নতুন বন্ধু চিনু – জয়দীপ চক্রবর্তী

নতুন বন্ধু চিনু – জয়দীপ চক্রবর্তী

বারুইপুরের বরদাচরণ স্মৃতি বঙ্গ বিদ্যালয়ের বয়স অনেক, কিন্তু বিদ্যালয় হিসেবে তার পরিচিতি তেমন উল্লেখ করার মতো নয়। আসলে আশপাশে দু-একটি ভালো স্কুল থাকার জন্য নিতান্ত নিরুপায় না হলে এখানে কেউ পড়তে আসতে চায় না। স্বাভাবিকভাবেই স্কুলটিতে ছাত্র কম এবং ছাত্রদের পড়াশোনার চেয়েও স্কুলের মস্ত মাঠটিতে ফুটবল খেলা এবং খেলার শেষে স্কুলের বাঁধানো পুকুরে দাপাদাপি করার দিকেই ঝোঁক বেশি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাণীব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় নিতান্তই ভালোমানুষ। দাপুটে হেডমাস্টার মশাই বলতে যা বোঝায়, তিনি তার ধারপাশ দিয়েও যান না। ছেলেরা পরীক্ষার ফল ভালো করতে না পারলে মনে মনে কষ্ট পান তিনি ঠিকই, কিন্তু কঠোর হাতে ফাঁকিবাজ ছাত্রদের যে শাসন করে বইমুখো করবেন, তেমন মানুষই তিনি নন, বরং পরিচিত ও কাছের মানুষদের সামনে এই অভিমতই ব্যক্ত করে এসেছেন তিনি যে, পড়াশুনা সব্বাইকে দিয়ে হয় না। আর গাধাকে যতই পেটানো হোক, সত্যি-সত্যি তাকে ঘোড়া বানিয়ে দেওয়াটা সম্পূর্ণতই অলৌকিক। কাজেই কল্পলোকে ঘুরে বেড়িয়ে অহেতুক বোকা বনে তো লাভ নেই। তার চেয়ে বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকাই ভালো।

দু-একজন বন্ধুবান্ধব তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, ‘দ্যাখো বাণী, জীবনে স্বপ্নেরও প্রয়োজন আছে। স্বপ্ন না থাকলে বড়ো হওয়া যায় না।’

বাণীবাবু সেকথায় কর্ণপাত করেননি। তাঁর সাফ কথা ‘বড়ো আবার কী। এই তো দিব্যি তরতর করে বুড়ো হয়ে গেলাম আমি। স্বপ্নের অপেক্ষায় কি থেমে থাকল কিছু? বরং ছোটো থেকে মুখ বুজে পড়তে-পড়তে হাত-পা রোগা-রোগাই থেকে গেল। বুকের নীচে মস্ত ভুঁড়ি, একতলা থেকে দোতলার সিঁড়ি ভাঙতে গেলেই বুক ধড়ফড় করতে শুরু করে। মনে হয় হৃৎপিন্ডটা যেন খাঁচা ভেঙে এক্ষুনি লাফিয়ে নেমে আসবে সিঁড়ির উপর। ভালো স্কুলের ভালো ভালো ছেলেরা তাই পড়াশুনো করুক মন দিয়ে। আমার ছেলেরা ফুটবল খেলুক, গাছে চড়ুক, সাঁতার কাটুক প্রাণ ভরে। ওতে শরীর শক্তপোক্ত হবে। খেটে খেতে পারবে বড়ো হয়ে।’

দু-একজন তবু বলার চেষ্টা করেছেন প্রাণপণে, ‘ইশকুলটাই তো উঠে যাবে তা হলে? হাজার হোক এতদিনের পুরোনো ইশকুল।’

বাণীব্রত দরাজ হাসেন এ-কথায়। তারপর নস্যির ডিবে থেকে একটিপ নস্যি নাকে দিয়ে ভরাট গলায় বলেন, ‘জানো তো, রবিঠাকুর কী বলেছেন?’

‘কী বলেছেন?’

‘বলেছেন, তোমার হাতে নেই ভুবনের ভার। প্রাকৃতিক নিয়মেই ছেলেরা বড়ো হবে। ক্লাসে উঠবে। একদিন মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। এমনকী তাদের মধ্যে এক-আধজন ফার্স্ট ডিভিশনও পেয়ে যাবে।’

‘এখন তো গ্রেডেশন।’

‘যাই হোক। মোদ্দা কথা, ওর মধ্যে তুমি মাতব্বরি করতে গেলেই মরেছ। পুরোনো হেডমাস্টার মশাই অবনীভূষণ দাসের মতো হাল হবে তখন।’

অবনীভূষণ দাস বরদাচরণের খুব জাঁদরেল হেডমাস্টার মশাই ছিলেন। ছেলেদের শাসন করতেন খুব। বরদাচরণের ছেলেরা অতিষ্ঠ হয়ে শেষমেশ আস্ত ভীমরুলের চাক ফেলে দিয়েছিল তাঁর ঘরে। অবনীভূষণবাবু চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে বেশি দেরি করেননি। বরদাচরণের অতখানি মারাত্মক ছেলে হয়তো এখন আর নেই। তবু যারা আছে, তাদেরও যথেষ্ট সমীহ করে চলেন বাণীবাবু। বকাবকি করে বাইরের বিপদ ঘরে ডেকে না এনে বরং তাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে ধুতি গুটিয়ে মাঠে নেমে পড়াটাই তাঁর কাছে অধিকতর বুদ্ধিমানের কাজ।

বরদাচরণ স্মৃতি বঙ্গ বিদ্যালয়ে ছাত্ররা নিরাপদ। বেশ একটা ‘যেমন খুশি চল’ গোছের ভাব স্কুলের সর্বত্র। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও ক্লাস সিক্সের শৌভিক বা সপ্তম শ্রেণির অর্পণ-মণীষ কিংবা এইটের দেবাঞ্জন-শ্যামল-সপ্তর্ষিদের মনে শান্তি নেই একটুও। সবকিছু যদি এমন নিরুদ্বিগ্ন ও শান্তিপূর্ণভাবে চলে তবে যে জীবনে কোনও রোমাঞ্চ থাকে না। স্কুলটা ক্রমশ যেন কেমন একঘেয়ে আর ফ্যাকাসে হয়ে উঠছে দিনকে দিন। মাঝে মাঝে যদি মাস্টার মশাইরা রেগে না ওঠেন বা নিজেদের মধ্যে অন্তত একটু-আধটু ঝামেলা গন্ডগোল না বাধে, তাহলে নিজেদের দুষ্টুমিগুলোর যে আর জোর থাকে না কোনও। সেই মাস-পাঁচেক আগে একবার অঙ্কের স্বপনবাবুর ক্লাসে হঠাৎ চিৎকার করে ছাগল ডাক ডেকে উঠেছিল অঙ্কন। ওঃ, তারপর তাকে ধরে স্যারের কী উত্তমমধ্যম পেটানি। এ ঘটনার পর স্বপ্ন স্যারকে টাইট দেওয়ার কম প্ল্যান-প্রোগ্রাম করেনি ওরা। কিন্তু স্বপনবাবু বোধহয় অন্য ধাতুতে গড়া। একমাত্র ওঁর সঙ্গেই খুব একটা সুবিধে করে উঠতে পারেনি ওরা। অঙ্কনের মার খাওয়াটা একদম ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে মধ্যিখান থেকে। সেই ঘটনার পর থেকে আড়ালে তারা স্বপন স্যারকে ‘টাইগার’ বলে ডাকে। সমীহও করে আপাদমস্তক। অন্য স্যারেদেরও নানারকম গোপন নাম আছে ক্লাসে-ক্লাসে। যেমন সংস্কৃত স্যারের নাম ‘দানুমণি, বাংলার বিভূতিবাবুর নাম ‘তানসেন’, হেডস্যার ‘নাড়ুগোপাল’। একবার সপ্তর্ষি হেড স্যারের সামনেই হঠাৎ করে নাড়ু স্যার বলে ডেকে ফেলেছিল, কিন্তু ব্যাপারটা জমেনি। বাণীবাবু একগাল হেসে সপ্তর্ষির মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে বললেন, ‘জানলি কী করে, আমার ফুলপিসি ছেলেবেলায় যে আমাকে ‘নাড়ু’ বলেই ডাকতেন রে।’ তাঁর গলায় রাগ ঝরে পড়ল না একটি ফোঁটাও।

এমন মন খারাপের মধ্যে দিয়েই দিন কাটছিল ছেলেদের। পুরোনো দুষ্টুমিগুলো করতেও মন চায় না আর। চুপ করে ক্লাসে বসে পড়া শুনতে-শুনতে পড়াশুনো করার একটা বিপজ্জনক ইচ্ছে ক্রমশ মনের মধ্যে ঢুকে পড়ছে হামাগুড়ি দিয়ে। এমন সময় হঠাৎ একদিন গুটি গুটি পায়ে একটা ভালো ছেলে-গোছের দেখতে নতুন ছেলে এসে ভরতি হল বরদাচরণ স্মৃতি বঙ্গ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণিতে। ছেলেটার নামটা অদ্ভুত, আলিম্পন পান। এমন নাম এই স্কুলে একটু বেমানান। আর বেমানান তার চেহারাটাও। আলিম্পন বেঁটে-খাঁটো এবং রোগা। তার চোখ দুটো ফোলা ফোলা, সরু-সরু, আর নাকটা চ্যাপটা।

ছেলেটাকে দেখে দেবাঞ্জন-শ্যামলরা বেশ উৎসাহিত হয়ে পড়ল। নতুন ছেলে তো, বেশ বাজান যাবে দিনকতক। নিজেদের মধ্যে একটু চোখাচোখি সেরে নিয়েই চিৎকার করে উঠল দেবাঞ্জন, ‘চিনু; চিনু!’ ব্যাস, সারা ক্লাস জুড়ে চিৎকার শুরু হয়ে গেল সঙ্গে-সঙ্গে ‘চিন দেশ থেকে চিনু…।’

ছেলেটার ফরসা মুখ একটু লালচে হল বটে, কিন্তু সেকোনও প্রতিবাদ করল না। বরং বেশ ধীরে-সুস্থে গুছিয়ে বসে পড়ল লাস্ট বেঞ্চটার আগের বেঞ্চে, ধারের দিকে। ছেলেটার রেগে না যাওয়াটা ভালো লাগল না অন্যদের। একটু অসহিষ্ণু হয়েই তারা এবার উঠে গেল ছেলেটার দিকে। তারপর সেবাধা দেওয়ার আগেই তার বইয়ের ব্যাগটা তুলে নিয়ে লোফালুফি করতে লাগল ক্লাসের মধ্যে।

ছেলেটা এবারেও খুব একটা রেগে উঠল না। বরং একটু রিনরিনে গলায় শান্তভাবে বলে উঠল, ‘ব্যাগটা নিয়ে অমন করলে টিফিন কৌটোটা যে পড়ে যাবে।’

মুহূর্তের মধ্যে যেন আলোড়ন পড়ে গেল ক্লাসে, ‘টিফিন—’ চিৎকার উঠল সমস্বরে। তারপর তড়িৎগতিতে আলিম্পনের ব্যাগের মধ্যে থেকে তার টিফিন কৌটোটা অন্য ছেলেদের হাতে উঠে এল এবং তার চোখের সামনেই সেটা একেবারেই নি:শেষ হয়ে গেল।

অন্য ছেলেদের অবাক করে দিয়ে আলিম্পন এবারেও কিছু বলল না। রাগলও না। শুধু মিটিমিটি হাসল খানিকটা। ছেলেরা অবশ্য তাতেও দমল না। এবারে সটান তার কাছে উঠে এসে, ‘দেখি তোর পকেটে কী আছে?’ বলে হাত ঢুকিয়ে দিল তার প্যান্টের পকেটে। এ সময় আলিম্পন কী প্রতিক্রিয়া জানাত কে জানে। হঠাৎ স্বপন স্যার ক্লাসে চলে আসায় সেদিনের মতো রণে ভঙ্গ দিল ছেলেরা।

বরদাচরণ বিদ্যালয়ের নিস্তরঙ্গ ভাবটা চিনু স্কুলে আসার মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই একেবারে পালটে গেল। বলতে গেলে চিনু একাই একেবারে মাত করে ফেলেছে সব্বাইকে। উঁচু ক্লাস, নীচু ক্লাস, সমস্ত জায়গায় চিনু এখন এক্কেবারে হিরো। এমনকী ওদের ক্লাসের সপ্তর্ষি-দেবাঞ্জন-শ্যামলরাও আজকাল বেশ একটা সম্ভ্রমের চোখে দ্যাখে চিনুকে। অথচ চিনুটা এমন বিচ্ছু যে, প্রথম দু-চারদিনে কিচ্ছুই বুঝতে দেয়নি কাউকে। ঘটনাটা সেদিন হঠাৎ ঘটে গেল টিফিনের সময়। ঢং ঢং ঢং ঢং করে যেই চতুর্থ পিরিয়ড শেষ হয়েছে, অমনি সপ্তর্ষি ছুটে গিয়ে অন্যদিনের মতোই আলিম্পনের ব্যাগ থেকে টিফিন কৌটোটা ছিনিয়ে নিয়ে চলে এল ক্লাসের মধ্যিখানে। শ্যামল এক টানে খুলে ফেলল কৌটোটার চৌকো ঢাকনাটা। দেবাঞ্জন সটান হাত বাড়িয়ে খাবলা মেরে খাবার তুলতে গিয়েই হঠাৎ স্থির হয়ে গেল। খাবারটার দিকে তাকিয়ে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল সপ্তর্ষিরও। বিকৃত মুখে ঠকাস করে টিফিন কৌটোটা হাইবেঞ্চের উপর রেখে দিয়ে অবাক গলায় বলে উঠল সে, ‘এটা আবার কোন দেশি খাবার রে?’

‘চিন।’ যেন কিছুই হয়নি, এমন মুখ করে হালকা গলায় বলে উঠল আলিম্পন।

‘অ্যাঁ, বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল সপ্তর্ষি।

দু-একজন কৌতূহলী হয়ে টিফিন বাক্সটার উপর ঝুঁকে পড়ল। ওর ভিতরে অনেকটা খিচুড়ির মতো দেখতে কী একটা জিনিস। তার মধ্যে থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে আরশোলার শুঁড়ের মতো লম্বা-লম্বা সব শুঁড় আর গঙ্গাফড়িঙের পায়ের মতো দেখতে কিছু পা। ছেলেগুলোকে খাবারটার দিকে অমন গোল গোল চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে ওদের অজ্ঞতায় যেন করুণা হচ্ছে, এমন মুখ করে আবারও শান্তগলায় বলল আলিম্পন, ‘আং শিং’

‘কী?’ আবার বিষ্ময়ের পালা ক্লাসের অন্য ছাত্রদের।

আলিম্পন তার জায়গা থেকে উঠে ছেলেদের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। তারপর খুব স্পষ্ট গলায় বলল, ‘খাবারটার নাম আং শিং। আরশোলা আর উচ্চিংড়ে দিয়ে ওটা বানানো হয়। হেভি টেস্ট।’

‘যা:, তুই গুল মারছিস।’ কেমন একটু ভ্যাবাচ্যাকা গলায় বলে উঠল সপ্তর্ষি।

‘মোটেই না। আমাদের কমিউনিটিতে এটা খুব চালু একটা রেসিপি।’

‘কী বলছিস তুই আলিম্পন, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। তুই কি বোকা বানাতে চাইছিস নাকি আমাদের?’ শ্যামল বলল সন্দেহের গলায়।

‘আলিম্পন নয়, চিনুই। প্রথম দিনের ওই নামটা বেশ ভালোই লেগেছে আমার। নামটা খুব আন্তরিক।’ খুব স্মার্ট গলায় বলল আলিম্পন।

‘যা:।’

‘সত্যিই। আসলে আমি তো সত্যি-সত্যিই চিনের লোক।’

‘বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে এবার চিনু।’

‘বিলিভ মি, সত্যি। আমার প্রকৃত নাম আল পেন পান। এখানকার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেটাকে আলিম্পন পান করে দিয়েছেন আমার বাবা।’

‘কেন?’

‘সেই কবে আমার ঠাকুরদা চিন থেকে চলে এসেছিলেন এই বাংলামুলুকে। আমরা তো এখন পুরোপুরি বাঙালিই। অবশ্য বাড়িতে আমরা এখনও চিনে ভাষায় কথা বলি মাঝে- মাঝে নিজেদের মধ্যে। কখনও কখনও ওদেশের পরিচিত কারও বাড়িতে গেলেও বলতে হয়—।’

‘তুই সত্যি চিনে ভাষা জানিস?’

‘এঁ তুং মাও!’

‘মানে?’

‘মোটামুটি।’

চিনুর কথাগুলো সন্দেহজনক হওয়া সত্ত্বেও তার মুখে ইংরেজি ও চিনেভাষা একসঙ্গে শুনে তাকে আর ঘাঁটাতে সাহস হল না কারও। বরং এ ঘটনার পরে চিনুর সঙ্গে বেশ পটেই গেল সব্বার। তার ব্যাগ নিয়ে আর লোফালুফি করে না কেউ। তার টিফিন কৌটোর প্রতিও কেউ আর অহেতুক কৌতূহল দেখায় না আজকাল। বরং মাঝেমধ্যে বন্ধুদের সামনে চিনে ভাষায় কথা বলে তাদের অবাক করে দেয় সে। অরুণ বা দেবাঞ্জনের মতো দু-একজন তবুও তার প্রতি একটু সন্দেহপ্রবণ ছিল। কিন্তু স্বপন স্যারের ক্লাসে সম্প্রতি যে খেল দেখিয়েছে চিনু, তারপরে আর তাকে সন্দেহ করার কোনও অবকাশই থাকতে পারে না কারও মনে।

সেদিন বীজগণিতের ক্লাসে উৎপাদকের সাহায্যে ল সা গু এবং গ সা গু শেখাচ্ছিলেন স্বপন স্যার। মানে শেখানোর চেষ্টা করছিলেন প্রাণপণে। আসলে বরদাচরণের ছেলেদের অঙ্ক শেখানোর কাজটা দৃষ্টিহীনকে বারের খেলা দেখাতে বলার মতো বিপজ্জনক। তবু স্বপনবাবুর চেষ্টার ত্রুটি নেই কোনও। ক্লাসটা করতে ছেলেদের স্বাভাবিকভাবেই ভালো লাগে না। কিন্তু এই স্বপনবাবু মানুষটি বড়ো গোলমেলে। বেয়াদপি করে তাঁর ক্লাস ভন্ডুল করে দেওয়াটা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর মধ্যে সম্ভবত একটা। বরদাচরণের পুরোনো ছেলেরা তাই এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে আর নিজেদের জড়ায় না। চিনু যেহেতু নতুন এবং স্বপন স্যারের থাপ্পড় বা কানমলার ভয়াবহতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, তাই অরুণ ভেবেছিল ছেলেটাকে এই ক্লাসেই একটু প্যাঁচে ফেলা যাক।

চিনু অঙ্ক ক্লাসে অরুণের পাশে বসে একমনে কী সব আঁকিবুকি কাটছিল তার খাতার পাতায়। অরুণ সেই সুযোগে চাপা গলায় হঠাৎ তাকে প্রশ্ন করে বসল আচমকা। ‘বল তো চিনু, চিনে ভাষায় টাইগারকে কী বলে?’

‘কাকে?’ খাতা থেকে মুখ তুলল চিনু।

‘টাইগার?’ আবার নীচু গলায় বলে উঠল অরুণ।

‘টাইগার, মানে বাঘ?’ কথাটা একটু জোরে বলে ফেলল চিনু এবং বিপদ যা ঘটার তা মুহূর্তে ঘটে গেল ক্লাসের মধ্যে। টাইগার শব্দটা কানে গিয়ে পৌঁছল স্বপন স্যারের। রাগে মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল তাঁর। বেয়াদপগুলো আড়ালে আবডালে তাঁকে ওই নামে ডাকে, তিনি জানেন। তাই বলে সামনাসামনি, ক্লাসের মধ্যে। কার এত সাহস!

চোখ লাল করে হুঙ্কার ছাড়লেন তিনি, ‘কোন বঁাদরটা কথাটা বলল ক্লাসের মধ্যে?’

সারা ক্লাস চুপ। পিন পড়লেও যেন আওয়াজ হবে ক্লাসের মধ্যে। আবার ধমকে উঠলেন তিনি, ‘কোন বেয়াদপের এত বড়ো আস্পর্ধা?’

এই মওকাটাই খুঁজছিল অরুণ। নি:শব্দে সেশুধু আঙুলটা বাড়িয়ে দিল চিনুর দিকে। স্বপন স্যার আগুন চোখে চিনুর দিকে তাকালেন। মেঘের মতো গর্জন করে উঠলেন, ‘তুই-ই তা হলে সেই বাঁদর?’

চিনু বিনা প্রতিবাদে সম্মতি জানাল মাথা নেড়ে। স্বপন স্যার হাঁক ছাড়লেন, ‘উঠে আয় এখানে।’

চিনু উঠে গেল। সারা ক্লাস প্রমাদ গুণছে এখন। চিনুটার কপালে যে কী আছে, কে জানে!

‘নতুন মনে হচ্ছে?’ চিনুকে এখন তীক্ষ্ণ নজরে জরিপ করছেন স্যার।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘তবু তোর এত সাহস যে আমাকে আওয়াজ দিস?’ বলতে বলতে স্বপন স্যারের মুষ্টিবদ্ধ হাতটা মাথার উপর উঠে গেল। কিন্তু কী আশ্চর্য, ঘুসিটা চিনুর পিঠে নেমে আসার মুহূর্তে আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় একটু বাঁদিকে সরে গিয়েই সেই অদ্ভুত রিনরিনে গলায় চিৎকার করে উঠল সে, ‘চে মাও দং, চে মাও দং!’

স্বপন স্যারের ঘুসি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে হাতটা তাঁর পাশে ঝুলে পড়ল। চিনুর দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি অবাক গলায়, ‘কী বললি?’

‘চে মাও দং।’ করুণ একটা আর্তি মুখে ফুটিয়ে তুলে বলল আবার চিনু।

স্বপন স্যারের মুখের হাঁ আর বন্ধ হচ্ছে না। এমনকী তাঁর মুখের কঠির রাগি রাগি ভাবটাও যেন কেমন ভেঙেচুরে গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে একদম। তার মধ্যে থেকেই অসহায় ভঙ্গিতে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, ‘হ্যাঁ রে, এ বলে কী রে?’

মুশকিল আসান করতে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল ছেলেরা, ‘স্যার, ও চিনু, চিনের লোক, চিনে ভাষায় কথা বলছে!’

‘বলিস কী রে?’ বলে চিনুর দিকে তাকিয়ে আলগা গলায় বললেন তিনি, ‘সত্যি? হ্যাঁ রে?’

‘হুঁ।’ সংক্ষিপ্ত জবাব দিল চিনু।

‘এর মানে কী?’

‘আমায় মাফ করে দিন!’

‘ওরে ব্বাবা।’ বলে চিনুর দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন তিনি। তারপর কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে তুই থাকিস কোথায়?’

‘সেগুন বাগান।’

‘নতুন বাড়ি?’

‘হ্যাঁ।’

‘আর কে আছেন?’

‘মা।’

‘বাবা?’

‘ব্যাবসার কাজে বাইরে। চলে আসবেন কয়েক মাসের মধ্যে।’

‘তোকে ভর্তি করল কে?’

‘মা।’

‘উনিও কি চিনের মানুষ?’

‘না, বাঙালি।’

‘ও।’ বলে উদাস ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ চিনুর দিকে তাকিয়ে থাকলেন স্বপন স্যার। তারপর ঘণ্টা পড়তে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন আনমনে।

এ ঘটনার পর ক্লাসে চিনুর সম্মান বেড়ে গিয়েছে। স্কুলেও তার প্রতি সকলের তীব্র আগ্রহ। এমনকী মাস্টার মশাইরাও সুযোগ পেলেই মাঝে মাঝে তাকে ডেকে পাঠান চিনে ভাষা শোনবার জন্যে। মোদ্দা কথা, বরদাচরণ বঙ্গ বিদ্যালয়ে চিনুর হাত ধরে চিনে ভাষার চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে এখন জোরকদমে।

বরদাচরণ বিদ্যালয়ের অতি-বড়ো শুভানুধ্যায়ীও যেমন এই স্কুলের ছাত্রদের পড়াশুনোর মান নিয়ে খুব একটা উচ্চ ধারণা পোষণ করেন না, তেমনি এই বিদ্যালয়ের অতি-বড়ো নিন্দুকেও কখনও বরদাচরণের ছেলেদের খেলাধুলো সম্পর্কে আগ্রহ ও দক্ষতার কথা অস্বীকার করতে সাহস পায় না। কয়েক বছর ধরেই বরদাচরণ ইন্টার স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন। কেউ কেউ অবশ্য এমন একটা ধুয়ো তোলার চেষ্টা করেছিল যে, বাণীবাবুর ছেলেরা নাকি খেলার মাঠে গুন্ডামি করে। তারা এমন কথাও বলে, গত বছর ফাইনাল খেলায় বারুইপুর হাইওয়ের কৌস্তভ এত বড়ো খেলেছিল যে, বরদাচরণ একদমই এঁটে উঠতে পারছিল না। দ্বিতীয়ার্ধে বরদাচরণের ছেলেরা ইচ্ছে করে তাকে এমনভাবে ট্যাকল করল যে, বেচারা কৌস্তভের পা-টাই ভেঙে গেল। আর ওই দ্বিতীয়ার্ধের শেষের দিকে দেওয়া গোলেই নাকি জিতে গেল বরদাচরণ। এই নিয়ে জলঘোলা হয়েছিল বিস্তর। অনেকে মনে করেন, ছেলেটাকে ওভাবে মারার ফন্দি ছেলেদের নাকি স্বয়ং বাণীব্রতবাবুই শিখিয়ে দিয়েছিলেন প্রথমার্ধের খেলা শেষ হওয়ার পর। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, অভিযোগটা বাণীবাবু পুরোপুরি উড়িয়েও দেননি বরং বুক ফুলিয়ে ছেলেদের সমর্থনে এগিয়ে এসে সাফাই গেয়েছেন তিনি ‘ফুটবল বডি কনট্যাক্ট গেম। ওখানে দু-চারজনের হাত-পা ভাঙতেই পারে। বিশ্বকাপেই পা ভেঙে যায় অনেক ফুটবলারের। ওতে অসম্মান কিছু নেই।’

ফুটবল ছাড়া হকিতেও অবশ্য বরদাচরণ তিনবারের রাজ্য চ্যাম্পিয়ন এবং সুখের কথা, এক্ষেত্রে কোনও বিরূপ সমালোচনাও তাদের নামে কখনও শোনা যায়নি।

বরদাচরণ স্মৃতি বঙ্গ বিদ্যালয়ে প্রতিবছর দুদিন করে বাৎসরিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বয়স ও উচ্চতা অনুসারে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ হয়ে ছেলেরা দৌড়, লংজাম্প, লৌহবল নিক্ষেপ ইত্যাদি নানা খেলায় অংশগ্রহণ করে। সব শেষে বিদ্যালয়ের মাঠে মঞ্চ বেঁধে ছোট্ট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পুরস্কার বিতরণ। এই যে এত বড়ো যজ্ঞ, তার সিংহভাগ দায়দায়িত্ব ছেলেরাই পালন করে। সঙ্গে পরামর্শদাতা হিসেবে দু-একজন শিক্ষক থাকেন বটে, তবে তাঁদের পরামর্শের সত্যি বলতে কী, ছেলেদের খুব একটা প্রয়োজনই পড়ে না।

এবারের এই অনুষ্ঠানে চিনুর ভূমিকা খুবই প্রশংসনীয়। প্রায় সমস্ত কাজেই অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে এগিয়ে এসেছে সে। মাঠে চুন দিয়ে ট্র্যাক তৈরি করা থেকে মঞ্চসজ্জা পর্যন্ত সর্বত্র তার সক্রিয় উপস্থিতি। এমনকী, বন্ধুদের অনুরোধে একশো মিটার ও দু-শো মিটার দৌড়েও অংশ নিয়েছিল, কিন্তু দু-ক্ষেত্রেই শেষ প্রতিযোগী হিসেবে লক্ষ্যে পৌঁছেছে সে। এ নিয়ে অবশ্য চিনুর খুব একটা দুঃখবোধ নেই। সন্ধের মুখে মুখে ‘গো অ্যা্যুজ ইউ লাইক’ প্রতিযোগিতা শেষ হওয়ার পর থেকেই সেগম্ভীর। তাকে নাকি এখন মনঃসংযোগ করতে হচ্ছে গভীরভাবে। আসলে এ বছর বরদাচরণের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণই হল চিনুর কন্ঠে চৈনিক দীর্ঘ কবিতা এবং চিনু কথা দিয়েছে যে, চিনে ভাষার কবিতানুষ্ঠানে সেএবারে একেবারে ফাটিয়ে দেবে। বিচিত্রানুষ্ঠানের মঞ্চে প্রধান শিক্ষকের ভাষণ শেষ। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানও শেষ হয়ে রাত বেশ ঘন হচ্ছে। বাংলার বিভূতিবাবু হারমোনিয়াম বাগিয়ে জুত করে বসেছেন গান শুরু করবেন বলে। ছেলেরাও মনে মনে প্রস্তুত, এক-দু-খানার বেশি বেসুর হেঁড়ে গলার গান এবারে আর অ্যালাউ করা হবে না তাঁর কন্ঠে। নিজে উঠতে না চাইলেও, জোর করে হাততালি দিয়ে তুলে দেওয়া হবে তাঁকে। এমন সময় স্কুলে ঘণ্টা বাজায় যে শিক্ষাকর্মী, সেই হাবলাদা মঞ্চে বসা বাণীবাবুর কানে কানে কীসব বলল খানিক। তার কথা শুনতে শুনতেই বাণীবাবুর চোখ দু-টো রসগোল্লার মতো হয়ে গেল। এমনকী, তাঁর পাশে বসা স্বপন স্যারও, ‘ইজ ইট ইজ ইট?’ বলতে বলতে চেয়ার ছেড়ে সোজা দাঁড়িয়ে পড়লেন মঞ্চের উপর। তারপর তাঁরা দু-জনেই মঞ্চ থেকে নেমে দ্রুত হাঁটতে লাগলেন হেড মাস্টার মশাইয়ের ঘরের দিকে।

হেড মাস্টার মশাইয়ের ঘরে বেশ একটু জড়সড় ভঙ্গিতে ভদ্রলোক একটা চেয়ারে বসে ছিলেন। পড়নে ধুতি আর বাংলা শার্ট। বঁা হাতে ঘড়ি। উচ্চতা বেশি নয়। শ্যামলা গায়ের রং আর টিকালো নাক। বাণীবাবু ঘরে ঢুকতেই সম্ভ্রমের সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। বাণীবাবু নিজের চেয়ারে বসে ইঙ্গিতে বসতে বললেন তাঁকে। স্বপনবাবু বললেন, ‘আপনিই তা হলে চিনুর বাবা?’

‘না না, চিনু না, আমি আলিম্পনের বাবা। আসলে এত রাত হয়ে যাচ্ছে, ছেলেটা একলাটি অত দূরে ফিরবে। তাছাড়া রাত বাড়লে ওদিকে যাওয়ার গাড়ি-ঘোড়াও পাওয়া যায় না। তাই ভাবলাম ছেলেটাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাই। ও অবশ্য একদমই চায় না যে, আমি স্কুলে আসি।’ একনাগাড়ে এত কথা বলে ফেলে ভদ্রলোক জোরে দম নিলেন।

‘আপনি সত্যি সত্যি বৃন্দাখালিতে থাকেন? মানে হাবলাকে তো সেকথাই বলেছেন আপনি?’

‘কেন বলুন তো?’

‘চিনু বলেছিল আপনারা সেগুনবাগানে থাকেন?’

‘আচ্ছা, চিনুটা কে বলুন তো? আমার ছেলের নাম বলতে যে লোকটি এই ঘরে এনে বসাল, আমায় সেও চিনু নামটাই বলছিল বারবার।’

‘আলিম্পনই চিনু। মানে স্কুলে ওই নামেই ও পরিচিত। যদিও ব্যাপারটা ঠিক নয়, আসলে অরিজিনালি আপনারা চিন দেশের তো, তাই ছেলেরা—।’

‘অ্যাঁ?’ আঁতকে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন ভদ্রলোক, ‘কী বলছেন আপনারা?’

‘সত্যি সত্যি আপনারা চিনের মানুষ নন?’

বাণীবাবু, স্বপনবাবু দু-জনেই যেন দিশেহারা।

‘কষ্মিনকালেও নই।’

‘আপনি বাড়িতেই থাকেন, মানে বাড়ি থেকেই অফিস-কাছারি যাতায়াত করেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘আপনার বাবাও কি এ দেশের?’

‘আচ্ছা, এ ধরনের প্রশ্ন আসছে কেন বলুন তো?’

‘গত কয়েক মাসে আপনার ছেলে যে আমাদের সবকিছু একেবারে তালগোল পাকিয়ে দিয়েছে।’

চিনুর বাবা হতাশ গলায় বললেন, ‘মাস্টার মশাই, ও কী বলেছে জানি না। তবে বুঝতে পারছি এখানেও একটা তালগোল পাকিয়েছে ও ঠিক আগের স্কুলের মতোই!’

‘মানে?’ স্বপনবাবুরা এবারে একেবারে থ।

‘আগের স্কুলে ও চাউর করে দিয়েছিল যে, ও আসলে নেপালের মানুষ। আমাকে বানিয়ে দিয়েছিল একজন বিখ্যাত শেরপা। বিশ্বাস করুন, আমি টেলিভিশনে ছাড়া কস্মিনকালেও কোনও সত্যিকারের পাহাড় দেখিনি, তায় আমার ছেলে আমাকে এভারেস্টের বেস্ট ক্যাম্প পর্যন্ত ঠেলে তুলে দিয়েছিল। কী লজ্জা বলুন তো? শেষমেশ পরিস্থিতি এমন দিকে গড়াল যে, ওই স্কুল থেকে ওকে ছাড়িয়েই নিতে হল!’

বরদাচরণ বিদ্যালয়ে ছাত্র বেশি আসে না। কাজেই চিনুকে ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রসঙ্গ আসতেই ব্যস্ত গলায় বলে উঠলেন বাণীবাবু, ‘ওকে এখান থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি আসবে না দেখবেন। আরে বাবা, আমি তো আছি।’

স্বপনবাবু চিন্তিত গলায় বললেন, ‘কিন্তু এমন ও করে কেন?’

চিনুর বাবা বললেন, ‘ঠিক জানি না। তবে সম্ভবত নিজেকে বঁাচাতে…!’

‘মানে?’

‘আসলে ওকে দেখতে অনেকটা ওইরকমই তো। বন্ধুরা হয়তো খেপায়।’

স্বপনবাবু মাথা নাড়লেন, ‘হতে পারে। আচ্ছা দাঁড়ান, ওকে ডাকি! ওর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হওয়া দরকার।’

চিনুর চৈনিক কবিতা তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে শেষ হয়েছে। অনুষ্ঠানও শেষ। আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণার জন্যে দশম শ্রেণির তমোঘ্ন মাইক্রোফোনের দিকে এগোচ্ছে ধীর পায়ে। এমন সময় হেডমাস্টার মশাই বাণীব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় হন্তদন্ত হয়ে মঞ্চে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন মাইক্রোফোনের সামনে। তারপর মন্দ্রকন্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘আজকের গো অ্যাজ ইউ লাইক-এ ‘ভন্ড কাপালিক’ সেজে প্রথম হয়েছে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র শ্রীমান বিমল। তার হাতে আজ সন্ধ্যায় পুরস্কারও তুলে দিয়েছি আমরা। কিন্তু এ বিষয়ে আরও একটি বিশেষ পুরস্কার আমরা তুলে দিতে চাই অষ্টম শ্রেণির ছাত্র শ্রীমান আলিম্পন পানের হাতে। যে গত কয়েক মাস ধরে চিনে সেজে বোকা বানিয়েছে সব্বাইকে।’

ক্লাসে চিনু নামটা এখনও প্রচলিত আছে আলিম্পনের। কিন্তু কেউ তাকে আর খেপায় না। বরং সত্য উদঘাটনের পর বেশ প্রশংসার গলাতেই তাকে বলেছে সপ্তর্ষি, ‘আমাদের হাত থেকে বাঁচতে কলটা কিন্তু ভালোই বের করেছিলি চিনু।’

শ্যামল বলল, ‘কিন্তু চিনে ভাষাটা আমদানি করলি কোত্থেকে বল দিকিনি?’

চিনু হাসল, ‘আমদানি করব কেন? ইতিহাস-ভূগোল বইয়ে যেসব চিনের মানুষজন আর চিনের জায়গার নাম পেয়েছি, সেগুলোই তো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বসিয়ে বলে গিয়েছি অনর্গল। তোরা ব্যাপারটা ধরতে পারিসনি কেউ।’

‘আর সেই আং শিং?’ মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করল দেবাঞ্জন।

‘সেআবার কী রে, নিজেই তো ভুলে গিয়েছি।’ বলে মাথা চুলকোতে থাকল চিনু।

‘আরে সেই তরকারিটা—’ দেবাঞ্জন মনে করিয়ে দিল তাকে।

হো হো করে গা দুলিয়ে হাসতে থাকল চিনু। আর হাসতে হাসতেই বলল, ‘ওঃ, কী কষ্ট করে যে আরশোলাগুলোকে পাকড়াও করেছিলাম মায়ের রান্নাঘর ঢুঁড়ে সারারাত জেগে বসে থেকে—!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *