আটচল্লিশ
কেবিন থেকে বেরিয়ে লামিয়াকে নিয়ে প্রথমে নর্দার্ন স্টারের রেডিও রুমে গেছে রানা, অপারেটরকে বেহুঁশ করে মেসেজ পাঠিয়েছে নুমা হেডকোয়ার্টারে, তারপর আবার বেরিয়ে এসেছে। এখন ছুটছে দু’জনে। পেছনে ধাওয়া করে আসছে কর্টেজের দলের মার্সেনারিরা।
ম্যাগাজিন ফুরিয়ে গেছে, পিস্তল রিলোড করল রানা। ধাওয়াকারীরা কিছুটা পিছিয়ে একটা সংকীর্ণ কুঠুরিতে ঢুকে থামল। গা-ঢাকা দিল ওখানে।
পরক্ষণে একটা নতুন আওয়াজ শোনা গেল—হুপ হুপ জাতীয় শব্দ… ডাইভ দেবার আগে সাবমেরিনে যেমনটা শোনা যায়, অনেকটা সেরকম।
‘কীসের আওয়াজ ওটা?’ জানতে চাইল রানা।
‘জানি না,’ ক্লান্ত গলায় বলল লামিয়া।
কয়েক মুহূর্ত পরেই লাউডস্পিকারে শোনা গেল যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর।
‘ফালক্রাম ডেপুয় হচ্ছে। সবাইকে মিডশিপ্স অ্যারে থেকে দূরে থাকতে বলা হলো। রিপিট। সবাইকে মিডশিপস অ্যারে থেকে দূরে থাকতে বলা হলো…’
‘সময় ফুরিয়ে আসছে আমাদের,’ উদ্বিগ্ন গলায় বলল লামিয়া। ‘কয়েক মিনিটের বেশি বাকি নেই।’
‘আর আমরা উল্টোপথে চলেছি,’ সখেদে যোগ করল রানা।
কিছু করারও ছিল না। পদে পদে ওদের বাধা দেবার জন্যে অপেক্ষা করছে জাহাজের লোকেরা, তাই বার বার দিক বদলাতে বাধ্য হয়েছে দু’জনে। রেডিও রুম থেকে বেরিয়ে আসার পর জাহাজের পেছনদিকে যাবার বদলে আরও সামনে এগিয়ে এসেছে ওরা।
একটা সুবিধে অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে—জাহাজটা বিশাল হলেও ক্রুর সংখ্যা একশোর বেশি নয়। তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন ডিউটি স্টেশনে যোগ দিয়েছে ফালক্রাম সংক্রান্ত অপারেশনটার জন্যে। তাই রানা আর লামিয়ার পেছনে খুব বেশি লোক লেলিয়ে দিতে পারেনি কর্টেজ।
তারপরেও জাহাজটার সেটআপ একটা মস্ত বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ওদের জন্যে। জাহাজের অর্ধেকটা দখল করেছে ফালক্রাম কম্পার্টমেন্ট, সেটা পুরো প্রস্থ জুড়ে বিস্তৃত। কাজেই জাহাজের পেছনদিকে যেতে চাইলে হয় ওটার ভেতর দিয়ে যেতে হবে, নয়তো একেবারে নিচের কোনও ডেক… অর্থাৎ, ফালক্রামের তলা দিয়ে। কোনোটাই করতে পারছে না ওরা।
এখনও অ্যালার্ম বাজছে লাউডস্পিকারে, শোনা যাচ্ছে রেকর্ড করা সতর্কবাণী। রানা অনুমান করল, জাহাজের ওপরের ডেক খুলে গেছে, ওখান দিয়ে পাখার মত বেরিয়ে আসছে বিশাল অ্যারে-টা।
‘চলো,’ লামিয়াকে দাঁড় করাল ও।
কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার, কিন্তু কোনও অভিযোগ করল না। যতটা পারল, তাল মিলিয়ে এগোল রানার সঙ্গে।
একটা ল্যাডার পেল রানা, নেমে গেছে নিচে। ওটা ধরে পিছলে নেমে গেল ও। ইশারা পেয়ে লামিয়াও নামল। রানা লক্ষ করল, ওর হাতের ব্যাণ্ডেজ ভিজে উঠেছে রক্তে।
‘কী অবস্থা, দেখি?’
‘আমি ঠিক আছি,’ রানাকে বাধা দিল লামিয়া। ‘এগোও।’
আরেকটা ল্যাডার ধরে আরও এক ডেক নামল দু’জনে। এবার থামল রানা। কানে বাজছে মেশিনারির জোরালো আওয়াজ। একটা বুদ্ধি খেলল মাথায়।
‘এখানেই অপেক্ষা করো,’ লামিয়াকে বলল ও। তারপর এগিয়ে গেল সামনে। একটা হ্যাচওয়ে পেল–পাল্লার ওপরে লেখা: থ্রাস্টার ইউনিট।
পেছনে বাল্কহেডের গায়ে হেলান দিয়ে বসে পড়েছে লামিয়া। রানাকে তাকাতে দেখে বলল, ‘এ…একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। এখুনি উ…উঠে পড়ব।’
আর বেশিক্ষণ ছোটাছুটি করতে পারবে না মেয়েটা, বুঝল রানা। অবশ্য ছুটে লাভও নেই। সময় ফুরিয়ে এসেছে ওদের।
লাউডস্পিকারটা আচমকা নীরব হয়ে গেল। কিছু একটা লক হয়েছে ওপরে, তার ধাক্কায় মৃদু কেঁপে উঠল পুরো জাহাজের কাঠামো।
‘কতক্ষণ বাকি?’ জানতে চাইল রানা।
‘এক মিনিট,’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল লামিয়া। ‘বা তারও কম।’ নেতিয়ে পড়েছে ও। ব্যাণ্ডেজ চুইয়ে এখন বেরিয়ে আসছে রক্ত।
দাঁতে দাঁত পিষল রানা। লামিয়ার জন্যে কিছুই করার নেই এ-মুহূর্তে। তার আগে ফালক্রামটা ঠেকানো দরকার। দেয়ালের ব্র্যাকেট থেকে খুলে আনল একটা ফায়ার-ফাইটিঙের কুঠার। সামনের হ্যাচ খুলে ঢুকে পড়ল ভেতরে।
প্রচণ্ড আওয়াজে কান ঝালাপালা। নিচে তাকিয়ে জাহাজের শক্তিশালী বো-থ্রাস্টারের মোটর দেখতে পেল রানা—যন্ত্রগুলো খাটছে প্রাণপণে। বিশাল জাহাজটাকে নির্দিষ্ট একটা পজিশনে স্থির রাখার জন্যে ব্যবহার করা হচ্ছে ওগুলোকে।
একটু ভাবল রানা। ধারণা করল, পার্টিকেল বিমের দিক পরিবর্তন করার জন্যে পজিশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। থ্রাস্টারগুলো যদি কোনোভাবে বিকল করে দেয়া যায়, নিঃসন্দেহে একটা গোলমাল দেখা দেবে ফালক্রামের অপারেশনে। তা-ই করার জন্যে পা বাড়াল ও।
.
চার নম্বর অয়েল রিগের কন্ট্রোল রুম থেকে রণক্ষেত্রের পরিস্থিতি বিচার করছেন আকুম্বা। দু’দফা হামলা ঠেকিয়ে দিয়েছেন তিনি, আমেরিকানদের বাধ্য করেছেন পিছু হটতে। এবার পাল্টা আঘাত হানার পালা।
‘সবগুলো ইউনিট ফুল পাওয়ারে আনো, হুকুম দিলেন তিনি।
প্রেসিডেন্টের পাশে জড়সড় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ম্যালোন; ভয়ঙ্কর যে-ধ্বংসযজ্ঞ ঘটতে চলেছে, তার রূপকার বলে তাকে মানাচ্ছে না মোটেই। বরং তাকে মনে হচ্ছে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসা একটা ভীত খরগোশের মত। হুকুম পেয়ে কন্ট্রোল প্যানেলে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে, বাকি টেকনিশিয়ানরাও লেগে গেল কাজে। কী করতে হবে, সে-ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে সবাইকে।
একটু পর সোজা হলো ম্যালোন। রিপোর্ট দিল: ‘সবগুলো ইউনিট একশো পার্সেন্ট ডিজাইন লোডে পৌঁছেছে। ম্যাগনেটিক টানেলগুলো এনার্জাইজড্-সবুজ রিডিং দিচ্ছে। হেভি পার্টিকেলের মিশ্রণ স্টেবল অবস্থায় আছে।’ কথা বলতে বলতে চেক করে নিল একটা মনিটর, সেখানে ফুটে উঠেছে নর্দার্ন স্টারের টেলিমেট্রি ডিসপ্লে। ‘ফালক্রাম ডেপ্লয় করা হয়েছে। আপনি এখন ফায়ার করতে পারেন।’
মৃদু হাসলেন আকুম্বা, মুহূর্তটা উপভোগ করছেন। মিসাইল নিয়ে, ফাইটার নিয়ে, তাঁকে আক্রমণ করেছিল আমেরিকানরা। কিচ্ছু করতে পারেনি। সোনার রিডিঙে এখন ধরা পড়ছে ওদের দুটো সাবমেরিন, অগভীর পানিতে প্রবেশ করছে। ওগুলোও ব্যর্থ হবে। এবার ওদের ধৃষ্টতার পাল্টা জবাব দেবেন তিনি।
তাঁর হুকুম পাওয়ামাত্র চালু হবে পুরো সিস্টেম। পনেরো সেকেণ্ড লাগবে অ্যাকসেলারেটরের টানেলে পার্টিকেল বিমের চার্জ তৈরি হতে। তার কোয়ার্টার সেকেণ্ড পরে অদৃশ্য সেই বিমের ধারা ছুটবে আটলান্টিকের ওপর দিয়ে, নর্দার্ন স্টারের ওপরে পৌঁছুবে, সেখান থেকে বাঁক নিয়ে আঘাত হানবে আমেরিকার রাজধানীতে। বেশিক্ষণ না, মাত্র একটা মিনিট পুরো শহরের ওপর দিয়ে পার্টিকেল বিমের প্রবাহ ঘটাবেন তিনি; তাতেই ঘটবে মহাপ্রলয়। দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছেন তিনি সেই দৃশ্য।
ম্যালোনের দিকে তাকালেন আকুম্বা। ‘তৈরি তুমি? ফায়ার!’
.
থ্রাস্টার রুমের ভেতরে, যা খুঁজছিল তা পেতে কয়েক সেকেণ্ড লাগল রানার। মোটাসোটা একটা হাই ভোল্টেজ পাওয়ার লাইন, রিঅ্যাক্টর রুমে যেমনটা দেখেছিল। দেরি না করে ওটার দিকে এগিয়ে গেল ও, কুঠারটা সজোরে ঘুরিয়ে কোপ মারল লাইনে। শেষ মুহূর্তে ছেড়ে দিল ওটা হাত থেকে, যাতে শক না খায়।
জায়গামত আঘাত হানল কুঠারের ফলা। আগুনের স্ফুলিঙ্গের ফুলঝুরি উঠল। চোখ-ধাঁধানো আলোর মাঝে দেখা গেল বিদ্যুতের শিখা—কেইবলের কাটা জায়গাটায় আধ সেকেণ্ডের জন্যে নাচানাচি করল। তারপরেই পুরো জাহাজ ডুবে গেল অন্ধকারে।
মেঝেতে ছিটকে পড়েছে রানা। মুখটা এমনভাবে জ্বলছে, যেন ঝলসে গেছে আগুনে। অন্ধকারে কিছুক্ষণ সচল রইল থ্রাস্টারের মোটর, তারপর ধীরে ধীরে কমে এল ওগুলোর গর্জন। থেমে যাচ্ছে। ইমার্জেন্সি লাইট জ্বলে উঠল হঠাৎ। তবে স্বস্তির সঙ্গে রানা লক্ষ করল, এছাড়া আর কোনও কিছুতেই পাওয়ার নেই।
কষ্টেসৃষ্টে উঠে দাঁড়াল ও। টলমল পায়ে এগোল হ্যাচের দিকে।
.
নর্দার্ন স্টারের ব্রিজে হতভম্ব অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে কর্টেজ। আলো নিভে গেছে গোটা জাহাজের, রাতের আঁধার যেন গ্রাস করেছে সবকিছু। খানিক পর মিটমিট করে জ্বলে উঠল ইমার্জেন্সি লাইট।
সমস্যাটা ধরতে পারছে না সে। প্রথমে ভাবল, অ্যারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে পুরো ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেম ওভারলোড হয়ে গেছে। এগিয়ে গিয়ে ফালক্রামের কন্ট্রোলে হাত রাখল, অন-অফ করল টগল সুইচ, কিন্তু কোনও লাভ হলো না। স্ট্যাণ্ডবাই লাইটও জ্বলছে না।
কয়েক সেকেণ্ড পর কয়েকটা বেসিক সিস্টেম চালু হলো। আশাবাদী হয়ে চারদিকে তাকাল কর্টেজ।
‘একশো বিশ ভোল্টের লাইনটা শুধু চালু হয়েছে,’ তাকে হতাশ করে দিয়ে বলল এক ইঞ্জিনিয়ার। ‘হাই-ভোল্টেজ লাইনটা এখনও বন্ধ।’ নিজের সামনের কয়েকটা সুইচ টিপল সে। ‘থ্রাস্টার কাজ করছে না। কোনও পাওয়ার পাচ্ছে না অ্যারে বা অ্যাকসেলারেটর।’
উইওশিল্ডের সামনে গিয়ে বাইরে তাকাল কর্টেজ। জাহাজের মাঝখান থেকে বেরিয়ে এসেছে ফালক্রাম, বিশাল একটা ছাতার মত দেখাচ্ছে ওটাকে… নিষ্প্রাণ একটা ছাতা। গুঞ্জন করছে না, আলো জ্বলছে না।
আবারও কন্ট্রোলের কাছে ফিরে এল সে। জয়স্টিক নিয়ে নাড়াচাড়া করল একটু। সাড়া দিল না ফালক্রাম। এতক্ষণ যে ক্ষীণ সন্দেহ মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, এবার সেটা পরিণত হলো স্থির বিশ্বাসে।
‘রানা!’ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল সে।
ক্রোধে কয়েক মুহূর্ত ফুঁসল কর্টেজ, তারপর লাগাম টানল আবেগের। উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই এখন, কাজ করতে হবে ঠাণ্ডা মাথায়। জানে, হাই-ভোল্টেজ লাইনটা পুনঃস্থাপন করা সম্ভব; কিন্তু তার আগে নিশ্চিত করতে হবে, রানা যেন দ্বিতীয়বার ওতে বাগড়া দিতে না পারে। আর সেটা করতে হবে তাকেই।
একটা রাইফেল তুলে নিল কর্টেজ। সেফটি চেক করল। তারপর নির্দেশ দিল, ‘কাউকে নিচে পাঠাও, হাই-ভোল্টেজ লাইনটা যেখানে কাটা পড়েছে, সেখান থেকে বাইপাস করে দিক। এরপর আবার কাজে নামব আমরা।’
মাথা ঝাঁকাল ইঞ্জিনিয়ার। বলল, ‘প্রেসিডেন্ট আকুম্বা যদি যোগাযোগ করেন, কী বলব?’
‘ধৈর্য ধরতে বলবে।’
রাইফেল নিয়ে ব্রিজ থেকে বেরিয়ে গেল কর্টেজ-শিকার করবে রানাকে।