নটিংহাম
০১.
আমাদের ছেলেবেলায় ঘটি-বাঙালে রেষারেষি ঠাট্টা-মশকরা ছিল ঢের ঢের বেশি। একটা মশকরা আমার মনে পড়ল নটিংহাম যাবার ট্রেনে বসে। বাঙালের সঙ্গে (বাঙাল সাথে বলে এবং গদ্যেও লেখে সাথে; রবীন্দ্রনাথ শেষ বয়সে সেটা কিঞ্চিৎ অনিচ্ছায় স্বীকার করে নেন) লিলুয়া স্টেশনে দেখা এক ঘটির। বাঙাল শুধাল, কোথায় চললেন দাদা? ঘটি বলল, চললুম, দাদা, পশ্চিমে। গায়ে এটুখানি গত্তি লাগিয়ে আসি। বাঙাল আমেজ করল, দাদা বুঝি হিলি দিল্লি বিজয় করতে চললেন। কারণ সে যখন প্রথম দেশ ছেড়ে শেয়ালদায় নামে তখন গান রচেছিল।
লাম্যা ইশটিশানে
গাড়ির থনে।
মনে মনে আমেজ করি
আইলাম বুঝি আলী মিয়ার রঙ-মহলে
ঢাহা (ঢাকা) জেলায় বশ্যাল (বরিশাল) ছাড়ি ॥
তার তরে বরিশাল ছেড়ে ঢাকা যাওয়াটাই একটা মস্ত কসরত। এবং শেয়ালদা আসাটা তো রীতিমতো গামার সঙ্গে লড়াই দেওয়া!… অবশেষে ধরা পড়ল ঘটি দাদা যাচ্ছেন লিলুয়া।
সবই পরিপ্রেক্ষিতের ব্যাপার। লন্ডন থেকে নটিংহাম সোয়া শো মাইল হয় কি না হয়। আমাদের কাছে লস্যি। অথচ লন্ডনের ইংরেজ দোস্তেরা যেভাবে আমাকে ওখানে যেতে নিরুৎসাহ করেছিলেন তার থেকে মনে হল ওরা ও-মুলুককে প্রায় দুশমনের পুরী বলে ধরে নিয়েছেন। একাধিক জন বললেন, ওখানে– অপরাধ নিয়ো না এই এই, অর্থাৎ সেখানে ইন্ডিয়ানদের ঠ্যাঙানো হচ্ছে। আমি বললুম, যেতে যখন হবেই তখন অত ভেবে কী হবে। তদুপরি আমাদের পোয়েট টেগোর বলছেন–
মৃত্যুকে যে এড়িয়ে চলে মৃত্যু তারেই টানে
মৃত্যু যারা বুক পেতে লয় বাঁচতে তারাই জানে ॥
ট্রেনে বসে চিন্তা করে দেখি, আমি নটিংহাম সম্বন্ধে যা জানি সে ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। (১) আমার একজন আত্মীয় সেখানে আছেন। আমার আপন আত্মীয় হলে না গেলেও চলত কিন্তু তিনি আমার ছোট বোনের দেবর। তিনি আবার তালেবর লোক। আমি যখন হামবুর্গে তখন কী করে কোথায় থেকে খবর পেয়ে তিনি নটিংহাম থেকে আমাকে ট্রাঙ্ক-কল করে সাতিশয় অনুরোধ জানালেন আমি যদিস্যাৎ ইংলন্ডে যাই তবে অতি অবশ্য আমাকে নটিংহাম যেতেই হবে, যেতেই হবে– তিন সত্যি। (২) ছেলেবেলায় রবিনহুডের কেচ্ছা পড়েছিলুম। তার কর্মস্থল ছিল নটিংহাম। পাশে ছিল শারউড বন। সেইটেই ছিল তাঁর স্থায়ী আস্তানা।… এদানির কলকাতার ছেলেছোকরারা আর রবিনহুডের কাহিনী তেমন একটা পড়ে না। কলকাতার গলিতে গলিতে এন্তের রবিনহুড। তবে অতি সামান্য একটা তফাৎ রয়েছে। রবিনহুড নাকি ডাকাতি করে যে-কড়ি কামাতো সেটা গরিব-দুঃখীদের বিলিয়ে দিত। অদ্যকার কলকাতার রবিনহুডরা চাঁদার নামে, হ্যাঁনত্যানার নামে যে-টাকা, প্রায়-ডাকাতি করে কামান, সেটা ঠিক ঠিক কোন জায়গায় যায়, এ-মূর্খ সে-বাবদে বিশেষজ্ঞ নয়। ঈশ্বর সুকুমার রায় তার একটি কবিতাতে, উপবেশন কী করে করতে হয়, সে সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে বলেছেন,
তবে দেখো, খাদ্য দিতে অতিথির থালে
দৈবাৎ না পড়ে যেন কভু নিজ গালে।
বাকিটা বলার কোনও প্রয়োজন নেই। চালাক মাত্রই মূর্খকে কথা বলতে দেয়। আমি বিশ্বাস করি, যদল্লং তন্মিষ্টং। (৩) আমাদের যেরকম বিদ্রোহী কবি শ্ৰীযুত নজরুল ইসলাম, ইংরেজের বিদ্রোহী কবি বায়রন। এবং তার বাস্তুভিটে নটিংহামের অতি কাছে। ইংরেজ সরকার তার মৃতদেহ বড় বড় মহৎ মহৎ কবির সঙ্গে লন্ডনে গোর দিতে চায়নি বলে তাঁকে গোর দেওয়া হয় তার বাস্তুভিটের গোরস্তানে।
নটিঙম! নটিঙম!! নটিঙম!!! কলরব চিৎকার।
আরেকটু হলেই পৌঁছে যেতুম নর্থ পোলে। প্রফেটরা বার বার বলেছেন, নিজেকে চিনতে শেখ। আত্মচিন্তা কর। তা আপনারা যত খুশি আত্মচিন্তা করুন। কিন্তু রেলগাড়িতে না। কহাঁ কহাঁ মুল্লুকে পৌঁছে, দু ডবল ভাড়া, জরিমানা দিয়ে মোকামে ফিরবেন বরঞ্চ সেইটেই চিন্তা করুন।
.
০২.
তনু, দেহ, শরীর, বপু, কলেবর, কোনটা ঠিক মধ্যিখানে বলা ভার। আমার আত্মীয় যিনি আমাকে নটিঙাম স্টেশনে রিসিভ করতে এলেন তিনি ওই মধ্যিখানে। বাইরে বেরিয়ে দেখি, তার ঢাউস মোটরগাড়ি। বাড়ি যাবার সময় অলস-নয়নে এদিক-ওদিক তাকালুম। ইংরেজ বিদেশে যদি বিশেষ কোনও নতুন চিজ না দেখতে পায় তবে বলে নাথিং টু রাইট হোম এবাউট। অর্থাৎ এমন কিছু দেখিনি যা চিঠিতে লিখে বাড়ির লোককে তাক লাগানো যায়। আমার হল তাই। এ জায়গায় লক্ষ করলুম, পর পর দুটো দোকানে যেন কিছু ভারতীয় সামান আসবাব আছে। শুধোলুম, এ দোকানগুলো কাদের? চৌধুরী বললেন, এক শিখ ভদ্রলোকের। বেশ দু পয়সা কামান। বড়লোক বলা যেতে পারে। চৌধুরীর বাড়ি পৌঁছে দেখি তিনিও কিছু কম যান না। তেতলা বাড়িতে বাস করেন। তিনটেই তার। তার পর গেলুম তাঁর রেস্তোরাঁ দেখতে। সে-ও এলাহি ব্যাপার; উপরের তলা নিচের তলা দু তলা নিয়ে পেল্লাই কাণ্ড।
কিন্তু এসব কথা অন্য দিন হবে।…. খবরের কাগজে পাঠক হয়তো লক্ষ করে থাকবেন যে ইংলন্ডের বর্তমান সরকার আইন পাস করতে যাচ্ছেন, এখন থেকে ওঁদের দেশে চলে যেতে হলে কমনওয়েলথ নাগরিক– যেমন ভারতীয়-পাকিস্তানি এবং পাক্কা বিদেশি– যেমন ফরাসি-জরমন– আর কোনও তফাৎ রইল না। বিগলিতাৰ্থ : ভারত-পাকিস্তানির পক্ষে এখন ও-দেশে গিয়ে দু পয়সা কামানো প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। আত্মাভিমানী পাঠক হয়তো ঈষৎ রাগত কণ্ঠে শুধোবেন, কী দরকার রে বাপু, বিদেশে গিয়ে এরকম হ্যাংলামো করার? কিন্তু আমি বিলক্ষণ অবগত আছি, আজ ওই বাংলা দেশেই হাজার হাজার ছেলে এবং মেয়েও আছে যারা বিলেত, বিলেত কেন হটেনটটের মুলুকেও যেতে রাজি আছে পেটের ভাতের তরে। এতে অভিমান করার কী আছে?…কিন্তু সেই কথায় ফিরে যাই। নটিঙামে গিয়েছিলুম গেল বছরের সেপ্টেম্বর মাসে। সেখানে গিয়ে শুনি, ওরা ইতোমধ্যে জেনে গিয়েছে, নতুন কনজারভেটিভ সরকার কোন তালে আছেন। বিশেষ করে সিলেটিরা আমাকে তাদের দুশ্চিন্তার কথা শোনাতে গিয়ে বলল, দেশ থেকে নতুন লোক যে আর আসতে পারবে না, শুধু তাই নয়, হুজুর। দেশে যাওয়া-আসা যে প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। আমাদের বেশিরভাগেরই বউ-বাচ্চা তো ওখানে। আমি বললুম, আচ্ছা, এখানে তো ভারতের লোকও রয়েছে। তাদের সঙ্গে পরামিশ-সুপারিশ করে দেখেছ? উভয় পক্ষের বিপদ তো একই। উত্তরে যা বলল সেটা, পাঠক একটু মন দিয়ে শুনুন। বলল, হুজুর ওদের সঙ্গে আমাদের ঠিক বনে না। ওদের বেশির ভাগই শিখ। ওরা হিন্দুস্থানি বলেই যে আমাদের সঙ্গে বনে না সেটা ঠিক না বিশ্বাস করুন হুজুর। আপনিও তো হিন্দুস্থানি। আপনাকে তা হলে এসব দরদ জানাই কেন? ছুটিছাটায় যখন লন্ডন যাই, তখন পুব-পশ্চিম দুই বাংলার লোকের সঙ্গেই দেখ-ভাল মোলাকাত-মহব্বত হয়– হিন্দু-মুসলমান দুই-ই। তারার লগে কথা কইতে কুনু অসুবিস্তা অয় না, তারা আমরার দুশকো (দুঃখ) বুঝে, আমরাও তারার দুশকো বুঝি। আর এই শিখদের সঙ্গে আমাদের আরেকটা ডাঙর ফারাক আছে। এরা এদেশেই বসতি গড়তে চায়, দেশে ফিরে যেতে চায় না। তাই তারা দেশের গাঁয়ে টাকাকড়ি পাঠায় না। আর আমাদের পনেরো আনা দেশে ফিরে যেতে চায়। তাই আমরা দেশে টাকা পাঠাই– যাতে করে দেশের ভাই-বেরাদর সুখে থাকে, পুরনো বাড়ি ঘরদোর মেরামতিতে রাখে, নয়া উমদা বাড়ি বানায়। আর দেশে টাকা পাঠানোতেও বিস্তর মুশকিল। ব্যাংকের মারফতে পাঠালে দেশের লোক পাবে কম, কালোবাজারে।
বাকিটা আমি শুনিনি।… আমি মনে মনে ভাবছিলুম (১) বাঙালি বাঙালিতে কী প্রণয়! (২) বাঙালি দেশকে বড়ই ভালোবাসে। এই নটিঙামের বাঙালি মুসলমান তার প্রাণ-জিগর কলিজা পড়ে আছে সিলেটে।