নবম অধ্যায়—নিশুম্ভ বধ
রাজা কহিলেন,—হে ভগবন্! আপনি রক্তবীজ-বধ-বিষয়ক অদ্ভুত দেবী-চরিত্র মাহাত্ম্য আমার নিকটে বলিলেন; এক্ষণে রক্তবীজ নিহত হইলে অতিকোপন শুম্ভ ও নিশুম্ভ যে কর্ম্ম করিল, তাহা শুনিতে আমার ইচ্ছা হইতেছে। ঋষি কহিলেন, সমরে রক্তবীজ নিপাতিত হইলে শুম্ভ ও নিশুম্ভ অসুরদ্বয় সাতিশয় কোপান্বিত হইল। অনন্তর সেই সকল সৈন্য নিহত হইতেছে দেখিয়া অতিক্রোধে শ্রেষ্ঠসৈন্যসমূহে পরিবৃত হইয়া নিশুম্ভাসুর দেবীর অভিমুখে ধাবিত হইল। নিশুম্ভের সম্মুখে, পৃষ্ঠদেশে ও উভয় পার্শ্বে স্থিত মহাসুরগণ ওষ্ঠপুট দংশন করত ক্রুদ্ধ হইয়া দেবীকে নিহত করিবার জন্য আগমন করিতে লাগিল। স্ববলবেষ্টিত মহাবীর্য্য শুম্ভাসুরও মাতৃগণের সহিত যুদ্ধ করিয়া দেবীকে হনন করিবার নিমিত্ত কোপে আগমন করিল। তখন দেবীর সহিত জলবর্ষণকারী মেঘদ্বয়ের ন্যায় অতি প্রচণ্ড শরবর্ষণকারী শুম্ভ ও নিশুম্ভের ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হইতে লাগিল। চণ্ডিকা সেই অসুরদ্বয় নিক্ষিপ্ত শরসমূহকে স্বীয় শরসমূহ দ্বারা শীঘ্র ছেদন করিয়া, শস্ত্র-নিকর দ্বারা অসুরেশ্বরদ্বয়ের অঙ্গসমূহে তাড়না করিতে লাগিলেন। ১–৮
নিশিত খড়্গ ও সুপ্রভ চর্ম্ম গ্রহণ করিয়া নিশুম্ভ দেবীর উত্তম বাহন সিংহের মস্তকে তাড়না করিল। বাহনকে তাড়িত দেখিয়া দেবী খুরপ্র (অর্দ্ধচন্দ্রাকৃতি বাণ বিশেষ, এক প্রকার অস্ত্র) দ্বারা নিশুম্ভের উত্তম অসি ছিন্ন করিলেন এবং অষ্টচন্দ্রক চর্ম্মও ছেদন করিলেন। খড়্গ ও চর্ম্ম ছিন্ন হইলে সেই নিশুম্ভাসুর শক্তি নিক্ষেপ করিল; দেবীও সেই অভিমুখাগত শক্তিকে চক্রদ্বারা দ্বিখণ্ড করিয়া ফেলিলেন। অনন্তর কোপপূরিত অসুর শূল গ্রহণ করিয়া নিক্ষেপ করিল; দেবী আগতপ্রায় সেই শূলকে মুষ্টিপাত দ্বারা চূর্ণ করিলেন। অনন্তর সেই অসুরও গদা ভ্রমণ করাইয়া নিক্ষেপ করিল, সেই গদাও দেবীর ত্রিশূলাঘাতে ভিন্ন হইয়া ভস্মীভূত হইল। অনন্তর পরশু হস্তে আগত সেই দৈত্যশ্রেষ্ঠ নিশুম্ভকে বাণ-নিকর দ্বারা আঘাত করিয়া দেবী ভূমিতে পাতিত করিলেন। ভীমবিক্রম ভ্রাতা নিশুম্ভ ভূমিতে পাতিত হইল দেখিয়া শুম্ভাসুর অতিশয় ক্রোধে দেবীকে হনন করিবার নিমিত্ত গমন করিল। ৯–১৫
সেই শুম্ভাসুর, উন্নত অতুলনীয় অষ্টভুজে উৎকৃষ্ট অস্ত্র সকল ধারণপূর্ব্বক অশেষ আকাশ ব্যাপিয়া রথের উপর অবস্থিত ছিল। তাহাকে আগমন করিতে দেখিয়া দেবী শঙ্খ বাদ্য করিলেন, অতীব দুঃসহ ধনুকের জ্যাশব্দ করিলেন এবং সমস্ত দৈত্য-সৈন্যের তেজোবিনাশকারী নিজ ঘণ্টাশব্দে দিক্ সকল পরিপূরিত করিয়া ফেলিলেন। হস্তিগণের মহামদ-বিদূরকারী মহানাদ দ্বারা সিংহও গগন, পৃথিবী ও দশদিক্ পরিপূরিত করিল। অনন্তর কালী আকাশে লম্ফ প্রদান করিয়া পরে হস্তদ্বয় দ্বারা পৃথিবীর উপর আঘাত করিলেন; সেই আঘাতশব্দে পূর্ব্বের সমস্ত শব্দই মন্দীভূত হইয়া গেল। শিবদূতীও শত্রুগণের অমঙ্গলকারী অতি উচ্চহাস্য করিতে লাগিলেন। সেই সকল শব্দে অসুরগণ ত্রস্ত হইয়া পড়িল এবং পরে শুম্ভ সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইল। যখন অম্বিকা শুম্ভকে “রে দুরাত্মন! থাক্ থাক্” এই কথা বলিলেন, তখন আকাশস্থিত দেবগণ জয়শব্দ করিতে লাগিলেন। শুম্ভাসুর আগমন করিয়া উগ্রদীপ্তি অতি ভীষণ শক্তি নিক্ষেপ করিল, সেই বহ্নিরাশি সদৃশ আগত শক্তিকে দেবী মহোল্কা শক্তি দ্বারা দূরে নিক্ষিপ্ত করিলেন। অনন্তর শুম্ভের সিংহনাদে ত্রিলোকান্তর ব্যাপ্ত হইয়া গেল এবং হে অবনীপাল! সেই নির্ঘাতশব্দ তৎকালীন অন্য শব্দসমুদয়কে জয় করিল। শুম্ভ প্রক্ষিপ্ত শত সহস্র শর দেবী স্বীয় উগ্র শর দ্বারা ছেদন করিলেন এবং শুম্ভও দেবী-প্রক্ষিপ্ত শত সহস্র শর স্বকীয় উগ্র শর দ্বারা ছেদন করিতে লাগিল। ১৬–২৫
অনন্তর সেই চণ্ডিকা দেবী ক্রুদ্ধ হইয়া শূল দ্বারা শুম্ভাসুরকে আঘাত করিলেন এবং শূলাহত শুম্ভাসুর মূর্চ্ছিত হইয়া ভূমিতে পতিত হইল। অনন্তর নিশুম্ভাসুর চৈতন্যলাভ করিয়া কার্ম্মুক (ধনুক) ধারণ করত শরসমূহ দ্বারা দেবী কালী ও সিংহকে আঘাত করিতে লাগিল। অনন্তর দনুজপতি (দৈত্যপতি) নিশুম্ভ দৈত্য অযুত বাহু বিস্তার করিয়া চক্র ও আয়ুধ দ্বারা চণ্ডিকা দেবীকে আচ্ছাদিত করিয়া ফেলিল। তৎপরে বিপন্নজনের পীড়ানাশিনী ভগবতী দুর্গা ক্রুদ্ধা হইয়া সেই চক্র ও বাণ সকলকে স্বকীয় শরনিকর দ্বারা ছেদন করিয়া ফেলিলেন। ২৬–২৯
অনন্তর দৈত্যসেনা-পরিবৃত নিশুম্ভ সেই দেবীকে হনন করিবার জন্য গদা গ্রহণ করিয়া অতিবেগে ধাবিত হইল। তখন আগতপ্রায় নিশুম্ভাসুরের গদাকে দেবী চণ্ডিকা শিতধার (শাণিত) খড়্গ দ্বারা ছেদন করিলেন। তখন নিশুম্ভ শূল গ্রহণ করিল। অনন্তর শূল গ্রহণ করত সম্মুখে আপতিত নিশুম্ভাসুরকে দেবী অতিবেগে প্রক্ষিপ্ত নিজ শূল দ্বারা হৃদয়ে বিদ্ধ করিলেন। অনন্তর শূল দ্বারা ভিন্ন সেই অসুরের হৃদয় হইতে অপর এক জন মহাবল ও মহাবীর্য্য পুরুষ দেবীকে “তিষ্ঠ (থাক্)” এই কথা বলিতে বলিতে নিষ্ক্রান্ত হইল। সেই নিষ্ক্রান্তপ্রায় অসুরের মস্তক, দেবী হাস্যপূর্ব্বক ছেদন করিলেন। তখন সেই অসুর ভূমিতে নিপতিত হইল। ৩০–৩৪
অনন্তর দন্ত দ্বারা গ্রীবাদেশ চর্ব্বণ করত সিংহ অসুরগণকে ভক্ষণ করিতে লাগিল। শিবদূতী এবং কালী অপরাপর অসুরগণকে ভক্ষণ করিতে লাগিলেন। কোন কোন মহাসুর কৌমারী শক্তির শক্তি আঘাতে নির্ভিন্ন (খণ্ডিত) হইয়া নষ্ট হইল। ব্রহ্মাণীর মন্ত্রপূত জলস্পর্শে অন্য অনেক অসুর দূরীকৃত (বিতাড়িত) হইল; অপর অনেক অসুর মাহেশ্বরীর ত্রিশূলাঘাতে ভিন্ন হইয়া পতিত হইল এবং কোন কোন অসুরগণ বারাহীর তুণ্ডাঘাতে চূর্ণীকৃত হইয়া পৃথিবীতে পতিত হইল; অন্যান্য দানবগণকে বৈষ্ণবী চক্রদ্বারা খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। ঐন্দ্রী-হস্তবিমুক্ত বজ্র দ্বারা আহত হইয়া অপর অসুরগণের মধ্যে কেহ বিনষ্ট হইল, কেহ কেহ বা মহাযুদ্ধ হইতে পলায়ন করিল। অবশিষ্ট যে সকল অসুর ছিল, তাহাদিগকে কালী, শিবদূতী ও সিংহ ভক্ষণ করিয়া ফেলিলেন। ৩৫–৩৯
নবম অধ্যায় সমাপ্ত॥৯॥
—