নতুন বাংলার প্রথম কবি
তোমরা কবি ঈশ্বর গুপ্তের কবিতা পড়েছ? পুরোনো বাংলার শেষ কবি ভারতচন্দ্র আর রামপ্রসাদ। নূতন বাংলার প্রথম কবি ঈশ্বর গুপ্ত। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন কিছু কম দেড়শো বছর আগে (১২১৮ সালে)।
যে যুগে পলাশির যুদ্ধ হয়, ভারতচন্দ্র ও রামপ্রসাদ ছিলেন সেই যুগের কবি। এ-দেশে ইংরেজ তখন সবে শিকড় গেড়ে কায়েমি হয়ে বসবার চেষ্টা করছে, কিন্তু ব্রিটিশ রাজ্যের বনিয়াদ তখনও শক্ত হয়নি এবং ইংরেজিয়ানা বলতে কী বুঝায়, বাঙালি তাও জানত না। তাই ভারতচন্দ্র ও রামপ্রসাদের সমস্ত কবিতা তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও এতটুকু ফিরিঙ্গি গন্ধ আবিষ্কার করা যাবে না। এই জন্যেই বলতে হয় খাঁটি বাংলার শেষ কবি ভারতচন্দ্র আর রামপ্রসাদ।
কিন্তু ঈশ্বর গুপ্তের যুগে এ দেশে বইতে শুরু করেছে দস্তুরমতো বিলাতি হাওয়া। বাঙালি ইংরেজি বলতে, কোট-পেন্টুলুন পরতে, খানার টেবিলে বসে ছুরি-কাঁটা ধরতে, রামপাখি খেতে এবং সভায় গিয়ে রাজনীতি নিয়ে বক্তৃতা করতে শিখেছে। ঈশ্বর গুপ্তের বহু ব্যঙ্গ-কবিতার ভিতরে সেই সব ইঙ্গ-বঙ্গ উপসর্গের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁর পূর্ববর্তী কোনও বাঙালি কবির কাব্যে ওই সব বিষয় স্থান পায়নি। এই জন্যেই তাঁকে বলি নূতন বাংলার প্রথম কবি।
দেশের হালচাল দেখে গুপ্তকবি দুঃখ করে বলছেন :
‘একদিকে দ্বিজ তুষ্ট গোল্লাভোগ দিয়া,
আরদিকে মোল্লা ব’সে মুর্গি মাস নিয়া।
একদিকে কোশকুশী আয়োজন নানা,
আরদিকে টেবিলে ডেবিলে খায় খানা।
পিতা দেয় গলে সূত্র, পুত্র ফেলে কেটে,
বাপ পুজে ভগবতী, বেটা দেয় পেটে।’
মেয়েদের ইংরেজিয়ানার দিকে সত্যদ্রষ্টা কবি যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, আজ তা প্রায় অক্ষরে অক্ষরে সফল হয়েছে :
তখন, ‘এ-বি’ শিখে, বিবি সেজে
বিলাতী বোল কবেই কবে।
এখন, আর কি তারা সাজি নিয়ে
সাঁজ-সেঁজোতির ব্রত গাবে?
সব, কাঁটা-চামচে ধরবে শেষে
পিঁড়ি পেতে আর কি খাবে?
ও ভাই, আর কিছুদিন বেঁচে থাকলে
পাবেই পাবেই দেখতে পাবে,
এরা, আপন হাতে হাঁকিয়ে বগী,
গড়ের মাঠে হাওয়া খাবে।”
ঈশ্বর গুপ্তের আর একটি মস্ত গুণ, বাংলা কাব্য-সাহিত্যে তিনিই হচ্ছেন প্রথম স্বদেশভক্ত কবি। তাঁর পূর্ববতী বাঙালি কবিরা দেশকে ভালোবাসতেন না, এমন অপবাদ দিতে পারি না—স্বদেশকে ভালোবাসে না এমন অমানুষ কে আছে? নিশ্চয়ই তাঁরা স্বদেশকে ভালোবাসতেন। কিন্তু স্বদেশের আশা-নিরাশা আলোচনা করা তাঁরা কাব্যের ধর্ম বলে মনে করতেন না। দৃষ্টান্তস্বরূপ ভারতচন্দ্রকে দেখানো যেতে পারে। বিধর্মী ফিরিঙ্গির আক্রমণে দেশের সর্বনাশ হল পলাশির প্রান্তরে। এতবড় একটা ওলটপালটে বাঙালি ভারতচন্দ্র যে প্রাণে বেদনা অনুভব করেছিলেন, এটুকু আমরা অনায়াসেই অনুমান করে নিতে পারি। কিন্তু তাঁর সমগ্র কাব্যগ্রন্থাবলীর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না কবির সে বেদনাকে।
কিন্তু ঈশ্বর গুপ্তই নানা কবিতার ভিতর দিয়ে বাঙালি জাতিকে সর্বপ্রথমে শোনান অধীনতার দুঃখ এবং স্বদেশের দুর্দশার কথা। তিনি হচ্ছেন বাংলার প্রথম চারণ-কবি এবং পরে তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে দেখা দিয়েছেন : মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলাল প্রমুখ। তাঁর ‘স্বদেশী কবিতার কিছু কিছু নমুনা উদ্ধার করছি।
স্বদেশ সম্বন্ধে কবির উক্তি :
‘জানো না কি জীব তুমি, জননী জনমভূমি,
সে তোমারে হৃদয়ে রেখেছে।
থাকিয়া মায়ের কোলে, সন্তানে জননী ভোলে,
কে কোথায় এমন দেখেছে।’
ভারতবাসীকে সম্বোধন করে কবি বলছেন :
‘জাগ জাগ জাগ সব ভারত-কুমার,
আলস্যের বশ হয়ে ঘুমায়োনা আর।
তোল তোল তোল মুখ, খোল রে লোচন,
জননীর অশ্রুপাত কর রে মোচন।
ভেঙেছে শোবার খাট পড়িয়াছে ভূমে,
এখনও তোমার এত সাধ কেন ঘুমে?’
কবির এই আশা আজ সফল হয়েছে :
স্বাধীনতা মাতৃস্নেহে, ভারতের জরা দেহে
করিবেন শোভার সঞ্চার।
দূর হবে সব ক্লান্তি, পালাবে প্রবলা ভ্রান্তি,
শান্তিজল হবে বরিষণ!
পুণ্যভূমি পুনর্বার, পূর্বমুখ সহকার,
প্রাপ্ত হবে জীবন-যৌবন।’
অন্যত্র :
‘জন্মভূমি জননীর
কোলেতে বসেছি।’
আর এক জায়গায় :
‘ভারতের দৃশ্য হেরি বিদরে হৃদয়।
জননী দুর্ভাগ্যে যথা অর্পিত তনয়।’
আবার :
‘জননী ভারতভূমি
আর কেন থাক তুমি,
ধর্মরূপে ভূষাহীন হয়ে?
তোমার কুমার যত
সকলেই জ্ঞানহত,
মিছে কেন মর ভার বয়ে?’
অন্যত্র বলেছেন :
‘ভ্রাতৃভাব ভাবি মনে, দেখ দেশবাসিগণে,
প্রেমপূর্ণ নয়ন মেলিয়া।
কত রূপ স্নেহ করি, দেশের কুকুর ধরি,
বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া।’
বিলাতের টোরি ও হুইগ সম্বন্ধে :
‘কিছুমাত্র নাহি জানি রাম রাম হরি,
কারে বলে রেডিকেল, কারে বলে টোরি।
হুইগ কাহারে বলে কেবা তাহা জানে,
হুইগের অর্থ কভু শুনি নাই কানে।
টোরি আর হুইগের যে হন প্রধান,
আমাদের পক্ষে ভাই সকল সমান।’
ইংরেজ সম্পাদক সম্বন্ধে :
‘এ দেশেতে আছে যত সম্পাদক সাদা,
সকলেই আমাদের বড় ভাই—দাদা।’
বহু-ব্যবহারের ফলে এ-সব ভাব ও কথা আজকাল এত সাধারণ হয়ে পড়েছে যে, আমাদের হৃদয়তন্ত্রীতে ঝঙ্কার তোলবার ক্ষমতা হয়তো আর ওদের নেই। কিন্তু ঈশ্বর গুপ্তের সমসাময়িক যুগে ওই সব ভাব এবং ‘জননী জনমভূমি’ ও ‘জননী ভারতভূমি’ প্রভৃতি কথা যে বাঙালিদের মনে কতখানি অপ্রত্যাশিত বিস্ময় জাগিয়ে তুলত, সেটুকু কল্পনা করা কঠিন নয়! জন্মভূমিকে মা বলে ডাকতে পেরেছিলেন বাঙালি কবিদের মধ্যে ঈশ্বর গুপ্তই সর্বপ্রথমে।
তবে নীচের এই কয়েকটি পঙক্তি লিখতে পারলে একালেরও যে-কোনও প্রথম শ্রেণির কবি গৌরব অনুভব করতেন :
‘ভ্রাতৃভাব ভাবি মনে, দেখ দেশবাসিগণে,
প্রেমপূর্ণ নয়ন মেলিয়া।
কত রূপ স্নেহ করি, দেশের কুকুর ধরি,
বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া।’
ঈশ্বর গুপ্তের কাব্য সমালোচনা করতে বসে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন : ‘দেশবাৎসল্য! বাৎসল্য পরমধর্ম; কিন্তু এ ধর্ম অনেক দিন হইতে বাঙালা দেশে ছিল না। কখনও ছিল কি না, বলিতে পারি না। এখন ইহা সাধারণ হইতেছে দেখিয়া আনন্দ হয়, কিন্তু ঈশ্বর গুপ্তের সময়ে ইহা বড়ই বিরল ছিল। তখনকার লোকে আপন আপন সমাজ, আপন আপন জাতি বা আপন আপন ধর্মকে ভালোবাসিত, ইহা দেশবাৎসল্যের ন্যায় নহে—অনেক নিকৃষ্ট। মহাত্মা, রামমোহন রায়ের কথা ছাড়িয়া দিয়া রামগোপাল ঘোষ ও হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে বাঙালা দেশে দেশবাৎসল্যের প্রথম নেতা বলা যাইতে পারে। ঈশ্বর গুপ্তের দেশবাৎসল্য তাঁহাদিগেরও কিঞ্চিৎ পূর্বগামী।’
এই তো গেল ঈশ্বরচন্দ্রের একটা দিক। আর একদিক দিয়ে দেখি তাঁকে সাহিত্য-গুরুরূপে। নতুন নতুন লেখক তৈরি করবার জন্যে তিনি প্রকাশ করতেন বিপুল উৎসাহ। সে-কালের অনেক লেখকেরই হাতে-খড়ি হয়েছিল তাঁর সাহিত্য-পাঠশালায়। রচনা-শক্তি প্রকাশ করলে ছাত্রদের জন্যে তিনি নগদ টাকা পুরস্কারের ব্যবস্থাও করতেন। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে অন্তত কয়েকজনের নাম বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছে—বঙ্কিমচন্দ্র ও দীনবন্ধু, কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, নাট্যকার মনোমোহন বসু ও গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ।
পুরাতন ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ প্রকাশিত ঈশ্বরচন্দ্রের ছাত্রদের কবিতা পাঠ করবার সুযোগ আমার হয়েছে। দেখেছি, ঈশ্বরচন্দ্র কেবল নতুন কবিদের কবিতাই প্রকাশ করতেন না, সেইসঙ্গে প্রকাশ করতেন ছাত্রদের দোষ ও গুণ সম্বন্ধে নিজের মতামতও। তরুণ বঙ্কিমচন্দ্র সম্বন্ধে বলেছিলেন : ‘বঙ্কিমের ভাষা কিঞ্চিৎ বঙ্কিম।’ তাঁকে উপদেশ দিয়েছিলেন সরল ভাষায় লিখতে। পদ্যের চেয়ে গদ্যই বঙ্কিমের পক্ষে অধিকতর উপযোগী, এমন কথাও বলেছিলেন। তাঁর শেষোক্ত উক্তিটি রীতিমতো ভবিষ্যদ্বাণীর মতো। পরে প্রমাণিত হয়েছিল তার সত্যতা।
সাহিত্যই ছিল ঈশ্বরচন্দ্রের জীবনের একমাত্র সাধনা এবং সেই জন্যেই বাংলাদেশে যাতে সাহিত্যসাধকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, তিনি বরাবরই সেই চেষ্টা করে গিয়েছেন। তাঁর এই উক্তিটির তুলনা নেই :
‘যে ভাষায় হতে প্রীত পরমেশ-গুণ-গীত
বৃদ্ধকালে গান কর মুখে।
মাতৃ-সম মাতৃ-ভাষা পুরালে তোমার আশা,
তুমি তার সেবা কর সুখে।’
আর একদিকে দিয়েও দেখা যায় ঈশ্বর গুপ্তকে। প্রথমে তাঁর সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের কথা উদ্ধার করি : ‘তিনি সদাই হাস্যবদন। মিষ্টি কথা, রসের কথা, রসের হাসির কথা নিয়তই মুখে লাগিয়া থাকিত। রহস্য এবং ব্যঙ্গ তাঁহার প্রিয় সহচর ছিল। কপটতা, ছলনা, চাতুরী জানিতেন না। তিনি সদালাপী ছিলেন। কথায় হউক, বক্তৃতায় হউক, বিষাদে হউক, কবিতার হউক, গীতে হউক, লোককে হাসাইতে বিলক্ষণ পটু ছিলেন…তিনি রস ব্যতীত একদণ্ড থাকিতে পারিতেন না!’
ঈশ্বরচন্দ্রের রসের কবিতা অনেক আছে, তা নিয়ে আমার নাড়াচাড়া করবার দরকার নেই, পাঠকরা অনায়াসেই সেগুলির আস্বাদ গ্রহণ করতে পারবেন।
তিনি খাবার জিনিস নিয়ে কতকগুলি কবিতা লিখেছেন, যেমন ‘পাঁটা’, ‘এন্ডাওয়ালা তপ্স্যা মাছ’ ও ‘আনারস’ প্রভৃতি : কিন্তু তাঁর কদলী কবিতা রচনার কথা কি আপনাদের জানা আছে?
বঙ্কিমচন্দ্রের মুখে আরও জানতে পারি : ‘ঈশ্বর গুপ্ত মেকির উপরে গালি-গালাজ করিতেন। মেকির উপর যথার্থ রাগ ছিল। মেকি বাবুরা তাঁহার কাছে গালি খাইতেন, মেকি সাহেবরা গালি খাইতেন, মেকি ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা ‘নস্য-লোসা দধি চোষা’র দল গালি খাইতেন।’
ঠিক কারণ জানি না, তবে অনুমানে বোধ হয়, ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ ঈশ্বরচন্দ্রের কোনও মন্তব্য পাঠ করে একদল ক্রুদ্ধ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের মুণ্ডিত মস্তকের শিখাগুলো অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে উঠল। তাঁরা মারমুখো হয়ে ঈশ্বরচন্দ্রের কাঁচড়াপাড়ার বাসভবনের দিকে ধাবমান হলেন।
তখন বেলা দুপুর। কবি বসেছেন মধ্যাহ্ন ভোজনে এবং খাদ্য পরিবেশন করছেন কবিজায়া দুর্গামণি দেবী।
এমন সময়ে বাড়ির সদর দরজায় এসে হানা দিলেন দুর্বাসার আধুনিক অবতারের দল। সে এক বিষম গন্ডগোল।
কেউ চিৎকার করছেন, ‘ওরে পাষণ্ড ঈশ্বর গুপ্ত, বেরিয়ে আয় তুই ভিতর থেকে, আমরা আজ তোর শাস্তিবিধান করব।’
কেউ বলছেন, ‘আজ তোকে পৈতে ছিঁড়ে অভিশাপ দেব!’
কেউ বলছেন, ‘আজ তোকে ভস্ম করে ফেলব।’
দুর্গামণি দেবী তো ভয়ে তটস্থ! ঈশ্বরচন্দ্র তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে ও হাত-মুখ ধুয়ে নিয়ে হাসতে হাসতে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন।
তারপর কথাবার্তার ধরনটা হল বোধ করি এইরকম :
মনে মনে সব বুঝে, কিন্তু মুখে হেসে ঈশ্বরচন্দ্র শুধোলেন, ‘দেবতারা হঠাৎ পায়ের ধুলো দিতে এলেন কেন?’
ও-তরফ থেকে জবাব এল, ‘জেনে শুনে আবার ন্যাকা সাজা হচ্ছে? ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ তুই আমাদের নামে কি দোষারোপ করেছিস?’
কবি বললেন, ‘প্রভুরা যখন ‘প্রভাকর’ পাঠ করেছেন, তখন আমাকে আর জিজ্ঞাসা করে মুখ ব্যথা করছেন কেন?’
প্রভুরা সগর্জনে ভবিষ্যদবাণী করলেন, ‘সর্বনাশ হবে, তোর সর্বনাশ হবে!’
বাড়ির কাছেই ছিল কলাগাছের ঝাড়। সেই দিকে তাকিয়ে হঠাৎ এক ব্রাহ্মণ সন্তানের মাথায় জাগল দুষ্টু-বুদ্ধি। ব্যঙ্গের স্বরে তিনি বলে উঠলেন, ‘ওঃ, ভারি তো কবি! ফরমাজ করলে এখনি তুই মুখে মুখে কবিতা রচনা করতে পারবি?’
কবি যুক্তকরে বললেন, ‘আজ্ঞে, হুকুম দিলেই পারি।’
‘উত্তম। এখনি কদলী নিয়ে একটা কবিতা রচনা কর দেখি।’
‘যথা আজ্ঞা! কিন্তু কবিতা শুনে প্রভুরা আরও বেশি ক্রুদ্ধ হবেন না তো?’
‘না, না, আমরা অভয় দিচ্ছি!’
কবি বললেন :
‘গোলোকবিহারী হরি,
ভূগুপদ বক্ষে ধরি
তোদের মান বাড়িয়েছে
শোন রে শোন নেড়ে নেড়ে,
গলায় দড়ি ভেড়ে ভেড়ে
তাইতে তোদের প্রণাম করি,
(দুই হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে)
নইলে কলা কেঁদেছে।’
অবশ্য গাছের কলার বদলে কবি দেখালেন হাতের কলা, তবে সেকালকার ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতরাও নিতান্ত বেরসিক ছিলেন না, গুপ্ত-কবির অভিনব কদলী-কবিতা শ্রবণ করে সম্ভবত তাঁরা মুখ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
ঘটনাটি বললুম আমার নিজের ভাষায়। গল্পটি শুনেছিলুম আমার স্বর্গীয় পিতৃদেবের মুখে।
নাট্যকার গিরিশচন্দ্র বলেন : ‘একদিন ছেলেবেলায় পাঁচালির গাওনা শুনতে যাই—খুব ভিড়। দেখলেম সেই গোলমালের মধ্যে একজন সহাস্যবদন পুরুষ এলেন—মুখে চোখে তাঁর প্রতিভার ছবি—বেশ উজ্জ্বল মূর্তি bright face আসরের তাবৎ লোক তাঁকে দেখে দাঁড়িয়ে উঠল—বেজায় খাতির, বেজায় সম্মান। তাঁর নাম জানবার জন্য আমার কৌতূহল হল। পাশের লোককে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম ইনিই কবি ঈশ্বর গুপ্ত। গুপ্তকবির এইরকম সম্মান-প্রতিপত্তি দেখে একবার কবি হবার সাধ হয়েছিল।’
ঈশ্বর গুপ্তের যুগে প্রথম ইংরেজি সভ্যতার চাকচিক্যে ভুলে শিক্ষিত বাঙালিরা দেশের সব কিছুকেই অনাদর করতে শিখেছিল। তাদের সবচেয়ে বেশি ঘৃণা ছিল বাংলা ভাষার উপরে। এমনকী মাইকেল মধুসূদনও প্রথমে বাংলা ভাষা প্রায় জানতেন না বললেই হয়। ‘পৃথিবী’ শব্দটি বানান পর্যন্ত করতে পারতেন না। কবিতা রচনা করতেন ইংরেজিতে। এইজন্যে পরে তিনি অনুতপ্ত হয়ে লিখেছিলেন :
‘হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন,—
তা সবে (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।’
মাতৃভাষার প্রতি এই অবহেলা ঈশ্বর গুপ্তের বুকে বড় বাজত। তাই তিনি বলেছেন :
‘হায় হায় পরিতাপে পরিপূর্ণ দেশ।
দেশের ভাষার প্রতি সকলের দ্বেষ।।’
আধুনিক বাংলা ভাষার মূলে ছিলেন কবি ঈশ্বর গুপ্ত। কারণ তাঁর কাছ থেকেই উপদেশ ও প্রেরণা লাভ করে বঙ্কিমচন্দ্র, দীনবন্ধু মিত্র, কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও নাট্যকার মনোমোহন বসু প্রমুখ স্বনামধন্য পুরুষরা তখনকার দিনে অবহেলিত বাংলা ভাষায় উচ্চশ্রেণির সাহিত্য সৃষ্টি করে গিয়েছেন।
আজ এ-উপদেশ অতিশয় সহজ ও পুরাতন বলে মনে হবে, কিন্তু গুপ্তকবির যুগে একমাত্র তিনিই দরাজ বুকে এমন কথা বলতে পেরেছিলেন। না, সেই সময়কার আর এক কবির (রামনিধি গুপ্ত বা নিধুবাবু) মুখেও আমরা এই রকম উক্তি শুনতে পাই :
‘নানান দেশের নানান ভাষা,
বিনে স্বদেশী ভাষা, মিটে কি আশা?’