১০
কৃষ্ণচন্দ্র এবার স্বয়ং এলেন আরণ্যক চতুষ্পাঠীতে। কিংখাবে-মোড়া পালুকিতে রাজমহিষী অশ্বপৃষ্ঠে মহারাজ। শহর-সীমার বাহিরে। কিছু খরগোশ আর বনতিতির ছোটাছুটি করছে। নাম-না-জানা হাজার পাখির রাজত্ব। তর্কসিদ্ধান্তের চতুষ্পাঠীর দ্বারে দুই অভ্রভেদী প্রহরী—এক জোড়া শিশুগাছ!
মহারাজ কোন দ্বর্থবোধক সংস্কৃত শব্দের ফাঁদে পা দিলেন না। সহজ সরল বঙ্গভায়ে পেশ করলেন তাঁর কুণ্ঠিত আবেদন। দেশের স্বার্থে, নবদ্বীপধামের সারস্বত-আরাধনাকে সার্থক করার প্রয়োজনে পণ্ডিতকে এ আরণ্যক পরিবেশ ত্যাগ করে যেতে হবে। নবদ্বীপ পণ্ডিত-সভার মধ্যমণির আসনটি অলঙ্কৃত করে নদীয়ারাজকে ধন্য করতে হবে।
সহজ সরল বঙ্গভাষেই প্রত্যাখ্যান করলেন সেই আদর্শ শিক্ষক: তা হয় না, মহারাজ!
রাজা ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, আপনি মহাপণ্ডিত! আমার একটি ‘অনুপপত্তি’ নিরাকরণ করে দিন তাহলে?
—বলুন, মহারাজ?
—উপনিষদ্ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবিদ্ মহামুনি যাজ্ঞবল্ক্য কেমন করে হয়েছিলেন জনকরাজার বৃত্তিভোগী সভাপণ্ডিত?
স্মিতহাস্যে প্রশান্ত হয়ে উঠল মহাপণ্ডিতের মুখমণ্ডল। বললেন, এর সমাধান তো সহজ মহারাজ! তিনি ছিলেন ব্রহ্মবিদ, আমি ব্রহ্মজিজ্ঞাসু। তিনি পেয়েছিলেন, আমি খুঁজছি। তিনি ঋষিশ্রেষ্ঠ যাজ্ঞবল্ক্য, আমি সামান্য বুনো রামনাথ :
পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হলেন কৃষ্ণচন্দ্র। রাজমুকুটটি খুলে ব্রাহ্মণের পদধূলি গ্রহণ করলেন মাথায়।
কিন্তু অত সহজে হার স্বীকার করতে পারলেন না রাজমহিষী। একই সময়ে কক্ষান্তরে তিনি বসেছিলেন ঐ সীমান্তনীর মুখোমুখি : কেন? কেন? কেন?
পণ্ডিত-গৃহিণী সহাস্যে বলেন, সে কথা তো আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না, রানীমা। এ যে ব্যাখ্যার অতীত—বোধের জগতে! এটাই যে ওঁর ধর্ম!
—ওঁর ধর্ম! আপনার কী? আপনি কেন পড়ে থাকবেন এই জঙ্গলে?
পুনরায় একই কথা বললেন পণ্ডিত গৃহিণী : একই প্রত্যুত্তর, রানীমা! সেটাও ব্যাখ্যার অতীত, বোধের জগতে। আমি যে ওঁর সহধর্মিণী!
রানী-মার শেষ সংযম ভেঙে পড়ল। অপমানিতা বোধ করলেন নিজেকে। স্বয়ং নদীয়াধিপতি সস্ত্রীক উপযাচক হয়ে এসেছেন—ভিক্ষা চাইছেন—আর তা প্রত্যাখ্যান করছেন এই ভিক্ষুকদম্পতি। কীসের এই দার্ঢ্য! কীসের এত অহঙ্কার?
কঠিনস্বরে বলেন, আপনার অভিরুচি। ইচ্ছা হয় এই জঙ্গলেই পড়ে থাকুন। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে একটা সত্যি কথা বলুন তো?
–‘বুকে হাত দিয়ে’সত্যকথা! ‘‘মিথ্যা’ বলতে যাব কিসের ভয়ে?
রানী-মা সে-কথায় কান দিলেন না। বললেন, স্বামীর ইচ্ছায় এই জঙ্গলে জীবন-যৌবন কাটাতে চান। কিন্তু আপনার কি কখনো সাধ হয় না, এই আমার মতো অলঙ্কারভূষিতা হতে?
ব্রাহ্মণী এখনো সহাস্যবদনা। বলেন, অলঙ্কার! মহারানী! এ অরণ্যে আমার অঙ্গে আমার স্বামী যে-অলঙ্কার পরিয়ে দিয়েছেন তা যে সারা নবদ্বীপের আর কোনও ভাগ্যবতীর অঙ্গে নেই। আমি আপনাদের ঈর্ষা করতে যাব কেন?
রানী-মা সবিস্ময়ে বলেন, অলঙ্কার! আপনার অঙ্গে? পণ্ডিতমশায়ের দেওয়া উপহার?
সন্ধানীদৃষ্টিতে ঐ শাখা-সর্বস্ব বধূটির সর্বাঙ্গ দেখে নিলেন। রাজবাটিতে নানান ধনাঢ্য পরিবারের কুলললনাদের নিত্য শুভাগমন ঘটে। কে কোন কারুশিল্পময় স্বর্ণভূষণ পরিধান করে এসেছেন তা চকিত দৃপাতে দেখে নেওয়া একটা বিশেষ চারুকলা। অলঙ্কারগর্বিতা যাতে বুঝতে না পারে অথচ ভবিষ্যতে স্বর্ণকারকে তা বুঝিয়ে দেওয়া যায়! রাজমহিষী সে চারুকলায় পারদর্শিনী। কিন্তু কিছুই নজরে পড়ল না—হস্তে, কণ্ঠে, কর্ণে একরতি সোনাও নেই। মায়, অঙ্গুরীয় পর্যন্ত নাই অনামিকায়। বরং দেখলেন—লালপাড় ধনেখালি শাড়ির অঞ্চলপ্রান্তে সীবনচিহ্ন।
ব্রাহ্মণী বলেন, বৃথাই তল্লাস করছেন মহারানী। আপনার নজরে পড়বে না।
রাজমহিষী প্রণিধান করেন—’অলঙ্কার’ শব্দটা ‘আলঙ্কারিক’ অর্থে ব্যবহার করেছেন পণ্ডিতজায়া—অর্থাৎ স্বামীর সোহাগের সোহাগায় গড়া ওঁর দার্ঢ্য-অলঙ্কার!
ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলেন, লোকে যা চোখে দেখে না, তাকে আপনি ‘অলঙ্কার বলেন?
—লোকে দেখে, আপনিই শুধু দেখতে পাচ্ছেন না রানী-মা!
—বটে! আমার দৃষ্টিহীনতার হেতু?
—’অহঙ্কারে’ অন্ধ হলে ‘অলঙ্কার’ যে দেখা যায় না, মহারানী! এই দেখুন!
অনশনক্লিষ্টা অরণ্যচারিণী তাঁর শীর্ণ হাতখানি তুলে দেখান : এই শাখা! এটি যতক্ষণ এই সৌভাগ্যবতীর হাতে আছে ততক্ষণই নবদ্বীপের গৌরব! ততক্ষণই সমগ্র আর্যাবর্ত স্বীকার করবে—কাশী নয়, মিথিলা নয়, এই আরণ্যক পর্ণকুটিরেই বর্তমানে মা সরস্বতীর অধিষ্ঠান!
রানী-মার মাথাটা নিচু হয়ে গেল। নিদারুণ সত্য কথা! সমগ্র বঙ্গভূমের কোন রাজমহিষী, কোন নবাবের বেগম ও–কথা বলতে পারে না। স্বামীর নিজে হাতে পরিয়ে দেওয়া প্রণয়োপহার দেখিয়ে অমন একটা কথা বলতে।
তিনি নত হলেন চীরধারিণীর চরণপ্রান্তে।
দুশ বছর কেটে গেছে তারপর।
সারা ভারতের শিক্ষাব্রতীর আদর্শ—আজও—বুনো রামনাথ।