1 of 2

ধ্বংসযজ্ঞ – ১৩

তেরো

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে অ্যাযোর্সে। পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়েছে সূর্য। লালচে হয়ে উঠেছে আকাশ, নিচে দীর্ঘ হচ্ছে ছায়া। বাতাসও হয়ে উঠছে আর্দ্র। কোমল আলোয় স্থির হয়ে আছে সাগরের পানি, ঢেউ-টেউ কিচ্ছু নেই—মনে হচ্ছে অস্তগামী সূর্য বুঝি হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে দুরন্ত সমুদ্রকে।

নেপচুনের পোর্ট সাইডের রেলিঙে ভর দিয়ে প্রকৃতির সুধা পান করছে রানা, মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে নানা চিন্তা। এক্সপি- ফোরকে উদ্ধারের পর কেটে গেছে দু’দিন, এর ভেতর ঘটে গেছে অনেক কিছু। জনসমক্ষে রানা ও মুরল্যাণ্ডকে ধন্যবাদ জানিয়েছে পর্তুগিজ কর্তৃপক্ষ, পরে আবার আড়ালে ডেকে দিয়েছে হুমকি। উদ্ধার অভিযানের কয়েক ঘণ্টা পরে আবারও নিচে নেমেছিল ওরা, নেপচুনও এসে পজিশন নিয়েছে ডুবন্ত জ্বালামুখটার কাছাকাছি। পর্তুগিজদের অনুমতি নেয়া হয়নি, আর তাতেই যত বিপত্তি। বলে দেয়া হয়েছে, বিনা- অনুমতিতে আর যেন নিচে না যায় ওরা… রেকগুলো থেকে যেন কিছু সরাবার চেষ্টা না করে। অপমানজনক একটা ব্যাপার। ভাবখানা এমন, যেন সুযোগ পেলেই ওরা নিচ থেকে কিছু চুরি করে নিয়ে যাবে।

ইতিমধ্যেই নানা রকম বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে সদ্য-আবিষ্কৃত আণ্ডারওয়াটার গ্রেভইয়ার্ড-এর ব্যাপারে। পর্তুগিজ কর্তৃপক্ষ বলছে, নিরাপত্তার স্বার্থে করা হয়েছে কাজটা। যুক্তিটা একেবারে উড়িয়ে দেবার মত নয়। অদ্ভুত ওই পাথরের টাওয়ারের ম্যাগনেটিক ফিল্ডের কারণে ইকুইপমেণ্ট ঠিকমত কাজ করে না, আণ্ডারওয়াটার নেভিগেশন অত্যন্ত কঠিন। চৌম্বকীয় শক্তিটাও স্থির নয়, বাড়ছে-কমছে। যখন চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছায়, ধাতব যে- কোনও জিনিসকে টেনে নেয় প্রচণ্ড টানে। সেই টানের ভেতরেই পড়েছিল হ্যামারহেড আর এক্সপি-ফোর। পরের বার নিচে নেমে রানা দেখেছে, কোনও কোনও জায়গায় চুম্বকের টান আর তীব্র স্রোত একই দিকে বইছে। কোনও সাবমারসিবল যদি তাতে আটকা পড়ে তো মুক্ত হওয়া অসম্ভব।

বিপজ্জনক জায়গা, কোনও সন্দেহ নেই। এক্সপি-ফোরের পর আরও একটা সাবমারসিবলেও ইলেকট্রিক্যাল ডিসটার্বেন্স দেখা দিয়েছিল; সৌভাগ্যক্রমে বেশি গুরুতর ছিল না সেটা। এক্সপি-ফোর বেশি আক্রান্ত হয়েছে, ওটার দুই আরোহীকে ভর্তি করতে হয়েছে হাসপাতালে। মাথাব্যথা আর চোখে ঘোলা দেখার কথা জানিয়েছে তারা। এসব কারণে জায়গাটা সম্পর্কে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব আর গুজব ছড়িয়ে পড়েছে।

ইচ্ছে করেই এসব গুজব দমাবার চেষ্টা করছে না পর্তুগিজ সরকার। গুজব যত রটে, ততই ভাল। মানুষ আকৃষ্ট হবে জায়গাটার প্রতি। টুরিস্ট বাড়বে। তার কিছুটা নমুনা ইতিমধ্যেই দেখতে পেয়েছে রানা। গতকাল পর্যন্ত নেপচুন ছাড়া আর কোনও জাহাজ ছিল না এলাকাটায়, আজ সকালেই নতুন তিনটে জাহাজ এসে উদয় হয়েছে। সন্দেহ নেই, খুব শীঘ্রি টুরিস্ট কোম্পানিগুলো তাদের অতিথিদের ডুবুরি পোশাক পরিয়ে কিংবা সাবমারসিবলে উঠিয়ে জাহাজের গোরস্থান দেখাতে নিয়ে যাবে।

পেছনে পায়ের আওয়াজ শুনে ঘুরে দাঁড়াল রানা। দু’হাতে দুটো বিয়ারের বোতল নিয়ে আসছে মুরল্যাণ্ড। কাছে এসে একটা বোতল তুলে দিল ওর হাতে।

‘বোহেমিয়া?’ লেবেল পড়ে ভুরু নাচাল রানা।

‘মেক্সিকোর সেরা বিয়ার,’ জানাল মুরল্যাণ্ড।

‘কোত্থেকে জোগাড় করলে?’

‘ক্যাপ্টেন মিচামের পার্সোনাল কালেকশন থেকে। কেবিনে লুকিয়ে রেখেছিলেন।’

‘আর, তুমি চুরি করে নিয়ে এলে? জানতে পারলে কেমন খেপবেন, আন্দাজ করতে পারছ?’

‘আরে নাহ্। খেপবেন কেন, আমাদের মনের অবস্থা দেখে বরং সমব্যথী হবেন। আফটার অল, খানিক আগে আমাদেরকে সাবমারসিবলের কম্পিটিশন থেকে অফিশিয়ালি ডিসকোয়ালিফাই করা হয়েছে।’

অবাক হলো না রানা। নিয়ম নিয়মই। বলল, ‘তো… দশ মিলিয়ন ডলার খুইয়ে কেমন লাগছে?’

‘আমি না, নুমা খুইয়েছে,’ বলল মুরল্যাণ্ড। ‘জিতলেও তো কিছু পেতাম না। সেটাই সান্ত্বনা।’

হাসল রানা। পরমুহূর্তেই আওয়াজ শুনে আকাশের দিকে তাকাল। পূর্ব দিক থেকে একটা সুপার লিঙ্কস হেলিকপ্টার সরলরেখায় এগিয়ে আসছে নেপচুনের দিকে। কাছে আসতেই গায়ে পর্তুগিজ নেভির মার্কিং দেখা গেল। জাহাজের পেছনদিকে গিয়ে স্থির হলো ওটা। আস্তে আস্তে নামল হেলি ডেকে।

একটু পরেই এক নাবিক উদয় হলো। ‘মি. রানা, মি. মুরল্যাণ্ড, আপনাদেরকে ক্যাপ্টেন তাঁর রেডি রুমে ডেকেছেন।’

‘আসছি,’ জানাল রানা।

বিয়ার শেষ করল ও আর মুরল্যাণ্ড। কয়েক মিনিটের মধ্যে পৌঁছুল রেডি রুমে।

কামরাটা বড় নয়। মাঝখানে একটা কনফারেন্স টেবিল। পর্তুগিজ নেভির ইউনিফর্মে একজন সিনিয়র অফিসারকে দেখা গেল বসে থাকতে। বাকি দু’জন অ্যাযোর্স দ্বীপপুঞ্জের গভর্নরের অফিস থেকে এসেছেন। ক্যাপ্টেন মিচামও উপস্থিত।

অতিথিদের দলনেতার সঙ্গে রানা ও মুরল্যাণ্ডকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন। ‘ইনি রিয়ার অ্যাডমিরাল মারিয়ো ফনসেকা। এখানকার সবকিছুর দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছে ওঁকে।’

উঠে এসে হাত মেলালেন রিয়ার অ্যাডমিরাল। বললেন, ‘আমাদের বিশ্বাস, আপনারা যা আবিষ্কার করেছেন, তা বৈজ্ঞানিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যে পুরো পর্তুগাল আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।’

আবারও ভোল পাল্টাচ্ছে পর্তুগিজরা। বিরক্ত হলো রানা। বলল, ‘কী যে আবিষ্কার করেছি, তা আমরা নিজেরাও জানি না। নিশ্চিত হবার জন্যে স্যাম্পল টেস্ট করা দরকার।’

‘কিছু তো নিশ্চয়ই আন্দাজ করেছেন।’

কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘টাওয়ারটা ম্যাগনেটাইজড় আয়রন অ্যালয়ের একটা বিশাল টুকরো হতে পারে। একসঙ্গে এত অ্যালয় সাধারণত পাওয়া যায় না, তবে আগ্নেয়গিরিটা কয়েক লক্ষ বছরের পুরনো। তাই ব্যাপারটা একেবারে অস্বাভাবিকও বলা যাচ্ছে না…’

‘নিশ্চিত থাকুন, রানাকে বাধা দিয়ে বললেন ফনসেকা, ‘এটা অস্বাভাবিকের চেয়েও বেশি কিছু। আজ আমরা কয়েকটা বিমান পাঠিয়েছিলাম, দেখেছেন নিশ্চয়ই?’

সায় জানাল রানা। সকাল থেকে কয়েক বারই মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেছে কয়েকটা পর্তুগিজ পি-থ্রি ওরাইয়ন। ভেবেছিল নেপচুন আর বাকি জাহাজগুলোর ওপর নজর রাখছে ওগুলো।

‘বিমানে বসানো সফিসটিকেটেড যন্ত্রপাতির সাহায্যে ম্যাগনেটিজমটা স্টাডি করেছি আমরা,’ বললেন রিয়ার অ্যাডমিরাল। ‘যা পেয়েছি, তা অবাক হবার মত। ম্যাগনেটিক ফিল্ডটা ক্রমাগত বদলাচ্ছে। কখনও কয়েকশো টন লোহা টেনে নেবার মত শক্তিশালী হয়ে উঠছে, আবার কখনও কমতে কমতে এমন অবস্থায় যাচ্ছে যে, পৃথিবীর ব্যাকগ্রাউণ্ড ম্যাগনেটিজম থেকে আলাদা করা যাচ্ছে না।’

একই ব্যাপার রানা ও মুরল্যাণ্ডও লক্ষ করেছে। সত্যিই অদ্ভুত। প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া কোনও চুম্বক এ-ধরনের আচরণ করে না। রানা জানে, ম্যাগনেটাইট নামে লোহা মিশ্রিত এক ধরনের চৌম্বক-ক্ষমতাসম্পন্ন পাথর আছে; সেগুলো যথেষ্ট স্টেবল। টাওয়ারের অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে, ওটা সেই ম্যাগনেটাইট বা সমগোত্রীয় কোনও পাথরে তৈরি নয়।

‘কী ভাবছেন আপনারা?’ জিজ্ঞেস করল ও।

‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে,’ বললেন ফনসেকা ‘তবে আমাদের বিজ্ঞানীরা বলছেন, আপনারা সম্ভবত সম্পূর্ণ নতুন কোনও বিদ্যুৎ-পরিবাহী প্রাকৃতিক পদার্থ আবিষ্কার করে বসেছেন। নির্দিষ্ট জিয়োলজিক্যাল কণ্ডিশনে, সম্ভবত ভূগর্ভের ম্যাগমার প্রবাহ, কিংবা পৃথিবীর ম্যাগনেটিজমের কারণে বিদ্যুতায়িত হয়ে উঠছে পুরো টাওয়ার, বৈদ্যুতিক চুম্বকে পরিণত হচ্ছে। সেটাই প্রচণ্ড শক্তিতে আশপাশের সমস্ত ধাতব জিনিস টেনে নিচ্ছে নিজের দিকে।’

‘আমরা তা হলে এমন একটা কণ্ডিশনের মাঝখানে পড়েছিলাম?’

ইতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন রিয়ার অ্যাডমিরাল। ‘আমাদের বিজ্ঞানীরা এ-ও ধারণা করছেন, সাগরের তলার ওই গোরস্থানটার জন্যে ওই টাওয়ারই দায়ী। ওটাই ডুবে যাওয়া সব জাহাজকে টেনে নিয়েছে জ্বালামুখটার ভেতরে।’

অবিশ্বাস ফুটল রানার চোখে। যা শুনছে তা সায়েন্স ফিকশনের পর্যায়ে পড়ে। ‘আপনি সিরিয়াস?’ বলল ও। ওখানে কার্গো শিপ দেখেছি আমরা, দুটো বিমানও দেখেছি। সেগুলোকে টানার জন্যে কী পরিমাণ ম্যাগনেটিক ফোর্স দরকার, কল্পনা করতে পারেন?’

ওর বলার ভঙ্গিতে যেন আহত হলেন ফনসেকা। অনুযোগ ফুটল চোখে। ‘আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না আপনার?’

‘দুঃখিত,’ বলল রানা। ‘আসলে… টাওয়ারটা সায়েন্টিফিক্যালি সত্যিই ইন্টারেস্টিং। ওটা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার—আমরা না করি, অন্য কেউ করুক। কিন্তু কোনও ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগেই আপনারা যে- ধরনের হাইপথেসিস দিচ্ছেন, তাতে সত্যিকার গবেষণা চালানো মুশকিল।’

‘আমি মনগড়া কিছু বলছি না,’ বললেন ফনসেকা। ‘আপনার কথায় যুক্তি আছে, কিন্তু… বাস্তবতা হলো, যে- ধরনের ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ফোর্সের কথা আপনি বলছেন, আমাদের ইকুইপমেন্ট সে-ধরনের রিডিং পেয়েছে ওখানে।’

‘সেটা কীভাবে সম্ভব?’

‘সুপারকণ্ডাক্টর কাকে বলে, আপনি জানেন? ‘

‘বেসিক আইডিয়া আছে। এমন সব পদার্থ, যার মাঝ দিয়ে কোনও ধরনের রেফিস্ট্যান্স ছাড়া বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতে পারে, রাইট? শুনেছি, ভবিষ্যতে সুপারকণ্ডাক্টর দিয়ে শূন্যে ভাসমান ট্রেন ও আরও কী কী যেন তৈরি করা যাবে।’

এবার মুখ খুললেন ক্যাপ্টেন মিচাম। কথা শুনে রানার মনে হলো, বিষয়টা নিয়ে রিয়ার অ্যাডমিরালের সঙ্গে আগেই আলোচনা হয়েছে তাঁর।

‘সুপারকণ্ডাক্টর দিয়ে আসলে অনেক কিছুই করা যাবে, মি. রানা,’ বললেন তিনি। ‘জিনিসটা যে-কোনও ইলেকট্রনিক অ্যাপ্লিকেশনের জন্যে আদর্শ। কম্পিউটার বলুন, চুম্বক-শক্তির সাহায্যে ভাসমান ট্রেন বলুন, অথবা গাড়ির মোটর… সবই বানানো যাবে সুপারকণ্ডাক্টর দিয়ে। যে-গাড়িতে এ-জিনিস থাকবে, সে-গাড়ি এক গ্যালন তেলে পাঁচশো মাইল চলবে। একটা স্টাডি বলছে, আমেরিকার পুরো ইলেকট্রিক্যাল গ্রিড যদি সুপারকণ্ডাক্টিং ওয়ায়্যার দিয়ে রিপ্লেস করা হয়, তা হলে চল্লিশ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। তাতে কয়লাচালিত অন্তত পাঁচশো ইলেকট্রিক প্ল্যান্ট বন্ধ করে দেয়া যাবে… পরিবেশ দূষণ কমবে।’

ভ্রূকুটি করল রানা। ‘আপনি যে এসবের এতবড় বিশেষজ্ঞ, তা জানা ছিল না, ক্যাপ্টেন।’

‘গতকাল পর্যন্ত আমারও জানা ছিল না,’ স্বীকার করলেন মিচাম। ‘তবে আজ সারাদিনই এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলছি নুমার বিশেষজ্ঞ আর পর্তুগিজ অথরিটির সঙ্গে।’

‘সুপারকণ্ডাক্টর যদি এতই পরিবেশবান্ধব হবে,’ বলল মুরল্যাণ্ড, ‘এখন পর্যন্ত কেউ সেটা ব্যবহার করছে না কেন?’

‘চরম শীতল তাপমাত্রা ছাড়া কাজ করে না সুপারকণ্ডাক্টর,’ জানালেন ফনসেকা। ‘সুপারকণ্ডাক্টিং এফেক্ট সৃষ্টির জন্যে তরল নাইট্রোজেনে ভিজিয়ে ঠাণ্ডা করে নিতে হয়।’

‘ইলেকট্রিক গ্রিডে তা হলে ব্যবহার করা কঠিন,’ মন্তব্য করল রানা।

‘সবকিছুতেই,’ বললেন ক্যাপ্টেন মিচাম। ‘ওভাবে সুপারকণ্ডাক্টিং কণ্ডিশন মেইনটেন করায় ঝক্কি অনেক।’

‘তা হলে বিষয়টা নিয়ে আমরা কথা বলছি কেন?’ মুরল্যাণ্ড ভ্রূকুটি করে জানতে চাইল।

‘কারণ,’ সামনে ঝুঁকলেন রিয়ার অ্যাডমিরাল, পালা করে তাকালেন রানা আর মুরল্যাণ্ডের দিকে, ‘আমাদের ধারণা, আপনারা এমন একটা সুপারকণ্ডাক্টিং অ্যালয় আবিষ্কার করেছেন, যেটা স্বাভাবিক টেম্পারেচারেই কাজ করে।’

মুখ চাওয়াচাওয়ি করল রানা ও মুরল্যাণ্ড। এবার পরিষ্কার হচ্ছে রহস্যটা। আণ্ডারগ্রাউণ্ড গ্রেভইয়ার্ড নিয়ে পর্তুগিজদের বাড়াবাড়ির কারণটা বোঝা যাচ্ছে। কেন ওখানে যেতে বারণ করা হয়েছে, কেন স্যাম্পল সংগ্রহে, বাধা দেয়া হচ্ছে… তা-ও।

ক্যাপ্টেন মিচাম বললেন, ‘নিচে যদি সত্যিই প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট সুপারকণ্ডাক্টিং মেটেরিয়াল থেকে থাকে, তার দাম দাঁড়াবে কয়েকশো বিলিয়ন ডলার।’

মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘টাওয়ারটা শক্তি পাচ্ছে কোত্থেকে?’

‘ভলকানিক এরিয়ায় আছি আমরা,’ বললেন ফনসেকা। ‘মাটির গভীরে উন্মত্তের মত ফুঁসছে গরম ম্যাগমা। তার ভেতর রয়েছে বিভিন্ন ধরনের তরল ধাতু। বিজ্ঞানীরা বলেন, সেসব ধাতুর মুভমেন্টে বিদ্যুৎ এবং ম্যাগনেটিক ফিল্ড সৃষ্টি হতে পারে।’

‘কিন্তু ম্যাগনেটিক ফোর্স তো আর জাহাজ ডোবায় না। এখানে এতগুলো জাহাজ আর বিমান এল কোত্থেকে?’

‘সত্যি বলতে কী, আমরা জানি না,’ শ্রাগ করলেন রিয়ার অ্যাডমিরাল। ‘তবে সামুদ্রিক দুর্ঘটনার জন্যে এই এলাকার বদনাম আছে—অনেকটা ক্যারিবিয়ানের বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মত। রেকগুলো জ্বালামুখের উত্তর-পশ্চিমে পেয়েছেন আপনারা, তাই না? শক্তিশালী একটা স্রোত আছে ওদিকে—দুটো ডুবোপাহাড়ের মাঝ দিয়ে পানির প্রবাহে সৃষ্টি হয়েছে। মন্দ কপালের কারণে যদি কোনও জাহাজ ওটায় আটকা পড়ে…

‘স্রোত আর ম্যাগনেটিজমের টানে ডুবে যাবে?’ রানা মাথা নাড়ল। ‘এই থিয়োরিতে যথেষ্ট ফাঁক আছে। নিচে বিমানও দেখেছি আমরা। বিমান নিশ্চয়ই স্রোতের কবলে পড়েনি?’

‘বললাম তো, আমাদের কাছে এর জবাব নেই,’ স্বীকার করলেন ফনসেকা।

‘ঠিক আছে, কাজের কথায় আসুন,’ প্রসঙ্গ বদলাল রানা। ‘আমাদের কাছে কী চান আপনি?’

দুই সঙ্গীর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলেন রিয়ার অ্যাডমিরাল। ইতস্তত করে বললেন, ‘ইয়ে… একটা জটিলতা দেখা দিয়েছে। সাগরের এই অংশের মালিকানা নিয়ে পুরনো একটা বিরোধ আছে পর্তুগাল আর স্পেনের মাঝে—পাঁচশো বছরের পুরনো বিরোধ, চলছে সেই কলম্বাসের সময় থেকে। জ্বালামুখটা পড়েছে এই বিরোধপূর্ণ এলাকায়। শান্তিরক্ষার জন্যে বেশ কিছু চুক্তি হয়েছে আমাদের দু’দেশের মাঝে—মাছ ধরা-সহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে সেসব চুক্তির ভিত্তিতে। ইন ফ্যাক্ট, সাগরের তলায় তেল পাওয়া গেলে কীভাবে ভাগ-বাটোয়ারা হবে, তারও চুক্তি আছে…’

‘কিন্তু আণ্ডারসি মাইনিঙের ব্যাপারে কোনও চুক্তি নেই, এই তো?’ বলল মুরল্যাণ্ড।

মাথা ঝাঁকালেন রিয়ার অ্যাডমিরাল। ‘এত বিশাল একটা আবিষ্কার… বুঝতেই পারছেন, দু’দেশই এর মালিকানা চায়। পরিস্থিতি গরম হয়ে উঠেছে। নিরাপত্তার জন্যে আমাদের সরকার একটা ফ্রিগেট পাঠাতে চাইছে এখানে, সে-খবর শুনে স্পেনও তাদের একটা যুদ্ধজাহাজ পাঠাবে বলে আমাদের জানিয়ে দিয়েছে। খুব বিশ্রী একটা অবস্থা। ‘

‘যুদ্ধ বেধে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন?’

‘সে-কথা বলছি না। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। কূটনীতিকরা কাজ শুরু করে দিয়েছেন, তবে সেটা সময়সাপেক্ষ। ততদিনে আবিষ্কারটায় হাত লাগাতে পারব না কেউ, গবেষণা পিছিয়ে যাবে। যদি না…’

কথা শেষ না করে নাটকীয় ভঙ্গিতে থেমে গেলেন ফনসেকা।

রানা প্রশ্ন করল, ‘যদি না… কী?’

‘যদি না কোনও বিশ্ববিখ্যাত নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান সাইটটার দায়িত্ব নেয়,’ বললেন ফনসেকা। ‘পর্তুগাল আর স্পেনের মধ্যে বোঝাপড়া না হওয়া পর্যন্ত তাদের তদারকিতে নির্বিঘ্নে প্রাথমিক গবেষণা এগিয়ে যেতে পারে।’

ক্যাপ্টেন মিচামের দিকে তাকাল রানা। তিনি বললেন, ‘অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। তিনি সম্মতি দিয়েছেন প্রস্তাবটায়।’

‘কাজটা এখুনি শুরু করা দরকার,’ বললেন ফনসেকা। ‘আমার ডেস্কে একগাদা পিটিশন

পিটিশন জমা পড়েছে ইতিমধ্যে—বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা সাইটটা স্টাডি করার অনুমতি চাইছেন। কিন্তু তাঁদেরকে আসতে দেবার আগে একটা নীতিমালা ঠিক করে ফেলা দরকার।’

‘এসব অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন আর ক্যাপ্টেন মিচাম দেখবেন। আমাকে আর ববিকে ডেকেছেন কেন?’

‘আপনারা ওই গ্রেভইয়ার্ডের আবিষ্কারক। তা ছাড়া সাগরভিত্তিক এক্সপিডিশন পরিচালনায় সুখ্যাতিও আছে আপনাদের। আপনারা যদি এখানে থাকেন, খুব ভাল হয়। সবাই সমীহের চোখে দেখে আপনাদের, কথা বললে শুনবে।’

‘আমাদেরকে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হতে বলছেন আপনি?’ রানা ভুরু কোঁচকাল।

‘কীভাবে কী করবেন, সেটা আপনাদের ওপরেই ছেড়ে দেব। আপনারা এখানে হাজির থাকলেই আমরা খুশি।’

‘ক্যাপ্টেন, আপনার সঙ্গে আলাদাভাবে একটু কথা বলতে পারি?’

রানার ডাকে উঠে দাঁড়ালেন মিচাম। বেরিয়ে এলেন রেডি রুম থেকে। মুরল্যাণ্ডও বেরুল।

‘এসবের অর্থ কী?’ আপার ডেকে বেরিয়ে জানতে চাইল রানা। ‘আমরা একটা ভিন্ন মিশনে এসেছি। কেন এই ঝামেলা ঘাড়ে নিচ্ছেন আপনি?

‘নুমা হেডকোয়ার্টারের হুকুমে,’ জানালেন মিচাম। ‘আরেকটা জাহাজ পাঠাতে প্রচুর সময় দরকার, তাই অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন আপাতত আমাদেরকেই কাজটা করে দিতে বলেছেন।’

‘আর আরাতামা মারু?’

‘ওটার ধ্বংসাবশেষে তল্লাশি চালাবার মত ফ্যাসিলিটি নেই আমাদের। হ্যামারহেডের মডিফিকেশন করে যেভাবে কাজটা করতে চাইছেন, সেটাও পুরোপুরি নিরাপদ নয়। অ্যাডমিরাল তাই দায়িত্বটা আপনার দুই বন্ধু ড. আসিফ আর ড. তানিয়াকে দিয়েছেন। এক্সপেরিমেন্টাল একটা আরওভি __ ওঁদের কাছে, ওটা নিয়ে ইতিমধ্যেই ওঁরা ফকল্যাণ্ড থেকে রওনা হয়ে গেছেন।’

‘আমরা কি তা হলে এখানে আটকা পড়ে গেলাম?’

‘নেপচুনকে থাকার জন্যে অর্ডার দিয়েছেন অ্যাডমিরাল। মি. মুরল্যাণ্ডের জন্যেও সেটা প্রযোজ্য। কিন্তু আপনি তো… এনিওয়ে, অ্যাডমিরাল আমাকে বলতে বলেছেন যে, আপনি যদি আমাদের সাহায্য করেন, খুশি হবেন তিনি।’

‘কীভাবে সাহায্য করব? আপনি কি চান, আমি আর ববি বসে বসে নীতিমালা বানাব? যারা গবেষণা করতে আসবে, তাদেরকে অনুমতিপত্র ইস্যু করব?’

‘শুনেই ভয় লাগছে,’ বলল মুরল্যাণ্ড। ‘অফিসওয়ার্ক আমার দু’চোখের বিষ।’

হাসলেন মিচাম। ‘ভয়ের কিছু নেই, আমি আর আমার অফিসারেরা পেপারওয়ার্ক আর লজিস্টিকস্ সামলাব। আপনারা দু’জন থাকবেন ফিল্ডে। গবেষণার জন্যে যারা আসছে, তারা নিয়মকানুন ঠিকমত মানছে কি না দেখবেন। তা ছাড়া সাইটের সিকিউরিটিরও একটা ব্যাপার আছে। কয়েকশো বিলিয়ন ডলারের মিনারেল… মন্দলোকের আনাগোনা হবেই।’

‘আমাকে ঢাকায় কথা বলতে হবে,’ বলল রানা। ‘দশ ‘মিনিট সময় দিন।’

একটু দূরে গিয়ে সেলফোন বের করল রানা। কল করল বিসিআই হেডকোয়ার্টারে—মেজর জেনারেল রাহাত খানের ব্যক্তিগত নাম্বারে। দু’বার রিং হতেই ধরলেন তিনি।

‘ইয়েস?’

দিব্যচোখে বসকে দেখতে পেল রানা। চুরুট ফুঁকছেন। কুঁচকে আছে কাঁচাপাকা ভুরু। পুরোটাই কল্পনা, তারপরেও বুক ধুকপুক করে উঠল। ঢোক গিলে বলল, ‘এমআরনাইন, স্যর। অ্যাযোর্স থেকে।’

‘খবর কী?’

‘এখানে একটা ব্যাপার ঘটেছে…’

‘সুপারকণ্ডাক্টিং মিনারেল আবিষ্কার করে বসেছ, এই তো? হ্যামিলটন ফোন করেছিল আমাকে। সব খুলে বলেছে। কয়েকদিনের জন্যে ধার চেয়েছে তোমাকে। আমি রাজি হয়েছি।’

‘কিন্তু, স্যর… যে-কাজে এসেছিলাম… মানে, হারানো জাহাজ…’

ওই কাজ তো এগোচ্ছে। হ্যামিলটন বলল, তোমার বন্ধু আসিফ আর তানিয়াকে পাঠিয়েছে আরাতামা মারুর ধ্বংসাবশেষ চেক করার জন্যে। ওদের ওপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করা যায়। একটু ধৈর্য ধরো, দেখো ওরা কিছু পায় কি না। তারপর নাহয় আবার ছুটবে রহস্যটার পেছনে। মাঝের ক’টা দিন যদি পর্তুগাল সরকারকে সাহায্য করা যায় তো মন্দ কী? ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট বলছে, সাগরতলের ওই মিনারেলের ওপর নজর পড়েছে অনেকের, নানা রকম ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। সেসব ঠেকানো দরকার। তা ছাড়া বাংলাদেশ আণবিক কমিশন থেকেও দু’জন বিজ্ঞানী যাচ্ছেন রিসার্চের জন্যে। তুমি ওখানে থাকলে আমাদের বিজ্ঞানীদের ওপর কেউ জোরজুলুম করতে পারবে না। আফটার অল, ওই মিনারেলের ওপর বাকি সবার মত আমাদেরও দাবি আছে।’

‘বুঝতে পেরেছি, স্যর।’

‘টেক কেয়ার, এমআরনাইন। সাবধানে থেকো।’

লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিলেন রাহাত খান।

ক্যাপ্টেন মিচাম আর মুরল্যাণ্ডের কাছে ফিরে এল রানা। মিচাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী বললেন আপনার বস?’

‘কী আর বলবেন, অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন আগেই কথা বলে রেখেছেন ওঁর সঙ্গে।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। ‘চলুন, রিয়ার অ্যাডমিরাল ফনসেকাকে জানিয়ে আসি, দায়িত্বটা আমরা নিচ্ছি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *