নবম অধ্যায় – উমাইয়া খিলাফতের শাসনব্যবস্থা, সমাজ ও সভ্যতা
সূচনা
খোলাফায়ে রাশেদূনের সময়ে ইসলামী গণতন্ত্র কায়েম ছিল এবং শরীয়ত অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় শাসন-ব্যবস্থা পরিচালিত হত। কিন্তু মুয়াবিয়া গণতন্ত্রের পরিবর্তে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং মনোনয়ন দ্বারা উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করবার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রনায়ক নির্বাচন অথবা মজলিস-উস-শূরা দ্বারা রাষ্ট্রীয় পরিচালনায় পরামর্শ দান বিলুপ্ত হয়ে যায়। ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজতন্ত্র ও একনায়কত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে বায়তুল মালও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হয়। উপরন্তু, খোলাফায়ে রাশেদূনের সময়ে জাঁকজমক, আড়ম্বর ও বিলাসিতা লক্ষ্য করা যায় নি। কিন্তু উমাইয়া খিলাফতে শাসনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়।
কেন্দ্ৰীয় শাসন
উমাইয়া খিলাফতে কেন্দ্রীয় শাসন-ব্যবস্থার কাঠামো ছিল খুবই দৃঢ় এবং এটি পাঁচটি প্রশাসনিক বিভাগে বিভক্ত ছিল :
(ক) দিওয়ান-আল-জুনদ (সামরিক বিভাগ)।
(খ) দিওয়ান-আল রাসাইল (চিঠিপত্র আদান-প্রদান বিভাগ)।
(গ) দিওয়ান-আল-খারাজ (রাজস্ব বিভাগ
(ঘ) দিওয়ান-আল-বারিদ (ডাক বিভাগ)।
(ঙ) দিওয়ান-আল-খাতাম (ব্যবস্থাপনা বিভাগ)।
দিওয়ান-আল-জুনদ : উমাইয়া খিলাফতে সামরিক প্রশাসনের দায়িত্বে নিয়োজিত দিওয়ান-আল-জুনদের পুনর্বিন্যাস হয়। প্রথম ওমরের খিলাফতে সামরিক বৃত্তি গ্রহণকারী সকল আরব এবং অনারব সৈন্যগণ বায়তুল মাল হতে নিয়মিত ভাতা পেত। যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ না করলেও এই ভাতা দেওয়া হত। কিন্তু উমাইয়া খলিফা হিশাম সর্বপ্রথম এই নীতির পরিবর্তন সাধন করে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সামরিক ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং এই ভাতা বেতন হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। এই নীতির ফলে অপচয় বন্ধ হয় এবং এটি এমন কঠোরভাবে পালিত হত যে, উমাইয়া যুবরাজগণও যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলে এবং এমনকি কোন প্রতিনিধি প্রেরণ করলেও তাদের ভাতা দেওয়া হত না। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইয়াকুত নাম্মী একজন মাওয়ালীকেও ভাতা প্রদান করা হয়।
দিওয়ান-আল-রাসাইল : রাসূলুল্লাহ (স) এবং খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে রাষ্ট্রীয় পত্রাদি, আদেশাবলী লিখন, বিভিন্ন প্রস্তাব এবং দলিল-পত্রাদি সংরক্ষণ কাজের জন্য সাহাবী ও ব্যক্তিগত কর্মচারী নিয়োজিত ছিল। কিন্তু উমাইয়া যুগে এই কার্যক্রমের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য দিওয়ান-আল-রাসাইল নামে একটি পৃথক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই বিভাগের সঙ্গে অন্যান্য বিভাগের যোগসূত্র ছিল এবং প্রত্যেক ঘোষণাপত্র প্রচার ও প্রদেশে বিতরণের ব্যবস্থা করা এই বিভাগের দায়িত্ব ছিল।
দিওয়ান-আল-খারাজ : কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যতম প্রধান বিভাগ ছিল রাজস্ব বিভাগ (রাহিব আল-খারাজ অথবা দিওয়ান-আল-খারাজ)। রাজস্ব সচিবের তত্ত্বাবধানে রাজস্ব সংক্রান্ত যাবতীয় কার্য পরিচালিত হত। রাষ্ট্রীয় আয়-ব্যয়ের হিসাব রক্ষা করা ছাড়াও প্রদেশ থেকে যাবতীয় আয়-ব্যয়ের হিসাব এবং উন্নয়নমূলক কাজে অর্থ ব্যয়ের পর উদ্ভূত অর্থ কেন্দ্রীয় কোষাগারে জমা দেয়ার ব্যবস্থা করা প্রভৃতি এই বিভাগের প্রধান দায়িত্ব ছিল।
দিওয়ান-আল-বারিদ : মুয়াবিয়া সর্বপ্রথম দিওয়ান-আল-বারিদ অর্থাৎ ডাক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে সৃষ্টি করা হলেও পরবর্তী পর্যায়ে জনসাধারণের সুবিধার্থে এই বিভাগ আত্মনিয়োগ করে। ঘোড়া অথবা উটের সাহায্যে দূর-দূরাঞ্চলে ডাক প্রেরণ করা হত এবং ১১ মাইল অন্তর বদলী ঘোড়ার ব্যবস্থা ছিল। এই সমস্ত উপায়ে কেবল ডাকই নয় বরং কোন জরুরী সংবাদ, বিদ্রোহ প্রভৃতি সংবাদ কেন্দ্রে প্রেরিত হত। খলিফা আবদুল মালিক ডাক বিভাগের প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। এই বিভাগের প্রধান কর্মকর্তঅকে বলা হত ‘সাহিব-উল-বারিদ’।
দিওয়ান-আল-খাতাম : জাল দলিল-দস্তাবেজ হতে সরকারি নথিপত্র রক্ষা করবার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার দিওয়ান-আল-খাতাম অথবা ব্যবস্থাপনা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে। মুয়াবিয়া সর্বপ্রথম এটি প্রবর্তন করেন। প্রত্যেকটি আদেশনামা তালিকাভুক্ত করবার পর যাতে নকল হতে না পারে, সেজন্য সরকারি সীলমোহর দ্বারা তা সনাক্ত করা হত।
উমাইয়া খিলাফতে আবদুল মালিক সর্বপ্রথম আরবি ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তার পূর্বে বিভিন্ন অঞ্চলে সরকারি চিঠিপত্র ও দলিল-দস্তাবেজ বিভিন্ন ভাষায় প্রচলিত ছিল। তিনি আরবি ভাষার গৌরবময় ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্ণ রাখার এবং আরবিকরণ নীতি দ্বারা স্বতন্ত্র প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার জন্য গ্রীক, পাহলবী, সিরীয় ও কপটিক ভাষার পরিবর্তে আরবি ভাষা সরকারি ভাষারূপে ব্যবহারের নির্দেশ দেন। দলির-দস্তাবেজ আদালতের নথিপত্র আরবি ভাষায় লিখা হতে থাকে। আবদুল মালিকের অপর একটি অবদান হচ্ছে রোমীয় পারসিক মুদ্রার পরিবর্তে আরবি ভাষায় লিখিত মুদ্রার প্রচলন। মুয়াবিয়া প্রথম রৌপ্য এবং স্বর্ণের মুদ্রা প্রবর্তন করেন। দিনার (স্বর্ণ) এবং দিরহাম (রৌপ্য) মুদ্রার প্রচলন করে আবদুল মালিক দামেস্কে একটি কেন্দ্রীয় টাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন। মুদ্রার উপর কলেমা ও টাকশালের নাম লেখা হত। দিনার, দিরহাম ছাড়াও ফালুস নামক মুদ্রাও প্রচলিত ছিল।
প্রাদেশের শাসন-ব্যবস্থা
উমাইয়া খিলাফতে সমগ্র সাম্রাজ্য পাঁচটি বিভাগে বিভক্ত ছিল; যথা- (১) আরব দেশের প্রদেশসমূহ-হেজাজ, ইয়েমেন, ওমান ও হাজর; এর রাজধানী ছিল মক্কা; (২) ইরাকের প্রদেশেসমূহ-কুফা, বসরা, ওয়াসিত, মাদাইন, হুলওয়ান এবং সামাররা, সিজিস্তান, খোরাসান, ট্রান্সঅক্সিয়ানা, সিন্ধু, পাঞ্জাবের কিয়দংশ; এর রাজধানী ছিল কুফা; (৩) নিম্ন ও উচ্চ মিসর নিয়ে গঠিত বিভাগ; এর রাজধানী ছিল ফুসতাত; (৪) জর্জিয়া, আর্মেনীয়া, আজারবাইজান এবং এশিয়া মাইনর নিয়ে গঠিত বিভাগ; এর রাজধানী ছিল মসুল; (৫) উত্তর আফ্রিকা, স্পেন, দক্ষিণ ফ্রান্স, সিসিলি, সার্ডিনিয়া ও ভূমধ্যসাগরের দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে গঠিত বিভাগ; এর রাজধানী ছিল কায়রোয়ান।
উমাইয়া খিলাফতে শাসন-ব্যবস্থা সূচারুরূপে পরিচালনার জন্য প্রত্যেক বিভাগকে কয়েকটি প্রদেশে এবং প্রদেশগুলোকে কতিপয় জেলায় বিভক্ত করা হয়। সর্বমোট ১৪টি প্রদেশ ছিল; এগুলো হচ্ছে – (১) আরব; (২) ইরাক; (৩) জর্জিয়া, (৪) সিরিয়া, (৫) প্রাচ্য-প্রদেশ; (৬) মিসর; (৭) আল-মাগরিব; (৮) আদ-দাইলাম; (৯) আর-রিহাব; (১০) আল-জিবাল; (১১) খুজিস্তান; (১২) ফারস; (১৩) কিরমান; (১৪) সিন্ধু-প্রদেশ।
প্রত্যেক বিভাগে খলিফা যোগ্য, সৎ ও কর্তব্যনিষ্ঠ একজন শাসনকর্তা অথবা রাজপ্রতিনিধি (ভাইসরয়) নিযুক্ত করতেন। তারা বিভাগের প্রশাসনিক ও সামরিক শাসনকার্যের জন্য খলিফার নিকট দায়ী থাকতেন। বিভাগীয় শাসনকর্তাগণ খলিফার অনুমোদনক্রমে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত করতেন। প্রত্যেক প্রদেশকে কয়েকটি জেলায় বিভক্ত করে একজন আমিরকে তবে প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত করা হত। কেন্দ্রীয় প্রশাসনের অনুরূপ প্রদেশেও দিওয়ান-আল-জুনদ, দিওয়ান-আল-রাসাইল, দিওয়ান-আল-খাতাম, দিওয়ান-আল-বারিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। দিওয়ান-আল-খারাজ, দিওয়ান-আল-মুমতাবিল্লাত নামেও পরিচিত ছিল। প্রাদেশিক কর্মচারীদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ‘আমির’ অথবা ‘ওয়ালী’, ‘সাহিব-আল-খারাজ’, ‘কাতিব’, ‘সাহিব-আল-আহদাত’ ও কাযী। প্রদেশে ‘আমির’ ছিলেন খলিফার প্রতিনিধি। ইমামতী, যুদ্ধাভিযান, রাজস্ব আদায়, দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলা পরিচালনা তাঁর কর্তব্যের অন্তর্গত ছিল।
রাজস্ব-ব্যবস্থা : উমাইয়া শাসনকালে রাজস্বের উৎসগুলো ছিল- (১) যাকাত; (২) খারাজ; (৩) জিজিয়া; (৪) উশর (মুসলমানদের দেয় ভূমিকর); (৫) আল-ফে; (৬) করদ রাজ্য হতে প্রাপ্য কর; (৭) উৎসব উপলক্ষে কর; (৮) উশূর (বাণিজ্য শুল্ক); (৯) খুমস প্রভৃতি।
খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে প্রতিষ্ঠিত কর ব্যবস্থা প্রচলিত থাকলেও উমাইয়া শাসনামলে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, এই সময়ে উৎসব কর, দ্রব্যাদির উপর ধার্য কর, বার্বার শিশুদের উপর ধার্য কর প্রবর্তিত হয়। প্রথম চারি খলিফার আমলে ‘উশর’ সামরিক কার্যে ব্যয় করা হলেও দ্বিতীয় ওমর কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী এই করের কিছু অংশ মদিনায় হাশিমীয়দের নিকট পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকারী খলিফাগণ এটি সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে পূর্ববর্তী ব্যবস্থা চালু করেন। খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে আরবগণ আরবদেশের বাইরে জমিজমা ভোগ-দখল করতে পারত না। কিন্তু উমাইয়া খিলাফতে এই নীতির ব্যতিক্রম দেখা যায়। এর ফলে আরবগণ আরবভূমিতে ভূসম্পত্তির উপর অর্পিত ‘উশর’ দেওয়ার যে প্রথা চালু ছিল, সে অনুযায়ী আরবভূমির বাইরেও উক্ত কর দিতে থাকলে রাজস্বে ঘাটতি দেখা দেয়। এ কারণে মুসলমান ভূ-স্বামীদের উপর খারাজ নির্ধারিত হয়। এটি ‘ইজারা’ নামে পরিচিত ছিল। খলিফা আবদুল মালিকের রাজত্বে ইরাকের শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন-ইউসুফ নব্য-মুসলমানদের জিজিয়া ও খারাজ দিতে বাধ্য করেন। রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য নব-দীক্ষিত মুসলমানদের ‘জিজিয়া’ দিতে বাধ্য করা হয়; অবশ্য দ্বিতীয় ওমর ইহা শরীয়তবিরোধী বিধায় প্রত্যাহার করেন। পরবর্তী উমাইয়া খলিফাগণ অবশ্য পূর্ববর্তী প্রথা পুনঃপ্রবর্তন করেন। খোরাসানের শাসনকর্তা নাসর-ইবন-সাইয়ার রাজস্ব- ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে ভূ-স্বামীদের খারাজ দিতে হত এবং নব-দীক্ষিত মুসলমানগণ জিজিয়া হতে মুক্তি লাভ করে। এই ব্যবস্থা অন্যান্য রাষ্ট্রেও অনুসৃত হয়। রাজস্ব বিভাগের অধিকর্তা ছিলেন সাহিব-আল-খারাজ। খলিফা স্বয়ং তাঁকে নিযুক্ত করেন এবং রাজস্ব বিভাগের যাবতীয় কার্যাবলি তাঁর উপর ন্যস্ত ছিল। রাজস্ব আদায় ও হিসাব রক্ষা প্রভৃতি কাজ ‘আমিল’ নামে একজন প্রাদেশিক কর্মচারীর উপর ন্যস্ত ছিল।
মুদ্রা-ব্যবস্থা
আরবি মুদ্রা-ব্যবস্থার প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক শাসন-ব্যবস্থার আরবিকরণের সাথে সাথে তিনি মুদ্রা-ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। প্রাক-ইসলামী যুগে আরব দেশে সাসানীয়, রোমীয়, হিময়ারী মুদ্রার প্রচলন ছিল। নবী করীমের আমলে রোমীয় ও সাসানীয় মুদ্রার প্রচলন ছিল, যা খলিফা আবুবকরের সময়ে অব্যাহত থাকে। কিন্তু ইসলামের সম্প্রসারণের ফলে প্রথম ওমরের খিলাফতে বিভিন্ন ধরনের মুদ্রার আমদানি হয়, যাতে ওজনের দিক থেকে তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। এই হের-ফের বাতিল করে তিনি ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে ওজনের নির্ধারিত (Standard) পরিমাপ স্থির করে ১৪ কারাতাব জত(৭,১০) মিসকালের দিরহাম প্রবর্তন করেন। এই সমস্ত মুদ্রায় ‘আল-হামদুল্লিাহ’ অথবা ‘মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ’ নাম মুদ্রিত হত। দিনারের সঙ্গে দিরহামের অনুপাত ছিল ১ : ১০। মুদ্রা প্রচলন সার্বভৌমত্বের লক্ষণ এবং এ কারণে প্রথম মুয়াবিয়ার রাজত্বে বিদ্রোহী প্রতিদ্বন্দ্বী খলিফা আবদুল্লাহ ইবন-যুবাইর গোলাকার দিরহাম মুদ্রিত করেন। লেনপুল বলেন যে, এই মুদ্রার এক দিকে ‘মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ’ এবং অপর দিকে আল্লাহ্ ইয়া মুরুবিল আদল-ওয়া-আল-ইহসান’ অঙ্কিত থাকত।
গিলমান বলেন, “আবদুল মালিকের রাজস্ব খুবই উল্লেখযোগ্য এ কারণে যে, এই সময়ে সারাসিনগণ সর্বপ্রথম নিজেদের জন্য মুদ্রা তৈরি করে।” তার পূর্বে আরবদের নিজস্ব মুদ্রা ও টাকশাল ছিল না। রাসূলে করীম এবং আবুবকরের আমলে রোমান ও পারসিক মুদ্রা প্রচলিত ছিল। এমনকি পেঁচক খোদিত হিমাইয়ারী রৌপ্য মুদ্রারও প্রচলন ছিল। হযরত ওমরের খিলাফতে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বিস্তার লাভ করলে বিজিত অঞ্চলে অমুসলমানদের মুদ্রা যেমন রোমীয় স্বর্নমুদ্রা (Denarius) এবং সাসানীয় রৌপ্য মুদ্রার (Drachma) প্রচলন ছিল। প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ নিজস্ব স্বাধীন টাকশালে প্রাচীন মুদ্রার অনুকরণে অথবা প্রাচীন মুদ্রায় কুরআন শরীফের উদ্ধৃতি খোদাই করে মুদ্রা তৈরি করতেন। মুদ্রার ছাপ, ওজন, আকৃতি এবং মূল্য (Intrinsic value) সমগ্র রাষ্ট্রব্যাপী ছিল অনির্ধারিত। খলিফা আবদুল মালেক সর্বপ্রথম জাতীয় টাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন। ৬৯৬-৯৭ খ্রিস্টাব্দে দামেস্কে এই টাকশাল স্থাপিত হয় এবং মুদ্রিত মুদ্রাসমূহ সমগ্র রাষ্ট্রে প্রচলিত হতে থাকে, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ও মুদ্রামানে। আরবি অক্ষরযুক্ত নির্দিষ্ট ও সর্বজনস্বীকৃত একক মুদ্রা-মানের দিনার বা স্বর্ণমুদ্রা, দিরহাম বা রৌপ্যমুদ্রা ও ফালুস বা তাম্রমুদ্রা সমগ্র রাজ্যে প্রচলিত হয়। মুদ্রাঙ্কন ত্রুটিমুক্ত হলে অবাধে জাল মুদ্রা তৈরি অসম্ভব হয়ে পড়ে।
সামরিক প্রশাসন
স্থল বাহিনী : উমাইয়া খিলাফতে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ; কারণ গৃহযুদ্ধ, যুদ্ধাভিযান প্রভৃতি ক্ষেত্রে একটি সুশৃঙ্খলিত ও সুদক্ষ সেনাবাহিনীর বিশেষ প্রয়োজন ছিল। সামরিক কৌশল অবলম্বনে উমাইয়াগণ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তাদের সুরক্ষিত সৈন্যবাহিনী কেবল সামরিক শিক্ষাই অর্জন করত না, রোমীয়দের রণ কৌশল অনুকরণে তাঁবু খাটিয়ে তারা প্রাচীর ও পরিখা দ্বারা সুরক্ষিত করত। খোলাফায়ে রাশেদূনের যুগে সামরিক বাহিনীর যে গোত্রভিত্তিক গঠন ছিল উমাইয়া যুগে তার পরিবর্তন হয় নাই; যেমন- ‘আল-খামিস’ বা সেনাবাহিনীর পাঁচটি ভাগ। অবশ্য শেষ খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ান ‘আল-খামিসের’ পরিবর্তে ‘কুরদুস’ পদ্ধতির প্রচলন করেন। একশত সৈন্যের দল নিয়ে ইউনিট তৈরি হত, এ রকম দশটি ইউনিটক নিয়ে ‘কুরদুস’ গঠিত হত। খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে হযরত ওমর স্বেচ্ছাসেবকের পরিবর্তে নিয়মিত বেতনভুক সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। উমাইয়া আমলে এই নীতিই অনুসৃত হয়। গোত্রভিত্তিক সেনাবাহিনী গঠনের দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, ৭১৪ খ্রিস্টাব্দে খোরাসানে ৪০,০০০ সদস্যের যে বাহিনী প্রেরিত হয় তাতে পাঁচটি গোত্রের লোক ছিল; যেমন- আলীয়া, বকর, তামীম, আবদ কায়েস ও আযদ। এক একটি বাহিনীকে ‘খুমস’ এবং একত্রে বলা হত ‘আখমাস’। গোত্র হতে সৈন্য গ্রহণের জন্য গোত্র প্রধানকে অর্থ দিতে হত। নিয়মিত সৈন্য ছাড়াও অনিয়মিত সৈন্য সামরিক বাহিনীতে যোগ দিত। নিয়মিত বাহিনী খলিফার নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল এবং নিয়মিত ভাতা (‘আতা’) লাভ করত। এ বাহিনীর নাম ছিল ‘মুরতাযাক’। অনিয়মিত বাহিনী বা স্বেচ্ছাসেবক গোষ্ঠী ‘মুতাতাভিয়া’ নামে পরিচিত ছিল। রাজ্য বিস্তার ছাড়া বিদ্রোহ দমনেও সেনাবাহিনী নিয়োজিত করা হত। কুফা এবং বসরায় হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফের সময়ে বাধ্যতামূলকভাবে মুসলমানদের সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে হত। সামরিক বাহিনীর সাম্রাজ্যব্যাপী বিভিন্ন সুরক্ষিত ঘাঁটি ছিল; যেমন-কুফা, বসরা, ফুসতাত প্রভৃতি।
বলাই বাহুল্য যে, খোলাফায়ে রাশেদূনের তুলনায় উমাইয়া যুগে সৈন্যসংখ্যা অস্বাভাবিক রকম বৃদ্ধি পায়। এর মূল কারণ হল, এ যুগে বিশেষ করে প্রথম ওয়ালিদের আমলে ইসলামের সর্বাধিক সম্প্রসারণ ঘটে। এ ছাড়া গৃহযুদ্ধে, বিদ্রোহ দমন, শান্তি- শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে ব্যবহারের জন্য স্বভাবত বৃহৎ সেনাবাহিনীর প্রয়োজন ছিল। উমাইয়া যুগে কেন্দ্ৰীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন সৈন্যসংখ্যা কত ছিল তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা দুষ্কর, তবুও ঐতিহাসিক তথ্য হতে জানা যায় যে, ইরাকের মুয়াবিয়ার নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ৬০,০০০। এই বিপুল সংখ্যক সৈন্যের জন্য রাজকোষ হতে বাৎসরিক ব্যয় হত ৬০,০০,০০০ দিরহাম। হযরত আলীর সঙ্গে মুয়াবিয়া যখন সংঘর্ষে লিপ্ত হন তখন তিনি ৮৫,০০০ সৈন্য নিয়ে সিরিয়ার প্রান্তরে যান। এর মধ্যে নিয়মিত সৈন্য ছাড়া স্বেচ্ছাসেবক মাওয়ালীরাও ছিল। মিসরে মুয়াবিয়ার সৈন্যসংখ্যা ছিল ৪০,০০০। উমাইয়া খিলাফতের শেষের দিকে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। শেষ খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ানের সময় এই সৈন্যসংখ্যা ১,২০,০০০-এ দাঁড়ায়। তবুও তারা জাবের যুদ্ধে আব্বাসীয়দের নিকট পরাজিত হন। উমাইয়া খিলাফতে সৈন্যদের বেতন কাঠামোর তারতম্য দেখা যায়। মুয়াবিয়ার সময়ে প্রত্যেক সৈন্য বছরে ১,০০০ দিরহাম পেত; নিয়মিত বেতন ছাড়াও সৈন্যদের উৎসাহিত করবার জন্য বিশেষ ভাতা দেওয়া হত; যেমন- ইয়াজিদ মদিনার বিরুদ্ধে সিরীয় সৈন্যদের মাথাপিছু একশত দিনার অতিরিক্ত দেন। দ্বিতীয় ওয়ালিদ সিংহাসনে আরোহণ করে সৈন্যদের বেতন বৃদ্ধি করেন। কিন্তু তৃতীয় ইয়াজিদের আমলে প্রতি সৈন্যের বেতন ১০ দিরহাম হ্রাস করেন। প্রত্যেক সেন্যকে ব্যক্তিগত বেতন প্রদান ছাড়াও দল বা ‘ইরফা’ ভিত্তিতে বেতন-ভাতা দেওয়া হত। কখনও কখনও প্রতিটি ‘ইরফা’কে ১,০০,০০০ দিরহাম প্রদান করা হত। সৈন্যদলে মহিলাগণও অংশগ্রহণ করতেন।
বলা নিষ্প্রয়োজন যে, খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলের তুলনায় উমাইয়া খিলাফতে সৈন্যবাহিনী বিপুল আকার ধারণ করে। ফলে সুগঠিত, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও চৌকষ সেনাবাহিনীর স্তরবিন্যাস বিশেষ প্রয়োজন ছিল। খলিফা ছিলেন সৈন্যবাহিনীর প্রধান; কিন্তু সৈন্যবাহিনীর কার্যকলাপ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয় একজন প্রধান সেনাপতির উপর। সৈন্যবাহিনীর স্তরবিন্যাসে ‘তাবীয়া’ পদ্ধতি অনুসরণ করা হত। এই পদ্ধতিতে সেনাবাহিনীকে পাঁচটি স্তরে বিভক্ত করা হত; যেমন- কেন্দ্র (‘কালব’), দক্ষিণ পার্শ্ব (মায়মানাহ), বাম পার্শ্ব (‘মাসারাহ’), সম্মুখ বা অগ্রভাগ (মুকাদ্দামা) এবং পশ্চাদ্ভাগ (‘সাকা’)। প্রতি দশজনের ইউনিটের অধিকর্তা ছিলেন ‘আরিফ’, প্রতি পঞ্চাশ জনের জন্য একজন ‘খলিফা’, প্রতি একশত জনের জন্য একজন ‘নকীব’ এবং প্রতি এক হাজারের জন্য একজন অধিনায়ক বা ‘কায়েদ’। সামরিক বাহিনীতে বেসামরিক কর্মচারীও যোগদান করতেন; যেমন- কোষাধ্যক্ষ, বেতন প্রদানকারী, কৌশুলী, দো- ভাষী, কাযী, সংবাদবাহক ও প্রকৌশলী।
সৈন্যবাহিনী সাধারণত অশ্বারোহী, পদাতিক, তীরন্দাজ, নৌ-বাহিনী, সহায়ক বাহিনী এবং নাককারুন’-এ বিভক্ত ছিল। পদমর্যাদার দিক হতে সর্বাধিক ক্ষমতা ছিল খলিফার, তারপর আমীরের, তারপর তাবীয়ার, অধিনায়কের, তারপর ‘আরীফ’, তারপর পতাকাবাহী অফিসারদের। অগ্রভাগের সৈন্যরা শত্রুর ব্যুহ ভেদ করার চেষ্টা করত এবং সকল বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে অগ্রসর হত। পারস্য বিজয়ের সময় মুসলিম সৈন্যের অগ্রবর্তী দল তাইগ্রীস নদী সাঁতরাইয়া প্রথমে শত্রু শিবিরে ত্রাসের সৃষ্টি করে। তাদের মুসলিম শিবিরের রক্ষণাবেক্ষণেও নিযুক্ত করা হত। ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন অশ্বারোহী গেরিলা বাহিনী গঠন করা হয় যাতে আকস্মিকভাবে শত্রু বা বিদ্রোহীদের ব্যুহ ভেদ করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা যায়। সৈন্য সমাবেশের একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি বা ‘সফবন্দী’ ছিল; প্রথমে পদাতিক, তার পশ্চাতে অশ্বারোহী এবং তৃতীয় সারিতে তীরন্দাজ। যুদ্ধে রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের জন্য অশ্ব ছাড়াও গাধা, খচ্চর ও উট ব্যবহৃত হত। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, মরু অঞ্চলে রসদ সরবরাহের জন্য উটের ব্যবহার বিশেষ উপকারী হয়। এ ছাড়া জাহাজেও যুদ্ধাস্ত্র ও রসদ সরবরাহ করা হত। উমাইয়া যুগে যে সমস্ত অস্ত্র ব্যবহৃত হত তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আটফুট লম্বা বর্শা, তীর, ধনুক, দুইধার বিশিষ্ট তরবারি, কুঠার, ঢাল। সৈন্যগণ বর্ম ও শিরস্ত্রাণ পরিধান করত। খাণ্ডা-খঞ্জর (‘দাব্বুস’) এবং দুর্গ বিধ্বংসী ফিঙ্গা (Manjanik) ব্যবহৃত হত। সৈন্যদের উৎসাহিত করবার জন্য ড্রাম বাজান হত। প্রত্যেক গোত্রের লোকেরা নিজস্ব পতাকা বহন করত। অবশ্য জাতীয় পতাকা সব পতাকার ঊর্ধ্বে শোভা পেত। যুদ্ধ আরম্ভের সূচনা করা হত পতাকা নাড়িয়ে, ঢাক-বাজিয়ে বা সংকেত দিয়ে। নাফথা বা অগ্নি প্রজ্বলিত তীর দ্বারা শত্রুর দুর্গে ত্রাসের সৃষ্টি করা হত। এজন্য একটি বিশেষ বাহিনী গঠিত হয়, যা ‘নাফফাতুন’ নামে পরিচিত ছিল। ‘তুরুতন’ বা তীক্ষ্ণ তীর-ধনুক ‘নাফফাতুন’ বাহিনীর সহায়তা করত। ফিঙ্গা বা মানজানিকের সাহায্যে বড় বড় পাথর ক্ষেপণ করে শত্রুর দুর্গে ফাটল সৃষ্টি করে দুর্গ অধিকার করার রীতি ছিল। এ ছাড়া দুর্গ প্রাচীরে আঘাত করার জন্য দীর্ঘ লোহার যন্ত্র বা ‘হাবস’ ব্যবহৃত হত। সিন্ধু বিজয়ে ‘নাফফাতুন’ মানজানিক ও ‘হাবস’ (Battering ran) বিশেষ উপকারী ছিল। মুসলিম যুদ্ধনীতি অনুযায়ী কেবল শত্রুদের নিধন করার বিধান ছিল। কোন শিশু, মহিলা, দরবেশ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বা দাসকে হত্যা করা যেত না। শস্যক্ষেত্র নষ্ট করা থেকে সৈন্যদের বিরত থাকতে বলা হত।
এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিস্তৃর্ণ অঞ্চল জুড়ে উমাইয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিশাল অঞ্চলের শান্তি-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত এবং প্রয়োজনে যুদ্ধাভিযানের জন্য প্রয়োজন হয় সামিরক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশাল সৈন্যবাহিনীর। ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে সেনানিবাস প্রতিষ্ঠিত হয় যা ‘জুনদ’ নামে পরিচিত। উমাইয়া আমলে ‘জুনদ’ বা সেনানিবাসের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল কুফা, বসরা, ফুসতাত, কায়রোয়ান, মার্ভ, মানসুরীয়া (সিন্ধু) মালাভীয়া, স্পেন, আল- ওয়াসিত। সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত মুসলিম সেনানিবাস ছিল কুফা। সা’দ-বিন-আবি-ওয়াক্কাস মা’দাইন থেকে সেনাঘাঁটি স্বাস্থ্যগত কারণে ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে কুফায় প্রতিষ্ঠিত করেন। কয়েক হাজার আরব ও মাওয়ালী নিয়ে খলিফা ওমরের সময়ে প্রতিষ্ঠিত কুফার সামরিক ছাউনি পরবর্তীকালে মুয়াবিয়ার খিলাফতে ১,৪০,০০০ বসবাসকারী সৈন্যের শক্তিশালী সেনানিবাসে রূপান্তরিত হয়। গোত্র প্রধান সেনাবাহিনীর সদস্যগণ সেনাছাউনির পৃথক পৃথক অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বাস করত। ইরাকের অপর শক্তিশালী ছাউনী ছিল বসরায়।
খলিফা ওমরের খিলাফতে ইউফ্রেটিস নদীর তীরে প্রতিষ্ঠিত বসরা সেনানিবাস উমাইয়া আমলে বিশাল আকার ধারণ করে। উল্লেখ্য যে, ওয়ালিদের সময়ে জিয়াদ-ইবন- আবীহের তত্ত্বাবধানে এই ছাউনীতে ২,০০,০০০ সৈন্যের বসবাস ছিল। সামরিক দিক হতে বসরা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ; কারণ, পারস্য ও মধ্য-এশিয়ায় সামরিক অভিযান প্রেরণ করা হয় বসরা থেকে। উপরন্তু, নৌ-বহর ও নৌ-বাণিজ্যের জন্য বসরার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। লক্ষণীয় যে, সমস্ত সামরিক ছাউনির প্রাণকেন্দ্র ছিল একটি মসজিদ। হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ প্রাচ্যদেশীয় প্রদেশসমূহের ভাইসরয় থাকাকালীন বসরা ও কুফা থেকেই বিদ্রোহীদের দমন করতে সক্ষম হন। উপরন্তু, তিনি এখান হতে সিস্তানে যাবুলিস্তানের রাজা জানবিলের বিরুদ্ধে ৪০,০০০ সদস্য বিশিষ্ট ময়ূর বাহিনী প্রেরণ করেন। হাজ্জাজ ওয়াসিতেও একটি শক্তিশালী ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করেন। মিসরে খলিফা আব্দুল মালিকের রাজত্বে ৩০,০০০ হতে ৪০,০০০ সৈন্যের একটি শক্তিশালী ‘জুনদ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। অনুরূপভাবে উত্তর আফ্রিকার কায়রোয়ানে ৬৭০ খ্রিস্টাব্দে উকবা-ইবন- নাফি সুদৃঢ় ঘাঁটি স্থাপন করেন।
নৌ-বহর : উমাইয়া খিলাফতে ইসলামের সম্প্রসারণের মূলে নৌবহরের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। সাম্রাজ্যের সীমারেখা আটলান্টিক এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বিস্তৃতি লাভ করলে উমাইয়া খলিফা মুয়াবিয়া একটি শক্তিশালী নৌ-বাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে বায়জানটাইন আক্রমণ প্রতিহত করবার জন্য তিনি মিসরের ন্যায় সিরিয়াতে একটি জাহাজ নির্মাণ কারখানা প্রতিষ্ঠিত করেন। মুয়াবিয়া সর্বপ্রথম একটি শক্তিশালী নৌ-বহর গঠন করে বায়জানটাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টনোপল অবরোধের প্রয়াস পান। এই অভিযানে নেতৃত্ব দেন তাঁর পুত্র ও উত্তরাধিকারী ইয়াজিদ। দ্বিতীয় অভিযান তাঁর রাজত্বে পরিচালিত হয় এবং মুসলমানগণ কৃতকার্য না হলেও ভূমধ্যসাগরের কতিপয় দ্বীপ অধিকার করতে সক্ষম হয়। ৬৭২ খ্রিস্টাব্দে রোডস এবং ৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে ক্রীটে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। মুয়াবিয়ার সময়ে জুনাদাহ এবং আবদুল্লাহ-বিন-কাসেম নামক দুজন প্রখ্যাত নৌধ্যক্ষ ছিলেন। জুনাদাহ বায়জানটাইনদের নিকট থেকে রোডস এবং ইরওয়াদ নামক দ্বীপপুঞ্জ দুটি দখল করেন। আবদুল্লাহ বায়জানটাইনদের বিরুদ্ধে ৬০টি নৌ-অভিযান পরিচালিত করেন।
মুয়াবিয়ার রাজত্বকালে মুসলমানদের ১৭০০টি দ্রুতগামী জাহাজ সংবলিত একটি সুসজ্জিত নৌ-বাহিনী ছিল। আবদুল মালিকের সময়ে এই বাহিনী আরও শক্তিশালী বহরে রূপান্তরিত হয়। তিনি তিউনিসিয়ায় একটি জাহাজ নির্মাণ কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। খলিফা ওয়ালিদের রাজত্বকালে নৌ-শক্তির চরম উৎকর্ষ সাধিত হয় এবং সিন্ধুর জলদস্যুদের উপযুক্ত শিক্ষা দিবার জন্য পূর্বদেশীয় শাসনকর্তা ওয়ালিদ-ইবন-আবদুল মালিক একটি নৌ-বহর প্রেরণ করেন। হুসাইনীর ভাষায়, “পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অধিকাংশ দ্বীপপুঞ্জ এবং সর্বোপরি স্পেন ও সিন্ধুদেশ শক্তিশালী মুসলিম নৌবাহিনীর সহায়তায় বিজিত হয়।” তাঁর সময় নৌবাহিনী পাঁচটি নৌ-বহরে বিভক্ত ছিল; যেমন- সিরীয়, আফ্রিকীয়, মিসরীয়, তিউনিসীয়, নীলনদের অববাহিকার নৌ-বাহিনী। মুসা-ইবন- নুসাইর খলিফা ওয়ালিদের শাসনকালে ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ মিনকা, মেজকা এবং আইভিকা অধিকার করেন। খলিফা সুলায়মানের সময়ে ৭১৭ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপল দখলের জন্য ১৮০০ জাহাজ সংবলিত একটি বিশাল নৌ-বহর প্রেরিত হয়।
মুসলিম নৌ-তৎপরতা সাধারণত ভূমধ্যসাগর এবং ভারত মহাসাগরে কেন্দ্রীভূত ছিল। এই দুই অঞ্চলে ব্যবহৃত নৌ-যানগুলো ছিল ভিন্ন ধরনের। ভূমধ্যসাগরীয় যুদ্ধজাহাজগুলোর তক্তা পেরেক দ্বারা সংযুক্ত ছিল কিন্তু লবণাক্ততার জন্য লোহিতসাগর এবং ভারত মহাসাগরের নৌ-যানগুলোর পাটাতন সেলাট দ্বারা যুক্ত ছিল। লোহিতসাগর ও ভারত মহাসাগরের ব্যবহৃত জলাযানগুলো ভূমধ্যসাগরের জাহাজের তুলনায় ছোট ছিল।
সামাজিক জীবন
খোলাফায়ে রাশেদূনের সময়ে মুসলিম সমাজ জীবন ছিল সরল, অনাড়ম্বরপূর্ণ এবং ইসলামের মূলনীতি দ্বারা পরিচালিত একটি সমাজজীবন প্রণালী। কিন্তু উমাইয়া খিলাফতে মুসলিম সমাজের অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়, এমনকি অনৈসলামিক কার্যকলাপও পরিলক্ষিত হয়। উমাইয়া যুগে ১২টি পৃথক সামাজিক স্তর ছিল। প্রথম স্তরে ছিলেন অভিজাত সম্প্রদায় অর্থাৎ রাজপরিবার এবং আরব বিজেতাগণ। এই সামাজিক স্তর কিরূপ বৃহৎ ছিল তা বলা দুষ্কর। তবে প্রথম ওয়ালিদের সময়ে দামেস্ক এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ভাতাপ্রাপ্ত আরব মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৫,০০০-এ। প্রথম মারওয়ানের রাজত্বে হিম্স এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এই সংখ্যা পৌঁছায় ২০,০০০-এ।
দ্বিতীয় স্তরে ছিল নব-দীক্ষিত মুসলমান বা মাওয়ালিগণ। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ফলে আইনত তারা আরবিয় মুসলমানদের মত সকল বিষয়ে সমান মর্যাদা লাভ করে নাই এবং তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকদের মর্যাদা পায়। প্রত্যেক নব-দীক্ষিত মুসলমানকে আরবিয় মুসলমান পরিবারের সঙ্গে যুক্ত অথবা আশ্রিত (মাওয়ালী) থাকতে হত। সাধারণত তারা শহরে বাস করত। মাওয়ালিগণ উমাইয়া আমলে নাগরিক মর্যাদা হতে বঞ্চিত ছিল এবং মুসলমান হয়েও তাদেরকে শরীয়তবিরোধী জিজিয়া কর দিতে হত। একমাত্র দ্বিতীয় ওমর তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং আরব ও অনারব মুসলমানদের মধ্যে বৈষম্য নীতি বিলোপ করেন। তাদের সাথে আরবিয় মুসলমানদের সমতুল্য ব্যবহার করা হত এবং তাদের খারাজ ও জিজিয়া কর হতে অব্যাহতি দেওয়া হয় নি। তাদের বেতন ও পেনসন প্রদানেরও ব্যবস্থা ছিল। মাওয়ালীদের পুঞ্জিভূত অসন্তোষের ফলেই তারা আব্বাসীয়দের সঙ্গে উমাইয়াবিরোধী আন্দোলনে যোগদান করে।
ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলমান সম্প্রদায়কে বলা হয় জিম্মি। ইহুদী, খ্রিস্টান, অগ্নি-উপাসক (পারসিক) এবং অপরাপর আশ্রিত অমুসলমানগণ জিম্মি নামে পরিচিত ছিল। তারা সমাজের তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত ছিল। তাদের সামরিক বাহিনীতে যোগাদন হতে অব্যাহতি দেওয়া হত, জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করা হত এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা দেওয়া হত। এর পরিবর্তে তাদের এক প্রকার কর দিতে হত যা জিজিয়া নামে পরিচিত। যেহেতু অনারব দেশে আরবগণ জমির মালিক হতে পারত না, সেহেতু কৃষিকার্য সাধারণত জিম্মিদের প্রধান উপজীবিকা ছিল এবং তাদের খারাজ দিতে হত। জিম্মিগণ খলিফাদের আস্থাভাজন ছিলেন কারণ তাদের রাজকার্যে নিযুক্ত করা হত। ওয়েলহাউসেন বলেন, “খলিফা ওমর (দ্বিতীয়) অমুসলমানদের সুবিধার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন এবং তাদের অবস্থার সার্বিক উন্নতির জন্য তিনি চেষ্টার ত্রুটি করতেন না।” খলিফাদের নির্দেশে জিম্মিদের মন্দির রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রয়োজনে সংস্কার করা হত। মুয়াবিয়ার রাজত্বে ৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে এডেসার বৃহৎ দুর্গটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে উহা পুননির্মাণ করা হয়।
মুসলিম রাষ্ট্রের সর্বনিম্ন স্তরে ছিল ক্রীতদাস। ইসলাম দাসপ্রথার ঘোর বিরোধী ছিল। কিন্তু এ ঘৃণ্য প্রথা বিলোপ করা সম্ভবপর হয় নি। উমাইয়া আমলে দাসপ্রথা চরম আকার ধারণ করে। যুদ্ধবন্দীদের দাসরূপে বিবেচনা করা হত। সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলে দাসপ্রথা প্রসারিত হয় এবং রাজপরিবার ও অভিজাত সম্প্রদায় দাসদের নিযুক্ত করতেন। কিন্তু অপরদিকে দাসদের সহজেই মুক্ত করা সম্ভবপর ছিল এবং ইসলামের ইতিহাসে দাস বংশের রাজত্ব বিরল নহে। গজনী, হিরাট, ভারত উপমহাদেশ এবং মিসর (মামলুক) প্রভৃতি দেশে দাসদের প্রতিপত্তি ও প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ডাউটির ভাষায়, “দাসদের অবস্থা মোটামুটি সহনযোগ্য ও সুখকর ছিল।”
উমাইয়া যুগে নারীদের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। পর্দা প্রথার প্রচলন থাকলেও সর্বক্ষেত্রে নারীদের পূর্ণ মর্যাদা ও স্বাধীনতা বিদ্যমান ছিল। ইমাম হুসাইনের কন্যা সখিনা এবং তালহার কন্যা আয়েশা বুদ্ধিবৃত্তি এবং সৌন্দর্যচর্চার জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। প্রথম ওয়ালিদের পত্নী উন্মুল বানীন একজন বিদূষী নারী ছিলেন এবং খলিফার উপর তার খুবই প্রভাব ছিল। তাপসী রাবেয়া আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে বিশেষ পরিচিত ছিলেন। নৃত্য, গীত, কবিতা রচনা, আবৃত্তি প্রভৃতি বিষয়ে তৎকালীন নারীদের পারদর্শিতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে খলিফাগণ শরীয়ত মেনে চলতেন কিন্তু উমাইয়া খিলাফতে অনৈসলামিক কার্যকলাপ পরিলক্ষিত হয়। খলিফাদের মধ্যে সর্বপ্রথম মধ্যপান শুরু করেন মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদ। অত্যধিক মদ্যপানের অভ্যাস থাকায় তাকে ‘আল-খুমার’ উপাধি দেওয়া হয়। আবদুল মালিক মাসে একবার, ওয়ালিদ একদিন অন্তর এবং হিশাম সপ্তাহে একবার মদ্যপান করতেন। খলিফা দ্বিতীয় ওয়ালিদ একটি মদের চৌবাচ্চা নির্মাণ করে তাতে সাঁতার কাটতেন এবং সর্বদা অপ্রকৃতিস্থ থাকতেন। সমাজে উপ-পত্নী প্রথা ইসলামবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও উমাইয়া খলিফাদের হেরেমে অসংখ্য উপ-পত্নী ছিল। দ্বিতীয় ইয়াজিদ সাল্লামাহ এবং হাবীবা নাম্মী দুজন গায়িকা দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতেন। খলিফাগণ দামেস্ক এবং পালমিরার মধ্যবর্তী স্থানে মরু-দুর্গ নির্মাণ করে তাতে ভোগ-বিলাসে অধিক সময় অতিবাহিত করতেন। ভোগ- বিলাস চরিতার্থ করবার জন্য তাঁরা গীত, বাদ্য, নৃত্য প্রভৃতি ইন্দ্রিয়পরায়ণতায় নিমগ্ন থাকতেন। শিকার, ঘোড়াদৌড়, পাশা খেলা প্রভৃতি ক্রীড়া প্রচলিত ছিল। মোরগের লড়াই একটি অতি প্রচলিত খেলা ছিল। প্রথম ইয়াজিদ একজন সুদক্ষ শিল্পী ছিলেন। তিনি তাঁর শিকারী কুকুরকে সোনার অলঙ্কারে সজ্জিত করে প্রত্যেকটির জন্য একজন পরিচালক নিযুক্ত করেন।
উমাইয়া খিলাফতে সামাজিক জীবনে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। রাজপরিবারের সদস্যগণই নহে, সাধারণ লোকও জাঁক-জমকপূর্ণ পোশাক পরিধানে অভ্যস্ত ছিল। নগরবাসীরা ঢিলা পায়জামা, লাল জুতা, বিরাট আকারের পাগড়ী পরিধান করত। বিদুঈনগণ ঢিলা লম্বা জামা পরিধান করত এবং মাথায় রুমাল বাঁধত। অভিজাত সম্প্রদায় রেশমী আচ্ছাদন পরিধান করে তরবারি বা বর্শা নিয়ে অশ্বপৃষ্ঠে যাতায়াত করত। অভিজাত পর্দানশীন মহিলাগণ রাস্তায় যাতায়াত করতেন না। তাঁরা সাধারণত ঢিলা পায়জামা, কামিজ ও বক্ষোপরি রুমাল ব্যবহার করতেন। গোত্রপ্রীতি প্রকট ছিল এবং এ কারণে এক এক গোত্রের লোক পৃথক পৃথকভাবে বসবাস করত।
ভনক্রেমার বলেন, “দামেস্ক আমোদ-প্রমোদের কেন্দ্র, গান-বাজনার আখড়া এবং বিলাস-বাসনের প্রাণকেন্দ্র ছিল; জীবন ছিল আনন্দের ভূমি, ধর্ম ছিল ভণ্ডামি মাত্র। উমাইয়া খিলাফতে রাজধানী দামেস্ক ছিল একটি সুরম্য নগরী।” হিট্টি যথার্থই বলেন, “উমাইয়াদের রাজত্বে হেরেম প্রথা চরম আকার ধারণ করে এবং ক্রীতদাস ও উপ-পত্নী দ্বারা হেরেম পরিপূর্ণ থাকত। দ্বিতীয় ওয়ালিদের সময় হতে এটি একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। দামেস্কের বাইরে মরূদ্যানে প্রাসাদ নির্মাণ করে খলিফাগণ বিলাস-বাসনে নিমগ্ন থাকতেন। এরূপ একটি মরু-প্রাসাদের নাম হচ্ছে ‘কুসাইর আমরা’।
শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা
উমাইয়া খিলাফতে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও শিক্ষা-দীক্ষা চরম উৎকর্ষতা লাভ করে। বলা বাহুল্য যে, মরুবাসী আরবগণ বিজিত অঞ্চলে আগমন করে গ্রীক, পারস্য ও ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসে। বস্তুত আরব শিক্ষা-ব্যবস্থা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে আরববাসী মুসলমান ছাড়াও অনারব মুসলমানগণ যথেষ্ট অবদান রেখে গেছেন। আরবিয় খিলাফতের আমলে পারসিয়ান, সিরিয়ান, মিসরীয়, আরবিয়, খ্রিস্টান, ইহুদী ও মুসলিম পণ্ডিতগণ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় একনিষ্ঠ সাধনা করেন।
উমাইয়া খলিফাগণ শিক্ষা বিস্তারে প্রয়াসী হন। কোন প্রকার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পদ্ধতির প্রচলন না থাকলেও সিরিয়ার মরুভূমি প্রাথমিক যুগে উমাইয়া যুবরাজদের ‘স্কুলের’ কাজ করত; যেমন- ‘কুসাইর আমরা’। প্রথম ইয়াজিদ ঐ স্থানে শিক্ষালাভ করেন। মাতৃভাষায় লিখতে ও পড়তে পারলে তাকে শিক্ষিত বলে গণ্য করা হত। কর্তব্যবোধ, উদারতা, পৌরুষ, অতিথিপরায়ণতা, প্রতিবেশীসুলভ দায়িত্ববোধ, সাহস, ধৈর্য, নারীর প্রতি শ্রদ্ধা এবং প্রতিশ্রুতি রক্ষাই শিক্ষার প্রকৃত নৈতিক আদর্শ ছিল। সাম্রাজ্যের প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র ছিল মসজিদসমূহ এবং প্রধান প্রধান শহর; যেমন- মক্কা, মদিনা, কুফা, বসরা ও মিসর প্রধান শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়। মসজিদে কুরআন ও হাদিস শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা লাভের পর ‘আল-ফাজিল’ উপাধি দেওয়া হত। কুরআন আবৃত্তিতে পারদর্শী কারীদের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করা হত। কুফায় জাহহাক ইবন-মুজাহিম একটি অবৈতনিক স্কুল স্থাপন করেন। অবশ্য পরবর্তী পর্যায়ে এই ধরনের স্কুলে ছাত্রদের নিকট হতে বেতন গ্রহণ করা হত।
উমাইয়া যুগে ইসলামের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে নব-দীক্ষিত মুসলমানগণ কুরআন পাঠের ভাষাতাত্ত্বিক প্রয়োজনীয়তা মিটাবার জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত আলিম এবং হযরত আলীর শিষ্য আবুল আসওয়াদ দু’আলী ৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম আরবি ব্যাকরণ শাস্ত্রের সুত্র নির্ধারণ ও পরিবর্ধন করেন। ইবন-খাল্লিকান বলেন যে, হযরত আলী তাঁকে ব্যাকরণ রচনার জন্য উৎসাহিত করেন। তিনি নির্দেশ দেন যে, আরবিতে তিনটি পদ থাকবে- বিশেষ্য, ক্রিয়া ও অব্যয়। তিনি ‘কিতাব-উল-আইন’ নামে প্রধান আরবি অভিধান রচনা করেন। আরবি ছন্দের প্রয়োগ ও তার বিশ্লেষণ করেন আল-খলিল। তাঁর শিষ্য পারস্যের সিবাওয়াইহ (৭৯৩ খ্রি.) যে আরবি ব্যাকরণ রচনা করেন তা অদ্যাবধি প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে সমাদৃত। এটি ‘আল-কিতাব’ নামে পরিচিত।
কুরআন পাঠ এবং তাঁর ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তার ফলে ভাষাতত্ত্ব, শব্দতত্ত্ব ও হাদিসের উপর গবেষণা শুরু হয় এবং কুরআন ও হাদিসের উপর ভিত্তি করে ইসলামী ধর্মশাস্ত্র ও আইনশাস্ত্রের উৎপত্তি ও বিকাশ হয়। আবদুল্লাহ ইবন-মাসউদ, আমীল ইবন – শারাহীল, ইবন-শিহাব আল-জুহুরী এবং হাসান বসরী প্রমুখ আইনশাস্ত্রবিদ ফিকহ শাস্ত্রের উৎকর্ষ সাধন করেন। এর ফলে আরবি জ্ঞান-ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়। আবদুল্লাহ বিন- মাসউদ প্রায় ৪৮৪টি হাদিস বর্ণনা করেন এবং তিনি কুফা স্কুলের নেতৃত্ব দেন। ইমাম হাসান বসরী বসরায় ধর্ম, ফিকাহ, দর্শন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর শিষ্য ওয়াসিল-বিন- আতা পরবর্তীকালে মুতাজিলা সম্প্রদায়ের প্রবর্তন করেন।
উমাইয়া খিলাফতে সর্বপ্রথম ইতিহাস রচনার সুচনা হয়। প্রবাদের ভিত্তিতে ইতিহাস রচনা প্রসঙ্গে হিট্টি বলেন, “এই যুগের আরবি ইতিহাস লিখন হাদিসকে ভিত্তি করে গড়ে উ।ে” হযরত মুহাম্মদ (স) এবং তাঁর সাহাবীদের জীবনধারা ও কার্যাবলি জানবার উদ্দেশ্যেই ইতিহাস রচনায় ঐতিহাসিকগণ ব্রতী হন। এই ঘটনাপঞ্জীকে ‘সিরাত’ বা ইতিহাস শাস্ত্র বলে। এ ছাড়া ইতিহাস লিখন পদ্ধতির উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে রাজা-বাদশাহদের কাহিনী, যুদ্ধ-বিগ্রহ, কুরশীনামা নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্তকরণ। উমাইয়া যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ ছিলেন আবিদ ইন-সারাইয়ার। মুয়াবিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় আবিদ “কিতাব আল-মূলক ওয়া আখবার আল-মাদীন” গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। ‘জন্ম বৃত্তান্ত’ সম্বন্ধে অভিজ্ঞ ঐতিহাসিক ছিলেন ওয়াহাব ইবন-মোনাব্বি। প্রাক-মুসলিম আরব এবং অনারব দেশের ইতিহাস রচনায় ওয়াহাব খ্যাতি অর্জন করেন। মুয়াবিয়ার শিক্ষক ও ‘উপদেষ্টা কাব’ আল-আহবাব মুসলিম ও ইহুদী সংক্রান্ত ঐতিহাসিক উপকরণ সংগ্রহ করেন।
কাব্য রচনায় উমাইয়া যুগে উৎকর্ষ সাধিত হয়। বলা বাহুল্য যে, আরবগণ প্রাক- ইসলামী যুগ থেকে কাব্যপ্রিয় ছিল। জাহেলিয়া যুগের ‘কাসিদাহ’ নামক প্রেমের কবিতা অবলম্বন করে উমাইয়া যুগের প্রেম আখ্যানমূলক কবিতাগুলো রচিত হয়েছিল। এই যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন ওমর ইবন-আবি রাবিয়াহ। তাঁকে ‘আরবদের অভিড’ আখ্যায় ভূষিত করা হয় এবং তিনি প্রেমের কবিতা লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। এ ছাড়া ইয়েমেনের জামিল (মৃত্যু ৭০১ খ্রি.) ‘লাইলী মজনু’ আখ্যান নিয়ে বহু কবিতা রচনা করেন। প্রেমের কবিতা ছাড়া রাজনৈতিক কবিতাও এই যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল। ইয়াজিদের মনোনয়ন সম্বন্ধে মিসকিন-আল-দারিমি কবিতা রচনা করেন। এই যুগের ব্যঙ্গ কবি ছিলেন জারির (৭২৯ খ্রি.)। প্রাক-ইসলামী আমলের কবিতা সংকলন করে হাম্মাদ উর- রাবিয়াহ (৭১৩-৭২ খ্রি.) এবং সভাকবি হিসেবে আল-ফারাজদাক (৬৪০-৭৩২ খ্রি.) বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। কবি হাম্মাদ-উর-রাবিয়াহ ২৯০০ পৃষ্ঠা ব্যাপী দীর্ঘ কাসিদা আবৃত্তি করে খলিফা দ্বিতীয় ওয়ালিদের নিকট হতে ১,০০,০০০ দিরহাম পুরস্কার লাভ করেন। সভাকবি ছাড়াও বিভিন্ন প্রদেশে কবিতা চর্চা করা হত।
আরবদের মতে বিজ্ঞান দুই ধরনের; যথা- ধর্ম সংক্রান্ত এবং শরীর সংক্রান্ত অর্থাৎ চিকিৎসাশাস্ত্র। আরবদের চিকিৎসাবিদ্যা গ্রীক এবং পারস্য চিকিৎসাশাস্ত্র হতে উদ্ভূত বলে মনে করা হয়। প্রথম হিজরীতে আরব চিকিৎসাশাস্ত্রের উদ্ভব হয় এবং তায়েফের আল- হারিস ইবন-কালাদা (মৃত্যু ৬৩৪ খ্রি.) বিশেষ সুনাম অর্জন করেন। তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন এবং ‘আরবদের চিকিৎসক’ আখ্যা লাভ করেন। মুয়াবিয়ার গৃহচিকিৎসক ইবন-উথাল, হাজ্জাজের গৃহচিকিৎসক তাযাদুক এবং মারওয়ানের গৃহচিকিৎসক মাসারাওয়াহ গ্রীক চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। দ্বিতীয় ওমর আলেকজান্দ্রিয়া হতে গ্রীক চিকিৎসাবিদদের এন্টিওক হাররানে নিয়ে যান এবং এর ফলে আরবি চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধিত হয়।
চিকিৎসাশাস্ত্রের মত রসায়নশাস্ত্রেও আবরগণ যথেষ্ট কৃতিত্ব অর্জন করেন। দ্বিতীয় উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদের পুত্র খালিদ (মৃত্যু ৭০৪ খ্রিস) “মারওয়ানদের চিকিৎসক” (হাকিম) নামে সুপরিচিত ছিলেন; তিনি ইসলামের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসে সর্বপ্রথম গ্রীক ও কপটিক ভাষা হতে চিকিৎসাশাস্ত্র এবং জ্যোতিষশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থাবলী আরবিতে অনুবাদ করেন। জাবির ইবন-হাইয়ান (৭৭৬ খ্রি.) উমাইয়া যগের একজন খ্যাত নামা চিকিৎসক ছিলেন। জ্যোতিষশাস্ত্রে জাফর আল-সাদিক (৭০০-৭৬৫ খ্রি.) এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন।
উমাইয়া যুগে সঙ্গীতচর্চা জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ‘মুখান্নাসুন’ নামক একজন সঙ্গীত সাধক সঙ্গীতকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেন এবং প্রসিদ্ধি লাভ করেন। মদিনার তুয়ায়েস (৬৩২-৭১০ খ্রি.) ইসলামী সঙ্গীতের জনক ছিলেন। প্রাক-ইসলামী যুগের সঙ্গীত বিভিন্ন ধরনের ছিল; যেমন- সামাজিক, উষ্ট্রচালকের, ধর্মীয় এবং প্রেম সম্পর্কিত গান। কবিতা আবৃত্তি সঙ্গীতের পর্যায়ে পড়ত এবং সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ছিল উষ্ট্রচালকের সঙ্গীত (‘হুদা’)। প্রাক-ইসলামী যুগে হেজাজে বাঁশী ও দফ খুবই জনপ্রিয় ছিল। আল- সুরায়েজ (৭২৬ খ্রি.) সর্বপ্রথম পারস্যদেশীয় বাদ্যযন্ত্র আরবদেশে প্রচলন করেন। মদিনার তুয়ায়েস সর্বপ্রথম আরবি সঙ্গীতের ঝঙ্কারের প্রবর্তন করেন। তুয়ায়েসের শিষ্য ইবন সুরায়েজ (৬৩৪-৭২৬ খ্রি.) আরবদে শ্রেষ্ঠ চার জন সঙ্গীতবিশারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। মক্কাবাসী নিগ্রো সাঈদ-বিন-মিসজাহ উমাইয়া যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। গায়ক হিসেবে মা’বাদও খ্যাতি অর্জন করেন। জামিলা (৭২০ খ্রি.) একজন প্রখ্যাত গায়িকা ছিলেন। দ্বিতীয় ইয়াজিদের রাজত্বকালে হেরেম-গায়িকা হিসেবে হাবীবা এবং সাল্লামাহর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
উমাইয়া যুগে স্থাপত্যশিল্পের চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। খোলাফায়ে রাশেদূনের সময় আরব স্থাপত্য ছিল খুবই সাধারণ ও অনাড়ম্বরপূর্ণ। ইসলামের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান স্থপতিগণ গ্রীক, রোমান, পারস্য স্থাপত্যকীর্তির সঙ্গে পরিচিত এবং প্রভাবান্বিত হন। মসজিদকে কেন্দ্র করে মুসলিম স্থাপত্যের উদ্ভব হয়। মুসলিম যুগে নির্মিত মসজিদগুলো সাধারণত মদিনায় নির্মিত নবী করীম (স)-এর মসজিদের অনুকরণে গড়ে উঠে। মসজিদের প্রধান উপকরণ হচ্ছে মিহরাব, মিম্বার, মাজিনা, সাহন, ওজুর স্থান প্রভৃতি। উমাইয়া খলিফা মুয়াবিয়ার জিয়াদ কুফা ও বসরার প্রাচীন মসজিদগুলোকে বায়জানটাইন রীতিতে সংস্কার করেন। অনুরূপভাবে আমর ফুসতাতের মসজিদে সর্বপ্রথম মিহরাব স্থাপন করেন। উত্তর আফ্রিকায় ওকবা ইবন-নাফি কায়রোয়ানে একটি মসজিদ (৬৭০-৭৬ খ্রি.) নির্মাণ করেন। উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় ওমর মদিনার মসজিদে সর্বপ্রথম মিহরাব স্থাপন করেন।” মসজিদ স্থাপত্যের অপর একটি উপকরণ ছিল মাসুরা। খলিফার নিরাপত্তার জন্য মসজিদে মিহরাবের সম্মুখে মাকসুরা বা বাক্স নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া উমাইয়া যুগে মিনার প্রবর্তিত হয়। দামেস্কের মসজিদের প্রাচীন গ্রীক চতুষ্কোণকার টাওয়ারের অনুকরণে আমর সর্বপ্রথম ফুসতাতের মসজিদে মিনার নির্মাণ করেন। উমাইয়া স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন হচ্ছে আবদুল মালিকের সময় নির্মিত ডোম-অব-দি-রক ও মসজিদ জেরুজালেমে নির্মিত ডোম-অব- দি-রক এক গম্বুজবিশিষ্ট একটি অষ্টকোণাকার ইমারত। এর মধ্যে একটি পবিত্র পাথর রয়েছে। বায়জানটাইন স্থাপত্যরীতির প্রভাবে নির্মিত এই অতুলনীয় ইমারত উমাইয়া স্থাপত্যের অপূর্ব স্বাক্ষর বহন করে আছে। দামেস্কে ওয়ালিদ কর্তৃক নির্মিত জামে মসজিদ অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যকীর্তি। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল হতে সংগৃহীত স্থপতিদের দ্বারা নির্মিত দামেস্কের মসজিদটিতে মুসলিম স্থাপত্যের সমন্বয় ঘটে। ধর্মীয় ইমারত ছাড়া উমাইয়া যুগে বিভিন্ন মরু-প্রাসাদ ও অনিন্দ্যসুন্দর ইমারত নির্মিত হয়; যেমন- প্রথম ইয়াজিদের সময়ে কুসাইর আমরা, হিশামের সময়ে খিরবত মাল-মাফজার, দ্বিতীয় ওয়ালিদের সময়ে মাশাত্তা প্রভৃতি। এই সমস্ত প্রাসাদে দেওয়াল চিত্র ও ভাস্কর্যের অপূর্ব নিদর্শনও দেখা যায়।