নকল রাণী
(অর্থাৎ স্বামী হত্যাপবাদের কলঙ্ক বিমোচনের চেষ্টা)
প্রথম পরিচ্ছেদ
অদ্য আমি যে ঘটনাটির বিষয় পাঠকগণের সম্মুখে উপস্থিত করিতেছি, তাহা কলিকাতার ঘটনা নহে; উহা বর্দ্ধমান জেলার অন্তর্গত কোন একটি পল্লীর ঘটনা। এই মকদ্দমার অনুসন্ধানের ভার কেন যে আমার উপর প্রদত্ত হইয়াছিল, তাহা আমি বলিতে পারি না। কিন্তু উপরিতন কর্মচারীর আদেশ আমাকে প্রতিপালন করিতেই হইবে, সুতরাং ঐ অনুসন্ধানের ভার আমাকে গ্রহণ করিতে হইল। অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমি যে আদেশ-পত্র প্রাপ্ত হইয়াছি, তাহার সহিত একখানি বেনামা-পত্র ছিল। ঐ পত্র হইতেই ঐ ঘটনার কতক বিষয় অবগত হইতে পারিয়া এই অনুসন্ধানে লিপ্ত হইলাম। ঐ পত্রে যাহা লেখা ছিল, তাহার সারমর্ম্ম এই;–
“কমলার বাড়ী বর্দ্ধমান জেলায়। কমলার পিতা এক্ষণে বর্তমান নাই, তিনি ধনী ছিলেন। যতকিছু পাপ এ জগতে থাকিতে পারে, বৃদ্ধ সমুদয়েরই অধিকারী হইয়া এই অতুল ধনরাশি সঞ্চয় করিয়াছিলেন। বৃদ্ধের কেবলমাত্র একটি কন্যা, সেইটিই সংসারের একমাত্র সম্বল,–নাম কমলা। কমলার বিবাহ হইয়াছে, কমলার স্বামী খুব বড় মানুষের ছেলে, অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিকারী। নিজে তিন শত টাকা মাহিনার চাকুরী করেন, নীলকুঠীর ম্যানেজার, মাসে প্রায় হাজার টাকা রোজগার। তিনি বিহার অঞ্চলে থাকেন; বাটীতে অন্য কোন অভিভাবক না থাকায়, ও কৰ্ম্মস্থলে স্ত্রীকে রাখিবার তাদৃশ সুবিধা না থাকায় কমলাকে পিত্রালয়েই রাখেন, — মাঝে মাঝে আসিয়া কমলাকে দেখিয়া যান, আজও সন্তানাদি হয় নাই। কমলার বয়স হইয়াছে, কমলা পূর্ণ যুবতী— কমলা সুন্দরী, হৃদয় দয়াদাক্ষিণ্যে পূর্ণ— বহুকালের পর কমলা আজ স্বামী- কমলা আদর্শ স্ত্রী। ছয় মাসের পর কমলার স্বামী আজ শ্বশুরালয়ে আসিয়াছেন- সন্দর্শন করিলেন। কমলার স্বামীর নাম সরোজকান্ত। সরোজকান্তের সমস্ত দিন আহার নাই— কমলা স্বামীকে শীঘ্র শীঘ্র খাওয়াইবার জন্য রন্ধনকার্য্যে ব্যাপৃত; সরোজবাবু উপস্থিত কিঞ্চিৎ জলযোগ করিয়া বৈঠকখানায় তাম্রকূট সেবনে ব্যস্ত। বৃদ্ধ শ্বশুর পার্শ্বের ঘরে,- সে ঘরে আরও দুটি লোক আছে বলিয়া বোধ হইল; কেন না, পরস্পর তাহারা কি বলাবলি করিতেছে। সরোজবাবুর ঔৎসুক্য জন্মাইল— তিনি কপাটের ছিদ্র দিয়া দেখেন— ভীষণাকৃতি দুইজন লোক বৃদ্ধের সহিত পরামর্শ করিতেছে। সরোজবাবু বৃদ্ধ শ্বশুরকে খুব ভালরকম জানিতেন; গোহত্যা, ব্রহ্মহত্যা, ডাকাতি, এ সব কিছুই বাকী নাই, এ বৃদ্ধ বয়সে এখনও সে পাপপ্রবৃত্তি বৃদ্ধের হৃদয় হইতে অন্তর্হিত হয় নাই. বৃদ্ধ আজ ডাকাতের সহিত পরামর্শে ব্যস্ত। সরোজ শুনিলেন, বৃদ্ধ, সাক্ষাৎ যমদূত সদৃশ ঐ দুইজনকে বলিতেছেন, —’
“দুজনে কুড়ী টাকা দেবো, পারবি ত?”
“কর্তা! আমাদের অসাধ্য কিছু আছে কি?”
“তোরা আছিস্ ব’লে—আমি আজও বেঁচে আছি।”
“তবে কি জানেন,—জামাইবাবু!”
“নে নে,—অনেক জামাইবাবু দেখেছি, টাকার কাছে কেউ নয়।”
“জামাইবাবু” এই কথা শুনিয়া সরোজকান্ত শিহরিয়া উঠিলেন, মনে মনে ভাবিলেন—“জামাই বাবু!” কোন জামাইবাবু? জামাই ত আমি— আমাকে কি এরা হত্যা করিবে বিশ্বাস নাই। দেখি, আর কি কথাবার্তা হয়!”
বুদ্ধ বলিলেন, “তবে তোরা যা, ঠিক সময়ে আসিস!”
“আজ্ঞে কর্তা তা আর বলতে হবে না।” এই কথা বলিয়া সেই দুই ব্যক্তি পার্শ্বের দরজা দিয়া চকিতের ন্যায় চলিয়া গেল; বৃদ্ধ একাকী রহিলেন।
সরোজকুমার চিন্তা-নিমগ্ন, ঘোর সন্দেহ-দোলায় দোদুল্যমান; এরা আমাকেই খুন করিবে বুঝিলাম, আজ মৃত্যু অনিবার্য্য নিয়তির হাত কেহই এড়াইতে পারে না, কপালে যা আছে, তাই হইবে, ভগবান ভরসা। কিন্তু শ্বশুর মহাশয় আমাকে খুন করিবেন কেন? আমার বিষয় আশয়, নগদ টাকাকড়ি হস্তগত হইবে বলিয়া? অর্থের জন্য নরহত্যা, বিশেষতঃ পুত্রে ও জামাতায় কোন প্রভেদ নাই, সেই জামাতাকে খুন করিয়া তাহার ধনদৌলত লইবার চেষ্টা! আজ যদি কোনরূপে বাঁচি, তবে এই পর্যন্ত— কমলা যে ভাল, তাহাও নয়- সেও এর ভিতর আছে নিশ্চয়ই। আর না রাক্ষসীর মায়া, আর না। সরোজ প্রতিমুহূর্তে মৃত্যু কল্পনা করিতে লাগিলেন।
কমলার রান্না হইয়া গিয়াছে— প্রাণ ভরিয়া আজ স্বামীকে অনেক দিনের পর খাওয়াইবে। সরোজবাবু অনিচ্ছাসত্ত্বেও আহার করিলেন। কমলা কারণ জিজ্ঞাসা করিলে কহিলেন, “সমস্ত দিনের পর আহারে তত ইচ্ছা নাই, তাই খাইতে পারিলাম না।”
আহারাদির পর সরোজকান্ত কমলার ঘরে শয়ন করিলেন, কমলা গুড়গুড়িতে তামাক সাজিয়া দিয়া গেল। বৃদ্ধ পিতার জলযোগের ব্যবস্থা করিয়া দিয়া স্বয়ং খাইতে বসিল। সমস্ত দিন না খাওয়া, না দাওয়া— সরোজ ভাবিতে ভাবিতে ঘুমাইয়া পড়িলেন। রজনী প্রভাত, কমলা উঠিল, উঠিয়া দেখে, ঘরে সরোজবাবু নাই— দরজা খোলা।
“এই ঘটনার কিছুদিন পরে একজন পুলিস-কৰ্ম্মচারী আসিয়া সরোজবাবুর খোঁজ করে, তখন বৃদ্ধ আর ইহজগতে নাই। কমলা একাকী, পুলিস-কৰ্ম্মচারীকে দেখিয়া কমলার মনে ভয় হইয়াছিল। কমলা বিবেচনা করিল, এস্থানে একাকী থাকা আর ভাল নয়, পিতাঠাকুর মন্দলোক ছিলেন, ইহারা কোনরূপে তাহার সুলুক সন্ধান পাইয়া এবং আমাকে তাঁহার উত্তরাধিকারিণী জানিয়া, পাছে আমার উপর জুলুম করে, এই ভাবিয়া কমলা পরদিন গ্রাম ত্যাগ করিয়া কাশীতে আসিল। কিন্তু সেই পুলিস-কৰ্ম্মচারীকে তাহার অনুসন্ধান করিতে ইহার পর আর কেহ দেখিল না। কমলা এখন কাশীতেই বাস করিতেছে। এখন আমরা লোক পরম্পরায় অবগত হইতে পারিয়াছি যে, কমলা তাহার পিতার সাহায্যে, ধনলোভে পতি হত্যা করিয়াছে ও সেই ধন লইয়া এখন কাশীতে রাণী নামে পরিচয় প্রদান করিয়া আপনার কলঙ্ক বিমোচনের চেষ্টা করিতেছে। তাহার পিতা এখন ইহ-জগত পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে। কমলকে ধৃত করিয়া তাহাকে একটু পীড়াপীড়ি করিলেই বোধ হয়, সে সকল কথা বলিয়া দিবে। তখন জানিতে পারিবেন যে, আমাদিগের কথা কতদূর সত্য।”
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়া বহু কষ্টের পর কমলার গ্রাম প্রাপ্ত হইলাম। সেই স্থানে গমন করিয়া জানিতে পারিলাম, বাস্তবিকই কমলার স্বামী সরোজকান্ত রাত্রিকালে শ্বশুরবাটী হইতে নিরুদ্দেশ হন, কিন্তু তাঁহার কর্ম্মস্থানে বা নিজ বাড়ীতে প্রত্যাগমন করেন নাই। এই ঘটনার কিছু দিবস পরেই, কমলার পিতার মৃত্যু হয়, ও কমলা ঐ গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া পবিত্র কাশীধামে গিয়া বাস করিতেছে। গ্রামে এই কথা রাষ্ট্র যে, সে তাহার স্বামীকে হত্যা করিয়া পুলিসের ভয়ে কাশীবাসী হইয়াছে। ঐ স্থান হইতে এই অবস্থা অবগত হইয়া, আমি কাশীতে গমন করিলাম। রাস্তায় একজন সন্ন্যাসীর সহিত আমার হঠাৎ সাক্ষাৎ হইল; তিনি আমার নিকট সমস্ত কথা গল্পচ্ছলে তঅবগত হইয়া, আমাকে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে বিশেষরূপ সাহায্য করিতে স্বীকার করিলেন। তিনি সন্ন্যাসী হইয়া কেন যে আমাকে এই কার্য্যে সাহায্য করিতে আপনা হইতে সম্মত হইলেন, তাহা কোন প্রকারে আমি কিছুমাত্র বুঝিতে পারিলাম না। কিন্তু পরে জানিতে পারিয়াছিলাম ও পাঠকগণও জানিতে পারিবেন। আমরা উভয়ে কাশীতে দশাশ্বমেধ ঘাটে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, সেইস্থানে আজ বড় ধূম, কেবল দীয়তাং ভুজ্যতাং। দশাশ্বমেধ ঘাটের ত্রিতল বাটী লোকে লোকারণ্য, যে যাহা খাইতে চাহিতেছে, সে তাহা তৎক্ষণাৎ পাইতেছে। কাঙ্গাল গরিব দুই হাত তুলিয়া “জয় রাণী-মার জয়! শব্দে দিক্দিগন্ত কাঁপাইয়া সহৰ্ষমনে চলিয়া যাইতেছে। বাহির-বাটীতে বড় ভিড়, কার সাধ্য সেই জনস্রোত ঠেলিয়া অগ্রসর হয়। কিন্তু এমনি বন্দোবস্তের সহিত কাৰ্য্য সমাধা হইতেছে যে, কাহাকেও বিশেষ কষ্টভোগ করিতে হইতেছে না। প্রাতঃকাল হইতে সমস্ত দিনই প্রায়ই এইভাবে চলিল। এখন অপরাহ্ণ, বেলা ৫টা বাজে। শীতকাল। একে একে লোকজন জমিতে আরম্ভ হইল। সন্ধ্যা হয় হয়, এমন সময় আমি সেই জটাজুটধারী সন্ন্যাসীর সহিত সেই স্থানে উপস্থিত হইলাম। সন্ন্যাসীকে ভাল করিয়া দেখিলে প্রাচীন বলিয়া বোধ হয় না, জোর ৩৪।৩৫ বৎসর বয়ঃক্রম হইবে। কেন না, সেই অন্ধকারের সমষ্টি শ্মশ্রুগুম্ফ ও জটাভার এখনও শেত বর্ণ ধারণ করে নাই-
যেমন তেমনই রহিয়াছে। সন্ন্যাসী বহির্বাটীর দ্বারবানকে জিজ্ঞাসা করিলেন,—“ওহে বাপু! তোমাদের রাণীজীর নাম শুনিয়া, অনেকদূর হইতে আসিয়াছি, একবার তাঁহার সহিত দেখা করা আবশ্যক।”
দ্বারবান কহিল, “আজ্ঞে হাঁ! কেন না দেখা হইবে! অবশ্যই হইবে।”
সন্ন্যাসী।— “তুমি যে বেশ লোক হ্যা, কৈ, তুমি ত আমাকে রাজবাটীর দরওয়ানের মত চোক দুটি লাল করিয়া কথা কহিলে না?”
দ্বার। আজ্ঞে, আপনাদের মত লোকের উপর আপনাদের কেন, কোন লোকের উপরই কড়া হুকুম নাই। স। এমন সদাশয়া রাণী ত কখনও দেখি নাই।
দ। মহাশয়! আমি আজ আট দিন এই রাণীজীর কাছে চাকরি করিতেছি, আমিও-
স। আচ্ছা রাণীজীর নাম কি? বাড়ী কোথায়, জান? দ। শুনিয়াছি, সুখগড়ে বাড়ী, নাম—কমলা।
স। এখানে কতদিন হইল আসিয়াছেন?
দ। প্রায় দশদিন।
স। সঙ্গে কত লোক?
দ। তা ঠিক জানি না, তবে দেখিতেছি, চাকর বাকর সব এই স্থানেই নিযুক্ত হইয়াছে।
স। তাঁহার সহিত কখন দেখা হইবে?
দ। আহারের সময়।
স। সন্ন্যাসী ব্রহ্মচারীকে তিনি নিজে থাকিয়া খাওয়ান?
দ। হাঁ।
স। দেখা কোথায় হইবে?
দ। কেন, উপরের বৈঠকখানায়!
এমন সময়ে উপর হাইতে কে ডাকিল,—“সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারী, যাঁহারা আছেন, রাণীজীর আদেশ—- তাঁহারা উপরে আসুন।”
স। তবে বাপু উপরে যাইবার পথটা দেখাইয়া দাও।
দ্বারবানের দ্বারা পথ প্রদর্শিত হইলে সন্ন্যাসী ঠাকুর উপরের বৈঠকখানায় উঠিলেন, আমিও তাঁহার সঙ্গ পরিত্যাগ করিলাম না। উঠিয়াই অবাক! — দেখিলাম, ইতিমধ্যে টিকিধারী ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ ও দণ্ডী-সন্ন্যাসী প্রভৃতি আপন আপন স্থান অধিকার করিয়া বসিয়া আছেন। সুতরাং আমরা কোনরূপ বানিষ্পত্তি না করিয়া সভার একপার্শ্বে উপবেশন করিলাম। দেখিতে দেখিতে ৮টা বাজিয়া গেল। সকলে বলাবলি করিতে লাগিল, এইবার রাণী আসিবেন। বাস্তবিক কিছুক্ষণ পরে এক অপরূপ রূপলাবণ্যবতী যুবতী সখিদ্বয় সমভিব্যাহারে সভাস্থলে আসিয়া গললগ্নীকৃতবাসে সভাস্থ দণ্ডী, সন্ন্যাসী এবং ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণকে প্রণাম করিলেন। যুবতীকে দেখিলেই রাণী বলিয়াই বোধ হয়। বয়স আন্দাজ ২৪।২৫, অতিমৃদুমধুরস্বরে বিনয়াবনত হইয়া সকলের সহিত আলাপ করিতে লাগিলেন। আমার সঙ্গী সন্ন্যাসী একবার রাণীজীর মুখের দিকে তাকাইয়া মুখ হেঁট করিলেন।
রাণী কমলাও সন্ন্যাসীকে দেখিয়া যেন ভীতচকিত হইলেন, মুখ-জ্যোতি যেন তিরোহিত হইল। মুখে হাসি আছে, অথচ যেন নাই। বেশী কোন কথা আর না কহিয়া ভৃত্যকে ডাকিয়া বলিলেন, “ইহাদের সুব্যবস্থা করিয়া দাও, আমি কিছু পরে আবার আসিব।” এই বলিয়া তিনি সখিদ্বয়কে সঙ্গে করিয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন। এদিকে জলযোগের ব্যাপার উপস্থিত। একটা সোরগোল পড়িয়া গেল। যে যার পাতা লইয়া বসিল। কিন্তু আমাদের সন্ন্যাসী ঠাকুরের বরাত বড়ই মন্দ! এই ভিড়ের ভিতর তিনি যে কোথায় চলিয়া গেলেন, তাহা কেহই জানিতে পারিল না, কিন্তু আমি জানিতাম, আমারই উপদেশমত তিনি কোন কার্য্যোদ্ধার মানসে কোনস্থানে গমন করিলেন। তাঁহার অদৃষ্টে রাজভোগ জুটিল না।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
আমি ব্রাহ্মণমণ্ডলীর মধ্যে উপবেশন করিয়া উত্তমরূপে আহারাদি সমাপনাত্তর আপনার বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। সন্ন্যাসী ঠাকুর আর সেই রাত্রিতে প্রত্যাগমন করিলেন না; পরদিবস অতি প্রত্যুষে তিনি বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন, ও আমাকে কহিলেন, “আমাকে যেরূপ উপদেশ প্রদান করিয়াছিলেন, আমি ঠিক তাহাই সম্পন্ন করিয়াছি। সকলে যখন আহার করিতে বসিল, সেই সময় আমি একটি ঘরের ভিতর অন্ধকার মধ্যে লুকাইয়া রহিলাম। আমি যে ঘরে লুকাইয়া ছিলাম, ঠিক তাহার পার্শ্বের ঘরেই কমলা থাকিতেন। দেখিলাম, একে একে বাটীর সব গোলমাল মিটিয়া গেল। রাত্রি হইতে চলিল। রজনী দ্বিযাম অতিক্রম করেন। রাজভবন নিস্তব্ধ, বৈঠকখানাঘরের আলোক নিৰ্ব্বাণোন্মুখ, জনপ্রাণীর সাড়া শব্দ নাই। ধরিত্রী ঝিল্লীরবে পরিপূর্ণ, এমন সময় রাজভবনের প্রকোষ্ঠে দুইটি মনুষ্যমূৰ্ত্তি কি বলাবলি করিতেছে। প্রথমটি আমাদের কমলাদেবী আর দ্বিতীয় ব্যক্তির নাম শঙ্করদাস। শঙ্করদাসকে দেখিতে খুব বলিষ্ঠ, বয়স ২৯।৩০, যুবক, একরকম দেখিতে মন্দ নহে। এই শঙ্করদাস রাণীর নিকট অনেক দিন আছে, জাতিতে উগ্রক্ষত্রিয়, নিবাস ঠিক কোথায়, তাহা জানি না। বড়ই বিশ্বাসী কৰ্ম্মচারী। রাণী কিছুক্ষণ পরে শঙ্করের দিকে চাহিয়া বলিলেন, —
“দেখ শঙ্করদাস! যদি তুমি আমার পথ নিষ্কণ্টক করিতে পার, তবে তুমি যা বল, সব শুনিতে প্রস্তুত আছি।” শঙ্কর কহিল,—“কেন না পারিব!”
শঙ্করদাস রাণীর প্রণয়-লাভাশায় গোড়াগুড়ি মনে মনে এক রকম উন্মত্ত মাঝে মাঝে দুএকটা রসিকতার
কথাও যে না বলিত, এমন নহে, রাণী তাহাতে অসন্তোষ বা বিরক্তিভাব বাহিরে কিছু মাত্র প্রকাশ করিতেন না। আজ রাণীর আশাব্যঞ্জক কথা শুনিয়া কহিল, —
“যাহা বলিবেন, এখনি করিতে প্রস্তুত আছি।”
রাণী। ঐ সন্ন্যাসীকে খুন।
শঙ্কর। কোন সন্ন্যাসী?
রা। যাহার সহিত বৈঠকখানায় কথা কহিয়া তৎক্ষণাৎ চলিয়া আসিলাম, দেখ নাই?
শ। দেখিয়াছি, সে কে?
রা। কেন, তুমি ঐ ভণ্ড তপস্বীকে কি চিনিতে পার নাই? আমি ওর ভয়ে কাশী এলুম, তবু ও আমার সঙ্গে সঙ্গে ফিরছে, ওর নাম অমরচাঁদ, বড় বদমায়েস।
অমরচাঁদের নাম শুনিয়া শঙ্করদাস স্তম্ভিত হইল, জিজ্ঞাসিল,–
“তামরচাঁদকে চেনেন?”
রা। হাঁ, চিনি।
শ। অমরচাঁদ কি আপনার শত্রু?
রা। যদি এই পৃথিবীতে আমার কেহ শত্রু থাকে, তবে সে অমরচাঁদ।
শ। কেন— কারণ কি, শুনিতে পাই না?
রা। এখন শুনিবার সময় নয়।
শ। তাহাকে কি আজিই নিকেশ করিতে হইবে?
রা। হাঁ, পারিলে ভাল হয়।
শ। যদি করিতে পারি, তাহা হইলে কি হইবে?
রা। তোমার সঙ্গে–।
শঙ্করদাস জালে পড়িল।
কমলা পুনরায় কহিলেন, “আর আমার এই অসীম ধনের অর্দ্ধেক তোমাকে তৎক্ষণাৎ দিব। যদি আমাকে চাও, ও আমার এই অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিকারী হইতে চাও, তবে যাহা বলিলাম, তাহা অবিলম্বে সম্পন্ন কর।”
শঙ্কর। ভয় কি— শঙ্কর দাস থাকিতে অমরচাঁদকে ভয়? নিশ্চয় বলিতেছি, সে আর এ পৃথিবীতে নাই, তাহার প্ৰাণবায়ু বায়ুতে মিশাইয়াছে, কলা সূর্যোদয়ের সঙ্গে তাহার নাম-গন্ধ পর্য্যন্ত এই পৃথিবী হইতে লুপ্ত হইবে।
কমলা একটু মধুর হাসি হাসিয়া বলিলেন, —
“তোমার সহিত অমরচাঁদের তুলনাই হয় না।”
শ। আচ্ছা, আমি আর একটা কথা জিজ্ঞাসা করিব।
রা। শীঘ্র বল, বিলম্বে কাৰ্য্যহানি।
শ। অমরচাদের দ্বারা আপনি কি কোন প্রকার অত্যাচারিত হইয়াছিলেন?
কমলা দেবীর চক্ষুদ্বয় হইতে যেন অগ্নিকণা বর্ষণ হইল। বলিলেন, “ও আমার যম! আমাকে খেতে এসেছে, এখানে যাই, সঙ্গে সঙ্গে। কাশীতেও এসেছে আমাকে খেয়ে ফেলার জন্যে।”
শ। সে আপনার জীবননাশ কেন করিবে?
“বুঝিতে পার নাই?” একটু হাসিয়া কমলা একটি অতি প্রকাণ্ড কটাক্ষ শঙ্কর দাসের উপর নিক্ষেপ করিলেন, শঙ্কর সে তেজ সহ্য করিতে পারিল না। যে তেজে খোদ শঙ্করকে খাই খাই ডাক ছাড়িতে হইয়াছিল, সে তেজ আজ শঙ্করদাস সহিবে? পারিল না, গলিয়া গেল। ভ্যাবা গঙ্গারামের মত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল,-
“ও ব্যক্তির নাম যথার্থই কি অমরচাদ, না আর কোন নাম আছে?”
রা। হাঁ—উহার নাম অমরচাঁদ। আমার ভয়ানক শত্রু, নাম করিলে শরীর কাঁপিয়া উঠে, উহার ভয়ে আমার আহার নিদ্রা নাই, উহার মরণ হইলে আমি নিরাপদ।
শ। ইহার ভিতর যে কি বিশেষ কারণ আছে, তাহা ত সম্যকরূপে বুঝিতে পারিলাম না।
রা। যখন আমি দেশ থেকে আসি, তখন হইতেই ও আমার পেছু পেছু। ও লোকটা মলেই বাঁচি, যখনই তোমার
সহিত দেখা হইয়াছে, তোমাকে চিনিয়াছি— মনে মনে ভাবি, কত সুখ, কত সুখ জীবন থাকিলে– এক একবার ভাবি, এ প্রাণ আর রাখিব না, কিন্তু আমার সুখ মনে হইলেই সে চিন্তা সব কোথায় চলিয়া যায়।
শ। এ কি যথার্থ সত্য যে, তুমি আমার।
রা। এখন বুঝলে, কেন আমি সব কথা প্রকাশ করিয়া বলি না? ও লোকটা কখন কোন্ বেশে যে উপস্থিত হয়, নির্ণয় করা কঠিন।
শ। ভয়ের কোন কারণ নাই, ও লোক কোথায় থাকে, বা যায়— সেদিকে আমার দৃষ্টি রহিল।
শঙ্করের কথাগুলি শুনিয়া কমলা একটু অন্যমনস্কভাবে থাকিলেন ও দরজার পরদা টানিয়া অন্য একটি প্রকোষ্ঠে চলিয়া গেলেন। কিছুক্ষণ পরে নিভাঁজ রৌপ্য বিনির্ম্মিত দুটি হাতবাক্স লইয়া উপস্থিত! আসিয়া কহিলেন, “শঙ্কর! আমাকে কি কেউ কোন বিষয়ে সন্দেহ করে?”
শ। কই, আমি ত কোথাও কিছু শুনি নাই।
রা। তুমি কি মনে কর?
শ। আমি— আমি!
রা। যাহাই হউক, আমি শুনিয়াছি, তুমি ঋণজালে বড়ই জড়ীভূত, উত্তমর্ণগণ তোমাকে জ্বালাতন করে, এমন কি, পথে ঘাটে দেখা পেলে অপমান করিতেও ত্রুটী করে না।
শ। সে কথা বলে কি আর জানাব।
রা। এই লও- তোমাকে ৫০০ শত মুদ্রা দিলাম,—কেমন, ইহাতেই হইবে বোধ হয়?
শ। যথেষ্ট হইবে।
কমলা পুনরপি কহিলেন, –– “আমি যদি এ প্রকার শত সহস্র মুদ্রা প্রত্যহ ব্যয় করি, তথাপি আমার ধনের কিছুমাত্র ক্ষয় হইবে না। এই যে অতুল ঐশ্বৰ্য্য দেখিতে পাইতেছ, এ সমস্তই আমার মৃত স্বামীর বলিতে বলিতে কমলার কণ্ঠশ্বাস যেন রুদ্ধ হইয়া আসিল; সুনীল বিশাল নেত্রদ্বয় হইতে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু পড়িল। যুবতী আর স্থির থাকিতে পারিলেন না, কাঁদিয়া ফেলিলেন। তখন তাঁহাকে দেখিলে বোধ হইবে, কত যে অন্তর্দাহনে কমলার হৃদয় ব্যথিত- অতীত স্মৃতি আসিয়া হৃদয়ের গূঢ়তম প্রদেশে প্রবেশ করিল, জ্বালা বাড়িল। শান্তি— শান্তি ত নাই, তবে কি না সৰ্ব্বশক্তিমান ভগবান ভিন্ন কেউ বলিতে পারে না।
বাষ্পদদস্বরে কমলা আবার বলিতে লাগিলেন, —“দেখ শঙ্কর! আমার পিতার আমিই একমাত্র সন্তান, তিনিও অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিকারী ছিলেন, তাঁহার সমস্ত ধন আমি প্রাপ্ত হইয়াছি। আমার ধনের ইয়ত্তা নাই, লোকে যে আমাকে রাণী বলে, তা অনেক রাজা অপেক্ষা আমার ঐশ্বর্য্য বেশী, এমন কি—” আর বলিতে পারিলেন না।
শঙ্করদাস এতক্ষণ পর্য্যন্ত নিৰ্ব্বাতনিষ্কম্প প্রদীপের ন্যায় দাঁড়াইয়া কমলার কথাগুলি শুনিতেছিল, হঠাৎ চটকা ভাঙ্গা মত হইয়া বলিল, “গত বিষয়ের উল্লেখ করিয়া আর দুঃখ প্রকাশ করিবার প্রয়োজন নাই। তবে বলিবার এইটুকু আছে যে, এত সঙ্গতির অধিকারিণী হইয়া একটা হাঘুরে সন্ন্যাসীকে ভয়?”
কমলা বলিলেন, “ও কথা ত তোমাকে পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, এখনকার সে সময় নয়, আমাকে নিরাপদ কর,
তখন–।”
শ। নিরাপদ— নিরাপদ! তাহাকে অদ্যই জন্মের মত পৃথিবী হইতে বিতাড়িত করিব।
রা। তাই হ’লেই হ’ল— যে দিন তুমি তার মৃতদেহ দেখাইতে পারিবে, সেই দিন তৎক্ষণাৎ তোমার সহিত—
.
আর ভাল কথা, তুমি তাহাকে চিনিতে পারিবে? আজ সে ছদ্মবেশে সন্ন্যাসীর রূপ ধারণ করিয়া আমাদের এখানে আসিয়াছিল, তোমার পক্ষে তাহাকে চেনা বড়ই কঠিন হইবে। আমি বলি শুন, অমরচাঁদ ঐরূপ ছদ্মবেশে প্রায়ই এখানে সেখানে বেড়ায়, দেখো, খুব সাবধানে উহার সঙ্গ লইও, যেন হিতে বিপরীত না হয়।
শ। সে বিষয়ে কোন চিন্তা নাই, যাহাকে একবার দেখিব, তাহাকে কি আর এ জন্মে ভুলিব!
“তবে শঙ্কর, তুমি যাও, শয়ন কর গে, রাত্রি ঢের হইয়াছে, আমিও যাই। দেখো, যত শীঘ্র পার, এই কার্য্য সম্পন্ন করো” এই বলিয়া কমলা শয়ন প্রকোষ্ঠে চলিয়া গেলেন। শঙ্করও নিজ কক্ষে শয়ন করিতে চলিয়া গেল। আমিও সুযোগমত ঐ বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া আসিলাম।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চৈত্রমাস- রৌদ্রের দিকে চায় কার সাধ্য, তায় পশ্চিমাঞ্চল পাথুরে গরমি, বেলা দ্বিপ্রহর। মাঝে মাঝে লু বহিতেছে। পথে লোকের চলাচল প্রায় বন্ধ, তবে যাদের না গেলে নয়, তারাই প্রচণ্ড মার্তণ্ডদেবকে উপেক্ষা করিয়া চলিয়া যাইতেছে। আমি ও সেই সন্ন্যাসী আমাদের কার্য্যোপলক্ষে বাহির হইয়াছি। এখন সন্ন্যাসী তাঁহার সন্ন্যাস-বেশ পরিত্যাগ করিয়াছেন। সেই দিবসই আমি জানিতে পারিলাম, সন্ন্যাসী প্রকৃত সন্ন্যাসী নহেন, সময় সময় সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করেন, কখন কখন অপর বেশও ধারণ করিয়া থাকেন। ডিটেকটিভ কর্ম্মচারীর ন্যায় ইনিও বেশ-পরিবর্তনে একজন সিদ্ধহস্ত। এমন সময় একটি লোক কাশীর শিকরোলের দিক হইতে ঘর্মাক্ত কলেবরে পূতসলিলা জাহ্নবীর তীর দিয়া কি যেন প্রনষ্ট বস্তু খুঁজিতে খুঁজিতে এদিক-ওদিক চারিদিক চাহিতে চাহিতে ক্রমশঃ মণিকর্ণিকার ঘাট সমীপে উপস্থিত হইল। পথিকবর, যেখানে পরমহংস বাবাজী থাকে, তাহার অনতিদূরে একটি ঘরের বারাণ্ডায় উপবেশন করিয়া আপনা আপনি বলিতে লাগিল, “ভোর থেকে দুপুর পর্য্যন্ত কাশীর সর্ব্বস্থান অন্বেষণ করিলাম, বেটাকে কোথায় দেখলাম না; কিন্তু আর ত পারি না, রোদ্দুরে রোদ্দুরে ঘুরে ঘুরে মাথার ঘাম পায়ে পড়ছে। চলা ভার, কাল আবার তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখবো, দেখি, দেখতে পাই কি না? পথিক দেবমন্দিরের সুশীতল ছায়ায় বিশ্রাম করিতে লাগিল। পাঠককে পথিকের বিষয় বোধ হয় বিশেষ পরিচয় দিতে হইবে না, ইনিই আমাদের শঙ্করদাস, অমরচাদকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছে।”
পথিক অন্যমনস্কভাবে বসিয়া আছে, আমরাও ঘুরিতে ঘুরিতে সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। আমার সঙ্গী তাহার পশ্চাদ্ভাগ হইতে কহিলেন,- “কেও! শঙ্করদাস নাকি? এত রোদ্দুরে কোথায়?”
শঙ্কর চমকিয়া উঠিয়া পশ্চাৎভাগে চাহিয়া দেখে, একটি সুন্দর যুবাপুরুষ তাহার দিকে অগ্রসর হইতেছে। যুবককে দেখিলে বিশেষ ভদ্রলোক বলিয়া প্রতীতি হয়। বয়স শঙ্কর অপেক্ষা এক আধ বৎসরের কমই হউক, আর সামান্য বেশীই হউক, যুবককে দেখিতে অতি সুন্দর, বলিষ্ঠ ও দৃঢ়কায়। অপরিচিত যুবক শঙ্করের নিকট আসিয়া বলিলেন, “শঙ্কর দাস, মেয়ে-মানুষের কথায় রোদ্দুরে ঘুরে ঘুরে মর কেন? যাহার জন্য না খেয়ে দেয়ে, সকাল হতে বেলা দ্বিপ্রহর পর্য্যন্ত এই প্রচণ্ড রৌদ্রে ঘুরিয়া বেড়াইতেছ, তাহার সন্ধান আমি বলিয়া দিতে পারি।”
শঙ্করের এত বেলা পৰ্য্যন্ত খাওয়া হয় নাই, তার উপর পথশ্রম, পথশ্ৰম ব’লে পথশ্রম! বারাণসীর এমন গলি খুঁজি নাই— গুপ্তস্থান নাই বা প্রকাশ্য রাজপথ নাই, যেখানে তন্ন তন্ন না করিয়া শঙ্করদাস অমরচাঁদের জন্য খুঁজিয়াছে। সুতরাং এ সময় ভাল কথাটাও মন্দ লাগে, তায় এই অপরিচিতের মেয়েমানুষ-সংযুক্ত ঠাট্টা বিদ্রূপের কথা শুনিয়া শঙ্করের মান্ধাতার আমলের পিত্ত পর্যন্ত চটিয়া উঠিল। শঙ্কর রোষভরে বলিয়া উঠিল,—“বেটা কি নিরেট, কেমন ক’রে ভদ্রলোকের সহিত কথা কহিতে হয়, জানে না। বিশ্বেশ্বরের এই সব বেওয়ারিস মালগুলোকে যদি দুই এক ঘা আক্কেল সেলামি দেওয়া যায়, তবে বেটারা ভদ্রলোকের সঙ্গে কেমন করিয়া কথা কহিতে হয়, শিখিতে পারে।”
আমার সঙ্গী কহিলেন, “আমি অভদ্র – না তুমি অভদ্র। তুমি টাকা খেয়ে একটি লোকের বহুমূল্য জীবন নাশ করিতে উদ্যত হইয়াছ, ইহাতে মূর্খ তুমি হইলে, না— হইলাম
আমি। বাহাদুরি আছে তোমার বুদ্ধির! তোমার কাছ থেকে এ রকম বুদ্ধির দৌড় একটু ধার করে নিলে হয়?”
বীরবর শঙ্করের এ ব্যঙ্গোক্তি সহ্য হইল না। সে উঠিয়া “পাজি! যা মুখে আসে তাই বলিস্, জানিসনে আমি কে?” এই বলিয়া যুবকের মাথায় সজোরে এক চপেটাঘাত করিল। যুবক কিছুমাত্র অসন্তোষ বা বিরক্তির ভাব প্রকাশ করিলেন না, কিছুমাত্র ক্রোধিত বা উত্তেজিত না হইয়া বরং হাস্য সহকারে কহিলেন,— “বেশ! বেশ! এইবার সন্তুষ্ট হইয়াছ ত— কাহাকে মারিয়াছ এখন বুঝিতে পারিলে? যার মস্তকের জন্য ৫০০ টাকা খেয়েছ, আমি সেই বদমায়েস অমরচাঁদ।”
“তুমি—তু–মি–আ–পনি অমরচাঁদ— যাহাকে ডিটেকটিভ পুলিসের কর্ম্মচারী বলিয়া সকলে সন্দেহ করে— আপনি সেই অমর চাঁদ!!” অমরচাঁদকে দেখিয়া শঙ্করের তেজ লোপ পাইল, শরীরের উষ্ণ শোণিত শীতল হইয়া গেল;–শঙ্কর স্থাণুবৎ।
যুবক কহিলেন, “কি হে বীরবর! চুপ করলে যে, মুখে কথা নাই কেন? অমরচাদের মাথা কাটতে বেরিয়েছ— এস্ আর দেরী কেন, টপ্ করে কেটে ফেল? তোমার কাছে মারধোর ত খেলুম, অপমানটাও খুব কল্পে, জীবনে আমার আর সাধ নাই, তোমার হাতে মরণই মঙ্গল!!”
অমরচাঁদের কথা শুনিয়া শঙ্কর অতিশয় লজ্জিত হইল। তখন অমরচাঁদ কহিলেন, “তোমার সহিত আমার অনেক কথা আছে, কোন নিৰ্জ্জন স্থানে তোমার সহিত সাক্ষাৎ হইলে সকল কথা হইবে, সেই সময় ইচ্ছা করিলে আমাকে হত্যা করিয়া তোমার মনিবের মনস্কামনাও পূর্ণ করিতে পারিবে।”
শঙ্কর এই প্রস্তাবে সম্মত হইল। পরদিবস রাত্রি ১১টার সময় বরুণার ধারে একটি ভগ্ন অট্টালিকায় উভয়ের নির্জ্জন সাক্ষাতের স্থান নির্দ্দিষ্ট হইল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
আজ কৃষ্ণপক্ষীয় চতুৰ্দ্দশী টিপ্ টিপ্ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে, রাত্রি এক প্রহর প্রায় অতীত ঘোর অন্ধকার, কোলের মানুষ দেখা যায় না। সৌদামিনী মেঘের কোলে বাসন্তী হিল্লোলে ক্ষণে ক্ষণে হাসিতেছেন, মুচকি হাসিয়া ব্রীড়াবনত আননে আবার একবার মুখ লুকাইতেছেন, যেন আর ও মুখ এ অন্ধকারে কাহাকেও দেখাইবেন না। প্রতিজ্ঞা রহিল না, মুখ দেখাইতে হইল। আবার হাসিলেন — আবার মুখ লুকাইলেন; নীরদবরের এ আবদার, এত বেয়াদবি সহ্য হইল না, তিনি হৃদয়ের জ্বালা হৃদয়ে মিটাইয়া ফেলিলেন, কেন না, স্ত্রী সৌদামিনী বড় চপলা, ক্রোধভরে নিজের মনে ঘোরতর চীৎকার করিয়া উঠিলেন, চীৎকারে সমগ্র জগৎ নিস্তব্ধ— স্পন্দহীন— স্তম্ভিত। ধন্য সৌদামিনি! তুমিও যে স্বামীর সহিত যোগ দিয়াছ। বুঝেছি, শক্তি ভিন্ন শক্তি হয় না, কিন্তু জগৎ যে আর ও ভ্রুকুটি সহ্য করিতে পারে না— ও হাসিতে জগৎ মুগ্ধ হইল। কি অন্ধকার! এমন অন্ধকার ত কখন দেখি নাই, ভয়ানক দুর্যোগ- রাস্তায় জনপ্রাণীর সাড়াশব্দ নাই যে যার আড্ডা নিয়েছে— কারই বা এত দরকার যে, এ দুর্যোগে বাটীর বাহির হইবে, তবে যে যেমন লোক, সে সেই কার্য্যে প্রবৃত্ত।
এমন সময় আমাদের শঙ্করদাস নিজের শয়ন-প্রকোষ্ঠে বসিয়া ভাবিতেছিল— “সময় হ’ল, যাই, দুৰ্য্যোগ বলিয়া প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন করিতে পারি না, দুইখানি ছুরিকা লইয়াই যাই বাঁচি ত ফিরে আসবো, না হয় এই পৰ্য্যন্ত।” এই বলিয়া শঙ্কর গৃহ হইতে সদর রাস্তায় বাহির হইল, বাহির হইয়া বরাবর বরুণা নদীর সমীপ সেই ভগ্ন অট্টালিকা অভিমুখে ধীরে ধীরে এই ভয়ঙ্কর সময়ে অগ্রসর হইতে লাগিল। পথে লোকজনের চলাচল বন্ধ। খুব তফাৎ তফাৎ মিউনিসিপ্যালিটীর আলোক-স্তম্ভ দণ্ডায়মান, দুগ্গো প্রদীপের মত কোনটি মিট্মিট্ করিয়া জ্বলিতেছে, কোনটি বা একেবারে নির্ব্বাণ। এমন সময় অনতিদূরে সেই অন্ধকার ভেদ করিয়া “বাবারে, গেলুম রে, রক্ষা কর!” এই করুণ শব্দ শঙ্করের শ্রুতিগোচর হইল।
শঙ্করকে হস্তগত করিবার জন্য আমরা এক জাল পাতিয়া রাখিয়াছিলাম, দেখিতে দেখিতে শঙ্কর আসিয়া সেই জালে পতিত হইল।
চীৎকার শুনিয়া শঙ্করের বোধ হইল, অত্যাচার-নিপীড়িত কোন স্ত্রীলোকের আর্দ্রধ্বনি। “অবলার উপর অত্যাচার!” এই বলিয়া শীঘ্রগতি অন্ধকারে সেই স্বর লক্ষ্য করিয়া সেইদিকে চলিয়া গেল। গিয়া দেখে, যাহা ভাবিয়াছিল, তাহাই; একটি যমদূত সদৃশ পুরুষমূর্ত্তি রাস্তার উপর একটি স্ত্রীলোকের হাত ধরিয়া সজোরে টানিয়া লইয়া যাইতেছে, নিকটে একখানি ২য় শ্রেণীর গাড়ী দণ্ডায়মান। শঙ্করকে নিকটে আসিতে দেখিয়া দুর্বৃত্ত রমণীকে ছাড়িয়া দিয়া অন্ধকারে কোথায় মিশিয়া গেল। শঙ্কর রমণীর নিকটে গিয়া বলিল, “আপনার আর ভয় নাই, সে পাষণ্ড আমাকে দেখিয়াই পলাইয়াছে।”
রমণী কহিল, “আমার জীবনদাতার নিকট আমি চিরকালের মত ঋণী রহিলাম।”
শঙ্কর কহিল, “বলুন, আপনার আর কি উপকার আমার দ্বারা হইতে পারে?”
রমণী। পাযণ্ড নরাধম চলিয়া গিয়াছে ত?
শঙ্কর। হাঁ, সে জন্য আর ভয় নাই।
র। অনুগ্রহ করিয়া যদি বাটী রাখিয়া আসেন।
শ। চলুন— পথ যতই কেন বিপদসঙ্কুল হউক না, আপনাকে নিরাপদে বাটী পঁহুছিয়া দিব।
র। আপনি অপরিচিত—আপনার সঙ্গে
শ। অপরিচিত বটে, কিন্তু যে ভদ্রলোক কোন নিরাশ্রয় ব্যক্তিকে বিপদ হইতে উদ্ধার করে, সে কি তাহাকেই আবার বিপদে ফেলিতে পারে?
রমণী বিশেষ লজ্জিতা হইয়া কহিল, “তবে দেখুন দেখি, গাড়োয়ান আছে না পলাইয়াছে?” শঙ্কর গাড়ীর নিকট গিয়া দেখে, চালকপ্রবর মড়ার মত গাড়ীর নীচে একখানি কম্বলে সমস্ত শরীর আবৃত করিয়া পড়িয়া আছে। শঙ্করের ডাকাডাকিতে শকটচালক ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে গাড়ীর নিম্ন হইতে বাহির হইল। রমণী ও শঙ্কর গাড়ীর ভিতর বসিল, চালক গাড়ী হাঁকাইয়া দিল। “এই ভয়ঙ্কর রজনীতে রাজপথে এ রমণী কে? ব্যাপার কি?” এই সমস্ত চিন্তাতে শঙ্কর এতই অন্যমনস্ক ছিল যে, গাড়ী কোন্ পথ দিয়া কতদূর আসিল, ঠিক করিতে পারিল না। অবশেষে গাড়ী আসিয়া একটি প্রকাণ্ড অট্টালিকার সদর দরজায় দাঁড়াইল। রমণী অমনি বলিয়া উঠিল, “আঃ! এইবার হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচলাম, আমরা বাড়ী এসেছি।” সেই অপরিচিতা রমণী ও শঙ্কর গাড়ী হইতে অবতরণ করিল। রমণী কহিল, “মহাশয়, আপনি আমার জীবনদান করিয়াছেন, এক্ষণে দয়া করিয়া আমাদের বাটীতে নিশাযাপন করিলে বড়ই সুখী হই।” শঙ্কর রমণীর কথায় দ্বিরুক্তি করিল না—- উভয়ে বাটীর মধ্যে প্রবেশ করিল।
সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিতে উঠিতে শঙ্কর রমণীকে জিজ্ঞাসা করিল,
“এই আপনার বাড়ী?”
র। আপাততঃ আমি এখানে বাস করি বটে।
শ। এটি বহুকালের পুরাতন বাটী বলিয়া বোধ হয়।
র। এরপর আপনাকে সমস্ত দেখাইব— এখন চলুন, উপরে বসিবেন।
উভয়ে সে দ্বিতল হর্ম্মের এক বৈঠকখানায় আসিল, ঘরে আলো জ্বলিতেছে, রমণী কহিল, “বোধ হয়, সকলেই ঘুমাইয়াছে, আপনি এইস্থানে বসুন, আমি ভৃত্যগণকে ডাকিয়া দিই।”
উজ্জ্বল আলোকে রমণীকে উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করিয়া শঙ্করদাস কহিল, “সুন্দরি! বড়ই আশ্চর্য্যের বিষয় যে, এত বড় বাড়ী। কিন্তু লোকজন নাই। সন্দেহ হচ্ছে। এর ভিতর কোন অভিসন্ধি নাই ত?”
র। অবলা স্ত্রীজাতির নিকট ভয় পাচ্ছেন না কি?
শ। স্ত্রীলোক দূরে থাকুক— কোন বীরপুরুষকেও আমি ভয় করি না।
“তবে নিশ্চিন্তমনে বিশ্রাম করুন” এই বলিয়া রমণী অন্য একটি দরজা দিয়া অন্দরমহলে চলিয়া গেল।”
প্রায় পনের মিনিট অতীত হয়, রমণীর আর দেখা নাই। শঙ্কর অস্থির হইয়া উঠিল— ভাবিতে লাগিল, রমণী কে? ইহার ভিতর নিশ্চয়ই কোন ষড়যন্ত্র আছে। আরও দশমিনিট অতিবাহিত হইল, শঙ্করের সন্দেহ বাড়িল, সে যে দরজা দিয়া বৈঠকখানায় প্রবেশ করিয়াছিল, সেই দরজার কাছে গিয়া দরজা খুলিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু হরি হরি! যাহা ভাবিয়াছিল, তাহাই হইল— দরজা বাহির হইতে বন্ধ।
শঙ্কর হতবুদ্ধি হইয়া একখানি চেয়ারের উপর বসিয়া পড়িল। তাহার নিকট যে দুইখানি অস্ত্র ছিল, হাত দিয়া দেখে, তাহা নাই। অন্ধকারে যখন রমণীর সহিত গাড়ীতে আসিতেছিল, তখনই কৌশলক্রমে সে দুইখানি রমণী দ্বারা অন্তর্হিত হইয়াছে, ইহা বেশ বুঝিতে পারিল। এখন আর উপায় নাই, অদৃষ্টে যাহা আছে, তাহাই হইবে, এই বলিয়া মনকে প্রবোধ দিতে লাগিল। আর এক একবার চিন্তা করিতে লাগিল— “এখন কৰ্ত্তব্য কি, কি উপায় করিলে এখান হইতে বাহির হইতে পারি?”
এমন সময় সহসা কপাট উন্মুক্ত হইল। “কি, শঙ্কর বাবু! ভাল আছ ত?” এই বলিয়া একটি ভদ্রলোক তাহার সম্মুখে উপস্থিত, সঙ্গে একজন লোক। শঙ্কর অন্যমনস্ক ছিল, চাহিয়া দেখিল, যাহা দেখিল, তাহাতে তাহার শরীরের রক্ত জল হইয়া গেল, প্রাণপাখী দেহপিঞ্জর ছাড়িবার উপক্রম করিল, তালু যেন শুকাইতে লাগিল— বোবার ন্যায় হইয়া গেল, মুখে কথা নাই। দেখিল, অমরচাদ ও তাঁহার সেই সঙ্গী অর্থাৎ আমি সেই স্থানে দণ্ডায়মান। অমরচাঁদ আসিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন, –“পালাবার চেষ্টা করছিলেন নাকি?”
শঙ্কর। বুঝিলাম— এ যড়যন্ত্র আপনারই।
অমর। আপনি কি ইহাকে চাতুরী বলেন?
শ। চাতুরী ছাড়া আর কি বলিব?
‘অ। হয় হ’ল। বল্ছি কি, এইবেলা আত্মীয়স্বজনকে একবার স্মরণ করলে হত না?
শ। হত্যা করবে নাকি?
অ। না—না, তা নয়; তবে কি জান, আত্মীয়-স্বজনের মায়া।
শ। যদি আমাকে এ প্রকারে খুনই করবে, তবে আমার অস্ত্রাদি অপহরণ করলে কেন?
অ। তোমার মঙ্গলের জন্য।
শঙ্কর ঘৃণার হাসি হাসিয়া বলিল, “মঙ্গলের জন্যই বটে! তাই আগে থেকে আমাকে নিরস্ত্র করা হয়েছে!”
অ। বুঝিয়ে বলছি— বাঁচাবার জন্যই তোমাকে নিরস্ত্র করা হয়েছে।
শ। চাতুরী করিয়া আপনিই আমাকে এখানে লইয়া আসিয়াছেন?
অ। আনিয়াছি, তোমার জীবনরক্ষা করিবার জন্য!
শ। শত্রু কি কখন শত্রুর জীবনরক্ষার জন্য ব্যাকুল হয়?
অ। আমরা উভয়ে শত্রু নয়।
শ। তবে কি?
অ। থাক্, –তুমি আমাকে কাল বড় অপমান করেছিলে, তার কারণ কি?
শ। কারণ বলিতে বাধ্য নহি।
অ। আচ্ছা, তুমি না বল, আমি বলছি। রমণীর মোহ, আর পাঁচ হাজার টাকা। কেমন, ঠিক বলছি কি না? এই কথা শুনিয়া শঙ্কর চমকিয়া উঠিল, মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিল, “এ ব্যক্তি ওসব কথা কোথা হইতে শুনিল, বড়ই আশ্চৰ্য্য! আমরা দুজনে বই আর কোন প্রাণীই ত এসব কথাবার্তার বিন্দুবিসর্গও জানে না। অমরচাঁদ কেমন করিয়া এই গূঢ়রহস্যের সন্ধান রাখিল, কি ভয়ানক লোক!”
তা। ভাবছো কি, কেমন ক’রে জানতে পাল্লেম? সে অনেক কথা।
শ। ভিতরের কথা তবে আপনি সকলি টের পাইয়াছেন— আপনি বলিলেন, আমাকে বাঁচাবার জন্য তোমার নিরস্ত্র করিয়াছি, এখন অনুগ্রহ করিয়া বিদায় দিন, আমি চলিয়া যাই।
অ। একটু স্থির হও—আমায় বড় অপমান ক’রেছ? আমাদের ত কথা ছিল, আজ রাত্রিতে তুমি আমাকে ইচ্ছা করিলে হত্যা করিবে। তা বরুণা নদীর সেই ভগ্ন অট্টালিকায় না হইয়া— এইখানেই হইল, তাতে ক্ষতি কি?
শ। আমি নিরস্ত্র।
অ। তোমার অস্ত্র দুইখানি আনিয়া দিতেছি।
আমি একাকী।
শ। আপনারা দুই জন –
“দ্বিতীয় ব্যক্তি কেহই থাকিবে না।” এই বলিয়া অমরচাঁদ শঙ্করের ছুরিকা দুইখানি লইয়া আসিলেন।
শঙ্কর দেখিল, তাহার নিজের ছুরিকা বটে।
পুনরায় অমরচাঁদ কহিলেন, “দেখ শঙ্কর, তোমার সহিত আমার বিবাদ করিবার কোন প্রয়োজন নাই। তুমি যে আমাকে হত্যা করিবে সংকল্প করিয়াছিলে, তাহা ত হইল না— এখন তুমি আমার আয়ত্তের মধ্যে, তোমাকে আসামীরূপে পুলিসে চালান দিতে পারি, কিন্তু তাহা করিব না— তোমার গায়ে একটি আঁচড়ও লাগিবে না। তুমি যাহাতে কমলা রাক্ষসীর কবল হইতে উদ্ধার পাও, তাহার চেষ্টা করিব তোমাকে বাঁচাইব।”
শ। আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না— প্রহেলিকার ন্যায় বোধ হইতেছে।
অ। আমরা দুজনে যাহাতে এক সঙ্গে মরি, সেই কৌশল করিয়া রাক্ষসী তোমাকে পাঠাইয়াছে।
শ। কিছুই বুঝিলাম না।
“সময়ে বুঝিবে।” এই বলিয়া অমরচাদ ভৃত্যকে বলিলেন, “দুটো ইঁদুর নিয়ে আয় ত?”
অনতিবিলম্বে পিঞ্জরাবদ্ধ ইঁদুরদ্বয় আনীত হইল।
অমরচাঁদ কহিলেন, “শঙ্কর, এই লও তোমার ছুরিকা। একটা ইঁদুরের গায় ছুরিকার একটু আল ফুটাইয়া দাও, এমন করিয়া ফুটাইয়া দিবে, যেন অল্প রক্ত বাহির হয়।
শঙ্কর তাহাই করিল। ছুরিকার খোঁচায় ইন্দুরের গাত্র হইতে যেমন রক্ত বাহির হইল, অমনি মুখ দিয়া গল গল করিয়া লাল পড়িতে লাগিল, ইঁদুরটি যাতনায় ছট্ ফট্ করিতে করিতে নিমেষের মধ্যে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল।
অমরচাঁদ কহিলেন, “দেখিলে শঙ্কর! ও ছুরিকাখানিও পরীক্ষা কর।”
শঙ্করদাস ঐরূপ করিলে পূর্ব্ববৎ এ ইঁদুরটাও তৎক্ষণাৎ প্রাণত্যাগ করিল।
তখন শঙ্করদাস অমরচাঁদের পদতলে পতিত হইয়া বলিতে লাগিল,—“ক্ষমা করুন, আমি পিশাচ- আপনি দেবতা—- ক্ষমা করুন। না, এ অধমকে ক্ষমা করিতে নাই! আমি কালভুজঙ্গিনীর কথায় ভুলিয়াছি।”
অ। এখন বুঝিতে পারিয়াছ কি?
শ। আমাকে বুঝাইয়া দিউন—আমি এখনও এ গূঢ় রহস্যের মম্মোদঘাটন করিতে পারি নাই।
অ। ছুরিকা দুইখানি বিষাক্ত— কমলারাণী এই দুইখানি আমাদের দুজনকে একসঙ্গে নিপাত করিবার জন্যই তোমাকে দিয়াছিল।— যদি আমরা এই অস্ত্রদ্বয় চালনা করিতাম, উভয়ের অঙ্গই ক্ষত বিক্ষত হইত, তাহা হইলেই নিমেষ মধ্যে ঐ দুইটি মুষিকের মত প্রাণ হারাইতাম, কমলা নিরাপদ হইত।
শ! আপনাকে হত্যা করিবার কমলার উদ্দেশ্য কি?
অ। কমলার আমি যম—- আমি বাঁচিয়া থাকিতে কমলার জীবনে এক দণ্ড সুখ নাই— তাই কমলা আমাকে যে প্রকারে হউক খুন করিতে উদ্যত। তুমি তাহাকে ভালবাস- আর সেও তোমাকে বিবাহ করিবে বলিয়াছে, আমাকে খুন করিতে পারিলেই তৎক্ষণাৎ সেই দণ্ডেই— তাহা আমি জানি, কিন্তু তাহা হইত না— হইবেও না। যদি তুমি অমরচাদকে খুন করিতে সমর্থ হইতে, তা হইলে দেখিতে পাইতে— তোমার কি লাঞ্ছনা হইত, তোমার অমৃতে গরল উঠিত- কমলা তোমার শত্রু হইত।
শ। আমি আর সেখানে যাইব না— আমার জ্ঞান হইয়াছে, করে কি করিয়া বিষ খাওয়াইয়া মারিয়া ফেলিবে। বুঝিলাম, স্ত্রীজাতির অসাধ্য কাৰ্য্য এ জগতে কিছুই নাই।
অমরচাঁদ পুনরায় কহিলেন, “আর কোন ভয় নাই, আজ হইতে তুমি আমার পরম মিত্র— আমার সহায়, তোমার বিপদে আমার বিপদ, টাকা কড়ি তোমার যখন যাহা দরকার হইবে— আমি দিব— সে বিষয় ভাবিও না। আমার নিকট আপাততঃ থাকা হইবে না— তোমাকে কমলার নিকট থাকিতে হইবে, নহিলে আমার কার্য্যসিদ্ধি বিষয়ে ব্যাঘাত ঘটিবে।”
শঙ্কর জিজ্ঞাসা করিল, “কি কার্য্য?”
অ। তুমি সহায় না হইলে আমরা কমলাকে গ্রেফতার করিতে পারিব না।
শ। গ্রেফতার! কমলা কি করিয়াছে?
অ। কমলা পতিঘাতিনী— রাক্ষসী, স্বামীকে খুন করিয়া দেশ হইতে পবিত্র কাশীধামে পলাইয়া রহিয়াছে, কিন্তু আমাদিগের চোখে ধূলা দেওয়া বড় কঠিন- আমারও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিয়াছি। এতদিন কবে আমরা পিশাচীকে রাজদ্বারে উপস্থিত করিতাম, কিন্তু করি নাই, মাগী বড় ধড়িবাজ, আমাদিগের উপরও চাল চালে, আমাদের চর সর্ব্বত্র তা জানে না।
শ। গ্রেফতার কল্পেই ত পারেন?
অ। এখন নয়, উহার জীবনের ঘটনাবলি জানিতে আরও বাকী আছে, কিন্তু উহার জীবনের উপর যাহাতে কোনরূপ আঘাত না হয়, তাহারও চেষ্টা করিব। কেন না, পাপের অনুতাপে ভবিষ্যতে স্বভাবের অনেক পরিবর্তন হইতে পারে।
শ। স্বামীঘাতিনীকে দয়া প্রকাশ অনুচিত।
অ। তাহার কিছু বিশেষ প্রমাণ অদ্যাপি পাই নাই, সেইজন্য তোমাকে বাঁচাইলাম, তোমার দ্বারা আমার কার্য্য সমাধা হইবে।
শঙ্কর বলিল, “এত বড় ধনশালিনী স্ত্রীলোক কখন দেখি নাই?”
অ। কমলা নিজের ধনে ধনী 1
শ। তবে কমলার জীবনী সম্বন্ধে আপনি সমস্ত জানেন?
অ। গোপনে অনুসন্ধান রাখাই আমাদের প্রধান কাজ।
শ। কমলা কে আমায় বলুন?
অমরচাঁদ একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন, “আমি বলিতে পারি কিন্তু আমার কথায় বাধ্য হইয়া চলিতে হইবে, যখন যেরূপ বলিব, তাহা সম্পন্ন করিতে হইবে, ইহাতে যদি সম্মত হও, তবে বলি।”
শ। আমি আপনার দাস যখন যাহা বলিবেন, অকপটে তাহা সম্পন্ন করিব, যাহাতে মাগী জব্দ হয়, তাহাই করিব।
অমরচাঁদ একটু হাসিয়া কহিলেন, “তবে যদি নিতান্তই শুনিবার ইচ্ছা হইয়া থাকে, তবে দুই এক দিবস অপেক্ষা কর, সমস্তই তোমাকে বলিব। এখন আমরা যেরূপ উপদেশ দিব, সেইরূপ কার্য্য কর। এখন তুমি কমলার নিকট গিয়া বল, অমরচাদ আর নাই, জন্মের মত তাহাকে পৃথিবী ছাড়া করিয়াছি। যদি আমার মৃতদেহ দেখিতে চায়, তুমি স্বচ্ছন্দে সেই বরুণার ভগ্ন অট্টালিকায় লইয়া যাইবে— আমি মৃতের ন্যায় পড়িয়া থাকিব— জীবিত কি মৃত, কমলা কিছুই বুঝিতে পারিবে না- পরে যা করিতে হইবে বলিয়া দিব।” এই বলিয়া অমরচাঁদ শঙ্করদাসকে সদর রাস্তায় তুলিয়া দিলেন। শঙ্করদাস চলিয়া গেল, অমরচাদও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গুপ্তভাবে গমন করিতে লাগিলেন।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
রাত্রি দুইটা বাজিয়াছে। এখনও টিপ্ টিপ্ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে। শঙ্করদাস হন্তো দুত্তো হইয়া একেবারে কমলার ঘরে গিয়া উপস্থিত, অমরচাঁদ গুপ্তভাবে পার্শ্বের ঘরে লুকাইয়া রহিলেন। শঙ্করকে দেখিয়াই কমলা জিজ্ঞাসা করিলেন,
“কাজ শেষ হ’য়েছে?”
গম্ভীরস্বরে শঙ্কর উত্তর করিল, “আমি খুনী!”
কমলা। নিকেশ করেছো?
শ। আমি হত্যাকারী!
ক। স্পষ্ট করিয়া বল, মরেছে কি না?
শ। ওঃ! মনে করলে এখনও গা শিউরে ওঠে— কমলা! আমি কল্লুম কি! প্রতারণা পূর্ব্বক একজনের জীবন নাশ কল্লেম, বিষমাখান ছোরা! উঃ! আর বলতে পারি না।
ক। একেবারে কি দ্বিখণ্ড করেছ?
শ। না; বাহুমূলে অল্পমাত্র আঘাত করিবামাত্র অমরচাঁদ বসিয়া পড়িল—পরক্ষণেই চিরকালের মত ঘুমাইয়া পড়িল।
ক। সেখানে আর কেউ ছিল?
শ! কেহই না।
ক। ধড়টা সেখানেই পড়িয়া আছে?
শ। হাঁ।
ক। আমি দেখবো চল।
শ। তোমাকে আমি সেখানে নে যেতে পারবো না। ক। এখুনি যেতে হ’বে
শ। আমি তোমার দাস, চল— মৃতদেহ দে খাইগে।
তৎক্ষণাৎ গাড়ী তৈয়ারী হইল, এদিকে অমরচাঁদ সেই ঘর হইতে বাহির হইয়া অপর একখানি গাড়ীতে আরোহণ করিয়া চলিয়া গেলেন। রাত্রি আন্দাজ তিনটার সময় শঙ্কর ও কমলা সেই ভয়ঙ্কর রাত্রিতে বরুণা নদীর ধারে সেই ভগ্ন অট্টালিকায় উপস্থিত। বাড়ীটা যেন খাঁ খাঁ করছে, জনমানবের সাড়া নাই, যেন যমপুরী— অন্ধকারে পূর্ণ। শঙ্কর সেই অন্ধকারে কমলাকে রাখিয়া কোথায় চলিয়া গেল, মুহূৰ্ত্তমধ্যে কাঁপিতে কাঁপিতে ফিরিয়া আসিয়া কহিল,—“আসুন না।” নীচেকার একটি ঘরে কমলাকে লইয়া গেল, তথায় অর্দ্ধস্তিমিত একটি আলো, সেই আলোকে কমলা যাহা দেখিলেন, অন্য কেহ হইলে মূৰ্চ্ছা যাইত। কমলা দেখিলেন, অমরচাঁদের দেহ পড়িয়া রহিয়াছে। কমলা মৃতদেহকে ভাল করিয়া দেখিতে লাগিলেন, একবার মৃতের কপালে হাত দিলেন, বক্ষঃস্থল পরীক্ষা করিলেন, শেষে বলিলেন,–“কোথায় আঘাত করেছ?”
শঙ্কর বাহুমূল দেখাইয়া দিল— তথা হইতে রক্তধারা এখনও পর্যন্ত বাহির হইতেছে।
“বেশ হ’য়েছে—আমি তোমার উপর বড়ই সন্তুষ্ট হ’লেম, চল, আমরা এখন যাই।” এই বলিয়া উভয়ে গাড়ীতে উঠিয়া বাড়ী চলিয়া গেল।
অমরচাদও উঠিয়া তাহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিয়া পুনরায় সেই বাড়ীর ভিতর অলক্ষ্যে প্রবেশ করিলেন। বাড়ীতে গিয়া কমলা শঙ্করকে বলিলেন, “কাল সকাল সকাল আমার সঙ্গে দেখা করবে?”
শ। কোথায়?
ক। এইখানে আর কোথায়।
শ। মনে আছে যা ব’লেছিলে?
ক। কাল তাহার উত্তর পাবে।
শঙ্কর নিজের প্রকোষ্ঠে চলিয়া গেল, গিয়া দেখে, একটি ভদ্রলোক তাহার অপেক্ষায় বসিয়া আছে। শঙ্করকে দেখিয়া ভদ্রলোকটি আস্তে আস্তে কহিলেন, “আপনার নাম বোধ হয় শঙ্করদাস?”
শ। হাঁ, আমারই নাম শঙ্করদাস।
ভ। একটি সংবাদ আছে।
শ। আপনি কোথা হইতে আসিতেছেন?
ভ। আমাকে কি আপনি চিনিতে পারিতেছেন না?
শঙ্কর আলোতে উত্তমরূপে ভদ্রলোকটিকে দেখিয়া কহিল,—“না আপনাকে আমি কখন দেখি নাই।”
ভ। তথাপি আমি অপরিচিত নহি।
শ! আপনাকে দেখিয়াছি— কই— কখন মনে পড়ে না।
ভ। আপনি এতক্ষণ কমলার ঘরে ছিলেন?
শ। হ্যাঁ, ছিলাম।
ভ। কমলাকে অমরচাঁদের মৃতদেহ দেখাইয়াছেন।
এই কথা শুনিয়া—শঙ্কর হতবুদ্ধির ন্যায় হইয়া গেল, ভাবিল, এ সেই রাক্ষসী কমলার চাতুরী—সাহসে ভর করিয়া উত্তর করিল, –
“আপনার পরিচয় আগে না পাইলে আপনার কথার উত্তর দিব না।”
ভ। আমি আপনার বন্ধু।
শ। তবে কেন অযথা কথা বলিতেছেন?
ভ। আপনি অযথা কাজ করিলেন কি প্রকারে?
শ। কি অযথা কায?
ভ। অমরচাদকে খুন!
শ। কে বলিল, আমি খুন করিয়াছি?
ভ। আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম!
শ। মিথ্যা কথা!
অপরিচিত ভদ্রলোকটি একটু হাসিয়া নিজের কৃত্রিম দাড়ী, গোঁফ ও টুপি নিমেষ মধ্যে খুলিয়া ফেলিলেন, শঙ্কর দেখিল, অমরচাঁদ।
শ। উঃ, এতক্ষণ পরে হাঁপ ছেড়ে বাঁচ্ম— কি আশ্চর্য্য! আমি কিছুতেই আপনাকে চিনতে পারিনি! বেশ পরিবর্তনের আচ্ছা বাহাদুরী!
অ। এ আর কি আশ্চর্য! আর দশ মিনিট পরে যদি তোমার সঙ্গে দেখা করি, তাহ’লেও তুমি আমাকে চিনতে পার না। কমলা ঠিক মনে করেছে যে, আমি মরেছি, না- শঙ্কর?
শ। যেরূপ মড়ার মত পড়েছিলেন, তাতে বিশ্বাস হবে না ধন্য কৌশল।
“যাহা হউক, সংবাদটা জেনে গেলুম, কিন্তু খুব সাবধান, যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায় তা হলেই তুমি গেছো! কাল এক সময়ে দেখা হবে?” এই বলিয়া অমরচাঁদ প্রস্থান করিলেন।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
কমলার কথানুযায়ী শঙ্কর পরদিন প্রাতে কমলার সহিত দেখা করিল। শঙ্করকে দেখিবামাত্র কমলা ভয়বিহ্বল স্বরে বলিয়া উঠিলেন, –
“শঙ্কর! সর্ব্বনাশ হয়েছে— আমরা ধরা পড়েছি?”
শ। ধরা পড়িছি!–কি করিয়া?
ক। পুলিসের গুপ্তচর এসেছিল।
শ। তার পর।
ক। তার পর আর কি– আমাদের উপর সন্দেহ হয়েছে, আমাদের গ্রেফতার করবে!
শ। কোন ভয় নাই।
ক। অমরচাদের মৃতদেহ যদি বা’র করে?
শ। সে দেহ কি আর আছে, আমি রাত্রেই উহা জ্বালাইয়া দিয়াছি। এখন তোমার প্রতিজ্ঞা পূরণ হইলেই হয়।
ক। এ অবস্থায় কিছুতেই হ’তে পারে না–তুমি খুনী, তোমার কখন কি বিপদ হয় তা কে বলতে পারে? আর বিশেষতঃ, তোমার বিশ্বাস কি?
শঙ্কর কহিল, “তুমি জান, তোমার হাতে আমি নই— বরঞ্চ আমার হাতে তুমি। অমরচাঁদের জামার ভিতর একখানি কাগজ ছিল, তাহা আমি পাইয়াছি, তাহাতে তোমার বিষয়— তোমার জীবনের সমস্ত বিষয় বিবৃত আছে; মনে করিলে তোমাকে আমি এই মুহূর্তে পুলিসের হস্তে সমর্পণ করিতে পারি। তুমি স্বামীঘাতিনী, স্বামীকে হত্যা করিয়া বারাণসীতে পলাইয়া আসিয়াছ, তা হ’লে আমি খুনী না তুমি খুনী! কেমন, এখন রাজী আছ ত?”
কমলার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল, কমলা কম্পিত স্বরে কহিলেন,–“রাজী আছি, কিন্তু কাগজখানি আমায় আগে দাও।”
শ। আগে আমি দিতে পারি না।
ক। অমরচাদকে তুমি খুন করিয়াছ —সাবধান।
শ। পতিহত্যা কে করিয়াছে?
ক। তাহার প্রমাণ নাই-
শ। অমরচাঁদের এই কাগজ প্রমাণস্বরূপে দাঁড়াইবে।
ক। না দাও–একবার দেখাও–
শ। আমার কথায় রাজী না হইলে আমি কিছুতেই দেখাব না।
ক। না দেখাও না দেখাইবে। তুমি ভৃত্য হইয়া চন্দ্রে হস্ত প্রসারণ করিতে যাইতেছ। তুমি কি আমাকে কুলটা জ্ঞান করিয়াছ যে, আমি তোমার প্রস্তাবে সম্মত হইব? তোমাকে আমি যে আশ্বাসবাক্য প্রদান করিয়াছিলাম, সে কেবল আমার কার্য্য উদ্ধার করিতে। এখন আমার কাৰ্য্য শেষ হইয়াছে। তুমি ভৃত্য, ভৃত্যের কার্য্য করিয়াছ, এখন তোমাকে আমি আরও পাঁচশত টাকা প্রদান করিতেছি, লইয়া এই স্থান হইতে প্রস্থান কর।
কমলা যখন শঙ্করকে এইরূপ কহিতেছেন, সেই সময় এক প্রকাণ্ড দীর্ঘ গোঁপদাড়ীবিশিষ্ট ভীমকায় পুরুষ কমলার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। কমলা ভয়ে আড়ষ্ট—- স্পন্দহীন। ভীতান্তঃকরণে জিজ্ঞাসিলেন,-
“তুমি কে?”
প। চিনতে পাচ্চ না?
ক। না।
“তুমি আমাকে খুব চিন।” এই বলিয়া সেই ভীমকায় পুরুষ মাথায় পাগড়ী ও কৃত্রিম শ্মশ্রুগুম্ফ খুলিয়া ফেলিল। কমলা দেখিলেন, অমরচাঁদ! অমরচাঁদকে দেখিয়া কমলা চীৎকার করিবার উপক্রম করিতেছিলেন, এমন সময় অমরচাঁদ কহিলেন, “চীৎকারে কোন ফল নাই!”
কমলা ভীতসহকারে কহিলেন—”তুমি কোথা হইতে আসিলে?”
অমর। চিল ভেদ করিয়া।
ক। আমি প্রতারিত হইয়াছি।
অ। মৃত ব্যক্তিকে দেখিয়া তোমার কি ভয় হয় না?
ক। কি জীবিত–কি মৃত, কাহাকেও আমি ভয় করি না; কেবল একজনকে ভয় করি— ঈশ্বরকে এবং বুঝিতে পারিলাম, শঙ্কর তোমার চেলা, তোমারই উপদেশানুসারে সে সমস্ত কার্য্য করে।
অ। সে যাহা হউক, এখন তোমাকে গ্রেপ্তার করিবার নিমিত্ত ডিটেকটিভ কৰ্ম্মচারী বাহিরে ওয়ারেন্ট হাতে দাঁড়াইয়া আছে। আমার আদেশ পাইলেই, তোমাকে গ্রেফ্তার করে। কমল! এইবার তুমি হাতে-নাতে ধরা পড়িয়াছ!
ক। কেন আমাকে গ্রেফতার করিবেন?
অ। স্বামীকে খুন করিয়াছ বলিয়া।
ক। ভগবান জানেন, আমি আমার প্রাণের স্বামীকে হত্যা করি নাই। মিথ্যা স্বামীহত্যার অপরাধে লোক-সমক্ষে আর আমাকে অপমানিত করিবেন না। একে স্বামীর শোক, তাহে আমার মিথ্যা কলঙ্ক রটনা করিয়া লোক-সমাজে আমাকে বিশেষরূপ অপমানিতা করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন। এই জন্যই আত্মহত্যা করিয়া জীবন জুড়াইবার নিমিত্তই এখানে আসিয়াছিলাম ও আমার যাহা কিছু আছে তাহা আমি মুক্তহস্তে দান করিতেছিলাম। এইরূপে অর্থ শেষ হইলেই মণিকর্ণিকার গর্ভে আমি আপন জীবন সমর্পণ করিতাম। আমার স্বামীর হঠাৎ নিরুদ্দেশে আমার মন একে অস্থির হইয়া রহিয়াছে, তাহার উপর মিথ্যা কলঙ্ক হৃদয়কে সর্ব্বদা দগ্ধ করিতেছে। সে যাহা হউক, এখন আমার সময় উপস্থিত হইয়াছে, আমার যাহা কিছু আছে তাহা লইয়া আপনি নিবৃত্ত হউন, আমি আপন কাৰ্য্য শেষ করি।
অ। আমি তোমার এক কপদকেরও আশা করি না, যে আপন স্বামীকে হত্যা করিয়া ধনাধিকারিণী হইয়াছে, তার ধনস্পর্শ করিলেও মহাপাপ।
চোক্ষের জল ফেলিতে ফেলিতে কমলা বলিলেন, “আপনি আমার উপর যে দোষারোপ করিতেছেন, তাহা সম্পূর্ণ মিথ্যা। স্বামী দেবতা।”
অ। তবে আমাকে হত্যা করিতে ইচ্ছা করিয়াছিলে কেন?
ক। আপনার উপর আমার বড়ই ক্রোধ, কারণ আপনি রাষ্ট্র করিয়াছেন যে, আমি আমার প্রাণের স্বামীকে হত্যা করিয়াছি। এই জন্যই আমি উহার প্রতিহিংসা লইবার চেষ্টা করিতেছিলাম। কারণ আমার সংসারে আর কোন সুখ ছিল না, আমার জুড়াইবার স্থান মণিকর্ণিকা গর্ভই স্থির করিয়া রাখিয়াছিলাম।
অ। তোমার সমস্ত অপরাধ চাপা পড়িতে পারে, রাজদ্বারেও তোমাকে যাইতে হইবে না, যদি তুমি সরলমনে ঈশ্বরকে সাক্ষী রাখিয়া, তোমার স্বামীর হত্যা-বিষয় স্বীকার কর, তাহা হইলেই তুমি নিরাপদ জানিবে।
কমলার নেত্রদ্বয় বাষ্পভারাক্রান্ত হইল— কমলা কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “আমি আমার জীবনের আর আশা করি না, রাজদ্বারে যাইতেও আমার ভয় নাই। তবে যখন আপনি আমার বিষয় অবগত হইতে চাহিতেছেন, তখন আমি আপনাকে সমস্ত প্রকৃত কথা বলিতেছি, আপনি আমার কথায় বিশ্বাস করুন আর না করুন তাহাতে আমার কিছুমাত্র ক্ষতি নাই। আজ চারি বৎসর হইল, আমার স্বামী স্বর্গধামে চলিয়া গিয়াছেন —তিনি অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিকারী ছিলেন, মোটা মাহিনার চাক্রী করিতেন, তাঁহার অন্য কোন অভিভাবক না থাকায়— আমি পিত্রালয়েই থাকি, আমার পিতার আমি একমাত্র সন্তান— মাতা জীবিত ছিলেন না— পিতার মত ধনশালী ব্যক্তি তখন আর সে অঞ্চলে কেহই ছিল না। তিনি বহুবিধ অত্যাচার করিয়া এই ধনরাশি উপার্জ্জন করিয়াছিলেন। তাঁহার অধীনে কতকগুলি বদমায়েস ডাকাত থাকিত, পিতার হুকুম অনুসারে তাহারা নানাবিধ কুকার্য্য করিয়া টাকাকড়ি আনিত। আমি পিতার পায় ধরিয়া কত বুঝাইয়াছি, কত কাঁদিয়াছি, ধনান্ধ পিতা আমার কথায় কর্ণপাতও করিতেন না। আমি স্ত্রীলোক, কি করিব, নীরবে সকলি সহ্য করিতাম। মনে হইত, এ পাপ-পুরীতে আর থাকিব না— এইবার স্বামী আসিলে তাঁহার সহিত চলিয়া যাইব। কিছুদিন পরে তিনি পনের দিনের ছুটী লইয়া আমাদের বাড়ী আসেন। বৎসরান্তে স্বামীর মুখ দেখিয়া আমার সকল চিন্তা দূরীভূত হইল। মনে করিলাম, এইবার ইঁহার সঙ্গে চলিয়া যাইব— এখানে আর থাকিব না। রন্ধন করিলাম, সমস্ত দিন অনাহারের পর তিনি সামান্য মাত্র আহার করিয়া শয়ন করিলেন। আমি বৃদ্ধ পিতাকে খাওয়াইলাম— পরে নিজে তাড়াতাড়ি দুটি মুখে দিয়া বহুকালের পর স্বামীর পদসেবা করিতে পাইব— এই ভাবিয়া ঘরে গেলাম। ঘরে গিয়া দেখি, তিনি গাঢ়নিদ্রায় অভিভূত, আমি পদপ্রান্তে বসিয়া রহিলাম, কিন্তু বহুক্ষণ বসিয়া থাকিতে পারিলাম না- স্বামীসেবা আমার অদৃষ্টে ঘটিল না, আমি ঘুমাইয়া পড়িলাম। প্রাতঃকালে আমার নিদ্রাভঙ্গ হইল— উঠিয়া দেখি, তিনি গৃহমধ্যে নাই— মনে করিলাম, বায়ুসেবন করিতে গিয়াছেন, ক্রমে ৭টা ৮টা বাজিয়া গেল। তাঁহার দেখা নাই— বড়ই চিন্তিত হইলাম, মনে সন্দেহ হইল,—তাড়াতাড়ি বাবার কাছে গিয়া সমস্ত বলিলাম। বাবা চক্ষু দুটি কট্ মট্ করিয়া চাহিয়া বলিলেন, “সে আছে কি গেছে, তার আমি কি জানি।” তৎকালে যদি শত শত অশনি আমার মস্তকে পতিত হইত, তাহাও আমি সহ্য করিতে পারিতাম, কিন্তু পিতার এই ভয়ানক কথা, অশনি অপেক্ষা মৰ্ম্মভেদী হইল—- আমি কাঁদিয়া উঠিলাম, পিতার পদপ্রান্তে পড়িয়া কত কাঁদিলাম, কঠিনহৃদয় পিতা চুপ করিয়া থাকিয়া অবশেষে কহিলেন, “সে আর ইহ-জগতে নাই।” আমার হৃদয়তন্ত্রী ছিঁড়িয়া গেল — হৃদপিণ্ডের ক্রিয়া বিলুপ্তপ্রায় হইল, আমি পাগলিনীর ন্যায় নিজগৃহে আসিয়া কাঁদিতে লাগিলাম। কিন্তু অভাগিনীর কাঁদিবারও অধিকার বেশীক্ষণ রহিল না- পিতা আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আমি লাগিলাম। বাবা বলিলেন, “যা হবার তা হয়ে গেছে, তাকে ত আর ফিরে পাবে না— মা, তুমি আর কেঁদ না।” আমি নিরস্ত হইলাম না। শেষে পিতা ক্রোধভরে কহিলেন, “যদি না চুপ কর— তোমাকে বাটী হইতে দূর করিয়া দিব।” অগত্যা আমি চুপ করিলাম, পিতা চলিয়া গেলেন। দিন যাইতে লাগিল, আমি কেবল বিরলে বসিয়া কাঁদি। কিছুদিন পরে হঠাৎ জ্বরবিকারে পিতার মৃত্যু হইল, আমি অসহায় ও একাকী হইলাম, জীবনে আর সুখ নাই। এইরূপে মাসাবধি গত হইল, একদিন পুলিস অর্থাৎ তুমি আসিয়া উপস্থিত। তোমাকে দেখিয়া আমার ভয় হইল, বুঝিলাম, আমার স্বামী খুন হইয়াছে, পুলিস জানিতে পারিয়াছে। সেখানে থাকা আর শ্রেয়স্কর বিবেচনা করিলাম না, অবশিষ্ট জীবন ব্রহ্মচারিণীরূপে পবিত্র কাশীধামে কাটাইব মনে করিয়া, এখানে আসিলাম। এখানেও আমার নিস্তার নাই, আপনিও সঙ্গে সঙ্গে। তখন মনে করিলাম, আমার সমস্ত অর্থ দান করিয়া গঙ্গাজলে আত্মবিসর্জ্জন করিব! শঙ্কর দাস বলিয়া একটা লোক আমার নিকট চাক্রী স্বীকার করিল— সে যে বদলোক, তাহা আমি বুঝিতে পারি নাই, বলিতে কষ্ট হয়, সে আমায় দেখিয়া পাগলের মত হইল, কপট বিশ্বাসে তাহাকে আশায় রাখিয়া কৌশলে তাহাকে জব্দ করিব, এই চেষ্টা করিতে -লাগিলাম। তাহার পর আপনি সমস্তই জানে—আমার আর বাঁচিবার সাধ নাই, মরণ হইলেও মঙ্গল। কিন্তু একবার সাধ করিয়াছিলাম, যতকাল বাঁচিব, সেই পতিদেবতার ধ্যানে নিযুক্ত থাকিয়া, ব্রহ্মচর্য্য ব্রতে দীক্ষিত হইয়া, পতির পদযুগল স্মরণ করিতে করিতে মরিব কমলা আর বলিতে পারিলেন না। কণ্ঠশ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিল— নেত্রদ্বয় উপরে উঠিয়া মুচ্ছিত হইল।
প্রায় অর্দ্ধঘণ্টা পরে, কমলার মূর্ছা অপনীত হইল। কমলা চক্ষু মেলিয়া চাহিলেন, আবার মুদিলেন। তাঁহার মস্তক এক দেবোপম সুন্দরকান্তি যুবকের ক্রোড়ে। যুবক একদৃষ্টিতে কমলার মুখের দিকে চাহিয়া আছেন। কমলাকে জাগিতে দেখিয়া যুবক মৃদুস্বরে কহিলেন, “কমলে! এখন উঠিবার প্রয়োজন নাই।” কমলা আবার চাহিয়া দেখিলেন। কিছুই ঠিক করিতে পারিলেন না, পাগলের মত ঊর্দ্ধদৃষ্টিতে যুবকের মুখপানে কেবল চাহিয়া রহিলেন। যুবক তালবৃত্ত ব্যজন করিতেছেন; কমলা শশব্যস্তে যুবকের ক্রোড় হইতে উঠিয়া উন্মত্তের ন্যায় প্রলাপ বকিতে আরম্ভ করিলেন, “সাপ— সাপ—কাল সাপ! তুই আমাকে দংশন করিয়াছিস!” কটিদেশ হইতে তীক্ষ্ণধার ছুরিকা বাহির করিয়া “এখনি কালসাপের বিষদত্ত ভগ্ন করিব” বলিয়া আলু-থালু বেশে ছুরিকা-হস্তে যুবকের বক্ষঃস্থলে আঘাত করিবার জন্য ধাবমান হইলেন। যুবক ত্বরিতগতিতে কমলার হস্ত হইতে ছুরিকাখানি কাড়িয়া লইয়া কহিলেন, “হৃদয়েশ্বরি! কমলে! আমায় চিনতে পাল্লে না? আমি তোমার সরোজ!” “ কে—কে, সরোজ! প্রাণেশ্বর- সরোজ! অভাগিনীকে মনে প’ড়েছে? স্বর্গ হইতে আমার নিতে এসেছ? দাঁড়াও-দাঁড়াও, প্রাণেশ্বর— যাচ্ছি।” এই বলিয়া পুনরায় মূর্ছিত হইয়া পড়িলেন। সরোজবাবু তৎক্ষণাৎ কমলাকে হৃদয়ে ধারণ করিয়া পালঙ্কের উপর ধীরে ধীরে শায়িত করাইয়া কমলার পার্শ্বে উপবেশন করিলেন।
উপসংহার
পাঠকগণের বোধ হয় স্মরণ থাকিতে পারে, আজ চারি বৎসর বাবু হইল সরোজ বাবু একবার শ্বশুর বাড়ী আসিয়াছিলেন এবং এখানে আসিয়াই এক ঘটনার সম্মুখীন হইয়াছিলেন। দুর্বৃত্ত শ্বশুর দস্যুদ্বয় সমভিব্যাহারে স্বীয় দুহিতার শয়নমন্দিরে প্রবেশ পূর্ব্বক কোন দ্রব্যবিশেষের দ্বারা উভয়কে অচেতন করণান্তর জামাতা সরোজবাবুকে হত্যা করিয়া দামোদরের জলে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন; কিন্তু যাহার পরমায়ু থাকে, তাহাকে কাহার সাধ্য বিনষ্ট করে। জামাতাকে মৃত ভাবিয়া, দস্যুদ্বয় চলিয়া গেল। কিন্তু ভগবানের কৃপায় সরোজবাবু দামোদরের স্রোতে ভাসিতে ভাসিতে এক চড়ায় গিয়া লাগেন। তখন তাঁহার অল্প জ্ঞান হইয়াছে, মৎস্যজীবীগণ তাঁহাকে তদবস্থাপন্ন দেখিয়া, সেবাশুশ্রূষা ও ঔষধ প্রয়োগ দ্বারা আরোগ্য করে। তথায় কিয়দ্দিবস থাকিয়া যখন দেখিলেন, পূর্ব্বের ন্যায় তাঁহার শরীর সবল হইয়াছে, শরীরে আর কোন গ্লানি নাই, তখন সেই সহৃদয় মৎস্যজীবীগণের নিকট বিদায় লইয়া কি করিবেন, চিন্তা করিতে লাগিলেন। স্ত্রীর উপর সন্দেহ হইল, পিতা-পুত্রী উভয়েই এই হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত ছিল, এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়া কমলার অপরাধ সপ্রমাণ ও স্বভাব পরীক্ষার জন্য বেশ পরিবর্তন করিয়া ‘পুলিস’ বলিয়া পরিচয় প্রদান করেন। এখন কমলাকে নিরপরাধিনী ও নিষ্পাপ মনে করিয়া পরদিন কমলাকে লইয়া জন্মভূমি- অভিমুখে যাত্রা করিলেন। রাণী-ভবনে তালাচাবি পড়িল। আমার অনুসন্ধানও এই স্থানে শেষ হইল।
[জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৩ ]