নখের আঁচড়
এক
আইটিসি সোনার কলকাতা হোটেলে প্রেস কনফারেন্স আছে৷ আই লিগ ফুটবল নিয়ে৷ সন্ধে সাতটার মধ্যে সেখানে পৌঁছোতে হবে৷ সাড়ে ছটার সময় সেক্টর ফাইভের অফিস থেকে বেরোতে যাচ্ছি, এমন সময় সৌম্য এসে বলল, ‘কালকেতুদা, বসিরহাট থেকে আমাদের করেসপনডেন্ট একটা খবর পাঠিয়েছে৷ খেলার পাতায় খবরটা কি আপনারা নেবেন?’ কথা বলার সময় নেই৷ চিংড়িহাটার কাছে রোজই এই সময়টায় জ্যাম হয়৷ আমার আরও আগে বেরিয়ে যাওয়া উচিত ছিল৷ কিন্তু খবরের কাগজের অফিসটাই এমন৷ অনবরত খবর আসছে নানা জায়গা থেকে৷ যে কোনো মুহূর্তে বড়ো খবর আসতে পারে৷ জানার জন্য বললাম, ‘খবরটা কী?’
‘কলকাতা থেকে মেয়েদের একটা ফুটবল টিম বসিরহাটে এগজিবিশন ম্যাচ খেলতে গিয়েছিল৷ সেই দলের একটা মেয়ে জলে ডুবে মারা গেছে৷’
শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল৷ দুটো পয়সা রোজগারের তাগিদে মেয়ে ফুটবলাররা প্রায়ই এদিক-ওদিক এগজিবিশন ম্যাচ খেলতে যায়৷ হয়তো বসিরহাটে সেই রকমই একটা দল খেপ খেলতে গিয়েছিল৷ সিরিয়াস খেলা নয়৷ জেলা শহরে এই রকম ম্যাচ ধরার অনেক লোক আছে৷ তাদের মধ্যে একজনকে আমি খুব ভালো করে চিনি, অসিতাভ৷ সেই সব খেলার রেজাল্ট যাতে দু-লাইন আমাদের কাগজে বেরোয়, সেই কারণে রিকোয়েস্ট নিয়ে আমার কাছে আসে৷ ওকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে, বসিরহাটে কী হয়েছে৷ এমনিতে জলে ডুবে মারা যাওয়া…এখন আর তেমন বড়ো খবর নয়৷ যদি না নামি কেউ মারা যায়৷ নামকরা কোনো প্লেয়ার মারা গেলে অসিতাভ নিজেই আমাকে ফোন করে জানাত৷ ওর কাছে খবরটা অনেক আগে পৌঁছে যেত৷ তবুও, যেই মারা যাক, খবরটা তো করতে হবে৷ সৌম্যকে তাই বললাম, ‘যে মেয়েটা মারা গেছে, তার নামটা কী দ্যাখো তো?’
‘কেকা রায়৷ মানিকতলার মেয়ে৷’
অসিতাভর দৌলতে মেয়ে ফুটবলারদের অনেককেই আমি চিনি৷ তাদের অনেকের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথাও হয়৷ ওরাও নানা দরকারে পরামর্শ নিতে আসে৷ কিন্তু কেকা নামের কাউকে মনে পড়ল না৷ নিশ্চয়ই নতুন কোনো মেয়ে৷ হাল আমলে খেলতে এসেছে৷ তাই চিনি না৷ সৌম্যকে বললাম, ‘রিপোর্টটা তথাগতর হাতে দিয়ে যাও৷ খবরটা ও করে দেবে৷’ তথাগত আমাদের স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টের প্রিন্সিপাল করেসপনডেন্ট৷ ওর হাত দিয়ে কপি গেলে ভুল বেরোনোর সম্ভাবনা থাকবে না৷ নিশ্চিন্তে অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম৷ ঠিক করে নিলাম, ফিরে এসে অসিতাভকে একবার ফোন করতে হবে৷ খবরটার ফলো-আপ করব৷ সাংবাদিক হিসাবে একটা কথায় আমি খুব বিশ্বাস করি, ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দ্যাখো তাই৷ পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন’৷ খবর তাড়া করে অনেক সময় অনেক ভালো ভালো খবর পেয়ে গিয়েছি৷ কে জানে, কেকা বলে মেয়েটার জলে ডুবে যাওয়ার পিছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না?
গাড়িতে ওঠার সময় হঠাৎ মনে হল, কী আশ্চর্য! আজই জার্মানিতে মেয়েদের বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হল৷ আর আজই আমাদের একটা মেয়ে ফুটবলার জলে ডুবে গেল? আমাদের পুরুষ ফুটবল দল কোনোদিন বিশ্বকাপ খেলতে পারেনি৷ কিন্তু মেয়েরা একাধিকবার খেলে এসেছে৷ একটু আগেই টিভিতে ব্রাজিল-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের টেলিকাস্ট দেখছিলাম৷ সত্যি, মেয়েদের খেলার স্ট্যান্ডার্ড এখন কোথায় উঠে গিয়েছে! ব্রাজিলের ক্যাপ্টেন মার্থার খেলা দেখে মন ভরে গেল৷ কয়েক মাস আগে এই মার্থা মেয়েটা বিশ্বসেরায় পুরস্কার নিতে গিয়েছিল জুরিখে৷ সেখানে দুঃখ করে বলেছে, পাঁচবার মেয়ে ‘ফুটবলার অব দ্য ইয়ার’ হওয়া সত্ত্বেও, তার কোনো রোজগার নেই৷ ব্রাজিলের পুরুষ ফুটবলাররা যা আয় করে, তার ছিটেফোঁটাও ওর কপালে জোটে না৷ সত্যি কথা বলতে কী, ফিফা মেয়েদের জন্য কিছুই করল না৷ মেয়েরা ব্রাত্যই রয়ে গেল৷ আইটিসি হোটেলে যখন পৌঁছোলাম, তখন প্রায় সোয়া সাতটা৷ আজকাল ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দৌলতে প্রচুর সাংবাদিক হয়ে গিয়েছে৷ প্রেস কনফারেন্সে ঢুকে দেখলাম, হলঘরে মারাত্মক ভিড়৷ পিছনের দিকে কোনোরকমে বসার একটা জায়গা পেলাম৷ প্রেস কনফারেন্স আগেই শুরু হয়ে গিয়েছে৷ কী নিয়ে তা আগে আমাদের জানানো হয়নি৷ বসার পর খানিকটা ধাতস্থ হতেই চমকে উঠলাম৷ এবার মেয়েদের আই লিগ ফুটবল চালু হতে যাচ্ছে৷ পুনের একটা কোম্পানি আছে—ভেঙ্কিস চিকেন৷ ইংল্যান্ডের প্রিমিয়ার লিগে তারা ব্ল্যাকবার্ন রোভার্স নামে একটা ক্লাব দু-বছর হল কিনেছে৷ তারাই মেয়েদের আই লিগে স্পনসর হচ্ছে৷ বিশ্বের নামকরা মেয়ে ফুটবলারদের তারা নিয়ে আসবে৷ প্রত্যেক ক্লাবকে এক-একজন প্লেয়ার এনে দেবে৷ যাতে দর্শকদের টানা যায়৷ ইতিমধ্যেই ছটা দল টিম দিতে রাজি হয়ে গিয়েছে৷ তাদের মধ্যে একটা কলকাতার৷ ভারতীয় ফুটবলের পক্ষে ভালো এবং বড়ো খবর৷ একটা কর্পোরেট সংস্থা ফুটবলে আগ্রহ দেখাচ্ছে৷
মন দিয়ে শুনছিলাম৷ হঠাৎ কানের পাশে মেয়েলি গলা শুনতে পেলাম, ‘কালকেতুদা, প্রেস কনফারেন্স শেষ হলে চলে যাবেন না৷ একটা খবর আছে৷’
চমকে তাকিয়ে দেখি, অনুরাধা দত্ত৷ আগে ফুটবল খেলত৷ নামকরা স্ট্রাইকার ছিল৷ এখন বিয়ে-থা করে খেলা ছেড়ে দিয়েছে৷ মেয়ে ফুটবলারদের তুলনায় অনুরাধা অনেক শিক্ষিত এবং সিরিয়াস টাইপের৷ ইংরেজিতে এমএ৷ খেলার সূত্রেই ইনকাম ট্যাক্সে চাকরি পেয়ে গিয়েছে৷ এখন ইনকাম ট্যাক্স মেয়ে ফুটবল টিমের কোচ৷ এই প্রেস কনফারেন্সে অনুরাধার থাকার কথা নয়৷ তাই পাশ ফিরে ওকে বললাম, ‘তুমি এখানে?’
‘বস দেখা করতে বলেছিলেন৷ তাই এলাম৷’
বলেই চোখের ইশারায় অনুরাধা দেখাল, পোডিয়ামে বসে থাকা ফেডারেশন সেক্রেটারি আলবার্তো কোলাসো-কে৷ ‘ইন্ডিয়া থেকে মেয়েদের ফুটবল টিম বাংলাদেশে একটা টুর্নামেন্ট খেলতে যাবে৷ প্রাইম মিনিস্টার শেখ হাসিনা ভারতকে ইনভাইট করেছেন৷ কোলাসো স্যার আমাকে সেই টিমটার কোচ হতে বললেন৷ দাঁড়ান, প্রেস কনফারেন্স শেষ হয়ে যাক৷ তার পর ডিটেলে বলছি৷’
বললাম, ‘খবরটা কি আর কাউকে দিয়েছ?’
‘না৷ প্রথম আপনাকেই বললাম৷ আপনার সঙ্গে একটা আলোচনা করারও ছিল বলে৷’
‘ঠিক আছে৷ পি সি হয়ে গেলে নীচে রেস্তোরাঁর সামনে ওয়েট কোরো৷ তখন কথা হবে৷’
রাত সাড়ে আটটার সময় প্রেস কনফারেন্স শেষ হল৷ ভিড়ের মাঝে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামার সময় দেখি, অসিতাভ৷ হয়তো কারও সঙ্গে এসেছিল৷ অসিতাভকে দেখেই বসিরহাটের খবরটার কথা মনে পড়ে গেল৷ রাতে ওকে ফোন করতামই৷ জিজ্ঞেস করতাম, কেকা রায় নামের মেয়েটার সম্পর্কে৷ ভালোই হল, এখানে দেখা হয়ে গেল৷ সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় অসিতাভর সঙ্গে আমার চোখাচোখি হল৷ অন্য সময় দেখা হলে, অসিতাভর কাছে এসে খানিকক্ষণ কথা বলে৷ কিন্তু আজ দেখলাম, চোখ নামিয়ে ও দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল৷ কেন জানি না, ওর হাবভাব দেখে মনে হল, যেন পালিয়ে বাঁচল৷ নীচে নেমে দেখি, অসিতাভ উধাও৷ মোবাইল ফোনে ওকে ধরার চেষ্টা করলাম৷ আশ্চর্য, ফোন বেজেই গেল৷ আমার নম্বর ওর ফোনে সেভ করা আছে৷ আমি জানি৷ অন্য সময় আমার ফোন পেলে ও কৃতার্থ হয়ে যায়৷ অথচ আজ ধরলই না!
নীচে নেমে দেখি, অনুরাধা রেস্তোরাঁর সামনে অপেক্ষা করছে৷ আমাকে দেখেই বলল, ‘আপনি তো সেক্টর ফাইভের দিকে যাবেন, তাই না কালকেতুদা? আমাকে একটু চিংড়িহাটার মোড়ে নামিয়ে দেবেন? আজ আমি মায়ের বাড়িতে যাব৷ একটা প্রবলেমে পড়েছি৷ চলুন, গাড়িতে যেতে যেতে আপনাকে বলব৷’ গাড়িতে উঠে অনুরাধা বলল, ‘প্রবাল আবার সেইরকম বিহেভ করছে কালকেতুদা৷ আমার লাইফটা হেল করে দিল৷’
প্রবাল ওর স্বামী৷ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার৷ ভালো চাকরি করে৷ বছর দু-এক হল, ওদের বিয়ে হয়েছে৷ ওদের বিয়েতে নেমন্তন্নও খেয়ে এসেছি৷ প্রথম প্রথম দুজনের সম্পর্কটা বেশ ভালো ছিল৷ মাস ছয়েক আগে কী যে হল, প্রবাল সন্দেহ করতে শুরু করল অনুরাধাকে৷ ওকে টিম নিয়ে বাইরে যেতে দেয় না৷ বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হলেই খারাপ কথা বলতে থাকে৷ ওর কাছে ফুটবলের কোনো লোক গেলে, তাঁর সঙ্গে বিচ্ছিরি ব্যবহার করে৷ মেয়েদেরও রেহাই দেয় না৷ প্রবালের ধারণা, অনুরাধার সঙ্গে ফেডারেশনের সচিব কোলাসো-সহ অনেক ফুটবল কর্তারই শারীরিক সম্পর্ক আছে৷ আগেও একদিন অনুরাধা আমার কাছে এসেছিল, প্রবাল সম্পর্কে অভিযোগ করতে৷ পুলিশের কাছে কমপ্লেন করাটা ঠিক হবে কি না, জানতে চেয়েছিল৷ আমি মানা করায় ও পুলিশের কাছে যায়নি৷ ওকে ধৈর্য ধরতে বলেছিলাম৷ এত তাড়াতাড়ি যেন কোনো ডিসিশন না নেয়৷ কাগজে লেখালিখি হবে৷ মাঝে ও আর আসেনি বলে ভেবেছিলাম, সম্পর্কটা ঠিক হয়ে গিয়েছে৷ কিন্তু তা নয়৷ বললাম, ‘আবার কী নিয়ে ঝামেলা হল, তোমাদের মধ্যে?’
অনুরাধা বলল, ‘আজ সকালে কলকাতায় এসেই মিঃ কোলাসো ফোন করেছিলেন আমাকে৷ কোচিং অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়ার কথাটা জানাতে৷ আমাদের কথাবার্তা শেষ হওয়ার পরই প্রবাল নোংরা নোংরা কথা বলতে শুরু করল৷ আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না৷ ঘেন্না হচ্ছিল ওকে স্বামী হিসাবে ভাবতে৷ রাগ করে বেরিয়ে এসেছি৷ আর ফিরব না৷ ওর সঙ্গে থাকলে আমার কেরিয়ার শেষ হয়ে যাবে কালকেতুদা৷’ বলেই কাঁদতে শুরু করল অনুরাধা৷
একদিকে কোচের কেরিয়ার, অন্যদিকে দাম্পত্য জীবন৷ মেয়েদের কী জ্বালা! অনুরাধাকে বললাম, ‘বাংলাদেশের ট্রিপটা তুমি ছেড়ো না৷ কোলাসের কথাবার্তায় বুঝলাম, তুমি না গেলে ওঁরা বেঙ্গালুরুর গঙ্গাদরনকে দায়িত্ব দেবে৷ দরকার হলে প্রবালের সঙ্গে আমি একবার কথা বলব৷’
আইটিসি হোটেল থেকে চিংড়িহাটার দূরত্ব খুব বেশি নয়৷ নেমে যাওয়ার সময় ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেকা রায় বলে কোনো ফুটবলারকে কি তুমি চেনো অনুরাধা?’
‘ভালোমতো চিনি৷ কেন বলুন তো? এই পরশুই একটা ম্যাচে আমার সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল৷ ও কি আপনার কাছে গিয়েছিল?’
বললাম, ‘না, আসেনি৷ কেমন প্লেয়ার ছিল?’
‘দারুণ৷ আউটস্ট্যান্ডিং ট্যালেন্ট৷ শান্তিদি আর শুক্লাদির পর এত ভালো প্লেয়ার মেয়েদের ফুটবলে আর আসেনি৷ মেয়েটা এ বছরই লিগে প্রচুর গোল করেছে৷ আমার ইনকাম ট্যাক্স টিমে একটা ভ্যাকেন্সি হয়েছে৷ চাকরি দিয়ে ওকে টিমে আনছি৷ সব ফাইনাল হয়ে গেছে৷ এই চাকরি নিয়ে ও একটা প্রবলেমে পড়েছে৷ সেই জন্যই আপনার কাছে আমি ওকে যেতে বলেছিলাম৷ কিন্তু আপনি…ছিল কথাটা বললেন কেন কালকেতুদা?’
‘বললাম এই কারণে, কেননা ও আর বেঁচে নেই৷ একটু আগে খবর পেলাম, জলে ডুবে মারা গেছে৷’
‘ইসসস৷’ আক্ষেপ ঝরে পড়ল অনুরাধার গলা থেকে, ‘অমন ফুটফুটে একটা মেয়ে এই ভাবে মারা গেল? ভগবানের কী বিচার!’ বলে আর দাঁড়াল না অনুরাধা৷ বাস স্টপের শেড-এর দিকে চলে গেল৷
দুই
সকালবেলা খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছি, এমন সময় সুদীশের ফোন, ‘কমরেড নন্দী, খবরের কাগজ পড়া কি শেষ হয়েছে?’ বামফ্রন্ট সরকার গত বছর আমাকে বর্ষসেরা সাংবাদিকের পুরস্কার দিয়েছে৷ তারপর থেকেই সুদীশ আমাকে কমরেড নন্দী বলে ডাকে৷ বন্ধু বলেই ওর ঠাট্টা আমি গায়ে মাখি না৷ সুদীশ আগে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে ছিল৷ তখনই ওর সঙ্গে আমার আলাপ৷ পাঁড় ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টার৷ ওর ধারণা, সত্তর দশকের ইস্টবেঙ্গল টিম এখনকার বার্সেলোনা এফসিকে হারিয়ে দিতে পারত৷ ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার কারণ, খেলার সাংবাদিকতা করার পাশাপাশি আমার আবার রহস্যভেদ করার অভ্যাসও আছে৷ শখের গোয়েন্দাগিরি আর কী৷ সুদীশকে আমি বেশ কয়েকটা কেস-এ সাহায্যও করেছি৷
অনেকদিন সুদীশের পাত্তা নেই৷ শুনেছিলাম, জেলার কোনো থানায় প্রোমোশন পাচ্ছে৷ ফোনটা ধরেই বললাম, ‘কোত্থেকে?’
‘বসিরহাট৷ আমি এখন সদর থানার ওসি৷ একটা দরকারে তোকে ফোন করলাম ভাই৷’
সঙ্গে সঙ্গে কেকা রায়ের কথা মনে হল৷ বললাম, ‘দরকারটা জানি৷ একটা মেয়ে ফুটবলারের মৃত্যু নিয়ে…তাই না? খবরটা কাল রাতেই পেয়েছি৷ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কী বলছে?’
ওদিকে সুদীশ অবাক, ‘তুই জানিস? আরে ভাই, সিম্পল জলে ডোবা কেস নয়৷ কমপ্লিকেটেড৷ ডেডবডিতে অত্যাচারের চিহ্ন ছিল৷ টিমের কয়েকজনকে তুলে এনে লক আপে ভরে রেখেছি৷ ভয় দেখানো সত্ত্বেও কেউ মুখ খুলছে না ভাই৷ বেশির ভাগই হিড়িম্বা টাইপের৷ কী তাদের ভাষা, শুনলে অজ্ঞান হয়ে যাবি৷ এদের তোরা ডিল করিস কী করে?’ হিড়িম্বা টাইপের কথাটা শুনে হাসি পেল৷ হাসি চেপে বললাম, ‘ইন্টারোগেশন করে কিছু পেলি?’
‘ম্যাচটা ছিল রোববার৷ এরা এসেছিল শনিবার দুপুরে৷ ছিল এখানকার একটা স্কুলে৷ অর্গানাইজার ছেলেটা বলল, বসিরহাট পৌঁছোনোর পরই ঘর অ্যালটমেন্ট নিয়ে, নাকি মেয়ে ফুটবলারদের মধ্যে হাতাহাতি হয়েছিল৷ কেউ কেউ ডর্মিটারিতে থাকতে চায়নি৷ নামি ফুটবলাররা আলাদা ঘর চেয়েছিল, জোড়ায় জোড়ায় থাকবে বলে৷ বাধ্য হয়ে অর্গানাইজাররা চার-পাঁচটা ক্লাসরুম খুলে দেয়৷ কেকা বলে মেয়েটা ছিল টিমের ক্যাপ্টেন শান্তার সঙ্গে৷ শুনলাম, কেকা কেন স্পেশাল ট্রিটমেন্ট পেয়েছে, তা নিয়ে অন্য ফুটবলারদের মধ্যে খুব অশান্তি হয়েছিল৷’
‘ঘটনাটা কীভাবে ঘটল সুদীশ?’
‘বলছি৷ রোববার রাতে ম্যাচ হয়ে যাওয়ার পর টিমের কয়েকজন সন্ধের ট্রেনে কলকাতায় ফিরে যায়৷ বিশেষ করে যারা ডর্মিটারিতে ছিল৷ আলাদা ঘরে যারা ছিল, তারা সবাই থেকে যায়৷ সোমবার সকালে এখানকার মাছরাঙা দ্বীপে বেড়াতে যাবে বলে৷ গরমের ছুটি চলছে, স্কুল বন্ধ৷ তাই অর্গানাইজাররা কেউ আপত্তি করেনি৷ এখানে স্কুলের কাছেই বিরাট একটা পুকুর আছে৷ সোমবার সকালে কেকাকে ওই পুকুরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়৷’
‘শান্তা কী বলছে?’
‘বলছে, কেকা নাকি ওকে বলেছিল, রাতে পুকুরঘাটে যেতে৷ খোলা হাওয়ায় বসে গল্প করবে৷ কিন্তু খেলার পর শান্তা খুব টায়ার্ড ছিল৷ তাই রাতে খাওয়াদাওয়ার পর ও শুয়ে পড়েছিল৷ শুনলাম, এই মেয়েটা নাকি ড্রিংক-ট্রিংকও করে৷ কী দিনকাল এল রে কালকেতু?’
‘অন্য মেয়েগুলো কী বলছে?’
‘আরে এদের মধ্যে এমন চুলোচুলি, কেউ কারও সম্পর্কে একটা ভালো কথা বলেনি৷ এদের মধ্যে অনেক ছোটো ছোটো গ্রুপ৷ বেশির ভাগ মেয়ের রাগ শান্তার উপর৷ দলের সবথেকে সিনিয়র৷ একটু ম্যানালি চেহারা৷ অর্গানাইজারদের ও-ই ডিল করে৷ কত টাকাপয়সা পেল, শান্তা নাকি আর কাউকে জানতে দেয় না৷ মেয়েটা নাকি খেপ খেলার অর্ধেক টাকা মেরে দেয়৷ শুনলাম, টিমের সবাই এসেছে ট্রেনে করে৷ শান্তা এসেছিল, বাইকে করে৷ ওর সঙ্গে ছিল কেকা৷ বোঝ, এমন ডাকাবুকো টাইপের এতটা রাস্তা এসেছে বাইকে চেপে৷’
শান্তাকে আমি ভালোমতো চিনি৷ বারো-চোদ্দো বছর ধরে দেখছি৷ অনুরাধাদের পরের জেনারেশন৷ স্টপার পজিশনে খেলে৷ ইন্ডিয়া টিমে খেলেছে৷ কিন্তু কোথাও চাকরি পায়নি বলে ফ্রাস্ট্রেটেড৷ কথাবার্তায় সেটা প্রকাশও পায়৷ চাকরি না হওয়ার জন্য সবাইকে ও দোষারোপ করে৷ কয়েক বছর আগে বাইকে করে কাঁচরাপাড়ায় ম্যাচ খেলতে যাওয়ার সময় কল্যাণী এক্সপ্রেস হাইওয়েতে একবার বড়ো অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল৷ সেই খবর আমরা বড়ো করে ছাপিয়েছিলাম৷ তার মানে মেয়েটা এখনও বদলায়নি৷ সুদীশকে বললাম, ‘কাকে তোর কালপ্রিট বলে মনে হচ্ছে?’
‘এই মেয়েদের মধ্যেই কেউ হবে৷ আমার সন্দেহ হচ্ছিল শান্তা মেয়েটাকে৷ চোয়াড়ে টাইপের৷ হয়তো কেকার সঙ্গে কোনো কারণে মারামারি হয়েছিল৷ রাগে তুলে নিয়ে গিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় পুকুরে ফেলে দিয়েছে৷ কিন্তু পরে দেখলাম, সেরকম করার মেয়ে ও নয়৷ নিজেই মারাত্মক শক পেয়েছে৷ কেমন যেন হয়ে গেছে৷ বিড়বিড় করে সবসময় নাকি বলছে, ‘‘তোকে আমি প্রোটেক্ট করতে পারলাম না৷ কী মূর্খামিই না করলাম৷’’ ‘‘কালকেতু, তুই তো এদের ভালো চিনিস৷ আমাকে হেল্প করবি?’
‘কেকার বাড়ির লোকজন কেউ যায়নি?’
‘ওর বাবা নেই৷ মা ডেডবডি নিতে এসেছে৷ বলল, মেয়েটা লেখাপড়াতেও খুব ভালো ছিল৷ হায়ার সেকেন্ডারিতে ভালো রেজাল্ট করেছে৷ ইনকাম ট্যাক্স অফিসে নাকি ওর চাকরি পাকা হয়ে গেছিল৷ কিন্তু ইদানীং নাকি কেউ ফোনে ওকে ভয় দেখাত, চাকরিটা নিলে জানে মেরে দেবে৷ তার মানে আর একজন কেউ ছিল, যে চাকরিটা পাওয়ার আশায় ছিল৷ খোঁজ করে জানলাম, কেকার ইমিডিয়েটলি চাকরির তেমন দরকার ছিল না৷ ওর বাবা যথেষ্ট টাকাপয়সা রেখে গিয়েছেন৷’
‘তুই একটা কাজ করতে পারবি সুদীশ? কেকার ফোনে কোন নাম্বার থেকে থ্রেট কল আসত, সেটা বের করে দিতে পারবি?’
‘অলরেডি বের করা হয়ে গিয়েছে৷ ফোন পাবলিক বুথ থেকে আসত৷ এসপ্লানেড অঞ্চল থেকে৷ ওখানকার কয়েকটা বুথে খোঁজ নিয়েছিলাম৷ কিন্তু ট্রেস করা মুশকিল, ফোনটা কে করত৷’
‘কেকার বাড়ির লোকজন কি কাউকে সন্দেহ করছে?’
‘ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলে তো তেমন কিছু মনে হল না৷ ভদ্রমহিলা গানের জগৎ নিয়ে আছেন৷ ছোটো একটা স্কুল চালান৷ ফুটবল জগৎ নিয়ে কিছু জানেন বলে মনে হল না৷ অদ্ভুত, উনি কিন্তু শান্তার খুব প্রশংসা করলেন৷ বললেন, আমার পাড়ার মেয়ে৷ ওকে ছোটোবেলা থেকে দেখছি৷ বাইরে থেকে ওকে বদমেজাজি বলে মনে হয়৷ কিন্তু ওর ভরসাতেই আমি কেকাকে ফুটবল খেলতে পাঠিয়েছি৷ শান্তা আমার মেয়েকে খুব ভালোবাসত৷’
‘কেকা কি সাঁতার জানত?’
‘জানত না৷ ছোটোবেলায় কোনো এক জ্যোতিষী নাকি কেকার হাত দেখে বলেছিল, জলে ফাঁড়া আছে৷ সেই থেকে ও জলের ধারে-কাছে যেত না৷ টিমের একটা মেয়ে বলল, কেকা যে সাঁতার জানত না, সেটা সবাই জানত৷ রবিবার সকালে সবাই পুকুরে স্নান করতে নেমেছিল৷ কেকা চুপ করে ঘাটে বসেছিল৷ সবাই ওকে জলে নামতে বলায়, শান্তা ধমক দিয়ে বলেছিল, ‘‘ওকে জোর করিস না৷ জলে নামতে ও ভয় পায়’’৷
‘পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কখন পাবি?’
‘মনে হয় বিকেলের দিকে৷ মেয়েটাকে মেরে ফেলা হয়েছে কী না, সে ব্যাপারে আমি শিয়োর নই৷ তবে ডেডবডি দেখে মনে হল, ওর উপর জোর খাটানোর চেষ্টা হয়েছিল৷ হাতে খামচাখামচির দাগ স্পষ্ট৷ ফোন করে তোকে আমি বিরক্ত করতাম না কালকেতু৷ আজ সকালে কলকাতা থেকে টিভির লোক এসেছে খবরটা করার জন্য৷ এই বুমওয়ালাদের বিশ্বাস নেই৷ কী খবর করে দেবে, আমার বাঁশ হয়ে যাবে৷ ওদিক থেকে তুই একটু খোঁজখবর নে৷ আমার মনে হচ্ছে, এটা নর্মাল ডেথ৷ এর পিছনে কোনো মিস্ট্রি নেই৷’
বললাম, ‘ঠিক আছে৷ দেখছি৷ তুই এক কাজ কর, যে-মেয়েগুলোকে আটকে রেখেছিস, তাদের ছেড়ে দে৷ ওরা খুন করবে বলে মনে হয় না৷ আর হ্যাঁ, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেলে, সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবি কিন্তু৷’
সুদীশ লাইন ছেড়ে দেওয়ার পর চুপ করে ভাবতে লাগলাম৷ মেয়ে ফুটবলারদের মধ্যে তীব্র আকচা-আকচি৷ সে সব ঘটনা কিছু কিছু আমি জানি৷ খেলার সূত্রে কেউ কোথাও চাকরি পেলে অন্যদের চক্ষুশূল হয়ে যায়৷ বেশির ভাগ মেয়েই গরিব ঘরের৷ পেটে বিদ্যে খুব কম৷ চাকরি পাওয়ার জন্য যেটুকু বিদ্যে থাকা দরকার, তাও নেই৷ কপাল খুব ভালো থাকলে, কেউ কেউ চাকরি পেয়ে যায়৷ যেমন এই কেকা বলে মেয়েটা পেয়েছিল৷ কিন্তু সেই রাগে ওকে কেউ মেরে ফেলবে, এটা বিশ্বাস করতে মন চাইল না৷ মেয়েটা মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে৷ খেপ খেলায় দু-চার টাকা কম পেলে, অন্যদের সঙ্গে ঝগড়া করবে বলেও মনে হয় না৷ তাহলে কী এমন হল, মেয়েটা মারা গেল? এটা নিছক অ্যাক্সিডেন্টও হতে পারে৷ কিন্তু তাই যদি হয়, তাহলে কেকার শরীরে অমন চোটের চিহ্ন থাকবে কেন?
নাহ, একটু খোঁজখবর নেওয়া দরকার৷ অসিতাভ খানিকটা বলতে পারত৷ কেননা, মেয়ে ফুটবলাররা ওর সঙ্গে সুখ-দুঃখের গল্প করে বলে শুনেছি৷ কিন্তু সেও তো আমার সামনে আসতে চাইল না৷ তার মানে, নিশ্চয়ই ও এমন কিছু জানে, যা আমার কাছে বলতে পারবে না৷ এমনও হতে পারে, অসিতাভ পুলিশের ঝামেলায় পড়তে চাইছে না৷ বসিরহাটে একবার গেলে ভালো হত৷ ঘণ্টা দেড়েকের তো রাস্তা৷ গেলে বিকেলের মধ্যে ফিরে আসা যেত৷ কিন্তু ফিরে বিকেলের দিকে একটা কাজ আছে৷ কাগজের এডিটরের সঙ্গে মিটিং৷ যদি ফিরে আসতে না পারি, তা হলে মুশকিল হয়ে যাবে৷ তার চেয়ে আমাদের বসিরহাট করেসপনডেন্টের সঙ্গে একবার কথা বলে নেওয়া যাক৷ দেখি, ও কিছু নতুন তথ্য দিতে পারে কি না? অনেক দিন পরে একটা মিস্ট্রি কেস হাতে পেয়েছি৷ এটা সলভ করতেই হবে৷ খুব জটিল কোনো কেস না হলে, সুদীশ আমার সাহায্য চায় না৷ শেষবার ও আমার বাড়িতে এসেছিল, বসিরহাটে বদলি হওয়ার আগে৷ রিজেন্ট পার্কে একজন বাচ্চার মার্ডার কেস নিয়ে৷ ছেলেটা রাজ্য টেবিল টেনিসে রানার্স হয়েছিল৷ আমি সেই রহস্য ভেদ করেছিলাম৷ কেন চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি, সেই রাগে ওর বিকৃতমনস্ক বাবা ওকে খুন করেছিল৷ বাবাই ছিল বাচ্চাটার কোচ৷ বসিরহাটে কথা বলার জন্য হাত বাড়িয়ে মোবাইল সেটটা নিতে যাচ্ছি, এমন সময় ডোরবেল বেজে উঠল৷ উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখি, প্রবাল৷ অনুরাধার হাজব্যান্ড৷ অবাক হয়ে বললাম, ‘তুমি?’
তিন
মেয়েদের বিশ্বকাপ ফুটবলে ব্রাজিলের মেয়েরা টাইব্রেকারে আমেরিকার কাছে হেরে গিয়েছে৷ খবরটা আমায় দিল তথাগত৷ ফোনে বলল, ‘মার্থার একটা ছবি পাঠিয়েছে এএফপি৷ দু-হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে৷ ছবিটা কি ছাপব?’
বললাম, ‘খেলার পাতায় বসিয়ে দে৷ সেমিফাইনালে আমেরিকা কার সঙ্গে খেলবে রে?’
‘ফ্রান্স৷ একটা সুন্দর স্টোরি এসেছে কালকেতুদা, ফরাসি কোচকে নিয়ে৷ আপনি বললে, স্টোরিটা নিতে পারি৷’
‘কী স্টোরি রে?’
‘ফ্রান্স টিমের এই কোচটার নাম ব্রুনো বিনি৷ খেলার আগের দিন এই ভদ্রলোক নাকি ওঁর প্লেয়ারদের খেলা নিয়ে একটা কথাও বলেন না৷ তার বদলে কবিতা শোনান, প্লেয়ারদের সঙ্গে গান গান৷ এটা ওঁর নিজস্ব থিওরি৷ এই ভাবে নাকি প্লেয়ারদের মোটিভেট করেন৷ সেমিফাইনাল ম্যাচের আগে বিনি নাকি প্লেয়ারদের ফুটবলের গল্প নিয়ে করা একটা সিনেমা দেখাবেন৷ সিনেমাটার নাম, ‘‘এনি গিভেন সানডে’’৷ নায়ক আলপাচিনো৷ স্টোরিটা ইন্টারেস্টিং না?’
বললাম, ‘খুব ইন্টারেস্টিং৷ কপিগুলো তুই করে রাখ৷ আমি এখন স্পোর্টস জার্নালিস্ট টেন্টে আছি৷ সন্ধে ছ’টার মধ্যে অফিসে ঢুকে যাব৷’
তথাগত বলল, ‘ওহ, সেই কেকা রায় কেসটা? সলভ করে ফেলেছেন নাকি?’
‘প্রায়৷ গিয়ে বলব৷ কীভাবে সলভ করলাম জানিস? মেয়েদের বিশ্বকাপ থেকে আসা একটা স্টোরি দেখে৷ এখন সাসপেন্স থাক৷ ছাড়ছি রে৷’
বসিরহাটে মেয়েদের যে-দলটা খেলতে গিয়েছিল, তাদের সবাইকে আজ ময়দানে স্পোর্টস জার্নালিস্ট টেন্টে আসতে বলেছি৷ কেকার ফ্যামিলির লোকজনকে আসতে বলেছিলাম৷ বসিরহাট থেকে সকালে সুদীশও চলে এসেছে৷ আমার বাড়িতে লাঞ্চ সেরে একটু আগে আমরা দুজন টেন্টে এসেছি৷ মিনিট পনেরো হল, মেয়ে ফুটবলাররা সব একে একে আসতে শুরু করেছে৷ অনেকের চোখমুখ শুকিয়ে গিয়েছে৷ প্রত্যেকেই একবার করে আমার কাছে এসে বলতে লাগল, সে নির্দোষ৷ এদের সবার সঙ্গে আমি আলাদা করে কথা বলেছি৷ মোটামুটি একটা আন্দাজ হয়েছে, কে দোষী? তিনদিন হয়ে গেল, কেকার জলে ডুবে যাওয়ার৷ এত তাড়াতাড়ি রহস্যটা ভেদ করতে পারব, আমি তা ভাবতেও পারিনি৷ পোস্টমর্টেম রিপোর্টে অস্বাভাবিক কিছু যে পাওয়া যায়নি, সেটা সুদীশ আমাকে সেদিনই জানিয়ে দিয়েছিল৷ অ্যাক্সিডেন্ট কেস ধরে নিয়ে ও আর এগোয়নি৷
তবুও আমার খটকা যায়নি৷ যদি সাধারণ দুর্ঘটনাই হত, তা হলে কেকার হাতে, গায়ে আঁচড়ের দাগ থাকত না৷ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে, মেয়েটা জলে ডুবে গেছিল, রাত এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে৷ অত রাতে ও পুকুরঘাটেই বা যাবে কেন? নিশ্চয়ই তখন কেউ ওর সঙ্গে ছিল৷ আমাদের বসিরহাটের রিপোর্টার বলেছে, পুকুরঘাটটা বেশ চওড়া এবং বাঁধানো৷ কেকা পা পিছলে পড়ে গিয়েছে, এমনটা হতেই পারে না৷ টেন্টের লনে এতক্ষণ বসেছিলাম৷ ভিতরে হলঘরে ঢুকব ঢুকব করছি, এমন সময় দেখলাম, অনুরাধাকে নিয়ে অসিতাভ আসছে৷ দুপুরে অসিতাভকে ফোন করে বলেছিলাম, যে-করেই হোক, তুই অফিস থেকে অনুরাধাকে তুলে আনবি৷ দু-দিন ধরে ফোনে আমি অনুরাধাকে ধরতে পারছিলাম না৷ কেকাকে ও যে চাকরিটা দিতে চেয়েছিল, তাতে আর কে কে দাবিদার ছিল, সেটা জানা খুব জরুরি মনে হয়েছিল৷ দূর থেকে এক ঝলক দেখেই মনে হল, অনুরাধার উপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে গিয়েছে৷ ওর মুখে যেন কেউ কালি লেপে দিয়েছে৷ প্রবালের সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যই কি এই পরিণাম?
হলঘরের ভিতর কেকার একটা ছবি সাজিয়ে রেখেছিলাম৷ তাতে মালা দেওয়ার পর সবাই থিতু হয়ে বসার পর আমি বললাম, ‘খুব বেশিক্ষণ সময় নেব না৷ গত রবিবার রাতে বসিরহাটে তোমাদেরই এক সতীর্থ ফুটবলারের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে৷ এটা তার শোকসভা হিসাবেও ধরে নিতে পার৷ আসলে ওর মৃত্যুর রহস্যভেদ করার জন্যই তোমাদের সবাইকে ডেকেছিলাম৷ আমাদের এখানে হাজির আছেন বসিরহাট থানার ওসি, আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু সুদীশ নাগ৷ আমি তার অনুরোধেই এই রহস্যভেদ করায় উদ্যোগ নিয়েছিলাম৷ খুব ট্যালেন্টেড ছিল এই মেয়েটি৷ কিন্তু অকালে ওকে চলে যেতে হল৷ আমি জানি, তোমাদের অনেকেই এ জন্য মনে মনে কষ্ট পাচ্ছ৷’ বলে একটু থেমে সামনের মুখগুলোর দিকে তাকালাম৷ শান্তা রুমাল দিয়ে মুখ মুছছে৷ অন্যরা শূন্য চোখে আমার দিকে তাকিয়ে৷ অসিতাভ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে৷ যেন পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচে৷ বাইরে এতক্ষণ বেশ গুমোট ছিল৷ আমরা ভিতরে ঢোকার পর বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে৷ বাইরে থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আমি বললাম, ‘বসিরহাটে সেদিন রাতে ঠিক কী হয়েছিল, তোমাদের ভিতর কয়েকজন তা জানো৷ কিন্তু লজ্জায় বলতে চাইছ না৷ ঠিক আছে, কী হয়েছিল, সেটা বলার দায়িত্ব না হয় আমি নিচ্ছি৷ সবার মুখ থেকে ঘটনাগুলো শুনে, আমি তা পরপর জুড়ে নিয়েছি৷ একটা কথা আগেই জানিয়ে রাখি, কেকার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থেকে এমন অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া যায়নি, যাতে প্রমাণ হয়, ওকে খুন করা হয়েছে৷ কিন্তু ওর মৃত্যুটা স্বাভাবিকও নয়৷
‘প্রায় চল্লিশ বছর আগে, আমাদের দেশে মেয়েদের ফুটবল যখন শুরু হয়, তখন পরিস্থিতিটা ছিল অন্যরকম৷ ট্রিমেন্ডাস এনথুসিয়াজম ছিল সেই সময়৷ কিন্তু ধীরে ধীরে সেটা কমে আসতে শুরু করল৷ সেই সময় যাঁরা মেয়েদের ফুটবল চালাতেন, তাঁদের অদূরদর্শিতায় খেলাটাই মিডিয়া ফোকাসের বাইরে চলে গেল৷ মেয়ে ফুটবলাররা একটা সময় আবিষ্কার করল, খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার৷ তাদের জন্য চাকরিবাকরি নেই৷ পুরুষ ফুটবলাররা ক্লাবে খেলে প্রচুর রোজগার করে৷ অথচ মেয়েদের জন্য সে সুযোগ নেই৷ মেয়েদের লিগ আছে বটে কিন্তু সেটা কখন শুরু হয়, কখন শেষ—কেউ জানতে পারে না৷ রোজগার সম্ভব, শুধু গ্রামেগঞ্জে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে৷ মেয়েদের ফুটবল সংস্থা পুরুষদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার পর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেল৷ প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শৃঙ্খলা নেই বলে হতাশা এখন চরমে৷
‘সাংবাদিক হলেও খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত জীবনে মাঝেমধ্যে আমাদের ঢুকতে হয়৷ অনেকসময় অনিচ্ছাসত্ত্বেও৷ সেই কারণেই জানতে পারি, হতাশার সঙ্গে কিছু কিছু ভাইসেসও এসে জুটেছে মেয়েদের ফুটবলে৷ বছর পনেরো আগে, একজন মেয়ে ফুটবলারের মা এসে আমার কাছে কমপ্লেন করেছিলেন, তাঁর মেয়ে রাখি…বাড়ি ছেড়ে অন্য এক মেয়ে ফুটবলার অমৃতার বাড়িতে গিয়ে উঠেছে৷ ওরা সারা জীবন একসঙ্গে থাকতে চায়৷ সতীর্থদের মধ্যে গাঢ় বন্ধুত্ব হতেই পারে৷ কিন্তু এই কেসটা ছিল অন্যরকম৷ রাখি পরে আমাকে বলেছিল, অমৃতাকে না পেলে ও সুইসাইড করবে৷ অনেক অনুরোধ করেও রাখিকে আমি বাড়ি ফেরাতে পারিনি৷ পরে শুনেছি, মেয়েটা ব্রেস্ট ক্যানসারে মারা যায়৷ একটা কথা আগেই বলে রাখি, সমকামিতা নিয়ে আমার কোনো ছুঁতমার্গ নেই৷ সমাজের পক্ষে এটা ভালো কি মন্দ, সময়ই তা বিচার করবে৷ সমকামিতা এখন আইনসিদ্ধ৷ কিন্তু এটা যদি ঈর্ষা আর কারও হত্যার কারণ হয়, তাহলে আইন তার মাঝে এসে দাঁড়াবেই৷’ কথাগুলো বলে আমি একটু থামলাম৷ সামনে বসে থাকা মুখগুলো নীচের দিকে ঝুঁকে গিয়েছে৷ হলঘরে পিন পড়লেও তার শব্দ শোনা যাবে৷ শান্তার দিকে চোখ পড়ায় দেখলাম, মুখ দু-হাত দিয়ে ঢেকে কাঁদছে৷ সময় নষ্ট না করে ফের বলতে শুরু করলাম, ‘কেকা রায়ের মৃত্যুও হয়েছে এই ঈর্ষাজনিত কারণে৷ আর যে-মেয়েটি এর নেপথ্যে, সে আমাদের সামনেই বসে আছে৷’
সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম, মেয়েদের মুখগুলো ঘুরে গিয়েছে শান্তার দিকে৷ ওদের মুখগুলোই বলে দিচ্ছিল, কেকার সঙ্গে শান্তার গোপন সম্পর্কটা কারও অজানা নয়৷ আমি এই প্রতিক্রিয়াটাই দেখতে চাইছিলাম৷ তাই বললাম, ‘বসিরহাটের অর্গানাইজাররা যখন ম্যাচের জন্য শান্তার কাছে যান, তখন শান্তা একটা কথাই বলেছিল, তিন রাত্তির থাকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে৷ আর আমাদের চারজন সিনিয়র মেয়ের জন্য চারটে আলাদা ঘর৷ অর্গানাইজাররা একটু অবাক হলেও, তাতেই রাজি হয়ে গেছিল৷ খেলার আগের দিন অন্য মেয়েরা শান্তার অনেক আগেই বসিরহাট পৌঁছে যায় ট্রেনে করে৷ গিয়ে দেখে আলাদা ঘরের ব্যবস্থা নেই৷
অর্গানাইজারদের প্রচুর গালাগাল করে সিনিয়র মেয়েরা৷ কেকাকে নিয়ে বাইকে করে শান্তা বসিরহাট পৌঁছোনোর পর অবশ্য আলাদা চারটে ঘরের ব্যবস্থা হয়৷ কেকাকে নিয়ে শান্তা একটা ঘরে ঢুকে যায়৷
‘সমস্ত ঠিকঠাকই চলছিল৷ কিন্তু খেলার দিন দুপুরে শান্তার এক প্রতিদ্বন্দ্বী গিয়ে হাজির হয় বসিরহাটে৷ প্রাক্তন ফুটবলার৷ ইন্ডিয়ান টিমের ক্যাপ্টেন ছিল৷ সে গিয়ে বলে, কেকার খেলা দেখতে এসেছে৷ অর্গানাইজাররা কৃতার্থ হয়ে যায়, তাকে দেখে৷ তার জন্য আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করে দেয়৷ কিন্তু এদিকে, শান্তা রাগে গুম হয়ে যায়৷ প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে কিছুদিন আগেই বনগাঁয় শান্তার হাতাহাতি হয়ে গিয়েছিল কেকাকে নিয়ে৷ একে কেকা পাড়ার মেয়ে, তার উপর বছর দু-এক ধরে পার্টনার৷ অন্য একজন ওকে ছিনিয়ে নেবে, এটা শান্তা সহ্য করতে পারেনি৷ কেকাকে ও বলেই দিয়েছিল, প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে ওকে খেপ খেলার টিম থেকে বাদ দিয়ে দেবে৷ তাই কেকা পড়েছিল মুশকিলে৷ খেপের খেলা থেকে বাদ পড়ে গেলে রোজগার হবে না৷ ছোটোখাটো শখ মেটানোর জন্য মায়ের কাছে হাত পাততে হবে৷ তবুও গোপনে ও শান্তার প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখত৷ তার বাড়িতে যেত৷ ওদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কও হয়েছিল৷ কেকা বেসিক্যালি খুব শান্ত প্রকৃতির নরম মনের মেয়ে ছিল৷ হঠাৎ ওর এতটা ডেসপারেট হওয়ার কারণ, শান্তার প্রতিদ্বন্দ্বী ওকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে৷ সেইসঙ্গে ইন্ডিয়া টিমে চান্স পাইয়ে দেবে৷
‘এই প্রতিশ্রুতির কথা, নানা মুখ ঘুরে একদিন শান্তার কানেও আসে৷ ময়দানে একদিন লিগের খেলার সময় দেখা হওয়ায় শান্তা এমন হুমকিও দেয়, কেকার দিকে হাত বাড়ালে ও জানে মেরে দেবে৷ এতে ওর প্রতিদ্বন্দ্বী আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে৷ কিন্তু ওর কপাল খারাপ, বাড়িতে ডেকে এনে কেকাকে আদর করার সময় ও স্বামীর কাছে ধরা পড়ে যায়৷ এমনিতেই ওদের কনজুগাল লাইফ ঠিকঠাক চলছিল না৷ ঝগড়ার সময় ওর স্বামী বলে ফেলে, কেকার সঙ্গে ওর সম্পর্কটার কথা সে শান্তার মুখে শুনেছে৷ দুজনের মধ্যে সেদিনই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়৷’
সুদীশ এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল৷ আমি থামতেই ও বলল, ‘কে সেই মেয়েটা? কেকার মৃত্যুর জন্য কীভাবে তাকে দায়ী করা যাবে?’
‘বলছি৷ বসিরহাটের খেলায় ম্যাচের সেরা হয়েছিল কেকা৷ ওকে একটা সোনার হার উপহার দেন কেউ৷ সেই পুরস্কার অর্গানাইজাররা কেকার হাতে তুলে দিতে বলেন শান্তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে৷ হার হাতে তুলে দেওয়ার সময় সে ফিসফিস করে বলে, রাতে পুকুরঘাটে চলে আসিস৷ শান্তা রাতে নেশা করেছিল৷ ও ঘুমিয়ে পড়তেই কেকা পুকুরঘাটে চলে আসে৷ শান্তার প্রতিদ্বন্দ্বী ওকে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে চায়৷ কিন্তু শান্তা বোধহয় মানা করে দিয়েছিল৷ ধরা পড়ে যেতে পারে, এই কারণে কেকা রাজি হয়নি৷ দুজনের মধ্যে স্কাফল হয়৷ শান্তার প্রতিদ্বন্দ্বী এমন রেগে যায় যে, কেকাকে ধাক্কা মেরে জলে ফেলে দেয়৷ ও অবশ্য জানত না, কেকা সাঁতার জানে না৷ কেকার হাতে যদি নখের আঁচড় না পাওয়া যেত, তা হলে কারও সন্দেহই হত না৷’ কথাগুলো বলেই অনুরাধার দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, ‘কী, আমি ঠিক বলেছি? আইটিসি হোটেলে তুমি কিন্তু সেদিন আমায় বলোনি, কেকার খেলা দেখার জন্য তুমি বসিরহাটে গিয়েছিলে৷ উলটে, খবরটা প্রথম শোনার ভান করেছিলে৷’
আধঘণ্টা পর অনুরাধাকে নিয়ে সুদীশ লালবাজারে চলে যাওয়ার পর স্পোর্টস জার্নালিস্ট টেন্ট থেকে বেরিয়ে আসছি, দেখি, অসিতাভ গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে৷ আমাকে দেখেই বলল, ‘আমাকে মাফ করবেন কালকেতুদা৷ সব জানতাম, কে কার পার্টনার, তাও৷ তবুও আপনাকে কিছু বলতে পারিনি৷ শান্তার সঙ্গে টিম নিয়ে আমিও বসিরহাটে গিয়েছিলাম৷ সেদিন রাতে অনুরাধাদি আর কেকাকে আমি পুকুরঘাটের দিকে যেতে দেখেছিলাম৷ তখন আমি স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে৷ কিছুতেই ঘুম আসছিল না৷ হঠাৎ দেখি, অনুরাধাদি পুকুরঘাটে কেকার হাত ধরে টানছে৷ কেকা বলছে, ‘আমাকে ছাড়ো, হাতে লাগছে৷’ তার একটু পরেই অনুরাধাদি ধাক্কা মেরে কেকাকে পুকুরে ফেলে দিল৷ বলল, ‘‘শান্তা তোকে একা ভোগ করবে, আমি তা হতে দেব না৷’’ অনুরাধাদি স্কুলবাড়িতে ঢুকে আসার পর আমি পুকুরঘাটে গিয়েছিলাম, যদি কেকাকে তুলে আনা যায়, তার জন্য৷ কিন্তু গিয়ে দেখি, পুকুরের জল নিথর৷ ভয়ে পরদিন ফার্স্ট ট্রেনে আমি বাড়ি ফিরে আসি৷ কিন্তু আপনি এসব জানলেন কী করে?’
শুনে মুচকি হাসলাম৷ মেয়েদের বিশ্বকাপ ফুটবল চলছে যে জার্মানিতে! মেয়ে ফুটবলারদের নিয়ে প্রচুর খবর আসছে৷ এজেন্সি একটা খবর পাঠিয়েছিল, মেয়ে ফুটবলারদের মধ্যে পঁচাত্তর শতাংশ সমকামী৷ খবরটা পড়ার পরই নতুন করে বসিরহাটের ঘটনাটা মিলিয়ে দেখতে শুরু করি৷ তার আগের দিনই অনুরাধার স্বামী প্রবাল আমার বাড়িতে এসে অভিযোগ করেছিল, অনুরাধা লেসবিয়ান৷ সেই কারণেই দুজনের মধ্যে যত অশান্তি৷ ওর দেওয়া সূত্র ধরে তারপর কয়েকজন মেয়ে ফুটবলারকে জিজ্ঞাসাবাদ করলাম৷ ওরাই স্বীকার করল, ওদের মধ্যে অনেকেই সমকামী৷ এমনকী, অনুরাধাও৷ ফলে রহস্য উদঘাটন করতে সময় লাগল না৷
গাড়িতে ওঠার পর বললাম, ‘পরে একদিন আসিস৷ তখন ডিটেলে কথা বলব৷ আজ অফিসে সবাই আমার জন্য বসে আছে৷’ কথাটা বলেই গাড়ি স্টার্ট দিলাম৷ সুদীশের ধমকানিতে একটু আগে কাঁদতে কাঁদতে সকলের সামনে অনুরাধা স্বীকার করেছে…হ্যাঁ, ও-ই ধাক্কা মেরে কেকাকে জলে ফেলে দিয়েছিল৷ পরে যদি বয়ান উলটে দেয়, তা হলে অসুবিধে নেই৷ অন্তত একজনকে তো পাওয়া গেল, যে আই উইটনেস৷ মামলা চলার সময় সাক্ষ্য দিতে পারবে৷
সমাপ্ত