ছত্রিশ
ওয়াশিংটন ডিসি।
এলিভেটর থামলে নুমা হেডকোয়ার্টারের এগারো তলায় নেমে পড়ল রানা ও মুরল্যাণ্ড। আস্তে আস্তে হাঁটছে দু’জনে, সারা শরীরে ব্যথা। চেহারা একেবারে বিধ্বস্ত। কোনও ধরনের ওয়েটসুট ছাড়া দীর্ঘ সময় পানিতে ডুবে ছিল, এরপর উদ্ধারকারী জাহাজ আসার আগে আট ঘণ্টা পুড়েছে রোদে। শরীরের নানান জায়গায় চামড়ার আস্তর তাই খসে খসে পড়ছে। কর্টেজের আঘাতে রানার কেটে যাওয়া ঠোঁটে জমে আছে কালচে রক্ত। মুরল্যাণ্ডের চেয়েও তাই খারাপ দেখাচ্ছে ওকে। আরও এক জায়গায় আঘাত পেয়েছে ও—ওর অহংবোধে। সে-আঘাত বাকি সব আঘাতের চেয়ে গুরুতর। ওর নাকের ডগা থেকে এতজন বিজ্ঞানীকে বন্দি করে নিয়ে গেল শত্রুরা, কিচ্ছু করতে পারল না ও… এমন ব্যর্থতা মেনে নেয়া কঠিন।
কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে হয়ে দেখা দিয়েছিল সাগর থেকে উদ্ধার পাবার পরের কয়েকটা ঘণ্টা। নেপচুনের কনফারেন্স রুমে বসে স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ কর্তৃপক্ষের জেরার মুখোমুখি হতে হয়েছিল ওকে আর মুরল্যাণ্ডকে। এমনভাবে প্রশ্ন করা হচ্ছিল, যেন সব দোষ ওদের… যেন দ্বীপের মাটিতেও নুমারই দায়িত্ব ছিল বিজ্ঞানীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। রিয়ার অ্যাডমিরাল ফনসেকা তো এ-ও বলে বসলেন, রানা আর মুরল্যাণ্ডের ওপর ভরসা করে মস্ত বড় ভুল করেছেন তিনি। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না, আন্তর্জাতিক মহলে কেলেঙ্কারি এড়াবার জন্যে নুমাকে বলির পাঁঠা বানাতে চাইছিলেন তাঁরা। চুপচাপ সেটা মেনে নেয়নি রানা বা মুরল্যাণ্ড, ক্যাপ্টেন মিচামও যোগ দিয়েছিলেন ওদের সঙ্গে; তর্ক বেধে গিয়েছিল। মিটিং শেষ হয়েছিল তিক্ত সুরে। সরকারি ইনভেস্টিগেটররা রানা ও মুরল্যাণ্ডকে কিছুদিনের জন্যে তাদের জিম্মায় নিতে চেয়েছিল তদন্তের স্বার্থে, অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত তারা সফল হয়নি। ওদেরকে দ্রুত আমেরিকায় উড়িয়ে এনেছেন তিনি।
চোদ্দ ঘণ্টার দীর্ঘ বিমানযাত্রা শেষে রানা ও মুরল্যাণ্ড এখন ক্লান্ত, অবসন্ন; পা টেনে টেনে এগিয়ে চলেছে আরেকটা কনফারেন্স রুমের দিকে। নুমার ডিরেক্টর-সহ আমেরিকান সরকারের উচ্চপদস্থ কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে মিটিঙে বসতে হবে। এই মিটিঙের কারণে ঠিকমত বিশ্রামও মেলেনি, হোটেলে উঠে মাত্র দু’ঘণ্টা ঘুমানোর সুযোগ পেয়েছে ওরা।
করিডোরের শেষ প্রান্তে পৌঁছুতেই দেখা মিলল পরিচিত একটা মুখের। কনফারেন্স রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে তানিয়া… একা। ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী আসিফ পাশে নেই দেখে কেমন যেন খারাপ লাগল। এগিয়ে গিয়ে ওকে আলিঙ্গন করল রানা; লক্ষ করল, মেয়েটার ভেতরে সেই সদাচঞ্চল ভাবটা আর নেই। মুরল্যাণ্ডও নীরবে সম্ভাষণ জানাল তাকে।
‘তোমাদের অবস্থা বিশেষ ভাল দেখাচ্ছে না, রানা,’ বলল তানিয়া। ‘কেমন আছ?’
‘আমাদেরকে নিয়ে ভাবতে হবে না,’ বলল রানা। ‘যথেষ্টই ভাল আছি। আসিফের খবর বলো।’
‘এখনও জ্ঞান ফেরেনি।’
‘শুনে খুব খারাপ লাগল।’
‘অতটা খারাপও নয়। ওর হার্টরেট বেড়েছে, ক্যাট স্ক্যানেও বড় ধরনের কোনও ড্যামেজ পাওয়া যায়নি। তারপরেও আমার ভয় করছে, রানা। ‘
‘ভয় পেয়ো না, ও ফিরে আসবে,’ আশ্বাস দিল রানা।
মুরল্যাণ্ড তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে যোগ করল, ‘রিল্যাক্স, যে-টান তোমাদের দু’জনের, আজরাইলও পারবে না আসিফকে টেনে নিয়ে যেতে।’
হাসার চেষ্টা করল তানিয়া, সফল হলো না। ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকিয়ে উল্টো ঘুরল; দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল কনফারেন্স রুমে। ওকে অনুসরণ করল রানা ও মুরল্যাণ্ড। টেবিলের একদিকে বসল ওরা-মাঝে রানা, দু’পাশে তানিয়া আর মুরল্যাণ্ড। খানিক পর কনফারেন্স রুমে হাজির হলেন অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন, সঙ্গে ল্যারি কিং আর আমেরিকান নেভির একজন রিয়ার অ্যাডমিরাল। রানাদের মুখোমুখি বসলেন তাঁরা, কুশল বিনিময় করলেন। সবশেষে হাজির হলেন ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির একজন হোমরাচোমরা প্রতিনিধি। গায়ে কালো সুট, চোখে কালো সানগ্লাস, সঙ্গে দু’জন এইড। টেবিলের মাথায়, সভাপতির চেয়ারে তাঁকে বসতে দিলেন অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন।
সবাই এসে গেছে। এবার মুখ খুললেন নুমা ডিরেক্টর। রানাদের উদ্দেশে বললেন, ‘আমি জানি, তোমাদের ওপর দিয়ে অনেক ঝড়-ঝাপটা গেছে, তারপরেও এভাবে ডেকে এনেছি বলে দুঃখিত। পরিস্থিতি সুবিধের নয়।’ সুটপরা ভদ্রলোকের দিকে ইশারা করলেন, ‘ইনি মি. অ্যারন ওয়েস্টলেক—এনএসএ-র ডেপুটি ডিরেক্টর। আর আমার পাশে যাঁকে দেখছ, ইনি রিয়ার অ্যাডমিরাল জোনাথন কারমেল। পুরো ব্যাপারটা সামলাবার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এঁদেরকে। আমরা আশঙ্কা করছি, বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত হবার মত একটা বিপদ দেখা দিয়েছে।’
অ্যাডমিরালের কথা শেষ হলে গলা খাঁকারি দিলেন ওয়েস্টলেক। বললেন, ‘বিষয়টা উদ্ঘাটনের জন্যে আমেরিকান সরকার আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আপনাদের মত আমাদেরও বিশ্বাস, অত্যন্ত ধনী ও সুসংগঠিত কোনও গোষ্ঠী একটা ডাইরেক্টেড-এনার্জি ওয়েপন তৈরি করে বসেছে। এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে অস্ত্রটা বর্তমান পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক ও সামরিক ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে বলে মনে করছি আমরা।’
বিরক্ত বোধ করল রানা। কঠিন ভাষায় কথা বলছেন ভদ্রলোক। ফিল্ডের লোক বলে মনে হচ্ছে না, নিশ্চয়ই পলিটিশিয়ান—বক্তৃতা দিতে অভ্যস্ত।
ল্যারি কিঙের দিকে তাকালেন ওয়েস্টলেক। ‘মি. কিং, আপনার সিমুলেশনে কী পেয়েছেন, জানান আমাদেরকে।’
নিজের ল্যাপটপ খুলল ল্যারি, রানাদের দিকে ঘুরিয়ে একটা গ্রাফিক সিমুলেশন দেখাল। সংক্ষেপে সেটা ব্যাখ্যা করার পর বলল, ‘সন্দেহ নেই, পার্টিকেল অ্যাকসেলারেটর ব্যবহার করছে ওরা। কোল্ড ওয়ারের সময় স্ট্র্যাটেজিক ডিফেন্স ইনশিয়েটিভের অংশ হিসেবে এই টেকনোলজি দিয়ে আমরা অ্যান্টি-মিসাইল শিল্ড তৈরি করতে চেয়েছিলাম, যদিও সেটা শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।’
ওয়েস্টলেক বললেন, ‘এনএসএ-র নিজস্ব স্টাডিতেও একই উপসংহারে পৌঁছেছি আমরা। ব্যাপারটা সত্যিই উদ্বেগজনক।’
নড়ে-চড়ে বসল রানা। যাক, বিপদটা তা হলে আঁচ করতে পারছেন এঁরা।
‘আরও খারাপ খবর হলো,’ বললেন ওয়েস্টলেক, ‘যে- সব বিজ্ঞানীকে অপহরণ করা হয়েছে, তাঁরা সবাই এই বিশেষ ফিল্ডের বিশেষজ্ঞ। এমন একটা অস্ত্র তৈরি বা ডেভেলপ করার জন্যে ঠিক এঁদেরকেই প্রয়োজন।’
‘এর পেছনে কারা আছে, তা জানা গেছে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
মাথা ঝাঁকালেন ওয়েস্টলেক। ‘কিছুটা। মার্সেনারি টিমের লিডারকে আপনারা আইডেন্টিফাই করতে পেরেছেন, তবে সে ভাড়াটে লোক। আজ সকালে আরেকটা সূত্র পাওয়া গেছে, তাতে মনে হচ্ছে এদের ঘাঁটি আফ্রিকায়।’
‘কী সূত্র?’ প্রশ্ন করল তানিয়া।
‘সাগর থেকে একটা লাশ উদ্ধার করা হয়েছে,’ বললেন ওয়েস্টলেক। ‘যেখানে মি. রানা আর মি. মুরল্যাণ্ডকে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল, সেখান থেকে দু’মাইল দক্ষিণে।’
একজন এইডের দিকে ইশারা করলেন তিনি। কয়েকটা ছবি এনে রানা আর মুরল্যাণ্ডের হাতে দিল সে।
‘লোকটাকে চিনতে পারছেন?’
পানিতে ফুলে-ফেঁপে গেছে লাশটা, তারপরেও পরিচয় আন্দাজ করতে অসুবিধে হলো না।
‘চাবিঅলা,’ বলল মুরল্যাণ্ড।
সায় জানাল রানা। ‘এ তো কুচিয়োর সঙ্গে ছিল,’ বলল ও। ‘মারা গেল কীভাবে?’
‘কপাল বরাবর গুলি,’ জানালেন ওয়েস্টলেক। ‘খুন করা হয়েছে একে। কেন, কিছু অনুমান করতে পারেন?’
‘উঁহু,’ মাথা নাড়ল রানা। ‘আমরা যখন শেষবার দেখি, তখনও বেঁচে ছিল। কে এই লোক?’
‘সিয়েরা লিওনের নাগরিক বলে তাকে সনাক্ত করেছি আমরা। ওখানকার আর্মির একজন প্রাক্তন মেজর। খুব সম্ভবত প্রেসিডেন্ট জোসেফ আকুম্বার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ছিল সে।’
‘সিয়েরা লিওন,’ বিড়বিড় করল রানা। এ নিয়ে দ্বিতীয়- বার দেশটার নাম শুনছে। প্রথমবার শুনেছিল ওয়াইবিসিও-র সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার জন্যে।
‘হ্যাঁ,’ ওয়েস্টলেক বললেন। ‘অদ্ভুত শোনালেও সমস্ত সূত্র ওই দেশটার দিকেই ইঙ্গিত করছে। ফ্রিটাউন থেকে শিপমেন্ট করা হয়েছিল সুপারকণ্ডাক্টিং মিনারেলের চালান। যারা ওটা জাপানি জাহাজে লোড করেছিল, আর যারা সান্তা মারিয়া থেকে বিজ্ঞানীদের অপহরণ করেছে, দুটো একই দল বলে ভাবছি আমরা। কুচিয়ো কর্টেজের দল।’
খটকা লাগছে রানার। ‘কিন্তু সিয়েরা লিওন দুনিয়ার সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটা,’ বলল ও। ‘ওখানকার লোকজন ঠিকমত খেতে-পরতেই পায় না। অথচ আপনি বলছেন, এরাই তৈরি করে বসেছে অ্যাডভান্সড সুপার- কণ্ডাক্টরের সাহায্যে পার্টিকেল অ্যাকসেলারেটর?’
‘ওদের যোগসূত্রের প্রমাণ হিসেবে প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর লাশ রয়েছে আমাদের হাতে, ‘ বললেন ওয়েস্টলেক। ‘তা ছাড়া টাকার অভাব সিয়েরা লিওনের সাধারণ জনগণের থাকতে পারে, ওদের সরকারের নেই। গত কয়েক বছরে প্রচুর বৈদেশিক ঋণ আর সাহায্য পেয়েছে ওরা পশ্চিমা দেশগুলো থেকে। সে-টাকা কোথায়-কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা আমাদের জানা নেই। উদ্বিগ্ন হবার মত আরেকটা ব্যাপারও আছে ওখানে। ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট বলছে, হঠাৎ করে ওখানে মিলিটারি মোবিলাইজেশন শুরু হয়েছে। কিছু একটা করতে চাইছে সামরিক বাহিনী।’
‘বেশ, আপাতত মেনে নিচ্ছি আপনার থিয়োরি,’ বলল রানা। ‘কথা হলো, এখন কী করবেন আপনারা?’
‘কড়া নজরদারি করা হবে সিয়েরা লিওনের ওপর। এতদিন ওদেরকে চোখে চোখে রাখার প্রয়োজন বোধ করিনি আমরা, তবে এবার রাখব।’
‘খুব ভাল। কিন্তু নুমা এখানে কী করতে পারে, তা ঠিক বুঝতে পারছি না।’
‘সাগরের সঙ্গে যোগাযোগ আছে দলটার। সাবমেরিন ব্যবহার করছে। পর্তুগিজ ডাইভাররা সাগরের তলার ওই টাওয়ারটায় ভালমত তল্লাশি চালিয়েছে; ভেতরে টার্বাইন, ব্যাটারি আর শক্তিশালী ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক কয়েল খুঁজে পেয়েছে। ওগুলোর সাহায্যেই সাজানো হয়েছিল ম্যাগনেটিক অ্যানোমেলির ধাপ্পাটা। অমন একটা জটিল কাজের জন্যে অবশ্যই সাবমেরিন লেগেছে ওদের।’
‘সেই সঙ্গে অনেক টাকা,’ বললেন রিয়ার অ্যাডমিরাল কারমেল। ‘একটা ব্যাপার শুধু বুঝতে পারছি না, এত ঝামেলায় গেল কেন ওরা? কাউকে কিডন্যাপ করতে চাইলে এরচেয়ে অনেক সহজ আর সস্তা উপায় আছে।’
‘সেটা দু-একজনের ক্ষেত্রে,’ বলল রানা। ‘সারা দুনিয়া থেকে আপনি যদি নির্দিষ্ট একটা ফিল্ডের বিজ্ঞানীদেরকে কিডন্যাপ করতে শুরু করেন, একটা-দুটো ঘটনার পরেই কেউ না কেউ ব্যাপারটা টের পেয়ে যাবে। সেজন্যেই একটা ফাঁদ পেতে একত্র করা হয়েছে সবাইকে, এক ধাক্কায় অনেক বিজ্ঞানীকে বন্দি করা হয়েছে।’
‘হুম!’
‘আমাদের কাছে কী চাইছেন, তা এখনও পরিষ্কার হলো না,’ ওয়েস্টলেককে বলল মুরল্যাণ্ড।
‘সাবমেরিনটা খোঁজার কাজে সাহায্য চাই আপনাদের,’ বললেন ওয়েস্টলেক। ‘নেভি থেকে একটা টাস্ক ফোর্স গঠন করা হচ্ছে এর জন্যে। আমরা চাই, আপনারা তিনজন ওদের সঙ্গে যোগ দিন। ড. তানিয়া কাজ করবেন অ্যাকুস্টিক্ টিমের সঙ্গে—শত্রুপক্ষের সাবমেরিনের অ্যাকুস্টিক সিগনেচার ডিটেক্ট করার জন্যে।’
‘আর আমরা?’
‘আপনারা দু’জনই সাবমারসিবলের কনস্ট্রাকশন আর অপারেশনে অভিজ্ঞ। তাই আপনাদের পাঠাতে চাইছি সাবমেরিন-হান্টিং গ্রুপের সঙ্গে। বেশ কিছু জাহাজ আর এয়ারক্র্যাফট পাঠাচ্ছি আমরা সাবমেরিনটাকে খুঁজে বের করার জন্যে।’
‘আপনাদের কি মাথা খারাপ হয়েছে?’ বিস্মিত গলায় বলল রানা। ‘আটলান্টিক মহাসাগরের আয়তন চার কোটি বর্গমাইল। এত বড় এলাকায় কীভাবে একটা সাবমেরিন খুঁজে বের করা সম্ভব? এমন তো নয় যে, ধরা পড়ার জন্যে ওরা আমাদের সামনে ঘুরঘুর করবে। খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজাও এর চেয়ে সহজ।’
‘আপনি আমাদের আণ্ডার-এস্টিমেট করছেন, মি. রানা, আহত গলায় বললেন রিয়ার অ্যাডমিরাল কারমেল। ‘আটলান্টিক মহাসাগর চষে ফেলার মত রিসোর্সের অভাব নেই আমাদের।’
‘মানছি। কিন্তু বাকি সব কাজ ফেলে সমস্ত রিসোর্স তো ব্যবহার করবেন না এই একটা কাজে। কী কী পাঠাচ্ছেন, জানতে পারি?’
‘সাতটা ফ্রিগেট আর বিশটা এয়ারক্র্যাফট। সাগরের তলায় বিছানো SOSUS লাইন আর দক্ষিণ আটলান্টিকের সমস্ত লিসেনিং স্টেশনেরও সাহায্য পাব আমরা।’
মন্দ নয়, ভাবল রানা, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ‘আগের হামলাগুলোর সময় SOSUS লাইনে কি কিছু ধরা পড়েছে?’
‘না,’ ইতস্তত করে স্বীকার করলেন কারমেল। ‘আরাতামা মারুর ডুবে যাবার শব্দ রেকর্ড করেছি আমরা। আর গ্রুপারের ওপর হামলার সময় টর্পেডোর বিস্ফোরণ।’
‘তারমানে, সাবমেরিনটাকে আইডেন্টিফাই করার মত কোনও অ্যাকুস্টিক সিগনেচার নেই আপনাদের কাছে। ওটা সোনারে ধরা পড়লেও নিশ্চিত হবার উপায় নেই। আর যদি কোথাও ঘাপটি মেরে থাকে…’
‘এরচেয়ে ভাল কোনও পন্থা যদি আপনার জানা থাকে, মি. রানা, সেটা নির্দ্বিধায় বলতে পারেন,’ বিরক্ত দেখাল ওয়েস্টলেককে।
‘আছে। আমি কুচিয়ো কর্টেজকে খুঁজতে যাচ্ছি। ওকে পেলে এর পেছনে কারা আছে, তা-ও জানা যাবে।’
‘লোকটা একটা ভূত। কোত্থেকে আসে, কোথায় যায়, কেউ জানে না। ইন ফ্যাক্ট, ও যে বেঁচে আছে, এটাই চব্বিশ ঘণ্টা আগ পর্যন্ত নিশ্চিত ছিলাম না আমরা। তাকে আপনি খুঁজে বের করবেন কী করে?’
‘সেটা নাহয় আমার ওপরেই ছেড়ে দিন।’
দাঁতে দাঁত পিষলেন ওয়েস্টলেক। রানার কথায় স্পষ্টতই অসন্তুষ্ট। নুমা ডিরেক্টরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি কিছু বলবেন, অ্যাডমিরাল?’
চেয়ারে হেলান দিলেন অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন। ‘নিশ্চয়ই বলব,’ বললেন তিনি। রানাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি সিরিয়াস? পারবে ওকে খুঁজে বের করতে?’
‘জী, স্যর,’ বলল রানা। ‘কুচিয়োর একজন কন্ট্যাক্টকে চিনি আমি। তাকে ধরলেই…’
‘সে-খবর আপনি সিআইএ-কে দিচ্ছেন না কেন?’ বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ওয়েস্টলেক। ‘ওই লোকের কাছ থেকে তথ্য আদায়ের কাজটা ওরাই করতে পারবে।’
‘সিআইএ তার গায়ে হাত দেবে না,’ শান্ত গলায় বলল রানা। ‘কিন্তু আমার সে-ধরনের বাধ্যবাধকতা নেই।’
‘মানে? কে এই লোক?’
জবাব না দিয়ে হাসল রানা।
অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন বললেন, ‘তা হলে তুমি এখনও বসে আছ কেন? জলদি কাজে নেমে পড়ো।’
‘ইয়েস, অ্যাডমিরাল।’ উঠে দাঁড়াল রানা।
‘এ স্রেফ পাগলামি,’ বললেন ওয়েস্টলেক।
‘ববিকেও নিয়ে যাও,’ যোগ করলেন অ্যাডমিরাল। ‘মানে, ও যদি যেতে চায় আর কী।’
‘সেটা আবার জিজ্ঞেস করতে হয়?’ এক গাল হাসি দিয়ে মুরল্যাণ্ডও উঠে দাঁড়াল।
রাগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছেন ওয়েস্টলেক। হুমকির সুরে বললেন, ‘একটা ফোন করেই আপনাদেরকে ঠেকাতে পারি আমি।’
‘না, পারেন না,’ শীতল গলায় বললেন অ্যাডমিরাল। ‘কারণ, রানা আমেরিকার নাগরিক নয়, আমাদেরকে সাহায্য করছে স্রেফ সৌজন্যের বশে। সেটা বাদ দিলেও নুমার ওপরে এনএসএ-র খবরদারির কোনও সুযোগ নেই। তা ছাড়া রানা আর ববিকে নেভির জাহাজে তুলে বসিয়ে রেখে কোনও কাজের কাজ হবে না। আপনি সেটা করতে চাইছেন সম্পূর্ণ নিজের স্বার্থে, যাতে ওরা কিছু করতে পারলে কৃতিত্বে ভাগ বসাতে পারেন, আর ব্যর্থ হলে দোষটা নিজে না নিয়ে নুমার ঘাড়ে চাপাতে পারেন। আপনার এ-ধরনের রাজনৈতিক এজেণ্ডার অংশ হতে যথেষ্টই আপত্তি আছে আমার।’
ওয়েস্টলেকের চেহারা দেখে মনে হলো, জোঁকের মুখে নুন পড়েছে। রিয়ার অ্যাডমিরাল কারমেলের চেহারাতেও ফুটে উঠল সন্তুষ্টি। সাবমেরিন হান্টিঙের মত একটা মিলিটারি অপারেশনে নুমার দু’জন লোক নিয়ে কী এমন লাভ হবে, তা এমনিতেই বুঝতে পারছিলেন না তিনি।
‘আপনাকে পেলে অবশ্য, মন্দ হয় না, ডক্টর,’ তানিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন কারমেল। ‘আমাদের অ্যাকুস্টিক টিমে আপনার অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে।’
‘আমার আপত্তি নেই,’ নড করে বলল তানিয়া। দরজার কাছে চলে গিয়েছিল রানা ও মুরল্যাণ্ড, ডাক দিয়ে থামালেন অ্যাডমিরাল। ‘একটা কথা, রানা।’
ঘাড় ফেরাল রানা।
‘বুঝে-শুনে কাজ কোরো। মিশনে যাচ্ছ তুমি, প্রতিশোধ নিতে নয়।’
অ্যাডমিরালের কথার মর্মার্থ বুঝতে অসুবিধে হলো না রানার। কর্টেজের বিষয়ে ওর মনোভাব আঁচ করতে পারছেন তিনি, রানার প্রতিশোধ-স্পৃহার ব্যাপারেও জানেন।
নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকিয়ে তাঁকে আশ্বস্ত করল ও। তারপর খুলে ফেলল দরজা। ওপাশে নুমার অল্পবয়েসী এক স্টাফ দাঁড়িয়ে আছে, টোকা দিতে যাচ্ছিল দরজায়। রানাকে দেখে একটু থতমত খেয়ে গেল মেয়েটা।
‘ইয়েস?’
‘একটা জরুরি মেসেজ আছে ড. তানিয়ার জন্যে।’
মেয়েটাকে ভেতরে ঢুকতে দিল রানা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল সবাই।
‘ড. আসিফের জ্ঞান ফিরেছে, ম্যাম,’ বলল সে। ‘আপনাকে দেখতে চাইছেন তিনি।’