1 of 3

নদীতীরে

নদীতীরে
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

তারপর আমি ইন্দিরা গান্ধীকে জিজ্ঞেস করলুম, আপনি বই পড়তে ভালোবাসেন?
উনি একটু হেসে বললেন, ছেলেবেলায় আমি বইয়ের পোকা ছিলুম।
—এখন বই-টই পড়ার সময় পান না বোধ হয়?
সে রকম সময় পাই না, তা ঠিকই। তবে, যেটুকু সময় বাঁচানো যায়… যেমন ধরো, যখন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হয়—এ রকম প্রায়ই যেতে হয়, বিমানে বসে আমি কারোর সঙ্গে কথা বলি না, শুধু বই পড়ি। একবার আসামে যাওয়ার সময় আদ্রে মলরোর ‘অ্যান্টি মেমোয়ার্স’ বইখানা পড়ছিলাম, মাত্র আটচল্লিশ পাতা পড়া হলো, সেখানে পেজ-মার্ক দিয়ে রাখলাম, আর সুযোগই পাইনি, তারপর লুঙ্মেবার্গ যাওয়ার পথে আবার ঊনপঞ্চাশ পৃষ্ঠা থেকে—
—এই বইটাতে আপনার বাবার সম্পর্কে চমৎকার লিখেছেন।
—হুঁ।
কথা থামিয়ে তিনি পাশ থেকে একটা কাগজের রুমাল তুলে নিলেন। সেটাতে সুগন্ধ রয়েছে। বিমানযাত্রার সময় এ রকম কাগজের রুমাল দেয়, আমি দেখেছি, একটু ভিজে ভিজে থাকে—মুখ মুছে নিলে পরিষ্কারও হয় এবং গন্ধের জন্য মন ভালো হয়। এয়ার হোস্টেস যখন ট্রে-টা বাড়িয়ে দিয়েছিল, তখন আমি একটার বদলে তিনটা তুলে নিয়েছিলাম। এ রকম নিয়ম নয়, তবে আপত্তি করে না।
ইনি কি একটার বদলে তিনটা তুলে নেন কখনো? তারপর মনে পড়ল, ওঁর দরকার হয় না। ওঁকে এ রকম দ্বিধায় পড়তে হয় না।
উনি পায়ের ওপর পা তুললেন। উরুর কাছে শাড়ি প্লেন করলেন এক হাত দিয়ে, শিশুর মতো চিবুকটি উঁচু করে এক পলক চিন্তা করে নিলেন অন্য কিছু।
তারপর উদাসীনভাবে বললেন, সবাই আমার কাছে এসে নানারকম প্রশ্ন করে। আমি কাউকে কোনো প্রশ্ন করি না। আমার কাজ শুধু উত্তর দেওয়া।
—এবং অধিকাংশই অবান্তর প্রশ্ন।
—প্রায়।
—আমার আর একটাই প্রশ্ন আছে। কী রকম লাগে জীবনটা? এর নাম কি সুখ?
—সুখ?
হ্যাঁ।
—সুখের কথা চিন্তা করিনি। জীবনে যখনই কোনো সংকট এসেছে, তখনই ভেবেছি আমায় যেন কেউ হারাতে না পারে। কখনো তো হারিনি আমি। অনেক কিছুই অসম্পূর্ণ আছে। কিন্তু হেরে যাইনি।
—আপনি বোধ হয় রবীন্দ্রনাথের ‘গান্ধারীর আবেদন’ পড়েননি। সেখানে তিনি এ কথাই দুর্যোধনের মুখে বসিয়েছেন :
‘সুখ চাহি নাই মহারাজ—
জয়! জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ।
ক্ষুদ্র সুখে ভরে নাকো ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা—’
—তুমি আমার সঙ্গে দুর্যোধনের তুলনা করলে?
—এবার আপনি প্রশ্ন করছেন।
—এটা পাল্টা প্রশ্ন। উত্তরটাকেই পরিষ্কার করে নেওয়ার জন্য।
—না, তুলনা করিনি। কাব্যের সঙ্গে জীবনের তুলনা চলে না। তা ছাড়া, মহাভারতে দুর্যোধন আর রবীন্দ্রনাথের দুর্যোধন এক নয়। আমি বলতে চাইছিলাম, যাদের হাতে শাসনভার থাকে, তাদের কাছে জয়টাই প্রধান। ‘রাজধর্মে, ভ্রাতৃধর্ম, বন্ধুধর্ম নাই, শুধু জয়ধর্ম আছে—’
—আমি ওটা আমার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বলছিলাম। —আপনার কোনো ব্যক্তিগত জীবন নেই। আপনি কতদিন একা কোথাও যাননি, কতদিন কোনো নদী দেখেননি।
—নদী দেখিনি?
—সেতু উদ্বোধন করার সময় দেখে থাকতে পারেন বটে।
তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো।
আমি মনে করলাম, সময় হয়ে গেছে, তাই উনি আমাকে যেতে বলছেন। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী আবার বললেন, চলো তোমার সঙ্গে কোনো নদী দেখে আসি।
আমি বললাম, আপনার বয়েসী কোনো নারীর সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার জন্য আমার প্রলুব্ধ হওয়ার কথা নয়। তবে আপনার একটা আলাদা আকর্ষণ আছেই। শুধু রাষ্ট্রপ্রধান বলেই নয়, বয়স হওয়া সত্ত্বেও আপনি এখনো যেন যৌবনের প্রতীক। আপনার হাবভাব, চলাফেরা ও পোশাকের মধ্যে এখনো যৌবনসুলভ ব্যাপার আছে। শুনেছি আপনি খুব নিষ্ঠুর, কিন্তু আপনার মুখে তার কোনো রেখা পড়েনি।
—আমরা নদী সম্পর্কে কথা বলছিলাম, যাবে?
—সঙ্গে আপনার সাতান্নজন দেহরক্ষীও যাবে নিশ্চয়ই!
উনি একটু হেসে বললেন, সাতান্নজন! তুমি গুনেছ নাকি? আমি তো জানি না।
—একবার রবীন্দ্রসদনে একটা উৎসবে আপনাকে দেখেছিলাম, তখনই শুনেছিলাম, সর্বসমেত সাতান্নজন ব্যক্তি আপনাকে পাহারা দিচ্ছে। বাইরে জল খেতে গেছি, সেখানেও দেখি কলের কাছে একজন লোক দাঁড়িয়ে। দেখলেই বোঝা যায়, প্রহরী। তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি বলে কেউ জল খেতে আসছে না। অথচ, আমার এখানেই দাঁড়াবার কথা।
—এ রকম হয় বুঝি?
যাই হোক, চলো, আজ আমি একাই গঙ্গার ধারে যাব। এ কথা ঠিক, আমি পৃথিবীর সর্বত্র গেছি, করতলের মতনই পৃথিবীটা চিনি। অনেক অনেকদিন কোনো নির্জন নদীতীরে দাঁড়াইনি। কলকাতার গঙ্গার ধার খুব সুন্দর?
—পৃথিবীর বিখ্যাত দৃশ্যগুলোর একটি। কিন্তু আপনি সেখানে যেতে পারবেন না। আপনি নিষেধ করলেও রক্ষীরা শুনবে না। একটু দূরে থেকে অনুসরণ করবে। তা ছাড়া—
—তা ছাড়া কী?
—বলতে আমার দ্বিধা হচ্ছে। অভয় পেলে বলতে পারি।
—বলো।
—গঙ্গার ধারের সেই আততায়ী যে রয়েছে।
—তার মানে?
—পৃথিবীর প্রতিটি জায়গায়ই কী আপনার জন্য একজন আততায়ী অপেক্ষা করে বসে নেই? নইলে এত রক্ষী কেন?
—উনি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তা আছে। এটা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমাকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে অনেকেরই স্বার্থ আছে। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষেত্রেই এ রকম হয়।
—জানি। কিন্তু সব সময়ই আমাকে কেউ হত্যা করতে চায়, এই চিন্তাটা কেমন লাগে।
—সব সময় মনে থাকে না।
—সব সময় রক্ষী থাকা মানেই চেতনে হোক অবচেতনে হোক এটা মেনে নেওয়া।
—অভ্যেস হয়ে যায়। এটাও পার্ট অব গেম।
—রবীন্দ্রসদনের বাইরে জলখাবার জায়গায় যে লোকটি একা দাঁড়িয়ে ছিল, তার সেই দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গির মধ্যে অদ্ভুত একটা কিছু ছিল। সেই জন্য আমি সপ্রশ্ন চোখে তাকিয়েছিলাম। তার ভঙ্গি অলস অথচ সতর্ক। অন্যমনস্কের ভান অথচ নজর তীক্ষ্ন। নিশ্চয়ই ওর কাছে কোনো অস্ত্র ছিল। ঐ লোকটিকেও আমি আততায়ী ভাবতে পারতাম। কিন্তু ও ছিল প্রহরী। ভেবে দেখতে গেলে আততায়ী ও প্রহরীর মধ্যে বেশ মিল আছে।
উনি আমার কথা শুনে একটু বিরক্ত হলেন মনে হলো। বিখ্যাত ভঙ্গিতে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন একটুক্ষণ। তারপর বললেন, কথায় কথা বাড়ে। আমি নদীর কাছে যেতে চেয়েছিলাম একা।
—একা।
—হ্যাঁ। এবং তুমি আমায় রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে যাবে। জানো বোধ হয়, আমি কোনো শহরেরই রাস্তা চিনি না। হঠাৎ ভিড়ের কলকাতা শহরের মাঝখানে আমাকে ছেড়ে দিলে আমি বাচ্চা মেয়ের মতো হারিয়ে যাব।
—কিন্তু তার আগে গঙ্গার ধারের সেই আততায়ীর ব্যাপারটা নিষ্পত্তি হওয়া দরকার নয় কি?
—মনে হয়, সেখানে কোনো আততায়ী নেই। তুমিই তো বললে, সেটা খুব সুন্দর জায়গা।
—আব্রাহাম লিঙ্কন যখন মুগ্ধ হয়ে নাটক দেখছিলেন, তখন মঞ্চের ওপর থেকেই লাফিয়ে এসেছিল আততায়ী। খুনির সৌন্দর্যবোধ নেই।
—কিন্তু আমাকে মারতে চাইবে কেন? আমি কি এই দেশটাকে বাঁচাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছি না?
দেশটাকে বাঁচানো বড়ো কথা নয়, কথা হচ্ছে কে তাকে বাঁচাবে। সবকিছুর থেকেই বড় হচ্ছে সেই আমি। মৃত্যু না হলে কিংবা নিহত না হলে কেউ তো দেশের পরিত্রাতার ভূমিকা ছাড়তে চায় না।
—আমরা কথা বলছিলাম নদী সম্পর্কে।
—নদী নয়, নদীর তীরে একা দাঁড়ানো সম্পর্কে।
—ঠিক, তুমি হঠাৎ এ কথাটা বলেছিলে কেন? আমি কতদিন কোনো নদী দেখিনি।
—আপনি বলেছিলেন আপনার ব্যক্তিগত জীবনের সম্পর্কে কিছু একটা—আমি বলেছিলাম, আপনার কোনো ব্যক্তিগত জীবন নেই। সে জন্যই নদীর কথা আসে। আপনার অ্যারোপ্লেন আছে, হুকুম আছে, সেতু উদ্বোধনের তারিখ আছে, কিন্তু আপনার কোনো নদী নেই।
—তাতে কিছু যায় আসে?
—না।
—তাহলে?
—তবু হঠাৎ আপনি নদী দেখতে চাইলেন।
—চলো। আমাকে কেউ চিনতে পারবে না। কেউ বিশ্বাসযোগ্য মনে করবে না আমার চেহারা। বড়জোর বলাবলি করবে, ওকে ঠিক ইন্দিরা গান্ধীর মতন দেখতে। স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধী হতেই পারে না।
—এ রকম বিভ্রম কোনো চিত্রতারকা সম্পর্কে হতে পারে, কিন্তু আপনার সম্পর্কে সন্দেহের কোনো কারণই নেই—প্রতিদিন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আপনার অসংখ্য ছবি ছাপা হয়।
—কথায় কথা বাড়ে।
—চলুন তাহলে দেখা যাক পরীক্ষা করে।
রাজভবনের গেটের বাইরে আমি অপেক্ষা করছিলাম, উনি একটা সাদা শাল জড়িয়ে বেরিয়ে এলেন। সন্ধে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। আমাকে দুটো সিগারেট পোড়াতে হয়েছিল।
—উনি এসে বললেন, কোনোদিন আমি এখানে পায়ে হেঁটে ঢুকিনি কিংবা বেরোইনি, তাই আমাকে কেউ লক্ষ করেনি। সবাই আমার গাড়িটা পাহারা দিচ্ছে।
—নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর আরো অসংখ্য লোকের দেখা করার কথা ছিল; অনেক দাবি, অনেক অনুগ্রহ, অনেক প্রতিবাদ।
—তা ছিল। কিন্তু যুবক, তুমি নিজেকে বিশেষ সৌভাগ্যবান মনে করো না। মনে রেখো, তুমি আমার পথপ্রদর্শক মাত্র।
—অদূরে গঙ্গা, আপনি সোজা চলে যান।
—তুমি রাগ করলে?
—আপনাকে একটু আগে আমি বলেছিলাম যে নারীর সঙ্গে সান্ধ্যভ্রমণে আমি কখনো নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি বটে, কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে সে কথা আসে না।
ইংরেজিতে যাকে বলে ফুল থ্রোটেড লাফটার, তিনি সেইভাবে হাসলেন। এ কথা ঠিক, সব প্রবীণ পুরুষ ও নারীর মধ্যেই কখনো কখনো একটি শিশুকে খুঁজে পাওয়া যায়।
রেডিও ভবনের পাশ দিয়ে, স্টেডিয়ামের গা ঘেঁষে আমরা হাঁটছিলাম। আবছা অন্ধকারের রাত্রি, পথে অনেক মানুষজন, কিন্তু কেউ আমাদের লক্ষ করছে না। অল্পবয়সী যুবক ও যুবতীরা নিজেদের নিয়েই মত্ত। একটি ভিখারি শিশু অনেকক্ষণ ধরে আমাদের পেছনে পেছনে আসছিল, উনি একটু বিব্রত বোধ করলেন, উনি সঙ্গে পয়সা আনেননি—খুব সম্ভবত কোনোদিনই ওঁর নিজের কাছে টাকা-পয়সা থাকে না। অন্তত গত কয়েক বছর।
উনি আমার দিকে তাকালেন।
আমি বললাম, খুচরো পয়সা আমার কাছে আছে, কিন্তু ভিক্ষে দেওয়াটা কি ঠিক নীতি?
—নিজের বিবেককে প্রশ্ন করো।
—আমার বিবেক একেক রকম নির্দেশ দেয়, সে জন্যই আপনার কাছে জানতে চাইছিলাম।
—আমি মানুষকে নীতিবোধ শেখাই না।
আমি ভিখারি শিশুটিকে দশ পয়সা দিলাম। সে চলে যাওয়ার পর আমি বললাম, ওর প্রতি দয়াবশত আমি পয়সা দিইনি, আমি চাইছিলাম ও যেন আর বিরক্ত না করে।
—কলকাতায় ও-ই কি একমাত্র ভিখারি?
—না, এখানে ভিখারির সংখ্যা তিন লাখ একজন।
—একজন মানে?
—আমাকে নিয়ে।
—তুমি কিসের ভিখারি?
আমি একটু চুপ করে রইলাম। তারপর উত্তর দিলাম, বলতে যাচ্ছিলাম, ভালোবাসার, তারপর মনে হলো, এটা একটা ক্লিশে, আবার মনে হলো, ক্লিশে হলেও সত্যি—অথচ এসব মুখে বলা যায় না।
—তুমি ভালোবাসা পাওনি?
—তা পেয়েছি, তবু একটা ভিখারিপনা থেকেই যায়।
—যাদের ও রকম থাকে, তারা জীবনে কোনো বড় কাজ করতে পারে না।
—আপনার ঐ দুর্বলতা নেই?
—ছিল এক সময়। খুবই। যখন আমার মায়ের খুব অসুখ…থাক্।
—ছেলেবেলায় একটা লেখা পড়েছিলাম, সক্রেটিস ইন অ্যান ইন্ডিয়ান ভিলেজ—
—আমার ক্ষেত্রে সেটা খাটে না।
ইডেন উদ্যানের কোণটায় এসে আমরা দাঁড়াই। রাস্তার মাঝখানে গোল একটা স্থাপত্য—এক সময় ওখানে বিদেশি কোনো রাজপুরুষের মূর্তি ছিল, এখন শূন্য প্যাডেস্টাল। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। মনোরম হাওয়া দিচ্ছে।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, পথ প্রদর্শক, এবার কোন দিকে?
আমি বললাম, রাস্তা পার হতেই হবে। পারবেন?
সট সট করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে, মাঝেমধ্যে বিশালকায় ট্রাক। উনি বহুদিন একলা এভাবে ট্রাফিকের মধ্যে হেঁটে রাস্তা পার হননি। কিন্তু সব ব্যাপারেই ওঁর একটা সপ্রতিভতা আছে। ডান দিক ও বাঁ দিকে তাকিয়ে ধীর পদক্ষেপে রাস্তা পার হয়ে এলেন, এই গতিভঙ্গিতে একটা আভিজাত্য আছে। ব্যস্ততা ওঁকে মানাত না।
তখনই কিন্তু গঙ্গার দিকে না গিয়ে আমি ওঁকে নিয়ে কেল্লার দিকের রাস্তা ধরে আরো একটু হাঁটলাম। হাওয়া ক্রমশ প্রবল হচ্ছে। বেশ শীতের শিরশিরে ভাব। উনি শালটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিলেন শরীরে। আপন মনেই বললেন, কলকাতায় আছি, অথচ এতখানি সময় আমার নিজস্ব, এটা যেন ঠিক বিশ্বাসই করতে পারছি না। কলকাতায় অভিযোগ অনেক বেশি থাকে।
আমি চুপ করে রইলাম। আমার দেশলাইয়ের কাঠি ফুরিয়ে গেছে, সিগারেট ধরাতে পারছি না, এইটাই আমার একমাত্র চিন্তা। উল্টোদিক থেকে একজন লোক হেঁটে আসছিল, মুখে সিগারেট, আমি তাকে বললাম, দাদা একটু আগুনটা দেবেন? লোকটি থমকে দাঁড়াল। আমার সিগারেট ধরাতে যেটুকু সময় লাগল, সেই সময়ে লোকটি তাকাল ভারত কিংবা পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত নারীটির দিকে। চিনতে পেরেছে কি না কে জানে, তবে নিশ্চিত অবাক হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আমার দিকে এবং তাঁর দিকে দুবার তাকাল।
উনি একটু পাশে সরে দাঁড়িয়ে স্থির চোখে তাকিয়ে আছেন এদিকে।
হঠাৎ আমার একবার মনে হলো, এই লোকটিই কি গঙ্গার ধারের সেই আততায়ী? এরা ঠিক খবর পেয়ে যায়।
আমি লোকটিকে বললাম, ধন্যবাদ।
না, লোকটি চিনতে পারেনি। আবার হাঁটতে আরম্ভ করল। আমি ওঁকে বললাম, আমি একটু বেশি সিগারেট খাই, আপনি কিছু মনে করছেন না তো?
উনি হাতের ভঙ্গিতে কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমরা নদীর দিকে যাচ্ছি না কেন?
আমি বললাম, ঠিক কোন জায়গায় আপনাকে মানাবে, ঠিক বুঝতে পারছি না। পথপ্রদর্শকের অনেক দায়িত্ব।
উনি বললেন, আমি নদী দেখতে এসেছি। আমাকে সবচেয়ে বেশি মানায় উঁচু মঞ্চে, সেটা আলাদা কথা।
আবার রাস্তা পার হওয়ার একটা ব্যাপার হলো। ছোটো রেললাইন পেরিয়ে আমরা এলাম স্ট্যান্ডে। জায়গাটা নির্জন।
নদী এখন কালো এবং গম্ভীর। একটা আলো ঝলমল বিদেশি জাহাজ খুব কাছেই। জলে পড়েছে লম্বা লম্বা আলোর রেখা। দূরে কয়েকটা ডিঙি নৌকার লণ্ঠনকে এখান থেকে জোনাকি বলে ভ্রম হয়।
উনি মুখ তুলে তাকালেন নদীর দিকে। বললেন, কই কিছুই হলো না তো?
—কী?
—আমি ভেবেছিলাম অন্যরকম মনে হবে। কিন্তু আমার মনে পড়ছে ফরাক্কার কথা, কলকাতা বন্দরের সমস্যা, বাংলাদেশের প্রয়োজনের কথা এবং দ্বিতীয় সেতু—
আমি বললাম, আপনি এখনো মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছেন কিংবা রাজভবনে প্রতিনিধি সম্মেলনে। আপনি নদীর কাছে আসেননি।
উনি চোখ বুজে আবার চোখ খুললেন। বললেন, এবার তো ভালো করে দেখতে পাচ্ছি নদীকে।
—জয় না সুখ, কোন্টা?
—প্রশ্ন করো না।
—কী অসহায় মনে হচ্ছে আপনাকে।
একটু দর্পিত ভঙ্গিতে আমার দিকে ঘুরে বললেন, অসহায় কেন?
—জয় না সুখ আপনি বুঝতে পারছেন না।
—আমি আত্মচিন্তা করি না। আমাকে সারা দেশের কথা চিন্তা করতে হয়।
—এখানে কোনো দেশ নেই। এখানে শুধু নদী, চিরকালীন।
উনি খানিকটা অহংকার ও অভিমান মিশ্রিত মুখে তাকিয়ে রইলেন নদীর দিকে। ওঁর ঠোঁট কাঁপছে। কিছু যেন বলতে চান।
তারপর নিজেই সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে গেলেন জলের কাছে। নিচু হয়ে জলে হাত দিলেন।
আমি ভাবলাম, উনি নিশ্চয়ই নদীর জল মাথায় ছিটাতে চান। পরক্ষণে মনে হলো, হয়তো নদীর কাছে গেলেন কোনো গোপন কথা বলার জন্য। আর তো কেউ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *