নবম অধ্যায় – কথান্ত
গত আটটি অধ্যায়ে খ্রীঃ পূঃ ২৩০০ থেকে খ্ৰীষ্টীয় ১২০০ পর্যন্ত সুদীর্ঘ সাড়ে তিন হাজার বছরের অর্থনৈতিক ইতিহাসের আলোচনা করা হয়েছে। প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের প্রারম্ভিক পর্বে বিস্ময় উদ্রেককারী যে নগরাশ্রয়ী অর্থনীতি দেখা গিয়েছিল, খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয় সহস্ৰকের দ্বিতীয়ার্ধে তার শুধু পতন ঘটল না, অর্থনৈতিক জীবনে নগরের ধারণাই প্রায় বাতিল হয়ে গেল। খ্রীঃ পূঃ ১৫০০-১০০০ পর্যন্ত পাঁচশ বছর ধরে তার জায়গায় বিরাজ করেছিল এক সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের অর্থনীতি যা প্রধানত পশুচারণকে আশ্রয় করেছিল। এই অর্থনীতির পরিচয় মূলত পাওয়া যায় সিন্ধু ও তার উপনদীগুলির উপত্যকাতে। খ্রীঃ পূঃ ১০০০ থেকে ৬০০ পর্যন্ত কালপর্বে আমরা দেখেছি কিভাবে পশুচারণের অর্থনীতি লুপ্ত হল ও তার জায়গা নিল স্থায়ী কৃষিজীবী সমাজ। স্থায়ী কৃষিপ্রধান অর্থনীতির গোড়াপত্তন ঘটেছিল গাঙ্গেয় উপত্যকার উত্তর-পশ্চিমাংশে। কৃষি অর্থনীতি এই পর্বে যে প্রতিষ্ঠিত হল, তারপর থেকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে আব তার পশ্চাদপসরণ ঘটেনি। খ্রীঃ পূঃ ১০০০ থেকে ৬০০ পর্যন্ত চারশ বছর ধরে কৃষিপ্রধান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধীরে ধীরে গাঙ্গেয় উপত্যকার অভ্যন্তরে প্রবেশ করছিল। পরবর্ত্তী প্রায় তিন শতাব্দী (খ্রীঃ পূঃ ৬০০-৩২৪) ভারতীয় অর্থনৈতিক ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই পর্বে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকা পাদপ্রদীপের আলোতে চলে আসে; কৃষি অর্থনীতির প্রাধান্য এই পর্বে সুপ্রতিষ্ঠিত; কারিগরী শিল্পের বিকাশ, বাণিজ্যের প্রসার ও মুদ্রার প্রথম প্রয়োগ এক প্রাগ্রসর ও জটিলতর আর্থ-সামাজিক পর্বকে চিহ্নিত করে; এই পর্বেই দ্বিতীয় দফার নগরায়নের সূচনা হয়। খ্রীঃ পূঃ ৩২৫ থেকে খ্রীঃ পূঃ ১৭৫-কে একটি স্বতন্ত্র পর্ব হিসেবে চিহ্নিত করার প্রধান যুক্তি এই যে, এই আমলে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত আর্থিক ক্রিয়াকলাপ নজরে আসে। রাষ্ট্র উৎপাদন, বণ্টন ও ব্যবসা বাণিজ্যে নির্দিষ্ট ভূমিকা নিয়েছিল; বেসরকারী উদ্যোগ কখনও নস্যাৎ করা হয়নি, কিন্তু বেসরকারী উদ্যোগগুলি সম্ভবত রাষ্ট্রের প্রভাবাধীন ছিল। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিতে কৃষিজাত উদ্বৃত্তের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও এই প্রসঙ্গে নির্দেশ করা হয়েছে। প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের এত ব্যাপক ও প্রায় সর্বভারতীয় রূপ আর কখনও দেখা যায় না; সেই দিক দিয়ে এই পর্বে এক অর্থনৈতিক পরীক্ষা চলেছিল বলে মনে করা অনুচিত হবে না। এর পরবর্তী প্রায় পৌনে পাঁচশ’ বছরে (খ্রীঃ পূঃ ১৭৫-৩০০ খ্রীঃ) দেখা গেল অব্যবহিত আগের পর্বের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ প্রায় বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অভাব বা পশ্চাদপসরণ অর্থনৈতিক জীবনে কোনও সংকট আনেনি। বরং ঐ পর্বে কৃষি অর্থনীতি প্রায় সর্বভারতীয় রূপ পরিগ্রহ করেছিল, কারিগরী শিল্প ও বিবিধ বৃত্তির ব্যাপক বিকাশ ঘটেছিল, ভারত সার্থকভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশ নিতে থাকে। মুদ্রাশ্রয়ী অর্থনীতির প্রসার ও দ্বিতীয় দফার নগরায়নের তুঙ্গাবস্থাও এই পর্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রোমের সঙ্গে প্রায় দুই শতাব্দী ব্যাপী আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে খ্রীঃ তৃতীয় শতকের মাঝামাঝি থেকে ভাঁটা পড়তে থাকে এবং খ্রীঃ চতুর্থ পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে পাশ্চাত্ত্যের সঙ্গে দূরপাল্লার বাণিজ্য পূর্ববর্তী আমলের তুলনায় নিঃসন্দেহে কমে যায়। অবশ্য অন্য দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময় বাড়তে থাকে। বাণিজ্যের এই পরিবর্ত্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে প্রায় একই সময়ে কৃষি অর্থনীতি ও ভূমি ব্যবস্থায় নূতন ক্রিয়াকলাপ দেখা গেল। ‘অগ্রহার’ ব্যবস্থার দ্বারা ধর্মাচরণের উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণ, পুরোহিত, বৌদ্ধ বিহার প্রভৃতিকে নিষ্কর জমি/গ্রাম দান করার দরুন হয়তো অনাবাদী এলাকাকে চাষের আওতায় আনা গিয়েছিল; কিন্তু একই সঙ্গে ভূমি ব্যবস্থায় ও কৃষি উৎপাদন সম্পর্কে জটিলতাও বেড়েছিল। অগ্রহারের অর্থনীতি ভূম্যধিকারী শ্রেণীর উত্থান ঘটাতে সাহায্য করে, যে ভূমধ্যকারী সম্প্রদায় প্রকৃত কৃষক ও রাষ্ট্রশক্তির মধ্যবর্তী স্তরে অবস্থান করছিল। এই প্রসঙ্গে আমরা দেখিয়েছি যে খ্রীঃ চতুর্থ থেকে সপ্তম শতকের মধ্যভাগকে ভারত ইতিহাসে সুবর্ণযুগ বলে চিহ্নিত করা যায় না; সামাজিক অর্থনৈতিক দিক দিয়ে প্রশংসনীয় নানা কৃতিত্ব আলোচ্য সময়ে দেখা দিলেও ‘সুবর্ণ যুগ’ বলতে শোষণমুক্ত, অবাধ ও সমানাধিকারের ভিত্তিতে গঠিত যে অনাবিল সমাজের কল্পনা করা যায়, তার সঙ্গে তথাকথিত ভারতীয় সুবর্ণযুগের মিল খুঁজে পাওয়া শক্ত। সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময় ভারত ইতিহাসের এক অত্যন্ত বিতর্কিত সময়। রামশরণ শর্মা সহ বেশ কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন যে এই পর্বের অর্থনৈতিক ইতিহাস অগ্রহারের অর্থনীতির ফলশ্রুতি মাত্র, যার ফলে ভারতে সামন্ত ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। কৃষির প্রসার হওয়া সত্ত্বেও কারিগরী ও বাণিজ্যিক অর্থনীতির ক্রমিক অবনয়ন, নগরের অবক্ষয়, ভূস্বামীদের ক্ষমতার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কর্ত্তৃত্বের হ্রাস ও কৃষকের সার্বিক দুর্গতির চেহারা শর্মা ও তাঁর অনুগামীরা প্রমাণ করতে চেয়েছেন। কিন্তু আমরা দেখিয়েছি যে ভূমিব্যবস্থায় অন্তর্বর্ত্তীর অস্তিত্ব থাকলেও সামন্ত ব্যবস্থা ছিল কিনা সন্দেহ। বর্তমানে দেখানো সম্ভব যে নগরের সার্বিক অবনয়ন ঘটেনি; বরং তৃতীয় পর্যায়ের নগরায়নের সূচনা খ্রীঃ অষ্টম শতক থেকে। বাণিজ্য হ্রাসের ধারণাও সাম্প্রতিক তথ্যের দ্বারা সমর্থন করা কঠিন; এছাড়া মুদ্রার প্রচলন যে অব্যাহত ছিল তা-ও দেখানো সম্ভব। কার্যত ৬৫০-১২০০ খ্রীঃ অর্থনেতিক জীবনে যে বিকাশ ঘটেছিল, তা আসন্ন মধ্যযুগীয় অর্থনীতির চরিত্র অনেকটা নির্ধারণ করে দেয়। ৬৫০-১২০০ খ্রীঃ-এর কালপর্বকে কোনওক্রমেই অর্থনৈতিক সংকটের কাল বলে মনে করা চলে না, যদিও রামশরণ শর্মা খ্রীঃ ৬০০ থেকে ১০০০ খ্রীঃ পর্যন্ত পর্বে অর্থনৈতিক অবক্ষয়ই প্রমাণ করতে প্রয়াসী হয়েছেন।
পাঠকের কাছে আশা করি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক জীবনে পরিবর্ত্তনের সম্ভাবনা ছিল যথেষ্ট, পরিবর্ত্তন ঘটাবার পক্ষে প্রয়োজনীয় উপাদানগুলিও ছিল সক্রিয়। এ কথা মানলে তার পরবর্ত্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় যে, প্রাচীন ভারতের সামাজিক-অর্থনৈতিক জীবন ছিল নিস্তরঙ্গ, উত্থান-পতনবিহীন এক জড়পিণ্ডবৎ অবস্থা, এই জাতীয় সযত্নলালিত ধারণা বাতিল করার মত সাক্ষ্য প্রমাণ ও তত্ত্বগত ভিত্তি এখন আমাদের কাছে আছে। সেই ১৮১৭ সালে জেমস মিল বলেছিলেন ভারতীয় সমাজ তার জন্মলগ্ন থেকেই পরিবর্ত্তনবিমুখ ও অনড়। ‘সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে’; তাই প্রখ্যাত দার্শনিক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত তাঁর এ হিস্ট্রী অভ স্যাংস্কৃট লিটারেচার (১৯৪৭) গ্রন্থের মুখবন্ধে লিখেছিলেন দুই হাজার বছর ধরে ভারতের অর্থনৈতিক জীবনে উৎপাদন ব্যবস্থা ও পদ্ধতি একই রকম রয়েছে। এই জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গীর বদল ঘটানো আশু প্রয়োজন। প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস খুঁটিয়ে দেখলে ভারতীয় আর্থ-সামাজিক জীবনে পরিবর্ত্তনহীনতার ধারণা মানা কঠিন।
এই প্রসঙ্গে আর একটি কথাও বলা দরকার। ভারতীয় উপমহাদেশের মত এক বৃহদায়তন ভূখণ্ডে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের কোনও সর্বভারতীয় একরৈখিক ছক খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন, প্রায় অসম্ভব। আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য এই বিশাল এলাকায় এত বেশী যে, কোনও একটি ছক বা তত্ত্বগত কাঠামোর ভিত্তিতে প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক জীবনের গতিপ্রকৃতি সঠিকভাবে অনুধাবন করা দুঃসাধ্য। অতএব প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রার আলোচনা করতে গেলে কালগত পরিবর্ত্তন ও এলাকাভিত্তিক বৈচিত্র্য দুই-এর প্রতিই যথাযথ নজর রাখা দরকার।
প্রাচীন ভারতীয় অর্থনৈতিক জীবনের যে গতিময়তা ও পরিবর্ত্তনশীলতার কথা বারবার এই গ্রন্থে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, সেই পরিবর্তনের ছন্দ কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দ্রুত নয়; ইউরোপীয় ইতিহাসের নিরিখে সেই পরিবর্তন প্রায় অনতিলক্ষ্য বলে মনে হবে। তাই প্রাচীন ভারতীয় অর্থনৈতিক জীবনে পরিবর্ত্তনের পাশাপাশি ধারাবাহিকতার ধারণাকে অস্বীকার করলে মস্ত ভুল হবে। অথনৈতিক ইতিহাসে এই পরম্পরা-পরিবর্ত্তনের যুগলবন্দীর চরিত্র বিচার করার বিশেষ প্রয়োজন আছে। ধারাবাহিকতার অন্যতম প্রধান লক্ষণ কৃষির উপর প্রাথমিক নির্ভরতা। ভারতীয় কৃষি অর্থনীতি সেই সুদূর অতীত থেকে আধুনিক আমল পর্যন্ত বর্ষার খামখেয়ালীপনার সঙ্গে নিরন্তর পাল্লা দিয়ে চলেছে, এবং বারবার প্রকৃতির কাছে অতীতে পিছু হঠেছে। কৃষির উপকরণ ও পদ্ধতিতে নতুন নতুন প্রক্রিয়া ও পরীক্ষা নিরীক্ষার অভাব ভারতীয় কৃষি অর্থনীতিকে প্রাচীন যুগে অনেকাংশেই অনিশ্চিত রেখে দিয়েছি। এর সঙ্গেই খেয়াল রাখতে হবে জলসেচ ও তার সংরক্ষণের সমস্যা। উত্তর ভারতের প্রধান নদীগুলির মধ্যে বেশীর ভাগেরই হিমালয়ের হিমবাহে উৎপত্তি; ফলে নদীগুলিতে সম্বৎসর জল পাবার সম্ভাবনা থেকে যায়। অন্য দিকে দাক্ষিণাত্য ও দক্ষিণ ভারতের সমস্ত নদীই একান্তভাবে বর্ষার জলের উপর নির্ভরশীল। তার ওপর দাক্ষিণাত্যে ও বিশেষত দক্ষিণ ভারতের চাল বা ভাতের প্রচলন উত্তর ভারতের চেয়ে বেশী; ধান ফলাতে জলের দরকার লাগে গম বা জোয়ার-বাজরার জন্য প্রয়োজনীয় জলের তুলনায় বেশী। ফলে সেচ ব্যবস্থা বিশেষত স্থানীয় সেচ ব্যবস্থার গুরুত্ব বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণস্থ ভূখণ্ডে অপরিসীম। প্রাচীন ভারতে সেচ ব্যবস্থার প্রবর্তন ও রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে রাজকীয় ভূমিকার নজীর অজানা নেই; কিন্তু সেচ ব্যবস্থার আয়োজন ও সংগঠন করে কৃষি অর্থনীতিতে সরকারী উদ্যোগ ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদাহরণ অল্পই। প্রাচীন ভারতের সেচ ব্যবস্থায় বিশেষত স্থানীয় সেচ প্রকল্পের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ও যৌথ (বেসরকারী) উদ্যোগই অধিকতর সক্রিয় ছিল; অবশ্য বৃহদায়তন সেচ প্রকল্পে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা বাতিল করা যায় না। কিন্তু কার্ল হ্বিটফোগেল ভারতের মত প্রাচীন সভ্যতায় ঔদকীয় সমাজের (‘হাইড্রলিক সোসাইটী’) প্রতিষ্ঠা ও সেই সমাজের চূড়ান্ত নিয়ন্তা হিসেবে সেচ ব্যবস্থায় রাজার অপ্রতর্ক্য কর্তৃত্বের যে জটিল তত্ত্ব হাজির করেছিলেন, তা মানা প্রায় অসম্ভব; হ্বিটফোগেলের তত্ত্বেরও মূল কথা হল প্রাচ্যের সমাজ চিরাচরিত, অনড়, অটল ও সনাতন, যে মতের অসারতা ইতিপূর্বেই আলোচিত হয়েছে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ধারাবাহিকতা আমাদের নজর এড়ায় না। এই ধারাবাহিকতা অনেক ক্ষেত্রেই ভৌগোলিক পরিবেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। গাঙ্গেয় উপত্যকার মত বিস্তীর্ণ সমতলভূমিতে প্রাকৃতিক বাধা প্রায় না থাকায় এই এলাকা স্থলপথে পণ্য পরিবহণের পক্ষে আদর্শ ছিল; তার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে উত্তর ভারতের নাব্য নদীগুলির ভূমিকা। যোগাযোগের কিছু পথঘাট (যেমন দাক্ষিণাত্যের মধ্যাংশ থেকে উত্তর প্রদেশের উত্তর-পূর্বাংশ পর্যন্ত) ধারাবাহিকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ব্যবসার ক্ষেত্রে বিশেষত সমুদ্র বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতার অন্যতম উপাদান ব্যবসায়ী ও মাঝি মাল্লাদের মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের উপর নির্ভরতা। জলপথে ভারতে আসা ও ফেরৎ যাওয়া অনেকাংশেই নির্ধারণ করতে হত মৌসুমী বায়ুর দিক পরিবর্তনের দিকে নজর রেখে। আদি মধ্যযুগে পারস্য উপসাগর ও লোহিত সাগরের বন্দর থেকে চীনের বন্দর পর্যন্ত যখন সমুদ্র বাণিজ্য চলত, তখন ভারতের বন্দরগুলিতে বিদেশী জাহাজ ভেড়াতেই হত; কারণ মৌসুমী বায়ুর দিক বদল বিচার করে এত দীর্ঘপথ একবারে পাড়ি দেওয়া ছিল অসম্ভব। অষ্টম শতক পর্যন্ত পশ্চিমী জাহাজগুলি সরাসরি চীন অবধি যেত; পরে নবম/দশম থেকে স্বল্পতর দৈর্ঘ পাড়ি দেওয়াই শ্রেয় বলে বিবেচিত হয়। তার ফলে ভারতের মালাবার উপকূলস্থ কুইলন ও কালিকটের মত বন্দরে পশ্চিমী ‘ধাও’ ও চীনা জাঙ্ক এসে ভিড়ত; সেখানে পরস্পরের পণ্য বিনিময় করে তারা ফিরে যেত স্বদেশাভিমুখে। প্রাচীন ভারতের বাণিজ্যের প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয়ের প্রতি নজর দেওয়া উচিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভারতীয় বাণিজ্যের চরিত্র বিচার করতে গিয়ে বলা হয়েছে ভারতে ব্যবসা হত অত্যন্ত দামী, বিলাসবহুল, স্বল্প পরিমাণ, সহজে পরিবহনক্ষম পণ্যসামগ্রী নিয়ে (যেমন মসলিম, রেশম, সুগন্ধী, মুক্তো, হীরা প্রভৃতি)। বিশেষত বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের বাজারে এই ভারতীয় পণ্যগুলির সমাদরের কথা বহু ঐতিহাসিকই দেখিয়েছেন। সনাতন ভারতীয় বাণিজ্যের এটাই ছিল অপরিবর্ত্তিত চেহারা। এই ধারণা যেমন ইওরোপীয় লেখকরা করেছেন, ইওরোপীয় ইতিহাসচর্চাকে পদ্ধতি অনুসরণ করে ভারতীয় লেখকরাও প্রায় একই কথা বলেছেন। যিনি এশীয় ইতিহাসচর্চাকে ইওরোপীয় ইতিহাসচিন্তার প্রাধান্য থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন, সেই ওলন্দাজ ইতিহাসবিদ ফান লিউয়্যারও ভারতীয় বাণিজ্যের প্রাক-আধুনিক পর্বের একই চরিত্র চিত্রণ করেছেন। ভারতে প্রস্তুত দামী ও বিলাসের উপকরণগুলির আর্থিক তাৎপর্য পুরোপুরি মেনে নিয়েও বলা চলে কেবলমাত্র দামী জিনিসের লেনদেনের উপর দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রাখলে ভুল হবে। দৈনন্দিন প্রয়োজনের সামগ্রীগুলি নিশ্চয়ই অপেক্ষাকৃত কম দামী, কিন্তু তার ক্রেতা ছিল সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। অন্য দিকে বিলাসব্যসনের সামগ্রীগুলি মূলত ধনীদের শখশৌখিনতা মেটাত। আটপৌরে জিনিসের লেনদেনের মধ্যে বিশেষ ভাবে নজর দেওয়া যেতে পারে, নুন, লোহা, মোটা কাপড় ও শস্য বিশেষত ধান চালের ওপরে। আটপৌরে জিনিসের কেনাবেচা কেবলমাত্র আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যেই দেখা যায় না, গয়টাইন অনেকগুলি বাণিজ্যিক চিঠির ভিত্তিতে দেখিয়েছিলেন যে দূরপাল্লার সমুদ্র বাণিজ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্যের ইতিহাস চর্চা করতে গেলে বণিকদের প্রকারভেদ ও নানা রকম বাজার ও বাণিজ্যকেন্দ্রের প্রতিও সচেতন থাকা দরকার। বণিকদের ও বাণিজ্যকেন্দ্রগুলির মধ্যে তারতম্য নির্দেশ করা বিশেষ জরুরী।
পরিবর্ত্তন ও পরম্পরার লক্ষণগুলিকে শনাক্ত করে যদি প্রাচীন ভারতীয় অর্থনৈতিক ইতিহাসকে বিচার করা যায় তা হলে বিষয়টি চিত্তাকর্ষক ও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। জাতিবর্ণ ব্যবস্থায় সংগঠিত সমাজ সম্ভবত দ্রুত অর্থনৈতিক পরিবর্তনের পরিপন্থী ছিল। যে অর্থনৈতিক বিকাশ প্রাচীন ভারতে দেখা যায় তার প্রায় সব সুযোগ সুবিধেই ভোগ করত দুই উচ্চতর বর্ণভুক্ত ব্যক্তিরা: ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়েরা। বাণিজ্যজাত অর্থ হয়তো বণিকদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটাত; কিন্তু বণিকদের সামাজিক মান মর্যাদা বোধহয় বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে বিচার করা হত না। শুধু কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রেই ‘বৈদেহক’ বা বণিককে রাষ্ট্রের পক্ষে ‘কণ্টক’ বলে ভাবা হয়নি, ধর্মশাস্ত্রেও বণিকের অন্যতম পরিচয় ‘প্রকাশ্যতস্কর’। শূদ্রসহ সমাজের বিভিন্ন ধনোৎপাদক সম্প্রদায়কে অত্যন্ত হেয় ভাবে বিচার করা জাতিবর্ণ প্রথার অন্যতম চিরাচরিত লক্ষণ। আদি মধ্যযুগে শূদ্রদের প্রকৃত মর্যাদা হয়তো কিছুটা উন্নত হয়েছিল বলে রামশরণ শর্মা মনে করেন; কিন্তু ব্রাহ্মণ্য মতাদর্শে বৈশ্য-শূদ্রের উত্থান কখনওই সুনজরে দেখা হয়নি। ভারতীয় সমাজ কেবলমাত্র চারটি বর্ণে বিভক্ত যে ছিল না, তা মোটামুটি সর্বজনস্বীকৃত; চারটি বর্ণের অস্তিত্ব কার্যত তত্ত্বেই সীমাবদ্ধ ছিল। মূল সামাজিক ভাগ ছিল জাতি; অধিকাংশ জাতি ছিল নির্দিষ্ট বৃত্তিধারী। সামাজিক গতিময়তা শাস্ত্রের অনুমোদন না পেলেও বাস্তবে যে ঘটত, তার প্রমাণ হাজির করা শক্ত নয়। কিন্তু অন্ত্যজ বা সমাজের নিম্নতম পর্যায়ভুক্ত ব্যক্তির পক্ষে উচ্চতর সামাজিক মর্যাদা লাভ কার্যত অসম্ভব ছিল। ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যবাহী জাতিবর্ণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ও বিশেষত ব্রাহ্মণের আধিপত্যের বিরুদ্ধে বুদ্ধ সহ একাধিক প্রাচীন চিন্তানায়ক ও ধর্মপ্রবর্ত্তক প্রতিবাদী আন্দোলন চালিয়েছিলেন; কিন্তু জাতিভেদ প্রথার বিলোপ ও উচ্চতর জাতির দ্বারা অন্ত্যজদের পীড়ন কোনওটিই বন্ধ হয়নি। বহুকাল পূর্বে নৃতাত্ত্বিক নির্মলকুমার বসু এ বিষয়ে যে মন্তব্য করেছিলেন তা প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে জাতিবর্ণ প্রথা ভারতে সামাজিক অসাম্য ও শোষণকে চিরস্থায়ী রূপ দিয়েছিল; কিন্তু যেহেতু জাতিগুলি সবসময়েই নির্দিষ্ট বৃত্তিধারী ছিল, ফলে একটি জাতির অন্তর্গত বৃত্তিজীবী মানুষ এক ধরনের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা পেতেন। চণ্ডাল নিঃসন্দেহে হীনতম এক বৃত্তিতে নিযুক্ত ছিলেন এবং ঐ অবস্থা থেকে তাঁর কোনও উদ্ধারের আশা প্রায় ছিল না, কিন্তু চণ্ডালের বৃত্তি যেহেতু অন্য কোনও জাতির দ্বারা করণীয় নয়, তাই চণ্ডালের বৃত্তি ছিল প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতারহিত। একটি কৃষিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থায় জাতিবর্ণ প্রথা ন্যূনতম অর্থনৈতিক সুযোগ ও উপায়ের পথ দেখাত। সেই কারণে নিম্নতম জাতির লোকেরা ও কৌম গোষ্ঠীভুক্ত মানুষ এই প্রথার প্রতি কিছুটা আকর্ষণ সম্ভবত বোধ করতেন। প্রাচীন ভারতের সামাজিক অর্থনৈতিক জীবনযাত্রায় ন্যূনতম অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিকল্প কোনও ব্যবস্থা বা সম্ভাবনা কোনও প্রতিবাদী আন্দোলন থেকে বেরিয়ে আসেনি। ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে পরিবর্তন যতটুকু এল তা ঘটেছিল মন্থরগতিতে; আমূল পরিবর্ত্তনের ক্ষেত্র তাই প্রাচীন ভারতের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ব্যবস্থায় তৈরি হয়নি।
ভারতের অতীত অনুসন্ধানে যাঁরা ব্রতী হয়েছেন তাঁদের অনেকের কাছেই প্রাচীন ভারতের পরমার্থ চিন্তা, লোকোত্তরভাবনা, আধ্যাত্মিকতা জাতীয় বিষয় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। বিশ্বের ইতিহাসে ধর্ম, দর্শন, অতীন্দ্রিয় চিন্তার ক্ষেত্রে ভারতের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু প্রাচীন ভারত মানেই যে কেবলমাত্র ঈশ্বরসন্ধান, মোক্ষলাভের আকূতি, একথা ধরে নিলে বড় মাপের ভুল হবে। এই বই এর আলোচনা হয়তো পাঠককে প্রাচীন ভারতের বস্তুগত সংস্কৃতি ও চেতনার প্রতি আকর্ষণ করবে; প্রাচীন ভারতের ধর্ম ও অধ্যাত্ম সাধনার পরিচয় পেতে গেলে আর্থ-সামাজিক ইতিহাসের পটভূমিতে পরমার্থ সন্ধানের চরিত্রকে বুঝতে হবে। হয়তো সেই কারণেই কৌটিল্যের মত শাস্ত্রকার চতুরাশ্রমের মধ্যে সন্ন্যাসকে শ্রেষ্ঠ বলে চিহ্নিত করলেও গার্হস্থ্যের মাহাত্ম্য অস্বীকার করেননি।
প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক জীবনে গতিময়তা (সে গতি অপেক্ষাকৃত ধীর হলেও), বৈচিত্র্য, আঞ্চলিক বিভিন্নতা সম্বন্ধে সচেতনতা ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু একটি সাবধানবাণী উচ্চারণের প্রয়োজনও থেকে যাচ্ছে। আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের সন্ধান করতে গিয়ে ইতিহাসপ্রেমী মানুষ যেন ভারতীয় ইতিহাসের আদি পর্বকে আঞ্চলিকতাদোষে দুষ্ট না করেন। আঞ্চলিক বৈচিত্র্যকে মেনে নেওয়ার অর্থ কিন্তু আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্ব, গৌরব বা অভিমানকে প্রশ্রয় দেওয়া নয়। সমগ্র ভারত ইতিহাসের পটভূমি অস্বীকার করে নিছক আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্যের সন্ধান করতে গেলে তা এক বিকৃত, খণ্ডিত, বিচ্ছিন্নতাবাদী ইতিহাসের জন্ম দেবে মাত্র।
সুদূর অতীতে প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক জীবনের বহু প্রশংসনীয় দিকের কথা আমাদের জানা আছে। কিন্তু অর্থনৈতিক জীবনের অতীতকথা রচনা করতে গিয়ে যদি ধরে নেওয়া হয় যে প্রাচীন আমলের অর্থনৈতিক জীবন ছিল সব মানুষের কাছে এক অবিমিশ্র আশীবাদ, তা সম্পূর্ণভাবে ঐতিহাসিক যুক্তি ও বিচারের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়াবে। অস্বীকার করার উপায় নেই, কখনও কখনও এমন যুক্তি দেওয়া হয় যে সুলতানী আমলের আগে প্রাচীন ভারত ছিল এক অসামান্য সমৃদ্ধ, উদার ও সুখপ্রদ দেশ। এমন ধারণা যে প্রমাণ করা শুধু অসম্ভব তা-ই নয়, এজাতীয় সাম্প্রদায়িক চেতনা ভারত-ইতিহাসচর্চাকে, অসুস্থ করে তুলতে বাধ্য। অতীতের প্রতি গৌরববোধ, ভক্তি, জাতীয়তাবাদী ঝোক প্রাচীন ভারতের প্রতি মুগ্ধতাবোধ থেকে সঞ্জাত ইতিহাসের ধারণা বস্তুনিষ্ঠ, তথ্যভিত্তিক ও বিশ্লেষণধর্মী ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে এক প্রধান অন্তরায়।
প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক জীবনের যে রূপ এখানে দেখানো হল, তা নিঃসন্দেহে রূপরেখা মাত্র, আংশিকও বটে। অতীতের সার্বিক পুনরুদ্ধার যদিও অসম্ভব, তবুও আশা করা যায় যে এই অর্ধস্ফূট, খণ্ডিত অর্থনেতিক ইতিহাসকে পূর্ণতর ও বাঙ্ময় করে তুলবেন আগামী দিনের ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু মানুষ। অতীতের অর্থনৈতিক জীবনের ছবি স্পষ্টতর হয়ে উঠবে, যদি “খোঁজের পরে আবার চলে খোঁজা।”
সংযোজন
বিগত শতাব্দীর শেষ দশকটিতে প্রাচীন ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন নিয়ে নতুন ভাবনাচিন্তা কিছু কম হয়নি। এই নতুন ভাবনাচিন্তার জন্ম হল অজ্ঞাত তথ্যের আবিষ্কারের ফলে, অথবা পরিচিত ও অবগত তথ্যের নব মূল্যায়নের জন্যে। অভিনব তথ্যের আবিষ্কার এবং জ্ঞাত বিষয়ের পুনর্বিবেচনার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকে ঐতিহাসিকদের বিবিধ দৃষ্টিভঙ্গি ও বিতর্ক দৃষ্টিভঙ্গির বৈচিত্র্য ও বিতর্কের সুযোগ থাকে বলেই ইতিহাসচর্চা হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত। বহুক্ষেত্রেই নতুন তথ্যের আবিষ্কার প্রাক্তন ধারণাগুলিকে বদলে দিতে পারে। ঘটে যাওয়া ঘটনাই ইতিহাসের উপজীব্য, কিন্তু নবীনতার স্পর্শ অতীতচর্চাকে গতিময় ও বর্ণিল করে তোলে। অতীতচর্চায় জানার মাঝে অজানারে সন্ধান করতে হয় অবিরাম। সেই কারণেই এই সংযোজনের পরিকল্পনা করা হল। মূল গ্রন্থে দ্বিতীয় থেকে অষ্টম—অর্থাৎ সাতটি অধ্যায়ে যেভাবে প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে সন্নিবেশিত হয়েছিল, সংযোজনেও সেই বিন্যাসটি অনুসৃত। একথা নিশ্চয়ই বিশদ ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না যে অর্থনৈতিক ইতিহাসের আলোচনাকে প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা থেকে বিযুক্ত ও বিশ্লিষ্ট করা অসম্ভব। প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক জীবনকে অবশ্যই বিচার করতে হবে পরম্পরা ও পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে মনে রেখে; কিন্তু প্রাচীন অর্থনৈতিক জীবনকে বোঝার জন্য বোধহয় নিছক কৃষি, পশুপালন, কারিগরি শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ইতিবৃত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা অনুচিত হবে। সেইজন্য সংযোজন অংশে অনেক সময়ই অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের পর্যালোচনা হবে বৃহত্তর ও জটিলতর সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে।
এই গ্রন্থের ‘কথামুখ’ অধ্যায়ে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের কালসীমা সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। ‘সংযোজন’ অংশেও ওই একই কালানুক্রম অনুসরণ করা হয়েছে: অর্থাৎ প্রাচীনতম পর্ব থেকে আ. খ্রি. ১২০০ বা ১৩০০ পর্যন্ত। কিন্তু এই বিষয়ে নতুন কিছু ভাবনাচিন্তার অবকাশ আছে। ইতিহাসচর্চায় তিনটি যুগবিভাগের যে পদ্ধতি—অর্থাৎ প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগ—প্রায় সার্বজনীন ভাবে যে কোনও দেশের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, তা প্রধানত ইউরোপীয় ইতিহাসের যুগবিভাগের কাঠামো। ইউরোপ-বহির্ভূত এলাকায় নির্বিচারে কি এই যুগবিভাগ-পদ্ধতি মানা চলে? সনাতন ভারতীয় ধারণায় যুগ চারটি সত্য (কৃত), ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি। এই যুগবিভাজনের ক্ষেত্রে কালের চক্রাকার গতিকে স্থান দেওয়া হয়েছে। সত্যযুগ থেকে ক্রমে কলির আবির্ভাব, কলির অন্তে আবার সত্যযুগের সূচনা। অন্য কালপর্বের ধারণায় রয়েছে আদি, মধ্য ও অন্ত এই তিন বিভাজনের প্রস্তাব। ফলে একটি জরুরি প্রশ্ন উঠেছে। তা হল, ভারতীয় ইতিহাসচর্চায় কি যুগ বিভাজনের এই ত্রৈরাশিক ছক—প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক কাল—মানতেই হবে? ইতিহাসে কালের ধারণা ও পরিবর্তন অপরিহার্য উপাদান। কিন্তু পরিবর্তন বোঝাবার জন্য ইউরোপীয় ইতিহাসের যুগবিভাগের পদ্ধতি নির্বিচারে ভারতীয় ইতিহাসে আরোপ করার দরকার কতটা যুক্তিযুক্ত? (বেলুতট ১৯৯৭, থাপার ১৯৯৬) রোমিলা থাপার সম্পাদিত (১৯৯৫) একটি প্রবন্ধ সংকলনে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের নানা পরিবর্তনশীল চরিত্রকে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু আনুমানিক খ্রি. ১৩০০ পর্যন্ত ভারতীয় ইতিহাসের আলোচনায় ‘এনশেন্ট’, ‘আর্লি হিস্টোরিকাল’ ‘আর্লি মিডিভ্যাল’ ইত্যাদি সুপরিচিত কালগত উপবিভাজন কার্যত বর্জন করা হয়েছে। বিষয়টির এখনও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি; যুগবিভাগের পদ্ধতি নিয়ে পূর্ণ ঐকমত্য অচিরেই হওয়া কঠিন। তবে ইউরোপীয় যুগবিভাগ পদ্ধতির অন্ধ অনুসরণ না করে বিকল্প কালানুক্রমের সন্ধান চলেছে।
॥ ২ ॥
ভারতে আদিমতম মানুষের অস্তিত্ব কখন থেকে দেখা গেল, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। কারণ ভারতে আদিম নরকঙ্কালের আবিষ্কার এখনও ঘটেনি। ফলে মানুষের ব্যবহৃত আয়ুধ ও হাতিয়ারই তার অস্তিত্বের পরোক্ষ প্রমাণ হিসেবে নিতে হবে। পুরাপ্রস্তর যুগের (প্যালিওলিথিক) আদিপর্যায়ে (লোয়ার প্যালিওলিথিক) যে হাতিয়ার আবিষ্কৃত হয়েছে, প্রত্নতাত্ত্বিকদের বিচারে তার প্রাচীনত্ব অন্তত এখন থেকে ১০৩৮০০ বছর আগে চিহ্নিত করা সম্ভব। (বি. কে. থাপার ১৯৮৮; দিলীপ চক্রবর্তী ১৯৯৭)। পুরাপ্রস্তর যুগের মধ্যপর্বে (আ. ৩৭০০০-১১০০০ বছর পূর্বে) বা ‘মিডল প্যালিওলিথিক এজ’-এ মানুষের অস্তিত্বের প্রমাণ রয়েছে উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে। তৎকালীন মানব সমাজ নিঃসন্দেহে শিকারি ও সংগ্রাহক। তাদের পরিচিত প্রাণীজগতে ছিল কুঁজবিশিষ্ট ভারতীয় বৃষ ও হাতি। প্রাচীন অস্থির অবশেষ থেকে এই প্রাণীগুলির অস্তিত্ব শনাক্ত করা যায়। মহারাষ্ট্রে গোদাবরী উপত্যকায় নেভাসা প্রত্নস্থল থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে জলহস্তীর অস্থি।
শিকারি ও সংগ্রাহকের ভূমিকা থেকে মানবসমাজে ধীরে ধীরে পশুপালনের পর্বে পৌঁছচ্ছিল, যদিও এই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের নিখুঁত কাল নির্দেশ করা দুষ্কর। পশুপালনের অর্থনৈতিক তাৎপর্য বোঝার জন্য কয়েকটি প্রত্নস্থলের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। এই প্রত্নক্ষেত্রগুলি প্রধানত মধ্যাশ্মীয় (‘মিডল স্টোন এজ’) ও নব্যপ্রস্তর যুগের। কোঠারি নদীর ডান তীরে অবস্থিত এবং রাজস্থানের ভিলওয়াড়া জেলার অন্তর্গত বাগোর এমনই এক অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত প্রত্নস্থল। মধ্যপ্রস্তর (মেসোলিথিক) যুগের ভারতীয় প্রত্নক্ষেত্রের মধ্যে এটিই বৃহত্তম। মানুষের অস্তিত্বের প্রমাণ যে স্তরগুলিতে রয়েছে তার মোট গভীরতা প্রায় ১.১৫০ মি.; পুরাতাত্ত্বিকরা এর থেকে অনুমান করেছেন এই অঞ্চলে মানুষ ছিল চার হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে। কার্বন ১৪ পরীক্ষায় দেখা যায় খ্রি. পূ. ৫০০০ থেকে ১০০০ পর্যন্ত মানুষ এই অঞ্চলে সক্রিয় ভাবে উপস্থিত ছিল। বাগোরের প্রাচীনতম সাংস্কৃতিক স্তরটি আ. ৫০০০-২৫০০ পর্যন্ত, দ্বিতীয় স্তরটির কালসীমা খ্রি. পূ. ২৫০০-১০০০ পর্যন্ত। প্রাচীনতম স্তরটির গভীরতা ৫০ থেকে ৮০ সে.মি.। এই স্তরটি থেকে পাওয়া গেছে প্রচুর পরিমাণে জীবজন্তুর দেহাস্থি ও ক্ষুদ্রাশ্মীয় (মাইক্রোলিথ) আয়ুধ। সমগ্র প্রত্নস্থল থেকে আবিষ্কৃত হয় ২২২৬টি অস্থি, যার মধ্যে ৭২.২৯% অস্থি প্রাচীনতম স্তরে পাওয়া যায়। দ্বিতীয় স্তরে প্রাপ্ত অস্থি ১৯.০৬%। উদ্ধার করা দেহাস্থি থেকে বোঝা যায় বাগোরের মানুষ কোন কোন প্রাণীকে জানত: ভেড়া, ছাগল, শূকর, মহিষ, কৃষ্ণসারহরিণ, সম্বর হরিণ, খরগোশ, শৃগাল, বেজী ও কুঁজবিশিষ্ট গবাদি পশু। স্পষ্টই বোঝা যায় যে উপরিলিখিত প্রাণীগুলির মধ্যে কয়েকটি বন্য প্রাণী। যেগুলি শিকার করত বাগোরের মানুষ। ভেড়া, ছাগল, শূকর, মহিষ ও গবাদিপশু নিঃসন্দেহে গৃহপালিত পশু। তা হলে দেখা যাচ্ছে, বাগোরে একই সঙ্গে শিকার ও পশুপালন প্রচলিত ছিল। এখানে যে কেবল আদিম মানুষের দুই ভিন্ন জীবিকার সহাবস্থান ছিল তাই নয়, পশুপালনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ায় বাগোরে অর্থনৈতিক নিশ্চিতিও বোধহয় লক্ষ করা যায়। তার স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে বাগোরবাসীর বসবাসের ব্যবস্থায়। নিছক শিকারি ও খাদ্যসংগ্রাহক গোষ্ঠীর মতো বাগোরের মানুষ কিন্তু গুহাবাসী ছিল না, তারা বাস করত ক্ষুদ্র কুটিরে। কুটিরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় পাথরের তৈরি মেঝে থেকে এবং মাটিতে খুঁটি পোঁতার গর্ত থেকে। এগুলি নিশ্চয়ই পাকা বসতির চিহ্ন নয়; কিন্তু পশুপালক গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হওয়ায় বাগোরবাসী অন্তত অনিয়মিত বাসস্থান নির্মাণ করতে পেরেছিল। দীর্ঘস্থায়ী বসতির অপর লক্ষণ পাওয়া যাবে এই প্রত্নস্থলে সমাধিগুলিতে; বাগোরের মানুষ মৃতের অন্ত্যেষ্টি করত পূর্ণাঙ্গ সমাধি দ্বারা। উপরের বিবরণ থেকে আরও একটি অনুমান করা চলে। পশুপালনে অভ্যস্ত হবার ফলে বাগোরের মানুষ ক্রমশ শিকারের উপর কম নির্ভরশীল হতে থাকে। সেইজন্য প্রথম পর্বে পশুর দেহাস্থির তুলনায় পরবর্তী পর্যায়ে দেহাস্থির সংখ্যার হ্রাস পেয়েছিল। অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে রূপান্তরের সাক্ষ্যবহন করে বলে বাগোরের উৎখনন বিশেষ অভিনিবেশ দাবি করে (মিশ্র ১৯৮৯: ৩৪-৩৬)।
অনুরূপ আরও একটি প্রত্নস্থলের দিকে এবার নজর দেওয়া যাক। এই প্রত্নক্ষেত্র মহাগড়া, অবস্থান উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদ জেলায় বেলান নদীর ডান তীরে। মহাগড়ার নিকটেই ছিল আরও একটি প্রত্নক্ষেত্র: কোলদিহাওয়া। প্রত্নক্ষেত্র হিসেবে মহাগড়া প্রায় ডিম্বাকার আয়তন প্রায় ৮০০০ বর্গমিটার। এরই মধ্যে প্রায় ১৬২২ বর্গমিটার জুড়ে পাওয়া গিয়েছে মধ্যাশ্মীয় (মেসোলিথিক) পর্বের কুড়িটি কুটিরের অবশেষ। কুটিরের উপরিকাঠামো অবশ্যই আর নেই। কুটিরের অস্তিত্ব বোঝা যায় মেঝে ও খুঁটি পোঁতার গর্তের সাহায্যে। প্রতিটি কুটিরের সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে খালি জমি থাকত। একটি কুটিরের সঙ্গে অপর কুটিরের ব্যবধান কমপক্ষে চার মিটার এবং খুব বেশি হলে বারো মিটার। মহাগড়ার সবচেয়ে চমকপ্রদ দিক হল একটি আয়তাকার (১২.৫ মি × ৭.৫ মি) গবাদি পশুর খোঁয়াড়। মহাগড়া প্রত্নস্থলের দক্ষিণপূর্ব অংশে খোঁয়াড়টি ছিল। বসতির প্রায় এক প্রান্তে ও নদীর সন্নিকটে খোঁয়াড়টির অবস্থান। পশুচারণের সুবিধার্থেই যে খোঁয়াড়টির এমন স্থান নির্বাচন করা হয়েছিল, তাতে দ্বিমত নেই। খোঁয়াড়টির চারপাশ দিয়ে অন্তত আটাশটি গোলাকৃতি গর্ত দেখা যায়, যা অবশ্যই খোঁয়াড়ের চারপাশে খুঁটিপোঁতার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু খোঁয়াড়ের ভিতরে একটিও অনুরূপ গর্ত নেই। অতএব যুক্তিসঙ্গত অনুমান করা চলে যে খোঁয়াড়টি ছিল অনাচ্ছাদিত। খোঁয়াড়ের এলাকায় গবাদি পশুর খুরের ছাপ স্পষ্ট। ছোট বড় নানা আকৃতির খুরের ছাপ থেকে বোঝা যায় পূর্ণবয়স্ক ও শাবক দুই প্রকার গবাদি পশুই খোঁয়াড়ে রাখার ব্যবস্থা ছিল। পশুপালক গোষ্ঠীর আবাসন ও খোঁয়াড়ের সহাবস্থান মহাগড়া ব্যতীত আর কোথাও দেখা যায় না। (শর্মা, মিশ্র, মণ্ডল এবং পাল ১৯৮০: ১৩৮-৪৬) প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রায় অনুরূপ একটি খোঁয়াড়ের সন্ধান পেয়েছিলেন রেমন্ড অলচিন কর্ণাটকের উৎনুরে। উৎনুর একটি নব্যপ্রস্তর যুগীয় প্রত্নক্ষেত্র; এখানেও মেঝেতে গবাদি পশুর খুরের ছাপ দেখা যায় (অলচিন ১৯৬১)।
বেলান নদীর ডান তীরে, যেখানে মহাগড়ার অবস্থান, তার প্রায় বিপরীতে ওই বেলান নদীরই বাম তীরে রয়েছে কোলদিহাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল। তিনটি ঢিবিতে উৎখনন চালিয়ে এখান থেকে পাওয়া গিয়েছিল নব্যপ্রস্তর, তাম্রপ্রস্তর ও লৌহযুগের পুরাবস্তু। নব্যপ্রস্তর আমলের পুরাসামগ্রীর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। এই যুগের পুরাবস্তুর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল মৃৎপাত্রের উপস্থিতি। এই মৃৎপাত্রগুলি হাতে তৈরি, অর্থাৎ কুমোরের চাকার ব্যবহার তখনও অজানা। হাতে তৈরি বলেই কৃৎকৌশলের দিক দিয়ে মৃৎপাত্রগুলি হয়তো উচ্চমানের নয়; কিন্তু হস্তনির্মিত মৃৎপাত্র নির্মাণ করার ক্ষমতা নব্যপ্রস্তর যুগে কোলদিহাওয়ার মানুষের ছিল। মৃৎপাত্রের গায়ে পাওয়া গিয়েছে ধানের তুষ: এটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য। ধানের তুষকে পুরাউদ্ভিদবিদ্যার আলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে আবাদি ধান হিসেবে। বিষ্ণুমিত্রে এবং চ্যাং-এর গবেষণায় স্পষ্ট যে, এই ধান কোনও মতেই বুনো শস্য নয়। পুরাবিদ্দের ধারণা নব্যপ্রস্তর যুগে এলাহাবাদের নিকটবর্তী অঞ্চলে ধানের ফলন শুরু হয়েছিল। কার্বন ১৪ পরীক্ষায় দেখা যায় যে খ্রি. পূ. সপ্তম বা ষষ্ঠ সহস্রকে কোলদিহাওয়ায় ওই আবাদি ধান ফলানো হয়। জি. আর. শর্মা ও তার সহযোগী প্রত্নবিদ্রা মনে করেন কোলদিহাওয়াতেই ধান উৎপাদনের প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায়। খ্রি. পূ. সপ্তম বা যষ্ঠ সহস্রকে সমগ্র ভারতবর্ষ নিঃসন্দেহে কৃষির আওতায় আসেনি। কিন্তু ভারতে কৃষি তথা ধান উৎপাদনের প্রাচীনত্ব যে সুদূর নব্য প্রস্তরযুগে নির্দেশ করা সম্ভব, তার সাক্ষ্য কোলদিহাওয়া বহন করছে (শর্মা, মিশ্র, মণ্ডল এবং পাল ১৯৮০: ২৩, ১৩৫-৩৭)।
ভারতীয় উপমহাদেশে নব্যপ্রস্তর যুগ বহুক্ষেত্রেই তাম্রপ্রস্তর পর্বের সঙ্গে সহাবস্থান করে (অলচিন এবং অলচিন ১৯৮২)। কৃষির প্রাচীনতম নিদর্শন কোলদিহাওয়াতে পাওয়া গেলেও উত্তর ভারতের নানা স্থানে কৃষির নিয়মিত প্রচলন দেখা যায় আরও কিছুকাল পরে। এই প্রসঙ্গে কাশ্মীরের প্রত্নস্থল বুরজাহোম (শ্রীনগরের ২৪ কিমি. উত্তর-পূর্বে অবস্থিত) সম্বন্ধে আলোচনা করা উচিত। বুরজাহোমের প্রাচীনতম দুটি সাংস্কৃতিক স্তর নব্যপ্রস্তরযুগের, পরবর্তী স্তরটি বৃহদশ্মীয় (মেগালিথিক) পর্বের এবং শেষ তথা চতুর্থ স্তরটি আদি ঐতিহাসিক (আর্লি হিস্টোরিকাল) আমলের। নব্যপ্রস্তরযুগের স্তরটি থেকে কোনও শস্যদানা আবিষ্কৃত হয়নি; বরং পাওয়া গিয়েছে পশুর দেহাস্থি, হরিণের শিং। অর্থাৎ বুরজাহোমের মানুষ নব্যপ্রস্তর পর্বে কৃষি উৎপাদনে অভ্যস্ত ছিল না। তারা মূলত পশুপালনের উপর নির্ভরশীল বলে মনে হয়। এই অনুমানের প্রধান ভিত্তি যে তারা শিকারি বা খাদ্যসংগ্রাহক গোষ্ঠীর মতো গুহাবাসী নয়। তাদের বসতির পরিচয় উৎখনন থেকে পাওয়া যায়। কিন্তু তাদের বাসস্থানের একটি বিশেষ চরিত্র আছে। মহাগড়া বা কোলদিহাওয়ার মতো তারা কুঁড়ে ঘরে থাকত না। মাটির নীচে গোল বা ডিম্বাকৃতি গর্তের মধ্যে তাদের বাসস্থান ছিল। গোলাকৃতি বাসস্থান নির্মিত হত মাটি থেকে দেড় বা আড়াই মিটার গভীরে। খাদে নেমে যাবার জন্য কয়েকটি ধাপও আমাদের নজর এড়ায় না। অন্তত একটি ভূগর্ভস্থ বাসস্থানে খুঁটির চিহ্ন থেকে অনুমান করা সম্ভব যে বাসস্থানটি আচ্ছাদিত ছিল। উৎখনন থেকে আরও পাওয়া গিয়েছে মসৃণ পাথরের কুঠার, এবং হাতে তৈরি ধূসর বর্ণের মৃৎপাত্র। লালরঙের মৃৎপাত্রের যে টুকরোটি আবিষ্কৃত হয়েছে তা অবশ্য কুমোরের চাকায় তৈরি। প্রথম স্তরে বুরজাহোমে যে ষোলোটি খাদ বা গর্ত পাওয়া যায় তার মধ্যে একটির আকার চন্দ্রকলার মতো। পুরাতত্ত্ববিদরা এটিকে সংগ্রহশালা বলে ধারণা করেন। বুরজাহোমের মানুষ নব্যপ্রস্তর যুগে প্রধানত পশুপালনে অভ্যস্ত। কিন্তু শিকারের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বোধহয় ওই সমাজে বাতিল হয়ে যায়নি। বুরজাহোমে আবিষ্কৃত প্রত্নসামগ্রীর মধ্যে অন্যতম হল একটি চিত্রিত প্রস্তরখণ্ড। এতে দেখা যায় এক শিকারির বর্শা পিছন দিক থেকে বিদ্ধ করেছে একটি মৃগকে; সামনের দিকে আর এক শিকারি মৃগের দিকে তীর নিক্ষেপ করতে উদ্যত; শিকারিদের সাহায্য করার জন্য দুটি কুকুরও চিত্রটিতে উপস্থিত। অতএব অনুমান করা সঙ্গত যে মূলত পশুপালক হলেও বুরজাহোমের নব্যপ্রস্তরযুগীয় বাসিন্দারা শিকারের মাধ্যমেও খাদ্য সংগ্রহ করত (অলাচিন এবং অলচিন ১৯৮২)।
কোলদিহাওয়াতে কৃষিকর্ম তথা ধান ফলনের যে প্রথম প্রয়াস দেখা গিয়েছিল, খ্রি. পূ. সপ্তম বা ষষ্ঠ সহস্রকে তা বিচ্ছিন্ন এমনকী বোধহয় একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। কিন্তু পুরাবস্তুর আলোকে বোঝা যায় যে, শিকারি এবং খাদ্যসংগ্রাহক মানবগোষ্ঠী ভারতীয় উপমহাদেশের নানা স্থানে ধীরে ধীরে পশুপালকের ও ক্রমে কৃষিজীবীর ভূমিকা নিচ্ছিল। খ্রি. পূ. পঞ্চম সহস্রকে কৃষিজীবী সমাজের চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া যায় বর্তমান পাকিস্তানের কোয়েটাতে অবস্থিত মেহেরগড় থেকে। মেহেরগড়ের পরিচয় সংক্ষিপ্তভাবে আগেই দেওয়া হয়েছে (পৃ. ২৫-২৬), তাই এখানে তার পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন।
॥ ৩ ॥ খ্রি. পূ. ২৫০০-১৭০০
হরপ্পা সভ্যতার আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্বন্ধে পুরাতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকদের অবিরাম গবেষণা বিষয়টিকে নিরন্তর সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত করে রেখেছে। ফলে এই বিষয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ ও প্রবন্ধের তালিকা সুবিশাল; তার পূর্ণাঙ্গ পরিচয় দেওয়া এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে অসম্ভব। জিজ্ঞাসু ব্যক্তি ইন্টারনেটের যুগে অবশ্য একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে হরপ্পা সভ্যতার অনেকগুলি প্রত্নক্ষেত্রের সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন। প্রায় ৯০টি স্লাইডে শোভিত এই ওয়েবসাইটটি হল www.harappa.com। হরপ্পা সভ্যতা নিয়ে সাম্প্রতিক যে গবেষণা চলেছে তার প্রধান ক্ষেত্র এই সভ্যতার নগরায়ণ ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে। তুলনায় কৃষি অর্থনীতির উপর আলোচনা কম। এই অংশে তাই হরপ্পা সভ্যতার কৃষি-বহির্ভূত অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপেরই পরিচয় দেওয়া হল।
নগরাশ্রয়ী অর্থনীতির একটি বিশিষ্ট দিক তার কারিগরি শিল্পোৎপাদন ব্যবস্থা। মহেঞ্জোদাড়ো, হরপ্পা, লোথাল, কলিবঙ্গান, ধোলাবীরা, বানাওয়ালি, চনহূদড়ো প্রভৃতি প্রধান নগর নিঃসন্দেহে কারিগরি শিল্পোৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে সক্রিয় ছিল। শিল্পোৎপাদনের কাঁচামাল তিন প্রকার: প্রাণিসম্পদ, খনিজ ও ধাতব। হরপ্পার মতো বৃহদায়তন শহরে দক্ষ পেশাদারি কারিগররা যে বহুবিধ সামগ্রী তৈরি করতেন, তার তথ্যনিষ্ঠ বিবরণ দিয়েছেন নয়নজ্যোত লাহিড়ী (১৯৯০)। হরিয়ানার হিসার জেলায় বিখ্যাত প্রত্নক্ষেত্র বানাওয়ালি হরপ্পা সভ্যতার একটি বিশিষ্ট শহর। বানাওয়ালির খননকার্য থেকে প্রাপ্ত অন্যান্য বহুবস্তুর মধ্যে একটি গৃহের অবশেষ এই প্রসঙ্গে আলোচনা করা উচিত। এটি বেশ বড় ইমারত। সূক্ষ্ম ওজনের জন্য ছোট ছোট বাটখারা এই ইমারতে ছিল। আরও দেখা যায় একটি বর্গাকৃতি অগ্নিকুণ্ড। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল এখানে পাওয়া গিয়েছিল বহুসংখ্যক পুঁতি বা মাল্যদানা। মাল্যদানা অধিকাংশই আধা দামি কার্নেলিয়ান পাথরের। আবার লাপিসলাজুলির মতো দুর্মূল্য পাথর এবং সোনার মতো দামি ধাতুর পুঁতিও সেখানে ছিল। অনুমান করা যুক্তিযুক্ত যে গৃহটি বোধ হয় কোনও অলঙ্কার শিল্পীর কারখানা। (বিশ্ট ১৯৯৩) মাল্যদানা তৈরি করা হরপ্পা সভ্যতার অগ্রগণ্য কারিগরি উৎপাদনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।
ধাতবদ্রব্য নির্মাণে হরপ্পা সভ্যতার কারিগরদের দক্ষতা মহেঞ্জোদাড়োতে পাওয়া বিখ্যাত নর্তকী মূর্তিটিতে নিঃসন্দেহে উপস্থিত। তার সঙ্গে অবশ্যই যুক্ত হবে দৈমাবাদ থেকে পাওয়া ব্রোঞ্জের কয়েকটি মূর্তি। মহারাষ্ট্রে আহমদনগর জেলার অন্তর্গত দৈমাবাদ প্রবর নদীর তীরে অবস্থিত। এটি পরিণত হরপ্পা সভ্যতার সমকালীন না হলেও নিঃসন্দেহে পরবর্তী হরপ্পা-সভ্যতা (লেট হরপ্পান) পর্যায়ের। দৈমাবাদে পরবর্তী হরপ্পা-সভ্যতার প্রায় অন্তিমকাল কার্বন ১৪ পরীক্ষা আ: খ্রি. পূ. ১৭৬০-এ নির্দেশ করা যায় (সালি ১৯৯৩)। দৈমাবাদের প্রসিদ্ধি চারটি ব্রোঞ্জ নির্মিত মূর্তির জন্য: (১) বৃষচালিত একটি রথজাতীয় শকট, (২) হাতি, (৩) গণ্ডার এবং (৪) মহিষ চারটি পৃথক ভাস্কর্য পাওয়া যায়। শকটের অনুকৃতি টেরাকোটা শিল্পেও আগে দেখা গিয়েছে। কিন্তু ব্রোঞ্জ নির্মিত শকটের ভাস্কর্য বিরল। চক্ৰযুক্ত রথসদৃশ এই যানটি আকারে প্রায় রোমান বিগার অনুরূপ। ব্রোঞ্জ নির্মিত পশুমূর্তির মধ্যে হাতির ভাস্কর্যটি বৃহত্তম। হাতিটি একটি আয়তাকার পীঠিকার (২৭ সেমি x ১৪ সেমি) উপরে দণ্ডায়মান। পীঠিকা সমেত হস্তীমূর্তির উচ্চতা ২৫ সেমি.। চারটি গোলাকৃতি আংটা দেখলে বোঝা যায় যে মূর্তিতে চাকা লাগানো ছিল, যদিও এখন চাকাগুলি অদৃশ্য। হস্তীমূর্তির মতো গণ্ডারমূর্তিতে কোনও পীঠিকা নেই। গণ্ডারটি দাঁড়িয়ে আছে দুটি সমান্তরাল অনুভূমিক দণ্ডের উপর। দুটি দণ্ডের সঙ্গে লাগানো রয়েছে দুটি চাকা। চাকাগুলির মধ্যে ব্যবধান ১৩ সে.মি.। গণ্ডার মূর্তিটি দৈর্ঘ্যে ২৫ সে.মি. এবং উচ্চতায় ১৯ সে.মি.। মহিষ মূর্তিতেও চাকা লাগানো ছিল। হস্তীমূর্তির মতো মহিষটিও একটি পীঠিকার উপর দণ্ডায়মান। চাকা সমেত মহিষ মূর্তিটি উচ্চতায় ৩১ সে.মি. এবং দৈর্ঘ্যে ২৫ সে.মি.। মূর্তিগুলির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতার হিসাব দেওয়ার অর্থ হল তাদের গঠন সম্বন্ধে পাঠককে অবহিত করা, কারণ মূর্তিগুলি ধাতব শিল্পে সিন্ধুসভ্যতার কারিগরদের বিস্ময়কর দক্ষতার সাক্ষ্যবহন করে। দৈমাবাদের কারিগররা কেন এমন পশুমূর্তি বানিয়েছিলেন, তার উপযুক্ত ব্যাখ্যা দেওয়া দুষ্কর। আর যাই হোক, এগুলি খেলনা নয়। কারণ ব্রোঞ্জ নির্মিত এই ভাস্কর্যগুলি খেলনা হবার পক্ষে অতিরিক্ত বড় ও ভারী। এছাড়া খ্রি. পূ. দ্বিতীয় সহস্রকের প্রথমার্ধে দাক্ষিণাত্যের উত্তরাংশে তামা এমন সুলভ ছিল না, যার ফলে ওই ধাতু খেলনা তৈরি করতে যথেচ্ছ ব্যবহার করা যেত। ফলে ধাতব কারিগরি কৌশলের এই অনুপম নিদর্শনগুলি ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে; ধর্মীয় শোভাযাত্রায় এগুলি প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকাও অসম্ভব নয় (ধাওলিকর ১৯৯৩)।
হরপ্পা সভ্যতার অর্থনৈতিক জীবনের যে দিকটি বহু আলোচিত, তা হল তার বাণিজ্য, বিশেষত দূরপাল্লার বাণিজ্য। হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে মেসোপটেমীয় সভ্যতার বাণিজ্যসম্পর্ক ইতিপূর্বেই আলোচিত। কিন্তু এই বিষয়ে নতুন বক্তব্য সংযোজনের অবকাশ আছে। মেসোপটেমীয় সভ্যতার সঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার বাণিজ্যিক লেনদেনের প্রমাণ মূলত সীলমোহর থেকে জানা যায়। এই প্রসঙ্গে সুমেরীয়-অক্কাদীয় একটি কীলকাকার (কুনেইফর্ম) সীলমোহর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সীলমোহরে উৎকীর্ণ দৃশ্যে দেখা যায় শাসকতুল্য মর্যাদা ও সম্ভমদ্বারা চিহ্নিত এক ব্যক্তি বসে আছেন। তাঁর কোলের উপর এক বামনাকৃতি খর্বকায় মানুষ। শাসক সম্ভবত দুইজন দর্শনার্থীর সঙ্গে আলাপরত। সীলমোহরে উৎকীর্ণ লেখাটিতে মেলুহ ভাষার দোভাষী সু-ইলি-সু নামক এক ব্যক্তির উল্লেখ করা হয়েছে। পণ্ডিতদের অনুমান যে শাসকের কোলে উপবিষ্ট খর্বাকার ব্যক্তিই সু-ইলি-সু। মেলুহ বলতে সাধারণত নিম্ন সিন্ধু উপত্যকা ও সিন্ধুর বদ্বীপ এলাকা বোঝায়। উৎকীর্ণ দৃশ্যে বোধহয় ধরা আছে অক্কাদীয় রাজদরবারে উপস্থিত মেলুহভাষার দোভাষীর নিয়মিত উপস্থিতির কথা। এর দ্বারা হরপ্পা সভ্যতা ও মেসোপটেমিয়ার মধ্যে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগসূত্রের ছবিটি আমাদের কাছে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে (তোসি ১৯৯৩)।
মেলুহ স্থাননামটির সঙ্গে সাধারণত যুক্ত থাকে আরও দুটি এলাকার নাম: তিলমুন/দিলমুন এবং মগন। মেসোপটেমীয় লেখ থেকে বোঝা যায় মেলুহ-র সঙ্গে তিলমুন/দিলমুন এবং মগনের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। তিলমুন/দিলমুন ও মগন-এর সম্ভাব্য অবস্থান কোথায়, এই বিষয়ে পুরাতাত্ত্বিক মহলে মতৈক্য নেই। একসময় মনে করা হত মগন সম্ভবত বালুচিস্তানের দক্ষিণে মাকরাণ উপকূলের সঙ্গে অভিন্ন; বিশেষত এই উপকূলেই অবস্থিত ছিল দুটি হরপ্পা-আমলের প্রত্নক্ষেত্র: সুতকাগেনডোর এবং সোতকাকোহ্ (পৃষ্ঠা ৩৩-৩৪ দ্রষ্টব্য)। কিন্তু মেসোপটেমীয় লেখতে মগন অঞ্চলের খ্যাতি তামার প্রাপ্তিস্থান হিসেবে; মাকরান উপকূলে তাম্রখনির অস্তিত্ব জানা নেই। ফলে ভিন্নতর শনাক্তকরণের সম্ভাবনা থেকে যায়। গত তিন দশক ধরে ওমান অঞ্চলে উৎখননের ফলে স্পষ্টই প্রতীয়মান যে তামা ওই অঞ্চলে পাওয়া যেত। এ ছাড়া ওমান অঞ্চলের সঙ্গে সিন্ধু বদ্বীপ এলাকার বাণিজ্যিক যোগসূত্রের প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যও হাজির করা সম্ভব। এই বাণিজ্যিক যোগাযোগ অবশ্যই হত সাগর পাড়ি দিয়ে। ফলে মগন বলতে সাম্প্রতিক গবেষকরা অধিকাংশই ওমান অঞ্চলকে বোঝান (তোসি ১৯৯৩, রত্নাগর ১৯৮১, ১৯৯৪)। তিলমুন /দিলমুনের সম্ভাব্য অবস্থান ছিল পারস্য উপসাগরের বাহরিন অঞ্চলে। বেশিরভাগ পুরাবিদ এই শনাক্তকরণ সম্বন্ধে সহমত হলেও ভিন্ন ধারণা পোষণ করতেন রোমিলা থাপার। তাঁর ধারণা হরপ্পা সভ্যতায় মূলত দ্রাবিড়ভাষা চলিত ছিল। ফলে তিনি মেলুহ, তিলমুন /দিলমুন, মগন এই স্থাননামগুলিকে দ্রাবিড়ীয় ভাষাতত্ত্বের মাধ্যমে শনাক্ত করার চেষ্টা করেন। তিনি উক্ত তিনটি অঞ্চলকে গুজরাট সৌরাষ্ট্র উপকূলবর্তী এলাকায় শনাক্ত করেন (থাপার ১৯৭৫, ১৯৮৩)। এই মত বিতর্কিত এবং তার কঠোর সমালোচনা করেছিলেন গোবিন্দকুট্টি ও ড্যুরিং কাসপার্স (১৯৭৮)। ড্যুরিং কাসপার্স দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেয়েছেন সমুদ্র বাণিজ্যের দ্বারা হরপ্পা সভ্যতা ওমান, বাহরিন ও সুমের অঞ্চলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিল। হরপ্পা সভ্যতায় সুমেরীয় বণিকদের অবস্থানের দিকেও তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন (ড্যুরিং কাসপার্স ১৯৭৯, ১৯৮৪, ১৯৮৭, ১৯৯১, ১৯৯২, ১৯৯৬)। হরপ্পা সভ্যতার বণিকরাও যে মেসোপটেমিয়ায় যেতেন তার পরিচয় কুনেইফর্ম লেখতে হাজির। এই লেখগুলিতে মেলুহবাসীদের (অর্থাৎ সিন্ধু বদ্বীপ এলাকার অধিবাসীদের) একটি গ্রাম বা নিবেশন এবং মেলুহর এক জাহাজি বণিকের উল্লেখও দেখা যাবে (এস. পারপোলা, এ. পারপোলা এবং ব্রানসউইক ১৯৭৭; তোসি ১৯৮৬)। হরপ্পা সভ্যতার দূর পাল্লার বাণিজ্য নিয়ে আলোচনায় সমুদ্রবাণিজ্য বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। ওমান উপসাগর ও পারস্য উপসাগরে হরপ্পা সভ্যতার বণিকদের আগ্রহ অস্বীকার করা কঠিন। ওমান অঞ্চল থেকে তামা আমদানি করে সেই তামা আবার রপ্তানি হত মেসোপটেমিয়াতে (রত্নাগর ১৯৯৪; ওয়াইজগাৰ্বার ১৯৮১) হরপ্পার সীলমোহরে জলযানের যে প্রতিকৃতি দেখা যায়, তার সঙ্গে নিম্ন সিন্ধু এলাকায় ও সিন্ধু বদ্বীপ অঞ্চলে আজও প্রচলিত সাবেকি জলযানের সাদৃশ্য লক্ষ করবার মতো।
তবে হরপ্পা সভ্যতার দূরপাল্লার বাণিজ্য বোধহয় কেবলমাত্র সমুদ্রনির্ভর ছিল না। উত্তর পূর্ব আফগানিস্তানের প্রাচীন ব্যাকট্রিয়া অঞ্চল থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে হরপ্পা সভ্যতার বিবিধ তৈজস (সারিয়ানিডি, ১৯৭৯)। হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী এলাকার মাধ্যমে মধ্য এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়া বাণিজ্যিক যোগাযোগের সম্ভাবনা এর ফলে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ইরানের টেপে ইয়াহিয়া ও শর-ই-সোকতা প্রত্নক্ষেত্র থেকেও পাওয়া গিয়েছে সিন্ধু সভ্যতার নানা সামগ্রী। এর দ্বারা কেবলমাত্র যে স্থলপথে ইরানের সঙ্গে বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া যায় তা-ই নয়, মনে হয় উত্তর পশ্চিম ভারত থেকে স্থলপথে মেসোপটেমিয়া পৌঁছতে ইরান বাণিজ্যিক অন্তর্বর্তীর ভূমিকাও নিয়েছিল (ল্যামবার্গ-কার্লোভস্কি ১৯৭২)। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইরানের আলতিন টেপ-এ ম্যাসন-এর পুরাতাত্ত্বিক প্রয়াস (১৯৮১)। তিনটি হাতির দাঁতের সামগ্রী এখানে পাওয়া যায় ও তাতে হরপ্পা-সভ্যতার কারিগরি কৌশলের প্রকাশ তর্কাতীত। নামগাজাতেও হরপ্পাসভ্যতার সামগ্রীর সন্ধানে মিলেছে। প্রাক-হরপ্পা যুগের প্রত্নক্ষেত্র মুণ্ডিগক (আফগানিস্তানে) হয়ে একটি উত্তরাভিমুখী পথ হরপ্পা সভ্যতাকে যুক্ত করেছিল দক্ষিণ তুর্কমেনিস্তানের সঙ্গে। ম্যাসনের অনুসরণে এই স্থলবাণিজ্যের গুরুত্ব স্বীকার করতেই হবে। ইরানের শাহদাদের প্রত্নবস্তু স্পষ্টই ইঙ্গিত দেয় কীভাবে সিন্ধুসভ্যতা ও ইরানের স্থলবাণিজ্যে শাহদাদ বিশেষ তাৎপর্য লাভ করেছিল (আস্থানা ১৯৮৪)। একথা ঠিকই হরপ্পা সভ্যতার বাণিজ্যের আলোচনা দূরপাল্লার ব্যবসার প্রসঙ্গ ঐতিহাসিকদের বেশি আকর্ষণ করে। এই সভ্যতার আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের গুরুত্ব যে নগণ্য নয়, সে বিষয়ে এস.পি. গুপ্তের গবেষণা উল্লেখের দাবি রাখে (গুপ্ত ১৯৮৪)। মহেঞ্জোদড়োর মতো বৃহদায়তন ও প্রধান শহরে কারিগরি শিল্পের যে বৈচিত্র্য দেখা যায়, তার থেকে বুঝতে অসুবিধে হয় না শিল্পজাত সামগ্রীর স্থলপথে ও নদীপথে সরবরাহ ও বণ্টনের কেন্দ্ররূপে মহেঞ্জোদাড়োর বিশেষ ভূমিকা ছিল। চনহৃদড়োও একইভাবে কারিগরি শিল্পোৎপাদনের কেন্দ্র এবং নদী পারাপারের পক্ষে অনুকূল এক এলাকা। আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যিক যোগাযোগের প্রসঙ্গে সিন্ধু ও তার উপনদীগুলির তাৎপর্য খাটো করা দুরূহ হবে (দিলীপ চক্রবর্তী ১৯৯৫: ১০৭-০৮)।
হরপ্পা-সভ্যতার অর্থনৈতিক জীবনের সর্বাপেক্ষা আলোচিত ও আকর্ষক বিষয় তার নগরায়ণ। এই বিষয়ে কিছু আলোচনা পূর্বেই করা হয়েছে (পৃ: ৩৫-৭)। তার সঙ্গে কয়েকটি নূতন আবিষ্কারের কথা অবশ্যই যুক্ত করতে হবে। লোথাল, দৈমাবাদ প্রভৃতি প্রত্নস্থলের আবিষ্কার থেকে বোঝা যায় হরপ্পা সভ্যতা ক্রমশ তার মূল এলাকা থেকে ক্রমে দক্ষিণ দিকে ছড়াচ্ছিল। এই প্রসারের অন্যতম সেরা নজির কচ্ছ অঞ্চলে অবস্থিত ধোলাবীরা। হরপ্পা সভ্যতার চারটি বৃহত্তম নগরের অন্যতম ধোলাবীরা, যার উৎখনন করেছিলেন আর. এস. বিশ্ত। প্রাকারবেষ্টিত নগরটি পূর্ব-পশ্চিমে ৮০০ মি. এবং উত্তর-দক্ষিণে ৬৫০ কি.মি. এলাকা জুড়ে বিরাজ করত। হরপ্পা-সভ্যতার নগরগুলিতে সাধারণত দুইটি এলাকাগত ভাগ চোখে পড়ে নগরের পশ্চিমে ‘সিটাডেল’ বা উঁচু এলাকা এবং পূর্বে বা দক্ষিণ-পূর্বে নগরের প্রধান বসতি এলাকা বা ‘নিচু’ শহর। ধোলাবীরার নগর বিন্যাস এই ছক থেকে স্বতন্ত্র। কারণ, এখানে আছে উঁচু শহর, মাঝ-শহর ও শহরের নিচু এলাকা। মাঝের শহর অন্য কোনও প্রত্নস্থলে দেখা যায় না। শহরের উঁচু এলাকায় যে বিশাল প্রকার ছিল, তাতে নানা সময়ে সংস্কার ও সংযোজন করা হয়। প্রাকারটিকে আরও শক্তপোক্ত করাই ছিল এই সংস্কারকর্মের মুখ্য উদ্দেশ্য। ধোলাবীরার পরিণত পর্যায়ে নগরটিতে কোনও এক প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে; বিশ্ট-এর মতে ভূমিকম্প ঘটে থাকতে পারে। ফলে ব্যাপক সংস্কারসাধন করা হয় প্রাকারটিতে। সিটাডেল এলাকাতে প্রবেশদ্বারও আবিষ্কৃত হয়েছে। উত্তরের প্রবেশদ্বারটির পিছনে সিটাডেল এলাকাতে একটি জলাধার দেখা যায়। জলাধারটি প্রস্থে ১২.৮০ মি; এর সঙ্গে যুক্ত ছিল ২৪ মি দীর্ঘ ও ৭০ মি চওড়া একটি প্রণালী। প্রণালীটির মাধ্যমে জলাধারে সংরক্ষিত হত বৃষ্টির জল। কচ্ছ-এর মতো শুষ্ক জলবায়ুতে নগরের জল সংরক্ষণের এই উন্নত ব্যবস্থা পুরাবিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
মাঝ-শহরটিও সিটাডেল এলাকার মতোই প্রাকারবেষ্টিত। এই অংশটির ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে আছে ৩৬০ মি (পূর্ব-পশ্চিম) x ২৫০ মি (উত্তর-দক্ষিণ) এলাকা জুড়ে। ইমারতগুলি ঘন সন্নিবিষ্ট; একটি বড় সড়কের অবশেষও উদ্ধার করা গিয়েছে।
ধোলাবীরার নিচু এলাকা বর্গাকৃতি: ৩০০ মি x ৩০০ মি.। এটিই প্রধান বসতি এলাকা। তিন খণ্ডে বিভক্ত ধোলাবীরার আরও একটি অনুপম চরিত্র আছে। শহরের তিন এলাকাতেই সুপরিকল্পিতভাবে প্রচুর পরিমাণে খোলা জায়গা রাখা হয়েছিল। এই ব্যবস্থা হরপ্পা-সভ্যতার অন্য কোনও বসতিতে চোখে পড়ে না। কলিবঙ্গনে অন্যান্য নগরের মতোই ‘সিটাডেল’-এর অবস্থান পশ্চিমে, আর তার পূর্বে ছিল শহরের বসতিপ্রধান নিচু এলাকা। কিন্তু ‘সিটাডেল’ এলাকাটি আবার দুইভাগে (উত্তর ও দক্ষিণ অংশে) বিভক্ত। হরপ্পা-সভ্যতার নগর পরিকল্পনায় ‘সিটাডেল’-এর দ্বিভাজিত বিন্যাসের দ্বিতীয় নজির নেই। গুজরাটের বিখ্যাত নগর লোথালের নগর বিন্যাসেও কয়েকটি স্বকীয়তা আছে। সমগ্র বসতি এলাকাটি পূর্ব-পশ্চিমে ২২৫ মি.। সিটাডেল-এর অবস্থান বসতির পশ্চিমে নয়, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। একটি বিশাল হৰ্ম্য সিটাডেল এলাকায় আবিষ্কৃত হয়। তাতে অনেকগুলি কক্ষ, প্রতিটি কক্ষের সঙ্গে সংলগ্ন স্নানাগার। একটি শস্যাগারের অবশেষও এখানে মিলবে। পুরাবিদ্দের ধারণা এটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ কোনও শাসকের বাসস্থান। নগরের পূর্বদিকে একটি বিশাল জলাধার, যাকে লোথালের আবিষ্কারক এস. আর. রাও চিহ্নিত করেছিলেন লোথালের ‘ডক’ হিসেবে।
লোথালকে যদি রাও-এর অনুসরণে হরপ্পা-সভ্যতার বন্দর নগর বলে মেনে নেওয়া হয়, তাহলে তার নগরবিন্যাসের স্বকীয়তাকে অনুধাবন করা সম্ভব। দিলীপ চক্রবর্তীর অভিমত যে, হরপ্পা-সভ্যতায় নগরবিন্যাসে পরিকল্পনার লক্ষ্মণ স্পষ্ট; কিন্তু সর্বত্র বাঁধা ছকে বড় নগরগুলিতে সোজা সোজা সড়ক ছিল না। এর ফলে হরপ্পা-সভ্যতা নগরগুলি যে অবধারিতভাবে চৌখুপি কাটা নকশা মাফিক তৈরি হয়েছিল, একথা নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়া কঠিন (চক্রবর্তী ১৯৯৫; রাও ১৯৭৩; বি. কে. থাপার এবং মুঘল ১৯৯২), হরপ্পা-সভ্যতার নগরায়ণ সম্বন্ধে আধুনিক গবেষণায় নগরের উচ্চাবচ ক্রম নির্ধারণ করার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। অর্থাৎ নগরের এলাকাটি কত বড়। সব নগর নিঃসন্দেহে সমান মাপের ছিল না। বড় নগর ও অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রতর নগরের অনুপাত সম্বন্ধেও পুরাতাত্ত্বিকর সচেতন। এই সভ্যতার বৃহত্তম নগর ছিল মহেঞ্জোদড়ো: আয়তন ২৪০-২৫০ হেক্টর, হরপ্পার এলাকা ১৫০ হেক্টর; বানাওয়ালী ১৬/ ১৭ হেক্টর; রাখিগঢ়ি ২৫ হেক্টর। আবার মাকরাণ উপকূলে ছিল মাত্র ২ হেক্টর এলাকা জুড়ে সুৎকাগেনডোর-এর মতো ক্ষুদ্রতর শহর (দিলীপ চক্রবর্তী ১৯৯৫)। পাকিস্তানের চোলিস্তান অঞ্চলে রফিক মুঘল (১৯৯২) ১৭৪টি পরিণত হরপ্পা-সভ্যতা পর্যায়ের প্রত্নক্ষেত্র আবিষ্কার করেন। তার মধ্যে অন্তত ৭৩টির আয়তনের হিসাব-নিকাশ স্পষ্ট। ০.১-৫ হেক্টর আয়তনের প্রত্নস্থল ৪৪; ৫.১-১০ হেক্টর আয়তনের প্রত্নক্ষেত্র ২০; ১০.১-২০ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট বৃহত্তর ক্ষেত্রের সংখ্যা ৮ এবং ৮০ হেক্টর বা তার চেয়েও বড় প্রত্নস্থল মাত্র একটি। এই পরিসংখ্যান থেকে নগরের উচ্চাবচক্ৰম সম্বন্ধে দ্বিমত থাকে না।
হরপ্পা সভ্যতার নগরাশ্রয়ী চরিত্রের সঙ্গে বাণিজ্য অবশ্যই ওতপ্রোত জড়িত। কিন্তু কেমন ছিল বণিকের জীবনযাত্রা? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন, কারণ তথ্যের অপ্রতুলতা। তবুও হরিয়ানার বানাওয়ালীতে খননকার্য চালিয়ে বিশ্ট বহু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের সঙ্গে একটি গৃহের অবশেষও খুঁজে পান। হরপ্পা-সভ্যতার পরিণতরূপ বানাওয়ালীতে দেখা যায়। শহরের নিচু এলাকায় অবস্থিত এই বাড়িটিতে বৈঠকখানার মতো একটি বসার ঘর ছিল; ঘরটির মেঝে ইট দিয়ে বাঁধানো। কয়েকটি সীলমোহর এবং ওজনের বাটখারাও উদ্ধার করা হয় বাড়িটি থেকে। বাড়ির মেঝেতে অর্ধ-প্রোথিত জালাজাতীয় বেশ কয়েকটি পাত্রও দেখা যায়। বাড়িটির স্নানাগারে হাত ধোওয়ার জন্য উঁচুতে একটা জায়গা ছিল। হাত ধোয়ার বেসিন জাতীয় সরঞ্জামটির পাশেই নালী; ব্যবহৃত জল নালী দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে পড়ত রাস্তায় রাখা আরও একটি ভাণ্ডের ভিতর। বিশ্ট ইমারতটিকে বণিকের বাসগৃহ বলে অনুমান করেছেন (বিশ্ট ১৯৯৩)।
॥ ৪ ॥
হরপ্পা-সভ্যতার অবসানের (আ: খ্রি: পূ: ১৭৫০) পর প্রায় একহাজার বছর ভারত ইতিহাসে বৈদিক যুগ বলে সাধারণত আখ্যাত। ঋগ্বেদ (খ্রি: পূ: ১৫০০-১০০০) এবং পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য (খ্রি: পূ: ১০০০-৬০০) থেকে উপরিউক্ত এক সহস্রকের সামাজিক-অর্থনৈতিক ইতিহাস জানার মুখ্য উপাদান। এর সঙ্গে সহায়ক তথ্য সূত্র হিসেবে পুরাতাত্ত্বিক সামগ্রীর উল্লেখ অবশ্যই করতে হবে। ঋগ্বেদের প্রধান সামাজিক ধনসম্বল পশুপালন ও পশুচারণ। যদিও কৃষিকর্ম একেবারেই অজানা ছিল না। কিন্তু ঋগ্বেদ অনুধাবন করলে বুঝতে অসুবিধে হয় না ঋগ্বেদের সমাজে অর্থনৈতিক ক্রিয়া হিসেবে কৃষি পশুপালনের-বিশেষত গবাদিপশুপালন—তুলনায় গৌণ ছিল। একথা অবশ্যই স্বীকার্য যে প্রায় পাঁচ শতাব্দীব্যাপী ঋগ্বেদের যে সময়সীমা, তাতে সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থাণু ছিল না। ঋগ্বেদের দশম তথা শেষ মণ্ডলটি প্রক্ষিপ্ত ও সম্ভবত পরবর্তীকালে সংযোজিত। দশম মণ্ডলে এক দ্যূতক্রীড়াসক্ত ব্যক্তিকে একটি উপদেশ দেওয়া হয়েছে, যা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। “হে দূতকার, পাশা কখনও খেলো না, বরং কৃষিকার্য কর। তাতে যা লাভ হয়, সে লাভে সন্তুষ্ট হও ও আপনাকে কৃতার্থ বোধ কর। তাতে পত্নী ও অনেক গাভী পাবে।” (ঋগ্বেদ ১০. ৩৪. ১৩)। কৃষির গুরুত্ব এখানে স্পষ্টতই স্বীকৃত। দ্যূতক্রীড়ায় জয়ী ব্যক্তি হয়তো হঠাৎ সম্পদ পেতে পারেন। আবার তাতে অনিশ্চয়তাও কম থাকে না। কিন্তু কৃষিতে অভ্যস্ত ভীবনে অর্থনৈতিক সুস্থিতি ও নিরাপত্তা নিশ্চয়ই অধিকতর। তার দ্বারাই সুষ্ঠুভাবে পারিবারিক ও সাংসারিক জীবনযাত্রা চালানো সম্ভব হত। ঋগ্বেদের একেবারে অন্তিম পর্যায়ে পশুপালনের উপর নির্ভরশীল সমাজ ক্রমেই কৃষির আর্থিক সুবিধা বুঝতে পারছিল। পশুপালনের উপর আশ্রিত সমাজ সাধারণত অপেক্ষাকৃত সরলতর, সামাজিক ভেদাভেদও কম প্রকট (থাপার ২০০০)। ঋগ্বেদের সমাজে ধনবণ্টনে অসাম্য ছিল, একথা অনস্বীকার্য। ফলে এই সমাজে পূর্ণ সাম্যের কোনও নজির নেই। যদিও চতুর্বর্ণভিত্তিক জটিল সমাজ ঋগ্বেদের আমলে দেখা দেয়নি। তবুও সুবীরা জয়সোয়ালের ধারণা ঋগ্বেদের কৌমপ্রধান সমাজে উচ্চনীচ তারতম্য বিরাজ করত (জয়সোয়াল ১৯৯৮: ১৩৩-৮৭)। পরবর্তী বৈদিক আমলে কীভাবে পুরোদস্তুর কৃষিজীবী সমাজের বিকাশ ঘটল এবং তার অভিঘাতে সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবনে যে জটিলতর পরিস্থিতির উদ্ভব হল, তার আলোচনা ইতিপূর্বে করা হয়েছে (পৃ. ৫৪-৬৭)। বৈদিক সাহিত্যের ভিত্তি অর্থনৈতিক জীবনে পরিবর্তনের যে চিত্রটি পাওয়া যায়, তা মূলত উত্তরভারত বা আরও স্পষ্ট করে চিহ্নিত করলে সিন্ধু নদনদী ব্যবস্থা ও গাঙ্গেয় উপত্যকার অনেকাংশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
কিন্তু ভারতের অন্যত্র কী ঘটছিল বা অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কেমন ছিল, তার পরিচয় পেতে গেলে পুরাবস্তুর সাক্ষ্যকে আশ্রয় করতে হবে। পুরাতত্ত্বের আলোকে দেখা যাবে যে খ্রি. পূ. তৃতীয় ও দ্বিতীয় সহস্রকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নিম্নোক্ত সংস্কৃতিগুলি বিরাজ করছিল:
(ক) তাপ্তী, প্রবর ও গোদাবরী বিধৌত দাক্ষিণাত্যে সাওয়ালা সংস্কৃতি (আ. খ্রি. পূ. ২০০০-১৭০০)।
(খ) চম্বল উপত্যকায় কায়াথা সংস্কৃতি (আ: ২১০০-১৮০০ খ্রি. পূ.)।
(গ) দক্ষিণ পূর্ব রাজস্থানে আহাড় বা বনস সংস্কৃতি (২১০০-১৪০০ খ্রি. পূ.)।
(ঘ) মধ্য ও পশ্চিম ভারতে মালব সংস্কৃতি (আ: ১৭০০-১৪০০) খ্রি. পূ.)।
(ঙ) দাক্ষিণাত্যের উত্তরাংশে জোড়ওয়ে সংস্কৃতি (১৪০০-৯০০) খ্রি. পূ.)।
(চ) গাঙ্গেয় উপত্যকার মধ্য ও নিম্নভাগে তাম্ৰাশ্মীয় সংস্কৃতি (খ্রি. পূ. ১৩০০-১০০০ খ্রি. পূ.)।
ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকলেও এই সংস্কৃতিগুলির মধ্যে কালগত নৈকট্য আছে। কয়েকটি সামান্য লক্ষণও দেখা যাবে। উপরিউক্ত সংস্কৃতিগুলি পুরাতাত্ত্বিক বিচারে নব্যপ্রস্তর পর্যায়ভুক্ত। উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য উৎপাদনের ক্ষমতা না থাকলেও কিছু পরিমাণ ফসল ফলাবার দক্ষতা সবগুলিতেই দেখা যাবে। উৎপন্ন শস্যের তালিকায় রয়েছে গম, যব, মসুর, মটর, ছোলা। পাথরের জাঁতার উপস্থিতিও খাদ্যোৎপাদনের পরোক্ষ প্রমাণ। কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী যুক্ত ছিল পশুপালন। অন্যদিকে তীরের ফলা, হারপুন ও বঁড়শির আবিষ্কার নির্দ্বিধায় প্রমাণ করে কৃষির পাশাপাশি শিকার ও মাছ ধরা এই সংস্কৃতিগুলির বস্তুগত জীবনে বিদ্যমান ছিল। কৃষি, পশুপালন ও আংশিক শিকার—এই তিনের সমাহারে নব্যপ্রস্তর তাম্ৰাশ্মীয় যুগের মানুষ যে অর্থনৈতিক জীবন গড়ে তুলেছিল, তা মূলত স্থায়ী আবাসভিত্তিক। এই আমলের আবাসন প্রধানত মাটির বাড়ি। আহাড় সংস্কৃতিতে অবশ্য মাটির বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে ইটের বাড়ি—এমনকী পোড়ানো ইটের বাড়িও রয়েছে। কারিগরি দক্ষতার সুস্পষ্ট নিদর্শন বহুবিধ মৃৎপাত্র নির্মাণে। বস্তুত এই সংস্কৃতিগুলির স্বকীয়তা তাদের মৃৎপাত্রের দ্বারাই চিহ্নিত। তামার ব্যবহার একদিকে যেমন কুঠারের মতো হাতিয়ার বানাতে দেখা যায়, আবার বালার মতো অলঙ্কার প্রস্তুত করতেও তামার প্রয়োগ অজানা ছিল না। অলঙ্কার-শিল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ পুঁতি বা মাল্যদানা নির্মাণ, যার প্রধান কঁচামাল আধাদামি পাথর (বি. কে. থাপার এবং রহমান ১৯৯২)। এই সামান্য লক্ষণগুলি স্বল্প পরিসরে বলে নিয়ে এবার কিছুটা বিশদ আলোচনা করা যাক ইনামগাঁও প্রত্নক্ষেত্র সম্বন্ধে। অত্যন্ত সুষ্ঠু উৎখননের জন্য ইনামগাঁওতে প্রত্নবস্তুর প্রাচুর্যই শুধু নেই, সেই প্রত্নবস্তুতে কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার ছবিও পাওয়া যাবে।
মহারাষ্ট্রের পুনা জেলায় ঘোড় নদীর তীরে তাম্ৰাশ্মীয় যুগের অন্যতম প্রধান প্রত্নক্ষেত্র ইনামগাঁও অবস্থিত। ইনামগাঁও-এর প্রাচীনতম বসতি খ্রি. পূ. ১৬০০-১৪০০ তে গড়ে ওঠে, এখানে খ্রি. পূ. ১৪০০-৭০০ কালসীমায় ইনামগাঁও-এর কৃষি অর্থনীতির উপর বিশেষ আলোচনা করা হবে। গম, যব, মসুর-এর সঙ্গে অল্প পরিমাণে হলেও এখানে ধান চাষের নিদর্শন উপস্থিত। পুরাতাত্ত্বিকরা মনে করেন ইনামগাঁওতে গমের ফলনের সূচনা ১৪০০-১০০০ খ্রি. পূ. নাগাদ। ইনামগাঁওতে পাওয়া গিয়েছে বহু বাড়ির অবশেষ। পুরাবিদ্রা গৃহগুলিকে ক্রমিক সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত করেছেন। কৃষিপ্রধান অর্থনীতি স্থায়ী আবাসন ব্যতিরেকে গড়ে উঠতে পারে না। ইনামগাঁও-এর গ্রামীণ কৃষি-অর্থনীতির একটি বিশেষ দিক তার সেচ ব্যবস্থা। একটি সেচ প্রণালীর অংশ বিশেষ পুরাতাত্ত্বিকরা উৎখননের মাধ্যমে উদ্ধার করেছেন। এটি ছিল দৈর্ঘ্যে ৪২০ মি. এবং প্রস্থে ৬ মি.। সেচ প্রণালীটি উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে চলে গিয়েছে। ইনামগাঁও-এর উত্তর-পূর্ব দিকে ছিল নদী। বুঝতে অসুবিধা হয় না, নদীর জল সেচ-প্রণালীর মাধ্যমে কৃষির কাজে সরবরাহ করা হত। আকাশ থেকে তোলা আলোকচিত্রে আরও একটি সেচখালের সন্ধান মিলেছে; এটি দক্ষিণ-পূর্ব থেকে উত্তর-পশ্চিমে বিন্যস্ত। প্রধান প্রণালীর উল্লেখ আগেই করা হয়েছে; এটি সম্ভবত একটি ছোট খাল, যার মধ্য দিয়ে প্রধান প্রণালীর জল খানিকটা ঘুরিয়ে পাঠানো হত। গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতিতে তাম্ৰাশ্মীয় পর্বে সেচখালের এত স্পষ্ট প্রমাণ সংখ্যায় সামান্যই। উন্নত জলসেচের সুবাদে ইনামগাঁও-এর মানুষ যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত ফসল ফলিয়ে থাকে, তাতে বিস্মিত হবার কিছু নেই। তার জোরালো প্রমাণ রয়েছে ইনামগাঁও-এর বসতবাড়িতে শস্য সংরক্ষণের ব্যবস্থার মধ্যে। ৭৫ নং বাড়িতে বেশ কয়েকটি জালার সন্ধান পাওয়া যায়। বাড়িটি থেকে শস্যের দগ্ধাবশেষও আবিষ্কৃত হয়েছে। জালাগুলিতে অনেক ক্ষেত্রেই চারটি পায়া লাগানো। আরও দুইটি বাড়ির দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। ৫১ এবং ৫১ক সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত বাড়ি দুটি পরস্পরের সংলগ্ন। ৫১ক বাড়িটি কার্যত ৫১ নং বাড়ির পিছন দিকের একটি ঘর। ৫১ নং বাড়িটির দৈর্ঘ্য ১০.৫০ মি., প্রস্থ ৫. ২০ মি.; ৫১ক দৈর্ঘ্যে ৯১.৫ মি এবং প্রস্থে ৫ মি.। এই দুইটি বাড়িতে দেখা গিয়েছে। ভূগর্ভে প্রোথিত শস্য সংরক্ষণের গোলা। কোনও কোনও ক্ষেত্রে গোলা ৮০ সেমি. গভীরে প্রোথিত। শস্যের গোলাটিকে একেবারে তলা থেকে ইঁদুরে যাতে কাটতে না পারে, তার ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছিল। ভূগর্ভে প্রোথিত শস্যগোলা ছাড়াও মাটির উপরে রাখা জালার মধ্যেও শস্য সংরক্ষণ করা হত। পুরাতাত্ত্বিকদের অনুমান ভূগর্ভে প্রোথিত গোলায় থাকত যব, আর জালা ব্যবহার করা হত গম সংরক্ষণের জন্য। ৫১ এবং ৫১ক সংখ্যক দুইটি বাড়ি, আগেই বলা হয়েছে, ছিল একেবারে লাগোয়া। ৫১ক সংখ্যক গৃহটিকে কার্যত পৃথক করা হয়েছে অনেকগুলি শস্য রাখার জালা বসিয়ে। আজকাল যেমন একটি বড় ঘরকে আলমারি পরপর রেখে ভাগ করা হয়, অনেকটা সেই আদলে। ৫১ এবং ৫১ক দুটি গৃহের কোনওটিতেই মৃৎপাত্র নেই, দৈনন্দিন গাৰ্হস্থ্যজীবনের অন্যকোনও উপকরণও চোখে পড়ে না। অতএব এই দুইটি কোনও মতেই বাসগৃহ নয়। সেই কারণে প্রত্নতাত্ত্বিকরা লাগোয়া বাড়ি দুটিকে শস্যাগার বলে যুক্তিসঙ্গতভাবে শনাক্ত করেছেন।
শস্যাগারের অনতিদূরে ৫২ থেকে ৫৬ সংখ্যক যে পাঁচটি বাড়ি দেখা যায়, তাকে পৃথক পৃথক পাঁচটি বসতবাড়ি বলে প্রত্নবিদ্রা মনে করেন না। এটি কোনও একজন ব্যক্তিরই দ্বারা ব্যবহৃত হত, এমন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ উৎখনন থেকে প্রতীয়মান। সেক্ষেত্রে অস্বীকার করা অসম্ভব যে ওই ব্যক্তি কোনও সাধারণ মানুষ নন, তিনি অন্যান্য বাসিন্দার তুলনায় বেশি সম্পন্ন ও ক্ষমতাধর। এই বৃহৎ আবাসে সমাধিও আবিষ্কৃত হয়েছে। সমাধিতে মৃতদেহ ছাড়াও বহু তৈজস মৃতব্যক্তির উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য প্রোথিত করা হয়। সমাধিতে রাখা বিবিধ তৈজস অবশ্যই ইঙ্গিত দেয় যে, বাড়ির মালিক ছিলেন অত্যন্ত সচ্ছল। অগ্নিকুণ্ডের উপস্থিতি থেকে অনুমান করা কঠিন হবে না যে, ধর্মীয় উদ্দেশ্যে অগ্নি উপাসনা হত। প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার থেকে যে সামগ্রিক চিত্রটি ফুটে ওঠে তা হল ৫২-৫৬ সংখ্যক বাড়িটি সম্ভবত ইনামগাঁও-এর প্রধানের বাসগৃহ। তিনি জনগোষ্ঠীর দলপতি তো বটেই, প্রধান পুরোহিত হলেও বিস্মিত হবার নেই। এইদিক থেকে বিচার করলে আরও একটি অনুমানও অযৌক্তিক হবে না। প্রধানের বাসগৃহ ও শস্যাগারের নিকট অবস্থান লক্ষ করার মতো। শস্যাগারে রাখা ফসল কি দলপতির উদ্দেশে প্রদত্ত উপহার বা বাধ্যতামূলক দেয় সামগ্রী? দলপতির ক্ষমতার দ্যোতক হিসেবেও তাই শস্যাগারটিকে বিচার করা চলে (ধাওলিকর, সাংকালিয়া, আনসারি ১৯৮৮: ১৬৩-৬৭; ১৮৯-৯৬; ধাওলিকর ১৯৯৪: ৩১-৫২)।
খ্রি. পূ. ১৫০০ থেকে ৬০০ এই পর্বটিতে ভারত ইতিহাসে নগরজীবন কার্যত অদৃশ্য ও অনুপস্থিত। গ্রামভিত্তিক কৃষিজীবী সমাজই এই নয়শত বছরের বস্তুগত জীবনের মুখ্য লক্ষণ। লেনদেন অন্তত খানিকটা যে প্রচলিত ছিল তার সন্ধান মিলবে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে; কিন্তু তা পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক ক্রিয়া কি না সে ব্যাপারে সংশয় থেকে যায়। ‘শ্ৰেষ্ঠী’ শব্দটি সর্বপ্রথম পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যেই ব্যবহার করা হল। তবে, অত্যন্ত ধনী বণিক অর্থে যে ‘শ্ৰেষ্ঠী’কে বৌদ্ধ ও পরবর্তী সাহিত্যে আমরা দেখতে অভ্যস্ত, সেই একই অর্থে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে শ্ৰেষ্ঠী শব্দটি আছে কি না, তা প্রমাণ করা কঠিন। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে পণ্যসিদ্ধি নামক একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উল্লেখ দেখা যায়। এই জাতীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিঃসন্দেহে করা হত পণ্য লেনদেন থেকে সাফল্য লাভের বাসনায়। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের প্রায় সর্বত্র অতি জটিল, দীর্ঘ ও ব্যয়সাপেক্ষ যজ্ঞানুষ্ঠানের জয়জয়কার। এই যজ্ঞানুষ্ঠানে সামাজিক ধনসম্বলের অনেক অংশই ব্যবহৃত হত। তার ফলে কৃষিপ্রধান সমাজে উদ্বৃত্ত উৎপাদনের সম্ভাবনা থাকলেও ওই উদ্বৃত্ত যজ্ঞের প্রয়োজনেই লাগত, লেনদেন বা বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপে বোধহয় যুক্ত হত না। যজ্ঞানুষ্ঠানের পর পুরোহিতদের জন্যে প্রদান করা হত বিপুল পরিমাণ দক্ষিণা। দক্ষিণার মধ্যে ছিল গবাদিসম্পদ, শস্য, মূল্যবান ধাতু (কিন্তু মুদ্রা নয়) ও দাসদাসী। দক্ষিণার মাধ্যমে ধনসম্বলের হস্তান্তর তথা কিছু পরিমাণ লেনদেনের সম্ভাবনাকে অবশ্য একেবারে বাতিল করা যায় না। (থাপার ১৯৮৪, ১৯৯৫)।
॥ ৫॥ খ্রি. পূ. ৬০০-৩০০
ভারত ইতিহাসে আলোচ্য সময়ে অনেকগুলি দিক বদল ঘটেছিল। তাই এই তিনশত বছরের অবস্থা বহুপঠিত ও আলোচিত। সাহিত্যগত ও পুরাতাত্ত্বিক তথ্যসুত্র থাকার ফলে এই পর্বটির গুরুত্ব অনুধাবন করা কঠিন নয়। বৌদ্ধ ও জৈনধর্মসহ নূতন ধর্মমতের জনপ্রিয়তা ও প্রসার; হরপ্পা-সভ্যতার অবসানের পর উত্তর ভারতে আবার নগর জীবনের আবির্ভাব এবং নির্দিষ্ট ভূখণ্ড দ্বারা চিহ্নিত রাজতান্ত্রিক ও অরাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উদ্ভব—এই ব্যাপক পরিবর্তনগুলির কারণে খ্রি. পূ. ৬০০-৩০০ ভারত ইতিহাসে বিশেষ স্থান পেয়েছে। অস্বীকার করা যাবে না যে এই পরিবর্তনগুলি দেখা যাচ্ছিল মূলত উত্তর ভারতে—আরও স্পষ্ট করে বললে গাঙ্গেয় উপত্যকাতে। দাক্ষিণাত্য ও দক্ষিণ ভারতে অনুরূপ পরিবর্তন দেখা যায় না।
যেহেতু আলোচ্য তিনশত বছরে গাঙ্গেয় উপত্যকায় প্রথম নগর জীবনের লক্ষণ প্রতিভাত হল, এবং যেহেতু খ্রি. পূ. ৬০০ থেকে ভারতে দ্বিতীয় নগরায়ণের সূচনা, তাই অর্থনৈতিক ইতিহাসে বহুক্ষেত্রেই আলোচনার সিংহভাগ ব্যয়িত হয়েছে নগর এলাকার কৃষি-বহির্ভূত অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ নিয়ে। অর্থাৎ কারিগরি শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে। কিন্তু নগরের উন্মেষ ও বিকাশ ভারতের মতো দেশে কৃষিকে আশ্রয় করেই গড়ে ওঠে। কৃষির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বিখ্যাত অষ্টাধ্যায়ীর প্রণেতা পাণিনি। সংস্কৃত ব্যাকরণের এই প্রসিদ্ধ গ্রন্থটিতে কৃষি বিষয়ক বহু তথ্য পাওয়া যায়। কৃষির উপযুক্ত জমির প্রতিশব্দ ক্ষেত্র, কর্ষ; ওই একই জমি হল্য এবং সীত্য বলেও অভিহিত, অর্থাৎ যে জমিতে হাল চালনা এবং লাঙ্গলের ফলা (সীতা) চালনা করা যায়। গোচর, গোষ্ঠ এবং ব্রজ বলতে পশুচারণভূমিই বোঝানো হয়েছে। অনুর্বর, নোনামাটির প্রতিশব্দ ঊষর। চাষের পক্ষে অনুকূল ক্ষেত্র সুহলী, অর্থাৎ সহজেই যে জমিতে হল চালনা করা যায়। যে ভূমিতে লাঙ্গল চালানো কষ্টকর, তা দুর্হলী। অনাবাদি, অকর্ষিত এলাকা ‘অহলী’ বলে আখ্যাত। ‘কীনাশ’ বা ‘কৃষিবল’ কৃষিকার্যে রত ছিলেন। পাণিনি জমির প্রকারভেদ করেছেন উৎপন্ন ফসলের পরিপ্রেক্ষিতে। ব্রীহি বা ধানচাষের পক্ষে উপযুক্ত জমি ব্রৈহেয়। আবাদী ধান্য ব্রীহি আর বুনো ধান নীবার যে পৃথক, এ ব্যাপারে পাণিনি সচেতন। ধানের মধ্যে সেরা ছিল শালি; তার উপযুক্ত জমি শালেয়। শালেয় জমি যে মগধে সুলভ তারও ইঙ্গিত আছে অষ্টাধ্যায়ীতে। মদ্র এলাকা প্রসিদ্ধ ছিল যব্য জাতীয় ভূমির জন্য, অর্থাৎ যে ভূমি যব উৎপাদনের জন্য প্রশস্ত। একইভাবে তিল ফলানো হত তিল্য জাতীয় জমিতে। ফসলের বৈচিত্র্য পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে অবশ্যই স্বীকৃত হয়েছে। সব ফসল একই সময় বা ঋতুর নয়। আশ্বিন মাসে যে ফসলের বীজ বপন করা হয় তার পরিচয় আশ্বযুজক; গ্রীষ্মকালে উপ্ত বীজ থেকে যে ফসল জন্মায় তা গ্রৈষ্মক আর বসন্তকালে বীজ বপন করলে সেই শস্য বাসন্তক বলে অভিহিত। বর্ষণ ও কর্ষণ যে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত সে ব্যাপারে পাণিনি সচেতন। বৃষ্টির স্বল্পতা হলে অবগ্রহ ঘটে। উদঞ্চন বা মাটির তৈরি বড় পাত্রে জল তুলে ধান্যক্ষেত্রে সেচের ব্যবস্থা করা হত (অগ্রবাল ১৯৫৩)।
কৃষির গুরুত্ব যথাযথ স্বীকৃত হয়েছে প্রাচীন পালি সাহিত্যে। পালি গ্রন্থগুলিতে ‘উক্কট্ঠ কম্ম’ বা উৎকৃষ্ট কর্ম (অর্থাৎ উচ্চমর্যাসম্পন্ন বৃত্তি) এর মধ্যে ‘বণিজ্জা’ (বাণিজ্য) এবং ‘গো-রক্খা’ (পশুপালন) ছাড়াও আছে ‘কসি’ বা কৃষি। এই উক্কট্ঠ কম্মগুলি ‘উক্কট্ঠ কুল’ (উৎকৃষ্ট কুল অর্থাৎ উচ্চ সামাজিক মর্যাদা বিশিষ্ট গোষ্ঠী)-র পক্ষে উপযুক্ত। উক্কট্ঠ বা উৎকৃষ্ট সামাজিক গোষ্ঠীর অন্তর্গত খত্তিয় (ক্ষত্রিয়), বহ্মণ (ব্রাহ্মণ) এবং গহপতি। এঁরা যে হীনকম্ম ও হীনসিপ্প অনুসরণকারী হীনকুলোদ্ভবদের তুলনায় উচ্চতর মর্যাদায় অবস্থান করতেন সেই বিষয়ে দ্বিমত নেই। ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ বৈদিক যুগ থেকেই সুপরিচিত, কিন্তু প্রাচীন পালি সাহিত্যেই প্রথম গহপতি নামক একটি বিশিষ্ট গোষ্ঠীর উপস্থিতি দেখা গেল। গহপতি যে বিপুল বিত্তের অধিকারী, সেই বর্ণনা পালি সাহিত্যে বারবার এসেছে। তার ফলে গহপতিকে প্রায়ই ‘সেটঠি’ (শ্রেষ্ঠী) বা অত্যন্ত ধনী বণিকের সঙ্গে অভিন্ন বলে ধারণা করা হয়েছে। এই শনাক্তকরণ মেনে নেওয়া কঠিন, কারণ সমগ্র পালি সাহিত্যে গহপতি ও সেটঠি কখনওই সমার্থক বলে বিবেচিত হন না। ফলে প্রশ্ন ওঠে গহপতির বিত্তের সূত্র কী? পালি সাহিত্যে গহপতিকে বলা হয়েছে ‘কস্সক’ অর্থাৎ কৃষক। সাধারণ কৃষক তিনি নিশ্চয়ই নন, কারণ গহপতি ও কুটুম্বিক বা বর্ধিষ্ণু রায়তী কৃষক আলাদা। পালি গহপতি শব্দটি সংস্কৃত ‘গৃহপতি’ থেকে উৎপন্ন। গৃহপতি অর্থাৎ গৃহস্থ বা পরিবারের প্রধান; এই কারণে পালি গহপতি ও সংস্কৃত গৃহপতি উভয় শব্দ গৃহস্থ তথা কৃষিজীবী একান্নবর্ত্তী পরিবারের প্রধান (ইংরেজি অনুবাদে ‘হাউস হোল্ডার’)। এই বহুল ব্যবহৃত অর্থে গহপতি শব্দটিকে মেনে নিতে কিছু সমস্যা আছে। পালি সাহিত্যে গার্হস্থ্যজীবনে প্রতিষ্ঠিত তথা অভ্যস্ত ব্যক্তির অভিধা ‘গহট্ঠ’ (=গৃহস্থ) এবং ‘গিহী’ (=গৃহী)। ‘গহট্ঠ’ এবং ‘গিহী’ শব্দদুটি কোনওমতেই পালি গহপতির সঙ্গে অভিন্ন নয়।
সংযুক্ত নিকায় ও অঙ্গুত্তরনিকায়তে প্রদত্ত গহপতিদের তালিকার প্রতি এই প্রসঙ্গে মনোযোগ দেওয়া দরকার। এই তালিকায় আছেন (১) রাজা উদেন (উদয়ন)। (২) হত্থিগামের উগগ্ গহপতি (৩) হলিদ্দিকের এক গহপতি, (৪) নকুলপিতা গহপতি, (৫) লোহিচ্চ ব্রাহ্মণ, (৬) বেসালির (বৈশালী) উগগ্ গহপতি, (৭) অলবির হত্থুক গহপতি, (৮) সোন গহপতিপুত্ত, (৯) মহানাম শাক্য, (১০) জীবক কোমারবচ্ছ। ‘গহপতিপুত্ত’ কথাটির অর্থ আক্ষরিকভাবে নিশ্চয়ই গহপতির পুত্র, কিন্তু গহপতিপুত্ত এবং গহপতি আসলে সমার্থক। অতএব গহপতির পরিচিতি পুরুষানুক্রমিক হতে পারত। গহপতিদের তালিকায় যেমন আছেন একজন রাজা, তেমনই রয়েছেন একজন ব্রাহ্মণ; আবার বুদ্ধের আমলের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক জীবক কোমারবচ্ছও এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যে কোনও বর্ণ বা জাতি থেকেই গহপতি হওয়া সম্ভব ছিল। সেক্ষেত্রে মানতে হবে, গহপতি শব্দটি প্রকৃতপক্ষে বিশিষ্ট সামাজিক মর্যাদা ও সম্ভ্রমের দ্যোতক। এই বিশিষ্ট মর্যাদা লাভের প্রধান উপাদান গহপতির বিপুল বৈভব। আগেই বলা হয়েছে, গহপতিদের সম্পদের উৎস বাণিজ্য নয়, কৃষি; অথচ তিনি সাধারণ কৃষক নন।
কৃষি-অর্থনীতির সূত্র ধরে কীভাবে গহপতি অপর্যাপ্ত সম্পদের অধিকারী হতেন, তার পরিচয় মিলবে বিনয়পিটকে বর্ণিত মেণ্ডক গহপতির কাহিনীতে। মেণ্ডক গহপতি ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতার অধিকারী। ওই ক্ষমতার দ্বারা তিনি নিমেষে শস্যবৃষ্টি ঘটিয়ে তাঁর শস্যাগার পূর্ণ করতে পারেন। তিনি একবার জমিতে হলকর্ষণ করলে জমিতে সাতবার হলচালনার দাগ ফুটে ওঠে: অর্থাৎ সাত সাতবার জমিতে লাঙ্গল দেওয়া সম্পন্ন হয়। এই পর্যন্ত বর্ণনা থেকে স্পষ্ট যে, মেণ্ডক গহপতি প্রভূত ভূসম্পদের অধিকারী। তাঁকে বিশাল খামারের মালিক বলে চিহ্নিত করা সম্ভব; তিনি কোনওক্রমেই সাধারণ কর্ষক নন। তাঁর কৃষিক্ষেত্র এতই বিশাল যে তাঁর নিজের পক্ষে, এমনকী পরিবারের সদস্যদের দ্বারাও ওই ভূ-সম্পদ যথাযথভাবে কর্ষণ করা সম্ভব ছিল না। তাই তাঁর কৃষিক্ষেত্রে নিযুক্ত হয়েছিল দাসকর্মকরপোরিস (দাস-ক্রীতদাস, কর্মকর-ভৃত্য এবং পোরিস-পুরুষ বা মুনিষ খাটা কৃষিমজুর)। এই কর্মচারীদের ছয়মাসের বেতন (‘ছম্মাসিক বেতন’) একসঙ্গে দিতে পারার ক্ষমতাও মেণ্ডকের ছিল। নগদ অর্থে বেতনের পরিবর্তে কৃষিকাজে নিযুক্ত মানুষকে তিনি ছয়মাসের খাদ্যসম্ভারও দিতেন। আরও চমকপ্রদ বিবরণ যে, মেণ্ডক রাজার সৈন্যবাহিনীকে খাদ্য সরবরাহ করতে পারতেন; সেনার বেতন (নগদে অথবা বস্তু দিয়ে) মেটাবার মতো সম্পদও তাঁর ছিল। এছাড়া মেণ্ডকের অধীনে কাজ করত ১২৫০ জন গোপালিক, অর্থাৎ রাখাল। এদের দ্বারা সংগৃহীত টাটকা দুধের একাংশ মেণ্ডক প্রতিদিন দান করতেন বৌদ্ধ সঙেঘর উদ্দেশে। মেণ্ডকের প্রভূত সম্পদ বিষয়ে লেশমাত্র সংশয় নেই; বিনয়পিটকের বর্ণনায় একথাও স্পষ্ট যে এই সম্পদের সূত্র ছিল মেণ্ডকের ভূরি পরিমাণ ভূসম্পদ। বাণিজ্য থেকে তাঁর ধনাগম ঘটেছিল, এইরকম আভাস বৌদ্ধ কাহিনীটিতে নেই। কৃষিই যদিও মেণ্ডকের সম্পদের আকর, কিন্তু তিনি গ্রামবাসী নন; তিনি ভদ্দিয়নগরে। এটিও গহপতিদের প্রায় নিয়মিত বৈশিষ্ট্য: তাঁরা প্রভূত ভূসম্পদের মালিক হলেও মূলত নগরবাসী। সংযুক্ত নিকায়তে এক গহপতির উল্লেখ আছে, যিনি প্রায়ই নগর ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে তার ভূসম্পদ পরিদর্শনে যেতেন। মেণ্ডক অবশ্য কেবলমাত্র বহুল ভূসম্পদের মালিক তা-ই নয়, তিনি ‘দাসকর্মকরপোরিস’-জাতীয় বিবিধ শ্রমজীবীর নিয়োগকর্তাও। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল তাঁর বৈভবের দরুন তিনি রাজদরবার ও বৌদ্ধসঙেঘর সঙ্গে যুগপৎ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারতেন। মেণ্ডক যে প্রয়োজনে রাজাকে আর্থিক সহায়তা করতে পারতেন এবং নানাবিধ রসদ সরবরাহ করতেন, সে কথাও বিনয়পিটকের নিরিখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বৌদ্ধগ্রন্থ দীঘনিকায়তে গহপতিদের সম্বন্ধে সাধারণভাবে বলা হয়েছে গহপতিরা করদাতা ও রাজার সম্পদবৃদ্ধিকারক (গহপতি করকারক, রাশিবড্ঢক’)। গহপতির প্রদত্ত কর যে রাজকোষকে সমৃদ্ধ করত, তাতে সন্দেহ নেই। এর ফলে শাসক গোষ্ঠী তথা রাজার কাছে গহপতির গুরুত্ব তর্কাতীত। সম্পদ এইভাবে গহপতির মর্যাদা লাভের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল। অন্যদিকে বৌদ্ধসঙ্ঘের দাতা হিসেবেও গহপতিদের ভূমিকা অত্যন্ত উজ্জ্বল। একমাত্র রাজাকে বাদ দিলে বৌদ্ধ সঙেঘর উদ্দেশে দানকর্মে গহপতিরাই সর্বাগ্রে ছিলেন। শ্রাবস্তী নগরীতে জেতবন প্রথমে কিনে ও পরে তা বুদ্ধের উদ্দেশে দান করে যে অনাথপিণ্ডিক বৌদ্ধ কাহিনীতে চিরস্থায়ী প্রসিদ্ধি পেয়েছেন, সেই অনাথপিণ্ডিকও একজন গহপতি।
কৃষি ও গোপালনের মাধ্যমে গহপতি প্রভূত ধনলাভ করেছিলেন; ওই কৃষি ও পশুপালন বৈদিক ঐতিহ্য অনুযায়ী বৈশ্যের বৃত্তি বলে নির্দিষ্ট। অথচ পরবর্তী বৈদিক আমলে এই বৃত্তি ধারণ করলেও বৈশ্যদের সামাজিক মর্যাদা ক্রমেই অধোগামী হচ্ছিল। খ্রি. পূ. ৬০০-৩০০-তে রাজ দরবারের সঙ্গে ও বৌদ্ধ সঙেঘর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ গহপতির সামাজিক উন্নয়নে নিঃসন্দেহে সহায়ক হয়। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপে পৃষ্ঠপোষকতা দাতা তথা পৃষ্ঠপোষকের মর্যাদা বৃদ্ধি করে থাকে। সামাজিক মর্যাদা লাভে গহপতির বিশেষ আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। আবার অন্যদিকে বৌদ্ধ সঙঘ তার প্রাতিষ্ঠানিক সংগঠন চালাবার জন্য যে সম্পদ ও পৃষ্ঠপোষকতার প্রত্যাশা করত, সেই প্রত্যাশাও অনেকটাই পূরণ করতেন গহপতিরা। নূতন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এইভাবে নূতন বিত্তবান সম্প্রদায় গহপতিরা ও বৌদ্ধ সঙঘ পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে উঠছিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে গহপতিদের ‘উক্কক্টঠ কুলে’ স্থান পাওয়ার ঘটনাটি বিচার্য। পালি সাহিত্যে গহপতি চক্রবর্তী (একচ্ছত্র আধিপত্যের অধিকারী) রাজার সপ্তরত্নের অন্যতম রত্ন বলেও কীর্তিত (ওয়াগলে ১৯৬৬; উমা চক্রবর্তী ১৯৮৭)।
এই প্রসঙ্গে ‘সেট্ঠি-গহপতি’দের আলোচনা করা উচিত। পালি সাহিত্যে গহপতি, সেট্ঠি এবং সেট্ঠি-গহপতি প্রত্যেকেরই পৃথক পরিচিতি আছে। অর্থাৎ, সেট্ঠি-গহপতি, গহপতি ও সেট্ঠি উভয়ের থেকেই আলাদা। গহপতিদের মতোই সেট্ঠি-গহপতিও বারাণসী, চম্পা, সাকেত, রাজগৃহ প্রমুখ প্রধান নগরের বাসিন্দা। রাজগৃহের এক সেট্ঠি গহপতি ছিলেন অনাথপিণ্ডিকের শ্যালক। অপর এক সেট্ঠি-গহপতি অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে তাঁর সব সম্পত্তি রাজকীয় অধিকারে চলে গিয়েছিল, পালি সাহিত্যে এমন কাহিনীও দেখা যায়। শেষোক্ত কাহিনীটি সেট্ঠি-গহপতির বিত্তের ইঙ্গিতবাহী। অঙ্গুত্তরনিকায় সহ প্রাচীন পালি গ্রন্থে কখনও কখনও বর্ণনা দেওয়া হয়েছে গহপতি ছোট দোকানদারকে, তন্তুবায়কে এবং তুন্নবায় (দর্জি)-কে অর্থ ধার দিতেন। গহপতি কি তাহলে তাঁর ভূসম্পদজাত প্রভূত সম্পদের একাংশ ছোটখাটো ব্যবসায়ে লগ্নি করতেন? এই কর্মে তিনি লিপ্ত হতেন অবশ্যই ঋণের মারফত সুদ পাবার আশায়। নগদ অর্থ বিভিন্ন ব্যবসায়ে লগ্নি করে গহপতি নিজেকে পুরোদস্তুর কৃষি অর্থনীতিতে আবদ্ধ রাখছেন না, আবার পেশাদারি ব্যবসায়ীতেও তিনি পর্যবসিত হচ্ছেন না। অথচ মহাজনী কারবারে যুক্ত থেকে টাকার বাজারে তাঁর ভূমিকা ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এইভাবে পরোক্ষ উপায়ে গহপতি যখন ব্যবসার জগতে স্থান করে নেন, তখন তিনি আর পাকাপাকি গহপতি নন, আবার শ্রেষ্ঠীর মতো সওদাগরও নন। সেই কারণেই তিনি উভয়ের থেকে আলাদা এবং সেট্ঠি-গহপতি এই স্বতন্ত্র অভিধায় চিহ্নিত (ওয়াগলে ১৯৬৬; থাপার ১৯৮৪, থাপার ১৯৯৫)।
কৃষি উৎপাদনে উল্লেখনীয় অগ্রগতি ৬০০-৩০০ খ্রি. পূ. কালীন গাঙ্গেয় উপত্যকা ও উত্তর ভারতে কারিগরি শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশের পক্ষে বিশেষ সহায়ক হয়ে ওঠে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার যে ঘটছিল, তার অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য প্রমাণ তৎকালীন মুদ্রাব্যবস্থায় উপস্থিত। এই বিষয়ে সাম্প্রতিক আলোচনা এখানে সংযোজিত হল। ধাতবখণ্ডের দ্বারা মুদ্রা নির্মিত হয় একথা সত্য, অর্থাৎ ধাতবখণ্ডটি বিনিময়ের একটি মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত হয়। বিনিময়ের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে গৃহীত হতে গেলে ধাতবখণ্ডটির একটি নির্দিষ্ট ওজন বা তৌল রীতি (‘ওয়েট স্ট্যান্ডার্ড’) থাকতেই হবে। অপর অপরিহার্য শর্ত এই যে ধাতবখণ্ডটির ধাতুগত বিশুদ্ধি (‘মেটালিক পিওরিটি’) বজায় রাখতে হবে। এই কারণে মুদ্রা তৈরির জন্য মূলত দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য ধাতু বেছে নেওয়া হয়, যেমন সোনা ও রূপা। অবশ্য তাম্রমুদ্রার প্রচলনও অজানা ছিল না। ধাতুগত বিশুদ্ধি বলতে অবশ্য একথা বোঝায় না মুদ্রায় নিছক খাঁটি ধাতুই ব্যবহৃত হবে। সোনা বা রূপার মুদ্রাতে খাদ মেশাতেই হবে, নচেৎ গলিত ধাতু জমাট বাঁধে না। স্বর্ণ বা রৌপ্য মুদ্রাতে সোনা বা রূপাই প্রধান ধাতু, তার সঙ্গে কিছু পরিমাণ ভিন্ন ধাতুর খাদ (‘অ্যালয়’) মেশানো হত। বলাই বাহুল্য, ধাতবখণ্ডে যদি প্রধান ধাতুর পরিমাণ ও অনুপাত কম থাকে এবং খাদের পরিমাণই বেশি হয়, তাহলে ওই ধাতবখণ্ড বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে তার বিশ্বস্ততা ও গ্রহণযোগ্যতা হারাবে এবং কালে পরিত্যক্ত হবে। ধাতবখণ্ড যখন মুদ্রা হিসেবে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তখন তা নিঃসন্দেহে প্রাণবন্ত বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপের ইঙ্গিত দেয়। মুদ্রার উপরে যে নানা প্রকার ছাপ এবং নকশা উৎকীর্ণ করা হয়, তার মূল উদ্দেশ্য ধাতবখণ্ডটির ধাতুগত বিশুদ্ধি ও নির্দিষ্ট তৌলরীতি সম্বন্ধে মুদ্রাব্যবহারকারীকে নিশ্চিত করা। ধাতুখণ্ডের এই ছাপ মারা সংস্কৃত ভাষায় ‘টঙ্ক’ বলে পরিচিত, ‘টঙ্ক’ শব্দ থেকেই বাংলায় টাকা কথাটির উৎপত্তি।
পালি সাহিত্যে কার্ষাপণ এই মুদ্রানাম বারবার উল্লিখিত। পাণিনি ‘রূপ্য’ বলতে সম্ভবত খ্রি. পূ. পঞ্চম শতকে প্রচলিত রৌপ্য মুদ্রাকেই বুঝিয়েছিলেন। এর কিছুকাল পরে, খ্রি. পূ. চতুর্থ শতকের শেষভাগে আলেকজান্ডার যখন ভারতের উত্তর-পশ্চিমাংশে অভিযান চালান, তখন গ্রিক বিবরণী অনুসারে তক্ষশিলার রাজা ওম্ফিস (অম্ভী) আলেকজান্ডারের উদ্দেশে ‘চিহ্নিত রৌপ্য’ (‘সিগনাটি আর্জেন্টি) উপঢৌকন দিয়েছিলেন। এই ‘চিহ্নিত রৌপ্যখণ্ড’গুলি খুব সম্ভবত রৌপ্য মুদ্রা। খ্রি. পূ. ষষ্ঠ ও পঞ্চম শতকে মুদ্রা ব্যবস্থা প্রচলিত হবার সাহিত্যগত প্রমাণ এখন পুরাতত্ত্বের দ্বারাও দৃঢ়ভাবে সমর্থিত।
গন্ধার মহাজনপদের রাজধানী ও উত্তর-পিশ্চম ভারতের অন্যতম প্রধান নগর তক্ষশিলার প্রাচীনতম পুরাতাত্ত্বিক পরিচয় পাওয়া যায় ‘ভির ঢিবি’ এলাকায় উৎখননের মাধ্যমে। পুরাবস্তুর আলোকে তক্ষশিলায় নগরায়ণ ঘটেছিল খ্রি: পূ: পঞ্চম শতক নাগাদ। তক্ষশিলার উৎখননে আবিষ্কৃত হয় একটি মৃৎপাত্র যার মধ্যে ছিল নানা প্রকারের ১১৭১টি মুদ্রা। এর মধ্যে কয়েকটি মুদ্রা আলেকজান্ডার ও গ্রিক অধিকৃত গন্ধারের প্রাদেশিক শাসনকর্তা ফিলিপের। বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা যে আলেকজান্ডার ও ফিলিপের মুদ্রাগুলি একেবারে নূতন ও আনকোরা। অর্থাৎ প্রস্তুত হবার অল্পকাল পরেই সেগুলিকে কোনও ব্যক্তি অন্যান্য মুদ্রার সঙ্গে একত্রে মৃৎপাত্রে রেখে তাকে মাটির তলায় পুঁতে লুকিয়ে রেখেছিল। মুদ্রাভাণ্ডারটির মধ্যে গ্রিক মুদ্রাগুলিই নবীনতম। অতএব তাদের নির্মাণ ও প্রচলন খ্রি: পূ: চতুর্থ শতকের শেষভাগে ঘটেছিল। তাহলে একথাও মানতে হবে মৃৎপাত্রের মধ্যে পাওয়া অন্যান্য মুদ্রা, যেগুলি গ্রিক মুদ্রার মতো একেবারে আনকোরা মুদ্রা নয়, সেগুলি আলেকজান্ডারের জারি করা মুদ্রার পরবর্তী তো নয়ই, সম্ভবত গ্রিক মুদ্রাগুলির চেয়ে পুরাতন। ফলে আলোচ্য মুদ্রাগুলির সম্ভাব্য কাল হিসেবে খ্রি. পূ. পঞ্চম শতককে নির্দেশ করা চলে। মৃৎপাত্রে রাখা ১১৭১টি মুদ্রার মধ্যে ১০৫৫টি ক্ষুদ্র ছাঁচে ছাপ মারা মুদ্রা। ৭৯টি মুদ্রা ওই একই ধরনের ছাঁচে ছাপ মারা মুদ্রা কিন্তু আয়তনে অত্যন্ত ক্ষুদ্র। মুদ্রাগুলিতে কোনও রাজার বা ব্যক্তির নাম নেই; পরিবর্তে নানাপ্রকার নকশা দেখা যায় মুদ্রার এক পিঠে। মুদ্রার অপর পিঠে কোনও লেখ বা নকশা নেই। এই জাতীয় এক পিঠে ছাঁচে ছাপ মারা মুদ্রা ভারতে বহুপ্রচলিত ছিল এবং এগুলি পাঞ্চ-মাকর্ড কয়েন বা অঙ্ক চিহ্নিত মুদ্রা বলে অভিহিত। তক্ষশিলার ছাঁচে ছাপ মারা মুদ্রাগুলি গড়পড়তা ৫৪ বা ৫৫ গ্রেণ ওজনের। মুদ্রাতাত্ত্বিকদের বিচারে মুদ্রাগুলি ৫৭.৬ গ্রেণ তৌলরীতির ভিত্তিতে নির্মিত হয়। ৫৭.৬ গ্রেণ ওজন আবার ভারতীয় শাস্ত্রে উল্লিখিত ৩২ রতির কার্ষাপণ ওজনের সমান। অতএব তক্ষশিলার মুদ্রাভাণ্ডার থেকে আবিষ্কৃত ৫৭.৬ গ্রেণ তৌলরীতির অনুসরণে প্রস্তুত রৌপ্যমুদ্রাগুলিই বৌদ্ধগ্রন্থসহ বিবিধ ভারতীয় শাস্ত্রে আখ্যাত ‘কার্ষাপণ’ মুদ্রা। উপরের আলোচনা থেকে একথাও প্রমাণ করা সম্ভব যে, কার্ষাপণ মুদ্রা তক্ষশিলা অঞ্চলে খ্রি. পূ. পঞ্চম শতকে প্রচলিত ছিল (গুপ্ত ১৯৬৯; মুখোপাধ্যায় ১৯৯২)।
পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে ‘শতমান’ নামক ধাতবখণ্ডের উল্লেখ দেখা যায়। মান বলতে যদি ওজনের একটি নির্দিষ্ট একক বোঝায়, শতমান তাহলে ওই এককের একশো গুণ বেশি ওজনকে ইঙ্গিত করে। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে উল্লিখিত এই জাতীয় ওজনের ন্যূনতম একক ‘কৃষ্ণল’ অর্থাৎ রতি (‘রক্তিকা’ থেকে রতি শব্দের উদ্ভব)। এক কৃষ্ণল বা রতির ওজন ১.৮ গ্রেণ। তাহলে শতমান ধাতবখণ্ডের ওজন ১.৮ গ্ৰেণ x ১০০= ১৮০ গ্রেণ। ১৮০ গ্রেণ ওজনের ধাতবখণ্ড মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল কি না, তার সংশয়াতীত প্রমাণ নেই। কিন্তু ৯০ গ্রেণ বা ৪৫ গ্রেণ তৌলরীতি অনুসারে প্রস্তুত মুদ্রার অস্তিত্ব জানা আছে। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের অভিমত যে এই মুদ্রাগুলি অর্ধশতমান এবং পাদ (এক চতুর্থাংশ) শতমান তৌলরীতিতে প্রস্তুত করা হয়েছিল। এই প্রকার মুদ্রার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়েছে কাবুলে পাওয়া চমান-ই-হুজুরির মুদ্রাভাণ্ডার থেকে। এই মুদ্রাভাণ্ডার থেকে আবিষ্কৃত হয়েছিল একটি পাত্র। পাত্রে ছিল নানা প্রকার মুদ্রা, যার অধিকাংশই গ্রিক মুদ্রা। গ্রিক মুদ্রাগুলি প্রধানত খ্রি. পূ. পঞ্চম শতকে নির্মিত হয়। অন্যান্য মুদ্রার মধ্যে ছিল ভারতীয় মুদ্রা যেগুলি শতমান বা শতমানের বিভিন্ন ভগ্নাংশের তৌলরীতিতে তৈরি করা হয়েছিল। অতএব ওই ভারতীয় মুদ্রাগুলিও নিঃসন্দেহে গ্রিক মুদ্রাগুলির সমকালীন। খ্রি. পূ. পঞ্চম-চতুর্থ শতকেই ভারতে নিশ্চিতভাবে ধাতবখণ্ড মুদ্রারূপে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বাণিজ্যের অগ্রগতির সমর্থনে এটি একটি অবিসংবাদী প্রমাণ।
বাণিজ্যের প্রসার আরও একপ্রকার প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের দ্বারা চিহ্নিত। এই উপাদান হল উত্তরভারতের কৃষ্ণ চিক্কন মৃৎপাত্র (নর্দার্ন ব্ল্যাক পলিশড্ ওয়্যার)। কারিগরি কৃৎকৌশলের নিরিখে অত্যন্ত উন্নত মানের এই মৃৎপাত্র খ্রি. পূ. ৬০০ নাগাদ থেকে নিয়মিত প্রস্তুত হতে থাকে। পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষ্যের দ্বারা দেখানো সম্ভব যে এই মৃৎপাত্রের উৎপাদনের এলাকা ছিল বর্তমান বিহার ও উত্তর প্রদেশের পূর্বাংশ। কিন্তু খ্রি. পূ. ৬০০-৩০০ এই কালসীমায় এই মৃৎপাত্রের সন্ধান পাওয়া যায় এক বিস্তীর্ণ এলাকায়। উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত চারসাদ্দা, তক্ষশিলা; পাঞ্জাব ও হরিয়ানার অন্তর্গত লুধিয়ানা, অমৃতসর, গুরুদাসপুর, আম্বালা, হিস্সার, রোহ্তক, কুরুক্ষেত্র; উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাংশে অবস্থিত মথুরা, আগ্রা, আলিগড়, মিরাট, বুলন্দশহর, এটাওয়া, লক্ষ্ণৌ প্রভৃতি অঞ্চল থেকে উত্তরভারতের কৃষ্ণ চিক্কন কৌলাল আবিষ্কৃত হয়েছে। মধ্যগঙ্গা উপত্যকায় (গোরখপুর, বারাণসী, এলাহাবাদ, মির্জাপুর, ফতেপুর, গয়া, পাটনা, সারন, মুঙ্গের, ভাগলপুর, পুর্ণিয়া) এই মৃৎপাত্র তো অবশ্যই আছে। কৃষ্ণ চিক্কন কৌলাল আটপৌরে তৈজস ছিল না; এগুলি মূলত বিলাসের উপকরণ। একটি বিশাল এলাকা জুড়ে কৃষ্ণ চিক্কন কৌলালের আবিষ্কার তাই ব্যবসায়িক যোগাযোগের নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য দেয় (ঘোষ সম্পাদিত ১৯৮৯; লাহিড়ী ১৯৯২)।
খ্রি. পূ. ৬০০ থেকে ৩০০ পর্যন্ত সময়সীমা বিখ্যাত হয়ে আছে ভারতে দ্বিতীয় নগরায়ণের সূচনা পর্ব হিসেবে। নগরায়ণের সম্ভাব্য কার্যকারণ ও পদ্ধতি নিয়ে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণা অব্যাহত আছে; বিতর্কও কম নেই। (দিলীপ চক্রবর্তী ১৯৯৫)। নগরগুলি তাদের নিজ নিজ পারিপার্শ্বিক থেকে বিযুক্ত ছিল না; একটি নগরকে কেবলমাত্র তার চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধভাবে বিচার করা সম্ভব নয়। একটি বৃহৎ নগর অন্যান্য প্রকার বসতির থেকে বোধহয় বিচ্ছিন্ন ছিল না। এই দিকটি জর্জ এরডোসির গবেষণায় মূর্ত হয়েছে। এরডোসি তাঁর পুরাতাত্ত্বিক গবেষণার জন্য বুদ্ধের আমলের বিখ্যাত নগর কৌশাম্বী (বৎস মহাজনপদের রাজধানী এবং বর্তমান এলাহাবাদের নিকটে অবস্থিত)-কে বেছে নিয়েছিলেন। কৌশাম্বী একটি বিখ্যাত প্রত্নক্ষেত্রও বটে। এই অঞ্চলে ৫৫০-৪০০ খ্রি. পূ. উত্তরভারতের কৃষ্ণ চিক্কন কৌলালের অস্তিত্ব সংশয়াতীত। আয়তনে কৌশাম্বীর প্রাচীন নগর ৫০ হেক্টর; বৎস মহাজনপদে এর চেয়ে বৃহত্তর বসতি ও নগর ছিল না। কিন্তু কৌশাম্বী নিছক একটি বিশাল নগর ও রাজধানী হিসেবে বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করেনি। কৌশাম্বীর প্রত্নস্থল থেকে কিছুটা দূরে ছিল আরও দুইটি নগরসুলভ প্রত্নক্ষেত্র: কারা ও শৃঙ্গবেরপুর। দুটিই গঙ্গাতীরে গড়ে উঠেছিল, দুটিই আয়তনে ১২ হেক্টর। শৃঙ্গবেরপুর ও কারার মধ্যবর্তী এলাকায় আরও একটি ক্ষুদ্রতর প্রত্নক্ষেত্রের সন্ধান মিলেছে—তার আয়তন ৬.১২ হেক্টর। অনুরূপ আর একটি প্রত্নক্ষেত্র দেখা যাবে শৃঙ্গবেরপুর ও কৌশাম্বীর মধ্যবর্তী এলাকায়—এটির আয়তন ৬.৭৫ হেক্টর। আয়তনে অনেক ছোট (.৪২ হেক্টর থেকে ২.০ হেক্টর) আরও ষোলোটি প্রত্নক্ষেত্র আছে। কৌশাম্বীর নগরায়ণ অনুধাবন করতে গেলে তাই নিছক কৌশাম্বীর এলাকার মধ্যে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখা সমীচীন হবে না। প্রত্নক্ষেত্রগুলির আয়তনের তারতম্য বসতিগুলির উচ্চাবচ ক্রমের পরিচয় দেয়। এই বসতিগুলির মধ্যে সবচেয়ে তলায় আছে প্রাথমিক এলাকা, অনেকটাই গ্রামীণ। এখানে কৃষি উৎপাদন ছাড়াও মৃৎপাত্র, পাথরের ছুরিকা, লোহার তৈজসপত্র নির্মাণ করা হত। তুলনায় বৃহত্তর এলাকাগুলি (যেমন কারা, শৃঙ্গবেরপুর) কারিগরি শিল্পোৎপাদন ছাড়াও চলত শৌখিন বিলাসদ্রব্যের উৎপাদন। স্থানীয় লেনদেনের কেন্দ্র হিসেবেও তাদের বিশিষ্ট স্থান অনুধাবন করা যায়। সর্বোপরি ছিল কৌশাম্বী যা আয়তনে কেবলমাত্র বৃহত্তমই নয়, ক্রিয়াকলাপের বৈচিত্র্য ও জটিলতাও সেখানেই সর্বাধিক। জনসংখ্যাও কৌশাম্বীতেই নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশি। ক্ষুদ্রতর বসতিতে যে সব ক্রিয়াকলাপ চলত, সেগুলি এখানেও ছিল। কিন্তু কৌশাম্বী একই সঙ্গে বৎস মহাজনপদের রাজধানী হিসেবে প্রধান রাজনৈতিক কেন্দ্র। ফলে গুরুত্বে কৌশাম্বী সন্নিহিত বসতিগুলিকে যে ছাপিয়ে যাবে, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই (এরডোসি ১৯৯৫)।
দ্বিতীয় নগরায়ণের প্রারম্ভিক পর্ব উত্তরভারতেই সীমাবদ্ধ দেখা যায়। এই উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে ছিল ষোলোটি মহাজনপদ, যা বৌদ্ধগ্রন্থ অঙ্গুত্তরনিকায়ে উল্লিখিত। মহাজনপদের মতো জটিল রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিকাশ এবং নগরের উদ্ভব সমকালীন। এই দুটি প্রক্রিয়া বিচ্ছিন্ন নয়, বরং পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ও একে অপরের পরিপূরক। এলাকাভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ব্যতিরেকে নগরের উদ্ভব ঘটা অসম্ভব ছিল। উপজাতিভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠনের চেয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা শুধু রাজনৈতিক দিক দিয়ে জটিলতর তা-ই নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে জটিলতা রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভবকে সুগম করে। আবার অন্যদিকে নগরায়ণ বলতে কেবলমাত্র নগরের তালিকা ও অবস্থানচর্চা নিশ্চয়ই বোঝায় না। কীভাবে নগর গড়ে ওঠে সেই প্রক্রিয়াটিকে অনুধাবন করা নগরায়ণ নিয়ে গবেষণার প্রধান উপজীব্য। কি আর্থ-সামাজিক কাঠামোর দিক দিয়ে, কি জনসংখ্যার বিচারে, কি সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে নগরের পরিস্থিতি গ্রামের তুলনায় একই সঙ্গে জটিলতর অথচ গোঁড়ামিমুক্ত। রাষ্ট্রব্যবস্থা ও নগরের বিকাশ দুইটির ক্ষেত্রেই মূল বিচার্য বিষয় পরিবর্তিত সামাজিক অবস্থা, যার ফলে সমাজ অপেক্ষাকৃত সরলতর ব্যবস্থা থেকে জটিলতর অবস্থায় রূপান্তরিত হয়। (অলচিন ১৯৯৫; থাপার ১৯৮৪, চক্রবর্তী ১৯৯১)।
॥ ৬ ॥ খ্রি. পূ. ৩২৪-১৮৭
আলোচ্য যুগ ভারতীয় ইতিহাসে মৌর্য আমল বলে প্রসিদ্ধ। প্রায় সমগ্র উপমহাদেশব্যাপী একচ্ছত্র ক্ষমতা বিস্তারের কৃতিত্ব মৌর্য বংশের অবশ্যই প্রাপ্য; যদিও এই রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ১৩৭ বছরের বেশি স্থায়ী হয়নি। মৌর্য রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সাধারণভাবে একশৈলিক ও অতিমাত্রায় কেন্দ্রীকৃত বলে চিহ্নিত করতে অধিকাংশ ইতিহাসবিদ্। অতিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে অর্থনৈতিক জীবনেও মৌর্যরা অভূতপূর্ব কেন্দ্রীকর্ণে প্রয়াস পেয়েছিলেন—এমন অভিমত বহু ঐতিহাসিকই পোষণ করেন। কিন্তু বিগত দুই দশকে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রণ সম্বন্ধে ঐতিহাসিকদের চর্চায় পরিবর্তন দেখা যায়। মৌর্য রাষ্ট্র তার বিশাল ভূখণ্ডের সর্বত্র একইরকম কেন্দ্রীকৃত নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারত কি না, এই নিয়ে পণ্ডিত মহলে হালে দ্বিমত দেখা যাচ্ছে (ফুসমান ১৯৮৭)। রোমিলা থাপার মৌর্য সাম্রাজ্যে অন্তত তিনটি প্রধান এলাকাগত বিভাজন দেখেন। মগধ ও সন্নিহিত অঞ্চল নিয়ে ছিল মাতৃরাষ্ট্র। তারপর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ছিল গাঙ্গেয় উপত্যকার প্রাক্তন মহাজনপদগুলি যা ইতিপূর্বেই মগধ তথা মৌর্য রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। পরিশেষে ছিল প্রান্তীয় এলাকা, যেমন গন্ধার-কম্বোজ অঞ্চল, আফগানিস্তানের অংশবিশেষ এবং দক্ষিণ কর্ণাটক। থাপারের অভিমত, মৌর্যদের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার প্রতাপ কার্যকরী ছিল মাতৃরাষ্ট্র এলাকায় ও গাঙ্গেয় উপত্যকার মূল ভূখণ্ডে প্রান্তীয় এলাকার প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক জীবনের উপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ পাটলিপুত্র থেকে বজায় রাখা আদৌ সম্ভব কি না, সে বিষয়েও থাপার প্রশ্ন তুলেছেন। কর্ণাটকসহ দাক্ষিণাত্যের প্রান্তীয় এলাকার প্রতি মৌর্যদের আগ্রহের প্রধান কারণ ওই অঞ্চলের খনিজ সম্পদের উপর অধিকার কায়েম করা। প্রান্তীয় এলাকা থেকে সম্পদ আহরণ করে মাতৃরাষ্ট্র ও কেন্দ্রীয় অঞ্চলকে ক্রমান্বয়ে সমৃদ্ধ করার নীতিই মৌর্যরা নিয়েছিলেন। সেই কারণে দাক্ষিণাত্যে তথা কর্ণাটকে ও অন্ধ্রপ্রদেশের কিছু অংশে মৌর্য রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় থাকলেও ওই অঞ্চলের অর্থনৈতিক জীবনে কোনও বড় মাপের বদল আসেনি। প্রাক-মৌর্য পর্বে এই অঞ্চলের বস্তুগত জীবনের প্রধান লক্ষণ সামান্য কৃষিকর্ম ও পশুপালন। মৌর্যদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও গাঙ্গেয় উপত্যকার লাঙ্গলভিত্তিক উন্নততর কৃষি অর্থনীতি—যা উদ্বৃত্ত উৎপাদনে সমর্থ—দাক্ষিণাত্যে মৌর্য আমলে দেখা গেল না। স্থায়ী কৃষিজীবী সমাজের উদ্ভব দাক্ষিণাত্যে ঘটে প্রকৃতপক্ষে মৌর্যোত্তর আমলে (থাপার ১৯৮৭)। কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত জনপদনিবেশ নীতির দ্বারা অনাবাদী এলাকায় কৃষির ব্যাপক সম্প্রসারণ কতটা বাস্তবে রূপায়িত হয়েছিল, তা নিয়েও সংশয় আছে। এই জাতীয় জনপদনিবেশ যে দাক্ষিণাত্য ও মধ্যভারতে খ্রি. পূ. চতুর্থ থেকে দ্বিতীয় শতকের প্রথমভাগে ঘটেনি, তা তো স্পষ্ট। এর ফলে বিশাল সাম্রাজ্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ মৌর্য রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল, ততটা বোধ হয় সংগৃহীত হয়নি। এর ফলে অর্থনৈতিক জীবনে নানাবিধ সমস্যা ও সংকট দেখা দিতে পারে, যার কিছুটা আভাস কৌটিল্য দিয়েছেন ‘প্রণয়ক্রিয়া’-র মতো আপৎকালীন পরিস্থিতিতে অনুসরণীয় কর ব্যবস্থার ক্ষেত্রে।
মৌর্য রাষ্ট্র খনিজ সম্পদ সংগ্রহে ও খনিজ সম্পদ নিষ্কাশনে সম্ভবত আগ্রহী ছিল; এ বিষয়ে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক তথ্য নিবেশন করা উচিত। তক্ষশিলা মৌর্য আমলের অন্যতম প্রধান নগর ও অন্যতম প্রাদেশিক শাসনকেন্দ্র যার দায়িত্বে ছিলেন মৌর্যবংশীয় কুমার বা রাজপুত্র। তক্ষশিলার ভিড় ঢিবিতে উৎখননের ফলে আবিষ্কৃত বহু বস্তুর মধ্যে ছিল একটি ধাতব পাত্র। এটি পিতলের তৈরি। প্রত্নতাত্ত্বিক বিচারে পিতলের পাত্রটি আ: খ্রি: পূ: চতুর্থ শতকের। পিতল একটি সংকর ধাতু; তামার সঙ্গে দস্তার মিশ্রণে পিতল উৎপাদন করা যায়। রাসায়নিক পরীক্ষা দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে পিতলের পাত্রে ৩৪, ৩৪% দস্তা ব্যবহৃত হয়েছিল। পুরাধাতুবিদ্যা অনুসারে দেখা যায় পিতল নির্মাণে ২৮% বা তার বেশি দস্তার ব্যবহারের বিশেষ তাৎপর্য আছে। এর তাৎপর্য যে, কারিগরদের কাছে ধাতু হিসেবে দস্তা পৃথকভাবে পরিচিত ছিল; আকর থেকে সম্ভবত দ্রবণের মাধ্যমে দস্তা উৎপাদন করা হত। একথা মানলে স্বীকার করতেই হবে মৌর্যযুগে দস্তার নিয়মিত উৎপাদন প্রচলিত হয়। পৃথিবীর অন্যত্র কোথাও এর চেয়ে প্রাচীনতর দস্তা উৎপাদনের নজির নেই। কিন্তু প্রশ্ন হল কোথায় পাওয়া যেত দস্তা? কারণ, তক্ষশিলায় তামা বা দস্তার কোনও খনি নেই। এই বিষয়ে চমকপ্রদ প্রমাণ এসেছে রাজস্থানের উদয়পুরের নিকটস্থ জাওয়ারমালা খনি এলাকা থেকে। আকরিক দস্তা জাওয়ারমালা খনিতে নিষ্কাশিত হয়েছিল জিঙ্ক (দস্তা) সালফাইড থেকে। ডলোমাইটের স্তরের অভ্যন্তরে আকরিক দস্তার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। এই খনিজ সম্পদ যে প্রাচীনকালে নিষ্কাশন করা হত, তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে ভূপৃষ্ঠের ১২০ মি. গভীরে। খনিজ নিষ্কাশনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হত লোহার বাটালি এবং শিলনোড়ার মতো দেখতে লোহার হাতুড়ি। আকর নিষ্কাশনের জন্য পাথর ফাটাতে ব্যাপকভাবে আগুনের প্রয়োগ জানা ছিল। জাওয়ারমালা খনিতে যে কাঠ ব্যবহার করা হয়েছিল, কার্বন ১৪ পরীক্ষার দ্বারা তার প্রাচীনতম কাল ৪৩০ খ্রি. পূ.। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৫২ মি. গভীরে আরও একটি কাষ্ঠখণ্ড অনুরূপ পদ্ধতিতে পরীক্ষা করা হয়েছে। তার কাল আ. ১৭০ খ্রি. পূ.। খনির ভিতরে যেটি প্রধান কাজের জায়গা ছিল সেখানেও কাষ্ঠখণ্ড আবিষ্কৃত হয়েছে। এইরকম একটি কাষ্ঠখণ্ডের কাল কার্বন ১৪ পরীক্ষায় ২০০ খ্রি. পূ. বলে নির্ধারিত হয়েছে। উপরিউক্ত তথ্যের ভিত্তিতে অবশ্যই বলা যায় মৌর্য আমলে নিয়মিতভাবে রাজস্থানে আকরিক দস্তা নিষ্কাশিত হত; এই দস্তাকে তামার সঙ্গে মিশ্রণ ঘটিয়ে উৎপন্ন হত পিতল। জাওয়ারমালা খনির অভ্যন্তরে আবিষ্কৃত হয়েছে চলাচলের জন্য সংকীর্ণ পথ, প্রচুর প্রদীপ (যার দ্বারা অবশ্যই খনি গহ্বর আলোকিত রাখা হত) ও বড় জল সংরক্ষণের পাত্র। এই খনিটিতে কয়েকশত শ্রমিকের সক্রিয় উপস্থিতি অনুমান করা সম্ভব (ক্র্যাডক, গুর্জর এবং হেগড়ে ১৯৮৩; বিশ্বাস ১৯৯৬: ২৪৯-৫৪, ৩৫১-৮৪)। এই জটিল খননকার্য ও খনিজ নিষ্কাশনের ব্যাপারে মৌর্য প্রশাসনের আগ্রহ থাকলে অবাক হবার কিছু নেই; কারণ অর্থশাস্ত্রসহ অন্যান্য প্রাচীন শাস্ত্রে যাবতীয় খনি ও খনিজ সম্পদকে রাজকীয় অধিকারভূক্ত বলে গণ্য করা হয়েছে।
প্রায় সমগ্র উপমহাদেশে রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপন করে মৌর্য শাসকরা (অন্তত অশোকের রাজত্বকাল পর্যন্ত) রাজনৈতিক সংহতি প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী ছিলেন। সেই সংহতি নিশ্চিত করতে গেলে অপরিহার্য ছিল যোগাযোগ ও যাতায়াতের ব্যবস্থা। অশোকের অনুশাসনগুলি যে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় উৎকীর্ণ করা হত প্রশাসনিক উদ্যোগে ও ব্যবস্থাপনায়, এই ঘটনাটিই সাম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার মধ্যে যোগাযোগের সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করে তোলে। অশোক স্বয়ং পরিভ্রমণে যেতেন। উচ্চপদস্থ আধিকারিকদেরও প্রশাসনিক কাজে পরিভ্রমণে যেতে হত—তার স্পষ্ট প্রমাণ অশোকের অনুশাসনে উপস্থিত। কর্ণাটকের ব্রহ্মগিরিতে অশোকের যে গৌণ গিরি অনুশাসনটি পাওয়া যায় তা ব্রাহ্মী হরফে উৎকীর্ণ। অনুশাসনের একেবারে শেষে যিনি লেখটি খোদাই করেছিলেন তিনি নিজেকে চাপড় বলে উল্লেখ করেছেন। চাপড় নামটি কিন্তু খরোষ্টী হরফে উৎকীর্ণ। ব্রাহ্মী লিপির ব্যবহার যেমন ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় দেখা যায়, খরোষ্টীর ব্যবহার কিন্তু প্রাথমিকভাবে উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তেই প্রচলিত ছিল। এই দিক দিয়ে বিচার করলে চাপড় সম্ভবত সুদূর উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী এলাকার অধিবাসী ছিলেন এবং সেই কারণে নিজের নাম তিনি খরোষ্টী লিপিতে উৎকীর্ণ করেছিলেন। মৌর্য আমলে মানুষ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল থেকে কর্ণাটক পর্যন্ত যাতায়াত যে করতেন, তার প্রামাণ্য পরিচয় ব্রহ্মগিরির গৌণ অনুশাসনটিতে উপস্থিত (মুখার্জী ২০০০: ৮৮)। কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত একটি তাম্রদণ্ডের প্রতি ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাম্ৰদণ্ডটির দ্বারা রামপূর্বাতে (উত্তর বিহার) আবিষ্কৃত অশোকস্তম্ভের উপরে দণ্ডায়মান পশুমূর্তিটি যুক্ত থাকত। এই তাম্রদণ্ডে মৌর্যকালীন খরোষ্টী হরফে ‘থবে’ (অর্থাৎ স্তম্ভে) কথাটি উৎকীর্ণ হয়েছে। এই লিপিকার নিঃসন্দেহে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল থেকে উত্তর বিহারে এসেছিলেন। প্রাচীন লিপির ব্যবহার এইভাবে মৌর্য সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে যোগসূত্রের পরিচয় দেয় (মুখার্জী ২০০০: ১০৪)।
অশোক যে তাঁর সাম্রাজ্যের বাইরে অবস্থিত ‘অবিজিত’ এলাকাতে ‘ধম্ম’ প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, একথা তাঁর অনুশাসন থেকে সুবিদিত। এমনই একটি ‘অবিজিত’ অঞ্চল তাম্রপর্ণী বা শ্রীলঙ্কা যার সঙ্গে মৌর্য সাম্রাজ্যের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রমাণিত। শ্রীলঙ্কার প্রাচীন রাজধানী অনুরাধাপুরের উৎখননে যে স্তরটি ৩৫০-২৭৫ খ্রি. পূ. বলে চিহ্নিত, সেখানে উদ্ধার করা হয়েছে লাপিস লাজুলি এবং কার্নেলিয়ান পাথর। এছাড়াও আবিষ্কৃত হয়েছে ব্রাহ্মী হরফ সংবলিত মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ। লাপিস লাজুলির একমাত্র প্রাপ্তিস্থান আফগানিস্তানের বদখশান অঞ্চল। লাপিস লাজুলি নিশ্চিতভাবে আফগানিস্তান থেকে শ্রীলঙ্কায় পৌঁছত মৌর্যকালীন ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে। কার্নেলিয়ান শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিল সম্ভবত গুজরাট থেকে। বৌদ্ধ কাহিনী অনুসারে অশোক যে শ্রীলঙ্কায় দৌত্য প্রেরণ করেছিলেন তা যাত্রা শুরু করে তাম্রলিপ্ত থেকে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ সমুদ্রপথেই হত এবং এই যোগাযোগ ব্যবস্থায় পূর্ব উপকূলের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা থাকা আশ্চর্যের নয় (কনিংহাম এবং অলচিন ১৯৯৫)।
পশ্চিম এশিয়াতে পাঁচজন যবন রাজার কাছেও অশোক দৌত্য পাঠিয়েছিলেন, যার উল্লেখ তাঁর ত্রয়োদশ মুখ্য অনুশাসনে পাওয়া যাবে। এই প্রসঙ্গ ইতিপূর্বেই আলোচিত (পৃ.১১১-১২)। পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ স্থলপথেই হবার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে কুয়েতের কাছে অবস্থিত ফাইলাকাতে উৎখনন জলপথে যোগসূত্রের দিকেও ইঙ্গিত করে। ফাইলাকাতে পাওয়া গিয়েছে আ. খ্রি. পূ. ৩০০ আমলের ভারতীয় কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্র (উত্তরভারতের চিক্কন কৃষ্ণ মৃৎপাত্র নয়)। এর দ্বারা ভারতের সঙ্গে পারস্য উপসাগরীয় এলাকার বাণিজ্যের সম্ভাবনাকে স্বীকার করতে হয়। সমুদ্রপথে এই যোগাযোগ হবার পক্ষে গুজরাট ও কোঙ্কন উপকূলের অবস্থান বিশেষ সুবিধাজনক। খেয়াল রাখা দরকার কোঙ্কন উপকূলের সোপারা (প্রাচীন বন্দর শূর্পারক, আধুনিক মুম্বই-এর নিকটে) ও কাথিওয়াড় উপকূলের নিকটবর্তী জুনাগড় থেকে অশোকের অনুশাসন পাওয়া গিয়েছিল (সাল ১৯৯৫; সাল ১৯৯৬)। খ্রি. পূ. দ্বিতীয় শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আগাথার্কিডেস আরব সাগরের সোকোত্রা দ্বীপের গুরুত্ব সম্বন্ধে সম্যক অবহিত ছিলেন। তাঁর বিবরণ অনুযায়ী সোকোত্রাতে বাণিজ্যতরী আসত নানা এলাকা থেকে, বিশেষত পোতান বা পোত্তলিস বন্দর থেকে। ওই বন্দরটি সিন্ধুনদের বদ্বীপ এলাকায় আলেকজান্ডার স্থাপন করেছিলেন (মুখার্জী ২০০০: ৮৮-৮৯)। তামিলনাড়ুর কারুর থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রথম সেলুকাস, প্রথম অ্যান্টিওকাস ও দ্বিতীয় অ্যান্টিওকাসের মুদ্রা (মুখার্জী ২০০০: ৮৮)। উৎখনন থেকে পাওয়া পুরাবস্তু, আগাথার্কিডেস-এর বিবরণী ও মুদ্রার সাক্ষ্য একসঙ্গে মিলিয়ে দেখলে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় যে পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে মৌর্য আমলে ভারতীয় ভূখণ্ডের যোগাযোগ স্থলপথে ও জলপথে দুইভাবেই ঘটত। অর্থশাস্ত্রে নাবধ্যক্ষের ভূমিকা নিয়ে কৌটিল্যের যে উপদেশ আছে, সেই আলোকে অনুমান করা অযৌক্তিক হবে না যে আরব সাগরে বাণিজ্য সম্বন্ধে মৌর্য রাষ্ট্র ওয়াকিবহাল ও আগ্রহী ছিল।
নগরায়ণের যে সূচনা বুদ্ধের সমকালীন গাঙ্গেয় উপত্যকায় দেখা দিয়েছিল, মৌর্য আমলে তার গতি অব্যাহত ছিল বলে মনে হয়। অনেকগুলি নগরের পরিচয় উৎখননের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে। নগরগুলির মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য অবশ্যই মৌর্য রাজধানী পাটলিপুত্র। বুদ্ধের সময় যে পাটলিগাম একটি নিছক বাণিজ্যকেন্দ্র বা পুটভেদন (চক্রবর্তী ১৯৯৬)—নগর বলে যার কোনও স্বীকৃতিই ছিল না—তা-ই পাটলিপুত্র হিসেবে মৌর্যকালীন ভারতের বৃহত্তম নগরী। তার আয়তন ২২০০ হেক্টর; পরিখাদ্বারা বিশেষভাবে সুরক্ষিত এলাকাটি প্রায় ৩৪০ হেক্টর। নগরের উচ্চাবচক্ৰম বিচার করলে নিম্নোক্ত পর্যায়গুলি নির্ধারণ করা যায়:
রাজগৃহ, কৌশাম্বী এবং বিদিশা ১৮১-২৪০ হেক্টর
অহিচ্ছত্র, শ্রাবন্তী, তোসলী, মহাস্থানগড় ১২১-১৮০ ,,
উজ্জয়িনী, সমাপা (জৌগড়), প্রতিষ্ঠান ৬১-১২০ ,,
কান্দাহার, তক্ষশিলা, বলিরাজগড়, সন্নাথি ৩১-৬০ ,,
ধান্যকটক (অমরাবতী)
কপিলাবস্তু, পুষ্কলাবতী ১৬-৩০ ,,
(অলচিন ১৯৯৫; ২০৭)
॥ ৭ ॥ ২০০ খ্রিঃপূঃ—৩০০ খ্রিঃ
অর্থনৈতিক ইতিহাসে আলোচ্য পাঁচ শতাব্দীর সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক দিক ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে—গাঙ্গেয় উপত্যকার বাইরে—কৃষি-অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা ও বিস্তার, বাণিজ্যে ব্যাপক অগ্রগতি এবং নগরায়ণের সর্বভারতীয় বিস্তার। গাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষি খ্রি.পূ. দ্বিতীয় সহস্রাব্দ থেকেই পরিচিত ছিল। কিন্তু দাক্ষিণাত্যে ও দক্ষিণ ভারতে লাঙ্গলভিত্তিক স্থায়ী কৃষিপ্রধান আর্থ-সামাজিক কাঠামো সুদৃঢ় হতে দেখা যাবে কার্যত মৌর্যোত্তর পর্বে। মৌর্য সাম্রাজ্য যখন প্রায় সমগ্র উপমহাদেশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে, তার অভিঘাতে গাঙ্গেয় উপত্যকার বস্তুগতজীবনের প্রধান প্রধান লক্ষণ দাক্ষিণাত্যে ও দক্ষিণ ভারতে ছড়াতে থাকে। এই প্রক্রিয়ার ফল দেখা যাবে আলোচ্য পাঁচ শতাব্দীতে। দীর্ঘদিন ধরে বিন্ধ্যের দক্ষিণে লোহার উপকরণ ব্যবহারে অভ্যস্ত যে বৃহদশ্মীয় সংস্কৃতি বিরাজ করছিল, তাতে পরিবর্তন নজর করা যায়।
প্রাচীনতম তামিল সাহিত্য, যা সঙ্গম সাহিত্য বলে অভিহিত, তাতে ‘তিনাই’ শব্দের দ্বারা বিভিন্ন এলাকাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনাইগুলি পরিবেশগত বিভিন্নতার কারণে স্বতন্ত্র ছিল। প্রধান প্রধান নদী উপত্যকা ও নদীর বদ্বীপ অঞ্চল স্বাভাবিকভাবেই উর্বর ও কৃষির পক্ষে বিশেষ অনুকূল। এই অঞ্চলগুলি ‘মরুদম তিনাই’ বলে আখ্যাত। কাবেরী বৈগাই ও তাম্রপর্ণী নদীতীরস্থ এলাকায় কৃষিপ্রধান ‘মরুদম তিনাই’-এর অবস্থান ছিল। পার্বত্য এলাকার নাম ‘কুড়িঞ্জি তিনাই’; সুগন্ধী কাঠের জন্য এই অঞ্চল প্রসিদ্ধ ছিল। ‘মরুদম তিনাই’-এর সীমান্তে ছিল ‘মুল্লাই তিনাই’। ‘মুল্লাই তিনাই’ মরুদম-এর তুলনায় কম উর্বর ও সমৃদ্ধ হলেও সেচব্যবস্থার সাহায্যে তাকে মরুদম তিন্নাই-এর মতোই পুরোদস্তুর কৃষিপ্রধান এলাকায় পরিবর্তন করা যেত। উপকূলবর্তী অঞ্চল ‘নেইদাল তিনাই’ বলে পরিচিত ছিল। সমুদ্রতীরে অবস্থিত হওয়ার দরুন এই অঞ্চল বাণিজ্য, নৌনির্মাণ ও লবণ তৈরির পক্ষে বিশেষ সুবিধাজনক বলে চিহ্নিত হয়েছিল। মরুদম তিনাইতে কৃষির প্রসারের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত হয়ে আছে নিয়মিত ধানচাষ। তাপদগ্ধ গ্রীষ্মের পর বর্ষার আগমনে কীভাবে সিক্ত হয় মৃত্তিকা, তার চমৎকার বর্ণনা সঙ্গম সাহিত্যে পাওয়া যায়। তারপর ওই সিক্ত মৃত্তিকায় হল চালনা করেন কৃষক। কৃষির সাফল্য যে উপযুক্ত সেচ ব্যবস্থার উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল তার আলেখ্য নারিনাই ও পুরনানূর-তে উপস্থিত। (শিবতাম্বি ১৯৭৪; চম্পকলক্ষ্মী ১৯৯৬: ২৬-২৭; রায়, চট্টোপাধ্যায়, চক্রবর্তী এবং মণি ২০০০; ২৮০-৮২)।
গাঙ্গেয় উপত্যকা ও গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকা যে কৃষির পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল, তা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রাচীন বাংলার অন্তর্গত গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায় কৃষিসমৃদ্ধির পরিচয় পাওয়া যাবে বিগত এক দশকে ওই অঞ্চল থেকে আবিষ্কৃত পোড়ামাটির তৈরি বহু নামমুদ্রায় ও অন্যান্য প্রত্নবস্তুতে। নামমুদ্রা বা সীলমোহর এবং তার ছাঁচে প্রায়শই খরোষ্ঠী এবং খরোষ্টী-ব্রাহ্মীমিশ্রিত লিপিতে লেখ উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। পুরালেখবিদ্যা অনুসারে মিশ্রিত লিপি সংবলিত পুরাবস্তুগুলির কাল আ. খ্রি.পূ. প্রথম শতক থেকে খ্রি. চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত নির্দেশ করা যায়। এই সম্পূর্ণ আনকোরা মিশ্রিত লিপির পাঠোদ্ধার করেন ব্রতীন্দ্রনাথ মুখার্জী (মুখার্জী ১৯৯০)। সীলমোহর বা নামমুদ্রায় উৎকীর্ণ দৃশ্যের মধ্যে বহুবার এসেছে একটি বা একাধিক উন্নত ধানের শীষ যা খ্রি. প্রথম তিন বা চার শতকে বাংলায় ধান উৎপাদনের সাক্ষ্য বহন করে। দক্ষিণ দিনাজপুরের বিখ্যাত প্রত্নক্ষেত্র থেকে আবিষ্কৃত পোড়ামাটির সীলমোহরের ছাঁচে প্রদর্শিত হয়েছে একটি পাত্র; পাত্র থেকে উদগত সশীষ ধান্যও দৃশ্যমান। উৎকীর্ণ লেখটিতে ওই পাত্রের অভিধা ‘শস্যাদি ধৃতস্থালী’ অর্থাৎ শস্যধারণের জন্য পাত্র (মুখার্জী ১৯৯০: ৪৪-৪৫)। চন্দ্রকেতুগড় থেকে পাওয়া অপর একটি প্রায় গোলাকৃতি সীলমোহরের ছাপ (আ. খ্রি. দ্বিতীয় শতকে উৎকীর্ণ) পাওয়া গিয়েছে। গৌণ দিকে দেখা যায় একটি পাত্রের মধ্যে তিনটি সশীষ ধান উদগত; মুখ্য দিকে উৎকীর্ণ আছে ‘স ৯০ কাহন’, অর্থাৎ ‘সস্যানি ৯০ কার্যাপণানি’ (মুখার্জী ১৯৯০: ৪৮)। পাত্রস্থ ধানের দাম ছিল ৯০ কার্ষাপণ, এই তথ্যটি সম্ভবত সীলমোহরের ছাপে বলা হয়েছে। প্রভূত পরিমাণ ধান উৎপাদন ঘটলে তবেই তা নগদ অর্থে বিক্রীত হতে পারে। চন্দ্রকেতুগড় থেকে পাওয়া ব্রাহ্মী-খরোষ্টী মিশ্রিত হরফে উৎকীর্ণ (আ. তৃতীয় শতকের) আর একটি প্রায় গোলাকার সীলমোহরের ছাপে উল্লিখিত হয়েছেন করছুগ্মা বা করফাগ্মা বলে। তিনি লেখটিতে ‘কোডিহালিক’ বলে আখ্যাত (মুখার্জী ১৯৯০: ৪৬)। ‘কোডিহালিক’ শব্দটি সম্ভবত এমন এক ব্যক্তিকে বোঝাচ্ছে যিনি কোটি (= অর্থাৎ অসংখ্য) হালের মালিক, অথবা যিনি বহু‘হালিক’ বা কৃষকের নিয়োগকর্তা। যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, করছুগ্মা বা করফাগ্মাকে প্রচুর ভূসম্পদের মালিক বলে মনে হয়। লাঙ্গলভিত্তিক কৃষিকর্ম যে বাংলার বদ্বীপ অঞ্চলে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল, সেই দিকেও আলোচ্য নামমুদ্রাটি ইঙ্গিত দেয়। উত্তর চব্বিশ পরগণার হাদিপুর থেকে পাওয়া গিয়েছিল একটি ছাইরঙা ছোট কলস। তার গলার কাছে খরোষ্ঠী লেখ দেখা যায়। লেখটির পাঠ নিম্নরূপ ‘বপায় কোষঃ’—অর্থাৎ বপনযোগ্য বীজ রাখার কোষ বা আধার (মুখার্জী ১৯৯০: ৪৪)। কৃষি যে গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায় অত্যন্ত সমৃদ্ধ রূপ নিয়েছিল, তার আরও একটি সাক্ষ্য পাওয়া যাবে হাদিপুর থেকে আবিষ্কৃত আ, খ্রি. তৃতীয় শতকের একটি লেখ সংবলিত পোড়ামাটির নামমুদ্রা বা সীলমোহরে। নামমুদ্রায় দেখা যায় শিরোভূষণে সজ্জিত, ‘চিটন’ জাতীয় রোমান পোশাক পরিহিত এক নারীমূর্তিকে; তাঁর বাম হাত কোমরের কাছে; ডান হাতে তিনি ধরে আছেন সশীষ ধান্য। তাঁর ডান দিকে দণ্ডায়মান ব্যক্তিকে ভক্ত বলে মনে হয়। অতএব, নামমুদ্রায় প্রদর্শিত নারীমূর্তি কোনও দেবীর মূর্তি। ব্রাহ্মী-খরোষ্টী লেখটিতে দেবী ‘ধান্যজী’ বলে অভিহিত; অর্থাৎ ধানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী (মুখার্জী ১৯৯০: ৫৯-৬০)। প্রায় একই রকম আরও একটি গোলাকৃতি পোড়ামাটির সীলমোহরের দিকে নজর দেওয়া যাক। চন্দ্রকেতুগড় থেকে পাওয়া ব্রাহ্মী-খরোষ্ঠী মিশ্রিত হরফে উৎকীর্ণ সীলমোহরটির কাল নির্দেশ করা হয়েছে খ্রি. তৃতীয় শতকে। এখানে দেখা যাবে আর একটি দেবীমূর্তি; দেবীর মস্তকে বৃহৎ ভূষণ; ডান হাত কোমরে রেখে তিনি দণ্ডায়মান। লেখ অনুসারে নারীমূর্তিটি ‘যক্ষী জিরাম্বী’ বলে আখ্যাত। ইনি অবশ্যই এক প্রকার মাতৃকা, এবং সম্ভবত জিরা-র অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কৃষির সাফল্যই প্রাচীন বাংলায় নানাবিধ ফসলের অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে আরাধনার পথ করে দেয় (মুখার্জী ১৯৯০: ৫৫-৫৬)।
সমগ্র উপমহাদেশে লাঙ্গল ভিত্তিক কৃষির প্রচলন অর্থনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বদল এনেছিল। কিন্তু খ্রি.পূ. ২০০ থেকে খ্রি. ৩০০ পর্যন্ত সময়সীমায় সবচেয়ে চমকপ্রদ অর্থনৈতিক পরিবর্তন দেখা যাবে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে, বিশেষত দূরপাল্লার বাণিজ্যে। রোম সাম্রাজ্যের সঙ্গে প্রাচ্যের বাণিজ্য প্রথমে পশ্চিম এশিয়া এবং মধ্য এশিয়া হয়ে চীন পর্যন্ত প্রসারিত হলেও, পরবর্তীকালে—বিশেষত খ্রি.পূ. প্রথম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে—দক্ষিণ এশিয়া এক বিশাল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সক্রিয় শরিক হয়ে যায়। এ কথা ঠিকই, ভারতের পরিপ্রেক্ষিত থেকে রোম সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্যের ইতিহাসে প্রধানত আলোচিত হয়েছে সাহিত্যগত তথ্যসূত্রের উপর ভিত্তি করে। এই বিষয়ে আমাদের আলোচনা আগে করা হয়েছিল পেরিপ্লাস অব দ্য ইরিথ্রিয়ান সী, প্লিনির ন্যাচুরালিস ইস্তোরিয়া (ন্যাচারাল হিস্ট্রি) এবং টলেমির জিওগ্রাফিকে হুফেগেসিস ধরে; তার সঙ্গে তামিল সঙ্গম সাহিত্যের বর্ণনাও সংযোজিত হয়েছিল। কিন্তু বিগত দুই দশকে সাহিত্যগত সাক্ষ্যের পাশাপাশি ব্যবহৃত হচ্ছে নানাবিধ পুরাবস্তু, যা ভারতের দূরপাল্লার বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি বুঝতে বিশেষ সহায়ক। সাহিত্যগত তথ্যসূত্রের গুরুত্ব কিছু কমেনি; কিন্তু তাকে পুরাতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণের সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে বাণিজ্যের ছবিটি স্পষ্টতর হয়ে উঠবে।
পূর্ব এশিয়া থেকে মধ্য এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া ও ইউরেশিয়া হয়ে যে স্থলপথ ভূমধ্যসাগরের পূর্বতীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, তাকে উনিশ শতকে এক জার্মান পণ্ডিত রেশমপথ (সাইডেনস্ট্রাসে/ সিল্ক রোড) বলে অভিহিত করেন। চীনের রেশমের প্রভূত জনপ্রিয়তা ও বাণিজ্যিক কদরের কারণেই এমন নামকরণ হয়েছিল। চীনা এবং গ্রিক সাহিত্যগত তথ্য ও পুরাবস্তুর সাক্ষ্য মিলিয়ে পড়লে অনুমান করা যায় যে এই স্থলপথের সূচনা পূর্ব চীনের লৌলান অঞ্চলে। সেখান থেকে আরও পশ্চিমে তুন হুয়াং বা দুন হুয়াং পরবর্তীকালে বৌদ্ধ চিত্রকলার কারণে জগদ্বিখ্যাত হয়। এই অঞ্চলের পশ্চিমে অবস্থিত টাকলা মাকান মরুভূমিকে পাশ কাটিয়ে যাবার জন্য ওই ভয়াবহ মরুভূমির উত্তর ও দক্ষিণ দিক দিয়ে দুটি পৃথক স্থলবাণিজ্যপথ উদ্ভূত হয়। উত্তরের পথটি গিয়েছিল তুরফান, কুচা, আকসু ছুঁয়ে সু-লে বা বর্তমান কাশগড় পর্যন্ত। দক্ষিণের পথটি শান শান, নিয়া, খোটান, ইয়ারকন্দ হয়ে আসত ওই কাশগড় পর্যন্ত। অর্থাৎ কাশগড় ছিল উত্তর ও দক্ষিণ দুই পথের সঙ্গমস্থল। কাশগড় থেকে মার্ভ বা মার্জিয়ানা পৌঁছনো যেত তা-ইয়ুয়ান বা ফরগনা এবং সমরকন্দ হয়ে; আবার উত্তরপূর্ব আফগানিস্তানে অবস্থিত ব্যাকট্রা (মজর-ই-শরিফ অঞ্চল) দিয়েও মার্ভে যাওয়া সম্ভব ছিল। এর পর বর্তমান ইরানের মধ্য দিয়ে হেকাটমপুলোস, একবাটানা, পেরিয়ে টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস বিধৌত ইরাকের হাটরা এবং পালমিরার মধ্য দিয়ে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরে পথটি শেষ হত। ব্যাকট্রিয়ার মধ্যে দিয়ে একটি পৃথক পথ কীভাবে কাবুল, পেশোয়ার ও তক্ষশিলা হয়ে উপমহাদেশে প্রবেশ করত, তার কথা পূর্বেই আলোচিত (পৃ. ১৩৬-৩৮)। বিগত দুই দশকে কারাকোরাম সড়কে বহু নতুন পুরাবস্তু আবিষ্কৃত হয়েছে। বোঝা যায়, রেশম পথের একটি শাখা এখনকার গিলগিট ও চিলাস-এর মধ্য দিয়ে (অর্থাৎ অনেক কম পথ পেরিয়ে উপমহাদেশকে যুক্ত করত। এই অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছে প্রচুর খরোষ্ঠী ও পরবর্তী আমলে ব্রাহ্মী লেখ, চীনা ও সোগদীয় ভাষায় উৎকীর্ণ শিলালেখ এবং শিলাগাত্রে উৎকীর্ণ/অঙ্কিত বিবিধ দৃশ্য। নানাবিধ লিপি ও ভাষার সহাবস্থান সহজেই বুঝিয়ে দেয় গিলগিট ও চিলাসে জড়ো হতেন নানা এলাকার মানুষ। ট্রাউজার, কোট ও কোনাচে টুপি পরিহিত অভারতীয় ব্যক্তিরা বৌদ্ধ স্তূপের সামনে উপাসনারত, এমন দৃশ্য প্রায়ই পর্বতগাত্রে ক্ষোদিত বা অঙ্কিত। মধ্য এশীয় পোশাক পরিহিত ব্যক্তি নিয়ে চলেছেন অনেকগুলি ঘোড়া, এমন দৃশ্যও দুর্লভ নয়। ঘোড়ার ছবিও যথেষ্ট। অনুমান করা যুক্তিযুক্ত যে এই পথটি যদিও অত্যন্ত বিপদসংকুল, কিন্তু দূরত্ব কমাবার তাগিদে বিভিন্ন বণিকগোষ্ঠী এই দুর্গম পথে পাড়ি দিতেন। ঘোড়া আমদানির জন্য এই বাণিজ্যপথটির গুরুত্ব অস্বীকার করা অসম্ভব। প্রাচীন চীনা তথ্যসূত্রের আলোকে এই পথটিকে ‘চি-পিন’ বা কাশ্মীর পথ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই অঞ্চল খ্রিস্টীয় প্রথম তিন শতক ধরে বোধহয় কুষাণ অধিকারে ছিল। এর ফলে রাজনৈতিক সংহতির মাধ্যমে কাশ্মীরের এই অপেক্ষাকৃত স্বল্পপরিচিত পথটি উত্তর ভারতীয় স্থলপথগুলির সঙ্গে গ্রথিত হয়ে যায় (য়েটমার ১৯৮৯, ১৯৯১; দানি ১৯৮৩, ১৯৮৯; মুখার্জী ১৯৯৬; ফ্রাই ১৯৯৬: ৪৫৬-৬০; ফ্রাই এবং লিটভিনস্কি ১৯৯৬: ৪৬১-৬৪)।
তবে দূরপাল্লার বাণিজ্যের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক দিক ভারত সাগরের সমুদ্র বাণিজ্যে ভারতের উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। এই বিষয়ে পূর্বোল্লিখিত আলোচনার (১৩৯-১৪৭) সঙ্গে আরও নূতন বক্তব্য সংযোজন করা জরুরি। জলপথে আরব সাগর ও লোহিত সাগরের মধ্যে যাতায়াত যে অত্যন্ত নিয়মিত হয়ে উঠেছিল, তার অন্যতম প্রধান উপাদান মৌসুমী বায়ুর গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে সম্যক ধারণা। গ্রিক ও ল্যাটিন গ্রন্থে এই বায়ুপ্রবাহ সাধারণত হিপ্পালাস এবং ইটেসিয়ান বায়ু বলে আখ্যাত। বহুপ্রচলিত ধারণা যে হিপ্পালাস নামক এক গ্রিক নাবিক এই বায়ুপ্রবাহ আবিষ্কার করেন, ফলে তাঁর নামেই গ্রিক এবং ল্যাটিন সাহিত্যে মৌসুমী বায়ুপ্রবাহ চিহ্নিত হয়ে যায়। ভিন্নভাবে বললে, এই যুক্তিতে এশীয় ও আফ্রিকায় জলরাশিতে বিচরণের প্রথম কৃতিত্ব ইউরোপীয়দেরই প্রাপ্য। কিন্তু এই ধারণা সম্বন্ধে বর্তমানে অনেক ঐতিহাসিকই সন্দিহান। গ্রিক ও রোমান বণিকদের ভারত মহাসাগরের চলাচলের পূর্ব থেকেই এই সমুদ্রে পাড়ি দেবার নজির আছে। ফলে মৌসুমী বায়ু আবিষ্কারের কৃতিত্ব নির্দ্বিধায় পাশ্চাত্যের বণিক ও নাবিকদের উপর আরোপ করার সমস্যা আছে।
প্লিনির গ্রন্থে এই বায়ুপ্রবাহ সম্বন্ধে যে বিশদ বর্ণনা দেখা যায়, তাকে অনুপুঙ্খসহ বিচার করে মাজারিনো একটি চমকপ্রদ তথ্য জানিয়েছেন। প্লিনির বর্ণনায় বায়ুপ্রবাহের নাম হিপ্পালাস নয়, ‘হাইপালুম্’। এর সঙ্গে কোনও গ্রিক নাবিকের নাম সম্পৃক্ত নয়, তিনি কোনও বায়ুপ্রবাহও আবিষ্কার করেননি। এডেন অঞ্চল থেকে বিশেষ ঋতুতে যে দক্ষিণ-পশ্চিম বায়ুপ্রবাহ চলত, তাকেই প্লিনি ‘হাইপালুম’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ‘হাইপালুম’ সম্ভবত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর সমার্থক (মাজারিনো ১৯৯৭)। প্লিনি জানিয়েছিলেন মৌসুমী বায়ু সম্বন্ধে ধারণা উত্তরোত্তর উন্নত হওয়ার ফলে লোহিত সাগরের বন্দর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু অনুসরণ করে মাত্র চল্লিশ দিনে মালাবার উপকূলের বিখ্যাত বন্দর মুজিরিসে পৌঁছনো যেত। সুদূর অতীতের জাহাজ নির্মাণ পদ্ধতি ও জলযান চালনার কৌশল সম্বন্ধে গভীর গবেষণার পর লায়নেল ক্যাসন জানিয়েছেন, চল্লিশ দিন নয়, মাত্র বিশ দিনেই লোহিত সাগর থেকে ভারতের মালাবার উপকূলে পৌঁছনো সম্ভব ছিল। তাঁর ধারণায় চল্লিশ দিনের হিসেবটি হয় ভ্রান্ত, নয় প্লিনির ন্যাচুরালিস ইস্তোরিয়ার পাণ্ডুলিপিতে লিপিকরের প্রমাদ বশত লেখা হয়েছিল। ভারত মহাসাগরে সাবেককালের (অর্থাৎ বাষ্পীয় শক্তি আবিষ্কারের আগে) জলযানের গতিবিধির দীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনা করে ক্যাসন আরও একটি ব্যাপারে সঠিক মন্তব্য করেছিলেন। পশ্চিম উপকূলে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর দাপটে বর্ষা যখন তুঙ্গে (জুন থেকে অগাস্টের শেষ), তখন দেশি-বিদেশি কোনও জাহাজই সমুদ্রপাড়ি দিত না; আর পশ্চিম উপকূলের অধিকাংশ বন্দরই তখন বন্ধ থাকত। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর তীব্রতা হ্রাস পেলে, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর নাগাদ, জাহাজগুলি লোহিত সাগর থেকে রওনা হত এবং সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে পশ্চিম উপকূলের বন্দরগুলিতে ভিড়ত। অক্টোবরের শেষ বা নভেম্বরের গোড়ায় মৌসুমী বায়ুর দিক পরিবর্তনের ফলে যখন তা উত্তর-পূর্ব দিক থেকে বইতে শুরু করত, তখন জাহাজগুলির পক্ষে পশ্চিম অভিমুখে যাত্রা করা সুবিধাজনক ছিল (ক্যাসন ১৯৮৮; ১৯৯২)।
এই প্রসঙ্গে অবশ্য আলোচনা করতে হবে একটি বিশেষ ধরনের তথ্যসূত্রের, রোম সাম্রাজ্যের সঙ্গে ভারতের সমুদ্র-বাণিজ্যের ইতিহাসে এমন আকর তথ্যসূত্র ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’। তথ্যসূত্রটি হল আ. খ্রি. দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগে প্রস্তুত একটি ঋণের চুক্তিপত্র; একটি প্যাপিরাসের উপর তা লেখা হয়। বর্তমানে ভিয়েনার একটি সংগ্রহশালায় রক্ষিত এই অসামান্য দলিলের সম্পাদনা করার জন্য ঐতিহাসিকমহল লায়নেল ক্যাসনের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন (ক্যাসন ১৯৯০)। এই ঋণপত্রের বক্তব্য বিষয় এখন বিচার করা যাক। মালাবারের শ্রেষ্ঠ বন্দর মুজিরিসে অপেক্ষমান জাহাজ হার্মোপোলনে তোলা হয়েছিল রফতানিযোগ্য কয়েকটি ভারতীয় পণ্য। এগুলি হল গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকার নার্ড (Nard) বা এক প্রকার সুগন্ধী তেল, উত্তম গজদন্ত এবং বহুমূল্য বস্ত্র। প্রতিটি পণ্যই নিঃসন্দেহে বিলাসের সামগ্রী। রোম সাম্রাজ্যের বিত্তবান গোষ্ঠীর কাছে এগুলির যে যথেষ্ট কদর ছিল, অন্যান্য তথ্যসূত্রে তার প্রচুর প্রমাণ আছে। মোট ছয়টি পেটিকায় এই সামগ্রী রাখা ছিল। প্রত্যেকটির ওজন ও মূল্যের তালিকাও দলিলে লিপিবদ্ধ আছে। তার বিশদ হিসেবের মধ্যে না গিয়েও দেখা যায় যে মোট ১১৫৪ ট্যালেন্ট ও ২৮৫২ দ্রাখমা (রৌপ্যমুদ্রা)-র মূল্যের সামগ্রী জাহাজে তোলা হয়। হার্মোপোলন জাহাজটির গন্তব্যস্থল মুজিরিস থেকে লোহিত সাগরের একটি বন্দরে। বন্দরের নাম পড়া যায় না; কিন্তু খুব সম্ভবত হয় বেরেনিকে অথবা মিস হর্মোস। লোহিত সাগরের বন্দরটিতে জাহাজ পৌঁছলে পণ্যসামগ্রী নামিয়ে তা নিয়ে যাওয়া হত উটের পিঠে বিখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্র কোপ্টস-এ। কোপ্টস থেকে তা আবার তোলা হবে নীলনদের জলযানে। শেষ পর্যন্ত তা পৌঁছবে মিশরের বিখ্যাত বন্দর আলেকজান্দ্রিয়া, যা তখন রোম সাম্রাজ্যের অধীন। আলেকজান্দ্রিয়ার সরকারি গুদামখানায় সামগ্রী রাখা থাকবে; এর উপর পঁচিশ শতাংশ আমদানি শুল্ক দিলে ওই সামগ্রী গুদামখানা থেকে বার করে ভূমধ্যসাগরীয় জাহাজে ওঠানো হবে; সেই জাহাজেই সামগ্রীগুলি শেষ পর্যন্ত রোমের বাজারে পৌঁছবে।
এই ঋণের চুক্তিপত্রটিতে মালাবারের বিখ্যাত পণ্য গোলমরিচ নেই; এটি অবশ্যই বিস্ময়কর। গ্রিক এবং ল্যাটিন বিবরণ এবং সঙ্গম সাহিত্যের বর্ণনা প্রায় সমস্বর: দেশি-বিদেশি দুই প্রকার তথ্যসূত্রেই বিশদভাবে বলা হয়েছে মালাবারের গোলমরিচ বহু স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে জাহাজ ভর্তি করে রোমের বাজারে নিয়ে যাওয়া হত। পশ্চিমি দুনিয়াতে আঠারো শতক পর্যন্ত মালাবারের গোলমরিচের যে ব্যাপক কদর তার সূচনা খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের গোড়ায়। রোমিলা থাপার এই গোলমরিচকে ‘ব্ল্যাক গোল্ড’ বলে যথার্থই চিহ্নিত করেছিলেন (থাপার ১৯৯২)। রোম সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্যের সূত্রে ভারতে, বিশেষত দক্ষিণ ভারতে, রোমান রৌপ্য ও স্বর্ণমুদ্রার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় মুদ্রাভাণ্ডার রয়েছে পশ্চিম তামিলনাড়ু ও কেরলের সীমান্তবর্তী পালঘাট অঞ্চলে। ভারতে পাওয়া রোমের রৌপ্য মুদ্রা (দিনেরিয়াস) এবং স্বর্ণমুদ্রা (অরিয়াস) সম্বন্ধে তথ্যের পরিমাণ ক্রমশই বাড়ছে। এই মুদ্রাগুলি রোম সম্রাট অগাস্টাসের সময় থেকে (৩১ খ্রি.পূ.—খ্রি. ১৪) ক্যারাক্যাল্লা (খ্রি. ২১৩-র রাজত্ব পর্যন্ত সময়সীমায় নির্মিত। অবশ্য পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে বাইজান্টাইন সম্রাটদের মুদ্রাও পাওয়া যায় কেরল, তামিলনাড়ু এবং অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে (বের্গহাউস ১৯৯১; গুপ্ত ১৯৬৫; ম্যাকডাওয়েল ১৯৯১, ১৯৯৬; রাধাকৃষ্ণণ ১৯৯৯)।
অতএব রোম সাম্রাজ্যের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বুঝতে হলে এখন আর গ্রিক-রোমক বিবরণীই একমাত্র নির্ভর নয়; মুদ্রাসহ নানাবিধ পুরাতাত্ত্বিক উপাদানেও এই সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া যায়। দক্ষিণ ভারতে প্রাচীন চের অঞ্চলের প্রধান ক্ষমতার কেন্দ্র কারুর (ত্রিচি জেলা, তামিলনাডু) থেকে বহু প্রত্নবস্তুর মধ্যে রয়েছে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার অ্যামফোরা বা পানীয় রাখার মৃৎপাত্র (মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশও আবিষ্কৃত)। কোয়েম্বাটুর ও সন্নিহিত অঞ্চল থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে খ্রিঃ প্রথম শতকের রোমক নকশায় শোভিত অপরূপ সোনার কণ্ঠহার ও আংটি (নাগস্বামী ১৯৯৫)। এই প্রসঙ্গে অবশ্যই বলতে হবে মহারাষ্ট্রের কোলহাপুর থেকে আবিষ্কৃত সমুদ্রের দেবতা পসেইডনের ব্রোঞ্জ নির্মিত মূর্তিটির কথা, যা নিঃসন্দেহে রোম সাম্রাজ্যের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য সম্পর্কের দ্যোতক। ওই কোলহাপুর থেকেই পাওয়া গিয়েছে সুদৃশ্য হাতলওয়ালা পাত্র, যাতে সম্ভবত পানীয় বা তরল পদার্থ রাখা হত। ব্রোঞ্জের তৈরি দর্পণগুলিও আমাদের নজর এড়ায় না। এগুলি ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা থেকে দাক্ষিণাত্যে এসেছিল (ডিপুমা ১৯৯১)। আবার অন্যদিকে সুদূর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকা পেরিয়ে কাবুলের নিকটবর্তী বেগ্রাম-এ সন্ধান মিলেছে ভারতীয় হস্তিদন্তনির্মিত শৌখিন তৈজস। এই ভারতীয় পণ্য যে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পেরিয়ে স্থলপথে রফতানি করা হয়েছিল সে বিষয়ে দ্বিমত নেই। গজদন্ত দিয়ে তৈরি একটি নারীমূর্তি পাওয়া গিয়েছে পম্পেই থেকে (হুইলার ১৯৫১)। রোম সাম্রাজ্যের সঙ্গে ভারতের প্রাণবন্ত বাণিজ্যের পরিচয় পাবার জন্য পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ অপরিহার্য বলে বিগত দুই দশকে স্বীকৃত (বুসাক এবং সাল সম্পা ১৯৯৫)।
এই পর্যায়ের সমুদ্রবাণিজ্যের ইতিহাসে পশ্চিম উপকূলের বন্দর তথা আরব সাগর এবং লোহিত সাগরের ব্যবসার প্রতি ঐতিহাসিকদের আগ্রহ সুবিদিত। তুলনায় পূর্ব উপকূল তথা বঙ্গোপসাগরীয় বাণিজ্যের উপরে গবেষণা কিছুটা কমই চোখে পড়ে। গত দুই দশকের ইতিহাসচর্চায় অবশ্য খানিকটা বদল দেখা যাচ্ছে। খ্রি. প্রথম শতকের শেষে পেরিপ্লাস-এর অজ্ঞাতনামা লেখক পূর্বতটের যতগুলি বন্দরের উল্লেখ করেছেন, তার চেয়ে আ. ১৫০ খ্রি.-এ টলেমির ভূগোলে পূর্ব উপকূলস্থ বন্দরের তালিকাটি বড়। টলেমিই প্রথম পাশ্চাত্য পণ্ডিত যিনি বঙ্গোপসাগরের নির্দিষ্ট নামকরণ করলেন: ‘দ্য গ্যাঞ্জেটিক গালফ’ বা গাঙ্গেয় খাড়ি। সব মিলিয়ে মনে হয় ভারত মহাসাগরের সমুদ্রবাণিজ্যে পূর্বতীরস্থ বন্দরগুলির তাৎপর্য বাড়ছিল। এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ মিলবে একটি বিশেষ ধরনের মৃৎপাত্রের মাধ্যমে। এই মৃৎপাত্র প্রায় সর্বদা থালার আকারবিশিষ্ট; থালার কানা উঁচু; সাধারণত কালো, ধূসর এবং ছাইছাই রঙই দেখা যায়। এই মৃৎপাত্রের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক দিক হল থালার উপর বৃত্তাকার নকশা। পুরাতাত্ত্বিক পরিভাষায় ‘রুলেটিং’ পদ্ধতিতে এই নকশা ফুটিয়ে তোলা হত; তাই এর অভিধা দেওয়া হয়েছে ‘রুলেটেড ওয়্যার’। এই পাত্র পাওয়া গিয়েছে প্রধানত পূর্ব উপকূলের নিকটস্থ প্রত্নক্ষেত্র থেকে, যদিও তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ এলাকাতে কখনও কখনও এই মৃৎপাত্র বা তার ভগ্নাবশেষ চোখে পড়ে। রুলেটেড ওয়্যার-এর প্রাপ্তিস্থানগুলি লক্ষণীয়। শ্রীলঙ্কার মান্তাই, কান্তারোদাই থেকে শুরু করে অলগণকুলম, উরাইয়ুর, কাবেরীপট্টিনম, বাসবসমুদ্রম (তামিলনাড়ুর অন্তর্গত), আরিকামেডু (পণ্ডিচেরি), কোট্টাপটনম, শালিহুণ্ডম, অমরাবতী, নাগার্জুনকোণ্ডা, কণ্টকশাল, কলিঙ্গপটনম (অন্ধ্রপ্রদেশ), মাণিকপটনম, শিশুপালগড় (উড়িষ্যা), তমলুক, চন্দ্রকেতুগড় (পশ্চিমবঙ্গ) এবং মহাস্থানগড় ও ওয়ারি-বটেশ্বর (বাংলাদেশ)। রুলেটেড ওয়্যার-এর প্রাপ্তিস্থানের এই তালিকাটি অসম্পূর্ণ। কিন্তু এর থেকে বুঝতে অসুবিধা হবে না যে এই মৃৎপাত্রটির ব্যবহার ছিল সমগ্র পূর্ব উপকূল ধরে—দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা থেকে উত্তরে গাঙ্গেয় বদ্বীপ পর্যন্ত (পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ সহ)। রুলেটেড ওয়্যার প্রথম আবিষ্কার করেন মর্টিমার হুইলার আরিকামেডুতে উৎখননের সময়। তাঁর ধারণা ছিল এই মৃৎপাত্র খ্রি. প্রথম শতকের পূর্ববর্তী নয়। কিন্তু বিমলা বেগলের সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত যে এই মৃৎপাত্রের সঙ্গে রোমক বাণিজ্যের সম্পর্ক নেই এবং এটির প্রাচীনত্ব অধিকতর। বেগলের বিচারে রুলেটেড ওয়্যার-এর ব্যবহার ছিল ২০০ খ্রি.পূ. থেকে খ্রি. ২০০ পর্যন্ত। উত্তর ভারতের কৃষ্ণচিক্কন মৃৎপাত্রের ব্যাপক প্রসার যেমন বাণিজ্যিক সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়, একইভাবে রুলেটেড ওয়্যার থেকে প্রমাণ করা সম্ভব যে সমগ্র পূর্বতটেই উপকূলাশ্রয়ী বাণিজ্য চলত (বেগলে ১৯৯১)। গোঘটে রুলেটেড ওয়্যার-এর মাটির রাসায়নিক পরীক্ষা করে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে রুলেটেড ওয়্যার-এর মূল উৎপাদন এলাকা চন্দ্রকেতুগড়-তাম্রলিপ্ত অঞ্চল। এখান থেকেই এই মৃৎপাত্র উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু এবং শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছত (গোঘটে ১৯৯৭)।
উপরের আলোচনা থেকে বাংলার উপকূলসহ পূর্ব উপকূলের গুরুত্ব অনুধাবন করতে সমস্যা হয় না। নিম্ন গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকা সহ বাংলার উপকূলবর্তী অঞ্চলের বাণিজ্য বিগত দশকে মূর্ত হয়েছে খরোষ্টী-ব্রাহ্মী মিশ্র লিপিতে উৎকীর্ণ পোড়ামাটির সীলমোহরগুলির পাঠোদ্ধার হওয়ায়। এই পাঠোদ্ধারের কৃতিত্ব ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়-এর (মুখার্জী, ১৯৯০)। চন্দ্রকেতুগড় প্রত্নস্থল থেকে প্রাপ্ত সীলমোহরগুলি এক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্যময়। অধিকাংশ সীলমোহরই, ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতে, খ্রিস্টীয় প্রথম থেকে চতুর্থ শতকের মধ্যে উৎকীর্ণ ও ব্যবহৃত। সীলমোহর বস্তুটিই ব্যবসা বাণিজ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী যুক্ত। চন্দ্রকেতুগড় থেকে আবিষ্কৃত কয়েকটি সীলমোহরে বিভিন্ন প্রকার জলযানের প্রতিকৃতি দেখা যায়। এগুলি প্রকৃতই ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’ তথ্যসূত্র, সমগ্র ভারতবর্ষে এর সমতুল্য কিছু নেই। সীলমোহরে প্রদর্শিত হয়েছে সাধারণ ডিঙি নৌকা জাতীয় ছোট জলযান। একটি সীলমোহরে যে জলযান দেখা যাচ্ছে, তার মাস্তুলটি ত্রিপদবিশিষ্ট একটি কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে আছে। উৎকীর্ণ লেখতে জলযানটি ‘ত্রপগ’ বলে অভিহিত। ‘এপ্পগ’ নামক তটীয় এলাকায় চলাচলকারী জলযান ব্যবহার হতে দেখেছিলেন পেরিপ্লাস-এর লেখক বারুগাজা বন্দরে। এপাগ বা এপ্পগ নামক জলযান কেমন ছিল দেখতে, তা জানা গেল চন্দ্রকেতুগড়ের সীলমোহরটি থেকে। এটাও বোঝা যায় যে এইপ্রকার জলযান গুজরাট উপকূলের মতোই গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকাতেও সক্রিয় ছিল। চন্দ্রকেতুগড়ের সীলমোহরে যে ‘এপ্যগ’ জাহাজটি প্রদর্শিত, তার উপরে দেখানো হয়েছে একটি দণ্ডায়মান ঘোড়া। কোনও ভারতীয় বন্দর থেকে জলপথে ঘোড়া পরিবহনের এটিই প্রাচীনতম নিদর্শন। এই ঘোড়া সম্ভবত বাংলায় আমদানি করা হত উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল থেকে; আমদানি করা ঘোড়ার কয়েকটি আবার জলপথে রফতানি করা হত। চীনা ও তামিল সাহিত্যিক তথ্যপঞ্জির উপর ভিত্তি করে ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ধারণা যে এই ঘোড়া জলপথে বাংলার উপকূল থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও করমণ্ডল উপকূলে পৌছত। আরও এক প্রকার জলযান সীলমোহরে প্রদর্শিত; উৎকীর্ণ লেখ অনুসারে এটির অভিধা ‘জলধিশত্রু’। অর্থাৎ সমুদ্রে ইন্দ্রতুল্য। ‘ত্রিদেশ যাত্রা’ অভিধাটি আরও একটি জলযানের প্রতিকৃতিতে ব্যবহৃত। ‘ত্রিদেশযাত্রা’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ তিন এলাকা বা তিন দিকে যাত্রা করতে যে জলযান সক্ষম। কিন্তু তার প্রকৃত অর্থ, সম্ভবত যে জলযান মাঝদরিয়া পেরিয়ে দূর দেশে পাড়ি দিতে পারত। জলধিশক্রও বোধহয় এমনই এক সমুদ্রগামী জাহাজ যা উপকূলে চলাচলকারী ‘এপ্যগ’ জাতীয় জলযান থেকে পৃথক। জাহাজগুলি প্রায় সবক্ষেত্রে একমাস্তুলবিশিষ্ট। এক বা একাধিক দাড়ও প্রতিকৃতিগুলিতে উপস্থিত। অন্তত একটি জলযানের ক্ষেত্রে হালচালনার উপকরণও দেখানো হয়েছিল। বহুক্ষেত্রেই জাহাজের পাটাতনের উপর রাখা একটি পেটিকা দেখা যায়; পেটিকা থেকে উদগত ধানের শীষ নজর এড়ায় না। কখনও ধানের শীষ পৃথকভাবে সীলমোহরের ডান দিকে বা বাঁদিকেও প্রদর্শিত হয়েছে। অনুমান করা যুক্তিযুক্ত যে বাংলা থেকে জলপথে রফতানি হত ধান। সমুদ্রবাণিজ্যে ধানও যে এত প্রাচীন কালে একটি পণ্য ছিল, চন্দ্রকেতুগড়ের সীলমোহর তাঁর জোরালো প্রমাণ নিয়ে হাজির (মুখার্জী ১৯৯০; চক্রবর্তী ১৯৯৬, ২০০০)।
কিছুটা ভিন্ন আকৃতির জলযান দেখা যাবে এক বিশেষ ধরনের সাতবাহন মুদ্রায়। এই মুদ্রাগুলি কেবলমাত্র দাক্ষিণাত্যের পূর্বাংশে এবং পূর্ব উপকূলেই প্রচলিত ছিল বলে মুদ্রাতাত্ত্বিকরা মনে করেন। সাতবাহন মুদ্রায় উৎকীর্ণ জাহাজে দুটি মাস্তুল দেখা যায়। আর একটি মুদ্রায় প্রদর্শিত হয়েছে অনেকগুলি জলযান। অন্ধ্র উপকূলে যে সমুদ্রবাণিজ্য ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল, তার অবিসংবাদী প্রমাণ এই মুদ্রাগুলি বহন করছে। অন্ধ্র উপকূলেই অবস্থিত কণ্টকসোল বা ঘণ্টশাল বন্দর, যা টলেমির ভূগোলে কোন্টাকসুল্লা বলে অভিহিত। খ্রি. প্রথম শতকের একটি লেখা থেকে জানা যায় ঘণ্টশালের এক মহানাবিকের কথা। তিনি জাহাজ চালনায় দক্ষ প্রবীণ নাবিক হতে পারেন, আবার ‘মহানৌ বা বৃহৎ সমুদ্রগামী জলযানের চালক হিসেবেও ‘মহানাবিক’ বলে আখ্যাত হতে পারেন (ঘোষ, ২০০১)।
ভারতের সঙ্গে রোম সাম্রাজ্যের বাণিজ্যসম্পর্ক নিয়ে গবেষণার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। নূতন নূতন পুরাতাত্ত্বিক আবিষ্কার ও লিখিত তথ্যসূত্রের নতুন পর্যালোচনা এই ইতিহাসচর্চাকে ক্রমশ সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১৯২৮ সালে ওয়ার্মিংটন যখন তাঁর প্রামাণ্য গবেষণা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন, তখন তিনি স্পষ্টই বলেছিলেন যে এই দূরপাল্লার বাণিজ্যে যাবতীয় উদ্যোগ ও উদ্যম এসেছিল পাশ্চাত্যের বণিক ও নাবিকদের তরফ থেকে। কারণ তাঁর বিচারে ভারতীয়রা একান্তভাবেই কৃষিনির্ভর এবং বাণিজ্যবিমুখ; শাস্ত্রীয় নিষেধাজ্ঞা তাদের সমুদ্রযাত্রার প্রতি সুদীর্ঘ অনীহার জন্ম দিয়েছিল (ওয়ার্মিংটন ১৯২৮: ১)। একথা ঠিকই ভারতীয়দের দূরদূরান্তরে যাত্রা—তা সে স্থলপথে বা জলপথে যেভাবেই হোক—সম্বন্ধে খুব বেশিসংখ্যক প্রমাণ নেই। তবে এই বিষয়ে সাম্প্রতিক নতুন তথ্য জানা গিয়েছে। লোহিত সাগরীয় এলাকা থেকে খ্রি. প্রথম-দ্বিতীয় শতাব্দীর একটি মৃৎপাত্রের টুকরোর উপর তামিল ভাষায় ও ব্রাহ্মী লিপিতে চট্টন বলে এক ব্যক্তির নাম দেখা যায়। মিশর থেকে পাওয়া গিয়েছে আ. খ্রি. দ্বিতীয় শতকের আরও একটি লেখ। তাতে উল্লিখিত হয়েছেন নাগদত্ত, বিষ্ণুপালিত নামক দুই ভারতীয় ব্যক্তি। এঁরা বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে লোহিত সাগরীয় এলাকা ও মিশর পর্যন্ত যাতায়াত করলে অবাক হবার নেই (সলোমন, ১৯৯১)। একথাও ভুললে চলবে না যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উৎপন্ন নানাবিধ সুগন্ধী, মশলা ও দুর্মূল্য রত্ন রোমের বাজারে পৌঁছত ভারতীয় বন্দরগুলি মারফত। পশ্চিমের ব্যবসায়ীরা সরাসরি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত সমুদ্রপাড়ি দিতেন কি না, সন্দেহ আছে। ফলে অনুমান করে যায় যে বঙ্গোপসাগরীয় এলাকায় যে সমুদ্র বাণিজ্য চলত, তাতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ও ভারতের বণিকরা অংশ নিতেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতির উপস্থিতি এই বাণিজ্যিক যোগাযোগেরই ফল (গ্লোভার, ১৯৯৬; রায় ১৯৯৫, চক্রবর্তী ২০০১)। বাণিজ্যিক তথা সাংস্কৃতিক যোগাযোগ যে প্রাচীন বাংলাকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেয়, তার স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে বাংলায় খরোষ্টী লিপির ব্যবহারের মধ্যে। ১৯৮৯-৯০ এর আগে পর্যন্ত এই ধারণাই ছিল যে খরোষ্টী মূলত উত্তর পশ্চিম ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকাতে বহুল প্রচলিত। পশ্চিমবঙ্গে খরোষ্টী (কখনও কখনও ব্রাহ্মী-র সঙ্গে মিশ্রিতভাবেও ব্যবহৃত)-র ব্যবহার থেকেই প্রমাণিত হয় যে এই লিপি গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায় এল উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল থেকে। উত্তরপ্রদেশের চুনার থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রস্তরস্তম্ভ; তার উপর খ্রি. প্রথম-দ্বিতীয় শতকের খরোষ্টী লিপিতে উৎকীর্ণ লেখ পাওয়া যায়। খরোষ্টী লিপি ব্যবহারকারী উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের মানুষ গাঙ্গেয় বদ্বীপে এসেছিলেন মধ্যগঙ্গা উপত্যকা পেরিয়ে—এই ছবিটি এখন অনেকটাই উজ্জ্বল (মুখার্জী ১৯৯০)।
এই যোগাযোগের একটি রাজনৈতিক মাত্রাও সম্প্রতি আমাদের গোচরে এসেছে। আফগানিস্তানের রবাতক থেকে পাওয়া কনিষ্কের একটি নূতন লেখ (ব্যাকট্রীয় ভাষায় রচিত) থেকে জানা যায় যে তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল সাগিদো (= সাকেত, অর্থাৎ বর্তমান অযোধ্যা অঞ্চল), কোসোম্বো (=কৌশাম্বী, এলাহাবাদের নিকটস্থ), পালিবোথ্রো (পাটলিপুত্র) এবং স্রোশোম্পো (= শ্রীচম্পা বা পূর্ব বিহারের ভাগলপুর)। কনিষ্কের শাসনকালে কুষাণ সাম্রাজ্যের সীমা বিহারের পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত প্রসারিত হয়, যা কার্যত প্রাচীন বাংলার লাগোয়া এলাকা। (সিমস-উইলিয়ামস এবং ক্রিব ১৯৯৬; মুখার্জী ১৯৯৮; রায়, চট্টোপাধ্যায়, চক্রবর্তী এবং মণি ২০০০: ৫৯৭-৬০১)। কুষাণদের রাজনৈতিক ক্ষমতা মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকার পূর্বতম সীমা পর্যন্ত প্রসারিত হওয়ায় উত্তর পশ্চিমাঞ্চল থেকে পূর্বভারতে খরোষ্টী লিপি ছড়িয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়েছিল।
বাণিজ্যের এই চমকপ্রদ বিস্তার নগরায়ণকে অবশ্যই ত্বরান্বিত করেছিল। নগরায়ণের সর্ব ভারতীয় বিস্তার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পুরাতাত্ত্বিক গবেষণায় অগ্রগতির ফলে নগরায়ণের ব্যাপকতা অনুধাবন করা সহজতর হয়েছে (চক্রবর্তী ১৯৯৫; অলচিন ১৯৯৫)। কোনও সন্দেহ নেই আদি ঐতিহাসিক পর্বের নগরায়ণ প্রক্রিয়ার সবচেয়ে চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হল তামিলভাষী অঞ্চলে নগরজীবনের প্রসার। নগরগুলির দেখা পাওয়া যাবে সঙ্গম সাহিত্যে বর্ণিত মরুদম্ তিনাই (উর্বর কৃষিপ্রধান নদী উপত্যকায়) এবং নেইদাল তিনাইতে (উপকূলবর্তী এবং বদ্বীপ এলাকায়)। খ্রি. পূ. প্রথম শতকের আগে দ্রাবিড় দেশে এতগুলি নগরের অস্তিত্ব কল্পনাতীত ছিল। এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। তামিলনাড়ুর ত্রিচিনোপল্লী জেলায় ছিল কারুর, যার পরিচয় বাণিজ্যের প্রসঙ্গে আগে বলা হয়েছে। এটি চেরদের রাজধানী; বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে তার খ্যাতি বহু রোমক মুদ্রা ও অন্যান্য প্রত্নবস্তু দ্বারা প্রমাণিত; এবং বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের কেন্দ্র হিসেবেও তার পরিচিতি নগণ্য নয়। ইরোড জেলার অন্তর্গত কোডুমানাল প্রত্নক্ষেত্রটিকে শনাক্ত করা হয়েছে সঙ্গম সাহিত্যে বর্ণিত পর্তিরুপ্পাট্টুর সঙ্গে। এই স্থানটি থেকে মাত্র ছয় কি. মি. দূরে পাওয়া যেত পডিয়ুর-এর বৈদূর্য। উৎখনন থেকে সন্ধান পাওয়া গিয়েছে নানাবিধ রত্নরাজির। স্বর্ণালঙ্কারগুলি ২৪ ক্যারাট সোনা দিয়ে তৈরি; রূপার তৈরি আংটিও পাওয়া গিয়েছে কোডুমানালে। কোডুমানাল যে দামি ধাতু ও রত্নের লেনদেনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা বুঝতে পারা যায়। কোডুমানাল থেকে পাওয়া একটি মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষে ‘নিগম’ শব্দটি উৎকীর্ণ দেখা যায়। ‘নিগম’ শব্দটি সাধারণত কোনও বণিক সংগঠনকে বোঝায়। কোডুমানালের বসতির কাছেই ছিল সমাধিক্ষেত্র। একটি বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে এই বসতিটি কীভাবে নগরসুলভ আকার ও চরিত্র লাভ করেছিল, পুরাতাত্ত্বিক উপাদান তার সাক্ষ্য বহন করে।
সঙ্গম সাহিত্যে যে নগর সালিউর নামে আখ্যাত, তার পুরাতাত্ত্বিক পরিচয় পাওয়া যাবে বৈগাই নদীর মোহনায় অবস্থিত এবং রামনাথপুর জেলার অন্তর্গত অলগনকুলম প্রত্নক্ষেত্রে। সঙ্গম সাহিত্যে বলা হয়েছে এটি ছিল ‘মারুঙ্গুর’ বা উপকূলে অবস্থিত একটি বন্দর নগর। এখান থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে কৃষ্ণলোহিত মৃৎপাত্র, উত্তর ভারতের কৃষ্ণচিকন মৃৎপাত্র, রুলেটেড পাত্র, পানীয় সংরক্ষণের অ্যামফোরা এবং রৌপ্য মুদ্রা। অপর একটি নগর হল উরাইয়ুর, তার অবস্থান ত্রিচিনোপল্লী জেলায়। সঙ্গম সাহিত্য অনুসারে এই নগরটির সুরক্ষাব্যবস্থা ছিল উচ্চমানের; নগরের বাইরে ছিল সমাধিক্ষেত্র। উৎখনন থেকেও সমাধিক্ষেত্রের পরিচয় পাওয়া গিয়েছে। উরাইয়ুর এর প্রথম সাংস্কৃতিক স্তর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে কৃষ্ণলোহিত মৃৎপাত্র, রুলেটেড পাত্র, ইটালির অ্যারেটাইন পাত্র এবং ব্রাহ্মী লেখ। দ্বিতীয় সাংস্কৃতিক পর্ব থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে কাপড় রং করার চৌবাচ্চা। নগরটি সম্ভবত বস্ত্রশিল্পের কেন্দ্র ছিল। সঙ্গম সাহিত্যের অন্তর্গত মাদুরাইক্কাঞ্চী কাব্য মধুরা/মাদুরাই এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ; এটি পাণ্ড্যদের শক্তিকেন্দ্রও বটে। সাহিত্যগত বর্ণনা অনুসারে দূর দূর দেশ থেকে বণিকরা এই নগরে আসতেন; নগরের বাজার এলাকার বিশদ বর্ণনাও মাদুরাইক্কাঞ্চী কাব্যে উপস্থিত। প্রাণবন্ত বাণিজ্যের পরিচয় পাওয়া যাবে রৌপ্য মুদ্রা আবিষ্কৃত হওয়ায়। কাবেরীপট্টিনম-এর প্রসঙ্গ পূর্বে আলোচিত; কিন্তু আরও দু একটি বাড়তি কথা এখানে যোগ করা যেতে পারে। তাঞ্জোর জেলায় অবস্থিত কাবেরীপট্টিনম সঙ্গম সাহিত্যে ‘পেরুর’ এবং “মানগর’ অর্থাৎ বৃহৎ নগর বলে প্রসিদ্ধ। নগরটি যে সত্যিই বৃহদায়তন ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে পুরাতত্ত্বে। পুহার-এর উৎখনন থেকে দেখা যায়, এই নগরের অবশেষ ছড়িয়ে আছে পুহার-এর আশপাশের অন্তত চল্লিশটি প্রত্নস্থলে। পড্ডিনাপ্পালাই, শিলাপ্পাদিকারম ও মণিমেখলাই-এর বর্ণনা অনুযায়ী নগরটির দুটিভাগ: পড্ডিনাপ্পাক্কম বা মূল বসতি এলাকা এবং মরুবুরপ্পাক্কম বা বন্দর এলাকা। এই নগরে ‘মণিগ্রামম্’ নামক তামিল বণিক সংঘের সক্রিয় উপস্থিতির বর্ণনাও পাওয়া যাবে তামিল সাহিত্যে। চতুর্থ-পঞ্চম শতকে যে পুহারে বৌদ্ধ বিহার ছিল তার নির্ভরযোগ্য পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ আছে।
তামিলনাড়ুর চিংলিপুট জেলায় অবস্থিত কাঞ্চীপুরম সপ্তম শতক থেকে পল্লবদের রাজধানী হিসেবে সুপরিচিত। কিন্তু সঙ্গম সাহিত্যেও এই নগর কাচ্চী নামে উপস্থিত। উৎখননের ফলে প্রথম সাংস্কৃতিক স্তরের সূচনাপর্বে (খ্রি. পূ. দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রি: তৃতীয় শতক) কৃষ্ণলোহিত মৃৎপাত্র, কালো পালিশযুক্ত পাত্র, রুলেটেড পাত্রের ব্যবহার দেখা যায়। এর পরবর্তী পর্বে (খ্রি. চতুর্থ থেকে নবম শতাব্দী) আবিষ্কৃত প্রত্নবস্তুর মধ্যে অ্যারেটাইন পাত্র ও লৌহ উপকরণ উল্লেখযোগ্য। সমুদ্র বাণিজ্যের মাধ্যমে এই নগরের সঙ্গে বহির্জগতের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপিত হত নিরপ্পেয়রু-র বন্দর এলাকায়। এই বন্দরটি বেগবতী নদীর উপর অবস্থিত ছিল। সঙ্গম সাহিত্যের বর্ণনায় দেখা যায় এই বন্দরে বাতিঘরের সুবিধা ছিল। সেখানে পরতবর বা মৎস্যজীবীদের বাস, আবার প্রশস্ত রাস্তা এবং বণিকদের সুউচ্চ অট্টালিকাও বন্দরটিতে ছিল বলে সঙ্গম সাহিত্য বিবরণ দেয়। কাঞ্চীপুরম-এ প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের অবশেষও পাওয়া গিয়েছে। কাঞ্চীপুরমের অনতিদূরে ছিল মামলপুরম। মামল্লপুরম থেকে ১৩ কি.মি. দক্ষিণে গেলে দেখা যাবে বাসবসমুদ্রম নামক প্রত্নক্ষেত্র। উৎখনন চালিয়ে এখান থেকে উদ্ধার করা গিয়েছে পানীয় রাখার অ্যামফোরা, রুলেটেড পাত্র, জল নিকাশের জন্য ভূগর্ভে প্রোথিত পোড়ামাটির কলসীসদৃশ ‘রিং-ওয়েল’, প্রচুর মাল্যদানা, ইটের তৈরি ইমারত (চম্পকলক্ষ্মী ১৯৯৬; চক্রবর্তী ১৯৯৫; ঘোষ, ১৯৮৯)।
সুদূর দক্ষিণ ভারতেও যে নগরায়ণের দ্রুত বিস্তার ঘটছিল, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। নগরায়ণের গতিপ্রকৃতি অনেকটাই গাঙ্গেয় উপত্যকার আদলে। চম্পকলক্ষ্মীর ধারণা যে তামিল এলাকায় নগরজীবন দেখা দিলেও তা মূলত বহিরাগত উপাদানের দ্বারাই চালিত হয়েছিল। অর্থাৎ ভারতে দ্বিতীয় নগরায়ণের প্রাণকেন্দ্র গাঙ্গেয় অববাহিকা, সেখান থেকে দক্ষিণ ভারত সহ ভারতের নানা প্রান্তে নগরসুলভ বসতি ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ে। তাই পরবর্তী নগরগুলিকে দ্বিতীয় দফার নগরায়ণের (‘সেকেন্ডারি আর্বানাইজেশন’) দ্যোতক বলে মনে করা হয়। নগরায়ণের আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী এই জাতীয় দ্বিতীয় দফার নগরায়ণে বহির্বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। দক্ষিণ ভারতে রোম সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্য এক্ষেত্রে তাই বিশেষ অভিনিবেশ দাবি করে। নগরায়ণের ফলে যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন এল দক্ষিণ ভারতে, তা অনেকাংশেই বহিরাগত উপাদানের অভিঘাতের দরুন ঘটেছিল। দূরপাল্লার বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য দক্ষিণ ভারতের নগরায়ণে বিশেষ ভূমিকা নেয়। ফলে এই বাণিজ্যের সংকোচন নগরজীবনের পক্ষে প্রতিকূল হয়ে দাঁড়ায় (চম্পকলক্ষ্মী ১৯৯৬)। অন্যভাবে বলতে গেলে দূরপাল্লার সমুদ্রবাণিজ্য দক্ষিণ ভারতে নগরায়ণ সহ উল্লেখযোগ্য বদল আনলেও সেই পরিবর্তন না হল দীর্ঘস্থায়ী, না হল সমাজজীবনে গভীরভাবে প্রোথিত।
॥ ৮ ॥ খ্রি. ৩০০-৬৫০
চতুর্থ শতক থেকে প্রায় আড়াইশো বছর ধরে উত্তর-ভারতে গুপ্ত সম্রাটরা এবং দাক্ষিণাত্যে বাকাটক শাসকগণ তাম্রশাসন জারি করে অগ্রহার ব্যবস্থার সূচনা করেছিলেন। এ বিষয়ে পূর্বে আলোচনা করা হলেও সমকালীন দক্ষিণ ভারতের পরিস্থিতি পর্যালোচিত হয়নি। এই অংশে সেই বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া যাক। দাক্ষিণাত্যে সাতবাহন সাম্রাজ্যের অবসানের পর যে সব ক্ষুদ্রতর রাজশক্তি দেখা দেয়, তার মধ্যে পল্লবরা কালক্রমে ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন। যদিও তাঁরা দাক্ষিণাত্যের নানা এলাকায় ছড়িয়ে ছিলেন, খ্রি. চতুর্থ শতক থেকে পল্লবদের একটি গোষ্ঠী কাঞ্চীপুরমকে কেন্দ্র করে তামিলনাড়ুর প্রাচীন তোগুইমণ্ডলম অঞ্চলে যথেষ্ট ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। চতুর্থ শতকে বিখ্যাত দক্ষিণাপথ অভিযানে সমুদ্রগুপ্ত যে বারোজন রাজাকে পর্যুদস্ত করেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম কাঞ্চীর বিষ্ণুগোপ, যিনি নিঃসন্দেহে পল্লববংশীয় শাসক। উত্তর ভারতের ও দাক্ষিণাত্যের শাসকদের মতোই পল্লবরাও দক্ষিণ ভারতে তাঁদের শাসনাধীন এলাকায় ধর্মীয় দানগ্রহীতাদের উদ্দেশে নিষ্কর ভূসম্পদ দানের প্রথা আরম্ভ করেন। দক্ষিণ ভারতে এই জাতীয় দান ব্ৰহ্মদেয় (অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের জন্য প্রদত্ত ভূসম্পদ) এবং দেবদান (ধর্মস্থানের উদ্দেশে প্রদত্ত ভূসম্পদ) বলে রাজকীয় শাসনে অভিহিত। নিয়মিত ভূসম্পদদানের ফলে কৃষি এলাকার সম্প্রসারণ ঘটতে থাকে। সঙ্গম সাহিত্যে কৃষির বর্ণনা পাওয়া যায় প্রধানত মরুদম্ তিনাই-তে। অগ্রহার ব্যবস্থার ফলে কৃষিপ্রধান বসতি ও ব্রাহ্মণ্য সমাজাদর্শ পল্লব আমল থেকে কুরিঞ্জি (পার্বত্য বনময় এলাকা) এবং পালৈ (বিশুষ্ক অঞ্চল) তিনাইতেও দেখা যেতে থাকে। বর্ণ-জাতি ব্যবস্থা দৃঢ়তর হতে থাকে। এর পূর্বে সঙ্গম সাহিত্যে বর্ণনা পাওয়া যেত ব্রাহ্মণরা সর্বসাধারণের সঙ্গে নিয়মিতভাবে মেলামেশা করছেন। ব্রহ্মদেয় ব্যবস্থার ফলে কৃষির প্রসার শুধু দেখা দিল তা-ই নয়, ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণ সামাজিক গোষ্ঠীগুলির মধ্যে ব্যবধান প্রকট হয়ে উঠল। এই প্রথম কয়েকটি গ্রাম নিয়ে এলাকাভিত্তিক একটি সংগঠন গড়ে ওঠে, যার পরিচয় ‘নাড়ু’। নাড়ুগুলি চোল আমলে বিশেষভাবে বিকশিত, কিন্তু কৃষিপ্রধান সমাজে তাদের ভূমিকা প্রথম নজরে আসতে থাকে পল্লব যুগ থেকেই (গুরুক্কল ১৯৯৫)।
বলা বাহুল্য, কৃষির সম্প্রসারণ একান্তভাবে নির্ভরশীল ছিল উপযুক্ত সেচ ব্যবস্থার উপর। খেয়াল রাখা দরকার যে উত্তর ভারতের মতো দাক্ষিণাত্যে বা দক্ষিণ ভারতে হিমবাহ নিঃসৃত কোনও নদী নেই। ফলে দক্ষিণ ভারতে সেচের জন্য জলের একমাত্র উৎস বর্ষার বারিধারা। বর্ষার জল যথাযথ সংরক্ষণ করা তাই দক্ষিণ ভারতীয় সেচ ব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ। নদীভিত্তিক বৃহদায়তন সেচ প্রকল্প নয়, গ্রাম পর্যায়ে স্থানীয় ও ক্ষুদ্রতর সেচ প্রকল্পের দ্বারাই একেবারে প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামগুলিতেও জলসেচের আয়োজন করা হত। গ্রামগুলি পল্লব লেখতে ‘উর’ বলে পরিচিত, গ্রামীণ প্রশাসন ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা-ব্যবস্থার তদারকি করত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত ‘সভা’ বা ‘মহাসভা’। উত্তিরমেরু চতুর্বেদীমঙ্গলম নামক বিখ্যাত গ্রামটির সেচব্যবস্থার বিশ্বস্ত বিবরণ পাওয়া যায় বেশ কয়েকটি পল্লব লেখতে, অবশ্য চোল আমলেই এই গ্রামের সেচব্যবস্থা বিষয়ে সবচেয়ে বেশি তথ্য জানা যায়। এই গ্রামের সভা কয়েকটি ‘বারিয়ম’ বা সমিতিতে বিভক্ত ছিল; এক একটি বারিয়ম-এর সদস্যগণ গ্রামের নির্দিষ্ট কোনও বিষয়ের দায়িত্বে থাকতেন। যেমন ‘এরি বারিয় পেরুমক্কল’-এর উপর গ্রামীণ সেচ ব্যবস্থার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়; এবং ‘তোট্ট বারিয় পেরুমক্কল’ সমিতির দায়িত্ব ছিল গ্রামের বাগিচাগুলি পর্যবেক্ষণ করা। গ্রামসভার অন্যতম প্রধান ক্রিয়াকর্ম যে। স্থানীয় সেচব্যবস্থাকে ঘিরে, তাতে সন্দেহ নেই। পল্লবরাজ দন্তিবর্মনের নবম রাজ্যাঙ্কে এই গ্রামের বৈরমেঘতটাক নামক এক বৃহৎ জলাশয়ের রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কারের দায়িত্ব দেওয়া হয় ‘এরি বারিয় পেরুমক্কল’-কে। ওই জলাশয়টির গভীরতা বাড়াতে মাটি কাটার জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল; স্পষ্টই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে ওই বরাদ্দ অন্য কোনও খাতে খরচ করা যাবে না। পল্লব আমলের প্রায় শেষ পর্বের একটি লেখতে দেখা যায় যে, শড়ৈয়ান নামক এক ব্যক্তি উক্কল গ্রামসভার উদ্দেশে ১০০০ কাড়ি পরিমাণ ধান দান করেন; এর উপর প্রতি বছর সুদ হিসেবে ৫০০ কাড়ি পরিমাণ ধান নির্দিষ্ট করা হয়। ওই ৫০০ কাড়ি ধান ব্যয়িত হবে গ্রামের একটি জলাশয় সম্বৎসর রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার সাধনের জন্য। মনে হয় ওই ধান দিয়ে পুষ্করিণী সংস্কারের কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের খাদ্যের ব্যবস্থা করা হত। তবে লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে এই জলাশয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল গ্রামসভার ‘বার্ষিক সমিতির’ (‘সম্বৎসর বারিয় পেরুমক্কল’) উপর; যদিও প্রকৃতপক্ষে এই দায়িত্ব ন্যস্ত হওয়া উচিত ছিল ‘এরি বারিয় পেরুমক্কল’ বা জলাশয় সমিতির উপরই। জনপ্রতিনিধিত্বমূলক স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন সংস্থার দ্বারা গ্রামীণ ও স্থানীয় সেচ ব্যবস্থার তত্ত্বাবধানের এই ধারা চোল আমল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। দক্ষিণ ভারতের কৃষি-অর্থনীতির এটি একটি বিশেষ লক্ষণ, যা ভারতবর্ষে অন্যত্র দেখা যায় না।
৩০০ থেকে ৬০০ খ্রি. পর্যন্ত সময়সীমায় ভারতে ব্যবসা বাণিজ্যের অবস্থা কেমন ছিল, সে বিষয়ে মূলগ্রন্থে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। একথা ঠিকই খ্রি. তৃতীয় শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে রোম সাম্রাজ্যের ব্যবসার যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা পরবর্তী আমলে অনেকটাই অবসিত। তবে একথা মনে করার কোনও কারণ নেই যে পশ্চিমের সঙ্গে সমুদ্র বাণিজ্যে ইতি পড়ল। কনস্টান্টিনোপল বা বর্তমান ইস্তাম্বুলে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী গড়ে ওঠার ফলে চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে ভারতের সঙ্গে পূর্ব রোম সাম্রাজ্যের বাণিজ্য বজায় ছিল। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ ভারতে বাইজান্টাইন শাসকদের মুদ্রার প্রাপ্তি; এগুলি প্রধানত দক্ষিণ ভারত থেকে আবিষ্কৃত (রাধাকৃষ্ণণ ১৯৯৯)। খ্রিস্টীয় প্রথম তিন শতকে ভারতের সঙ্গে রোম সাম্রাজ্যের বাণিজ্য অবশ্য বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্যর তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু চতুর্থ শতকের পর থেকেই ভারতের বহির্বাণিজ্যে ভাটা পড়ল, এই বহুপ্রচলিত ধারণা মেনে নেওয়া কঠিন।
ষষ্ঠ শতকের সূচনায় পশ্চিম ভারতে বাণিজ্য নিয়ে অধুনা আবিষ্কৃত কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য এখানে উপস্থাপিত করা যায়। যষ্ঠ শতকের সূচনায় তোরমান ও মিহিরকুল নামক দুই হূণ শাসক উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় ক্ষমতা বিস্তার করেছিলেন, এই ঘটনা সুবিদিত। ক্ষয়িষ্ণু গুপ্ত সাম্রাজ্যের পক্ষে এর অভিঘাত নিশ্চয়ই শুভ হয়নি। হূণ শাসক তোরমানের রাজত্বকালে গুজরাটের সঞ্জেলি থেকে তিনটি নূতন তাম্রশাসন পাওয়া গিয়েছে। লেখগুলি তাঁর তৃতীয়, ষষ্ঠ ও ঊনবিংশ রাজ্যবর্ষে উত্তীর্ণ হয়েছিল। অর্থাৎ তোরমান অন্তত উনিশ বছর রাজত্ব করেন, আ. ৫০০ থেকে ৫১৯ খ্রি.। এই তাম্রশাসন তিনটির প্রথম সম্পাদনা ও অনুবাদ করেছিলেন আর. এন. মেহতা এবং এ. এম. ঠক্কর; পরবর্তীকালে এগুলির পুনঃসম্পাদন ও নূতন অনুবাদ করেন কে. ভি. রমেশ (মেহতা ও ঠক্কর ১৯৭৮; রমেশ ১৯৮৬)। লেখগুলিতে বণিকদের ও বিশেষত একটি বিশিষ্ট বণিক সংগঠনের সক্রিয় উপস্থিতির প্রমাণ রয়েছে। বদ্রপালি নামে একটি স্থানে (সম্ভবত একটি বাণিজ্যকেন্দ্র) সমবেত হয়েছিলেন বদ্রপালির স্থানীয় (‘বাস্তব’) এবং বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীবৃন্দ (‘চাতুর্দিশাভ্যাগতকবৈদেশ্য’)। তাঁরা সমবেত হয়েছিলেন একটি বিষ্ণুমন্দিরের উদ্দেশে নানাবিধ দান করার জন্য। যেটি বিশেষভাবে উল্লেখ্য, তা হল স্থানীয় ও ‘বৈদেশ্য’ বা বহিরাগত বণিকরা ‘বণিগগ্রাম’ নামক সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ‘বণিকগ্রাম’ বা ‘বণিগগ্রাম’ আক্ষরিক অর্থে বণিকদের কোনও গ্রামীণ এলাকার বসতি নয়, ‘গ্রাম’ কথাটি এখানে সমূহ বা গোষ্ঠী অর্থে ব্যবহৃত। ‘বণিকগ্রাম’-এর এই তাৎপর্য প্রথম তুলে ধরেন ১৯৫৫ সালে দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বী (কোসাম্বী, ১৯৫৫)। এ সত্ত্বেও ১৯৮৬ সালে লেখগুলির সম্পাদনা করতে গিয়ে কেন যে রমেশ ‘বণিগগ্রাম’কে আক্ষরিক অর্থে বণিকদের গ্রাম (‘ভিলেজ’) অর্থে গ্রহণ করেছিলেন, তার যৌক্তিকতা বোঝা দুষ্কর।
বৈষ্ণব জয়স্বামীর উদ্দেশে স্বেচ্ছায় বাণিজ্যিক পণ্যের উপর কর জাতীয় আদায় প্রদান করতে যেসব বণিকরা সম্মত হয়েছিলেন, তাঁদের তালিকা নিম্নরূপ:
১। দশপুর (= মান্দাসোর) থেকে আগত গোমিক।
২। কান্যকুব্জের পিতৃযশ চিরায়ুষ
৩। উজ্জয়িনী থেকে আগত গদুসুয়েভস্মম্
৪। বরুণোদরীর দ্রোণসোম ভষ্কল।
৫। মহিষহ্রদকের ভন্নিতীয় ধ্রুবভক্ষণ অগ্নিশর্মা (মহিষহ্রদক = বর্তমান মহিষ, কয়রা জেলা, গুজরাট)।
৬। প্রচকাশ (= তাপ্তী নদীর তীরে অবস্থিত প্রকাশ) থেকে আগত ভস্কুর।
৭। গণ্যতর (= গোধ্রা, পঞ্চমহল জেলা, গুজরাট)
৮। কালয়োত্তিভট্টি যিনি এসেছিলেন সঙ্গঢ্যক থেকে।
৯। প্রিয়ঞ্চরায়াস-এর ভরণভট্টীশ শর্মা
১০। রিবসুলবাণিজক (= রাসেল, নান্দোড় তালুক, গুজরাট)
১১। ভট্টি মহত্তর
১২। স্বামিক মহেশ্বর মল্লক
১৩। সস্বাস-এর কোট্টদেব।
সবগুলি স্থাননাম নির্ভুলভাবে আধুনিক মানচিত্রে শনাক্ত করা যায়নি। কিন্তু এটুকু নিশ্চয়ই বোঝা যায় যেসব বণিকের নামের সঙ্গে স্থাননাম বলা হয়নি, তাঁরা বোধহয় বদ্রপালির স্থানীয় ব্যবসায়ী। দশপুর, উজ্জৈয়িনী এবং কান্যকুব্জ-এর দূরবর্তী এলাকা থেকে বণিকরা যেহেতু বদ্রপালিতে স্থানীয় বণিকদের সঙ্গে সমবেত হয়েছিলেন, সেহেতু বদ্রপালিকে একটি সক্রিয় বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে অবশ্যই চিহ্নিত করা চলে। স্থানীয় ও বহিরাগত ব্যবসায়ীরা মিলিত হয়েছিলেন, অপর এক বণিক ষষ্ঠীর গৃহে৷ এই ষষ্ঠীও বোধহয় বদ্রপালিরই বাসিন্দা; কারণ তোরমানের ষষ্ঠ বর্ষের তাম্রশাসন অনুসারে তিনি বৈষ্ণব মন্দিরের উদ্দেশে (‘পরমদেবতা ভগবৎপাদায়তন’) দান করেন নিজস্ব বাসগৃহ (স্বদীয় গৃহবাস্তু)। বদ্রপালিতে ধান, গুড়, লবণ, গুগ্গুল (সুগন্ধী বিশেষ) প্রভৃতি নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর লেনদেন যে চলত, তার স্পষ্ট উল্লেখ তাম্ৰশাসনগুলিতে উপস্থিত। এইসব সামগ্রী বহন করে নিয়ে আসার জন্য ভারবাহীপশু হিসেবে গর্দভের নিয়মিত ব্যবহারও জানা গিয়েছে। লেখগুলিতে রৌপ্যমুদ্রা (‘রূপিনীক’) এবং তাম্রমুদ্রা (‘বিংশোপনিক’)-র ব্যবহারের উল্লেখও লক্ষণীয়। বণিকরা যে বৈষ্ণব মন্দিরের উদ্দেশে বিবিধ দান সম্পাদন করলেন, তা নিছক একটি বৈষ্ণব উপাসনালয় নয়। মন্দিরের লাগোয়া একটি বিশ্রামাগারের কথা জানা যায়, যা নির্মিত হয়েছিল জ্ঞানীগুণী ভক্ত ও শিষ্যবর্গের জন্য (ভক্তচৈল্যাদিপ্রগুণাঃ)। মন্দিরটিতে চিকিৎসার সুযোগ সুবিধাও পাওয়া যেত—ঔষধ ও পথ্য দুই দেওয়া হত পীড়িতদের জন্য (‘ভৈষজ্যপথ্যভোজন’)। পশ্চিমভারতে ষষ্ঠ শতকের প্রারম্ভে একটি বণিকগোষ্ঠী কেবলমাত্র ব্যবসা বাণিজ্যেই যুক্ত ছিলেন না। তাঁরা সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপে গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন। লক্ষণীয় যে সমাগত বণিকদের মধ্যে অন্তত দুইজনের নামের অন্তে শর্মা শব্দ আছে। শৰ্মা বা শর্মণ ব্রাহ্মণদের নামেই সাধারণত যুক্ত থাকে। এই ব্রাহ্মণরা বণিক তো বটেনই, তাঁরা একটি বণিক গোষ্ঠীরও সদস্য ছিলেন। গুপ্ত আমলে বর্ণ-জাতি ব্যবস্থার কঠোর গণ্ডি পেরিয়ে ভিন্নবৃত্তিতে যুক্ত থাকার এটি একমাত্র নিদর্শন নয়। শূদ্রকের বিখ্যাত নাটক মৃচ্ছকটিকের নায়ক চারুদত্ত জন্মসূত্রে বিপ্র অর্থাৎ ব্রাহ্মণ বটে, কিন্তু তিনি বৃত্তিতে ‘সার্থ’ বা সার্থবাহ অর্থাৎ ব্যবসায়ী ছিলেন।
॥ ৯ ॥ আদি মধ্যকালীন ভারতের অর্থনীতি (খ্রি. ৬৫০-১৩০০)
মূল গ্রন্থের অষ্টম অধ্যায়ে আদি মধ্যযুগে ভারতীয় অর্থনৈতিক জীবনের চরিত্র ও গতিপ্রকৃতি নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছিল। এই আলোচনার অনেকটাই ব্যয়িত হয়েছিল একটি বিতর্ককে ঘিরে: ৬৫০-১৩০০ এই সময়সীমায় ভারতীয় অর্থনীতি কি সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিল? এই বিতর্কের তিনটি প্রধান ধারা দেখা যাবে। যাঁরা প্রাক-আধুনিক ভারতে বিশেষ লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখতে পান না, সেই প্রথানুগ ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচ্য সাত শতাব্দী ধরে অর্থনৈতিক অবস্থার বদল বিশেষ কিছু নেই। দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বী, রামশরণ শর্মা, বি.এন.এফ যাদব, দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ ঝা প্রমুখ ঐতিহাসিকদের মতামত সুপরিচিত: তাঁরা ওই সময়ে আর্থ-সামাজিক জীবনে বহু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখেন। এই পরিবর্তনের প্রধান চাবিকাঠি, তাঁদের বিচারে অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে খুঁজতে হবে। এই ঐতিহাসিকদের অবস্থান আমাদের অজানা নয়—সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ভারতের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় সুখকর হয়নি। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় অন্তত ৬০০-১০০০ খ্রি. (অর্থাৎ চারশো বছরে) অর্থনৈতিক সংকট বিরাজ করছিল। তার মূল চরিত্র চিহ্নিত হয়েছে বাণিজ্যনির্ভর নগরাশ্রয়ী অর্থনীতির অবসানে এবং গ্রামমুখী, আবদ্ধ এবং স্বনির্ভর কৃষি-অর্থনীতির বিকাশে। তৃতীয় গোষ্ঠীর ঐতিহাসিকরা আদিমধ্যকালীন অর্থনৈতিক জীবনে বদলের সম্ভাবনা মেনে নিয়েছেন; কিন্তু তাঁদের ব্যাখ্যায় অর্থনৈতিক অবস্থায় সংকটের পরিবর্তে তার সজীব চরিত্রই উপস্থাপিত, এর জন্য আমরা ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়, চম্পকলক্ষ্মী প্রমুখের কাছে ঋণী। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে কোশাম্বী ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের যে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ করেছিলেন, ষাট ও সত্তরের দশকে রামশরণ শর্মা ও তাঁর অনুগামীদের গবেষণা ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের চর্চাকে বহুগুণে সমৃদ্ধ করেছিল। এই ব্যাখ্যার ফলে যে বিতর্কের সূত্রপাত, সেই বিতর্ক এখনও চলছে। তার দরুন ভারত ইতিহাসের আদিমধ্যপর্ব সম্বন্ধে ঐতিহাসিক মহলে আগ্রহও অব্যাহত।
আদিমধ্যকালীন ভারতের অর্থনীতি যে সামন্ততান্ত্রিক লক্ষণ দ্বারা চিহ্নিত, এই অভিমত যাঁরা মানেন, তাঁরাও কিন্তু স্পষ্টত—কখনও বা পরোক্ষভাবে—স্বীকার করছেন অগ্রহার ব্যবস্থার ফলে কৃষি অর্থনীতির ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। একটু ভিন্নভাবে বললে তাম্রশাসন জারি করে ব্রাহ্মণ নিবেশন সৃষ্টির মাধ্যমে বহু অনাবাদি এলাকাকে কর্ষণযোগ্য করে তোলা হয়। রামশরণ শর্মা (১৯৮৭) যদিও নগরের অবক্ষয় সম্পর্কে ব্যাপক তথ্য ও বিশ্লেষণ করেছেন, তবুও তিনি সরাসরি বলেন যে নগরের অবক্ষয় কৃষিপ্রধান গ্রামীণ অর্থনীতির বহুল প্রসার (‘রুর্যাল এক্সপানশন’) ঘটিয়েছিল। রমেন্দ্রনাথ নন্দী সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির সপক্ষে সওয়াল করলেও মেনে নিয়েছেন আদিমধ্যযুগে গ্রামীণ কৃষিপ্রধান অর্থনীতির বিকাশের যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে (নন্দী ১৯৮৪)।
উত্তর ভারতের তাম্রশাসনগুলি নিয়ে আলোচনার অভাব নেই ঠিকই, কিন্তু তাম্রশাসন ও গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণবন্ত রূপটি দাক্ষিণাত্যে—বিশেষত কর্ণাটকে—যথেষ্ট উজ্জ্বল। সে দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। ষষ্ঠ শতকে গোয়া অঞ্চলে কদম্ববংশীয় শাসকদের একটি ক্ষুদ্র শাখা যখন রাজত্ব করছিল, তখন এক ব্রাহ্মণকে তাম্রশাসন জারি করে নিষ্কর জমি দেওয়া হয়। তার উদ্দেশ্য ছিল প্রদত্ত এলাকার অন্তর্গত বনভূমিকে আবাদি এলাকায় পরিণত করা (‘অরণ্যকর্ষণ’)। এই কাজে দানগ্রহীতা ব্রাহ্মণ চার গোষ্ঠীর কৃষিশ্রমিক (‘প্রেষ্যকুল’) নিয়োগ করার অধিকারও পেয়েছিলেন। ওই একই তাম্রশাসনে দেখা যায় একটি ‘ক্ষেত্র’ বা কৃষিজমির কথা যাকে বর্ণনা করা হয়েছে ‘বহুকচ্ছক্ষেত্র’ বলে। ‘কচ্ছ’ শব্দটি তটীয় এলাকার সমার্থক। সমুদ্রের জলকে বাঁধ দিয়ে ঘিরে কীভাবে ওই তটীয় এলাকা ধান ফলনের পক্ষে উপযুক্ত হয়ে উঠল, তার বিবরণ লেখটিতে পাওয়া যাবে। ৭৬২ খ্রি. উৎকীর্ণ গোরিবিডনুর তালুক থেকে পাওয়া লেখটিও কম চিত্তাকর্ষক নয়। দানগ্রহীতা এক ব্রাহ্মণকে চারটি গ্রামে ছড়ানো যে ভূখণ্ডগুলি দেওয়া হয় তার মধ্যে ছিল একটি বন। বনটি কার্যত চারটি-গ্রামেরই সীমানায় অবস্থিত। দানগ্রহীতা ব্রাহ্মণ যে অরণ্যটিকে কালে কৃষিজমিতে উন্নীত করে নেবেন, এই ইঙ্গিত তাম্রশাসনে স্পষ্ট। তানাগুণ্ডুরমহারাম-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ গ্রামীণ জনকল্যাণের জন্য বিবিধ পদক্ষেপ নেন; তার বর্ণনা ৯০৪ খ্রি. একটি কর্ণাটকী লেখতে পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণের অন্যতম কৃতিত্ব ছিল একটি বিশাল জলাশয় খনন করা। জলাশয়ের জল আসত তিনটি ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনী থেকে, নিকটবর্তী মানালি অরণ্য থেকে ওই তিন স্রোতস্বিনীর উৎপত্তি। বুঝতে অসুবিধে হয় না, নদীর জল সংরক্ষণের মাধ্যমে সেচব্যবস্থার উন্নতি বিধান করে স্থান কৃষি সম্পদের বৃদ্ধি ঘটিয়েছিলেন ওই ব্রাহ্মণ ব্যক্তি। অরণ্য এলাকাটি নিঃসন্দেহে কালক্রমে আবাদি অঞ্চলে পরিণত হয়। তার ফলে লেখটির বিবরণ অনুযায়ী, স্থানীয় সমাজে জনসংখ্যার বৃদ্ধি (‘জনোদয়’) ঘটেছিল। কৃষি এলাকার প্রসার, কৃষি উৎপাদনে বৃদ্ধি যে এই অঞ্চলে আর্থিক উন্নয়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি দুই-ই ঘটিয়েছিল, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কৃষির সম্প্রসারণ ও সেচব্যবস্থা যে পরস্পর অতি নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত, তারও পরিচয় আলোচ্য লেখটিতে মিলবে।
দাক্ষিণাত্যে সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নে উদকবন্ধ বা জলকপাট (‘স্লুইস’) ব্যবহারের বিশেষ তাৎপর্য আছে। দাক্ষিণাত্যে অতীতে জলসেচের প্রধান মাধ্যম ছিল জলাশয় ও কূপ, যেগুলি আবার একান্তভাবে বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল। আদিমধ্যকালে কর্ণাটক অঞ্চলে প্রণালী বা সেচখালের মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থার প্রসার ঘটানোর প্রয়াস দেখা যায়। এর ফলে কেবলমাত্র বৃষ্টির জলের উপর কৃষকের নির্ভরতা বোধ হয় আপেক্ষিকভাবে কমেছিল। অষ্টম শতকের পরবর্তী কর্ণাটকের লেখতে জলকপাট যুক্ত জলাশয়ের উল্লেখ আগের তুলনায় যথেষ্ট বেড়ে যায়। ৮৯০ খ্রি. হিরিয়ুর তালুকে এমন একটি জলাশয়ের উল্লেখ একটি লেখতে আছে যাতে অন্তত চারটি জলকপাট লাগানো হয়েছিল। ১০৮০ খ্রি. অপর একটি লেখতে জানা যায় জলাশয়ের উত্তর প্রান্তে একটি জলকপাটের কথা। জলাশয়ের অন্যান্য দিকেও অনুরূপ জলকপাট থাকলে বিস্মিত হবার নেই।
সেচ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটলে কৃষি উৎপাদনে অগ্রগতি দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। অষ্টাঙ্গহৃদয় নামক চিকিৎসা বিদ্যার গ্রন্থে (আ. সপ্তম শতক) নিকৃষ্ট পর্যায়ের শস্যের মধ্যে কঙ্গু, কোদ্রব ও শ্যামক-এর উল্লেখ আছে। নবম শতকের অপর একটি গ্রন্থে কঙ্গু, শ্যামক, নীবার, কোদ্রব প্রভৃতি শস্য নিন্দিত, কারণ এগুলি খেলে ঠাণ্ডা লাগার আশঙ্কা এবং হজমের অন্তরায় ঘটে। এক কর্মকারের যে একটি কঙ্গুক্ষেত্র আছে, এমন উল্লেখ আমাদের সামনে হাজির করে কাডুর জেলার একটি আদি মধ্যকালীন লেখ। এটি যে শস্য হিসেবে অতি নিম্নমানের তাতে তথ্যসূত্রগুলিতে প্রায় দ্বিমত নেই। কিন্তু দ্বাদশ শতকের বিখ্যাত গ্রন্থ মানসোল্লাসে (কর্ণাটকের পশ্চিম চালুক্য নরপতির দ্বারা প্রণীত) শ্যামক ও নীবার সহ কঙ্গু ‘সুতণ্ডুল’ অর্থাৎ উৎকৃষ্ট খাদ্যশস্যের মর্যাদা পেয়েছিল। কৃষির অগ্রগতি ‘কুধান্য’ বলে পরিচিত কঙ্গুকে ‘সুতণ্ডুল হিসেবে প্রসিদ্ধি দিয়েছিল (নন্দী: ২০০০) আদিমধ্য পর্বে কৃষির ব্যাপক প্রসার ও ফসলের বহুল বৈচিত্র্য কৃষি অর্থনীতির সজীব চরিত্রেরই নির্দেশ দেয়; সংকটাপন্ন কৃষি-অর্থনীতির পরিচয় খুব সুলভ নয়।
তাম্রশাসন জারি করে কৃষির সম্প্রসারণের যে উপায় উদ্ভূত হল, আদি মধ্যযুগে তার সুযোগ কি গ্রামীণ কৃষিজীবী সব মানুষ পাচ্ছিলেন? এর স্পষ্ট উত্তর না। কৃষি-অর্থনীতি বিকাশের সুযোগ সুবিধাগুলি ভোগ করতেন শাসকগোষ্ঠী, দানগ্রহীতা ব্রাহ্মণগণ, প্রশাসনে উচ্চপদাধিকারীরা (সামন্তপ্রভু সহ) এবং সামরিক বিভাগের ক্ষমতাবান আধিকারিকরা। অগ্রহার ব্যবস্থার দরুন জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা আগের তুলনায় অনেক বেশি নিয়মিত হয়ে যায়। কিন্তু জমির উপর মালিকানা প্রকৃত কৃষকের অত্যন্ত সামান্য সংখ্যকের উপরেই যে বর্তেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। আদি মধ্যকালের বিবিধ তথ্যসূত্রে কৃষক ‘আশ্রিতহালিক’ এবং ‘বদ্ধহল’ বলে যে অভিহিত সে কথা মূল গ্রন্থে পূর্বেই আলোচিত। ‘কৃষক’ কথাটির আরও কয়েকটি সমার্থক এবং প্রতিশব্দও এখানে বিচার্য। নবম শতকে কল্যাণবর্মা তাঁর সারাবলী গ্রন্থে কৃষক বলতে ‘প্ৰেষ্যকৃষিবল’ বুঝিয়েছেন অর্থাৎ যে কৃষককুল নিপীড়িত। কল্যাণবর্মার রচনা আদিমধ্যকালীন গুজরাটে কৃষকের দুর্গতির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আরও দুই শতাব্দী পরে জিনসেনসূরি তাঁর কথাকোশপ্রকরণে বললেন যে কৃষকের মর্যাদা অন্ত্যজ (জাতিবর্ণে বিভাজিত সমাজের হীনতম গোষ্ঠী) ও ‘কারু’ অর্থাৎ কারিগরের তুলনায় সামান্যই ভাল। এই বর্ণনায় সাধারণ কৃষকের দুঃসহ দারিদ্র্য ও আর্থিক দুরবস্থার ছবিই ফুটে ওঠে। পাইয়-লচ্ছি নামমালা নামক আদিমধ্যযুগীয় প্রাকৃত অভিধানে ধনপাল ‘কসয়’ (=কর্ষক) এবং ‘হালিক’ (অর্থাৎ হালচালক কৃষক) শব্দদুটিকে ব্যাখ্যা করেছেন ‘পামর’ অর্থে; অর্থাৎ কৃষক নীচ পাপাত্মা এবং নরাধম। সাধারণ কৃষকের ‘পরদসত্তন’ অবস্থা বা পরাশ্রিত, অধীন অবস্থার সম্বন্ধে আমাদের অবহিত করেন অমরকীর্তি (১২১৮)। এখানেও কৃষকের দারিদ্র্য ও অত্যাচারিত অবস্থার বাস্তব বর্ণনাই পাওয়া যায় (যাদব ১৯৯৬)।
আর্থিক দুর্গতি ও রাজস্বের ক্রমবর্ধমান বোঝা কৃষককে কখনও কখনও বিক্ষুব্ধ করে তুলত। মার্কসীয় ঐতিহাসিকরা কৈবর্ত বিদ্রোহকে কৃষকদের প্রতিবাদ হিসেবে চিহ্নিত করলেও, সেই ব্যাখ্যা সর্বজনসম্মত নয়। এই প্রসঙ্গে আদি মধ্যকালীন দক্ষিণ ভারতের পরিস্থিতি বিচার করা চলে। নবম শতকে একটি দক্ষিণ ভারতীয় তাম্রশাসনে গ্রামীণ মানুষদের (যাঁরা মূলত কৃষিজীবী) হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে যে তাঁরা যেন দানগ্রহীতা (অর্থাৎ ব্রহ্মদেয়প্রাপ্ত) ব্রাহ্মণদের উৎপাত (‘উপদ্রব’) না করেন। ‘উপদ্রব’ করলে তা হবে ‘মহাদ্রোহ’-এর শামিল। তাম্রশাসনের মাধ্যমে দানগ্রহীতাদের উদ্দেশে যে ব্যাপক পরিমাণ জমি হস্তান্তরিত হত, তারই প্রতিক্রিয়া কি কখনও কখনও কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের ‘মহাদ্রোহ’ ঘটাত? তাম্রশাসনে প্রজাদের প্রতি যে চেতাবনী দেখা যায়, তার থেকে কি অনুমান করা যায় না যে প্রজাবিক্ষোভের বিপদ সম্বন্ধে শাসককুল সচেতন ছিলেন?
চোল শাসনের শেষভাগে ত্রয়োদশ শতকে অনুরূপ চিত্ৰই উপস্থিত। চোল শাসক তৃতীয় রাজরাজের রাজত্বের তেইশতম বছরে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কথা একটি সমকালীন লেখতে উল্লিখিত আছে। দুর্ভিক্ষপীড়িত গ্রামবাসী অণ্ডরাণ্ড নামক এক ব্যক্তির নেতৃত্বে স্থানীয় মন্দিরের কোষাগার উন্মুক্ত করে দেন ও গচ্ছিত ধনসম্পদ লুঠ করেন। স্থানীয় মন্দিরের বৈভবের প্রধান সূত্র যে ‘দেবদান’ পর্যায়ভুক্ত জমিজমা, তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। এই অপরাধের জন্য স্থানীয় বিচারক অণ্ডরাণ্ড ও তাঁর অনুগামীদের জমিজমা বাজেয়াপ্ত করে কঠিন শাস্তি দেন। দুর্ভিক্ষজনিত আর্থিক চাপ সহ্যের সীমা ছাড়ালে সাধারণ কৃষকের রোষ কি গ্রামের অন্যতম প্রধান ভূম্যধিকারী মন্দিরের বিরুদ্ধে প্রকটিত হত? রাজরাজের তেইশতম রাজ্যাঙ্কে আরও একটি ঘটনা ঘটেছিল। চোল শাসনের প্রধান ঘাঁটি তাঞ্জোর অঞ্চলে দুই শিবব্রাহ্মণ (অর্থাৎ শৈব পুরোহিত) একটি শৈব মন্দিরের মূল্যবান অলঙ্কার এক বারাঙ্গনাকে গোপনে দিয়ে দেন, মন্দিরের তহবিল তছরুপ করেন এবং রাজস্ব প্রদানের ব্যাপারে বিবিধ গোলযোগ ঘটান। তাঁরা প্রজাদের কাছ থেকে ৫০,০০০ কাসু পরিমাণ অর্থ আদায় করেছিলেন। এই বিধিবহির্ভূত কার্যকলাপের জেরে যখন কেন্দ্রীয় প্রশাসন থেকে রাজদূত পাঠানো হয়, তখন রাজদূতকে এই দুষ্টাচারী পুরোহিতদ্বয় কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। এর ফলে এই দুই পুরোহিতের বিরুদ্ধে স্থানীয় সমাজে বোধহয় বিক্ষোভ দানা বাঁধছিল। মাহেশ্বর সম্প্রদায়ভুক্ত শৈবভক্তবৃন্দ ও প্রধানত অব্রাহ্মণ গ্রামের জনপ্রতিনিধিত্বমূলক স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন সংস্থা ‘উর’-এর যৌথ উদ্যোগে এই দুই ব্রাহ্মণকে শাস্তি দেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। স্থানীয় ‘উর’-টি দুই ব্রাহ্মণকে চিহ্নিত করে দিল ‘শিবদ্রোহী’ ও ‘রাজদ্রোহী’ হিসেবে। অগ্রহার জাতীয় নিষ্কর ভূসম্পদ ব্রাহ্মণদের/ধর্মপ্রতিষ্ঠানের উদ্দেশে দান করলে যে বহুক্ষেত্রে ভূমিব্যবস্থা জটিলতা দেখা দিত, তা এই দলিলে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দানগ্রহীতা ব্রাহ্মণদের অসাধুতার ফলে স্থানীয় গ্রাম সমাজে বিক্ষোভের আশঙ্কাও থাকত।
চোল শাসক তৃতীয় রাজরাজের রাজত্বকালে পাণ্ড্য আক্রমণে চোলদের রাজনৈতিক ক্ষতি ঘটেছিল। রাজরাজের রাজনৈতিক দুরবস্থার সুযোগ নিতে তখন তাঁর অধীনস্থ সামন্তবর্গ বেশ আগ্রহী। এই সামন্তরা স্ব স্ব এলাকায় প্রাধান্য বিস্তার করে প্রজাবর্গকে করভারে পীড়িত করতে থাকেন। অত্যাচারিত গ্রামীণ জনসাধারণের মধ্যে এর ফলে ‘ক্ষোভ’ দেখা দেওয়ার যথেষ্ট যুক্তি আছে। বিক্ষুব্ধ প্রজার হাতে দানগ্রহীতা ও মন্দিরের সম্পত্তিহানির ঘটনাও সমকালীন লেখতে বিবৃত (শর্মা ২০০১: ২১৪-৩৪)।
অগ্রহারের সুযোগ সুবিধা পাবার আকাঙ্ক্ষায় ব্রাহ্মণরা যে কখনও কখনও অসাধুতার আশ্রয় নিতেন, তার প্রমাণ দ্বাদশ শতকের একটি উত্তরভারতীয় লেখতে উপস্থিত। কনৌজের গহড়বাল রাজত্বে ১১৬৪ খ্রি. কয়েকজন ব্রাহ্মণ উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীকে ঘুষ দিয়ে (‘উৎকোচ’) একটি জাল দলিল (‘কু-তাম্র’ বা জাল তাম্রশাসন) তৈরি করিয়েছিলেন। জালিয়াতির কথা প্রকাশ পেলে গহড়বাল রাজ তাকে বাতিল বলে ঘোষণা করেন। এই অসাধু কর্মের জন্য ওই ব্রাহ্মণরা ‘লম্পট’ বা লোভী বলে তাম্রশাসনে নিন্দিত (সরকার ১৯৬৬)।
এবার প্রসঙ্গান্তরে ‘কারু’ বা কারিগরদের অবস্থান দেখা যাক। বস্ত্রশিল্প, ধাতব (বিশেষত লোহা) শিল্প, লবণ উৎপাদন, খনিজ পদার্থ নিষ্কাশন, খাদ্যতৈল নিষ্কাশন, আখ থেকে চিনি তৈরি করা—এই জাতীয় সুপরিচিত কারিগরি বৃত্তিগুলি আদিমধ্যপর্বে আগের মতোই সজীব ও সক্রিয়। বিদেশি—বিশেষত আরব লেখকদের এবং চীনা লেখকদের—বিবরণীতে ভারতীয় বস্ত্র, ধাতব সামগ্রী, চিনি প্রভৃতির প্রশংসা বহুশ্রুত। কিন্তু একথাও সত্য যে কায়িকশ্রমে নিযুক্ত কারিগররা প্রায়শই উচ্চবর্ণের এবং ব্রাহ্মণ্য সমাজাদর্শের কাছে হেয় ও অপাঙ্ক্তেয়। তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় আদিমধ্যকালীন বিবিধ গ্রন্থে অন্ত্যজ ও অস্পৃশ্যদের ক্রমবর্ধমান তালিকা অনুধাবন করলে। আদিমধ্যকালীন বাংলা তথা পূর্বভারতের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায় বৃহদ্ধর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্ত নামক দুই পুরাণ থেকে। এই দুই গ্রন্থে সমাজের সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা হল অন্ত্যজ (অর্থাৎ ‘অধমসংকর’) জাতিগুলিকে: (১) মলেগ্রাহী (ঝাড়ুদার), (২) কুণ্ডব (মাঝি), (৩) তক্ষক (কাঠুরিয়া) (৪) চর্মকার, (৫) দোলাবাহী (শিবিকাবাহক)। বলা বাহুল্য অন্ত্যজ ও অস্পৃশ্যদের তালিকায় ব্রাহ্মণসমাজ অবধারিতভাবে জুড়ে দিতেন চণ্ডালদের। বৃহন্নারদীয় পুরাণের বক্তব্যও অনুরূপ: অন্ত্যজ/অস্পৃশ্যদের তালিকাভুক্ত চর্মকার, ব্যাধ, রজক, কুম্ভকার, লোহাকার, সুবর্ণকার এবং তন্ত্রবায়। অবাক হতে হয় যখন দেখি জৈনগ্রন্থের উপর স্পৃশ্যতা-অস্পৃশ্যতার ধারণার কী ব্যাপক প্রভাব। জম্বুদ্বীপপ্রজ্ঞপ্তিতে কারিগরদের ভাগ করা হয়েছে দুই গোষ্ঠীতে: ‘নরুয়া’ (স্পৃশ্য) ও ‘করুয়া’ (অস্পৃশ্য)। কুম্ভকার, সুবর্ণকার, সূবকার (পাচক), কসবগ (নাপিত)—এই সব অপরিহার্য বৃত্তিকে ‘নরুয়া’ বা স্পৃশ্য বলে স্থির করা হয়েছে। অবশ্য এঁদেরকে অস্পৃশ্য বললে জীবনযাত্রার পক্ষে অপরিহার্য অনেকগুলি সামগ্রী ও অভ্যাসকেও অস্বীকার করতে হয়। তাই বোধহয় উপরিউক্ত গোষ্ঠীগুলির স্পর্শে দোষ নেই। অন্যদিকে ‘চন্ময়রু’ (চর্মকার), ‘যন্তপিলগ’ (তৈলিক), ‘ঘাঞ্চিয়’ (অশ্বশকটচালক), ‘ছিম্পায়’ (রংরেজ), ‘কংসার’ (কাঁসারী), ‘সীবগ’ (সীবনশিল্পী), ‘ধীবর’ প্রভৃতিরা ‘করুয়া’ বা অস্পৃশ্য (যাদব ১৯৭৩; শর্মা ২০০১, গোপাল ১৯৬৫)।
একাদশ শতকের প্রথমার্ধে অল-বিরুনিও লক্ষ করেছিলেন কারিগর গোষ্ঠীগুলিকে অস্পৃশ্য হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা। তাঁর বর্ণনায় দেখা যায় রজক, চর্মকার, ঝুড়ি বানানোর কারিগর, নাবিক/মাঝিমাল্লা, ধীবর, ব্যাধ ও তাঁতি অস্পৃশ্য বলে পরিগণিত হতেন। আদিমধ্যকালে কারিগরদের উৎপাদন ও সংখ্যা পূর্বের তুলনায় বাড়লেও, তাঁদের বৃত্তির প্রতি ব্রাহ্মণ্য সমাজের অসহিষ্ণুতা ও হেয় মনোভাব ক্রমশ প্রকট হচ্ছিল। এর ফল সম্ভবত আর্থিক ও সামাজিক জীবনে শুভ হয়নি।
আদিমধ্যপর্বের অর্থনৈতিক ইতিহাসের চরিত্রবিচার করতে গিয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক উঠেছে, তার অন্যতম প্রধান বিষয় ৬০০-১৩০০ খ্রি. (বিশেষত ৬০০-১০০০ খ্রি.)-এর সময়সীমায় বাণিজ্যের পরিস্থিতি কেমন ছিল। ভিন্নভাবে বললে, সামন্ততন্ত্রের অভিঘাতে অর্থনৈতিক জীবনে সংকটের রূপ যে সব ঐতিহাসিক দেখেন, বাণিজ্যের—বিশেষত দূর পাল্লার বাণিজ্যের—ব্যাপক সংকোচকে প্রমাণ করা তাঁদের প্রধান উপজীব্য। বিষয়টি যে বিতর্কিত, তা সহজবোধ্য। এ বিষয়ে মূলগ্রন্থে আলোচনাও করা হয়েছিল। সাম্প্রতিক তথ্য ও গবেষণার আলোকে এখন আদিমধ্যযুগের ভারতীয় বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতির সন্ধান করা যায়। প্রথমে আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের দিকে নজর দেওয়াই ভাল।
আদিমধ্যযুগে বাণিজ্যের অন্যতম উল্লেখনীয় বৈশিষ্ট্য নানা প্রকার বাণিজ্যকেন্দ্র বা বিপণন এলাকার উদ্ভব। এই বাণিজ্যকেন্দ্রগুলির উল্লেখ আছে যেমন সমকালীন সাহিত্যগত সূত্রে, তেমনই দেখা যাবে তাম্রশাসনে। নানাপ্রকার তথ্যসূত্র পরীক্ষা করলে বাণিজ্যকেন্দ্রের প্রকারভেদই শুধু বোঝা যায় না। বাণিজ্যকেন্দ্রগুলির উচ্চাবচক্রমও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সংস্কৃত তথ্যসূত্রে ‘হট্ট’ বা ‘হট্টিকা’-র ব্যবহার আদিমধ্যকালে নিয়মিত। যে কোনও বাণিজ্যকেন্দ্র—এমনকী নগরের অন্তর্গত বাজারও—‘হট্ট’ বলে পরিচিত হতে পারে। তবে প্রধানত ‘হট্ট’ বলতে গ্রামীণ ও আয়তনে ক্ষুদ্র বাজার এলাকা, আমাদের বহু পরিচিত হাট। আদিমধ্যকালীন তেলুগু লেখতে দেখতে পাওয়া যায় ‘অড্ড’ শব্দটি। এটি সংস্কৃত ‘হট্ট’ শব্দের সমার্থক, অর্থাৎ অন্ধ্র এলাকার গ্রামীণ বিপণন এলাকা। বুঝতে অসুবিধা হয় না হাল আমলের মতো আদিমধ্যপর্বের গ্রামীণ হাট সপ্তাহে একদিন বা বড়জোর দুই দিন বসত। হাট সপ্তাহের প্রতিদিনই সক্রিয়, এমনটা কষ্টকল্পনা। অর্থাৎ হাটে যে লেনদেন হয়, তা দৈনন্দিন নয় বরং সাময়িক। সংস্কৃত তথ্যসূত্রে ‘যাত্রা’ নামক যে বিপণন এলাকা বর্ণিত, তা নিশ্চয়ই কোনও অভিনীত ঘটনা নয়। এটির অর্থ মেলা ও মেলা চলাকালীন বাজার। উত্তরভারতে যে মেলা ‘যাত্রা’ বলে অভিহিত, তার সমতুল্য মহারাষ্ট্রে ও কর্ণাটকে ‘সন্থে’। হাটের মতোই ‘যাত্রা’ বা ‘সন্থে’-তে নিত্যনিয়মিত বেচাকেনা চলে না, তারও চরিত্র সাময়িক। কিন্তু মেলাগুলি প্রতি সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে নিশ্চয়ই বসত না। উৎসব অনুষ্ঠান, ধর্মীয় পরব ইত্যাদির সঙ্গে মেলা বসার নিবিড় সম্পর্ক। মেলাগুলিতে লেনদেন হত দীর্ঘদিন ধরে; সম্ভবত কোনও বিশেষ ঋতুতে, অথবা কোনও বিশেষ মাসে, কিংবা কোনও ধর্মীয় উৎসবকালে।
গ্রামীণ হাট বা বছরের নির্দিষ্ট সময়ে আয়োজিত মেলার চেয়ে আরও নিয়মিত ও বৃহত্তর বাজার এলাকা উত্তরভারতে ‘মণ্ডপিকা’ বলে পরিচিত। বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে ‘মণ্ডপিকা’কে আদিমধ্যযুগের পূর্বে দেখা যায় না। ‘মণ্ডপিকা’গুলি গ্রামীণ হাটের চেয়ে বৃহত্তর। কিন্তু বোধহয় বৃহৎ নগরের বড় বাজার এলাকার তুলনায় ছোট ও গৌণ। অর্থাৎ বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে তাদের অবস্থান হাট ও নগরের বিপণন এলাকার মধ্যবর্তী পর্যায়ে। এই বিষয়ে মূল গ্রন্থে ইতিপূর্বেই আলোচনা আছে, তার পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন।
আদিমধ্যকালীন লেখমালা ও গ্রন্থাদিতে মণ্ডপিকার যাবতীয় উল্লেখ কিন্তু কেবলমাত্র উত্তরভারতেই সীমাবদ্ধ; বিন্ধ্যের দক্ষিণে মণ্ডপিকা কার্যত অদর্শন। অতএব মণ্ডপিকাগুলির বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে একটি বিশিষ্ট আঞ্চলিক চরিত্র আছে। যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন উঠতে পারে বিন্ধ্যের দক্ষিণে মণ্ডপিকার সমতুল্য মাঝারি মাপের বাণিজ্যকেন্দ্র কিছু ছিল কি? থাকলে তার নাম ও চরিত্র কী? এই বিষয়ে সাম্প্রতিক গবেষণার সংক্ষিপ্তসার এখানে দেওয়া চলে। আদিমধ্যকালীন দাক্ষিণাত্যে নতুন একটি বাণিজ্যকেন্দ্রের সন্ধান পাওয়া যায়, যা ‘সন্থে’ বা ‘অড্ড’-এর তুলনায় বড়; কিন্তু বৃহৎ নগরের বাজারের চেয়ে ছোট। এই মধ্য পর্যায়ের বাণিজ্যকেন্দ্রটি ‘পেণ্ঠা’, ‘পিণ্ঠা’, ‘পেংটা’ বলে আদিমধ্যকালীন দাক্ষিণাত্যের তথ্যসূত্রে অভিহিত। ‘পেণ্ঠা’, ‘পিণ্ঠা’ বা ‘পেংটা’কে দেখা যাবে বর্তমান কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশের বহু স্থাননামের অন্ত্যাংশে—‘পেঠ’ (যেমন কাজিপেঠ, নারায়ণপেঠ, বেগমপেঠ ইত্যাদি)।
বস্তুত ‘পেঠ’ শব্দটিই খ্রি. ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে লেখমালায় ব্যবহৃত। বুন্দেলখণ্ড থেকে পাওয়া উচ্চকল্প শাসকদের দুটি লেখতে (৫২৯ ও ৫৩৩-৩৪ খ্রি.) প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে ‘পেঠ’ শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয়। সপ্তম শতকে মহারাষ্ট্রের সাতারা জেলায় ‘পেঠ’ একটি প্রশাসনিক এলাকা বোঝাত। তার প্রমাণ সপ্তম শতকের একটি তাম্রশাসনে আছে। আবার কাথিয়াওয়াড় অঞ্চলে (প্রাচীন বলভীদেশে) মৈত্রক রাজ্যেও ‘পেঠ’ একটি প্রশাসনিক এলাকার সমার্থক। মৈত্রক বংশীয় তাম্রশাসনে তার তর্কাতীত সাক্ষ্য পাওয়া যাবে। এই তিন অঞ্চলেই ‘পেঠ’ প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে গ্রামের চেয়ে বৃহত্তর, কিন্তু জেলা (‘বিষয়’)-র চেয়ে আয়তনে ছোট। অতএব ‘পেঠ’-এর অবস্থান প্রশাসনিক স্তরবিভাজনে মধ্যবর্তী পর্যায়ে। সপ্তম শতক পর্যন্ত ‘পেঠ’-এ প্রশাসনিক ক্রিয়াকলাপই চোখে পড়ে; তা তখনও এলাকাভিত্তিক বাণিজ্যকেন্দ্র নয়। অবশ্য ‘পেঠ’তে উপস্থিত থাকেন ‘কারু’ (কারিগর) এবং বণিক, ‘সন্ধিবিগ্ৰাহিক’, ‘দূতক’ এবং ‘লেখক’ (=করণিক)-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজকর্মচারী। মহারাষ্ট্রে সাতারা জেলায় পঙ্গারক নামক যে পেঠটি ছিল সপ্তম শতাব্দীতে তার কাছেই ছিল হরিবৎস নামক একটি ‘কোট্ট’ বা প্রাকারযুক্ত বসতি। উপরের তথ্যগুলি থেকে এটুকু পরিষ্কার যে প্রশাসনিক এলাকা ও কেন্দ্র হিসেবে পেঠ কোনওক্রমেই গ্রাম নয়। তা হয়তো পুরোদস্তুর নগরও নয়, কিন্তু সম্ভবত পেঠ গ্রাম ও নগরের মাঝামাঝি এক প্রকারের অঞ্চল।
এমন অবস্থান থাকলে পরে পেঠ গ্রাম ও বড় নগরের মধ্যে সংযোগের এক গুরুত্বপূর্ণ স্তর ও বাহন হয়ে দেখা দিতে পারে। এখানেই সম্ভবত তার বাণিজ্যিক সম্ভাবনা নিহিত ছিল।
পেঠ বা পেণ্ঠাতে বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপের এক মনোজ্ঞ বিবরণ ফুটিয়ে তুলেছেন জৈন লেখক সোমদেবসূরি তাঁর যশস্তিলকচম্পূ গ্রন্থে (আ. ৯৫৯ খ্রি. রচিত)। যশস্তিলকচম্পূর লেখক যে দাক্ষিণাত্যের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে সম্যক অবহিত ছিলেন, তার বিশ্বস্ত পরিচয় তাঁর রচনায় দেখা যাবে। যশস্তিলকচম্পূতে সোমদেব ব্রাহ্মণ শ্রীভূতির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি পেণ্ঠার বিবরণ দিয়েছেন। শ্রীভূতি ঐতিহাসিক চরিত্র কি না, সন্দেহ আছে। কিন্তু ‘পেণ্ঠা’-র বিবরণটি ঘটনাপ্রসূত না হলেও বাস্তবানুগ—এতে দ্বিমত নেই। শ্রীভূতি যে ‘পেণ্ঠাস্থান’টি নির্মাণ করলেন তা ছিল অনেকগুলি সুসজ্জিত কক্ষে বিভক্ত (‘বিভক্তানেকাপবরকরচনাশালিনী’)। পণ্য মজুত রাখার জন্য বৃহদায়তন ভাণ্ডারও ছিল (‘মহাভাণ্ডবাহিনী’)। পেণ্ঠাস্থানে ‘প্রপা’ (বা জলপানগৃহ), ‘সত্র’ (ভোজনালয়), ‘সভাসনাথ’ (আসনযুক্তসভাগৃহ) এবং ‘বীথি’ (রাস্তা বা দোকান) সন্নিবেশিত হয়। পেণ্ঠাটিতে নিয়মিত আসতেন নানা দেশের বণিকবৃন্দ (নানাদিগ্দেশোপসৰ্পণযুজাং বণিজাম্)। পেণ্ঠাটি আয়তনে প্রায় দুই মাইল (‘গোরুৎপ্রমাণ’)। খাত (‘কুল্যাঃ’), প্রাচীর (‘বপ্র’), প্রাকার এবং পরিখা দ্বারা সুরক্ষিত এই পেণ্ঠাস্থানে রাখা থাকত উৎকৃষ্ট পণ্যসামগ্রী; বাক্সজাতীয় আধারে পণ্যগুলি সংরক্ষিত হত; এবং এই পণ্যসম্ভারের রক্ষণাবেক্ষণ করতেন দক্ষ প্রহরীরা (‘ভাণ্ডনারম্ভোদ্ভটভরীর পেটকপক্ষরক্ষাসারম্’)। ‘পেণ্ঠা’ যে বাণিজ্যকেন্দ্র, তার চমৎকার আলেখ্য সোমদেবসূরি উপহার দিয়েছেন। তবে পেণ্ঠায় যে লেনদেন চলত, তার আরও স্পষ্ট প্রমাণ এই যে গ্রন্থকার পেণ্ঠাটিকে বলেছেন ‘পুটভেদিনী’। পুটভেদন বা পুটভেদিনী কথাটির আক্ষরিক অর্থ এমন একটি স্থান যেখানে পণ্যসামগ্রীর আচ্ছাদন (‘পুট’) উন্মোচন (‘ভেদন’) করা হয়। অর্থাৎ এটি একটি বাণিজ্যকেন্দ্র যেখানে ব্যবসায়ীরা তাঁদের পণ্যসামগ্রী লেনদেনের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। পেণ্ঠাস্থানের বিবরণ এমন ইঙ্গিত দেয় যে এই জাতীয় বাণিজ্য কেন্দ্রে পণ্যসম্ভার মজুত রাখার ব্যবস্থা ছিল। শ্রীভূতি পণ্যসামগ্রী মজুত রাখার জন্য, পণ্যসামগ্রী প্রদর্শনের জন্য এবং তাদের ক্রয়বিক্রয়ের জন্য সস্তায় পেণ্ঠাস্থানের জায়গা ভাড়া দিতেন (‘প্রশান্তশুল্কভাগহার ব্যবহারমচিকরৎ’)
যশস্তিলকচম্পূ ছাড়া সোমদেব রাজনীতিবিষয়ক একটি শাস্ত্রগ্রন্থের প্রণেতা। তার নাম নীতিবাক্যামৃতম্। অর্থশাস্ত্রের প্রায় সংক্ষিপ্তসার এই গ্রন্থে সোমদেবসূরি ‘পিণ্ঠা’র উল্লেখ করেছেন, যা অবশ্যই ‘পেণ্ঠা’র সঙ্গে অভিন্ন। নীতিবাক্যামৃতম্-এও ‘পিণ্ঠা’কে পুটভেদিনী বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই শাস্ত্র অনুসারে রাজা যদি পিণ্ঠাকে ন্যায়সঙ্গতভাবে রক্ষা করেন, তাহলে পিণ্ঠা রাজার পক্ষে কামধেনুস্বরূপ। পিণ্ঠা/পেণ্ঠা থেকে বাণিজ্যশুল্ক বাবদ রাজার যে প্রভূত অর্থাগম ঘটতে পারে, তার স্পষ্ট স্বীকৃতি দিয়েছেন সোমদেবসূরি। সেইজন্যে ‘পিণ্ঠা’ নীতিবাক্যামৃতম্-এ ‘শুল্কস্থান’ বলে আখ্যাত। দুই ভিন্নধর্মী গ্রন্থে ‘পেণ্ঠা’ বা ‘পিণ্ঠা’-র প্রাথমিক পরিচয় যে একটি প্রাণবন্ত বাণিজ্যকেন্দ্র সোমদেবসূরি সেই দিকে অকাট্য সাক্ষ্য প্রদান করেন।
পেণ্ঠা বা পিণ্ঠা সামান্য ভিন্ন নামে ‘পেংটা’ রূপে অন্ধ্রপ্রদেশের ত্রয়োদশ শতকের কয়েকটি লেখতেও উপস্থিত। ত্রয়োদশ শতকে অন্ধ্রপ্রদেশে ক্ষমতায় আসীন ছিলেন কাকতীয় বংশ। ওই বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা গণপতি (১১৯৯-১২৬১)-র রাজত্বকালে তাঁর রাজধানী বরঙ্গলেই ছিল তিনটি ‘পেংটা’। আকু-পেংটা নামক বিপণন কেন্দ্রে ছিলেন পান, নারকেল, আম ও তেঁতুল বিক্রেতা ‘সসিরবরু’ ব্যবসায়ীরা। নুবুল-পেংটাতে দেখা যায় ‘সসিরবরু’ ব্যবসায়ীদের এবং ‘স্বদেশি-পরদেশি’ বণিকরা। নুবুল-পেংটাতে হাজির ‘স্বদেশি-পরদেশি’ ব্যবসায়ীরা গম, ধান, ছোলা ও ভোজ্যতেল নিয়ে লেনদেন করছিলেন। সবশেষে ‘উপ্প-পেংটা’তে কেনাবেচা হত নুনের। ‘উপ্পু’ কথাটির অর্থ লবণ। তিনটি পেংটাতেই ব্যবসা হচ্ছিল দৈনন্দিন, আটপৌরে সামগ্রী নিয়ে। অনুমান করা যায় এই ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হয়তো খুব বেশি দামি নয়, কিন্তু তা বহুল পরিমাণে লেনদেন হত। কাকতীয় লেখতে পেংটাগুলি ‘সুঙ্কস্থান’ অর্থাৎ সুঙ্ক বা বাণিজ্যিক শুল্ক আদায়েরও কেন্দ্র। পাঠকের স্মরণে আসবে সমকালীন উত্তরভারতে স্থানীয় বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে ‘মণ্ডপিকা’গুলিও প্রায়ই ‘শুল্কমণ্ডপিকা’ (অর্থাৎ মণ্ডপিকাতে শুল্ক আদায়ের ব্যবস্থা) বলে অভিহিত।
চতুর্দশ শতকের গোড়ায় অন্ধ্রপ্রদেশের আরও একটি লেখতে ‘অঙ্গাডি’ বা দোকানঘর সমেত একটি পেংটাতে বাণিজ্যের প্রাণবন্ত পরিচয় জানা যায়। ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকের লেখমালায় ‘পেংটা’গুলি ‘অড্ড’ বা গ্রামের হাটের চেয়ে বড় বলেই প্রতিভাত হয়। পরবর্তীকালে দাক্ষিণাত্যের শ্রেষ্ঠ শক্তি বিজয়নগর সাম্রাজ্যেও এইজাতীয় স্থানীয় বাণিজ্যকেন্দ্র অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। বিজয়নগরের লেখতে তারা ‘বেণ্ঠ’ নামে আখ্যাত। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে ‘বেণ্ঠ’ কার্যত ‘পেণ্ঠা’/‘পিণ্ঠা’/’পেংটা’-র সমার্থক। বিজয়নগরের একটি লেখতে তো একটি বাণিজ্যকেন্দ্র ‘সন্থে-পেটে’ বলে অভিহিত। অর্থাৎ যা এককালে ছিল মেলা চলাকালীন বিপণনকেন্দ্র (‘সন্থে’), তাই কালক্রমে বৃহত্তর ‘পেটে’-তে পরিণত (চক্রবর্তী ২০০২: ২০১-১৯)।
স্থানীয় বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসাবে চোলশাসিত সুদূর দক্ষিণভারতে সক্রিয় ছিল ‘নগরম’গুলি। সে বিষয়ে মূল গ্রন্থে যেহেতু আলোচনা রয়েছে, তাই তার পুনরাবৃত্তি করা অনুচিত হবে।
আদিমধ্যকালীন বাংলায় স্থানীয় বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসাবে ‘হট’ হট্টিকার অস্তিত্ব জানা গেলেও তথ্যসূত্রে ‘মগুপিকা’ বা ‘পেণ্ঠা’-কে দেখতে পাওয়া যায় না। তাহলে কি তৎকালীন বাংলায় গ্রামের হাট ও বড় শহরের বাজারের মধ্যবর্তী পর্যায়ে মাঝারি মাপের কোনও বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল না? ৯৭১ খ্রি. চন্দ্রবংশীয় রাজা শ্রীচন্দ্রের একটি তাম্রশাসনে ‘সম্ভাণ্ডারিয়ক’-এর উল্লেখ দেখা যায়। লেখটি বর্তমান ঢাকা শহরের অনতিদূরে বিখ্যাত সাভার গ্রাম থেকে আবিষ্কৃত। ‘সম্ভাণ্ডারিয়ক’ শব্দের অর্থ হল এমন এক স্থান যেখানে পণ্যসামগ্রী সম্যকরূপে ভাণ্ডার বা সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা আছে। ‘সম্ভাণ্ডারিয়ক’টি আলোচ্য তাম্রশাসনে গ্রাম বলে অভিহিত নয়, তার অবস্থান কোনও নগরেও ছিল না। ‘মণ্ডপিকা’ বা ‘পেণ্ঠা’-র মতোই সম্ভাণ্ডারিয়কটি বোধহয় গ্রাম ও শহরের মধ্যবর্তী মাঝারি আয়তনের একজাতীয় বাণিজ্যকেন্দ্র। ৯৭১ খ্রি.-এর লেখটি অনুপুঙ্খসহ পড়লে মনে হয় সাভার-এর নিকটেই ওই ‘সম্ভাণ্ডারিয়ক’টি অবস্থিত ছিল। বস্তুত নলিনীকান্ত ভট্টশালী একদা অনুমান করেছিলেন ‘সাভার’ নামটি আসলে সংস্কৃত ‘সম্ভার’ থেকে উদ্ভূত। ‘সম্ভার’ শব্দটি তো পণ্যসামগ্রী বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়। এই দিক থেকে বিচার করলে সাভার-এর কাছেই অবস্থিত ছিল সম্ভাণ্ডারিয়কটি। প্রত্নক্ষেত্র হিসেবে সাভার-এর তাৎপর্য অনস্বীকার্য (জাকারিয়া ১৯৮৫, চক্রবর্তী ১৯৯৪)। সাভার-এর অবস্থান বংশী নদীর তীরে। যুক্তিসঙ্গত অনুমান করা সম্ভব যে দশম শতকে সাভার তার ‘সম্ভাণ্ডারিয়ক’ সমেত একটি আভ্যন্তরীণ নদী বন্দরের ভূমিকা পালন করত। এই কারণেই বোধহয় ৯৭১ খ্রি.-এর তাম্রশাসনে রাজকর্মচারীদের তালিকায় ‘নৌবাটক’ এবং ‘অর্দ্ধনৌবাটক’ নামক পদস্থ আধিকারিকদের উল্লেখ দেখা যায়। ‘নৌবাটক’ কথাটি নদীবক্ষে প্রবাহমান সারিসারি রণতরী বোঝাতে পালদের লেখতে থাকলেও পদস্থ আধিকারিক অর্থে আর কোথাও ব্যবহৃত হয়নি। নদীপথে বাণিজ্যের কারণে যেসব জলযান চলাচল করত, সাভারের মতো নদীবন্দরে তার দেখাশোনা করতেন সম্ভবত ‘নৌবাটক’-এর মতো রাজপুরুষ। ‘অর্দ্ধ নৌবাটক’, অতএব, তাঁর সহকারী বা ‘জুনিয়র’ রাজকর্মচারী। নদীমাতৃক বাংলায় নদীবন্দরগুলি সম্ভবত গ্রাম ও নগরের বড় বাজারের মধ্যে প্রধান যোগসূত্র গড়ে তুলত। এই দিক দিয়ে সাভার-এর সম্ভাণ্ডারিয়কটি উত্তরভারতের মণ্ডপিকা বা দাক্ষিণাত্যের পেণ্ঠা অনুরূপ ভূমিকা নিয়েছিল।
এমনই আর একটি নদীবন্দর দেবপর্বত, যার সঙ্গে বাংলাদেশের ময়নামতীকে শনাক্ত করা হয়েছে। সপ্তম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শ্রীধরণারাতের কৈলান তাম্রশাসনে, অষ্টম শতকে অভিনবমৃগাঙ্ক ভবদেবের তাম্রশাসনে (৭৬৫-৮০) এবং শ্রীচন্দ্রের পশ্চিমভাগ তাম্রশাসনে (৯৩০) দেবপর্বতের বর্ণনা পাওয়া যাবে। ক্ষীরোদা নদী (বর্তমান ক্ষীরনাই) দেবপর্বতকে বেষ্টন করে ছিল; ক্ষীরোদা নদীর উভয়তীরে বহু জলযানের সমাবেশ; নদীর জলে ক্রীড়ারত হস্তীকুল। জলযানের নাবিকদের উল্লেখও রয়েছে। ক্ষীরোদানদী বেষ্টিত দেবপর্বত ‘সর্বতোভদ্র’ বলে বর্ণিত, অর্থাৎ যে এলাকায় চারটি প্রবেশদ্বার অথবা যে এলাকার চারদিক দিয়েই পৌছনো যায় (‘অথ মত্তমাতঙ্গ-শত-সুখ-বিগাহ্যমান-বিবিধতীর্থ্যা নৌভিরপরিমিতাভিরুপরচিতকুলয়া পরীক্ষিতাদভিমতনিম্নগামিন্যা ক্ষীরোদয়া সর্বতোভদ্রকাদ্দেবপর্বতাৎ’)। নির্দ্বিধায় বলা যায় দেবপর্বত ছিল একটি প্রাণবন্ত আভ্যন্তরীণ নদীবন্দর।
গঙ্গাসাগরের নিকটবর্তী কোনও অঞ্চলে স্বেচ্ছায় জলসমাধি নিয়েছিলেন ১১৯২ সালে স্থানীয় শাসক শ্রীমড্ডোমনপাল। এই অঞ্চলেই ছিল দ্বারহাটক নামক একটি স্থান। স্থাননামটি অবশ্যই চিত্তাকর্ষক। দ্বার বলতে অবশ্যই দরজা। হাটক কথাটি হট্ট বা হাটের সমার্থক। গঙ্গাসাগরের কাছে নদী সন্নিহিত এলাকায় দ্বাদশ শতকের প্রান্তে একটি হাট এর অবস্থিতি এখানে প্রমাণিত। বাণিজ্যকেন্দ্রটি নিঃসন্দেহে সমুদ্রের এতটাই নিকটে যে এটি বোধহয় সমুদ্রের দ্বারদেশে বিদ্যমান ছিল। সেই কারণেই নদীবন্দরটি দ্বারহাটক বলে পরিচিত (চক্রবর্তী ২০০২)।
লক্ষণ সেনের (১১৭৯—১২০৬) রাজত্বের দ্বিতীয় বছরে উৎকীর্ণ গোবিন্দপুর তাম্রশাসনে পাওয়া যায় বেতড্ড-চতুরক নামক একটি জায়গার কথা। বিশ্বরূপ সেনের (১২০৬-২২) সাহিত্য পরিষৎ তাম্রপট্টে উল্লিখিত আছে আরও তিনটি চতুরক: উরা-চতুরক, নবসংগ্রহ-চতুরক এবং লৌহণ্ড-চতুরক। এই জাতীয় স্থাননাম সেন আমলের পূর্ববর্তী যুগে নেই। চতুরকগুলি গ্রাম নয়, শহরও নয়। গ্রাম ও গ্রামের ঊর্ধ্বে যে প্রশাসনিক স্তর সেই মণ্ডল—এই দুইয়ের মধ্যে চতুরক-এর অবস্থান। অর্থাৎ গ্রামের চেয়ে বড় এলাকা। বেতড্ড-চতুরক-এর পূর্বে ছিল গঙ্গা (‘পূর্বে জাহ্নবীসীমা’)। বেতড্ড-চতুরক অবশ্যই বর্তমানের বেতোড়, হাওড়া জেলার অন্তর্গত। ষোড়শ শতকের পর্তুগিজ সাক্ষ্য অনুযায়ী বৃহদায়তন পর্তুগিজ জাহাজ গঙ্গাবক্ষে বেতোড় পর্যন্ত আসত। সেখানে ক্ষুদ্রতর জলযানে পণ্যসামগ্রী আনা নেওয়া করা হত বিখ্যাত বন্দর সপ্তগ্রাম থেকে। সপ্তগ্রামের সঙ্গে বেড়ে যুক্ত সরস্বতী নদী দ্বারা। ষোড়শ শতকে সপ্তগ্রামের সহায়ক নদীবন্দর হিসেবে বেতোড়ের যে পরিচিতি তার সূচনা সম্ভবত দ্বাদশ শতকের শেষপর্বে।
মণ্ডপিকা বা পেণ্ঠা না থাকলেও নদীমাতৃক গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকার নদীবন্দরগুলি বাংলায় অনুরূপ স্থানীয় বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হয়। আভ্যন্তরীণ ও স্থানীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তো বটেই, এই নদীবন্দরগুলি সম্ভবত বাংলার দূরপাল্লার সমুদ্রবাণিজ্যে সরাসরি না হলেও পরোক্ষ ভূমিকা নিত। এই নদীবন্দরগুলি আদি মধ্যকালীন বাংলার শ্রেষ্ঠ বেলাকুল বা বন্দর সমন্দর বা সুদকাওঁয়া (চট্টগ্রামের নিকট অবস্থিত)-র পশ্চাদভূমি হিসেবে বোধহয় সক্রিয় ছিল (চক্রবর্তী ২০০১)।
নবম-দশক শতক থেকে বাংলার সমুদ্রবাণিজ্যে আরব বণিকদের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। সেই সুবাদে আরব বিবরণীতে বঙ্গোপসাগর বহর হরকল নামে অভিহিত। বহর-এর অর্থ সমুদ্র; হরকল বলতে বোঝায় বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত হরিকেল। অর্থাৎ আক্ষরিকভাবে হরিকেলের সমুদ্র। ৯৭১ খ্রি. শ্রীচন্দ্রের যে তাম্রশাসনে সাভার গ্রামের নিকটবর্তী যে ‘সম্ভাণ্ডারিয়ক’টির আলোচনা আগে করা হয়েছে, সেই তাম্রশাসনেই সর্বপ্রথম পাওয়া যায় বঙ্গসাগর। বঙ্গসাগর ও বহর হরকল কার্যত সমার্থক এবং নিঃসন্দেহে বঙ্গোপসাগরের দুই ভিন্ন নাম। ভারত মহাসাগরের পূর্বদিকস্থ জলরাশি যে বঙ্গ ও হরিকেল নামক প্রাচীন বাংলার দুই অঞ্চলের দ্বারা চিহ্নিত হল আদি মধ্যকালে, তার দ্বারা বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রবাণিজ্যের বাংলার ভূমিকা মূর্ত হয়ে ওঠে (চক্রবর্তী ২০০২)।
আদিমধ্যকালে ভারতবর্ষ ভারত মহাসাগরের সমুদ্রবাণিজ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে ভারতের দুই উপকূলে অনেকগুলি বন্দর বা বেলাকুলের তালিকা গ্রন্থের মূল অংশে দেওয়া হয়েছে। ভারত মহাসাগরের সমুদ্রবাণিজ্যে জাহাজি সওদাগরদের তাৎপর্য অপরিসীম। এঁরা সাধারণ মাঝিমাল্লা নন। জাহাজের চালক বা ক্যাপটেনের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও ধনী। আদি মধ্যযুগের ভারতীয় তাম্রশাসনে এই বিশেষ বণিক ‘নৌবিত্তক’ বলে আখ্যাত; অর্থাৎ যাদের বিত্তের উৎস নৌ বা জলযান। তাঁদের সহজেই জাহাজি বণিক বলে চেনা যায়। সমকালীন আরব বিবরণ ও ইহুদিবণিকদের চিঠিপত্রে (গয়টাইন ১৯৭৩) জাহাজি বণিকদের অভিধা ‘নাখুদা’। নাখুদার অর্থ নাও বা জলযানের খুদা অর্থাৎ প্রভু বা মালিক। উপকূলের সমাজে নাখুদা ও নৌবিত্তক আদিমধ্যযুগে যথেষ্ট পরিচিত। সেই কারণে কয়েকটি লেখমালায় নাখুদা ও নৌবিত্তক সমার্থক প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত। এত নিয়মিত ও বহুল এই দুই শব্দের ব্যবহার যে সংস্কৃত লেখতে কখনও কখনও নৌবিত্তক ‘নৌ’ ও নাখুদা ‘নাখু’ এই সংক্ষিপ্ত অভিধায় চিহ্নিত। সমুদ্রবাণিজ্যের ইতিহাসে আরব বণিকদের ভূমিকা সুবিদিত। এর সঙ্গে যুক্ত হবে ইহুদি বণিকদের কথা। দ্বাদশ শতকের ব্যবসায়িক চিঠিপত্রে ইহুদি বণিক ও ইহুদি জাহাজি বণিকদের সক্রিয় ভূমিকা চোখে পড়ে লোহিত সাগর অঞ্চলে, বিখ্যাত বন্দর এডেনে এবং ভারতের পশ্চিম উপকূলে। বিশেষত মালাবারে ও কানাড়া উপকূল অঞ্চলে। এমনই এক ইহুদি বণিক এব্রাহাম ইশু অলমঞ্জরুর বা বর্তমান ম্যাঙ্গালোরে এসেছিলেন সুদূর টিউনিসিয়া থেকে; ম্যাঙ্গালোরে ছিলেন দীর্ঘ সতেরো বছর (১১৩২-৪৯ খ্রি.)। অন্যান্য ইহুদি বণিক, জাহাজি বণিক বা নাখুদা (আরব মুসলমান ও ইহুদি ব্যবসায়ী) এবং ভারতীয় বণিকদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগসূত্রের উজ্জ্বল সাক্ষ্য দেবে এই পত্রগুচ্ছ। অন্তত দুইজন ভারতীয় জাহাজি বণিকের উল্লেখ আছে এই চিঠিপত্রে। তাঁদের একজনের দুটি জাহাজ যাতায়াত করত মালাবার থেকে এডেন পর্যন্ত। অপর জন ম্যাঙ্গালোর থেকে কোঙ্কনের থানা (মুম্বই-এর নিকটবর্তী) বন্দর পর্যন্ত জাহাজ চলাচলের ব্যবসায়ে যুক্ত ছিলেন। ব্যবসায়িক বিশদ তথ্য—বিশেষত কিছু পরিসংখ্যান নির্ভর তথ্য, যা প্রাচীন ভারতীয় অর্থনৈতিক ইতিহাসে প্রায় বিরল—এই চিঠিপত্রে রয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা এই পত্রগুচ্ছ বিভিন্ন ধর্ম, জাতি ও দেশের বণিকদের মধ্যে সহাবস্থান ও সহমর্মিতার এক অসামান্য দলিল। বিভিন্ন বণিকের মধ্যে রেষারেষি নিশ্চয়ই ছিল, প্রতিযোগিতাও ছিল। পত্রগুচ্ছে মামলা মোকদ্দমার প্রসঙ্গও আছে (ঘোষ, ১৯৯০)। কিন্তু ধর্মীয় বিভিন্নতা সত্ত্বেও ভারতীয় হিন্দু বণিক, আরব মুসলমান ব্যবসায়ী ও ইহুদি সওদাগরের মধ্যে অসদ্ভাবের চিহ্নমাত্র নেই। এব্রাহাম ইশু-র এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ম্যাঙ্গালোর থেকে থানা পর্যন্ত সমুদ্রযাত্রাকালে বোম্বেটের উপদ্রবে পড়েন। এই দুঃসংবাদ পেয়ে এব্রাহাম ইশু বিপন্ন আত্মীয়টির জন্য ভারতীয় জাহাজি বণিক তিনবু/তিম্পু-র হাত দিয়ে ২১ মিথকাল নগদ অর্থ (মিশরীয় স্বর্ণমুদ্রা) পাঠান। আত্মীয়টিকে আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে যে আরও অর্থ লাগলে তিনি নির্দ্বিধায় ভারতীয় জাহাজি বণিকের কাছে তা চাইতেই পারেন। কারণ ইহুদি ও ভারতীয় বণিকদ্বয় ছিলেন প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।
আদিমধ্যকালে ভারত মহাসাগরের দূরপাল্লার বাণিজ্যে ভারতের উজ্জ্বল ভূমিকা সংশয়াতীত। কিন্তু তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই যে, দূরপাল্লার বাণিজ্য ভারতীয় ও বিদেশি বণিক সম্প্রদায়কে পরস্পরের কাছাকাছি এনে দেয়। এর সেরা নজিরটি ত্রয়োদশ শতকের বিখ্যাত শৈবতীর্থক্ষেত্র ও বন্দর কাথিয়াওয়াড়ের সোমনাথে দেখা যায়। ১২৬৪ ও ১২৮৭ খ্রি. দুইটি লেখতে সোমনাথ ‘পট্টন’ বলে আখ্যাত। এই অন্ত্যনামই সোমনাথকে বন্দর বলে চিহ্নিত করে দেয়। অবশ্য একাদশ শতকের প্রথমভাগেই অল বিরুনি সোমনাথ বন্দরের গুরুত্ব সম্বন্ধে সম্যক অবহিত ছিলেন। ১০২৫-২৬ খ্রি. গজনীর অভিযানে সোমনাথ উপদ্রুত ও লুণ্ঠীত হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু বন্দর হিসেবে সোমনাথ যে সক্রিয় ছিল তার তর্কাতীত প্রমাণ রয়েছে ১২৬৪ খ্রি.-এর লেখতে। ১২৬৪ ও ১২৮৭-র লেখ দুটিতে এটাও স্পষ্ট যে সোমনাথ শৈব পাশুপত ধর্মের অত্যন্ত প্রাণবন্ত তীর্থক্ষেত্র হিসেবে অব্যাহত ছিল। ১২৬৪ সালে সোমনাথে এসেছিলেন পারস্য উপসাগরের প্রসিদ্ধ বন্দর হোরমুজের জাহাজি বণিক (নাখুদা/নৌবিত্তক) নুরুদ্দীন ফিরুজ। সম্ভবত কোনও ব্যবসার কাজে (‘কার্যবশাৎ’)। তিনি সোমনাথে একটি মসজিদ বা ‘মিজিগিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই মসজিদের কথাই ১২৬৪-র লেখতে বিশদভাবে বর্ণিত। লেখটি দ্বিভাষী: সংস্কৃত ও আরবিতে রচিত। সংস্কৃত লেখটি বিশদ, তুলনায় আরবি লেখটির বক্তব্য কার্যত সংস্কৃত লেখটির সংক্ষিপ্তসার। এই মসজিদ নির্মাণের জন্য নাখুদা ফিরুজ আনুকূল্য পেয়েছিলেন স্থানীয় হিন্দু বণিকগোষ্ঠীর কাছ থেকে। সোমনাথের পৌর-প্রতিষ্ঠানের প্রত্যক্ষ সমর্থন এতে ছিল, যে প্রতিষ্ঠানের প্রধান শৈব পাশুপতাচার্য ত্রিপুরান্তক। মসজিদ নির্মাণের চূড়ান্ত অনুমোদন এসেছিল গুজরাটের শাসক চৌলুক্যবংশীয় বাঘেলরাজ অর্জুনদেবের কাছ থেকে। বন্দরনগরটিতে হিন্দু মন্দিরের ও মসজিদের অবস্থান লক্ষণীয়। এখানে সহাবস্থান করতেন শৈব পাশুপতাচার্যসহ বহু ব্রাহ্মণ, বিভিন্ন বণিক, মুআল্লিম এবং খাতিব সহ মসজিদের বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ। এই পরিপ্রেক্ষিতে নুরুদ্দীনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে লেখটিতে প্রতিভাত হন হিন্দু বণিক ছাড়। এতই ঘনিষ্ঠ মিত্ৰতা এই ভিন্নধর্মাবলম্বী দুই বণিকের যে ১২৬৪-র লেখতে তাঁরা ‘ধর্মবান্ধব’ (অর্থাৎ ন্যায়নিষ্ঠ মিত্র) বলে অভিহিত। সবচেয়ে চমকপ্রদ বক্তব্যটি সংস্কৃত লেখটির একেবারে প্রারম্ভে বলা হয়েছে। লেখটির মূল উদ্দেশ্য যেহেতু মসজিদ প্রতিষ্ঠার ঘটনাকে লিপিবদ্ধ করা, তাই লেখটির সূচনা হয়েছে আল্লার উদ্দেশে স্তুতি জানিয়ে। চারটি অসামান্য অভিধায় আল্লার বর্ণনা করা হয়েছে সংস্কৃততে: তিনি ‘বিশ্বরূপ’, ‘বিশ্বনাথ’, ‘শূন্যরূপ’ (= নিরাকার) এবং লক্ষ্যালক্ষ্য (যিনি দৃশ্যমান আবার নিরাকার বলে অলক্ষ্যেও থাকেন)। সোমনাথ বন্দরের ইতিবৃত্তে এইভাবে বণিকরা, সাংস্কৃতিক জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং প্রশাসক গোষ্ঠী এমন এক সামাজিক পরিমণ্ডল রচনা করেছিলেন, যেখানে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং আর্থ-সামাজিক ভিন্নতার মধ্যেই সহাবস্থান সম্ভব হয়েছিল। (চক্রবর্তী ২০০০)