ত্রিশ
কয়েক ঘণ্টা আগে, রানা ও মুরল্যাণ্ড যখন হ্যামারহেডকে নিয়ে লিবার্টি শিপটার পাশে ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করছে, লামিয়া লিভানোভা তখন নিজের হোটেলের কামরায় সুটকেস গোছাচ্ছে। মেজর ইভান রাবিনোভিচ পাহারা দিচ্ছে তাকে। পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নেয়ায় মিশন বাতিল করার সিদ্ধান্ত এসেছে হাই কমাণ্ড থেকে।
‘মাসুদ রানার সঙ্গে রোমান্টিক্যালি জড়িয়ে গেছেন আপনি,’ হঠাৎ বলল রাবিনোভিচ। গলায় অসন্তোষের সুর।
‘পারলাম কই?’ হালকা গলায় বলল লামিয়া। ‘বেরসিকের মত মাঝখানে এসে আপনি উদয় হলেন।’
‘এসবের জন্যে আপনাকে পাঠানো হয়নি এখানে।’
সোজা হয়ে মেজরের দিকে ফিরল লামিয়া! বলল, ‘ডাইভ এরিয়ার দায়িত্বে রয়েছে রানা। ভাবছিলাম, ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পারলে কিছু সুযোগ-সুবিধে পাব। খুব কি অন্যায় হয়েছে সেটা?’
সন্দেহের চোখে ওর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল রাবিনোভিচ, তারপর হাসল। মনে হলো যেন মেঘ কেটে গেল তার রুক্ষ চেহারা থেকে। ‘চমৎকার জবাব,’ বলল সে। ‘সত্য বলে থাকুন, বা মিথ্যে… এটুকু পরিষ্কার যে আপনি গুপ্তচরবৃত্তি শিখতে শুরু করেছেন।’
তার উদ্দেশ্যে বাঁকা এক টুকরো হাসি হাসল লামিয়াও। নাহ্, যতটা রসকষহীন মনে হচ্ছিল, মেজর আদপে তা নয়। নিচু হয়ে আবারও সুটকেস গোছাতে শুরু করল সে।
দরজায় টোকা পড়ল।
লামিয়ার সঙ্গে চোখাচোখি করল রাবিনোভিচ। তারপর জ্যাকেটের ভেতরে গোঁজা ম্যাকারভ পিস্তলটায় একটা হাত রেখে এগিয়ে গেল দরজার দিকে।
.
কামরার বাইরে, হলওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন লোক। প্রথমজন তুলনামূলকভাবে খাটো, মাথায় কালো চুল; টেলিস্কোপের মত একটা যন্ত্র দরজার পিপহোলে ঠেকিয়ে চোখ লাগিয়ে রেখেছে সে। দ্বিতীয়জন খানিকটা লম্বা, ঠোঁটের ওপরে মোটা গোঁফ, দাঁড়িয়ে আছে সঙ্গীর পেছনে। হাতে পাইপের মত একটা জিনিস ধরে রেখেছে, পাইপটার মাথায় জমে আছে বরফ-কোমরে বাঁধা ব্যাটারি প্যাকের সঙ্গে সংযোগ দেয়া আছে ওটার।
‘মুভমেন্ট দেখতে পাচ্ছি,’ বলল প্রথমজন। ‘লোকটা এগিয়ে আসছে। তিন সেকেণ্ড।’
স্কোপ নামিয়ে দরজা থেকে সরে গেল সে। এবার দ্বিতীয়জন এগিয়ে গেল। পাইপসদৃশ অস্ত্রটা ঠেকাল দরজার পাল্লায়।
‘কে?’ দরজার ওপাশ থেকে ভেসে এল রাশান মেজরের ভারিক্কি কণ্ঠ। ‘কী চাই?’
‘এবার!’ চাপা গলায় বলল খাটো লোকটা।
একটা বোতাম চাপল দ্বিতীয়জন। শোনা গেল গুঞ্জন, তারপর একটা ধাক্কার আওয়াজ। পাইপের যে-প্রান্তটা দরজার গায়ে ঠেকানো, তার চারপাশে ছিটকে উঠল ভাঙাচোরা কাঠের টুকরো। অস্ত্রটা আসলে একটা ছোট রেইল-গান—সুপারকণ্ডাক্টিং ম্যাগনেট ওটাকে শক্তি জোগায়। প্রজেক্টাইল হিসেবে ভেতরে ভরা হয়েছে একটা দু’পাউণ্ড ওজনের লোহার শিক। বোতাম চাপতেই সেটা একশো মাইল বেগে বেরিয়ে এসেছে পাইপের মাথা দিয়ে। দরজার পাল্লা আর ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেজরকে গেঁথে ফেলার জন্যে সেটা যথেষ্টর চেয়ে বেশি।
কাতর একটা আর্তনাদ শোনা গেল ওপাশে। দু’পা পিছিয়ে গেল দীর্ঘদেহী দুর্বৃত্ত। সজোরে লাথি মারল দরজায়। ডোরনব ভেঙে গেল, খুলে গেল বিধ্বস্ত দরজাটা।
.
বিদঘুটে একটা আওয়াজ শুনে মুখ তুলে তাকাল লামিয়া। বিস্ফারিত চোখে দেখল, রুমের ভেতরে উড়ছে কাঠের কণা। পেছনদিকে হোঁচট খেল মেজর রাবিনোভিচ, দু’হাতে আঁকড়ে ধরেছে পেট, সেখানে গেঁথে রয়েছে একটা লোহার শিক। রক্তে ভিজে যাচ্ছে শার্ট। কাতর একটা আওয়াজ করে চিৎ হয়ে পড়ল সে।
ক্ষণিকের জন্যে স্থবির রইল লামিয়া, তারপরেই ছুটে গেল রাবিনোভিচের পাশে। ত্রস্ত হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে তার জ্যাকেটের ভেতর, পিস্তলটা খুঁজছে। তখুনি ভোঁতা আওয়াজ তুলে খুলে গেল দরজাটা। পিস্তলের বাট হাতে ঠেকল ওর, এক টানে বের করে আনল ওটা। সেফটি ক্যাচ অফ করতে করতে ঘোরাল দরজার দিকে। তবে দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে।
মুখের একপাশে বুটের একটা লাথি খেল লামিয়া। ঝট করে একদিকে ঘুরে গেল মাথা। চোখের সামনে ফুটে উঠল এক ঝাঁক তারা। ভারসাম্য হারিয়ে কাত হয়ে গেল ও, হাতের মুঠো থেকে খসে পড়ল পিস্তল।
কেউ একজন চেপে বসল ওর ওপরে। বাধা দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করল ও, লাভ হলো না। ক্লোরোফর্মে ভেজা একটা কাপড় চেপে ধরা হলো ওর নাকে-মুখে। সারা শরীর অসাড় হয়ে গেল লামিয়ার, এরপর আঁধার হয়ে গেল দুনিয়া।