নখের আঁচড়
শো শেষ করে গ্রিনরুমে এসে ধড়াচূড়া ছাড়ছি, পরদা সরিয়ে অনন্ত এসে ঘরে ঢুকল। বলল, মোহনদা, একজন ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। বাইরে অপেক্ষা করতে বলে এসেছি।
অনন্ত আমার ফাস্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট। ভীষণ কাজের ছেলে। ম্যাজিশিয়ান হিসেবে আমার যেটুকু নামডাক তার অনেকটাই অনন্তর জন্যে। ছেলেটার বুদ্ধি আছে, নিয়মমাফিক কাজ করে, আর খাটতেও পারে খুব। আমার সারা বছরের প্রোগ্রাম ও-ই ঠিক করে। বলতে গেলে অনন্ত একরকম আমার ম্যানেজার, ডান হাত, ফার্স্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট, সবকিছু। সেই গোড়া থেকেই ও আমার ম্যাজিকের দলে রয়েছে।
পাগড়ি, আলখাল্লা, সিল্কের পাজামা খুলে গুছিয়ে রাখতে রাখতে অনন্তকে বললাম, মিনিট দশেক পরে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ো।
অনন্ত ঘাড় নেড়ে ব্যস্তভাবে চলে গেল। আজ ওর ব্যস্ত থাকার কারণ আছে। সাতদিনের শো করতে আমরা রাণাঘাটে এসেছিলাম। আজ তার সপ্তম দিন শেষ হল। কাল ভোরেই আমরা রওনা হব কৃষ্ণনগরের দিকে। সেখানে দশদিনের প্রোগ্রাম আছে। সুতরাং শেষ রজনীর শো খতম হওয়ামাত্রই অনন্ত গোছগাছের তত্ত্বাবধানে লেগে পড়েছে। দলে আমি আর অনন্ত ছাড়া আছে আরও চোদ্দোজন মেয়ে-পুরুষ। তাদের সবরকম দায়দায়িত্বই অনন্তর একার কাঁধে।
পাজামা-পাঞ্জাবি পরে গায়ে একটা শাল জড়িয়ে নিলাম। শীতটা এবারে যেন বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। তাঁবুর ভেতরেও কাঁপুনি ধরে যায়।
একটু পরেই পরদা সরিয়ে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক এসে ঘরে ঢুকলেন। তার ঠিক পিছনেই অনন্ত। ওর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ও ভদ্রলোকের দিকে ইশারা করে ঘর ছেড়ে চলে গেল। আমি একটা টুল এগিয়ে দিয়ে তাঁকে বসতে বললাম।
আমি এখনও অটোগ্রাফ দেওয়ার মতো নামি ম্যাজিশিয়ান হইনি। ভোলা মাঠে তাঁবু ফেলে ম্যাজিক শো করাই আমার অভ্যেস। থিয়েটার হলের জাতে উঠতে পারিনি। সুতরাং আমার সঙ্গে লোকজন দেখা করতে আসে সাধারণত দুটো কারণে কোথাও শো করতে নিয়ে যাওয়ার চুক্তি করতে, কিংবা কোনও ম্যাজিকের কৌশল জানতে। প্রথমটির জন্যে আসে বয়স্করা, আর শেষের কারণে আসে ছেলে-ছোকরারা। এই ভদ্রলোক আমাকে কোথায় কল-শোর আমন্ত্রণ জানাতে চান?
ভদ্রলোকের পরনে ছাই রঙের ঢোলা ফুলপ্যান্ট। গায়ে ঢোলা একটা হাতকাটা বাদামি সোয়েটার। আর গলায় হলদেকালো চেক চেক কম্বল মাফলার। এককালে বোধহয় স্বাস্থ্য ভালো ছিল, এখন ভেঙে গিয়ে পোশাকগুলো ঢিলেঢালা হয়ে গেছে।
ভদ্রলোকের চোখের দিকে তাকালে বয়েস পঞ্চাশের এপিঠে বলে মনে হয়, কিন্তু তার ভাঙা গাল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখের নীচে কালি, এসব দেখামাত্রই বয়েসটা একলাফে ষাটের ওপিঠে চলে যেতে চায়।
টুলে বসে ভদ্রলোক গ্রিনরুমটা জরিপ করছিলেন। নানারকম জিনিসে ছোট্ট ঘরটা একেবারে জবরজং। পোশাক, টুল, কাঠের বাক্স, রঙিন ফিতে, বিচিত্র আসবাব, মুখোশ, পাখির খাঁচা, আরও কত কী! ভদ্রলোক বোধহয় কোনও ছোটখাটো জাদুকরের গ্রিনরুমে কখনও ঢোকেননি।
মিছিমিছি সময় বয়ে যাচ্ছিল দেখে শেষ পর্যন্ত আমিই মুখ খুললাম, বলুন, কী দরকার?
ভদ্রলোকের কপালে ভাঁজ পড়েছিল দুশ্চিন্তায়। আমার দিকে ফিরে কপাল সাফ করে হাসতে চেষ্টা করলেন। বললেন, মোহনবাবু, আমার নাম নিমাইচন্দ্র সরকার। চূর্ণি নদী পেরিয়ে গাঙনাপুরে আমি থাকি। এই সাতদিনে সাতবার আমি আপনার ম্যাজিক দেখেছি। দেখে মনে হয়েছে আপনিই আমাকে বাঁচাতে পারবেন, আমার ছেলেকে বাঁচাতে পারবেন।
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছিল। সাতবার আমার ম্যাজিক দেখে নিমাইবাবুর মনে হয়েছে আমি ওঁকে, ওঁর ছেলেকে বাঁচাতে পারি! ভদ্রলোক বলছেন কী! ওঁর মাথার গোলমাল হয়নি তো!
কিন্তু আমি কিছু বলে ওঠার আগেই ঠিক আমার মনের কথাটি পড়ে নিয়ে তিনি বললেন, মোহনবাবু, আমি পাগল নই। তবে মরিয়া মানুষ বোধহয় পাগলের মতোই আচরণ করে। আপনার ভাসমান তরুণীর খেলা দেখে আমি বুঝেছি আপনি সত্যি-সত্যি হিপনোটিজম জানেন। আর যে ভয়ানক বিপদে আমি পড়েছি তাতে হিপনোটিজম জানা কোনও বিশেষজ্ঞ ছাড়া বোধহয় আমার গতি নেই। অবশ্য তাতেও যদি সমস্যার সমাধান না হয় তা হলে ধরে নেব গোটা ব্যাপারটা অলৌকিক, ভূতপ্রেতের নিষ্ঠুর খেলা।
ভাসমান তরুণীর খেলায় আমি একজন পঙ্গু যুবতাঁকে সম্মোহিত করে শূন্যে ভাসিয়ে দিই। তারপর তার শরীরের ওপরে বিভিন্ন মুদ্রায় হাত চালিয়ে তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলি। বলা বাহুল্য, তরুণীটি মোটেই পঙ্গু নয়, আর পুরো ব্যাপারটাই স্রেফ ম্যাজিকের কৌশল। তবে আলোছায়াময় পরিবেশে অনন্তর দক্ষ পরিচালনায় আর আমার নিখুঁত উপস্থাপনায় ওই ম্যাজিকটা সব দর্শকদের একেবার মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। ম্যাজিকটা শেষ হলে সকলে যেন স্বপ্ন ভেঙে চেতনা ফিরে পায়।
নিমাইবাবু বললেন, মেয়েটিকে মঞ্চের ওপরে হিপনোটাইজ করার সময়ে আমি আপনার হাত চালানোর ভঙ্গি প্রতিদিনই খুব খুঁটিয়ে লক্ষ করেছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনি হিপনোটিজম জানেন..ভালোরকমই জানেন। দয়া করে অস্বীকার করবেন না। আমাকে আপনি বাঁচান, প্লিজ, মোহনবাবু।
ভদ্রলোক সোজা উঠে এসে আমার দু-হাত চেপে ধরলেন। ঝুঁকে পড়ে আর্ত অনুনয়ের সুরে বললেন, আমার যথাসাধ্য আপনাকে আমি দেব। দয়া করে এই হতভাগা বাপটাকে নিরাশ করবেন না।
আমি খুব দোটানায় পড়ে গেলাম।
মঞ্চের ব্যাপারটা অভিনয় হলেও হিপনোটিজম যে আমি জানি না তা নয়। অনেকের মতে বেশ ভালোই জানি। আর সেইসঙ্গে পড়তে শুরু করেছি সম্মোহনবিদ্যাসংক্রান্ত নানান বইপত্র। বহু দেশি-বিদেশি বই গুলে খেয়েছি, অভ্যাস করেছি দিনরাত, পরিশ্রম করেছি প্রাণপাত। এ পর্যন্ত সম্মোহন বা জাদুবিদ্যা কতখানি আয়ত্ত করতে পেরেছি জানি না, তবে জাদুকর মোহনকুমারের নাম পশ্চিমবাংলার লোকের কাছে এখন আর একেবারে অজানা নয়।
কিন্তু কাল ভোরেই যে সদলবলে আমাকে কৃষ্ণনগরে রওনা হতে হবে। আবার নিমাইবাবুর সমস্যাটা শুনতেও কৌতূহল হচ্ছে খুব। ভদ্রলোক এখনও আমার হাত দুটো আঁকড়ে ধরে রয়েছেন।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, আপনি এখানে বসুন। আমি একটু কথা বলে দেখি–
বেরিয়ে এসে দ্বিতীয় বড় গ্রিনরুমটায় অনন্তকে খুঁজে পেলাম। ওকে একপাশে ডেকে নিয়ে সংক্ষেপে সব জানালাম। ও খুব অবাক হয়ে গেল। চোখে-মুখে কৌতূহল ফুটে উঠল। আমি বললাম, অনন্ত, তুমি আর সবাইকে সবকিছু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কৃষ্ণনগরে রওনা করে দাও। আমরা দুজন আর একটা-দুটো দিন এখানে কাটিয়ে যাই। কৃষ্ণনগরে দুদিন দেরির ব্যাপারটা পরে ম্যানেজ করে নেব। এরকম বিচিত্র অভিজ্ঞতার সুযোগ আর বোধহয় আসবে না।
অনন্ত এককথায় রাজি।
আমি ফিরে এসে নিমাইবাবুকে সিদ্ধান্তের কথা বললাম। উনি প্রায় কেঁদে ফেললেন। নিজেকে কোনওরকমে সামলে নিয়ে বললেন, আপনারা তা হলে আমার বাড়িতে চলুন। দুটো দিন আমার অতিথি হয়ে সেখানেই থাকবেন। যেতে যেতে ঘটনাটা সবিস্তারে আপনাকে খুলে বলব।
আমি নিমাইবাবুর আশায় উজ্জ্বল শীর্ণ মুখটা দেখছিলাম। আমি কি পারব ওঁকে কিংবা ওঁর ছেলেকে বাঁচাতে?
.
সামান্য লটবহর নিয়ে অনন্ত একটা সাইকেল রিকশায় উঠল। অন্য একটা রিকশায় উঠলাম আমি ও নিমাইবাবু। রিকশা গাঙনাপুরের পথে রওনা হতেই ঘড়ি দেখলাম। সাড়ে নটা। আমাদের রিকশা অনন্তকে পথ দেখিয়ে চলল। এর মধ্যেই রানাঘাটের আলো-জনরব স্তিমিত হয়ে চারপাশে ঘুম নেমে আসছে। রিকশার হর্ন বলতে গেলে বাজাতেই হচ্ছিল না।
নিমাই সরকার সিগারেট বের করে আমাকে দিলেন, নিজে একটা ঠোঁটে রাখলেন। তারপর দেশলাই জ্বেলে দুটো সিগারেটে আগুন ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়লেন। ধীরে-ধীরে বললেন, মোহনবাবু, মাত্র মাসখানেক হল আমি কৃষ্ণনগরে বদলি হয়ে এসেছি। সেখানে ঘর পেতে অসুবিধে হচ্ছিল, তখন পরিচিত একজন গাঙনাপুরে একটা বাড়ির সন্ধান দেয়। বেশ সস্তায়। ফলে রাজি হয়ে গেলাম। সেখানে থেকেই কৃষ্ণনগরে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করি। আমার বাড়িটা একতলা। গুটি তিনেক ঘর, বাথরুম, রান্নাঘর, আর ছোট্ট এক টুকরো বাগান মতো আছে পিছনদিকে। আমার সংসার ছোট। স্ত্রী আর দুই ছেলে। বড় ছেলে বিনোদ একটা ওষুধ কোম্পানির সেলসম্যান, আর ছোট ছেলে রূপক ক্লাস টেন-এ পড়ে। আমি বদলি হওয়ায় ও একমাস হল রানাঘাট হাই স্কুলে পড়ছে। আগে আমরা কলকাতায় ছিলাম। তখন ও হিন্দু স্কুলে পড়ত। পড়াশোনায় বেশ ভালো। তবে দিন পনেরো হল ওকে নিয়েই গোলমালটা শুরু হয়েছে।
রিকশা গতি নিয়েছে। শীতের বাতাস গায়ে বিঁধছে ছুঁচের মতো। আকাশে আধখানা চাঁদ আর কুচি কুচি তারা। আমি নিমাইবাবুর দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছিল।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উনি আবার বলতে শুরু করলেন ও রূপকের একটা বদ অভ্যেস আছে। ও ঘুমের মধ্যে প্রায়ই কথা বলে। কিন্তু সে-কথার মাথামুন্ডু কিছুই বোঝা যায় না। তা ছাড়া মাঝে-মাঝে ও কোনও-কোনও কাজ করে যা পরে ওর একদম মনে থাকে না। বেমালুম ভুলে যায়। অথচ পড়াশোনার ক্ষেত্রে এরকম ভুল ওর হয় না। যাই হোক, এ নিয়ে আমরা তেমন দুশ্চিন্তায় পড়িনি। ভেবেছি, বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু দিন পনেরো আগে একটা ঘটনা আমাদের সবাইকে ভয় পাইয়ে দিল।
নিমাইবাবু সিগারেটে গভীর টান দিলেন। একটা ছোট কাশি সামলে নিয়ে বললেন, বিনোদ প্রায় দিন কুড়ি আগে কোম্পানির কাজে ট্যুরে গিয়েছিল। ও থাকলে দু-ভাই একসঙ্গেই শোয়। বিনোদ চলে যাওয়ার পর রূপক একাই শুতে চাইল। ওর মা-কে স্পষ্ট জানিয়ে দিল, একা শুতে ওর একটুও ভয় করে না। আমরাও আর জোর করিনি। কিন্তু দিন পনেরো আগে, একটু আগে যা বলছিলাম, দেখি ঘুম থেকে উঠে রুপু খুব খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে আয়নায় মুখ দেখছে। একটু পরে ও আমার কাছে এসে বলল ভালো করে ওর মুখটা দেখতে। ছেলেটা কেমন যেন দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। একটু ভয়ও পেয়েছিল বোধহয়…।
আমি আর থাকতে না পেরে জিগ্যেস করলাম, কী কী দেখলেন ওর মুখে?
সামনের আঁধারি পথের দিকে চোখ রেখে ক্লান্ত স্বরে নিমাইবাবু বললেন, ছোট-ছোট কয়েকটা আঁচড়ের দাগ। দেখে নখের আঁচড় বলেই মনে হল। ধারালো নখের সূক্ষ্ম আঁচড়।
নিমাইবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমাদের রিকশা এখন চূর্ণি নদীর ব্রিজের ওপর দিয়ে চলেছে। আমি গায়ের শালটাকে আরও ভালো করে জড়িয়ে নিলাম। হাতের সিগারেটে শেষ টান দিয়ে টুকরোটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। বললাম, তারপর?
তারপর আর কী! পরদিনও আবার সেই নখের আঁচড়! মুখে আর হাতে। লক্ষ করলাম, দু-এক জায়গায় বিন্দু বিন্দু রক্তও জমাট বেঁধে রয়েছে। অথচ রুপু এর বিন্দুবিসর্গও কিছু জানে না। মোহনবাবু, এদিকটা বেশ খোলামেলা জায়গা, গাছগাছালিও কম নয়। সুতরাং নানা জাতের পাখিও অনেক আছে। আমি ভেবেছি, রাত-বিরেতে আঁধারকানা কোনও পাখি হয়তো জানলা-টানলা দিয়ে ঢুকে পড়েছে রূপকের শোওয়ার ঘরে। তারপর অন্ধকারে দিশেহারা হয়ে ঘরময় উড়ে বেড়িয়েছে, আর তখনই রুপুর হাতে-মুখে তার নখের আঁচড় লেগেছে। রুপু হয়তো অঘোরে ঘুমোচ্ছিল, তাই টের পায়নি। পরে পাখিটা জানলা দিয়েই কোনওরকমে আবার উড়ে বেরিয়ে গেছে। তবে একটা কথা, এরকম সন্দেহ আমার হয়েছিল বটে, কিন্তু পাখির ওড়াউড়ির জন্যে ঘরের কোনও জিনিস ওলটপালট অবস্থায় দেখিনি। সে যাই হোক, তৃতীয় রাতে রুপুকে সব জানলা-দরজা ভালো করে ছিটকিনি এঁটে ঘুমোতে বললাম। কিন্তু পরদিনও একই ব্যাপার। বরং আঁচড়ের চিহ্ন যেন আরও বেশি।
ঘরে ঘুলঘুলি আছে? আমি নিমাইবাবুকে বাধা দিয়ে প্রশ্ন করলাম।
–আছে, তবে সেগুলো সিমেন্টের ঢালাই করা। একটা চড়ুই পাখিও গলতে পারে না।
–তারপর?
–তারপর আর কী! একদিন দু-দিন ছাড়া-ছাড়া ওই একই ব্যাপার। আমি ওর সঙ্গে রাতে শুয়ে দেখেছি, কিন্তু কিচ্ছু টের পাইনি। ওর মা শুয়েছে, কিন্তু আঁচড়ের চিহ্ন ঠেকাতে পারেনি। বিনোদ দিন চারেক আগে ফিরে এসে সব শুনেছে। শুনে সারা রাত্তির জেগে ছোটভাইকে পাহারা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু মাঝরাতে আচমকাই ও ঘুমের ঘোরে ঢলে পড়েছে। ঘুম ভেঙেছে সেই সকালে। রূপকের হাতে-মুখে তখন নতুন নখের আঁচড় পড়েছে। আমি আর আমার স্ত্রীও রাত জেগে রুপুকে পাহারা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমাদের অবস্থাও হয়েছে ঠিক বিনোদের মতো। হঠাৎই যেন গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গেছি।
চূর্ণি নদী পেরিয়ে গাঙনাপুরে কিছুটা ঢুকে পড়েছি। পিছনে তাকিয়ে অনন্তর রিকশাটাকে একবার দেখে নিলাম। নিমাইবাবু পুরোনো সিগারেট শেষ করে নতুন একটা ধরিয়েছেন। তাতে কয়েকটা টান দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আলো-আঁধারির মধ্যেও তাঁর চোখ স্পষ্ট দেখতে পেলাম। তিনি যেন নীরবে আমাকে অনুনয় করে বলছেন, মোহনবাবু, কিছু বলুন।
আমি জিগ্যেস করলাম, রূপককে ডাক্তার দেখিয়েছেন?
ক্লান্তভাবে নিমাই সরকার বললেন, হ্যাঁ, এমনিতেই তো আঁচড়ের জন্যে টেট ভ্যাক ইঞ্জেকশান দিতে হয়েছে। তা ছাড়া একজন সাইকিয়াট্রিস্ট-এর সঙ্গেও কথা বলেছি। ভদ্রলোক কৃষ্ণনগরে বসেন। উনি সব শুনে-টুনে বেশ ঘাবড়ে গেলেন। তারপর বললেন, ঘুমের ঘোরে ও নিজেই নিজের হাতে মুখে আঁচড় কাটে না তো! তখন আমি বলেছি, না, কারণ আঁচড়গুলো বেশ সূক্ষ্ম–অনেকটা সুতোর মতো। মানুষের নখে হওয়ার কথা নয়। পরে আমি এক সকালে রুপুর নখ পরীক্ষা করে দেখেছি। সেখানে ছাল-চামড়া বা রক্তের কোনও চিহ্ন দেখিনি।
নিমাই সরকার হতাশার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এই ঘটনার যুক্তিসঙ্গত কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে না পেয়ে সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোক আমাকে সমনামবুলিজম, হিপনোটিজম, মেসমেরিজম, এইসব ভারী-ভারী শব্দ শুনিয়েছিলেন। তার মধ্যে হিপনোটিজম শব্দটাই আমার যা একটু চেনা। তখন হিপনোটিজম নিয়ে কয়েকদিন বেশ পড়াশোনা করলাম, কিন্তু রহস্যের কিনারা করতে পারলাম না। পরে আমার স্ত্রী কমলাকে হিপনোটিজম-এর কথা বলতেই সে আপনার কথা আমাকে বলল। পোস্টার না হোর্ডিং কিসে যেন সে দেখেছে আপনি রানাঘটে আসছেন সাতদিনের শো করতে। এমনিতে আমরা তো খুবই ভেঙে পড়েছিলাম, তা ছাড়া পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধুবান্ধবদের নানারকম উপদেশ আর পরামর্শে আমি কীরকম যেন বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ফলে কমলার কথাটা বেশ মনে ধরল…।
ডানদিকের একটা পুকুরে চাঁদের ছায়া পড়েছিল। সেদিকে এক পলক চোখ রেখেছিলাম। হঠাৎই টের পেলাম নিমাইবাবুর কর্কশ হাতের চেটো আমার হাতের ওপরে। তিনি চাপা গলায় বললেন, এখন আপনিই আমাদের শেষ ভরসা, মোহনবাবু!
তারপর একটু থেমে গলার স্বর স্বাভাবিক করে আবার বললেন, আমরা এসে গেছি।
চোখে পড়ল, সামনে খানিকটা ফাঁকা জমিতে একটা একতলা বাড়ি। তার থেকে বেশ কিছুটা দূরে দু-চারটে একই ঢঙের বাড়ি দাঁড়িয়ে। তারও ওপিঠে কয়েকটা আলোর বিন্দু, গাছগাছালি, আর অন্ধকার।
রিকশা থেকে নেমে নিমাইবাবুর বাড়িতে ঢোকামাত্রই আমার কেমন শীত শীত করে উঠল।
.
পরিচয় এবং খাওয়াদাওয়ার পালা শেষ করে আমি আর অনন্ত রূপকের শোবার ঘরে এলাম। ও তখন পড়াশোনা শেষ করে সবে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়েছে। বিনোদ একপাশে একটা চেয়ারে বসে একটা বই পড়ছিল। আমাদের ঢুকতে দেখেই উঠে দাঁড়াল। ওর হাতে একটা টর্চ ছিল। সেটা আমাকে দিয়ে মলিন হেসে বলল, এটা রাখুন। একটু থেমে আবার বলল, আমি তা হলে যাই। রাত-বিরেতে কোনও দরকার পড়লেই ডাকবেন কিন্তু।
লক্ষ করলাম, বাইশ-তেইশ বছরের যুবকটিকে এখনই কেমন বুড়োটে দেখাচ্ছে। নিমাইবাবু আমাদের পিছনে-পিছনে ছেলেদের শোওয়ার ঘরের দরজা পর্যন্ত এসেছিলেন। চাপা গলায় আয় বিনু বলে বিনোদকে ডেকে নিলেন।
ওঁরা চলে যেতেই টর্চটা পকেটে রেখে আমি চটপট দরজা বন্ধ করে দিলাম। শুধু-শুধু দেরি করে লাভ নেই। অনন্ত তখন ঘরের প্রতিটি ইঞ্চি খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখছে। আর রূপক শুয়ে-শুয়েই কৌতূহলী চোখে আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে।
বাড়িতে এসে কমলাদেবীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ভদ্রমহিলা যে ভীষণ ভেঙে পড়েছেন তাতে সন্দেহ নেই। রূপকের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলছিলেন বারবার। বড় ভাই বিনোদ খুব কম কথা বলছিল। ছোট ভাইকে সুস্থ করতে না পারার গ্লানি বোধহয় ওকে ভিতরে ভিতরে কষ্ট দিচ্ছিল।
রূপককে সেই তুলনায় বেশ হাসিখুশি দেখছি। মা-বাবা-দাদার মনমরা ভাব ওকে সে সামান্য অবাক করেছে তা-ও ওর অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট ছিল। প্রথম পরিচয়ের সুযোগেই ওর সঙ্গে বেশ আলাপ জমিয়ে নিয়েছি। এমনকী দু-চারটে চটজলদি ম্যাজিক দেখিয়ে ওকে একেবারে তাক লাগিয়ে দিয়েছি। বলেছি, চলে যাওয়ার আগে অনেক ম্যাজিক ওকে শিখিয়ে দিয়ে যাব। অনন্তও ম্যাজিকের নানান গল্প করে ওর সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব করে ফেলেছে। খেতে বসে লক্ষ করছিলাম, ওরা একমনে গল্প করে চলেছে, আর মাঝে-মাঝেই হেসে উঠছে একসঙ্গে।
আমি রূপকের কৌতূহলে ভরা মিষ্টি মুখটা দেখলাম। অলৌকিক আঁচড়ের চিহ্নগুলো এক নিষ্ঠুর ছবি এঁকে দিয়েছে সেখানে। তবে কোনও আঁচড় থেকেই ঘা হয়নি। নিমাইবাবুর কাছে শুনেছি, ওকে নিয়মিত অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হচ্ছে। তা ছাড়া টেট ভ্যাক ইঞ্জেশান তো নেওয়াই রয়েছে। সেইজন্যেই জ্বালাযন্ত্রণা থেকে রেহাই পেয়েছে বেচারা।
অনন্তকে বললাম, ঘরের সব জানলা ভালো করে বন্ধ করে ছিটকিনি এঁটে দাও।
অনন্ত কোনও প্রশ্ন না করে কাজে লেগে গেল। আমি ঘরের ভিতরে অনুসন্ধানী চোখ বুলিয়ে নিলাম। একটা ডবল বেড খাট-রূপক আর বিনোদের জন্যে। একজোড়া চেয়ার, একটা টেবিল, টেবিলের পাশে দেওয়ালের তাকে রূপকের বই-খাতা, টেবিলেও তার কিছু কিছু ছড়ানো। দেওয়ালে দুটো ক্যালেন্ডার–দুটোই ওষুধ কোম্পানির। একটা দেওয়াল-আয়না, তাছাড়া দুর্গা ও সরস্বতীর ফটো ফ্রেমে বাঁধানো। খাটের তলায় দুটো ট্রাঙ্ক আর একটা বেতের মোড়া।
ঘরে মোট চারটে জানলা, একটা দরজা, আর দুটো ঘুলঘুলি। ঘুলঘুলির ফাঁকগুলো খুব ছোট যেমনটি নিমাইবাবু বলেছিলেন।
আমার কথায় চারটে জানলার কাচের পাল্লাই অনন্ত ঠিকঠাক এঁটে দিল। তারপর খাটের ওপরে গিয়ে বসল। রূপককে জিগ্যেস করল, ভয় করছে?
রূপক বলল, না।
তারপর একটু চুপ করে থেকে আমার দিকে তাকিয়ে ও প্রশ্ন করল, মোহনদা, তোমরা ওটাকে ধরতে পারবে তো?
আমি অবাক হয়ে বললাম, কাকে?
রূপক চোখ বড় বড় করে বলল, ওই কালো ভ্যাম্পায়ারটাকে। যেটা মাঝরাতে এসে আমার গায়ে আঁচড় কেটে রক্ত খেয়ে যায়।
–এসব কথা তোমাকে কে বলেছে?
–ইস্কুলের বন্ধুরা। গল্পের বইয়ে নাকি এরকম লেখা আছে।
আমার খুব কষ্ট হল। ক্লাস টেনের ছেলে, কিন্তু মনটা এখনও অনেক কচি কাঁচাও বলা যায়।
আমি ওর কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ওসব বাজে কথা। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আমি আর অনন্তদা তোমার অসুখ সারিয়ে দেব। কোনও ভয় নেই। কাল থেকে তোমার গায়ে কেউ আর আঁচড় কাটবে না।
রূপক আশ্বস্ত হয়ে চোখ বুজল। কিন্তু আমার কথাগুলো নিজের কানেই কেমন ফাঁকা আওয়াজের মতো শোনাল। নিমাইবাবু তিনটে কথা আমাকে বলেছিলেন ও সমবুলিজম, হিপনোটিজিম আর মেসমেরিজম। কেন যেন মনে হচ্ছে এর মধ্যেই কোথাও রহস্যের সূত্র লুকিয়ে আছে। এর ওপর ভিত্তি করে একটা থিয়োরিও আমি খাড়া করেছি।
পাশের ঘরের দেওয়াল-ঘড়িতে ছমছমে শব্দ করে রাত এগারোটা বাজল। রূপক পাশ ফিরে গুটিশুটি মেরে শুল। মনে হল ঘুম আসতে ওর দেরি হবে না। আমি এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে একটা লাঠি জাতীয় অস্ত্র খুঁজছিলাম, হঠাৎই চোখ গেল রূপকের পড়ার টেবিলের পিছনে। দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো রয়েছে একটা হকি স্টিক। এগিয়ে গিয়ে সেটা বের করে নিলাম। বেশ মজবুত। অনন্ত প্রশ্ন ভরা চোখে আমাকে লক্ষ করছিল। তাই হেসে ছোট্ট করে বললাম, সাবধানের মার নেই।
অনন্ত বলল, আমাদের যেমন করে তোক জেগে থাকতেই হবে, মোহনদা। হঠাৎ করে ঘুমে ঢলে পড়লে চলবে না।
আমি বললাম, নিশ্চিন্ত থাকো, সে ভয় নেই। আমি দরজার কাছে চেয়ার নিয়ে বসছি। তুমি বিছানায় থাকবে। নাও, এবারে আলো নিভিয়ে দাও।
অনন্ত উঠে গিয়ে সুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিল। ঝুপ করে অন্ধকার লাফিয়ে নেমে এল ঘরে। শরীরের প্রতিটি স্নায়ু উল্কণ্ঠা ও উত্তেজনায় টানটান। অপেক্ষা করছি কোনও ভয়ংকর ঘটনার জন্য। তবে কী সে ঘটনা তা জানি না। আর আজ রাতে সে-ঘটনা ঘটবে কি না তা-ও জানি না। কিন্তু তবুও সজাগ থাকতেই হবে। নিষ্পাপ ছেলেটাকে বাঁচাতেই হবে এই নিষ্ঠুর অভিশাপ থেকে।
অন্ধকার ভেদ করে রূপকের লেপে মোড়া দেহটা অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। অনন্তর চেহারাও খানিকটা বোঝা যাচ্ছে। জানলার কাচের শার্সির ওপিঠে শীতের রাত ঘুটঘুটে অন্ধকার। গাছপালা আকাশ কিছুই প্রায় চেনা যাচ্ছে না। খুব ভালো করে নজর করলে কয়েকটা তারার ফুটকি শুধু চোখে পড়ে। মাঝে-মাঝে ভেসে আসছে রাতপাখির ডাক আর শেয়ালের আর্তকান্না।
অপেক্ষায় কতক্ষণ কেটে গেছে জানি না, হঠাৎই একটা অদ্ভুত তন্দ্রার আমেজ আমার কাঁধে চেপে বসল। চোখের পাতা হঠাৎই হয়ে উঠল লোহার মতো ভারী, আর মনটা যেন পলকে কুয়াশা মোড়া ঝাপসা হয়ে গেল। কিন্তু তখনও স্পষ্ট অনুভব করতে পারছি, একটা গাঢ় থমথমে বাতাস যেন ঘরের ভিতরে জাঁকিয়ে বসছে। ঠিক ফুটবলে পাম্প করা বাতাসের মতো ঘরের বাতাসের চাপ বাড়ছে…ক্রমেই বাড়ছে। চোখ বুজে আসতে চাইছে। আর নাম-না-জানা এক বুনো গন্ধ নাকে ঢুকে পড়ে সমস্ত চেতনাকে যেন অবশ করে দিচ্ছে।
আমি এক ঝটকায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। হকি স্টিকটাকে শব্দ করে মেঝেতে ঠুকলাম একবার। কিন্তু কোনও অলৌকিক বাতাস যেন আমার শরীরের সমস্ত শক্তি ক্রমশ শুষে নিচ্ছে। আর কতক্ষণ আমি দুপায়ে খাড়া থাকতে পারব জানি না। প্রাণপণ চেষ্টায় হকি স্টিকটা মেঝেতে আবার ঠুকলাম। এপাশ-ওপাশ ঝটকা মেরে মাথা ঝাঁকিয়ে ডেকে উঠলাম, অনন্ত! অনন্ত!…তার পর পকেট থেকে টর্চ বের করে খাট লক্ষ্য করে বোতাম টিপলাম।
কোনও উত্তর নেই। অনন্ত আর রূপক দুজনেই ঘুমে অসাড়। টর্চ নিভিয়ে দিলাম।
বন্ধ কাচের জানলার বাইরে রাতের চেয়েও গাঢ় অন্ধকার কোনও ছায়া যেন নেমে এসেছে। ঘিরে ধরেছে নিমাই সরকারের ছোট্ট বাড়িটাকে।
আমার ইচ্ছাশক্তির সঙ্গে অন্য কারও ইচ্ছাশক্তির প্রচণ্ড লড়াই চলছিল। আড়ালে থেকে কেউ যেন শুষে নিতে চাইছে আমার মনের জোর, মনের সমস্ত প্রতিরোধ। আমি আবার চিৎকার করে অনন্তর নাম ধরে ডেকে উঠলাম।
কোনও সাড়া নেই। তবে রূপক ঘুমের ঘোরেই জড়ানো গলায় কী যেন বলে উঠল।
এবারে স্পষ্ট বুঝলাম, আড়ালে অদৃশ্য থেকে কেউ আমাদের সম্মোহিত করতে চাইছে! কে সে? কোন সম্মোহন-বিশারদ?
প্রাণপণ জেদ আর প্রতিজ্ঞায় নিজেকে সচেতন রাখলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার তন্দ্রার ভাবটা কেটে গেল। বুঝলাম, লড়াইয়ে জিতে গেছি। কিন্তু তখনও মাথাটা সামান্য ঝিমঝিম করছিল।
বিনোদ বলেছিল রাত-বিরেতে কোনও দরকার পড়লেই ডাকতে। অতএব বেশ চিৎকার করেই বিনোদ এবং নিমাইবাবুর নাম ধরে কয়েকবার ডাকলাম। ফল যা আশা করেছিলাম তাই হল : কোনও সাড়া নেই।
ঠিক কী যে ঘটতে চলেছে সেটা স্পষ্ট বুঝে উঠতে না পারায় কিছুটা দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। আবার টর্চ জ্বেলে অন্ধকার ঘরের নানান কোণে সতর্কভাবে নজর করে দেখলাম। ভাবলাম, ঘরের আলোটা জ্বেলে দিই, কিন্তু কাজে তা করে ওঠার আগেই দেখি এক ঝটকায় লেপ সরিয়ে রূপক বিছানায় উঠে বসেছে। সঙ্গে সঙ্গে টর্চ নিভিয়ে দিলাম। হকি স্টিকটা শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে ওকে লক্ষ করতে লাগলাম।
রূপক খুব স্বাভাবিক ও অভ্যস্তভাবে বিছানা থেকে নেমে এল। জামা সোয়েটার সব ঝটপট গায়ে চড়িয়ে নিল। তারপর ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।
আমি উত্তেজিত হয়ে ডাকলাম, রূপক! রূপক!
ও ভ্রূক্ষেপও করল না। মনে হল না আমার ডাক শুনতে পেয়েছে। দরজার দিকে তড়িঘড়ি এগোতে গিয়ে রূপক চেয়ারে টেবিলে ধাক্কা খেল–অনেকটা অন্ধ মানুষের মতো। কিন্তু যন্ত্রণা বা বিরক্তির কোনও শব্দ বেরিয়ে এল না ওর মুখ থেকে। পরক্ষণেই আমাকে পাশ কাটিয়ে ও দরজার কাছে পৌঁছে গেল। তারপর ছিটকিনি খুলে দরজা হাট করে সোজা ঘরের বাইরে।
আমি অনন্তকে বৃথাই আরও বারদুয়েক ডাকলাম। তারপর টর্চ আর হকি স্টিক বাগিয়ে ধরে রূপককে অনুসরণ করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
বাইরে বারান্দায় এসে রূপক জুতো পরে নিল। তারপর সদর দরজা খুলে বেরিয়ে গেল বাড়ির বাইরে।
ওকে অনুসরণ করতে আমার বেশ কষ্ট হচ্ছিল। যেন ভারী বাতাস ঠেলে লড়াই করে এগোতে হচ্ছে। কিন্তু চটি জোড়া পায়ে গলিয়ে চটপট বাইরে আসতেই দমচাপা আবহাওয়াটা যেন একটু হালকা হল।
এপাশ-ওপাশ তাকাতেই রূপককে দেখতে পেলাম। ডানদিকে বাঁক নিয়ে ও বাড়ির পিছনদিকে যাচ্ছে। আধখানা চাঁদের আবছায়া আলোয় ওকে দেখতে তেমন অসুবিধে হচ্ছিল না। কিন্তু যখন ও ফাঁকা জমিতে এসে পড়ল তখন যেন মনে হল একটা কুৎসিত কালো কুয়াশা ওকে ঘিরে রয়েছে। ফলে রূপক অনেকটা অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে আমার চোখে।
রূপককে অনুসরণ করে কতক্ষণ পথ চলেছি মনে নেই। অন্ধকার মাঠ, গাছপালা, ডোবা পুকুর, সব পেরিয়ে অবশেষে যেখানে এসে ও থামল, সে-জায়গাটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। একপাশে একটা উঁচু পাঁচিল, আর তার গা ঘেঁষে বিশাল বিশাল একজোড়া বটগাছ। তাদের ডালপালা, পাতা, ঝুরি সব মিলে চাঁদের আলোকে রুখে দিয়েছে।
আমি কিছুটা দূরত্ব রেখে রূপককে অনুসরণ করছিলাম। অন্ধকার জায়গাটায় ঢুকে পড়তেই আমি রূপককে আর দেখতে পেলাম না। নিঝুম রাতের কনকনে শীতে আমার হাত-পা কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল, হকি স্টিকটা এই বুঝি মুঠো থেকে আলগা হয়ে পড়ে যাবে। নিতান্তই মনের জোরে সামনে এগিয়ে চললাম।
এদিকটায় কোনও বসতি নেই। সামনে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা যে-পুরোনো আমলের বাড়িটা দেখতে পাচ্ছি সেটা বোধহয় পরিত্যক্ত। হয়তো কোনওকালের রাজবাড়ি কি জমিদারবাড়ি হবে। আর একটু এগোতেই অন্ধকার এবং পাঁচিল বাড়িটাকে সম্পূর্ণ আড়াল করে দিল। তারপরই একটা উৎকট দুর্গন্ধ আমার নাকে এল।
গাঢ় অন্ধকারের ভিতরে পুরোপুরি ঢুকে পড়তেই একটা খসখস শব্দ আমার কানে এল। তরপরই ঝটপটানির শব্দ এবং কয়েকটা চাপা কর্কশ চিৎকার। আমি টর্চ জ্বেলে ওঠার আগেই হুটোপুটি আরও বেড়ে গেল, বেড়ে উঠল চিৎকার।
টর্চ জ্বালতেই এক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল।
প্রকাণ্ড মাপের চার-পাঁচটা শকুন জোড়া-বটগাছের গুঁড়ির কাছে রূপককে ঘিরে ঝটপটিয়ে বেড়াচ্ছে। আঁধারকানা হয়ে শকুনগুলো ছেলেটাকে আঁচড়াচ্ছে, ঠোকরাচ্ছে, বিশাল ডানা ঝাঁপটে কর্কশ চিৎকার করছে। কিন্তু ছেলেটার সেসব দিকে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। যেন শকুনগুলোর কোনও অস্তিত্বই ও টের পায়নি। ও একমনে বটগাছের গুঁড়ির কাছে এখানে-ওখানে বিক্ষিপ্তভাবে মাটি খুঁড়তে চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে, লুকোনো কিছু যেন মরিয়া হয়ে খুঁজছে।
টর্চের আলো একটু বাঁদিকে ঘোরাতেই দুর্গন্ধের উৎসটাও খুঁজে পেলাম। মৃত পশুর একটা ভাগাড়। শেয়াল-শকুনে খুবলে খাওয়া গলিত শবদেহের নরক। কয়েকটা কালো শকুন সেখানে বসে আছে। উশখুশ করছে।
আমি হাতের টর্চটা জুলন্ত অবস্থাতেই মাটিতে রাখলাম। তারপর হকি স্টিক নিয়ে এগিয়ে গেলাম আচ্ছন্ন রূপককে শকুনের হিংস্র নখের আঁচড়ের হাত থেকে বাঁচাতে। ও তখনও বটগাছের গোড়ায় মাটি খোঁড়ার চেষ্টা করছে।
আমি বারকয়েক এলোপাতাড়ি স্টিক চালাতেই শকুনগুলো তীব্র চিৎকার করে সরে গেল তফাতে। আমার গায়ের শালটা খুলে পড়ে গেল। আমি তখনও ক্ষিপ্তের মতো হকি স্টিক চালাচ্ছি। কনকনে শীতের অনুভূতি মুহূর্তেই যেন উবে গেছে।
রূপকের নাম ধরে কয়েকবার ডাকলাম। ও শুনতেই পেল না। তখন ঝুঁকে পড়ে ওর হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান মারলাম। কিন্তু ও ঝটকা দিয়ে আমার হাত ছাড়িয়ে নিল। আবার মাটি খুঁড়তে লাগল।
শকুনগুলো আবার ধেয়ে এসেছে আমাদের কাছে। ঠোঁট নখে আক্রমণ করতে চেষ্টা করছে। ওদের শরীরের বিশ্রী গন্ধে যেন বমি পেয়ে যাবে এখুনি। আমি স্টিক ঘুরিয়ে আবার ওদের হটিয়ে দিলাম। তারপর রূপকের হাত ধরে প্রাণপণে টান মারলাম। ও বাধা দিতে চেষ্টা করল। টের পেলাম, রোগা ছেলেটার শরীরে কী অস্বাভাবিক ক্ষমতা! যেন অলৌকিক কোনও শক্তি ভর করেছে। তবে আমি হাল ছাড়লাম না। ওর সঙ্গে ধস্তাধস্তি চালিয়ে গেলাম পুরোদমে। ওকে ঘিরে থাকা একটা রহস্যময় কুয়াশা আমার এই আক্রমণে অস্থিরভাবে পাক খেতে লাগল। একটা বুনো গন্ধ নাকে আসছিল–আমার চেতনা অবশ করে দিতে চাইছিল যেন। আমি লড়াই করে চললাম–শরীর ও মনের লড়াই।
হঠাৎই কুয়াশাটা কেটে গেল। মনের চাপটাও হালকা হয়ে গেল একইসঙ্গে। দড়ি টানাটানির খেলায় আচমকা কেউ যেন অন্য প্রান্তের মুঠো আলগা করে দিয়েছে।
রূপকের প্রতিরোধ শিথিল হয়ে এল। ওকে টেনে দাঁড় করিয়ে ছুটতে চেষ্টা করলাম। হকি স্টিক ফেলে রেখে জ্বলন্ত টর্চটা তুলে নিলাম। টর্চের আলোর তেজ কিছুটা কমে এলেও একেবারে অকেজো হয়ে যায়নি। কোথা থেকে দু-টুকরো ছেঁড়া মেঘ এসে চাঁদকে আড়াল করে দিয়েছে। ফলে ফেরার পথে টর্চের আলো কাজে লাগল। ঘোলাটে অন্ধকারে দ্রুত পা ফেলে আমরা ফিরে চললাম। রূপকের মুখে কোনও কথা নেই। যন্ত্রের মতো আমার পাশে পাশে পা চালিয়ে চলেছে। শকুনগুলোর ডানা ঝাপটানির শব্দ এখন কানে আসছে না বটে, তবে তাদের কর্কশ ডাকের বিক্ষিপ্ত অংশ এখনও শোনা যাচ্ছে।
নিমাইবাবুর বাড়িতে যখন পৌঁছোলাম তখন শরীর ভীষণ ক্লান্ত। একইসঙ্গে ঠান্ডা লেগে গলা ভারী হয়ে উঠেছে।
রূপকের ঘোর তখনও বোধহয় পুরোপুরি কাটেনি। কারণ, ও জুতো খুলে প্রথমেই গেল কলতলার দিকে। মাটি-মাখা হাত-পা ধুয়ে নিল। তারপর হাত-পা মুছে সটান ওর ঘরে গিয়ে ঢুকল। জামাকাপড় ছেড়ে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। আমি ঘরের আলো জ্বেলে ওর কিশোর মুখটির দিকে দেখলাম। সরল নিষ্পাপ ঘুমন্ত মুখে বিশ্রী নখের আঁচড়। কয়েক জায়গায় রক্তও ফুটে বেরুচ্ছে। জানি, ওর হাতেও একইরকম চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে।
ফিরে এসে বাড়িটাকে আগের মতোই নিঝুম অবস্থায় পেয়েছি। কারও ঘুম ভাঙেনি, এমনকী অনন্তও রূপকের খাটে একপাশে ঘুমোচ্ছে। দরজা বন্ধ করে ওকে নীচু গলায় ডাকলাম। কিন্তু ওর ঘুম ভাঙল না। তখন আলতো করে বারকয়েক ধাক্কা দিলাম। এবারে অনন্ত ধড়মড়িয়ে চোখ কচলে উঠে বসল। আমার দিকে তাকিয়েই ও বলে উঠল, এ কী, মোহনদা, আপনার শাল কোথায়! আর পোশাকেরই বা এই হাল কেন?
অকুস্থল থেকে শালটা ফেরত আনা হয়নি। তা ছাড়া পাখিগুলোর আঁচড়ে পাঞ্জাবি ছিঁড়ে গেছে। সারা পোশাকে ময়লা মাটির দাগ। হাতের দু-এক জায়গায় ছড়ে গিয়ে জ্বালা করছে। তবে রক্ত বেরোয়নি।
অনন্তকে বললাম রূপকের মুখটা দেখতে। দেখে ও অবাক হয়ে বলল, সে কী, আজ রাতেও ঠেকানো গেল না!
আমি বললাম, না। তবে রহস্যটা কিছুটা ভেদ করেছি। বাকিটা সমাধান করব কাল সকালে। এখন ভীষণ টায়ার্ড লাগছে। তুমি একটু সরে শোও দেখি। এই খাটেই তিনজনে ভাগাভাগি করে ঘুমিয়ে পড়ি।
জামাকাপড় ছেড়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। খুব শীত করছিল। খাটের পায়ের কাছে বাড়তি কম্বল ছিল। সেটা টেনে নিয়ে গায়ে মুড়ি দিলাম।
যতদূর মনে পড়ে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছি।
.
গভীর সম্মোহনে রূপককে ঘুম পাড়িয়ে ঘরের দরজা খুলে দিলাম। বাইরে অনন্ত অপেক্ষা করছিল। ওকে বললাম, বাড়ির সবাইকে আসতে বলল। রহস্যের বাকি সমাধানটুকু সকলের সামনেই হোক।
অনন্ত চটপট চলে গেল সবাইকে ডেকে আনতে। আমি জানি কী ভীষণ উৎকণ্ঠা নিয়ে নিমাইবাবু, কমলাদেবী আর বিনোদ অপেক্ষা করছে। খুব ভোরে নিমাইবাবু আমাদের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙিয়েছেন। তারপর রূপকের অবস্থা দেখে হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছেন, ছেলেটাকে তা হলে আর বাঁচাতে পারলাম না, মোহনবাবু!
আমি তাঁকে ভরসা দিয়ে বলেছি, আমি কিন্তু এখনও আশা ছাড়িনি। রূপক ঘুম থেকে উঠুক। কিছু খেয়েদেয়ে নিক। তারপর ওকে আমি কিছুক্ষণের জন্যে হিপনোটাইজ করব। আমার ধারণা, সম্মোহিত অবস্থায় প্রশ্ন করলেই রূপকের কাছ থেকে সব রহস্যের উত্তর আমরা পেয়ে যাব। আপনাকে শুধু এটুকু জানিয়ে রাখি, ওর গায়ে-মুখে যে-আঁচড়ের দাগ গত পনেরো দিন ধরে দেখেছেন সেগুলো শকুনের নখের আঁচড়।
–শকুনের নখ!
–হ্যাঁ।–গত রাতের সব ঘটনা তখন তাকে খুলে বলেছি।
তারপর প্রাতরাশের পালা শেষ করে আমি রূপককে নিয়ে তৈরি হয়েছি। অনন্তকে বলেছি ঘরের বাইরে অপেক্ষা করতে। গভীর সম্মোহনের সময়ে তৃতীয় কেউ সামনে থাকলে আমার অসুবিধে হয়।
রূপককে গভীর সম্মোহনে ডুবিয়ে দিতে বিশেষ বেগ পেতে হল না। এমনিতেই ওর ঘুমের ঘোরে কথা বলার অভ্যাস, তা ছাড়া কিছুটা ভুললামনও বটে। এই ধরনের মানুষদের সচেতন জগৎ থেকে অবচেতন জগতে ঠেলে দেওয়া বেশ সহজ। এরাই সম্মোহনের আদর্শ পাত্র।
একটু পরেই সবাইকে সঙ্গে করে অনন্ত এসে ঘরে ঢুকল।
রূপক চোখ বুজে টান টান হয়ে বিছানায় শুয়ে। নিমাইবাবু, তার স্ত্রী ও বিনোদ রূপকের মাথার দিকে গিয়ে দাঁড়াল। অনন্ত রইল আমার পাশে।
আমি নিমাইবাবুকে লক্ষ করে বললাম, সম্মোহনের ঘোরে রূপক এখন ঘুমিয়ে। কিন্তু আমি ওকে যেসব প্রশ্ন করব ও ঘুমন্ত অবস্থাতেই তার ঠিক-ঠিক উত্তর দিয়ে যাবে। আপনার যা জিগ্যেস করার আমাকে জিগ্যেস করবেন। কারণ আমি ছাড়া আর কারও কথাই রূপক এখন শুনতে পাবে না।
সকলে নীরবে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। তখন রূপকের শরীরে ঝুঁকে পড়ে আমি আরও বারকয়েক সম্মোহনের ভঙ্গিতে ওর দেহের ওপরে হাত চালালাম। তারপর শুরু হল প্রশ্ন-উত্তরের পালা।
–রূপক, আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?
ক্লান্ত স্বরে ঘুমন্ত রূপক উত্তর দিল, হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি।
–আমি যা জিগ্যেস করব তুমি তার ঠিক-ঠিক জবাব দেবে। আমি ছাড়া আর কারও আদেশ তুমি এখন মানবে না।
না, মানব না।
–তা হলে বলো, পোড়া জমিদারবাড়ির পাশের জোড়া বটতলায় তুমি রোজ কী করতে যাও?
সকালে বিনোদের কাছেই জেনেছি পাঁচিল-ঘেরা পুরোনো বাড়িটা এককালে জমিদারবাড়ি ছিল।
রূপক বলল, মেসমারের পুঁথি খুঁজতে।
মেসমারের পুঁথি! আমি অবাক হয়ে গেলাম। মেসমার সম্পর্কে এই বালক কতটুকু জানে? ঘরের আর সবাই আমার স্তম্ভিত মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি স্পষ্ট স্বরে ঘুমন্ত রূপককে প্রশ্ন করলাম, তুমি ঠিক বলছ, মেসমারের পুঁথি? তুমি জানো মেসমার কে?
সঙ্গে-সঙ্গেই উত্তর পাওয়া গেল, হা, জানি। অস্ট্রিয়ান ডাক্তার ফ্রানৎস্ আন্তন মেসমার। ১৭৩৪ সালে জার্মানিতে জন্ম, মারা গেছেন ১৮১৫ সালে জার্মানিতেই। রুগিদের দেহের ওপরে চুম্বক চালিয়ে রোগ সারাতেন। পরে চুম্বক ছেড়ে শুধু হাত চালিয়েই রোগ সারাতে শুরু করেন। তিনি এটাকে বলতেন অ্যানিম্যাল ম্যাগনেটিজম। কিন্তু কয়েকজন রুগির রোগ সারাতে গোলমাল হওয়ায় পুলিশের নজরে পড়েন। তখন দেশছাড়া হয়ে চলে যান প্যারিসে। পরে একই কারণে তাকে প্যারিস ছাড়তে হয়। সকলে মেসমারকে প্রতারক, ভণ্ড বলে অভিযুক্ত করে। তার রোগ সারানোর পদ্ধতি নাকি পুরোপুরি ফঁকিবাজি ছিল। কিন্তু মেসমার যে ভণ্ড ছিলেন না তার দু-দুটো উজ্জ্বল প্রমাণ রয়েছে। প্রথমত, স্কটল্যান্ডের সার্জন জেমস ব্রেইড উনিশ শতকের মাঝামাঝি মেসমারের পদ্ধতিকে উন্নত করে তার নাম দেন হিপনোটিজম গ্রিক শব্দ হিপনোসিস থেকে হিপনোটিজম শব্দটা তিনি তৈরি করেছিলেন। হিপনোসিস-এর অর্থ হল ঘুম। যেমন আমি এখন ঘুমিয়ে রয়েছি। হা, যা বলছিলাম। ফ্রানৎস্ মেসমাসের নাম থেকেই মেসমেরিজম শব্দটা এসেছে যার অর্থ হিপনোটিজম।
পড়া মুখস্থ বলার মতো কথা শেষ করে রূপক থামল। শেষের দিকে ওর কণ্ঠস্বর কিছুটা ক্ষীণ হয়ে এসেছিল।
ও থামতেই নিমাইবাবু আমাকে জিগ্যেস করলেন, মোহনবাবু, ও যা যা বলল, সব সত্যি?
আমি মাথা নেড়ে জানালাম, সব সত্যি।
তখন আত্মগতভাবে নিমাই সরকার বললেন, কৃষ্ণনগরের সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোক বলেছিলেন, সামবুলিজম, হিপনোটিজম, মেসমেরিজম…।
তারপর আমার চোখে চোখ রেখে তিনি প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, মোহনবাবু, সন্নামবুলিজম মানে কী? ওটাও কী হিপনোটিজম?
আমি একটু কেশে বললাম, না। ওর মানে হল, ঘুমিয়ে-চলা। যেমন রোজ রাতে রূপক ঘোরের মধ্যে চলাফেরা করে, জোড়া বটতলায় গিয়ে মাটি খোঁড়ে। আপনার কাছে সব শুনে আমার মনে হয়েছিল রূপক ঘরের মধ্যে আক্রান্ত হতে পারে না। তা হলে কি রাতে ও বাইরে বেরোয়? বেরিয়ে কোনও পশু বা পাখির নখের আঁচড়ে আহত হয়? দেখলাম, আমার সন্দেহই সত্যি হল। সম্মোহনের ঘোরে রূপক রোজ রাতে বেরিয়ে পড়ত বাইরে–ঠিক ঘুমিয়ে-চলা মানুষের মতো।
কমলাদেবী হঠাৎ মুখে আঁচল গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠলেন। বিনোদ মা-কে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল।
আমি রূপককে আবার প্রশ্ন করলাম, মেসমারের পুঁথিতে কী আছে?
রূপক বলল, তাতে হিপনোটিজম-এর অনেক বিচিত্র পদ্ধতির কথা লেখা আছে। মেসমারের নিজের হাতে লেখা–জার্মান ভাষায়। মেসমারের সময়ে টাইপরাইটার আবিষ্কার হয়নি, তাই হাতে লেখা। পুঁথিটা খুব দামি। এটার কথা পৃথিবীর মানুষ এখনও জানে না।
–পুঁথিটা জোড়া বটতলায় কোথায় আছে তুমি জানো?
না। জানি না বলেই তো রোজ রাতে খুঁজতে যাই। তবে ওখানে কোথাও আছে নিশ্চয়ই।
রূপকের দৃঢ় বিশ্বাসের কারণ বুঝতে পারলাম না। কেউ কি ওর মনে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল করে দিয়েছে?
–পুর্থিটা কার?–পরের প্রশ্ন করলাম ওকে লক্ষ্য করে।
আগ্রহে, কৌতূহলে অনন্ত আমার কাছে এগিয়ে এল।
রূপক বলল, ওটা উলফগ্যাং মুলার-এর কাছে ছিল। উনি কোত্থেকে পেয়েছিলেন জানি না। পরে তার কাছ থেকে কিনেছিলেন হরিশ চক্রবর্তী।
–উলফগ্যাং মুলার কে?
সম্মোহন-বিশারদ। জার্মানি থেকে পালিয়ে ভারতে চলে এসেছিলেন। মুলার মেসমারের পুঁথির পাঠোদ্ধার করতে পারেননি। তাই হরিশ চক্রবর্তীকে তিরিশ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন।
–আর হরিশ চক্রবর্তী।
তিনিও সম্মোহনশাস্ত্রে পণ্ডিত। মেসমারের পুঁথিটা কেনার পর তার পাঠোদ্ধার করার আগেই সেটা তাঁর বাড়ি থেকে চুরি হয়ে যায়।
–কে চুরি করেছিল?
বুড়ো পতিতপাবন। সে হরিশ চক্রবর্তীর বাড়িতে কাজ করত। তাকে অন্য কেউ বোধহয় অনেক টাকার লোভ দেখিয়েছিল। তাই সে কিছু না বুঝেই পুঁথিটা চুরি করে। হরিশ চক্রবর্তী পতিতপাবনকে সন্দেহ করে জেরা করেন। তারপর তাকে সম্মোহন করে অনেক প্রশ্ন করেন। তাতেই জানা যায় পতিতপাবন পুঁথিটা জোড়া বটতলায় লুকিয়ে রেখেছে।
রূপক সামান্য উশখুশ করছিল দেখে আমি আরও কয়েকবার গভীর মনোযোগে ওর শরীরের ওপরে হাত চালালাম। ও আবার শান্ত হল।
আমি জিগ্যেস করলাম, জোড়া বটতলার কোথায় লুকিয়ে রেখেছে সেটা পতিতপাবন বলেনি?
–না। তার আগেই সম্মোহিত অবস্থায় সে হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। তার অনেক বয়েস হয়েছিল।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাটের কাছ থেকে সরে এলাম। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে তাতে গা ছেড়ে বসে পড়লাম। নিমাইবাবু, কমলাদেবী ও বিনোদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো রূপকের কথা শুনছিল। আমাকে চেয়ারে বসে পড়তে দেখে উদগ্রীব স্বরে তিনজনেই একসঙ্গে বলে উঠল, কী হল, মোহনবাবু!
আমি হেসে বললাম, কিছু না। একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। রূপকের উত্তর শুনে এটা স্পষ্ট বোঝা যায় কেউ ওকে এসব কথা সবিস্তারে বলেছে, ওকে পাখি-পড়া করে শিখিয়েছে। আর যে শিখিয়েছে, সম্ভবত সেই হিপনোটাইজ করে ওকে দিয়ে পুঁথিটা খোঁজাচ্ছে। রহস্যটা এবারে নিশ্চয়ই পরিষ্কার হয়ে গেছে আপনাদের কাছে?
–কিন্তু কে ওকে হিপনোটাইজ করে বারবার রাতের অন্ধকারে মেসমারসাহেবের পুঁথি খুঁজতে পাঠাচ্ছে?–বিনোদ জোরালো গলায় জানতে চাইল। যেন নামটা জানতে পারলেই সে লোকটাকে একহাত দেখে নেবে।
আমি বললাম, সেটা রূপককেই জিগ্যেস করে দেখি।
তারপর চেয়ারে বসেই রূপককে উদ্দেশ করে উঁচু গলায় প্রশ্ন করলাম, তোমাকে কে পুঁথি খুঁজতে পাঠায়?
ও স্পষ্ট গলায় বলল, হরিশ চক্রবর্তী।
আমি ঘরে উপস্থিত সবাইকে জিগ্যেস করলাম এই নামে কাউকে তারা চেনেন কি না। তাতে নিমাইবাবু, কমলাদেবী, বিনোদ সকলেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমি নিমাইবাবুকে বললাম, নিমাইবাবু, রাতের ওই ঘটনা যাতে আর না ঘটে সেজন্য আমি রূপককে সম্মোহিত অবস্থায় কতকগুলো আদেশ দিয়ে যাচ্ছি। তাতে কতটুকু বা কতদিন কাজ হবে বলতে পারছি না। বরং সবচেয়ে ভালো হয়, যদি আপনি এ-অঞ্চল ছেড়ে চলে যেতে পারেন। কারণ, দু-দুটো সম্মোহনের শক্তির লড়াইয়ে রূপকের মনের কোনও ক্ষতি হতে পারে। ওর পড়াশোনাও নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
কমলাদেবী ডুকরে কেঁদে উঠে স্বামীকে বললেন, তুমি কালই এ-পাড়া ছেড়ে চলো।
বিনোদ কিছুক্ষণ গম্ভীর থেকে বলল, সেই ভালো, বাবা।
আমি তখন চেয়ার ছেড়ে খাটের কাছে উঠে এলাম। রূপককে বারবার করে নির্দেশ দিলাম, জোড়া বটতলায় আর কখনও যেন সে না যায়। ওকে বোঝালাম, হরিশ চক্রবর্তীর সমস্ত কাহিনি মিথ্যে, পুঁথির কথা মিথ্যে, পতিতপাবনের কাহিনি মিথ্যে, সব মিথ্যে।
রূপক সম্মোহনের ঘোরেই বলল, সব মিথ্যে, সব মিথ্যে, সব মিথ্যে। আমি আর জোড়া বটতলায় যাব না, কিছুতেই যাব না।
অনুভব করলাম, হঠাৎই ঘরের মধ্যে বাতাসের চাপ বাড়ছে। রূপকও একটু যেন ছটফট করছে। নাকে আসছে হালকা বুনো গন্ধ। আর কাল রাতের মতোই শুরু হয়ে গেছে দু-দুটো ইচ্ছাশক্তির টানাপোড়েন।
আমি সমস্ত মনোযোগ এক করে রূপককে নির্দেশ দিয়ে চললাম। ওর শরীরের ওপর হাত চালাতে লাগলাম বারবার। নিজের কানেই আমার গলার স্বর কেমন হিসহিসে ভয়ংকর শোনাচ্ছে।
একটু পরেই রূপক ভীষণ ঝিমিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। ওর কথাগুলো কেমন অস্ফুট শব্দে থেমে-থেমে বেরিয়ে আসছে ঠোঁট চিরে। ঘরের বাতাসের চাপ ধীরে-ধীরে যেন কমে গেল। বুনো গন্ধটা মিলিয়ে গেল। ইচ্ছাশক্তির টানাপোড়েনও আলগা হল। পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালে বুলিয়ে নিলাম। এই শীতেও আমি ঘেমে উঠেছি। মনে-মনে খুব আনন্দ হল। হরিশ চক্রবর্তীর সম্মোহনের জাদুকে হারিয়ে দিতে পেরেছে জাদুকর মোহনকুমার।
কিন্তু একটা কথা ভেবে বেশ খটকা লাগল। হরিশ চক্রবর্তী এখন কোথায় জানি না। তবে দূরে থেকেও সে কিন্তু রূপককে সম্মোহন করতে পেরেছে। এই দূরসম্মোহনবিদ্যা আমার জানা নেই। কখনও এ-বিষয়ে শুনিওনি কিছু। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, হরিশ চক্রবর্তী সম্মোহনবিদ্যায় অত্যন্ত দক্ষ। কারণ, দূরত্বের ব্যবধান পেরিয়ে তার সম্মোহন অচেতন করে দিতে পারে কোনও সচেতন মানুষকে। এমনকী আমার মনের ওপরেও চাপ সৃষ্টি করেছিল দূর থেকে। কিন্তু এখন কোথায় সে? কত দূরে আছে?
সেকথাই জিগ্যেস করলাম রূপককে। ও ক্লান্ত স্বরে জবাব দিল, জানি না। অনেক দূরে…।
একটু থেমে আবার বলল, আগে তো এই ঘরেই থাকতেন। রোজ রাতে বেরিয়ে জোড়া বটতলায় যেতেন পুঁথি খুঁজতে। একদিন…এক ঝড়বৃষ্টির রাতে বটতলা থেকে হাতে-পায়ে কাদামাটি মেখে বাড়ি ফেরার সময়ে তার মাথায় বাজ পড়ে। তারপর থেকে উনি কোথায় গেছেন জানি না। অনেক দূরে…জানি না…সে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা…জানি না…অনেক দূরে…।
শীতের বাতাস ঘুরপাক খেয়ে গেল ঘরের ভেতরে। কমলাদেবী ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন। বিনোদ হাঁ করে ছোটভাইকে দেখছিল। আর নিমাইবাবু পাথর।
রূপকের শেষ কথাগুলো ফিশফিশে প্রতিধ্বনি হয়ে ঘরের মধ্যে ভাসছিল। জানলার বাইরে দিনের আলো যেন কমজোরি হয়ে গেল সহসা। একটা শকুনের আর্ত চিৎকার শোনা গেল দূর থেকে।
আমি অনন্তর দিকে ফিরে বললাম, অনন্ত, কাজ শেষ। এবারে তৈরি হয়ে নাও। রূপকের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েই আমরা কৃষ্ণনগরে রওনা হব।
আমি নিমাইবাবুকে বললাম, এ-বাড়িতে একটা দিনও থাকবেন না। প্রেতের সম্মোহনের সঙ্গে লড়াই করার শক্তি আমার নেই। আজ না হয় কাল আমাকে হারতেই হবে। শেষ পর্যন্ত অলৌকিক সম্মোহন জিতবেই।
ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে আমি ধীরে-ধীরে রূপকের ঘুম ভাঙালাম। সম্মোহিত অবস্থায় সব কথা যেন ও ভুলে যায় সেরকমই নির্দেশ দিয়েছিলাম। ফলে ঘুম ভেঙে আমাকে দেখেই রূপক বলল, কী মোহনদা, ম্যাজিক হয়ে গেল! কই, দেখাও! আর সেই পয়সার ম্যাজিকটা শিখিয়ে দেবে বলেছিলে–।
আমি ওকে শুয়ে থাকতে বলে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম।
টাকা নিতে রাজি না হওয়ায় নিমাইবাবু শেষ পর্যন্ত আমাকে পাজামা-পাঞ্জাবি ও একটা কাশ্মীরী শাল উপহার দিয়েছিলেন। কৃষ্ণনগরের ট্রেনে তুলে দিতে এসে দু-হাত ধরে বারবার কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন।
ওই ঘটনার পর বহুদিন কেটে গেছে, কিন্তু আজও আমি হরিশ চক্রবর্তীর কথা ভুলিনি। ভুলিনি মেসমারের পুঁথির কথা। বিশ্বাস হতে চায় না, আবার অবিশ্বাস করি এমন মনের জোরও আমার নেই।