নদী

নদী

যুধিষ্ঠির ইলিশের সঙ্গে আমার আলাপ হয় ১৯৮৪-র সেপ্টেম্বরে। বরানগর বাজারের পেছনে। বাড়িটা এখন আমি ভুলে গেছি। তার জোয়ান নাতি আমাকে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। বাড়িটা খুব সম্ভব রতনবাবুর ঘাট আর প্রামাণিক ঘাটের মাঝামাঝি। খুব সাধারণ বসতবাড়ি। খালি বারান্দা। একচিলতে উঠোন। টালির চাল। মরা ডুমের আলাে।

তখন আমি নগর বরাহনগরের গায়ে গঙ্গার বুক দেখি। জল। মাছের নৌকো। বন্ধ কারখানার ভাঙা দেওয়ালের ভেতর দিয়ে ফলন্ত বাতাবি গাছের নুয়ে-পড়া মাথা। একটা শঙ্খচিল রােজ দুপুরে তার দুই ছানাকে নিয়ে শিকারের—আকাশে উড়ে বেড়াবার কোচিং দিতে আসত।

এইসব দেখতে দেখতে কুঠিঘাট থেকে প্রামাণিক ঘাট, রতনবাবুর ঘাট, সর্বমঙ্গলা ঘাট অবধি চলে যেতাম। মাঝে কাশীপুর মহাশ্মশান, অর্ডনান্স কারখানা, বরাহনগর থানার ভাঙাবাড়ি, সন্ধ্যার আঁধারে বাঁধানাে কুঠিঘাটে বসে ওসি গরম দুধ খাচ্ছেন, টালি আর চুনের নৌকো এসে ভিড়ছে মেদিনীপুর থেকে। জলের গায়েই হরকুমার ঠাকুর রােডে ইমারতি স্টোর্স। উল্টোদিকেই ওপারে বেলুড় মঠ, বালি ব্রিজে রেলগাড়ি ঝমঝম।

গঙ্গার গায়ে ঘুরি। প্রামাণিক ঘাটে জলের ওপর অনেক উঁচুতে কাঠের জলটুঙি, অশ্বত্থ গাছের ঝুরি, মাছখেকো কুকুর জলের কিনারায় লাফিয়ে লাফিয়ে মাছ খাচ্ছে। আমি হাঁটছি জল ধরে ধরে। যেখানে না পারি—সেখানে মিউনিসিপ্যালিটির সরু রাস্তা ধরি। প্রাচীন জমিদার বাড়িগুলাের গা দিয়ে—যেখানে

এখন মােটর গ্যারেজ, গুলকয়লার কারখানা।

এইভাবেই পেয়ে যাই একটা বাড়ি—যার গায়ে লেখা

হেয়ার লিভড ডাচ গভরনর। বাড়িটা এখন গার্লস ইস্কুল। আরও এগােই। লােকালয়। চিত্তেশ্বরীর মন্দির। শাহজাহানের আমলের। তারপর সর্বমঙ্গলা ঘাট। শীতের ভােরে খুরির চা। সর্বমঙ্গলা ঘাটের গায়ে পাথরে লেখা—

ক্যালকাটা পাের্ট

ইস্টার্ন লিমিট

১৮৬১ তারপরই গঙ্গার গায়ে সেইসব ভুতুড়ে গুদাম—যার গা দিয়ে রেললাইন বেরিয়ে ঘাসে-ঢাকা বাফারে এসে বুজে গেছে। তীর ঘেঁষে ঝাকড়া নিষ্ফলা সবেদা গাছ। গাছের পায়ের কাছে জোয়ারের গঙ্গা যতবার পারে তীরে উঠতে চেষ্টা করছে—ততবারই একটা জখম শকুন পা হেঁচড়ে গাছটার শেকড়ে উঠে বসে বাঁচতে চাইছে। পারছে না। জল তাকে টেনে নামাবেই। অথৈ জলে।

গাছতলায় ঘাসে-ঢাকা, জং-ধরা রেলপাটির ওপর যশাের খুলনার অভাবী মুসলমানরা এসে ঝুপড়ির নগর তুলেছে। তাদের বাচ্চারা শকুনটাকে বাঁশ দিয়ে জলে ঠেলে দেবেই। বাচ্চাদের বাবারা বিনা লাইসেন্সের তে-ভাঙা রিকশা-সাইকেল চালিয়ে সর্বমঙ্গলা ঘাটে প্যাসেঞ্জার নামিয়ে দিয়েই ঝুপড়ির সংসারে নিজের নিজের বাজার নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। দেড়শাে সর্ষের তেল, চারআনার মিল্ক পাউডার, মরা তেলাপিয়া, পচা কুমড়াে, বাসি পাউরুটি, বাংলা গােলা সাবান, ব্ল্যাকে কেনা রেশনের কাঁকুরে চাল, কৌটো থেকে বানানাে মগ।

শিকারি শঙ্খচিল, জখম শকুন, ঘাসে-ঢাকা রেলপাটি, অভাব থেকে রিফিউজি, নদীতে ভাসিয়ে আনা মেদিনীপুরি বাঁশের গােছা, গঙ্গার ঘাটে ঘাটে লেগে থাকা হরকুমার ঠাকুরের নামে রােড, গরম দুগ্ধপায়ী ও সি, ক্যালকাটা পাের্টের ১৮৬১ সনের সীমানা, হিয়ার লিভড ডাচ গভরনর, চৈতন্যদেব ত্রৈলঙ্গস্বামী-রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ পা ধুয়ে ডাঙায় উঠেছেন যে কুঠিঘাটে—তার গা দিয়ে থানার সামনে বয়ে-যাওয়া এই গঙ্গায় একদিন সুবে বাংলার সুবেদার শাহজাদা সুজা নৌকোয় করে এলাহাবাদে গিয়ে উঠেছেন—এই জলধারাই কাশীতে পৌছে একদিন আকবর বাদশাকে হাতির দঙ্গলসমেত মুঘল ফৌজ নিয়ে পারাপার হতে দেখেছে। আকবর তখন বিদ্রোহ গুড়িয়ে দিতে বাস্ত।

আর সেই গঙ্গার পারেই ছােট্ট একখানি ঘরে যুধিষ্ঠির ইলিশে সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল তারই জোয়ান নাতি। স্বয়ম্বর কাওরা। এমনই এক ইলশেগুঁড়ি সেপ্টেম্বরের ঝিরঝিরে বিকেলে।

স্বয়ম্বরেরর কাছে আমি অনেকদিন গঙ্গার ইলিশ নিয়েছি। বিকেলের দিকে। গঙ্গার ওপার থেকে পড়ন্ত সূর্য তখন ফাঁকা বরাহনগর বাজারের ভেতর তিন-চারটি আলাের রেখা পাঠায়। সেই আলােয় স্বয়ম্বর গােনাগুনতি তিনটি কি চারটি গঙ্গার ইলিশ নিয়ে বসে। চকচকে। সেদিনেরই ধরা। হয়তাে কয়েক ঘণ্টা আগে। নাক থেকে লেজে পাটের সুতুলি বাঁধা। ধনুক-হয়ে-ওঠা ইলিশ সামনে রেখে স্বয়ম্বর চুপ করে বসে থাকে।

আমি গঙ্গা দেখি, গঙ্গার সঙ্গে জড়ানাে ইতিহাস চালি। হাওড়ার ঘুসুড়ি থেকে তাঁতের কাপড় নিয়ে তাঁতিরা এই গঙ্গা পেরিয়ে গােবিন্দপুর, সুতানুটি মাড়িয়ে লাসা অবধি চলে যেত জাহাঙ্গির বাদশার আমলে। লাসায় সব বিক্রি না হলে ঘুসুড়ির তাঁতিরা সেখান থেকে সিঙকিয়াঙ-কাশগড় অবধি ধাওয়া করত। এই নদী দিয়েই আওরঙ্গজেবের নৌকোরা পাটনা চলে গেছে একদিন—আমাদের এই তীর ঘেঁষেই পর্তুগিজ হার্মাদরা চলে যেত হুগলির গায়ে গায়ে-হাটবারে— গরু-ছাগলের মতাে মানুষজন তুলে এনে গােলামবাদী করে বেচে দিত। ওইসব ঢেউয়ের ওপর দিয়েই এলাহাবাদের ব্রিটিশ রেসিডেন্সির জন্যে কলকাতা থেকে বজরায় করে গােলাবারুদ যেত তখন—যখন রেললাইন বসেনি—সিপাহি বিদ্রোহ হয়নি। একটা ভুল হল। ওইসব ঢেউ নয়। তখন তাে অন্য ঢেউ ছিল।

একটা দুটো করে গঙ্গার ইলিশ কিনতে কিনতে আমি আর স্বয়ম্বর বন্ধু হয়ে গেলাম। শেষদিকে ও বাকিতেও দিত। এক কেজি সাড়ে তিনশাে হলে স্বয়ম্বর পঞ্চাশ গ্রামের দাম ছেড়েও দিত। একদিন স্বয়ম্বর বলল, ইলিশ চিনতেন আমার ঠাকুর্দা। কিন্তু—

আমি তাকিয়ে পড়ায় বলল, ঠাকুর্দা জানত-ইলিশের ঝক কখন আসবে। হাওয়া দেখে—ঢেউ দেখে বলে দিত। এই গঙ্গায় মােহানা অবধি–গঙ্গাসাগর ফেলে ভেতর-দরিয়ায় পাঁচ-সাত মাইল অবধি সেঁধিয়ে গিয়ে ঠাকুর্দা ইলিশের গন্ধ পেত। গঙ্গা ছিল তার বৈঠকখানা। গঙ্গার দু-পাড়–গঙ্গার গায়ে বুলগানিন জেটি, পির সারেংয়ের দরগা, রেক টিসিমারু, আছিপুর, কুইনাইন রেক, রাঙ্গাফুলার চর, ওয়াল্লিশ ঘাট—সব ঠাকুর্দার যেন খেলার মাঠ। তক্তাঘাট, ভূতঘাট, কালাদুনিয়া মিল, কুকরাহাটি—এসব জায়গায় তাে দাদু যৌবন বয়সে এক-একসময় থেকেছে।

ওসব জায়গায় থাকতেন?

হা। আমার এক-এক ঠাকুরমায়ের সঙ্গে এক-এক জায়গায় সংসার করেছেন।

রেক টিসিমারু, ওয়াল্লিশ ঘাট, কালাদুনিয়া মিল—এসব নাম শুনি আর মনে হয়—ওসব নাম যেন দূর-দরিয়া-পেনাং, সিঙ্গাপুর কিংবা জাকার্তার দিককার। অথচ ওরা আমাদের এই বাস-ট্রামের কলকাতার গায়েই–গঙ্গায়। বাড়িঘরদোর দিয়ে ঢাকা বলে দেখতে পাই না।

দাদু কতদিন হল মারা গেছেন? কে? যুধিষ্ঠির ইলিশ? তিনি তাে মারা যাননি। অবাক হলাম। জানতে চাইলাম, যুধিষ্ঠির ইলিশ ?

হ্যা। যুধিষ্ঠির ইলিশই আমার দাদু। আসলে তিনি যুধিষ্ঠির কাওরা। সবাই যুধিষ্ঠির ইলিশ বলে। একবার—একটু থেমে স্বয়ম্বর আমার মুখ দেখে বলল, হয়তাে প্রত্যয় যাবে না—সারা জীবন মাছ ধরে ধরে স্বয়ম্বর যে কোত্থেকে এত ভালাে ভালাে বাছাই বাংলা শব্দ পায় জানি না। বললাম, কেন বিশ্বাস করব না। বল যা বলবে—

দাদু একবার গঙ্গাসাগর ফেলে ভেতর দরিয়ায় এগিয়ে যান নৌকো নিয়ে। ওর সঙ্গী থাকত আমার বাবা, জ্যাঠা, কাকারা। জাল ফেলতে ফেলতে এগিয়ে গিয়ে দাদু একসময়-—এক ভাদ্র মাসের দুপুরবেলায়—অত বড়াে দরিয়ার ভেতর একা নৌকোয় দাঁড়িয়ে পড়ে চেঁচাতে লাগলেন—ইলিশ! ইলিশ !! ওরে ইলিশ !!

কী ব্যাপার ?

দাদু পাগল হয়ে গিয়েছিল। হা কিছুক্ষণের জন্যে পাগল। কয়েক বছরের ইলিশ যেন একটা ঝাঁকে ঝাঁক বেঁধে সেদিন দুপুরে দাদুর জালে দেখা দেয়। তাইতাে বলেছিলেন বড়াে জ্যাঠা। সেদিন ওরা জাল টানেনি। টানলে সবাইকে তলিয়ে যেতে হত ঝকের সঙ্গে। এত ইলিশ এসেছিল। কিন্তু—

কিন্তু কী?

আমার দিকে না তাকিয়েই স্বয়ম্বর বলল, সেই থেকে দাদুর মাথাটা গণ্ডগােল হয়ে যায়।

পাগল?

ঠিক পাগল নয়। এমনিতে কোনও পাগলামি নেই। হঠাৎ হঠাৎ এক-একসময় ইলিশের কথা বলতে থাকেন দাদু। একটানা। অনেকক্ষণ ধরে। আর চোখটাও চোখ?

হা। ডাক্তার দেখানাে হয়। তিনি বলেছেন, অত ইলিশ একসঙ্গে। খােলা আকাশের আলাে পড়ে একসঙ্গে অত ইলিশ ঝিকমিক করে উঠেছিল। সেই আলােয়—

চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল? তাই হবে। তবে এমনিতে দেখতে পান। মাঝে মাঝে সব গুলিয়ে যায়। তাহলে আমায় তােমার দাদুর কাছে নিয়ে চল।

সেই যাওয়া আমার। তখনও জানি না—ছােট্ট একখানা ঘরে অমন একা বসে থাকা–জীবনের প্রায় সব ভুলে যাওয়া—মাঝে মাঝে ইলিশ! ইলিশ !! বলে চেঁচিয়ে ওঠা—জলদস্যু দর্শন-প্রায় পর্তুগিজ হার্মাদ-কান্তি এই যুধিষ্ঠির ইলিশের সঙ্গে জীবনের উত্তর-পঞ্চাশে আমার সেরা বেরিয়ে পড়া ঝুলছিল।

ছােট্ট ঘরখানায় মানুষটি বসে। ছােট্ট খাটে। শাহজাহান বাদশার ব্যান্ডেল ঘাঁটি ভেঙে দেবার পর কোনও পালিয়ে বেড়ানাে পর্তুগিজ সর্দার যেন। ঈষৎ লালচে গায়ের রং। ছােটো করে ছাঁটা সাদা চুল। যেকোনও বলশালী মানুষের মতােই ভেঁতা নাক—ভারী চোয়াল। তাতে ভুলভুলে সাদা দাড়ি। চোখ অস্থির। কিন্তু মগ্ন। ভাবের পাগলের মতাে। এমন মানুষই বিশাল ভেতর দরিয়ায় ইলিশের ঝাঁকের মুখােমুখি দাঁড়িয়ে উঠে ইলিশ! ইলিশ !! বলে চেঁচিয়ে পাগল হয়ে যেতে পারে খানিকক্ষণের জন্যে। অত ইলিশকে চলে যেতে দিতে হবে বুঝতে পেরেই কি বিষাদে যুধিষ্ঠির ইলিশ অমন হয়ে যান? তাঁর মুখােমুখি তাঁরই ঘরে বসে আমি যখন এসব ভাবছি—তখন আমাদের সে জায়গা থেকে তিন ফারলং দূরে বি টি রােডের ওপর দিয়ে ভীমনির্ঘোষে লরির পর লরি যাচ্ছিল নিশ্চয়। এই বি টি রােড দিয়েই তাে একসময় ব্রিটিশ বড়ােলাট সপরিবারে হাতির পিঠে ব্যারাকপুরের লাটভবনে যেতেন। সবই যাওয়া আসা।

একদিন বানের পর প্রামাণিক ঘাটে জলটুঙির সামনে ধ্বস্ত গঙ্গার বুকে স্বয়ম্বরের মাছমারার নৌকোটি একা ভাসছে। দুপুরের ঠিক মাঝামাঝি। আমি অশ্বথের ছায়ায়। হঠাৎ দেখি সে নৌকোয় যুধিষ্ঠির ইলিশ এসে বসল। এসেই ঘাটে বাঁধা কাছি খুলে ফেলল। করেন কী ? করেন কী?—বলতে বলতে আমি নৌকোয় উঠে তাকে আটকাতে গেলাম। পারব কোত্থেকে? গঙ্গা যে তার বৈঠকখানা !! স্রোত চেনেন। বৈঠাখানা এক বিশেষ কায়দায় ধরলেন। আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন, চুপ করে বসুন।

যুধিষ্ঠির ইলিশের চোখে বা গলার স্বরে কোনও পাগলামি নেই। নৌকো চলেছে বন্ধু স্রোতে। একসময় জগন্নাথ ঘাট পেরিয়ে হাওড়া ব্রিজের তলা দিয়ে বাবুঘাটের দিকে চলে এলাম। চলেছি পাগলের সঙ্গে। তবে বানের পর যেমন শান্ত থাকে গঙ্গা–তেমনি শান্ত। জানা কলকাতা এবার চঁছাছােলা হয়ে ভেসে উঠছে চোখের সামনে। যেন কলকাতায় বেড়াতে এসেছি। নিউ সেক্রেটারিয়েট বাড়িটা পাড়ার মােড়ে মুদিখানায় সওদা করতে আসা সিড়িঙ্গে মেয়েটার মতাে দাঁড়িয়ে। রেল আর জাহাজ কোম্পানির চেনা বাড়ি দুটোকে সেই তুলনায় বেঁটে ছােকরা মতাে দেখতে। বাবুঘাটের বাস-মিনিবাস বুঝিবা খেলনা নিয়ে আঁকা কোনও ক্যালেন্ডারের ছবি। এভাবে তাে কখনও কলকাতাকে দেখিনি।

তাকিয়ে দেখি—-যুধিষ্ঠির ইলিশ গাদাবােটে দাঁড়ানাে এক বুড়াে লস্করকে দেখে হাত নাড়ছে। আমাকে বলল, চেনা মানুষ। কতকাল পরে দেখছি। এ তাে স্বাভাবিক মানুষের গলা। গঙ্গাই বােধহয় যুধিষ্ঠিরের ওষুধ। আলটপকা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে প্রামাণিক ঘাটে চলে এসেছে। কেউ জানে না হয়তাে। হয়তাে প্রামাণিক ঘাট থেকেই একসময় মাছ ধরতে বেরােত। আগাম ডাকবাংলাে ভাড়া করে–ডবলু ওয়াই লাক্সারি গাড়ি রেডি করে কিংবা ট্রেনে জানলার গায়ের সিট রিজার্ভ করে বেরিয়ে পড়া একরকম। আর কিছুই ঠিক করে জলপথে চেনা কলকাতাকে দেখতে দেখতে আনতাবাড়ি ভেসে পড়া আরেকরকম। বিশেষ করে একজন পাগলের সঙ্গে। যে কিনা গঙ্গাকে জানত। ইলিশকে চিনত। কিন্তু সব ভুলে গেছে। আর তারই হাতে নৌকো। আমি চালাতে জানি না। সাঁতার জানি। কিন্তু নৌকো ওল্টালে সাঁতরে তীরে উঠতে পারব বলে ভরসা রাখি না। কারণ, অনেকদিন তাে সাঁতরাইনি। সাইকেল চালাইনি। গাছে উঠিনি। একটা বিশাল জাহাজ দেখিয়ে বলল, নুনের জাহাজ।

প্রায়ই আসে।

একদম স্বাভাবিক গলা। নদীপথে সঙ্গী এমন পাগলই যেন আমার সই। স্বাভাবিক মানুষদের নিয়ে হাওড়া থেকে লঞ্চ বাগবাজার ঘাটে যাচ্ছে। গােয়ালিয়র মনুমেন্ট পড়ল বাঁ-হাতে।

জাহাজের পর জাহাজ। যুধিষ্ঠির ইলিশ গঙ্গার ধারাবিবরণী দিচ্ছিল একা একাই। অনেকটা এরকম

খিদিরপুর ডক। এখানে একটা সময় আমরা লুকিয়ে-চুরিয়ে ভেড়ানাে সব জাহাজের দরকারি লােহা-লক্কড় গঙ্গায় ফেলে দিতাম।

বড়াে তৃপ্তি-মাখানাে হাসি যুধিষ্ঠিরের মুখে। বললাম, কখন ?

সে অনেক বছর আগে। তখন বয়স কম ছিল। মনে হল, যুধিষ্ঠির এইমাত্র তার স্মৃতি ফিরে পেয়েছে।

আমরা দরকারি জিনিস গঙ্গায় ফেলে দিতাম। বয়া দেখে ফেলার জায়গার নিরিখ রাখতাম। ভিনদেশি সব জাহাজ। ওরা মাথার চুল ছিড়ত। জাহাজ সারাই বন্ধ হয়ে যেত। তখন এগিয়ে গিয়ে বলতাম—দেখি খুঁজে। কী দেবে? দর কষাকষির পর মােটা টাকা নিয়ে ডুব দিতাম।

খুঁজে পাওয়া যেত? যাবে না কেন? গঙ্গার পেট তাে দশ-বারাে বছর বয়স থেকেই চিনি।

এমন গঙ্গালজিস্ট-—অথচ সব ভুলে যান মাঝে মাঝে। ধারাবিবরণী বন্ধ হয়নি। যুধিষ্ঠির ইলিশ বললেন, ওই যে কলেজ চরা।

সত্যিই তাে! এভাবে তাে কোনওদিন শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে দেখিনি। গাছগাছালির ভেতর জলের ট্যাঙ্ক। আদালত-বাড়ির মতাে লালচে দেওয়াল। জল থেকে দেখতে একদম অন্যরকম। কাছাকাছি বটানিকসের কঁকড়া কোনও গাছের মাথা।

ফের বাঁদিক দেখিয়ে বললেন, ওখান থেকে তুফান সিগনাল দেখায়। ঝড়ের আগে।

একটা উঁচু লােহার টঙ। সেখানে উঁচুতে চোপসানাে একটি বেলুন ঝুলছে। সামনেই নেতাজি ডক। ওর উল্টোদিকে বুলগানিন জেটি। এই জেটির গায়ে একবার সংসার পাতি।

তার মানে কোনও বউ নিয়ে ঘর করেছিলেন যুধিষ্ঠির। বড়াে বড়াে জাহাজ দাঁড়িয়ে। লঞ্চের আনাগােনা। লঞ্চের লেজে ভাঙা ঢেউয়ের ভেতর মাছের আশায় ভাসন্ত বক। বাঁ-হাতে খিদিরপুর ফুরিয়ে যাচ্ছে। গঙ্গাও সরু হয়ে আসছে।

এই তাে সাঁকরাইলের চরা। সামনে আক্রা-শ্যামপুর। এখানে একসময় খুব ইলিশ পড়ত। স্বয়ম্বর তখনও হয়নি।

একদম টনটনে স্মৃতি। যাক, কোনও ভয় নেই। সাঁকরাইলের চরার ওপারে ডাঙায় বর্ষার পরেকার বাগানবাড়ি। চাষের জায়গা। সাইকেল সারাইয়ের দোকান দেখা যায়। গাছপালা ঘন সবুজ। একদল স্কুলের ছেলে ছুটতে ছুটতে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়াল। আঃ! যদি ছবি আঁকতে জানতাম।

গঙ্গা এখানটায় অনেকটা সরু। ওই যে কালাদুনিয়া মিল। আমরা ইলিশ দিলে ওদের মিলের খালাসি চটের বস্তা দিত। এক ইলিশে চার বস্তা।

ভাবি, যুধিষ্ঠির ইলিশ কি আজ আমাকে সব দেখাবে বলে বেড়াতে নিয়ে বেরিয়েছে ?

রােদ পড়ে আসার আভাস। এক জায়গায় নৌকো ভিড়িয়ে দিয়ে যুধিষ্ঠির একটা গাছের শেকড়ে কাছি বাঁধল। কাছেই কোনও পাটকলে ভেঁ দিচ্ছে। বােধহয় দিনের পয়লা শিক্ট শেষ হল। কোথায় ?

এখানে পির সারেংয়ের দরগায় যাব। এর পরেই তাে বজবজের তেল-জেটি। যখন বলছেন যুধিষ্ঠির তখন বজবজের তেল-জেটি নির্ঘাত এই পির সারেংয়ের দরগার পরেই।

বােঝাই যায়–গঙ্গার গা থেকে ডাঙার ভেতর দিকে গেলে ঘনবসতি আছে। ছালতােলা একটি বাজারে রাস্তা। তার গায়ে সােডাকল। ভাতের হােটেল। ইলেকট্রিক খুঁটি এসেছে। কারেন্ট আসেনি।

একটা সবুজ মাঠের ভেতর সাদা একতলা। তার ছাদে সিমেন্টের উড়ন্ত কিন্তু ডানাভাঙা পরী। নিশ্চয় এটাই দরগাহ। লুঙ্গির ওপর ফতুয়া গায়ে যুধিষ্ঠির ইলিশ সাদা মাথা—ভুলভুলে সাদা চিবুকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সঙ্গে আমি বুঝি ফড়ের মতাে।

পড়ন্ত দুপুর বলে দোকানপাট সবই বন্ধ। একটু বাদেই খুলবে। যুধিষ্ঠির ইলিশ যেন খুব চেনা জায়গায় এগিয়ে যাচ্ছেন। লম্বা লম্বা পা ফেলে।

হঠাৎ দরগাহর ভেতর থেকে বিশাল লম্বা একটা লােক বেরিয়ে এল। হাসতে হাসতে। মাথায় বােধহয় রাঙতার টুপি। হাতে রুপােলি ছড়ি। লালচে মুখে সাদা খটখটে দাড়ি। গলায় ডুমাে-ডুমাে কালাে মটরমালা। গায়ের আলখাল্লাটি ঘাসে লুটোচ্ছে। তাই পা দেখা যায় না। বড়াে হুজুর! কতদিন পরে

বড়াে হুজুর এগিয়ে এলেন। দু-হাত বাড়িয়ে যুধিষ্ঠিরের হাত দু-খানি ধরলেন। কতকাল পরে—কতদিন আসাে না।

দেখলাম, বড়াে হুজুরের চোখে মােটা করে সুরমা। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। শুনলাম, যুধিষ্ঠির ইলিশ বলছেন, এদিকটায় তাে আর ইলিশ পড়ে না। তাই আসা হয় না। করেকন্মে আর সময়ও থাকে না যে আসব।

তােমার হাতের ইলিশ কতকাল খাই না।

এবার এদিকে এলে যদি ধরা পড়ে তাে দিয়ে যাব। এই একটাকার বাতাসা চড়াব।—বলতে বলতে ফতুয়ার পকেট থেকে বড়াে একটা কাঁচা টাকা বের করলেন যুধিষ্ঠির তাতে জর্জ দ্য সিক্সথের মুখ।

বড়াে হুজুর আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, ইনি—?

যুধিষ্ঠির ইলিশ সেই ভাবের পাগল চোখ তুলে আমায় দেখলেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, চিনি না তাে। কথাটা মিথ্যে বলেননি। এর আগে একবার মাত্র দেখেছেন। আমাকে মনে রাখার কথাও নয়। বুঝলাম, আমার জীবনের সেরা বেরিয়ে পড়ার গাইড গঙ্গায় পড়লে তার চেনাজানা ঘাটে এলে স্বাভাবিক হয়ে ওঠেন।

পৃথিবীতে আরেকটা দিন ফুরােবার মুখে। নানান সভ্যতায় এখন পড়ন্ত বেলায় রােদ ফেলে ফেলে সূর্য একদম নিস্পৃহ। পির সারেংয়ের দরগার সামনে দাঁড়িয়ে সূর্যের সে মুখে তাকানাে যায় না। সে এক বলকা দিয়ে ফুটে ওঠা প্রাচীন আলাে। অথচ দেখতে কিন্তু নিত্য নতুন।

সেই আলােয় গঙ্গার বুকে প্রতিটি ভাঙা ঢেউ এক একটি মিনি-আয়না। সে আয়নাগুলাের দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়ানাে আরেক নিস্পৃহ মানুষ যুধিষ্ঠির ইলিশ। যে কিনা যৌবন বয়সে এক-এক ঘাটে সংসার পেতে ফেলেছিলেন। নদীর পাড়ে নারী নিয়ে।

সেইসব ঘরনি এখন কোথায় ?

স্বয়ম্বর তা আমায় বলেনি। তার ঠাকুর্দা ইলিশের ঝাক দেখে সব সংসার—সব গেরস্থালি ভুলে গেলেন? বুঝি না। জানি না। নদী জনপদ খায়। জনপদ তার পেটে তলিয়ে যায়। আবার কোনাে জনপদকে দেখে দিব্যি ভুলে গিয়ে দূরে সরে যায়। যুধিষ্ঠির ইলিশ কি সেইভাবে তার ঘরনিদের খেয়ে ফেলেছেন? না, তাদের ছেড়ে দিয়ে দুরে সরে এসেছেন?

আমি স্বয়ম্বরের ঠাকুর্দার মুখে তাকালাম। তার চোখে আমার কোনও ছায়া পড়ল না। খানিক আগেই তাে গঙ্গায় তিনি আমার গাইড ছিলেন। আর এখন?

আমাকে চিনছেনই না। সম্পূর্ণ অপরিচিত আমার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ফের বড়াে হুজুরের দিকে তাকালেন যুধিষ্ঠির। যেনবা বিরক্ত হয়েছেন আমার ওপর। যেন আমি একজন সম্পূর্ণ অজানা লােক। নাছােড় ল্যাংবােট হয়ে ওঁর সঙ্গ নিয়েছি। উনি আমায় ছাড়াতে পারলে বাঁচেন।

বড়াে হুজুর এবার ফের আমার দিকে তাকালেন। সে চোখে বিরক্তি নেই। আবার কোনওরকমের আত্মীয়তাও নেই। আমার একবার মনে হল—এই বড়াে হুজুর কি আজকের! এই প্রাচীন দরগায় উনি শ-শ বছর ধরে পির সারেংয়ের মাজারে চামর দোলাচ্ছেন। গাঁদাফুল চড়াচ্ছেন। বাতাসা চড়াচ্ছেন। কত মানুষ কত মাসিক নিয়ে আসে দরগায়। সবার সব প্রার্থনা—সব মােনাজাত শুনে রাখেন বড়াে হুজুর। সারাদিন ধরে। তারপর গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে—শুধু গঙ্গা যখন জেগে থাকে-তখন তিনি দরগার ভিতর মাজারের ওপর থেকে ফুল-কাপড় সব সরিয়ে দেন। ফিরে মাজারের খুব কাছে গিয়ে বলে—

 পির সারেং। যুধিষ্ঠির ইলিশ এসেছিল তােমার দরগায়। বাতাসা চড়িয়ে দিয়ে গেল এক টাকার। ওর মােনাজাত হাসিল হয়নি এ-জীবনে। দরিয়াজুড়ে ইলিশ ঝুঁকবেঁধে এসেছিল। আটকাতে পারেনি। পাছে জালে আটকে অত বড়াে ঝকের ইলিশ ওদের নৌকো উল্টে দেয়। তাই—।

পির সারেং। যুধিষ্ঠিরের খায়েশ পূর্ণ করে দাও। দুনিয়ায় আবার ইলিশ আসবে একদিন। যুধিষ্ঠিরও আবার এ দুনিয়ায় ফিরে আসবে তখন। সেদিন যেন যুধিষ্ঠির সেই ঝকের সব ইলিশকে আটকাতে পারে।

পির সারেং। যুধিষ্ঠির গঙ্গার ঘাটে ঘাটে সংসার পেতেছিল। এক-একজনার সঙ্গে। ঘর-গেরস্থালিতে যুধিষ্ঠিরের বড়াে সাধ। সে সাধ ওর মেটেনি। এক-এক ঘাটে এক-এক বেগম। কোনও বেগম নিপাত্তা। কোনও বেগম যুধিষ্ঠিরকে ফেলে অন্য জায়গায় গিয়ে সংসার পেতেছে। এবার ওর ঘর-গেরস্থালির সাধ মিটিয়ে দাও।

 আমি বড়াে হুজুরের মুখে তাকিয়ে বুঝি আমাদের সাধ—ইচ্ছেগুলাে ইলিশ হয়ে ঝাকবেঁধে আসে। সেসব ইচ্ছায় রােদ পড়ে ঝিকমিক করে ওঠে। আমাদের। চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তবু আমরা ইলিশ! ইলিশ !!—-বলে চেঁচিয়ে উঠি। কোনওটাও ধরতে পারব না জানি। ধরতে গেলে ভেসে যাব। ইচ্ছেগুলাে এতই জোরালাে। এত ধাঁধালাে। তাই বিষাদের প্রজা হয়ে যাই পাকাপাকি।

যুধিষ্ঠির আমাকে দেখেছেন তাে পাগল দশায়। চিনবেন কী করে? হয়তাে এই পির সারেংয়ের দরগার কাছাকাছি কোনও দিন সংসার পেতেছিলেন।

বড়াে হুজুরকে পকেট থেকে একখানা দু-টাকার নােট এগিয়ে দিয়ে বললাম, আমি আলাদা এসেছি। বাতাসা চড়াব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *