ননীচোর

ননীচোরা

সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সৃষ্টির পাট, একটু যদি নিশ্বাস ফেলিবার সময় থাকে; তাহার উপর ঐ দজ্জাল ছেলে সামলানো। ভোরে উঠিয়া বাসি কাজ সারা, তাহার পর স্নান সারিয়া পূজার বাসন মাজা, পূজার ঘর নিকানো—এই দুই প্রস্থ হইয়া গিয়াছে, এখন তিন নম্বর আরম্ভ হইয়াছে এই রান্নাঘরে। স্বামীর নয়টায় গাড়ি, দেবরের দশটায় স্কুল। আমিষের ল্যাঠা চুকিলে শাশুড়ির হবিষ্য রান্না। মাথার ঠিক থাকে না।

কাকা-ভাইপোতে দাপাদাপি করিতে করিতে ভিতরে ঢুকিল। কাকা কুঁজো হইয়া এত জোরে দৌড়াইয়াও ভাইপোকে কোনোমতেই ছুঁইতে পারিল না; যদিও ভাইপো এরই মধ্যে তিন-তিনবার আছাড় খাইয়াছে এবং প্রচণ্ড হাসিতে তাহার নিজের গতিবেগটাও নিশ্চয় ব্যাহত হইয়াছে।

উঠানের মাঝখান এক লাফে পলাতকের সামনে আসিয়া দুই হাতের আড়াল দিয়া বলিল, “কী দৌড়স রে খোকা! কিন্তু এইবার?”

জেতার চেয়ে হারার এই নূতনতর কৌতুকে খোকার হাসিটা আরও প্রচণ্ড হইয়া উঠিল।

“আবার কাল দু পয়সা লেট-ফাইন হয়েছে, এই ছ পয়সা হল; দিও বউদি।”

“বউদির মস্তবড় মহাল রয়েছে, নিলেম করে নিও।”—বলিয়া হাসিয়া কড়ায় খুন্তির একটা ঘা দিয়া বধূ ফিরিয়া বসিল।

“সে জানি না, দাদাকে বলো।”—বলিয়া দেবর হাসিয়া চলিয়া গেল।

বধূর ননদের কথা মনে পড়ে। সে দেবরের চেয়েও বয়সে ছোট; কিন্তু এই জায়গাটিতে ঠিক কুটুস করিয়া কামড় দিয়া বসিত। আহা বেটাছেলে, বড্ড নিরীহ জাত!

“মা, মুনা।”—বলিয়া খোকা আসিয়া পিঠে ঝাঁপাইয়া পড়িল। ওই ওর রীতি।

“সর খোকা, আমার এখন মরবার ফুরসত নেই, শুনলি তো কাকার তাগাদা?”

“উঁ, থুনলি।”—বলিয়া খোকা আর অধিক বাক্যব্যয় না করিয়া ঝাঁকড়া মাথাটা মার ঊরু আর বাহুর মাঝখান দিয়া বুকে গুঁজিয়া স্বকার্যসাধনে প্রবৃত্ত হইয়া গেল। মা একটু স্থির হইয়া দিল খানিকটা স্তন্য, তাহার পর তরকারি নামাইবার মতো হওয়ায় খোকার মাথাটা বাহির করিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, “হয়েছে, যা এবার; ক্রমাগত দামালপানা করবি, ক্ষিদে পাবে ছুটে আসবি, আমি কাঁহাতক বসে বসে তোকে মাই দিই খোকা? ছাড়, যাও তো সোনা আমার। যা, একজন এবার নাইতে যাবে, যা দিকিন, গামছা-কাপড় দিগে।”

ছেলে মার পিঠের উপর লতাইয়া বাঁ হাতে মুখটা ঘুরাইয়া নিজের মুখের অত্যন্ত কাছে টানিয়া প্রশ্ন করিল, “বাবা অঙ্গা অঙ্গা মা?”

এত কাজের ভিড়েও অত কাছে রাঙা ঠোঁট দুইটি পাওয়া গেলে মুহূর্তের জন্য সব ভুলাইয়া দেয়। একটা চুম্বন দিয়া মা বলিল, “হ্যাঁ, গঙ্গা গঙ্গা করবে, যাও।”

তরকারি নামাইতে, ঢালিতে, কড়া চাঁচিয়া আবার চড়াইতে একটু দেরি হইয়া যায়। কড়ায় তেল দিবার জন্য পিছন থেকে তেলের বাটি লইতে গিয়া দেখিল, সেটা ছেলের দখলে; হাত দুইটি তেলে চোবানো, পেটটি তেলে চকচক করিতেছে, নীচে একরাশ তেলের ছড়াছড়ি। মার পানে চাহিয়া সংক্ষেপে বলিল, “অঙ্গা অঙ্গা।”

রোষে বিরক্তিতে প্রায় কাঁদ-কাঁদ হইয়া মা বলিল, “ও মাগো! এ কি করেছিস খোকা? না বাপু, আমি আর পারি না এই হতভাগা ছেলেকে নিয়ে, কোন্ দিক সামলাই বল তো?”

চড় উঁচাইয়া ধমকাইয়া বলিল, “দোব ওই ওরই ওপর দু ঘা কষিয়ে, ভিরকুটি ঘুচিয়ে?”

খোকা তৈলাক্ত হাত দুইটি পেটের উপর জড়সড় করিয়া অপ্রতিভভাবে মার কড়া চোখের উপর চোখ তুলিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার মনে হইয়াছিল, সে একটা মস্ত শ্লাঘনীয় কার্য করিতেছে, মা দেখিয়া তাহার বাহাদুরিতে বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া যাইবে, এ ধরনের সম্ভাষণ মোটেই আশঙ্কা করে নাই। একবার উঠানের দিকে চাহিয়া দেখিল, লাঞ্ছনাটা কাহারও নজরে পড়িল কি না! তাহার পর মার দিকে চাহিয়া তাহার ঠোঁটটা একটু উল্টাইয়া গেল। বার দুই গালের একটা শিরা একটু কুঁচকাইয়া সামলাইয়া গেল; ভূজোড়াটি দুই- তিনবার স্পন্দিত হইয়া উঠিল।

এসব রঙ-বেরঙের বিদ্যুৎস্ফূরণ বর্ষণের পূর্বলক্ষণ, মার জানা আছে। খোকার চোখের জল, সেটা দেখিতেও কষ্ট, সামলাইতেও কষ্ট, তাহা ছাড়া শাশুড়ির গঞ্জনা, সে তো আছেই। মা হঠাৎ মুখের ভাব বদলাইয়া ফেলিয়া বলিল, “ওরে খোকন, না না, তোকে বলি নি; তোমায় কি বলতে পারি বাবা! আমি যে তেলকে বলছিলাম—হতভাগা তেল, আমার যাদুর পেটে উঠে কি করেছিস বল তো?—ওরে খোকা, কি চমৎকার পাখি দেখ, তুই নিবি? ওমা!”

খোকা টালটা সামলাইয়া লইয়াছে, অর্থাৎ চোখের জল ছলছল করিতেছে বটে, কিন্তু উছলিয়া পড়িতে পায় নাই। মার পাশে ঠেস দিয়া ধরা গলায় বলিল, “আঙা পাখি।”

শান্তিদূতের মতো সামনের নিমগাছটায় একটা পাখি এইমাত্র আসিয়া বসিয়াছে। রঙটা রাঙা মোটেই নয়; খানিকটা মিশ-কালো, খানিকটা বাসন্তী হলদে। দুই-একবার গলা দুলাইয়া একটা হ্রস্ব তরল আওয়াজ করিল।

বর্ণজ্ঞান সম্বন্ধে ছেলেকেই মর্যাদা দিয়া মা বলিল, “হ্যাঁ, আঙা পাখি। নিবি খোকা? তাহলে যা তোর কাকার কাছে, যা দিকিন। আয়, তেলটা একটু চারিয়ে দিই। হয়েছে, এইবার যাও।”

খোকা অত্যন্ত ভালো ছেলে হইয়া গিয়াছে। একটু কুঁজো হইয়া, ছড়ানো বাসন-পত্ৰ বাটনা-কুটনার মধ্যে খুব সন্তর্পণে পা ফেলিয়া চলিয়াছে, যেন কত ভয়! তাহার হঠাৎ ভাব পরিবর্তন দেখিয়া মা মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল। কয়েক পা গেলে বলিল, “ওরে খোকা, চুমো দিয়ে গেলি নি? মা যে মরে যাবে তাহলে।”

খোকা ফিরিয়া আসিল, চুমা খাওয়া হইল, আবার বুড়ার চালে গন্তব্যপথে চলিল। মা একবার দেখিয়া লইয়া ঘুরিয়া বসিল, কড়ায় তেল দিতে দিতে বলিল, “যাও, কাকাকে বল গে। বল, কাকা, রাঙা পাখিটা—”

পাখিটা মাঝখানের শব্দটায় একটা দীর্ঘ টান দিয়া আওয়াজ করিয়া উঠিল- “গেরস্তের খোক্কা হোক।”

কি বলে পাখি সে-ই জানে, কিন্তু এই সূত্রে মানুষের সঙ্গে তাহার একটা গাঢ় আত্মীয়তা আছে। ঘরে ঘরে তাহার সঙ্গে উত্তর-প্রত্যুত্তর, কথা-কাটাকাটি চলে। বধূ তপ্ত তৈলে একটা লঙ্কা ছিঁড়িয়া বলিল, ‘আর খোকার প্রার্থনায় কাজ নেই বাপু, ঢের হয়েছে, একটি সামলাতেই মানুষের প্রাণান্ত—”

“ওমা! অমন কথা বলো না বউমা; ওই একটিই ঢের হয়েছে? পাখির মুখে ফুলচন্দন পড়ক, কোলে-পিঠে জায়গা না থাক, ঘর আমার ভরে উঠুক দিন দিন।”

শাশুড়ি যে ইহার মধ্যে কখন গঙ্গাস্নান সারিয়া পূজার ঘরের রকে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন, বধূ সেটা কাজের ভিড়ে, বিশেষ করিয়া ছেলের দৌরাত্ম্যে, জানিতে পারে নাই। হাতে গঙ্গাজলের ঘটি, পরনে গরদ। বধূ একটু লজ্জিতা হইয়া পড়িল; একটু থামিয়া বলিল, ‘দেখ না এসে কাণ্ডটা মা, এক বাটি তেল ফেলে নৈরেকার করেছে। অপরাধের মধ্যে বলেছিলাম, নাইতে যাচ্ছে—”

স্বামীর প্রসঙ্গ আসিয়া পড়ায় আবার লজ্জিতা হইয়া থামিয়া গেল।

“ফেলুক, দৌরাত্ম্যির বয়স এখন, সইতে হবে। হীরে থির থাকলে আলো ঠিকরোয় না বউমা। চারটে মাস ছিল না, বাড়ি যেন—ও বউমা, শিগগির দৌড়োও, খেলে আমার মাথা!”

খোকা ঠাকুরমার গলা শুনিয়া পাখির কথা ভুলিয়া ছুটিয়া আসিয়াছে; বধূর প্রতি উপদেশ শেষ করিবার পূর্বেই দুলিতে দুলিতে তাঁহাকে দুই হাত দিয়া জড়াইয়া ধরিবার উপক্রম করিল। তাড়াতাড়ি হাত তুলিয়া কয়েক পা পিছাইয়া গিয়া বিপর্যস্ত ভাবে তিনি বলিতে লাগিলেন, “সরে যাও দাদু, আমায় ছুঁয়ো না—কি গেরো! ও বউমা? ওরে, তোর গায়ে রাজ্যির অনাচার দাদা, আমায় ছুঁস নি, দোহাই তোর—ও বউমা, তুমি বুঝি তামাশা দেখছ? ও দাদু, লক্ষ্মী আমার, সোনা আমার—”

বউমা লঙ্কার ঝাঁজের অছিলায় মুখে কাপড় দিয়া তামাশাই দেখিতেছিল। খোকা মস্ত একটা কৌতুক পাইয়া গিয়াছে; যতই না এড়াইবার চেষ্টা, সে ততই দুই হাত তুলিয়া ঠাকুরমাকে ছুঁইবার জন্য ছুটিয়াছে; হাসির চোটে সারা মুখটা সিন্দূরবর্ণ। ষাট বছরের বৃদ্ধা নাতির সমবয়সী হইয়া সমস্ত রকটা ছুটাছুটি করিতেছেন আর চেঁচাইতেছেন, “অ দাদু, খাস নি মাথা আমার, আবার নাওয়াস নি বুড়িকে—ও বউমা, শিগগির এস বাছা, সব ছেড়ে—”

বউমা গরম তেলে তরকারি ছাড়িয়া তাড়াতাড়ির ভান করিয়া ধীরেসুস্থে হাত দুইটা ধুইয়া উঠিল। শাশুড়ি বুঝুন, উপদেশ দিলেই হয় না। ঠোঁটে কোথায় যেন একটু হাসি লাগিয়া আছে, পা চালাইয়া আসিয়া খোকাকে ধরিয়া ফেলিয়া বলিল, “এই রকম দাম্পাণ্ডা দিয়ে ঘর ভরে উঠলেই তো—”

কথাটা শেষ করিবার পূর্বেই দুষ্টামির হাসি সজোরেই প্রকাশ হইয়া পড়িল। ঢাকা দিবার জন্য খোকাকে বলিল, “ঠাকুরমাকে ছুঁতে নেই এখন।”

খোকা মার মুখের কাছে মুখ আনিয়া ঘৃণায় নাকটা একটু কুঞ্চিত করিয়া প্রশ্ন করিল, “ঠাম্মা, অ্যা ছিঃ, মা?”

ঠাকুরমা হাসিয়া রাগিয়া বলিলেন, “হ্যাঁ, ঠাম্মা হল অ্যা ছিঃ, আর তুমি ভারি পবিত্তির, নবদ্বীপের পণ্ডিত। আমায় রীতিমতো হাঁপ ধরিয়ে দিয়েছে গো! কুশানটা বার করে দাও তো মা, একটু বসে জিরিয়ে নিই, আর পেরেক থেকে মালাটা নামিয়ে দিও। ওইঃ, একা হয় না, আবার জুড়িদার এল! সর সর, পড়ল বুঝি ঘাড়ে।”

.

“ব্যাঁ” করিয়া ছোট্ট একটি আওয়াজ করিয়া তিন-চারি দিবসের একটি বাছুর সদর- দরজায় প্রবেশ করিল, এবং সমস্ত উঠানটা দুড়মুড় করিয়া ছুটিয়া সামনে আসিয়া হঠাৎ দাঁড়াইয়া পড়িল। খোকা উল্লসিত আবেগে “গোউ গোউ!” বলিয়া করতালি দিয়া উঠিল, এবং সঙ্গে সঙ্গে হাত-পা সোজা করিয়া দিয়া মার কোল হইতে নামিয়া ছুটিল। ঠাকুরমা কিঞ্চিত ভীত হইয়া বলিলেন, “ঘাড়েটারে পড়বে না তো বাপু? দেখো!”

“না, ও নিজেই বাঁচিয়ে পালায়। যাই, বাবাঃ!”—বলিয়া একটা নিশ্চিত্ততার নিশ্বাস ফেলিয়া বধূ হেঁসেলে চলিয়া গেল।

একটার পর একটা চলিতেছেই, শ্রান্তি নাই, বিরামও নাই। এবার বাছুরের সঙ্গে চলিল। হাতে একটা ছোট শুকনো আমের ডাল তুলিয়া লইয়াছে, বাছুরটাকে ছোঁয়-ছোঁয়, সে উঠানময় দুই-একটা চক্র দিয়া আবার দূরে দাঁড়াইয়া পড়ে। খোকা হাসিয়া লুঠাইয়া যায়, ওঠে, আবার ছোটে। সর্বাঙ্গ ধূলায় ধূসরিত; কপাল, বক্ষ আর কাঁধের ধূলা ঘামের সঙ্গে সাদা হইয়া কণায় কণায় জমিয়া উঠিয়াছে, হাসির চোটে মুখে লালা উঠিয়া গড়াইয়া পড়িতেছে, গলার হারটা কখনও বুকে, কখনও পিঠে। মাথার ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুলগুলোর দুর্দশার আর পরিসীমা নাই।

দেখাও যায় না, অথচ এই অশেষবিধ বিশৃঙ্খলতার মধ্যে খোকা যে কেমন ভাবে কি সুন্দর হইয়া উঠিয়াছে, তাহা হইতে চোখ ফিরাইয়া রাখাও যায় না।

মা আড়চোখে দেখিয়া হাসে। তরকারি নাড়িতে গিয়া খুন্তিটা এক-এক বার কড়ার বাহিরে শূন্যে ওলট-পালট খায়।

ঠাকুরমার মালা অস্বাভাবিক দ্রুতবেগে ঘুরিতেছে, জপের সঙ্গে যে তাহার একটা যোগ আছে, তাহা বোধ হয় না; কেননা হিসাব রাখার মালিক যে মন, সে উঠানে। খোকা সেখানে তাঁহাকে ধূলার মধ্যে, তাহার অকাজের মধ্যে, তাহার বিসদৃশ সাথীর মধ্যে, এক কথায় তাহার শত রকম বেহিসাবের মধ্যে টানিয়া লইয়াছে।

এ মোহ, এরূপ ভ্রান্তি হইবারই কথা। এই পরিবারের গৃহদেবতা গোপাল। ভগবান এখানে সম্ভ্রমের অধিকারী নন, স্নেহের ভিখারি। তিনি বিরাট নন; তিনি অপ্রমেয় অজ্ঞেয় নন; তিনি নন্দের দুলাল, যশোদার নয়নমণি, তাঁহার সম্বন্ধে কথা আর আসে কোথা হইতে? তিনি প্রতিদিনের, প্রতিক্ষণের, সংসারের হাসি-অশ্রু দিয়া গড়া। যশোদা তাঁহাকে তাড়নাও করে, আবার নধর অধরে ক্ষীর সর ননী দেয়, চাঁদমুখ মুছাইয়া ললাটে তিলক আঁকে, মাথায় শিখিপাখা, শ্যামদেহে পীতধড়া, হাতে পাচনি দিয়া ধেনুদলের সঙ্গে গোচারণে পাঠাইয়া দেয়। গোপাল যখন খায়, যতক্ষণ দেখা যায়, মায়ের চির-অতৃপ্ত নয়ন লইয়া চাহিয়া থাকে; আবার সন্ধ্যার গোধূলিক্ষণে আসিয়া দুয়ারে দাঁড়ায়, এখনই গোপাল মলিন মুখে মলিন বেশে আসিয়া মায়ের বক্ষলগ্ন হইবে।

সে সুদূর নয়, শিশুরা তাহাকে সবার ঘরে ঘরে আনিয়া দেয়, নিয়তই। খোকার মুখে কি তাহারই ছায়া পড়িয়াছে? ধূলি-পাটল পেলব অঙ্গে কি তাহারই বর্ণাভাস? কচি পায়ের চঞ্চলতায় কি তাহারই নৃত্যবিলাস? ঠাকুরমার মুখে স্নিগ্ধ হাসি, চোখে অশ্রু। ঝাপসা দৃষ্টিতে মুহূর্তের জন্য এক-একবার মনে হয়, যেন গোপাল নিজেই,—ছায়া নয়, আভাস নয়। শ্যামদেহ ঘিরিয়া পীতবাস, মাথায় বিস্রস্ত মোহনচূড়া, হাতে পাচনবাড়ি, কপালের চন্দন কাদার সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে। ঠাকুরমার অঙ্গ আলোড়িত করিয়া যশোদার স্নেহ নামে; আহা, অসহায় শিশু, খেলায় অসহায়, শ্রান্তিতে অসহায়; কি যে করে, কি না করে, নিজেই জানে না। ও আবার দেবতা কবে হইল?

যশোদা ঘরে ঘরে নিজের শিশুকে বিলাইয়া, মায়ের ব্যাকুলতা লইয়া সবার বুকে আসিয়া উঠিয়াছে। ঠাকুরমা, বলে, “ওরে অ খোকা, ঘেমে নেয়ে গেলি যে! দেখ তো ছিষ্টিছড়া খেলা ছেলের!”

ওদিকে ধবলী “ম্ভা!” করিয়া আওয়াজ করে; চারিদিকে বিপদ-আপদ ঢের, অবুঝ বৎস, সে চোখের আড়ালে কেন যে যায়!

কিন্তু খেলা তবুও চলিতে থাকে।

অবশেষে বোধ হয় শ্রান্তি একটু আসিল। খোকা অবশ্য বাহ্যত সেটা স্বীকার করিল না। উঠানে বসিয়া হাসিতে হাসিতে ঘাড় এলাইয়া একবার মার দিকে চাহিল, একবার ঠাকুরমার দিকে চাহিল। হঠাৎ তাহার একটা কথা মনে হইল, খুব সহজ ব্যাপার, অথচ খুব মজা হয় তাহা হইলে। রকের উপর উঠিয়া গিয়া, আমের ডালটা দুই হাতে পিছনে ধরিয়া, ঘাড় দুলাইয়া প্রশ্ন করিল—”ঠাম্মা, খেব্বি?”

ঠাকুরমা হাসিয়া উদ্বেলিত অশ্রু মোচন করিয়া বলিলেন, “হ্যাঁ ভাই, খেলব, ডেকে নে, অনেক হয়েছে এখানকার খেলা।”

দেরি হইয়া যাইতেছে, উঠিয়া সজল নয়নে পূজার ঘরে প্রবেশ করিলেন।

সেদিন এই পরিবারের ক্ষুদ্র ইতিহাসে এক পরমাশ্চর্য ঘটনা ঘটিল।

ঠিক পূজা সেদিন হইল না, যেন একটি দুরন্ত উচ্ছৃঙ্খল শিশুর পরিচর্যায় কাটিয়া গেল, তাহার চঞ্চলতা আর প্রতিকূলতার জন্য পদে পদেই বাধা। বৃদ্ধা গোপালের সাজগোজ একটি একটি করিয়া খুলিয়া ঝাড়িয়া ঝুড়িয়া আবার অতি সন্তর্পণে, প্রাণের দরদ দিয়া পরাইয়া দিতে লাগিলেন। সঙ্গে সঙ্গে মৃদুকণ্ঠে নানা রকম আদেশ, উপদেশ, অনুরোধ— “এইবার এই করে দাঁড়াও তো ঠাকুর, পীতধড়াটা এঁটে দিই। এই বাঁশী ধর। কতদিন থেকে ইচ্ছে, একটি সোনার বাঁশী গড়িয়ে দিই; সে সাধ আর গোপাল মেটাবে না! আর কবেই যে মেটাবে!”

যেন প্রত্যক্ষ গোপালের সামনে কথাটা বলিয়া দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে। সারা দেহে ধূলি, বদনে স্বেদবিন্দু কল্পনা করিয়া বস্ত্রাঞ্চল দিয়া মুছাইয়া দেন। মুখে অনুযোগ, ‘জগতের ভাবনা ভেবেই তুমি সারা হলে, নিজের দিকে আর দেখবে কখন?”

হিন্দুর মন, পুতুলখেলার পাশে পাশে গীতার ধ্বনি উঠে। অলকা-তিলকা দিয়া শৃঙ্গার শেষ হয়। তখন আবার নিজের প্রগল্ভতায় হাসি পায়। “হে ঠাকুর, আমায় অহমিকা দিয়ে তোমার এ খেলার মর্ম তুমিই বোঝ। আমি আবার তোমায় সাজাব, মোছাব। যেমন তোমার যশোদার ছেলে হওয়া, তেমনই আমার সেবা নেওয়া; তোমার লীলার অন্ত আমি আর কি পাব ঠাকুর?”

শৃঙ্গারের সময় দেবতা বিগ্রহের মূর্তিতে জীবন্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন; কিন্তু পূজার সময় তাঁহাকে পাওয়া দুষ্কর হইয়া উঠিল। আজ খোকার খেলার পথে আসিয়া তিনি যেন অতিমাত্র চঞ্চল। চিত্তের সমস্ত ব্যাকুলতা দিয়াও তাঁহাকে পূজার আসনে ধরিয়া রাখা যায় না। আজ তিনি ধ্যানাতীত। কখনও বায়ুর মতো স্পর্শের অগোচর, সমস্ত ইন্দ্রিয় ব্যাপ্ত করিয়া আছেন, অথচ আকারে ধরা যায় না। কখনও তিনি নাই, একেবারেই বিলুপ্ত, শুধু শিশুতে শিশুতে সমস্ত বিশ্ব একাকার হইয়া যায়।…মায়ের নতদৃষ্টির নীচে শিশুর হাসি; ছায়াশ্যাম বৃক্ষতলে খেলায় মত্ত শিশুর দল; কোথাও দরিদ্র-পল্লীতে জীর্ণ গৃহ, অবসরহীন জননী, উঠানে ছিন্ন বাস পরা শিশু-ভগ্নীর কোলে রুগ্ন শিশু, অশ্রুভরা নিষ্প্রভ তাহার চোখ; কোথাও শিশুর দুর্জয় অভিমান, চাপা ঠোঁট, শান্ত গম্ভীর ভাব, খাবার খেলনা রাজ্যের যত জিনিস একত্র করিয়াও মা মন পায় না; এক-এক সময় সব মুছিয়া এক অপূর্ব দৃশ্য ভাসিয়া উঠে, নবদূর্বাদলশ্যাম নবনীতদেহ এক শিশু, মাথায় চিক্কণ চূড়া বায়ুভরে দোদুল; পীতবাস- পরা বঙ্কিম কটি, যমুনাকূলের বেণুবন তাহার চঞ্চল নৃত্যপর রাঙা চরণের ঘায়ে তৃণগুচ্ছে রোমাঞ্চিত, কখনও সে ধেনুর গায়ে লুটাইয়া পড়ে, কখনও নাচিতে নাচিতে বংশীধ্বনি করে; তাহার বাঁশীর স্বরে আকাশ-বাতাস ভরিয়া যায়, বনপ্রান্তর পুষ্পে পুষ্পে মুঞ্জরিত হইয়া উঠে, যমুনার কালো জলে ঢেউয়ে ঢেউয়ে আলোর খেলা চলে।

দৃশ্যপট পরিবর্তিত হইয়া গেল। যশোদার গৃহে, ঘরের মেঝেয় ভাঙা ননীর পাত্র। গোপালের মুখে হাতে যেখানে-সেখানে চুরি করা ননীর পোঁচ, শ্যাম দেহখানি ননীর স্নিগ্ধসাদা ছোপে ছোপে অপরূপ হইয়া উঠিয়াছে। রাণী আর পারে না, নিত্যই এই চৌর্যবৃত্তি, এই অপচয়! শাসন মানে না, এমন বিড়ম্বনার শিশুকে লইয়া কি করা যায়?…তোকে এবারে না বাঁধলে চলছে না গোপাল, রস্ তুই, দড়ি নিয়ে আসি।…গোপালের কাতর দৃষ্টি, অনুনয় করিতে করিতে ক্ষুদ্র দেহখানি ত্রিভঙ্গ হইয়া বাঁকয়া গিয়াছে….মা গো, আর হবে না, এই শেষ; তোর বাঁধন যে বড় কঠিন হয় মা।…আহা, শিশুর অদম্য লোভে, কিই বা করে সে?

পূজার সম্ভার পড়িয়া থাকে, মন্ত্র অনুচ্চারিত। মুদিত চোখের পক্ষ্ম ভিজাইয়া শুধু অশ্রুর ধারা গড়াইয়া পড়ে। “হে শ্যামসুন্দর, এস, তোমার শিশু-মনের সমস্ত লোভ, তোমার সেই পরম করুণা নিয়ে এস। এখানে তোমার পায়ে সমস্ত উজাড় করে দোব বলে বসে আছি অথচ তুমি বিমুখ! হোথায় যশোদার কি পূণ্যবলে তার সমস্ত লাঞ্ছনা অঙ্গের ভূষণ বলে মেনে নিচ্ছ ঠাকুর?”

অনেকক্ষণ এই রকম যেন একটা স্বপ্নের ঘোরে মনটা আচ্ছন্ন থাকে। হঠাৎ ছেলের বকাবকিতে চৈতন্য হয়।

“আবার আজ ভাতের দেরি করে ফেললে? নাঃ, চাকরিটা না খেয়ে আর- বধূর চাপা গলায় উত্তর, “কি করব, যা দজ্জাল ছেলে হয়েছে! একটিবার যে ডেকে নিয়ে উবগার করবে—”

“ও! মনিব-ঠাকরুণের ছেলে না আগলালে বুঝি একমুঠো ভাত—”

আরও চাপা গলায় প্রত্যুত্তর হয়, “আঃ চুপ কর, পুজোর ঘরে মা!”

আবিষ্ট ভাবটা কাটিলে বৃদ্ধা নিজের মনেই বলিলেন, “আজ তুমি তো ঠিক ধ্যানের রূপে দেখা দিলে না ঠাকুর, কেন তা তুমিই জান।”

পুষ্পরাশি চন্দনে মাখাইয়া বেদীতে নিক্ষেপ করিলেন; তাহার পর কুষিতে জল লইয়া নৈবেদ্য নিবেদন করিতে যাইতেই “এ কি হল!” বলিয়া যেন চিত্রার্পিতের মতো কয়েক মুহূর্তে নিশ্চল হইয়া গেলেন।

চোখের জলে এখনও দৃষ্টিটা একটু ঝাপসা রহিয়াছে, অঞ্চল দিয়া মুছিলেন। না, ঠিকই তো, রেকাবির মাঝখানের নৈবেদ্যের চূড়ার উপর বড় যে ক্ষীরের নাড় টি—সব চেয়ে যেটি বড়—সেইটি নাই! এইমাত্র নিজের হাতের রচনা করা নৈবেদ্য, ওই নাড় টি একবার পড়িয়া গিয়াছিল, ভালো করিয়া বসাইয়া দেওয়া হয়, ভুলের তো কোনো সম্ভাবনাই নাই!

তবু নিজের অদৃষ্টকে বিশ্বাস হয় না, আবার ভালো করিয়া চোখ মুছিতে যান। কম্পিত হস্তে চোখে অঞ্চল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু এক অননূভূতপূর্ব ভাবের উচ্ছ্বাসে মনকে অভিভূত করিয়া ফেলে। শরীর কণ্টকিত, মনে হয় যেন ঢেউয়ের পর ঢেউ ভাঙিয়া সমস্ত শরীরের বন্ধন শিথিল করিয়া দিতেছে। চক্ষের জল মুছিবে কে? কূল ছাপাইয়া বন্যা নামিয়াছে।

মুখে একটি মাত্র কথা, আনন্দ-ব্যাকুল একটি মাত্র বিস্মিত প্রশ্ন—”হে ঠাকুর, এ কি দেখালে?”

.

যখন বাহির হইয়া আসিলেন, চোখের পল্লব সিক্ত, মুখে একটি শান্ত জ্যোতি। বধূর বড় আশ্চর্য বোধ হইল, একটু ঘুরাইয়া প্রশ্ন করিল, “মা, আজ তোমার এত দেরি হল?”

“বউমা, একবার পুজোর ঘরে এস।”

ঘরের দুয়ারের কাছে আসিয়া ঘুরিয়া বলিলেন, “রান্নাঘরের কাপড়টা ছেড়ে এস বউমা।”

বধূ কাপড় ছাড়িয়া আসিলে ভিতরে গিয়া বলিলেন, “এই দেখ বউমা, আমি নিজের হাতে বড় নাড়টি মাঝখান বসিয়ে দিয়েছিলাম, চোখ মেলে দেখি, নেই।”

শাশুড়ির মুখের আলো বধূর মুখমণ্ডলে প্রতিভাসিত হইয়া উঠিল, সে চোখ দুইটি বিস্ফারিত করিয়া নির্বাক বিস্ময়ে দাঁড়াইয়া রহিল। পুরুষানুক্রমে বৈষ্ণব, এ বাড়ির মাটির প্রতি কণাটি পর্যন্ত রাধাকৃষ্ণের রসে সিক্ত, বিশ্বাস এঁদের কোনোখানে কখনও বাধা পায় না। গোপালের এ গৃহে পদার্পণই অলৌকিকত্বের মধ্য দিয়া। এই পরিবারের সঙ্গে তাহার লীলার লুকোচুরি চলিয়া আসিতেছে, বিশেষ করিয়া পূর্বজদের আমলে। তাহার মধ্যে কত ঘটনা ভ্রান্তি বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়াছে, কতক আজ পর্যন্ত সংশয়ের আলো-ছায়ায় দুলিতেছে, কতক বা একেবারেই নিসংশয়িত ধ্রুব সত্য—জীবনের চেয়েও সত্য, গোপালের বিগ্রহের মতোই সত্য।

শাশুড়ি বলিলেন, “এ সেই, যাঁর নাম করতে পারি না, গোসাঁইয়ের বংশ বউমা, এ রকম ব্যাপার তো এ বাড়িতে নতুন নয়; তবে আজকাল আর আমাদের পুণ্যির জোর নেই—এই যা। পুজো সেরে শ্বশুর ভাগবত পড়তেন, খুব তন্ময় হয়ে পড়তেন কিনা- তেমনি সুকণ্ঠও ছিল, একটি বছর তিনেকের শ্যামবর্ণ ছোট ছেলে এসে বসল, একখানি হলদে রঙে ছোপানো কাপড়, কোমর থেকে খসে গেছে, জড়িয়ে-সরিয়ে কাঁখে পুঁটুলি করে নিয়েছে। বসল তো বসল, শ্বশুর একবার দেখে আবার নিজের মনেই পড়ে যেতে লাগলেন। অনেকক্ষণ পরে আর একবার একটু অন্যমনস্ক হতে গিয়ে ছেলেটির ওপর একটু নজর পড়ল, ঠায় এক-ভাবে বসে আছে। পাঠ শেষ করতে আরও অনেকক্ষণ গেল। বই মুড়ে চোখ তুলে দেখলেন, ছেলেটি নেই, কখন উঠে গেছে। আহা, ছোট্ট ছেলেটি, হুড়োহুড়ি করে ক্লান্ত হয়ে বসে ছিল, একটু নৈবিদ্যি হাতে দিই। এই ভেবে তিনি রেকাবি থেকে ক্ষীরে ___ ফলেতে মুঠোটি ভরে বাইরে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হ্যাঁগা, যে ছোট ছেলেটি আমার ঘরে গিয়ে এতক্ষণ বসে ছিল, কোথায় গেল, দেখেছ?’

“সকলেই বলল, “কই, না, দেখি নি তো!’

“শ্বশুর বলিলেন, “সে কি! এই যে এতক্ষণ বসে ছিল আমার কাছে—ন্যাংটো, কাঁধে একখানা হলদে কাপড়, ভাসা-ভাসা, ডাগর চোখ দুটি!’

“শাশুড়ি একটু খিটখিটে ছিলেন, ধমক দিয়ে বললেন, ‘জ্বালিও না বাপু; একবাড়ি লোক গিজগিজ করছে, ছোট ছেলে একটা এল, রইল, বেরিয়ে গেল—কাকে-কোকিলে জানতে পারলে না! বউমা, ওঁর মিছরির পানাটা দিয়ে এস; রাজ্যির বেলা করবেন, না নিজের মাথার ঠিক থাকবে, না অন্যের মাথা ঠিক থাকতে দেবেন।

“কে আর মিছরির পানা খাবে? সেই নৈবিদ্যির ফল নাড় হাতে করে সমস্ত পাড়ায় বাড়ি-বাড়ি ঘুরে বেড়ালেন— হ্যাঁগা, এ রকম একটি ছেলে, হলদে কাপড় কাঁখে, তোমাদের বাড়ির ছেলে কি? দেখেছ কি?’ কিন্তু কে দেখবে? সে কি কারুর বাড়ির ছেলে যে, লোকে দেখবে তাকে?”

শাশুড়ি একটু থামিলেন। দুইজনের চোখই জলে ভাসিয়া যাইতেছে। আবার বলিতে লাগিলেন, “তখন এসে, সেই হাতের নৈবিদ্যি হাতে করে পূজার ঘরে ঢুকে আসনে শুয়ে পড়লেন। সমস্ত দিন গেল, সমস্ত রাত গেল, আহার নেই, নিদ্রে নেই। শেষরাত্রে একটু তন্দ্ৰা এসে স্বপ্ন হল, “পাড়ায় পাড়ায় ঘুরলেই কি আমায় পাবি? ওঠ, তোর নৈবিদ্যি খেয়েছি, ক্ষীরের এক পাশে আমার দাঁতের চিহ্ন দেখতে পাবি। খা, আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছে, তুই আমাকেও উপোসী করে রেখেছিস।”

অশ্রু মুছিতে মুছিতে দুইজনে বাহিরের রকে আসিয়া বসিলেন। এই ধরনের গল্প চলিতে লাগিল। তাহার সঙ্গে গীতা ও ভাগবতের তত্ত্ব-কথা, ভক্তের জন্য তিনি কি ভাবে কত লীলারূপ ধরেন, নিজের মুখে কোথায় কি আশার কথা কবে বলিয়াছেন, সেই সব।

গল্পের মধ্যে শাশুড়ি বলিলেন, “এসব কথা কাউকে আর এখন জানিয়ে কাজ নেই বউমা। অবিশ্বাসীর কানে গেলে তিনি কষ্ট পান, কতবার স্বপ্নে বলেছেন, আমার লাঞ্ছনা হয় ওতে।”

উঠানের ওদিকে সদর দরজায় খোকার আবির্ভাব, কে কাপড় পরাইয়া দিয়াছিল, শুধু কোমরের গেরোটি লাগিয়া আছে; বাঁ হাতে কাপড়ের পাড়ে বাঁধা একটা ভাঙা কলাই-করা সানকি, ডান হাতে সেই চিরন্তন লাঠি; সানকির উপর এক ঘা বসাইয়া মার দিকে চাহিয়া বলিল, ‘গোউ—ছোনা।”

মা হাসিয়া বলিল, ‘নির্বিবাদে মার খাচ্ছে কিনা, সোনা তো হবেই।”

খোকা হঠাৎ গরু আর গরু-শান্ত-করা লাঠি ফেলিয়া ছুটিয়া আসিয়া কোলে ঝাঁপাইয়া পড়িল এবং তাহার রেওয়াজ মাফিক বস্ত্রাঞ্চলের মধ্যে মাথাটা গুঁজিয়া দিল। ঠাকুরমা তাহার পিঠে হাত বুলাইয়া প্রশ্ন করিলেন, “কোথায় গিয়েছিলে ভাই? আজ তোর সাথী তোর সঙ্গে খেলবার জন্যে যে—”

খোকার পাঁচ-সাত টানের বেশি গ্রহণ করিবার কোনো কালেই ফুরসত থাকে না। খেলার নামে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া উঠিল। চোখ দুইটা বড় করিয়া বলিল, “ঠাম্মা, টুই—”

এই সময় কাকা আসিয়া বলিল, “বউদি, ভাত।”

খোকা বোধ হয় ঠাকুরমাকে খেলিবার জন্য উৎসাহিত করিতে যাইতেছিল, সামনে এমন জবর সঙ্গী পাইয়া মত পরিবর্তন করিয়া ফেলিল। ছুটিয়া গিয়া চোখে প্রবল আগ্রহের দীপ্তি ভরিয়া প্রশ্ন করিল, “ছেয়ে, খেবি?”

কাকা শখ করিয়া ভাইপোকে পিতৃত্বে বরণ করিয়াছে। পিতাপুত্রে আবার একচোট মাতামাতি চলিল।

.

আশায় আশায় দিন কাটিতেছে, গোপালের আগমনের কিন্তু কোনো নিদর্শনই আর পাওয়া যায় না। নৈবেদ্যের পরিবর্ধিত আয়োজন—শুদ্ধাচারে তৈয়ারি করা, দুইটি অন্তরের ভক্তিরস দিয়া সিঞ্চিত—যেমনকার তেমনি পড়িয়া থাকে। বাটিতে বাটিতে সব ক্ষীর ননী, রেকাবিতে ক্ষীরের ছাঁচ, ক্ষীরের নাড় কোনোটারই কোনোখানে প্রত্যাশিত ক-র চিহ্নটুকু পড়ে না। বধূ উদ্‌গ্রীব হইয়া চাহিয়া থাকে, শাশুড়ি বাহির হইলে মুখে গাঢ় নিরাশার ছায়া দেখিয়া আর প্রশ্ন করিতেও সাহস করে না।

চারিটি দিন কাটিয়া গেল। হাতে দুইটি নাড় লইয়া রান্নাঘরের রকে আসিয়া শান্তকণ্ঠে শাশুড়ি বলিলেন, “নাঃ বউমা, কাল থেকে গয়লা-বউকে বলে দিও, যেমন দুধ দিচ্ছিল তেমনি দেবে। মিছে আশা।—কই দাদু, পেসাদ খেয়ে যা রে।”

বধূ ক্ষুব্ধচিত্তে বলিল, “আমাদের কি সে রকম অদৃষ্ট মা?”

খোকার কাকা ঘর হইতে চেঁচাইয়া বলিল, “মা, ও হতভাগাকে কিছু দিও না; আমার সব নষ্ট করে দিয়েছে, দেখ এসো বরং।”

খোকা ছুটিতে ছুটিতে আসিয়া হাজির হইল। বুকে পিঠে সর্বাঙ্গে কালি, একটা চড়ের উপর দিয়াই ফাঁড়াটা কাটিয়া গিয়াছে বলিয়া মুখে হাসি। সিঁড়ি দিয়া রকে উঠিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, “ক ক।”

মা ধমক দিয়া বলিল, “খুব ক খ হয়েছে; তোমার ঠ্যাং খোঁড়া না করে দিলে আর—”

ঠাকুরমা বলিলেন, “থাক হয়েছে, আর বকে না।” হাতে নাড় দিয়া খোকাকে আলগোছে বুকের কাছে টানিয়া বলিলেন, “তোর সাথী আমার পুজোর ঘরে কবে আসবে দাদু, ক্ষীর সর নিয়ে এই রকম দৌরাত্ম্যি করতে?”

খোকা নাড় চিবানো বন্ধ করিয়া কথাটা যেন একটু বুঝিবার চেষ্টা করিল, তাহার পর পুনরায় বার কয়েক মুখ নাড়িয়া, খানিকটা গলাধঃকরণ করিয়া প্রশ্ন করিল, “পেছা, ঠাম্মা?”

“হ্যাঁ ভাই, পেসাদ খেতে সে আর আসবে না?”

খোকা ঠাকুরমার মুখের খুব কাছে মুখটা লইয়া গিয়া, নিজের চোখ দুইটা খুব জোর একটু বুজিয়া থাকিয়া, আবার খুলিয়া বলিল, “ঠাম্মা, এনো কলো।”

ঠাকুরমা হাসিয়া বলিলেন, ‘মিছিমিছি চোখ ওরকম করতে যাব কেন রে হনুমান?”

খোকা আর একবার চোখ বুজিয়া ব্যাপারটা পুনরাভিনয় করিতে যাইতেছিল, বুঝেছি!” বলিয়া ঠাকুরমা আবেগভরে বুকে চাপিয়া গভীর বিস্ময়ে বধূর পানে চাহিয়া বলিলেন, “বউমা, দেখলে? আমি বলি তোমাদের, এ আমাদের ছলতে এসেছে।”

বধূও বিস্মিত হইয়াছিল, তবে সেটা প্রধানত শাশুড়ির আচরণে; নির্বাক হইয়া সপ্ৰশ্ন নেত্রে চাহিয়া রহিল। শাশুড়ি বলিলেন, “ওর বলবার ইচ্ছে একেবারে চোখ বুজে বসে থেকো, তা হলেই আসবেন। ঠিক তো বউমা, এখন বেশ মনে পড়ছে কিনা, একটু দেখতে পাব আশা করে এ কটা দিন ধ্যানের সময় ক্রমাগতই চোখ খুলে যাচ্ছে, তাতে কি আর তিনি আসেন মা? যেদিন আসেন, সেদিন কতক্ষণ যে একঠায় চোখ বুজে ছিলাম, এখন সে সব কথা মনে পড়ছে। তাতে মন সুস্থির না হলে তো হবে না মা, গাছটিকে যদি ক্রমাগতই ওপড়াও, তবে কি গোড়া বসতে পারে? কিন্তু ওই শিশু নিজের খেলায়ই মত্ত, কি করে জানলে ও?”

খোকাকে বুকে মিশাইয়া লইবার মতো করিয়া সজল নয়নে প্রশ্ন করিলেন, “তোর মনে কি আছে দাদু? বড় যে ভয় করে ভাই!”

অমঙ্গল আশঙ্কায় মাও চক্ষে অঞ্চল দিল।

.

তাহার পরদিন রবিবার ছিল, রান্নাবান্নার তাড়া নাই। বড় ছেলেকে রোজ আটটার সময় আহার করিতে হয় বলিয়া, রবিবার দিন একটার সময় আহারে বসিয়া যুগপৎ নিজের স্বাধীনতা উপভোগ করে এবং চাকরির উপর আক্রোশ মিটায়। শাশুড়ি-বধূতে পরামর্শ হইল, পূজার সময় সেদিন বধূ পর্যন্ত বাড়িতে থাকিবে না, খোকাকে লইয়া পাশের বাড়িতে যাইবে। ভিতর-বাড়িতে শুধু-শাশুড়ি থাকিবেন একা, পূজার ঘরে।

সেদিন রাত্রি থাকিতেই শাশুড়ি-বধূতে উঠিয়া, একান্ত শুচিতার সহিত স্নানাদি সারিয়া পূজার আয়োজন করিলেন। ক্রমে গব্য দ্রব্যের ফুল ও চন্দনের গন্ধে ঘরটি ভরপুর হইয়া উঠিল। একটু বেলা হইলে বড় ছেলে রবিবারের অনিশ্চিত আড্ডায় চলিয়া গেল। ছোট ছেলের ক্যারাম প্রতিযোগিতা সামনে, সে মহলা দিতে গেল। বধূও এদিক-ওদিক একটু পাট সারিয়া খোকাকে লইয়া পাশের বাড়িতে চলিয়া গেল। নির্জন নিঃশব্দ বাড়িটিতে শুধু একটি ব্যাকুল ভক্ত সংসারের সহস্র প্রয়োজনে বিক্ষিপ্ত চিত্তকে সাধ্যমতো আকৃষ্ট করিয়া, আশায় অবাধ্য নয়নদ্বয়কে প্রতীক্ষায় সংযত করিয়া, পূজার আসনে বসিয়া রহিল। শিশুর কথা দেবতারই ইঙ্গিত, খোকা চোখ বুজিতে বলিয়া চোখ খুলিয়া দিয়াছে। অনেকক্ষণ গেল, ক্রমেই শরীর-মন যেন কী একটা অপার্থিব সুষমায় ভরিয়া আসিতে লাগিল—প্রথম দিনের মতোই, ক্রমে ক্রমে প্রথম দিনকেও অতিক্রান্ত করিয়া।

কাকা খোকাকে ঘাঁটাঘাঁটি না করিয়া বেশিক্ষণ থাকিতে পারে না, বিশেষ করিয়া ছুটির দিন। খেলার মধ্যেই একবার বাড়ি আসিয়া দেখিল, আর কেহ নাই, শুধু খোকা পূজার ঘরের নীচু জানালাটায় পেটটি চাপিয়া গভীর একাগ্রতার সহিত উঁকি মারিতেছে। কাছে যাইতে ডান হাতের কচি মাংসল আঙুল কয়টি জড়ো করিয়া অত্যন্ত গম্ভীরভাবে ফিসফিস করিয়া বলিল, “তুপ, বাবা অবো।

তাহার মুখের ভাব দেখিয়া, বিশেষ করিয়া তাহার বাবা হওয়ার লোভ দেখাইবার ধরন দেখিয়া কাকার বেজায় হাসি পাইল। ফিসফিস করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার মা কোথায়?”

খোকা মুঠাটি গালের উপর বসাইয়া, ক্ষুদ্র তর্জনীটি পাশের বাড়ির দিকে নির্দেশ করিয়া একটু কুঁজোর মতো হইয়া দাঁড়াইল, কোনো কথা বলিল না। তাহার নূতনত্ব আর বিচিত্রতায় কাকার হাসি চাপিয়া রাখা দুষ্কর হইল, পাশের বাড়িতে ছুটিয়া গিয়া বলিল, “বউদি, শিগগির এস; একটা মজা দেখবে এস তোমার ছেলের।”

বউদিদি নিশ্চিন্ত হইয়া গল্প করিতেছিল, বিবর্ণ মুখে বলিয়া উঠিল, “ওমা, তাই তো! কখন চলে গেছে সেটা?”

হনহন করিয়া ছুটিল, ছোটদের মধ্যে দুই-একজন সঙ্গও লইল।

খোকা জানালার কাছে নাই। দেবরের সঙ্গে সঙ্গে রকে উঠিয়া জানালার মধ্য দিয়া ভিতরে নজর দিয়াই বধূ বিস্ময়ে আশঙ্কায় নির্বাক হইয়া গেল। শাশুড়ির মুদ্রিত নয়নযুগলে ধারা গড়াইয়া পড়িতেছে; একটু দূরে কালো পাথরের বাটীতে ক্ষীরের মধ্যে হাত ডুবাইয়া খোকা সতর্কভাবে ঠাকুরমার চোখের দিকে চাইয়া; পলাইবার উদ্যমে শরীরটা মাটি হইতে একটু উঠিয়া পড়িয়াছে।

জানালা দিয়া ছায়া পড়িতেই ফিরিয়া চাহিয়া দুইটা হাত পেটে জড়ো করিয়া হতভম্ব হইয়া দাঁড়াইয়া পড়িল।

“ও মা গো!”—বলিয়া বধূ ঘরের মধ্যে ছুটিয়া গেল। শাশুড়ি হঠাৎ চক্ষু খুলিয়া আচ্ছন্ন ভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি বউমা?” কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সামনের দৃশ্যটিতে নজর পড়ায় আর উত্তরের প্রয়োজন হইল না।

বধূ বলিতে লাগিল, “তোমার এই কীর্তি, হতভাগা চোর? আমরা নাগাড়ে ক্ষীর সর মাখন তোয়ের করে হয়রান হচ্ছি, আর তোমার ভেতরে ভেতরে এই মতলব? তুমি আমার কাছে না ছুটে যদি ধরে নিতে ঠাকুরপো, কি নৈরেকার, কি অনাচারটাই—”

“আমি কি জানি? ভাবলাম, এর পরে নকল করবে বলে জানলা থেকে মার পুজো দেখছে; ওঁর মালাজপের নকল করে, দেখ না? ওর পেটে পেটে যে এ মতলব, তা কেমন করে জানব? সে বুড়টে ভাব যদি দেখতে! আবার বলে বাবা হব, চুপ কর।”

“হওয়াচ্ছি বাবা। এইজন্যে ঠাকুরমাকে কাল পরামর্শ দেওয়া হল, চোখ বুজে থেকো—চেপে। চার দিন থেকে জুত হচ্ছিল না, না?—” বলিয়া রাগ না চাপিতে পারিয়া বধূ হাত উঠাইয়া আগাইয়া গেল।

শাশুড়ি এতক্ষণ বিস্মিত হাস্যে খোকার দিকে চাহিয়া এক রকম ধ্যানের ভঙ্গীতেই মৌন হইয়া বসিয়া ছিল। বধূ অগ্রসর হইতেই বলিয়া উঠিলেন, ““খবরদার বউমা।” সঙ্গে সঙ্গে উঠিয়া খোকাকে কোলে লইয়া আসিয়া আসনে বসিলেন। ক্ষীর-মাখানো হাতটা তুলিয়া ধরিয়া বলিলেন, “এই তাঁর হাত বউমা, এই তাঁর চাঁদমুখ। বউমা, বললে বোধহয় বিশ্বাস করবে না, আজ গোপাল এসেছিল। ধ্যান করবার সময় মনে হল, যেন ঘর আলো করে এলেন, ক্ষীরের বাটির মধ্যে হাত ডুবুলেন, এমন সময় তোমাদের গলা শুনে জেগে উঠলাম।”

খোকার কীর্তি রাষ্ট্র হইয়া গেল। কত মুখে বিদ্রুপের হলাহল উদ্‌গিরিত হইতে লাগিল। বধূরও ভ্রান্তি ঘুচিল বোধ হয়। কিন্তু একজনের মনে কেমন করিয়া সত্যের একটি শিখা অম্লান আলোয় জ্বলিয়া রহিল। বধূকে আদেশ হইল, “কাল থেকে খোকার জন্যে ছোট্ট একটি নৈবিদ্যি আমার আসনের পাশে রাখা থাকবে বউমা, যখন গোপালকে ওদিকে নিবেদন করব, খোকা তার নিজেরটি নিয়ে খেতে বসবে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *