নবগ্রামের মেয়ে – অমর মিত্র
তোর সঙ্গে নবীন ঘোষের দেখা হয়নি তো খোকা?
কথাটা আচমকা কানে যেতেই খোকা কিরে দেখল সেই ধূর্ত মুখ। নবীন ঘোষের সঙ্গে তার দেখা হয়নি বাঁচোয়া, কিন্তু এই লোকটার সঙ্গে পথে দেখা হওয়াও ভাল নয়। দুজনে সারাদিন আলাদা আলাদা ভিন্ন পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চুক্তি আছে পথে যেন এক সঙ্গে ওদের কেউ না দেখতে পায়। সে বাড়ি ফিরছে নবগ্রামের মেয়ের টানে, বাপ ভুবন সেনাপতি এই সন্ধেয় ফিরছে কেন? তার আবার কোন টান? খোকা দেখল বাপের চোখ জোড়াই আছে আগের মতো। ধুতি জামা পায়ের চটি সমেত দেহটার ভিখিরির দশা। সারাদিন এ পথে ও পথে ধান্ধায় ঘুরে ঘুরে এখন মাথাটা যেন বুকের কাছে ঠেলে যাচ্ছে। কারবার দিন দশেক বন্ধ! বন্ধ রাখতে হয়েছে। শুধু শুধু ঝাঁপ খুলে পাওনাদারদের সুযোগ করে দেয়ার অর্থ হাঁড়িকাঠে মাথা দেয়। পুঁজিপাটা এখন শূন্যের ঘরে ঠেকেছে প্রায়।
বাপের সঙ্গে খোকার দেখা এই বড় রাস্তার মোড়ে। এখান থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি দশ মিনিট। এই দশ মিনিটই ভয়ের। যদি নবীন ঘোষ বা রাখাল সর্দারের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। খোকা এল পুব থেকে, বাপ হেঁকে উঠল পশ্চিমের ধুলোবালি মেখে। চুক্তিমত এখন একজনের যাওয়ার কথা যেন উত্তরে, অন্যজন পা বাড়াবে দক্ষিণে। ভাগ্যিস পৃথিবীর চারটে দিক আয়ত্তে ছিল মানুষের। এই চারদিক নিয়ে কলকাতা শহরটাও ভুলভুলাইয়া। গলি, ঘুপচি, লেন বাইলেন তস্য বাইলেন নিয়ে একেবারে বংশলতিকার মতো! শেষ নেই। সব গোলকধাঁধা পাওনাদারদের চেয়ে বেশি চেনে খোকা। তাই পার পেয়ে যাচ্ছে।
তোমায় ধরেছিল? এক হাত দূর থেকে জিজ্ঞেস করল খোকা।
হুঁ। বিষণ্ণ ভুবন সেনাপতি আরও একহাত সরে গেল। এখন পাশাপাশি হাঁটতে রীতিমত ভয়। দূর থেকেই কথা হোক। একজনকে ধরলে অন্যজন সটকে যেতে পারবে।
মতি সিং ধারে মাল দেবে? খোকা দূর থেকে আবার জিজ্ঞেস করল। জবাব দিল না ভুবন। এখানে মৌন থাকার অর্থ অন্য, তা তার ছেলের বুঝতে অসুবিধে হয় না। হালকা অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে পুরনো শহরের প্রতিটি বিন্দু। দুজনে চাইছিল আর একটু অন্ধকার নামুক এই এতটুকু পথের ভিতরে। নাহলে কী হতে কী হয়ে যাবে। কারবারে বাপ বেটায় খুব ফেঁসে গেছে। ফেঁসে এখন পাওনাদারদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আর খোকার তো সাড়ে সব্বোনাশ। ঘরে বাইরে তাড়া খাওয়া অবস্থা। ছেলেকে নবগ্রামে বিয়ে দিয়েছিল ভুবন সেনাপতি। নবগ্রামের সেই মেয়ে এখন রণচণ্ডী মূর্তি ধরেছে। স্বামী শ্বশুর সব তার কাছে সমান। ফুলশয্যের রাত থেকে ধান্ধায় ছিল স্বামীকে নিয়ে আলাদা হবে। খোকা তার কাছে গোপনে ছ মাস সময় নিয়েছিল। কিন্তু কপালের গেরো, টিমটিমে কারবার হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়ল। দেনায় দেনায় দোকান লাটে ওঠার জোগাড়। এখন আর আলাদা হওয়া সম্ভব নয়। তাহলে কারবাবের দেনা মাথায় একা হতে হয়। আর একা হলেই পাওনাদারের দল ঠেসে ধরতে সুবিধে পাবে। খোকা প্রত্যেকদিন সকাল বিকেল থেঁতো হচ্ছে নবগ্রামের মেয়ের কাছে। শশুরকেও ছাড়ে না বউ, আজ সকালেই তো স্বামী শ্বশুরের দুটো মাথা যেন ঠোকাঠুকি করে দিয়েছে বাক্যবাণে। খোকা ফিরছে ভয়ে ভয়ে। ঘরে ফিরলে বউ দিনরাত্তির বলে কবে যে থান কাপড় পরে শাঁখা ভাঙব। শাঁখা আগে ভাঙে না থানকাপড় আগে পরে, এটা ভুবনের ছেলের জানা নেই। বউকে যে জিজ্ঞেস করবে তাতেও ভয় করে। মেয়ে মানুষের মুখ আর জিভে কী পার্থক্য। মুখের কথা মনে পড়লে জিভের কথা ভুলে টানে টানে ঘরে ছুটতে হয়। নবগ্রামের সুন্দরীর টান আছে।
ভুবন সেনাপতি বলল, ক্যানিং ইস্টিটের মুখে নবীন ঘোষের সঙ্গে দেখা, আমি ওরে দেখিনি, আমাকে পিছন থেকে খপ করে ধরে বলল, পাঁচশো টাকা কবে দেবা, দোকান বন্ধ কেন?
খোকা বাপের দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি বললে তুমি?
—শালা এখন চা সিগারেটে ভোলে না, ফালতু ষাট পয়সা খরচা হল, শেষে তোর ঘাড়ে চাপলাম খোকা।
হুঁ। খোকা কিছু বলল না। এটা তো অলিখিত চুক্তি, বাপ তোর নামে বলবে, সে বাপের নামে, না হলে রেহাই পাবে কিভাবে?
—বললাম ছেলের হাতে দিয়েছিলাম, অপগণ্ড ছেলে তার বউয়ের জন্য গয়না গড়ে সব্বোনাশ করে দিয়েছে পাঁচশো টাকার।
খোকার বুকটা কেঁপে উঠল। করেছে কী তার বাপ। একথা যদি নবগ্রামের সুন্দরীর কানে যায় তো অনর্থ করবে। আর সুন্দরীর বাপের কানে গেলে তার শেষ। খোকার শ্বশুরের অবস্থা ভাল। চালু মিষ্টির দোকান নবগ্রাম ইস্টিশনের গায়ে। বিয়েতে মেয়ে জামাই মিলিয়ে পাঁচ ভরি সোনা দিয়েছিল। সেই গয়না যে সুন্দরী কোথায় সরিয়ে ফেলেছে তার খোঁজ পাওয়া দুষ্কর। বড় চতুর মেয়েমানুষ। কান গলাও খালি করে ফেলেছে। এমনকি ফুলশয্যার রাতে সে যে নাকছাবি দিয়ে প্রথম চুম্বন করেছিল নবগ্রামের সুন্দরীকে, তাও নেই। বউ বলে অভাবী কারবারে সামনে থাকলে ও গয়না থাকবে না, কারবার খেয়ে নেবে। বাপ তার বড় কারবাবি, এসব খবর সে জানে। এ নিয়ে কিছু বলতে গেলে নবগ্রামের মেয়ে চোখ রাঙায়, কোন বাপের মেয়ে আমি তা জান? খোকা তখন চুপসে যায়। শুধু তার বাপ ভুবন সেনাপতি মাঝে মধ্যে ছেলেকে উপদেশ দেয়, বউ তোর খুব স্যায়না, বউয়ের খপ্পরে পড়িসনি খোকা, রস নিংড়ে নেবে, ও হল ময়রার মেয়ে।
ময়রা শ্বশুরকে দেখে শেখার আছে এটা মনে হয় মাঝে মধ্যে, কিন্তু কী যে শিখবে তা খুঁজে পায় না খোকা। শুধু মনে হয় শেখার আছে। বউ-এর মন ভিজোতেও একথা বলে মাঝে মধ্যে। তখন বউ যেন পাথরে পাথরে ঠিকরানো আগুন হয়ে ওঠে, ‘কিন্তু শেখ না কেন, শেখ তো ওই ফেলমারা কারবারি নিজের বাপের কাছে, যাও ধরো আমার বাপেরে।’
ধরেছিল খোকা তার শ্বশুরকে। গোবেচারা হয়ে মুখ অন্ধকার করে হাত কচলে বলেছিল, কারবার এখন লাটে উঠতে গেল বাবা।
কারবারটি কি? না গো-খাদ্য বিক্রি করা। খড় ভুষি খইল আর চিটে গুড়ের কারবার ভুবন সেনাপতির। সঙ্গে আছে নবগ্রামের জামাই, তার ছেলে। এ তল্লাটে খাটাল কম নয়। গরু মোষ ছাগল যে কত বেওয়ারিশ হয়ে ঘুরে বেড়ায় তারও ইয়ত্তা নেই। তার চেয়েও বেশি আছে খাটালের গরু মোষ। কিন্তু ইদানীং হয়েছে বিপদ। এক বিহারী ঢুকে পড়েছে ব্যবসায়ে। পঞ্চাশ গজ দূরে গোবিন্দ আঢ্যি লেনের মুখে দোকান খুলে বসেছে। বিহারী গোয়ালার দল সব দেশওয়ালি ভাইয়ের কাছে ছুটছে।
খোকা ভেবেছিল শ্বশুর বাঁচাবে। বাঁচাতও হয়তো এই ভরাডুবি থেকে কিন্তু কারবারে তার বাপ অংশীদার শুনে পিছিয়ে গেছে। নবগ্রামের শাশুড়ি আবার শ্বশুরের চেয়ে বেশি বুদ্ধি ধরেন। তাঁর পরামর্শেই তো শ্বশুরমশায়ের এত রমরমা। শোনা যায় শ্বশুর নাকি প্রত্যেক দিন সকালে—। যা শোনা যায় যাক। শ্বশুর শাশুড়ি পিতৃমাতৃতুল্য, তাঁদের কারবারে মাথা গলানো পাপ। শ্বশুর মশায় তো বাঁচালেন না, উল্টে নবগ্রামের মেয়ে সুন্দরী বলেছিল, তোমাদের কোনও কালচার নেই।
কালচার। হাঁ হয়ে গিয়েছিল ভুবন সেনাপতির ছেলে। এসবের কথা ভাবেওনি কোনওদিন। কারবারে লাভ করো, সংসারধর্ম পালন করো, এর বাইরে অন্য কিছু থাকতে হয় নাকি?
—তফাৎটা দ্যাখো, তোমরা কর গো-খাদ্যের ব্যাওসা, আমার বাপ করে মানুষের সোয়াদের কারবার—।
—তো, কারবার কারবারই, যাতে লাভ হয়।
—উহুঁ, কোথায় জিভের সোয়াদ, আর কোথায় গোরুর জাবনা…।
গোঁয়ার গোবিন্দ খোকা তার বউয়ের সঙ্গে জোর তক্কে নেমেছিল। চিৎকার করে করে বোঝাচ্ছিল, ‘বড়বাজার নে যাব, মতিসিং মশায়ের গোডাউন দেখলে হাঁ হয়ে যাবা, কত বড় কারবার খইল আর চিটেগুড়ের, আহিরিটোলায় তিনতলা বাড়ি—’
ফিকফিক করে হেসেছিল সুন্দরী, ‘এই তোমার শালাশালি আসে যদি, হাতে ধরো পয়সা নেই, কি দিয়ে আতিথ্য করব?’
—কেন পয়সা থাকবে না, থাকবে, কবে আসবে তা যদি জানা যায়—মাথা নেড়েছিল সুন্দরী, ‘ফুহ, যদি তাদের ভাগ্নে ভাগ্নী হয় তো বলে আসবে বোনের বাড়ি, যখন তখন।’
খোকা আকাশ থেকে পড়েছিল, ভাগ্নে হবে নাকি।
সুন্দরী তার গা থেকে আরশোলা ঝেড়ে ফেলার মতো সরিয়ে দিয়েছিল খোকার হাত। সরিয়ে দিয়ে স্বামীকে তাচ্ছিল্য করে বলেছিল,‘আমার বাপের মিষ্টির দোকান আতিথ্য করার অসুবিধে নেই, খপর পাঠালেই হল, গজা বালুসাই চলে আসবে, কিন্তু তোমাদের কারবার, একবার ভেবে দ্যাখো দিকি।’
মনে লেগেছিল খোকার। বউ আপন হলেও তো আসলে আপন নয়, আপন হল বাপ মা। ভেবেছিল কারবারে উন্নতি করে দেখিয়ে দেবে নবগ্রামের মেয়েকে, গো-খাদ্যও একটা ব্যবসা বটে। আদি ব্যবসা, এ ব্যবসা না থাকলে ছানার কারবার থাকত? ফুটে যেত না সুন্দরীর বাপ, তার নবগ্রামের শ্বশুর। কিন্তু তার যেন সারা জীবন হেনস্থা হওয়ার জন্য ওই মেয়ের সঙ্গে মালাবদল হয়েছে। পঞ্চাশ গজ দূরে ওই দোকানটা খুলতেই ভুবন সেনাপতির কারবারের তেল কমতে কমতে এখন যেন প্রদীপের বুক পুড়ছে চচ্চড়িয়ে। ধারে ধারে বাপবেটায় ডুবে যাচ্ছে। এখন বউয়ের নাম জুড়ে দিয়েছে ভুবন নবীন ঘোষের কাছে। আসলে পুত্রবধূর চালচলনে ভুবনের ভিতরে বিন্দু বিন্দু রাগ জমেছিল, তা এই ভাবে মেটাল।
খোকা তার বাপকে বলল, তুমি যে বলেছ বউরে আমি গয়না গড়ে দিয়েছি, এটা কি ভাল করলে, সত্যি তো দিইনি, শুধু শুধু নবগ্রামের মেয়েরে জড়ালে কেন?
আকাশ থেকে পড়ল ভুবন, তোর বউয়ের কী দোষ, দোষ তো তোর নামে দিলাম, তুই বউপাগলা, বউয়ের ইয়েতে দিয়েছিস পাওনার টাকা?
—ঘরের বউ টানলে কেন চিটেগুড়ের কারবারে, তার চেয়ে যদি বলতে সব আমি চোলাই খেয়ে উড়োয় দিছি!
ভুবনের মুখ অন্ধকার, গোমড়া মুখে সে বলল, তা কী হয়, ছেলে আমার চোলাই খেয়ে পয়সা উড়োবে, তেমন ছেলের জম্মো দিইনি আমি।
—কিন্তু এখন যদি সুন্দরীর কানে যায়!
চমকালো খোকার বাপ। সত্যি তো! রাগে ছেলের বউকে ঢিট করেছে এইভাবে, কিন্তু কথাটা তো মিথ্যে। নবগ্রামের বেয়াই বেয়ান যদি শোনে। তারা তো জানে না, এইভাবে বাপ-বেটায় পাওনাদারের কাছ থেকে রেহাই পাচ্ছে। ছেলের সঙ্গে দেখা হলে সে বাপের ঘাড়ে চাপায়, আর বাপ দোষী করে ছেলেকে। সঙ্গে আজ কায়দা করে নবগ্রামের মেয়েকে জুড়ে দিয়েছে। ক্যানিং স্ট্রিটে নবীন ঘোষকে বলেছে,‘ছেলে হয়েছে বউয়ের ন্যাওটা, দিলাম আপনার পাঁচশো টাকা শোধ করতে, গড়ে এনেছে বউয়ের হার, কী দিনকালই না পড়ল, ছেলে সর্বক্ষণ বউয়ের আঁচল ধরে বসে আছে।’
ঘরের সামনে বাপবেটায় কাছাকাছি হল। ভয় কেটেছে। এখন শুধু নবগ্রামের মেয়েকে সামলাতে হবে। যদি তার কানে যায়। আজ সকালে বেরোনোর সময়ই বউ একচোট শুনিয়েছে। দোষের মধ্যে নাকছাবিটা চেয়েছিল খোকা। তাও বেচার কথা বলেনি। শুধু বলেছিল একবার চোখের দেখা দেখবে। ফুলশয্যের কথা আজ সকাল থেকে খুব মনে পড়ছিল খোকার। শুনে বউয়ের কী তর্জন গর্জন। নবগ্রামের মেয়ের চোখ ফাঁকি দেয়া খোকার সাধ্য নয়। উঠোনে পা দিয়ে বাপবেটায় ভূত দেখল।
আরে একী। নবীন ঘোষ গ্যাঁট হয়ে বসে আছে চায়ের কাপ নিয়ে। নিশ্চয়ই সুন্দরীর কাজ। না হলে পাওনাদারকে ঘরে বসিয়ে চা খাওয়ায় কোনও বউ, বড়মানুষের ঝি স্বামী শ্বশুরের দুঃখ বোঝে না।
ভুবন সেনাপতি কাঁচা ভয় গিলে নিরীহ হয়ে জিজ্ঞেস করল, নবীনবাবু যে, হঠাৎ।
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে ঠং করে কাপটা মেঝেয় রেখে নবীন উঠে দাঁড়াল। মুখের চেহারার কী বিকৃতি। মেঝেয় কাপের শব্দে খোকার বুক ভেঙে গেল যেন।
আর রক্ষা হল না। নবীন ঘোষ খোকার দিকে এগোচ্ছে। ফলাফল জলের মতো। ইঙ্গিত করেছে ভুবন। নবীন ঘোষ টাকার কথা উচ্চারণ করার আগেই থোকা ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার পায়ে,‘কটাদিন সময় দাও দাদা, খরচ হয়ে গেছে সব।’
পায়ে ঝাঁপালে সমুদ্র কেন বৈতরণী পার হওয়া যায়। এ শিক্ষা ভুবনের। ছেলেকে শিখিয়েছে দরকারে বউয়েরও পায়ে পড়বি, দেখবি সব ঠাণ্ডা।
—অ্যাই অ্যাই। সরে যা, টাকা দিয়ে পা ধর, খবদ্দার আর পায়ে হাত দিবিনে…বলতে বলতে নবীন ঘোষ নিজেই সরে গেছে এক লাফে। টাকা ছেড়ে কথা বল, কোনও ভুজুং ভাজুং-এ আর ভুলছিনে…।
ঝড় এখন খোকার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। ঘুরে তার বাপের দিকেও আসতে পারে। এবার সটকে যেতে হয়। সেনাপতি রণে ভঙ্গ দিয়ে পালাতে যেতেই তার জামায় টান পড়ল। কে? নবগ্রামের মেয়ে। হে ভগবান। এ যে দেখি জলে বাঘ ডাঙায় কুমির। পালানো যাবে না। সেনাপতি দেখল পুত্রবধূর চোখ জ্বলছে, মাথায় ঘোমটা নেই, চুল খোলা, কপালের সিঁদুর নাকে গড়াচ্ছে। স্বামী শ্বশুরের হেনস্থায় বড়মানুষের মেয়ের খুব ফুর্তি।
—কেউ বেরোবে না, ছিঃ, দেনার জন্য মানুষের পা ধরা, কী কপাল আমার! এই যে তুমি চিটে গুড়ের পাওনাদার, থুঃ, বাইরে গিয়ে দাঁড়ান, দেখছি আমি।
উঠে দাঁড়িয়েছে খোকা। তার চোখে জল, সর্বাঙ্গে ধুলোবালি। পাওনাদার বাড়ির বাইরে। সে দেখতে লাগল সুন্দরীর কাণ্ড। বউ ঘরে ঢুকল, বেরোল। শ্বশুরকে ডেকে কী যেন বলল। হাতে কী যেন দিল। সেনাপতি তা নিয়ে একলাফে ছুটে গেল পাওনাদারের কাছে। আহা, কী সুন্দর লাগছে বউকে। এর রূপে মজেছিল খোকা। ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বউ যে সামনে এল, এসে আবার তর্জন গর্জন, ‘দিয়ে দিলাম হার ছড়া, তোমার কালচার বলে কিছু আছে, কিনা ফুলশয্যের নাকছাবি বেচতে চাও, এই জন্য বলি সোয়াদের কারবার ধরো। ছি! ছি! ছি! হার বন্ধক দিয়ে দেনা শোধ করে এসো!’
খোকা চমকে উঠল। নবগ্রামের মেয়ের নাকে সেই নাকছাবি জ্বলজ্বল করছে। বুকটা ধক করে উঠল ছোট সেনাপতির। হারের চেয়ে কি নাকছাবির দাম বেশি?
২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮৪