নজরুল-জিজ্ঞাসা
প্রিয়জন ও শ্রদ্ধাভাজনের গুণকীর্তন ও দোষ-খণ্ডন মানব-স্বভাব। শ্রদ্ধাবানেরা একে পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মনে করেন। ভাল কবিতার কবি এবং ভাল কাজের কর্তাও প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয়। কাজেই তার কথা বলতে আবেগজাত অভিভূতি, শ্রদ্ধাপ্রসূত দোষগুপ্তি এবং পক্ষপাত দৃষ্টি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে। কেননা, অনুরক্ত মাত্রই অনুগত হয়। অনুরাগ স্বভাবতই আনুগত্য দান করে। তাই সব জনপ্রিয় কবি-লেখক কিংবা সমাজ-ধর্ম-রাষ্ট্রনেতা সম্বন্ধেই অনুরাগীরা প্রশস্তিমুখর ও বিচারবিমুখ।
কিন্তু সাধারণ মানুষের স্বভাব যা-ই হোক, ঐতিহাসিকের কিংবা সমালোচকের ভূমিকায় যারা অবতীর্ণ, তাদের পক্ষে এ দুর্বলতা দায়িত্ব ও কর্তব্যভ্রষ্টতা। এ দুর্বলতা যারা অতিক্রমণের সামর্থ্য অর্জন করেননি, তাঁদের পক্ষে লেখনী ধারণ অনুচিত। কারণ বাস্তব প্রতিবেশে সত্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দেয়াই ঐতিহাসিক ও সমালোচকের দায়িত্ব। মিথ্যার প্রলেপে ক্রুর ও রূঢ় সত্য আবৃত করলে ইতিহাস ও সমালোচনার ফলশ্রুতিলব্ধ প্রাপ্তি ও প্রজ্ঞা থেকে সমাজ বঞ্চিত থাকে। ফলে চেতনার ও মননের জ্ঞানজ বিকাশধারা হয় বিকৃত। না বললেও চলে যে খণ্ড ও ভুল জ্ঞানের চাইতে অজ্ঞতা শতগুণে শ্রেয়। উপকার করবার অধিকার সবার থাকলেও ক্ষতি করার অধিকার স্বীকৃতি পায় না। ঐতিহাসিক ও সমালোচক হবেন সত্যসন্ধ, ন্যায়নিষ্ঠ ও বিবেকানুগত। আমাদের ঐতিহাসিক ও সমালোচকদের মধ্যে এসব গুণ বিরলতায় দুর্লক্ষ্য।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রসঙ্গেই এ ভূমিকাটির অবতারণা। আমাদের পূর্ব বাঙলায় নজরুল আজকাল বহুল আলোচিত ঘরোয়া কবি। প্রবন্ধের তো সংখ্যাই নেই, তার সম্বন্ধে লেখা বড় ছোট বইয়ের সংখ্যাও দিনদিন বেড়ে চলেছে। কিন্তু সে অনুপাতে আমাদের নজরুল সম্পর্কে জ্ঞান ও বোধ বৃদ্ধি পাচ্ছে না বরং বিভ্রান্তি বাড়ছে। তার মুখ্য কারণ, সমালোচনা যে অংশত গবেষণাও এবং সমালোচককে প্রয়োজনমতো যে, ঐতিহাসিক আর গবেষকের দায়িত্বও পালন করতে হয়, তা আমাদের সমালোচকগণ যেন স্বীকার করেন না। তাই তত্ত্ব ও তথ্য, সত্য ও শ্রুতি, স্মৃতি ও সদিচ্ছা, বাস্তব ও কল্পনা তাদের চোখে একাকার এবং ভালকথা ও সত্যকথা তাঁদের কাছে একই মূল্যে বিকায়। প্রতিজ্ঞায় (Promise-এ) যদি ভুল থাকে, সিদ্ধান্ত সত্য হতে পারে না। অঙ্গীকারে গলদ সিদ্ধান্ত অসার্থক করবেই। প্রস্তাবের ফাঁকির দরুন প্রাপ্তিতে প্রবঞ্চনার ফাঁক থাকবেই।
কবিও মানুষ। তাই তারও রয়েছে গৃহগত জীবন, তাঁরও মন-মেজাজ গড়ে উঠে ধার্মিক, আঞ্চলিক, সামাজিক, শৈক্ষিক, আর্থিক ও প্রতিবেশিক প্রভাবে। কাজেই এই পারিবেশিক পটে অর্জিত চেতনার পরিপ্রেক্ষিতেই আত্মপ্রকাশ করে মানুষ তার প্রাত্যহিক আচরণে। অতএব, ব্যবহারিক কিংবা মানসিক কোনো অভিব্যক্তিই স্থান-কাল প্রসূত চেতনা-নিরপেক্ষ নয়। কবি-কৃতি বুঝবার জন্যে যার মন-মননের সন্ধান নিচ্ছি, তার মন-মনন কখন কোথায় কেমন করে লালন পেয়েছে, তা যদি না জানি তাহলে সিদ্ধান্ত মিথ্যা হতে বাধ্য। খণ্ডদৃষ্টি কেবল খণ্ড সত্যের সন্ধান দিতে পারে এবং খণ্ড সত্য মিথ্যারও অধম এবং ক্ষতিকর।
নজরুল সম্বন্ধীয় গ্রন্থের নাম যদিও নজরুল চরিত-মানস, নজরুল-সমীক্ষা, নজরুল-প্রতিভা প্রভৃতি তবু এগুলোতে আবেগের উচ্ছ্বসিত প্রকাশ যতখানি আছে, তথ্যবিচার ও সত্য নির্ধারণের প্রবণতা ততখানি নেই। ফলে সমালোচনাগুলো আলোড়িত আবেগ উঁচুমাত্রায় প্রকটিত করেছে বটে, যথার্থ মূল্যায়নের সহায়ক হয়নি।
নজরুলকে পাঠকের বোধগত করবার জন্যে যেসব গ্রন্থকার ও সংকলকের প্রয়াস, তাদের কাছেই তাদের বিবেচনা-প্রত্যাশায় নজরুল সম্পর্কিত আমদের কয়েকটি জিজ্ঞাসা পেশ করছি :
১. ১৮৯৯ সনের ১১ জ্যৈষ্ঠ যে নজরুল ইসলামের জন্ম–এ তথ্য কোনো প্রমাণে স্বীকৃত? একি পারিবারিক লিখিত কাগজ সূত্রে না বিদ্যালয়ে ভর্তির খাতার প্রমাণে?
২. সম্রাট শাহ আলমের আমলে এ পরিবার কোথা থেকে চুরুলিয়ায় এলেন? এঁরা কোন্ কাজীর বংশধর? শাহ আলমের আমলে বাঙলা দেশে বসতি করে দু-তিন পুরুষের মধ্যে বাঙালি হয়ে উঠেছে, তেমন ভদ্র পরিবারের নজির বিরল। বিশেষত পলাশীর যুদ্ধোত্তরকালে অবাঙালিরা উত্তরভারতের দিকেই হিজরত করছিল। সেখান থেকে তখন এদেশে লোক আসার সাক্ষ্য বিরল।
৩. দশ-এগারো বছর বয়সেই লেটোর দলের গান বাঁধার যোগ্যতা অর্জন স্বাভাবিক নয়। কচি বালকের প্রতিভার এমন বিকাশের তথ্য কোন্ সূত্রে সংগৃহীত?
৪. গায়ের গরিবের ছেলে নজরুল মাঝে মাঝে পড়া ছেড়েছেন, রেল-গার্ডের বাসায়, রুটির দোকানে চাকরিও করেছেন, অমনোযোগ ও উচ্ছলতার খবরও মেলে, তবু সতেরো-আঠারো বছর বয়সেই দশম শ্রেণীতে পড়ছেন, দেখতে পাই। এ-ই বা কোন্ যাদুবলে সম্ভব?
৫. চুরুলিয়ায় যখন ছিলেন, তখন নজরুল নিতান্ত বালক। সে বালকই ইমামতি করেছেন, আর মুসলমানেরা সেই বালকের মুবতদী হয়ে নামায পড়ছে–যোগ্যতা ও বৈধতার কোনো প্রশ্নই উঠল না?
৬. রেল-গার্ডের বাসায় নজরুল কী ঘটিয়েছিলেন?
৭. রুটির দোকানে নজরুল যে-কাজে নিযুক্ত (ময়দামাখা, রুটি-তৈরি ও বিক্রি) তাতে গান গাইবার অবকাশ ছিল কী? হারমোনিয়ামই বা সেকালের রুটির দোকানে যোগাড় হল কী করে?
৮. আলি আকবরের ভাগ্নী নার্গিস বেগম এখনো হয়তো জীবিতা এবং ঢাকাবাসিনী। সম্ভবত আলি আকবর সাহেবও জীবিত আছেন। তা ছাড়া কবি আজিজুল হাকিমের সঙ্গে পরে নার্গিস বেগমের বিয়ে হয়েছিল। আলি আকবর সাহেবের গায়েও তার শত্রু-মিত্রের অভাব নেই। নজরুলের জীবনীকার কিংবা কাব্য-সমালোচকদের কেউ এ যাবত সদ্য-বিয়ে-করা বউয়ের সঙ্গে নজরুলের বিচ্ছেদের কারণ সন্ধানে উৎসুক হননি। অথচ কোন্ কোন্ কবিতায় এ বিচ্ছেদ-বেদনার প্রভাব পড়েছে তাও আলোচিত হয়েছে। তাহলে এ ব্যাপারে তাদের এমন ঔদাসীন্যের কারণ কী?
৯, মা জাহেদা খাতুনের প্রতি সন্তান নজরুলের বিরূপতার কারণ আবিষ্কারেও কেউ উদ্যোগী হননি। মুসলিম সমাজে মা যদি চাচার কাছে নিকাহ্ বসে থাকেন, তাতে কী অন্যায় আছে যে লেখকগণ তা গোপন করতে চান? তাঁদের সঙ্কোচের ফলে এমন একটি নির্দোষ ব্যাপারও রহস্যময় হয়ে উঠে এবং পাঠকের মনে বীভৎস কল্পনা প্রশ্রয় পায়।
১০. নজরুল যখন লব্ধপ্রতিষ্ঠ কবি, লিখে টাকা পাচ্ছেন, তখনও তার ঘন ঘন আর্থিক সঙ্কট দেখা দেয়ার কারণ কেউ উল্লেখ করেন না। গান বেঁধে কিংবা পত্রিকা সম্পাদক হয়েও তার অভাব ঘোচেনি, কিন্তু কেন? একি নেশা করতেন বলে?
১১. তার রোগের উৎপত্তি ও বিস্তারের কারণও কেউ চিকিৎসকদের থেকে জানবার চেষ্টা করেননি। এ রোগের লক্ষণও কেউ বর্ণনা করতে চাননি। একি নেশা করার পরিণাম?
১২. তাঁর বৃদ্ধা বিধবা শাশুড়ি গৃহগত কোন্ বিসম্বাদের ফলে নির্লক্ষ্য নিরাশ্রয় জীবন বরণ করলেন, তারও কোনো হদিশ মেলে না এদের আলোচনায়।
১৩. নজরুলের যদি ইসলামেই আস্থা থাকে, তাহলে কালী-সাধনার প্রেরণা পেলেন কী করে? আর ঘরোয়া জীবনে যদি তিনি কুসংস্কারপ্রবণ ও ভূত-ভীরু হন, তাহলে তার বিপ্লব-বিদ্রোহ মূলক কবিতা কিংবা আচারিক ধর্মবিরোধী বাণী কৃত্রিম ফরমায়েশী রচনা হয়ে যায় না কী?
১৪. তাঁর অনিচ্ছা সত্ত্বেও যদি তাঁর পারিবারিক আবহাওয়া হিন্দুয়ানী হয়ে থাকে, তাহলে তাঁর যে কোনো ব্যক্তিত্ব ছিল না, তা স্বীকার করতেই হয়। অথচ এসব নিদর্শন কোনো কেতাবে মেলে না।
১৫. স্ত্রী ও শাশুড়ির প্রভাবে ও প্রতাপে যদি হিন্দুয়ানীতেই তিনি সমর্পিত চিত্ত এবং সে কারণেই যদি ছেলেদের খত্না না করিয়ে থাকেন, তাহলে প্রমীলা নজরুলের চিতার বদলে কবর হল কী করে?
১৬. মানুষ নজরুলের চরিত্রে কী কোনো দোষ-দুর্বলত ছিল না কেবলই গুণ এবং সবই ছিল গুণ? সগুলোয় বর্ণনা থাকে না কেন?
১৭. তাঁকে পাকিস্তানের জাতীয় কবি বলেই প্রচার করা হয়। পাকিস্তান ও মুসলিম জাতীয়তা সম্বন্ধে তাঁর পরিব্যক্ত অভিমত নবযুগের সম্পাদকীয় প্রবন্ধ ও কবিতার আলোকে আলোচিত হয় না কেন?
এমনি নানা জিজ্ঞাসার পূর্ণাঙ্গ জবাব না থাকলে আলোচনা-সমালোচনা যে বৃথা ও ব্যর্থ তা উপলব্ধি করবার সময় আজ সমাগত। কেননা, কবি জীবনৃত। যেখানে জিজ্ঞাসা নেই, সেখানে উত্তরও অনায়ত্ত। আর উত্তরই যে জ্ঞান, তা কে না বোঝে! অতএব যে-প্রয়াস জ্ঞান দেয় না, বোধের বিকাশ ঘটায় না, তা পণ্ডশ্রম মাত্র। পাঠকের পক্ষে বিভ্রান্তিকর এমনি গ্রন্থরচনার উৎসাহ না-থাকাই শ্রেয় ও বাঞ্ছনীয়।