নববর্ষ

নববর্ষ

০১.

প্রবুদ্ধ মানুষের জাগ্রত জীবন প্রতি নববর্ষে নবজীবনের দ্বার উন্মুক্ত করে। যে-মানুষ দু:খী, যে-মানুষ জিজ্ঞাসু ও অন্বেষ্টা, সে-মানুষেরই আসে নবজীবনের আহ্বান। কেননা, সুখ ও তৃপ্তি বন্ধ্যা। দুঃখ ও আর্তিই কেবল সৃষ্টিশীল। সুখ ও তৃপ্তি লক্ষেই মানুষের জীবন-প্রয়াস নিয়োজিত বলেই সুখ ও তৃপ্তি স্বস্তি আনে এবং তখন প্রয়াসের প্রেরণা অবসিত হয়। বঞ্চিতের অভাববোধই অভিপ্রায় ও আকাঙ্ক্ষা হয়ে প্রয়াসে ও সগ্রামে রূপ পায়।

নববর্ষের পূর্বাশার নতুন সূর্য জাগ্রত মানুষের মনে নতুন আশা জাগায়। ভরসাপুষ্ট মানুষ হৃত অতীতের আচ্ছন্নতা ও অবসাদ পরিহার করে নবোদ্যমে এগিয়ে চলে উত্তরণের পথে সাফল্যের স্বর্ণমিনার লক্ষ্যে। তখন সে অকুতোভয়, আত্মপ্রত্যয়ে দুর্জয় ও অত্যুঙ্গ আকাঙ্ক্ষায় উদ্দীপ্ত। তখন তার অমিততেজ, অপরিমেয় উদ্যম। প্রতি নববর্ষে প্রবুদ্ধ-চেতনা উজ্জ্বল প্রাণবন্যার উত্তল ঊর্মি হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে চারদিকে। জাগিয়ে দেয় ও মাতিয়ে তোলে আধমরা, আধ-ভোলা বিকৃত চেতনার মানুষগুলোকে। বর্ষণের ছোঁয়া-লাগা দূর্বার মতো জেগে উঠে জীবন্ত মানুষ, প্রাণের সাড়া দোলা দিয়ে যায় চিন্তায় ও কর্মে। . নববর্ষ তাই নবজীবনের নকীব। নববর্ষ চেতনাকে ঢালাই করবার, চিন্তাকে ঝালাই করবার এবং ক্রটি শোধনের, ভ্রান্তি নিরসনের ও নব পরিকল্পনায় জীবন-রচনার আহ্বান জানায়। প্রতি নববর্ষ তাই এক-একটি জীবন-বসন্ত। হৃত-অতীতের সুপ্তি থেকে, গ্লানি থেকে, ব্যর্থতা থেকে, অনুশোচনা থেকে নির্জিত জীবনকে নববর্ষের বাসন্তী হাওয়ায় উজ্জীবিত করে চেতনার কিশলয়ে, চিন্তার প্রসূনে, প্রাণময়তার পরাগে মণ্ডিত করার লগ্নরূপে আসে এক-একটি নববর্ষ।

আমাদের জীবনে নববর্ষের প্রথমদিন আসে আমাদের জন্মদিনের মতো হয়ে। জন্মবার্ষিকী কিংবা বিবাহবার্ষিকীর দিনটি যেমন আনন্দের ও উৎসবের, মনের উপর এর যেমন একটি স্বপ্ন-মধুর ও অনুভূতি-সুন্দর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে, নববর্ষের প্রথম দিনও আমাদের প্রাণে তেমনি এক আনন্দ সুন্দর শিহরণ জাগায়। স্বল্প-অনুভূত এক অব্যক্ত মাধুর্যে, এক অস্ফুট উষার আভাসিত লগ্নের লাবণ্যে, এক সুদিনের অনুচ্চারিত আশ্বাসে আমাদের চিত্তলোক ভরে তোলে এই নববর্ষ।

.

০২.

মধ্যযুগেও আমাদের দেশে নববর্ষের উৎসব হত। শাসকগোষ্ঠীও উদ্‌যাপন করত নওয়োজ। কিন্তু আমাদের মধ্যযুগীয় চেতনায় এর গুরুত্ব যতটা বৈষয়িক ছিল, মানসিক ছিল না ততটা। তাই এর পার্বণিক প্রকাশ নিষ্প্রাণ রেওয়াজে ছিল সীমিত, কখনো তা মানস-বিকাশের সহায়ক হয়ে উঠেনি। স্থিতিশীলতার সাধক মধ্যযুগীয়, মানুষ তাই জন্মদিন পালন করত না, মৃত্যুদিবসই স্মরণীয় করে রাখবার প্রয়াসী ছিল। জন্মোৎসবে আমাদের আগ্রহ জাগে প্রতীচ্য প্রভাবে। জন্ম ও জীবনের মহিমা প্রতীচ্য প্রভাবেই আমাদের হৃদয়বেদ্য হয়ে উঠে। সেই থেকে বছরান্তে জন্মদিন কিংবা নববর্ষ আমাদের জন্যে নবজীবনের, নবজাগরণের ও নতুন আশার বাণী বয়ে আনে।

পাশ্চাত্য প্রভাব গাঢ় হওয়ার সাথে সাথে আফ্রো-এশিয়ার গণমনের সুপ্তি টুটে গেল, তখন জাগ্রত জীবনের চাঞ্চল্যে জন্ম নিল দুর্বার আকাঙ্ক্ষা। সম্ভাবনার প্রসারিত দিগন্তে মনবিহঙ্গ পক্ষ বিস্তার করল জীবনের অনন্ত তৃষ্ণাতৃপ্তির বাসনা নিয়ে। মন-চাতকের সে অভিসারে ছিল অভিযানের আয়োজন ও দাপট। কেননা অভিপ্রেত বর্ষণবিন্দু নির্বিঘ্নে লভ্য যে নয়, তা বোঝা কঠিন ছিল না। প্রলয়ঙ্কর ঝড়ের মুখেই যে অগ্রসর হতে হবে, তা তারা কেবল জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়েই নয়, প্রাণের মধ্যেও অনুভব করেছিল। সে ঝড় কালবৈশাখীর ঝড়; কালান্তরের, রূপান্তরের ও বিবর্তনের ঝড়–সেই যুগান্তকর বিপ্লবী ঝড় ভাঙল বিশ্বাস, টুটল সংস্কার, উড়িয়ে নিল অন্ধতা, ঝেটিয়ে নিল ভীরুতা, আরো নিল কত কত জান-মাল। সে-ঝড়ে আনল রক্তবন্যা, জাগাল রক্তোচ্ছাস। প্রাণের প্রেরণাপ্রসূত জীবনতৃষ্ণা তাতে আরো তীব্র হয়ে, তীরতীক্ষ্ণ সংকল্প হয়ে দুর্জয় করে তুলল গণমানবকে। তারই ফলে এ শতকের প্রথম সূর্যের কাল থেকে জাগ্রত গণমানব জগতের কোথাও না-কোথাও প্রতিদিন কোন-না-কোনো ক্ষেত্রে মরণপণ সংগ্রামে জয়ী হচ্ছে। সংগ্রাম চলছে পরাধীনতার বিরুদ্ধে, পীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে, অজ্ঞতার ও অবিদ্যার বিরুদ্ধে, দারিদ্র্য ও বৈষম্যর বিরুদ্ধে, অন্যায় ও অধর্মের বিরুদ্ধে। সংগ্রাম শুরু হয়েছে রোগ-জরা মৃত্যুর বিরুদ্ধে, প্রকৃতির কার্পণ্য ও রহস্যময়তার বিরুদ্ধে।

আমাদের দেশেও সংগ্রাম চলছে। সগ্রামী গণমানব আজ সুন্দর ও কল্যাণের অন্বেষ্টা। নৈতিক ও বৈষয়িক অধিকার প্রতিষ্ঠায় চেতনা-চঞ্চল মানুষ আজ সংগ্রাম-মুখর। কিন্তু তার মানস-নৈপুণ্য অশিক্ষাজাত অপ্রত্যয়ে আজো অনার্জিত ও অনায়ত্ত। তাই তার সগ্রাম বহুমুখী ও সর্বাত্মক হয়ে উঠতে পারেনি, পারেনি সে বিচিত্র ও বহুধা আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেলিত হতে। তাই তার দুঃখ ঘোচেনি, সংগ্রাম পায়নি পূর্ণতা, সিদ্ধি রয়েছে অনায়ত্ত, সুখ-স্বস্তি-স্বাচ্ছন্দ্য রয়েছে দৃষ্টিসীমার বাইরে।

নববর্ষের প্রথম সূর্যের আলোয় তার সংগ্রামী সংকল্প ঝালাই করবার, দৃঢ়তর করবার সুযোগ আসে বৎসরান্তে একবার। এই শতকে পলাশ-লাল সূর্য মন ও মাটি রাঙিয়ে রাঙিয়ে নবজীবনের আলপনা এঁকে দিচ্ছে। দেশে দেশে ঘরে ঘরে সেই রাঙা-প্রভাতের প্রসাদ-পুষ্ট মানুষ তৈরি হচ্ছে, যারা রচনা করবে নতুন জগৎ ও মহিমান্বিত নবীন জীবন। মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান-মানববাদীর এই মন্ত্রে দীক্ষা নেবার লগ্ন হচ্ছে নববর্ষের প্রথম প্রভাত। প্রতি নববর্ষই মুক্তির প্রতীক। অজ্ঞতা, অন্ধতা, অবিদ্যা আর অন্যায়, পীড়ন, শোষণ, দারিদ্র্য থেকে কাম্য-মুক্তির প্রতিভূ প্রতিটি নতুন বছর। প্রতিটি নববর্ষ হচ্ছে মুক্তির প্রমূর্ত সংকল্প, শপথ ও সংগ্রাম। মানব-মুক্তি সংগ্রামে, মানবকল্যাণে আমার দেহ-মন-আত্মা নিয়োজিত হোক, সমর্পিত হোক–নববর্ষের প্রথম প্রভাতে এই দৃপ্ত শপথ স্মরণ করেই শুরু হোক এ বছরের জীবন।

.

০৩.

বিশ শতকের পলাশ-লাল সূর্য বিশ্বমানবের জন্যে মুক্তির বাণী বয়ে এনেছিল। সে-সূর্য আজো রোজ ভোরে খুন-রাঙা রূপ নিয়ে পূর্বাশায় উদিত হয়। বদ্ধ মানুষকে দেয় আশ্বাস ও অভয়, শোনায় আশার বাণী, পীড়ক-শোষকদের করে দেয় সতর্ক।

বিশ শতকের সূর্য প্রতি প্রভাতে মানুষের জন্যে মুক্তি বয়ে আছে। সে-মুক্তি আসে পরাধীনতা থেকে, অজ্ঞতা থেকে, অবিদ্যা থেকে, অশিক্ষা থেকে, কুসংস্কার থেকে, দারিদ্র্য থেকে, কাপুরুষতা থেকে, পীড়ন থেকে, শোষণ থেকে। দুনিয়ার কোথাও-না-কোথাও প্রতিদিন মানুষের জীবনের কোন-না-কোনো ক্ষেত্রে মুক্তি আসছে। এই সাফল্যে, এই আশ্বাসে ও এই প্রত্যয়ে মানুষ আজ বিদ্রোহী, সংগ্রামী ও আত্মপ্রত্যয়ী। আমাদের দেশ-দুনিয়ায়ও সে-রাঙা প্রভাত আসে। আমাদেরও আশ্বস্ত করে যায়। প্রতি নববর্ষে আমাদের প্রথম সূর্য আমাদেরও মনে জাগিয়ে তোলে রঙিন স্বপ্ন। প্রতি নববর্ষে আমাদের আকাশেও জাগে কালবোশেখী-নববর্ষের সওগাত ও আশীর্বাদ। তাতে আমাদের মধ্যে জাগে প্রাণের সাড়া। বন্দীর বেদনা, শোষিতের ক্ষোভ ঝড় হয়ে দেখা দেয়। তাতে মুছে যায় সব গ্লানি, খসে পড়ে জীর্ণতা, উড়ে যায় জড়তা, নতুন ভুবনে নব সৃষ্টির আশা ও আশ্বাসে ভরে উঠে বুক। উল্লসিত প্রাণপুরে জেগে উঠে গান :

ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কাল-বোশেখীর ঝড়–
 ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর প্রলয় নতুন সৃজন-বেদন
আসছে নবীন জীবনহারা–অসুন্দরের করতে ছেদন।

 অতএব,

তোরা সব জয়ধ্বনি কর!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *