নতুন দিন
অবশেষে ঘটনার এক সপ্তাহ পর, ৩১শে ডিসেম্বর রাতে খোলা দুয়ারে বসে রোজিকে সবটাই খুলে বলল আশেক।
সব শুনে অনেক্ষণ কোনো কথা বলল না মেয়েটা। তবে তাকে সব বলতে পেরে নির্ভার লাগলো আশেকের।
“আগে কইলে তো তুই আমারে জীবনেও এইটা করতে দিতি না।“
গভীর করে শ্বাস নিলো রোজি। কথাটা মিথ্যে নয়, এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ সে কখনও করতে দিতো না।
“কিন্তু এইটা না করলে আমি সারা জীবনে একটুও শান্তি পাইতাম না,” উদাস হয়ে বলল আশেক। “বারোটা বচ্ছর আমি দুদুরে বেঈমান ভাবছি! কী কষ্টটাই না পাইছি!”
আস্তে করে তার পিঠে হাত রাখলো রোজি।
“দুদুমাস্টর আমার কোন জায়গায় থাকতো, জানোস না?”
রোজির চোখদুটো ছল ছল করে উঠল।
“যে মানুষটারে এত আপন ভাবতাম, ভাবতাম, এত ভরসা করতাম…তার বেঈমানি মাইনা নিতে…” আশেক আর কথা বলতে পারলো না। তার কণ্ঠ ধরে এলো।
তার পিঠে আলতো করে মায়ার পরশ বুলিয়ে দিলো রোজি।
“যা করছি তার জন্য পারলে আরেক বার মাফ কইরা দিস আমারে! “
মাথা দোলালো রোজি, ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে বলল, “মানুষ এত অমানুষ হয় কেমনে! লোভেরও তো একটা সীমা থাকে!”
বাঁকাহাসি দিলো মির্জা আশেক। “লোভের কোনো সীমা নাইরে!” দুদুমাস্টারের কথাটাই প্রতিধ্বণিত করলো সে। “লোভ হইলো পাগলা ঘোড়া, ছুটতেই থাকে…রাস্তা শেষ হইয়া যায় কিন্তু ছোটা শেষ হয় না। নতুন রাস্তা বানায়া ছোটে।”
“ঐ শুয়োরটা তাইলে আমার কাছে আইছিল ট্যাকাগুলার খোঁজে!” নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো রোজি।
মাথা নেড়ে সায় দিলো আশেক। রোজির কাছ থেকে যখনই এটা শুনেছে, তখনই বুঝতে পেরেছিল। ভাগ্য ভালো, টাকাগুলো রোজির কাছে ছিল না। নইলে তার পরিণাম যে কী হতো কে জানে।
“কিন্তু আমার তো এখন তরে নিয়া চিন্তা হইতাছে,” ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল রোজি। “ঐ হারামিটা জেল থেইকা ছাড়া পাইলে তরে কী করবো আল্লাহ্ জানে! “
মির্জা আশেক পকেট থেকে পত্রিকার একটি ক্লিপিং বের করে দিলো রোজিকে। মেয়েটা অবাক হলেও লেখাটা পড়লো :
কারাগারে সংঘর্ষে গুরুতর আহত একজন
কাশিমপুর কারাগারে কয়েদীদের মধ্যে এক সংঘর্ষে গুরুতর আহত হয়েছে পাভেল রহমান নামের একজন। কিছুদিন আগে চাঞ্চল্যকর খবরের শিরোনাম হয়েছিল এই লোক। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পরিমাণের জাল টাকা নিয়ে ডিবির হাতে গ্রেফতার হয়েছিল সে। কারাসূত্রে জানা গেছে, রিমান্ড শেষে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হলে সেখানে অন্যান্য কয়েদীদের সঙ্গে কিছু একটা নিয়ে তার বচসা বাধে। এক পর্যায়ে মারপিটের সূত্রপাত হলে পাভেল রহমান মারাত্মকভাবে আহত হয়। বর্তমানে তাকে পিজি হাসপাতালের প্রিজন সেলের আইসিইউ’তে রাখা হয়েছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মাথায় মারাত্মক আঘাত পাওয়া এই রোগির অবস্থা বেশ আশঙ্কাজনক।
মেয়েটার পিঠে আলতো করে হাত রাখলো আশেক। “এইটা কাইলকার নিউজ…আইজ বিকালে মইরা গেছে।“
স্বামীর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো রোজি।
“আমি ছাড়াও দুদুমস্টারের অনেক ঘনিষ্ঠ মানুষ আছে।”
মাথা নেড়ে দিলো মেয়েটা। সে বুঝতে পেরেছে। গভীর করে শ্বাস নিয়ে বলল, “এক্কেবারে সিনেমার মতোন কাহিনি!”
বাঁকা হাসি ফুটে উঠল আশেকের ঠোঁটে। সিনেমায় সে টিকতে পারেনি সত্যি কিন্তু তার জীবনটাই সিনেমার মতো হয়ে গেছে!
“অনেক রাইত হইছে,” বলল রোজি। “যাই, খানা গরম করি,” কথাটা বলেই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো সে।
আশেক ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে চুপচাপ বসে রইলো আর্জুমান্দের চেয়ারটায়। ভারি কুয়াশা পড়েছে, রাত বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে শীতও। যতো দ্রুত সম্ভব ফার্নিচারের কারখানাটা দিতে হবে। এখনও তার যে বয়স, প্রচুর খাটতে পারবে। কয়েক বছর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করলে গুছিয়ে নিতে পারবে অনেকটাই। তার তো বেশি চাহিদা নেই। ভাগ্য ভালো, রোজিও তার মতোই, বেশি কিছু চায় না। কারখানাটা দিতে পারলে মেয়েটাকে আর পার্লারের কাজ করতে দেবে না। পনেরোটা বছর একা একা টেনে নিয়ে গেছে এই সংসার, এখন তার বিশ্রামের দরকার।
হঠাৎ বাতাসে একটা গন্ধ পেল আশেক। চেয়ার থেকে উঠে গন্ধটা অনুসরণ করে বাড়ির পশ্চিম দিকের ঝোঁপঝাঁড়ের দিকে চলে গেল সে। ঝোঁপের সামনে এক চিলতে খালি জায়গায় বেশ বাড়ন্ত একটি হাসনাহেনার গাছ দেখতে পেল। ফুল ফুটেছে, সেই ফুলের ঘ্রানে মৌ মৌ করছে পুরো বাড়ি।
“কী খুঁজেন, ভাই?”
কথাটা শুনে চমকে পেছনে ফিরে তাকালো আশেক। পশ্চিম দিকের ঘরের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে চার্লি।
“এই হাসনাহেনা কে লাগাইছে?”
চার্লি ঢোক গিলল। “দুদুমাস্টর…ভাই।”
আশেকের কপাল কুঁচকে গেল। “দুদু?!”
“হ। আপনে জেলে যাওনের পর একদিন আইছিল না…” একটু থেমে আবার বলল, “…হের পরই তো লাপাত্তা হয়া গেল।”
রোজির কাছ থেকে এটা শুনেছে সে। ঢাকা ছাড়ার আগে দুদু এসেছিল এখানে। কেন যে এসেছিল কেউ জানে না। কিন্তু সেই আসাটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। এই বাড়ি থেকে বের হতেই পাভেল আর মতি তাকে ধরে নিয়ে যায় গোপন আস্তানায়।
আশেকের মাথায় অনেক কিছুই ঘুরপাক খেতে লাগলো।
‘হাসনাহেনার কাব্যগাঁথা’ দুদুমাস্টারের লেখা বইয়ের নাম!
হাসনাহেনা আর্জুমান্দের আসল নাম!
গা ঢাকা দেবার আগে দুদু এই গাছটা লাগিয়ে গেছে!
বহুকাল আগে দুদুমাস্টারের সঙ্গে তার কথোপকথনটা প্রতিধ্বণিত হলো মাথার ভেতর :
এই টাকাগুলান কি এইখানেই রাখবা, ওস্তাদ?
না। আমার হাসনাহেনার কাছে রাখবো।
কী! একটা মাইয়ামানুষের কাছে রাখবা? মাথা গেছেনি
তোমার! ট্যাকাগুলা ব্যাঙ্কে রাখা দরকার।
না, না…ব্যাঙ্কে রাখা যাবে না।
তাইলে?
এ নিয়ে একদম চিন্তা করবে না। টাকাগুলোর সদগতি করে ফেলবো আমি।
সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশে কিছু খুঁজতে শুরু করলো আশেক।
“কী খুঁজেন, ভাই?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো চার্লি।
“বাগানে কোদাল আছে না?”
“আছে তো…ঐ যে, ডাবগাছটার নিচে দেহেন।” একটু থেমে আবার জানতে চাইলো সে, “কী করবেন, ভাই?”
এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কোদালটা হাতে নিয়ে আশেক চলে এলো হাসনাহেনা গাছটার কাছে। বুক ভরে শ্বাস টেনে গাছটার গোড়ার দিকে মাটিতে কোপ দিলো সে।
চার্লি এখনও দুদুমাস্টারের পরিণতি সম্পর্কে কিছুই জানে না। সে ধরেই নিলো, আশেক তাকে এখনও বেঈমান হিসেবে দেখে।
“গাছটা কি কাইট্টা ফালাইবেন?”
চার্লির দিকে তাকালো আশেক। “তুই ঘুমা, চার্লি।”
ছেলেটা আর কিছু না বলে বেজার মুখে জানালাটা বন্ধ করে দিলো।
হাসনাহেনা গাছের গোড়ার দিকে বেশ কিছু মাটি তুলে আনলো আশেক। পাঁচ-দশ মিনিট পর ঘেমে উঠল তার শরীর I প্রায় দেড় ফুটের মতো একটা গর্ত হতেই শক্ত কিছুর উপর কোদালের কোপ পড়লো। আরেকটু মাটি সরাতেই দেখতে পেল ছোট্ট একটা টিনের বাক্স। খুবই হতাশ হলো সে। আশা করেছিল তার ভাগের টাকাগুলো হয়তো এখানে রেখে গেছে দুদু, কিন্তু এই বাক্সে কোনোভাবেই কোটি টাকা থাকার কথা না!
কোদালটা রেখে বাক্সটা তুলতে গিয়ে টের পেল বেশ ভারি ওটা। পনেরো বছর ধরে মাটির নীচে থেকে জং ধরে গেছে। কোনো তালা মারা নেই। ডালাটা খুলতেই দেখতে পেল ভেতরে পলিথিনে মোড়ানো একটা প্যাকেট। পলিথিনটা ছিঁড়ে ফেলতেই চকোলেট আকৃতির অনেকগুলো সোনার বার আর এক শত ডলারের নোটের বান্ডিল বেরিয়ে এলো!
ধপাস করে মাটিতে বসে পড়লো মির্জা আশেক। তার দুচোখে আনন্দের অশ্রু!
“কী হইছে…” রোজির কণ্ঠটা শোনা গেল। “তুই এইহানে কী করোস?”
আশেক ফিরে তাকালো। মেয়েটা তার পেছনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে চেয়ে আছে বাক্সটার দিকে।
“দুদু, এইটা রাইখা গেছিল!”
একটু ঝুঁকে তাকালো রোজি। “সোনা?…ডলার?!”
অশ্রুভরা মুখেই হেসে ফেলল আশেক। “আমার ওস্তাদের বুদ্ধিটা দেখছোস!”
রোজি হা করে চেয়ে রইলো।
দুদুর কৌশলটা এখন ধরতে পেরেছে মির্জা আশেক। কোটি কোটি টাকা রাখতে বেশ জায়গা লাগে, সেগুলোকে সোনা আর ডলারে পরিণত করে ফেললে খুব অল্প জায়গাতেই লুকিয়ে রাখা সম্ভব। এতে আরেকটা লাভও আছে-দিনের পর দিন সোনা আর ডলারের দাম বাড়ে, দেশি টাকার মান বরং দিন দিন কমে যায়।
তাদের দু-জনের ভাগের টাকা ছিল প্রায় দুই কোটি পঁচাশি লাখ টাকা। আশেক দশ লাখ আর দুদু খরচ করেছিল সম্ভবত চার-পাঁচ লাখ টাকা, বাকি টাকাগুলো দিয়ে সে ডলার আর স্বর্ণ কিনে নিয়েছিল। সবগুলো টাকা দিয়ে স্বর্ণ কিনতে পারেনি বলে বেশ কিছু টাকা রয়ে গেছিল, ওগুলো দিয়ে ডলার কিনে নিয়েছে হয়তো। এই পনেরো বছরে সেই টাকা আর স্বর্ণের মূল্য কম করে হলেও আড়াই গুণ বেড়ে গেছে।
“মানুষটার অনেক বুদ্ধি আছিল!” প্রশংসার সুরে বলল রোজি।
“তার চায়া বেশি বড় আছিল তার মন!” বাক্সটা মাটিতে রেখে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে বলল মির্জা আশেক।
এমন সময় চারপাশ কাঁপিয়ে আতশবাজি ফুটতে শুরু করলে রাতের আকাশ আলোকিত হয়ে উঠল। পৃথিবী প্রবেশ করলো আরেকটি নতুন বছরে। মির্জা আশেকের মনে হলো, তাদের দু- জনের জীবনটা নতুন দিনের মতো নতুন আলোয় আবারো নতুন
করে শুরু হবে।
***
দারুণ লাগলো..
onk Sundor,,,
ছোট পরিসরে চমৎকার গল্প।