নদিয়া মাঝারে অগ্রদ্বীপ একনাম – বারিদবরণ ঘোষ
হঠাৎ করে একখানি সদ্যপ্রকাশিত বই হাতে এল। বইটা পেয়েই পড়তে শুরু করেছিলাম ব্যক্তিগত কারণে। আমার মধ্যমাগ্রজার বিয়ে হয়েছিল কাটোয়ার সোনার গৌরাঙ্গ পাড়ায়। দিদির কাছে যাবার সূত্রে কাটোয়ার কাছাকাছি গ্রামগুলো ঘুরে দেখার ইচ্ছে হত। কর্মসূত্রে দিদিরা শ্রীবাটী গ্রামে গেলে সেখানের শিবমন্দিরগুলি আমার আকর্ষণের বিষয় হয়ে ওঠে। আবার করে দাঁইহাট থেকে পূর্বস্থলী—বিস্তীর্ণ অঞ্চলগুলো ঘুরে দেখতাম। ছোট্ট থেকেই ডায়েরি লেখার অভ্যাস। সেই সুবাদে দেখা জায়গাগুলো নিয়ে আমার মনের ছাপ ওই লেখাগুলোতে রয়ে গেল। তার ওপরে আমার জন্মভূমি বৈষ্ণবপ্রধান জায়গা। দাঁইহাটের কাছে আখড়াগ্রামে আমার বাল্যবন্ধুর বিয়ে হল। আবার করে পরিক্রমার সুযোগ হল। গ্রামের নাম আখড়া থেকেই বোঝা যায় বৈষ্ণব প্রভাবের কথা।
একটু বড়ো হয়ে বৈষ্ণব পদাবলি পড়ার অবকাশ হল। সেই সূত্রে চৈতন্য-সমসাময়িক গোবিন্দ-বাসুদেব-মাধব ঘোষের কথা জানা হল। একবার অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ মন্দির দেখে এলাম। মনের মধ্যে আরও জানবার আগ্রহ ছিল। তাই মহেশ্বরপ্রসাদ লাহিড়ির অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ বইটি পেয়েই পড়তে লেগেছিলাম। গোপীনাথ নিয়ে এতখানি আগ্রহ ছিল না—কিন্তু গোপীনাথকে ঘিরে যে ইতিহাস গড়ে উঠেছিল—তা আসলে অগ্রদ্বীপেরই ইতিবৃত্ত—এটা জানতে কৌতূহল হল। এটা-সেটা প্রাসঙ্গিক বইপত্র পড়তে লাগলাম। একসময় বর্ধমানের ইতিহাস লেখার একটা বাসনা জেগেছিল। সেটা অনেকখানিই মিটে গেছিল বন্ধুবর যজ্ঞেশ্বর চৌধুরির বর্ধমানের ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে তিন খন্ডে লেখা বইটি পড়ে। ব্যক্তিগত আগ্রহ ছিল বর্ধমানের বাসিন্দা হিসেবে। এর ইতিহাসের নানা সমিধ সংগ্রহও করেছিলাম।
এই যে ‘আমি’ করেছিলাম-ভেবেছিলাম-পড়েছিলাম—ইত্যাদি লিখছি তাতে কোনো ইতিহাস নেই। কিন্তু এর মূল ইতিহাসটুকু পড়ার বাসনা পুনশ্চ জেগে ওঠাতেই মনে হল এই অঞ্চলের বিস্মৃতপ্রায় ইতিহাস জানা দরকার। যে-চৈতন্যের আবির্ভাব একটা যুগের সূচনা করেছিল—তাঁরই স্নেহপুষ্ট এক বৈষ্ণব কবি গোবিন্দ ঘোষ জড়িয়ে আছেন অগ্রদ্বীপের ইতিহাসের সঙ্গে। আগ্রহাতিশয্য যে ঘটেছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
অগ্রদ্বীপ বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার সদর থানায় গঙ্গার চড়ায় গড়ে ওঠা একটা গ্রাম যেটি যেখানে গড়ে উঠেছিল, সেটি আর সেখানে নেই। ছিল গঙ্গা-ভাগীরথীর যে পাশে এখন সেখান থেকে উলটোদিকে পুনর্গঠিত হয়েছে। যে মন্দিরের জন্যে এখানের রমরমা—সেই মন্দিরটিও গ্রামটির মতোই বিলুপ্ত। গ্রাম নতুন করে গড়ে উঠেছে, মন্দিরও নতুন—কিন্তু নতুন-পুরোনো মিশিয়ে একটা প্রায় ছ-শো বছরের ইতিহাস ও সংস্কৃতি আজও প্রবহমান। আজও এখানের দু-টি মেলাকে উপলক্ষ্য করে অজস্র মানুষের আনাগোনা। প্রাচীন সংস্কৃতির মতোই গঙ্গার চড়ার প্রাচীনতার সঙ্গে এর যে ইতিহাস গড়ে উঠেছে তা আঞ্চলিক ইতিহাস কিন্তু বঙ্গের বৃহত্তর ইতিহাসের অগ্রগণ্য অংশ হিসেবে এখনও সমাদৃত। বছর ষাটেক আগে অগ্রদ্বীপের জনসংখ্যা ছিল তিন হাজারের কিছু বেশি। চৈতন্য পার্ষদ গোবিন্দ ঘোষ নাকি চৈতন্য নির্দেশেই এখানের গোপীনাথ মূর্তির প্রতিষ্ঠা করেন। তিনিই এর সেবাইত এবং পূজারিও। ব্রাহ্মণ সন্তানের বৃত্তি তিনি গ্রহণ করেছিলেন বলে তিনিও যেন ব্রাহ্মণ হয়ে গেলেন। তাঁর বংশ গোবিন্দ ঘোষের বংশ নয়। ‘ঘোষ ঠাকুরে’র বংশ নামে পরিচিত হয়ে উঠল। ব্যাণ্ডেল-বারহারোয়া লুপ রেলপথে পাটুলি স্টেশন থেকে কাটোয়ামুখী ৫ কিলোমিটার রেলপথ অতিক্রম করলেই উত্তরে ভাগীরথীর পূর্ব পাড়ে অগ্রদ্বীপের অবস্থান। মেলা-উৎসবের ইতিহাস কতটা পুরোনো জানি না—তবে বারুণী উপলক্ষ্যে এখানে পক্ষকালব্যাপী মেলার পত্তন এবং চৈত্র মাসে ‘সাহেবধনী’ উপাসক সম্প্রদায়ের উৎসবও অনুষ্ঠিত হয়। একসময় ধারণা ছিল ‘সাহেবধনী’ সম্প্রদায় মুসলমান সমাজের অন্তর্ভুক্ত। বিজয়রাম সেনের তীর্থমঙ্গল কাব্যে (ভূকৈলাসরাজ জয়নারায়ণ ঘোষালের তীর্থসঙ্গী জনৈক কবিভাবাপন্ন চিকিৎসক) পড়েছিলাম ভাগলপুরেই ছিল ‘সাহোধনী পিরের মোকাম’। তা থেকেই এমনতর ধারণা গড়ে উঠেছিল। অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁর সুখ্যাত ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় গ্রন্থে এঁদের কথা লেখার অনেক পরে এঁদের নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থরচনা করেছেন কৃতবিদ্য অধ্যাপক শ্রীসুধীর চক্রবর্তী মশায়। তিনি ভাগলপুরে ‘সাহোঁ ধনী’কে পির বলে অভিহিত করেননি। সম্ভবত তীর্থমঙ্গল-এর উৎস তাঁর চোখ এড়িয়ে গেছিল। তাতে অবশ্য তাঁর গ্রন্থের মহিমা এতটুকু ক্ষুণ্ণ হয়নি।
কিন্তু এটা একটা ইতিহাস হয়ে উঠেছে যে অগ্রদ্বীপ নামে একটি গ্রাম মানেই এখানে প্রতিষ্ঠিত ‘গোপীনাথ’ অথবা গোপীনাথ এবং অগ্রদ্বীপ সমার্থক—সমমর্যাদাসম্পন্ন ও পরস্পর নির্ভর। বস্তুত কাটোয়ার আশপাশে বর্ধমান জেলার এই অংশ মানেই বৃহত্তর বৈষ্ণবীয় ক্ষেত্র। অগ্রদ্বীপ তার বিশিষ্ট অংশ। বাঙালি গল্পপ্রিয়। ঈশ্বরীয় মহিমাকে প্রবাদের পর্যায়ে না-তোলা পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই। এর ফলে আঞ্চলিক ইতিহাসের নির্ভরযোগ্যতা কমে গেছে। কিন্তু উলটো ব্যাপারটিও সত্য যে এই জনপ্রবাদই স্থানের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়ে এর ঐতিহাসিক গুরুত্বকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
আমরা ইঙ্গিত দিয়েই এসেছি অগ্রদ্বীপ তার আদি অবস্থান থেকে সরে গেছে। কতখানি সরে গেছে। এখন যেখানে অগ্রদ্বীপ তার প্রায় দেড় কিলোমিটার উত্তরে এর অবস্থান ছিল। গ্রামের ইতিহাস চলিষ্ণু হতে পারে, কিন্তু গ্রাম নিজেই তো চলমান হতে পারে না। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই প্রধানত এই সৃয়মানতার জন্যে দায়ী। দু-দুবার ভাগীরথীর প্রবল বন্যা অগ্রদ্বীপের মানচিত্রকে বদলে দিয়েছে। আর মানুষের আত্মগৌরব খ্যাপনের জন্য মানুষ দেববিগ্রহকে স্থানান্তরিত করেছে।
অগ্রদ্বীপ, গোপীনাথ, গোবিন্দ ঘোষ—ঘনসংলগ্ন এই তিনের অবস্থানের জন্য এখনই যে এর চর্চা শুরু হয়েছে তা মনে করার কারণ নেই। ভন, ডেন. ব্রুফ এবং বেনেল তাঁদের আঁকা মানচিত্রে কবে আমাদের দেশের ভৌগোলিক পরিচয় দিয়েছেন। অগ্রদ্বীপকে দেখেছিলেন হেনরি মার্টিন সওয়া দু-শো বছর আগে প্রায় ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে। রেভারেণ্ড জেমস লঙ লিখেছেন The Banks of the Bhagirathi। ক্যালকাটা রিভিউ প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর ও অন্যদের কত প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে। The Hindoos-এ অগ্রদ্বীপের কথা লিখেছেন ওয়ার্ড সাহেব। দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায় লিখেছেন ক্ষিতীশবংশাবলিচরিত। জনৈক সীতারাম এঁকেছেন গোপীনাথ মন্দিরের ছবি। সংবাদ ভাস্কর পত্রিকায় কত প্রসঙ্গে কতবার লিখেছেন সম্পাদক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য। তালিকা দীর্ঘায়িত করা যেতে পারে। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে যে আঞ্চলিক ইতিহাস সুলিখিত না হলে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস কখনোই লেখা যায় না। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে, ঠিক এক-শো বছর আগে সার্ভে মানচিত্রে ইতিহাসের উৎস বিধৃত আছে।
এই যে মানচিত্রগুলির কথা বলছিলাম সেখানেই পেয়েছি আমরা ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের বিধ্বংসী বন্যার আগে অগ্রদ্বীপ অবস্থিত ভাগীরথীর বামতীরে। কিন্তু ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে লঙের বইতে দেখি অগ্রদ্বীপ নদীর দক্ষিণতীরে চলে এসেছে। নদীখাতের এই পরিবর্তন একটি গ্রামকে তার অবস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছে। অগ্রদ্বীপ নামটি নিয়েও ভাবনা করা যেতে পারে, বস্তুত গবেষক যজ্ঞেশ্বর চৌধুরি তা করেছেনও। কিন্তু যখনই দেখি অগ্রদ্বীপকে টলেমি Aganagara বলেছেন, তখনই মনে সন্দেহ জাগে ‘নগর’ ‘দ্বীপ’-এ বদলে গেছে সম্ভবত নবদ্বীপ ইত্যাদির প্রভাবে। যদি এর উচ্চারণ করি অগ-নগর—তাহলে একে অগ্র-নগর ভাবা যেতে পারে। যদি উচ্চারণ হয় আগ-নগর—তবে তা আগ=অগ্র বা অগ্নিতে ভস্মীভূত—এমন অর্থও করা যেতে পারে। কতই তো বদল হয়। এখন আমরা বলি অম্বিকা-কালনা। অম্বিকা নামের মহিমা যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু অম্বিকা ও কালনার আদতে পৃথক অবস্থান ছিল। অম্বিকা ছিল Amboca এবং কালনা Culna। একটা কথা মেনে নিতেই হবে যতই পুরোনো হোক—অগ্রদ্বীপের নাম-ডাক হয়েছিল গোপীনাথ মন্দিরের কারণে, আরও স্পষ্ট করে চৈতন্য প্রবর্তনায় গোবিন্দ ঘোষের উদ্যোগে। আমরা যদি পুরোনো সড়ক পথের সন্ধান করি তাহলে দেখতে পাব এরা সড়ক পথে কীভাবে যুক্ত ছিল। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে (১৬ জুন) রবার্ট ক্লাইভ মিরকাশিমের সঙ্গে বিবাদের সময়ে পাটুলিতে এসে শিবির করে রাত কাটান। পরের দিন সড়ক পথে কাটোয়া যান। পাটুলিকে লেখা হত ‘Pattolu’। এই সড়কের প্রসঙ্গে একটি নতুন রাস্তা তৈরি করার ব্যাপারে জনৈক কালীপ্রসাদ পোদ্দারের ভূমিকার কথা বিশেষ করে মনে পড়ে। তাঁর বাড়ি ছিল বকচরে। এবং যশোর থেকে অগ্রদ্বীপ পর্যন্ত একটি নতুন রাস্তা তৈরি করেন এই সুবর্ণবণিক সন্তান ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে। ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল সড়ক পথে যুক্ত হয়।
আমরা বলেছিলাম অগ্রদ্বীপ মানেই গোপানীথ—আরও সূক্ষ্মার্থে গোবিন্দ ঘোষ। কুলপঞ্জিকায় তার উল্লেখ আছে এমনতর—
ধন্যরে গোপাল ঘোষ সকলি বৈষ্ণব।
যে কুলে জন্মিলা বাসু, গোবিন্দ, মাধব।
তাঁরা তিন ভাই ছিলেন। তিন ভাই-ই অকৃতদার ছিলেন এবং তিনজনেই বৈষ্ণব, বৈষ্ণবপদকর্তা ও চৈতন্য অনুগৃহীত। গোবিন্দ কাটোয়া থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অজয় নদ-তীরবর্তী কুলাই গ্রামে জন্মেছিলেন। তিনিই অগ্রদ্বীপে গোপীনাথের শ্রীপাট স্থাপন করেন। আমরা বলেছি তিন ভাই অকৃতদার। কিন্তু গোবিন্দ বিবাহিত ছিলেন, তাঁর একটি মাত্র পুত্র ৫ বছর বয়সে মারা যায়। একে কিংবদন্তী বলা যাবে কি না—বলা মুশকিল। কারণ ছেলে মারা গেলে স্বয়ং গোপীনাথ নাকি তাঁকে শোক করতে নিষেধ করেছিলেন। উভয়ের সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্রের মতো—এমন কথাও প্রচারিত। এমন জনশ্রুতিও প্রচারিত গোবিন্দের মৃত্যু হলে গোপীনাথের মূর্তির নয়ন দু-টিতে অশ্রু ছলছলিয়ে উঠেছিল। আঞ্চলিক ইতিহাসগুলি বহুক্ষেত্রেই জনশ্রুতিকে গুরুত্ব দিয়ে ইতিহাসকে আবৃত করেছে।
কিন্তু গোপীনাথের গুরুত্ব নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। বহুজনই তাঁর মূর্তিকে নিজের অধিকারে রাখার জন্যে তাঁকে স্থানচ্যুত করেন এমনকী তাঁর নকল মূর্তিও নির্মিত হয়। কখনো গোবিন্দ ঘোষের জ্ঞাতিবর্গের কেউ বিগ্রহকে পূর্ববঙ্গে নিয়ে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। বাধা পেলেও তাঁরা সেই কাজটি সম্পন্ন করেন ও বিগ্রহকে কুষ্টিয়ায় নিয়ে যান। সেবাইতরা বিষয়টি পাটুলির জমিদারের গোচরে আনলে তিনি সৈন্য পাঠিয়ে বিগ্রহকে ফিরিয়ে এনে পাটুলি-নারায়ণপুরের রাজবাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন। এই রাজবংশই পরে হুগলির বাঁশবেড়িয়াতে দেবরায় রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন।
আরও একবার বিগ্রহ-লুন্ঠন-কার্য সম্পাদিত হয়। কোনো এক বারুণী উৎসবের সময় জনতার চাপে কিছু লোক পদপিষ্ট হয়ে মারা গেলে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর কাছে সংবাদ যায়। তিনি প্রতিপক্ষের জমিদারকে কারণ দর্শাবার নোটিশ দেন। শেষ পর্যন্ত এমনটি আর ঘটবে না, প্রচুর লোক সমাগমের কারণেই এমনটি ঘটেছে বলে নবাবকে জানালে তিনি তুষ্ট হন। এই সময়ে উকিলের কারসাজিতে বিগ্রহ নদিয়ার রাজার হস্তগত হয়। অগ্রদ্বীপ ছিল তাঁর জমিদারির অধীন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে গোপীনাথের প্রথম মন্দির নির্মিত হয়—সে মন্দির গঙ্গাগর্ভে মিশে গেছে কবে। গোপীনাথকে উদ্ধার করে পুনরায় অগ্রদ্বীপে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। কেবলমাত্র বারদোল উৎসবকালে বিগ্রহকে কৃষ্ণনগরের রেউরে নিয়ে যাওয়া হত—এই প্রথা এখনও চলমান।
আমরা বিজয়রামের যে তীর্থমঙ্গল কাব্যের কথা বলেছি তাতে দেখা যায় কাশী যাবার পথে অগ্রদ্বীপে জয়নারায়ণ ঘোষালের নৌকা থামলে তাঁরা গোপীনাথকে দেখতে যান। তাঁরা ফিরে আসেন ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে। ফেরার পথে তাঁরা শোনেন যে বিগ্রহকে তখন শোভাবাজার রাজবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জনশ্রুতিতে গল্পটি একটু আলাদা চরিত্র পেয়েছে। শোভাবাজারে গোপীনাথের যে বিগ্রহ দেখা যায়, সেটি নাকি নকল—চরিত্রে অনেক বেশি শিল্পিত। এই নিয়ে অনেক গল্প তৈরি হয়েছে। আসল-নকল যাচাই করা মুশকিল।
কিন্তু এই গোপীনাথকে কেন্দ্র করে যে দু-টি মেলা হয় তার উল্লেখ আমরা দু-শো বছর আগেও পেয়েছি। বারুণী মেলায় ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে অগ্রদ্বীপে প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোকের সমাগম হয়। এখানে সাহেবধনী সম্প্রদায়ের লোকেরাও আসেন। বাউলেরাও আসেন। নতুন মন্দিরের পত্তন হয় ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে। এখানে যাঁরা বাস করেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই সূত্রধর। আসলে এই অঞ্চলেই সূত্রধরদের প্রধান বাস। অনেক পরে অপূর্ব গোপীনাথের বিগ্রহের পাশে রাধিকার বিগ্রহও প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলার তীর্থস্থানগুলির মধ্যে অগ্রদ্বীপের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তবে সাধারণ মানুষ গোপীনাথজিকে ‘ঘোষঠাকুর’ নামেই অভিহিত করে। দিগ্বিজয় প্রকাশ গ্রন্থে অগ্রদ্বীপ দর্শন কাশী দর্শনের তুল্য বলা হয়েছে। ছড়ায় যতই বলা হোক—
অগ্রদ্বীপের কোলে
নেড়ানেড়ি দোলে—এর মর্যাদা এখনও বহমান।