নতুন বন্ধু

নতুন বন্ধু

বর্ধমান স্টেশনের রেস্টোর‍্যান্টে ভদ্রলোক নিজেই যেচে এসে আলাপ করলেন। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আর গোঁফ, মোটামুটি আমারই বয়সী—অর্থাৎ বছর চল্লিশ-বেয়াল্লিশ—বেশ হাসিখুশি অমায়িক হাবভাব। বারোটা বাজে, তাই লাঞ্চটা সেরে নিচ্ছিলাম। আসলে চলেছি শান্তিনিকেতন আমার সদ্য কেনা মারুতি ভ্যান-এ। ড্রাইভার সন্তোষকেও বলেছি খেয়ে নিতে।

একটা চারজনের টেবিলে বসেছি আমি একা। সবে ভাত আর মাংস অর্ডার দিয়েছি এমন সময় ভদ্রলোক আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, ‘আপনার টেবিলে বসতে পারি?’ আমি বললাম, ‘বিলক্ষণ। আমি ত একা। আপনিও একা বুঝি?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ,’ বললেন। ‘আপনি কোথায় চললেন?’

‘শান্তিনিকেতন।’

‘বাঃ—ভালোই হল। আমিও শান্তিনিকেতনেই যাচ্ছি। সেখানে আমার ছেলে আর মেয়ে পড়ে। ওদের দেখতে যাচ্ছি। গিন্নীরও আসার শখ ছিল, কিন্তু আমার শ্বশুর মশাইয়ের শরীরটা হঠাৎ খারাপ হয়ে যাওয়াতে শেষ মুহূর্তে আর আসতে পারল না। আপনি কি ওখানে থাকবেন কিছুদিন?’

‘দিন দুয়েক,’ বললাম আমি। আমি ওখানে একটা জমি দেখতে যাচ্ছি। একটা ছোট্ট বাড়ি করার ইচ্ছে আছে, যাতে মাঝে মাঝে গিয়ে থাকতে পারি। আমি একজন লেখক। উপন্যাস-টুপন্যাস লিখি।’

‘আপনার নামটা—?’

‘অমিয়নাথ সরকার।’

‘ও হো! আপনার লেখা ত আমি পড়েছি। আপনি ত সাক্সেসফুল রাইটার মশাই! দিব্যি লেখেন। একবার ধরলে ছাড়া যায় না।’

‘আপনি শান্তিনিকেতনে কদিন থাকবেন?’

‘আমিও ওই দিন দুয়েক।’

‘আপনার পরিচয়টা—?’

‘আমাকে নামে চিনবেন না। আমি ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশনে কাজ করি; নাম ‘জয়ন্ত বোস।’

আমাদের খাবার এসে গেল। ভদ্রলোক দেখলাম অমলেট আর টোস্ট খেলেন, আর তার সঙ্গে এক কাপ চা। দশ মিনিটের মধ্যে খাওয়া শেষ করে আবার রওনা দেবার উদ্যোগ করছি, এমন সময় ভদ্রলোক বললেন, ‘এতটা পথ একা একা যাওয়া কেন—আপনি আমার অ্যাম্বাসাডারে আসুন না; আপনার গাড়ি পেছন পেছন আসুক। বেশ গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে।’

প্রস্তাবটা আমার ভালোই লাগল। ড্রাইভারকে বলে দিলাম, তারপর জয়ন্তবাবুর গাড়িতে উঠলাম। এই গাড়িটাও মোটামুটি নতুন বলেই মনে হল। ভদ্রলোককে জিগ্যেস করতে বললেন বছরখানেক হল কিনেছেন। আমরা পৌনে একটা নাগাদ রওনা দিয়ে দিলাম।

‘সিগারেট চলে?’ জয়ন্তবাবু প্রশ্ন করলেন।

‘তা চলে। তবে আপনি আমার একটা খান না।’

‘সে হবে এখন। আপাতত আমারটাই চলুক।’

‘আপনি দেখছি আমারই ব্র্যান্ড খান! উইল্‌স।’

“আজ্ঞে হ্যাঁ। অনেকদিনের অভ্যাস। তবে আজকাল খাওয়া অনেকটা কমিয়ে দিয়েছি।’

‘আমিও। দিনে এক প্যাকেট। তার বেশি না।’

‘আমারও তাই। ক্যানসার-ক্যানসার বলে যা ভয় দেখাচ্ছে।’

আমাদের গাড়ি চলতে লাগল। এতখানি পথ কথা না বলে এসেছি, এখন বাক্যালাপের সুযোগ পেয়ে ভালোই লাগছে।

‘আপনার আদি নিবাস কোথায়?’ জয়ন্তবাবু জিগ্যেস করলেন।

‘পৈত্রিক বাড়ি পূর্ববঙ্গে—ফরিদপুর। তবে সে বাড়ি আমি কখনো দেখিনি। আমি কলকাতাতেই মানুষ।’

‘আমিও পূর্ববঙ্গ। নোয়াখালি। পার্টিশনের সময় বাবা চলে আসেন। তখন অবিশ্যি আমি শিশু।’

‘কলকাতায় কোথায় থাকেন?’

‘নিউ আলিপুর।’

‘আমি থাকি জনক রোড।’

‘পড়াশুনা কলকাতাতেই করেছেন বোধহয়?’

‘হ্যাঁ। মিত্র ইনস্টিটিউশন আর আশুতোষ কলেজ। আমার সায়ান্স ছিল। সিক্সটি-ফাইভে বি-এস-সি পাশ করি।’

‘আমিও, তবে বি-এস-সি নয়, বি-এ। আর আমার স্কুল ছিল সাউথ সাবারব্যান মেন, আর কলেজ সেন্ট জেভিয়ার্স।’

‘খেলাধুলোর শখ ছিল?’

‘ক্রিকেট খেলতাম। খেলা দেখার খুব নেশা ছিল। তখন ত আর টেলিভিশন ছিল না যে বাড়িতে বসে দেখব। তখন মাঠে যেতে হত। বিশেষত ফুটবল দেখতে।’

‘ফুটবলই যদি বললেন, তাহলে কোন দলের সাপোর্টার সেটাও জেনে নিই। ইস্টবেঙ্গল না মোহনবাগান?’

‘মোহনবাগান। এ বিষয় আর কোনো কথা নেই।

‘আসুন, হাতে হাত মেলাই।’

জয়ন্তবাবু সিগারেটটা বাঁ হাতে নিয়ে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। আমরা দুজনে করমর্দন করলাম। দুজনে এত মিল দেখে আশ্চর্য লাগছিল। জয়ন্তবাবু বললেন, ‘আপনার সঙ্গে আলাপ করে সত্যিই ভালো লাগছে। এতখানি পথ একা চুপচাপ বসে প্রাণ হাঁপিয়ে উঠেছিল। তাছাড়া দুজনে এত মিল, সেটাও ত একটা আশ্চর্য ব্যাপার।’

‘এরকম মিল হয়ত অনেকের মধ্যেই থাকে, কিন্তু তাদের পরস্পরে আলাপ হয় না।’

‘আমাদের যে আলাপ হয়ে গেল সেটাই বড় কথা।’

শান্তিনিকেতন যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় সাড়ে তিনটে বাজে। দুজনেরই বুকিং ছিল বোলপুর টুরিস্ট লজে। তার উপর আবার পাশাপাশি ঘর—একেবারে অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

ঘরে মালপত্তর রেখে হাত মুখ ধুয়ে দুজনেই যে যার কাজে বেরিয়ে পড়লাম। শান্তিনিকেতনে অনেকদিনের এক বাসিন্দার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল, তিনিই আমাকে জমির কথাটা বলেছিলেন। তাঁকে সঙ্গে করে দেখে এলাম জমিটা। পছন্দ হল। জমির মালিকের সঙ্গেও কথা হয়ে গেল। কিছু আগাম দিয়ে জমিটাকে বুক করে নিলাম। তারপর আমার আলাপীর—নাম ভবতারণ দত্ত—বাড়িয়ে গিয়ে চা খেয়ে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ লজে ফিরলাম। জয়ন্তবাবু দেখলাম তখনো ফেরেননি।

ভাবছি বেয়ারাটাকে ডেকে আরেক কাপ চা দিতে বলি, এমন সময় অনুভব করলাম মাথাটা বেশ ধরেছে। সঙ্গে অ্যাসপ্রো ছিল, একটা খেয়ে নিয়ে বিছানায় শুলাম। ঘন্টাখানেক শুয়ে থেকেও মাথা ধরাটা গেল না। এবার অনুভব করলাম শুধু মাথা ধরা নয়। তার সঙ্গে চোখ জ্বালা করছে আর গা ম্যাজ ম্যাজ করছে। নাড়িটা টিপে দেখলাম যে বেশ দ্রুত। এ দিকে থার্মোমিটার সঙ্গে নেই, তাই জ্বর দেখতে পারছি না।

এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। গলাটা তুলে বললাম, ‘ভেতরে আসুন।’

দরজা ঠেলে জয়ন্তবাবু ঢুকলেন। আমাকে দেখেই ভদ্রলোকের মুখে একটা উদ্বিগ্নভাব দেখা দিল।

‘সে কি, আপনি বিছানায় কেন? বেরোননি?’

‘বেরিয়েছিলাম। কাজ হয়ে গেছে। ফিরে এসে দেখি শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছে। আর মাথাটাও ধরেছে।’

ভদ্রলোক আমার কপালে হাত দিয়ে বললেন, ‘একি, আপনার ত বেশ জ্বর। দাঁড়ান, আমার কাছে থার্মোমিটার আছে।’

ভদ্রলোক তাঁর ঘর থেকে থার্মোমিটার নিয়ে এলেন। জ্বর উঠল ১০২। জয়ন্তবাবু বললেন, ‘দাঁড়ান, নিজে থেকে কিছু ডিসাইড না করে ব্যাপারটা ডাক্তারের হাতে ছেড়ে দেওয়া ভালো।’

‘ডাক্তার—?’

‘কোন চিন্তা নেই। বোলপুরে কাছেই ডাক্তার আছে। আমার চেনা। আমি সব ব্যবস্থা করছি।’

ভদ্রলোক ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

আধ ঘন্টার মধ্যে ডাক্তার চলে এল। তিনি আমাকে পরীক্ষা করে প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন, আর বললেন যেন রাত্রে শুধু মুরগির স্টু খাই। আমি ডাক্তারকে জিগ্যেস করে তাঁর ভিজিট দিয়ে দিলাম। সেটাও জয়ন্তবাবু অফার করেছিলেন, কিন্তু আমি রাজি হলাম না।

ডাক্তার চলে যাবার পর জয়ন্তবাবু বললেন, ‘এই প্রেসক্রিপশনটা আমি নিলুম। ওষুধ আমি এনে দিচ্ছি, আর কিচেনেও বলে দিচ্ছি রাত্রে যেন আপনার জন্য মুরগির স্টু করে।’

আমি বাধা দিয়ে বললাম, ‘ওষুধ আপনি আনবেন কেন, আমার ড্রাইভারই ত রয়েছে।’

ভদ্রলোক কথাটা কানেই তুললেন না।

বচসা করে লাভ নেই, তাই ভদ্রলোকের সহৃদয় সহায়তা মেনে নিলাম, আর মনে মনে বললাম—ইনি না থাকলে সত্যিই আতান্তরে পড়তে হত।

জয়ন্তবাবু ওষুধ এনে দিলেন, আমি একটা বড়ি খেয়ে নিলাম। ভদ্রলোক বললেন, ‘আমার ছেলে মেয়ে ভালো আছে, কাজেই আমি নিশ্চিন্ত। আমার এমন কোনো কাজ নেই, আমি এখানেই বসছি। আপনি চুপচাপ শুয়ে থাকুন। যদি ঘুম পায় ত ঘুমোন। আমার বিশ্বাস আপনার কলকাতা থেকেই শরীরটা একটু বেসামাল হয়ে ছিল।’

আমি আবার আপত্তি করে বললাম, ‘আপনার থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি একা থেকে একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করি।’

‘তা বেশ। আমি বরং ঘন্টাখানেক পরে এসে একবার খোঁজ নিয়ে যাব। দরজাটা আর ভিতর থেকে ছিট্‌কিনি দেবেন না। এখানে চোরের কোনো ভয় নেই।’

আমি একটু হেসে বললাম, ‘আর আমার সঙ্গে ধনদৌলতও কিছু নেই।’

জয়ন্তবাবু চলে গেলেন। পরোপকারটা সকলের আসে না। অধিকাংশ মানুষই স্বার্থপর হয়—অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে। কিন্তু জয়ন্তবাবুকে দেখলাম তিনি শুধু পরোপকারীই নন, যা করেন তা হাসিমুখে করেন।

ঘুম এল না। ঘন্টাখানেক পরে জয়ন্তবাবু আবার এসে বললেন, ‘জেগেই যখন আছেন তখন চটপট খেয়ে নিন। আপনার স্টু তৈরি—আমি খোঁজ নিয়েছি। আপনার ত ডাইনিং রুমে যাবার কোনো প্রশ্ন ওঠে না, আমি বেয়ারাকে বলছি আপনার ঘরেই খাবারটা এনে দেবে।’

আমি অগত্যা রাজি হয়ে গেলাম।

রাত্রে ঘুম ভালোই হল। সকালে বুঝতে পারলাম শরীরটা বেশ হাল্কা বোধ হচ্ছে। ডাক্তারের ওষুধ তাহলে কাজ দিয়েছে।

আমি বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে দাড়িটা পর্যন্ত কামিয়ে ফেললাম। দেখলাম কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।

আটটা নাগাদ জয়ন্তবাবু এলেন। বললেন, ‘বাঃ—দিব্যি ফ্রেশ লাগছে। দেখি ত টেম্পারেচারটা।’

টেম্পারেচার উঠল ৯৮.৮। অর্থাৎ জ্বর নেই বললেই চলে।

আমি একটা কথা জয়ন্তবাবুকে না বলে পারলাম না, এবং সেটা অন্তর থেকেই বললাম। ভদ্রলোকের ডান হাতটা আমার দুহাতে চেপে বললাম, ‘আপনি আমার জন্য যা করলেন, এ ঋণ পরিশোধ হবার নয়। সত্যি, বিপদে আপনার মতো বন্ধু না পেলে কী করতাম জানি না।’

‘বন্ধুই যদি বললেন তাহলে আর “আপনি” কেন?’ বললেন জয়ন্তবাবু। ‘“তুমি”-তে নেমে আসা যাক না। আড়ষ্টভাবটা তাহলে একেবারে কেটে যায়।’

এত অল্প সময়ে আপনি থেকে তুমিতে নামাটা বোধহয় স্বাভাবিক নয়, কিন্তু প্রস্তাবটায় আমি আপত্তি করতে পারলাম না। বললাম, ‘বেশ ত, তোমার যদি আপত্তি না থাকে ত আমারও নেই। তুমিই চলুক।’

‘তাহলে আজকের দিনটা এখানে থেকে কালকে রওনা হওয়া যাক, কী বল? আজ একটা গান বাজনার ব্যাপার আছে সিংহ সদনে, সেটা সন্ধ্যায় দেখা যেতে পারে। আমার মেয়ে অনেক করে বলে দিয়েছে।’

আমি বললাম, ‘তথাস্তু।’

পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। শরীরটা ঝরঝরে লাগছে। জ্বরের লেশমাত্র নেই।

এবার জয়ন্তকে মারুতিতে তুলে আমরা আগে গেলাম, পিছনে অ্যাম্বাসাডার। পথে নানান গল্পে, রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে নেমে চা খাওয়ায়, পান্ডুয়াতে নেমে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ঘুরে দেখায়, বন্ধুত্বটা আরো জমে উঠল। মনে মনে বললাম, এ লোকটা এতদিন কোথায় ছিল? কী আশ্চর্যভাবে মানুষে মানুষে আলাপ জমে ওঠে। এর সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে অনেক দেখা হবে, সুখ দুঃখের কথা হবে, দুজনে সন্ধ্যায় বসে দাবা খেলব, ভাবতেও মনটা খুশিতে ভরে উঠল।

কলকাতা পৌঁছে স্বভাবতই জয়ন্তকে আগে নিউ আলিপুরে পৌঁছে দিয়ে বললাম, ‘বাড়ি ত চিনে গেলাম; এবার একদিন সপরিবারে আসব।’

বাড়িতে এসে স্ত্রী মনোরমাকে সব ঘটনা বললেন, ‘অতি মূল্যবান জিনিস লাভ হল। একটি নতুন, খাঁটি বন্ধু।’

চিঠিটা এল তিনদিন পরে। লেখা হয়েছে শান্তিনিকেতন থেকে ফিরেছি সেইদিনই, কিন্তু স্থানীয় ডাকের সাহায্যে এই অল্প পথটুকু আসতে লেগেছে তিন দিন। চিঠিটা এই—

ভাই অমিয়,

পঁচিশ বছর পরেও তোকে আমার চিনতে অসুবিধা হয়নি, কিন্তু আমার দাড়ির জন্য তুই বোধহয় আমাকে চিনতে পারিসনি। আমার আসল নামটা আমি তোকে বলিনি, আর সেই সঙ্গে আরো কিছু কথা বানিয়ে বলেছি, কারণ আমার আসল পরিচয়টা জানলে তোর সঙ্গে বন্ধুত্বটা হত না, আর সেই সঙ্গে আমার প্রায়শ্চিত্তটাও হত না। আমি হলাম তোর স্কুলের সহপাঠী কৌশিক মিত্র—ডাকনাম রেন্টু। তোকে নিশ্চয়ই মনে করিয়ে দিতে হবে না যে তোর সঙ্গে সাপে নেউলে সম্পর্ক ছিল আমার। তুই ছিলি ক্লাসের ভালো ছেলে, আর আমি ছিলাম সেরা শয়তান। তোর পিছনে যে কতদিন ধরে কতরকম ভাবে লেগেছি, সেটা আজ ভাবতে অবাক লাগছে। তোর যদি সেই সব দিনের কথা মনে করে কোনো তিক্ত ভাবও থেকে থাকে, আশা করি এই দুদিনের বন্ধুত্বে সেটা কেটে গেছে। মনে রাখিস, আমরা দুজনেই এখন অন্য মানুষ, স্কুল হল সুদূর অতীতের ব্যাপার। এই নতুন সম্পর্কটাই আসল, পুরোনটা কিছু না।

ইতি তোর বন্ধু

রেন্টু

পুন : “তুমি” থেকে “তুই’য়ে নামতে আপত্তি নেই ত?

আমি চিঠিটা পেয়ে তখনই উত্তর দিয়েছিলাম—

ভাই রেন্টু,

তোর চিঠিটা পেয়ে খুব খুশি হলাম। আগামী রবিবার সন্ধ্যায় আমি তোর বাড়িতে আসছি। তখন কথা হবে।

ইতি তোর বন্ধু

অমু

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

নতুন বন্ধু
অনুবাদ
2 of 2

নতুন বন্ধু

নতুন বন্ধু

বর্ধমান স্টেশনের রেস্টোর্যান্টে ভদ্রলোক নিজেই যেচে এসে আলাপ করলেন। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আর গোঁফ, মোটামুটি আমারই বয়সী–অর্থাৎ বছর চল্লিশ-বেয়াল্লিশ–বেশ হাসিখুশি অমায়িক হাবভাব। বারোটা বাজে, তাই লাঞ্চটা সেরে নিচ্ছিলাম। আসলে চলেছি শান্তিনিকেতন, আমার সদ্য কেনা মারুতি ভ্যান-এ। ড্রাইভার সন্তোষকেও বলেছি খেয়ে নিতে।

একটা চারজনের টেবিলে বসেছি আমি একা। সবে ভাত আর মাংস অর্ডার দিয়েছি এমন সময় ভদ্রলোক আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, আপনার টেবিলে বসতে পারি? আমি বললাম, বিলক্ষণ। আমি তো একা। আপনিও একা বুঝি?

আজ্ঞে হ্যাঁ, বললেন। আপনি কোথায় চললেন?

শান্তিনিকেতন।

বাঃ–ভালই হল। আমিও শান্তিনিকেতনেই যাচ্ছি। সেখানে আমার ছেলে আর মেয়ে পড়ে। ওদের দেখতে যাচ্ছি। গিন্নিরও আসার শখ ছিল, কিন্তু আমার শ্বশুরমশাইয়ের শরীরটা হঠাৎ খারাপ হয়ে যাওয়াতে শেষ মুহূর্তে আর আসতে পারল না। আপনি কি ওখানে থাকবেন কিছুদিন?

দিন দুয়েক, বললাম আমি। আমি ওখানে একটা জমি দেখতে যাচ্ছি। একটা ছোট্ট বাড়ি করার ইচ্ছে আছে, যাতে মাঝে মাঝে গিয়ে থাকতে পারি। আমি একজন লেখক। উপন্যাস-টুপন্যাস লিখি।

আপনার নামটা–?

অমিয়নাথ সরকার।

ও হো! আপনার লেখা তো আমি পড়েছি। আপনি তো সাকসেসফুল রাইটার মশাই! দিব্যি লেখেন। একবার ধরলে ছাড়া যায় না।

আপনি শান্তিনিকেতনে কদিন থাকবেন?

আমিও ওই দিন দুয়েক।

আপনার পরিচয়টা–?

আমাকে নামে চিনবেন না। আমি ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশনে কাজ করি; নাম জয়ন্ত বোস।

আমাদের খাবার এসে গেল। ভদ্রলোক দেখলাম অমলেট আর টোস্ট খেলেন, আর তার সঙ্গে এক কাপ চা। দশ মিনিটের মধ্যে খাওয়া শেষ করে আবার রওনা দেওয়ার উদ্যোগ করছি, এমন সময় ভদ্রলোক বললেন, এতটা পথ একা একা যাওয়া কেন–আপনি আমার অ্যাম্বাসাডারে আসুন না; আপনার গাড়ি পেছন পেছন আসুক। বেশ গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে। ৫৯২

প্রস্তাবটা আমার ভালই লাগল। ড্রাইভারকে বলে দিলুম, তারপর জয়ন্তবাবুর গাড়িতে উঠলাম। এই গাড়িটাও মোটামুটি নতুন বলেই মনে হল। ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করতে বললেন বছরখানেক হল কিনেছেন। আমরা পৌনে একটা নাগাদ রওনা দিয়ে দিলাম।

সিগারেট চলে? জয়ন্তবাবু প্রশ্ন করলেন।

তা চলে। তবে আপনি আমার একটা খান না!

সে হবে এখন। আপাতত আমারটাই চলুক।

আপনি দেখছি আমারই ব্র্যান্ড খান। উইলস।

আজ্ঞে হ্যাঁ। অনেকদিনের অভ্যাস। তবে আজকাল খাওয়া অনেকটা কমিয়ে দিয়েছি।

আমিও। দিনে এক প্যাকেট। তার বেশি না।

আমারও তাই। ক্যানসার ক্যানসার বলে যা ভয় দেখাচ্ছে।

আমাদের গাড়ি চলতে লাগল। এতখানি পথ কথা না বলে এসেছি, এখন বাক্যালাপের সুযোগ পেয়ে ভালই লাগছে।

আপনার আদি নিবাস কোথায়? জয়ন্তবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

পৈতৃক বাড়ি পূর্ববঙ্গে–ফরিদপুর। তবে সে বাড়ি আমি কখনও দেখিনি। আমি কলকাতাতেই মানুষ।

আমিও পূর্ববঙ্গ। নোয়াখালি। পার্টিশনের সময় বাবা চলে আসেন। তখন অবিশ্যি আমি শিশু।

কলকাতায় কোথায় থাকেন?

নিউ আলিপুর।

আমি থাকি জনক রোড।

পড়াশুনা কলকাতাতেই করেছেন বোধহয়?

হ্যাঁ। মিত্র ইনস্টিটিউশন আর আশুতোষ কলেজ। আমার সায়ান্স ছিল। সিক্সটি-ফাইভে বিএসসি পাশ করি।

আমিও, তবে বিএসসি নয়, বি-এ। আর আমার স্কুল ছিল সাউথ সাবারব্যান মেন, আর কলেজ সেন্ট জেভিয়ার্স।

খেলাধুলোর শখ ছিল?

ক্রিকেট খেলতাম। খেলা দেখার খুব নেশা ছিল। তখন তো আর টেলিভিশন ছিল না যে বাড়িতে বসে দেখব। তখন মাঠে যেতে হত। বিশেষত ফুটবল দেখতে।

ফুটবলই যদি বললেন, তা হলে কোন দলের সাপোর্টার সেটাও জেনে নিই। ইস্টবেঙ্গল না মোহনবাগান?

মোহনবাগান। এ বিষয় আর কোনও কথা নেই।

আসুন, হাতে হাত মেলাই।

জয়ন্তবাবু সিগারেটটা বাঁ হাতে নিয়ে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। আমরা দুজনে করমর্দন করলাম। দুজনে এত মিল দেখে আশ্চর্য লাগছিল। জয়ন্তবাবু বললেন, আপনার সঙ্গে আলাপ করে সত্যিই ভাল লাগছে। এতখানি পথ একা চুপচাপ বসে প্রাণ হাঁপিয়ে উঠেছিল। তা ছাড়া দুজনে এত মিল, সেটাও তো একটা আশ্চর্য ব্যাপার।

এরকম মিল হয়তো অনেকের মধ্যেই থাকে, কিন্তু তাদের পরস্পরে আলাপ হয় না।

আমাদের যে আলাপ হয়ে গেল সেটাই বড় কথা।

.

শান্তিনিকেতন যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় সাড়ে তিনটে বাজে। দুজনেরই বুকিং ছিল বোলপুর টুরিস্ট লজে। তার ওপর আবার পাশাপাশি ঘর–একেবারে অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

ঘরে মালপত্তর রেখে হাতমুখ ধুয়ে দুজনেই যে যার কাজে বেরিয়ে পড়লাম। শান্তিনিকেতনে অনেকদিনের এক বাসিন্দার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল, তিনিই আমাকে জমির কথাটা বলেছিলেন। তাঁকে সঙ্গে করে দেখে এলাম জমিটা। পছন্দ হল। জমির মালিকের সঙ্গেও কথা হয়ে গেল। কিছু আগাম দিয়ে জমিটাকে বুক করে নিলাম। তারপর আমার আলাপীরনাম ভবতারণ দত্তবাড়িতে গিয়ে চা খেয়ে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ লজে ফিরলাম। জয়ন্তবাবু দেখলাম তখনও ফেরেননি।

ভাবছি বেয়ারাটাকে ডেকে আরেক কাপ চা দিতে বলি, এমন সময় অনুভব করলাম মাথাটা বেশ ধরেছে। সঙ্গে সপ্রো ছিল, একটা খেয়ে নিয়ে বিছানায় শুলাম। ঘন্টাখানেক শুয়ে থেকেও মাথাধরাটা। গেল না। এবার অনুভব করলাম শুধু মাথাধরা নয়। তার সঙ্গে চোখ জ্বালা করছে আর গা ম্যাজম্যাজ করছে। নাড়িটা টিপে দেখলাম যে বেশ দ্রুত। এ দিকে থার্মোমিটার সঙ্গে নেই, তাই জ্বর দেখতে পারছি। না।

এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। গলাটা তুলে বললাম, ভেতরে আসুন।

দরজা ঠেলে জয়ন্তবাবু ঢুকলেন। আমাকে দেখেই ভদ্রলোকের মুখে একটা উদ্বিগ্নভাব দেখা দিল। সে কী, আপনি বিছানায় কেন? বেরোননি?

বেরিয়েছিলাম। কাজ হয়ে গেছে। ফিরে এসে দেখি শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। আর মাথাটাও ধরেছে।

ভদ্রলোক আমার কপালে হাত দিয়ে বললেন, এ কী, আপনার তো বেশ জ্বর। দাঁড়ান, আমার কাছে থার্মোমিটার আছে।

ভদ্রলোক তাঁর ঘর থেকে থার্মোমিটার নিয়ে এলেন। জ্বর উঠল ১০২। জয়ন্তবাবু বললেন, দাঁড়ান, নিজে থেকে কিছু ডিসাইড না করে ব্যাপারটা ডাক্তারের হাতে ছেড়ে দেওয়া ভাল।

ডাক্তার–?

কোনও চিন্তা নেই। বোলপুরেকাছেই ডাক্তার আছে। আমার চেনা। আমি সব ব্যবস্থা করছি।

ভদ্রলোক ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

আধ ঘণ্টার মধ্যে ডাক্তার চলে এল। তিনি আমাকে পরীক্ষা করে প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন, আর বললেন যেন রাত্রে শুধু মুরগির স্টু খাই। আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে তাঁর ভিজিট দিয়ে দিলাম। সেটাও জয়ন্তবাবু অফার করেছিলেন, কিন্তু আমি রাজি হলাম না।

ডাক্তার চলে যাওয়ার পর জয়ন্তবাবু বললেন, এই প্রেসক্রিপশনটা আমি নিলুম। ওষুধ আমি এনে দিচ্ছি, আর কিচেনেও বলে দিচ্ছি রাত্রে যেন আপনার জন্য মুরগির স্টু করে।

আমি বাধা দিয়ে বললাম, ওষুধ আপনি আনবেন কেন, আমার ড্রাইভারই তো রয়েছে।

ভদ্রলোক কথাটা কানেই তুললেন না।

বচসা করে লাভ নেই, তাই ভদ্রলোকের সহৃদয় সহায়তা মেনে নিলাম, আর মনে মনে বললাম–ইনি না থাকলে সত্যিই আতান্তরে পড়তে হত।

জয়ন্তবাবু ওষুধ এনে দিলেন, আমি একটা বড়ি খেয়ে নিলাম। ভদ্রলোক বললেন, আমার ছেলে মেয়ে ভাল আছে, কাজেই আমি নিশ্চিন্ত। আমার এমন কোনও কাজ নেই, আমি এখানেই বসছি। আপনি চুপচাপ শুয়ে থাকুন। যদি ঘুম পায় তো ঘুমোন। আমার বিশ্বাস, আপনার কলকাতা থেকেই শরীরটা একটু বেসামাল হয়ে ছিল।

আমি আবার আপত্তি করে বললাম, আপনার থাকার কোনও প্রয়োজন নেই। আমি একা থেকে একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করি।

তা বেশ। আমি বরং ঘণ্টাখানেক পরে এসে একবার খোঁজ নিয়ে যাব। দরজাটা আর ভিতর থেকে ছিটকিনি দেবেন না। এখানে চোরের কোনও ভয় নেই।

আমি একটু হেসে বললাম, আর আমার সঙ্গে ধনদৌলতও কিছু নেই।

জয়ন্তবাবু চলে গেলেন। পরোপকারটা সকলের আসে না। অধিকাংশ মানুষই স্বার্থপর হয়–অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে। কিন্তু জয়ন্তবাবুকে দেখলাম তিনি শুধু পরোপকারীই নন, যা করেন তা হাসিমুখে করেন।

ঘুম এল না। ঘণ্টাখানেক পরে জয়ন্তবাবু আবার এসে বললেন, জেগেই যখন আছেন তখন চটপট খেয়ে নিন। আপনার স্টু তৈরি–আমি খোঁজ নিয়েছি। আপনার তো ডাইনিং রুমে যাওয়ার কোনও প্রশ্ন ওঠে না, আমি বেয়ারাকে বলছি আপনার ঘরেই খাবারটা এনে দেবে।

আমি অগত্যা রাজি হয়ে গেলাম।

.

রাত্রে ঘুম ভালই হল। সকালে বুঝতে পারলাম শরীরটা বেশ হালকা বোধ হচ্ছে। ডাক্তারের ওষুধ তা হলে কাজ দিয়েছে।

আমি বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে দাড়িটা পর্যন্ত কামিয়ে ফেললাম। দেখলাম কোনও অসুবিধা হচ্ছে না।

আটটা নাগাদ জয়ন্তবাবু এলেন। বললেন, বাঃ–দিব্যি ফ্রেশ লাগছে। দেখি তো টেম্পারেচারটা।

টেম্পারেচার উঠল ৯৮.৮। অর্থাৎ জ্বর নেই বললেই চলে।

আমি একটা কথা জয়ন্তবাবুকে না বলে পারলাম না, এবং সেটা অন্তর থেকেই বললাম। ভদ্রলোকের ডান হাতটা আমার দুহাতে চেপে বললাম, আপনি আমার জন্য যা করলেন, এ ঋণ পরিশোধ হওয়ার নয়। সত্যি, বিপদে আপনার মতো বন্ধু না পেলে কী করতাম জানি না।

বন্ধুই যদি বললেন তা হলে আর আপনি কেন? বললেন জয়ন্তবাবু। তুমি-তে নেমে আসা যাক না। আড়ষ্টভাবটা তা হলে একেবারে কেটে যায়।

এত অল্প সময়ে আপনি থেকে তুমিতে নামাটা বোধহয় স্বাভাবিক নয়, কিন্তু প্রস্তাবটায় আমি আপত্তি করতে পারলাম না। বললাম, বেশ তো, তোমার যদি আপত্তি না থাকে তো আমারও নেই। তুমিই চলুক।

তা হলে আজকের দিনটা এখানে থেকে কালকে রওনা হওয়া যাক, কী বলো? আজ একটা গানবাজনার ব্যাপার আছে সিংহসদনে, সেটা সন্ধ্যায় দেখা যেতে পারে। আমার মেয়ে অনেক করে বলে দিয়েছে।

আমি বললাম, তথাস্তু।

পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। শরীরটা ঝরঝরে লাগছে। জ্বরের লেশমাত্র নেই।

এবার জয়ন্তকে মারুতিতে তুলে আমরা আগে গেলাম, পিছনে অ্যাম্বাসাডার। পথে নানান গল্পে, রাস্তার পাশে চায়ের দোলনে নেমে চা খাওয়ায়, পাণ্ডুয়াতে নেমে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ঘুরে দেখায়, বন্ধুত্বটা আরও জমে উঠল। মনে মনে বললাম, এ লোকটা এতদিন কোথায় ছিল? কী আশ্চর্যভাবে মানুষে মানুষে আলাপ জমে ওঠে। এর সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে অনেক দেখা হবে, সুখ দুঃখের কথা হবে, দুজনে সন্ধ্যায় বসে দাবা খেলব, ভাবতেও মনটা খুশিতে ভরে উঠল।

কলকাতা পৌঁছে স্বভাবতই জয়ন্তকে আগে নিউ আলিপুরে পৌঁছে দিয়ে বললাম, বাড়ি তো চিনে গেলাম; এবার একদিন সপরিবারে আসব।

বাড়িতে এসে স্ত্রী মনোরমাকে সব ঘটনা বললাম, অতি মূল্যবান জিনিস লাভ হল। একটি নতুন, খাঁটি বন্ধু।

চিঠিটা এল তিনদিন পরে। লেখা হয়েছে শান্তিনিকেতন থেকে ফিরেছি সেইদিনই, কিন্তু স্থানীয় ডাকের সাহায্যে এই অল্প পথটুকু আসতে লেগেছে তিনদিন। চিঠিটা এই–

ভাই অমিয়,

পঁচিশ বছর পরেও তোকে আমার চিনতে অসুবিধা হয়নি, কিন্তু আমার দাড়ির জন্য তুই বোধহয় আমাকে চিনতে পারিসনি। আমার আসল নামটা আমি তোকে বলিনি, আর সেই সঙ্গে আরও কিছু কথা বানিয়ে বলেছি, কারণ আমার আসল পরিচয়টা জানলে তোর সঙ্গে বন্ধুত্বটা হত না, আর সেইসঙ্গে আমার প্রায়শ্চিত্তটাও হত না। আমি হলাম তোর স্কুলের সহপাঠী কৌশিক মিত্র–ডানাম রেন্টু। তোকে নিশ্চয়ই মনে করিয়ে দিতে হবে না যে, তার সঙ্গে সাপে-নেউলে সম্পর্ক ছিল আমার। তুই ছিলি ক্লাসের ভাল ছেলে, আর আমি ছিলাম সেরা শয়তান। তোর পিছনে যে কতদিন ধরে কতরকম ভাবে লেগেছি, সেটা আজ ভাবতে অবাক লাগছে। তোর যদি সেইসব দিনের কথা মনে করে কোনও তিক্ত ভাবও থেকে থাকে, আশা করি এই দুদিনের বন্ধুত্বে সেটা কেটে গেছে। মনে রাখিস, আমরা দুজনেই এখন অন্য মানুষ, স্কুল হল সুদূর অতীতের ব্যাপার। এই নতুন সম্পর্কটাই আসল, পুরনোটা কিছু না।

ইতি তোর বন্ধু
রেন্টু

পুনঃ তুমি থেকে তুইয়ে নামতে আপত্তি নেই তো?

আমি চিঠিটা পেয়ে তখনই উত্তর দিয়েছিলাম–

ভাই রেন্টু,

তোর চিঠিটা পেয়ে খুব খুশি হলাম। আগামী রবিবার সন্ধ্যায় আমি তোর বাড়িতে আসছি। তখন কথা হবে।

সন্দেশ, পৌষ ১৩৯৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *