নজরুল-কাব্যে বীর ও বীর্যপ্রতীক

নজরুল-কাব্যে বীর ও বীর্যপ্রতীক

যদি আমরা বিশ্বাস করি, যে-কোনোকিছুর উপযোগ ও ফলপ্রসূতা তার স্বকালেই সীমিত, তাহলে কোনোকিছুই কালজয়িতা ও চিরন্তনতার জন্যে আমাদের উৎকণ্ঠা ঘুচাবে। আসলে চিরন্তনতার কামনা একটি মানসমোহ ছাড়া কিছু নয়। এটি আবেগের প্রসূন, উপযোগ-বুদ্ধি কিংবা প্রয়োজন চেতনার ফল নয়। প্রকৃতির জগতে ফুল-পাতা, অথবা আম-জাম, কলা-মূলা স্বল্পজীবী, তাই বলে কোনো অর্থেই তাদের জীবন মিথ্যে বা ব্যর্থ নয়। তেমনি মানুষের জীবনে ও সমাজে কোনোকিছুরই উপযোগ চিরস্থায়ী নয়–অন্তত তার স্থানিক, কালিক ও ব্যক্তিক উপযোগ ভেদ ও রূপান্তর আছে। কোনো পুরাতনই নতুনকালের নতুন মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারে না। এই তাৎপর্যে নতুন মানে বর্তমান আর পুরাতন অতীতেরই প্রতীক। সকালে যা নতুন, অতিক্রান্তকালে তাই হৃতউপযোগ পুরাতন।

এই দৃষ্টিতে নজরুল-কাব্য আজো নতুন। তার উপযোগ ও প্রয়োজন আজো বর্তমান। কেননা আমাদের সমাজে, ধর্মে, অর্থনীতিতে ও রাজনীতিতে আজো রূপান্তর ঘটেনি। নজরুল-বিঘোষিত সগ্রাম ও সগ্রামের উদ্দেশ্য আজো সফল হয়নি। লক্ষ্য আজো অনায়ত্ত, মঞ্জিল আজো অদৃষ্ট। তাই নজরুল আজো প্রিয়নাম। নজরুল-কাব্য আজো অবশ্যপাঠ্য। এ-কারণেই বাঙলার সবকিছু ভাগ হয়েছে, ভাগ হয়নি নজরুল। পর হয়ে যাননি তিনি কারো–তাই তাকে নিয়ে আজো দুই বঙ্গে এত টানাটানি ও কাড়াকাড়ি।

বলাবাহুল্য, নজরুল ছিলেন বিপ্লবী ও বিদ্রোহী। তিনি উপায়নিষ্ঠ ছিলেন না বটে, কিন্তু তাঁর লক্ষ্য ছিল অবিচল। এ-ও সত্য যে, তিনি রাজনীতিক জটিলতা বুঝতেন না। কিন্তু বৈপ্লবিক চেতনা ছিল তাঁর গভীর ও তীব্র। তাঁর মন ও মস্তিষ্কের মেলবন্ধন ছিল না বলেই তাঁর ভাবকর্ম যতটা আবেগ-চালিত, ততটা মনীষা-নিয়ন্ত্রিত ছিল না। রক্তপিচ্ছিল সহিংস বিপ্লবই তাঁর প্রিয় ছিল, তবু তিনি অভীষ্ট সিদ্ধির অন্য উপায়কেও অভিনন্দিত করেছেন। তার অস্থির অথচ অকৃত্রিম আগ্রহ ও সমর্থন ছিল সব পদ্ধতিরই প্রয়োগ-প্রয়াসে।

সমাজ ও ধর্মবুদ্ধির সংস্কারে, আর্থিক জীবনের রূপান্তরে এবং রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা অর্জনে তাঁর আকুতি-আকুলতার তীব্রতাই তাঁকে মারি অরি পারি যে-কৌশলে মতে প্রবর্তনা দিয়েছিল। এসব কিছুর মূলে রয়েছে শোষিত-পীড়িত মানুষের প্রতি দরদের গভীরতা। তা ছাড়া আরো একটি অবচেতন প্রেরণা হয়তো ছিল–সেটি আত্মত্রাণের; কেননা তিনিও ছিলেন নিঃস্বদের একজন। এই দ্বৈতকারণের সমন্বয়ে তাঁর বাণী তীব্র, তীক্ষ্ণ ও অকৃত্রিম যেমন হয়েছে, তেমনি হয়েছে ক্ষুব্ধ, কুদ্ধ ও বঞ্চিত ব্যক্তির প্রাত্যহিক জীবনের তুচ্ছ আবেগে ভারগ্রস্ত।

এ কারণেই জাগ্রত জীবনের আহ্বানে যারা বুকের রক্ত দিয়ে কঠিন মাটি নরম ও উর্বর করে, যারা পলাশলাল সূর্যের অনুধ্যানে আনন্দিত, যারা খুন-রাঙা তরুণ তপনের আকর্ষণে চঞ্চল, যারা আত্মাহুতির উল্লাসে মত্ত, যারা বাঁচবার আগ্রহে মৃত্যুবরণ করে চরম তাচ্ছিল্যে, যারা মহিমান্বিত মৃত্যুর সঞ্চয়ে ও জাগ্রত জীবনের ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ করে দেশ ও জাতিকে; তাদেরই বন্দনা গেয়েছেন। কবি। তাদেরকেই তিনি জেনেছেন দেশ-জাত-মানুষের ত্রাণকর্তা বলে। যৌবনে ও তারুণ্যে তাঁর প্রত্যয় ছিল প্রবল। তার দৃঢ় বিশ্বাস–চিরকাল এমনি তরুণেরাই নর-দানবের পাশব শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে লড়ে আত্মাহুতি দিয়ে দেশ-জাত-মানুষকে পীড়ন থেকে, শোষণ থেকে ও অপমৃত্যু থেকে বাঁচিয়েছে। তাই যার মধ্যেই এই প্রাণপ্রাচুর্য, এই তারুণ্য, এই যৌবনদীপ্তি ও সংগ্রামী স্পৃহা প্রত্যক্ষ করেছেন; দেশ-কাল-জাতের গণ্ডী অতিক্রম করে তিনি তারই প্রশস্তি রচনা করেছেন। তাদের নামে সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করতে চেয়েছেন দেশের তরুণদের। প্রবুদ্ধ তারুণ্যের ও জাগ্রত যৌবনের বন্দনায় তিনি মুখর থেকেছেন সর্বক্ষণ।

শাসক-শোষক-পীড়ক এক রক্ত-খেকো রাক্ষুসে শক্তি। বাঘ-সিংহের মতোই তার লোভ ও হিংস্রতা। বুকের রক্ত দিয়েই তার মোকাবিলা করতে হয়। পার্থক্য কেবল এই, বাঘ-সিংহ রক্ত খেয়ে হয় পুষ্ট এবং আরো লুব্ধ, আর রক্তের স্পর্শে চুন-লাগা জেঁকের মতো কাবু হয়ে পড়ে ঐ দানবীয় শক্তি, গণরক্তের বিষক্রিয়ায় তার শক্তি-ভাণ্ড হয় জর্জরিত। এজন্যেই রক্তের বিনিময়ে আসে মুক্তি। দানবীয় রাক্ষুসে শক্তির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিংবা সম্মুখসমরের জন্যে তাই তরুণের তাজা টকটকে লাল রক্ত প্রয়োজন।

অতএব রক্তদানের অঙ্গীকারে নজরুলের গণসংগ্রামের শুরু এবং যারা এভাবে বুকে বুলেট কিংবা গলায় ফাঁস গ্রহণ করেছে, তারাই নজরুলের ব্যবীর। আর যারা মুক্তিসংগ্রামে বুকের রক্তদানে উৎসুক তারাই তাঁর ভরসাস্থল। সংগ্রাম-সুন্দর রক্ত-ঝরা দিন এবং রক্ত-রাঙা মাটিই তাঁর স্মৃতির সঞ্চয় ও ঐতিহ্যের আকর। তাই মৃত্যুর মহিমান্বিত রূপের অনুধ্যানে তার আনন্দ। নতুন সৃষ্টির সুখ-উল্লাসই তাঁকে প্রবর্তনা দেয় পুরোনো সবকিছুর ধ্বংস সাধনায় এবং জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ-স্বপ্নই মৃত্যুবরণ করে উৎসাহিত। এই ধ্বংস ও মৃত্যুর ভয়াল রূপের অন্তরে রয়েছে কল্যাণ সুন্দর রূপ :

জরায় মরা মুমূর্ষদের
 প্রাণ লুকানো ঐ বিনাশে–
এবার মহানিশার শেষে
আসবে ঊষা অরুণ হেসে
করুণ বেশে।
 দিগম্বরের জটায় লুটায়
শিশু চাঁদের কর
আলো তার ভরবে এবার ঘর।

 কাজেই,

 ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর?
প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন।
আসছে নবীন জীবনহরা
অসুন্দরে করতে ছেদন।

কেননা,

ভেঙে আবার গড়তে জানে।
সে চির-সুন্দর।

এই ভয়ঙ্কর আসে দুরন্ত, দুর্মদ, দুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, অথচ গণকল্যাণকামী রক্ত-মাতাল মৃত্যু-মাতাল তরুণরূপে। তাই বেদুঈন, চেঙ্গিস, পরশুরাম, দুর্বাশা, জমদগ্নি, নটরাজ, বিশ্বামিত্র, খালেদ, উমর, হায়দর, কামাল, আনোয়ার প্রভৃতি তার কাছে পৌরুষের আদর্শ। এ দুর্বার বিদ্রোহ ভৃগুর মতোই ভগবান-বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেয়ার স্পর্ধা রাখে।

কবির প্রিয় ধ্বজা রক্তরঙিন, তাঁর প্রিয় ফুল জবা ও পলাশ, তাঁর প্রিয় পোশাক লাল-গৈরিক, তাঁর প্রিয় শরাবও রক্তরাঙা; তার সংগ্রামী প্রেরণাও হয়তো এসেছিল লালফৌজ থেকে, তাঁর আসমানও খুন-খারাবির রঙ মাখা, তাঁর বিপ্লবের ঘোড়াও রুধির-লাল-রক্ত অশ্ব। তাঁর প্রিয় শাড়ি লাল, কেননা তার বিশ্বাস রক্ত-দান ও গ্রহণ- সামথ্যেই মানবিক সমস্যার সমাধান। তাই তিনি শক্তিরূপিণী দেশমাতৃকার অঙ্গে কামনা করেছেন রক্তাম্বর, হাতে চেয়েছেন খুনরাঙা তরবারি, ললাটে দেখতে চেয়েছেন সিঁদুরের বদলে কালচিতার রাঙা আগুন এবং আরো কামনা করেছেন দেশমাতার চরণ-আঘাতে উদগারে যেন আহত বিশ্ব রক্ত-বান, এবং বুকে-মুখে-চোখে রোষ হুতাশন, নয়নে তার ধূমকেতু জ্বালা উঠুক সরোষে উদ্ভাসি। আর জালিমের বুক বেয়ে খুন ঝরে লালে লাল হোক শ্বেত হরিৎ।

যখন ছোটে রক্ত উদধি এবং ফেনা-বিষ ক্ষরে গলগল যখন ছোটে রক্ত-ফোয়ারা বহ্নির বান, যখন কোটি বীর প্রাণে–শত সূর্যের জ্বালাময় রোষ গমকে শিরায় গমগম, যখন স্বর্গমর্ত্য পাতাল-মাতাল রক্তসুরায়, বিধাতাও ত্রস্ত; তখনই কেবল দানবীয় শক্তির ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। কামাল পাশা, আনোয়ার পাশা, রণভেরী, কোরবানী প্রভৃতি কবিতায় তাঁর বীর ও বীরত্বের আদর্শ সুপ্রকট। রক্ত ও মৃত্যু, প্রাণদান ও গ্রহণ, হিম্মত ও খঞ্জর বীরের নিত্যসঙ্গী–বলা চলে জীবনচর্যার অবলম্বন। খুনে খেলব খুন-মাতন এই হচ্ছে বীরব্রত। রণ-বিপ্লব-রক্ত বর্জিত মুক্তি তার কল্পনাতীত। বাহুবল ও মনোবল ব্যতীত প্রতিকার প্রতিরোধের অন্য কোনো উপায় তার মনে ঠাই পায়নি।

তার কল্পনা উদ্দীপ্ত হয়েছে রণ, রক্ত, রুদ্র, শক্তি, ঝড়, সূর্য, বহ্নি, মৃত্যু প্রভৃতি অবলম্বনে। এগুলোকে তিনি বল-বীর্যে প্রতীকরূপে গ্রহণ করেছেন। তেমনি ন্যায়, কল্যাণ ও অধিকারের প্রতীক হয়েছে সত্য। আর সবকিছুর গোড়ায় রয়েছে অহংবোধ–আমিত্ব তথা আত্মপ্রত্যয়। এটিই তাকে আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে দিয়েছে প্রবর্তনা।

কিশোর বয়সেই নজরুল ইসলাম সৈন্যদলে ভর্তি হয়েছিলেন। পল্টনী ব্যায়ামেই তাঁর সৈনিক জীবন সীমিত। লড়াইয়ের কল্পচিত্র (যেমন ভার্দুনট্রেঞ্চ) ও বীরত্বের স্বপ্ন-সুন্দর জীবন তার মন হরণ করেছিল। বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকলে হয়ত তিনি এত রণ-রক্ত প্রিয় হতে পারতেন না, সহিংস বিপ্লবেও হয়তো থাকতো না তার এত আগ্রহ। ক্ষুধা-যন্ত্রণা-মৃত্যুশাসিত সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতা ছিল না বলেই Chivalry যুগের কুইকসোটি প্রেরণার প্রভাব ছিল গভীর ও ব্যাপক। তাঁর সংগ্রামী কবিতায় তাই রক্ত-অগ্নি-ঝড় মৃত্যুই পেয়েছে প্রাধান্য। ত্রাস ও ধ্বংসকর মহাশক্তির অনুধ্যানেই তাঁর আনন্দ, সত্যের প্রতিষ্ঠা শক্তি দিয়েই সম্ভব–এই তার বিশ্বাস। কাব্যের ক্ষেত্রে এই প্রলয়ঙ্কর ভয়াল ভৈরবত্বের আবহ সৃষ্টির জন্যে প্রায় প্রতি কবিতায় হাইফেন-যোগে তিনি অসংখ্য বাপ্রতিমা নির্মাণ করেছেন। তাঁর মনোনীত ছন্দের বন্ধনে তাঁর নির্মিত বাক্-খণ্ডও উত্তেজিত মানুষের আবেগচালিত অনর্গল বক্তৃতার মতো করে তুলেছে তাঁর কবিতাগুলোকে। রুদ্ধশাসে যেন অনবসর জীবনের কথাগুলো বলে শেষ করতে পারলেই আবেগ-ভারাক্রান্ত মানুষটি স্বস্তি পান। আবেগের তাপে মুখে যেন তার খই ফুটছে, পটকার মতো গর্জে উঠছে যেন এক-একটি কথা।

অগ্নি-ঋষি, বহ্নি-রাগ, অগ্নি-মরু, বেদন-বেহাগ, অগ্নি-সুর, রক্ত-শিখা, প্রলয়-নেশা, মৃত্যুগহন, বজ্র-শিখা, প্রাণ-লুকানো, রক্ত-তড়িৎ, সৃজন-বেদন, বজ্ৰ-গান, শাসন-ত্রাসন, চুম্বন-চোর-কম্পন, রৌদ্র-রুদ্র, হিম্মত-হ্রেষা, অগ্নি-পাথার, নভ-তড়িৎ,বহ্নি-ফিনিকি, লাল-গৈরিক, রোষ-হুঁতাশন, রক্ত উদধি, ফেনা-বিষ, রক্ত- ফোয়ারা, রক্ত-সুরা, মন-খুনী, খুন-খচা, রক্ত-অশ্ব, জ্বালা-ক্রন্দন-কুর, বিষ-মদ-চিকুর, ফণা-ছায়া-দোল, অশুভ-অগ্নি-পতাকা, মমতা-মানিক, বিষ-অভিশাপ-সিক্ত, অগ্নি স্নান, অগ্নি-ফণী, সোহাগ-সুখ-ছোঁওয়া, জরজর শোক, বহ্নি-সিন্ধু, আঁসু-পরিমল, হারামণি-পাওয়া হাস্য, রক্ত-পাথার, ক্রন্দন-ঘন, জীবন-ফাগুন, মালঞ্চ-ময়ুর-তখৃত, ধ্বংস-বন্যা, শক্তি-বস্ত্র, বহ্নি বীর্য, অগ্নি-মন্ত্র, মুক্তি-তরবারি, উল্কাপথিক, মাভেঃবিজয়মন্ত্র, ফন্দি-কারার, গণ্ডী-মুক্ত, ভয়-দানব, অমর-মর-সিন্ধু-তীর, রক্ত-যুগান্তর, স্বরাজ-সিংহদুয়ার, দেশ-দ্রৌপদী, দুঃশাসন-চোর, জাত-শেয়াল, জাত-জুয়ারী, বহ্নি-লিখা, মুক্তি-শখ, মৃত্যু-শোণিত এলকোহল, প্রাণ-আঙুর, আকাশ গাঙ, স্নেহ সুরধুনী, গ্রহণ-বালা, বোলতা-ব্যাকুল–এমনি আরো শত শত বাক-মূর্তি রয়েছে তাঁর কাব্যে। বস্তুত এগুলো তার মনোভঙ্গির–তার মানস বা Style-এর পরিচয়বাহী এবং হয়তো অসম্ভুত আবেগেরও প্রমাণক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *