1 of 2

ধ্বংসযজ্ঞ – ৩৫

পঁয়ত্রিশ

চার নম্বর ভুয়া অয়েল রিগের হেলিপ্যাডের ধারে দাঁড়িয়ে আছেন প্রেসিডেন্ট আকুম্বা। এই রিগেই রয়েছে তাঁর মারণাস্ত্রের কন্ট্রোল সেন্টার, আর প্রয়োজনের মুহূর্তে সেটাকে নিজের কমাণ্ড পোস্ট হিসেবে ব্যবহার করবেন তিনি। হেলিপ্যাড থেকে তিন ধাপ ওপরে রয়েছে কন্ট্রোল সেন্টারটা। চারপাশ কাঁচ দিয়ে ঘেরা; মূল কাঠামো থেকে খানিকটা বেরিয়ে এসেছে জাহাজের ব্রিজের মত।

এ-মুহূর্তে আকুম্বার মনোযোগ অবশ্য অন্যদিকে। রেলিঙে ঠেস দিয়ে ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, চোখদুটো বরাবরের মত গাঢ় সানগ্লাসের পেছনে লুকানো। তাকিয়ে আছেন হেলিপ্যাডের দিকে, কড়া রোদের মাঝে সেখানে সার বেঁধে দাঁড় করানো হয়েছে অপহৃত বিজ্ঞানীদের। একটা টোপ দিয়েছিলেন তিনি—সুপারকণ্ডাক্টিং মিনারেলের টোপ—আর সেই টোপে ধরা পড়েছে এরা।

মনে মনে নিজের কূটকৌশলের তারিফ করলেন প্রেসিডেন্ট। আত্মতৃপ্তিতে ভরপুর। সবকিছু তাঁর প্ল্যান মোতাবেক এগোচ্ছে।

প্রেসিডেন্টের সামনে পেশ করার জন্যে দাঁড় করানো হচ্ছে বিজ্ঞানীদের। কেউ বসে পড়ার চেষ্টা করলে, বা লাইনচ্যুত হলেই ছুটে যাচ্ছে কুচিয়োর লোকেরা। চড়-থাপ্পড় বা হুমকি দিয়ে সিধে করছে তাদের। হেলিপ্যাডের চারদিকে অস্ত্রহাতে হাঁটছে কয়েকজন, পাহারা দিচ্ছে বন্দিদের।

অবশেষে, বিজ্ঞানীরা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়লেন… যখন কমে এল তাঁদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, আকুম্বার দিকে এগিয়ে এল কর্টেজ।

‘ওদেরকে আর বেশিক্ষণ রোদে দাঁড় করিয়ে রাখলে অসুস্থ হয়ে পড়বে,’ বলল সে। ‘আপনার তো সুস্থ লোক দরকার, নাকি?’

জবাব দিলেন না আকুম্বা। কর্টেজের দিকে না তাকিয়েই বললেন, ‘সান্তা মারিয়ায় সুপারকণ্ডাকশন, পার্টিকেল ফিজিক্স আর ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক এনার্জির ওপরে আটত্রিশজন বিশেষজ্ঞ হাজির হয়েছিল। এখানে আমি তেত্রিশজন দেখতে পাচ্ছি। বাকিরা কোথায়?’

রেলিঙের ওপর দিয়ে সাগরে এক দলা থুতু ফেলল কর্টেজ। তারপর বলল, ‘টাওয়ার থেকে গোপনে একটা কোর স্যাম্পল জোগাড় করেছিল ফরাসি টিমটা। ওটা পরীক্ষা- নিরীক্ষার সুযোগ দিলে আমাদের পুরো প্ল্যান মাঠে মারা পড়ত। তাই ওদেরকে খুন করতে হয়েছে।

‘হুম। চারজনের হিসেব পাওয়া গেল। আরও একজন কম তোমার।’

‘রাশান মেয়েটার কথা বলছেন তো? বিজ্ঞানী-টিজ্ঞানী কিছু না, ছদ্মবেশী একটা স্পাই ছিল ও। দু-দু’বার পালাবার চেষ্টা করেছে। তাই ঝুঁকি নিইনি, ওকেও খতম করে দিয়েছি।’

মুখ ঘুরিয়ে এবার কর্টেজের দিকে তাকালেন আকুম্বা। ‘আর রুফাস?’

‘আপনার ওই চামচাটা নিজের অবস্থান ভুলে গিয়েছিল, ‘ তাচ্ছিল্যের গলায় বলল কর্টেজ। ‘সবার সামনে আমার নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে বসেছিল সে। কী করে সেটা বরদাস্ত করি, বলুন?’

চাপা একটা ক্রোধ অনুভব করলেন আকুম্বা। রুফাসকে পাঠিয়েছিলেন তিনি কর্টেজের ওপর নজর রাখার জন্যে, প্রয়োজনে তার লাগাম টেনে ধরার জন্যে। সন্দেহ নেই, সেজন্যেই প্রথম সুযোগে তাকে খুন করেছে কর্টেজ। ব্যাপারটা বুঝতে পারলেও রাগটা প্রকাশ করলেন না তিনি, কর্টেজের প্রয়োজন এখনও ফুরোয়নি তাঁর কাছে। তাই লোক-দেখানো হাসি হাসলেন। বললেন, ‘ঠিকই বলেছ। এমন বেয়াদবি সহ্য করা মুশকিল।’

রেলিঙের পাশ থেকে সরে এসে হাঁটতে শুরু করলেন তিনি। বন্দিদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন কথা বলার জন্যে। সেখানে যখন পৌঁছুলেন, জুলফি দিয়ে ঘামের সরু ধারা বইতে শুরু করেছে। আসলেই ভীষণ গরম পড়েছে। বিজ্ঞানীদের দেখে মনে হলো, তাঁরা জ্ঞান হারাতে বসেছেন। তাঁদের বেশিরভাগই এসেছেন আমেরিকা, ইয়োরোপ আর জাপানের মত শীতপ্রধান এলাকা থেকে।

চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেললেন আকুম্বা। বন্দিদের সামনে নিজের শক্তি আর দৃষ্টির আগুন প্রদর্শন করতে চাইছেন। ‘আফ্রিকায় স্বাগতম,’ উদাত্ত গলায় বললেন তিনি। ‘আপনারা সবাই জ্ঞানী-গুণী বুদ্ধিমান মানুষ, তাই লুকোচুরি না করে যা বলার সরাসরি বলছি। আমি জোসেফ আকুম্বা—সিয়েরা লিওনের প্রেসিডেন্ট। আজ থেকে আপনারা সবাই আমার হয়ে কাজ করবেন।’

‘কী কাজ?’ ক্রুদ্ধ গলায় জানতে চাইলেন এক বিজ্ঞানী।

বাঁকা চোখে তাঁর দিকে তাকালেন প্রেসিডেন্ট। দেখা যাচ্ছে কর্টেজের লোকেরা এঁদের সবার আগুন নেভাতে পারেনি।

‘একটা পার্টিকেল অ্যাকসেলারেটর তৈরি করেছি আমি,’ বললেন তিনি। ‘সেটার বিস্তারিত স্পেসিফিকেশন দেয়া হবে আপনাদের। এরপর আপনারা সেটাকে কীভাবে, আরও শক্তিশালী করে তোলা যায়, তা বের করবেন। এ-কাজের জন্যে পারিশ্রমিকও দেয়া হবে আপনাদের—কৈশোরে আমি যখন সিয়েরা লিওনের খনিতে কাজ করতাম, সেই রেটে। দৈনিক তিন ডলার।’

ডানদিকে দাঁড়ানো এক মাঝবয়েসী বিজ্ঞানী নড়ে উঠলেন। প্রতিবাদের সুরে বললেন, ‘আপনার হয়ে আমি কোনও কাজ করব না—দিনে তিন ডলারই দিন, বা তিন মিলিয়ন ডলার দিন।’

ভ্রূকুটি করে তাঁর দিকে তাকালেন আকুম্বা। সবার ফাইল মুখস্থ আছে তাঁর, চিনলেন বিজ্ঞানীকে। ড. ফারুক আহমেদ—বাংলাদেশি ফিযিসিস্ট। অবাক হলেন না, বাঙালিরা কেমন স্বাধীনচেতা জাতি, জানা আছে তাঁর। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘বেশ, সেটা আপনার মর্জি। তবে কাজ না করলে এখানে থাকার অধিকার নেই আপনার।’

কর্টেজকে ইশারা করলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে ডা. ফারুকের দিকে এগিয়ে গেল সে। ঘাড় ধরে বিজ্ঞানীকে নিয়ে গেল রেলিঙের কাছে, তারপর চ্যাংদোলা করে নিচে ছুঁড়ে ফেলল।

পড়তে পড়তে চিৎকার করে উঠলেন ডা. ফারুক, আচমকা থেমে গেলেন। হেলিপ্যাড থেকে একশো বিশ ফুট নিচে পানি, সেখানে আছড়ে পড়েছেন।

‘খোঁজ নাও, বেঁচে আছে না মরে গেছে,’ কর্টেজকে বললেন আকুম্বা। ‘বাঁচলে আরেকবার জিজ্ঞেস কোরো, প্রস্তাবে রাজি আছে কি না। নইলে…’

কর্টেজের দু’জন অস্ত্রধারী লোক সিঁড়ি ধরে নেমে গেল নিচে। বিজ্ঞানীরা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে রইলেন রেলিঙের দিকে, যেখান থেকে ফেলে দেয়া হয়েছে বাংলাদেশি বিজ্ঞানীকে। বুঝতে পারছেন, আর ফিরে আসবেন না তিনি বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ, বাঁচলেও প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবে রাজি হবার, বা কাজে ফেরার মত অবস্থায় থাকবেন না তিনি। ভয়ঙ্কর সত্যটা টের পেয়ে মুখে হাতচাপা দিল কেউ, আবার কেউ বসে পড়ল হাঁটু গেড়ে।

,

‘কাজের কথায় ফেরা যাক, প্রসন্ন গলায় বললেন আকুম্বা, বেয়াড়া বিজ্ঞানীকে শাস্তি দিতে পেরে সন্তুষ্ট; আর কেউ বিরোধিতা করবে না তাঁর। ‘কীভাবে কাজ করবেন, আর বিনিময়ে কী পাবেন, তা ব্যাখ্যা করছি। আশা করি খুশি হবেন সবাই, কাজের উৎসাহ পাবেন। চারটা গ্রুপে ভাগ করা হবে আপনাদেরকে। একই কাজ দেয়া হবে সবাইকে। সমস্যাটার সেরা সমাধান যে-গ্রুপ আবিষ্কার করবে, তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখা হবে।’

ঝট্ করে তাঁর দিকে ঘুরে গেল সবার চোখ। দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে।

‘ঠিক শুনেছেন,’ বললেন আকুম্বা। ‘সেরা গ্রুপের সবাই বেঁচে যাবে, আর বাকি গ্রুপের সবাই যাবে স্বর্গে।’

কর্টেজের লোকেরা এগিয়ে এল, ভাগ করতে শুরু করল বিজ্ঞানীদের।

‘আরেকটা ব্যাপার, ‘ যোগ করলেন প্রেসিডেন্ট, ‘আপনাদের প্রাথমিক সমাধান আমি বাহাত্তর ঘণ্টার ভেতর চাই। অন্যথায় প্রত্যেক গ্রুপ থেকে একজন করে খুন হবে। বাকিদের নিয়ে আবার প্রথম থেকে কাজ শুরু করব আমি এভাবেই চলতে থাকবে, যতক্ষণ না আপনারা সমাধানটা আবিষ্কার করতে পারছেন।’

তাজ্জবের দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন বিজ্ঞানীরা। মুখে হাসি ফুটিয়ে তাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলেন আকুম্বা। প্রাণভয়ে ভীত চেহারাগুলো দেখে বুঝতে পারছেন, সবাই না হোক, অধিকাংশই কাজ করবে প্রাণ বাজি রেখে, সর্বস্ব ঢেলে দেবে প্রত্যাশিত সমাধানের খোঁজে।

চার দলে ভাগ করা হলো বিজ্ঞানীদের-একেক দলে আটজন। অস্ত্রের মুখে ঠেলাধাক্কা দিয়ে তাঁদের সরিয়ে নেয়া হলো হেলিপ্যাড থেকে। রয়ে গেলেন শুধু প্রেসিডেন্ট আকুম্বা, কর্টেজ, আর সিয়েরা লিওন আর্মির ইউনিফর্ম পরা একজন জেনারেল। বিজ্ঞানীরা এলিভেটরের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেলে সঙ্গীদের দিকে ফিরলেন প্রেসিডেন্ট।

‘কুচিয়ো, নর্দার্ন স্টারে ফিরে যাও,’ নির্দেশ দিলেন তিনি। ‘জাহাজটাকে যত দ্রুত সম্ভব ওর পজিশনে নিয়ে যাবে।’

মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল কর্টেজ। এবার জেনারেলের দিকে ফিরলেন আকুম্বা।

‘অপারেশন পাইথন শুরুর সময় এসে গেছে, বন্ধু, ‘ বললেন তিনি। ‘এবার আমাদের ন্যায্য সম্পদ পুনরুদ্ধারের পালা।’

মৃদু হেসে প্রেসিডেন্টকে স্যালিউট ঠুকলেন জেনারেল। তারপর চলে গেলেন বুটের মচমচ শব্দ তুলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *