কাশীধাম : 1774 - প্ৰথম পৰ্ব
সোঞাই : 1742 - দ্বিতীয় পৰ্ব
নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর : 1742 - তৃতীয় পৰ্ব
তীর্থের পথে : 1742 - চতুর্থ পর্ব
1 of 2

নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর – ১৭

১৭

আজ রূপেন্দ্রনাথ স্বগ্রামে প্রত্যাবর্তন করবেন।

ভারতচন্দ্র বলেছিলেন—সপ্তপদ একসঙ্গে হাঁটলে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। সপ্তরজনী একই কক্ষে যাপন করলে কী হয়, তা খোলাখুলি বলেননি। দুজনেই আদর্শবাদী, সাত্ত্বিক প্রকৃতির, কবিভাবাপন্ন। পরস্পরের মধ্যে প্রগাঢ় ভালবাসা জন্মেছে। দুজনেই দুজনের সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনেছেন। ভারতচন্দ্র বন্ধুকে শুনিয়েছেন তাঁর বিচিত্র জীবন কথা। নোলক-দোলানো এক রাধার আহ্বানে কিশোর কৃষ্ণ শুরু করেছিলেন বাগদেবীর আরাধনা। বস্তুত সেটাই তাঁর জীবনে প্রথম সরস্বতী টাঁজা। তার পূর্বেও অঞ্জলি দিয়েছেন—কিন্তু পুরোহিত হিসাবে নয়। এও এক… ‘বিপরীত কাণ্ড! কৃষ্ণের বাঁশরী শুনে রাধা ছুটে আসেননি—রাধার বাঁশরী-তানে কিশোর পণ্ডিত এলেন বাণীমন্দিরে।

শুরু করলেন সারস্বত আরাধনা! সে জন্য ভর্ৎসিত হয়েছেন গুরুজনদের কাছে—দাদা, বাবা, কে নয়? তাঁরা যে চেয়েছিলেন উনি ফারসী শিখুন, সংস্কৃত নয়। তার উপর এই দুঃসাহসিক গোপন বিবাহ! তিরস্কৃত কিশোর গৃহত্যাগ করে আশ্রয় নিয়েছিলেন দেবানন্দপুরে। পরে বর্ধমানরাজের বন্দীশালা। সেখান থেকে পলায়ন, পুরীধামে সন্ন্যাস গ্রহণের ইচ্ছা, প্রত্যাবর্তন, ফরাসডাঙ্গায় অন্নসংস্থানের প্রচেষ্টা। শেষমেশ নৌকা ভিড়িয়েছেন নদীয়ারাজের ঘাটে। রাজাদেশে আজ গাইছেন—’অমাবস্যার গান’। প্রোষিতভর্তৃকা রাধা আজও বিরহযন্ত্রণা ভোগ করছে পিত্রালয়ে। প্রায় অনাহারে।

রূপেন্দ্রও শুনিয়েছেন তাঁর অভিজ্ঞতা। মৃন্ময়ীর অনুরাগের কথা গোপন করেছেন, কিন্তু কুসুমমঞ্জরীর আদ্যন্ত ইতিহাসটি মেলে ধরেছিলেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর ‘বিদ্যাসুন্দর’ সম্বন্ধে আলোচনার কথাও সবিস্তারে জানিয়েছেন। ভারত কোন প্রত্যুত্তর করেননি। নির্লিপ্ত উদাসীনতায় শুধু শুনে গেছেন।

ভারত বললেন, তোমার সময় কম। নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগরের অনেক-অনেক কিছু অদেখা রয়ে গেল। শান্তিপুরে যাওনি, মায়াপুরেও নয়….

বাধা দিয়ে রূপেন্দ্র বললেন, সেসব পরে আর একবার এসে দেখব। সস্ত্রীক। মঞ্জুর ইষ্টদেবতা হচ্ছেন শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু। তাকে বঞ্চিত করে একা-একা সেই ঠাকুরের কীর্তি-কাহিনী দেখে যাওয়া কি ঠিক?

ভারত সকৌতুকে বলেন, একেই বলে ‘নিকষিত হেম’! আদর্শ প্ৰেম!

রূপেন্দ্র রুখে ওঠেন, বটে! তাহলে তুমি মহারাজের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলে না কেন? মহারাজ তো আমাদের দুজনকেই মধ্যাহ্ন-আহারে আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন? তুমি তোমার কী এক ব্রতের ছুতো করে বাড়িতে পড়ে রইলে! কেন?

—কেন? তুমি কী ভেবেছ? কেন আমি নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিনি?

রূপেন্দ্র বলেন, ভারত, ‘অন্নদামঙ্গলে’ ভিক্ষাজীবী শিব একবার মনের দুঃখে মা অন্নপূর্ণাকে বলেছিলেন, ‘সাধ হয় একদিন পেট ভরে খাই।’ মনে আছে? সে সময় যদি কেউ একা শিবকে নিমন্ত্রণ করত তাহলে তিনি কী করতেন? ‘পঞ্চরঙ অপলান্ন’ ভোজ খেতে ছুটতেন? না! তাঁর মনে পড়ত, তেজপুর গাঁয়ে প্রোষিতভর্তৃকা সীমন্তিনী অন্নপূর্ণা হয়তো কন্দমূল চিবিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করছে।

ভারত ম্লান হেসে বলেন, তোমার কাছে অস্বীকার করব না, বন্ধু! তোমার কল্যাণে এ কয়দিন রাজবাড়ি থেকে কাঁচা-সিধে আসছে, ভোলা ভালমন্দ রান্নাও করছে। কিন্তু ঠিক ঐ কারণে তা আমার মুখে রোচে না। যা হোক, তাহলে শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর জন্মস্থান দেখতে সস্ত্রীক কবে আবার আসবে?

—যবেই আসি, সেবার তো কবি ভারতচন্দ্রের অতিথি হব না, তোমার কী?

ভারতচন্দ্র একেবারে সাদা হয়ে যান। বলেন, মহারাজ বুঝি আগাম নিমন্ত্রণ করে রেখেছেন?

—না! কিন্তু সস্ত্রীক এলে তো কোনও প্রোষিতপত্নীকের ভদ্রাসনে আশ্রয় নিতে পারব না। তাই আশা করব, আমার অন্য এক বন্ধু তখন এখানে সস্ত্রীক বাস করবে—তার গৃহেই আতিথ্য নেব। আমার সেই বন্ধুটির নাম—শ্রীরাধানাথ রায় গুণাকর।

ভারত হেসে বললেন, তোমার মুখে ফুল-চন্দন পড়ুক! তোমার বিবাহে আমি উপস্থিত থাকতে পারছি না। কিন্তু আমি বয়োজ্যেষ্ঠ—বন্ধু হলেও। সেই অধিকারে আশীর্বাদ করি তোমাদের বিবাহিত জীবন সুখের হোক। তুমি যে পত্নীপ্রেম দেখালে—

বাধা দিয়ে রূপেন্দ্র বলেন, পত্নীপ্রেম! বিবাহ না হতেই আমার কী পত্নীপ্রেম দেখলে হে?

ভারত হেসে বলেন, এটুকুও যদি না বুঝি তবে বৃথাই আমার কবির অভিমান!

—এটুকুও! কোনটুকু?

—শাক্তবংশের সন্তান কেন তার আজীবনের অভ্যাস ত্যাগ করে আজ নিরামিষাশী হয়ে গেল। মাত্র পক্ষকাল পূর্বে!

এবার রূপেন্দ্রর স্বীকার করার পালা, বলেন তুমি ঠিকই বুঝেছ। আমি মনে করি, দাম্পত্য-জীবনে স্ত্রী-পুরুষের সমান অধিকার। স্ত্রী শুধু স্বামীর সহধর্মিণী নয়, স্বামীকেও হতে হবে স্ত্রীর সহধর্মী! তার পক্ষে এই বয়সে আমিষ খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্ত হওয়ার চেয়ে সহজতর সমাধান আমার নিরামিষাশী হয়ে যাওয়া।

ভারত বলেন, দেখ রূপেন্দ্র, তুমি অবিলম্বে সস্ত্রীক নবদ্বীপধামে তীর্থ করতে আসবে বলেছ, কিন্তু ভাগ্যের কথা কিছুই বলা যায় না। রাষ্ট্রবিপ্লব আসন্ন। নবাব আলিবর্দীর বয়স হয়েছে, তিনি অপুত্রক। গদী নিয়ে যে কোন সময় লড়াই বাধতে পারে। হয়তো তোমাতে আমাতে আর কখনো দেখাই হবে না। তাই—তুমি যদি অনুমতি দাও, আমি তোমার-আমার বন্ধুত্বের একটি স্থায়ী স্মৃতিচিহ্ন উপহার দিতে চাই। যাতে আমার কথা তোমার বারে বারে মনে পড়ে যায়। তোমার বিবাহে এই দীন কবি আর কী উপহার দিতে পারে বল?

কী উপহার? শুনি আগে।

—মদনারিরিপুর আশীর্বাদে তোমাদের মিলন সার্থক হবেই। সেই অনাগত মানবশিশুটির নামকরণ আমি করে দেব। তাকে যতবার ডাকবে ততবারই আমার কথা মনে পড়ে যাবে।

—এ তো খুবই আনন্দের কথা। কবির দেওয়া নাম। বল? কী নাম?

—তোমার পুত্রের নাম দিও : ‘আত্মদীপ’!

—আত্মদীপ?

—হ্যাঁ। তুমি বিবেকের নির্দেশে পথ খুঁজে এগিয়ে চলতে চাও। মহাকারুণিক গৌতম বুদ্ধের সেই শেষ নির্দেশটিই তোমার জীবনের মূলমন্ত্র—আত্মদীপো ভব!

রূপেন্দ্র হেসে বললেন, বন্ধু! তুমি অপূর্ব নামকরণটি করেছ। আমার পুত্রসন্তান হলে নিশ্চয় তার নাম দেব : ‘আত্মদীপ’; কিন্তু তুমি কট্টর স্মার্ত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের মতো এ পরামর্শ দিলে; ঠিক কবির মতো নয়।

–কবির মতো নয়? কী ত্রুটি হল আমার?

—তুমি কবি হিসাবে বিস্মৃত হয়েছ—এই রূপরসশব্দগন্ধস্পর্শময় জগতের অধিকার একা পুরুষের নয়। এ বিবাহ সার্থক হলে আমার কন্যা-সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা পঞ্চাশভাগ ভারত বললেন, ঠিক কথাই বলেছে বন্ধু! পুত্রের নাম করেছিল কট্টর পণ্ডিত; এবার কন্যার নামকরণ করবে—কবি। রূপেন্দ্রনারায়ণ আর কুসুমমঞ্জরীর যৌথ মনসিজ-সাধনার ফলশ্রুতি যদি কন্যারূপে আবির্ভূতা হয়, তবে তার নাম হোক : রূপমঞ্জরী!

—রূপমঞ্জরী! বাঃ! সুন্দর নামটি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *