নন্দকুমার
বন্ধুগণ! (কে কার বন্ধু!)
কলকাতার বয়স হল তিনশো। মানুষ হলে বারপাঁচেক মরে জন্মাত। শহর বলে গেঁজে গিয়েও টেঁসে যায়নি। এই ভেরি ওল্ডসিটির জন্মোৎসব হচ্ছে। কেন হচ্ছে, তার একটা কারণ অনুমান করা যায়। ব্যাবসা। বেওসা। এই হুজুগে বেওসায় একটু বুম আনা। বই বেরোবে পত্রপত্রিকা বেরোবে। বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি হবে। ফাংশান হবে। স্টেজ, মাইক, ডেকরেশান, আর্টিস্ট সবাই একটু নড়েচড়ে বসবেন ক্যালকাটা থ্রিহান্ড্রেড। শাড়ির পাড়ে, গেঞ্জির বুকে। মাথাটা খেলেছে ভালো। তা বন্ধুগণ! আমাদের একটা অরিজিন্যাল প্ল্যান ছিল। ওসব ওই সংস্কৃতি টংস্কৃতি নয়। কলকাতার হাল বদলে দেওয়া। সেই তিনশো বছর আগে যেমনটি ছিল সেইরকম করে দেওয়া। এইবার আমাদের রূপকারের মুখে শুনুন।
।। রূপকার।।
তিনশো বছর আগে জোব চার্নক যখন গঙ্গার তীরে এসে নামলেন, তখন কলকাতা বলে কিছু ছিল? ছিল না। একটা উঁচু ডাঙা। চারপাশে বনবাদাড়। গোটাকতক আটচালা। সেদিন আবার তেড়ে বৃষ্টি পড়ছিল। বগবগে কাদা। খানাখন্দ। কোথায় রোড রোড! কোথায় সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ, কলেজ স্ট্রিট, কর্নওয়ালিস স্ট্রিট! সায়েব একটা আটচালায় আশ্রয় নিলেন। বিদ্যুৎ তখন কোথায়! সি ই এস সি জন্মায়নি। সায়েব একটা ল্যাম্পো জ্বালিয়ে ধড়া-চূড়া ছেড়ে বসলেন। ভাদ্রের ভ্যাপসা গরম। হাজারখানেক মশা তেড়ে এল ফোরেন রক্তের লোভে। বাইরে কোলা ব্যাঙের কনসার্ট। দূরের জঙ্গলে শেয়ালের কোরাস। সায়েব মনে-মনে গাইতে লাগলেন, গড সেভ দি কিং। রুপিয়া কামানে আয়া। অওর কোই ধান্দা নেই।।
ঠিক এই জায়গাটাতে আমাদের প্ল্যান করে ফিরে যেতে হবে। খুব কঠিন কাজ। এম্পায়ারের একটা বদ স্বভাব ছিল, যেখানেই যাবে সেখানে একটা ইংল্যান্ড তৈরি করে বসবে। সবচেয়ে প্রবলেম করেছিল সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ। দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধের মিলিটারি ইঞ্জিনিয়াররা রাস্তা নয় তো বজ্র তৈরি করে গিয়েছিল। ভাগ্যিস পাতালরেলের সাহায্য পাওয়া গিয়েছিল, নয়তো মেয়রের খোন্দকার বাহিনী খুব বিপদে পড়ে যেত। আমাদের বৈষ্ণব নীতি হল, বাইরে কোনও কিছুর অহংকার রাখবে না। বিদেশি চেকনাইওয়ালা ব্যাপারটাকে আমরা পাতালে ঠেলে দিয়ে ইংলিশ মিডিয়ামের মতো ইংলিশ শহরটাকে খাবলে-খুবলে, কুদলে-কাদলে অরিজিনাল অবস্থায় নিয়ে যেতে পেরেছি। আপনারা জেনে রাখুন সিনিয়ারিটি থাকলে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়। সৎ হতে হবে, প্রবল ইচ্ছাশক্তির অধিকারী হতে হবে। সেই মন্ত্র—করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে। আমরা করে ছেড়েছি। গোটা শহরে এক চিলতে রাস্তাও আমরা আস্ত রাখিনি। ওই জন্যেই বলে, সবে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ। আমরা সবাই মিলে কলকাতার নাড়ি ভুঁড়ি বের করে ছেড়ে দিয়েছি। তা ছাড়া বিধি আমাদের সহায়। কোথা থেকে এসে গেল গঙ্গা-অ্যাকসান প্ল্যান। কলকাতা কোদলাবার টাকার অভাব হল না। কলকাতার গঙ্গাযাত্রা সহজ হল। বেশ ঘটা করেই হল। ইলেকট্রিক সাপ্লাই আর টেলিফোনও আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। এমন সিনসিয়ার খোঁড়া-খুঁড়ি কারও কাছ থেকে আশা করা যায় না। তিনশো বছর যার বয়স তার তো গঙ্গাযাত্রাই হওয়া উচিত। এইবার একটা ঘটা করে শ্রাদ্ধ করতে হবে।
‘শ্রাদ্ধাদি পিণ্ডদান প্রভৃতিতে তো উদ্ধার পেয়ে যাবে! সেটা আর নাই বা করলেন। ভূত হয়ে থাক না। ভূতুড়ে শহরে প্রেতের নৃত্য।’
আইডিয়া ইজ নট ব্যাড। তিনশো বছর আগের ভৌতিক অবস্থাটাকে যদি ফেরানো যায়, নট ব্যাড। মানুষ যদি ভূত হতে পারে শহর কেন ভূত হবে না। তাহলে দেখুন, শহরের উত্তরাঞ্চলকে আমরা মোটামুটি তিনশো বছর আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে পেরেছি। সেই উক্তিটি নিশ্চয় মনে আছে গড হেল্প দোজ হু হেল্প দেমসেলভস। বৃষ্টি আমাদের কী রকম সহায় হয়েছে। জল-নিকাশী ব্যবস্থাটাকে মোটামুটি আমরা অকেজো করে দিতে পেরেছি। একটু আধটু যা লিক করে বেরিয়ে যাচ্ছে, তাও বন্ধ হয়ে যাবে। একপশলা বৃষ্টি মানেই এক হাঁটু ভড়ভড়ে কাদা। তারপর আমাদের অন্ধকার প্ল্যানিং , তার তো কোনও তুলনা নেই। পৃথিবীর সব দেশের পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে আলো বেরোয়; আমাদের দেশের পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে মেগাওয়াট মেগাওয়াট অন্ধকার বেরোয়। থইথই অন্ধকার, দঁক কাদা, গাড়ির পর গাড়ি লাইন দিয়ে আটকে বসে আছে। বহুকাল আগে নবদ্বীপ হালদারের একটা গান ছিল—লাগ, লাগ, লাগ, লাগিয়ে বসে আছি। ঠিক সেইরকম। গাড়িবাবুরা লাগিয়ে বসে থাকো। যতক্ষণ পারো থাকো। হাতির মতো স্টেটবাস, মুড়ির টিনের মতো মিনিবাস ঘোঁত-ঘোঁত করে কালো ধোঁয়া ছাড়ছে। আকাশে মেঘের কম্বল। জমিতে কোমর-ভর নর্দমা আর বৃষ্টির জলের ককটেল। আবর্জনা ভেসে-ভেসে বেড়াচ্ছে। ভ্যাপসা গরম। পোড়া ডিজেল আর পেট্রলের ধোঁয়া। চোখ জ্বলছে, নাক জ্বলছে, হাঁপানি আসছে। ক্যালকাটা থিরি হান্ড্রেড। ম্যানহোলের ঢাকনা চোরে চৌপাট করে দিয়েছে। পাতালরেল পথে যে লোহার প্লেট সাজিয়েছিল, জায়গায় জায়গায় সরে গেছে। যাও পথিক ওই তোমার বেদান্তের পথ। উপনিষদ যেমন বলেছেন—ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুর্জয় দুর্গাং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি। মানেটা কি? ক্ষুরের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগের মতো যে পথ, সেই পথকেই বিবেকমান মানুষ বলেছেন দুর্গম পথ। আর সেই পথ দুরতিক্রমণীয়। বাছারা সারাদিনের পর বাড়ি ফিরে ফুড়ুক ফুড়ুক চা খাবে, বিশ্রাম করবে, বউয়ের সঙ্গে প্রেমালাপ করবে! তা যাও, ওই উপনিষদের পথ সামনে পড়ে আছে। এখন-তখন রুগিকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। কিসে? অ্যাম্বুলেনসে? ওঁয়াওঁয়া করে কঁকিয়ে মরবে, পথ পাবে না। ঝাঁকায় করে মুটের মাথায় চাপিয়ে নিয়ে যেতে পারো। অ্যামনেও টাঁসবে, অমনেও টাঁসবে। চার্নকের আমলে হাসপাতালও ছিল না। এখনও নেই। বিল্ডিং আছে। ক্লাস ফোর আছে। চুল্লু আছে। চিকিৎসা নেই। একটা হাসপাতালে ছাদ খসে খসে পড়ে। বাথরুমের দরজার সামনে রুগি বসে-বসে কঁকাচ্ছিল। ভগবান মুখ তুলে চাও। ভগবান মুখ নীচু করে তাকালেন। বোম্বাই এক চাংড়া খুলে পড়ে গেল সোজা মাথায়। রুগি স্বর্গে। বন্ধুগণ! ব্যাপারটা ভালো করে অনুধাবন করুন—চার্নকের আমলে কলের গাড়ি ছিল না। মানুষ পয়দালে মারত। পালকি ছিল। হিঁয়াসে হুঁয়া যেতে পথে হেঁটে যতটা সময় লাগা উচিত ততটাই লাগত। এখন একগুঁয়েরা তিনশো বছরের কলকাতায় গাড়ি চাপছে; কিন্তু ফল পাচ্ছে হাঁটার। তাও পাচ্ছে না। জ্যামে আটকে বসে থাকছে এক যুগ। দিল্লি থেকে দেড় ঘণ্টায় এল প্লেন। দমদম থেকে চৌরঙ্গী এল সাত ঘণ্টায়। কেমন হল! ক্যালকাটা থ্রি হান্ড্রেড।
কথায় আছে, ইতিহাস রিপিট করে। ইতিহাস তো নিজে নিজে রিপিট করবে না, মানুষই রিপিট করাবে। সিরাজ একটা ব্ল্যাকহোল করেছিলেন। আমরা গণ্ডা গণ্ডা চলমান ব্ল্যাকহোল করেছি। বাস, ট্রাম, মিনি। যাও না, ভেতরে একবার ঢোকো। চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে দম আটকে মরো, মরো। সিরাজের হোলে টিকিট ছিল না। এখানে টিকিট লাগে। সেই টিকিটের দাম আমরা ডবল করেছি। যত দাম বাড়াবে ততই তার ইজ্জত বাড়বে। ক্যাপিট্যালিজমের উলটো হল ফ্যাসিজম। হিটলার জগদগুরু। প্রতিটি বাস, ট্রাম, ট্রেন, মিনি একটা করে কনসেনট্রেশান ক্যাম্প। সঙ্গে-সঙ্গে না মরো, তিলে তিলে মরবে।
আলিবর্দির আমলে বর্গির হাঙ্গামা হয়েছিল। আমরাও বর্গি ছেড়েছি ফিল্ডে। ঘোড়াটা সাপ্লাই করতে পারিনি। রিভলভার, পাইপগান, ভোজালি, নানা মাপের ডান্ডা, ঠ্যাঙা অকৃপণ বিতরিত হয়েছে। পুলিশ বাহিনীতে বেদান্ত, শঙ্করের মায়াবাদ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। গীতা ঢুকেছে :
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ
নায়ং ভূত্বাহভবিতা বা ন ভূয়:।
অজো নিত্য: শাশ্বতোহয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।
এই যে আত্মা, প্রেতাত্মা, জন্মায় না মরে না। কারণ যা আগে ছিল না কিন্তু পরে এল মানে বিদ্যমান হল, তারই নাম জন্ম। আর যা আগে ছিল এখন নেই, তারই নাম মৃত্যু। আত্মাতে এই দুই অবস্থার কোনওটাই নেই। মোদ্দা কথা, আত্মার জন্মও নেই মৃত্যুও নেই। অপক্ষয়হীন এবং বৃদ্ধিশূন্য। আত্মার জামা হল শরীর। জামা ছিঁড়ে গেল, গেল। আত্মা আবার নতুন জামা পরবে। পুলিশ দীর্ঘ সাধনায় আত্মোপলব্ধির চরম পর্যায়ে উঠতে পেরেছে। তাঁদের চোখের সামনে যা ঘটছে সবই মায়া। তাই বর্গিরা এখন বেশ দাপটে তাদের খেলা দেখাতে পারছে। তীর্থে মৃত্যু হলে যেমন স্বর্গে যায়, গণধোলাইতে মৃত্যু হলে অক্ষয় স্বর্গবাস হয়। ইংরেজ যে ভুল করেছিল বেদ-বেদান্ত না জেনে, আমাদের সে ভুল সাজে না। আমাদের দমন-পীড়ন চলবে তাদের বিরুদ্ধে, যারা আমাদের কলকাতা-তিনশো-ব্যাকওয়ার্ড মার্চে বাধা সৃষ্টি করবে। যেমন করেই হোক আমাদের পেছতে হবে। এগোনো তেমন কঠিন নয়। পেছোনোটাই কঠিন। যাঁরা গাড়ি চালান, তাঁরা জানেন ব্যাকগিয়ারে গাড়ি চালানো কি কঠিন। একবছরে পেছতে হবে তিনশো বছর। তাহলে ব্যাকগিয়ারে স্পিডটা একবার ক্যালক্যুলেট করুন। এই পেছোতে গিয়ে দুটো বড় ঐতিহাসিক ঘটনা আমাদের মাড়িয়ে যেতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কলকাতা, দুর্ভিক্ষের কলকাতা, দেশবিভাগের কলকাতা। আমাদের অতিসক্রিয় প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট প্ল্যান আর একজিকিউটিভ ডিপার্টমেন্টের একজিকিউশান সুন্দর মিলেছে। মিলিয়ে নিন;
যুদ্ধে কি হয়?
বোমা পড়ে। বোমা পড়লে কি হয়! সব ভেঙে চুরে যায়। কিছুটা আস্ত থাকে। কলকাতার অবস্থা অবিকল সেইরকম। রাতে অন্ধকার। আমরা একধাপ এগিয়ে—দিবারাত্র অন্ধকার। জল, খাদ্য, কেরোসিন উধাও। কেরোসিনের লাইনটা একবার দেখলেই বুঝতে পারবেন। আমরা সেন্টপারসেন্ট সফল। স্বামীজি বলেছিলেন, বলো, মায়ের জন্যে আমাদের জীবন বলিপ্রদত্ত। এখন বলতে হবে—’এক লিটার কেরোসিনের জন্য আমাদের জীবন বলিপ্রদত্ত। লাইন থেকে অক্ষত ফিরবে, না বর্গিদের হাতে বিক্ষত হয়ে ফিরবে—একেবারেই ভোগে চলে যাবে, ভাগ্যদেবীই জানেন।’ টালার জলের প্রেসার আমরা কমাতে পেরেছি। মনে করুন, যে বোমাটা ট্যাঙ্কে ৪৩ সালে পড়ার কথা ছিল, সেইটা পড়ল এই নব্বই সালে। জনজীবনে কেরোসিনের টিন আর জলের বালতি ছাড়া কিছুই থাকবে না বন্ধুগণ।
আমরা একটা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তৈরি করতে পেরেছি। রোজ দুপুরে স্ট্রিটফাইট শুরু হয়, চলে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। রাস্তায় ইটপাটকেল, ভাঙা কাচ, ছেঁড়া চটি। ডজনখানেক লাশ পড়ে যাওয়া কোনও ব্যাপার নয়। বাঙালি বাঙালির সঙ্গে লড়ছে। বাঙালি পরিবার আগেই ভেঙেছে, এইবার ভাঙছে সমাজ। এই হল ক্যালকাটা ৩০০ স্পেশাল।
আপনারা একবার রাতের দিকে টালা থেকে টালিগঞ্জ ঘুরে আসুন। বুঝতে পারবেন তিনশো বছর পেছোতে পেরেছি কি না। কলকাতার জাতীয় সঙ্গীত হল ভটর-ভটর। অর্থাৎ, জেনারেটার চলার শব্দ। কলকাতার স্বাভাবিক অবস্থা হল নৃত্য। গর্তে পড়ছে, গর্ত থেকে উঠছে। ভোটার নাচছে। নাচছে নেতা। কলকাতার ঘট হল ধর্মঘট। দ্রব্যমূল্য আর ট্যাকস এমন বেড়েছে দুর্ভিক্ষ না হলেও অনাহার কপালের লিখন। চলমান অন্ধকূপের ভাড়া ডবল করে দিয়েছি। সুখের দাম না বাড়ুক, কষ্টের দাম বাড়িয়েছি। চার্নকের অন্ধকার, আলিবর্দির অরাজকতা, জগৎ শেঠের কেরামতি, সবই আমরা ফিরিয়ে এনেছি।
কোথায় পালাবে নন্দকুমার!