এগারো
পানির একশো ফুট নিচ দিয়ে ছুটে চলেছে হ্যামারহেড। ডানা ছড়ানো একটা মান্টা রে-র মত আকৃতি; আকারে একটা কম্প্যাক্ট কারের অর্ধেক। নাকটা গোঁজের মত—চ্যাপ্টা, সরু, ডগাটা ভোঁতা। হাইড্রোডাইনামিক এই ফিচারের কারণে অনায়াসে সাবমারসিবলটার ওপর-নিচ দিয়ে বয়ে যায় পানি, গতিকে বাধাগ্রস্ত করে না। এ ছাড়াও ওটার স্টেইনলেস স্টিলের আবরণে রয়েছে অসংখ্য মাইক্রোস্কোপিক ভি- আকৃতির খাঁজ, যেমনটা রেসিং ইয়টে থাকে। খাঁজগুলো পানির সঙ্গে ঘর্ষণ কমায় পুরো কাঠামোর, স্পিড বাড়াতে সাহায্য করে।
স্যালভিজ ওয়ার্কের সুবিধার কথা চিন্তা করে বানানো হয়েছে সাবমারসিবলটা, দুই ডানার তলায় লাগানো আছে কাটিং টর্চ, গ্র্যাপলিং হুক আর অন্যান্য যন্ত্রপাতি। ককপিটের ভেতরে বসে আছে রানা ও মুরল্যাণ্ড। রানা কন্ট্রোলে, আর পেছনে বসে মুরল্যাণ্ড মনিটর করছে পুরো সিস্টেম। চৌত্রিশ নট স্পিডে ছুটছে হ্যামারহেড, সর্বোচ্চ পঁয়তাল্লিশ নটে ছুটতে পারে, তবে তাতে দ্রুত ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে যাবে। পঞ্চাশ মাইল দীর্ঘ কোর্সে দুটো চক্কর দিতে হবে ওদেরকে, তাই স্পিড একটু কমিয়ে রাখতে বলেছে মুরল্যাণ্ড।
‘ডেপথ চেঞ্জের পয়েন্টে পৌঁছাচ্ছি,’ জানাল সে।
রেসটা গাড়ির রেসের মত স্রেফ দূরত্ব অতিক্রম করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, আরও অনেক কিছু অন্তর্ভুক্ত এতে। সাবমারসিবলের সম্পূর্ণ সামর্থ্যের পরীক্ষা দিতে হবে: বাড়াতে-কমাতে হবে গভীরতা, বদলাতে হবে কোর্স, এমনকী একটা অংশে গিয়ে সাগরের গভীরে পোঁতা কিছু পিলারের মাঝ দিয়ে আসা-যাওয়া করতে হবে এঁকে-বেঁকে।
তিন ধাপে হচ্ছে প্রতিযোগিতাটা, অংশ নিচ্ছে প্রায় বিশটা সাবমারসিবল। যার পয়েন্ট সবচেয়ে বেশি হবে, তাকেই সার্বিকভাবে বিজয়ী বলে ঘোষণা দেয়া হবে।
‘বিশ্বাস করতে পারো, ব্যাটারা দশ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে এই প্রতিযোগিতার জন্যে?’ হঠাৎ বলল মুরল্যাণ্ড।
‘নিশ্চয়ই জানো, জিতলে টাকাটা নুমার ফাণ্ডে যাবে?’ বলল রানা।
‘আগুনে জল ঢেলো না,’ মুরল্যাণ্ড বলল। ‘আমি স্বপ্ন দেখছি। ওই টাকায় কোথাও একটা র্যাঞ্চ কিনব, পাশে থাকবে সুন্দরী বউ…’
হাসল রানা। ক্ষণিকের জন্যে ভাবল, টাকাটা পেলে ও কী করবে। বোধহয় যা করছে তা-ই, আন্দাজ করল ও। রোমাঞ্চকর জীবন ওর, কাজের খাতিরে সারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াতে পারছে। রিটায়ার করে কোথাও থিতু হয়ে স্বস্তি পাবে না।
‘কার মাথা থেকে বেরিয়েছে এই রেসের আইডিয়া?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘মানে, টাকাটা কে ঢালছে?’
‘কোন্ এক আফ্রিকান অফশোর কর্পোরেশন। এরা নাকি আণ্ডারসি মাইনিঙের সঙ্গে জড়িত।’
রেসের মূল উদ্দেশ্য কিছুটা আন্দাজ করা যাচ্ছে এবার। পানির তলায় কাজকারবার স্পনসরদের; নিশ্চয়ই উন্নতমানের সাবমারসিবল খুঁজছে। এই রেস আসলে সেটার ট্রায়াল। যার সাবমারসিবল পছন্দ হবে, সেটার ডিজাইন কিনে নেয়ার চেষ্টা করবে।
টাকার কোনও লোভ নেই রানার, তবে ও জিততে পছন্দ করে। মনোযোগ দিল কন্ট্রোলে।
‘পনেরো সেকেণ্ড পর আড়াইশো ফিট গভীরতায় নামো,’ বলল মুরল্যাণ্ড।
কি-প্যাডে টু-ফাইভ-যিরো টিপল রানা। আঙুল ঝুলতে থাকল এন্টার বাটনের ওপর। চাইলে ম্যানুয়ালিও করতে পারে কাজটা, তবে হ্যামারহেডের কম্পিউটার অনেক বেশি নিখুঁত।
‘থ্রি… টু… ওয়ান… এবার!’
মুরল্যাণ্ডের সঙ্কেত পেয়েই এন্টার চাপল রানা। সঙ্গে সঙ্গে সাবমারসিবলের পেছনের অংশে একটা পাম্প চালু হলো—রিয়ার চেম্বার থেকে ফরোয়ার্ড চেম্বারে ফিউয়েল শিফট করছে। সামনের অংশ ভারী হয়ে যাওয়ায় নাক নিচু করল হ্যামারহেড, ডাইভ দিল গভীরে। সনাতন সাবমেরিনের মত ব্যালাস্টে পানি ভরতে হচ্ছে না, কিংবা ডাইভ প্লেন ব্যবহার করতে হচ্ছে না; কাজেই স্পিড কমাতে হলো না এক বিন্দু, বরং খানিকটা বাড়াতে পারল। নির্ধারিত ডেপথে পৌছুবার পর কম্পিউটারই আবার সমান্তরাল করবে কাঠামোটাকে।
আশপাশ থেকে আলো কমতে শুরু করল। আকাশি নীল থেকে কালচে বর্ণ ধারণ করছে পানি। বোঝার উপায় নেই, ওপরে রোদ ঝলমলে চমৎকার একটা দিন বিরাজ করছে।
‘কদ্দূর এগোলাম?’ জানতে চাইল রানা।
‘আর চার মাইল দূরে আউটার মার্কার,’ মুরল্যাণ্ড বলল।
‘সামনের সাবমারসিবলটা দেখতে পাচ্ছ?’
দশ মিনিট অন্তর ছাড়া হচ্ছে একটা করে সাবমারসিবল, যাতে স্বাধীনভাবে চলতে পারে প্রত্যেকে। টাইমিং রাখা হচ্ছে সবার, ওভাবেই বিজয়ী নির্ধারিত হবে; একসঙ্গে ছাড়া হয়নি, তাতে হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে একটার সঙ্গে আরেকটার সংঘর্ষে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। অবশ্য, যথেষ্ট ব্যবধানে রওনা হলেও ইতিমধ্যে দুটো সাবমারসিবলকে ওভারটেক করেছে হ্যামারহেড, তৃতীয়টাকে ধরবার চেষ্টা করছে।
‘চিন্তা কোরো না,’ বলল মুরল্যাণ্ড। ‘যদি পথ আটকাতে চায়, গুঁতো মেরে বেরিয়ে যাব।’
‘এটা ফর্মুলা ওয়ানের রেস না। নিশ্চয়ই পয়েন্ট কাটবে।’ কি-বোর্ডে মুরল্যাণ্ডের আঙুল নেচে বেড়াল। জানাল, ‘টেলিমেট্রি বলছে, আধমাইল সামনে আছে এক্সপি-ফোর… মানে, আমাদের সামনের সাবমারসিবলটা। যেভাবে এগোচ্ছি, তাতে দশ মিনিটের মধ্যে মোলাকাত হবে আমাদের।’
মাথা ঝাঁকাল রানা। সাত মিনিট পর আরেকটা ডেপথ চেঞ্জ আছে—দেড়শো ফিটে উঠতে হবে ওদেরকে, একটা রিজ অতিক্রম করার জন্যে। রিজের ওপরে রয়েছে একটা আণ্ডারওয়াটার মেসা, বা মালভূমি; সেটার ওপর দিয়ে গাড়ির রেসের মত ছোটাতে হবে সাবমারসিবল।
‘দর্শক থাকলে বেশি উৎসাহ পেতাম,’ বলল ও।
সাত মিনিট পেরুল। কম্পিউটারের সাহায্যে রিজের ঢাল ধরে দেড়শো ফিট গভীরতায় ভেসে উঠল হ্যামারহেড। কয়েক মুহূর্ত পরেই খড়খড় করে উঠল রেডিও।
‘হেল্প… ইলেকট্রিক্যাল ডিসটার… ব্যাটারি… সিস্টেম ম্যালফাঙ্ক…’
লো ফ্রিকোয়েন্সির দুর্বল ট্রান্সমিশন, ভেঙে ভেঙে আসছে। তবে সারমর্ম বুঝতে অসুবিধে হলো না।
চঞ্চল হয়ে উঠল রানা। ‘শুনলে?’
‘ইলেকট্রিক্যাল ডিসটার্বেন্স আর সিস্টেম ম্যালফাঙ্কশনের কথা শুনলাম,’ বলল মুরল্যাণ্ড। ‘কেউ বিপদে পড়েছে।’
‘ডাকো ওদেরকে।’
রেডিওর বাটন চাপল মুরল্যাণ্ড। ‘হ্যালো? কেউ কি সমস্যায় পড়েছেন? আপনাদের ট্রান্সমিশন পরিষ্কার নয়। রিপিট করুন।’
কয়েক সেকেণ্ড পেরিয়ে গেল। জবাব এল না কোনও। শঙ্কিত হয়ে উঠল রানা। গতি বাড়াবার জন্যে প্রতিযোগী বিভিন্ন সাবমারসিবলে এক্সপেরিমেন্টাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে। কেউ কেউ লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি ব্যবহার করছে; সেগুলোয় আগুন ধরে যাওয়া বিচিত্র নয়। এক্সপেরিমেন্টাল মোটর রয়েছে কয়েকটায়, একটার খোল আবার পাতলা পলিমার দিয়ে বানানো। বিপদে পড়ার জন্যে যেন তৈরি হয়েই আছে ওগুলো।
আবার ডাকাডাকি করল মুরল্যাণ্ড। ‘দিস ইজ হ্যামারহেড। কারও সাহায্যের প্রয়োজন হলে সাড়া দিন। আমরা সারফেসে আপনাদের মেসেজ রিলে করে দেব।’
সামনে বুদের সারি দেখতে পেল রানা—নিশ্চয়ই এক্সপি-ফোরের ট্রেইল। ভুলেই গিয়েছিল ওটার কথা। তাড়াতাড়ি গতি কমাল, নইলে পেছনে গিয়ে ধাক্কা খাবে। বামে সরে আসতেই অদ্ভুত একটা ব্যাপার লক্ষ করল। বাঁকা হয়ে বুদ্বুদের ট্রেইল নেমে গেছে নিচে, ডানদিকে। এর মানে…
‘ববি! এক্সপি-ফোর বিপদে পড়েছে! ওরাই সাহায্য চাইছে।’
‘তুমি শিয়োর?’
‘জিপিএস চেক করো।’
স্ক্রিন দেখল মুরল্যাণ্ড। ‘আমরা ওদের ঘাড়ের ওপর রয়েছি।’
‘তা হলে দেখতে পাচ্ছি না কেন?’
রেডিও নিয়ে ফের ব্যস্ত হলো মুরল্যাণ্ড। ‘এক্সপি-ফোর, শুনতে পাচ্ছ? তোমাদের কি কোনও সমস্যা দেখা দিয়েছে?’
খড়খড় করে উঠল স্পিকার।
‘দেখা দরকার ব্যাপারটা,’ রানা বলল।
‘নাক ঘোরালে হেরে যাব আমরা,’ জানাল মুরল্যাণ্ড।
সেটা রানা জানে। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্ত দেরি করল না।
‘গোল্লায় যাক রেস,’ বলল ও। কন্ট্রোল ম্যানুয়ালে শিফট করে বাঁক নিতে শুরু করল। এক্সপি-ফোরের ট্রেইল অনুসরণ করে নিচে নামছে। জানতে চাইল, ‘এক্সপি-ফোর কীসের তৈরি?’
‘স্টেইনলেস স্টিল,’ বলল মুরল্যাণ্ড। ‘আমাদের মতই।’
‘সেক্ষেত্রে ম্যাগনিটোমিটার দিয়ে হয়তো ওদেরকে ডিটেক্ট করা যাবে। কমপক্ষে এক হাজার পাউণ্ড ওজন ওটার, এই ডিসট্যান্সে নিশ্চয়ই রিডিং পাব।’
মাথা ঝাঁকিয়ে কয়েকটা বাটন চাপল মুরল্যাণ্ড, ম্যাগনিটোমিটার চালু করল। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘ঝামেলা দেখা দিয়েছে।’
‘কী ঝামেলা?’
‘নিজেই দেখো।’
রানার ড্যাশবোর্ডের সেন্ট্রাল স্ক্রিনে ম্যাগনিটোমিটারের ফিড পাঠাল মুরল্যাণ্ড। ফুটে উঠল হলদে রঙের অনেকগুলো রেখা আর বিন্দু। স্থির থাকার কথা ওগুলোর, কিন্তু নাচানাচি করছে। কোনার ডিরেকশনাল ইণ্ডিকেটর পাগলের মত ঘুরপাক খাচ্ছে কম্পাসের কাঁটার মত।
‘হচ্ছেটা কী!’ রানা বিস্মিত।
‘আমিও বুঝতে পারছি না।’
আবারও খসখসে আওয়াজ করল রেডিও। তার মাঝ দিয়ে আবছাভাবে শোনা গেল একটা কণ্ঠ।
‘…প্লিজ, হেল্প… কেবিন ভরে যাচ্ছে ধোঁয়ায়… ইলেকট্রিক্যাল ফায়ার… সিস্টেম শাট ডাউন…’
নীরব হয়ে গেল রেডিও। প্লেক্সিগ্লাসের উইণ্ডশিল্ড ভেদ করে সামনে তাকাল রানা, গতি আরও কমিয়ে আনল হ্যামারহেডের। নিচু করল নাক। ধীরে ধীরে এবার নিচে নামছে সাবমারসিবল। তলায় কী আছে বোঝার চেষ্টা করল ও। দেড়শো ফুট গভীরতায় সারফেসের আলো খুব সামান্যই পৌঁছুচ্ছে, চারপাশে ঘন নীল পানি। পঞ্চাশ ফুটের বেশি দেখতে পাবার কথা নয়, তবে হ্যামারহেডে আলাদা স্পেকট্রামের বিশেষ ধরনের হেডলাইট লাগিয়েছে মুরল্যাণ্ড। হলদে-সবুজ আলোর রেখা ছুরির মত ভেদ করছে অন্ধকার, আলোকিত করছে সামনের অনেকখানি জায়গা।
সাগরতলে পৌঁছুল হ্যামারহেড। বালির ওপর লম্বা একটা রেখার মত দেখতে পেল রানা, অনুসরণ করল ওটাকে। খানিক পরেই মুরল্যাণ্ড উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘ওই যে!’
একশো গজ সামনে, বালির ওপর কাত হয়ে আছে একটা ছায়া। আকৃতিটা সাধারণ সাবমেরিনের মতই, তবে অনেক ছোট। একটু এগোতেই ধাতব খোলের গায়ে আলো পড়ল, কালো পেইন্টে লেখা এক্সপি-ফোর দেখা গেল পরিষ্কারভাবে।
সাবমারসিবলটার ওপর দিয়ে ঘুরে এল রানা। টেইল সেকশন থেকে বেরিয়ে আসছে বুদ্বুদ, তবে ক্যানোপিটা অক্ষত আছে বলে মনে হলো। লাইট নিভিয়ে দিয়ে এক্সপি- ফোরের পাশে নেমে এল ও, হোভার করতে থাকল পাওয়ার বাড়িয়ে-কমিয়ে।
‘সিগনাল দাও ওদের।’
একটা পেনলাইট নিল মুরল্যাণ্ড, এক্সপি-ফোরের দিকে তাক করে মোর্স কোডে একটা মেসেজ দিল। ওদের কেবিনের ভেতর নড়াচড়ার আভাস পাওয়া গেল, কয়েক সেকেণ্ড পর একই কায়দায় দেয়া হলো জবাব।
‘ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার হারিয়েছি,’ কোডের পাঠোদ্ধার করল মুরল্যাণ্ড।
পেছন দিকে ভেসে যাচ্ছে হ্যামারহেড, থ্রাস্টার চালিয়ে আগের জায়গায় ফিরে এল রানা।
‘অক্সিজেন সিলিণ্ডার থাকার কথা ওদের,’ প্রতিযোগিতার সেফটি রুল স্মরণ করল রানা। ‘ক্যানোপি খুলতে পারবে?’
মোর্স কোডে প্রশ্নটা পাঠিয়ে দিল মুরল্যাণ্ড। জবাবটা পাবার পর হতাশ গলায় বলল, ‘না। ক্যানোপিটা ইলেকট্রিক্যাল। আটকা পড়ে গেছে ওরা।’
‘গাধা নাকি? ইলেকট্রিক্যাল ক্যানোপির কথা কে কবে শুনেছে?’ আড়চোখে মুরল্যাণ্ডের দিকে তাকাল রানা। ‘তুমিও একই বোকামি করোনি তো?’
‘না, না। আমাদেরটা ম্যানুয়ালি খোলা যায়।’
‘শুনে খুশি হলাম। ওদেরকে টো করা যাবে?’
’আর তো কোনও উপায় নেই। দেখি চেষ্টা করে।’
কন্ট্রোল প্যানেলে কয়েকটা বোতাম টিপল মুরল্যাণ্ড। হ্যামারহেডের ডানদিকে ডানায় একটা আলো জ্বলে উঠল। সরে গেল একটা প্যানেল। সেখান দিয়ে বের হয়ে এল একটা ভাঁজ করা মেকানিক্যাল আর্ম। বেইসটা লক হয়ে গেলে ভাঁজ খুলে আর্মটাকে প্রসারিত করল সে।
হ্যামারহেড আবার ভেসে যেতে শুরু করেছে পেছনদিকে, টের পেল রানা।
‘কাছে নিয়ে চলো আমাদের,’ পেছন থেকে বলল মুরল্যাণ্ড।
আবারও থ্রাস্টার অন করল রানা। নাক ঘুরিয়ে এক্সপি- ফোরের রিয়ার সেকশনের দিকে এগোল হ্যামারহেড। মাছের পিঠের কাঁটার মত একটা হ্যাণ্ডেল বেরিয়ে আছে ওখানে সারফেসে ভেসে ওঠার পর ওই হ্যাণ্ডেলের সঙ্গে ক্রেনের হুক লাগিয়ে সাবমারসিবলটাকে পানি থেকে তোলা হয়। রানা ও মুরল্যাণ্ড এখন একই কাজ করতে চলেছে, তবে পানির তলায়।
‘এর জন্যে কম্পিটিশনে কিছু বাড়তি পয়েন্ট দাবি করা যেতে পারে,’ হালকা গলায় বলল মুরল্যাণ্ড। ‘কী বলো?’
‘জলদি করো!’ তাড়া দিল রানা।
হ্যাণ্ডেলের দিকে থাবা দিল আর্ম, কিন্তু মিস করল। পজিশন অ্যাডজাস্ট করল রানা, আরেক দফা চেষ্টা করল মুরল্যাণ্ড, এবারও লাগাতে পারল না।
‘কোথাও সমস্যা আছে,’ বলল সে।
‘হ্যাঁ। তোমার নিশানায়।’
‘কিংবা তোমার ড্রাইভিঙে।’
ঠাট্টার ছলে কথাটা বলা হলেও রানা বুঝতে পারছে, অভিযোগটা সত্যি। কারেকশন দেবার পরও বার বার কোনও এক অদৃশ্য শক্তির টানে সরে যাচ্ছে হ্যামারহেড। নিচের বালির দিকে তাকাল ও, বুঝতে চাইল স্রোতের মতিগতি।
‘ইয়ে, রানা…’ ডাকল মুরল্যাণ্ড।
কান দিল না রানা। সমস্যাটা ধরতে পেরেছে, তবে সেটা চোখের ভুল কি না বুঝতে পারছে না। স্রোতের বিপরীতে ভেসে যাচ্ছে হ্যামারহেড। আরও অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এক্সপি-ফোরও বালির ওপর ঘষা খেয়ে সরছে একই দিকে কীভাবে তা সম্ভব!
‘রানা!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুরল্যাণ্ড।
‘কী হয়েছে?’
‘দয়া করে পেছনে তাকাও।’
হ্যামারহেডকে কয়েক ডিগ্রি ঘোরাল রানা, বকের মত গলা বাড়িয়ে উঁকি দিল পেছনে। সমুদ্রের আলোকিত তলদেশ হঠাৎ করে আঁধারে মিলিয়ে গেছে। খাড়া একটা ঢালের দিকে ভেসে চলেছে ওরা। চার্ট চেক করল। পেয়ালার মত বিশাল একটা খাদ ওটা—প্রাচীন কোনও ডুবো-আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ, এখন মরে গেছে। ভাসতে ভাসতে ওটার দিকে চলেছে ওরা।
আসন্ন বিপদটা টের পেয়ে বাকি সব ভুলে গেল রানা। তাড়াতাড়ি এগোল এক্সপি-ফোরের দিকে। প্রায় চড়ে বসল সাবমারসিবলটার গায়ে। থ্রাস্টারের ধাক্কায় আলোড়ন উঠল বালিতে। আরেকবার মেকানিক্যাল আর্ম দিয়ে থাবা মারল মুরল্যাণ্ড, কিন্তু এবারও ধরতে পারল না হ্যাণ্ডেল।
ঢালের কিনারে পৌঁছে গেছে সাবমারসিবলদুটো। এখুনি নিচে পড়ে যাবে। অদৃশ্য শক্তিটা জ্বালামুখের ভেতরে টানছে ওদেরকে। হ্যামারহেডকে এক্সপি-ফোরের পেছনে নামিয়ে আনল রানা, নাক ঠেকাল খোলের গায়ে। মেইন পাওয়ার ব্যবহার করে একটু গুঁতো দিল, ঢালের কিনারে আটকে রাখতে চায়।
হ্যামারহেডের নাকে শরীর ঠেকিয়ে ঘুরতে শুরু করল এক্সপি-ফোর, থামানো যাচ্ছে না।
‘এটাই শেষ সুযোগ, ববি,’ বলল রানা।
শান্ত ভঙ্গিতে ক্যালকুলেশন সারল মুরল্যাণ্ড। বোতাম চাপতেই প্রসারিত হলো মেকানিক্যাল আর্ম, ধাতব তিনটে আঙুল আঁকড়ে ধরল এক্সপি-ফোরের হ্যাণ্ডেল।
‘ধরেছি,’ জানাল ও।
ততক্ষণে খাদের কিনারে পৌঁছে গেছে
পৌঁছে গেছে খুদে সাবমেরিনটা। পড়ে গেল ভেতরে। সঙ্গে টেনে নিল হ্যামারহেডকে। ঠেকানোর চেষ্টা করল না রানা—এখন যদি থ্রটল দেয়, মেকানিক্যাল আর্ম ভেঙে যাবে, ওজন নিতে পারবে না।
কালো পানি চিরে নিচের দিকে চলেছে হ্যামারহেড আর এক্সপি-ফোর। কয়েক সেকেণ্ড পর সাবধানে থ্রাস্টার ব্যবহার করল রানা, মৃদু টান দিয়ে খাড়া প্রাচীরের পাশ থেকে সরিয়ে আনল এক্সপি-ফোরকে, আস্তে আস্তে লেভেল হলো সাবমার- সিবলদুটো। তবে এখনও ডুবছে ওরা। জ্বালামুখের কেন্দ্রের দিকে ওদেরকে টেনে নিয়ে চলেছে অদৃশ্য কোনও শক্তি।
থ্রটল ব্যবহার করল রানা, ক্রমশ গতি বাড়াল। পেছনে টো করছে এক্সপি-ফোরকে। তাড়াহুড়ো করছে না; বুঝতে পারছে, মেকানিক্যাল আর্মের ওপর যদি হ্যাঁচকা টান না পড়ে, ওটা টিকে থাকবে।
‘এখনও নামছি আমরা,’ মুরল্যাণ্ড বলল।
‘ওদের খোলে পানি ঢুকেছে বোধহয়, অনুমান করল রানা। ‘ওজন বেড়ে গেছে।’
থ্রটল ঠেলে দিল ও। ডোবার গতি কমল, স্পিড বাড়ল হ্যামারহেডের-একটু একটু করে উঠতে শুরু করল ওপরে।
সামনে বিশাল একটা আকৃতি মাথাচাড়া দিল। একশো ফুট লম্বা একটা পাথুরে কলাম, জ্বালামুখের ঠিক মাঝখান থেকে উঠে এসেছে। জিনিসটা ভলকানিক প্লাগ বলে সন্দেহ হলো রানার, আগ্নেয়গিরির মৃত্যুর পর জমে শক্ত হয়ে গেছে। সমস্যা হলো, ওদের পথরোধ করছে কলামটা।
‘ব্যালাস্ট ট্যাঙ্ক খালি করে দেব?’ জিজ্ঞেস করল মুরল্যাণ্ড।
‘না,’ মানা করল রানা। ‘মেকানিক্যাল আর্মের ওপর প্রচণ্ড প্রেশার পড়বে।’
থ্রটল বাড়িয়ে ফুল পাওয়ারে নিল ও, নাক ওঠাল হ্যামারহেডের। খুব দ্রুত কাছে চলে আসছে পাথুরে টাওয়ার।
‘কাম অন!’ দাঁতে দাঁত পিষল রানা।
ব্ল্যাকহোলের মত টাওয়ারটা যেন টানছে ওদেরকে। পেছনে বাড়তি ওজনের কারণে ওঠার গতি মন্থর।
‘জলদি ওঠ, ভাই।’ হ্যামারহেড যেন কোনও জীবন্ত প্রাণী, অনুরোধ করছে মুরল্যাণ্ড।
সরাসরি টাওয়ারের দিকে চলেছে সাবমারসিবল, মনে হচ্ছে বুঝি একটা বিমান আছড়ে পড়তে চলেছে পাহাড়ের গায়ে। সারফেসের সব আলো ঢাকা পড়েছে অতিকায় পাথরটার ছায়ায়। উঠছে হ্যামারহেড, তবে যথেষ্ট দ্রুত নয়।
‘রানা?’ ডাকল মুরল্যাণ্ড, একটা হাত ব্যালাস্ট কন্ট্রোলে।
‘না, দাঁড়াও!’
হঠাৎ করে আলো দেখা গেল সামনে। একেবারে শেষ মুহূর্তে টাওয়ারের ডগা অতিক্রম করল হ্যামারহেড, কোনোমতে সংঘর্ষ এড়াল। কন্ট্রোলের সাহায্যে সাবমার- সিবলকে লেভেল করল রানা, গতি বাড়তে দিল।
‘কানের পাশ দিয়ে গুলি গেছে,’ শব্দ করে শ্বাস ফেলল মুরল্যাণ্ড। ‘এত শান্ত ছিলে কী করে?’
‘কে বলল শান্ত ছিলাম?’ রানা হাসল।
প্যানেলের দিকে তাকাল মুরল্যাণ্ড। ‘ম্যাগনিটোমিটারের অবস্থা দেখেছ?’
ওর কথা কানে যাচ্ছে না রানার।
‘আমাদের ঠিক পেছনে তাক হয়ে আছে কাঁটা—পাথরের ওই টাওয়ারটার দিকে,’ জানাল মুরল্যাণ্ড। ‘হাই-ইনটেনসিটির একটা ম্যাগনেটিক ফিল্ডের মধ্যে আছি আমরা।’
অন্য কোনও সময় হলে বিষয়টা নিয়ে আগ্রহী হতো রানা, কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। বিস্ফারিত চোখে সামনে তাকিয়ে আছে ও। হ্যামারহেডের হলদে-সবুজ আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে এক অদ্ভুত দৃশ্য।
বিশাল এক জাহাজের মাস্তুল মাথা তুলেছে সামনে-ন্যাড়া গাছের মত দেখাচ্ছে। ওটার পেছনে রয়েছে একটা ছোট মাছধরা ট্রলার, কাত হয়ে আছে বালির ওপর। বাঁয়ে আরেকটা ধ্বংসাবশেষ… কোনোকালে একটা ট্র্যাম্প স্টিমার ছিল ওটা।
‘ববি, দেখতে পাচ্ছ?’
নড়েচড়ে বসল মুরল্যাণ্ড, নাক ঠেকাল ক্যানোপির গায়ে। জাহাজতিনটের ওপর দিয়ে হ্যামারহেডকে নিয়ে গেল রানা। চোখে পড়ল আরও বেশ কয়েকটা। কার্গো জাহাজ-পুরনো আমলের লিবার্টি শিপের মত দেখতে। গায়ে সামুদ্রিক আগাছা আর বালির আস্তর পড়েছে। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে নানা রকম কন্টেইনার, যেন ভাসমান কোনও জাহাজ থেকে পানিতে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে।
ছোট্ট একটা এয়ারক্র্যাফটের ডানা দেখা গেল; দেখা গেল চেনার অযোগ্য আরও কিছু আকৃতি—সবই মানুষের তৈরি।
‘কেমনতরো জায়গা এটা!’ রানার গলায় বিস্ময়।
‘মনে হচ্ছে জাহাজের গোরস্থান,’ মন্তব্য করল মুরল্যাণ্ড।
‘এখানে এল কী করে?’
কাঁধ ঝাঁকাল মুরল্যাণ্ড। ‘আমার কোনও আইডিয়া নেই।’
ধ্বংসাবশেষগুলো পেরিয়ে এল ওরা। সাগরের তলাটা আবার ফিরে পেল স্বাভাবিক চেহারা—সামুদ্রিক উদ্ভিদ আর প্রবালের সারি ছাড়া দেখার কিছু নেই। উল্টো ঘুরে জায়গাটা ভাল করে দেখার ইচ্ছে হলো রানার, কিন্তু এখন তার সময় নেই। আগে এক্সপি-ফোরকে পৌছে দিতে হবে ওপরে। হ্যামারহেডের নাক আবারও উঁচু করল ও, উঠতে শুরু করল সারফেসের দিকে। তলায় অদৃশ্য হয়ে গেল সাগরের মেঝে।
শেষ মুহূর্তে, নিচটা আঁধারে ঢেকে যাবার ঠিক আগে, এক পলকের জন্যে আরেকটা জিনিস দেখল রানা। বিশাল এক বিমানের ফিউয়েলায, অর্ধেকটা দেবে আছে বালিতে দীর্ঘ, সরু কেবিনটা দৃষ্টিনন্দন ঢেউ খেলে মিলেছে তিনটে ফিনের সমন্বয়ে গড়া ট্রিপল টেইলে।
এমন বিমান দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি নেই। মডেলটা চেনে রানা, ছবিতে দেখেছে বহুবার। অপূর্ব সুন্দর বিমানটা একটা লকহিড কনস্টেলেশন।