ঘুমন্ত লোকটির মাথাও তত বেশি এগিয়ে লুটিয়ে পড়ছে।… কেবলমাত্র ‘পিট’ ও ‘গ্যালারি’র দর্শকরা তখনও একেবারে মুশড়ে পড়েনি। সখীদের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই তারা চঞ্চল ও মুখর হয়ে উঠছে। নট-নটীরা যখন জমাতে পারলে না, তখন দর্শকরাই শিস বা হাততালির সঙ্গে টিপ্পনী কেটে আসর গরম না রাখলে আর উপায় কী? সাধারণত বাংলা থিয়েটারি বিজ্ঞাপনে যে গ্র্যান্ড ‘সাকসেসে’র কথা পড়া যায়, সেই ‘সাকসেস’ আসে নট-নটীর পক্ষ থেকে নয়, ওই ‘গ্যালারি’র অন্ধকূপের গর্ভ থেকেই। থিয়েটারের লক্ষ্মী বাস করেন ওই গ্যালারির মধ্যেই— যেখানে ‘ফ্রি পাসের’ উপদ্রব নেই।
***
টীকা
৯.১ রঙ্গালয়— ১৮৭২ সালের ৭ই ডিসেম্বর। বাগবাজারের কতিপয় নাট্যামোদী যুবক সেদিন এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটিয়ে ফেললেন। বাংলা থিয়েটারের সেদিন থেকে শুরু হল এক নতুন গন্তব্যে পথচলা। পেশাদার রঙ্গালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল বাংলা থিয়েটার।
কলকাতায় বাংলা নাট্যশালার জন্ম হয়েছিল ১৭৯৫ সালে। সে নাট্যশালার জন্ম দিয়েছিলেন একজন রাশিয়ান মানুষ, হেরাসিম লেবেদেফ। যিনি পর্যটক হিসেবে কলকাতায় এসেছিলেন ১৭৮৫ সালে। সদ্য শতবর্ষ অতিক্রান্ত কলকাতা শহরবাসীকে তিনি উপহার দিলেন বাংলা নাটক। তিনি দুটো বিদেশি নাটকের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। একটা The disguise, বাংলা রূপান্তরে নাম হয়েছিল ‘কাল্পনিক সংবদোল’। আর-একটি Love is the best doctor। প্রথম নাটকটির দুটি অভিনয় হয়েছিল বলে শোনা যায়। সে থিয়েটার টিকিট কেটে দেখতে হয়েছিল। এবং তাতে বাঙালিরাই অভিনয় করেছিলেন, এবং নাটকের স্ত্রী-চরিত্রেও অভিনয় করেছিলেন বাঙালি মহিলারাই। এই নাট্যশালার ঠিকানা ছিল ২৫ নম্বর ডোমতলা, আজ যেটা এজরা স্ট্রিট। তাঁকে এ কাজে সাহায্য করেছিলেন গোলোকনাথ দাস নামে এক বাঙালি। ভাবা যায়, কলকাতার বুকে বাংলা নাটকের জয়যাত্রা শুরু হল যার হাত ধরে, তিনি বাঙালি তো ননই, ভারতীয়ও নন! সেসময় কলকাতায় থিয়েটার বলতে ছিল ব্রিটিশদের থিয়েটার। মনে করা হয় ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকেই লেবেদেফের থিয়েটারে আগুন লাগানো হয়েছিল। এই অগ্নিকাণ্ডে সবকিছু ভস্মীভূত হয়ে যায়, প্রচুর দেনা হয়ে যায় তাঁর, শেষে তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। একটা উজ্জ্বল অধ্যায়ের শুরুতেই ঘটে যবনিকাপতন।
বাঙালির উদ্যোগে তৈরি প্রথম নাট্যশালা ১৮৩১ সালে প্রসন্নকুমার ঠাকুরের হিন্দু থিয়েটার। তাঁর নারকেলডাঙা বাগানবাড়িতে ছিল এই রঙ্গমঞ্চ, কিন্তু সেখানে কোনও বাংলা নাটকের অভিনয় হয়নি। ১৮৩৫ সালে শ্যামবাজারে নবীনচন্দ্র বসুর থিয়েটারে বাঙালির উদ্যোগে প্রথম বাংলা নাটক অভিনীত হয়। তাঁর পরিচালিত এই বিদ্যাসুন্দর নাটকে স্ত্রী-চরিত্রে নারীরাই অভিনয় করেছিলেন।
লেবেদেফের পর অনেকদিন বাংলা নাটক অভিনীত হয়েছে ধনী ব্যক্তিদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায়। এসব থিয়েটারের দর্শকরা ছিলেন প্রায় সকলেই অভিজাত শ্রেণির এবং সকলেই আমন্ত্রিত। সাধারণ মানুষের সেখানে অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল না। এমনই এক অভিজ্ঞতার পর কিছু মধ্যবিত্ত যুবক স্থির করেন, থিয়েটারকে আর ধনীগৃহের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে পৌঁছে দিতে হবে সকলের মধ্যে। তাঁদের একজন গিরিশচন্দ্র ঘোষ। তিনি পরামর্শ দিলেন, মাইকেলের (মাইকেল মধুসূদন দত্ত) কথামতো সবাই মিলে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা তোলার চেষ্টা করো। তাঁরা প্রথমেই যান পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরপরিবারের সুযোগ্য সন্তান নাট্যামোদী যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বাড়ি। ইতিমধ্যে যতীন্দ্রমোহনের উদ্যোগে পাথুরিয়াঘাটার টেগোর ক্যাসেলে ১৮৫৯ সালের জুলাই মাসে মহাকবি কালিদাসের সংস্কৃত নাটক মালবিকাগ্নিমিত্রম মঞ্চস্থ হয়েছে। কিন্তু চাঁদার কথা শুনে চাঁদাসংগ্রহকারীদের উদ্দেশে কিছু ব্যঙ্গোক্তি করলেন যতীন্দ্রমোহনের ভগ্নীপতি নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। খালি হাতেই ফিরতে হল তাঁদের। আরও কয়েকজন ধনী ব্যক্তির কাছে যাওয়া হল চাঁদার জন্য। কিন্তু তাতে বিশেষ কিছু লাভ হল না। শেষে ঠিক হল বড়োলোকদের কাছে আর হাত না পেতে বরং পাড়ার গৃহস্থদের কাছে যাওয়াই ভালো। আর পাশাপাশি উদ্যোক্তারা ঠিক করলেন নিজেরাই সাধ্যমতো টাকা দিয়ে তাঁদের স্বপ্নটাকে সাকার করে তুলবেন। এইভাবে সর্বসাকুল্যে আদায় হল মাত্র আড়াইশো টাকা।
অনেক বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে দৃশ্যপট আঁকা আর প্ল্যাটফর্ম তৈরির কাজ যখন অর্ধেক এগিয়েছে, তখন খবর পাওয়া গেল কে যেন এইসব আগুনে পুড়িয়ে দেবার চক্রান্ত করেছে। তখন ধর্মদাস সুরের পরামর্শে সবকিছু খুলে শ্যামবাজারে রাজেন্দ্রনাথ পালের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। ঠিক হল রাজেন্দ্রনাথের বাড়ির উঠোনেই মঞ্চ বেঁধে থিয়েটার হবে। এই সময় চুঁচুড়ায় দীনবন্ধু মিত্রের ‘লীলাবতী’ নাটকের অভিনয় হল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও অক্ষয়চন্দ্র সরকারের উদ্যোগে। তবে সে নাটকে কাটাছেঁড়া করেছেন স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র ও অক্ষয়চন্দ্র। তা বিশেষ মনঃপূত না হলেও মেনে নিয়েছিলেন নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র। বাগবাজারও সেই সময়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিল একই নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য। ১৮৭২ সালের ১১ই মে রাজেন্দ্রনাথের বাড়ির উঠোনে অভিনীত হল লীলাবতী। সেদিন বৃষ্টিতে সবকিছু ভিজে গেলেও ভেজা চেয়ারে বসেই দর্শকরা লীলাবতীর অভিনয় দেখলেন। যদিও নিমন্ত্রিত ছাড়া খুব কম সংখ্যক মানুষই লীলাবতী দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। অনেকেই হতাশ হয়ে ফিরে যান। নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র খুব খুশি হয়ে গিরিশচন্দ্রকে জানান, তাঁদের অভিনয়ের সাথে চুঁচুড়ার অভিনয়ের কোনও তুলনাই হয় না, তিনি চিঠি লিখবেন ‘দুয়ো বঙ্কিম’ বলে। পরপর তিন শনিবার একই জায়গাতে ‘লীলাবতী’ অভিনয় হয়েছিল। সেই সময় বাগবাজারের দলের নাম ছিল, শ্যামবাজার নাট্যসমাজ। ‘লীলাবতী’ অভিনয়ের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। এতে উৎসাহ আরও বেড়ে গেল সকলের। শুরু হল দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের মহলা। এবার স্থির হল, টিকিট বিক্রি করে তৈরি হবে স্থায়ী নাট্যশালা। আর নতুন নাট্যশালার নাম হবে, ন্যাশনাল থিয়েটার। কিন্তু গিরিশ ঘোষ বেঁকে বসলেন। তিনি ন্যাশনাল থিয়েটারের উপযুক্ত সাজসরঞ্জাম ছাড়া সাধারণের কাছে টিকিট বিক্রি করার পক্ষপাতী নন। শেষে ‘নীলদর্পণ’ নাটকের মহলা শুরু হল ভুবনমোহন নিয়োগীর বাড়ির দোতলার হলঘর আর একটা ছোটো কুঠুরিতে। একটা টেবিল হারমোনিয়ামও দিলেন তিনি। অবশেষে কতিপয় জেদি বাগবাজারের যুবকের অদম্য ইচ্ছে পূরণ হল। চিৎপুরের মধুসূদন সান্যালের বাড়ির উঠোন ভাড়া নেওয়া হল মাসিক চল্লিশ টাকার বিনিময়ে। যে বাড়িটা আজ রবীন্দ্র সরণিতে ঘড়িওয়ালা মল্লিক বাড়ি নামে পরিচিত। সেখানেই মঞ্চ তৈরি হল। বিজ্ঞাপনও দেওয়া হল নীলদর্পণ নাটকের। টিকিট বিক্রি করে উপার্জন হয়েছিল দুশো টাকা। এ নাটকে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফী একাই চারটি ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এ ছাড়া ছিলেন মতিলাল সুর, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অবিনাশ চন্দ্র কর, অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়, অমৃতলাল বসু ও মহেন্দ্রলাল বসু। এভাবেই শুরু হয়েছিল মৌলিক বাংলা নাটকের পেশাদার অভিনয়ের জয়যাত্রা।
কিন্তু গিরিশচন্দ্র এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেননি। তিনি ‘নীলদর্পণ’ নাটকের অভিনয়কে সমালোচনা করে ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকায় দুটি চিঠি (১৯ এবং ২৭শে ডিসেম্বর, ১৮৭২) লেখেন। এ ছাড়াও তিনি অভিনেতাদের নামে শ্লেষাত্মক ছড়াও লিখেছিলেন।
৯.২ বিদ্যাসুন্দর— বিদ্যাসুন্দর মধ্যযুগের একখানা প্রণয়কাব্য; বিদ্যা ও সুন্দরের প্রণয়কাহিনী এর উপজীব্য। কাব্যটির উৎস এগারো শতকের সংস্কৃত কবি বিলহনের চৌরপঞ্চাশিকা। রূপবান ও গুণবান রাজকুমার সুন্দর কালিকাদেবীকে আরাধনায় তুষ্ট করে সুন্দরী বিদুষী রাজকন্যা বিদ্যার পাণিলাভের বর পায়। পরে দেবীপ্রদত্ত শুকপাখি নিয়ে সুন্দর বিদ্যার পিতৃরাজ্যে উপস্থিত হয়। রাজপ্রাসাদের মালিনীর মাধ্যমে চিত্র ও প্রণয়লিপি প্রেরণ করে সুন্দর বিদ্যাকে আকৃষ্ট করে এবং তাদের প্রণয় ঘটে। পরে সুড়ঙ্গপথে সুন্দর বিদ্যার শয়নগৃহে প্রবেশ করে এবং তাদের মিলন হয়। ক্রমে বিদ্যার শরীরে গর্ভলক্ষণ ফুটে উঠলে রাজা ক্রুদ্ধ হন এবং সুন্দরকে শূলদণ্ডের আদেশ দেন। সুন্দর তখন স্তব দ্বারা দেবীকে পুনরায় তুষ্ট করে প্রাণে রক্ষা পায় এবং বিদ্যাকে লাভ করে। বিদ্যা ও সুন্দরের এই প্রেমকাহিনি অবলম্বনে প্রথমে বাংলা ভাষায় কাব্য রচনা করেন ষোলো শতকের কবি শাহ বিরিদ খান ও দ্বিজ শ্রীধর। পরে কৃষ্ণরাম, বলরাম, কবিশেখর, রামপ্রসাদ সেন, ভারতচন্দ্র রায় প্রমুখ এ ধারায় কাব্য রচনা করে যশস্বী হন। তবে এঁদের মধ্যে ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দরই কাব্যগুণে শ্রেষ্ঠ।
৯.৩ এম্পায়ার থিয়েটার— ১৯০৮-০৯ সালে অপেরা হাউজ হিসেবে পথ চলা শুরু করেছিল রক্সি। কিন্তু চারের দশকের শুরুতেই তার রূপ পরিবর্তন করা হয় সিনেমা হলে। রক্সিতে প্রদর্শিত প্রথম ছবি ছিল অশোককুমার অভিনীত ‘নয়া সংসার’। ১৯৪৩ সালের ছবি ‘কিসমৎ’ ১৮৬ সপ্তাহ ধরে চলেছিল রক্সিতে। এ ছবির প্রধান চরিত্রেও ছিলেন তৎকালীন সুপারস্টার অশোককুমার এবং এই ছবি দেখতে গিয়েছিলেন স্বয়ং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। চৌরঙ্গী প্লেস-এর ৪-বি প্লটের উপর তৈরি করা হয়েছিল রক্সি হলটি। তখন তার নাম ছিল ‘এম্পায়ার থিয়েটার’। বর্তমানে রক্সি ও তার পাশের ৪-এ, দুটো প্লটের মালিকানা রয়েছে ‘বেঙ্গল প্রপারটিজ প্রাইভেট লিমিটেড’-এর হাতে।
৯.৪ কনসার্ট— নাটক শুরুর আগে নানান বাদ্যযন্ত্র বাজানো হত, যতক্ষণ না থার্ড বেল পড়ে। একেই কনসার্ট বলা হত।
৯.৫ এঙ্কোর— অভিনয় নৃত্যগীত প্রভৃতি শিল্পকলা আবার দেখাবার বা শোনাবার জন্য অনুরোধ; আবার আবার; মূল ফরাসি উচ্চারণ অঁকর্। কিন্তু শব্দটির ইংরেজি উচ্চারণ অনুসারে এনকোর বাংলায় প্রচলিত হয়েছে।
৯.৬ বিনোদিনী— ১৮৬৩ সালে জন্মের পর তাঁর ঠিকানা ছিল ১৫৪ নং কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট। মা-দিদিমার তত্ত্বাবধানে বড়ো হওয়া। অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থা ছিল তাঁদের। খোলার চালের বাড়ি, তারই দু-একটি ঘর আবার ভাড়া দেওয়া অন্নসংস্থানের জন্য। পুঁটি নামে ডাকত সবাই ফুটফুটে ছোট্ট মেয়েটিকে। মা ভাই আর দিদিমাকে নিয়ে সংসার। ঘরভাড়া আর মা-দিদিমার সামান্য অলংকার, এই ছিল আয়ের পথ। দিদিমা তারই মধ্যে পুঁটির বিয়ে দিয়ে দিলেন তারই খেলার সাথির সঙ্গে। কিন্তু সে বিয়ে স্থায়ী হল না। পুঁটির স্বামীকে তার বাড়ির লোকেরা নিয়ে চলে গেল। পুঁটিকে ভরতি করা হল কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটের অবৈতনিক স্কুলে— নাম লেখানো হল বিনোদিনী দাসী।
পুঁটি থেকে বিনোদিনীতে রূপান্তরিত হওয়া শুরু হল সেই মুহূর্ত থেকে। পড়াশোনাতে তার মেধার পরিচয় পাওয়া এক আশ্চর্য কথাই! পরিবেশ তো অনুকূল ছিল না। গানের গলাও ছিল অদ্ভুতরকমের ভালো। বিনোদিনীর বাড়িতে গঙ্গাবাই নামে এক গায়িকা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন মাঝে মাঝে। বয়সে বিনোদিনীর থেকে অনেক বড়ো। তাও বিনোদিনী তার সঙ্গে সই পাতাল, গোলাপফুল বলে ডাকত তাকে। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুঝতে না পেরে বিনোদিনীর মা দিদিমা এই গঙ্গাবাইয়ের কাছেই গান শিখতে দিলেন তাকে। আশ্চর্য দরদভরা কণ্ঠ, সুর লয় তালের জ্ঞান যেন এই মেয়ের সহজাত। অল্প কদিনেই সে আয়ত্ত করে নিল সুমধুর সব গান।
এদিকে গঙ্গাবাইয়ের ঘরে গানের আসর বসত প্রায়ই। আসতেন তখনকার সমাজের গানের সমঝদার জ্ঞানীগুণীরা। বিনোদিনীর এই গান গাইবার ক্ষমতা পালটে দিল তাঁর জীবন। দারিদ্র্যদোষ যেমন তাঁর জীবন পরিবর্তনের অন্যতম কারণ, আর-এক কারণ গঙ্গাবাই। তখনকার সমাজে আসরে গান গাইতেন বারাঙ্গনারাই। গঙ্গাবাইয়ের আসরে আসতেন পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায় আর ব্রজনাথ শেঠ। তাঁরা বিনোদিনীকে ভরতি করে দিলেন ‘গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে’, দশ টাকা বেতনে। মহেন্দ্রলাল বসুর উপর তাঁকে শেখানোর ভার পড়ল। পরে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফী, অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়- নাট্যজগতের এইসব দিকপালেরা তাঁর শিক্ষার ভার নিলেন। ১৮৭৪ সালের ১২ই ডিসেম্বর মাত্র ১১ বছর বয়সে দু-চারটি মাত্র সংলাপের মাধ্যমে অভিনয় করলেন ‘শত্রুসংহার’ নাটকে। মাত করে দিলেন দর্শককুল ও নাট্যজগৎকে। বিনোদিনী তাঁর আত্মজীবনীতে এই অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়েছেন। পরের নাটকে নামলেন নায়িকার ভূমিকায়, বয়স এত কম হওয়া সত্ত্বেও। (সেই সময়ে অভিজাত ঘরের মেয়েরা নাটক-যাত্রায় অংশগ্রহণ করতেন না, তাই থিয়েটারকে বারাঙ্গনাপল্লি থেকেই স্ত্রী-ভূমিকার জন্য মেয়ে জোগাড় করতে হত।) বিনোদিনী লিখেছেন, ‘আমাকে সাজাতে বেশকারীর পরিশ্রমের অন্ত ছিল না, ছোট ছিলাম তো, কিন্তু সাজতে হত যুবতী।’
তারপর থেকেই অবিসংবাদিত নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় ও প্রতিভাবলে স্বর্ণশিখরে আরোহণ। ১৮৭৫ সালে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার উত্তর ভারত ভ্রমণে বেরোয়। বিনোদিনীই ছিলেন দলের প্রধান অভিনেত্রী। ‘নীলদর্পণ’ নাটক শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বিনোদিনী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখে গেছেন সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের কথা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সরোজিনী’ নাটকে বিনোদিনীর অভিনয় আর-এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। ১৮৭৬-এর ডিসেম্বরে তিনি গ্রেট ন্যাশনাল ছেড়ে ‘বেঙ্গল’ থিয়েটারে যোগ দিলেন। ১৯ মাস কাজ করেছিলেন এই দলে। এই সময়কালের অভিনয়ই তাঁকে থিয়েটারে উচ্চাসনে বসাল। তাঁর জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ও রচিত হল এই সময়েই। ১৩ বছর বয়সকে একালে আমরা বলি ‘টিন এজ’, কিশোরী থেকে যুবতিতে রূপান্তরিত হবার প্রথম ধাপ। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর মনস্কতায় তিনি তখন পূর্ণযুবতি। গাম্ভীর্য ও ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী বিনোদিনী অন্তর্দ্বন্দ্বে বিদীর্ণ চরিত্রগুলিকে বোঝার ক্ষমতা যেমন সহজাত বুদ্ধিতে আত্মস্থ করেছিলেন, তেমন অভিনয়দক্ষতায় পরিপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন সেইসব চরিত্রগুলিকে। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের নায়িকা চরিত্রগুলিতে তিনিই অভিনয় করেছেন। তখন তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন শরচ্চন্দ্র ঘোষ। নিজেকে সম্পূর্ণ করে মেলে ধরার সুযোগ পেলেন এখানে, নাটক যে কেবল প্রমোদের উপকরণ নয় তা বুঝতে শিখলেন এখানেই। এই দলে নাটকের মহড়ায় আসতেন সমসাময়িক গুণীজনেরা। সেই সাংস্কৃতিক পরিবেশ বিনোদিনীকে যে প্রভাবিত করেছিল, তার প্রমাণ তাঁর চরিত্রাভিনয়।
তাঁর বেঙ্গল থিয়েটার ছাড়ার কারণ ছিলেন গিরিশ ঘোষ। ‘কপালকুণ্ডলা’ নাটক দেখতে এলেন ন্যাশনাল থিয়েটারের মালিক কেদারনাথ চৌধুরি, সঙ্গে গিরিশ ঘোষ। মুগ্ধ ও বিস্মিত গিরিশ ঘোষ বিনোদিনীকে নিয়ে এলেন ন্যাশনাল থিয়েটারে, ১৮৭৭ সালে।
ন্যাশনাল থিয়েটারে আসার পর বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের সর্বত্র তাঁর অভিনয়প্রতিভা স্বীকৃতি পায়। তিনি হয়ে উঠলেন নাট্যসম্রাজ্ঞী। ‘মৃণালিনী’ নাটকে ‘মনোরমা’ চরিত্রে তাঁর অভিনয় দেখে স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, ‘আমি মনোরমার চিত্র পুস্তকেই লিখিয়াছিলাম, কখনো যে প্রত্যক্ষ দেখিব এমন আশা করি নাই। আজ বিনোদের অভিনয় দেখিয়া সে ভ্রম ঘুচিল।’ ন্যাশনাল থিয়েটারে বিনোদের শিক্ষাগুরু হলেন এবার স্বয়ং গিরিশ ঘোষ। বিনোদের বাড়িতে আলোচনার আসরে আসতেন গিরিশ ঘোষ, অমৃতলাল বসু, অমৃতলাল মিত্র। আলোচিত হত বিলেতের অভিনেত্রীদের অভিনয়কৌশল থেকে শেক্সপিয়র-মিলটন-বায়রন-পোপ প্রমুখ কবিদের কাব্য।
উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো বিনোদিনীর আলো বিচ্ছুরিত হয়েছিল টানা বারো বছর ধরে। তারপর কালের করাল দংশন পড়তে আরম্ভ করল বিনোদিনীর অভিনয়জীবনে। নানা কারণে অবস্থার বিপাকে পড়ে কেদারনাথ চৌধুরি ন্যাশনাল থিয়েটার বিক্রি করতে বাধ্য হন। দু-তিনবার হাতবদল হয়ে প্রতাপচাঁদ জহুরী কিনলেন ন্যাশনাল। গিরিশ ঘোষকে অধ্যক্ষ করা হয়। শুরু হয় আদ্যন্ত ব্যবসায়িক থিয়েটারের যুগ।
একবার পনেরো দিনের ছুটিতে কাশী গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে বিনোদিনী এক মাস অভিনয়ে যোগ দিতে পারেননি। সেই মাসের বেতন কেটে নেন প্রতাপচাঁদ। আত্মসম্মানী বিনোদিনী তখনই থিয়েটার ছেড়ে দিতে চাইলে গিরিশ ঘোষ ও অন্যরা নিজেদের থিয়েটার তৈরির কথা বলে তাঁকে শান্ত করেন। নিজেদের থিয়েটার তৈরি করার জন্য তাঁরা আশ্রয় করলেন গুর্মুখ রায় নামে এক ধনী যুবককে। বিনোদিনীকে পাওয়ার বিনিময়ে তিনি রাজি হন থিয়েটার গড়ার টাকা দিতে। গিরিশ ঘোষ ও অন্যান্যদের বারবার প্ররোচনায় এই প্রস্তাবে সম্মত হলেন বিনোদিনী। বিডন স্ট্রিটে জমি নেওয়া হল। স্থির হয় ‘বি থিয়েটার’ নামে রেজিস্ট্রি হবে থিয়েটার। কিন্তু রেজিস্ট্রির পর বিনোদিনী জানলেন থিয়েটারের নাম হয়েছে ‘স্টার থিয়েটার’। বারাঙ্গনার নামে থিয়েটার খুলতে রাজি হননি নাট্যজগতের মানুষেরাই।
১৮৮৩ সালের ২১শে জুলাই স্টার থিয়েটারের উদ্বোধন হল ‘দক্ষযজ্ঞ’ নাটক দিয়ে। সতীর ভূমিকায় বিনোদিনীর অভিনয় সকলকে অভিভূত করে। ১৮৮৩ সালের শেষ পর্যন্ত গুর্মুখ স্টারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ‘নলদময়ন্তী’-তে দময়ন্তী ও ‘ধ্রুবচরিত্র’-তে সুরুচির ভূমিকায় বিনোদিনীর অভিনয় আবারও প্রমাণ করল তাঁর অভিনয়দক্ষতা। কিন্তু আবার দুর্যোগের ঘনঘটা! অসুস্থ গুর্মুখ পরিবারের চাপে পড়ে স্টারের স্বত্ব বিক্রি করতে মনস্থ করেন। তিনি বিনোদিনীকে অংশীদার করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বারাঙ্গনার অধীনে কাজ করতে আপত্তি উঠল নাট্যসমাজ থেকেই! গিরিশ বিনোদিনী ও তাঁর মাকে স্বত্ব গ্রহণ না করতে রাজি করালেন। স্টারের স্বত্বাধিকারী হলেন অমৃতলাল মি, দাশুচরণ নিয়োগী, হরিপ্রসাদ বসু ও অমৃতলাল বসু।
স্টারে তখন অভিনীত হচ্ছে ‘চৈতন্যলীলা’। বিপুল আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই নাটকটি ১৮৮৪-র ২রা আগস্ট প্রথম অভিনীত হয়। চৈতন্যের ভূমিকায় বিনোদিনীর অভিনয় দেখে ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছিলেন “আসল নকল এক দেখলাম।” শ্রীরামকৃষ্ণের স্পর্শে গ্লানিহীন, কলুষমুক্ত হলেন বারাঙ্গনা, সঙ্গে বাংলার রঙ্গালয়ও অশুচিমুক্ত হল। স্টারে বিনোদের শেষ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ‘বিল্বমঙ্গলের’ চিন্তামণি। সেই সময়েই সঙ্গীসাথিদের সঙ্গে বিনোদিনীর বিরোধ আরম্ভ হয়। অনেকসময় স্টারের জন্য তাঁর আত্মত্যাগের কথা মুখ ফুটে বলে ফেলতেন— তাই বিরোধ। সহকর্মীরা এটাকে বারাঙ্গনার ধৃষ্টতা বলে মনে করতেন। গিরিশ ঘোষ এসব ব্যাপারে একেবারে নিস্পৃহ ভাব দেখাতেন। এই অপমান বিনোদ কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। একপ্রকার বাধ্য হয়ে ১৮৮৭-র ১লা জানুয়ারি ছেড়ে দিলেন থিয়েটার। তাঁর অভিনীত শেষ নাটক ‘বেল্লিক বাজার’।
বিনোদিনী লিখেছেন, “থিয়েটার ভালোবাসিতাম, তাই কার্য করিতাম, কিন্তু ছলনার আঘাত ভুলিতে পারি নাই। তাই সুযোগ বুঝিয়া অবসর বুঝিয়া লইলাম।বিনোদিনীর ভাষা লক্ষ করার মতো! কতটুকুই বা পড়াশোনা করেছিলেন তিনি! নিজের বারাঙ্গনা পরিচয়কে কোনোদিন তিনি অস্বীকার করেননি। কিন্তু মর্যাদাহীন জীবনকে সম্মানের শিখরে নেবার সাধনা তিনি করেছিলেন তাঁর সারস্বত সম্পদের নৈবেদ্য সাজিয়ে। লিখেছিলেন দুটি আত্মজীবনীমূলক বই- ‘আমার কথা’, ‘আমার অভিনেত্রী জীবন’। যদিও দ্বিতীয়টি তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। তাঁর এই আত্মজীবনীমূলক লেখা তত্কালীন বাংলার সমাজ ও বাংলা থিয়েটারের এক ঐতিহাসিক দলিল- যার ভাষাও ছিল অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল। তাঁর রচিত দুটি কবিতার বই—’বাসনা’ ও ‘কনকনলিনী’। তাঁর সময়েই বাংলা রঙ্গজগৎও রূপান্তরিত হয়েছিল মুক্তমঞ্চের যাত্রা ঢং-এর অভিনয় থেকে মঞ্চে পর্দা সহ ইউরোপিয়ান বৈশিষ্ট্যের অভিনয়ের দিকে। বিনোদিনীই ভারতীয় বা দেশজ সাজসজ্জার সঙ্গে ইউরোপীয় সাজসজ্জার (make up) সংমিশ্রণ করেন, যদিও তাঁর সামনে কোনও রোল মডেল ছিল না। Moon of The Star, Flower of the Native Stage, এইসব বিশেষণে ভূষিতা হয়েছিলেন তিনি। তবুও মাত্র ২৩ বছর বয়সে অভিনয়জীবনের মধ্যগগনে পৌঁছে তাঁকে ছাড়তে হল তাঁর ভালোবাসার পেশা ও জীবন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের অনেকটাই পর্দার আড়ালেই থেকে গেছে। স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসারের স্বপ্নও তিনি দেখতেন। সন্তান এসেছিল তাঁর কোলে, কিন্তু ১৯০৪ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে তাঁর কন্যা মারা যায়। থিয়েটার থেকে বিদায় নেবার পর তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁর প্রকৃত উপকারী বন্ধু ও ভালোবাসার জন রাঙাবাবুর কাছে। তিনিও পরপারে চলে গেলেন ১৯১২ সালে। সেই সময় থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত (১৯৪২ সাল) ত্রিশ বত্সরব্যাপী জীবন কীভাবে কেটেছে ভালো জানা যায় না। সম্ভবত যে জায়গাকে ও যে পেশাকে তিনি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করতেন, সেই জায়গায় যেখানে তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে— সেখানেই ফিরে গেছিলেন পেটের দায়ে! মাঝে মাঝে স্টার থিয়েটারেও গিয়ে বসে থাকতেন- হয়তো ভিক্ষেও করতে হয়েছে তাঁকে। ৭৯ বছর বয়সে মৃত্যু তাঁকে শান্তি দিল। তবুও এই কথা বলা যায়, লেডিজ গ্রিনরুমের আড়াল থেকে বেরিয়ে তিনি নারীর অধিকার দাবি করেছিলেন।