নকশা

নকশা

শুনেছিস? অরি বিশ্বাস বেপাত্তা—সুদেব সরকার বলল সমীরকে, এখনও পাবলিক জানে না।

বলিস কি? এ তো অবিশ্বাস্য খবর? ফার্স্ট পেজের অ্যাঙ্কর-এ যাবে।

হ্যাঁ। সে ডিটেলস বার করতে পারলে। খুঁজে আনতে পারলে তো আর দেখতে হচ্ছে না। এখন ব্যাপারটা খুন, না অ্যাবডাকশন, না স্বেচ্ছা-পলায়ন … সেটা সার্কামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স থেকে বার করতে হবে। একটু টিকটিকিগিরি আর কি।

সমীর বলল, এই সেদিন নতুন ছবির মহরত হল অত ঘটাপটা করে, অত খানাপিনা নাচা-গানা। এত উল্লাসের কেন্দ্রীয় কারণই তো অরি বিশ্বাস।

আবার কি? কত দিন থেকে জাল পেতেছে বল তো। এতদিনে ধরা পড়ল। ধাড়ি কাতলা। আগের ছবিগুলোর দুটোই তো পাবলিক গপাগপ খেল। প্রথমটা একটু বেশি নাটুকে হয়ে গেছিল, তা-ও।

এবারেরটা জানিস তো? অরিজিৎ-প্রতিভার বিভিন্ন দিকের দর্পণ বিশেষ।

কী রকম?

আরে আমি তো প্রেস-কার্ডে গিয়েছিলাম। পরিচালক সামন্তই বলল, এবার উনি পঁচিশ বছরে সা-জোয়ান ছোকরা থেকে বাহাত্তুরে বুড়ো পর্যন্ত সাজছেন। লিডার। অরিজিতের অ্যাকটিং, অরিজিতের মেকআপ-এর উপরই ছবিটা দাঁড়িয়ে আছে।

সমীর বলল, হতেই পারে। স্টেজের উপর তো চাষাভুসো সাজলে মনে হয় এই বুঝি দেহাত থেকে ধরে নিয়ে এল। আবার আঁতেল হয়ে নামলে মনে হয় আরে, এই তো সেদিন ইনিই কফিহাউসের লর্ডস-এ বসে যুক্তি-তর্ক-গপ্পো কেঁদেছিলেন। আচ্ছা সুদেব, ওঁর অম্বরীষ-এর কী হবে? বা হচ্ছে?

চলছে। একেবারে তো ছেড়ে দেননি। টিমটা গড়ে ছিলেন প্রাণ দিয়ে। কাজেই চলছে। ওঁর নামেই এখন পয়সাগুলো উঠে আসছে সব। তবে ওরা একটু মিইয়ে গেছে। আমার ভাইয়ের বন্ধু আছে তো ওখানে। বলছিল টিম-ওয়ার্ক খুব ভালো কথা। কিন্তু সেটা করাতে ব্যক্তিত্ব লাগে। জ্ঞান, ভালোবাসা এবং ক্রোধও লাগে। সেসব অরিজিৎ বিশ্বাসের মতো আর কারও নেই। সত্যি, ওই রকম চলা-বলা-গলা পালটাতে আর কাউকে দেখলাম না। এক কেয়া চক্রবর্তী পেরেছিল ভালোমানুষ

অরিজিৎ বিশ্বাসকে শেষ দেখা গিয়েছিল শর্মিলি সেনের গাড়িতে। শর্মিলি সেন মানে শ্যামলী তরফদার। প্রচারের প্রয়োজনে পালটে ফেলা হয়েছে নামটা। প্রাচীন শ্যামলী হয়েছে মডার্ন শর্মিলি। তরফদারটা সেতারে ছাড়া চলে না এ বিষয়ে সবাই এক মত। এবং পদবি খুঁজতে খুঁজতে স্বভাবতই সেন। সেন পদবিটা বাংলা-জয়ী। যেমন বল্লাল সেন, সুকুমার সেন, বনলতা সেন, সুচিত্রা সেন …। দুষ্টু লোকেরা বলে শর্মিলি নয়, এঁটুলি। অরি বিশ্বাসের লেটেস্ট। শর্মিলিও রয়েছে ছবিটায়। তারই সাদা অ্যামবাসেডার-এ অরিজিৎকে শেষ দেখা গিয়েছিল। শর্মিলির শফার, ক্যামেরাম্যান ধীরু ব্যানার্জি এবং অরিজিতের নিজস্ব মেকআপম্যান শিবসাধন সেনাপতি ঠেসেটুসে তাঁকে সাদা অ্যামবাসাডরটায় তুলেছিলেন। অরিজিৎ স্ববশে ছিলেন না।

চোদ্দো পনেরো লাখ খরচ হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। বাংলা ছবির পক্ষে যথেষ্ট। প্রচার দেওয়া হচ্ছে খুব। ডিস্ট্রিবিউটার মুখিয়ে আছে। সবারই ধারণা ছবি পড়তে পাবে না। এমত সময়ে অরিজিৎ সেটে এলেন না। প্রথমেই ফোন করা হল শর্মিলির ফ্ল্যাটে। হয়তো সেখানেই মশগুল হয়ে রয়েছে। আর্টিস্টরা যে যত প্রতিভাশীল হোক না কেন আসলে সব… সামন্ত একটা মধুর গালাগাল উচ্চারণ করল মনে মনে। কিন্তু না, শর্মিলি জানে না। না, সেদিন ওঁকে ওঁর হোটেলের ঘরেই পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। না, উনি শর্মিলির ফ্ল্যাটে যাবার অবস্থায় ছিলেন না।

এবার কোথায়? হোটেলে।

না, সাতাশে অক্টোবর থেকে অরি বিশ্বাসের চাবি ম্যানেজমেন্টের কাছে, ঝুলছে।

আসেননি। না, একবারও না।

অম্বরীষ-এর অফিসে ফোন করা হল।

আপনারা জানেন না, আমরা জানব? অভিমানী উত্তর।

সত্যি সত্যি জানেন না?

মানে? আপনারা কি ভাবেন ওঁকে আমরা কিডন্যাপ করব?

তবে অম্বরীষ থেকে কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবদের ঠিকানা মিলল। প্রায় সকলেই বললেন, অরি বিশ্বাসের কোনো সংবাদই তাঁরা রাখেন না। একজন রেগে মেগে বললেন, আপনারা, এই আপনারাই চাঁদির জুতো মেরে তাকে আমাদের কাছ থেকে ফুসলিয়ে নিয়েছেন। আবার এত বড়ো আস্পদ্দা যে আমাদের কাছেই তার খোঁজে এসেছেন। পালিয়েছে? খুব ভালো কথা। এমনটাই চাইছিলুম। খোঁজ পেলেও বলব না। পরবর্তী অভিযান আত্রেয়ী ভট্টাচার্যের আস্তানায়। আত্রেয়ী অরিজিতের ভূতপূর্ব স্ত্রী। অনেক চেষ্টা করে তাঁর ঠিকানা জোগাড় হয়েছে। আসলে ব্যাপারটা খুব যাকে বলে ডেলিকেট। আত্রেয়ী দেবীও এক সময়ে বহুদিন অম্বরীষ-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, নাটকে অংশ নিতেন না। উনি ছিলেন শিল্পী। সেট তৈরি করা, আঁকাজোকার কাজ, পাবলিসিটির জন্যে লে-আউট তৈরি করা এইসব দায়িত্বে ছিলেন। অরিজিতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিঁড়ে যাবার পর অম্বরীষকেও উনি ছেড়েছেন। অম্বরীষ-এর ক্ষতির খাতায় উনি দু-নম্বর। আজকাল এক ইনটিরিয়র ডেকোরেটর্স সংস্থায় কাজ করেন। তা, তাঁর অফিসে ফোন করায়, অরিজিতের খবর জিজ্ঞেস করা হচ্ছে শুনে উনি দ্বিতীয় শব্দ উচ্চারণ না করে ফোন নামিয়ে রাখলেন। অগত্যা ওঁর বাড়ি। দু কামরার একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট। উত্তর কলকাতার একটা সরু গলিতে। সামন্তকে উনি চিনতেন না বলেই বোধহয় দরজা খুলে দিয়েছিলেন। অরিজিতের প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন, আর কত সরববা?

মানে? আপনি কী বলছেন আমি ঠিক …

বলছি, আর কত সরববা? এই দেখুন, আট বাই দশ দুখানা ঘর কুল্লে, রান্না আর খাওয়া এক জায়গাতেই সারি। বাথরুমটা রান্নার জায়গার একেবারে পাশেই। উত্তর-পশ্চিমের ফ্ল্যাট। শীতকালে কী ঠান্ডা ধারণা করতে পারবেন না। বাবা, মা, ভাই, বোন কেউ নেই। মানে, থেকেও নেই। আর কোথায়? আর কত সরবো?

যদি একটা ধারণাও দিতে পারতেন। একটা আইডিয়া… উনি কোথায় যেতে পারেন।

আইডিয়া? আমার মাথায় অত আইডিয়া আবার খেলে না, বুঝলেন। কী নাম আপনার? সামন্ত? আমি ওই ব্রথেল-ট্রথেল পর্যন্ত জানি। তারপর জাহান্নমের পথে যেতে ঠিক কতগুলো, কতরকম স্টপ আছে, থাকে, আমার জানা নেই। এবার আপনি আসুন। কই উঠুন? কুইক। আমার কাজ আছে।

সামন্ত কপালের ঘাম মুছতে মুছতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। বাপরে। কী মহিলা। দিব্যি ঠান্ডা, শান্ত-শিষ্ট মনে হয় দেখলে। এ যেন কোল্ড ড্রিংক-এর বোতল। হাত বোলালে ঠান্ডা। ছিপি খুললেই ফোঁসস।

***

ট্রেনটা আরও স্পিড় নিচ্ছে না কেন? কী হবে এতগুলো চোতা স্টেশনে থেমে? নিদারুণ অধৈর্যে, বিরক্তিতে ষষ্ঠতম সিগারেটটা শেষ না করেই বাইরে ছুড়ে ফেলে দেন অরিজিৎ বিশ্বাস। এক ব্যাটা ভিখিরি লোপ্পা ক্যাচের মতো সেটা লুফে নিল। এটাই একটা অকাট্য প্রমাণ যে যতটা স্পিডে স্টেশন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা ততটা স্পিড নিচ্ছে না গাড়িটা। প্লেনে যাওয়ার জায়গা নয়। গাড়িতে গণ্ডগোল। গ্যারাজে অতএব। একগাদা টাকা দিয়ে ঘটা করে বিদেশি গাড়ি কেনবার মজাটা এবার বোঝো হে বিশ্বেস। অতীন, সর্বেশ্বর, মণীশ সবাই বারণ করেছিল। হো হো করে তাদের কথা উড়িয়ে দিয়েছিলে। দিয়েছিলে তো? ভেবেছিলে গ্রুপ থিয়েটার হল শো-বিজ-এ মিডল ক্লাস। একেবারে মিডল মিডল ক্লাস। বড়ো বড়ো বক্তিমে করো সুযোগ পাবে। ফটাফট হাততালি। হ্যাঁ, তা-ও। রিভিউ?—প্রচুর প্রচুর। কিন্তু লক্ষ্মী কখনও ঝেড়ে কাশবে না, দাদা! ঢাকের দায়ে মনসা বিককিরি। তা সেই গ্রুপ থিয়েটারের ওরা দেশি-বিদেশির তফাত আর কী বুঝবে?

যেমন চোতা ট্রেন, তার তেমনই চোতা ফার্স্ট ক্লাস। বাথরুমে বেসিনটা ফটাস করে খুলে এল। মানে কোনও শ্রীমান তাকে সরাবেন শিগগিরই। কাজ এগিয়ে রেখেছেন। সপ্তম সিগারেটটা ধরালেন অরিজিৎ। রাত বাড়ছে। রাত। আহা রাত? রাত বড়ো ভালো মাল। ঝিকমিক আলো। চেনা মুখ অচেনা। অচেনা মুখ যেন বড়ো চেনা চেনা ঠেকে হে। খাও দাও বেপাত্তা হয়ে যাও। কে তোমায় চ্যাং-দোলা করে তুলে নিয়ে গেল, কার সঙ্গে কী বোঝাপড়া হল, কাকে কাকে চুমু খেলে, সব রঙিন বুদবুদের মতো ফেটে যায়, আবার গজায়, আবার ফাটে, আবার গজায়। আর সকাল? সকাল হল শালা ঘেয়ো কুকুরের বাচ্চা। ছাল চামড়া সুদু উঠে গেছে। ছ্যাঃ। খোঁয়ারি ভাঙার সকাল। অন্য সময়। অন্য সময়ে মেজাজে থাকলে তুমি সকাল, দুপুর, বিকেল কিছুর পরোয়া করো না অরি বিশ্বেস। করো না কি? নাঃ, করি না। কাজ করি। কা-জ। এমন কাজ যে হোল ওয়ার্ল্ডের তাক লেগে যায়। এই পাঁচ ফুট সাড়ে এগারো ইঞ্চির খোলে ডিনামাইট ঠাসা আছে হে সামন্ত। পাল্লা দিতে চেষ্টা কর। পারবি না।

আরেকটু পরেই এরা ডিনার দেবে বলেছে। ইংলিশ ডিনার আবার। হাঃ হাঃ। পায়রার ঠ্যাং, বেমালুম পায়রার ঠ্যাং চালাবে মোরগার ঠ্যাং বলে। ঘোড়ার পেচ্ছাপের মতো চা খাইয়েছে কয়েকবার। এবারে পায়রার ঠ্যাং। রাসকেল সব, স্কাউন্ট্রেল। গোটা রেলওয়েজ, রেলওয়ে মিনিস্ট্রি। এদের চাকরিতে যে যেখানে আছে, সব, সব। পয়সা নেবে, গলায় গামছা দিয়ে, দেবার বেলায় লবডঙ্কা। এদিক থেকে হিন্দি ফিলমও সৎ। পাবলিক রেপ চায়, রেপ দেয়, মারদাঙ্গা চায়, মারদাঙ্গা দেয়। আধ ন্যাংটো মেয়েছেলে দেখতে চায়, তো তাই দেয়।

সুটকেসটা খুললেন অরিজিৎ। মাল বার করতে হবে। নইলে পায়রার ঠ্যাং গলা দিয়ে নামবে না। সামনে আবার তিনটি পুঙ্গব বসে। বহুক্ষণ থেকে গবাদি পশুর মতো চেয়ে আছে। হয় বাইরের দিকে, নয় তাঁর মুখের দিকে। চিনতে পেরে থাকবে। চেনো বাবা, চেনো। খালি ভাব জমাতে যেয়ো না। আর চরণামেত্তোও আশা কোরো না। যারা একা একা মাল এনজয় করতে পারে না, অরিজিৎ তাদের দলে নয়। তা কয়েক ঢোঁক খাবার পরে দেখলেন পুঙ্গবগুলি প্রকৃতি দেখছে। অদূর ভবিষ্যতে যখন গপ্পো ফাঁদবে তখন কিন্তু ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে যাবে, জানিস ফটিক, অরিজিৎ বিশ্বাসের সঙ্গে সেবার ট্রাভল করছিলুম। কী সদাশয় ভদ্রলোক খুব গপ্পে। যা জমেছিল না। শেষ কালটা মানিক-অরিজিন্দা, অরিজিন্দা-মানিক … ইত্যাদি ইত্যাদি।

ট্রেনটা হঠাৎ হেঁচকি তুলে থেমে গেল। এতক্ষণ বেশ আমি যাব না, তুমি যাবে, তুমি যাবে না আমি যাব না করে যে করে হোক চলছিল। এখন যেন গোঁত্তা খেয়ে ঘুড়ি লাট খেয়ে পড়েছে। বোতলটা ঢুকিয়ে সুটকেসের ডালা বন্ধ করে দিলেন অরিজিৎ। বাইরে পৃথিবীর আদি রং, নিকষ কালো। বন-জঙ্গলের মতো মনে হচ্ছে জায়গাটা। উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। উলটো দিকের সিট থেকে একটি যুবক চেঁচিয়ে উঠল, স্যার, এখানে নামতে যাবেন না, অন্ধকার, অনেক নীচু, তা ছাড়া ভীষণ ডাকাতি হয় এ লাইনে। দরজা একদম খুলবেন না, কাইন্ডলি।

অপাঙ্গে একবার চেয়ে দেখলেন অরিজিৎ। ডাকাত। মানে দস্যু। মানে গুন্ডা? অর্থাৎ মাফিয়া? সর্বনাশ। তিনি ফিরে এসে অষ্টম সিগারেটটা ধরালেন। হঠাৎ মনে হল পকেটে বিছে কামড়াচ্ছে। টেলিগ্রাম। টেলিগ্রাম। হোটেলের কাউন্টারে খোঁয়ারি ভাঙার সকালে আকাট টেলিগ্রাম একখানা। পাঁচ দিন না সাড়ে ছ দিন পার হয়ে গেছে। পোস্টাল সার্ভিস কী তোর বাপের? যে টেলিগ্রাম করলেই সঙ্গে সঙ্গে দিতে হবে। কী আছে ওতে জানেন অরিজিৎ, তবু আরেকবার খুলে পড়তে লাগলেন। তিনটে শব্দ। ব্যাস আর কিছু না। এখন তাহলে আমি কী করব। হাততালি কুড়োতে পারি, কনট্র্যাক্ট সই করতে পারি। মাল খেতে পারি। কিন্তু হনুমানের মতো লম্ফ তো দিতে পারি না। আর সব স্পোর্টস ছেড়ে এখন পশ্চিমবঙ্গে এই লম্ফ দেওয়ার খেলাটিই প্রোমোট করা উচিত। ট্রেন ধরবে? পাথর পাতা স্ট্র্যান্ড রোড দিয়ে রে রে করে আসছ! জ্যাম। কুছ পরোয়া নেই। গুনে গুনে দশ পা পিছিয়ে যাও তারপর রই রই করে স্পিড় নিয়ে লাফ ঝাড়ো, এক লম্ফে হাওড়ার পুল, দুই লম্ফে হাওড়ার নতুন অ্যানেক্স। হাজরা মোড় থেকে ঠনঠনে পর্যন্ত জলে ভাসছে? পঁচিশ মিনিটের প্রবল বর্ষণে কলকাতার জনজীবন বিপর্যস্ত? আবারও ওই উল্লম্ফন ভরসা। লাফ দাও বঙ্গ সন্তান, লাফ দাও। লাফ দিতে দিতে শিরদাঁড়ার তলার হাড়টি বাড়তে পারে। কার্টিলেজ, শক্ত হাড় নয়। এর নাম অভিযোজন। সোজা বাংলায় অ্যাডাপ্টেশন। এয়ার পিলো মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়লেন অরিজিৎ।

***

আমি এবার যাই খোকা, আমার কেমন সব ত্যাগ হয়ে যাচ্ছে।

সে কী? রাগ করেছ? এত অভিমান করে না মায়ি। বিহার শরিফে ট্রাক নিয়ে গেছি। ন দিনের জায়গায় পনেরো দিন। এরকম একটু আধটু হয়েই থাকে মাগো। অপরাধই যদি হয়ে থাকে এবারের মতো মাফ করে দে মা। আর কখনও এমন হবে না।

না রে, অভিমান-টান নয়। একটুও উদ্বেগ হয়নি আমার। সেটাই আশ্চর্য। জানিসই তো আগে তোর ফিরতে দেরি হলে কেমন মুখ শুকিয়ে আমসি করে থাকতুম। এখন, এবার এসব কিছু হল না খোকা। তুই সাবালক হয়ে গেছিস। নিজের পথে চলবি।

মা, মা, মা, তুমি বেঁচে আছ তো? কথা আছে। কথা ছিল। অনেক। মা তুমি চুপ করে থেকো না। একটু কথা বলো। একটু।

স্যার, স্যার আপনার কি কোনও কষ্ট হচ্ছে?

ধড়ফড় করে উঠে বসলেন অরিজিৎ।

ঘুমের মধ্যে খুব যন্ত্রণার শব্দ করছিলেন।

ওহ সরি। সরি টু হ্যাভ ডিসটার্ব ইউ।

অরিজিৎ মাথার এলোমেলো চুলের মধ্যে দিয়ে আঙুল চালালেন। ঢক ঢক করে জল খেলেন খানিকটা। নবম সিগারেটটা ধরালেন। ভোর হয়ে আসছে। ঘুমজড়ানো প্ল্যাটফর্ম সব পার হয়ে যাচ্ছে। আধো আধো গলায় চা-গ্রম।

এই এদিকে দেখি, দু গ্লাস, হ্যাঁ। যাক পৌঁছোনো গেল। তাহলে পৌঁছোনো যায়।

ফাঁকা ফাঁকা জায়গাটা। যখন মাকে রাখতে এসেছিলেন, তখন আরও ফাঁকা ছিল। এখন অনেক বাড়ি ঘর। দোকানপাট। চায়ের স্টল। ধাবা। টেম্পো, অটো, সাইকেল রিকশা। কিন্তু বাগান-ঘেরা ছোট্ট বাড়িটিতে বসে মনে হল কিছুই নেই। যা কিছু আপাত পরিচিত, জীবন-যাপনের যন্ত্রাংশ, কিছুই নেই। মা-ও তো নেই। মা সেবা-ভবনে। অথচ এই ছোটো বাড়িটাতে মা যেন আছে। সেই গর্ভধারিণী যিনি এক হাতে বড়ো করে তুলেছিলেন একটি শিশুকে, একটি বালককে। একটি কিশোরের, একটি যুবকের যিনি সব বুঝতেন। এক সময়ে তিনি মা বাবা-দাদা দিদি-বন্ধু-সবই ছিলেন। সেই মা-ই তো? না, মা তো নয়। যেন জননী-জননী মনে হয়।

অল্প বয়সি ডাক্তারটি বললেন, সংকটটা কেটে গেছে। হার্ট ডাইলেটেড। এদিকে প্রেশার বড্ড ফ্লাকচুয়েট করছিল। ভাবিনি বাঁচাতে পারব।

মা ক্ষীণকণ্ঠে বলে, হ্যাঁ, ওকে ভালো করে বলো। নইলে ও ভাববে…

ভৎসনার দৃষ্টিতে মার দিকে চেয়ে অরিজিৎ বললেন, থামো তো তুমি …!

মা বিছানা ছাড়ল। ধীরে ধীরে বাগানে বেড়াচ্ছে আজকাল। ভোরে একবার, সন্ধ্যায় একবার। সঙ্গে অরিজিৎ, মা তুমি বল পাচ্ছ তো শরীরে?

পাচ্ছি। কিন্তু খোকা কত দীর্ঘদিন আমাকে দেখিস না। আমি থাকলেই বা কী? গেলেই বা কী! যুক্তি দিয়ে বোঝ। বোঝবার চেষ্টা করো।

ঠিক আছে। যুক্তি দিয়েই বুঝি। মা, তুমি আছ, কোথাও আছ, এই জ্ঞানটা আমার বেঁচে থাকার পক্ষে কাজ-কর্ম করার পক্ষে দরকার। তুমি দূরে থাকলেও আছ তো! ইচ্ছে করলেই দেখতে পাব। না হলে আমার সব গোলমাল হয়ে যায়।

মা খুব মৃদু কণ্ঠে বলল, আমি থাকলেও কি গোলমাল আটকাতে পারি খোকা?

অরিজিৎ অনেকক্ষণ ধরে ভাবলেন, তারপর বললেন, হয়তো পারো। ইচ্ছে করলে। তাঁর মাথার মধ্যে একটা স্তব্ধতা, আশরীর কেমন একটা শৈথিল্য, আলস্য। প্রবল ঝঞ্ঝাবাত্যা থেকে কোনো গতিকে রক্ষা পেয়ে যদি তার নৌকো পায় সবাতাস, শান্ত জল, সবজ দ্বীপ, তাহলে নাবিক যেমন ডাঙা আর ছাড়তে চায় না, তেমনই।

হঠাৎ একদিন খেয়াল হল। জিজ্ঞেস করলেন, মা, তাই তো! তোমায় গুরু কই?

মা হাসল, বলল, কই? গুরু নেই তো!

তবে? তোমার ঠাকুর? যার জন্য তোমার নাকি সব ত্যাগ হয়ে গেল?

মা সন্তর্পণে ফুলের গাছগুলোতে হাত বোলাতে লাগল, এখানে তোর ভালো লাগছে।

না?

ভালো লাগছে বইকি! এত সুন্দর জায়গা! এমন নিঃশব্দ। আমার ভিতরটা জুড়িয়ে যাচ্ছে।

মা নীচু হয়ে একটা গোলাপ গাছের ফুল সুষ্ঠু ডাল সাবধানে তার দিকে ফিরিয়ে বলল, দ্যাখ।

অদ্ভুত উজ্জ্বল মভ রঙের গোলাপ। আকারে প্রায় একটা মাঝারি চন্দ্রমল্লিকার মতো। মভ গোলাপ অরিজিৎ কখনও দেখেননি। শিশিরে ভেজা। অদ্ভুত কোমল, মসৃণ স্পর্শ।

আরও আছে, মা বলল।

গাছে গাছে যেন তারা ফুটে রয়েছে। সাদা তারা, নীল তারা, আলতা রঙের তারা। বিশাল সাদা ক্যাকটাসের ফুল ফুটেছে। তার বাইরেটা সাদা, ভিতরটা হলুদ।

একদিন আবিষ্কার করলেন খুব ভোরবেলায় মেয়েরা সব ঝুড়ি ঝুড়ি ফুল আনে। আর একটা বেদির উপর মা তাদের সঙ্গে মিলে ফুলের নকশা বানায়। ঘন ঠাসবুনুনি সব নকশা! গন্ধে-বর্ণে যেন নন্দন-কানন।

এই বেদিটাই তাহলে তোমার ঠাকুর! মা কিছুই বলল না। সব উত্তরই যেন তাঁকে নিজেকে খুঁজে পেতে হবে। কিন্তু রোজই ভোরে এসে তিনি দেখতে থাকেন শ্বেতজবা, মভ গোলাপ, কদম্ব, শিরীষ, কুমুদ, জুই, ফুলের পরে ফুল, ফুলের পাশে ফুল। অখণ্ড মনোযোগে নকশা তৈরি হচ্ছে।

মেয়েদের জিজ্ঞেস করেন, কী করিস তোরা? যে যার জীবনের নকশাখানা ফুটিয়ে তোলবার চেষ্টা করছিস নাকি?

যা বলেন, মেয়েরা দুলে দুলে হাসে, তারপর আবার ফুলের মধ্যে ডুবে যায়। দেখতে দেখতে একদিন কেমন জেদ চেপে গেল। অরিজিৎ বললেন, ঠিক আছে। আমিও সাজাব। অনেক নির্মাণ তত করলাম জীবনে, দেখি এটা কেমন পারি। দে আমাকে ফুল দে।

মায়ের বাড়ির মেয়েগুলি হাসে, নিজের ফুল আপনাকে নিজেকেই বেছে নিতে হবে, এটাই নিয়ম।

অরিজিৎ হাত বাড়িয়ে তুলে নিলেন। বিচিত্র বর্ণের সব বোগেনভিলিয়ার মতো পত্রালি।

মেয়েরা বলল, বাঃ, আরক্ষা নিয়েছেন দাদা। ভালো। ভাগ্যবান আপনি। তখন তিনি তুলে নিলেন লাল রঙের, সাদা রঙের, হলুদ রঙের গোলাপ। মেয়েরা যেন রুদ্ধশ্বাসে চেঁচিয়ে উঠল, শরণাগতি। শরণাগতি। আপনি কিন্তু শরণ নিয়ে নিলেন দাদা মনে রাখবেন।

কীসের শরণ? কার শরণ? সব কিছু উড়িয়ে দেবার হাসি হাসতে হাসতে অরিজিৎ ডবল রজনিগন্ধার ছড়িতে হাত রাখলেন। মেয়েরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, অ্যাসপিরেশন। অভীপ্সা বাছলেন দাদা। অরিজিৎ তুলে নিলেন আকন্দ। ওরা উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, সাহস, সাহস! ঠিক আছে তবে সাজান এবার। বেদির নৈঋত কোণটুকু আপনার জন্যে ছেড়ে রাখলাম।

সেই থেকে অরিজিৎ সাজান। কখনও অভীপ্সার গুচ্ছ মাঝখানে লম্বা ফুলদানে উল্লম্ব রেখায় বসিয়ে তার চারদিক ঘিরে শরণাগতির চক্র রচনা করেন। সাহসের রেখা, চক্রের অরের মতো চারদিক থেকে গিয়ে ছুঁয়ে থাকে শরণের গোলাপগুলোকে। আরক্ষার পত্রালি দিয়ে দুর্ভেদ্য বৃত্ত রচনা করেন তারপরে। কখনও রজনিগন্ধা দিয়েই শুরু করেন। তার কেন্দ্র নেই। সব সোপান। তাদের দুপাশ ঘিরে জমাট হয়ে থাকে রক্তগোলাপ। তারপরে আকন্দ, হলুদ গোলাপ। এইভাবে নানা নকশা বুনতে থাকেন অরিজিৎ। সাজাতে সাজাতে একদিন নিজেই বললেন, বাঃ। নানা রঙের বোগেনভিলিয়ার পাপড়ি পুরো নকশার উপর ছড়িয়ে দিতে থাকেন অরিজিৎ। পত্ৰং পুস্পম। পত্রং পুস্পম। কানে আসে বাড়ির দিক থেকে একটা তুরীয় উল্লাস, একটা কোলাহল যেন ভেসে আসছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ে।

উঠতে উঠতে অরিজিৎ একটা আলোর ঝলক দেখতে পেয়ে ভেবেছিলেন বিদ্যুৎ চমকাল। কিন্তু মুসাণ্ডার ঝাড়ের ওপার থেকে সুদেব সরকার উঠে দাঁড়াল। পাশে সমীর। সে-ই ফটোটা তুলেছিল।

কী দাদা। চিনতে পারছেন? অনেকগুলো দিনের অনভ্যাস, অরিজিৎ ভুলে গিয়েছিলেন। এখন সমস্ত ব্যাপারটা ফ্ল্যাশ-গানের ঝলকের মতোই ঝট করে বুঝে ফেললেন। সুদেব তো একজন সাংবাদিক, খুব ভালো করেই ওকে চেনেন অরিজিৎ। ও-ই তাঁর সব কাজকর্মকে সবচেয়ে ভালো কভারেজ দ্যায়। আরে চলো, চলো। বিষ্টি পড়ছে। খোলা আকাশের নীচে কথা হয়? কীভাবে যে আপনার ঠিকানা বার করেছি। চিন্তা করতে পারবেন না অরিজিৎদা।

তাই না কি? কীভাবে করলে? উৎসুক গলায় অরিজিৎ বললেন।

সে সব ট্রেড-সিক্রেট বলা হবে না। সুদেব সমীরের দিকে চোখ রেখে হাসল। ঘরে পৌঁছে অরিজিৎ পা তুলে বসলেন তাঁর তক্তাপোশে। সুদেব বসল সামনের চেয়ারে। অরিজিৎ দেখলেন সুদেব টেপ-রেকর্ডারের সুইচটা অন করছে। চমৎকার ব্যাটারি সেটটা ওর। ঘুরে ঘুরে ছবি নিতে থাকল সমীর। সুদেব ষড়যন্ত্রীর হাসি হাসছে, হঠাৎ অজ্ঞাতবাসের কারণটা কী অরিজিৎদা?

প্রয়োজন ছিল নিশ্চয়ই! গলা গাঢ় করে বললেন অরিজিৎ।

প্রেশার না কি? খুব চিন্তা?

হ্যাঁ। তবে আমার না। মায়ের। চিন্তা তাঁর জন্য?

তা একটা খবর দিলেন না কেন?

খবর? …তাই তো। ভীষণ রকমের অবাক হয়ে অরিজিৎ বললেন, ভুলে গিয়েছিলাম… একেবারে ভুলে…

আমাকেও ঠিক কথাটা বলবেন না দাদা! সাউজি আর সামন্তর সঙ্গে টার্মস নিয়ে গণ্ডগোল তো আপনার গোড়া থেকেই! আপনাকে দিয়েই লাভ তুলবে, অথচ আপনি যা চেয়েছেন তার অর্ধেকও দেবে না…

তাই তো … তুমি জানলে কোথা থেকে?

আরে দাদা, আমাদের সব জানতে হয়, আমরা অবিকল জাগ্রত ঠাকুরের মতো।

তা বটে। কিন্তু সে জন্যে তো আমি চলে আসিনি সুদেব!

জানি দাদা, শর্মিলি সেন… প্লিজ কিছু মনে করবেন না, ওকে এড়ানো ভগবানের বাবারই সাধ্য নেই, তো আপনি!

শর্মি-লি সেন? ও হ্যাঁ। শর্মিলি! একটু নাছোড়বান্দা টাইপের বটে। কিন্তু ওকে এড়ানোর জন্যে আমি চলে আসতে যাব কেন? একেবারে পিয়োর অ্যান্ড সিম্পল কারণটা। মা মরণাপন্ন শুনে মাথার মধ্যে সব কেমন হয়ে গিয়েছিল।

টেপ-রেকর্ডারের নব খটাশ করে বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল সুদেব। মুখে হতাশা।

ঠিক আছে দাদা, আজ বিশ্রাম করি।

এঁদের গেস্ট-হাউসটা ভারি সুন্দর। শান্ত। আরে আমাদের তো স্বস্তি-শান্তি দরকার। যেভাবে বেঁচে থাকি ওকে কি আর বাঁচা বলে? বলে কোনোমতে টিকে থাকা। প্রচণ্ড ঝড় চারদিকে, এলোমেলো বাতাস, তার মধ্যে দৌড়োতে হচ্ছে। এখন, পায়ের ব্যালান্স কে কতটা ঠিক রাখতে পারে। এই তো কথা। দু হাত ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল সুদেব। গেস্ট-হাউজে ফিরতে ফিরতে সমীর বলল, অরিজিৎদাকে কেমন নার্ভাস লাগছিল, খেয়াল করেছিলি?

সুদেব আড়চোখে তাকিয়ে বলল, উনি একজন নট, মনে রাখিস।

তুই বলছিস, সবটাই অভিনয়?

অফ কোর্স। মায়ের অসুখ! লাখ লাখ টাকার প্রজেক্ট, বন্ধু-বান্ধবী, এত্তো জানাশুনো কাউকে কোথাও কোনো খবর দেওয়া নেই। ইয়ার্কি নাকি?

অন্য কিছু বলছিস?

আই বেট।

অগাথা ক্রিস্টির কেসটা মনে আছে? স্বামী আর বান্ধবীর বিশ্বাসঘাতকতার শকে স্মৃতিভ্রংশ হয়ে গিয়েছিল। শর্মিলির সঙ্গে… সে রকম কিছু…

শর্মিলি নয়। শর্মিলি নয়। যবনিকার অন্তরালে কেউ আছে… কেউ… উঃ সুদেব নিজের বাঁ হাতের পাতার ওপর ডান হাত দিয়ে ঘুসি মারল।

মায়ের অসুখ দিয়ে স্মৃতিভ্রংশ হয় না। স্টোরিও হয় না। ঠিকই। তারের পাপোশে জুতোর কাদা তুলতে তুলতে সমীর মন্তব্য করল।

কাল আবার…

উঁহু। কাল নয়। দুটো দিন সময় দে। আমরাও চারদিকটা একটু দেখে নিই। কে জানে সেই শ্ৰীমতী এখানেই কি না!

ইতিমধ্যে আর কেউ গন্ধে গন্ধে এসে পড়লে?

সম্ভব নয়। তবু যদি আসে, আসবে! ঘাবড়াচ্ছিস কেন?

ও কী তুললেন দাদা? মায়ের বাড়ির মেয়েগুলি শিউরে উঠল।

মুঠো ভরা বড়ো বড়ো নীল অপরাজিতা নিয়ে অরিজিৎ, কেন? কী হল? তিনি তুললেন রক্তকরবী। মেয়েগুলি কাঁপছে। অরিজিৎ বললেন, রোজ রোজ একই ফুল দিয়ে কত আর নকশা করা যায়। আজ নতুন কিছু বানাব। এই করবীকে তোরা কী বলিস?

সংগ্রাম।

আর এই নীল অপরাজিতা?

মেয়েদের দলে কাজের ধুম পড়ে গেল। ভীষণ ব্যস্ত। কেউ দীপ সাজাচ্ছে, কেউ ধূপ জ্বালাচ্ছে। কেউ রাশীকৃত পাতা ঝাঁট দিচ্ছে। কেউ ঝরিতে করে জল আনছে। অরিজিৎ শেষ উত্তরটা পেলেন না।

নীল অপরাজিতা আর রক্তকরবী, ডগডগে গাঢ় সব রং। তবু বড়ো সুন্দর মানিয়েছে। মাঝখানে উঁচিয়ে আছে মুদিতকলি রজনিগন্ধা। গোলাপের পাপড়ি দিয়ে বৃত্তের পরিধি শেষ করলেন অরিজিৎ।

… প্রচণ্ড ঝড় দিচ্ছে চারদিকে। তারই মধ্য দিয়ে দৌড়োতে হচ্ছে। এখন পায়ের ব্যালেন্স কে কতটা ঠিক রাখতে পারে। … কোন নাটকে ছিল সংলাপটা। কে কাকে বলেছিল? মাথার মধ্যে বোলতা ঘুরছে, ভোঁ ভোঁ। এলোমেলো বাতাস। প্রচণ্ড ঝড়। পা রাখা যাচ্ছে না। কিন্তু রাখতে হবে। কোথায়? কোথায় এমন পরিস্থিতি? বোলতাটা এখনও বেরল না। আরও যেন ডেকে আনছে। বোলতার ঝাঁক এখন। আলগা হয়ে যাওয়া মোটা তামার তারের ভ্যাঁ ভ্যাঁ শব্দ করে ঘুরপাক খাচ্ছে।

ডাক্তার বললেন, এত জ্বর! সামলাতে পারছি না। অ্যান্টিবায়টিক দিই মা!

দাও।

জ্বর কমেছে। কিন্তু অরিজিৎ নিস্তেজ, নিথর, প্রেশার নেমে যাচ্ছে। আচ্ছন্ন ভাব।

ডাক্তার বললেন, সেবা-ভবনে নিয়ে যাই মা?

যাও।

নৈঋত কোণে কী রচনা করেছে অরিজিৎ। মা এসে দাঁড়ায়। নীল, নীল, ঘন নীল। কেন এত নীল? কেন খোকা? পাশে পাশে লালের বুনট। সংগ্রামী লাল। রজনিগন্ধাগুলি খুলে গেছে। আকাশের দিকে মুখ। মৃদু সুগন্ধে সবাইকে যেন হারিয়ে দিতে চায়। গোলাপের পাপড়িগুলো মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। জমাট। মা দেখতে থাকে। দেখতে থাকে।

সুদেব, সমীর সেবা-ভবনে রোজ আসে, যায়। ক্যামেরা খাপে বন্ধ। টেপ রেকর্ডার চুপ। পাঁচ দিনের দিন অবস্থা সঙিন হয়ে উঠল। ডাক্তার গম্ভীর। কোনো কথাই বলতে চান না। ছ-দিনের দিন সমীরকে চলে যেতেই হয়। মা বললেন, সুদেব, তুমিও যাও। কাজের ক্ষতি হচ্ছে।

আমরা ওদিকের একটা ব্যবস্থা করেই আবার… তা ছাড়া বড়ো ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। এতবড়ো একটা প্রতিভা… এভাবে…।

না, আসতে হবে না। অন্য ব্যবস্থার দরকার হলে করা হবে। তেমন কিছু হলে তোমরাই আগে খবর পাবে। ঠিকানা, ফোন নম্বর সব রেখে যাও। চমকে মুখ তুলে তাকায় সুদেব, তাকায় সমীর। মার মুখের একটি পেশিও কাঁপছে না। ভাবান্তর নেই।

নীল ফুলগুলি সব শুকিয়ে, হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে। করবীর লাল নিশান উড়ছে ঠিক। প্রস্ফুটিত রজনীগন্ধার দণ্ডগুলি ঊর্ধ্বমুখ, সমান সতেজ। গোলাপের পাপড়ি মাটি কামড়ে আছে।

ড্রিপের ছুঁচ যেখানটায় ফোঁটানো ছিল ইঙ্গিতে সেখানে আঙুল দেখিয়ে অরিজিৎ মাকে জিজ্ঞেস করল, কী?।

মা হাত বুলিয়ে দেয়। আস্তে আস্তে সব তুলে নেওয়া হয়। নাড়ি স্বাভাবিক। প্রেশার স্বাভাবিক। বিছানায় আজ প্রথম উঠে বসেছে অরিজিৎ বিশ্বাস। হাতে ছোটো কাচের গ্লাসে কমলালেবুর রস। মাথার দিকে মা, পায়ের কাছে মা। অরিজিৎ দেখতে পাচ্ছে খানিকটা। বুঝতে পারছে বাকিটা।

কী হয়েছিল বলো তো ডাক্তার?

অপ্রতিভ মুখে ডাক্তার বলে, যখন কিছুতেই কিছু ধরা যায় না, তখন সত্যি কথা বলতে কি আমাদের একটা স্টক ডায়াগনোসিস আছে।

কী? কী সেটা?

আমতা আমতা করে লজ্জিত ডাক্তার বলে, ভাইরাস। কোনো অচেনা ভাইরাস।

বাঃ, তাহলে বাঁচালে কেমন করে?

আমি বাঁচাইনি তো? মেডিকাল টার্মসে বলতে গেলে… আসল কথা, আপনি নিজেই নিজেকে বাঁচিয়েছেন।

বেদির চারধারে মায়ের বাড়ির মেয়েগুলি অখণ্ড মনোযোগে ফুল সাজাচ্ছে। নানা রকম ফুল, নানারকম নকশা। সাজাতে থাকে। সাজাতে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *