নটবরের কারসাজি

নটবরের কারসাজি

নেই ছেলেটা প্রথম যেদিন মাস্টারমশাইয়ের পিছন পিছন ক্লাসে ঢুকল, গায়ে নীল ডোরাকাটা গলাবন্ধ কোট আর খাকি হাফ-প্যান্ট, চুলগুলো লম্বা হয়ে নোটানোটা কানের উপর ঝুলে পড়েছে, তেল-চুকচুকে আহ্লাদে আহ্লাদে বোকামতন ভাবখানা দেখেই আমার গায়ে জ্বর এল। আবার আমোদও লাগল, একে নিয়ে বেশ একটু রগড় করা যাবে মনে করে।

ছেলেটার পায়ে ফিতে-দেওয়া কালো জুতো একটু কিচকিচ করছিল, তাইতে নগা তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, জুতোর দামটা বুঝি আসছে মাসে দেওয়া হবে।

ছেলেটা কিন্তু কিছু না বলে খাতা-পেনসিল নিয়ে থার্ড বেঞ্চে গিয়ে চুপ করে বসল। মাস্টারমশাই বললেন, ওহে নটবরচন্দ্র, বছরের মাঝখানে এয়েচ, ভালো করে পড়াশোনা কোরো। নাম শুনে আমরা তো হেসেই কুটোপাটি, নগা তক্ষুনি তার নাম দিয়ে ফেলল– লটবহর। সত্যি নগার মতন রসিক ছেলে খুঁজে পাওয়া দায়!

টিফিনের সময় নটবরচন্দ্র একটা ছোট্ট বইয়েরমতন টিনের বাক্স খুলে লুচি আলুরদম খেয়ে, হাত চাটতে চাটতে বার বার আমাদের দিকে তাকাতে লাগল। তাই-না দেখে নগা বললে, কী রে ছোঁড়া, মানুষ দেখে বুঝি অভ্যেস নেই?

আমরা তাগ করেছিলাম, চটেমটে ছেলেটা কী করে দেখব। ছেলেটা কিন্তু খানিক চুপ করে থেকে হঠাৎমুখে হাত দিয়ে বিশ্রী রকম ফ্যাচফ্যাচ করে হাসতে লাগল।নগা রেগে বলল– অত হাসির কথা কী হল শুনতে পারি?

ছেলেটা অমনি নরম সুরে বলল– কিছু মনে কোরো না ভাই, সত্যি আমার হাসা উচিত হয়নি, কিন্তু তোমাদের দেখে আমার হঠাৎ মেজোমামার পোষা বাঁদরগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। কেবল ওই ওকে ছাড়া বলে আমাকে দেখিয়ে দিল।

নগারা রেগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল, আমি কিন্তু একটু খুশি না হয়ে পারলাম না, অল্প হেসে জিজ্ঞেস করলাম আর আমাকে দেখে কীসের কথা মনে হচ্ছে?

সে অম্লানবদনে বললে–মূলতানি গোরুর কথা।ভীষণ রাগ হল। ভাবলাম ছোটোবেলা থেকে এই যে শ্যামবাবুর কাছে স্যান্ডো শিখেছি সে কি মিছিমিছি! তেড়ে গিয়ে এইসা এক প্যাঁচ কষে দেবার চেষ্টা করলাম যে কী বলব! সে কিন্তু কী একটা ছোটোলোকি কায়দা করে এক সেকেন্ডে আমাকে আছাড় মেরে মাটিতে ফেলে দিল। ঠিক তক্ষুনি ক্লাসের ঘণ্টা পড়ল, নইলে তাকে বিষম সাজা দিতাম।

ক্লাসের পর বাড়ি যাবার পথে তার জন্য ওত পেতে রইলাম, আমি আর একটা ছেলে। দেখা হতেই সে হাসিমুখে বলল, কী হে, চীনাবাদাম খেতে আপত্তি আছে? আমরা আর কী করি একেবারে তো আর অভদ্র হতে পারি না, তাই চীনাবাদাম নিয়ে তাকে বুঝিয়ে বললাম দেখ, নতুন ছেলে এসেছিস, নতুন ছেলের মতো থাকবি, আজ দয়া করে তোর চীনাবাদাম খেলুম বলে যেন মনে করিস না যে দুপুরের কথা ভুলে গেছি।

সে বললে, রাগ কোরো না ভাই। আমি যদি জানতাম অমন হোঁতকা শরীর নিয়েও তুমি এমন ল্যাদাড়ে তবে কি আর কষ্ট করে জনসেসানিয়ান প্যাঁচ লাগাতাম, এই এমনি দু-আঙুলে ধরে আস্তে আস্তে শুইয়ে দিতাম। এই বলে আমাকে কী একটা কায়দা করে চিতপাত করে দিয়ে নিমেষের মধ্যে সে তো হাওয়া! এর থেকেই বোঝা গেল সে কী ভীষণ ছেলে! সারারাত মাথা ঘামিয়েও তাকে জব্দ করবার উপায় দেখলুম না। পরদিন সকালে ছোটোমামা বলল, কী রে ভোদা, মুখ শুকনো কেন? পেট কামড়াচ্ছে বুঝি? রোজ বলি অত খাসনি। যা বুদ্ধি এদের! বললুম–যে-বিষয়ে কিছু বোঝ না, সে-বিষয়ে কিছু বলতে এসো না।

নটবরকে না পারতে পারি, তাই বলে যে অন্যদেরও এক কথায় চুপ করিয়ে দিতে পারি না, একথা যেন কেউ মনে না করে। হাবুটার কাছ থেকেও কোনো সাহায্য পাওয়া গেল না। নিজের বেলা তো খুব বুদ্ধি খোলে, কিন্তু আমি যখন সব খুলে বলে পরামর্শ চাইলাম সে উলটে বললে, তুই আর তোর নগা না বগা, দু-টি মানিকজোড়! আমার কাছে যে বড়ো পরামর্শ চাইতে এসেছিস! ওরে ছোঁড়া, আগে পরামর্শ নেবার মতন একটু বুদ্ধি গজা!

নাক সিঁটকে চলে এলুম। হ্যাঁ! পরামর্শ আবার কী! মেয়েদের সঙ্গে আবার পরামর্শ! জানে তো কেবল হি হি করে হাসতে আর কালো গায়ে লাল জামা চড়িয়ে সং সাজতে! সাধে কি মুনি-ঋষিরা ওদের বিষয়ে ওইসব লিখে গেছেন!

ইস্কুলে গিয়ে দেখি ছেলেটা আজ ফাস্ট বেঞ্চে গিয়ে বসেছে। একদিনেই দেখি মাস্টারদের বেশ প্রিয়পাত্র হয়ে উঠল! বোকার মতন মুখ করে থাকলে সবাই অমন পারে। আর বুঝি আন্দাজে। আন্দাজে কতকগুলো সোজা সোজা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল। পড়ত ওর ঘাড়ে আমাদের সব শক্ত শক্ত প্রশ্নগুলো, তবে দেখা যেত। যাই হোক, এক দিনেই নাম করবার তার এমন কিছু তাড়াহুড়ো ছিল না।

নগা বললে–ব্যাটা খোশামুদে!

ছেলেটা শুনে বললে, ছিঃ, হিংসে করতে নেই, পরে কষ্ট পাবে। রাগে নগা হাতের মুঠো খুব তাড়াতাড়ি খুলতে ও বন্ধ করতে লাগল। গেল বছর যদি ওর টাইফয়েড না হত নিশ্চয় সেদিন একটা কিছু হয়ে যেত।

.

এমনি করে কদ্দিন যেতে পারে! শেষটা একদিন গবুই এক বিষম ফন্দি বার করল। গবুটা দেখতে রোগাপটকা, আর প্রত্যেক পরীক্ষায়, প্রত্যেক বিষয়ে লাস্ট হলে কী হবে ছেলেটার খুব বুদ্ধি আছে। সেদিন ক্লাসে এসেই সে নগাকে কানে কানে কী বলল। তাই-না শুনে উৎসাহের চোটে নগা অঙ্ক-টঙ্ক ভুল করে কোণে দাঁড়িয়ে একাকার! তাতে বরং একদিক দিয়ে সুবিধেই হল, নগা কোণে দাঁড়িয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে মতলবটা দিব্যি পাকিয়ে নিল।

সেইদিনই টিফিনের সময় নটবরকে ডেকে নগা বলল, ভাই নটবর, যা হবার তা হয়ে গেছে, একটা বড়ো দুর্ঘটনা ঘটেছে, হেডমাস্টারকে তাই একটু সাহায্য করা চাই। তুমি ক্লাসের ভালো ছেলে, তুমি বললে দেখাবেও ভালো, তা ছাড়া তোমার মতন গুছিয়ে কেই-বা বলতে পারবে?

নটবর খুশি হয়ে বলল– তা তো বটেই! ক্লাসের অর্ধেক ছেলে তোতলা, আর বাকিগুলো একেবারে গবচন্দ্র।

নগা আশ্চর্য রকমভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে ঠান্ডা হয়ে বলল– তা, তুমি গিয়ে তাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলবে যে তার বাবার শ্রাদ্ধে তুমি কয়েকজন ছেলেকে নিয়ে সাহায্য করতে চাও এই একটু সম্মান দেখাবার জন্য আর কী! বুঝলে তো? ভালো করে বুঝিয়ে বলল, এই কাল ওঁর বাবা মারা গেছেন কি না।

নটবর হাঁ করে শুনে বলল– আহা, তাই নাকি? তোমরা ভেবনা, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি। তোমরা একটু অপেক্ষা করে থাকলে ফল টের পাবে। বলে হেডমাস্টারের ঘরের দিকে চলে গেল। তার ওই টের পাওয়ার কথাটা আমার ভালো লাগল না। টের পাওয়া বলতে আমরা অন্য মানে বুঝি। সে যাই হোক গে। ক্লাসের ঘণ্টা পড়বামাত্র নটবর ছুটতে ছুটতে এসে বলল–হেডমাস্টার রাজি হয়েছেন। তোমাদের ক-জনকে এক্ষুনি ডেকেছেন কীসব কাজ বুঝিয়ে দেবার জন্য। তোমরা কী করে জানলে তাও জিজ্ঞেস করছিলেন। মনে হল খুব খুশি হয়েছেন। তোমরা এক্ষুনি যাও।

আমরা প্রথম তো অবাক! শ্রাদ্ধের কথাটা গবুর সম্পূর্ণ বানানো। কোথায় নটবর ইয়ার্কি দেবার জন্য মার খাবে, না সত্যি হেডমাস্টারের বাপের শ্রাদ্ধ! এ-রকম কিন্তু আরও হয়। আমি একবার একটা অচেনা ছেলেকে মজা দেখবার জন্য বলেছিলাম, কী হে, চাটগাঁ থেকে কবে এলে? সে বলল– কাল এলাম, তুমি কী করে জানলে? আমি অবিশ্যি আর কিছু ভেঙে বলিনি।

যাই হোক, আমরা তো গেলাম। দেখলাম হেডমাস্টার গোমড়া মুখ করে ফার্স্ট ক্লাসের ছেলেদের ইংরেজি খাতায় লাল পেনসিলের দাগ কাটছেন। আমাদের দেখে খেঁকিয়ে বললেন– কী, ব্যাপার কী তোমাদের? ক্লাস নেই নাকি, এখানে যে বড়ো দঙ্গল বেঁধে এসেছ?

নগা গলা পরিষ্কার করে বলল– আজ্ঞে, আপনার বাবার শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করতে এসেছি। এই আমরা–এইটুকু বলতেই হেডমাস্টারের এক ভীষণ পরিবর্তন হল। মুখটা লাল হয়ে বেগুনি হল, হাতের পেনসিলের মোটা সিস মট করে ভেঙে গেল, গোঁফ-চুল সবখাড়া হয়ে গেল, জোরে জোরে নিশ্বাস পড়তে লাগল। তার চোটে শার্টের গলার বোতাম ফট করে ছিঁড়ে মাটিতে পড়ে গেল। কীরকম একটা শব্দ করে আস্তে আস্তে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আমরা এতক্ষণ হাঁ করে দেখছিলাম, এবার হঠাৎ একটা বিকট সন্দেহ হল। নটবর আগাগোড়া মিছে কথা বলেছে। হেডমাস্টার ডাকেননি। সে হয়তো দেখাই করেনি! হেডমাস্টার গর্জন করে উঠলেন, জানলার খড়খড়ি কেঁপে উঠল। আমরা ছিটকে বাইরে এসে পড়লাম, তিনি ফেলে দিলেন কী আমরাই পালিয়ে গেলাম, আজও ঠিক জানি না। কাঁপতে কাঁপতে ক্লাসে ঢুকেই শুনলাম, পণ্ডিতমশাইনটবরকে বলছেন, সে কী নটবর, হেডমাস্টারের ভাইপো তুমি, সেকথা অ্যাদ্দিন বলনি!

নটবর বললে- বাবা বলেন ও সম্পর্কটা কিছু ঢাক পেটাবার মতো নয়। তা ছাড়া ইস্কুলটা বাজে। এইমাত্র কাকাকে সেই কথা বলে এলাম। তিনি তো রেগে কাই।

এমন সময় দরোয়ান এসে বলল, গবুবাবু আর ভোঁদাবাবুকে বেত খেতে হেডমাস্টারবাবু ডাকছেন।

তাই শুনে পণ্ডিতমশাইও বললেন–আর, বেত খেয়ে এসে আধ ঘণ্টা বেঞ্চে দাঁড়াবে, লেট করে ক্লাসে এসেছ।

তাই বলি পৃথিবীটাই অসার!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *