1 of 3

নদীর মাঝখানে

নদীর মাঝখানে

অনেক লোকজনের ভিড় ঠেলে সেই মেয়েটি এসে অবনীশের পায়ের ওপর একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রণাম করবার জন্য।

অবনীশ সেই মুহূর্তে হেডমাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করছিলেন, বেশ চমকে উঠে কিছুটা পিছিয়ে গেলেন। মেয়েটি হাঁটু গেড়ে বসে থাকা অবস্থাতেই মুখ তুলে জিগ্যেস করল, আমায় চিনতে পারছেন? মনে আছে?

কোনও মেয়েকে মুখের ওপর মনে নেই, চিনতে পারছিনা বলা যায় না। অবনীশ হাসি-হাসি মুখ করে মাথাটা হেলালেন একটুখানি।

হেডমাস্টার ও অন্যান্য কয়েকজন বললেন, আরে পাগল মেয়ে, ওঠ, ওঠ!

মেয়েটি এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমার নাম শান্তি, শান্তি সান্যাল। আপনি বর্ধমানে বইমেলায় আমার খাতায় চার লাইন কবিতা লিখে দিয়েছিলেন। অবনীশ এবার খুব নিপুণ মিথ্যে আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন, বাঃ, মনে থাকবে না কেন?

হেডমাস্টার মশায়ের সঙ্গে আলোচনা আর জমল না। অন্যদের দু-একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলেন অবনীশ। শান্তি মাঝে-মাঝে বাধা দিয়ে বলতে লাগল, আঃ, তোমরা ওঁকে অত বিরক্ত কোরো না, উনি টায়ার্ড হয়ে আছেন। বিকেলবেলা তো উনি মিটিং-এ বলবেনই।

অন্যরা তবু ছাড়তে চায় না, শান্তি তাঁর হাত ধরে টেনে বলল, এই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে কী করবেন? আসুন, আমার সঙ্গে আসুন!

ইস্কুল বাড়ির সামনের মাঠে মেলা বসেছে। একদিকে ঘুরছে নাগরদোলা। আর-একদিকে মঞ্চ বাঁধা হচ্ছে, বিকেলে সেখানে শুরু হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অবনীশ সেটা উদ্বোধন করবেন।

প্যান্ট-শার্টের বদলে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে এসেছেন অবনীশ। তিনি ভেবেছিলেন, গ্রামের অনুষ্ঠানে প্যান্ট-শার্ট পরাটা মানাবে না। এসে অবশ্য দেখছেন, গ্রামের অনেকেই এখন প্যান্ট-শার্ট পরে, ইস্কুলের মাস্টাররা পর্যন্ত, ধুতি প্রায় চোখেই পড়ে না।

ইস্কুল বাড়ির পেছন দিকে ছোট বাগান আর পুকুর। বেশ পরিষ্কার জল। হাঁটতে-হাঁটতে সেদিকে এসে শান্তি বলল, আপনার সঙ্গে যখন প্রথম দেখা হয়, তখন আমি ছাত্রী ছিলাম।

কিছু একটা কথা খুঁজে পেয়ে অবনীশ জিগ্যেস করলেন, তুমি কোন কলেজ থেকে পাস করেছ? এখন তুমি কী করো?

শান্তি ফিক করে হেসে বলল, আমাদের এখানেই তো কলেজ আছে। মাত্র তিন মাইল দূরে। সেখান থেকেই পাস করেছি। তারপর এখন বেকার। হাজার-হাজার ছেলেমেয়ের মতন! টুকটাক টিউশনি করি।

অবনীশ অনেকদিন কোনও গ্রামের দিকে আসেননি। আজকাল অনেক জায়গাতেই কলেজে হয়েছে। গ্রামের ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষার জন্য শহরে আসতে হয় না। খুব ভালো কথা। গ্রামের ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে এবং গ্রামে শিক্ষিত বেকার তৈরি হচ্ছে। গ্রামের মেয়ে টিউশনি করে জীবিকা অর্জন করছে, এটা তাঁর কাছে একেবারে নতুন খবর!

কালো রঙের ছিটছিপে গড়ন শান্তির। মুখখানায় তেমন সৌন্দর্য নেই তবে সপ্রতিভ ভাব আছে। সে কথা বলার সময় অবনীশের চোখের দিকে সোজাসুজি তাকায়।

সে আবার হেসে বলল, আপনি আমাকে মোটেই চিনতে পারেননি, পারবেনও না তা জানতুম!

অবনীশ বললেন, তুমি গ্রাজুয়েট মেয়ে, অমন ঢিপ করে পায়ের ওপর আছড়ে প্রণাম করতে গেলে কেন? সেইজন্যই তোমায় চিনতে পারিনি। অত ভক্তির কী আছে!

শান্তি বলল, ওইরকম করতে হল আপনার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। যদি শুধু অটোগ্রাফের খাতা বাড়িয়ে দিতুম, আপনি আমার মুখের দিকে ফিরেও তাকাতেন না! আপনি কি ভিড় পছন্দ করেন?

—না! একেবারেই না!

—তাহলে এইসব সভা-সমিতিতে আসেন কেন?

—দু-একটা জায়গায় না গিয়ে পারা যায় না। চেনাশুনারা ধরাধরি করে। তবে, এ জায়গাটায় আমি আগ্রহ করেই এসেছি। অনেকদিন গ্রামের মাটিতে পা দিইনি, খেজুরের রস খাইনি!

—ভাগ্যিস এসেছেন, তাই আপনাকে কাছাকাছি পাওয়া গেল। আপনার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। আজ রাত্তিরটা থাকছেন তো? কাল সকালে আপনাকে খেজুরের রস খাওয়াব।

—আমার সঙ্গে তোমার অনেক কথা আছে?

—হ্যাঁ। তার আগে একটা অভিযোগ জানাই। আমি আপনাকে অন্তত সাতখানা চিঠি লিখেছি। আপনি মোটে একবার উত্তর দিয়েছেন, সেই প্রথমবার। তারপর একদম চুপ। আমাদের বুঝি চিঠি লিখতে পয়সা খরচ হয় না?

চিঠির প্রসঙ্গে অবনীশের মনে পড়ল! হ্যাঁ, শান্তি সান্যাল নামটা তার চেনা। বেশ গোটা-গোটা হাতের লেখা। চিঠির সঙ্গে একটি-দুটি কবিতা থাকে।

সব চিঠির উত্তর দেওয়া যায় না। শুধু সময়ের অভাবেই নয়। একজনকেই বারবার কী লিখবেন! সাধারণ চিঠি লিখতে ইচ্ছে করে না। প্রায় প্রতিটি চিঠিকেই অসাধারণ করে তোলার প্রতিভা একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই ছিল।

চিঠির সঙ্গে যদি কেউ গল্প-কবিতা পাঠায়, তাহলে উত্তর দেওয়া আরও মুশকিল হয়। সেই সব লেখা খারাপ লাগলে মিথ্যে প্রশংসা করা যায় না, আবার সত্যি কথাও বলা যায় না।

শান্তির কবিতাগুলি বেশ কাঁচা। কবি হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই তার মধ্যে নেই।

অবনীশ কথা ঘোরাবার জন্য বললেন, তোমার কবিতাগুলো আমার মনে পড়ছে। তুমি শুধু প্রেমের কবিতা লেখো। কারুর সঙ্গে তোমার গভীর প্রেম আছে বুঝি?

শান্তি বলল, ওসব বানানো। গ্রামে আবার প্রেম নয় নাকি?

—কেন, রাধা-কৃষ্ণও তো গ্রামের ছেলেমেয়ে ছিল!

–কৃষ্ণ কালো, রাধা ফরসা। এটা মনে নেই? কালো মেয়েরা প্রেমিকা হতে পারে না। কেউ পাত্তাই দেয় না!

অবনীশবুঝতে পারলেন, এই প্রসঙ্গটা আর বেশিদূর না টানাই ভালো। শান্তি শুধু বেকার নয়। তার বয়েসি মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা। বিশেষত গ্রামে। শান্তির বিয়ে হয়নি বোঝাই যাচ্ছে।

পুকুরের ঘাটে বসে অবনীশ একটা সিগারেট ধরাতেই উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে দুটি ছেলে এসে বলল, স্যার, আপনাকে আমাদের প্রেসিডেন্ট একবার ডাকছেন।

শান্তি একজনকে ধমক দিয়ে বলল, আবার ওনাকে বিরক্ত করছিস? প্রেসিডেন্টকে বল যে উনি গ্রাম দেখতে বেরিয়ে গেছেন।

অন্যজনকে সে বলল, এই তাপস, তোরা ওনাকে ডেকে নিয়ে এসে শুধু বকাবকি করবি? উনি কাছাকাছি গ্রাম-ট্রাম একটু ঘুরে দেখতে চান।

তাপস বলল, একটা গাড়ির ব্যবস্থা হচ্ছে। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর ওঁকে নিয়ে বেরুনো হবে। প্রেসিডেন্ট বলেছেন, বিকেলে তাঁর বাড়িতে স্যারকে চা খেতে হবে।

শান্তি সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে বলল, শুনলেন তো। এরা যা ঠিক করবে, আপনাকে তাই করতে হবে! আপনি প্রেসিডেন্টের বাড়িতে চা না খেলে তাঁর প্রেস্টিজ থাকবে না।

বাইরে সভা-সমিতি করতে গেলে এরকম কিছু বাধ্যবাধকতা যে থাকেই, তা কি অবনীশ জানেন? তিনি ছেলে দুটিকে বললেন, ঠিক আছে, বিকেলে যাব চা খেতে। তোমরা ওকে বলে দিও।

ছেলে দুটি চলে যাওয়ার পর শান্তি খানিকটা ঠাট্টার সুরে বলল, আপনি গাড়িতে চেপে গ্রাম ঘুরতে বেরুবেন?

অবনীশ বললেন, আর কী ভাবে যাওয়া যায়?

—পায়ে হেঁটে না ঘুরলে কিছুই দেখা হবে না। আপনি এক-দেড়মাইল হাঁটতে পারবেন? তাহলে আপনাকে একটা চমৎকার জায়গায় নিয়ে যেতে পারি!

—কীরকম চমৎকার জায়গা?

—একটু দূরেই আমাদের গ্রাম। আমাদের বাড়িতে একবার আপনাকে নিয়ে যেতে চাই। একটা নদী পেরিয়ে যেতে হয়। আমাদের গ্রামে এখনও অনেক গাছপালা আছে, এরকম সবুজ গ্রাম। আপনি বেশি দেখেননি!

ঠিক আছে, যেতে পারি। হাঁটতে আমার আপত্তি নেই। সঙ্গে আর কেউ যাবে না?

—আর কারুর যাওয়ার দরকার কী? আপনাকে নিয়ে আমি চুপিচুপি পালিয়ে যাব। ভয় নেই, ঠিক সময়ে আবার আপনাকে ফিরিয়ে দেব!

অবনীশ একটুক্ষণ চিন্তা করলেন। মিটিং করতে এসে একটি মেয়ের সঙ্গে আলাদাভাবে কোথাও চলে যাওয়া কি ভালো দেখাবে? কেউ-না-কেউ নিশ্চয়ই তাঁর খোঁজ করবে!

শান্তি তাঁর হাত ধরে টেনে বলল তাহলে দেরি করে কী লাভ, উঠুন!

অবনীশ বললেন, উদ্যোক্তাদের কারুকে একটু খবর দিয়ে এসো।

—কিছু খবর দিতে হবে না। ওরা তো জানেই, আপনি আমার সঙ্গে আছেন। আমাকে সবাই চেনে, ঠিক বুঝতে পারবে।

পুকুরের পাশ দিয়ে রাস্তা, তারপর ধানখেত। আলের ওপর দিয়ে শর্টকার্ট করতে চায় শান্তি। জমিতে এখন সদ্য ধান রোয়া হয়েছে। এরকমভাবে মাঠের মধ্য দিয়ে অনেক দিন হাঁটেননি অবনীশ। ধুতিটা উঁচু করে ধরে রেখে ভাবলেন, প্যান্ট পরে এলেই হত। চটিতে কাদা লেগে যাচ্ছে। এইসব জায়গায় সবচেয়ে সুবিধে খালি পায়ে হাঁটা।

শান্তির পায়ে রবারের চটি। সে-ও তার হলদে রঙের শাড়িটা একটু উঁচু করে খুঁজে নিয়েছে। প্রাইভেট টিউশানি করার বদলে ধান রোয়ার কাজ করলেই যেন শান্তিকে বেশি মানাত। অবশ্য যে চাষিরা মাঠের কাজ করে, তারা যে কলেজে পড়াশুনো করতে পারবে না, তারও কোনও মানে নেই।

অবনীশজিগ্যেস করলেন, তুমি কটা টিউশনি করো শান্তি?

—তিনটে। তার মধ্যে এক জায়গায় মাইনে দেয় না। আমার বাবা একজনের কাছ থেকে। আড়াইশো টাকা ধার নিয়েছিলেন, আমি তার মেয়েকে পড়িয়ে সেই ধার শোধ দিচ্ছি। এক বছর পড়াতে হবে!

—আজকাল গ্রামের ছেলেমেয়েদেরও বুঝি বাড়িতে মাস্টার লাগে?

—মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে অনেকেই মাস্টার রাখে। ইস্কুলে লেখাপড়া তো বিশেষ হয় না।

—তুমি কবিতা লেখার উৎসাহ পেলে কার কাছ থেকে?

—কেউ উৎসাহ দেয়নি। এমনকী আপনিও কিছু সাহায্য করলেন না। আপনাদের শহরের ছেলেমেয়েরাই বুঝি সবকিছু করবে? কোনও পত্রপত্রিকায় আমাদের চান্স দেয় না।

—দেয় না বুঝি?

—আহা-হা, আপনি তো ভালো করেই জানেন। আপনি নিজেই তো চান্স দেননি আমাকে। কত কবিতা পাঠিয়েছি!

—মুশকিল কী জানো, কবিতার ভাষা খুব তাড়াতাড়ি বদলায়। গ্রামে বসে তোমরা ঠিক বুঝতে পারো না, তোমরা যে কবিতা লেখো, তা বড় পুরোনো ভাষায়।

—আমরা তো গ্রামে বসে সব বই আর পত্রপত্রিকা পাই না, আমরা শিখব কী করে?

—সে সমস্যার সমাধান তো আমি করতে পারব না। তবে না শিখলে চান্স পাওয়া অসম্ভব। তুমি বরং গল্প-টল্প লেখার চেষ্টা করতে পারো। কবিতার চেয়ে গল্প লেখা বোধহয় সহজ!

—গল্প লেখা সহজ? তাহলে তো সবাই গল্প লিখত।

কোনাকুনি একটা ধানখেত পার হয়ে ওরা একটা আমবাগানে ঢুকল। এই বাগানটা আগে বেশ বড় ছিল বোঝা যায়, এখন ভেতরে ভেতরে বাড়ি উঠছে। এক জায়গায় একটা গাছ কেটে তার ডালপাল চাপানো হচ্ছে একটা গোরুর গাড়িতে।

বাগানটার পাশেই নদী।

সেই নদীটি দেখে অবনীশ প্রথমে অবাক, তারপর খুশি হলেন। এরকম একটা নদী তিনি আশাই করেননি। অধিকাংশ নদীই তো এখন মজে-হেজে গেছে। এই শীতকালে প্রায় কোনও নদীতেই জল থাকে না। কিন্তু এই নদীটিতে বেশ জল আছে, স্রোত আছে। বেশ টলটলে জল, দুপাশে উঁচু পাড়। বেশ একটা ঝকঝকে তকতকে ভাব।

অবনীশবলল, বাঃ, বেশ সুন্দর তো!

শান্তি বলল, বলেছিলাম না আপনার ভালো লাগবে! ওপাশে আমাদের গ্রাম। আমাদের বাড়িটা কিন্তু মাটির বাড়ি।

—আমার জন্মও মাটির বাড়িতে।

—আপনি গ্রামে জন্মেছিলেন।

—হ্যাঁ। তবে গ্রাম ছেড়েছিও বহুবছর হয়ে গেল।

—চলুন, আমাদের বাড়িতে আপনাকে মুড়ি আর পাটালিগুড় খাওয়াব। নিশ্চয়ই অনেকদিন খাননি। আপনারা তো সকালে স্যান্ডুইচ খান, তাই না?

–কলকাতায় মুড়ি আর পাটালিগুড় দুটোই পাওয়া যায় তবে, অনেকদিন মুড়ি-পাটালিগুড় একসঙ্গে খাইনি তা ঠিকই। আমি কোনওদিন স্যান্ডুইচ খাই না। মুড়ির সঙ্গে ডিমভাজা খাই।

জলের কাছে এসে অবনীশ বললেন, কাছাকাছি কোনও ব্রিজ নেই তো দেখছি, এদিক থেকে ওপারে যায় কী করে?

–খেয়া নৌকো আছে। দেখি, মাঝি কোথায় গেল!

ঘাটে দু-তিনটে নৌকো বাঁধা। কিন্তু কাছাকাছি কোনও মানুষজন দেখা গেল না। একটু দূরে একটা দোকানঘর, শান্তি সেদিকে খোঁজ নিতে গিয়েও ফিরে এল। খেয়া নৌকোর মাঝি সেখানে নেই। কেউ বলছে, তার নাকি খুব জ্বর, অন্য একজনের আসবার কথা।

শান্তি বলল, আসুন নৌকোয় উঠে বসি।

নৌকোয় ওঠার কায়দাটা একেবারেই ভুলে গেছেন অবনীশ। তিনি আনাড়ির মতন গলুইতে পা দিতেই নৌকোটা সরে গেল, তিনি আর একটু হলে আছাড় খাচ্ছিলেন। শান্তি শেষ মুহূর্তে তাঁকে ধরে ফেলে হাসিতে একেবারে নুয়ে পড়তে লাগল। অবনীশের মতন একজন খ্যাতিমান মানুষকে লজ্জায় পড়তে দেখে সে বেশ মজা পেয়েছে।

নৌকোর খোলে বেশ খানিকটা জল জমা রয়েছে। শান্তি একটা মগ দিয়ে জল হেঁচতে লাগল। অবনীশ বসে পড়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে ব্যক্তিত্ব ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করলেন। তিনি যে এখন আটান্ন বছর বয়স্ক একজন ভারিক্কি মানুষ, সেটা মাঝে-মাঝে ভুলে যান।

শান্তি বলল, আমি নৌকো চালাতে পারি জানেন? মাঝির জন্য বসে না থেকে, আমিই আপনাকে ওপারে নিয়ে যেতে পারি। যাব?

কিছু না ভেবেই অবনীশ মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।

শান্তি প্রায় বালিকার মতন খুশি হয়ে দড়ি খুলে দিল। তারপর বইঠা জলে ডুবিয়ে বলল, আমি ভালো কবিতা লিখতে পারি না বটে, কিন্তু গোরুর দুধ দুইতে পারি, কাসুন্দি বানাতে পারি, বড়ি দিতে পারি, এমনকি গাছেও উঠতে পারি।

অবনীশ স্মিত হেসে শান্তির দিকে তাকিয়ে রইলেন। এত গুণের মেয়ে, অথচ তার বিয়ে হচ্ছে না শুধু গায়ের রং কালো বলে? নিশ্চয়ই ওর বাবার পণ দেওয়ার সাধ্য নেই। অপমানজনকভাবে। বিয়ে করার চেয়ে এরকম একটা মেয়ে কুমারী অবস্থাতেও তো কাটিয়ে দিতে পারে সারাজীবন!

কিন্তু বিয়ে না হোক, একজন প্রেমিকও থাকবে না। তখন প্রেমের প্রসঙ্গ তুলতে শান্তি চোখ নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। মেয়েটি এমনিতে বেশ হাসিখুশি হলেও ওর কোনও গোপন দুঃখ আছে। সে কথা জিগ্যেস করা যায় না। ওর কবিতাগুলিকে তিনি নিতান্ত তুচ্ছ, অকিঞ্চিকর ভেবেছিলেন, কিন্তু সেগুলির রচনার পিছনে আছে এক যুবতীর অকপট হৃদয়বেদনা।

বেশ ভালোই বইঠা চালাতে পারে শান্তি। নৌকোটা হেলল দুলল না, ঘুরে গেল না, সোজাই। এগোল। অবনীশের মুখোমুখি বসেছে শান্তি, আঁচলটা জড়িয়ে নিয়েছে কোমরে। এখন, এই ভূমিকায় তার মুখে একটা অন্যরকম সৌন্দর্য এসেছে।

ষড়যন্ত্র করার মতন মুখটা ঝুঁকিয়ে এনে শান্তি ফিসফিস করে বলল, নৌকোটা যখন পাওয়াই গেছে তখন এটুকু গিয়ে কী হবে? আরও খানিকটা ঘুরবেন? ওই যে দূরে তালগাছটা দেখছেন, ওই পর্যন্ত ঘুরিয়ে আনতে পারি। যাবেন?

এ ক্ষেত্রে হ্যাঁ কিংবা না কী বলা উচিত, তা ভেবে পেলেন না অবনীশ। আর কেউ নেই, শুধু একটি মেয়ের সঙ্গে নৌকোয় করে বেড়ানো তো আনন্দের ব্যাপার। কিন্তু সেটা কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না? এইরকম গ্রাম দেশে নিশ্চয়ই এ নিয়ে কথা উঠবে। অবনীশ তো ফিরে যাবেন আগামীকাল, তারপর যদি শান্তির ওপর অত্যাচার হয়?

কিন্তু অবনীশ তাঁর লেখার মধ্যে কোনওরকম সংস্কারকে প্রশ্রয় দেন না। নারী-পুরুষের সহজ মেলামেশায় বিশ্বাস করেন। তিনি একটি মেয়ের আহ্বানে সাড়া দেবেন না।

তিনি জিগ্যেস করলেন, এটা তো খেয়ার নৌকো, অন্যদের লাগবে না?

—অন্যরা না হয় একটুখানি দাঁড়িয়ে থাকবে।

—না চলো, ওপারে গিয়ে তোমার বাড়িটাই ঘুরে আসি। মুড়ি আর গুড় খাওয়াবে বললে যে!

—এই যাঃ! ধরুন, ধরুন!

বৈঠাটা শান্তির হাত থেকে খসে জলে পড়ে গেল না শান্তি ইচ্ছে করে ফেলে দিল? বেশ স্রোত আছে, হাত বাড়িয়েও সেটা ধরা গেল না। এবার নৌকোটা ঘুরতে লাগল।

শান্তি বলল, এখন আমরা ভাসতে-ভাসতে যেখানে খুশি চলে যাব! আর ইচ্ছে করলেও ফেরা যাবে না!

অবনীশবিরক্ত হওয়ার বদলে হালকাভাবে হাসলেন। হঠাৎ একটি মেয়ে তাকে ভিড় থেকে টেনে নিয়ে এল, তারপর নদীর বুকে তাঁর সঙ্গে নৌকোয়, এই নৌকো আপন মনে ভাসবে! এ যেন এক প্রেমের দৃশ্য!

বয়েসটা আর একটু কম হলে আরও উৎসাহিত হওয়া যেত। শান্তির সঙ্গে তাঁর বয়েসের তফাত প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর তো হবেই। কেউ তাঁকে শান্তির প্রেমিক ভাববে না ভুলেও। অন্যদের চোখে তিনি একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি! তাঁর বদলে অন্য কারুর সঙ্গে শান্তির এই পাগলামির খেলাটা খেলা উচিত ছিল।

সেরকম তো চওড়া নদী নয়, অকূলে ভেসে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। দু-পাড়ে কিছু কিছু লোক জমছে। তারা এই দৃশ্য দেখছে।

কে একজন চেঁচিয়ে উঠল, এই শান্তি, নৌকোটা এদিকে নিয়ে এসো!

শান্তি অবনীশকে বলল, ওদের কথা শুনবেন না। ওদিকে তাকাবেন না!

অবনীশ মনে মনে বললেন, আমি বেদব্যাস, তুমি মৎস্যগন্ধা?

ক্রমে চেঁচামেচি বাড়তে লাগল। নদীর বুকে একটা নৌকোয় শুধু একটি নারী ও পুরুষ আপন মনে বসে আছে, এই দৃশ্য অন্যদের সহ্য হয় না! অবনীশও বেদব্যাস নন, চারপাশে কুয়াশার আড়াল সৃষ্টি করার ক্ষমতা তাঁর নেই।

একসময় শান্তি চেঁচিয়ে বলল, ফিরতে পারছি না। বইঠা ভেসে গেছে!

এবার আর-একটা নৌকো এগিয়ে এল। তাতে দুজন মানুষ। একজন নৌকোটা চালাচ্ছে, অন্যজন দাঁড়িয়ে রাগত সুরে বলতে লাগল, এই শান্তি, তুই কার হুকুমে এই নৌকো নিয়ে এসেছিস? খেয়ার নৌকো নেওয়ার অর্ডার তোকে কে দিয়েছে? কলকাতা থেকে ভদ্রলোক এসেছেন, যদি নৌকো উলটে যেত?

অবনীশ সে ব্যাপারে চিন্তিত ছিলেন না। একসময় তিনি ভালোই সাঁতার জানতেন। সাঁতার কেউ ভোলে না। ধুতি-টুতি নিয়ে একটু অসুবিধে হত বটে, কিন্তু জলে ডুবে যেতেন না!

শান্তি সেই লোকটিকে বলল, তুমি এত ধমকাচ্ছ কেন, তোমার নৌকো এনেছি নাকি?

লোকটি দাঁত কিড়মিড় করে বলল, তোর বড় বাড় বেড়েছে না?

শান্তি অবনীশের দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা বেড়াচ্ছিলুম তো, তাই ওদের হিংসে হয়েছে।

দুটো নৌকো গায়ে-গায়ে লাগল। সেই লোকটি আবার বলল, শান্তি, তুই কারুকে কিছু না বলে কেন এনাকে নদীতে নিয়ে এসেছিস?

শান্তি বলল, বেশ করেছি। তুমি বেশি চোখ রাঙাবে না। বিশুদা!

তখন সেই বিশুদা নামের যুবকটি ঝুঁকে এসে ঠাস করে একটা চড় কষাল শান্তির গালে।

অবনীশ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এ কী কাণ্ড! কিন্তু তিনি কিছু প্রতিবাদ করার আগেই শান্তিও উলটে চড় লাগাতে গেল যুবকটিকে, দুজনের ঝটাপটিতে নৌকো এবার সত্যি উলটে যাওয়ার জোগাড়।

তা অবশ্য হল না। অন্য নৌকাচালকটির বকুনিতে দুজনেই থেমে গিয়ে ফুসতে লাগল। অবনীশ আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলেন।

সভার উদ্যোক্তাদেরও দুজন ছুটে এসেছে নদীর ধারে। এদিকে নৌকো ভিড়তেই তারা শান্তিকে খানিকটা বকাবকি করে, অবনীশের কাছে ক্ষমা চেয়ে তাঁকে নিয়ে গেল ইস্কুলবাড়িতে। সেখানে আলাদা একটি ঘরে তাঁর বিশ্রামের ব্যবস্থা।

শান্তির বাড়িতে আর যাওয়া হল না, শান্তির সঙ্গে তার দেখাও হল না। বিকেলের মিটিং-এর সময়ও শান্তি নেই। অভিমান হয়েছে তার? তা তো হতেই পারে। কিন্তু শান্তিকে যে চড় মারা হয়েছে, তা নিয়ে কোনও চাঞ্চল্য নেই, কেউ সে বিষয়ে আলোচনাও করছে না।

সন্ধের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সবটা বসে দেখতে হল অবনীশকে। খুব যে ভালো লাগছে তা। নয়, কিন্তু ভদ্রতা করে বসে থাকতেই হয়। একসময় তিনি সিগারেট টানবার জন্য বাইরে এলেন।

বেশ বড় মাঠ, পেছন দিকে লোকজন রয়েছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। অবনীশ হাঁটতে-হাঁটতে অনেকটা চলে এলেন। একেবারে পেছন দিকে, আধো অন্ধকারে দুটি নারী ও পুরুষ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। অবনীশ সেদিকে আর এগোতে চাইলেন না।

হঠাৎ একটা হাসির শব্দ শুনে তিনি চমকে উঠলেন। হাসিটা চেনা। শান্তি!

অবনীশ একপলক তাকিয়ে দেখলেন তার পাশের যুবকটি সেই বিশুদা। ওদের দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠতার স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে।

আজ দুপুরের ঘটনার পরেই ওদের মধ্যে এই ঘনিষ্ঠতা হল? শান্তি তাঁকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিল বলেই ঈর্ষা হয়েছিল ওই বিশু নামের ছেলেটির? তাহলে, এতটা বয়েস হলেও, তিনি পুরোপুরি বুড়োদের দলে চলে যাননি, যুবকেরা এখনও তাঁকে ঈর্ষা করে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *