নজরুল সমীক্ষা : অন্য নিরিখে
০১.
কাজী নজরুল ইসলাম পূর্ব বাঙলার সবচেয়ে প্রিয় নাম। দুই বঙ্গেই এই নাম নিত্য উচ্চারিত এবং পূর্ববাঙলায় নিত্য আলোচিতও। এ প্রিয়তা যতখানি আবেগ সঞ্জাত, ততখানি বিচারসিদ্ধ যে নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ শতকের দ্বিতীয়-তৃতীয় দশকে বাঙালি মাত্রেই ছিল তাঁর কাব্যের রসমুগ্ধ, এবং অনুরাগপ্রসূত আবেগ-বশে তাঁকে বিদ্রোহী, বিপ্লবী, গণসংগ্রামী, সাম্যবাদী, এবং মানবতার, যৌবনের, তারুণ্যের ও স্বাধীনতার কবি প্রভৃতি নানা আখ্যায় বিভূষিত করে কৃতজ্ঞ মানুষ তাদের আকৃতির অভিব্যক্তি দিয়েছে।
তিনি বাঙালিকে চমকে দিয়েছিলেন, মাতিয়ে তুলেছিলেন ঠিকই। এবং এও সত্য যে রবীন্দ্রনাথ যে-দেশে অর্ধজীবন নিন্দা ও তাচ্ছিল্য পেয়েছেন, নজরুল প্রথম দর্শনেই পেয়েছেন বরণডালা। এটি তার প্রথম জয়।
যুদ্ধোত্তর য়ুরোপীয় বিপর্যয়, রুশবিপ্লব, বেঙ্গল প্যাক্ট, অসহযোগ, জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ড, সাইমন কমিশন, নেহেরু রিপোর্ট, কোলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, শ্রমিক ধর্মঘট, স্বরাজবাদী প্রভৃতির উত্তেজনাকর পরিবেশে নজরুলের কবিকর্মের শুরু ও চরম বিকাশ। গণসমাজের সব মতবাদীরই ঠিক মনের কথাটি প্রকাশ পাচ্ছিল তার রচনায়। কেননা তিনি কোনো একক মতে নিষ্ঠ ছিলেন না। বারোয়ারি দাবী মিটিয়েই তার আনন্দ। তাঁর বাণীও নতুন ছিল না, কারণ এক্ষেত্রে পূর্বসূরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ও যতীন্দ্রনাথ। অবশ্য পাঠক-সমাজে তাদের প্রভাব ছিল সামান্য। তার মুখ্য কারণ তাঁদের বাণী যতটা তাত্ত্বিক, ততটা বাস্তব ছিল না। কিন্তু নজরুলের দৃষ্টি ছিল বাস্তব এবং ভঙ্গি ছিল অভিনব। ফলে তাকে মনের কথার মুখপাত্ররূপে পেয়ে দেশের শিক্ষিত মানুষ হল প্রীত। এভাবে গণহৃদয়ে আসন হল তার অনায়াসলব্ধ। তখন মানুষের ঔৎসুক্য ছিল উত্তেজনার ইন্ধন সন্ধানে এবং নজরুল তা না চাইতেই দিলেন অঢেল অজস্র। কাজেই নজরুল হলেন তাদেরই একজন। এই চারণ কবিকে আশ্রয় করেই তাদের যন্ত্রণা পেল অভিব্যক্তি, উত্তেজনা পেল প্রকাশ-পথ এবং তারুণ্য ও বাহুবল হল মহিমান্বিত। নজরুল হলেন গণকবি, তারুণ্যের কবি, যৌবনের কবি, জীবনের কবি, মুক্তির দিশারী কবি। এটি তাঁর দ্বিতীয় সাফল্য।
তাঁর তৃতীয় সাফল্য আসে সঙ্গীতকার রূপে। গণমানসে এই নতুন সুরের আবেদনও ছিল তীব্র ও দ্রুত। প্রথম দুটো স্বীকৃতি এসেছে শিক্ষিত সাহিত্য-পাঠক থেকে। তৃতীয়টি এল গণমানুষ থেকে। অতএব নজরুলের জনপ্রিয়তা ছাপিয়ে উঠল রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠাকেও। এতে অবশ্য বিস্ময়ের কিছু নেই। কেননা বিশেষ স্তরের বিদ্যা, বুদ্ধি ও রুচি অর্জিত না হলে রবীন্দ্রনাথ থাকেন নাগালের বাইরে। আসলে তো এবার ফিরাও মোরে, দীনের সঙ্গী, ধূলা মন্দির, অপমানিত, সবুজের অভিযান, নববর্ষ, শঙখ প্রভৃতি কবিতায় ও গানে বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ বাঙলার তরুণদের যে আহ্বান জানিয়েছেলেন, তাতেই সাড়া দিয়েছিলেন নজরুল ইসলাম। নজরুলের আবেদন ছিল কানের কাছে–যা দৈহিক উত্তেজনা আনে ও লড়তে পাঠায় এবং যা স্বল্পপ্রাণ ও ক্ষণজীবী। আর রবীন্দ্রনাথের আর্জি ছিল বিবেক ও বুদ্ধির কাছে যা দায়িত্ববোধে প্রবুদ্ধ করে, যার ফল পরোক্ষ কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী।
.
০২.
যে পরিবেশে নজরুলের প্রতিষ্ঠা, তা আজ অপগত। এখন নজরুলকে কোনো দৃষ্টিতে দেখব, যাচাই করব কোনো নিরিখে, দৃষ্টি হবে কি ঐতিহাসিকের, নিরিখ হবে কি সাহিত্যের?
ঐতিহাসিকের বিচারে নজরুল যুগের দান ও যুগধর। তাঁর ভূমিকা ও সাফল্য সময়োচিত। তাঁর প্রয়াস ও প্রভাব উত্তেজনার মুহূর্তে গণমানসের চাহিদার আনুপাতিক। তাঁর চেতনা ও জীবনদর্শন পুরোনো ও স্থূল। সে কারণে তাঁর আহ্বান মর্মস্পর্শী ও গণ- বুদ্ধিগ্রাহ্য। কাজেই নজরুল Heor–জনমন অধিনায়ক।
উত্তেজনা জিনিসটি একমুখো বিশেষ চেতনার প্রসূন। কাজেই তা কেবল উদ্দীপক চায়, হিতাহিত পরখ করে না। অতএব নজরুলকে দিয়ে সমকালীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয়েছে, তাঁর মাধ্যমে গণবিক্ষোভ পেয়েছে অভিব্যক্তি। তাই নজরুল সফল ও সার্থক। গণমানসও কৃতার্থ এবং কৃতজ্ঞ। সুতরাং তার ভূমিকা কালিক, তাঁর সাফল্য স্থানিক এবং তাঁর প্রয়াস সাহিত্যিক।২ সদর্থেই বলা চলে, তিনি হুজুগ মিটানো যুগের কবি। তাঁর হালকা বক্রোক্তিই নিয়তি নির্দেশের মতো তাঁর সম্বন্ধে সত্য ভাষণের রূপ নিয়েছে :
বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই নবি।
ইতিহাস হচ্ছে মুখ্যত কাল-চেতনার স্বাক্ষর। এবং Literature-ও is a journalism that lasts, কাজেই নজরুল-সাহিত্য এ তত্ত্বের স্বীকৃতি অনুসারে সাময়িক নয়, চিরন্তন। এক বিশেষ দেশ-কালে মানুষের জীবন-প্রতিবেশ ও জীবন-চেতনার অক্ষয় শৈল্পিক সাক্ষ্য।
.
০৩.
কিন্তু সাহিত্যশিল্পের দাবী অন্যতর। শিল্প- নিরিখে যাচাই করলে নজরুলের ঠাই কোথায়, দেখা যাক। যাঁরা ঐতিহাসিক দৃষ্টির পক্ষপাতী, তাঁদের সঙ্গে আমাদের এখানেই ছাড়াছাড়ি। কেননা আমরা ভিন্নযুগের মানুষ। আমাদের কাছে নজরুল কেবল কবি-শিল্পী। তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ও সম্পর্ক সাহিত্যের হাটে। এখানে বক্তব্যের মূল্য কানাকড়ি, ভঙ্গির দাম অপরিমেয়, আদর্শের মূল্য গুরুতর, লক্ষ্যের প্রয়োজন স্বীকৃত, দর্শনের মিশ্রণ অভিপ্রেত। নজরুলের রচনায় আমরা কী পাই, এ তৌলে নজরুল কোথায় দাঁড়ান, খুঁটিয়ে দেখা যাক।
নজরুলের প্রথমদিককার সগ্রামী কবিতায় রয়েছে কোরান-হাদিস ও গীতা-পুরাণের বাণীর। ছান্দসিক রূপায়ণ। আস্তিক কবি ধর্মীয় চেতনার আশ্রয়ে, ধর্মীয় ঐতিহ্য ও বাণীর আবরণে তার বক্তব্য পেশ করেছেন। পুরোনো কথাই পাঠকের সুপ্ত চেতনায় তীক্ষ্ণ করে তুলবার এ এক সুপ্রয়াস মাত্র। অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী, ভাঙ্গার গান স্মর্তব্য। এক্ষেত্রে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের কবির জীবন-চেতনা কালোচিত নয়। কেননা তাঁর শাস্ত্রীয় মানবতা ন্যায় ও করুণাভিত্তিক, জীবন জীবিকার ক্ষেত্রে সম-অধিকারের অঙ্গীকারপ্রসূত নয়। তবু কবিচিত্তে অতীতের বন্ধনমুক্তির একটি লক্ষণ ছিল সুস্পষ্টতা তার গোঁড়ামিমুক্ত উদার দৃষ্টি, যে দৃষ্টি সম্প্রদায়-ভেদ মিথ্যা বলে জেনেছিল। এখানেই তাঁর আত্মশক্তির পরিচয়, তাঁর সৃষ্টির সৌন্দর্যের উৎস, এবং তাঁর কাব্য হৃদয়ভেদ্য হবার কারণ। এ পর্বে কবি মুখ্যত ন্যায়-নীতি ও আদর্শবাদের প্রেরণা সঞ্চারে প্রয়াসী। সে-প্রেরণা প্রধানত নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা এবং চেতনাপ্রসূত। তাই সর্বত্র তাঁর বাণীর বাহন ও সহগামী হয়েছে মুসলিম ঐতিহ্য ও হিন্দু পুরাণ।
দ্বিতীয় পর্বে পাচ্ছি! সাম্যবাদী, সর্বহারা, ফণিমনসা, জিঞ্জির, সন্ধ্যা ও প্রলয় শিখা। এ সময়ে কবি মানবিক আবেদনের ফলপ্রসূতায় আস্থাবান। এবার তাঁর যুক্তি দ্বিমুখো–শাস্ত্রীয় ও মানবীয়। ধর্মের দোহাই, বিবেকের দিব্যি ও মানবতার যুক্তি প্রয়োগে মানুষকে দায়িত্ব-সচেতন, কর্তব্যপরায়ণ, ন্যায়নিষ্ঠ ও সংবেদনশীল করে তুলতে কবির প্রযত্ন লক্ষণীয়। এ পর্বে কবির শাস্ত্র-চেতনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাশিয়ার সাম্য ও সমাজবাদের পরোক্ষ প্রভাব। এ স্তরে কবি তাই দ্বৈতসত্তায় দিশাহারা। আসলে ইসলামী সাম্য ও সমাজবাদের ধন বণ্টননীতির সমন্বয়ে তিনি দুকূল রক্ষায় প্রয়াসী। কেননা তার যুগে সমাজতন্ত্রে দীক্ষার পূর্বশর্ত ছিল নাস্তিক্য, তা তিনি গ্রহণ করেননি। কাজেই তিনি মার্কসীয় সমাজতত্ত্বে কিংবা লেনিনীয় সমাজ বিন্যাসে আস্থা রাখতে পারেননি। অতএব তার শ্রেণী-চেতনা তখনো ধর্মীয় সংস্কার প্রভাবিত। তাই তিনি যখন বলেন :
গাহি সাম্যের গান।
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই
নাহি কিছু মহীয়ান।
তখন তা মার্কসীয় শ্রেণীবিরোেধতত্ত্বের স্বীকৃতি নয়, বরং তার শাস্ত্রীয় মানুষ যে নুর-ই-ইলাহি ও আশরাফুল মখলুকাত কিংবা নরনারায়ণ ও জীব্ৰহ্ম—এ তথ্যের অঙ্গীকার মাত্র। কাজেই তিনি ধার্মিকের ন্যায় শাসিত প্রীতি-সুন্দর সমাজ কামনা করেছিলেন, নাস্তিকের ধন নিয়ন্ত্রণ ভিত্তিক সমাজ তাঁর অভিপ্রেত ছিল না। এক্ষেত্রে নজরুলের ভূমিকা কতকটা এ যুগের স্বধর্মপ্রিয় বুদ্ধিজীবীর মতো, যাঁরা ক্যুনিজমকে গ্রহণ করতে নারাজ, কিন্তু তার সুব্যবস্থায় ও প্রভাবে বিচলিত এবং স্বধর্মে ক্যুনিজমের ব্যবস্থাবলী সন্ধানে উৎসুক এবং স্বধর্মে কমুনিজমের নীতি ও আদর্শের মিল আবিষ্কার করে তৃপ্ত ও নিশ্চিন্ত। কাজেই মুক্তপ্রাণ হলেও নজরুল ছিলেন বদ্ধচিত্ত। তাই তিনি লড়িয়ে সৈনিক হয়েই রইলেন, জিগীষু সেনাপতি হয়ে উঠেননি। তাঁর কাব্যে তাই সমাজ ভাঙার গান আছে, গড়ার পরিকল্পনা নেই।
.
০৪.
অতএব নজরুল প্রথম পর্বে কামালপন্থী ছিলেন না, দ্বিতীয় পর্বেও ছিলেন না সমাজবাদী কিংবা ডেমোক্র্যটিক সোসিয়ালিস্ট। তিনি ছিলেন মূলত ধার্মিক। তিনি চেয়েছিলেন আল্লাহ ও বিবেকের দোহাই দিয়ে পীড়নপ্রবণ লোভী মানুষকে সংযত রাখতে, যা যে-কোনো ধর্মবাদী ও ধার্মিকের লক্ষ্য।
নজরুল ছিলেন সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক আকাক্ষার প্রচারক কোনো সূক্ষ্মতত্ত্ব বা অভাবিতপূর্ণ মহৎ আদর্শের উদ্ভাবক নন। মানুষের স্থূল চেতনায় ব্যবহারিক প্রয়োজনের তাকিদ সৃষ্টিই ছিল তাঁর সাহিত্য সাধনার লক্ষ্য। অর্থাৎ তিনি দেশের মানুষের দ্বিবিধ মুক্তি কামনা করেছিলেন–রাজনীতিক পরাধীনতার ও অর্থনীতিক পরবশ্যতার বিরুদ্ধেই ছিল তার সংগ্রাম। এ সংগ্রামে তাঁর কোনো নির্দিষ্ট অস্ত্র ছিল না, কিন্তু লক্ষ্য ছিল স্থির।
স্বদেশের স্বাধীনতাই তাঁর কাম্য ছিল বলে তিনি হিন্দু-মুসলমানের মিলন সাধনা করেছেন। এজন্যে তিনি তাঁদের কুসংস্কারমুক্ত করতে চেয়েছেন, ধর্মের অবিকৃত সারবাণী স্মরণ ও অনুসরণ করতে আহ্বান জানিয়েছেন, আচারিক ধর্মের নিন্দা করেছেন। তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ ভূমিকার মূলে রয়েছে এ আদর্শ। কবিতায় মুসলিম ঐতিহ্য এবং হিন্দু পুরাণের মিশ্রণও এ উদ্দেশ্য ও আদর্শ প্রণোদিত। হিন্দু-মুসলিম মিলন না হলে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম হবে অসম্ভব। ফলে স্বাধীনতা থাকবে অনায়ত্ত। মুসলিম ঐতিহ্য ও হিন্দু পুরাণের নির্বিচার বহুল ব্যবহার তাঁর কাব্যকে করেছে হিন্দু মুসলমানের হৃদয়গ্রাহী। তাঁর উদাত্ত আহ্বান তাই সাড়া দিয়েছে উভয় সম্প্রদায়ের সমধর্মী মানুষের মন।
স্বদেশবাসীকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করবার জন্যে তিনি আরো এক পন্থা গ্রহণ করেছিলেন–আফ্রো-এশিয়ার পরাধীন জাতির মুক্তিসংগ্রামী নেতাদের প্রশস্তি গান রচনা করেছিলেন। আকস্মিক যোগাযোগে (accidental coincidence) তাঁরা ছিলেন মুসলিম অধ্যুষিত দেশের মুসলিম নেতা। কাকতালীয় ন্যায় প্রয়োগে নজরুল হলেন মুসলিম জাগরণের চারণ কবি Pan Islamist যারা তাকে বিশ্বমুসলিম জাতীয়তাবাদী ঠাওরিয়ে উল্লসিত হলেন, সেই শিক্ষিত মুসলিম বাঙালিরাও স্বস্থ ছিলেন না, তাঁরা তখনো জামালুদ্দীন আফগানীর প্রভাবে অভিভূত। এবং নিজেরা নিঃস্ব ও অসমর্থ বলে জ্ঞাতির সৌভাগ্যস্বপ্নে আনন্দিত। তাই কোনো কৃতীপুরুষ আরবি-ফারসি নামধারী হলেই, তার গৌরব-গর্বে তাঁরা হতেন স্ফীত। এজন্যেই যে কামাল আতাতুর্ক কোরান পুড়িয়ে, মসজিদ ভেঙে এবং আরবি ছাড়িয়ে তুর্কীজাতিকে নবজীবন দানে হলেন প্রয়াসী অর্থাৎ ইসলামের কবলমুক্ত করেই বাঁচাতে চাইলেন স্বজাতিকে, তিনিই এদেশী মুসলমানদের চোখে হলেন মুসলিমদের জাতীয় বীর ও ইসলামের ত্রাণকর্তা। স্বয়ং নজরুল ইসলাম এঁদের অন্যতম।
যদিও নজরুল pan Islamist ছিলেন না, তবু স্বধর্মীপ্রীতির সংস্কার তাঁরও ছিল। এখানেও তাঁর দ্বৈতসত্তা। Pan Islamist নন অথচ একপ্রকার ধর্মীয় জাতীয়তায় আস্থা রাখেন। ফলে তিনি কখনো দেশগত জাতি নির্মাণে ব্রতী, কখনোবা ধর্মীয় স্বজাতির কীর্তি ও কর্ম থেকে প্রেরণা সঞ্চয়ে উদ্যোগী। অবশ্য তিনি হিন্দু-মুসলমানের স্বাতন্ত্রের মধ্যেই ঐক্যকামনা করেছেন, অভিন্ন জাতিরূপে গড়ে তোলা সম্ভব, ভাবেননি। অর্থাৎ পারস্পরিক প্রীতির সম্পর্কে নয়–সহিষ্ণুতার ভিত্তিতে সমস্বার্থে সমবেত হতে আহ্বান জানিয়েছেন মাত্র। এটি বাস্তব পন্থার কাছাকাছি কিন্তু বাস্তব নয়। কেননা সমস্বার্থে মিলনের আগে স্বার্থ ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে বোঝাঁপড়া দরকার। এটি রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, নজরুল নয়।
নিপীড়িত জনতার দারিদ্র্যমুক্তির ব্যাপারেও তিনি কোনো নতুন মতাদর্শের অনুসারী ছিলেন না। ধর্মীয় চেতনার মাধ্যমে তিনি শোষক-পীড়কদের ন্যায়নিষ্ঠ ও কৃপাবান করতে চেয়েছিলেন। সামন্ত সমাজের অশোভন অসঙ্গতি থেকে বিবেকবান সমাজে উত্তরণই যেন তাঁর কাম্য ছিল। তাই তিনি কুলি-মজুর-চাষীর প্রতি সুবিচার দাবী করেছেন। মার্কসীয়তত্ত্বের অনুসরণে কিংবা লেনিনীয় সমাজের অনুকরণে ধন বণ্টনভিত্তিক শ্রেণীহীন সমাজ নির্মাণ তাঁর অভিপ্রেত ছিল না। এখানেও তিনি শাস্ত্রানুমোদিত অথচ কিছুটা মার্কসবাদ সমর্থিত আদর্শ সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন। এ একপ্রকার গোঁজামিলে দুকূল রক্ষার প্রয়াস। তাই তিনি যন্ত্রের পরিবর্তন চাননি–যন্ত্রজ পদার্থকে প্রতিপক্ষ ভেবে গাল দিয়েছেন জমিদার, মহাজন, সওদাগর ও কল মালিককে। এখানেও তার সেই দ্বৈতসত্তা প্রত্যক্ষ করি। এর কারণ নজরুলের চেতনায় কোনো সংস্কার-মুক্তি ছিল না। পরিবেশ থেকে পাওয়া নতুন ভাব-চিন্তা তার অন্তরের রক্ষণশীলতার ও সংস্কারাচ্ছন্নতার মূলোচ্ছেদ করতে পারেনি। ফলে তাঁর প্রগতিবাদিতা তথা নতুন চিন্তানুরাগ বাহ্যাড়ম্বর ও বাগাড়ম্বররূপে ত্বকে প্রলিপ্ত চন্দনের মতো আভরণ হয়ে কিংবা অঙ্গে মর্দিত তৈলের মতো লাবণ্য হয়েই রইল, তাঁর কাব্যে এটি মর্মবাণী হয়ে উঠল না।
.
০৫.
প্রতিভা কেন, কোনো মানুষেরই মত-পথ ধ্রুবতায় অবসিত হয় না। কেননা অভিজ্ঞতার আলোকে মত বদলাতে হয়, পাল্টাতে হয় পথ। এ অসঙ্গতি সব প্রতিভারই চেতনায় ও কর্মে সুলভ। এটি বরং চলমানতার ও গতিশীলতার লক্ষণ, অগ্রগতির ও উত্তরণের পরিমাপক। কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে স্ববিরোধ–দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ও অস্থিরতারই সাক্ষ্য। নজরুলে এই স্ববিরোধ অত্যন্ত প্রকট। স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে সন্ত্রাসবাদ এবং শোষণ মুক্তির জন্যে সাম্যবাদ তাঁর প্রিয় হলেও তিনি একাধারে নিয়মতান্ত্রিক, গান্ধীপন্থী, কামালপন্থী, গণবিপ্লবী, সমাজ-সংস্কারক, চরকা-মাহাত্ম প্রচারক, লীলাবাদী আধ্যাত্মিক ও মরমী, সর্বসংস্কারমুক্ত, ভৌতিক বিশ্বাসে অভিভূত, স্বধর্মনিষ্ঠ ও নাতে আসক্ত এবং শ্যাম-শ্যামা সঙ্গীতে আগ্রহী।
এমনকি তিনি কোরআনের মুমীন অনুবাদক এবং রসুলজীবনের ভাষ্যকারও। কোরআনে আল্লাহ বলেন, আমি যাকে ঐশ্বর্য দিই, তাকে বেহিসাব অপরিমেয় দিই। আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করি। এবং রসুল ন্যায়নিষ্ঠায়, অনুকম্পায় ও দানে দীক্ষা দিয়েছেন, ধনবৈষমের নিন্দা করেননি। শাস্ত্র ও সাম্যবাদের মহিমা একই সঙ্গে উচ্চারণ নীতি-নিষ্ঠার অভাবপ্রসূত।
কোনো একক প্রত্যয় তাকে একনিষ্ঠ করেনি বলেই যা-কিছু তার কল্পনা-উদ্দীপিত করেছে, যা-কিছু তার বক্তব্যের অনুকূল, তা তিনি নির্বিচারে গ্রহণ করলেন এবং মত-পথের বিচার না করেই স্বাধীনতার সংগ্রামী মাত্রকেই সমান আগ্রহে করেছেন অভিনন্দিত। আবার কার্যকারণ বিচার না করেই ধনীকে জেনেছেন অপরাধী, ভেবেছেন শত্রু। নিজে নিঃস্ব ও দুঃস্ব বলেই তিনি নিপীড়িত মানবতার প্রতি সহানুভূতিশীল, নির্যাতিত মানবতার বিক্ষুব্ধ নায়ক। কিন্তু তার অবচেতন লক্ষ্য ছিল বুর্জোয়া ঐশ্বর্য ও বুর্জোয়া বিলাস। তাই ধনিক-বণিকদের হত্যা করে ধ্বংস করে তাদের ঐশ্বর্য ভোগ করতে চেয়েছেন তিনিঃ
এই ক্ষুধার জোরেই করব এবার সুধার জগৎ জয়।
—কৃষাণের গান
সংবেদশীলের যে মানবতাবোধ বুর্জোয়াকে স্বস্বার্থবিরোধী গণসংগ্রামে অনুপ্রাণিত করে, নিঃস্ব নির্যাতিত মানুষের দুঃখ মোচনে উদ্বুদ্ধ করে, নিজের কায়েমী স্বার্থ ও নিশ্চিত আরামের জীবন ত্যাগের তাকিদ দান করে, নজরুলের মানবতাবাদ সে শ্ৰেণীর নয়। এ অনেকটা স্বস্বার্থে সংগ্রাম এবং জৈবিক উত্তেজনা প্রসূত, তাই এ তমঃগুণজাত। এ কারণে এত দূরদৃষ্টি নেই–স্থায়ী সমাধান পন্থার নির্দেশ এতে অনুপস্থিত। শ্ৰেণীহীন সমাজ গড়ে তাতে নির্বিশেষ মানুষের কল্যাণ তিনি চাননি। কেননা ধনবৈষম্য তাঁর অনভিপ্রেত নয়। কেবল বুভুক্ষা-নগ্নতা-নিরাশ্রয় মুক্ত সমাজই তার। কাম্য যা ঐশ্বর্যশালী পুঁজিবাদী সমাজে দুর্লভ নয়। অতএব কুলি-মজুর-চাষীর জন্যে অন্ন, বস্ত্র, গৃহ সংস্থানই তাঁর লক্ষ্য, তা যেভাবেই হোক–দয়ায় বা দাবীতে।
এখানে রবীন্দ্রনাথের একটি গানের কলি মনে পড়ছে :
চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে।
নজরুলেরও মনটি ছিল ঠিক চোখের কোলেই। তিনি যা দেখেছেন, তাই বলেছেন, ভাবেননি কিছুই। তিনি চোখের আনুগত্যে চলেছেন, অন্তরের নির্দেশ পাননি। এর একাধিক গূঢ় কারণ আছে নিশ্চয়ই। সেগুলোর একটি শিক্ষাগত আর একটি আবেগসঞ্জাত।
.
০৬.
নজরুল দুটো বিষয়ে ব্যুৎপন্ন ছিলেন। একটি পাঁচশ বছর আগেকার ফারসি সাহিত্য এবং অন্যটি দুই-আড়াই হাজার বছর পূর্বেকার হিন্দু-পুরাণ। অথচ আমাদের আজকের জীবনবোধ ও শিল্পচেতনা পাশ্চাত্য শিক্ষায় লব্ধ। আধুনিক বাঙলা সাহিত্য তো ইংরেজি সাহিত্যেরই প্রতিরূপ। সেই কারণেই মোহিতলাল নজরুলকে একটি সৎ পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাঁকে ইংরেজি সাহিত্য পাঠ করতে বলেছিলেন। তিনি তা গ্রহণ করেননি। আধুনিক জীবনবোধ বিকাশের জন্যে সমকালীন সাহিত্য, বিজ্ঞান ও দর্শন পাঠ আবশ্যক ছিল। নজরুল সে শিক্ষা গ্রহণ করেননি। নজরুলের জন্মের পূর্বেই ডারুইন, মার্কস ও ফ্রয়েড মানুষের জগতে ও জীবনে কালান্তর ঘোষণা করেছেন। এই তিনজনকে অবহেলা করে আধুনিক মানুষ হওয়া চলে না। নজরুলের কাছে ডারুইন ও ফ্রয়েড অজ্ঞাত আর মার্কস অবহেলিত। কাজেই তার বন্ধুরা তাঁর সম্বন্ধে সত্য কথাই বলেছিলেন :
পড়ে না কো বই, বয়ে গেছে ওটা।–কবির কৈফিয়ৎ
ফলে কাব্যের ক্ষেত্রে তিনি কেবল লাটিমের মতো ঘুরেছেন, অগ্রসর হননি মোটেই। ভাব ভাষা ছন্দ কিংবা ভঙ্গির ক্ষেত্রে তাঁর কাব্যে আবর্তন আছে, বিবর্তন নেই। কোনো নতুন অভিজ্ঞতার আনন্দে, কোনো নতুন প্রত্যয়ের ঐশ্বর্যে, কোনো নতুন সৃষ্টির সাফল্যে, কোনো নবলব্ধ চেতনার চাঞ্চল্যে, কোনো নবাবিষ্কৃত সত্যের প্রসঙ্গে তার জীবন কিংবা সাহিত্য উত্তরণের পথ খুঁজে পায়নি। জীবনে, সমাজে ও সাহিত্যে তিনি অন্ধের মতো কেবলই ছুটোছুটি করেছেন–বিপ্লবীরূপে, ধার্মিকরূপে, মরমীরূপে, প্রেমিকরূপে। শ্রান্ত হয়েছেন, সফল হননি।
নব নব কিশলয় মাধ্যমে বৃক্ষ বেড়ে ওঠে, আত্মবিস্তার করে। নজরুল-প্রতিভাকে বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করা চলে না। তাঁর প্রতিভা গুল্ম-জাতীয়–সহজে স্বপ্রতিষ্ঠ, নাতিবৃদ্ধি ও স্বল্পজীবী। ১৯২২ থেকে ১৯৩২ সনের মধ্যেই তার আকস্মিক উন্মেষ, বৈদ্যুতিক বিকাশ ও বেলুনীয় পরিণতি! এ সময়ের মধ্যে আম-জাম-বেগুন-বরইর মতোই তাঁর সৃষ্টি অঢেল অজস্র! বাকি বারো বছরের ফসল সামান্য, বৈশিষ্ট্য বর্জিত, নিস্পন্দ ও ম্লান। অথচ তখনো তিনি প্রৌঢ় নন, যৌবনের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে মাত্র।
.
০৭.
নজরুল তাঁর মন ও মস্তিষ্কের অদ্বয় সহযোগিতা পাননি কোনোদিন। হৃদয়বৃত্তিই ছিল তাঁর সম্বল। তাই তিনি সর্বত্র আবেগ চালিত। আবেগ পরিমিতি মানে না। তাই তাঁর রচনায় পরিমিতি দুর্লভ। অতিকথন তাঁর গল্পে উপন্যাসে নাটকে প্রবন্ধে এবং গানে কবিতায় সর্বত্র দৃশ্যমান। এই আবেগ বিহ্বলতা, এই উচ্ছ্বাসের অপ্রতিরোধ্যতা তার গল্প উপন্যাস নাটক প্রবন্ধ মাটি করেছে। গান ও কবিতা দুঃসহ হয়নি অন্য কারণেএস কথা পরে হবে। এমকি সামান উৎসর্গপত্র কিংবা মুখবন্ধও উচ্ছ্বাসের আত্যন্তিকতায় ফেনিল। আবেগ উচ্ছ্বাস স্থানকাল বিশেষে ভালোই, এমনকি প্রয়োজনীয়ও। কিন্তু সার্বত্রিক প্রয়োগে তা শিল্পকলাকে নষ্ট করে, বক্তব্যকে করে লঘু ও নিষ্ফল। উচ্ছ্বাস মুখ্য হলেও গল্পে উপন্যাসে নাটকে রূপক-রচনায় নজরুল ইসলামের ব্যর্থতার অন্য কারণও রয়েছে। গল্প উপন্যাস নাটক লেখার প্রতিভা নজরুলের সামান্যই ছিল। এতে মস্তিষ্কের প্রয়োজন বেশি, হৃদয়বৃত্তির স্থান সামান্য। ভূয়োদর্শন, পরিবেষ্টনী চেতনা, মানবিক বৃত্তি-প্রবৃত্তির গতি-প্রকৃতি জ্ঞান, ব্যক্তির পারস্পরিক আচরণের ও বাহ্য ঘটনার আন্তর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অভিজ্ঞতা, মনস্তত্ত্বের ধারণা এবং প্রজ্ঞা প্রভৃতির সমন্বিত সামর্থ্যেই সম্ভব গল্প উপন্যাস নাটক সৃজন। নজরুলে এগুলো সুলভ ছিল না। তাই তাঁর পরিকল্পিত কাহিনী শিথিলগ্রন্থি, তাঁর অঙ্কিত চরিত্র নির্বণ ও বৈশিষ্ট্য বর্জিত। তার বক্তব্য তাৎপর্যহীন। সংলাপ প্রায় অপ্রতিরোধ্য প্রলাপ ও জীবনবোধ সংকীর্ণ। অবশ্য খণ্ডচিত্র দুর্লভ নয়, মনোহর বাণীমূর্তিও সুলভ। এবং কোনো কোনো প্রবন্ধ সুখপাঠ্য। ভাষাও স্থানে স্থানে হৃদয়গ্রাহী, কিন্তু সামগ্রিক সৌন্দর্য দুর্লক্ষ্য।
.
০৮.
আরো দুটো বিষয়ে তার প্রবল আগ্রহ ছিল-ছন্দে ও শব্দে। ছন্দের ক্ষেত্রে সত্যেন্দ্রনাথের প্রবল প্রভাব অনুকৃতি ও অনুসৃতির পথে তাকে ছন্দো-স্রষ্টার মর্যাদায় উন্নীত করে। আরবি-ফারসি ছন্দের আদলে বাঙলা ছন্দ সৃষ্টি করে তিনি বাঙলা ছন্দে বৈচিত্র্য ও বিস্তার দান করেছেন, তেমনি সুরের ক্ষেত্রেও তিনি অনেক নতুন ও মিশ্র রাগ-রাগিণীর স্রষ্টা।
রবীন্দ্রনাথের ভাষার প্রভাবও নজরুলে ছিল গভীর। রবীন্দ্র-কাব্যের ও গানের বহু Phrase নজরুল হুবহু গ্রহণ করেছেন, তাঁর অনেক বাক্যাংশ কিংবা চরণাংশও দুর্লভ নয় নজরুলের কাব্যে। নজরুল আরবি-ফারসি শব্দ প্রয়োগের প্রেরণা পেয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ও মোহিতলাল থেকে। এ বিষয়ে সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন মোহিতলালেরও গুরু।
দেশী মুসলমানরা দৈশিক ও ভাষিক পরিচয়ে বাঙালি। এবং আরব-উদ্ভূত ধর্মে বিশ্বাসী। বাঙালি হিসেবে সব মুসলমানেরই দৈশিক ঐতিহ্য ও পুরাণের–যা নামান্তরে হিন্দুর ও হিন্দুয়ানীর সঙ্গে অল্পবিস্তর পরিচয় ঘটে এবং ধর্মীয় সূত্রে আরব-ইরানি ঐতিহ্য ও পুরাণেরও কিছু কিছু জানাশোনা থাকে। ফলে মুসলমান মাত্রেই হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্য ও পুরাণের সঙ্গে পরিচিত। এবং যেহেতু হিন্দুর দৈশিক ও ধার্মিক ঐতিহ্য ও পুরাণ অভিন্ন, তাই হিন্দু মাত্রই কেবল দৈশিক নামান্তরে হিন্দুর–ঐতিহ্য ও পুরাণই জানে। এরই অপব্যাখ্যায় নজরুল বা মুসলিম লেখক উদার বলে প্রশংসিত, আর রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি হিন্দু লিখিয়েরা নিন্দিত হয়েছেন গ্রহণ-বিমুখ সংকীর্ণচিত্ত বলে।
বলেছি নজরুল অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এই দ্বিবিধ ঐতিহ্য ও পুরাণ আয়ত্ত করেছিলেন। এবং মুসলিম ঐতিহ্যের ও হিন্দু পুরাণের সার্বত্রিক সুপ্রয়োগে নতুন রস ও লাবণ্য লাভ করেছে তার কবিতা ও গান। এজন্যেই তাঁর কবিতা ও গানে অতিকথন দোষ, আবেগপ্রাধান্য, চটুল ছন্দের বহুল প্রয়োগ, শিথিল বাকৃবিন্যাস, ভাবগত স্ববিরোধ ও অসংলগ্নতা এবং পৌনপুনিকতা দোষ সহসা দৃষ্টিগোচর হয় না। নইলে এমনও দেখা যায় পৌরাণিক রূপ-প্রতীকাদি কিংবা তাঁর প্রিয় শব্দগুলো প্রয়োগ করবার লোভে বক্তব্য শেষ হওয়ার পরেও তিনি কবিতা দীর্ঘ করেছেন। এতে কবিতায় ভাবগত স্ববিরোধ ও অসঙ্গতি প্রশ্রয় পেয়েছে, ফলে কাব্যে রসাভাস ঘটেছে। বিদ্রোহী, দারিদ্র্য, পূজারিণী, সিন্ধু প্রভৃতি বহু শ্রেষ্ঠ কবিতায় এ দোষ লক্ষণীয়। আর এই ঐতিহ্য ও পুরাণ সংপৃক্ত উপমা-রূপক-উৎপ্রেক্ষার বহুল প্রয়োগ নেই বলেই তাঁর উচ্ছ্বাসপূর্ণ গদ্য রুচিবান পাঠকের পক্ষে প্রায় অসহ্য।
আসলে ভঙ্গিও নয়, বক্তব্যও নয়, মুসলিম ঐতিহ্যের ও হিন্দু পুরাণের সুষম দেদার অঢেল অজস্র ব্যবহারই নজরুলের কবিতা ও গানকে লোকপ্রিয় করেছে। তাঁর কবিগৌরব এতেই লব্ধ, তার জনপ্রিয়তা এতেই প্রতিষ্ঠিত, তাঁর বৈশিষ্ট্য এতেই সুপ্রকাশিত।
.
০৯.
নজরুলের প্রেমের কবিতা ও গান সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য সামান্য। নজরুল বলেছেন বটে : মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ তুর্য কিন্তু তাঁর অন্তরলোকেও দেখছি দুটো আলাদা কোঠা। একটি অপরটি থেকে পাকা দেয়ালে বিচ্ছিন্ন। এ-কক্ষ ও-কক্ষ দুটো সদর-অন্দরের মতো একেবারে ভিন্ন জগৎ, ভিন্ন আলো আকাশ, বিপরীত আবহাওয়া। এক কক্ষে আগুন, অপর কক্ষে অশ্রু। এখানেও কবির দ্বৈতসত্তা প্রকট।
একই কালে তিনি শোষণ, পীড়ন, ভণ্ডামি, পরাধীনতা, কুসংস্কার প্রভৃতির বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ চিত্তে সংগ্রামী কবিতা যেমন লিখেছেন, তেমনি নারীপ্রেমের কোমলকান্ত পদও রচনা করেছেন, তেমনি লিখেছেন নাত কিংবা শ্যাম-শ্যামাসঙ্গীত। অথচ একভাব কোনো ক্রমেই অন্যভাবকে প্রভাবিত করেনি, লজ্ঞান করেনি, করেনি আচ্ছন্ন। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার, কবির আশ্চর্য দক্ষতার স্বাক্ষর, এবং আমাদের কাছে বিস্ময়কর সংবাদ। এ কি গভীর বোধ, প্রত্যয় ও নিষ্ঠার অভাবপ্রসূত! এ কি চঞ্চল চিত্তের অস্থির প্রকাশ সঞ্জাত অথবা এ ধীরচিত্ত প্রতিভার এক আশ্চর্য প্রকাশ! না কি একটা মিটিংকা বাত, অপরটা অন্তরঙ্গ আলাপ! এর হদিসের জন্যে কবির ব্যক্তিক জীবনের অনুষঙ্গ জ্ঞান আবশ্যক।
অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশীর সঙ্গেই পাচ্ছি দোলন চাঁপা, ছায়ানট, পুবের হাওয়া; আবার ভাঙার গান, সাম্যবাদী, সর্বহারা, ফণিমনসা ও জিঞ্জিরের পাশে পাই বুলবুল, চোখের চাতক, চক্রবাক; পুনরায় পাচ্ছি সন্ধ্যা ও প্রলয় শিখার সঙ্গে চন্দ্রবিন্দু। কিন্তু যতই অবাক হই, এও নজরুলের পক্ষে সম্ভব এবং সত্য ছিল।
নজরুলের প্রেমের গান ও কবিতা বৈচিত্র্যবিহীন। Pangs of separation and disappointment-ই তার প্রেমের কবিতা ও গানের প্রধান সুর। তার পত্রোপন্যাস বাঁধনহারায় এর প্রথম উন্মেষ। না-পাওয়ার বেদনা, পেয়ে হারানোর জ্বালা, অবহেলা প্রাপ্তির ক্ষোভ, ভুলতে না-পারার যন্ত্রণা, সাধাসাধির ব্যর্থতায় হতাশা, পাওয়া-না পাওয়ার অবমাননা, প্রিয়ার স্মৃতির সঞ্চয়ে ঠাই না-পাওয়ার ব্যথা, মিলনোক্কণ্ঠা, বিচ্ছেদ শঙ্কা, আনন্দিত স্মৃতির বিষাদ, বিরহ বিধুরতা, অতৃপ্তির অস্থিরতা, প্রতিদান না-পাওয়ার দাহ প্রভৃতিই তাঁর প্রেমবিষয়ক বিভিন্ন কবিতায় ও গানে অভিব্যক্ত।
এ প্রেমে সূক্ষ্ম ও মহৎ দর্শন নেই। এ নিতান্ত শারীর ও নির্লক্ষ্য। একনিষ্ঠতাও নেই। কবি বহুবল্লভ। আছে কেবল হৃদয়ের আকৃতি ও প্রণয়-বিহ্বলতা। একটা অসহ্য আবেগ, একটা অদম্য আকর্ষণ, একটা অসীম উৎকণ্ঠ, একটা অশেষ বাসনা, একটা অসহ্য অতৃপ্তি কবিকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে কাঁদিয়ে মারছে। বৈষ্ণব পদাবলীর রাধাও এমনি বিচলিতা, এমনি হতভাগিনী। তবু বিপ্রলব্ধ পর্বে-পূর্বাগে প্রেমবৈচিত্র্যে মানে প্রবাসে উপলক্ষ্য ও অনুভূতির বৈচিত্র্য আছে। নজরুলের কাব্যে তা দুর্লভ। তাই একই অনুভূতির পৌনপুনিকতা পীড়াদায়ক। মনে হয় একটা অকারণ ক্ষোভ, একটা অহেতুক বেদনা, একটা অগভীর অতৃপ্তি ও একটা কৃত্রিম বিরহ বাঞ্ছ বা বিলাস যেন কবিকে পেয়ে বসেছে। নজরুলের প্রেমের কবিতায় ও গানে তাই ক্ষোভ, কান্না ও বিলাপই মুখ্যত দৃশ্যমান। বহু-বল্লভের এই শারীর-প্রেম কবিকে কোনো বোধের তথা উপলব্ধির জগতে উত্তীর্ণ করেনি। তাই এ প্রেম নজরুলের চৈতন্যস্বরূপ হয়ে ফোটেনি।
.
১০.
এবার গানের কথা বলি। সত্য বটে নজরুল অজস্র গান রচনা করেছেন। তাঁর গানের সংখ্যা কেউ বলেন দু-হাজার, কেউ বলেন তিন হাজার। সুরস্রষ্টা হিসেবেও তিনি প্রখ্যাত। বিদেশের ও বিভাষার নানা সুর বাঙলা গানে সংযোজিত করে এবং অনেক মিশ্ররাগ নির্মাণ করে তিনি গানের আকাশ করেছেন বিস্তৃত, সঙ্গীতশাস্ত্রকে করেছেন ঋদ্ধ। তাঁর গানের কথা ও সুর সঙ্গীতরসিকদের মুগ্ধ করেছে। তাঁর গানের স্বীকৃত বিশিষ্টতা রবীন্দ্রসঙ্গীতের মতো নজরুলগীতিরও গর্বিত স্থূল বা খান্দান গড়ে তুলেছে। গানের জগতে নজরুলের দিগ্বিজয়ী জনপ্রিয়তা-মুগ্ধ কোনো কোনো গুণী ও বিদ্বান এমনও মনে করেন যে, কাজের ক্ষেত্রে যাই হোক, গানের ভুবনে নজরুল অমর এবং তাঁর গান ও সুর থাকবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অবিনশ্বর। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, দুনিয়ায় অক্ষয় অবিনাশী কিছুই নেই। রবীন্দ্রনাথের গান যেমন কাব্য হিসেবেও সুন্দর ও ভাবগর্ভ অর্থাৎ তাতে ভাব, ভাষা, ছন্দ যেমন আছে, তেমনি আছে সূক্ষ্ম গভীর বাণীও। নজরুলেরও অনেক গান তেমন সব গুণে ঋদ্ধ। কিন্তু আধুনিক গানের তোড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতই পিছিয়ে পড়ছে, নজরুল গীতই বা কি টিকবে! কালান্তরে পুরোনো সুর টেকে না বলেই গান নশ্বর। যুগে যুগে যুগোপযোগী সুরই যুগের চাহিদা মিটায় এবং কালান্তরে তা বিলীন হয় কালগর্ভে। মানুষ চিরকালই সুখে দুঃখে, কাজে অকাজে, ভয়ে ভক্তিতে, দ্বন্দ্বে সগ্রামে গান গেয়েছে বটে, কিন্তু তা কখনো অপরিবর্তিত থাকেনি। বৈদিক বন্দি গন্ধর্বের গায়ত্রী বন্দনা থেকে আজকের আধুনিক গান অবধি সঙ্গীতের এদেশী বিবর্তন ধারাই আমাদের এ ধারণার সমর্থক। কালে কালে মানুষের মন বদলায়, বদলায় রুচি। তাছাড়া ভাষা আর সুরও বদলায়। কাজেই মনের সঙ্গে কথা এবং ভাষার সঙ্গে সুরের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তাই তো আমাদের কীর্তন, গাজন, গম্ভীরা, রামপ্রসাদী যেমন সাধন-ভজন সংপৃক্ত হয়েও লুপ্তপ্রায়, তেমনি মানবিক সুখ দুঃখের গানও অতিক্রান্তকালে চিরদিনই হয়েছে বিলুপ্ত। বাউলগান, ব্রহ্মসঙ্গীত, দ্বিজেন্দ্র-রজনী-অতুল-মুকুন্দের গানই বা আজ আর কে গায়! কাজেই মর্মান্তিক হলেও এ সত্য অস্বীকার করা চলবে না যে রবীন্দ্র-নজরুলসঙ্গীতও আগামী পঞ্চাশ বছরও টিকবে না।
.
১১.
নজরুলের অনেক অপূর্ণতার কথাই বলা হল বটে, কিন্তু তবু একটা প্রশ্ন থেকে যায়। গীতিকবি তো দার্শনিক কিংবা সমাজকর্মী নন, তাঁকে নানা দায়ে দায়ী করার সার্থকতা কী? স্বেচ্ছায় যা দিয়েছেন বা দিতে পেরেছেন, এবং আমরা যতটুকু আনন্দ ও প্রেরণা পেয়েছি বা পাচ্ছি তা তো যথালাভ। তাছাড়া সাধারণ পাঠকের কাছে তিনি আজকের পরিবেশেও অম্লান সূর্য, প্রাণময়তার উৎস। তার ছিল তাজা, তরুণ ও উচ্ছল প্রাণ। সেই প্রাণের স্পর্শে দেশে জেগে উঠেছিল লক্ষ প্রাণ। আজো তেমনি জাগে, কেননা তিনি যে-পরিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করেছিলেন, তা আজো অবিলুপ্ত। তাই আজ বাঙলার সবকিছু ভাগ হয়েছে। ভাগ হননি কেবল নজরুল। এজমালি সম্পদরূপে তাঁর এই স্থিতিই প্রমাণ করে যে নজরুল এত বিচ্যুতি সত্ত্বেও সার্থক ও সফল কবি। বাঙলার ও বাঙালির তিনি আজও মনের মানুষ, হৃদয়ের ধন, সংগ্রামের প্রবর্তনদাতা নায়ক। এক হৃদয়ের প্রীতি অন্য হৃদয়েও অনুরাগ জাগায়। সীমিত ও সংকীর্ণ অর্থে নজরুলও মানবতাবাদী ও মানবপ্রেমিক। তাঁর বিদ্রোহের জড় রয়েছে এই মানবতাবোধে। মানবপ্রীতিই তাঁকে বিদ্রোহী ও নিষ্ঠুর সংগ্রামী করেছিল। তিনি বলেছেন, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। তাঁর সেই অভিলাষ পূর্ণ হয়েছে। নজরুল দীন-দুঃখী-নিপীড়িত মানুষকে ভালোবাসতেন, তাই শোষক- পীড়করা ছিল তার শত্রু। স্বদেশের কৃতজ্ঞ মানুষের কাছে তিনি প্রাণপ্রিয় হয়েই আছেন। তাই তারা তাঁকে ভুলেনি, ভুলবে না, ভুলতে পারবে না। জয়তু নজরুল।