ছয়
একটা সপ্তাহ যে কোথা দিয়া কেমন করিয়া কাটিয়া আবার রবিবার ফিরিয়া আসিল, শৈলেশ ঠাহর পাইল না। সকালে উঠিয়াই ঊষা কহিল, তোমাকে রোজ বলচি কথা শুনচো না—আজ যাও ঠাকুরঝির ওখানে।সে কি মনে করচে বল ত? তুমি কি আমার সঙ্গে তার সত্যিই ঝগড়া করিয়ে দেবে নাকি?
শৈলেশ মনে মনে অতিশয় লজ্জা পাইয়া বলিল, কলেজের যে-রকম কাজ পড়েচে—
ঊষা বলিল, তা আমি জানি। কলেজ থেকে ফেরবার মুখেও তাই একবার গিয়ে উঠতে পারলে না!
কিন্তু কি রকম ক্লান্ত হয়ে ফিরতে হয়, সে ত জান না? তোমাকে ত আর ছেলে পড়াতে হয় না।
ঊষা হাসিয়া ফেলিল, কহিল, তোমার পায়ে পড়ি, আজ একবার যাও। রবিবারেও ছেলে পড়ানোর ছল করলে বিভা জন্মে আর মুখ দেখবে না। এই বলিয়া সে সহিসকে ডাকাইয়া আনিয়া গাড়ি তৈরি করিবার হুকুম দিয়া কহিল, বাবুকে শ্যামবাজার পৌঁছে দিয়েই তোরা ফিরে আসিস। গাড়িতে আমার কাজ আছে।
যাবার সময় শৈলেশ ছেলেকে সঙ্গে লইবার প্রস্তাব করিলে সে বিমাতার গায়ে ঠেস দিয়া মুখখানা বিকৃত করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। পিসিমার কাছে যাইতে সে কোনদিনই উৎসাহ বোধ করিত না, বিশেষতঃ সেদিনের কথা স্মরণ করিয়া তাহার ভয়ের অবধি রহিল না। ঊষা ক্রোড়ের কাছে তাহাকে টানিয়া লইয়া সহাস্যে বলিল, সোমেন থাক, ও না হয় আরেকদিন যাবে।
শৈলেশ কহিল, বিভার ওখানে ও যে যেতে চায় না, সে দেখচি তুমি টের পেয়েচ।
তোমাকে দেখেই কতকটা আন্দাজ করচি, এই বলিয়া সে হাসিমুখে ছেলেকে লইয়া উপরে চলিয়া গেল।
স্নানাহার সারিয়া শ্যামবাজার হইতে বাড়ি ফিরিতে শৈলেশের বেলা প্রায় আড়াইটা হইয়া গেল। বিভা, ভগিনীপতি ক্ষেত্রমোহন এবং তাহার সতর-আঠার বছরের একটি অনূঢ়া ভগিনীও সঙ্গে আসিলেন। বিভাকে সঙ্গে আনিবার ইচ্ছা শৈলেশের ছিল না। সে নিজে ইচ্ছা করিয়াই আসিল। ঊষার বিরুদ্ধে তাহার অভিযোগ বহুবিধ। কেবলমাত্র দাদাকেই বাঁকা বাঁকা কথা শুনাইয়া তাহার কিছুমাত্র তৃপ্তিবোধ হয় নাই; এখানে উপস্থিত হইয়া এতগুলি লোকের সমক্ষে নানাপ্রকার তর্কবিতর্কের মধ্যে ফেলিয়া পল্লীগ্রামের কুশিক্ষিতা ভাতৃবধূকে সে একেবারে অপদস্থ করিয়া দিবে এই ছিল তাহার অভিসন্ধি। দাদার সহিত আজ দেখা হওয়া পর্যন্তই সে অনেক অপ্রিয় কঠিন অনুযোগের সহিত এই কথাটাই বারংবার সপ্রমাণ করিতে চাহিয়াছে যে, এতকাল পরে এই স্ত্রীলোকটিকে আবার ঘরে ডাকিয়া আনায় শুধু যে মারাত্মক ভুল হইয়াছে, তাহাই নয়, তাহাদের স্বর্গগত পিতৃদেবের স্মৃতির প্রতিও প্রকারান্তরে অবমাননা করা হইয়াছে। তিনি যাহাকে ত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন, তাহাকে পুনরায় গ্রহণ করা কিসের জন্য? সমাজের কাছে, বন্ধু-বান্ধবের কাছে যাহাকে আত্মীয় বলিয়া পরিচিত করা যাইবে না, কোথাও কোন সামাজিক ক্রিয়াকর্মে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাওয়া যাহাকে চলিবে না, এমন কি বড়ভাইয়ের স্ত্রী বলিয়া সম্বোধন করিতেই যাহাকে লজ্জাবোধ হইবে, তাহাকে লইয়া লোকের কাছে সে মুখ দেখাইবে কি করিয়া?
অপরিচিত ঊষার পক্ষ লইয়া ক্ষেত্রমোহন দুই-একটা কথা বলিবার চেষ্টা করিতেই স্ত্রীর কাছে ধমক খাইয়া সে চুপ করিল। বিভা রাগ করিয়া বলিল, দাদা মনে করেন আমি কিছুই জানিনে, কিন্তু আমি সব খবর রাখি। বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই এতকালের খানসামা আবদুলকে তাড়ালেন মুসলমান বলে, গিরিধারীকে দূর করলেন ছোটজাত বলে। এত যাঁর জাতের বিচার তাঁর সঙ্গে সম্বন্ধ রাখাই ত আমাদের দায়। আমি ত এমন বৌকে একটা দিনও স্বীকার করতে পারব না, তা যিনিই কেন না যত রাগ করুন।
এ কটাক্ষ যে কাহাকে হইল, তাহা সকলেই বুঝিলেন। শৈলেশ আস্তে আস্তে বলিতে গেল যে, ঠিক সে কারণে নয়, তাহারা নিজেরাই বাড়ি যাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিল। এই কথায় বিভা দাদার মুখের উপরেই জবাব দিল যে, বৌদিদির আমলে তাহাদের এতখানি ব্যগ্রতা দেখা দেয় নাই, কেবল ইনি ঘরে পা দিতে-না-দিতেই তাহারা পলাইয়া বাঁচিল।
এই শ্লেষের আর উত্তর কি? শৈলেশ মৌন হইয়া রহিল।
বিভা জিজ্ঞাসা করিল, চাকর-বাকর ত সব পালিয়েছে, তোমার এখন চলে কি করে?
শৈলেশ নিস্পৃহকণ্ঠে কহিল, অমনি একরকমে যাচ্ছে চলে।
বিভা কহিল, যারা গেছে তারা আর আসবে না, আমি বেশ জানি। কিন্তু বাড়ি ত একেবারে ভট্চায্যি-বাড়ি করে রাখলে চলবে না, সমাজ আছে। লোকজন আবার দেখেশুনে রাখো—মানুষে বলবে কি?
শৈলেশ কহিল, না চললে রাখতে হবে বৈ কি!
বিভা বলিল, কি করে যে চলচে সে তোমরাই জান, আমরা ত ভেবে পাইনে। এই বলিয়া সে কাপড় ছাড়িবার জন্য উঠিতে উদ্যত হইয়া কহিল, বাপের বাড়ি না গিয়েও পারিনে, কিন্তু গেলে বোধ করি এক পেয়ালা চাও জুটবে না।
ক্ষেত্রমোহন এতক্ষণ পর্যন্ত চুপ করিয়াই ছিলেন, ভাইবোনের বাদ-বিতণ্ডার মধ্যে কথা কহিতে চাহেন নাই, কিন্তু আর থাকিতে না পারিয়া বলিলেন, আগে গিয়েই ত দেখ, চা যদি না পাও তখন নাহয় বলো।
বিভা কহিল, আমার দেখাই আছে। প্রথম দিন তাঁর ভাব দেখেই আমি বুঝে এসেচি! এই বলিয়া সে চলিয়া গেল। তাহার অনুযোগ যে একেবারেই সত্য নয়, বস্তুতঃ সেদিন কিছুই দেখিয়া আসিবার মত তাহার সময় বা মনের অবস্থা কোনটাই ছিল না, তাহা উভয়ের কেহই জানিতেন না। ক্ষেত্রমোহন কহিলেন, বাস্তবিক শৈলেশ, ব্যাপার কি তোমাদের?
চাকর-বাকর সমস্ত বিদায় করে দিয়ে কি বোষ্টম-বৈরাগী হয়ে থাকবে নাকি? আজকাল খাচ্চো কি?
শৈলেশ কহিল, ডাল ভাত লুচি তরকারি—
গলা দিয়ে গলচে ওগুলো?
অন্ততঃ গলায় বাঁধচে না এ কথা ঠিক।
ক্ষেত্রমোহন হাসিয়া কহিলেন, ঠিক তা আমিও জানি। এবং আমার যে সত্যি সত্যিই বাধে তাও নয়, কিন্তু মজা এমনি যে, সে কথা নিজেদের মধ্যে স্বীকার করবার জো নেই। তুমি কি এমনই বরাবর চালিয়ে যাবে স্থির করেচ নাকি?
শৈলেশ ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিল, দেখ ক্ষেত্র, যথার্থ কথা বলতে কি, স্থির আমি নিজে কিছুই করিনি, করবার ভারও আমার ‘পরে তিনি দেননি। শুধু এইটুকু স্থির করে রেখেচি যে, তাঁর অমতে তাঁর সাংসারিক ব্যবস্থায় আর আমি হাত দিচ্চিনে।
ক্ষেত্রমোহন দ্বারের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া চুপি চুপি কহিলেন, চুপ চুপ, এ কথা তোমার বোনের যদি কানে যায় ত আর রক্ষা থাকবে না, তা বলে দিচ্ছি!
শৈলেশ কহিল, এদিকে যদি রক্ষা নাও থাকে অন্য দিকে একটু রক্ষা বোধ হয় পেয়েচি যে, আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি এ দুশ্চিন্তা আর ভোগ করতে হবে না। বল কি হে, অহর্নিশি কেবল টাকার ভাবনা, মাসের পনর দিন পার হলেই মনে হয় বাকি পনরটা দিন পার হবে কি করে—সে পথে আর পা বাড়াচ্ছি নে। আমি বেঁচে গেছি ভাই—টাকা ধার করতে আর যেতে হবে না। যে ক’টা টাকা মাইনে পাই, সেই আমার যথেষ্ট, এ সুখবরটা এঁর কাছে আমি পেয়ে গেছি।
ক্ষেত্রমোহন কহিলেন, বল কি হে? কিন্তু টাকার দুর্ভাবনা কি একা তোমারই ছিল নাকি? আমি যে একেবারে কণ্ঠায় কণ্ঠায় হয়ে উঠেচি, সে খবর ত রাখো না।
শৈলেশ বলিতে লাগিল, এলাহাবাদে পালাবার সময় পুরো একটি মাসের মাইনে আলমারিতে রেখে যাই। বলে যাই, একটি মাস পুরো চলা চাই। আগে ত কোন কালেই চলেনি, সোমেনের মা বেঁচে থাকতেও না, তাঁর মৃত্যুর পরে আমার নিজের হাতেও না। ভেবেছিলাম এঁর হাত দিয়ে যদি ভয় দেখিয়েও চালাতে পারি ত তাই যথেষ্ট। যাদের তাড়ানো নিয়ে বিভা রাগ করছিল, তাদের মুসলমান এবং ছোটজাত বলেই বাস্তবিক তাড়ানো হয়েছে কি না আমি ঠিক জানিনে, কিন্তু এটা জানি, যাবার সময়ে তারা এক বছরের বাকি মাইনে নিয়ে খুব সম্ভব খুশি হয়েই দেশে গেছে। মুদির দোকানে চার-শ’ টাকা দেওয়া হয়েচে, আরও ছোটখাটো কি কি সাবেক দেনা শোধ করে ছোট্ট একখানি খাতায় সমস্ত কড়ায় গণ্ডায় লেখা—ভয় পেয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, এ তুমি কি কাণ্ড করে বসে আছো ঊষা, অর্ধেক মাস যে এখনো বাকি—চলবে কি করে? জবাবে বললেন, আমি ছেলেমানুষ নই, সে জ্ঞান আমার আছে। খাবার কষ্ট ত আজও তাঁর হাতে একতিল পাইনি ক্ষেত্র, কিন্তু ডাল-ভাতই আমার অমৃত। আমার দর্জি ও কাপড়ের বিল এবং হ্যান্ডনোটের দেনাটা শোধ হয়ে যাক ভাই, নিশ্বাস ফেলে বাঁচি।
ক্ষেত্রমোহন কি একটা বলিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু স্ত্রীকে প্রবেশ করিতে দেখিয়া চুপ করিয়া গেলেন।
মোটর প্রস্তুত হইয়া আসিলে তিনজনেই উঠিয়া বসিলেন। সমস্ত পথটা ক্ষেত্রমোহন অন্যমনস্ক হইয়া রহিলেন, কাহারও কোন কথা বোধ করি তাঁহার কানেই গেল না।
সাত
অল্প কিছুক্ষণেই গাড়ি আসিয়া শৈলেশ্বরের বাড়ির দরজায় দাঁড়াইল। ভিতরে প্রবেশ করিয়া প্রথমেই সাক্ষাৎ মিলিল সোমেনের। সে কয়লাভাঙ্গা হাতুড়িটা সংগ্রহ করিয়া লইয়া চৌকাঠে বসিয়া তাহার রেলগাড়ির চাকা মেরামত করিতেছিল—তাহার চেহারার দিকে চাহিয়া হঠাৎ কাহারও মুখে আর কথা রহিল না। তাহার কপালে, গালে, দাড়িতে, বুকে, বাহুতে—অর্থাৎ দেহের সমস্ত উপরার্ধটাই প্রায় চিত্র-বিচিত্র করা। গঙ্গার ঘাটের উড়ে পাণ্ডা সাদা, রাঙা, হলুদ রঙ দিয়া নিজের দেশের জগন্নাথ হইতে আরম্ভ করিয়া পশ্চিমের রাম-সীতা পর্যন্ত সর্বপ্রকার দেবদেবীর অসংখ্য নাম ছাপিয়া দিয়াছে।
বিভা শুধু একটু মুচকিয়া হাসিয়া কহিল, বেশ দেখিয়েচে বাবা, বেঁচে থেকো!
শৈলেশের এই দুইজনের কাছে যেন মাথা কাটা গেল। স্বভাবতঃ সে মৃদুপ্রকৃতির লোক, যে-কোন কারণেই হউক, হৈ-চৈ হাঙ্গামা সৃষ্টি করিয়া তুলিতে সে পারিত না, কিন্তু ভগিনীর এই অত্যন্ত কটু উত্তেজনা হঠাৎ তাহার অসহ্য হইয়া পড়িল। ছেলের গালে সশব্দে একটা চড় বসাইয়া দিয়া কহিল, হতভাগা পাজি! কোথা থেকে এই সমস্ত করে এলি? কোথা গিয়েছিলি?
সোমেন কাঁদিতে কাঁদিতে যাহা বলিল, তাহাতে বুঝা গেল, আজ সকালে সে মায়ের সঙ্গে গঙ্গাস্নানে গিয়াছিল। শৈলেশ তাহার গলায় একটা ধাক্কা মারিয়া ঠেলিয়া দিয়া বলিল, যা সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেল্ গে, যা বলচি!
তিনজনে আসিয়া তাহার পড়িবার ঘরে প্রবেশ করিল। ভাই-বোন উভয়েরই মুখ অসম্ভব রকমের গম্ভীর; মিনিটখানেক কেহই কোন কথা কহিল না, শৈলেশের লজ্জিত বিরস মুখে ইহাই প্রকাশ পাইল যে, এতটা বাড়াবাড়ি সে স্বপ্নেও ভাবে নাই, কিন্তু বিভা কথা না কহিয়াও যেন সগর্বে বলিতে লাগিল, এসব তার জানা কথা। এইরূপ হইতেই বাধ্য।
কথা কহিলেন ক্ষেত্রমোহন। তিনি হঠাৎ একটুখানি হাসিয়া ফেলিয়া বলিলেন, শৈলেশ, তুমি যে একেবারে চায়ের পেয়ালায় তুফান তুলে ফেললে হে! ছেলেটাকে মারলে কি বলে! তোমাদের সঙ্গে ত চলাফেরা করাই দায়।
স্বামীর কথা শুনিয়া বিভা বিস্ময়ে যেন হতবুদ্ধি হইয়া গেল, মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, চায়ের পেয়ালায় তুফান কি রকম! তুমি কি এটাকে ছেলেখেলা মনে করলে নাকি?
ক্ষেত্রমোহন বলিলেন, অন্ততঃ ভয়ানক কিছু একটা যে মনে হচ্ছে না তা অস্বীকার করতে পারিনে।
তার মানে?
মানে খুব সহজ। আজ নিশ্চয় কি একটা গঙ্গাস্নানের যোগ আছে, সোমেন সঙ্গে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে স্নান করেছে। একটা দিন কলের জলে না নেয়ে দৈবাৎ কেউ যদি গঙ্গায় স্নান করেই থাকে ত কি মহাপাপ হতে পারে আমি ত ভেবে পাইনে।
বিভা স্বামীর প্রতি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া কহিল, তার পরে?
ক্ষেত্রমোহন জবাব দিলেন, তার পরের ব্যাপারও খুব স্বাভাবিক। ঘাটে বিস্তর উড়ে পাণ্ডা আছে, হয়ত কেউ দুটো-একটা পয়সার আশায় ছেলেমানুষের গায়ে চন্দনের ছাপ মেরে দিয়েচে। এতে খুনোখুনি কাণ্ড করবার কি আছে!
বিভা তেমনি ক্রোধের স্বরে প্রশ্ন করিল, এর পরিণাম ভেবে দেখেচ?
ক্ষেত্রমোহন বলিলেন, বিকালবেলা মুখহাত ধোয়ার সময় আপনি মুছে যায়—এই পরিণাম।
বিভা কহিল, ওঃ—এই মাত্র! তোমার ছেলেপুলে থাকলে তুমিও তা হলে এইরকম করতে দিতে?
ক্ষেত্রমোহন কহিলেন, আমার ছেলেপুলে যখন নেই, তখন এ তর্ক বৃথা।
বিভা মনে মনে আহত হইয়া কহিল, তর্ক বৃথা হতে পারে, চন্দন ধুয়ে ফেললে উঠে যায় আমি জানি, কিন্তু এর দাগ হয়ত অত সহজে নাও উঠতে পারে। ছেলেপুলের ভবিষ্যৎ জীবনের পানে চেয়েই কাজটা করতে হয়। আজকার কাজটা যে অত্যন্ত অন্যায় এ কথা আমি একশ’বার বলব, তা তোমরা যাই কেন না বল।
ক্ষেত্রমোহন কহিলেন, তোমরা নয়—একা আমি! শৈলেশ ত চড় মেরে আর গলাধাক্কা দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করলে—আমি কিন্তু এ আশা করিনে যে, অধ্যাপক-বংশের মেয়ে একদিনেই মেমসাহেব হয়ে উঠবে। তা সে যাই হোক, তোমরা দু’ ভাইবোন এর ফলাফল বিচার করতে থাকো, আমি উঠলুম।
শৈলেশ চুপ করিয়াই ছিল, তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া কহিল, কোথায় হে?
ক্ষেত্রমোহন কহিলেন, উপরে। ঠাকরুনের সঙ্গে পরিচয়টা একেবারে সেরে আসি, কথা কন কি না একটু সাধ্যসাধনা করে দেখি গে। এই বলিয়া ক্ষেত্রমোহন আর বাক্যব্যয় না করিয়া বাহিরে গেলেন।
উপরে উঠিয়া শোবার ঘরের দরজা হইতে ডাক দিয়া কহিলেন, বৌঠাকরুন নমস্কার।
ঊষা মুখ ফিরাইয়া দেখিয়াই মাথার কাপড় তুলিয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।
সোমেন কাছে বসিয়া বোধ করি মায়ের কাজ বাড়াইতেছিল, কহিল, পিসেমশাই।
ঊষা অদূরে একটা চৌকি দেখাইয়া দিয়া আস্তে আস্তে বলিল, বসুন। তাহার সম্মুখের গোটাদুই আলমারির কপাট খোলা, মেঝের উপর অসংখ্য রকমের কাপড় জামা শাড়ি জ্যাকেট কোট পেন্টুলান মোজা টাই কলার—কত যে রাশিকৃত করা তাহার নির্ণয় নাই। ক্ষেত্রমোহন আসন গ্রহণ করিয়া কহিলেন, আপনার হচ্ছে কি?
সোমেন স্তূপের মধ্য হইতে একজোড়া মোজা টানিয়া বাহির করিয়া কহিল, এই আর একজোড়া বেরিয়েছে। এইটুকু শুধু ছেঁড়া—চেয়ে দেখ মা!
ঊষা ছেলের হাত হইতে লইয়া একস্থানে গুছাইয়া রাখিল। তাহার রাখিবার শৃঙ্খলা লক্ষ্য করিয়া ক্ষেত্রমোহন একটু আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিলেন, এ কি অনাথ আশ্রমের ফর্দ তৈরি হচ্ছে, না জঞ্জাল পরিষ্কারের চেষ্টা হচ্ছে? কি করচেন বলুন ত? তিনি ভাবিয়া আসিয়াছিলেন, পল্লী অঞ্চলের নূতন বধূ তাঁহাকে দেখিয়া হয়ত লজ্জায় একেবারে অভিভূত হইয়া পড়িবে, কিন্তু ঊষার আচরণে সেরূপ কিছু প্রকাশ পাইল না। সে মুখ তুলিয়া চাহিল না বটে, কিন্তু কথার জবাব সহজকণ্ঠেই দিল; কহিল, এগুলো সব সারাতে পাঠাবো ভাবচি।
কেবল মোজাই এত জোড়া আছে যে, বোধ করি দশ বচ্ছর আর না কিনলেও চলে যাবে।
ক্ষেত্রমোহন একমুহূর্ত স্থির থাকিয়া কহিলেন, বৌঠাকরুন, এখন কেউ নেই, এই সময় চট করে একটা কথা বলে রাখি। আপনার ননদটিকে দেখে তাঁর স্বামীর স্বরূপটা যেন মনে মনে আন্দাজ করে রাখবেন না। বাইরে থেকে আমার সাজসজ্জা আর আচার-ব্যবহার দেখে আমাকে ফিরিঙ্গি ভাববেন না, আমি নিতান্তই বাঙ্গালী। কেউ গঙ্গাস্নান করে এসেছে শুনলে তাকে আমার মারতে ইচ্ছা করে না, এ কথাটা আপনাকে জানিয়ে রাখলাম।
ঊষা চুপ করিয়া রহিল। ক্ষেত্রমোহন কহিলেন, আরও একটা কথা নিরিবিলিতেই বলে রাখি। সোমেনের মারটা নিজের গায়ে পেতে নিলে শৈলেশ বেচারার প্রতি কিন্তু অবিচার করা হবে। এত বড় অপদার্থ ও সত্যিসত্যিই নয়।
ঊষা এ কথারও কোন জবাব দিল না, নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া রহিল। ক্ষেত্রমোহন বলিলেন, এখন আপনি বসুন। আমার জন্যে আপনার সময় না নষ্ট হয়। একটু মৌন থাকিয়া বলিলেন, আপনার লক্ষ্মী হাতের কাজ করা দেখে আমিও গৃহস্থালীর কাজকর্ম একটু শিখে নিই।
ঊষা মেঝের উপর বসিয়া মৃদু হাসিয়া বলিল, এ-সব মেয়েদের কাজ, আপনার শিখে লাভ কি?
ক্ষেত্রমোহন কহিলেন, এর জবাব একদিন আপনাকে দেব, আজ নয়।
ঊষা নীরবে হাতের কাজ করিতে লাগিল; কিন্তু একটু পরেই কহিল, এসব ত গরীব-দুঃখীদের কাজ, আপনাদের এ শিক্ষায় ত কোন প্রয়োজনই হবে না।
ক্ষেত্রমোহন একটা নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, বৌঠাকরুন, বাইরের চাকচিক্য দেখে যদি আপনারও ভুল হয় ত সংসারে আমাদের মত দুর্ভাগাদের ব্যথা বোঝবার আর কেউ থাকবে না। ইচ্ছে করে, আমার ছোট বোনটিকে আপনার কাছে দিনকতক রেখে যাই। আপনার লক্ষ্মীশ্রীর কতকটাও হয়ত সে তাহলে শ্বশুরবাড়িতে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে।
ঊষা চুপ করিয়া রহিল। ক্ষেত্রমোহন পুনরায় কি একটা বলিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু সহসা অনেকগুলি জুতার শব্দ সিঁড়ির নীচে শুনিতে পাইয়া শুধু বলিলেন, এঁরা সব উপরেই আসচেন দেখচি। শৈলেশের বোন এবং আমার বোনের বাইরের বেশভূষার সাদৃশ্য দেখে কিন্তু ভিতরটাও একরকম বলে স্থির করে নেবেন না।
ঊষা শুধু একটুখানি হাসিয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিল, আমি বোধ হয় চিনতে পারব।
ক্ষেত্রমোহন কহিলেন, বোধ হয়! নিশ্চয় পারবেন, এও আমি নিশ্চয় জানি।
আট
সিঁড়িতে যাহাদের পায়ের শব্দ শোনা গিয়াছিল তাহারা শৈলেশ, বিভা এবং বিভার ছোট ননদ উমা। শৈলেশ ও বিভা ঘরে প্রবেশ করিল, সকলের পিছনে ছিল উমা; সে চৌকাঠের এদিকে পা বাড়াইতেই, তাহার দাদা তাহাকে চোখের ইঙ্গিতে নিষেধ করিয়া কহিলেন, জুতোটা খুলে এস উমা।
বিভা ফিরিয়া চাহিয়া স্বামীকে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, কেন বল ত?
ক্ষেত্রমোহন বলিলেন, দোষ কি? পায়ে কাঁটাও ফুটবে না, হোঁচটও লাগবে না।
বিভা কহিল, সে আমি জানি। কিন্তু হঠাৎ জুতো খোলার দরকার হ’ল কিসে তাই শুধু জিজ্ঞাসা করেচি।
ক্ষেত্রমোহন বলিলেন, বৌঠাকরুন হিঁদু মানুষ—তা ছাড়া গুরুজনের ঘরের মধ্যে ওটা পায়ে দিয়ে না আসাই বোধ হয় ভাল।
বিভা স্বামীর পায়ের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া দেখিল, শুধু কেবল ভগিনীকে উপদেশ দেওয়াই নয়, নিজেও তিনি ইতিপূর্বে তাহা পালন করিয়াছেন দেখিয়া তাহার গা জ্বলিয়া গেল; কহিল, গুরুজনের প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা তোমার অসাধারণ সে ভালই, কিন্তু তার বাড়াবাড়িটা ভাল নয়। গুরুজনের এটা শোবার ঘর না হয়ে ঠাকুরঘর হলে আজ হয়ত তুমি একেবারে গোবর খেয়ে পবিত্র হয়ে ঢুকতে।
স্ত্রীর রাগ দেখিয়া ক্ষেত্র হাসিতে লাগিলেন, বলিলেন, গোবরের প্রতি রুচি নেই, ওটা বৌঠাকরুনের খাতিরেও মুখে তুলতে পারতুম না, কিন্তু ঠাকুর-দেবতার সঙ্গে যখন কোন সুবাদই রাখিনে, তখন অকারণে তাঁদের ঘরে ঢুকেও উৎপাত করতুম না। আচ্ছা বৌঠাকরুন, এ ঘরে ত আগেও বহুবার এসেচি, মনে হচ্চে যেন একটা ভাল কার্পেট পাতা ছিল, সেটা তুলে দিলেন কেন?
ঊষা কহিল, ধোয়ামোছা যায় না, বড় নোংরা হয়। শোবার ঘর—
বিভা বিদ্রূপের ভঙ্গীতে প্রশ্ন করিল, কার্পেট পাতা থাকলে ঘর নোংরা হয়?
ঊষা তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া ধীরে ধীরে কহিল, হয় বৈ কি ভাই। চোখে দেখা যায় না সত্যি, কিন্তু নীচে তার ঢের ধুলোবালি চাপা পড়ে থাকে।
বিভা বোধ করি ইহার প্রতিবাদ করিতে যাইতেছিল, কিন্তু স্বামীর প্রবল কণ্ঠে অকস্মাৎ তাহা রুদ্ধ হইয়া গেল। তিনি অত্যন্ত উৎসাহের সহিত বলিয়া উঠিলেন, ব্যস্ ব্যস্, বৌঠাকরুন, নোংরা চাপা পড়লেই আমাদের কাজ চলে যায়—তার বেশি আর আমরা চাইনে। ও জিনিসটা চোখের আড়ালে থাকলেই আমরা খুশি হয়ে থাকি। কি বল শৈলেশ, ঠিক না?
শৈলেশ কথা কহিল না। বিভার ক্রোধের অবধি রহিল না; কিন্তু সেই ক্রোধ সংবরণ করিয়া সে তর্ক না করিয়া মৌন হইয়া রহিল। তাহাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সত্যকার স্নেহ ও প্রীতির হয়ত কোন অভাব ছিল না, কিন্তু বাহিরে সাংসারিক আচরণে বাদ-প্রতিবাদের ঘাত-প্রতিঘাত প্রায়ই প্রকাশ হইয়া পড়িত। লোকের সম্মুখে বিভা তর্কে কিছুতেই হার মানিতে পারিত না, ইহা তাহার স্বভাব। সেই হেতু প্রায়ই দেখা যাইত, এই বস্তুটা পাছে কথায় কথায় বাড়াবাড়িতে গিয়া উপনীত হয়, এই ভয়ে প্রায়ই ক্ষেত্রমোহন বিতণ্ডার মাঝখানেই রণে ভঙ্গ দিয়া সরিয়া পড়িত। কিন্তু আজ তাহার সে ভাব নয়, ইহা ক্ষণকালের জন্য অনুভব করিয়া বিভা আপনাকে সংবরণ করিল।
বস্তুতঃই তাহার বিরুদ্ধে আজ ক্ষেত্রমোহনের মনের মধ্যে এতটুকু প্রশ্রয়ের ভাব ছিল না। পরের দোষ ধরিয়া কটুকথা বলা বিভার একপ্রকার স্বভাবের মধ্যে গিয়া দাঁড়াইয়াছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়ত ইহাতে অশিষ্টতা ভিন্ন আর কোন ক্ষতিই হইত না; কিন্তু এই যে নিরপরাধ বধূটির বিরুদ্ধে প্রথম দিন হইতেই সে একেবারে কোমর বাঁধিয়া লাগিয়াছে, বিনাদোষে অশেষ দুঃখভোগের পর যে স্ত্রী স্বামীর গৃহকোণে দৈবাৎ স্থানলাভ করিয়াছে, তাহার সেইটুকু স্থান হইতে তাহাকে ভ্রষ্ট করিবার দুরভিসন্ধি আর একজন স্বামীর চিত্ত দুঃখে ও বিরক্তিতে পূর্ণ করিয়া আনিতেছিল। অথচ ইহারই পদধূলির যোগ্যতাও অপরের নাই, এই সত্য চক্ষের পলকে উপলব্ধি করিয়া ক্ষেত্রমোহনের তিক্ত ব্যথিত চিত্তে বিভার বিরুদ্ধে আর কোন ক্ষমা রহিল না। অথচ এই কথা প্রকাশ করিয়া বলাও এই উচ্চশিক্ষিত সম্প্রদায়ে তেমনি সুকঠিন। বরঞ্চ যেমন করিয়া হউক, সভ্যতার আবরণে বাহিরে ইহাকে গোপন করিতেই হইবে।
ক্ষেত্রমোহন ভগিনীকে উদ্দেশ করিয়া কহিলেন, উমা, তোমার এই পল্লীগ্রামের বৌদিদির কাছে এসে যদি রোজ দুপুরবেলা বসতে পার, যে-কোন সংসারেই পড় না কেন দিদি, দুঃখ পাবে না তা বলে রাখচি।
উমা হাসিমুখে চুপ করিয়া রহিল। ঊষা মুখ না তুলিয়া বলিল, ত হলেই হয়েচে আর কি! আপনাদের সমাজে ওকে একঘ’রে করে দেবে।
ক্ষেত্রমোহন কহিলেন, তা দিক বৌঠাকরুন। কিন্তু ওরা স্বামী-স্ত্রীতে যে পরম সুখে থাকবে তা বাজি রেখে বলতে পারি।
শৈলেশ বিভার প্রতি একবার কটাক্ষে চাহিয়া ঠাট্টা করিয়া কহিল, বাজি রাখতে আর হবে না ভাই, এই বলাতেই যথেষ্ট হবে।
ক্ষেত্রমোহন জবাব দিয়া কহিলেন, আর যাই হোক, আজকের কাজটুকুও যদি মনে রাখতে পারে ত নিরর্থক নিত্য নূতন মোজা কেনার দায় থেকেও অন্ততঃ ওর স্বামী বেচারা অব্যাহতি পাবে।
বিভা সেই অবধি চুপ করিয়াই ছিল, আর পারিল না। কিন্তু গূঢ় ক্রোধের চিহ্ন গোপন করিয়া একটুখানি হাসিবার প্রয়াস করিয়া বলিল, ওর ভবিষ্যৎ সংসারে হয়ত মোজায় তালি দেবার প্রয়োজন নাও হতে পারে। দিলেও হয়ত ওর স্বামী পরতে চাইবে না। আগে থেকে বলা কিছুই যায় না।
ক্ষেত্রমোহন কহিলেন, যায় বৈ কি। চোখ-কান খোলা থাকলেই বলা যায়। যে সত্যিকারের জাহাজ চালায়, সে জলের চেহারা দেখলেই টের পায় তলা কত দূরে। বৌঠাকরুন, জাহাজে পা দিয়েই যে ধরে ফেলেছিলেন, একটু অসাবধানেই তলায় পাঁক গুলিয়ে উঠবে, এতেই আপনাকে সহস্র ধন্যবাদ দিই। আর শৈলেশের পক্ষ থেকে ত লক্ষকোটি ধন্যবাদেও পর্যাপ্ত হবার নয়।
ঊষা অত্যন্ত লজ্জা পাইয়া সবিনয়ে বলিল, নিজের গৃহে নিজের স্বামীর অবস্থা বোঝাবার চেষ্টা করার মধ্যে ধন্যবাদের ত কিছুই নেই ক্ষেত্রমোহনবাবু।
এ কথার জবাব দিল বিভা। সে কহিল, অন্ততঃ নিজের স্ত্রীকে অপমান করার কাজটা হয়ত সিদ্ধ হয়। তা ছাড়া, কাউকে উঞ্ছবৃত্তি করতে দেখলেই বোধ হয় আর কারুর ভক্তিশ্রদ্ধা উথলে উঠে।
ঊষা মুখ তুলিয়া চাহিয়া প্রশ্ন করিল, স্বামীর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করার চেষ্টাকে কি উঞ্ছবৃত্তি বলে ঠাকুরঝি?
ক্ষেত্রমোহন তৎক্ষণাৎ বলিয়া উঠিলেন, না, বলে না। পৃথিবীর কোন ভদ্রব্যক্তিই এমন কথা মুখে আনতেও পারে না। কিন্তু স্বামীর চক্ষে স্ত্রীকে নিরন্তর হীন প্রতিপন্ন করবার চেষ্টাকে হৃদয়ের কোন্ প্রবৃত্তি বলে, আপনার ঠাকুরঝিকে বরঞ্চ জিজ্ঞাসা করে নিন।
বিভার মুখ দিয়া সহসা কোন কথা বাহির হইল না। অভিভূতের মত একবার সে বক্তার মুখের দিকে, একবার শৈলেশের মুখের দিকে নির্বাক হইয়া চাহিয়া রহিল। এতগুলি লোকের সমক্ষে তাহার স্বামী যে যথার্থই তাহাকে এমন করিয়া আঘাত করিতে পারে প্রথমে সে যেন বিশ্বাস করিতেই পারিল না। তার পরে শৈলেশের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া হঠাৎ কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, এর পরে আর ত তোমার বাড়িতে আসতে পারিনে দাদা! আমি তা হলে চিরকালের মতই চললুম।
শৈলেশ ব্যাকুল হইয়া উঠিল। ঊষা হাতের কাজ ফেলিয়া শশব্যস্তে উঠিয়া দাঁড়াইয়া তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল, আমরা ত তোমাকে কোন কথা বলিনি ভাই!
হঠাৎ একটা বিশ্রী কাণ্ড হইয়া গেল, এবং এই গণ্ডগোলের মধ্যে ক্ষেত্রমোহন নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেলেন। বিভা হাত ছাড়াইয়া লইয়া চোখ মুছিতে মুছিতে বলিল, আমি যখন আপনার কেবল শত্রুতাই করচি, তখন এ বাড়িতে আমার আর কিছুতেই প্রবেশ করা উচিত নয়।
ঊষা কহিল, কিন্তু এমন কথা আমি ত কোনদিন মনেও ভাবিনি ঠাকুরঝি!
বিভা কানও দিল না। অশ্রুবিকৃত স্বরে বলিতে লাগিল, আজ উনি মুখের উপর স্পষ্ট বলে গেলেন, কাল হয়ত দাদাও বলবেন তাঁর নূতন ঘর-সংসারের মধ্যে কথা কইতে যাওয়া শুধু অপমান হওয়া।
উমা, বাড়ি যাও ত এস। এই বলিয়া সে নীচে নামিতে উদ্যত হইয়া কহিল, বৌদিদি যখন নেই, তখন এ বাড়িতে পা দিতে যাওয়া চাই আমাদের ভুল। এবার বাড়ির সকল সম্বন্ধই আমার ঘুচল। এই বলিয়া সে সিঁড়ি দিয়া নীচে চলিয়া গেল। শৈলেশ পিছনে পিছনে নামিয়া আসিয়া সসঙ্কোচে কহিল, নাহয়, আমার লাইব্রেরি ঘরে এসেই একটু বস্ না বিভা।
বিভা ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না। কিন্তু আমার বৌদিদিকে একেবারে ভুলে যেও না দাদা। তাঁর বড় ইচ্ছে ছিল, সোমেন বিলাতে গিয়ে লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়—দোহাই তোমার, তাকে নষ্ট হতে দিয়ো না। আজ তাকে যেভাবে চোখে দেখতে পেলুম, এই শিক্ষাই যদি তার চলতে থাকে, সমাজের মধ্যে আর মুখ দেখাতে পারব না।
তাহার অশ্রু-গদগদ কণ্ঠস্বরে বিচলিত হইয়া শৈলেশ মিনতি করিয়া কহিল, তুই আমার বাইরের ঘরে বসবি চল্ বোন, এমন করে চলে গেলে আমার কষ্টের সীমা থাকবে না।
বিভার চোখ দিয়া পুনরায় জল গড়াইয়া পড়িল। সোমেনের ভবিষ্যৎ চিন্তা করিয়া কিনা জানি না, কিন্তু অঞ্চলে অশ্রু মুছিয়া বলিল, কোথাও গিয়ে আর বসতে চাইনে দাদা, কিন্তু সোমেন আমাদের বাপের কুলে একমাত্র বংশধর, তার প্রতি একটু দৃষ্টি রেখো, একেবারে আত্মহারা হয়ে যেয়ো না দাদা। এই বলিয়া সে সোজা বাহির হইয়া আসিয়া তাহার গাড়িতে গিয়া উপবেশন করিল। উমা বরাবর নীরব হইয়াই ছিল, এখনও সে একটি কথাতেও কথা যোগ করিল না, নিঃশব্দে বিভার পার্শ্বে গিয়া স্থান গ্রহণ করিল।
শৈলেশ সঙ্গে সঙ্গে আসিয়া হঠাৎ বলিয়া ফেলিল, বিভা, সোমেনকে নাহয় তুই নিয়ে যা। তোর নিজের ছেলেপুলে নেই, তাকে তুই নিজের মত করেই মানুষ করে তোল্।
বিভা এবং উমা উভয়েই একান্ত বিস্ময়ে শৈলেশের মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল। বিভা কহিল, কেন এই নিরর্থক প্রস্তাব করচ দাদা, এ তুমি পারবে না—তোমাকে পারতেও দেব না।
শৈলেশ ঝোঁকের উপর জোর করিয়া উত্তর করিল, আমি পারবই—এই তোকে কথা দিলাম বিভা।
বিভা সন্দিগ্ধকণ্ঠে মাথা নাড়িয়া কহিল, পার ভালই। তাকে পাঠিয়ে দিয়ো। তাকে উচ্চশিক্ষা দেবার টাকা যদি তোমার না থাকে, আমিও কথা দিচ্চি দাদা, সে ভার আজ থেকে আমি নিলাম। এই বলিয়া সে উমার দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া দেখিল, উপরে বারান্দায় দাঁড়াইয়া ঊষা নীচে তাদের দিকেই চাহিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। পরক্ষণে মোটর ছাড়িয়া চলিয়া গেলে ভিতরে প্রবেশ করিয়া শৈলেশ তাহার পড়িবার ঘরে গিয়া বসিল। উপরে যাইতে তাহার ইচ্ছাও হইল না, সাহসও ছিল না, সমস্ত কথাই যে ঊষা শুনিতে পাইয়াছে, ইহা জানিতে তাহার অবশিষ্ট ছিল না।
নয়
রাত্রে খাবার দিয়া স্বামীকে ডাকিতে পাঠাইয়া ঊষা অন্যান্য দিনের মত নিকটে বসিয়াছিল। শুধু সোমেন আজ তাহার কাছে ছিল না। হয়ত সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, কিংবা এমনি কিছু একটা হইবে। শৈলেশ আসিল, তাহার মুখ অতিশয় গম্ভীর। হইবারই কথা। ব্যর্থ প্রশ্ন করা ঊষার স্বভাব নয়, আজিকার ঘটনা সম্বন্ধে সে কোনও কথা জিজ্ঞাসা করিল না, এবং যাহা জানে না, তাহা জানিবার জন্যও কোন কৌতূহল প্রকাশ করিল না। স্ত্রীর এই স্বভাবের পরিচয়টুকু অন্ততঃ শৈলেশ এই কয়দিনেই পাইয়াছিল। আহারে বসিয়া মনে মনে সে রাগ করিল, কিন্তু আশ্চর্য হইল না। ক্ষণে ক্ষণে আড়চোখে চাহিয়া সে স্ত্রীর মুখের চেহারা দেখিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু তাহার নিশ্চয় বোধ হইল, ঊষা ইচ্ছা করিয়াই আলোটার দিকে আড় হইয়া বসিয়াছে। অন্যান্য দিনের মত সে খাইতে পারিল না। যেজন্য আজ তাহার আহারে রুচি ছিল না তাহার কারণ আলাদা, তথাপি জিজ্ঞাসা না করা সত্ত্বেও গায়ে পড়িয়া শুনাইয়া দিল যে, অনভ্যস্ত খাওয়া-পরা শুধু দু-চার দিনই চলিতে পারে, কিন্তু প্রাত্যহিক ব্যাপারে দাঁড় করাইলে আর স্বাদ থাকে না, তখন অরুচি অত্যাচারে গিয়ে দাঁড়ায়।
কথাটা তর্কের দিক দিয়া যাই হোক, এ ক্ষেত্রে সত্য নয় জানিয়া ঊষা চুপ করিয়া রহিল। মিথ্যা জিনিসটা যে নিশ্চয়ই মিথ্যা, ইহা প্রমাণ করিবার জন্য তর্ক করিতে কোনদিনই তাহার প্রবৃত্তি হইত না। কিন্তু এমন করিয়া নিঃশব্দে অস্বীকার করিলে প্রতিপক্ষের রাগ বাড়িয়া যায়। তাই শুইতে আসিয়া শৈলেশ খামকা বলিয়া উঠিল, আমরা তোমার প্রতি একদিন অতিশয় অন্যায় করেছিলাম তা মানি, কিন্তু তাই বলেই আজ তোমার ছাড়া আর কারও ব্যবস্থাই চলবে না এও ত ভারি জুলুম!
এরূপ শক্ত কথা শৈলেশ প্রথম দিনটাতেও উচ্চারণ করে নাই। ঊষা মনে মনে বোধ হয় অত্যন্ত বিস্মিত হইল, কিন্তু মুখে শুধু বলিল, আমি বুঝতে পারিনি।
কিন্তু এমন করিয়া অত্যন্ত বিনয়ে কবুল করিয়া লইলে আরও রাগ বাড়ে।
শৈলেশ কহিল, তোমার বোঝা উচিত ছিল। আমাদের শিক্ষা, সংস্কার, সমাজ সমস্ত উল্টে দিয়ে যদি এ বাড়িকে তোমার বাপের বাড়ি বানিয়ে তুলতে চাও ত আমাদের মত লোকের পক্ষে বড় মুস্কিল হতে থাকে। সোমেনকে বোধ হয় কাল ওর পিসির বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হবে। তুমি কি বল?
ঊষা কহিল, ওর ভালর জন্যে যদি প্রয়োজন হয় ত দিতে হবে বৈ কি।
তাহার বলার মধ্যে উত্তাপ বা শ্লেষ কিছুই ধরিতে না পারিয়া শৈলেশ দ্বিধার মধ্যে পড়িল। কিসের জন্য যে এসব করিতেছে তাহার হেতুও মনের মধ্যে বেশ দৃঢ় এবং সুস্পষ্ট নয়; কিন্তু এই সকল দুর্বল-প্রকৃতির মানুষের স্বভাবই এই যে, তাহারা কাল্পনিক মনঃপীড়া ও অসঙ্গত অভিমানের দ্বার ধরিয়া ধাপের পর ধাপ দ্রুতবেগে নামিয়া যাইতে থাকে। একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া কহিল, হ্যাঁ, প্রয়োজন আছে বলেই সকলের বিশ্বাস।
যে-সব আচার-ব্যাবহার রীতিনীতি আমরা মানিনে, মানতে পারিনে, তাই নিয়ে অযথা ভাইবোনের মধ্যে বিবাদ হয়, সমাজের কাছে পরিহাসের পাত্র হতে হয়—এ আমার ভাল লাগে না।
ঊষা প্রতিবাদ করিল না, নিজের দিক হইতে কৈফিয়ত দিবার চেষ্টা মাত্র করিল না, কিন্তু তাহার মুখ দিয়া হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস পড়িল, নিস্তব্ধ ঘরের মধ্যে শৈলেশের তাহা কানে গেল। ঊষা নিজে কলহ করে নাই, তাহার পক্ষ লইয়া বিভার প্রতি যত কটু কথা উচ্চারিত হইয়াছে, তাহার একটিও যে ঊষার নিজের মুখ দিয়া বাহির হয় নাই, তাহা এতখানিই সত্য যে সে লইয়া ইঙ্গিত করাও চলে না, ভুলাও যায় না। সুতরাং ক্ষেত্রমোহনের দুষ্কৃতির শাস্তি যে আর একজনের স্কন্ধে আরোপিত হইতেছে না—ইহাতে প্রতিহিংসার কিছুই যে নাই—ইহাই সপ্রমাণ করিতে সে পুনশ্চ কহিল, যাকে বিলেতে গিয়ে লেখাপড়া শিখতে হবে, যে সমাজের মধ্যে তাকে চলাফেরা করতে হবে, ছেলেবেলা থেকে তার সেই আবহাওয়ার মধ্যে মানুষ হওয়া আবশ্যক। শিশুকালটা তার অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে কাটতে দেওয়া তার প্রতি গভীর অন্যায় এবং অবিচার করা হবে। এই বলিয়া সে ক্ষণকাল উত্তরের জন্য অপেক্ষা করিয়া কহিল, এ সম্বন্ধে তোমার বলবার কিছু না থাকে ত স্বতন্ত্র কথা। কিন্তু মুখ বুজে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেললেই তার জবাব হয় না। সোমেনের সম্বন্ধে আমরা রীতিমত চিন্তা করেই তবে স্থির করেচি।
সোমেন পাশেই ঘুমাইতেছিল। এ বাটীতে আর কোন স্ত্রীলোক না থাকায় আসিয়া পর্যন্ত ঊষা তাহাকে নিজের কাছে লইয়া শয়ন করিত। তাহার নিদ্রিত ললাটের উপর সে সস্নেহে ও সন্তর্পণে বাম হাতখানি রাখিয়া ধীরে ধীরে কহিল, যাই কেননা স্থির কর, ছেলের কল্যাণের জন্যই তুমি স্থির করবে। এ ছাড়া আর কি কেউ কখনও ভাবতে পারে! বেশ ত, তাই তুমি করো।
ইলেকট্রিক আলোগুলি নিবাইয়া দিয়া ঘরের কোণে মিট্মিট্ করিয়া একটা তেলের প্রদীপ জ্বলিতেছিল, সেই সামান্য আলোকে শৈলেশ নিজের বিছানায় উঠিয়া বসিয়া অদূরবর্তী শয্যায় শায়িত ঊষার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, তা ছাড়া সে সোমেনের সমস্ত পড়ার খরচ দেবে বলেচে। সে ত কম নয়!
ঊষার কণ্ঠস্বরে কিছুতেই উত্তেজনা প্রকাশ পাইত না। শান্তভাবে কথা কহাই তাহার প্রকৃতি। কহিল, না, সে হতে পারবে না। ছেলে মানুষ করবার খরচ দিতে আমি তাকে দিতে পারব না।
শৈলেশ কহিল, সে যে অনেক টাকার দরকার।
ঊষা তেমনি শান্তকণ্ঠে বলিল, দরকার হয় দিতে হবে। কিন্তু আর রাত জেগো না, তুমি ঘুমোও।
পরদিন অপরাহ্নকালে শৈলেশ কলেজ ও ক্লাব হইতে বাড়ি ফিরিয়া রান্নার একপ্রকার সুপরিচিত ও সুপ্রিয় গন্ধের ঘ্রাণ পাইয়া বিস্মিত ও পুলকিতচিত্তে তাহার পড়ার ঘরে প্রবেশ করিল। অনতিকাল পরে চা ও খাবার লইয়া যে ব্যক্তি দর্শন দিলেন, শৈলেশ মুখ তুলিয়া চাহিয়া দেখিল, সে মুসলমান।
রাত্রে খাবার ঘরে আলো জ্বলিল, এবং সজ্জিত টেবিলের চেহারা দেখিয়া শৈলেশ মনে মনে অস্বীকার করিতে পারিল না যে, ইহার জন্য অত্যন্ত সঙ্গোপনে মন তাহার সত্যই ব্যগ্র এবং ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিল।
ডিনার তখনও দুই-একটা ডিসের অধিক অগ্রসর হয় নাই, ঊষা আসিয়া একখানা চৌকি টানিয়া লইয়া একটু দূরে বসিল।
শৈলেশের মন প্রসন্ন ছিল, ঠাট্টা করিয়া বলিল, ঘরে ঢুকলে জাত যাবে না? ঘ্রাণেও যে অর্ধভোজনের কথা শাস্ত্রে লেখা আছে।
ঊষা অল্প একটুখানি হাসিয়া কহিল, এ তোমার উচিত নয়। যে শাস্ত্রকে তুমি মান না, গণ না, তার দোহাই দেওয়া তোমার সাজে না।
শৈলেশও হাসিল। কহিল, আচ্ছা হার মানলুম। কিন্তু শাস্ত্রের দোহাই আমিও দেব না, তুমিও কিন্তু পালিয়ো না। তবে এ কথা নিশ্চয় যে, ভাগ্যে কাল খোঁটা দিয়েছিলুম, তাই ত আজ এমন বস্তুটি অদৃষ্টে জুটল! ঠিক না ঊষা? কিন্তু খরচপত্র কি তোমার খুব বেশি পড়বে?
ঊষা ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না। অপব্যয় না হলে কোন খাবার জিনিসেই খুব বেশি পড়ে না। আসচে মাস থেকে আমি নিজেই এসব করব ভেবেছিলাম। কিন্তু এইটি দেখ, জিনিসপত্র বৃথা নষ্ট যেন না হয়। আমার খরচের খাতায় যেমনটি লিখে রেখেচি, ঠিক তেমনটি যেন হয়। হবে ত?
শৈলেশ আশ্চর্য হইয়া বলিল, কেন হবে না শুনি?
ঊষা তৎক্ষণাৎ ইহার উত্তর দিতে পারিল না। ক্ষণকাল নীরবে নিচের দিকে চাহিয়া থাকিয়া সহসা মুখ তুলিয়া স্বামীর মুখের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া কহিল, কাল সারারাত ভেবে ভেবে আমি যা স্থির করেচি তাকে অস্থির করবার জন্য আমাকে আদেশ করো না, তোমার কাছে আমার এই মিনতি।
শৈলেশ আর্দ্রচিত্তে কহিল, তা ত আমি কোনদিন করবার চেষ্টা করিনে ঊষা! আমি নিশ্চয় জানি, তোমার সিদ্ধান্ত তোমারই যোগ্য। তার নড়চড় হয়ও না, হওয়া উচিতও নয়। আমি দুর্বল, কিন্তু তোমার মন তেমনি সবল, তেমনি দৃঢ়।
স্বামীর মুখের উপর হইতে ঊষা দৃষ্টি সরাইয়া লইয়া ধীরে ধীরে কহিল, সত্যিই আর কিছু হবার নয়, আমি অনেক ভেবে দেখেচি।
শৈলেশ নিশ্চয়ই বুঝিল ইহা সোমেনের কথা। সহাস্যে কহিল, ভূমিকা ত হল, এখন স্থির কি করেচ বল ত? আমি শপথ করে বলতে পারি তোমাকে কখনো অন্যথা করতে অনুরোধ করব না।
ঊষা মিনিটখানেক চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তার পরে বলিল, দাদার সংসারে আমার চলে যাচ্ছিল—বিশেষ কোন কষ্ট ছিল না। কাল আবার আমি তাঁদের কাছেই যাব।
তাঁদের কাছে যাবে? কবে ফিরবে?
ঊষা বলিল, তুমি আমাকে ক্ষমা করো, ফিরতে আর আমি পারব না। আমি অনেক চিন্তা করে দেখেচি, এখানে আমার থাকা চলবে না। এই আমার শেষ সিদ্ধান্ত।
কথা শুনিয়া শৈলেশ একেবারে যেন পাথর হইয়া গেল। বুকের মধ্যে তাহার সমস্ত চিত্ত যেন নিরন্তর মুগুর মারিয়া মারিয়া কহিতে লাগিল, যে লৌহকবাট রুদ্ধ হইয়া গেল, তাহা ভাঙ্গিয়া ফেলিবার সাধ্য এ দুনিয়ায় কাহারও নাই।
দশ
সকালে ঘুম ভাঙ্গিয়া শৈলেশের প্রথমেই মনে হইল, সারারাত্রি ধরিয়া সে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখিয়াছে। জানালা দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিল ঊষা নিত্যনিয়মিত গৃহকর্মে ব্যাপৃতা,—সোমেন সঙ্গে, বোধ হয় সে খাবার তাগাদায় আছে। সিঁড়িতে নামিবার পথে দেখা হইতে ঊষা মুখ তুলিয়া কহিল, তোমার চা তৈরি করে ফেলেচে, মুখহাত ধুতে দেরি করলে সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে কিন্তু। একটু তাড়াতাড়ি নিয়ো।
শৈলেশ কহিল, বেশ ত, তুমি পাঠিয়ে দাও গে, আমার এক মিনিট দেরি হবে না। এই বলিয়া সে যেন লাফাইতে লাফাইতে গিয়া তাহার বাথরুমে প্রবেশ করিল। মনে মনে কহিল, আচ্ছা ইডিয়ট আমি? দাম্পত্য-কলহের যুদ্ধ-ঘোষণাকে ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা জ্ঞান করিয়া রাত্রিটা যে তাহার অশান্তি ও দুশ্চিন্তায় কাটিয়াছে, সকালবেলায় এই কথা মনে করিয়া সুদ্ধ তাহার হাসি পাইল তাই নয়, নিজের কাছে লজ্জা বোধ হইল। সংসার করিতে একটা মতভেদ বা দুটা কথা-কাটাকাটি হইলেই স্ত্রী যদি স্বামীগৃহ ছাড়িয়া দাদার ঘরে গিয়া আশ্রয় লইত, দুনিয়ায় ত তাহা হইলে মানুষ বলিয়া আর কোন জীবই থাকিত না। সোমেনের মা হইলেও বা দু-দশ দিনের জন্য ভয় ছিল, কিন্তু ঊষার মত নিছক হিন্দু-আদর্শে গড়া স্ত্রী,—ধর্ম ও স্বামী ভিন্ন সংসারে আর যাহার কোন চিন্তাই নাই, সে যদি তাহার একটা রাগের কথাকেই তাহার আজন্মের শিক্ষা ও সংস্কারকে ছাড়াইয়া যাইতে দেয়, তাহা হইলে সংসারে আর বাকি থাকে কি? এবং এ লইয়া ব্যস্ত হওয়ার বেশি পাগলামিই বা কি আছে, ইহাই অসংশয়ে উপলব্ধি করিয়া তাহার ভয় ও ভাবনা মুছিয়া গিয়া হৃদয় শান্তি ও প্রীতির রসে ভরিয়া উঠিল। এবং ঠিক ইচ্ছা না করিয়াও সে ঊষার সঙ্গে বিভার ও তাহাদের শিক্ষিত সমাজে আরও দুই-চারিজন মহিলার মনে মনে তুলনা করিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, থাক বাবা, আর কাজ নেই, আমার নিজের মেয়ে যদি কখনও হয় ত সে যেন তার মায়ের মতই হয়। এমনি ধারা শিক্ষা-দীক্ষা পেলেই আমি ভগবানকে ধন্যবাদ দেব। এই বলিয়া সে তাড়াতাড়ি কাজ সারিয়া মিনিট পাঁচ-ছয়ের মধ্যেই তাহার পড়িবার ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইল।
নবনিযুক্ত মুসলমান খানসামা চা, রুটি, মাখন, কেক প্রভৃতি প্রাতরাশের আয়োজন লইয়া হাজির হইতে তাহার হঠাৎ যেন চমক লাগিল। এই সকল বস্তুতেই সে চিরদিন অভ্যস্ত, মাঝে কেবল দিন কয়েক বাধা পড়িয়াছিল মাত্র; কিন্তু টেবিলে রাখিয়া দিয়া বেহারা চলিয়া গেলে এই জিনিসগুলির পানে চাহিয়াই আজ তাহার অরুচি বোধ হইল; ঊষা গৃহে আসিয়া পর্যন্ত এই সকলের পরিবর্তে নিমকি, কচুরি প্রভৃতি স্বহস্ত-রচিত খাদ্যদ্রব্য সকালের চায়ের সঙ্গে আসিত, সে নিজে উপস্থিত থাকিত, কিন্তু আজ তাহার কোনটাই নাই দেখিয়া, তাহার আহারে প্রবৃত্তি রহিল না। শুধু এক পেয়ালা চা কেৎলি হইতে নিজে ঢালিয়া লইয়া খানসামাকে ডাকিয়া সমস্ত বিদায় করিয়া দিয়া শৈলেশ পর্দার বাহিরে একটা অত্যন্ত পরিচিত পদধ্বনির আশায় কান খাড়া করিয়া রাখিল।
এবং না-খাওয়ার কৈফিয়ত যে একটু কড়া করিয়াই দিবে, এই মনে করিয়া সে ধীরে ধীরে অযথা দেরি করিয়া পেয়ালা যখন শেষ করিল, তখন চা ঠাণ্ডা এবং বিস্বাদ হইয়া গেছে; ফিরিয়া আসিয়া লোকটা শূন্য পেয়ালা তুলিয়া লইয়া গেল, কিন্তু আকাঙ্ক্ষিত পায়ের শব্দ আর শোনা গেল না, ঊষা ঘরে প্রবেশ করিল না।
ক্রমে বেলা হইয়া উঠিল, স্নানাহার সারিয়া কলেজের জন্য প্রস্তুত হইবে। খাবার সময় আজও ঊষা অন্যান্য দিনের মত কাছে আসিয়া বসিল; তাহার আগ্রহ, যত্ন বা কথাবার্তার মধ্যে কোন প্রভেদ বাড়ির কাহারও কাছে ধরা পড়িল না, পড়িল শুধু শৈলেশের কাছে। একটা রাত্রির মধ্যে একটা লোক যে বিনা চেষ্টায়, বিনা আড়ম্বরে কতদূরে সরিয়া যাইতে পারে, ইহাই উপলব্ধি করিয়া সে একেবারে স্তব্ধ হইয়া রহিল। কলেজ যাইবার পোশাক পরিতে এ ঘরে ঢুকিয়া এখন প্রথমেই তাহার চোখে পড়িল টেবিলের উপরে সংসার-খরচের সেই ছোট্ট খাতাটি।হয়ত কাল হইতেই এমনি পড়িয়া আছে, সে লক্ষ্য করে নাই—না হইলে তাহারই জন্য ঊষা এইমাত্র রাখিয়া গেছে তাহা সম্ভবও নয়, সত্যও নয়। আজও ত মাস শেষ হয় নাই—অকস্মাৎ এখানে ইহার প্রয়োজন হইলই বা কিসে? তথাপি গলায় টাই বাঁধা তাহার অসমাপ্ত রহিল, কতক কৌতূহলে, কতক অন্যমনস্কতাবশে একটি একটি করিয়া পাতা উলটাইয়া একেবারে শেষ পাতায় আসিয়া থামিল। পাতায় পাতায় একই কথা—সেই মাছ, শাক, আলু, পটল, চালের বস্তা, দুধের দাম, চাকরের মাইনে—কাল পর্যন্ত জমা বইতে খরচ বাদ দিয়া মজুত টাকার অঙ্ক স্পষ্ট করিয়া লেখা। এই লেখা যেদিন আরম্ভ হয়, সেদিন সে এলাহাবাদে। তখনও তাহার হাত ছিল না, আজ এইখানেই যদি ইহার সমাপ্তি ঘটে তাহাতেও তেমনি হাত নাই। বহুক্ষণ পর্যন্ত প্রথম দিনের প্রথম পাতাটির প্রতি শৈলেশ নির্নিমেষ চক্ষে চাহিয়া রহিল। এই জিনিসটা সংসারে তাহার দু’দিনের ব্যাপার। আগেও ছিল না, পরেও যদি না থাকে ত সংসার অচল হইয়া থাকিবে না,—দু’দিন পরে হয়ত সে নিজেই ভুলিবে। তবুও কত কি-ই না মনে হয়। খাতাটা বন্ধ করিয়া দিয়া পুনশ্চ টাই বাঁধার কাজে আপনাকে নিযুক্ত করিয়া হঠাৎ এই কথাটাই আজ তাহার সবচেয়ে বড় বলিয়া মনে হইতে লাগিল, এ জগতে কোন কিছুর মূল্যই একান্ত করিয়া নির্দেশ করা চলে না। এই খাতা, এই হিসাব লেখারই একদিন প্রয়োজনের অবধি ছিল না, আবার একদিন সেই-সকলই না কতখানি অকিঞ্চিৎকর হইতে চলিল।
অবশেষে পোশাক পরিয়া শৈলেশ যখন বাহির হইয়া গেল, তখন সহস্র ইচ্ছা সত্ত্বেও সে ঊষাকে ডাকিয়া কোন কথাই জিজ্ঞাসা করিতে পারিল না। অপরিজ্ঞাত ভবিষ্যতের মধ্যে মন তাহার বারংবার আছাড় খাইয়া মরিতে লাগিল, তথাপি অনিশ্চয় আশঙ্কাকে সুনিশ্চিত দুর্ঘটনায় দৃঢ় করিয়া লইবার সাহসও সে নিজের মধ্যে কোনক্রমেই খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিল না।