নগ্ন সত্য – অনুবাদক: কমলা রায়

নগ্ন সত্য

‘মরে গিয়েও বুঝলে বন্ধু, মরে গিয়েও মানুষ নিজস্ব একটা আস্তানা চায়। যদি পয়সাওয়ালা মড়া হয় তা হলে তো কথাই নেই— বেশ ভাল আস্তানা তার দরকার, সুখে স্বচ্ছন্দে থাকবে— মার্বেল পাথরের উপর সুন্দর কাজ করা কবর না হলে কি চলে! তার উপর যদি দু’ হাতে বিলোবার মতো পয়সা থাকে তা হলে তো কবরের ওপর আমার মতো একজন বড় শিল্পীর তৈরি একটা বিরাট… বিরাট… কী বলে কথাটা?… রূপক, হ্যাঁ, একটা বিরাট রূপক বানিয়ে নিতে না পারলে মন ভরবে কেন? সুন্দর পাথরের তৈরি কবর— তার উপর ল্যাটিন ভাষায় লেখা… Hic Jacet… তলায় লেখা মৃত ব্যক্তিটি কেমন মানুষ ছিলেন বা ছিলেন না… চারদিকে ফুলে ফলে ভরা ছোট্ট বাগান… তারপর কুকুর তাড়ানোর জন্যে ঝকমকে লোহার রেলিং আর তারপর…’

সারা সকাল হাড়ভাঙা খাটুনির ফলে কনস্তানতিনো পলিয়ানির মুখ-চোখ লাল, কপাল দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। সে আর চুপ করে থাকতে পারল না, বলে উঠল, ‘আঃ, থামো! জ্বালাতন করে মারলে!’ সিরো কল্লি এতক্ষণ বুকের উপর মুখ গুঁজে বকবক করছিল। বন্ধুর বিরক্তিতে সে আঁকশির মতো বাঁকানো ছাগলদাড়ি সমেত মুখ তুলে পলিয়ানির দিকে তাকাল। তারপর, যেন অনেক ভেবেচিন্তে মনস্থির করে বন্ধুর সম্বন্ধে নিজের মতামত প্রকাশ করল শুধু একটি মাত্র কথা বলে— ‘গাধা!’

ওই একটি কথায় যেন পলিয়ানির সম্বন্ধে কল্লির যা কিছু বক্তব্য ছিল সব শেষ হয়ে গেল।

একটু আগেই পলিয়ানি সোফাটি আর সোফার সামনেকার ছোট্ট কার্পেটটি খুব যত্ন নিয়ে পরিষ্কার করেছিল। সিরো কল্লি তার লম্বা পা দুটো কার্পেটের উপর ফাঁক করে ছড়িয়ে নিশ্চিন্ত আরামে এসে সোফায় বসল। স্টুডিয়োটা পলিয়ানি পরিষ্কার করার জন্যে প্রাণপণে চেষ্টা করছিল— বাস্টগুলো এমনভাবে সাজিয়ে রাখছিল যাতে সেগুলোকে দেখায় খুব ভাল। একজিবিশন থেকে ফেরত-আসা ওর নিজের তৈরি প্লাস্টারের পুরনো ধুলোমাখা মূর্তিগুলো স্টুডিয়োর পিছন দিকে সরিয়ে রেখে, ভবিষ্যতে যেসব মূর্তি সে একজিবিশনে পাঠাবে সেগুলো সামনের দিকে ভাল করে সাজিয়ে রাখছিল, নিজে এত খাটছে আর বন্ধুটি আরামে বসে বাজে বকছে এই ভেবে ভারী বিরক্ত বোধ করছিল পলিয়ানি, অনেকক্ষণ বিরক্তিটা চাপবার চেষ্টা করে, শেষকালে অধৈর্য হয়ে বলে উঠল, ‘বাজে কথা রাখো, তুমি এখান থেকে যাচ্ছ কি না তাই বলো!’

নির্বিকারভাবে বন্ধু জবাব দিল, ‘উঁহু।’

‘দোহাই তোমার, অন্তত যে দিকটা আমি পরিষ্কার করেছি সেদিকটায় বসে আবার নোংরা কোরো না।’ বলল পলিয়ানি। ‘কতবার তোমায় বলব যে কয়েকজন মহিলার আজ এখানে আসবার কথা আছে।’

‘বাজে কথা, আমার বিশ্বাস হয় না।’ কল্লি জবাব দিল।

বিরক্তিতে প্রায় ফেটে পড়ে পলিয়ানি বলল, ‘বিশ্বাস না হয় এই চিঠিটা দেখো। কাল কমান্ডার সেরাল্লির কাছ থেকে এসেছে এই চিঠি, এই দেখো, লিখেছেন— “শ্রদ্ধাস্পদেষু, আপনাকে একটা খবর দেবার আছে। আগামীকাল বেলা প্রায় এগারোটার সময়—” ’

‘এগারোটা এখনও বাজেইনি,’ বাধা দিয়ে বলে উঠল কল্লি।

‘অনেকক্ষণ এগারোটা বেজে গেছে!’ বলল পলিয়ানি।

গম্ভীরভাবে কল্লি বলল, ‘এবারেও বিশ্বাস করতে পারলাম না। যাক, পড়ো চিঠিখানা।’

পলিয়ানি পড়ে চলল, ‘আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন সিনোরা কন… কন… কী যেন নামটা?’

সত্যি যেন সাহায্য করতে সে খুব ব্যগ্র এমনিভাবে কল্লি বলল, ‘নামটা নিশ্চয় কনফ্যুশিয়াস?’

‘কন্ত… না, বোধহয় কনসালভি… ঠিক পড়তে পারছি না। “তিনি আর তাঁর মেয়ে আপনাকে কোনও একটা মূর্তি তৈরি করতে দেবার জন্যে দেখা করতে যাবেন। আমার স্থির বিশ্বাস” ইত্যাদি ইত্যাদি। কী, বিশ্বাস হল তো এবার?’ পলিয়ানি বলল।

মুখটা আবার বুকের উপর গুঁজে কল্লি আস্তে আস্তে বলল, ‘চিঠিটা নিজের নামে নিজেই লেখোনি তো হে?’

হাসবে কি কাঁদবে ঠিক করতে না পেরে হতাশ হয়ে পলিয়ানি বলে উঠল, ‘ইডিয়ট!’

কল্লি এবার রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে আঙুল নেড়ে জবাব দিল, ‘উঁহু, হল না। ওই একটি কথা আমাকে বলতে পারবে না— কথাটা আমি রীতিমতো অপমানকর মনে করি। সত্যিকার ইডিয়ট হলে কীরকম আমি হতাম জানো? তা যদি হতাম, তা হলে আমি আর সবাইকে করুণার দৃষ্টিতে দেখতাম— পোশাক পরতাম ভাল, জুতো পরতাম ভাল; আর সুন্দর একটা টাই লাগাতাম! কী রঙের টাই জানো? ওই যে কী বলে— হেলিয়োপ্রো, উঁহু, হোলিয়োট্রো— আহা বলো না ছাই— হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে— হেলিয়োট্রোপ রঙের! চাই কী, তোমার মতো ভেলভেটের একটা ওয়েস্টকোটও চড়িয়ে ফেলতে পারতাম… হায় রে, যা আমার ফাটা কপাল! যদি তোমার মতো একটা ওয়েস্টকোটও থাকত!… দেখো, এসো এক কাজ করা যাক; আমার কথা শুনলে তোমার ভালই হবে হে, ভালই হবে। যদি সত্যি-সত্যিই তোমার ওই মহিলা কনফ্যুশিয়াসরা আসেন তা হলে তোমার এই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন স্টুডিয়ো দেখলে তোমার সম্বন্ধে তাঁদের খুব ভাল ধারণা হবে না। তার চেয়ে এসো আবার নোংরা করে ফেলি। তাঁরা এসে দেখবেন যে তুমি কাজে একেবারে মগ্ন আর তোমার মাথার ঘাম— কী বলে কথাটা?— ঘামের মাথা— মানে পায়ের ঘাম মাথায় টপ টপ করে পড়ছে। একতাল কাদা নাও, তারপর আমি যে এখানে আরাম করে শুয়ে আছি, যতটা সম্ভব আমার একটা প্রতিমূর্তি গড়ার চেষ্টা করো, তোমার সেই মূর্তিটার নাম দেওয়া যাবে— “শ্রমিক।” শুধু নামটা দেখেই ন্যাশনাল গ্যালারি আদর করে কিনে নিয়ে যাবে। শুধু বিপদ হচ্ছে আমার এই জুতোজোড়া নিয়ে— বড্ড পুরনো হয়ে গেছে। তা হোক গে, তুমি ইচ্ছে করলেই মূর্তির জুতোজোড়া নতুন হয়ে যাবে। সত্যি কথা বলতে কী, ভেবো না, আমি তোমায় খোশামোদ করছি, কিন্তু তোমাকে অনায়াসে ভাস্কর দলের মুচি বলা যেতে পারে।’

পলিয়ানি এ সব কথায় কোনও খেয়ালই না করে দেয়ালে কতকগুলো কার্টুন ছবি টাঙাচ্ছিল। তার মতে কল্লির জীবনটা একেবারে ব্যর্থ। ও যেন গত যুগের যেতে-যেতে থমকে দাঁড়ানো কোনও স্মৃতি। শিল্পী মহলের সেই পুরনো কায়দা— ঢিলেঢালা চেহারা, কুঁড়েমির দিকে ঝোঁক বেশি। সত্যি কথা বলতে কী, এই কুঁড়েমি কল্লির একেবারে মজ্জাগত। নয়তো কাজ করার মেজাজ যখন আসে তখন কল্লির মাথা থেকে যা বেরোয়, তা তেমন-তেমন উঁচুদরের ভাস্করের পক্ষেও শ্লাঘনীয়। কল্লির কাজ যে কেমন তা পলিয়ানির নিজেরও কিছু কিছু জানা আছে। কত সময় কোনও মূর্তির মধ্যে কোনও একটা বিশেষ ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টায় ও যখন গলদঘর্ম হচ্ছে তখন কল্লি এসে যেন কত অবহেলার সঙ্গে বুড়ো আঙুল দুটো দিয়ে এখানে ওখানে একটু টিপে অতি সহজেই ঠিক সেই ভাবটি ফুটিয়ে তুলেছে। ওর দোষের মধ্যে ভাস্কর্যের ইতিহাস সম্বন্ধে পলিয়ানির তুলনায় একফোঁটা বিদ্যেও ওর পেটে নেই। তা ছাড়া নিয়ম মতো স্নানাহার করে চেহারাটা একটু ভদ্র গোছের করা ওর দরকার। যতসব অদ্ভুত ভাবনা ওর মাথায় আর ওই বিদঘুটে পোশাক! সত্যি ওকে এক-একসময় আর সহ্য করা যায় না। পলিয়ানি নিজে বছর দুয়েক ইউনিভার্সিটিতে পড়ে এখন তো বেশ আস্তে আস্তে কাজের মধ্যে ঢুকে পড়ছে…

ঠিক এমনি সময় দরজায় মৃদু দুটো টোকা পড়ল। টুলের উপর দাঁড়িয়ে পলিয়ানি তখন তার স্কেচগুলো দেয়ালে টাঙাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি মাটিতে নেমে ঘুসি পাকিয়ে সে বলল, ‘এখনও যাবে না?’

নড়বার কোনও লক্ষণই কল্লির দেখা গেল না, সে উত্তর দিল, ‘আহা, তাঁরা আসুনই না, তারপর না হয় যাওয়া যাবে। তুমি যে একেবারে ধরাকে সরা জ্ঞান করলে! এমন স্বার্থপর অসভ্যের মতো ব্যবহার না করে, ওঁদের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিলে তোমার মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।’

এ কথার জবাব দেবার মতো মনের অবস্থা পলিয়ানির নয়— কপাল থেকে কোঁকড়া চুলের গুচ্ছ সরিয়ে তাড়াতাড়ি সে দরজা খুলে দিতে গেল।

ঘরে ঢুকলেন সিনোরা কনসালভি— পিছনে তাঁর মেয়ে। মেয়েটির বয়স বেশি নয়, কিন্তু বেশভূষায় সে গভীর শোকেরই প্রতিমূর্তি, মোটা ক্রেপের ঘোমটায় মুখটা ঢাকা। তার হাতে লম্বা একটা পাকানো কাগজ। মা’র পরনে সুন্দর হালকা ধোঁয়াটে রঙের পোশাক— সুগঠিত দেহে মানিয়েছে চমৎকার। চুলে পাক ধরেছে, তবুও যুবতীসুলভ ঢঙেই বাঁধা। মাথায় ভায়োলেট ফুল বসানো ছোট্ট সুন্দর টুপি। মোটের উপর ভদ্রমহিলাকে দেখেই বোঝা যায় যে বয়স হলেও তিনি যে এখনও সুন্দরী এ বিষয়ে তিনি বেশ সচেতন। মেয়ে যখন মুখের ঘোমটা টুপির উপর তুলল, তখন বোঝা গেল যে শোকে

কাতর হলেও সেও কম সুন্দরী নয়। প্রাথমিক ভদ্রতা-বিনিময়ের পর পলিয়ানি লক্ষ করল যে হাত দুটো পকেটে ঢুকিয়ে, বিদঘুটে টুপিটা প্রায় নাকের উপর নামিয়ে এনে, একটা আধপোড়া নিভন্ত সিগারেট ঠোঁটের ফাঁকে লাগিয়ে তখনও কল্লি দাঁড়িয়ে আছে। চলে যাবার কোনও লক্ষণই তার দেখা যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে মহিলাদের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলে পলিয়ানি।

সিনোরিনা কনসালভি হঠাৎ যেন অত্যন্ত অবাক হয়ে বলে উঠল, ‘সিনোর কল্লি? সিরো কল্লি? আপনি কি ভাস্কর!’

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, মাথার টুপিটা খুলে কল্লি জবাব দিলে, ‘ভাস্কর? হ্যাঁ… তা আমাকেও ভাস্কর বলতে পারেন বই কী!’

সিনোরিনা যেন একটু বিরক্ত হল, একটু অপ্রস্তুতও। বললে, ‘কিন্তু আমি যে শুনলাম আপনি আজকাল আর রোমে থাকেন না?’

‘না— আমি এখানেই আছি। ব্যাপারটা কী জানেন, আমি এখন ছুটি উপভোগ করছি।’ অভ্যাসমতো কল্লি বলেই চলল, ‘প্রথমে একটা স্কলারশিপ নিয়ে রোমের মতো একটা সুন্দর জায়গায় এসে চিরকাল কুঁড়েমি করেই কাটাব ঠিক করেছিলাম, তারপর…’

মা মৃদু-মৃদু হাসছিলেন, মেয়ে তাঁর দিকে ফিরে বললে, ‘এখন কী করা যায়?’

কল্লি জিজ্ঞেস করল, ‘আমি চলে যাব?’

সিনোরিনা তাড়াতাড়ি জবাব দিলেন, ‘না, না, আপনি যাবেন কেন, আমিই বরং আপনাকে অনুরোধ করছি, আর কিছুক্ষণ এখানে থাকতে মানে— কারণ’— ব্যাপারটাকে সহজ করে নেওয়ার জন্যে মা তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ‘ভগবান কীরকম মিলিয়ে দেন দেখুন।’ তারপর পলিয়ানির দিকে ফিরে বললেন, ‘তা হোক, একটা উপায় করা যাবেই …আচ্ছা, আপনারা দু’জনে খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু নয় কি?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আমরা সত্যি-সত্যিই খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু’, পলিয়ানির জবাব দিতে দেরি হল না।

‘হ্যাঁ, এত ঘনিষ্ঠ যে এই কয়েক মিনিট আগেই উনি আমাকে তাড়িয়ে দেবার জন্যে রীতিমতো ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন,’ বাধা দিয়ে কল্লি বললে।

গলার স্বর নামিয়ে পলিয়ানি ধমক দিয়ে উঠল, ‘আঃ, চুপ করো না।’ তারপর মহিলাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘আপনারা আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন? বসুন।’ একটু ইতস্তত করে বলে চলল, ‘কিছু যদি মনে না করেন, আমার সঙ্গে দেখা করতে আসার কারণটা জানতে পারি কী?’

সিনোরা কনসালভি সোফায় বসতে বসতে জবাব দিলেন, ‘ব্যাপারটা কী জানেন? আমার মেয়ে যার বাগদত্তা ছিল সে ছেলেটি হঠাৎ মারা গিয়েছে।’

দু’ বন্ধু একসঙ্গে বলে উঠল, ‘আহা!’

সিনোরা বলে চললেন, ‘বুঝতেই পারছেন আমার মেয়ে কত বড় আঘাতটা পেয়েছে! ঠিক বিয়ের আগে! শিকারে গিয়েছিল, সেখানে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়। বোধহয় খবরের কাগজে পড়েও থাকবেন। ছেলেটির নাম ছিল জুলিয়ো সরিনি।’

‘ও, হ্যাঁ, হ্যাঁ, পড়েছি বটে,’ পলিয়ানি বলল, ‘কাগজে লিখেছিল বন্দুকের গুলি ছুটে গিয়ে’—

সিনোরা বাধা দিয়ে বললেন, ‘গেল মাসের প্রথমে… না, না, তার আগের মাসে…উঁহু, এ মাস নিয়ে তিনমাস হল এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে… ছেলেটি আমাদের দূর-সম্পর্কের আত্মীয়ও ছিল। তার বাপ আমার সম্পর্কে একরকম ভাই হতেন— স্ত্রী মারা যাবার পর আমেরিকায় গিয়ে বসবাস করছিলেন। যাক সেসব কথা, এখন, জুলিয়েত্তা— মানে আমার মেয়ের নামও জুলিয়া’—

মেয়ের নাম ওঠবার সঙ্গে সঙ্গেই পলিয়ানি কেতাদুরস্তভাবে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালে।

মা বলে চললেন, ‘ভাবী স্বামীর স্মৃতিরক্ষার জন্যে জুলিয়েত্তা ভের্যারনোতে (রোমের সবচেয়ে বড় গোরস্থান) একটা ভাল স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করাতে চায়। এখন সেখানে সাধারণ রকম একটা কবর আছে শুধু। সেটি কীরকম হবে এ বিষয়ে ওর নিজের কতগুলো ধারণা আছে। আপনারা বোধহয় জানেন না, আমার মেয়ের স্কেচিং সম্বন্ধে মাথা খুব পরিষ্কার।’

মেয়ে চোখ নামিয়ে লজ্জানম্রকণ্ঠে বাধা দিল, ‘না, না, আপনারা মা-র কথা শুনবেন না। শুধু সময় কাটানোর জন্যে একটু আধটু…’

মা রীতিমতো আহতভাবে বললেন, ‘শুধু আমি কেন, জুলিয়ো-ও তো তোমাকে স্কেচিং ভাল করে শিখতে’—

মেয়ে একটু জোর দিয়ে বলল, ‘মা, চুপ করো। দেখুন, একটা সচিত্র মাসিক পত্রে এঁর মানে সিনোর কল্লির আঁকা কবরের উপরকার স্মৃতি-ফলকের একটা স্কেচ দেখে আমার ভারী ভাল লেগেছিল, তাই…’

‘আর সেইজন্যই আমাদের এখানে আসা’ —মেয়ে বলতে দ্বিধা করছে দেখে মা তাড়াতাড়ি কথাটা শেষ করে দিলেন। মেয়েটি বলতে লাগল, ‘আমি এই স্কেচটায় কিছু কিছু অদল বদলের কথা ভেবেছি…’

‘আচ্ছা, কোনটা বলুন তো?’ বাধা দিয়ে কল্লি জিজ্ঞাসা করল, ‘জ্যান্ত মানুষরা তো আমায় কোনও আদর করে না। তাই অন্তত মৃতমহল থেকেও যদি কোনও অর্ডার আসে এই ভেবে আমি কয়েকটা স্মৃতিফলকের নকশা এঁকেছিলাম’—

পলিয়ানি যে কথাবার্তা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এটা তার ভাল লাগছিল না। কল্লির কথা শেষ হবার আগেই সে বলে উঠল, ‘মাপ করবেন, আমার এই বন্ধুর কোনও স্কেচ অনুযায়ী স্মৃতিফলক তৈরি করবেন এই কি আপনারা স্থির করেছেন?’

‘না, ঠিক তা নয়,’ মেয়েটি ঈষৎ উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘আমি চাইছি, এইরকম। আমি স্কেচটার অর্থ যতদূর বুঝতে পেরেছি তাতে মনে হয় সিনোর কল্লি দেখাতে চেয়েছেন মৃত্যু যেন জীবনকে তার দিকে টেনে নিচ্ছে।’ কল্লি বলে উঠল, ‘ও, বুঝতে পেরেছি আপনি কোনটার কথা বলছেন। একটা আবরণের মধ্যে একটা কঙ্কাল, সেইটে, না? আবরণের ভাঁজের ভিতর দিয়ে স্তব্ধ কঙ্কালটার অস্তিত্বটুকু শুধু বোঝা যাচ্ছে। জীবনের প্রতিমূর্তি একটি সুন্দরীকে সে আঁকড়ে ধরেছে, আর জীবন চাচ্ছে সেই কঙ্কালের কাছ থেকে— মৃত্যুর কাছ থেকে দূরে সরে যেতে। সেই স্কেচটার কথা বলছেন তো? ওটা সত্যিই সুন্দর… অপূর্ব!’

এই অদ্ভুত চেহারার শিল্পীর আত্মকেন্দ্রিকতায় সিনোরা কনসালভি একটু আশ্চর্য বোধ করলেও হাসি চাপতে পারলেন না।

পলিয়ানি তাঁকে বলল, ‘লক্ষ করছেন, আমার বন্ধুর বিনয়ের অন্ত নেই। এমন বিনয় আপনি যেখানে সেখানে খুঁজে পাবেন না।’

মা তখন মেয়েকে বললেন, ‘আর ভূমিকা না করে তাড়াতাড়ি তুমি যে স্কেচটা করেছ সেইটা এঁদের দেখিয়ে দাও।’

মেয়ে লজ্জিতভাবে বলল, ‘দাঁড়াও মা, আগে সিনোর পলিয়ানিকে ব্যাপারটা ভাল করে খুলে বলা দরকার। আপনি বুঝতেই পারছেন, স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করার কথা প্রথম যখন মনে হয়েছিল তখন সিনোর কল্লিকেই কাজটার ভার দেব ভেবেছিলাম। এর অন্য কোনও কারণ নেই; শুধু ওঁর স্কেচ-এর জন্যে।’

এবারে সে কল্লির দিকে ফিরে বললে, ‘কিন্তু আগেই বলেছি পাঁচজনের কাছে শুনলাম যে আপনি এখন আর রোমে থাকেন না। কাজে কাজেই আমি নিজেই আমার সাধ্যমতো আপনার স্কেচটাকে এমনভাবে অদলবদল করলাম যাতে আমার নিজের ইচ্ছে ও ধারণা ওটার ভিতর দিয়ে প্রকাশ পায়। আমি বোধহয় আমার কথাটা পরিষ্কার করে বলতে পারছি না, কিন্তু’—

পলিয়ানি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘না, না, আপনি বলুন। আমরা বেশ বুঝতে পারছি।’

সিনোরিনা বলে চলল, ‘মৃত্যু ও জীবনের প্রতিমূর্তি দু’টির উপর আমি কোনও কারিগরি করিনি। তবে মৃত্যু জোর করে জীবনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে এই ধারণা আমি বদলে দিয়েছি। আপনার স্কেচ-এর এইটুকু মাত্র বদল করেছি আমি। আমার মনে হয় মৃত্যু জীবনকে জোর করে আঁকড়ে ধরে নেই, বরং ভাগ্যের কাছে পরাভূত হয়েই জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর এই বিবাহ।’

‘বিবাহ?’ পলিয়ানির কণ্ঠে বিস্ময় ফুটে উঠল।

‘দিনে দিনে আরও কত কী শুনব!’ কল্লি চিৎকার করে উঠল, ‘জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর বিবাহ!’

সিনোরিনা একটু নম্র হাসি হেসে বললে, ‘হ্যাঁ, জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর বিবাহ। শুধু তাই নয়, এই মিলনকে একটা রূপক দিয়ে বোঝাবারও চেষ্টা করেছি। সিনোর কল্লি যেমন করেছিলেন, ঠিক তেমনি, কঙ্কালটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুধু কাপড়ের ভাঁজের ফাঁক দিয়ে কঙ্কালের মানে মৃত্যুর হাতটি একটুখানি দেখা যাচ্ছে। আর দেখা যাচ্ছে সেই হাতে একটি বিয়ের আংটি। লজ্জানম্র বিনত জীবন কঙ্কালের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আঙুল বাড়িয়ে দিয়েছে আংটি পরবার জন্যে।’

‘চমৎকার! খুব সুন্দর! এবারে আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি,’ কল্লি বাধা দিয়ে উঠল, ‘এর সঙ্গে আমার স্কেচের কোনও তুলনাই হয় না। অপরূপ! ভাবটি একেবারে নতুন। আংটি!… আঙুল বাড়িয়ে দিয়েছে… সুন্দর!’

এই উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় রক্তিম হয়ে সিনোরিনা বললে, ‘হ্যাঁ, কিছুটা আলাদা বটে, কিন্তু এটা তো অস্বীকার করা চলবে না যে আপনার স্কেচটা দেখেই এটা আমার মনে এসেছিল আর’—

‘ও নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।’ কল্লি বলল, ‘এটা আপনারই, আপনারই নিজস্ব, আমার স্কেচের চেয়েও হাজার গুণে ভাল এটা। আমার মনে ওটা কোথা থেকে এসেছিল তা ভগবানই জানেন’—

সিনোরিনা সোজা হয়ে বসে আবার চোখ দুটো নামালে।

মা একটু অসহিষ্ণুভাবে বলে উঠলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কী, মেয়ে তার ইচ্ছে মতো সব করছে বটে, কিন্তু আমার এটা একটুও ভাল লাগছে না।’

মেয়ে তাঁকে বাধা দিয়ে চুপ করিয়ে দিলে। তারপর পলিয়ানির দিকে ফিরে বললে, ‘কয়েকদিন আগে আমরা কম্যান্ডার সেরাল্লির কাছে গিয়েছিলাম তাঁর মতামত জানতে। তিনি আমাদের অনেকদিনের বন্ধু কিনা—’

মা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ওদের বিয়েতে তাঁরই সাক্ষী হবার কথা ছিল।’

মেয়ে বলে চলল, ‘তাঁর কাছেই আপনার নাম জানতে পারি। আর তাঁর কথামতোই স্থির করি যে আপনাকেই এই কাজের ভার দেব—’

‘না, না, মাপ করুন, সিনোরিনা।’ পলিয়ানি তাড়াতাড়ি জবাব দিল, ‘আমার বন্ধুকে এখন আপনারা এখানে পেয়েই গেছেন—’

কল্লি রাগের চোটে ঘাড় দুলিয়ে বললে, ‘বাজে কথা বোলো না। তোমার কথা শুনলে পিত্তি সুদ্ধ জ্বলে যায়।’

সে দরজার দিকে এগোচ্ছিল। পলিয়ানি তার হাত ধরে আটকে রেখে বলল, ‘আরে শোনো, শোনো। তুমি রোমে নেই এই কথা ভেবেই তো সিনোরিনা আমার কাছে এসেছিলেন।’

কল্লি হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে করতে বলল, ‘উনি আমার ডিজাইন সব বদলে দিয়েছেন। যেতে দাও আমাকে। উনি এসেছেন তোমার কাছে। আমায় মাপ করবেন সিনোরা, সিনোরিনা, আমাকে এখন যেতে হবে। নমস্কার।’

পলিয়ানি হাত না ছেড়ে বেশ দৃঢ়ভাবেই বলল, ‘দেখো কল্লি, এই মূর্তি তৈরি করার ভার আমি কিছুতেই নিচ্ছি না। তুমিও নিতে রাজি হচ্ছ না। তার মানে কাজটা আমাদের দু’জনেরই হাতছাড়া হবে—’

সিনোরা বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, ‘আচ্ছা, তা হলে আপনারা দু’জনেই করুন না কেন? দু’জনে কি মূর্তিটা তৈরি করা যাবে না?’

সিনোরিনা তাড়াতাড়ি বললে, ‘আমার জন্যে আপনাদের মধ্যে—’

কল্লি ও পলিয়ানি একসঙ্গে বলে উঠল, ‘না, না, তা নয়, তা নয়।’ কল্লি বলতে লাগল, ‘এ ব্যাপারের সঙ্গে আমার আর কোনও সম্বন্ধই নেই, সিনোরিনা। আর তা ছাড়া— মানে, তা ছাড়া আমার এখন কোনও স্টুডিয়ো নেই। কাজে কাজেই এই মূর্তি গড়ার ভার আমার পক্ষে নেওয়া অসম্ভব। চারদিকে যে যেখানে আছে সবাইকে গালাগালি দেওয়া ছাড়া আমি এখন আর কোনও কাজেরই উপযুক্ত নই। আপনাদের উচিত এই বদ্ধপাগলটিকে জোর করে এই কাজের ভার’

পলিয়ানি বলল, ‘বাজে বকে কোনও ফল হবে না কল্লি। সিনোরা যেমন বলেছেন, হয় সেরকম আমরা দু’জনে কাজটা নেব আর তা না হলে আমি একা এ কাজ কিছুতেই নেব না।’

সিনোরিনার পাশে সোফার উপর যে ভাঁজ-করা কাগজটা ছিল সেইটের দিকে হাত বাড়িয়ে কল্লি বলল, ‘মাপ করবেন সিনোরিনা, আপনার আঁকা স্কেচটা দেখবার জন্যে আমার ভারী লোভ হচ্ছে। ওটা দেখবার পর বলতে পারব যে কাজের ভার—’

‘অপরূপ কিছু দেখবার আশা করবেন না,’ সিনোরিনা কনসালভি কম্পিত হাতে কাগজটা খুলতে খুলতে বললে, ‘আমি এখনও ঠিক পেনসিল ধরতেই জানি না… শুধু আমার ভাবটা বোঝাবার জন্যে কয়েকটা লাইন টেনে ছেলেমানুষি করেছি… দেখুন…’

স্কেচটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে কল্লি চমকে উঠে চিৎকার করে বললে, ‘কাপড় পরিয়েছেন?’

‘তার মানে?’ সিনোরিনা একটু ভয় পেয়ে জিজ্ঞাসা করলে, ‘কেন, কাপড় পরাব না কেন?’

‘মাপ করবেন। কিছুতেই না’, কল্লি রীতিমতো গরম হয়ে বলে উঠল, ‘জীবনের প্রতিমূর্তি সেমিজ পরা!… না, না, তা কখনও হতে পারে না। নগ্ন, নগ্ন! জীবনকে নগ্ন হতে হবে সিনোরিনা— সম্পূর্ণ নগ্ন।’

সিনোরিনা কনসালভি আমতা আমতা করে বললে, ‘দেখুন কোনও মত প্রকাশ করবার আগে স্কেচটা আর একবার দেখুন।’

এবারে কল্লি প্রায় চিৎকার করে উঠল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি দেখতে পাচ্ছি। আপনি নিজের ছবি এঁকেছেন— জীবনের প্রতিমূর্তি আঁকতে গিয়ে আপনি নিজেকে প্রকাশ করেছেন। (যদিও বাস্তবের জীবনের চেয়ে আপনি ঢের বেশি সুন্দর!) তাতে কী হয়েছে? যখন এই স্কেচটার কথা আলোচনা হচ্ছে, তখন আমরা চলে এসেছি আর্টের ক্ষেত্রে। আমাদের বিষয় হচ্ছে জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর বিবাহ। যখন কঙ্কালের উপর আবরণ দেওয়া হয়েছে তখন জীবনের মূর্তিটা নগ্ন হতেই হবে… সম্পূর্ণ নগ্ন আর অপরূপ সুন্দর। ওই আচ্ছাদিত কঙ্কালের ভীষণ মূর্তিটার পাশে জীবনের প্রতিমূর্তি এইরকম হওয়াই দরকার। পলিয়ানি তুমি কী বলো, নগ্ন হওয়াই উচিত নয়? সিনোরা, আপনার কী মত? সম্পূর্ণ নগ্ন, সিনোরিনা, মাথা থেকে পা পর্যন্ত কোথাও এতটুকু আবরণ থাকবে না। আমার কথা বিশ্বাস করুন, এরকম না হলে ঠিক মনে হবে কোনও হাসপাতালের ছবি তৈরি হয়েছে— একটা মূর্তি কাপড়ে মোড়া আর একটা পরানো চান-কাপড়। আমরা যা বানাব তাকে তো আর্ট হতে হবে, সিনোরিনা, আর তাই যদি হতে হয় তা হলে জীবনকে নগ্ন হতেই হবে।’

সিনোরিনা কনসালভি আর তাঁর মা উঠে দাঁড়ালেন। সিনোরিনা বললে, ‘আমি সত্যিই অত্যন্ত দুঃখিত, কিন্তু আপনার মত আমি গ্রহণ করতে পারছি না। আপনি যা বলছেন, আর্টের দিক থেকে তা হয়তো সত্যি— তা নিয়ে আপনার সঙ্গে আমি তর্ক করব না। আমার এই স্কেচটিতে আমি কিছু বলবার চেষ্টা করেছি। অন্য যে-কোনওভাবে এটি আঁকলে সে কথা বলা হবে না। আপনার মতে চললে যে কথা আমি বলতে চাচ্ছি তা আর আমার বলা হবে না।’

‘তা কেন? মাপ করবেন, আমি কিছুতেই আপনার সঙ্গে একমত হতে পারছি না,’ কল্লি বলল, ‘আপনার ভুল হচ্ছে এইখানে যে আপনি আপনার দেহটাকে একটা রূপক বলে গ্রহণ না করে আপনার নিজস্ব জিনিস বলে ভাবছেন। এই ভেবেই আপনি স্কেচ তৈরি করেছেন— কাজে কাজেই যেমন সুন্দর হওয়া উচিত ছিল, তেমনটি হয়নি।’

সিনোরিনা জবাব দিল, ‘না, ওটা যে সুন্দর হয়েছে এ কথা আমি বলছি না। আপনি এখনই যে কথা বললেন সেইটেই সত্যি। আমি মূর্তিটিতে কোনও রূপক প্রকাশ করতে চাইনি। আমি আমার নিজের মূর্তি, নিজের ঘটনা, আমার ভবিষ্যতের কর্মপদ্ধতি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি। আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন না… যেখানে স্তম্ভটি তোলা হবে সেই জায়গাটার কথা একবার ভেবে দেখুন। না, না, অন্তত সেখানে, আপনি যেরকম বলছেন, জীবনের মূর্তি সেরকম করা অসম্ভব’—

কল্লি হাত দুটো উপর দিকে তুলে ঘাড় বেঁকিয়ে বলল, ‘এ শুধু আপনার কল্পনা’—

বিষণ্ণ মধুর হেসে সিনোরিনা তাকে শুধরে দিলে, ‘কল্পনা বলবেন না, বলুন ভাবপ্রবণতা, আর তার সম্মান আপনাকে রাখতেই হবে।’

পলিয়ানি আর কল্লি ঠিক করল যে কম্যান্ডার সেরাল্লির সঙ্গে তারা মূর্তি তৈরি করার সমস্ত ব্যবস্থা ঠিক করে নেবে। একটু পরেই সিনোরা কনসালভি আর তাঁর শোকাচ্ছন্ন মেয়ে পলিয়ানির স্টুডিয়ো থেকে বিদায় নিলেন।

সিরো কল্লি আনন্দের আতিশয্যে স্টুডিয়োময় পায়চারি করে বেড়াতে লাগল, গান গেয়ে গেয়ে।

সপ্তাহ খানেক পরে কনস্তানতিনো পলিয়ানি মূর্তিটার মাথা তৈরি করার জন্যে কয়েকটা সিটিং দেওয়ার কথা সিনোরিনাকে বলতে কনসালভিদের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হল।

কম্যান্ডার সেরাল্লির সঙ্গে সিনোরা কনসালভির বন্ধুত্ব ছিল প্রগাঢ়। কম্যান্ডারের কাছে পলিয়ানি শুনেছিল যে, সরিনি সেই ভীষণ অ্যাকসিডেন্ট-এর পর মাত্র তিনদিন বেঁচে ছিল, মারা যাবার সময় তার অগাধ পৈতৃক বিষয়সম্পত্তি সব সিনোরিনা কনসালভিকে দিয়ে যায়। তাই এই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করতে যত টাকাই লাগুক, সিনোরিনা তাতে কার্পণ্য করবেন না।

কম্যান্ডার আরও বলেছিলেন যে এই দুর্ঘটনার জন্যে তাঁর নিজের দুশ্চিন্তার আর বিরক্তির আর শেষ নেই— সিনোরিনা কনসালভির ব্যবহারে তা আরও বেড়েই চলেছে। আহা বেচারি, সত্যি ওকে দেখলে দুঃখ হয়, কিন্তু ও যেন একটু বাড়াবাড়ি করছে। সত্যি কথা বলতে কী— দেখলে মনে হয় শোকের প্রকাশটা অত্যন্ত বেশি গভীর করে ও যেন এক অদ্ভুত আনন্দ পায়। অস্বীকার করবার উপায় নেই যে ব্যাপারটা আকস্মিক— একেবারে বিনা মেঘে বজ্রাঘাত। আর সরিনি সত্যিই সে ছিল— ভাল ছেলে যেমন সুন্দর চেহারা, তেমনি ব্যবহার। মেয়েটাকে ভালও বাসত তেমনি, বিয়ে হলে দু’টিতে ভারী সুখী হত। সেইজন্যেই বোধহয় ভগবান তাকে টেনে নিলেন।

কম্যান্ডার সেরাল্লির কথা শুনে মনে হয়, সরিনির মতো ভাল ছেলে যে মারা গেছে এ শুধু কম্যান্ডারের দুশ্চিন্তা বাড়াবার জন্যে। বিয়ে হবার পর দু’জনে থাকবে বলে সরিনি যে বাড়িটা সাজিয়ে রেখেছিল, সেই বাড়িটা পর্যন্ত মেয়েটা ছাড়বে না। ওর ভাল জামাকাপড় সব ও-বাড়িতে সিনোরিনা নিয়ে গেছে; দিনের বেশিরভাগ সময় কাটায় সেখানেই— কিন্তু কাঁদে না। বধূ হয়ে যে জীবন ও-বাড়িতে ও কাটাতে পারত, অকারণে যে জীবন ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, সেই জীবনের স্বপ্ন দেখে ও অনুতাপে কাটিয়ে দেয় দিনের পর দিন।

যা বলেছিলেন কম্যান্ডার তাই হল— পলিয়ানি তাদের নিজেদের বাড়িতে সিনোরিনা কনসালভিকে পেল না। বাড়ির দাসীর কাছ থেকে ভিয়া দি পোর্তা পিনচিয়ানোতে নতুন ঠিকানা সংগ্রহ করে পলিয়ানি সেদিকে অগ্রসর হল। যে তিক্ত মধুর ব্যথার ভিতর দিয়ে মেয়েটির দিন কাটছে সে কথা ভেবে পলিয়ানির মনও হয়ে উঠল ব্যথিত। বিয়ের আগেই বিধবা— ভাগ্য বাধা না দিলে কয়েকদিন পরেই যে স্বপ্ন সত্যে পরিণত হত, সেই স্বপ্নের মধ্যেই যে সে তার অতৃপ্ত আত্মার শান্তি দিনের পর দিন খুঁজে মরছে— এ কথা ভেবে পলিয়ানির রীতিমতো মন খারাপ হয়ে গেল।

কত আসন্ন মধুর দিনের কথা ভেবে বাগদত্ত বরবধূ কত দোকান ঘুরে ঘুরে একটি একটি করে আসবাব কিনে বাড়িটিকে কত আনন্দে সাজিয়েছিল— কয়েকটা দিন পরেই তারা দু’জনে ওখানে থাকবে! মধুর স্মৃতিতে, আশায়, আকাঙ্ক্ষায় জড়ানো সেইসব জিনিসপত্র যেমনভাবে তারা সাজিয়েছিল ঠিক তেমনিভাবেই পড়ে আছে… আজকের এই এমন সুন্দর দিনে, বধূর প্রতি ভাগ্যের নিষ্ঠুরতার কথা ভেবে পলিয়ানি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাতাসে বসন্তের আগমনবার্তা, সূর্যের আলোয় বসন্তের উষ্ণস্পর্শ— মন তার আনন্দে ভরে ভরে উঠছিল, সামনেই নতুন বাড়িটিতে খোলা জানলার ভিতর দিয়ে যেখানে সকালবেলাকার রোদ্দুর এসে পড়েছে, সেখানে আজকের দিনে কোনও মধুর স্বপ্নের যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন অবস্থায় জুলিয়েত্তা কনসালভিকে সে একটু পরেই দেখতে পাবে!

পলিয়ানি যখন ঘরে ঢুকল তখন ইজেল-এর সামনে বসে বাগদত্ত স্বামীর একটি ছোট্ট ফোটোগ্রাফ থেকে জুলিয়েত্তা একটা বড় স্কেচ আঁকতে ব্যস্ত ছিল। তার মা পাশে বসে কম্যান্ডার সেরাল্লির লাইব্রেরি থেকে ধারকরা একটা ফরাসি উপন্যাস পড়ছিলেন।

সত্যি কথা বলতে কী, তার মর্মান্তিক দুঃখের ‘ভাল-বাসায়’ একা থাকতেই সিনোরিনা কনসালভি পছন্দ করত বেশি— বিশেষ করে মা-র উপস্থিতি তার কাছে মোটেই বাঞ্ছনীয় ছিল না। কিন্তু সিনোরার মনে মনে ভয় যে মেয়ের মনের যা রোমান্টিক হাবভাব, কোনওদিন হয়তো-বা একটা দুর্ঘটনাই ঘটিয়ে বসবে— তাই তিনি কখনও ওকে একা থাকতে দিতেন না। মেয়ের দুঃখ ভোগের এই একান্ত নিবিষ্টতায় তিনি পাশে বসে মনে মনে চটতেন— অনেক চেষ্টায় মুখ ফুটে কিছু বলতেন না।

অল্প বয়সে এই মেয়েটিকে নিয়ে সিনোরা কনসালভি বিধবা হন— স্বামী একটি পয়সাও রেখে যাননি। জীবনের সব সুখস্বাচ্ছন্দ্য খাঁচার মধ্যে পুরে স্বামীবিয়োগের যে দুঃখকে সেই খাঁচার প্রহরী করে রাখতে তাঁর মেয়ে যেমন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠেছে, তিনি তা কোনওদিনই পারেননি। ভাগ্য যে নিষ্ঠুর আঘাত দিয়েছে তার জন্যে জুলিয়েত্তা কোনও শোক প্রকাশ করবে না এমন কথা তিনি বলেন না। কিন্তু তিনি ও তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু কম্যান্ডার সেরাল্লি দু’জনেরই মনে হচ্ছে যে মেয়ে যেন একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলছে, তাঁর ধারণা যে ভাবী স্বামী যে অগাধ বিষয়-সম্পত্তি রেখে গিয়েছে তারই সুযোগ নিচ্ছে তাঁর মেয়ে এবং সেইজন্যেই এই অবাধ দুঃখ প্রকাশের বিলাসে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে পারছে। জীবনের ঘৃণ্যতম সত্যগুলির সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট পরিচয় আছে— স্বামীর মৃত্যুবেদনা মলিন হয়ে যাবার আগেই তাঁকে কীরকম যুদ্ধ করতে হয়েছিল সংসার চালানোর জন্যে, তা তাঁর এখনও মনে পড়ে। মেয়ে তো তার দুঃখের সময় অনেক সহজেই দিন কাটাতে পারছে। তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার কথা মনে করলে মেয়ের এই হাল ছেড়ে দেওয়া বাড়াবাড়িকে হয়তো ক্ষমা করা যায়— বিশেষ এই অবস্থায়— তবে বেশিদিন যদি এরকম না চলে তা হলেই রক্ষে। এ কথা তাঁর বন্ধু কম্যান্ডার সেরাল্লি প্রায়ই বলে থাকেন।

সিনোরার সাধারণ বুদ্ধি প্রখর, জীবনের বহু বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা, তাই তিনি অনেকবার মেয়েকে তার দুঃখবিলাপ সম্বন্ধে সংযত হতে বলেছেন, কিন্তু কোনওই ফল হয়নি। জুলিয়েত্তা বড্ড বেশি রোম্যান্টিক। বোধহয়, দুঃখ যত না বেশি, দুঃখ ভোগের সূক্ষ্ম আনন্দটাই ওকে পেয়ে বসেছে, আর তা হয়েছে বলেই মুশকিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভাবাবেগের শক্তি যেমন কমে আসতে থাকে ঠিক তেমনি কোনও বিশেষ ধারণা মনের মধ্যে বদ্ধমূলও হতে থাকে। এই দুঃখভোগের যে আনন্দ তারই ফলে জীবন মৃত্যুকে বিয়ে করছে— এইরকম অদ্ভুত একটা ধারণা অবলম্বন করে স্মৃতিস্তম্ভ রচনা করার কথা ওর মনে এসেছে। তারপর ওই ওর আর একটা বিশ্রী খেয়াল— ঠিক যেমনভাবে বাড়িটি দু’জনে সাজিয়েছিল, ঠিক তেমনিভাবে রেখে দেওয়া। যে বিবাহিত জীবন ও উপভোগ করতে পারল না, সেই প্রায়-সত্য-হয়ে-আসা স্বপ্নের ছোঁয়া দিয়ে আজও সে বাড়িটিকে ঘিরে রাখতে চায়।

পলিয়ানি দেখা করতে এসেছে দেখে সিনোরা খুব খুশি হলেন।

জানলা দিয়ে সূর্যের আলো ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। বাইরে ভিলা বর্গেসে— চারদিকে বড় বড় সবুজ সুন্দর মাঠ, লম্বা লম্বা পাইনের সারি গভীর নীল বসন্তের আকাশকে প্রায় স্পর্শ করছে— দৃশ্যটি চিত্তহারী। পলিয়ানি ঘরে ঢুকতেই সিনোরিনা তাড়াতাড়ি উঠে স্কেচটা যাতে ওর নজরে না পড়ে তার চেষ্টা করতে লাগল। পলিয়ানি সামান্য বাধা দিয়ে বললে, ‘লুকোচ্ছেন কেন? দিন না দেখি, কী আঁকছেন!’

সিনোরিনা লজ্জিত হয়ে জবাব দিল, ‘সবে মাত্র আরম্ভ করেছি কিনা, তাই—’

নিচু হয়ে স্কেচটা দেখতে দেখতে পলিয়ানি বলে উঠল, ‘চমৎকার আরম্ভ করেছেন। সত্যিই বেশ ভাল হচ্ছে। সরিনির ছবি, নয়? এই ফোটোগ্রাফটা দেখে এখন তাঁর মুখটা মনে করতে পারছি। আপনার আঁকাতে বেশ চেনা যাচ্ছে— কিন্তু তিনি কি দাড়ি রাখতেন?’

মেয়েটি তাড়াতাড়ি জবাব দিল, ‘না, না, দাড়ি রাখতেন না, অন্তত আমার সঙ্গে আলাপ হবার পর দেখিনি।’

‘হুঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছিল।’ পলিয়ানি বলল, ‘চমৎকার চেহারা ছিল —ভদ্রলোকের চমৎকার।’

সিনোরিনা তার নিজের কথার রেশ টেনে বলল, ‘কিন্তু আমি তো আর ছবিটা নিয়ে এগোতে পারছি না। এই ফোটোগ্রাফটা থেকে বোঝা যায় না— মানে, আমার মনে তার যে ছবি আছে তার সঙ্গে এর কোনওই মিল নেই।’

পলিয়ানি বলল, ‘হ্যাঁ, আপনি যা বলতে চাচ্ছেন তা আমি বুঝতে পেরেছি। তিনি আরও বেশি— আরও বেশি… জীবন্ত ছিলেন। আরও বেশি সজীব ছিলেন।’ মা বললেন, ‘আমার মেয়ের— বিয়ের কথাবার্তা হবার কিছুদিন আগে আমেরিকায় ওই ছবিটা তোলা হয়েছিল।’

বিষাদভরা কণ্ঠে সিনোরিনা বলল, ‘তার আর কোনও ছবি আমার কাছে নেই। দেখুন, আমি যখন এইরকম করে চোখ বন্ধ করি, মরবার আগে যেরকম সে দেখতে ছিল, ঠিক সেই মূর্তিতেই তাকে আমি দেখতে পাই। কিন্তু যে মুহূর্তে ছবি আঁকার জন্যে তুলি হাতে নিই, তখনই তার মুখটা আমি হারিয়ে ফেলি। তখন আমি ফোটোটার দিকে তাকাই— মনে হয় এইটাই তার প্রায় জীবন্ত প্রতিকৃতি। আবার স্কেচটা আঁকার চেষ্টা যখন করি তখন আর ফোটোর সঙ্গে কোনও মিলই খুঁজে পাই না। আমার ছবি আঁকার বিষয়ে ক্রমেই আমি হতাশ হয়ে পড়ছি।’

সিনোরা এতক্ষণ একদৃষ্টে পলিয়ানির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘জুলিয়া দেখো দেখো, তুমি সরিনির থুতনির কথাটা বলছিলে না? দাড়িটা সরিয়ে নিলে থুতনিটা কেমন দেখাবে ভাবছিলে! সিনোর পলিয়ানির থুতনিটা দেখো, তোমার মনে হয় না কি’ —

পলিয়ানি লজ্জায় লাল হয়ে অল্প একটু হাসল। প্রায় নিজের অজান্তে সে তার থুতনিটা একটু উঁচু করল। যেন সিনোরিনা কনসালভি ইচ্ছে করলেই মৃদু হাতে তার চিবুকটি তুলে ধরে সরিনির ছবিতে বসিয়ে দিতে পারে।

জুলিয়েত্তা মা-র কথায় রীতিমতো লজ্জিত ও বিব্রত বোধ করছিল। মাথা তুলে সে পলিয়ানির দিকে তাকাতেই পারলে না। তার দুঃখ নিয়ে এরকমভাবে কথা বলা মা-র কিছুতেই উচিত হয়নি।

কিছু না ভেবেই সিনোরা বলতে লাগলেন, ‘আর গোঁফজোড়াও দেখো, জুলিয়ো বেচারা মারা যাবার কিছুদিন আগে ঠিক এইরকমের গোঁফই রাখত না?’

সিনোরিনা এবার রীতিমতো আহত বোধ করলে। গম্ভীর গলায় বললে, ‘আমরা গোঁফের কথা আলোচনা করছিলাম না, মা। ছবিতে আমি গোঁফ রাখবই না।’

পলিয়ানি জুলিয়েত্তার কথার সঙ্গে একমত হয়ে বলল, ‘না সত্যিই, গোঁফ দিলে ছবিটা ঠিক ভাল দেখাবে না।’ কিন্তু বলার সঙ্গে সঙ্গে অভ্যাস মতো নিজের গোঁফে একটু হাত বুলিয়ে নিল, তারপর বলল, ‘দেখুন, সিনোরিনা আপনি যদি অনুমতি করেন, তা হলে আপনাকে একটু সাহায্য করতে পারি। আপনার স্কেচটার এই কোণে কয়েকটা তুলির টান— আপনি কিছু মনে করবেন না তো? পরে আপনি ইচ্ছে করলে মুছে ফেলতেও পারেন। সরিনিকে আমার কতটা মনে আছে আপনাকে তা-ই দেখাতে চাই।’

পলিয়ানি চেয়ারে বসে ফোটোগ্রাফটার সাহায্যে জুলিয়েত্তার মৃত বাগদত্তের ছবি আঁকতে আরম্ভ করল। খুব মন দিয়ে ওর তুলির দ্রুত টানগুলি লক্ষ করতে লাগল সিনোরিনা কনসালভি। তার সমস্ত মন একাগ্র হয়ে আশায় উন্মুখ হয়ে উঠল। কাজটা যত এগোতে লাগল, তত নতুন নতুন তুলির টানে সে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। পলিয়ানির তুলিও যেন উৎসাহ পেয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে চলল। জুলিয়েত্তা শেষে আর তার মনের ভাব চেপে রাখতে পারল না, বলে উঠল, ‘মা, দেখো, দেখো। সরিনি— একেবারে ঠিক সরিনি! বদলাবেন না, কিচ্ছু বদলাবেন না দয়া করে… ঠিক হয়েছে… আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ… কী সুন্দর আপনি আঁকতে পারেন! চমৎকার!’

চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে পলিয়ানি বলল, ‘একটু অভ্যাস করলে আপনিও এর চেয়ে ভাল আঁকতে পারবেন। আর সরিনিকে আমার খুব ভাল মনে আছে কিনা তাই’ — বিনয়নম্র সুরে বললেও জুলিয়েত্তার অকপট প্রশংসায় ও যে বেশ আনন্দ পেয়েছে সেটা প্রকাশ করতে পলিয়ানি দ্বিধা করল না।

সিনোরিনা কনসালভি তখনও স্কেচটার দিকেই তাকিয়ে ছিল, যেন দেখে দেখে তার আর আশ মিটছিল না। কিছুক্ষণ পরে সে বলল, ‘থুতনিটা—হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে, যেমনটি ছিল ঠিক তেমনি হয়েছে… ওঃ, আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেব!’

এই সময়, সরিনির যে ফোটোগ্রাফটা মডেল করে জুলিয়েত্তা স্কেচটা আঁকবার চেষ্টা করছিল সেটা ইজেল থেকে মাটিতে পড়ে গেল— সে তখন পলিয়ানির আঁকা ছবিটার প্রশংসায় ব্যস্ত, ফোটোগ্রাফটা মাটি থেকে তুলতে আর তার মনে রইল না।

ঝাপসা হয়ে যাওয়া ফোটোগ্রাফটা মাটিতেই পড়ে রইল— ছবিটার চোখে যেন বিষাদ ফুটে উঠেছে, ও যেন বুঝতে পেরেছে মাটি থেকে আর কখনও তাকে তোলা হবে না।

পলিয়ানি কিন্তু নিচু হয়ে ছবিটা তুলে জুলিয়েত্তার দিকে এগিয়ে দিল। ‘ধন্যবাদ’, বলল জুলিয়েত্তা, ‘এখন থেকে এই বিশ্রী ফোটোটার আর দরকারই হবে না। আপনার স্কেচটা দেখেই আমি এখন নতুন নতুন ছবি আঁকতে পারব।’

এইসময় সে একবার মুখ তুলে তাকাল। এক পলকে তার মনে হল, ঘরটা যেন আগের চেয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। লম্বা ফরাসি জানলার ভিতর দিয়ে সুন্দর ভিলাটি আর তার চারপাশের বাগানের অপূর্ব দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে জুলিয়েত্তা তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলল। এতদিন দুঃখে তার মন ভারাক্রান্ত ছিল। আজ এই সুন্দর দিনের ঝলমলানো আলো তার মনের গভীরতম পর্যন্ত আলোকিত করে তুলল, তার মনে হল যে, অন্যকে প্রশংসা করার ওই সামান্য অভিব্যক্তি যেন তার মনের সব বোঝা সরিয়ে দিয়ে মুক্তির বিহ্বল নেশায় মাতিয়ে দিয়েছে।

এই পরিবর্তন ঘটল যেন এক মুহূর্তে। মনের ভিতরে কী যে হল, সিনোরিনা কনসালভি তার কোনও মানে খুঁজে পেল না। হঠাৎ তার ধারণা হল— চারপাশের নতুনত্বের সঙ্গে সেও যেন নতুন হয়ে উঠেছে— শুধু নতুন নয়, কয়েক মুহূর্ত আগেও যে-দুঃস্বপ্ন তাকে ঘিরে ছিল, তা থেকে মুক্ত হয়েছে সে। খোলা জানলা দিয়ে তার বুকের মধ্যে ভরা জীবনের একটা নিশ্বাস প্রবেশ করে সবকিছু তোলপাড় করে তুলেছে। শুধু ভিতরে নয়, বাইরে, চারপাশের যেসব জিনিসকে প্রাণহীন বলে সে এতকাল জেনে এসেছে, যেসব জিনিসের এতটুকু স্থানান্তর সে ঘটায়নি, তার মৃত্যু-স্বপ্নের পাহারায় তাকে সাহায্য করবে বলে সেইসব জিনিসগুলোও যেন প্রাণ পেয়ে বেঁচে উঠেছে।

পলিয়ানি তার মা-র সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাড়িটির এবং তার চারপাশের দৃশ্যের প্রশংসা করছে— জুলিয়েত্তা শুনল, মনে হল, কী মধুর কণ্ঠস্বর লোকটির! মা পলিয়ানিকে বাড়ির প্রত্যেকটি ঘর ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগলেন, মনের মধ্যে ঝড়ের দোলা নিয়ে মেয়েও তাঁদের পিছন পিছন ঘুরতে লাগল। সত্যি সত্যি এই প্রায়-অচেনা লোকটি তার মরণ-মোহের মধ্যে ঢুকে পড়ে তাকে আবার জীবন্ত করে তুলল নাকি?

মনের এই আকস্মিক ভাবটি এত প্রবল হয়ে উঠল যে যখন তারা শোবার ঘরের কাছে এল তখন সে কিছুতেই সেই ঘরের মধ্যে ঢুকতে পারল না। লক্ষ করল যে তার মা আর পলিয়ানির মধ্যে যেন ঘরটি নিয়ে একবার দৃষ্টি বিনিময় হল। আর সে নিজেকে সামলে রাখতে পারল না— একেবারে ভেঙে পড়ল কান্নায়!

যে দুঃখে সে এতদিন বহুবার ভেঙে পড়েছে সেই দুঃখেই তার চোখ দিয়ে অবিরল জল পড়তে লাগল। কিন্তু এবারে সে যেন এক অস্পষ্ট উপায়ে বুঝতে পারল যে তার কান্নাও কোথায় যেন বদলে গেছে— আগের মতো তার কান্নার স্বর বুকের ভিতর দুঃখের প্রতিধ্বনি জাগিয়ে তুলল না, যেসব স্মৃতি-ছবি প্রতিবার কান্নার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের উপর ভেসে উঠত আজ আর তাদের দেখা মিলল না। এটা সে আরও স্পষ্ট বুঝতে পারল, যখন তার মা তাড়াতাড়ি এসে আগেকার মতো সেই একই কথায় তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন, মনে জোর আনতে বললেন। এই রকমের সান্ত্বনা আজ তার মোটেই ভাল লাগল না। অনেক চেষ্টা করে সে জোর করে কান্না থামিয়ে ফেলল। পলিয়ানি যখন তার মনটা বিক্ষিপ্ত করবার জন্যে বুকস্ট্যান্ডের উপর তার স্কেচ-এর অ্যালবামটা দেখাতে বলল, তখন সে যেন কৃতজ্ঞ বোধ করল। পলিয়ানি স্কেচগুলোর পরিমিত প্রশংসা করল, নতুন নতুন ইঙ্গিত দিল, ভুলগুলো দেখিয়ে দিল। প্রশ্নের উত্তরে জবাব দিতে গিয়ে দু’জনে আলোচনায় মেতে উঠল। সব শেষে জুলিয়েত্তার অসাধারণ ক্ষমতার কথা উল্লেখ করে পলিয়ানি তাকে ভালভাবে ছবি আঁকা শিখতে বলল! এই ক্ষমতার অপব্যবহার করা পাপ হবে, রীতিমতো পাপ। ছবিতে রং দেবার চেষ্টা সিনোরিনা কখনও করেছেন? করেননি? সত্যি! কিন্তু কেন? স্কেচ করার যাঁর এমন সুন্দর হাত, এমন উৎসাহ, তাঁর পক্ষে জিনিসটা মোটেও শক্ত হবে না।

ছবি আঁকা শেখানোর ভার নিতে রাজি হল সে। সিনোরিনাও শিখতে রাজি হলেন। ঠিক হল পরের দিন থেকেই নতুন বাড়িতে শেখানোর কাজ আরম্ভ হবে— বাড়িটি বোধহয় তাদের ডেকে নেবার জন্যে আনন্দে উন্মুখ হয়েছিল।

প্রায় দু’ মাস পরে, পলিয়ানির স্টুডিয়োতে সিরো কল্লি সোফার উপর লম্বা হয়ে পড়ে ছিল। স্টুডিয়োর ভিতরে একটা বিরাট স্মৃতিস্তম্ভ— কাজটি সবেমাত্র আরম্ভ হয়েছে। একটা পুরনো সুতির ওভারঅল দু’ পায়ের ফাঁকে সেফটি-পিন দিয়ে এঁটেছে কল্লি। পাইপ টানতে টানতে সে সামনে কাঠের কালো টুলটার উপর একটা কঙ্কালের সঙ্গে অদ্ভুত কথাবার্তা বলছিল। এক ডাক্তার-বন্ধুর কাছ থেকে মডেল করার জন্যে কঙ্কালটা ও চেয়ে এনেছে।

কঙ্কালটার মাথার খুলির উপর একটু বেঁকিয়ে একটা কাগজের টুপি সে পরিয়ে দিয়েছে। দেখাচ্ছে যেন কঙ্কালটা সৈনিক—সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ভাস্কর-কর্পোরাল সিরো কল্লি পাইপ টানার ফাঁকে ফাঁকে যে উপদেশ দিচ্ছে, তাই শুনছে মনোযোগ দিয়ে।

‘আচ্ছা শিকারে কি তোমার না গেলেই চলত না? বুঝতে পারছ, কী একটা বিশ্রী গোলমালের মধ্যে তুমি পড়ে গেছ! কদাকার ভূতের মতো হয়েছে চেহারা— কাঠির মতো পা…সমস্ত দেহটা একরাশ হাড় ছাড়া আর কিছু নয়। বাজে কথা থাক— তুমি কি এখনও মনে করছ যে জীবনের সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে? দেখো, দেখো জীবন তো পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাকিয়ে দেখো। কী সুন্দর করে আমি তাকে গড়েছি— যেমন রূপ তেমনি স্বাস্থ্য। তুমি বুঝি এই ভেবে আত্মশ্লাঘা অনুভব করছ যে, ওই মেয়েটি সত্যিই তোমাকে বিয়ে করতে চায়? হ্যাঁ, লজ্জিত মধুর আনত ভঙ্গিতে তোমার গা ঘেঁষে সে দাঁড়িয়েছে তা সত্যি; তোমার জন্যে বালতি-বালতি চোখের জল ঢেলেছে তাও সত্যি। কিন্তু বিয়ের আংটির কথা একবার বলে দেখো না— সেটি আর হবে না। ওই সব বাজে ধারণা মাথা থেকে ভাগাও… তার চেয়ে বরং এক কাজ করো, মেয়েটির পিছনে পয়সা খরচ করো, তোমার সর্বস্ব ঢেলে দাও। কী বললে?…ব্যাগসুদ্ধু সব টাকাকড়ি আগেই ওকে দিয়ে দিয়েছ! তা হলে আমি আর তোমার জন্যে এখন কী করতে পারি বলো?…যাক, যাক, আমাকে আর শোনাতে হবে না, কী বিপদে তুমি পড়েছ! আমি আগেই জানতাম তোমার কী দুর্দশা হবে। জানো তো, পৃথিবীটা ভারী বিশ্রী জায়গা, কাউকে বিশ্বাস করার জো নেই… তুমি জানো বোধহয় সম্প্রতি কী ঘটেছে, জানো না? তিনি ছবি আঁকা শিখছেন—কে? কে আবার, জীবন, জীবন গো! কে শেখাচ্ছে বলো দেখি? কনস্তানতিনো পলিয়ানি! হাঃ, হাঃ, হাঃ —কী? ব্যাপারটা একটু ঘোরালো মনে হচ্ছে, না? ঠাট্টার সীমানা পেরিয়ে যাচ্ছে? যদি তোমার অবস্থায় আমি পড়তাম তা হলে কী করতাম জানো? আমি পলিয়ানিকে ডুয়েল লড়তে বলতাম… আজ সকালে কী হয়েছে শুনেছ? আমার উপর কড়া হুকুম…তিনি পছন্দ করেন না, তাঁর বিশেষ বারণ, জীবনকে আমি নগ্নরূপ দিতে পারব না। এখন পলিয়ানি আসলে গাধা হলেও, ভাস্কর তো? সে জানে যে আগে নগ্ন মূর্তি না তৈরি করলে কোনও কাপড়চোপড় পরানো যায় না। এখন মজার ব্যাপারটা শোনো। তার প্রিয়ার মুখ এই সুন্দর নগ্ন মূর্তিটার উপর বসাতে দিতে পলিয়ানি রাজি ছিলেন না। সকালে তিনি স্টুডিয়োতে ঢুকেই— দেখোনি তাকে তুমি? বুঝলে, স্টুডিয়োতে ঢুকেই টুলের উপর দাঁড়িয়ে দু’-চারটে টানেই ওই মূর্তির যে মুখ আমি তৈরি করেছিলাম, সেটাকে একেবারে খারাপ করে দিলে। কেন এটা করল বলো তো, বন্ধু? আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও, করছ কী? আধ মিনিটের মধ্যে ওকে আমি কাপড় পরাচ্ছি। নগ্ন রাখব না কিছুতেই।’ কে শোনে কার কথা? ব্যাপারটা কী জানো! এখন ওরা জীবনের নগ্নরূপ দেখতে চায়— নগ্ন, আদিম জীবন। আমার প্রথম স্কেচটা যা— ছিল, সেই যে জীবন হবে একটা রূপক, সেই ভাবটাই এখন ওরা গ্রহণ করেছে। কাজে কাজেই জুলিয়েত্তার নিজের মূর্তি তৈরি করার কথা এখন আর উঠছেই না। ব্যাপারটা উলটে গেছে… এখন তুমি ওকে আঁকড়ে ধরতে চাইবে…আর সে চাইবে তোমার কাছ থেকে পালাতে। বোঝো এখন! বলতে পারো বন্ধু, শুধু-শুধু তোমার শিকারে যাবার কী দরকার ছিল?’

—কমলা রায়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *