ধ্বনিবদলের কথা
বাঙলার মূলে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা। তাতে অনেকগুলো ধ্বনি ছিলো। স্বরধ্বনি ছিলো : অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, ঋ, ৯, এ, ঐ, ও, ঔ। ছিলো অনেকগুলো ব্যঞ্জনধ্বনি : ক, খ, গ, ঘ, ঙ, চ, ছ, জ, ঝ, ঞ, ট, ঠ, ড, ঢ, ণ, ত, থ, দ, ধ, ন, প, ফ, ব, ভ, ম, য, র, ল, ল [মূর্ধণ্য-ল], হ্ল [মহাপ্ৰাণ- ল], ব [অন্তঃস্থ ব], শ, ষ, স, হ, ং, :। এ-ধ্বনিগুলোই আছে বাঙলা ভাষায়। তবে সবগুলো নেই। এগুলোর কয়েকটি লোপ পেয়েছে বাঙলা থেকে। আবার কয়েকটি জন্ম নিয়েছে বাঙলা ভাষায়। এগুলো প্রাচীনকালে পৃথকভাবে যেভাবে উচ্চারিত হতো এখন বাঙলায় তেমন হয় না। আদিযুগের বাঙলায় হয়তো হতো। ধ্বনি মিলে গ’ড়ে ওঠে শব্দ। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা থেকে বাঙলা পর্যন্ত আসতে শব্দে ধ্বনির বিন্যাস ও উচ্চারণ বদলে গেছে নানাভাবে। তাতে ধ্বনি পরিবর্তিত হয়েছে, শব্দ ভিন্ন চেহারা পেয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা থেকে আদি বাঙলা ভাষায় ধ্বনির পরিবর্তন, আর আদি বাঙলা থেকে আধুনিক বাঙলায় ধ্বনির পরিবর্তনের ইতিহাস খুবই জটিল। এখন সব বলা যাবে না। শুধু কয়েকটির কথা বলি।
বাঙলা ভাষার প্রথম ধ্বনি ‘অ’। হাজার বছর আগে, “চর্যাপদ”-এ এই ‘অ’ অবিকল এমন ছিলো না। উচ্চারণ আজকের উচ্চারণের মতো ছিলো না। খুব সহজে বলা যায় তখন ‘অ’ ছিলো অনেকটা আজকের ‘আ’-র অনেক কাছাকাছি। আমরা এখন ‘ই’-কে বলি হ্রস্ব-ই, আর ‘ঈ’-কে বলি দীর্ঘ-ঈ। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষায় ‘অ’ ছিলো হ্রস্ব-আ। পুরোনো বাঙলা ভাষায়ও অনেকটা তাই ছিলো।
এই ‘অ’ যে অনেকটা ‘আ’-র কাছাকাছি ছিলো, তার প্রমাণ পাই “চর্যাপদ”-এ। “চর্যাপদ”-এর বিভিন্ন শব্দের আদিতে যেখানে জোর পড়েছে, সেখানেই মাঝেমাঝে বিপর্যয় ঘটেছে ‘অ’ এবং ‘আ’-র। পাওয়া যায় ‘অইস’ আর ‘আইস’; ‘কবালী’ আর ‘কাবালী’, ‘সমাঅ’ আর ‘সামাঅ’ প্রভৃতি শব্দ। “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এও ‘অ’ অনেকটা ‘আ’-র মতোই ছিলো। তাই পাই ‘আকারণ’, ‘আচেতন’, ‘আতিশয়’, ‘আতী’ প্রভৃতি শব্দ। উল্লেখ করা ভালো যে আদিযুগে অ-কারান্ত শব্দ অর্থাৎ যে-সব শব্দের শেষে ‘অ’ আছে সে-সব শব্দের শেষে ‘অ’ উচ্চারিত হতো। ‘আকারণ’ উচ্চারিত হতো ‘আকারণঅ’, ‘আচেতন’ উচ্চারিত হতো ‘আচেতনঅ’। তাই এখন পুরোনো বাঙলা উচ্চারণ শুনলে আমাদের কেমনকেমন লাগে।
‘আ’ এখন আছে, চিরকাল ছিলো। “চর্যাপদ”-এ ছিলো। তবে শব্দের শেষে ‘আ’ শ্বাসঘাত না পেলে পরিণত হয়ে যেতো হ্রস্ব ‘অ’ ধ্বনিতে। “চর্যাপদ”-এ পাওয়া যায় ‘পাণিআ’ ও ‘পানী’, ‘করিআ’, ও ‘করিঅ’, ‘অমিআ’ ও ‘অমিঅ’ প্রভৃতি একই শব্দের দু-রূপ। এসব উদাহরণে দেখা যাচ্ছে শব্দের শেষের ‘আ’ লোপ পেয়ে গেছে, বা পরিণত হয়ে গেছে ‘অ’-তে।
আধুনিক বাঙলায় বানানেই শুধু পার্থক্য করা হয় ‘ই’ আর ‘ঈ’ এবং ‘উ’ আর ‘উ’-মধ্যে। উচ্চারণে ‘ই’ আর ‘ঈ’, ‘উ’ আর ‘ঊ’র মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এমন ঘটেছে বাঙলা ভাষার জন্মকাল থেকেই। “চর্যাপদ”-এ হ্রস্ব ও দীর্ঘ স্বরের কোনো পার্থক্য ছিলো না; পার্থক্য ছিলো না “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ, ও পরে। “চর্যাপদ”-এও পাওয়া যায় ‘সবরী’ ও ‘শবরি’, ‘জোই’ ও ‘জোঈ’, ‘লুই’ ও ‘লূয়ি’ প্রভৃতি শব্দ। এগুলো প্রমাণ করে উচ্চারণে ভিন্নতা ছিলো না ‘ই’ আর ‘ঈ’, ‘উ’ আর ‘উ’-র মধ্যে। “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাই ‘কাজলে রঞ্জিল দুঈ আখী’, ‘অমৃতেঁ সিঞ্চিঊ দুই আখী’, ‘মোর দুঈ আখি ধারা শ্রাবণে’, ‘মাণিক জিনিআঁ তোর দশন উজলে’, ‘মণিকিরণ ঊজলে আঙ্গদ ভুজযুগলে’ প্রভৃতি উদাহরণ। এগুলোতে দেখা যায় কোনোই পার্থক্য নেই ‘ই’/’ঈ’, আর ‘উ’/’উ’-র মধ্যে। পার্থক্য ছিলো না মধ্যযুগে। নেই আধুনিক কালে।
‘ঋ’ ধ্বনিটি স্বরধ্বনির মধ্যে স্থান পেলেও এটি স্বরধ্বনি নয়। আগের ‘ঋ’ আদি বাঙলায় পরিণত হয়ে যায় ‘উ’-তে। ‘ঋজু’ শব্দটি “চর্যাপদ”-এ হয়ে গেছে ‘উজু’। কবি সরহ বলেছেন, ‘বপা উজুবাট ভাইলা’; অর্থাৎ ‘বাবা, সোজা পথ দেখা গেলো’।
আরো বহু ব্যাপার ঘটে স্বরধ্বনিরাশিতে।
প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার ব্যঞ্জনধ্বনিগুলো বাঙলায় আসে কিছুটা বিকল হয়ে।
কয়েকটির কথা বলা যাক।
আমাদের কাছে দুটি ‘ন’, ‘ণ’। এ-দুটির উচ্চারণে কোনো পার্থক্য নেই। শুরুতেও পার্থক্য ছিলো না। পার্থক্য ছিলো প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষায়। কিন্তু “চর্যাপদ”, “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ এ-দুটি ধ্বনিত হতো একই রূপে। তাই এ-বই দুটিতে পাওয়া যায় ‘ন্’ আর ‘ণ্’-র যথেচ্ছ ব্যবহার। “চর্যাপদ”-এ পাই ‘ণিঅ মণ ণ দে উলাস’, অর্থাৎ ‘নিজের মন উল্লাস দেয়’; আবার পাই ‘নিঅ দেহ করুণা শূন মেহেরী’, অর্থাৎ ‘নিজ দেহ হলো করুণা ও শূন্য-মহিলা’। তাই দেখি কোনোই ভেদ নেই ‘ন’ আর ‘ণ’- তে। “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাই ‘আঝর ঝরয়ে মোর নয়নের পাণী’। ‘পানি শব্দের বানানে “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ কোথাও ‘ন’ ব্যবহৃত হয় নি। তাই কেউকেউ মনে করেন হয়তো ‘ণ’-এর একটি পৃথক উচ্চারণ ছিলো কিন্তু তা থাকার কথা নয়। ‘ণাম্বায়িল’ ও ‘নাম্বায়িল’ ধরণের বানান খুব পাওয়া গেছে এ-কাব্যে।
এখন তিনটি ‘শ্’, ‘ষ্’, ‘স্’ আছে আমাদের। “চর্যাপদ”, “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এর কালেও ছিলো। এখনকার মতোই তিনটিরই প্রধান উচ্চারণ ছিলো ‘শ্’। “চর্যাপদ”-এ পাওয়া ‘শূণ’ ও ‘সুণ’, ‘সহজে’ ও ‘ষহজে’, ও ‘মুসা’ ও ‘মুষা’—মনে হয় উচ্চারণ ছিলো এদের একই। বিভিন্ন শব্দের বানান তখনো স্থির হয় নি ব’লে যেখানেসেখানে বসানো হয়েছে ‘শ’, ‘ষ’, ‘স’ তিনটিকে।
“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাই ‘শিশের সিন্দুর সুরেখ শোভে আর দশনের যুতী’, ‘মুছিআঁ পেলায়িবোঁ বড়ায়ি শিষের সিন্দুর’, ‘সিশের সিন্দুর তোর লাসে’। এতে বুঝি তিন ‘শ’-র ভেদ ছিলো না উচ্চারণে।
আমাদের আছে দুটি ‘জ’ আর ‘য’। এদের উচ্চারণের ভেদ নেই। প্রাচীন আর্যভাষায় ‘য’ উচ্চারিত হতো অনেকটা ‘য়’-র মতো। বাঙলায় সে- পুরোনো ‘য’-র উচ্চারণ কোথাও ‘জ’ হয়ে গেছে, কোথাও হয়েছে ‘য়’। তাই একটি নতুন অক্ষরই তৈরি করতে হয়েছে আমাদের ‘য়’-রূপে। শব্দের শুরুতে ‘য’ নতুন উচ্চারণ অনুসারে সাধারণত ‘জ’-ই উচ্চারিত ও লিখিত হতো। “চর্যাপদ”-এ পাওয়া যায় ‘জবে মুষাএর চার তুটআ’, ‘জে জে আইলা তে তে গেলা’, ‘গঙ্গা জউনা মাঝে রে বহই নাঈ’। “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”- এও একই রকম ঘটে। পাওয়া যায় ‘তাহার ঠাইক জাইতেঁ লাগে বড় ডরে’, ‘আজি যখনে মোঁ বাঢ়য়িলোঁ পাএ’, ‘মথুরা নগর যাইতেঁ দিলান্ত মেলানী’,’বৃন্দাবন মাঝে যমুনা নদী বহে।
আধুনিক বাঙলায় বেশ কিছু মহাপ্রাণ ধ্বনি আছে। যেমন ‘খ্’, ‘খ্’, ‘চ্’, ‘খ্’ প্রভৃতি। আরো কিছু মহাপ্রাণ ধ্বনি আছে, যেগুলো এখন শুধু লেখায় ব্যবহৃত হয়, কিন্তু তাদের উচ্চারণ বদলে গেছে। যেমন ‘হ্ম’, ‘হ্ন’, ‘ঢ়’, হ’ প্রভৃতি। “চর্যাপদ”-এ’হ্ম’, ‘হ’, ‘ঢ়’ খাঁটি মহাপ্রাণ রূপেই হয়তো উচ্চারিত হতো। “চর্যাপদ”-এ পাই ‘অহ্মে ভলি দান দাহ’, ‘ভণই কাহ্নু’, ‘নউ দাঢ়ই নউ তিমই ন ছীজই’। “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এর কাল থেকেই অবশ্য এগুলো মহাপ্রাণতা হারাতে থাকে। তবে এ-কালে ‘হ্ম’, ‘হ্ন’, ‘ঢ়’, ‘হ্র’, ‘ব্লু’ মহাপ্রাণ ধ্বনি ছিলো। পাওয়া যায় ‘আহ্মাক পরাণে মাইলে কি লাভ তোহ্মার’, ‘কেহ্নে ঘর জাইতে মোকে বোল গুণনিধী’, ‘বজরে গঢ়িল বুক না জাএ ফুটিআঁ’, ‘পুহাইল হরিষমণে কণ্ঠত ভূষণগণে’, ‘কনক যূথিকা মাহলী লবঙ্গ সেয়তী’। এগুলো এখন শুধুই কয়েকটি শব্দের বানানে পাওয়া যায়। উচ্চারণে পাওয়া যায় না।