নট গিলটি

নট গিলটি

সর্বপ্রথম যেদিন আমার লেখা ছাপাতে বেরুল তার কয়েক দিন পরই আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক মহাশয় আমাকে একখানি চিঠি রিডাইরেক্ট করে পাঠালেন। চিঠিখানা আমার উদ্দেশে লেখা। পত্রলেখক আমার ঠিকানা জানেন না বলে সেটি সম্পাদকের C/o করে লিখেছেন। এইটেই বিচক্ষণের লক্ষণ। এবং বহু বত্সরের অভিজ্ঞতা-সঞ্চিত আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিবলে, যেসব স্পর্শকাতর পাঠকপাঠিকা কারও লেখা পড়ে মুগ্ধ হন, বিরক্ত হন বা বিচলিত হন তারা যেন তাদের মানসিক, হার্দিক প্রতিক্রিয়া সম্পাদকের মারফতে লেখকের কাছে পাঠান। এবারে বাকিটা বলছি।

প্রথম গোটা পাঁচেক চিঠি তো আমাকে অভিনন্দন জানাল। তার ধরন অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন। কোনও কোনও পত্ৰলেখক আমাকে সবিনয়, সসম্মান, সশ্রদ্ধ আনন্দভিবাদন জানাল, আর কোনও কোনও লেখক আমার পিঠ চাপড়ে মুরুব্বিয়ানা মোগলাই কণ্ঠে বললেন, বেশ লিখেছিস ছোঁড়া, খাসা লিখেছিস। লেগে থাক। আখেরে টু-পাইস কামাতেও পারবি।

দ্বিতীয় পক্ষের মুরুব্বিয়ানা আমাকে ঈষৎ বিরক্ত করেছিল, সেকথা আমি অস্বীকার করব না। কিন্তু সেটা ক্ষণতরে। কারণ, আমি কাগজে লেখা আরম্ভ করি, বিয়াল্লিশ বছর বয়সে। ততদিনে বাস্তব জীবনে নানা প্রকারের চড়-চাপাটি খেয়ে খেয়ে আমার দেহে তখন দিব্য একখানা গণ্ডারের চামড়া তৈরি হয়ে গিয়েছে। বিস্তর মুরুব্বি এতদিন ধরে, আমার কর্মজীবনে আমার পিঠ চাপড়ে আমাকে এন্তের সদুপদেশ দিয়েছেন। কই? আমি তো তখন চটিনি। অবশ্য এনারা উপদেশ দিয়েছিলেন বাচনিক; উপস্থিত যেসব এই জাতীয় মুরুব্বিয়ানার চিঠি আসছে সেগুলো লেখনিক।

তাতে কীই-বা যায়-আসে!

কিন্তু আমার মনে তখন প্রশ্ন জাগল, এসব তাবৎ ব্যক্তিগত চিঠির প্রত্যেকটির উত্তর আমাকে স্বহস্তে লিখতে হবে কি না?

তা হলেই তো হয়েছে! কতখানি সময়, শক্তিক্ষয়, ডাকটিকিটের ব্যয়, কে জানে?

আমার টাইপরাইটার আছে। আমি অবশ্যই আধঘন্টার ভিতর খান তিরিশেক কার্বন কপি তৈরি করতে পারি। তার বক্তব্য হবে Many Thanks for your good wishes.

.

উঁহু! হল না।

যারা চিঠি লিখেছেন তারা সাহিত্যরসিক-রসিকা। তারা চান, সাহিত্যিক উত্তর। লড্রির চিঠিতে প্রশ্ন, আপনার অত অত নম্বরের জামাকাপড় ছাড়াচ্ছেন না কেন? আপনি তখনই ওই গদ্যময় বেরসিক ভাষায়ই উত্তর দেবেন। কিন্তু এনারা তো সাহিত্যিক উত্তর চান।

ইতোমধ্যে আরেকখানি মোলায়েম চিঠি। তার বক্তব্য, মোটামুটি যা মনে আসছে, কারণ চিঠিখানি আমার বউ পুড়িয়ে ফেলেছেন :

মহাশয়, আমার মনের গভীরতম কথাটি আপনি কী মরমিয়া ভাষায়ই না প্রকাশ করেছেন! ইত্যাদি ইত্যাদি প্রায় তিন পাতা জুড়ে। পড়ে আমিও রোমাঞ্চিত হলুম। লেখিকাকে মনে মনে শুকরিয়া জানালুম।

কিন্তু ইয়াল্লা! আমি খেজুরগাছের শেষ আড়াই হাতের দিকে আদৌ খেয়াল করিনি। কিংবা বলতে পারেন, বন থেকে বেরুবার পূর্বেই হর্ষধ্বনি করে বসে আছি।

চিঠির সর্বশেষে আছে, আমি পঞ্চদশী। এ চিঠির উত্তর আপনাকে স্বহস্তে দিতেই হবে। এবং তার পরেই, সর্বশেষে মোক্ষম কথা : এখন থেকে আমি পিওনের পদধ্বনির প্রতীক্ষায় প্রহর গুনব।

সর্বনাশ, এস্থলে আপনি কী করবেন? আরবি ভাষায় প্রবাদ আছে : অল ইতিজারু আপা মিনাল মউত। অর্থাৎ প্রতীক্ষা করাটা (ইনতিজার) মৃত্যুর চেয়েও কঠোরতর।

অনেক ভেবেচিন্তে একটি চিঠি লিখে পত্রলেখিকাকে ধন্যবাদ জানালুম এবং সর্বশেষে একটা অতি সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনাময় প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিলুম যে, আমার বয়স বাড়তির দিকে, শক্তি কমতির দিকে, অতএব চিঠিচাপাটি লেখা বাবদে আমাকে যেন একটু সদয় নিষ্কৃতি দেওয়া হয়–ইত্যাদি ইত্যাদি।

তার পর কী হল? আমি আশা করেছিলুম, এখানেই শেষ। মূর্খ আমি, জানতুম না, এইখানেই আরম্ভ।

দিন পনেরো পর ওই পঞ্চদশীর পাড়া থেকে এল আরও পাঁচখানা চিঠি! সবকটা চিঠি যে একই পাড়া থেকে, সেটা হৃদয়ঙ্গম করার জন্য আমাকে ব্যোমকেশ-হোমস্ হতে হয়নি। মসজিদবাড়ি পাড়া, কলকাতা-৬ আমার বিলক্ষণ চেনা।

স্পষ্ট বোঝা গেল, পঞ্চদশীটি আমার চিঠিখানা তার পাড়ার তাবৎ বান্ধবীকে দেখিয়েছেন।

এস্থলে পাঠকদের কাছে আমার একটি অতিশয় ক্ষুদ্র আরজি আছে। এবং সেটি যদি তারা মঞ্জুর না করেন তবে আমি সত্য সত্যই মর্মাহত হব। এটা কথার কথা নয়, হৃদয়ের কথা। আমি জানি, আমি মোকা-বেমোকায় ঠাট্টা-মশকরা করি, কিন্তু আমার এ আরজি মোটেই মশকরা-রসিকতা নয়- সিরিয়াস। আমার নিবেদন :

এই যে এতক্ষণ ধরে আমি আমাকে লেখা চিঠিপত্র নিয়ে যে আলোচনা করেছি সেটা আমার মূল্য বাড়াবার জন্য নয়।

আমি আল্লা মানি। আল্লার কসম খেয়ে একথা বলছি।

আপনারা তারাশঙ্করাদি প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের শুধোন মিথ্যা বিনয় নয়, আমি তো ওঁদের অনেক পিছনে তারা কত না কত রঙের কত ঢঙের, কত না কল্পনাতীত জায়গা থেকে, কত না অবিশ্বাস্য ধরনের চিঠি পান।

ওঁরা যত চিঠি পান, তার শতাংশের একাংশও আমি পাই না।

এখানে এসে আমাকে আরেকটি কথা বেশ জোর গলায় বলতে হবে।

অদ্যাবধি কি দেশে, কি বিদেশে আমি একটি লেখকও পাইনি যিনি অপরিচিত পাঠকের স্বতঃপ্রবৃত্ত পত্র পেয়ে আনন্দিত হন না। এমনকি কড়া চিঠি পেয়েও লেখকরা খুব একটা বিমুখ হন না। তবে এ ধরনের চিঠি আসে কমই। কারণ স্বয়ং কবিগুরু বলেছেন,

আমার মতে জগৎটাতে
ভালোটারই প্রাধান্য
 মন্দ যদি তিন-চল্লিশ
ভালোর সংখ্যা সাতান্ন।

তবে লেখককুল তিন-চল্লিশখানা মন্দ চিঠি পান না, পান তার চেয়ে ঢের ঢের কম। তবে অন্য মন্দ চিঠিগুলো যায় কোথায়? সেগুলো যায় সোজা সম্পাদক মহাশয়ের নামে। সেগুলোতে থাকে নানা প্রকারের প্রতিবাদ, মন্দমধুর সমালোচনা বা তীব্র কঠোর মন্তব্য। সম্পাদক আপন দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন বলে কোনওটা ছাপান, কোনওটা ছাপান না।

এই ব্যবস্থাই উত্তম। বুঝিয়ে বলি :

আপনি আমাকে সরাসরি চিঠি লিখলেন (সম্পাদক মহাশয়কে না), মহাশয়, আপনার শহ-ইয়ার নিতান্তই কাল্পনিক রচনা। এরকম মুসলমান মেয়ে বাঙালা দেশে সম্পূর্ণ অসম্ভব। তার পর আপনি সুচারুরূপে আপন অভিজ্ঞতাপ্রসূত সম্পদ যুক্তিযুক্তভাবে প্রকাশ করলেন।

এস্থলে আমি করি কী?

আপনি এম্বুলে বলেছেন, তুমি, আলী, অপরাধী!

এস্থলে চিন্তা করুন তো, কোন অপরাধী সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, হ্যাঁ, আমি অপরাধী, স্যার!–গিলটি, মিলাট (মাই লর্ড)!

ব্যাপার যদি এতই সরল হবে তবে তো আদালতের শতকরা নব্বইটি মোকদ্দমা সঙ্গে সঙ্গে ফৈসালা হয়ে যেত।

কিন্তু আমি নট গিলটি বললেই তো অনুযোগকারী পত্ৰলেখক (প্রসিকিউশন, ফরিয়াদি) সঙ্গে সঙ্গে সেটা মেনে নেবেন না।

তাই পুনরায় প্রশ্ন, এস্থলে আমি করি কী?

এইবারে আমি আমার মোদ্দা কথাতে এসে গিয়েছি।

পত্ৰলেখক যদি তাঁর অনুযোগ আমাকে সরাসরি না লিখে সম্পাদক মশাইকে জানাতেন, তবে আমি বেঁচে যেতুম। সম্পাদকমশাই না ছাপালে তো ল্যাঠাই চুকে যেত। অর্থাৎ মোকদ্দমা আদৌ আদালতে উঠল না।

কিন্তু তিনি ছাপালেও আমি খুশি। কারণ, তখন যারা এ বাবদে ভিন্নমত পোষণ করেন। তারা আমার পক্ষ নিয়ে সাক্ষ্য দেবেন। ভূরি ভূরি প্রমাণ পেশ করবেন যে, শহর-ইয়ার আদৌ কাল্পনিক নয়।

আমার মনে হয়, এই পন্থাই (প্রসিডিয়র সর্বোত্তম।

এ বাবদ ভবিষ্যতেও লেখার আশা পোষণ করি।

.

ইতোমধ্যে, দোহাই পাঠক, তুমি আদৌ ভেবো না, আমি সরাসরি চিঠি পেতে আদপেই পছন্দ করি না। খুব পছন্দ করি, বিলক্ষণ পছন্দ করি।

কিন্তু সেগুলোর উত্তর দেওয়াটা যে বড়–।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *