ষোলো
ভূমিধসের আওয়াজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে থরথর করে কাঁপছে গ্রুপার। টর্পেডোর বিস্ফোরণে ডুবোপাহাড়ের ওপরের অংশ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, ঢাল ধরে আরাতামা মারুর দিকে ঢেউয়ের মত নেমে আসছে পাথর, বালি আর মাটি। প্রচণ্ড ধাক্কায় সরিয়ে দিচ্ছে পানি, তৈরি করছে নিজস্ব একটা স্রোত। মুহূর্তেই কাদায় ঘোলা হয়ে গেল চতুর্দিক, সাবমারসিবলের আলোয় ধূসর একটা মেঘ দেখা গেল, ঢেকে দিচ্ছে সবকিছু।
‘এখনও বসে আছ কেন?’ স্বামীর উদ্দেশে চেঁচাল তানিয়া।
ঠোঁট কামড়াল আসিফ। কী ধরনের জাহাজ থেকে টর্পেডো ছোঁড়া হয়েছে কে জানে, ওটা এখনও ওদের অপেক্ষায় বসে থাকতে পারে। আড়াল থেকে বেরুলেই হয়তো আবার টর্পেডো মারবে। রীতিমত উভয়সঙ্কট! হয় টর্পেডোর আঘাতে মরো, নয়তো ভূমিধসে চাপা পড়ে।
যা হয় হবে ভেবে ব্যালাস্টের সুইচ টিপল ও, ফেলে দিল সব ওজন। এরপর থ্রটল বাড়িয়ে নাক উঁচু করল গ্রুপারের। লাভ হলো না। তীব্র স্রোতের ফাঁদে আটকে গেছে সাবমারসিবল। ওপরে তো উঠলই না, বরং আবারও বাড়ি খেল জাহাজের ডেকে।
ফুল থ্রটল দিল আসিফ, এবার ধীরে ধীরে আগে বাড়ল গ্রুপার। কিন্তু কিছুদূর গিয়েই হ্যাঁচকা টান খেয়ে থমকে’ দাঁড়াল।
‘কিছু একটা আটকে রেখেছে আমাদের,’ বলল তানিয়া। পোর্টহোল দিয়ে বাইরে উঁকি দিল, বোঝার চেষ্টা করছে জিনিসটা কী।
রিভার্সে থ্রটল দিল আসিফ, খানিক পিছিয়ে মুখ ঘোরাল গ্রুপারের, তারপর আবার ওঠার চেষ্টা করল। এবারও সেই একই কাণ্ড—কিছুদূর যেতেই হ্যাঁচকা টান খেয়ে থেমে গেল গ্রুপার।
সামনের ভিউয়িং পোর্টে তাণ্ডব দেখতে পাচ্ছে ওরা। পাথর আর মাটির ঢল নেমে আসছে আরাতামা মারুর ডেকে। ক্ষতবিক্ষত সুপারস্ট্রাকচারের অনেকখানি অংশ যেন ছিঁড়ে চলে গেল। গুমগুম আওয়াজটা পরিণত হলো গগনবিদারী গর্জনে।
ঘন কাদার একটা ঢেউ এসে ধাক্কা দিল সাবমারসিবলের গায়ে। সঙ্গে সঙ্গে আঁধার হয়ে গেল সব। ধাতব কিছু একটা ছিঁড়ে গেল, গড়াতে শুরু করল গ্রুপার। তানিয়ার ভাইজর-সহ বিভিন্ন জিনিস পিছলে গেল মেঝের ওপর দিয়ে, দেয়ালে গিয়ে পড়ল, সেখান থেকে পড়ল ছাতে। কন্ট্রোল প্যানেল আঁকড়ে ধরে রেখেছে আসিফ, কিন্তু তানিয়া ধরার মত কিছু পাচ্ছে না। দেয়ালে গিয়ে বাড়ি খেল ও, এরপর আছড়ে পড়ল ছাতে।
উল্টে গেছে সাবমারসিবল, ক্ষণিকের জন্যে স্থির হলো। হাত বাড়িয়ে তানিয়াকে কাছে টেনে নিল আসিফ।
‘আমাকে ধরে থাকো।’
তানিয়া ওকে আঁকড়ে ধরতে না ধরতে আবার গড়াতে শুরু করল গ্রুপার। কাদা আর তীব্র স্রোত গ্রুপারকে নিয়ে আবাহনী-ব্রাদার্সের মত খেলছে ফুটবল। ধাম করে কী যেন একটা ভিউয়িং পোর্টের বাইরে বাড়ি খেল, পরক্ষণে স্রোতের তোড়ে ভেসে গেল। ভেতরে ক্রমাগত বাড়ি খাচ্ছে স্বামী-স্ত্রী, কখনও নিজেদের সঙ্গে, কখনও দেয়াল বা ইকুইপমেন্টের সঙ্গে। সব বাতি নিভে গেল। সাবমারসিবলের বাইরে থেকে ভেসে আসা ধাতব খসখসানি থেমে গেল বিকট একটা আওয়াজের সঙ্গে।
এরপরেই থেমে গেল সব।
গুমগুম আওয়াজটা আরও কিছুক্ষণ শোনা গেল—ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে, যেন একদল পাগলা ঘোড়া ওদের মাড়িয়ে চলে গেছে দিগন্তের পানে।
দম আটকে অপেক্ষা করছে আসিফ। বিশ্বাস করতে পারছে না, ওরা বেঁচে আছে!
অন্ধকারে তানিয়ার শ্বাস ফেলার শব্দ পেল ও-হাঁপাচ্ছে। ওর বুকের ভেতরেও পাগলের মত লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড, শিরায়- উপশিরায় বইছে অ্যাড্রেনালিনের প্রবাহ। কেউ কোনও কথা বলল না, যেন শব্দ করলেই আরেক দফা ভূমিধস নামবে। নীরবতায় দীর্ঘ কয়েক মিনিট কেটে যাবার পর, যখন বোঝা গেল বিপদ কেটে গেছে, নড়ে উঠল তানিয়া।
ইমার্জেন্সি লাইটিঙের আবছা আলোয় স্বামীর দিকে তাকাল সে। চেহারা দেখে বোঝা গেল, বেঁচে আছে দেখে আসিফের মত ও-ও বিস্মিত।
‘কোথাও লিক হয়েছে?’
চারদিকে তাকাল আসিফ। ‘না, তেমন কিছু দেখছি না।’
ওকে ছেড়ে দিল তানিয়া। ‘বাড়ি ফেরার পর মনে করিয়ে দিয়ো, যে-ই সাবমারসিবলটা বানিয়ে থাকুক, এক বোতল স্কচ পাওনা হয়েছে তার।’
হাসল আসিফ। ‘শুধু স্কচ? আমি তো ভাবছি লোকটাকে নোবেল পুরস্কার দিয়ে দেব!’
তানিয়াও হাসল। কন্ট্রোল প্যানেলের রিডিং চেক করল আসিফ। বেকায়দা ভঙ্গিতে পড়ে আছে গ্রুপার। পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি নিচু হয়ে আছে নাক, পাশে কাত হয়ে আছে ত্রিশ ডিগ্রি।
‘মেইন পাওয়ার অফ হয়ে গেছে,’ জানাল ও। ‘তবে ব্যাটারিগুলো কাজ করছে ঠিকমত।’
‘পাওয়ার ফিরিয়ে আনা যায় কি না দেখো।’ জলকন্যার গিয়ার চেক করছে তানিয়া।
সব সুইচ অফ করে দিল আসিফ। তারপর রিস্টার্ট করল পুরো সিস্টেম। আস্তে আস্তে সবকিছুই চালু হলো। ব্যাকআপ লাইনের সাহায্যে বাতিগুলোয় পাওয়ার সাপ্লাই করল। আলোকিত হয়ে উঠল সাবমারসিবলের অভ্যন্তর।
‘বাইরের কী অবস্থা দেখা যাক…’
বলতে বলতে থমকে গেল ও। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তানিয়া। মাথা ঘুরিয়ে ও-ও তাকাল।
ভিউয়িং পোর্টের ওপর চেপে বসে আছে কাদা। কাঁচের ওপর আঁকা স্যাণ্ড পেইন্টিঙের মত লাগছে। অর্থটা পরিষ্কার।
‘কাদায় তলিয়ে গেছি আমরা,’ ফিসফিস করে বলল তানিয়া। ‘সেজন্যেই হঠাৎ থেমে গেছে সব শব্দ। আসিফ, জ্যান্ত কবর হয়ে গেছে আমাদের!’