ধোঁয়া – শোভন সোম
সম্পাদক মশাই,
আপনার ফরমাশ মতো গল্প লিখতে বসে অনেক কাগজ নষ্ট করেছি। অনেক প্লট মাথায় ঘোরাফেরা করছে, কিন্তু লিখতে বসলেই কোন এক অদৃশ্য শক্তি বারবার আমার কলমকে এমন এক ঘটনার দিকে চালনা করছে, যে ঘটনার কথা আমি আজ পর্যন্ত কাউকে বলিনি। ঘটনাটি অতি ব্যক্তিগত। আপনি জানেন, ত্রিভুজ প্রেমের মূলে থাকে কিছু ঈর্ষা, কিঞ্চিৎ হীনমন্যতা বোধ। আপনি এও জানেন, ত্রিভুজ প্রেমের পথ কণ্টকসংকুল না হলেও বঙ্কিম তো বটেই। এই ধরনের প্রেমের পরিণতিতে একজনের হার ও একজনের জিত হয়ে থাকে। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যাকে হার মনে হয় আসলে তা জয় এবং অনেকে জিতেও হেরে যায়। যে হেরে যায় সে হেরে গিয়েও ছায়ার মতো, হাওয়ার মতো, আলোর মতো, গন্ধের মতো বাকি দু—জনের মাঝখানে বর্তমান থাকে। ত্রিভুজ প্রেমে তৃতীয় ব্যক্তিটির ভূমিকাও তেমনি।
সম্পাদক মশাই, ধান ভানতে শিবের গীত অনেক গাওয়া হল। আসল কথায় এবার আসি। এই কাহিনি নারী সম্পর্কিত এবং সেই নারী অগ্নি—চন্দ্র—সূর্যকে সাক্ষী রেখে বিয়ে করা আমার স্ত্রী।
আমার ফুলশয্যার রাতের অভিজ্ঞতা আদৌ সুখকর হয়নি। পরদিন সকালে বারান্দায় বসে বিনিদ্র রাতের ক্লান্তি দূর করবার জন্য দ্বিতীয় কাপ চা পান করছিলুম। ঝি—চাকরেরা পোর্চে দাঁড় করানো গাড়িতে মিষ্টির হাঁড়ি তুলে রাখছিল। উৎসব বাড়ির উদবৃত্ত মিষ্টান্ন আত্মীয়—বন্ধুজনের বাড়িতে বিতরণের রীতি আছে। ড্রাইভার রামদুলারে ইতিমধ্যেই মিষ্টি বিতরণের দুটো ট্রিপ দিয়ে এসেছে। এবারও সে স্বভাবতই তার গন্তব্যস্থল জানতে চাইল। আমি বারান্দা থেকেই গলা চড়িয়ে জানতে চাইলুম : মা, রামদুলারে কোথায় যাবে, বলে দাও!
মা সম্ভবত কাজে ব্যস্ত ছিলেন; ভেতর থেকে জবাব দিলেন, সইয়ের বাড়িতে।
আমি রামদুলারেকে বললুম, অমলদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসো। রামদুলারে আমার নির্দেশ শুনেও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল দেখে আমি চটে গেলুম : দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও।
রামদুলারে জবাব দিল, ভাই সাব, মিষ্টিগুলো তুলে নিতে বলুন। এখন পাঠানো ভালো দেখাবে না।
একটা সন্দেহের কাঁটা রামদুলারে আমার মনে বিঁধিয়ে দিল। ব্যাপারটা অনেকেই জানে। তা বলে একটা মাইনে করা ড্রাইভারের এমন আস্পর্ধা! অমলের সঙ্গে না—হয় অনিতার ভালোবাসাবাসি ছিল, তবু অনিতা আমার বিবাহিতা স্ত্রী এখন। মা তাঁর সইয়ের বাড়িতে মিষ্টি পাঠাচ্ছেন, অমলের জন্যে নয়।
রেগে অস্থির হয়ে আমি চেঁচিয়ে উঠলুম, ভালোমন্দ বিচার তোমার কাজ নয়, রামদুলারে। তোমাকে যা বলা হচ্ছে, তা করো।
সে শান্ত স্বরে বলল, আপনি একটু মাতাজিকে আসতে বলুন। আর মিষ্টিগুলো এ অবস্থায় পাঠাবেন না।
আমাদের কথাবার্তা শুনে মা নিজেই বেরিয়ে এলেন।
রামদুলারের সঙ্গে মা—র কথাবার্তা শুনে হতচকিত আমি দ্রুতপায়ে দোতলায় নিজের ঘরটিতে পালিয়ে এলুম। ঘরভরতি যৌতুকের জিনিসপত্র, টাটকা তাজা দোকান—দোকান গন্ধ আর সকালের ঝকঝকে আলো। আমি বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লুম। এরপর এখানে আর থাকা যাবে না, কালই বোম্বেতে ফিরে যাব এবং অনিতাকে সঙ্গে নিয়েই।
কিছুক্ষণ বাদেই অনিতা ঘরে ঢুকল। ওর সর্বাঙ্গে সুস্নাত স্নিগ্ধতা। ওর দিকে তাকিয়ে মনে হল, অনিতা যেন রূপকথার মানবী। দৈনন্দিনতার মধ্যেও এক দুর্জ্ঞেয় রহস্যে নিজেকে সে আবৃত করে রাখে।
অনিতা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল। আয়নায় আমি ওকে দেখতে পেলুম। দেখলুম তার চোখে রাতভর কান্নার চিহ্ন অবগাহনেও ধুয়ে যায়নি।
হালকা প্রসাধন সেরে অনিতা বলল, তুমি একটু উঠে ওই চেয়ারটায় বসবে! আমি বিছানা তুলব।
আমি হাত বাড়িয়ে ওর একটা হাত ধরলুম। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললুম, মিষ্টি কুল আমার ভুল হয়েছে; রাগ করো না।
অনিতা তেমনি দাঁড়িয়ে থেকে বলল, ভুল তোমার নয়। যা চেয়েছিলে, দিচ্ছি।
না, মিষ্টি কুল, ওগুলো তোমারই থাক। আমি দেখতে চাই না।
ওর কোনো ভাবান্তর আমার চোখে পড়ল না। আর ওর হাত ছেড়ে দিয়ে উঠে চেয়ারে বসলুম। ও শান্ত ভাবে বিনা তুলতে লাগল।
অমল গত রাতে এসেছিল। আমি তাকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছিলুম। উচ্ছ্বসিত নয়, উল্লসিত হয়েছিলুম। তাকে নিয়ে গিয়েছিলুম অনিতার কাছে। লাল বেনারসিতে, গয়নায় কনেচন্দনে অনিতাকে দেবীর মতো দেখাচ্ছিল। আমি বলেছিলুম, দেখ, কে এসেছে।
অনিতা চোখ তুলে তাকায়নি। অমল নীরবে অনিতার হাতে একটা নীল ফিতে বাঁধা মোড়ক তুলে দিয়েছিল। তারপর সে বহু অনুরোধ—উপরোধ অগ্রাহ্য করে না খেয়েই চলে গিয়েছিল। যাবার সময় বাইরে গিয়ে আমার দুটি হাত ধরে বলেছিল, ‘তমাল, তুই সুখী হ’।
আমি মনে মনে হেসেছিলুম। মনে হয়েছিল, ব্যর্থ প্রেমিকের আত্মপ্রসাদ— আহা, এতেই যদি তার মন ভরে তো ক্ষতি কি।
রাত বারোটা নাগাদ খাওয়া—দাওয়ার পালা চুকে যাবার পর যখন নিজের ঘরে এলুম, তখন ঘর শূন্য। কিছুক্ষণ বাদে বউদি অনিতাকে নিয়ে এল।
ভাই, তোমাদের আর জ্বালাতন করব না। অনেক রাত হল। এবার নিজের মানুষ বুঝে নাও।
বউদির রসিকতার জবাব দেবার মতো মনের অবস্থা ছিল না। আমি গিয়ে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিলুম। অনিতা ততক্ষণে এসে বিছানার পাশে দাঁড়িয়েছে। আমি একটানে ওকে কাছে এনেই জানতে চাইলুম অমল কী দিয়েছে!
অনিতা নিরুত্তর রইল।
কই, দেখাও।
অনিতার চোখ থেকে কান্নার বিন্দু উপচে পড়তে লাগল : সবই তো তুমি জানো।
আমি জানতুম, অমল অনিতার লেখা প্রেমপত্র ফিরিয়ে দিয়েছিল। ব্যর্থ প্রেমিকরা কখনো কখনো এমনি উদারতা দেখায়। আমি শ্লেষের স্বরে বললুম, এই নাটুকেপনার কী প্রয়োজন ছিল আজ! এই ঢং অন্তত আজকের দিনে সে না দেখালে কি পারত না!
অনিতা কান্না—ভেজা স্বরে বলল, তুমিই আমার সর্বস্ব।
মনের জ্বালা যেন বিছুটির জ্বালা, কিছুতে যেতে চায় না। আমি সেই জ্বালার বশে কথার পিঠে কথা তুললুম : দেখ, কথা দিয়ে মন ভিজিও না।
আমার বাকি রাত মনের জ্বালায় জ্বলে পুড়ে শেষ হল। ভোরের আলো স্পষ্ট হতেই রাতের সেই অপ্রসন্নতার জন্যে নিজেরই খারাপ লাগল। খামোকা আমি কেন সেন্টিমেন্টাল হতে গেলুম। জীবনের স্মরণীয় একটি রাত ব্যর্থ হয়ে গেল একজন তৃতীয় ব্যক্তির জন্যে। নারীর স্বামীত্বের প্রশ্নে পুরুষ চিরকাল নির্মম, নির্লজ্জ, সন্দেহপরায়ণ ও ঈর্ষাকাতর—জগতের এই সনাতন সত্য আমিও অগ্রাহ্য করতে পারিনি। যদি পারতুম, তবে অমলকে ক্ষমা করতুম আর ফুলশয্যার রাতের সব মাধুর্য আকণ্ঠ পান করতে পারতুম।
দুপুরবেলা মা—কে নিভৃতে ডেকে বললুম, মা, আমি কালই চলে যাব। অনিতাকেও নিয়ে যাব।
আমার ছুটির মেয়াদ তখনও ফুরোয়নি। অনায়াসে আরও চারদিন থাকতে পারি। ফেরা যাত্রা সেরে যাব, এটাই মা জানতেন। বোম্বেতে একটা ঘর নিয়ে থাকি, বড়ো ফ্ল্যাট না—পাওয়া পর্যন্ত অনিতা মা—র কাছে থাকবে কথা ছিল। হঠাৎ আমার অমন প্রস্তাবে মা স্পষ্টতই অসন্তুষ্ট হলেন, তোদের রাজ্যি ছাড়া কাণ্ডকারখানা আমি বুঝি না। তোরা যা খুশি তাই কর।
মা—র কথায় কী ইঙ্গিত ছিল, বুঝতে আমার কষ্ট হয়নি। অমলের সঙ্গে অনিতার ভালোবাসাবাসির কথা জব্বলপুর সুদ্ধ সব বাঙালি জানে। অমলের মা আমার মায়ের ছোটোবেলার সই। এলাহাবাদের মেয়ে দু—জনই। দু—জনেরই বিয়ে হয়েছিল জব্বলপুরে। দুই পরিবারে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা ছিল। মা তাই এই বিয়েতে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আপত্তি করেছিলেন।
আমি আর অমলও ছোটোবেলা থেকে একসঙ্গে পড়েছি একেবারে এমএ পর্যন্ত। আমরা রবার্টসন কলেজে যখন থার্ড ইয়ারে পড়ি, তখন অনিতার বাবা জব্বলপুরে স্টেশন মাস্টার হয়ে এলেন। অনিতা তখন ম্যাট্রিকের ছাত্রী। পনেরো বছর বয়েস। দু—বিনুনি বেঁধে শাড়ি পরে রিকশায় চড়ে রাইট—টাউনে স্কুলে যেত। আমাদের উনিশ বছরের উঠতি যৌবনের চোখে নেশা ধরানোর মতো ওই বয়েস ছিল যথেষ্ট। আমরা সাইকেলে করে কলেজে যাবার পথে রোজ রিকশায় ওর দেখা পেতুন। স্টেশন মাস্টারের মেয়ে দেখতে মিষ্টি, তাই আমরা নাম দিয়েছিলুম ইস্টিশনের মিষ্টি কুল। অমল সেই মিষ্টি কুলের ঘায়ে অতি সহজেই কাত হল। অমল ছিল মিশুকে।
অমল তার ভালোবাসার ব্যাপার নিয়ে আমার বা বন্ধুবান্ধব কারও সঙ্গেই কোনো আলোচনা করত না। আমরাও তাকে কোনোদিন কিছু জিজ্ঞেস করিনি। ছোটো শহরে বাঙালির সমাজও ছোটো, সবাই সবাইকে চেনে এবং কোনো কথাই গোপন থাকে না। অমল—অনিতার ব্যাপারও সবাই জানত। তাই নিয়ে কারও কৌতূহল ছিল না।
এমএ পাশ করে কপালের ফেরে আমি পেলুম বোম্বেতে বড়ো চাকরি আর অমল বসে রইল বেকার।
দু—বছর বাদে দিয়ে জব্বলপুরে এসে দেখি, অমল স্কুলে মাস্টারি করছে। মঢ়াতালের কফি হাউসে বসে অনেকক্ষণ গল্প করলুম ওর সঙ্গে। বললুম, চল আজ দু—জনে এম্পায়ারে ছবি দেখে আসি। মনে আছে, কলেজে পড়বার সময় এম্পায়ারে আর ডিলাইটে কত ছবি দেখেছি!
সে আর মনে নেই!—অমল হাসল : তুই তো আরও দু—তিন দিন আছিস। যাব’খন একদিন। আজ একটু কাজ আছে।
রাখ তোর কাজ। কতদিন একসঙ্গে ছবি দেখিনি।
অমল সলজ্জ হেসে বলল, তমাল আজ থাক।
আমার জেদ চেপে গেল, তোর এমনকী কাজ দেখব আমি, চল যাই।
অমল আমাকে নিয়ে সিদ্ধিবালা গ্রন্থাগারে আসতেই বইয়ের তাকের জ্যামিতি ফুঁড়ে যেন সে উদয় হল,—আমার বই এনেছ!
হ্যাঁ, এনেছি। এই যে!—অমল হেসে ওর হাতে একটা বই তুলে দিল। আমাকে বলল, চিনতে পারিসনি!
আলবাৎ। ইস্টিশনের মিষ্টি কুল না। আচ্ছা, আমি চলি রে।—আমি বললুম।
ছবি দেখতে যাইনি বলে রাগ করিসনি তো?
না রে না।—আর কিছু বললুম না বটে, তবে তখন আমি তাজ্জব বনে গেছি। এত বলল আমি অনিতার দিকে তেমন ভাবে তাকিয়ে দেখিনি? আজ যেন ওকে নতুন করে দেখলুম। যে অনিতাকে প্রথম দেখেছিলুম, সে ছিল কিশোরী, আমাদের উঠতি যৌবনের চোখের নেশা। আজ যাকে দেখলুম, সে যে সেই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে, সে আজ দেহের কামনা, মনের বাসনা।
কী আছে অমলের মধ্যে! এই রোগা পাতলা চেহারা, বাঁ গালে বিশ্রী জড়ুল, ওই তো সামান্য এক চাকরি, বাড়ির অবস্থাও তথৈবচ, একগাদা স্বজন পরিজনের সংসার। কী এমন পেয়েছে অনিতা ওর মধ্যে! আমার মাইনে চার অঙ্কের, আমি মোটামুটি সুপুরুষ, স্বাস্থ্যবান, স্মার্ট বলে আমার খ্যাতি আছে, বাড়ির অবস্থা বেশ ভালো; নিজস্ব বাড়ি, গাড়ি, সচ্ছলতা, সিকিউরিটি—আর কী চায় মেয়েরা। আদর্শ স্বামী হবার সব যোগ্যতা, কোনো মেয়ের প্রেমিক হবার সংগত অধিকার আমার আছে!
সম্পাদক মশাই, এইখানেই দুটি সমান্তরাল রেখা ‘হঠাৎ অন্য একটি রেখার আবির্ভাবের দরুন তিনে মিলে ত্রিভুজ হয়ে গেল। ইটারন্যাল ট্রায়ানগল।
বোম্বেতে ফিরে গেলুম বড়ো জ্বালা নিয়ে।
সুযোগ আপনিই এল। মা চিঠিপত্রে বিয়ের কথা তুলতেই আমি আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার প্রার্থনা জানালুম। প্রত্যুত্তরে মা আমায় সরেজমিনে তলব করলেন।
বাপ—মরা আদুরে বাধ্য ছোটো ছেলে এমন অবাধ্য হবে, মা ভাবতে পারেননি। আকারে ইঙ্গিতে অমল অনিতার মাখামাখির কথাও তুলেছিলেন। আমি বলেছিলুম, তাহলে থাক, আমার বিয়ের দরকার নেই। মিথ্যে ডেকে পাঠালে।
সম্পাদক মশাই, এত ঘটনার ঘনঘটার পর যদি গল্পটা এখানে শেষ করতে পারতুম, তবে ভালো হত। কিন্তু আপনি যা চান, এবং যে উদ্দেশ্যে এই এত কথা বলা, তার শুরু এখান থেকে।
শ্বশুরমশাই পরদিন আমাদের দু—বাথের একটা কূপের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ট্রেনের কামরার নিভৃত পরিবেশে প্রথম মিলিত হবার যথেষ্ট অবকাশ ছিল, কিন্তু বাঁধবার আগেই যে বীণার তার ছিঁড়ে গেছে, সেই বীণা তো সুরহীনা। আমাদের ব্যর্থতার ফিরিস্তি দিয়ে কী হবে, সম্পাদক মশাই! কোন এক কবির কবিতায় পড়েছিলুম :
যে কথা ভুলতে চাও কিছুতে পারো না ভুলতে তা’
সে যেন বুকের মধ্যে টনটনে পুরাতন ব্যথা।
বোম্বেতে আমার এক—কামরার আবাস বান্দ্রায়। নতুন সংসার পাতবার কোনো আনন্দ, উৎসাহ আমি বোধ করিনি। পঁচিশ বছর বয়সের সব কামনা বাসনা নিয়ে যতবার অনিতার কাছে যাবার চেষ্টা করেছি, মনে হয়েছে একটি তৃতীয় অবাঞ্ছিত সত্তা ছায়ার মতো, হাওয়ার মতো, আলোর মতো, গন্ধের মতো আমাদের জড়িয়ে অবশ্যম্ভাবী, দুর্নিবার হয়ে রয়েছে।
কয়েক মাস বাদে অনিতা বেশ স্বাভাবিক হয়ে এল। ওর সাংসারিক কথাবার্তা, টুকরো হাসি, ঈষৎ অভিমানের মধ্যে ওর স্বাভাবিকতার স্পর্শ পেলুম। আমি চাকরির সময়টুকু বাদে বাকি সময় অনিতার সান্নিধ্যেই কাটাতুম। ছুটির দিনে হয় সিনেমায় নয় কোথাও একসঙ্গে বেড়াতে যেতুম। একদিন সন্ধেবেলা অনিতা আমাকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বলল, তোমাকে একটা জিনিস দেব।—বলে অমলের দেওয়া সেই মোড়কটা আলমারি খুলে আমার হাতে তুলে দিল।
আমি বাথরুমে গিয়ে সেটা পুড়িয়ে ফেলে ঘরে এসে দেখি, অনিতা বিছানার এক কোণে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে। আমি সেই প্রথম তাকে উন্মুক্ত বাহু দিয়ে বুকে টেনে নিলুম।
অনিতার দেহে এরপর মাতৃত্বের লক্ষণ দেখা দিল; কিন্তু আমি সাহস করে ওকে জব্বলপুরে পাঠালুম না। বোম্বে আসা তক আমরা আর জব্বলপুরে যাইনি।
বিশেষ করে দুপুরবেলা আমার অনুপস্থিতিতে অনিতার একাকিত্ব এই সময় আদৌ নিরাপদ নয়, তাই ওর দেখাশোনার জন্য বুড়ি ঝি সুলভাবাঈকে ঠিক করলুম।
একদিন অফিসের জরুরি কাজে আটকা পড়ে ফিরতে বেশ দেরি হল। বাড়ি যখন পৌঁছলাম তখন রাত আটটা। ফিরে এসে দেখি অনিতা মিটিমিটি হাসছে। টিপয়ে রাখা অ্যাশট্রে ভরতি চার্মিনারের টুকরো। অনুমান করলুম, কেউ এসেছিল। অনিতা আমাকে কিছু বলল না; আমিও আপাতত চেপে গেলুম।
দূরে গির্জের ঘড়িতে ঘণ্টা পিটিয়ে রাত এগিয়ে চললেও আমার চোখে তিলমাত্র ঘুম এল না। আর থাকতে না পেরে অনিতাকে কাছে টেনে জিজ্ঞেস করলুম, মিষ্টি কুল, কে এসেছিল বললে না তো?
অনিতাও জেগে ছিল, অবাক হয়ে বলল, কখন!
তাহলে অ্যাশট্রেতে অত সিগারেটের টুকরো কেন?
যাও, দুষ্টুমি কোর না।—খিলখিল শব্দে অনিতা হেসে উঠল।
না, না, সত্যি করে বল।
বাব্বা, কোনদিন না আমায়ই ভুলে যাবে।
হেঁয়ালি রাখ, অনিতা। কী লুকোচ্ছ তুমি?
আমার স্বরের কঠোরতায় অনিতা বিস্মিত হল বোঝা গেল তার জবাবে।
হেঁয়ালি করব কেন? তুমিই তো ন—টায় বেরিয়ে সাড়ে ন—টা না বাজতেই ফিরে এলে। বললে, দেরি করে যাবে। সারাদিন রইলে। তিনটের সময় বেরিয়ে গেলে। বলে গেলে ফিরতে দেরি হবে।
সুলভাবাই কোথায় ছিল?—রুদ্ধশ্বাসে আমি জানতে চাইলুম।
ও তো তুমি আসতেই তোমাকে দেখে চলে গেল। ফিরল বিকেল চারটের পর।
অবাক হইনি, ভয় পেলুম। সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল, দরদর করে ঘামের স্রোত রোমকূপ গড়িয়ে ঝরতে লাগল। চার্মিনার সিগারেট আমি খাই না। চার্মিনার আমার সয় না। অনিতা সেটা জানে না সম্ভবত। দু—তিনটে ব্র্যান্ডে আমার আনাগোনা, কিন্তু কদাপি চার্মিনারে নয়। চার্মিনার অমলের প্রিয় ব্র্যান্ড ছিল। আমি অনিতাকে তখন আর কিছু বললুম না।
পরদিন সুলভাবাইকে রাস্তায় পাকড়ালুম। কাল সারা দুপুর সে কোথায় ছিল, জানতে চাইলুম। কুঞ্চিত মুখে হাসির ঝালর ঝরিয়ে বুড়ি বাই জবাব দিল, ওই তো এক চিলতে ঘর। তোমরা দুটিতে থাকলে আমি মাঝখানে বাগড়া দিই কেন?
ওকে আর কিছু জিজ্ঞেস করা সমীচীন বোধ করলুম না। সেদিন আর শরীর খারাপের অজুহাতে অফিসে গেলুম না।
অনিতাকে শত চেষ্টাতেও কিছু বলতে পারলুম না। গতকাল আমি ন—টার সময় অফিসে বেরিয়ে বান্দ্রা স্টেশন থেকে ন—টা দশের ট্রেন ধরে ভি—টি স্টেশনে গেছি। ফোর্ট এলাকায় অফিসের বাড়িতেই ছিলুম সন্ধে ছ—টা অবধি! মাঝখানে একবার বাথরুমে আর একবার ডিরেক্টরের চেম্বারে যাবার জন্যে চেয়ার ছেড়ে উঠেছি। বাকি সময়টুকু বলতে গেলে চেয়ারের সঙ্গে সেঁটে ছিলুম। কাজের চাপ ছিল খুব বেশি। কোয়ালিটি কন্ট্রোল সেমিনারে ডিরেক্টর যে পেপার পড়বেন, সেটি গতকাল হাজার রেফারেন্স মেটিরিয়্যাল আর ডাটা ঘেঁটে আদ্যোপান্ত তৈরি করে টাইপ করা কপি ডিরেক্টরের হাতে তুলে দিয়ে তবে অফিস ছেড়েছি। যতক্ষণ অফিসে ছিলুম, দুনিয়ার তাবৎ কিছু তো বটেই, অনিতার সম্পর্কেও একলহমা ভাববার ফুরসত পাইনি। আমার পক্ষে তাই সারা দুপুর অনিতার সান্নিধ্যে শারীরিক উপস্থিতির কোনো প্রশ্নই ওঠে না। অনিতা বা সুলভাবাই অন্য কাউকে আমি বলে ভুল করবে মনে হয় না, অথচ আমি কস্মিনকালেও চার্মিনার খাই না। তাহলে তমাল—কৃষ্ণ মজুমদার নামক ব্যক্তি সকাল সাড়ে ন—টা থেকে দুপুর তিনটে অবধি একই সঙ্গে দু—জায়গায় কী করে উপস্থিত ছিল!
পরদিন অফিসে বেরোবার সময় অনিতাকে বলে গেলুম, আমি কিন্তু অফিস কামাই করে ফিরে আসব না। ফিরতে সন্ধে ছ—টা সাতটা হবে। ততক্ষণ যেন বাই থাকে।
অনিতা কী বুঝল কে জানে।
সেদিনও ফিরে দেখি টিপয়ে রাখা অ্যাশট্রে ভরতি চার্মিনারের টুকরো। আমি আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলুম, এত সিগারেট কে খেল?
অনিতা জবাব দিল, সারা দুপুর বিছানায় গড়িয়ে তুমিই তো ধ্বংস করলে।
আমি!—বিস্ময়ে আমার গলা আটকে এল।
না তো কে? তুমিই তো সাড়ে ন—টায় ফিরে এলে, রইলে তিনটে অবধি। আমি তোমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলুম, আজ যে বড়ো বলে গেলে কামাই করবে না, অথচ সে কথা রাখতেই পারলে না।
তাই নাকি?
কেন, এত ক্ষীণ তোমার স্মৃতিশক্তি! কী দেখছ অবাক হয়ে! তুমি না বললে, মিষ্টি কুল, তোমার কথা বড্ড মনে হচ্ছিল, ট্রেনে চড়তে গিয়েও তাই ফিরে এলুম।
তারপর!
তারপর তুমি তো সুলভাবাইকে সিগারেট আনতে পাঠালে। ওই তো প্যাকেটটা পড়ে আছে।
মাথার বালিশের কাছে পড়ে থাকা চার্মিনারের হলদে প্যাকেট তুলে এনে আমি বললুম, এই সিগারেট তো আমি খাই না, অনিতা!
কী বলছ তুমি!—অনিতা অবাক হয়ে তাকাল আমার মুখে : আমি বললুম, অত সিগারেট খাচ্ছ কেন। তুমি আমার কথা শুনলে না। আচ্ছা, তুমি আজকাল সব ভুলে যাও কেন, বল তো!
কিন্তু অনিতা, আমি তো চার্মিনার খাই না। তুমি জান না!
অনিতা স্তব্ধ বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। থরথর করে ওর ঠোঁট দুটো কাঁপতে লাগল, কিন্তু কোনো কথা উচ্চারিত হল না।
আমি আর নিজেকে চেপে রাখতে পারলুম না, এই ভয়ংকর খেলা আর আমার সহ্য হল না, দাঁতে দাঁত কষে বললুম, অনিতা, তুমি যত কথাই সাজাও না কেন, আমি সকাল ন—টায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা অফিসেই গেছি। বিকেল পাঁচটা অবধি অফিসে ছিলুম। অফিসের প্রতিটি লোক এর স্বপক্ষে সাক্ষী দেবে। সুতরাং…সুতরাং…
আমার অসমাপ্ত কথা কেড়ে নিয়ে অনিতা হঠাৎ জ্বলে উঠল, তুমি মিথ্যুক, মিথ্যেবাদী। সব পেয়েছ, এখন আরও কী চাও বল! তুমি এত ছোটো আমি জানতুম না।
এই বিস্ফোরণের জন্যে আমি তৈরি ছিলুম না।
পরদিন সুলভাবাইকে পইপই করে বলে গেলুম, যেন দুপুরে আমি এলেও সে অনিতাকে ছেড়ে না যায়। টেলিফোনে যোগাযোগ করে সেদিনই সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরে এসে মনঃসমীক্ষকের কাছে অনিতাকে নিয়ে গেলুম। যে ক—দিন চিকিৎসা চলল, ছুটি নিয়ে রইলুম বাড়িতে। নির্দিষ্ট ক—টি সিটিং—এর পর ডাক্তার আমাকে নিভৃতে ডেকে বললেন, আপনি কি আপনার স্ত্রীকে সন্দেহ করেন?
আমিও তাঁকে যতদূর সম্ভব খুলে বললুম। তিনি প্রেসক্রিপশন দিলেন, উপদেশ দিলেন : আপনার স্ত্রী মানসিক অবদমনে ভুগছেন, আর তার জন্যে আপনি দায়ী। ওঁকে সর্বদা প্রসন্ন রাখতে চেষ্টা করবেন। খোলামেলা জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাবেন। আর, কখনো কোনো কৈফিয়ত তলব করবেন না; কোনো কথায় বুঝতে দেবেন না যে আপনি ওঁকে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ করেন। ভালো কথা, ক—দিন গোয়াতে গিয়ে হাওয়া বদলে আসুন না! দেখবেন, মনের দিক থেকে আপনিও অনেকখানি সেরে যাবেন।
গোয়া যাওয়া হয়নি ছুটির অভাবে। শেষপর্যন্ত অনিতাকে জব্বলপুরে মা—র কাছে পাঠানো ঠিক করলুম।
রিজার্ভেশন হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু যত যাবার দিন এগিয়ে আসতে লাগল, অনিতার ভাবান্তর লক্ষ্য করে বিস্মিত হলুম। অনিতা কচি খুকির মতো আবদেরে হয়ে উঠল, আমার গলা জড়িয়ে প্রতিনিয়ত গাইতে লাগল : ওগো, তোমাকে ছেড়ে আমি যাব না। তাহলে আমি বাঁচব না।
হৃদয় তো হৃদয়, এমন কাকুতিতে পাষাণও গলে।
ওকে আর জব্বলপুরে পাঠালুম না।
মনঃসমীক্ষকের কাছে যাবার পর থেকে এই পর্যন্ত প্রায় সাত—আট মাস আর দ্বিপ্রহরে দ্বিতীয় তমালকৃষ্ণ মজুমদারের আবির্ভাব ঘটেনি। আমিও তাই বেশ নিশ্চিন্ত ছিলুম। অনিতাকে ঘিরে সারাক্ষণ আসন্ন মাতৃত্বের এক স্বপ্নমেদুর বিহ্বল ভাব জড়িয়ে থাকত; ওকে আমি যেন নতুন করে চিনলুম। আমার সন্তানের মাতৃত্বের অধিকারে সে এখন আমার আরও বেশি আপন, আমার রক্তের রক্ত, নিশ্বাসের নিশ্বাস, অস্তিত্বের অস্তিত্ব।
সম্পাদক মশাই, এখানেও যদি শেষ টানতে পারতুম, তাহলে নিজেকে সুখী বলে মনে করতুম। কিন্তু শেষটা যতই আকস্মিক হোক, আমাকে তা বলতেই হবে।
সেদিন সকাল ন—টায় অফিসের উদ্দেশে বেরিয়ে স্টেশন অবধি এসেও হঠাৎ বুকের ভেতর কেমন হা—হা করে উঠল, আমি বাড়ি ফিরে এসে কলিংবেল টিপতেই দরজার ম্যাজিক—আইতে অনিতার চোখের আভাষ দেখতে পেলুম।
ঝটিতি দরজা খুলে অনিতা বিছানার দিকে একবার মুখ ফিরিয়ে আবার আমার মুখে তাকাল। অনিতার সারা মুখে আতঙ্কের ছাপ, ব্যাস বিস্রস্ত, চুল অবিন্যস্ত। এলোমেলো বিছানায় এককোণে অ্যাশট্রেতে আধ—পোড়া চারমিনার ধোঁয়ার ফাঁস ওড়াচ্ছে।
অনিতা বিস্ফারিত চোখে তেমনি আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, কে তুমি, কে…
আমি, আমি অনিতা।—অধীর আগ্রহে এগিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলুম : কী হয়েছে তোমার?
আমার বাহুবন্ধনে তখন অনিতা থরথর করে কাঁপছে : তাহলে একটু আগে কে এসেছিল গো! সে—ও তো তুমি। আমি যখন দরজা খুলতে উঠি, তুমি তো তখন বিছানায় শুয়েছিলে। আবার কী করে তুমি বাইরে থেকে ফিরে এলে গো!—বলতে বলতে অনিতার মুখ বেয়ে গাঁজলা গড়াল, আমার বুকে যে মূর্ছা গেল।
আপ্রাণ চেষ্টা করেও ডাক্তাররা কাউকেই বাঁচাতে পারলেন না। অনিতার সারা মুখে মৃত্যুর শান্ত প্রতিভা, ঈষৎ স্ফুরিত দুটি ঠোঁটে কোন সে অনুচ্চারিত শব্দের স্তব্ধতা, অনিতা এখন অতি দূরের রহস্যের, রূপকথার মানবী।
নার্স হয়তো আমার মনের গোপন কথা বুঝতে পেরেছিলেন। যে অনাগত সন্তানকে ঘিরে অনেক কল্পনার প্রশ্রয় দিয়েছি, অথচ যে পৃথিবীর আলোয় চোখ মেলল না, এই হাওয়ায় বুক ভরে নিল না, তাকে একবার দেখতে বড়ো ইচ্ছে হল। আলতো হাতে শিশুর মুখের আবরণ নার্স সরিয়ে দিতেই আমি দেখলুম, শিশু অমল শুয়ে আছে। কোনো ভুল নেই— অমলই; মায় বাঁ—গালের সেই জডুüলটি পর্যন্ত!
অব্যক্ত যন্ত্রণায় আমি চোখ বন্ধ করলুম। এ কী করে সম্ভব! অমল যে আমার ফুলশয্যার রাতে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। ড্রাইভার রামদুলারের মুখে এই বার্তা শুনেই তো পরদিন আমি জব্বলপুর থেকে পালিয়ে এসেছি।
অমল এতদিন আমার আর অনিতার মাঝখানে অদৃশ্য দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর এখন, দুই মৃত্যুর মাঝখানে জেদ, দম্ভ আর ঈর্ষার ব্যবধান সৃষ্টি করে মূর্তিমান আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমি জিতে গিয়ে হেরে গেলুম। দেহ সৎকার করে ঘরে ফিরে আলো জ্বাললুম। চতুর্দিকে আমাদের বিবাহিত জীবনের স্মৃতির ছাপ। ঘরময় বুকচাপা, দম আটকানো চারমিনারের গন্ধ। দরজা—জানলা খুলে ফুলস্পীডে পাখা চালিয়ে দিলুম। রঞ্জিতবাবু, ওই গন্ধ নিরন্তর আমাকে জড়িয়ে রয়েছে। এর থেকে কি পরিত্রাণ আছে?