নবদুর্গা

নবদুর্গা

গরু দুইতে নারু আসছে ওই যে। বৈষ্ণবদীঘির পার দিয়ে বাঁশতলা পেরিয়ে। ভারী সুন্দর জায়গা ওটা। মিষ্টি তেঁতুলের একটা সার আছে ওখানে। সে ভারী সুন্দর তেঁতুল, পাকলেই মিষ্টি। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। এই বিকেলের দিকে গড়ানে রোদ্দুরের আলোয় ওই তেঁতুলবনে যে আলোছায়ার চিকরিমিকরি তৈরি করে তা যেন রূপকথার মতো।

এ-বাড়ির সবাই গরু দুইতে পারে। তবু নারুকে আসতে হয় লছমীর জন্য। ভারী দুষ্ট গরু। জগা খুড়ো বলে, বাপ রে, ও হল লাথ মারুয়া গরু, ওর কাছে যেতে আছে? অথচ লছমী দুধ দেয়। এককাঁড়ি। আবার লাথি বা টুসো মারতেও কসুর করে না। কিন্তু নারুর কাছে তার মাথা হেঁট। তার কাছে কোনও জারিজুরি খাটে না। নারু খুব যত্ন করে লছমীর পিছনের পা দুটো গামছা দিয়ে বাঁধে। তারপর পেতলের বালতিতে চ্যাংচুং শব্দে দুধ দোয়ায়। লছমী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, একটুও দুষ্টুমি করে না।

আচ্ছা নারুদাদা, তোমাকে কি লছমী ভয় পায়?

নারু হাসে। বলে, না রে পাগলি, ভয় পাবে কেন? ও আমাকে ভালোবাসে।

তা তোমাকেই বাসে, আর আমাদের বাসে না কেন? আমরা তো ওকে খড় বিচালি দিই, জাবনা দিই, ভাতের ফ্যান তরকারির খোসা খাওয়াই, কত আদর করি গলকম্বলে হাত বুলিয়ে।

কোনও-কোনও গোরু ও রকম হয়।

জগা খুড়ো বলে, তুমি নাকি মন্তরতন্তর জানো।

খুব হাসে নারু, শোন কথা। মন্তরতর কোথা থেকে জানব? আমাদের কি তত ক্ষমতা আছে? জগা খুড়ো হলো মাথা–পাগলা মানুষ, কত কী বলে।

নবদুর্গার খুব ইচ্ছে করে লছমীর সঙ্গে ভাব করতে। ইচ্ছে হবে না-ই বা কেন? কী সুন্দর দেখতে লছমী! দুধসাদা রঙের ওপর কালো ছোপ। তেমনি মায়াবী দু-খানা চোখ। বলতে নেই, লছমী বেশ বড়সড় গরু, তেজও তেমনি। নবদুর্গার সঙ্গে কি তা বলে লছমীর ভাব নেই? আছে। লছমী যখন মাটির কালো গামলায় জাবনা খায় তখন তো নবদুর্গাই জাবনা নেড়ে চেড়ে দেয়। তখন গলায় হাত বোলালে লছমী ভারী আরাম পায়। কিন্তু তাদের অন্য আর পাঁচটা গরু যেমন মাটির মানুষ আর বাধ্যের মানুষ, ডাকলেই কাছে আসে, লছমী তেমনটি নয়। আর এই যে নারুদার ওপর লছমীর একটু পক্ষপাত এতেও নগদুর্গার একটু হিংসে আছে। হিংসে হবে না, বলো! এত ভালোবাসে সে লছমীকে, আর লছমী কিনা অমন!

নবদুর্গার একটু হিংসে টিংসে আছে বাপু। ওই যে তার খেলুড়ি বন্ধুরা এসে জামতলায় জড়ো হয়েছে ওদের মধ্যে যেমন তোটন আর রমলা তার খুব বন্ধু অন্যরা কি তেমন? তোটনের সঙ্গে পুষ্পর যদি বেশি ভাব দেখতে পায় নবদুর্গা তবে তার হিংসে হয়। কেন, তা কে বলবে।

তোটন অবশ্য বলে, তোর একটুতেই বড্ড গাল ফোলে।

তা ফোলে বাপু, নবদুর্গা মিথ্যে কথা বলতে পারবে না।

জগা খুড়ো ওই যে আছে তার দাওয়ায় এক কোণটিতে। নগদুর্গাদের মস্ত উঠোন। তাও একটা নয়, চারখানা। বেশির ভাগই মাটির ঘর। একতলাও আছে, দোতলাও আছে। হালে একখানা পাকা দোতলাও উঠেছে ওই ধারে। জগা খুড়ো এ-বাড়ির কেউ নয়, আছে মাত্র। তিন কুলে কেউ নেই। ঘরে বসে নানারকম কিস্তুত ওষুধ, আচার এ সব বানায় আর ধর্মের বই পড়ে। এই যে বিকেলটি হয়ে আসছে, এই সময়টায় জগা খুড়ো এসে দাওয়ায় বসবে মাদুর পেতে। সামনে একখানা জলচৌকি, কত কী পাঠ করে সুরেলা গলায়। সন্ধের পর জগা খুড়োকে ঘিরে। বাড়ি আর পাড়ার বউ–ঝি আর বুড়ো–বুড়িদের জমায়েত হয়। জগা খুড়ো একদিন তাকে বলেছিল, নরক কা মূল অভিমান। তোর অত কথায়-কথায় গলা ফোলে কেন রে? ওরকমটা ভালো নয়।

তা কী করবে নবদুর্গা? তার যে হয়! নরক কা মূল অভিমান–কথাটা মনে হলে তার একটু ভয়ও হয়। তার যে কথায় কথায় গাল ফোলে ভগবান? তবে কি নরকেই যেতে হবে তাকে? মাগো! বাজিতপুরের হাটে নরকের একখানা বড় পট দেখেছিল নবদুর্গা। পাজি মেয়েদের কী দুরবস্থা বাবা! ফুটন্ত হাঁড়িতে ফেলছে একজনাকে তো অন্যজনকে চুলের মুঠি ধরে গদা দিয়ে পেটাচ্ছে। একজনকে তো ন্যাংটো করে–মাগো!

দুধে ভরা পেতলের বালতিটা নারুদার হাত থেকে নিতে–নিতে কে জানে কেন নগদুর্গা বলে ফেলল, তুমি খুব ভালো লোক নারুদাদা।

নারু হেসে লজ্জার ভাব করে বলে, শোনো কথা। আমরা কেমন করে ভালো লোক হতে পারি বলো। আমাদের কি জ্ঞান আছে? অজ্ঞানী যে বড়।

তুমি নিশ্চয়ই ভালো লোক, নইলে কি লছমী তোমাকে অত ভালোবাসত?

এটা কোনও কথা হল নবদিদি? গরু দিয়ে কি মানুষ চেনা যায়? তোমার যেমন কথা! খেলুড়িরা সব জামতলায়। পেতলের বালতিটা ভাঁড়ারঘরে মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে নবদুর্গা বলল , খেলতে যাচ্ছি মা!

দিন–রাত খেলা আর খেলা। কীসের খেলা রে? ধিঙ্গি–ধিঙ্গি মেয়েরা বসে-বসে কেবল গুজগুজ ফুসফুস। ওটা খেলা নাকি?

কথাটা মিথ্যে নয়। আজকাল তারা একটু পেকেছে। আগে যেমন পুতুলে খেলা, এক্কা–দোক্কা, চোর-চোর, গোল্লাছুট ছিল এখন আর তেমনটি ইচ্ছে যায় না। বসে-বসে গল্প করতেই ভালো লাগে। হ্যাঁ বটে, তার মধ্যে আজকাল রসের কথাও কিছু থাকছে।

সে কাঁদো–কাঁদো হয়ে বলল , যাই না মা!

মা একবার কঠিন চোখে তার দিকে চেয়ে বলল , কাল তোমাকে দেখতে আসছে গোবিন্দপুরের লোকেরা। কথাটা মনে রেখো। শেফালীকে বলে দে কাল সকালে নাপতেবুড়ি এসে যেন তোর পা ঝামা ঘষে পরিষ্কার করে দিয়ে যায়, আর বিকেল-বিকেল এসে খোঁপা বেঁধে দিয়ে যাবে।

পাত্রপক্ষের কথা নবদুর্গা জানে। এর আগেও দুটো পক্ষ এসে দেখে গেছে। এক পক্ষ পছন্দই করেনি, আর-এক পক্ষ পছন্দ করলেও দেনা-পাওনায় মেলেনি।

বিয়ের কথা ভাবতে যে তার ইচ্ছে হয় না তা নয়। কিন্তু ওই যে একলাটি সে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, অচেনা এক মানুষ আঁচলে গেরো দিয়ে টেনে নিয়ে যাবে তাকে এ কথা ভাবলে বুকে একটা কষ্ট হয়। মা, বাবা, ভাই, বোন, খেলুড়ি বন্ধুরা, ভুলো কুকুর কিংবা টেনি বেড়াল, এই গাঁ, ওই ষষ্ঠীতলা, আর ওই যে মিষ্টি তেঁতুলের ঝিরিঝিরি ছায়া, লছমী বা রাঙা গাই, এদের সবাইকে ফেলে যেতে হবে তো। তার কাছে সবাই মানুষের মতো। এমন কি বেড়াল, কুকুর, গাছ, গাঁ সব সব সব। এদের ছেড়ে গিয়ে সে কি বাঁচবে?

মায়ের যখন মেজাজ ভালো থাকে তখন মা বলে, বাঁচবি রে বাঁচবি। মেয়ে হয়ে জন্মেছিস তো পরের ঘরের জন্যই। এ জন্যই তো মেয়ে দিয়ে বংশরক্ষা হয় না। না বাঁচে কে বল তো! এই তো আমি কেমন বেঁচে আছি দেখছিস না। সব ছেড়ে আসিনি আমি? আবার সব পেয়েছিও তো!

সাঁজবেলাতে এমনিতেই মন একটু খারাপ হয়। পাত্রপক্ষের কথা শুনে আরও একটু হল। গোবিন্দপুর কেমন গাঁ কে জানে! সেখানে হয়তো সবাই গোমড়ামুখো, সবাই রাগি। কে জানে কী।

খেলুড়িরা গোল হয়ে বসে ছিল। নবদুর্গা কাছে যেতেই চারি বলল  বাব্বাঃ রে বাব্বাঃ। কতক্ষণ। বসে আছি তোর জন্য। এই তোর আসার সময় হল!

ধুস আমার কিছু ভালো লাগছে না।

কেন, কী আবার হলো?

কারা যেন দেখতে আসবে কাল।

পটলী একটু কম কথা কয়। সে ভারী ভালোমানুষ। খুব ছোটখাটো, রোগা আর কালো।

ফস করে বলে, উঠল, আমি জানি।

কী জানিস রে?

গোবিন্দপুরে আমার জ্যেঠতুতো দিদির শ্বশুরবাড়ি। দিদি আজই এল সকালে। মাকে বলছিল ওখানে সমীরণ না কে একটা ছেলে আছে, তার সঙ্গেই তোর সম্বন্ধ।

সমীরণ নামটা খুব এটা খারাপ লাগল না নবদুর্গার। ঠোঁট উলটে অবশ্য বলল , বয়েই গেছে বিয়ে করতে।

পটলী বলল , দিদি বলছিল সে নাকি পাগলা মানুষ।

বলিস কী? বলে সবাই চমকে উঠল।

হিহি করে হাসল পটলী, পাগলা বলতে তেমন নয় কিন্তু। খেয়ালি।

তার মানে কী? বিড়বিড় করে নাকি?

সে আমি জানি না। দিদি বলছিল, ছেলে নাকি মন্দ নয়।

চারি বলল , কেমন দেখতে? মুশকো, কালো, ঝাঁটা গোঁফ নাকি?

তা কে জানে। অত শুনিনি।

নবদুর্গা বলল , তাই হবে। আমার কপালে কি ভালো কিছু জুটবে?

মান্তু বলল , কেন বাবা, তোর কপালটা এমন কি খারাপ। আমাদের মতো তো তোর গরিব ঘর নয়। দশ-বিশ হাজার টাকা খরচ করতে পারে জ্যাঠামশাই, আমার বাবা পারবে?

কয়েক মাস আগে লোহাগঞ্জের মস্ত এক পরিবারে মান্তুর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। দশ হাজার টাকা পণের জন্য ভেস্তে যায়।

মান্তুর মুখখানা দেখে ভারী কষ্ট হল নবদুর্গার। গরিব ঘরের হলেও মান্তু দেখতে বেশ। বড় বড় চোখ, রংটাও ফরসার দিকে, ভারী ঢলঢলে মুখ। ভালো ঘরেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল প্রায়। মান্তুর বাবা হরিপদ ধারকর্জের চেষ্টাও করেছিল কম নয়। পায়নি।

মান্তর কথাটার পরই আজকের জমায়েতটার কেমন যেন তাল কেটে গেল। কারও আর কথা আসছিল না। তাদের যা বয়স এখন, তাতে সকলেরই দিন আসছে। কার ভালো বিয়ে হবে, কার খারাপ তা যেন রথের মেলায় মোয়াওয়ালা ফটিকের ঘুরণচাকি। পঞ্চাশটা পয়সা ফেললেই ফটিক তার চাকির কাঁটা বাঁই করে ঘুরিয়ে দেবে। চাকির গায়ে নম্বর লেখা। কাঁটা যে ঘরে থামবে ততটা মোয়া। কারও ভাগ্য দশও ওঠে, কারও ভাগ্য শূন্য। বিয়েটাও হল তাই। আর সে জন্যই তাদের বুকে একটা গোপন দুরদুরুনি আছে। মাঝে-মাঝে যেন শ্বাসকষ্ট হয়।

আজ জোরদার পাঠ হচ্ছে জগা খুড়োর দাওয়ায়। দশ-বারোজন জুটেছে। খেলুড়িরা একে একে চলে যাওয়ার পর জামতলা থেকে ফেরার সময়ে দৃশ্যটা দেখতে পেল নবদুর্গা। একখানা পেতলের ঝকঝকে হ্যারিকেন জ্বেলে নিয়ে বসেছে জগা খুড়ো। যাই–যাই শীত। খুড়োর গায়ে নস্যি রঙের র‍্যা পার।

নবদুর্গারও একটু শীত করছিল। সে অন্তি জ্যাঠাইমার দাওয়ায় পাতলা অন্ধকারে বসে চেয়ে রইল। গোবিন্দপুর কতদূর? যাবে কি সেখানে? সমীরণ নামটা কিন্তু বেশ।

দিঘির জলে সূর্য ডুবে গেল একটু আগে। পশ্চিমের আকাশে একটা  ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো মেঘ এসে শেষ আলোটুকুও পুঁছে দিচ্ছিল। এ সময়ে নবদুর্গার কেন যে রোজ কান্না পায়! রোজ পায়।

লছমীর ডাক শোনা যাচ্ছে। একটু চমকে ওঠেনবদুর্গা। লছমী খুব কমই ডাকে। আজ ডাকছে। কেন? জাবনার গামলার মধ্যে মুখ দিচ্ছে না তো! ঘাড় ফিরিয়ে–ফিরিয়ে কাকে দেখছে যেন।

হঠাৎ নবদুর্গার বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল। রোজ সে লছমীর সোহাগ পাওয়ার জন্য জাবনাটা নেড়ে দেয়। আজ দেয়নি। তাই কি খুঁজছে? যদি তাই হয়? ইস, আনন্দে বুকটার মধ্যে যেন একটা বাতাস বয়ে গেল।

নবদুর্গা এক ছুটে গিয়ে হাঁফাতে-হাঁফাতে বলল , আমাকে খুঁজছিস, ও লছমী? আমাকে? ও আমার সোনালক্ষ্মী, ও আমার বুকের ধন…

নবদুর্গা হাত দিল গামলার মধ্যে। আর কী আশ্চর্য ভগবান, এমনও হয় নাকি? লছমী একটা বড় শ্বাস ফেলে জাবনা খেতে লাগল মসমস করে।

নবদুর্গার চোখের জল বাঁধ মানল না। হাপুস কাঁদতে কাঁদতে বলল , তা হলে তুই আমাকে ভালোবাসিস লছমী! এত ভালোবাসিস?

কত সোহাগ বল দুজনে। এ সব কেউ বুঝবে। শুধু সে বোঝে এ সব অদ্ভুত আশ্চর্য আবিষ্কার। রাত্রিবেলা যখন পাঠ শেষ করে ঘরে বসে জগা খুড়ো খই দুধে মেখে খাচ্ছে তখন গিয়ে তার ঘরে হানা দিল নবদুর্গা। জগা খুড়ো তার মস্ত অবলম্বন।

জগা খুড়ো, একটা কথা। গোবিন্দপুর থেকে কাল আমাকে কারা দেখতে আসছে গো।

তা আসুক না।

শোনোনি?

আমাকে কি কেউ কিছু বলে? পড়ে আছি একধারে কুকুরটা বেড়ালটার মতো।

এই জগা খুড়োই না বলে নরক কা মূল অভিমান!

কী হল গো তোমার খুড়ো!

জগা খুড়ো খইয়ের বড় বাটিটা মেঝের ওপর রেখে উদাস মুখে বলল , কী মনে হয় জানিস? মনে হয় বয়সকালে সংসারধর্ম করাই ভালো ছিল। তাতে তো আপনজন হত কয়েকজন। ওই দেখ খই দুধে কেমন মিশ খেয়ে গেছে। তেমনধারা মিশ খেতে পারলুম কই তোদের সংসারের সঙ্গে?

তুমি কি কালকের ঝগড়ার কথা কইছ খুড়ো? নগেনকাকা তো মাথাগরম মানুষ, সবাই তো জানে।

জগা খুড়োর সঙ্গে কাল নগেনকাকার লেগেছিল খুব। তেমন কিছু ব্যাপার নয়। নগেনকাকা তার ছেলে মদনকে খুব মারধর করছিল কাল, ঝড়পট্টিতে গিয়ে ভিডিও দেখে রাত কাবার করে ফিরেছিল বলে। নগেনকাকার মার মানে পুলিশের মারকেও হার মানায়। মোটা বেতের লাঠি দিয়ে যখন মারে আর মদন যখন চেঁচায় তখন আশপাশে মানুষ থাকতে পারে না। জগা খুড়ো গিয়ে তখন মাঝখানে পথে পড়েছিল। নগেনকাকার তাই রাগ, তুমি কে হে বারণ করার? আমি আমার ছেলেকে শাসন করছি, তুমি বলতে আসো কেন? ভালোমানুষি দেখাতে এসোনা, ছেলেটা যদি নষ্ট হয় তো তাতে তোমার তো ক্ষতি হবে না, হবে আমারই…তোমার আর কী…এইসব। গায়ে না মাখলেও চলে।

জগা খুড়ো খইয়ের বাটিটা ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল , মাঝে-মাঝে ইচ্ছে হয় তোদের সংসার ছেড়ে হিমালয়ে চলে যাই।

তুমি গেলে আমি কাঁদব কিন্তু। ওরকম বলে না। কালকেই দ্যাখো, মদনকাকা এসে তোমার কাছে গাঁইগুই করবে।

ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে জগা খুড়ো বলল , তা আর করতে হবে না। মনটাই আমার ভেঙে গেছে। তাকী বলতে এসেছিলি?

আগে খই–দুধ খাও, বলছি। বলে বাটিটা হাতে তুলে দেয় নবদুর্গা। একটু চুপ করে থেকে জগা খুড়ো বলে, সংসারটানরক। আর নরক কা মূল অভিমান, তাইনা খুড়ো?

জগা খুড়ো ভ্রূ কুঁচকে বলে, কোথা থেকে শিখলি কথাটা?

যার কাছ থেকে শিখি। তুমি গো।

অ। পেকেছ খুব। বৃত্তান্তটা কী? গোবিন্দপুর তো?

হ্যাঁ। পাত্রের নাম সমীরণ। তারা কেমনধারা লোক?

তার আমি কী জানি?

২.

এ কাজটা কার তা বলা কঠিন। হাটুরে ধুলোয় লোকটা পড়ে আছে। একটু আগে মুখ দিয়ে রক্ত আর গোঙানি বেরোচ্ছিল। এখন গোঙানিটা নেই। মরে গেল নাকি? নাঃ, শ্বাস চলছে।

যারা মেরেছিল তারা এখন তফাত হয়েছে। সে চারদিকটা দেখে নিল একবার। নীলুদাদু কি সাধে বলে, লোকের ভালো করতে নেই। যতবার ভালো করতে গেছে সে ততবারই গণ্ডগোল হয়েছে। তবু এই ভালোটা না করেও সে পারে না। লোকটা চোর এবং পাকা চোর। মার কি আর এমনি খায়? লোকে খেটেপিটে রোজগার করে আর এ ব্যাটা ফাঁকতালে। তবে এরও হয়তো বালবাচ্চা এণ্ডিগেণ্ডি, বাপ মা আছে। এটাই কষ্টের। চোর গুন্ডা খুনে যা-ই হোক–তাদেরও জন থাকে। জনগুলোরই কষ্ট।

লোকটাকে কাঁধে তুলেই ফেলল সে। খুব ভারী মানুষ নয়। কাঁধে দো ভাঁজ চাদরের মতো নেতিয়ে পড়ল। কুমোরপাড়া পেরোলেই সাউ ডাক্তারের ঘর।

ডাক্তারবাবু, আছেন নাকি?

ডাক্তার আছে। আজ হাটবার, মেলা রুগি। এ দিনটা সাউ সেঁটে থাকে।

কে রে?

আজ্ঞে আমি, সমীরণ।

সাউ মুখ বেঁকাল, অ। তাকী মনে করে? কাঁধে আবার কোন গন্ধমাদন বয়ে আনলে বাপ?

এ ব্যাটা হাটুরে ঠ্যাঙানি খেয়েছে। বাঁচবে কি না দেখে দিন তো!

ও বাবা, ও আপদ বিদেয় করে এসো। হাটের জিনিস হাটেই পড়ে থাকত বাবা, বয়ে আনার কী ছিল? কলজের জোর থাকলে হাওয়া বাতাসেই আরাম হবে, ওষুধ লাগে না ওদের।

একটু দেখে দিন তবু।

ভিজিটটা দেবে কে?

দেওয়া যাবে।

কেন যে বাপু এ সব ঝামেলায় আমাকে জড়াও। সদ্য চেম্বার বন্ধ করতে যাচ্ছিলাম…গজগজ করতে-করতে ডাক্তার সাউ লোকটাকে দেখল। দেখতে-দেখতে বলল , বলেছি না এ শালা বেজম্মাদের ওষুধ লাগে না। দিব্যি বেঁচে আছে। মারের চোটে ভিরমি খেলেও কিছু নয়। টিকে যাবে। নিয়ে যাও।

একটু ওষুধ–টসুধ দেবেন না?

পয়সা?

হবে।

দ্যাখো বাপু। বাকি কারবারে ফেলোনা। অনেক ভিজিট মার গেছে আমার জীবনে।

তা ওষুধ হল, পট্টি লাগানো হল। লোকটা একটু ঘোলা চোখে চাইলও।

সমীরণ বারোটা টাকা হিসেবমতো দিয়ে দিল। তারপর লোকটাকে দাঁড় করিয়ে বলল , চল ব্যাটা। বেঁচে গেছিস।

লোকটা টলতে টলতে বেরিয়ে এল সঙ্গে-সঙ্গে।

কুমোরপাড়ার রাস্তায় পড়ে লোকটা সটান হল। বলল , বাবু কি আমাকে পুলিশে দিচ্ছেন?

দেওয়াই উচিত।

ও শালা পুঙ্গির ভাইয়েরা যে পেটাল ওদের কী করছেন?

হাটসুষ্ঠু কি পুলিশ দেওয়া যায়? বেশ করেছে মেরেছে।

বেশ করা আমিও বের করে দেব, দেখবেন। বনমালীর দোকান থেকে–বললে বিশ্বেস করবেন না-মোটে পাঁচটা টাকা কুড়িয়েছি তাইতেই ওই কাণ্ড।

কুড়িয়েছ মানে?

বনমালী ক্যাশবাক্স খুলে টাকা খাবলে কাকে যেন খুচরো ফেরত দিতে যাচ্ছিল, পাঁচ টাকার নোটটা উড়ে এসে পড়ে মাটিতে। সেইটে কুড়িয়ে গস্ত করায় এই হেনস্থা।

তুমি চোর নও তা হলে?

কোন শালা নয়। সব চোর। হাটে বাজারে পথেঘাটে দাঁড়িয়ে যে দিকে তাকাব সব চোর।

জানি। বাড়ি যাও।

গেলেই হবে?

তার মানে?

শুধু হাতে গিয়ে মা কালীর মতো জিব বের করে দাঁড়াব নাকি মাগের সামনে? সে আমার ট্যাঁক দেখবে না? তবে যদি ঢুকতে দেয় ঘরে।

ভালো জ্বালা দেখছি।

আপনি ভালো লোক। সমীরণবাবু তো!

চিনলে কী করে?

গোবিন্দপুরে থাকেন, রায়বাড়ির ছোট ছেলে। সবাই জানে।

কী বলে জানে? বোকা না পাগল?

দুটোই। তা ওরকমধারাই ভালো। বোকা যদি না হতেন, ছিটিয়াল যদি না হতেন তা হলে আজ এই রকম শর্মার কি প্রাণখানা থাকত দেহপিঞ্জরে?

কত চাই?

যা দেন। দশ-বিশ।

খাঁই তো কম নয় দেখছি।

দশটা টাকা পেয়ে নয়ন সেলাম বাজিয়ে হাওয়া হল। তখন ভারী বোকা–বোকা লাগল। নিজেকে সমীরণের। ঠকে গেল নাকি? হিসেবটা সে করতে চায় না। আবার করেও ফেলে। কত ঠকল জীবনে?

ঠকেও সে। আবার পুরোপুরি ঠকেও না। এ তিন বছর আগেকার কথা। নয়ন শর্মা এর পরে, তাদের বাগানের বেড়া বেঁধে দিয়ে গেছে। গোয়ালঘর ছেয়ে দিয়ে গেছে। একটা কুড়ুল আর একখানা বাটি চুরি করে নিয়ে গেছে। এই লেনদেন নিয়ে সংসারসমীরণ যা বোঝে।

সে যে খানিক পাগল এটা সে জানে। আবার জানেও না। বাসুলি পুকুরে হরিমতিপিসির নারকোল তুলতে গিয়ে বিপদ হয়েছিল সেবার।

নারকোল বেচেই বুড়ির চলে। সেবার ঝড়বৃষ্টিতে মেলা নারকোল পড়ল জলে আর ডাঙায়। সমীরণ ফিরছিল তার তাঁতঘর থেকে। বুড়ি ধরে পড়ল, ও বাবা, নারকোল কটা তুলে দিয়ে যা। নইলে সব তুলে নিয়ে যাবে। যা হারামি সব ছেলেপুলেগুলো।

তা নেমেছিল সমীরণ। মোট কুড়িখানা নারকোল ডাঙায়  ছুঁড়ে দিয়ে যখন উঠে আসছে তখনই মস্ত এক সাপ। ফণা তুলে সামনে দাঁড়ানো। একেবারে নাগালের মধ্যে, মুখোমুখি। বাঁচার উপায় অনেক ছিল। উলটে জলে পড়লেই হত। কিংবা হাতের একখানা নারকোল  ছুঁড়ে মারলেও হতে পারত।

কিন্তু সমীরণের স্তম্ভনটা অন্য কারণে। সাপটা অদ্ভুত। বুকখানা টকটকে লাল। আর পিঠটা সাদা চিকরিমিকরি, এরকম অদ্ভুত সাপ সে জন্মে দেখেনি। ভয় পাবে কি, সাপ দেখে সে মুগ্ধ। বিড়বিড় করে বলেও ফেলল, তুমি কী সুন্দর! কী সুন্দর!

কয়েক সেকেন্ড ফণা তুলে দুলল সাপটা। সমীরণ দাঁড়িয়ে। শরীর ভেজা। টপটপ করে জল পড়ছে। বুকে একটুও ভয় নেই।

সাপটা তাকে দেখল কিছুক্ষণ। বোধহয় বোকা আর পাগল বলে চিনতেও পারল। তাই হঠাৎ একটা শ্বাস ফেলে মাথাটা সরসর করে নামিয়ে ঘাসবনে অস্ত গেল।

কাউকে বলেনি সমীরণ। বললে লোকে বলবে, তুমি সত্যিই পাগল হে।

বাড়ি গিসগিস করছে লোকে। তাই সমীরণের জায়গা হয় না। আসলে একটু দাপের লোক হলে জায়গায় অভাব হয় না। কিন্তু সমীরণের মতো মুখচোরার দ্বারা তা হওয়ার নয়। নবীনদাদু মরার পর তার ঘরখানা সমীরণের পাওনা ছিল। কিন্তু গদাইকাকা এসে ঘরখানার দখল নিয়ে ফেলল, বলল , তুই একাবোকা মানুষ, তোর আস্ত একখানা ঘরের দরকারটা কী? যখন বিয়ে করবি তখন দেখা যাবে।

সমীরণ তাই একটু ফাঁকে থাকে। ঘর নয়। রাঙাকাকার ঘরের লাগোয়া দাওয়ার উত্তর দিকটা একটু বেড়া দিয়ে ঘিরে নিয়েছে। সেই ঠেকখানা তেমন মজবুত নয়। শীতের হাওয়া, গরমের হাওয়া দুইই ঢোকে, বৃষ্টির ছাঁট আসে, ব্যাং লাফায়, ইঁদুর দৌড়োয়, কুকুর বেড়াল ঢুকে পড়ে। বেড়ালদের বাচ্চা দেওয়ার সময় হলে তারা আর কোথায় যাবে সমীরণের চৌকির তলা ছাড়া? সমীরণের বিয়ের উদ্যোগ হচ্ছে। সে ভাবে, বিয়ে না হয় হল, কিন্তু এই এক চিলতে ঘরে বউ আর সে বড্ড ঘেঁষাঘেষি হবে না? তার ওপর ওই একটা সরু চৌকি, রাতবিরেতে হয় তার ধাক্কায় বউ পড়ে যাবে, নয় তো বউয়ের ধাক্কায় সে। কী কেলেঙ্কারিটাই হবে তা হলে! ভালোমানুষের মেয়েকে কষ্ট দেওয়া বই তো নয়।

সকালবেলাটায় সমীরণের মনটা বেশ ভালো থাকে। আজও ছিল। সোনাজ্যাঠা এসে সেটা কেমন উলটে দিল। এসে ঘরের ভিতরে উঁকি মেরে দেখে নিয়ে নাক সিঁটকে বলল , এ ঘরটায় এমন মুতের গন্ধ কেন রে?

সমীরণ অবাক হয়ে বলল , নাকি?

নয়? তোর তো দেখছি তুরীয় অবস্থা, মুতের গন্ধ পায় না এমন আহাম্মক কে?

সমীরণ ভারী কাঁচুমাচু হল। মুতের গন্ধের দোষ কী? মোতি নামের বেড়ালটার প্রসব হয়েছে কদিন। চৌকির তলায় তার আঁতুরঘর। অপকর্মটা হয়তো মোতিই করে। কে জানে বাবা।

নবাবগঞ্জের মেয়েটা বাতিল হয়ে গেল, বুঝলি!

বুঝল না সমীরণ। বলল , কোন মেয়ে?

আমার খুব পছন্দ ছিল। গণেশদাদাও বলছিল দুর্গাপ্রতিমার মতো দেখতে। কিন্তু সেজবউ বলল , মেয়ের খুঁত আছে। কী খুঁত তা ভেঙে বলল  না। মেয়েলি ব্যাপার, কে জানে বাবা কী। মোটমাট বাতিল।

ও। আচ্ছা। সমীরণ এর বেশি আর কী বলবে?

সমীরণ চেয়ে রইল।

ও মেয়ে দেখার পর সেজবউ ভয় পেয়েছে, সুন্দরী বলে তার যে গ্ল্যামার ছিল তা এবার যাবে। নবদুর্গা এলে তাকে কেউ ফিরেও দেখবে না। তা বলে মুখের ওপর অমন কটমট করে কথা না শোনালেও পারত।

কী কথা জ্যাঠা।

এই হেনতেন, মেয়েদের অনেক কায়দা জানা আছে। বিঁধিয়ে–বিধিয়ে এমন বলে। মেয়েটা ভারী দুঃখ পেল।

সমীরণ একটু বিষণ্ণ হল। মুখের ওপর কাউকে বাতিল করা কি ভালো?

তুই মুতের গন্ধ পাস না কেন রে? এঃ বাবা, নাক যে জ্বালা করছে।

সমীরণ পায় না তা কী করবে। ভারী দুঃখী হয়ে সে বসে রইল। হোক মুতের গন্ধ, তা বলে কি সে মোতিকে বাচ্চাসমেত ঘরের বার করতে পারে? সমীরণ অনেক কিছুই পারে না যা পারা। উচিত।

তাঁতঘরে আজ সারাদিন ভারি আনমনা রইল সমীরণ। অন্যদিন তাঁতের শব্দ তার সঙ্গে নানা কথা বলে। শুনলে লোকে তাকে আরও পাগল বলবে বলে সে কথাটা কাউকে বলে না। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি তাঁতের সঙ্গে তার নানা কথা হয়। তাঁতও তার কথা বুঝতে পারে, সেও বোঝে তাঁতের ভাষা।

আজ তাঁত বলল , পরশু শিবরাত্রি।

হ্যাঁ, তা জানি, তাতে কী?

 জানো? ভালো। এই বলছিলাম আর কি, শিবরাত্রি ভারী ভালো দিন।

অ। তা হবে। আজ আমার মনটা ভালো নেই।

ভালো না থাকারই কথা। বলি কি শিবরাত্রির দিনই গিয়ে নবাবগঞ্জে হানা দাও। মেয়েটার কাছে ক্ষমা চেয়ে নাও।

যাব?

যাও। খুঁতো মেয়ে বলছে, তা খুঁতো নয় কে? সবাই খুঁতো।

সমীরণ একটা শ্বাস ফেলল। বলল , দুনিয়াটা কেমনধারা বলো তো!

তোমার জায়গা নয় হে এটা। তুমি হলে পাগল আর বোকা।

তা তো জানি।

ওরকমই থাকো। অন্যরম হওয়ার কথা নয় তোমার। ঠাকুর যেমনটি করেছেন তোমায় তেমনটিই থাকো।

৩.

জগা খুড়ো এসে বলেছিল, তোর কপালে হলে হয়। ছেলে পাগল ঠিকই, বোকাও হয়তো, কিন্তু ভগবান কাউকে কাউকে পাঠান। এ তার নিজের লোক।

পাগল আর বোকা! মাগো!

জগা খুড়ো যেন কেমনধারা পাগুলে চোখে আনমনা চেয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলল , সংসারী হিসেবে সে এমন কিছু আহামরি নয়। তবে অন্য একটা হিসেবও তো আছে। অন্য হিসেব

এই অন্য হিসেবটা বোঝে না নবদুর্গা। সে তো সংসারী মানুষ, বুঝবে কী করে? আবার তার মনটা মাঝে-মাঝে ভারী অন্যরকম, তখন সে ঠিক সংসারী থাকে না। তখন তারও হিসেব উলটেপালটে যায়।

গোবিন্দপুরের লোকেরা এসেছিল। তাকে নাকচ করে গেছে মুখের ওপরেই। ভগবানের লোকের সঙ্গে তার বিয়েটা হচ্ছে না। একটা বউ এসেছিল তাদের সঙ্গে দেখতে ভারী ঢলঢলে। কিন্তু জিবের যা ধার। মিষ্টি–মিষ্টি করে এমন সবকথা বলল , রংটা তো তেমন নয়, চুলের গোছ কী আর ভালো, দাঁতগুলো অমন কেন, পান খাও নাকি? পোকা নয় তো! খ্যামোকা কথা সব। বলতে হয় বলে বলা।

কাল শিবরাত্রির উপোস গেছে। আজ নবদুর্গার শরীর ভারী দুর্বল। সকালে কাঁচা মুগ ভেজানো গুড় দিয়ে খেয়েছে আর মিছরির শরবত। শরীর নয়, মনটাই যেন আজ তেমনধারা। শিবরাত্রি করে কী হয়? কচু হয়? কিছু হয় না। ন’বছর বয়স থেকে শিবরাত্রি করে আসছে সে। কিছু হল?

জগা খুড়ো এল বেটান’টা নাগাদ।

আছিস নাকি ঘরে?

আছি গো, কেন?

 শরীর খারাপ নাকি?

ব্রত করলাম না?

ও, তাই তো বটে!

জগা খুড়োর মুখে কেমন যেন বোকা–বোকা হাসি। মাথাটাথা চুলকে বলল , ওই একটা ব্যাপার হয়েছে।

কী ব্যাপার খুড়ো?

বাড়ির লোক টের পেলে কী করবে কে জানে।

ভয় খেয়ে নবদুর্গা উঠে বসল। তার যে বুক দুরদুর করছে!

কী হল খুড়ো?

আমার ঘরটায় একবার যা। একজন এসে বসে আছে। বড় দুঃখী মানুষ।

কে গো?

যা না। দেখে যদি বুঝতে পারিস তবেই হয়। যা একবার।

নবদুর্গার বুকের মধ্যে কেমন যেন আছাড়ি পিছাড়ি ভাব। বড্ড মোচড় দিচ্ছে পেটের মধ্যে। মুখ শুকিয়ে কাঠ। সে তবু উঠল।

খুড়োর ঘর পর্যন্ত যেতে উঠোনটা যেত তেপান্তরের মাঠ। সিঁড়ি মোটে এক ধাপ। তাও পেরোতে যেন হাঁটু ভেঙে এল। ঘরের দাওয়ায় উঠে দরজা অবধি যেন যেতেই পারছিল না। দরজায় থমকে গেল।

একে সে এ জন্মে দেখেনি ঠিক। কিন্তু এ তার সাত জন্মের চেনা। এ কি আজকের?

অপরাধী একজোড়া চোখ তুলে সে চাইল। তারপর তার চোখও পলকহীন। চিনেছে কি?

হ্যাঁ চিনেছে। সেই চেনার ঝিকিমিকি চোখে উথলে উঠল।

নবদুর্গা একটু হেসে মাথা নোয়াল।

দুজনের কোনও কথা হল না। শুধু আড়াল থেকে জগা খুড়োর মৃদু গলা খাঁকারির একটা শব্দ হল। উঠোনের ওধার থেকে লছমী হঠাৎ ডেকে উঠল অকারণে। কিংবা কে জানে তত অকারণে হয়তো নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *