বত্রিশ
হ্যাণ্ডকাফের শেকল ধরে এক ঝটকায় রানাকে টেনে দাঁড় করাল দু’জন অস্ত্রধারী।
‘তোমাকে কিছু দেখানো দরকার, রানা,’ বলল কর্টেজ। ইয়টের দিকে ফিরে হাতের ইশারা করল।
ইঞ্জিনের একটা ছোট্ট ধাক্কায় সামান্য আগে বাড়ল ইয়টটা, পাওয়ারবোটের বরাবরে চলে এল আফট ডেক। খোলা আকাশের নিচে সেখানে জনাত্রিশেক মানুষকে বসে থাকতে দেখা গেল। বিভিন্ন জাতির, বিভিন্ন বয়সের মানুষ-নারী-পুরুষ দু’রকমই আছে। হাত-পায়ে শেকল পরানো সবার, অস্ত্র হাতে কয়েকজন মার্সেনারি পাহারা দিচ্ছে ওদেরকে। মানুষগুলোকে চিনতে পেরে হতাশায় ছেয়ে গেল রানার অন্তর। সারা দুনিয়া থেকে ছুটে আসা বিজ্ঞানী এঁরা—পাথরের টাওয়ারের ম্যাগনেটিজম স্টাডি করতে এসেছিলেন। নেপচুনে খবর পাঠিয়ে কোনও লাভ হয়নি, তার আগেই সবাইকে ধরে এনেছে কর্টেজের লোকেরা।
বন্দিদের মাঝে বাংলাদেশি দুই বিজ্ঞানী আছেন, আর আছে লামিয়া—মুখের একপাশে কালশিরে ফুটে উঠেছে ওর। এক পলকের জন্যে রানার চোখে চোখ পড়ল ওর, দৃষ্টিতে ফুটে উঠল বেদনা আর আকুতি।
রক্ত মেশানো একদলা থুতু ফেলল রানা। ‘এসবের মানে কী, কুচিয়ো?’ ক্রুদ্ধ গলায় বলল ও। ‘কী করছ তুমি এখানে?’
‘অবশেষে আমাকে চিনতে পেরেছ দেখে খুশি হলাম, ‘ বলল কর্টেজ। ‘তবে এতটা সময় নিলে দেখে একটু অপমানিতও বোধ করছি। আমার ধারণা ছিল, একবার পরিচিত হলে কেউ সহজে ভোলে না আমাকে।’
‘আমি জানতাম তুমি মারা গেছ।’
‘বালাই ষাট! মরতে যাব কেন? আমার জীবনরেখা অনেক লম্বা।’ হাসল কর্টেজ। ‘অবশ্য আমিও একটু দেরি করেছি তোমাকে চিনতে। সাগরের মাঝখানে তোমাকে আশা করিনি কিনা!’
টানটান হয়ে গেল রানার দেহ, পারলে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় লোকটার ওপর। বন্দি বিজ্ঞানীর দল, লামিয়ার মুখে আঘাতের চিহ্ন, আর কুচিয়োর উদ্ধত কথাবার্তা সহ্য হচ্ছে না। হাতের বাঁধনটা না থাকলে নির্ঘাত খুন করত শয়তানটাকে।
রানার চারপাশে একপাক ঘুরে এল কর্টেজ, শান্ত চোখে মাপছে ওকে। ‘নুমার সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে, জানতাম। তাই শুরুতেই আন্দাজ করা উচিত ছিল, আমার কাজে যে-লোকটা বাগড়া দিচ্ছে, সে তুমি ছাড়া আর কেউ না। মাসুদ রানা… ন্যায়ের অবতার। কোথাও গোলমালের আভাস পেলেই নাক গলানো চাই। গতকালই সেজন্যে খতম করতে চেয়েছিলাম তোমাকে, পারলাম না। পরে মনে হলো, তোমার মত ছোঁকছোঁকে লোক নির্ঘাত এখানে হাজির হবে, তাই ফাঁদ পাতলাম। ভুল করিনি, দেখতেই পাচ্ছ।’
‘নিজের গুণগান এখন না-করলে হয় না?’ বিরক্ত গলায় বলল রানা। ‘একশো বছরের নির্জন কারাবাসে যখন পাঠানো হবে তোমাকে, আপনমনে বকবক করার অনেক সময় পাবে।’
‘নির্জন কারাবাস?’ মুখ বাঁকা করল কর্টেজ। ‘খুব অন্যায়! আমি যখন তোমাকে সাগরের তলায় পাঠাব, অন্তত একা পাঠাব না।’ ওর মুখের কাছে মুখ আনল সে। ফিসফিসাল, ‘হ্যাঁ, রানা, মাছের খাবার হতে চলেছ তুমি। আর আমি হতে চলেছি রাজা!’
তার চোখদুটোয় অশুভ দ্যুতি দেখতে পেল রানা। কী মতলব এঁটেছে কে জানে। নিজের জন্যে নয়, লামিয়ার জন্যে ভয় হলো রানার। সে-ভয়টাকে সত্য প্রমাণ করার জন্যেই বোধহয় লাফ দিয়ে ইয়টের পেছনে উঠে পড়ল কর্টেজ। লামিয়ার কাছে গিয়ে চুল ধরে টেনে দাঁড় করাল তাকে।
‘গতকাল অনেক ভুগিয়েছ আমাকে, মেয়ে। এবার তোমার ভোগান্তির পালা,’ বলল কর্টেজ। নিজের অনুচরদের দিকে তাকাল। হুকুম দিল, ‘মাসুদ রানাকে তার সাবমেরিনে ওঠাও।’
তিনজন মার্সেনারি এগিয়ে এল—দু’জন শ্বেতাঙ্গ, অন্যজন আফ্রিকান। রানাকে বলতে গেলে ছুঁড়ে ফেলল হ্যামারহেডের ককপিটের ভেতর।
‘রুফাস,’ আফ্রিকান লোকটাকে ডাকল কর্টেজ, ‘লিফট বারের সঙ্গে আটকাও ব্যাটাকে।’
কার্বন স্টিলে তৈরি বারটার দিকে তাকাল রানা। তোয়ালে ঝোলানোর র্যাকের মত দেখতে, ককপিটের ঠিক বাইরে। সাবমারসিবলের মূল ফ্রেমের একটা অংশ, পুরো কাঠামোর সবচেয়ে শক্ত জায়গা, এমনভাবে বানানো হয়েছে যাতে জলযানটার পুরো ওজন বইতে পারে। পানি থেকে হ্যামারহেডকে তোলার সময় ওটার সঙ্গে আটকানো হয় ক্রেনের হুক। এ-জিনিস ভেঙে কারও পক্ষে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।
গলায় ঝোলানো একটা চাবি খুলে হাতে নিল রুফাস। এগিয়ে এসে খুলে দিল রানার হাতের হ্যাণ্ডকাফ। সঙ্গে সঙ্গে কনুই চালাল ও। শ্বেতাঙ্গ এক মার্সেনারির পাঁজরে লাগল আঘাত, কাতরে উঠল সে। পরক্ষণে শটগানের বাট দিয়ে ওর ঘাড়ে বাড়ি মারল অন্যজন। চোখে আঁধার দেখল রানা, তাল হারিয়ে ঝুপ করে পড়ল ককপিটের ভেতর, কপাল বাড়ি খেল ফ্রেমের গায়ে। আধো-অচেতন অবস্থায় টের পেল, লিফট বারের তলা দিয়ে হ্যাণ্ডকাফটা ঘুরিয়ে এনে আবার আটকে দেয়া হলো ওর হাতে।
‘এবার ওর দোস্তের পালা,’ বলল কুচিয়ো।
মুরল্যাণ্ড বাধা দিল না। শান্ত ভঙ্গিতে নামল ককপিটে রুফাস ওর হ্যাণ্ডকাফও আটকে দিল লিফট বারের সঙ্গে।
ঘোর কেটে গেছে রানার। সোজা হয়ে বসল। দেখল, একটা রাইফেল তুলে নিয়েছে কর্টেজ। ওর ওপর থেকে চোখ না সরিয়েই একটা হাত পেতে দিল পাশে। ‘অ্যামিউনিশন!’
তাড়াতাড়ি একটা প্যাকেট তুলে দেয়া হলো তার হাতে। চেম্বারে কয়েকটা হাই পাওয়ার বুলেট ভরল সে। এরপর রাইফেল কক করে এগিয়ে এল সামনে। সাবমারসিবলের ইমপেলার তাক করে দুটো গুলি ছুঁড়ল প্রথমে, তৃতীয় গুলিতে ফুটো করে দিল স্টারবোর্ড সাইডের উইং। পানির কলকল ধ্বনি শুনতে পেল রানা। ফাঁপা উইং আর কাঠামোর ভেতরে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। আরেকবার ট্রিগার চাপল কর্টেজ, এবার ফুটো হয়ে গেল পোর্ট সাইডের উইং।
কী করবে ভেবে পাচ্ছে না রানা। এখুনি ডুবে যাবে ওরা, পানির তলায় অপেক্ষা করছে যন্ত্রণাদায়ক নিশ্চিত মৃত্যু। রাগে চেঁচিয়ে উঠল ও, ‘ভেবেছ আমাদেরকে খুন করলেই সব চুকেবুকে যাবে? তোমার ব্যাপারে শুধু আমরা নই, নুমার সবাই জানে।’
মুরল্যাণ্ড কিছু বলল না। বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে সে, ফুসফুস ভরিয়ে তুলছে বাতাসে – পানিতে ডুব দেবার প্রস্তুতি। রানা বুঝতে পারছে, ওর নিজেরও তা-ই করা উচিত, কিন্তু ঠেকাতে পারছে না নিজেকে। নিঃশব্দে মৃত্যুকে বরণ করে নেবে না ও।
উইংদুটোর ভেতরে পানি ভরে যেতেই তলাতে শুরু করল হ্যামারহেড। মাথা খাটাল রানা, এমন কিছু বলা দরকার, যাতে খানিকটা সময়ের জন্যে থমকে যায় কর্টেজ। জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে হলেও বাঁচিয়ে রাখে ওদেরকে।
‘তোমার সাবমেরিনটার খবর জানি আমরা,’ চেঁচাল ও। একটা ভুরু উঁচু করল কর্টেজ। ‘তাই নাকি? যতটা ভেবেছি, তার চেয়ে বেশিই জানো তা হলে। তবে ব্যাপার হলো কী, সাবমেরিনটার আসল মালিক আমি নই।’
মনোযোগ আকর্ষণ করা গেছে লোকটার। একটু আশাবাদী হলো রানা। বলল, ‘তোমাদের প্ল্যান আমরা জানি। এনার্জি ওয়েপনের খবরও জানা আছে আমাদের।’
‘বলো কী!’ জ্বলজ্বল করে উঠল কর্টেজের চোখ। ‘হায়, হায়, অনেক কিছুই তো জেনে ফেলছ দেখছি! তারপর? বলো, বলো, আর কী জেনেছ?’
ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপের এক টুকরো হাসি ঝুলে আছে লোকটার। রানা বুঝল, আসলে ওকে উপহাস করছে সে।
ওকে চুপ করে থাকতে দেখে রুফাসকে কাছে ডাকল কর্টেজ। গলা থেকে টান দিয়ে খুলে নিল হ্যাণ্ডকাফের চাবিটা। রানার উদ্দেশে বলল, ‘কই, আমি অপেক্ষা করছি, রানা। জলদি কিছু বলো। বুঝিয়ে দাও, তোমাকে বাঁচিয়ে রাখা আমার জন্যে কতটা জরুরি।’
‘জাহান্নামে যাও, কুচিয়ো!’ গাল দিয়ে উঠল রানা।
লামিয়াকে নড়ে উঠতে দেখল ও। রেলিঙের কাছে ছুটে আসার চেষ্টা করছে। একজন মার্সেনারি ওর চুল টেনে ধরল, তারপর ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল ডেকে। দৃশ্যটা দেখে রক্ত গরম হয়ে উঠল ওর।
‘সময় ফুরিয়ে আসছে, রানা,’ বলল কর্টেজ। কোমর থেকে বের করে আনল পরিচিত ছুরিটা। সুতো-সহ চাবিটা পেঁচিয়ে বাঁধল হাতলের সঙ্গে। ‘শেষ সুযোগ।’
হ্যামারহেডের উইঙের ওপরে উঠে এসেছে পানি, আর কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই ককপিটে ঢুকতে শুরু করবে।
‘ওয়াইবিসিও-র খবর জানি আমরা,’ শেষবারের মত চেষ্টা করল রানা, যদিও জানে, তাতে লাভ নেই কোনও। ধাপ্পা দেয়ার চেষ্টা করল, ‘কে ওটা তোমাদের কাছে বিক্রি করেছে, তা-ও। ফ্রিটাউন থেকে আরাতামা মারুতে লোড করা হয়েছিল কার্গোটা।’
কপালে ভাঁজ পড়ল কর্টেজের। এক মুহূর্তের জন্যে তাকিয়ে রইল রানার দিকে। তারপরেই রুফাসের দিকে তাকিয়ে সশব্দে হেসে উঠল। ‘দারুণ! অনেক কিছুই জানে দেখছি। এর পুরস্কার দিতে হয়, কী বলো? অন্তত অর্ধেক পুরস্কার।’
হাত উঁচু করল সে, ছুরিটা ছুঁড়ে দিল হ্যামারহেডের দিকে। সাবমারসিবলের গায়ে বিঁধে গেল ওটা, রানার নাগালের ঠিক বাইরে। চাবিটা ঝুলছে হাতলের সঙ্গে।
জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করল কর্টেজ। ‘দুর্ভাগ্য, রানা, অর্ধেক পুরস্কারে জীবন বাঁচবে না তোমাদের দু’জনের।’
ককপিটে কলকল করে ঢুকতে শুরু করল পানি। পাক খেতে শুরু করল রানার পায়ের কাছে। ডুবে যাচ্ছে ওরা।
মুরল্যাণ্ডের দিকে ঘাড় ফেরাল রানা। ‘যা-ই ঘটুক, আমি যা করি তা-ই কোরো।’
মাথা ঝাঁকাল মুরল্যাণ্ড। বড় করে শ্বাস নিল রানা। পরক্ষণে নাক নিচু হয়ে গেল হ্যামারহেডের, পানিতে আলোড়ন তুলে অদৃশ্য হয়ে গেল সাগরের গভীরে। চোখের সামনে থেকে সূর্যের আলো অদৃশ্য হয়ে গেল রানার। শেষ যে-শব্দটা শুনল, তা লামিয়ার কণ্ঠ থেকে। রানার নাম ধরে চেঁচিয়ে ডাকছে ও।