ধূম্রজটিল

ধূম্রজটিল

অধ্যায় ১

কান্যকুব্জ বর্ধিষ্ণু নগরী, সমুদ্রগুপ্তের বিশাল সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। রাজগৃহ থেকে বারাণসীর বাণিজ্যপথে এই নগরীর গুরুত্ব অসীম; গঙ্গা ও ঈষান নদীর তীরে গড়ে ওঠা জনপদটি স্থল ও জল দুই পথেই সুসংযুক্ত। আর সে কারণে, বৃহত্তর কান্যকুব্জ ভুক্তি গুপ্তসাম্রাজ্যের একটি সামরিক কেন্দ্রও বটে। দক্ষিণ পশ্চিমের স্বাধীন ক্ষত্রপ রাজ্যের শ্যেণদৃষ্টি থেকে সীমান্ত সুরক্ষিত রাখতে এখানেই গড়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও আধিকারিক কার্যালয়। সদ্য অধিকারে আসা মথুরা ও এরাকন্যা অঞ্চল কান্যকুব্জ ভুক্তির অন্তর্ভুক্ত। কান্যকুব্জের উপারিক উগ্রসেন একজন প্রতিভাবান সেনানায়ক, সেইসাথে বিচক্ষণ আধিকারিক; তিনি নিজগুণে সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র।

নগরীর মাঝখানে, উপারিকের প্রাসাদ ও আধিকারিক কার্যালয়ের থেকে কিছুটা দূরত্বে গড়ে উঠেছে সুরম্য বৈশ্যপল্লী; সেখানে কিংশুক ও মন্দার গাছের ছায়া ঘেরা পাথরে বাঁধানো পথ, আর তার দুইপাশে সারি দিয়ে প্রাচীর ঘেরা সব বাগানবাড়ি। বাড়ীগুলির মতই, এখানকার অধিবাসীরাও ধনে ও মানে বিশিষ্ট। বৈশ্যপল্লীর পূর্ব সীমায় একটি বড় আমের বাগান, আর তার ধার ঘেঁসে একটি সুন্দর দোতলা গৃহ; এটি শ্রেষ্ঠী চারুদত্তের বাসস্থান। শ্রেষ্ঠী মধ্যবয়সী, তবে সুদর্শন ও সুস্বাস্থের অধিকারী; এই গৃহে তিনি একাই থাকেন, ব্যক্তিগত সেবক, পাচক ও দুটি সহায়ক নিয়েই তাঁর গৃহস্থালী। ব্যবসায়ের কারনে আগে যাতায়াত থাকলেও, কান্যকুব্জে বছর খানেক হল পাকাপাকি ভাবে স্থিতু হন তিনি, বাড়ীটি সেইসময়েই তৈরী হয়েছে। শোনা যায়, তাঁর আদি বাড়ী ছিল রাজগৃহে, কিন্তু কয়েক বছর আগে এক ভীষণ অগ্নিকাণ্ডে স্ত্রীপুত্র হারিয়ে শোকতাড়িত ভবঘুরে জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন শ্রেষ্ঠী। পরিবার বিয়োগের বেদনা কাটিয়ে তিনি আবার গৃহী হয়েছেন, তবে গৃহিনীর অধিষ্ঠান ঘটেনি এখনও। গৃহিণী না থাকলেও সঙ্গিনীসুখ থেকে বঞ্চিত নন চারুদত্ত, পরিচিতদের ধারনা, গণিকাপল্লীতে যাতায়াত আছে তাঁর।

গৃহের একতলায় অতিথি আপ্যায়নের জন্য রয়েছে বিশ্রামকক্ষ, শ্রেষ্ঠী সেই ঘরের জানালার পাশে একটি সুখাসনে বসে মনযোগ সহকারে কিছু নথি পরীক্ষা করছেন; তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত মুখশ্রী ও পেশীবদ্ধ শরীর দেখে বৈশ্য নয় বরং তাঁকে জাতিতে ক্ষত্রীয় বলে ভুল হয়। কিছু আগে নগরীর বিপনন কেন্দ্র থেকে ফিরেছেন দিনের কাজ সেরে, নির্জন সন্ধ্যা বেশীরভাগ দিনই ব্যবসায়িক হিসাব নিকাশ বা পুথি পাঠ করেই কাটে তাঁর, আজও তার ব্যতিক্রম নয়। বাইরের আলো কমে এসেছে, ব্যক্তিগত সেবক জম্বুক একহাতে জ্বলন্ত দীপদানি ও অন্যহাতে একটি লিপি নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। দীপদানিটি সমুখের পিঠিকায় রেখে, লিপিখানি প্রভুর দিকে বাড়িয়ে দেয় সে নিঃশব্দে, চারুদত্ত আনমনে সেটি হাতে নিয়ে, নথিতে মনযোগী হন। তবে জম্বুক বিদায় হবার সাথে সাথে লিপিখানি খুলে দেখেন তিনি, সুগন্ধি রেশমী বস্ত্রে লেখা সংক্ষিপ্ত বার্তা; পড়তে পড়তে মুখে স্মিত হাসি ফুটে ওঠে শ্রেষ্ঠীর। হয়তো, আজকের সন্ধ্যা নির্জনে কাটবেনা তাঁর।

***

নগরীর মাঝখানে অনেকখানি অংশ জুড়ে পণ্যবীথি, কর্মব্যস্ততা ও দেশী বিদেশী বণিকদের উপস্থিতিতে জায়গাটি কান্যকুব্জের অন্যতম আকর্ষন। পাথরে বাঁধানো মূল রাজপথের দুইপাশে বড় বড় বিপনি, তাদের ভিন্ন ভিন্ন পসরা, তবে সবচেয়ে বেশী চোখে পড়ে গন্ধদ্রব্য ও সুগন্ধির ভাণ্ডার। রাজপথ থেকে যে সকল শাখাপথ ছড়িয়ে পড়েছে মূল বিপনিগুলিকে সামনে রেখে, সেখানে চোখে পড়ে সারিসারি কর্মশালা; অগরু, চন্দন ও জাতিপুষ্পের মিলিত সৌরভে ভারাক্রান্ত সেই অঞ্চলের বাতাস; কর্মশালাগুলিতে সুগন্ধি তৈরী হচ্ছে বুঝতে পারা যায় সহজেই। কান্যকুব্জ উৎকৃষ্ট সুগন্ধি উৎপাদনের কারনে সমস্ত আর্যাবর্তে বিখ্যাত, এখানকার তৈরী অগরু ও চন্দনের তেল এবং পুষ্পসুবাস সরবরাহ হয় দূর দূরান্তরে। শ্রেষ্ঠী চারুদত্তের গন্ধদ্রব্যের বিপণিটি মূল রাজপথের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে, তবে নিজস্ব কর্মশালা নেই তাঁর বাকি গন্ধবণিকদের মত। সুগন্ধি ছাড়াও অগরু, ধুনক, গুগগুল ও ধুপক জাতীয় গন্ধদ্রব্যও পাওয়া যায় তাঁর পণ্যসম্ভারে। শ্রেষ্ঠী সুদুর সুবর্ণভূমি থেকে গন্ধদ্রব্য আমদানী করে সরবরাহ করেন কান্যকুব্জের কর্মশালাগুলিতে, পরিবর্তে সুগন্ধি সংগ্রহ করে সেগুলি সরবরাহ করেন বারানসী ও ভৃগুকচ্ছের বৃহত্তর বাণিজ্যকেন্দ্রে।

পণ্যবীথীর শাখাপথে ছোট একটি বিপনি, তার বাইরের অংশে পরিবস্ত্র ঘেরা অতিথিকক্ষ ও ভিতরভাগে একটি কর্মশালা। ছোট হলেও এখানে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পদধূলি পরে, বহির্কক্ষের সাজসজ্জা থেকেই তা স্পষ্ট হয়। এটি ভদ্র ধনঞ্জয়ের কর্মশালা, তিনি জাতিতে স্বর্ণকার; তাঁর শিল্পকর্মের গুণগ্রাহী নগরীর প্রায় সকল ধনাঢ্য মানুষ। শোনা যায়, স্বয়ং উপারিক উগ্রসেনের অন্দরেও ধনঞ্জয়ের তৈরী গহনার বিশেষ সমাদর।

অঘ্রানের সকাল, বেলা প্রায় দ্বিতীয় প্রহর, অতিথিকক্ষের জানালার পরিবস্ত্রের ফাঁক দিয়ে নরম রোদ এসে পড়েছে কক্ষের মাঝখানে; ধনঞ্জয় ভূমিসংলগ্ন মন্দুরায় বসে নিবিষ্ট মনে কয়েকটি রত্ন পরীক্ষা করছেন, পশমের নকশাদার উত্তরীয়টি আলগোছে ছড়িয়ে আছে কাঁধে, তাঁর সৌম্যকান্তি মুখশ্রীতে যৌবনের লাবন্যের চেয়ে বুদ্ধির দীপ্তি ও বিচক্ষণতা অধিক স্পষ্ট।

দরজায় মৃদু করাঘাতের শব্দে সচকিত হন স্বর্ণকার, আলগোছে ভেজানো দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন শ্রেষ্ঠী চারুদত্ত। তাঁকে দেখে ধনঞ্জয়ের মুখ উজ্জ্বল হয়, নীরব হাসি বিনিময়ে প্রীতির সম্পর্ক প্রকাশ পায় দুজনের মধ্যে। চারুদত্ত প্রায়ই ধনঞ্জয়ের জন্য রোমক রত্ন সংগ্রহ করেন ভৃগুকচ্ছের বণিকদের কাছ থেকে, এছাড়াও কোনও দ্যুষ্প্রাপ্য রত্নের সন্ধান থাকলে ধনঞ্জয়কে সংবাদ দেন; সে থেকেই এই বিপণিতে তাঁর যাতায়াত। দুজনের মধ্যে ব্যবসায়িক বিশ্বস্ততার কারণে একপ্রকার বন্ধুত্ব তৈরী হয়েছে যা ঠিক ব্যক্তিগত না হলেও সম্পূর্ণ ভাবে পেশাগত ও নয়।

‘স্বাগতম ভদ্র, আজ সকাল থেকে আপনাকেই স্মরণ করছিলাম’, ধনঞ্জয় অভ্যর্থনা করেন অতিথিকে।

‘কোনও বিশেষ প্রয়োজনে কি?’

‘হ্যাঁ, কয়েকটি উৎকৃষ্ট গুরুরত্ন অঙ্গুরীয়ের অনুরোধ এসেছে, আমার সংগ্রহে যা আছে যথেষ্ট নয়, ভেবেছিলাম আপনি যদি আনিয়ে দিতে পারেন।’

‘হঠাৎ কান্যক্যব্জে অর্থাভাব ঘটেছে নাকি, সকলেই গুরুরত্ন ধারণে ব্যস্ত?’ চারুদত্ত রসিকতা করেন।

‘কয়েকদিন হল ত্রিকালজ্ঞ শঙ্কুদেব আবার এসেছেন নগরীতে’, ধনঞ্জয়ের অর্থপূর্ণ ব্যাখ্যায় হেসে ওঠেন দুজনেই।

‘আজ আমিও নিজের প্রয়োজনে এসেছি ভদ্র; এই মরকতটি দিয়ে একটি গহনা বানিয়ে দিতে হবে আপনাকে’, চারুদত্ত একটি রেশমীবস্ত্রের থলিকা থেকে একখানি অতি উচ্চমানের মণি বের করে ধনঞ্জয়কে দেন।

‘অপূর্ব! কিরকম গহনা চান আপনি? অঙ্গুরীয়ের পক্ষে কিছু বৃহৎ এই রত্ন; কন্ঠে পরবেন কি?’

‘কণ্ঠহার হলে ভালো হয়, তবে নারীকন্ঠের উপযুক্ত করে তৈরী করুন।’ শ্রেষ্ঠীর কথা শুনে কিছুটা অবাক হলেও মুখের ভাবে তা প্রকাশ করেন না ধনঞ্জয়। চারুদত্ত সম্ভবতঃ এরকম অনুরোধ আগে কখনও করেননি তাঁর কাছে।

***

উপারিক উগ্রসেনের কার্যালয় বাগান ঘেরা একখানি দোতলা প্রাসাদ, প্রাসাদের চারপাশে কঠিন সুরক্ষাব্যবস্থা; একতলার কক্ষগুলিতে বিভিন্ন আধিকারিকদের কাজের স্থান ও উপর তলাটি সম্পূর্ণভাবে উপারিকের ব্যক্তিগত কার্যালয়। দোতলার সামনের দিকে একটি সভাগৃহ, সেটি একাধারে দর্শন কক্ষ ও মন্ত্রণালয়, আর পিছন দিকে উপারিকের কর্মকক্ষ ও বিশ্রামকক্ষ। দোতলায় ওঠার একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রবেশপথ আছে প্রাসাদের পিছনদিক থেকে, সেটির দরজা রক্ষার দায়িত্বে থাকে দুইজন করে উর্ধতন দ্বারী। নীম্নতল থেকে উপরে ওঠার সিঁড়িতেও লোহার দরজা, দ্বারীর অনুমতি ছাড়া সেখানেও প্রবেশ করা চলে না।

কর্মকক্ষে লেখন পীঠিকার উপর রাখা কিছু প্রশাসনিক সনদ, সেগুলি একে একে পরীক্ষা করে নিজস্ব শীলমোহরে নামাঙ্কিত করছেন উগ্রসেন, পাশে অপেক্ষায় রয়েছেন সহকারী শ্রীদাম; সনদ সংক্রান্ত উপারিকের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলেছেন তিনি, প্রয়োজনে দেওয়ালের নিধানিকা থেকে নিয়ে আসছেন বিভিন্ন নথী। উগ্রসেন বয়সে যুবক, কিন্তু গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ, সাবধানী ও বিচক্ষণ; কোনও কাজে নিশ্চিত না হয়ে সিদ্ধান্ত নেননা। তাঁর বিশ্বস্ত অনুচরেদের একজন ভদ্র শ্রীদাম, মূলতঃ কার্যালয়ের নথিবিষয়ক কাজের দায়িত্বে থাকলেও, সামরিক গূঢ় মন্ত্রনাতেও উপারিকের সঙ্গী থাকেন এই অভিজ্ঞ আধিকারিক।

‘কেতু ও শঙ্খচূড় এসেছেন কিনা একবার খোঁজ নিন ভদ্র’, সনদ্গুলিতে স্বাক্ষরপর্ব শেষ করে মন্তব্য করেন উগ্রসেন।

‘ওঁরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন সভাগৃহে, পূর্বেই সংবাদ পাঠিয়েছেন।’ শ্রীদামের উত্তর শুনে সভাগৃহের দিকে রওয়ানা হন উপারিক, শ্রীদাম তাঁকে অনুসরণ করেন।

***

সভাগৃহে অপেক্ষায় রয়েছেন দুই রাজপুরুষ, দুজনেই প্রায় সমবয়স্ক, যুবাপুরুষ এবং দুজনেরই একেবারে বিশেষত্বহীন চেহারা, ভীড়ের মাঝে দেখে চিনে রাখা শক্ত। আর তার চেয়েও বড় কথা, সাজপোশাকের পরিবর্তন ঘটিয়ে এঁদের যেকোনও পেশার মানুষ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যায়। এঁরা উগ্রসেনের গুপ্তচর বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিক, কেতুবর্মা ভৃগুকচ্ছ্বের বাণিজ্যকেন্দ্রে ও শঙ্খচূড় কান্যকুব্জ ভুক্তির অন্তর্গত সীমান্তবর্তী নগরী ও গঞ্জগুলিতে কার্য পরিচালনা করেন। অভিবাদন পর্ব শেষ হতে আলোচনা শুরু হয় রূদ্ধ সভাকক্ষে, এখানে যেসকল ব্যক্তি যাতায়াত করেন, নীচের কার্যালয়ে তার সংবাদ পৌঁছোয় না। চরবাহিনীর সাফল্য নির্ভর করে মন্ত্রগুপ্তিতে, একথা মনে প্রানে বিশ্বাস করেন উপারিক।

‘কোনও নতুন সংবাদ আছে কি ভদ্র কেতু? পশ্চিমা ক্ষত্রপদের উপর বিশ্বাস রাখা কঠিন। তার উপর এতবড় বাণিজ্যকেন্দ্র ওদের করায়ত্ত।’

‘নতুন সংবাদ সেভাবে কিছু নেই, তবে মাগধী বণিকদের উপর নজরদারী বজায় আছে, সময়ে সময়ে পণ্যপরীক্ষার ছুতায় নিগ্রহও ঘটে থাকে রাজকর্মচারীদের হাতে। বিগত আশ্বিনে এক মাগধী লবণ ব্যবসায়ীকে ধরে নিয়ে যায় দণ্ডাধিকারিকের প্রহরী, অভিযোগ গুপ্তচরবৃত্তি। পরে অবশ্য প্রমানাভাবে ছেড়ে দেয়।’

‘শ্রেষ্ঠী কি আপনার অনুগ্রহভোগী?’ উগ্রসেনকে চিন্তিত দেখায়।

‘আজ্ঞে না, অন্য এক ব্যক্তি একই নামে বাস করেছিল সেখানে কয়েকমাস, তবে গোলমালের আভাস পেয়ে আগেই স্থান ত্যাগ করেছিল সে।’ কেতুবর্মার ইঙ্গিতপূর্ণ উত্তরে হাসি খেলে যায় উপারিকের ঠোঁটে।

‘ভদ্র শঙ্খচূড় কিছু বলতে চান মনে হচ্ছে?’ শঙ্খচূড়ের চেহারায় চঞ্চলতা লক্ষ্য করে প্রশ্ন করেন উপারিক। বক্তব্য শুরু করার আগে কিছুটা সময় নেন আধিকারিক।

‘ঘটনা সামান্যই, তবু ঠিক নিশ্চিন্ত হতে পারছিনা, আপনাকে জানাতে চাই সেকারণে। বেশ কিছুদিন যাবৎ এক মূক ও বধির যুবা এরাকন্যার পথেঘাটে, পণ্যবীথীতে ঘোরাঘুরি করছিল। যুবক ঈষৎ পাগলাটে, তবে শান্তিপ্রিয়, স্থানীয় দোকানীরা দয়াপরবশ হয়ে খাবার দাবার দিত তাকে। কিন্তু সপ্তাহ খানেক আগে, একটি ঘটনা ঘটে। রাজপথে এক ক্ষ্যাপা ষাঁড় তেড়ে আসে বেলা দ্বিপ্রহর নাগাদ; ব্যস্ত পথ, সকলে প্রাণভয়ে সরে যেতে থাকে তার দৃষ্টিপথের বাইরে। গোলমালে একটি শিশু সামনে পড়ে যায়, তার সঙ্গী গৃহসেবকটি চিৎকার করলেও উদ্ধারের চেষ্টা করে না। ঠিক সেই মূহূর্তে এই মুক-বধির যুবক ছুটে এসে প্রচণ্ড শক্তিতে ষাঁড়ের গতিরোধ করে, শিশুটি রক্ষা পায়, জনতার সমবেত চেষ্টায় ষাঁড়ও বশীভূত হয়। কিন্তু ততক্ষণে এই যুবক গুরুতর আহত হয়েছে, বৈদ্যগৃহে নিয়ে যেতে যেতেই তার প্রাণনাশ হয়।’

‘কিন্তু এতে সংশয়ের কারণ কি?’

‘সংশয়ের কারণ দুটি। প্রথমতঃ মৃতব্যক্তির বাহূতে একটি নাগচিহ্নযুক্ত কবজ পাওয়া যায়। আর দ্বিতীয় কারণ হল, এক বধির তার ঘোলাটে বুদ্ধি নিয়ে চিৎকারই বা শুনল কি করে, আর উদ্ধার কাজে তৎপরতাই বা দেখাল কি ভাবে।’

‘আপনি কি মথুরার পরাজিত নাগরাজ পরিবারের গুপ্তচর সন্দেহ করছেন লোকটিকে? কিন্তু তাদের এখন আর অস্তিত্ব কোথায়? রাজা গণপতি নাগের মৃত্যু ঘটেছে, তিনি অপুত্রক ছিলেন। গুপ্তচর বাহিনী নিযুক্ত করার মত বাহুবল, অর্থবল অথবা উচ্চাশা কিছুই সে পরিবারের আর অবশিষ্ট নেই। তাছাড়া নাগ বংশজ বহু নাগরিক বাস করে মথুরা ও তার আশেপাশে, এও সেরকম কেউ হতে পারে। আর লোকটি হয়ত স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতেই ছুটে গিয়েছিল উদ্ধারকাজে। তবে আপনি সতর্কতা বাড়ান, এরাকন্যায় নতুন আগন্তুকদের উপর গোপনে দৃষ্টি রাখার ব্যবস্থা করুন।’

আলোচনা সভা ভঙ্গ হয়, শীতের অপরাহ্নের মন কেমন করা ছায়াচ্ছন্নতায় ঘরে ফেরার আবহ। উগ্রসেন কিছু পরে কার্যালয় ত্যাগ করেন সেদিনকার মত।

***

নগরীর মূল জনবসতির থেকে কিছুটা দূরত্বে ঈষাণ নদীর তীরে বনানীর ছায়াঘেরা একটি নিভৃত পল্লী, এটি কান্যকুব্জের গণিকাদের আলয়। এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি সুদৃশ্য বাগানবাড়ী, উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা গৃহগুলি রাস্তা থেকে চোখে পড়েনা, প্রবেশ পথেও কড়া পাহারার ব্যবস্থা। এই স্বতন্ত্র পল্লীটিতে শুধুমাত্র গণিকাশ্রেষ্ঠাদেরই বাস; বহু বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজপুরুষদের নিয়মিত যাতায়াত এই সব গৃহে।

পড়ন্ত বিকেলের ম্লান রৌদ্র ছুঁয়ে আছে দোতলার দীর্ঘ অলিন্দটিকে, সমুখে বয়ে চলেছে ঈষান নদী, জলস্রোতের মৃদু কলধ্বনিতে সুললিত মুখরতা। অলিন্দের সাথে যুক্ত সভাকক্ষটির একপাশে ভূমিতে পাতা মন্দুরায় এক বিশিষ্ট অতিথি আধশোয়া হয়ে বিশ্রাম করছেন; অন্যপাশে মৃদঙ্গ ও মঞ্জিরা হাতে সঙ্গীত পরিবেশনে প্রস্তুত দুই সুন্দরী তালবাদিকা; জানালা ও ঘরের থামে ফুলেরসাজ, কুরঙ্গীতে জ্বলছে সুগন্ধি ধুপক, গোধূলির অস্তরাগে মোহময় পরিবেশ। ধীরে, অন্দরের দরজা থেকে কক্ষে প্রবেশ করে এক দিব্যাঙ্গনা, নূপরের মৃদু নিক্কন তুলে কক্ষের মাঝখানে আলপনা চিত্রিত বেদিকায় গিয়ে দাঁড়ায় নারী, পরনে তার অগ্নিবর্ণ অন্তরীয় ও স্বর্ণজরীর মেখলা, কুঙ্কুম চিত্রিত অপূর্ব মুখশ্রী, সিঁথিতে পদ্মরাগ মণি; যৌবনের উদযাপন দেহের প্রতিটি বিভঙ্গে, চেহারার প্রতিফলন তার নামেও, সে বসন্তমল্লিকা। অতিথিকে করজোরে অভিবাদন করে নটী, স্মিত হাসি ও কোমল কটাক্ষে অভিষিক্ত হন সম্মানিত রাজপুরুষ। বাদ্য শুরু হয়, আর তারই সাথে স্বর্গীয় নৃত্যশৈলী জেগে ওঠে মায়াবী দেহভঙ্গীমায়।

বসন্তমল্লিকা এই গণিকাপল্লীর রত্নশ্রেষ্ঠা, তার নৃত্যসভায় নিমন্ত্রন পেতে বহু মান্যগন্য ব্যক্তিই ব্যাকুল; কিন্তু সীমিত কিছু মানুষেরই সে সৌভাগ্য ঘটে থাকে। আর নটীর একান্ত সান্নিধ্যলাভের অধিকার সমগ্র কান্যকুব্জে কেবল একজনেরই আছে, তিনি আজকের সভার মহামান্য অতিথি, উপারিক উগ্রসেন।

নৃত্যসভা শেষ হয়, উগ্রসেনকে পাশের বিশ্রামকক্ষে নিয়ে যায় বসন্তমল্লিকা। সেখানে নিজের হাতে আহার্য পরিবেশন করে সে পরম যত্নে।

‘তুমি আগে গ্রহন কর প্রিয়ে’, উগ্রসেন স্মিত হেসে নটীর মুখে তুলে দেন প্রতিটি আহার্য, প্রণয়ালাপের আড়ালে প্রতিদিনকার এই ছলনাটুকু বুঝতে পারলেও বসন্তমল্লিকা উপভোগ করে এই অন্তরঙ্গতা। উগ্রসেন সাবধানী রাজপুরুষ, ব্যক্তিগত মূহূর্তেও সতর্কতা ত্যাগ করেননা।

***

বসন্তমল্লিকা নটী গুণধরীর শিষ্যা ও কন্যাসমা, তার গৃহেই বাস। গুণধরী এককালের সুন্দরী ও বিদূষী গণিকা, এখন বয়স বেড়েছে। দীর্ঘকাল অবসর যাপনের পরে সম্প্রতি নিজের একমাত্র কন্যা তনুশ্রী ও পালিতা কন্যা বসন্তমল্লিকাকে নিয়ে নতুন করে উন্মুক্ত করেছে সে গৃহদ্বার অতিথিদের জন্যে।

তনুশ্রী বসন্তমল্লিকারই সমবয়স্কা, কিন্তু চেহারা ও ব্যক্তিত্বে সম্পূর্ন বিপরীত। তার চেহারার স্নিগ্ধ যৌবনশ্রী সুশীতল বনছায়ার মত, সম্মোহনী নয়, বরং শান্তির আশ্বাস সেখানে। তনুশ্রীর চলনে বলনে সহজ সাবলীলতা, অতিথিকে তুষ্ট করার অতিরিক্ত প্রয়াস নেই ব্যবহারে। বেশীরভাগ গণিকার মত নৃত্যে পারদর্শী নয় সে, মায়ের বহূ অনুযোগ উপেক্ষা করে বীণাবাদন শিক্ষা করেছে সেই কিশোরী বয়স থেকে, তার সুরঝঙ্কারে লাস্য নেই, আছে আত্মমগ্নতা। বসন্তমল্লিকার তুলনায়, তনুশ্রীর অনুরাগী সংখ্যা কম, তার অতিথিদের বেশীরভাগই বয়স্ক শ্রেষ্ঠী, যাঁরা মূলতঃ কিছুটা শান্তিপূর্ণ একান্ত সময় কাটাতে আসেন গণিকাগৃহে। তবে বৈপরীত্য যতই থাক সৌহার্দ্রের অভাব নেই এই দুই তরুনীর মধ্যে, এরা একে অন্যের প্রিয়সখী ব্যক্তিগত জীবনে।

অপরাহ্নের স্বপ্নমদির আলোয়, মরকত মণির হরিৎ আভা প্রতিফলিত হয় তনুশ্রীর লজ্জানত মুখশ্রীতে, কণ্ঠহারটি স্বহস্তে তাকে পরিয়ে দিয়ে মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকেন শ্রেষ্ঠী চারুদত্ত।

‘কেমন হয়েছে বললে না তো প্রিয়ে, পছন্দ হয়নি কি?’ চারুদত্তের প্রশ্নে নীরব থাকে তনুশ্রী।

‘পরিবার পরিজনহীন ছন্নছাড়া জীবন, তোমার মত তরুণীর হৃদয় পাওয়া যায় কিসে, জানা নেই। হয়তো এ উপহার অকিঞ্চিৎকর।’ চারুদত্তের বক্তব্যে সঙ্কোচ প্রকাশ পায়। তনুশ্রীর ওষ্ঠাধর কেঁপে ওঠে, দুফোঁটা অশ্রু ঝরে পরে চোখের কোল বেয়ে।

‘একি তুমি কাঁদছ! কেন?’ বিস্মিত চারুদত্ত তার মুখখানি তুলে ধরেন পরম আদরে।

‘এ আনন্দের অশ্রু দেব; উপহার অতি মূল্যবান, কিন্তু তার সাথে রয়েছে যে প্রীতি, আমার কাছে তা অমূল্য। এই আনুকুল্যের প্রতিদান দিতে পারি সে ক্ষমতা আমার কোথায়!’ তনুশ্রীর কণ্ঠস্বর বীণার তানের মতই সুমধুর, তার শান্ত বাচনভঙ্গীতে এমন কিছু আছে, যা হৃদয় ছঁয়ে যায়।

‘এক নিঃসঙ্গ বিগতযৌবন পুরুষের জীবনে নতুন আশার আলো দেখিয়েছ তুমি, এর চেয়ে বড় আর কি উপহার হতে পারে প্রিয়ে? আমার এই অনিশ্চিত জীবনে স্থিরতা এনেছ তুমি, ভয় হয় বুঝি বাঁধা পড়ে যাব তোমার অঞ্চল ছায়ায় চিরকালের তরে।’

‘সে সৌভাগ্য কি গণিকার কপালে থাকে প্রভু? আপনি অকারনে ভীত হবেন না।’ স্মিত হেসে উত্তর দেয় তনুশ্রী, তার চোখের গভীর দৃষ্টিতে বিষণ্ণতার আভাস দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায়।

‘যদি বাঁধা না পড়ি, জানবে তার কারন ভিন্ন, তোমার সামাজিক অবস্থান নয়।’ তনুশ্রীর হাত দুটি নিজহস্তে নিয়ে কথাগুলি উচ্চারণ করেন শ্রেষ্ঠী; নীরবে চেয়ে থাকেন দুজনে দুজনার দিকে, গোধূলির রাঙা আলোয় অভিষিক্ত হয় মিলন মুহূর্ত।

*** ***

অধ্যায় ২

কান্যকুব্জ ভুক্তির দক্ষিনে বিদিশা ও সাঁচী অঞ্চল জুড়ে ক্ষত্রপ রাজ শ্রীধরবর্মনের রাজত্ব, বছর দুয়েক হল মুখোমুখি যুদ্ধে রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুর্গনগরী এরাকন্যা গুপ্তসাম্রাজ্যের দখলে চলে গেছে। বৃহত্তর সামরিক শক্তির কাছে পরাজিত ক্ষত্রপরাজ মিত্রতার শর্ত মেনে নিয়ে বর্তমানে তাঁর সঙ্কুচিত রাজ্য নিয়ে সন্তুষ্ট আছেন। বেত্রবতী নদীর তীরে তাঁর রাজধানী প্রাচীন বিদিশা নগরী।

রাজসভা সংলগ্ন মন্ত্রণা কক্ষটিতে মহারাজ ও তাঁর অতিবিশ্বস্ত চারজন অমাত্য জরুরী আলোচনায় ব্যস্ত। পরিণত বয়স্ক সৌম্যদর্শন মহারাজ আপাততঃ অন্যদের বক্তব্য শুনতে মনযোগী, তাঁর মুখের ভাবে কিছু প্রকাশ না পেলেও কপালে চিন্তার রেখা গভীর হয়ে উঠেছে। মন্ত্রণাসভার মধ্যমণি শ্রীধরবর্মন হলেও প্রকৃত সভাপতি সেনানায়ক সত্যনাগ, এই আলোচনা সভার আয়োজন তাঁরই উদ্যোগে। সভার অন্য অমাত্যরা যথাক্রমে সুরসেন, রুদ্রবাহূ ও পঞ্চানন। সুরসেন সাঁচীর সীমান্তবর্তী দুর্গের অধিপতি, রুদ্রবাহূ মহাদণ্ডাধিকারিক ও পঞ্চানন সত্যনাগের সহকারী ও গুপ্তচর বাহিনীর অধিকর্তা।

‘ধর্মনাগের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর পর এরাকন্যার প্রশাসন সতর্কতা বাড়িয়েছে, এ অবস্থায় নতুন করে চর নিয়োগ প্রায় অসম্ভব।’ এরাকন্যার পরিস্থিতি বর্ণনা করতে মন্তব্য করেন পঞ্চানন।

‘নিজের কর্তব্য ভুলে ওইরূপ দায়িত্বজ্ঞানহীনের মত কাজ করবে তার মত অভিজ্ঞ ব্যক্তি, এ তো কল্পনারও অতীত। সকল অবস্থায় নিজেকে নির্বেদ, অনাসক্ত রাখা গুপ্তচরবৃত্তিতে আত্যাবশ্যক, তবু কিভাবে যে এরকমটা ঘটল! বিগত ছয়মাসের পরিশ্রম সকলই বিফলে গেলো!’ রুদ্রবাহূর গলায় হতাশার সুর স্পষ্ট হয়।

‘এ সবই ভাগ্যের ফের, ধর্মনাগকে দোষ দিয়ে লাভ নেই ভদ্র। বর্তমান পরিস্থিতিতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী না হওয়াই উচিৎ হবে বলে আমি মনে করি। গুপ্তসম্রাট শক্তিমান, তবে সত্যভঙ্গ করেননা; আমরা শত্রুতা না করলে, তাঁর দিক থেকে বিপদের আশঙ্কা দেখি না।’ মহারাজ ধীরে ধীরে নিজের বক্তব্য রাখেন।

‘ক্ষমা করবেন রাজন, এবিষয়ে আমার মত কিছু ভিন্ন।’ সেনানায়ক মন্তব্য করেন এতক্ষণে; তাঁর গম্ভীর কণ্ঠস্বরে অসম্ভব দৃঢ়তা। সত্যনাগ যুবাপুরুষ; দীর্ঘদেহী, বৃষস্কন্ধ, দেখেই যোদ্ধা বলে চেনা যায়। তীক্ষ্ণনাসা বুদ্ধিদীপ্ত মুখশ্রী, দুচোখের প্রখর দৃষ্টি দিয়ে যেন প্রতিপক্ষের অন্তঃস্থল দেখে নিতে জানেন। সব মিলিয়ে তিনি প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী।

‘এরাকন্যার বর্তমান পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নেওয়া কি ঠিক হবে সেনাধিপতি?’ মহারাজকে উদ্বিগ্ন দেখায়।’

‘না, এরাকন্যায় এখন উদ্যোগী হওয়া চলে না; তবে কান্যকুব্জের সেনাশিবিরে আঘাত হানার পরিকল্পনা করা যেতে পারে অবশ্যই। এতে, গুপ্ত সাম্রাজ্যে ধাক্কা লাগবে, সীমান্তে বিশৃংখলার সুযোগ নিয়ে এরানকন্যা ছিনিয়ে নেওয়া সহজ হবে আমাদের পক্ষে।’

‘কান্যকুব্জ! কিভাবে?’ মহারাজের সাথে বাকি সকলেও বিস্ময় প্রকাশ করেন, উপারিক উগ্রসেনের নিরাপত্তার বেড়াজাল ভেঙে সেখানে আক্রমণ করা আত্মহত্যার সামিল, একথা অনুভব করেন সকলেই।

‘কম্বল যতই মূল্যবান হোক, তাতে ছিদ্র থাকলে শীত আটকাবে না; ধরে নিন সেই ছিদ্রের ব্যবস্থা করতে পারলে উদ্দেশ্য সাধন সম্ভব।’

‘একটু বিশদে বলুন ভদ্র, আমরা বিহ্বল বোধ করছি।’ সুরসেন মন্তব্য করেন।

‘কান্যকুব্জের প্রশাসনে ছিদ্র সৃষ্টি করতে পারলে, আচমকা আক্রমনে জয়ের সম্ভাবনা।’

‘কিন্তু ছিদ্র সৃষ্টি করতে চর নিয়োগ করা প্রয়োজন, এরাকন্যার ঘটনার পরে এইকাজ খুব সহজ হবে কি?’ মহারাজ প্রশ্ন করেন।

‘এখন চর নিয়োগ করা বিপজ্জনক, তবে যদি বলি ছিদ্র তৈরীর জন্যে মুষিকের ব্যবস্থা আগেই হয়েছে, আস্বস্ত হবেন কি রাজন?’

‘ওঃ! আমার অগোচরেই এই ব্যবস্থা নিয়েছেন তাহলে?’ মহারাজ যেন কিছুটা ক্ষুন্ন।

‘ক্ষমা করবেন মহারাজ, এবিষয়ে কতখানি সফলতা আসবে, নিজের কাছে অস্পষ্ট ছিল এতদিন, সেকারণেই মৌন ছিলাম। যে মুষিকের কথা বলছি সে স্বাধীনচেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তি, বিদিশার প্রজা নয়।’

‘তবে কিসের স্বার্থ তার এই বিপদের ঝুঁকি নেবার?’

‘আমার মত তিনিও নাগ বংশীয়, পরাজিত মথুরা রাজপরিবারের কুলজ্যোতিষী ছিলেন শঙ্কুদেব; গণপতি নাগের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে দৃঢ়বদ্ধ ব্রাহ্মণ।’

‘একা শঙ্কুদেব কি বা করতে পারবেন?’

‘তাঁর পক্ষে সঙ্গী সংগ্রহ করা কঠিন হবেনা রাজন; তিনি বিচক্ষণ ব্যক্তি সব দিক বিচার করেই কর্তব্য স্থির করবেন। তাছাড়া, পাণ্ডিত্যের কারণে লোকপ্রিয় এবং সর্বস্থানে অবাধ যাতায়াত। শুনেছি স্বয়ং উগ্রসেনের পরিবারও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

‘বেশ, যা ঠিক মনে করবেন, তবে একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আপনাকে, অতি উচ্চাশার বশে ভুল পদক্ষেপ নিলে ধ্বংস হবে রাজ্য; নষ্ট হবে বহু নিরীহ প্রাণ।’ মহারাজের সাবধান বাণী শুনে সত্যনাগের মুখের পেশী দৃঢ় হয়ে ওঠে, তিনি নীরব থাকেন কিছুক্ষণ।

***

রাত্রি গভীর, কৃষ্ণপক্ষের একাদশী, চারিদিকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, নিঝুম সুপ্তিতে ডুবে আছে দ্বিতল প্রাসাদটি; শুধু ঘুম নেই সত্যনাগের চোখে। একান্ত কর্মকক্ষে দীপের আলোয় পদচারণা করছেন তিনি, চোখ দুটি গভীর চিন্তায় একাগ্র, কপালে ভ্রুকুটি। প্রতিশোধ! ভগিনীপতি রাজা গণপতির মৃত্যুর প্রতিশোধ, অসহায়া ভগিনী ও ভাগিনেয়ীদের দুর্দশার প্রতিশোধ! এরজন্যে বিদিশার ভবিষ্যৎ পণ রাখতেও তিনি মরীয়া।

কোথাও একটি পেচক ডেকে ওঠে নির্জনতা ভঙ্গ করে; এ কিসের সঙ্কেত? ধ্বংস না সৌভাগ্যলক্ষীর? শঙ্কুদেব গণনা করে দেখেছেন, উগ্রসেন স্বল্পায়ু, রাজা গণপতির বিষয়েও যুদ্ধের পূর্বে সেইরূপ ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন তিনি সত্যনাগের কাছে; তাঁর বিচার অভ্রান্ত। এই সুযোগ! বলে নয়, ছলে পরাস্ত করতে হবে শত্রুকে।

পূবের আকাশে ফিকে হয়ে আসে অন্ধকার, সেনাপতি ধীর পায়ে বিশ্রামকক্ষে প্রবেশ করেন, এখন শয়ন করবেন তিনি, বুঝিবা নতুন দিনের স্বপ্ন চোখে নিয়ে।

*** ***

অধ্যায় ৩

কান্যকুব্জ নগরীর একপ্রান্তে নিরিবিলি একটি দোতলা কাঠের গৃহ, তার চারপাশ ঘিরে সাজানো বাগান ও একপাশে একটি পুষ্করিণী। গৃহ সংলগ্ন উঠান ছাড়িয়ে পিছন ভাগের একপাশে অশ্বশালা ও খিড়কির দরজা, সামনের সিংহ দুয়ারে দ্বারী রয়েছে ও সমুখের পথের একধারে একটি আম্রকুঞ্জের ছায়ায় অতিথিদের শিবিকা ও অশ্ব রাখার ব্যবস্থা। গৃহটি শ্রেষ্ঠী হরনাথের বাগান বাড়ী, তবে আপাততঃ সেখানে শঙ্কুদেব বসবাস করছেন। প্রিয় শিষ্যের একান্ত অনুরোধেই এই ব্যবস্থা, আচার্যের ভ্রাম্যমান জীবনে, বিভিন্ন নগরীতে শিষ্যগৃহেই আতিথেয়তা নিয়ে থাকেন তিনি, এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়।

গৃহের নিচতলায় একখানি প্রশস্ত বসবার ঘর, সেখানে দেওয়াল সংলগ্ন একটি কাঠের বেদীতে বসে আছেন শঙ্কুদেব। নিয়মনিষ্ঠ কৃশ দেহ, বসার ভঙ্গী ঋজু, গোঁফ-দাড়িহীন মুখশ্রীতে দৃঢ় চোয়াল, তীক্ষ্ণ নাক আর উজ্জ্বল দুটি চোখ; সবমিলিয়ে শঙ্কুদেবের সঠিক বয়স আন্দাজ করা শক্ত, তবে পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে অবশ্যই। তাঁর সমুখে বেশ কয়েকটি সুখাসন রাখা রয়েছে, সেগুলির প্রায় সবকটিতেই বসে রয়েছেন দর্শনপ্রার্থী অতিথিরা; তাঁদের পোশাক ও চেহারায় বিশিষ্টতা স্পষ্ট। এঁরা যে শুধু ভাগ্যগণনার উদ্দেশ্যেই এখানে আসেন তা নয়, শঙ্কুদেবের মনগ্রাহী বেদান্ত আলোচনাও সভার অন্যতম আকর্ষণ।

‘প্রণাম আচার্য, আপনার আগমনের সংবাদ পেয়েছিলাম আগেই, কিন্তু আসতে দেরী হল’, এক সুবেশ যুবক কক্ষে প্রবেশ করে শঙ্কুদেবকে সম্ভাষণ করেন।

‘ভদ্র সুশান্ত যে, স্বাগতম, সকল সংবাদ শুভ তো?’

‘কিছুদিন যাবৎ একটি বিষয়ে কিছু বিব্রত আছি, অবসর মত একবার আপনার পরামর্শ নিতে চাই।’

‘বেশ, আজকের সভার শেষে বসব আপনার সাথে; জন্ম পত্রিকাটি সাথে এনেছেন তো?’ আচার্যের কথায় সম্মতি জানিয়ে গন্ধব্যবসায়ী সুশান্ত একপাশে আসন গ্রহণ করেন।

এরপরে আলোচনা এগিয়ে চলে। সাম্প্রতিককালের তাঁর ভৃগুকচ্ছ্ব ভ্রমণকালীন এক চৈনিক দার্শনিকের সাথে আলাপের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন শঙ্কুদেব আজকের সভায়; তাঁর গল্প বলার ভঙ্গীটি এতই আকর্ষনীয় যে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকেন সকলে।

***

সভাভঙ্গ হয়েছে কিছু আগে, অতিথিরাও বিদায় নিয়েছেন একে একে, অপরাহ্নের আলো ছায়াময় হয়ে উঠছে ক্রমশঃ। গৃহ সেবক দীপাধার রেখে গেছে কক্ষ মাঝে, দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে মুখোমুখি গম্ভীর আলোচনায় ব্যস্ত সুশান্ত ও শঙ্কুদেব। ভাগ্যবিচার ব্যক্তিগত বিষয়, সেকারনে গোপনীয়তা রক্ষা করা পছন্দ করেন আচার্য; তবে এই মূহূর্তে তিনি গণনায় আগ্রহী নন মোটেই, সুশান্তের সাথে তাঁর প্রয়োজন একেবারে ভিন্ন।

‘কান্যকুব্জ ভুক্তির সামরিক শিবিরের সেনাধ্যক্ষ বজ্রবাহূ, তবে উগ্রসেনের অনুমতি ছাড়া কোনও সিদ্ধান্তই নেননা তিনি। এছাড়া, উগ্রসেন নিজে শিবির পরিদর্শনে যান সপ্তাহে অন্তত একবার‘; সুশান্ত জানান।

‘হ্যাঁ, উগ্রসেন ক্ষমতার কেন্দ্রীকরনে বিশ্বাসী, নিজের হাতে সকল ক্ষমতা রাখতে চান। তাঁর বিচক্ষণতা ও সামরিক দক্ষতাও সন্দেহাতীত। এতে অবশ্য আমাদের সুবিধাই হবে।’

‘সে কি প্রভু, উগ্রসেনের সাথে পাল্লা দেওয়া সবচেয়ে কঠিন, যে কোনও সময় পরিকল্পনা ব্যর্থ হবার সম্ভাবনা। সে তুলনায় তাঁর অধস্তন যে কোনও অধ্যক্ষ প্রতিপক্ষ হিসাবে অনেক নিরাপদ।’

‘উগ্রসেনের বিষয়ে ভাবনা আপনি আমার উপর ছেড়ে দিন। এখন বলুন, শিবিরের সামরিক শক্তি কি প্রকার?’

‘দুই সহস্র অশ্বসেনা, পাঁচসহস্র পদাতিক, এছাড়া, ধনুর্বিদ একশত। তবে এই বাহিনী অত্যন্ত সুশিক্ষিত ও দ্রুত চলাচলে সক্ষম।’

‘হুমম… শিবিরের একটি মানচিত্রের প্রয়োজন, বহির্বৃত্ত থেকে নাভিকেন্দ্র, এর পূর্ণ অঙ্কন চাই, জোগাড় করতে পারবেন?’ শঙ্কুদেবের কথায় কিছুটা বিচলিত দেখায় সুশান্তকে।

‘কাজটা সহজ নয়, আশাকরি বুঝতে পারছেন আচার্য?’

‘সহজ হলে তো আমি নিজেই করতাম, আপনার সাহায্যের প্রয়োজন হোতনা ভদ্র। সহজ নয়, তাই তো এত প্রস্তুতি। আপনি অর্থের জন্য চিন্তা করবেন না, ছলে, বলে, উৎকোচ দিয়ে, যে ভাবে হোক ব্যবস্থা করুন।’ কথা বলতে বলতে শঙ্কুদেবের চোখদুটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে উত্তেজনায়।

***

শ্রেষ্ঠী হরনাথের বাসগৃহে আজ উৎসবের পরিবেশ, গুরুদেবের সেবার ব্যবস্থা হয়েছে সেখানে; শ্রেষ্ঠীপত্নী নিজহাতে পাক করেছেন অন্ন ব্যাঞ্জন। অতি ঘনিষ্ঠ কিছু অতিথির আগমন ঘটেছে সেই উপলক্ষে, যাঁরা একান্তে শঙ্কুদেবের সান্নিধ্য পেতে চান। উগ্রসেনের স্ত্রী রাজশ্রী হরনাথ পত্নীর বাল্যসখী, তিনিও এসেছেন। রাজশ্রী সুন্দরী ও যুবতী, ধনীগৃহের কন্যা হিসাবে এক সহজ আভিজাত্যের অধিকারিনী; তবে পরিস্থিতির কারণে কিছুটা অন্তর্মুখী হয়ে পড়েছেন। শঙ্কুদেব নগরীতে এলে তিনি সখীগৃহে এসে তাঁর দর্শন করে যান, নিজের জীবনের জটিলতা কাটাতে স্নেহশীল আচার্য তাঁর বড় আশ্রয়। ইচ্ছা থাকলেও নিজগৃহে ব্রাহ্মণকে আমন্ত্রন জানানোর ক্ষমতা তাঁর নেই, উগ্রসেন জ্যোতিষবিদ্যায় বিশ্বাসী নন, জগতের সব গণকদের প্রতিই তিনি ঘোরতর বিরূপ।

‘মুখখানি এমন আঁধার কেনো মাতা, গৃহে কোনও সমস্যা ঘটেছে কি?’ একান্ত সাক্ষাতে শঙ্কুদেব প্রশ্ন করেন রাজশ্রীকে, তাঁর কণ্ঠস্বর স্নেহে আর্দ্র।

‘নতুন করে আর কি ঘটবে প্রভু, পুরাতন সমস্যাই তো মিটল না আজও। আপনি স্বামীর কোষ্ঠী বিচার করে আমাকে কমলহীরা ধারণ করতে বললেন, পার্বতী ব্রত করতে বললেন, সবই তো করেছি, তবু স্বামীর মনযোগ পেলাম কই? দুটি কন্যার জন্ম দিয়েছি, পুত্র দিতে পারিনি, আজ তাই আমি মূল্যহীন ওঁর কাছে‘; রাজশ্রীর দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে।

‘সে অর্বাচীন, তোমার মূল্য বোঝেনি তাই। স্ত্রীর পূণ্যে স্বামীর মঙ্গল, পত্নীকে যাতনা দিয়ে নিজের অকল্যান ডেকে আনছে সে।’

‘না না ওকথা বলবেন না ভগবন, তাকে আপনি আশীর্বাদ করুন।’

‘দেবী, আমি সামান্য ব্যক্তি, আমার অভিশাপ বা আশীর্বাদের মূল্য কতটুকু? মানুষের নিয়তি তার কর্মফলের সাথে একসূত্রে গাঁথা, ভবিতব্য খণ্ডাতে পারে কে?’

‘আপনি একথা বলছেন কেন? আশঙ্কায় বুক কাঁপছে আমার।’

‘চিন্তা কোরনা পুত্রী, তোমার সংসার, সন্তান সবই সুরক্ষিত থাকবে আজীবন।’

‘আর স্বামীভাগ্য?’

‘গৃহলক্ষীকে অবহেলা করে যে গণিকাগৃহে যায়, তাকে ফেরায় কার সাধ্য!’

‘তবু আপনি কিছু উপায় করুন প্রভু’, রাজশ্রীর কণ্ঠস্বরের আকুতি স্পর্শ করে শঙ্কুদেবকে।

‘তুমি পারলে কিছুকাল পিতৃগৃহে বাস করো পুত্রী, হয়তো তাহলে সে তোমার অভাব বোধ করবে।’ তাঁর কথা শুনে দু-ফোঁটা অশ্রু নেমে আসে বিরহিনী বধূর চোখ বেয়ে।

***

দিবা দ্বিপ্রহর, ভোজনকক্ষের মাঝখানটিতে সুদৃশ্য আসনে আহারে বসেছেন উগ্রসেন, দাসীরা একে একে সমুখে সাজিয়ে দিয়ে যায় নানাবিধ অন্নব্যাঞ্জন রাজশ্রীর তত্ত্বাবধানে; স্বামীর পাশটিতে এসে হাসিমুখে বসেন তিনি অবশেষে।

‘আহার শুরু করুন আর্য, আজ আমি পাক করেছি আপনার জন্য।’

‘জটাধর কোথায়?’ স্বামীর প্রশ্নে চমকে ওঠেন রাজশ্রী।

‘আমি রান্না করেছি, তারপরেও আহার্য পরীক্ষার প্রয়োজন?’ আহত শোনায় তাঁর কণ্ঠস্বর।

‘হ্যাঁ প্রয়োজন; অযথা ঝুঁকি নেওয়া অবিবেচকের কাজ। জটাধর, জটাধর!’

‘তাকে আমি আসতে মানা করেছিলাম, ভুল হয়ে গেছে প্রভু। আপনার আহার্য না হয় আমিই চেখে দেখছি।’ কথাকটি বলে একে একে প্রত্যেকটি ব্যঞ্জন অল্প অল্প গ্রহণ করেন রাজশ্রী, তাঁর মুখখানি বেদনায়, অপমানে লাল হয়ে ওঠে ক্রমশঃ। উগ্রসেন লক্ষ্য করেননা কিছু, বরং আস্বাদন কার্য শেষ হতে আহার শুরু করেন রোজকার মতই।

‘আপনি তো কিছুই খেলেননা তেমন, ব্যঞ্জন স্বাদু হয়নি কি?’

‘এখনি জরুরী কাজে বেরোতে হবে, ব্যঞ্জনের রসাস্বাদনের সময় কোথায়?’ উগ্রসেনের বাক্য শেষ হতে না হতে দাসী এসে সংবাদ দেয় যে, শ্রেষ্ঠী ধনঞ্জয় এসেছেন। উপারিক খাওয়া শেষ করে বহির্কক্ষের দিকে রওয়ানা দেন।

‘উপারিক কাজের চাপে বিমনা থাকেন, তা বলে তোমার প্রতি স্নেহের অভাব নেই তাঁর।’ প্রবীণা দাসী জটিলা রাজশ্রীর বাপেরবাড়ী থেকেই তাঁর সঙ্গে এসেছে, কন্যাসমা গৃহস্বামিনীকে আশ্বাস দেয় সে।

‘এসব কথা এখন থাক।’

‘থাকবে কেন? দেখলে না স্বর্ণকার এসেছে, সে কি এমনি এমনি? তুমি যে ধনঞ্জয় ছাড়া কারও হাতের কাজ পছন্দ করনা, তিনি জানেন যে!’

***

‘কোনও নতুন সংবাদ আছে কি ভদ্র ধনঞ্জয়?’ উগ্রসেন রূদ্ধদ্বারে স্বর্ণকারের সাথে আলোচনায় বসেন।

‘সেরকম কিছু নয়, তবে এক ক্ষত্রপ শ্রেষ্ঠী বিগত কয়েকমাসে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করেছেন আমার সাথে। ব্যবসায়িক কারণে তাঁর নিজের এত ঘন ঘন কান্যকুব্জে আসার কারণ ছিল না।’

‘নগরীতে তাঁর গতিবিধির ব্যাপারে সন্ধান করেছিলেন কি?’

‘আপাত ভাবে সেরকম সন্দেহজনক কিছু দেখিনি, তবে……’

‘তবে কি? সঙ্কোচ না করে বলুন।’

‘আপনার সহকারী শ্রীদামের সাথে সাক্ষাৎ করেছে সে প্রতিবারই। অবশ্য আপনি হয়তো এ বিষয়ে জ্ঞাত আছেন।’

‘শ্রেষ্ঠীর নাম কি?’ উগ্রসেনের মুখভাব জটিল হয়ে ওঠে।

‘পশুপতি।’

‘বটে…। আপনি আপাততঃ এবিষয়ে নীরব থাকুন, শ্রেষ্ঠী এরপর নগরীতে এলে আমাকে সংবাদ দেবেন।’

‘বেশ, আমি আসি তবে।’

‘আপনার সাথে আর একটি ব্যক্তিগত প্রয়োজন ছিল।’

‘গহনা গড়াবেন তো?’ হেসে প্রশ্ন করেন ধনঞ্জয়।

‘হ্যাঁ, একখানি ইন্দুচন্দ হার গড়াতে চাই, শ্রেষ্ঠ রত্নের সমাহারে বানাবেন গহনাটি, মূল্যের জন্য ভাববেন না।’

‘আচ্ছা বেশ, দেবী রাজশ্রীর সাথে এবিষয়ে আলোচনা করে নেব আমি’, হেসে উত্তর দেন ধনঞ্জয়।

‘গৃহিনীকে জানানোর প্রয়োজন নেই, আপনি নিজরুচি অনুযায়ী তৈরী করুন। আর গহনা প্রস্তুত হলে সেটি আমার কার্যালয়ে পৌঁছে দেবেন।’ উগ্রসেনের বক্তব্যে কিছুটা রুক্ষতা প্রকাশ পায়, ধনঞ্জয় আর কথা না বাড়িয়ে বিদায় নেন।

***

কার্যালয়ে অপরাহ্নপ্রায়, উগ্রসেনের কর্মকক্ষ দীপের আলোয় আলোকিত। উগ্রসেন ও বজ্রবাহূ সেখানে সামরিক বিষয়ে আলোচনায় ব্যস্ত, যথারীতি শ্রীদামও রয়েছেন সাথে। বজ্রবাহূ মনে করেন কিছু গজসেনা শিবিরে যুক্ত হলে ভাল হয়, এতে শক্তি বাড়বে, তিনি উগ্রসেনের আনুমতি চান এ বিষয়ে।

‘আমার মতে গজসেনা শক্তি নয় বাধাসৃষ্টি করবে অযথা’, শ্রীদাম নিজের মতামত জানান। উগ্রসেনের একান্ত কাছের মানুষ হওয়ার সুবাদে এসকল আলোচনায় তিনি অবাধে নিজের বক্তব্য রাখেন, উপারিক তাঁর চিন্তা ভাবনাকে গুরুত্ব দেন।

‘একথা কেন বলছেন ভদ্র?’ উগ্রসেন আপত্তির কারণ জানতে চান।

‘আমাদের সামরিক শিবিরের প্রধান কাজ সীমা সুরক্ষায় সহায়তা, সেক্ষেত্রে ক্ষিপ্রতা অতি জরুরি। গজসেনা শক্তিশালী কিন্তু গতিমান নয়, যদি সত্বর কোথাও যেতে হয়, এদের কারণে পুরো শিবিরের গতি হ্রাস পাবে।’

‘সামরিক বিষয়ক সিদ্ধান্তে প্রশাসনিক আধিকারিকের মতামত নিতে গেলে তো কাজ করাই অসম্ভব! যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা নেই যার, তাকে গজসেনার সুফল বোঝাই কি করে?’ বজ্রবাহু রীতিমত বিরক্ত হন শ্রীদামের মন্তব্যে।

‘আপনি উত্তেজিত হবেন না সেনাধিপতি, ভদ্র শ্রীদামের ভাবনায় যুক্তি আছে। গতি হ্রাস পাবে সেনার এবিষয়ে সন্দেহ নেই আমারও, তবে আপনার যুক্তিও শুনতে আগ্রহী আমি।’

‘গজসেনা শিবিরের প্রতিরক্ষার জন্য অত্যন্ত কার্যকরী হবে, শিবিরের বহির্বৃত্তে যদি এদের ব্যবহার করা হয়, তাহলে অল্প সংক্ষক সেনা নিয়েও শিবির প্রতিরোধ করা সম্ভব।’

‘কিন্তু, আমাদের সামরিক শক্তি যথেষ্ট, গজসেনা না থাকলেও শিবির অতি সুরক্ষিত। তাছাড়া, সেনা শিবির আক্রমণ করতে গেলে শত্রুকে সীমা পেরিয়ে কান্যকুব্জে আসতে হবে, সে অসম্ভব!’ শ্রীদামের এই বক্তব্যকে সমর্থন করে গজসেনার প্রস্তাব বাতিল করে দেন উগ্রসেন। বজ্রবাহূর মুখমণ্ডল রক্তাভ হয়ে ওঠে অপমানে।

‘আপনি এই বিষয়টিকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নেবেন না আর্য, শ্রীদামের যুক্তি সঠিক মনে হয়েছে আমার এক্ষেত্রে।’ সেনাপতিকে একান্তে শান্ত করার চেষ্টা করেন উগ্রসেন।

‘আপনি বিচক্ষণ ব্যক্তি, আপনাকে পরামর্শ দিতে যাওয়া আমার পক্ষে বাতুলতা, তবু বলব, বিশ্বাসযোগ্যতা সকলক্ষেত্রে চিরস্থায়ী হয়না। ‘কথাটি বলে বিদায় নেন বজ্রবাহূ। উগ্রসেনের কপালে চিন্তার রেখা প্রকট হয়, সেদিনকার মত কার্যালয় ত্যাগ করেন তিনি আনমনে।

***

একপক্ষকাল কেটে গেছে, রাজশ্রী কন্যাদের নিয়ে পিত্রালয়ে বাস করছেন কিছুদিন হল; উগ্রসেন আপত্তি করেননি, শুধু জানিয়েছেন, ফেরার আগে সংবাদ দিতে, তিনি চতুর্দোলা ও রক্ষীদল পাঠাবেন। রাজশ্রীর মনে ক্ষীণ আশা, হয়তো তার প্রয়োজন হবে না, স্বামী নিজেই আসবেন তাঁদের নিতে, ধনঞ্জয়কে গহনার বরাত দিতেই ডেকেছিলেন তিনি, সে বিষয়ে তো সন্দেহ নেই।

এক অপরাহ্নের মায়াবী আলোয় মুখোমুখি বসে উগ্রসেন ও বসন্তমল্লিকা; সুরার প্রভাবে অল্প ঘোর লেগেছে উপারিকের চোখে, আজ আর গৃহে ফেরার তারা নেই তাঁর, গৃহিনীহীন গৃহে চক্ষুলজ্জা অপ্রয়োজনীয়। কক্ষের বাইরে পাহারায় আছে তাঁর দেহরক্ষীর দল, সাবধানতার অভাব নেই বিলাসগৃহেও।

‘আপনি এই স্থান রাত্রিবাসের যোগ্য মনে করেছেন, আমি ধন্য প্রভু; কিভাবে আপনার সেবা করব জানিনা।’

‘সেবা তো দাসীরা করে, তুমি বিলাসিনী নারী, মনরঞ্জন করবে।’

‘আপনি যথার্থ বলেছেন আর্য, গণিকার কাজ অতিথির ক্লান্তি দূর করে আনন্দ দেওয়া, সেবায় তার কী বা অধিকার’; উগ্রসেনের কথায় আহত হলেও নিজেকে সামলে উত্তর দেয় নর্তকী।

‘সেবা একঘেয়ে, ক্লান্তিকর, না চাইতেও মেলে; কিন্তু তোমার শ্রম মূল্য দিয়ে কিনতে হয়, তাইতো আকর্ষনীয়। নিজেকে সুলভ কোরনা সেবা দিতে চেয়ে।’ উগ্রসেনের ঠোঁটের কোনে স্মিত হাসি দেখা দেয়।

‘আমার সমগ্র রাত্রি কিনতে কি মুল্য ধার্য করেছেন দেব? জেনে রাখি নিজের সঠিক দাম।’

‘এটি দেখ তো যথেষ্ট হবে কিনা?’ উগ্রসেন মখমলের পেটিকা থেকে বের করেন সদ্য তৈরি করা ইন্দুচন্দ হার, প্রায় চার হাত দীর্ঘ এই হারে একশত মাণিক্য ঝলসে ওঠে দীপের আলোয়। চমকে ওঠে বসন্তমল্লিকা, এরূপ উপহার তারও কল্পনার অতীত ছিল, এ যে রাজ অন্তঃপুরের উপযুক্ত আভরণ, রাজলক্ষীর শোভা!

তবে উগ্রসেন বেহিসেবী নন, উপহারের প্রতিদান নিতে জানেন তিনি ভালোভাবেই, সে কথা বুঝতে বেশী সময় লাগেনা বসন্তমল্লিকার।

***

সম্প্রতি মাসাধিককাল ভৃগুকচ্ছে কাটিয়ে নগরে ফিরেছেন চারুদত্ত, তনুশ্রীর কাছে তাঁর মধ্যাহ্ন ভোজনের নিমন্ত্রন সেকারণে। সে নিজের হাতে নানান পদ রেঁধেছে সকাল থেকে, গণিকা হলেও রান্নায় পারদর্শী তনুশ্রী। সদ্য আহার শেষ হয়েছে, প্রেয়সীর হাতে সাজা তাম্বুল মুখে দিয়ে বিশ্রামের উদ্যোগ করছেন শ্রেষ্ঠী, এরকম সময়ে বসন্তমল্লিকা দেখা দেয় তনুশ্রীর মহলে।

‘এতকাল ডুমুরের ফুল হয়েছিলেন, এখন দেখা দিয়েই দিবানিদ্রার মতলব?’ বিশ্রামকক্ষে ঢুকে শ্রেষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করে বলে সে। চারুদত্ত তনুশ্রীকে যেমন স্নেহ করেন, মর্যাদা দেন, তার সখীটিকেও রসিকা শ্যালিকার মত মনে করেন। মাঝে মাঝেই তিনজনের হাসি তামাশার আসর বসে তাই।

কিছু সময় পরে শ্রেষ্ঠীকে বিশ্রামের সুযোগ দিয়ে দুই সখীতে অন্য ঘরে যায় নিভৃত আলাপের জন্যে। বসন্তমল্লিকা গণিকাশ্রেষ্ঠা, তবু সে তার নবীন হৃদয়খানি নিয়ে হয়তো বা বড় একা, তনুশ্রীই তার সুখদুঃখের সাথী। ঝলমলে রাত্রির শেষে দিনের আলোয় সেও আর পাঁচটি মেয়ের মতই স্বাভাবিক হতে চায়।

‘শ্রেষ্ঠী কি আনলেন তোমার জন্য, দেখালে না তো?’ তনুশ্রীর কাছে জানতে চায় সে।

‘ভিতরের অলিন্দের দাঁড়ে রয়েছে, দেখে এসো, একজোড়া শুক-শারী, কথা বলে‘; লাজুক হেসে জানায় তনুশ্রী।

‘ওমা, নিজের অবর্তমানে তোমার মনরঞ্জনের ব্যবস্থা বুঝি?’

‘উপহার সামান্যই, তোমার ইন্দুচন্দ হারের কাছে অতিতুচ্ছ’, তনুশ্রীর মুখখানি পরিপূর্নতার আনন্দে ঝলমল করে ওঠে।

‘তুমি ভুল করছ সখী, চারুদত্ত তোমার হৃদয়ের মূল্য দিয়েছেন, আর উগ্রসেন আমার রূপযৌবনের। এবার তুমিই বল কার দাম বেশী, হৃদয় না যৌবনের?’ পরম স্নেহে তনুশ্রীর চিবুকখানি ছুঁয়ে উত্তর দেয় বসন্তমল্লিকা।

***

‘ভদ্র ধনঞ্জয়কে কিছু অর্থ দেবার ব্যবস্থা করুন’ একদিন কর্মকক্ষে দৈনিক কাজ সারতে সারতে শ্রীদামকে নির্দেশ দেন উগ্রসেন।

‘তার গহনা বাবদ পাওনা তো আপনার ব্যক্তিগত খাতা থেকে মিটিয়ে দিয়েছি প্রভু, আরও কিছু বাকি আছে কি?’

‘না এই অর্থ সরকারি খাতে দেবেন, এ তার অন্য কাজের পারিশ্রমিক।’

‘কিন্তু গত ছয় মাসে সে তো কোনও তথ্য দিতে পারেনি আমাদের?’

‘এখন পারেনি, কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে পারবে। আপনি কি ভুলে গেছেন, তার দেওয়া সংবাদের উপর ভিত্তি করে গত বছর এক যবন চর ধরা পরেছিল? প্রশাসনিক কার্যালয়ের গুরুত্বপূর্ন নথি পাওয়া গিয়েছিল তার গৃহে।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু চর দেশান্তরী হয়েছিল রক্ষীরা তার গৃহে পৌঁছাবার আগেই।’ শ্রীদামের স্বর কিছুটা ক্ষুণ্ণ শোনায়।

‘কিন্তু সে জন্যে তো ধনঞ্জয় দায়ী নয়, তার দেওয়া সংবাদ তো খাঁটি ছিল।’

‘সে কি আবার কোনও তথ্য এনেছে আপনার কাছে?’ শ্রীদামের স্বরে সন্দেহের সুর স্পষ্ট হয়।

‘আপনি কি কৈফিয়ৎ চাইছেন আমার কাছে? সকল বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা অনধিকারচর্চা, একথা স্মরনে রাখলে আপনারই মঙ্গল’, উগ্রসেন রুক্ষস্বরে ধমকে ওঠেন।

‘মার্জনা করবেন প্রভু, আমি কি কোনও অসঙ্গত কাজ করেছি?’

‘আপনি সেদিন বজ্রবাহূর বিরূদ্ধাচারন করেছিলেন কেন? সে কি শুধুই সামরিক নীতির কারনে, নাকি কোনও ব্যক্তিগত আক্রোশ?’

‘এ আপনি কি বলছেন দেব? আমি আপনার আজ্ঞাবহ আধিকারিক। বিগত কয়েক মাস ধরে, সামরিক শিবিরের পশুখাদ্য বাবদ যে হিসাব জমা পড়েছে কার্যালয়ে, তা অত্যাধিক ও অন্যায্য। এর উপর আবার গজসেনার প্রস্তাব কেন যেন ঠিক স্বার্থহীন মনে হয়নি আমার।’

‘আপনি কি বজ্রবাহূ কে চোর সন্দেহ করেন? আর সেক্ষেত্রে কথাটা আমাকে জানাননি কেন?’

‘আপনাকে জানাতে গেলে উপযুক্ত প্রমাণ চাই, শুধুমাত্র সন্দেহের বশে নালিশ করা চলেনা। আগামী সপ্তাহে একজন হিসাব পরীক্ষক পাঠাবো শিবিরে, সেরকমই ইচ্ছা ছিল।’

‘আপনি এখন আসতে পারেন, আর ধনঞ্জয়কে অর্থ পাঠাতে ভুলবেননা’, শ্রীদামকে বিদায় দিয়ে চিন্তায় ডুবে যান উগ্রসেন। উপারিকের জীবন সন্দেহকুটিল, কে যে কখন বিশ্বাসঘাতকতা করে! অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি।

*** ***

অধ্যায় ৪

মথুরা এক প্রাচীন ও উন্নত নগরী, যবন ও কুষাণ রাজবংশের রাজত্বকালে এখানে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে অনুপম স্থাপত্য ও ভাস্কর্য। কুষান সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছে বৌদ্ধ চৈত্য ও স্তূপ; কুষাণ পরবর্তী নাগবংশ ও বর্তমানের গুপ্ত শাসনেও এতটুকু ক্ষুণ্ণ হয়নি এই বৌদ্ধধর্মের প্রভাব। সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত সকল ধর্মের প্রতি উদার মনভাব পোষন করেন, সম্প্রতি সিংহলরাজ মেঘবর্নকে তিনি অনুমতি দিয়েছেন উরুবেলা গ্রামের সামবোধি মন্দিরের চত্বরে একখানি বৌদ্ধ মন্দির নির্মানের। তাঁর ছত্রছায়ায় মথুরার গরিমাও দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে, আর্যাবর্ত তথা বিদেশের বহু বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীদের পদার্পনে বহূজাতিক হয়ে উঠেছে এই মথুরা অঞ্চলের সংস্কৃতি।

মথুরা নগরীর নাগ বংশীয় রাজপ্রাসাদটি এখন মহাদণ্ডাধিকারিকের কার্যালয় ও বাসস্থান, এছাড়াও সেখানে গড়ে উঠেছে রাজকীয় অতিথিশালা, মাগধী আধিকারিক ও সম্মানীয় অতিথিরা নগরীতে থাকাকালীন সেখানেই বসবাস করেন। কয়েকদিন হল কুমার পুষ্পকেতু এসেছেন মথুরায়, সাথে আছেন প্রিয়বন্ধু উল্মুক, তাঁরাও উঠেছেন সেখানেই।

গুপ্ত রাজবংশের সন্তান পুষ্পকেতু, মগধ দণ্ডাধিকারিকের কনিষ্ঠ পুত্র, কিন্তু জন্ম পরিচয় অতিক্রম করে নিজগুণে আত্মপরিচয় তৈরি করতে পেরেছেন তিনি এই তরুণ বয়সেই। কয়েকমাস হল তিনি সুদূর সুবর্ণভুমি থেকে ফিরেছেন; মগধ সম্রাটের প্রতিভূ হয়ে গিয়েছিলেন শৈলদেশে, চাঞ্চল্যকর অভিযান, ষঢ়যন্ত্র, সব মিলিয়ে ঘটনাবহূল ছিল এই যাত্রা। তবে তাঁর পরিব্রাজক মন শুধু এতেই তুষ্ট নয়, দেশ ভ্রমণ ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয়, কুমারের কাছে এতেই জীবনের সার্থকতা। মহামন্ত্রী হরিষেণের তিনি প্রিয়পাত্র, নিজের বুদ্ধিমত্তা ও দূরদৃষ্টি দিয়ে ক্রমশঃ তাঁর চক্ষু-কর্ণ হয়ে উঠেছেন কুমার। সম্প্রতি, পুষ্পকেতু দেশভ্রমণের উদ্যোগ নিচ্ছেন জেনে হরিষেণই তাঁকে মথুরা যাত্রার প্রস্তাব দেন। ভ্রমণের সাথে সাথে সীমান্তবর্তী সদ্য অধিকার করা অঞ্চলটির পরিস্থিতিও বুঝে নেবেন কুমার, এই ছিল তাঁর ইচ্ছা। উল্মুক কুমারের ছায়াসঙ্গী, শিক্ষিত অভিজাত বংশীয় মানুষটির মধ্যে একটি রসিক মন আছে, পুষ্পকেতু বন্ধুর সান্নিধ্য উপভোগ করেন সেই কারনে।

‘বলি আর তো পারা যাচ্ছে না হে!’ অতিথিশালার উদ্যানে প্রাতঃভ্রমণ করছেন দুই বন্ধু, হঠাতই দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠেন উল্মুক।

‘তোমার আবার কি হল? বেশ তো খাচ্ছ দাচ্ছ ঘুরে বেড়াচ্ছ, মথুরার হাওয়ায় গাল দুটিও দ্রাড়িম্ব হয়ে উঠেছে কয়েকদিনেই।’

‘আরে সমস্যা তো সেখানেই, এ অঞ্চলের দুগ্ধ, ঘৃতের প্রভাবে খুব শীঘ্রই যে একটি নধর হস্তিশাবকে পরিণত হব সে দুশ্চিন্তায় অনিদ্রার উপক্রম হয়েছে।’

‘অনিদ্রার লক্ষণ তো গত রাতে কিছু দেখলাম না, আমার কক্ষ থেকে তোমার নাসিকা গর্জন শুনতে পেয়েছি বেশ।’

‘আহা, সে তো আমার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ; তুমি বড় বেরসিক।’

‘শীঘ্র তোমার কষ্ট লাঘবের বন্দোবস্ত করতে হয় তাহলে, চল কাল উত্তরের দুর্গ পরিদর্শনে যাই, সেখানেই থাকা যাবে কয়েকদিন, দুর্গাধিশ বলভদ্রকে সংবাদ পাঠিয়েছেন দণ্ডাধিকারিক। সেখানে শুকনো যবের রোটিকা আর মসুরিকা খেয়ে মনের অশান্তি দূর কোরো।’

‘অহোঃ! তোমার বন্ধু-বাৎসল্য ইতিহাসে লেখা হয়ে থাকবে।’ উল্মুকের কথায় হেসে ওঠেন দুজনেই।

***

উত্তর সীমান্তে একটি টিলার উপর একখানি ছোট দুর্গ, সেখানে একশত পদাতিক ও দশজন ধনুর্ধর নিয়ে বাস করেন সেনাপতি বলভদ্র। সামরিক শক্তি বেশী না হলেও উচ্চতার কারনে দূর্গটির বিশেষ সুবিধা আছে; বলভদ্র নিয়মিত ছোট ছোট সেনাদল পাঠান আশে পাশের অঞ্চলে। মথুরা কান্যকুব্জ ভুক্তির অন্তর্গত, বলভদ্র উপারিক উগ্রসেনের অধস্তন সেনানায়ক, দূতের মাধ্যমে এই অঞ্চলের সংবাদ পাঠান উপারিকের কার্যালয়ে প্রতি একপক্ষকাল অন্তর।

পুষ্পকেতু ও উল্মুক এসেছেন দুর্গে, বলভদ্র সাথে নিয়ে ঘুরে দেখিয়েছেন সবকিছু। এখানে কিছুদিন থাকার প্রস্তাব করায় সানন্দে মেনে নিয়েছেন দুর্গপতি; পাটলীপুত্রের রাজপুরুষ তাঁর দুর্গে মনযোগী হয়েছেন, এ শুধু সম্মানের নয়, বলভদ্রের ভবিষ্যৎ পদোন্নতির পক্ষেও আশাব্যঞ্জক।

শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া, প্রায় চন্দ্রহীন রাত্রি, বিশ্রামকক্ষের জানালার ধারে বসে গল্প করছেন দুই বন্ধু। রাতের আহার কিছু আগেই শেষ হয়েছে, বলভদ্র আতিথেয়তা সেরে বিদায় নিয়েছেন সেই সাথে।

‘যাই বল তুমি কেতু, মথুরার লোক বড় অতিথিবৎসল; দুর্গ বলে শুকনো রোটিকার ব্যবস্থা করেনি মোটেই। আহা, নিরামিষ আহারেও কত স্বাদ! আচ্ছা, এখানে বেশীরভাগ মানুষ নিরামিষাশী, সে কি বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে?’

‘হ্যাঁ মূলতঃ তাই, সাথে বিষয়টি স্থানীয় সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে কালের প্রবাহে।’

‘কুষানেরা তো অগ্নির উপাসক, তাহলে এত বৌদ্ধ মন্দির, স্থাপত্য, এসবের কারণ কি?’

‘দেখো, কুষানরা মূলতঃ বহিরাগত, কিন্তু ক্রমে তারা স্থানীয় সংস্কৃতি, লোকাচার, ভাষা সবই আয়ত্ত্ব করে, তখন থেকেই এখানে ধর্মীয় কেন্দ্রীকরন ঘটেছে, কুষানেরা নিজস্ব ধর্মের সাথে বৌদ্ধধর্মকেও গ্রহন করেছে; সম্রাট কনিষ্ক স্বয়ং বৌদ্ধ মনভাবাপন্ন ছিলেন। যেখানে রাজপরিবার এক বিশেষ ধর্মের সহায়ক, সাধারণ প্রজার মধ্যে তার প্রভাব তো পড়বেই।’

‘তা বটে, ঠিক যেভাবে সুবর্নভূমিতে হিন্দুত্বের প্রভাব প্রকট হয়েছে রাজ আনুকুল্যে।’

‘ঠিক তাই। সে দেশ সত্যি সোনার দেশ, সুজলা, সুফলা, শান্তিময়।’ স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আবেগে নরম হয়ে আসে পুষ্পকেতুর কণ্ঠস্বর।

‘ভুলতে পারছ না, তাই না?’

‘ভুলতে চাইছি না।’

‘এখনও সময় যায় নি কেতু, হয়তো চেষ্টা করলে…’

‘থাক না বন্ধু সেসব কথা, কিছু ঘটনা স্মৃতিতেই বেশী মধুর।’ দুই বন্ধুর আলাপন অন্ধকার রাত্রির মতই বিষাদগম্ভীর হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে রাত্রি গভীর হয়, নিদ্রার বক্ষে তলিয়ে যায় চারিধার, রূদ্ধ আবেগ নিয়ে শয়ন করেন দুই তরুণ।

***

চন্দ্রমাহীন নিশুতি রাত সকলের জন্যে নিদ্রালু নয়, তস্কর ত্রিদিব ধীরে ধীরে অগ্রসর হয় এক নিশাচর সরীসৃপের মত, ঝোপ ঝাড় পেরিয়ে, অতি সন্তর্পনে; তার গন্তব্যস্থল কান্যকুব্জ সামরিক শিবির। রাতের অতিথি সে, গৃহস্থ গৃহে এমনি নিঃশব্দেই সিঁধ কাটে সকলের অজান্তে। কিন্তু তার আজকের অভিযান ধন নয় তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। কিছুকাল আগে এক শ্রেষ্ঠীর গুদামে সিঁধ কাটতে গিয়ে ধরা পড়েছিল রক্ষীদের হাতে, সাধারণত তাকে ধরা রক্ষীদের কর্ম নয়, কিন্তু সেদিন দীর্ঘ রোগভোগের পরে কাজে বেরিয়েছিল সে অশক্ত শরীরে, ফলে অসাবধান হয়ে পড়েছিল। কিন্তু, যে কোনও কারনেই হোক শ্রেষ্ঠী তাকে কারাগারে পাঠাননি, বলেছিলেন প্রতিদান নেবেন পরিবর্তে। দুইদিন আগে তিনি যখন এই কাজের কথা জানান, কিছুটা কৃতজ্ঞতা, কিছুটা শঙ্কা নিয়ে রাজী হয়েছিল সে। এই কাজে বিফল হলে ধরা দেওয়া চলবেনা, কোমরের কষিতে আছে ধুতুরার বিষ, প্রয়োজনে মুখে পুরে দিতে হবে, তাতেই সব শেষ। শ্রেষ্ঠী অর্থ দিয়েছেন যথেষ্ট, কার্যসিদ্ধি হলে দেবেন আরও; তবে ধরা পরলে, পরিবারের সর্বনাশ ঘটবে জানিয়েছেন সেকথাও। হঠাৎ স্তব্ধতা ভঙ্গ করে পেঁচা ডেকে ওঠে কোথাও, মনে মনে বৃদ্ধা মাতা ও ছোট দুটি ভাইবোনের মুখ স্মরণ করে, আবার মনঃসংযোগ করে সে।

***

দুইদিন কেটে গেছে, সুশান্ত আবার গিয়েছেন শঙ্কুদেবের বাসস্থানে, হাতে পত্নীর জন্মপত্রিকা।

‘এটি আজ রেখে যান ভদ্র, ভাল করে বিচার করা প্রয়োজন, গণনা শেষ হলে সংবাদ দেব আপনাকে’; পত্রিকাটি হাতে নিয়ে জানান আচার্য।

সেদিন সভাশেষে দ্বাররূদ্ধ কক্ষে দীপের আলোয় শঙ্কুদেব মেলে ধরেন লিপিখানি, সেখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সামরিক শিবিরের মানচিত্র। তাঁর মুখভাবে ফুটে ওঠে উল্লাস ও জিঘাংসার এক অদ্ভূত মিশ্রণ।

অধ্যায় ৫

‘শ্রেষ্ঠী পশুপতি নগরে এসেছেন গতকাল, আমার সাথে ব্যব্সায়িক সাক্ষাৎ করবেন আজ অপরাহ্নে, বার্তা এনেছিল তাঁর অনুচর।’ দিবা প্রথম প্রহর তখনও শেষ হয়নি, ভোরের নরম আলোয় উগ্রসেনের গৃহের বসবার ঘরটি ছায়ামাখা। ধনঞ্জয় উপস্থিত হয়েছেন জরুরী সংবাদ দেবার উদ্দেশ্যে।

‘শ্রেষ্ঠী উঠেছেন কোথায় জানা গেছে?’

‘হ্যাঁ, বজ্রপাণির ধর্মশালায় আশ্রয় নিয়েছেন তিনি, অনুচরটিকে প্রশ্ন করে জেনেছি, পরে আমার কর্মশালার এক সহকারীকে পাঠিয়েছিলাম লোকটিকে অনুসরণ করতে, সে এখনও ধর্মশালার সমুখে অপেক্ষায় আছে আশা রাখি।’

‘ভালো করেছেন, আমার কার্যালয় থেকে দুজন চর পাঠাচ্ছি সেখানে পাহারার জন্যে, আপনার লোকটি পশুপতিকে চেনে কি? তাহলে সে চিহ্নিত করে দেবে তাকে চরেদের কাছে।’

‘হ্যাঁ, সে চেনে শ্রেষ্ঠীকে, আমি এখন ফেরার কালে তাকে উপযুক্ত নির্দেশ দিয়ে যাব, আপনি কার্যালয় কর্মীদের আমার সাথে দিয়ে দিন।’

‘তারা সামান্য পোশাকে যাবে, আপনার অশ্বকে অনুসরণ করে। সহকারীটির সাথে ধর্মশালার কাছাকাছি তাম্বুল বিপণির সামনে গিয়ে কথা বলবেন, আপনি বিদায় নিলে, আমার কর্মীরা সেখানেই যোগাযোগ করে নেবে লোকটির সাথে।’ উগ্রসেনের নির্দেশ বুঝে নিয়ে বেরিয়ে যান ধনঞ্জয়, এই কাজে কোনও ভুল হলে উপারিকের রোষে পড়তে হবে, সেকথা জানেন তিনি ভালভাবেই।

***

‘গতবার বেশ কিছু পদ্মরাগ নিয়েছিলেন আপনি, এখন সংগ্রহে আছে সিংহলী পদ্মরাগ, নেবেন কি কয়েকটি?’ শ্রেষ্ঠী পশুপতি এসেছেন ধনঞ্জয়ের বিপণিতে, সেখানেই কথবার্তা চলছে। পশুপতি রত্ন কারবারী, নগরীতে এলে বিশিষ্ট কিছু রত্নকারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। পূর্বে লোক মারফৎ সরবরাহ করতেন পণ্য, তবে কিছুকাল হল নিজেই যাতায়াত করছেন।

‘না, এই তো দুইমাস হল নিয়েছিলাম পদ্মরাগ, এখনই প্রয়োজন নেই আর।’

‘সে কি? আপনি নিশিষ্ট মণিকার, উত্তম মণি মাণিক্যের প্রয়োজন তো আপনারই সর্বাধিক।’

‘না না, নগরীর অনেক স্বর্ণকার আমার থেকে বেশী ব্যস্ত। আমার কর্মশালা তেমন বড় নয়।’

‘এ আপনার বিনয়, উপারিকের পরিবারের মণিকার আপনি, সম্প্রতি ইন্দুচন্দ হার গড়িয়েছেন তাঁর নির্দেশে, আপনি সামান্য নন।’ পশুপতির মন্তব্য শুনে চমকে ওঠেন ধনঞ্জয়।

‘আপনি জানলেন কি করে সেকথা? এ অতি ব্যক্তিগত বিষয়।’

‘না, না, লোকমুখে কানে এলো তাই।’ ধনঞ্জয়ের স্বরে মৃদু ভর্ৎসনা শুনে নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টা করেন পশুপতি।

‘কার কাছে শুনলেন এরূপ গূঢ় সংবাদ?’

‘কি জানি বলতে পারিনা, হয় তো বা অন্য কোনও স্বর্ণ ব্যবসায়ীর কাছে। আপনি বিব্রত হবেননা, আমি এ বিষয়ে আলোচনা করিনি কারো সাথে।’ পশুপতি অবস্থা সামাল দেবার চেষ্টা করেন, যদিও ধনঞ্জয়ের মুখ আঁধার হয়ে ওঠে। এর পরে আর আলোচনা এগোয় না বেশীদূর, কয়েকটি মুক্তা ও দুটি কমলহীরা নিয়ে শ্রেষ্ঠীকে বিদায় দেন ধনঞ্জয়।

***

‘সংবাদ গুরুতর, আপনার সাহায্য ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়।’ আধো অন্ধকারে ঢাকা একখানি কক্ষ, সেখানে নিভৃত আলোচনা চলছে। কক্ষটি শ্রীদামের গৃহের পিছন দিকে খিড়কির পুকুর সংলগ্ন একটি পরিত্যক্ত গুদাম ঘর, অতীতে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র ব্যবহার করত এটি, সে ছিল পাকা মৎস্যশিকারী। কিন্তু কয়েক বছর হল সে নিরুদ্দেশ, সেই থেকে ঘরটি বন্ধই থাকে। একখানি মাত্র তেলের পিদিম জ্বলছে কুরুঙ্গীতে, সে আলোয় বক্তা পশুপতির মুখভাব বোঝা যায় না কিছু, তবে তাঁর কণ্ঠস্বরে উৎকন্ঠা প্রকাশ পায়।

‘সাহায্য তো করেছি আপনাকে যথাসাধ্য, অসৎ হয়েছি আপনার প্ররোচনায়, বজ্রবাহূকে দোষারোপ করেছি অযথা। কিন্তু সামান্য রাজ কর্মচারী আমি, এর বেশী আমার নাগাল কোথায়!’

‘কান্যকুব্জের উপারিকের নিকটজন আপনি একথা জানেন দণ্ডাধিকারিক, এত অল্পে সন্তুষ্ট নন তিনি। যা করবেন শীঘ্র করুন ভদ্র, সময় খুবই অল্প।’

‘আপনি যা চাইছেন তা করতে গেলে বিশ্বাসঘাতী হতে হয়, দীর্ঘ বিশ বছর দায়িত্বে আছি কার্যালয়ের, এর আগে কখনও এমন কাজ করিনি।’

‘এর আগে এরূপ পরিস্থিতি হয়েছিল কি?’

‘আমাকে কয়েকদিন সময় দিন ভদ্র, উপারিক এখন কান্যকুব্জেই স্থিতু আছেন, তাঁর উপস্থিতিতে এ কাজ অসম্ভব।’

‘তাহলে আমাকেও থেকে যেতে হবে, শূন্যহাতে ফেরা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।’

‘চিন্তা নেই ভদ্র, আমাদের ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন থাকতে পারবেন আপনি!’ আচমকা দ্বারের অর্গল ভেঙে কক্ষে প্রবেশ করেন কার্যালয়ের সুরক্ষা প্রধান, তাঁর সাথে জনা ছয়েক সশস্ত্র প্রহরী।

আচমকা এই আক্রমণে হতচকিত হয়ে পড়েন দুজনেই, তাঁদের হাতে বেড়ি পরিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় কারাঘরে; অন্ধকার রাত্রিতে ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে যায় শ্রীদামের সকলের অগোচরে।

***

‘পশুপতি মুখ খুলেছে?’ দণ্ডাধিকারিক ও কারাধ্যক্ষের সাথে জরুরী আলোচনায় বসেছেন উগ্রসেন গ্রেপ্তারের পরের দিন অপরাহ্নে।

‘না, কিছুই বলতে চায় না সে, শুধু কপালে করাঘাত করছে আর বলছে সে সামান্য রত্ন ব্যবসায়ী, ভৃগুকচ্ছে বাস‘; কারারক্ষকের কণ্ঠস্বর হতাশা ব্যঞ্জক।

‘কথা তাকে বলতেই হবে, সহজে না হলে, কঠিন উপায় অবলম্বন করুন। কারাগারের নিষ্ঠুরতম জল্লাদকে বলুন পশুপতিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে, তাকে বলবেন, যে করে হোক সব তথ্য আমাদের চাই!’ গর্জে ওঠেন উগ্রসেন।

‘আমি বলি কি, তার আগে একবার শ্রীদামের সাথে কথা বলা যাক, সে যদি মুখ খোলে, তাহলে আর সমস্যা থাকে না‘; দণ্ডাধিকারিক চন্দ্রবর্মা মতামত দেন।

‘শ্রীদামকে আপনার থেকে অনেক বেশী চিনি আমি, সে কথা বলবে না কিছুতেই; তার ব্যবস্থা আমি নিজে করব ভিতরের ষঢ়যন্ত্র ফাঁস হবার পর‘; উগ্রসেনের চক্ষু দুটি জ্বলে ওঠে জিঘাংসায়।

***

‘উজ্জ্বয়িনীর কোন স্থানে বাস তোমার?’ কারাধ্যক্ষ প্রশ্ন করেন, তাঁর পাশে অপেক্ষমান জল্লাদের মুখ কারাগৃহের মশালের আলোয় নির্মম, তার হাতে একখানি চামড়ার কশা।

‘আমি ভৃগুকচ্ছের ব্যবসায়ী, সেখানেই বাস করি।’ পশুপতির কথা শেষ হবার পূর্বেই কশাঘাত এসে পড়ে তার পিঠে ও কাঁধে, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায় প্রৌঢ়।

‘ভৃগুকচ্ছে তোমার প্রভু কে? কার নির্দেশে কান্যকুব্জে যাতায়াত করছ?’ এ কথার কোনও উত্তর আসে না, আবারও কশাঘাত, এবার উপর্যুপরি বুকে, পিঠে এমনকি মুখেও। নিজেকে বাঁচানোর অক্ষম চেষ্টা ছেড়ে পশুপতি আত্মসমর্পন করেন জল্লাদের হাতে।

‘শ্রীদামের সাথে তোমার সম্পর্ক কি?’

‘তার সাথে আত্মীয়তার সম্বন্ধ, যা নিতান্তই ব্যক্তিগত।’

‘রাষ্ট্রনীতিতে কিছুই ব্যক্তিগত নয়; বল তার কাছে কিসের সাহায্য চেয়েছিলে?’

‘কিছুদিন যাবৎ অর্থকষ্টে আছি, তাই অর্থসাহায্য চেয়েছিলাম, এর বেশী কিছু নয়।’

‘রত্নব্যবসায়ী অর্থভিক্ষা করে সরকারী আধিকারিকের কাছে, এই কথা বিশ্বাস করতে বল আমাদের? তোমার তোরঙ্গে আবিষ্কৃত হয়েছে বেশ কিছু মূল্যবান রত্ন, এই কি অর্থকষ্টের নমুনা?’ এরপর চলতে থাকে নিরন্তর কশাঘাত, রক্তাক্ত শরীরে লুটিয়ে পড়ে বন্দী প্রৌঢ়। জল্লাদের শরীর স্বেদময়, সেও ক্লান্তি দূর করতে বিরতি নেয় কিছুক্ষণের জন্য। চরম হতাশায় ক্রমে নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে কারাধ্যক্ষের মুখ।

***

‘একটি দুঃসংবাদ আছে প্রভু’; পরের দিন উগ্রসেনের কার্যালয়ে কারাধ্যক্ষকে সাথে নিয়ে ছুটে আসেন দণ্ডাধিকারিক।

‘কি হয়েছে? পশুপতি কিছু বলছে না?’

‘পশুপতি আর কোনওদিনই কিছু বলবে না।’

‘স্পষ্ট করে বলুন কি ঘটেছে!’

‘কাল সমস্ত দিন জিজ্ঞাসাবাদের পর আজ ভোরে তাকে মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করে কারারক্ষী’, দণ্ডাধিকারিকের স্বরে অনুশোচনা।

‘অর্বাচীনের মত কাজ করেছেন আপনারা, এখন উপায় কি হবে বলুন?’

‘প্রভু, শ্রীদামকে নিয়ে চেষ্টা করে দেখি, আমাকে আর একটি দিন সময় দিন। পশুপতির মৃত্যু হয়েছে জল্লাদের হাতে, একথা শুনলে সে নিশ্চুপ থাকতে সাহস করবে না।’, কাকুতি জানান কারাধ্যক্ষ।

‘থাক, আপনি অনেক দক্ষতা দেখিয়েছেন, এবার শেষ যোগসূত্রটিও নষ্ট হবে আপনার নির্বুদ্ধিতায়‘; ভর্ৎসনা করে ওঠেন উগ্রসেন।

‘প্রভু, আমি কিছু অন্যরকম চিন্তা করেছি, অভয় দেন তো বলি’, দণ্ডাধিকারিক মন্তব্য করেন।

‘আপনার কি বলার আছে শুনি; এখন তো উপায়ও কিছু দেখছি না আর।’

‘আমি বলি কি, পশুপতির মৃত্যুসংবাদ আপাততঃ গোপন থাক। শ্রীদামের সাথে আমি নিজে বার্তালাপ করব। তাকে জানাব যে, পশুপতি সকল কথা বলে দিয়েছে, এখন আত্মসমর্থনে তার কি বলার আছে জানতে আমরা আগ্রহী।’ দণ্ডাধিকারিকের বক্তব্য শুনে কিছুক্ষণ চিন্তা করেন উগ্রসেন, তারপর অনুমতি দেন এ বিষয়ে।

‘কিন্তু স্মরনে রাখবেন, শ্রীদামের কোনোরূপ শারিরিক ক্ষতি হলে দায়ী থাকবেন আপনারা দুজন!’ সাবধান করে দেন উপারিক।

***

‘আপনি আমার বহুদিনের সহকর্মী, ব্যক্তিগতভাবে কোনও বৈরী নেই আপনার সাথে। সেকারণে, চাইনা কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক।’ শ্রীদামের কারাকক্ষে মুখোমুখি দুটি সুখাসনে বসে দণ্ডাধিকারিক ও শ্রীদাম। শ্রীদামের হাতে বন্ধন নেই, শুধু কক্ষের দরজার বাইরে প্রহরায় আছে দুইজন রক্ষী।

‘আমি অপেক্ষা করছি ভদ্র, আপনি নিজ বক্তব্য জানান।’ শ্রীদাম চুপ করে আছেন দেখে দণ্ডাধিকারিক আবার বলে ওঠেন।

‘আমার কিছু বলার নেই, একথা জানিয়েছি আগেই।’

‘কিছুই বলার নেই, আত্মপক্ষ সমর্থনেও না?’

‘না।’

‘কিন্তু আপনার সহকারী তো সবকিছু স্বীকার করেছেন আমাদের কাছে‘; নাটকীয় ভাবে কথাটি বলে ওঠেন দণ্ডাধিকারিক, শ্রীদাম চমকে ওঠেন এই কথায়।

‘শ্রেষ্ঠী যদি বলে থাকেন সব কিছু, আমাকে আর জিজ্ঞাসা করছেন কেন? প্রাপ্য শাস্তি নিতে প্রস্তুত আছি আমি‘; শ্রীদামের কণ্ঠস্বর ভিজে আসে আবেগে।

‘তবু দণ্ড দেবার পূর্বে আপনার স্বীকারোক্তি নিতে হবে, এটাই মাগধী বিচারবিধি।

‘পশুপতি যা কিছু বলেছেন, আমি নিঃশর্তে মেনে নিচ্ছি, এর অধিক কিছু বলার নেই আমার।’

‘আপনার অপরাধের বিস্তারিত বিবরন দিন।’

‘বিশদে বলার মত নেই কিছু, এতকালের কর্মজীবনে পদস্খলন ঘটেছে এই প্রথমবার। এখন আপনারা যা সঠিক মনে করবেন।’

‘এত সহজে এর নিষ্পত্তি হবে না ভদ্র, কিভাবে সংশ্পর্শে এলেন পশুপতির, এযাবৎ কি কি সরবরাহ করেছেন তাকে, এসবই জানতে চাই আমরা।’

‘পশুপতি তো বলেছেন সব কথা, আমি আর নতুন কি বলতে পারি।’

‘পশুপতি কি বলেছে সে কথা থাক, আমি আপনার কাছে জানতে চাই বিশদে!’ হতাশায় ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন দণ্ডাধিকারিক। তাঁর প্রতিক্রিয়া মনযোগ দিয়ে লক্ষ্য করেন শ্রীদাম, চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে তাঁর কপালে।

‘পশুপতি কিছু জানায়নি তাই না? তাকে যতদুর চিনি আমি, সে কিছু জানাবে না‘; প্রত্যয়ের সাথে মন্তব্য করেন শ্রীদাম, ক্ষীণ হাসি ফুটে ওঠে তাঁর ঠোঁটের কোণে।

‘আপনার সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী, আর এর জন্যে দায়ী হবেন আপনি নিজে!’ কথাগুলি বলে কারাকক্ষ ত্যাগ করেন দণ্ডাধিকারিক।

***

‘শ্রীদাম এখনও কারাগৃহে, তবে মনে হয় উগ্রসেন তাকে সময় দেবেন। বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছি, পশুপতির মৃত্যু হয়েছে’; বিদিশায় সত্যনাগের প্রাসাদে একান্তে আলোচনা চলছে আচার্য শঙ্কুদেব ও সেনাপতির মধ্যে।

‘সব কিছুর মধ্যে এই মৃত্যুই বড় বেদনার; উদ্দেশ্যে সিদ্ধির পথে আরও কত প্রান বলি হতে চলেছে কে জানে!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সেনানায়ক।

‘কূটনীতিতে ব্যক্তিগত আবেগের কোনও মূল্য নেই, নিজেকে নির্বেদ করতে শেখো পুত্র‘; শঙ্কুদেবের মন্তব্যে মৃদু তিরস্কারের সুর স্পষ্ট হয়।

‘কান্যকুব্জে আমাদের প্রস্তুতি কতদূর, সময় হয়েছে কি প্রহারের?’ নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করেন সত্যনাগ।

‘ক্ষেত্র তৈরী আছে, এখন উপযুক্ত ক্ষণের অপেক্ষা। তুমি সৈন্য প্রস্তুত রাখো, আমার কাছ থেকে সংবাদ পেলেই আক্রমণ করবে।’

‘সংকেতের আশায় রইলাম ভগবন, আপনার যাত্রা শুভ হোক।’

*** ***

অধ্যায় ৬

দিন দুয়েক হল পুষ্পকেতু ও উল্মুক মথুরা নগরীতে ফিরেছেন, নগরীর স্থাপত্য ও মন্দির গাত্রের অনুপম ভাস্কর্য্য দেখে সময় কাটছে। স্থাপত্যে ভারতীয় ও যবন শিল্পের অপূর্ব মেলবন্ধন দেখে মুগ্ধ হন দুজনেই।

‘কালজয়ী হবে এই শিল্প, দেখে নিও বন্ধু’, পুষ্পকেতু একটি তথাগত মূর্তি পর্যবেক্ষণ করতে করতে মন্তব্য করেন।’

‘আর্যাবর্ত অদ্ভূত দেশ, যে আসে সেই বাঁধা পড়ে যায় এখানকার মায়ায়।’

‘তা বটে, আমাদের পূর্বপুরুষ আর্যরাও তো এসেছিলেন সুদূর উত্তর-পশ্চিম থেকে।’

এভাবেই আলোচনা এগিয়ে চলে মন্দির দেখার সাথে সাথে; মধ্যাহ্ন আহারের সময় হতে অতিথিশালায় ফিরে আসেন তাঁরা। রাজপ্রাসাদের মূল দ্বারের কাছে বেশ একটি জটলা চোখে পরে, অতিথিশালার ভিতরেও চাঞ্চল্যকর পরিবেশ, এসব দেখে কৌতুহল বোধ করেন দুই বন্ধু। ভোজনের পরে অতিথিশালার অধিকর্তাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করবেন স্থির করেন পুষ্পকেতু। নিজ নিজ কক্ষে গিয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে তাড়াতাড়ি ভোজনকক্ষে পৌঁছন দুজনে, ঘোরাঘুরির ফলে ক্ষিদে পেয়েছে যথেষ্ট। সবে ঘৃত তণ্ডুল ও পর্পট দিয়ে আহার শুরু করেছেন, একজন প্রবীন আধিকারিক হন্তদন্ত হয়ে উপস্থিত হন সেখানে।

‘আপনাদের অপেক্ষাতেই ছিলাম দেব, ফিরেছেন শুনে ছুটে এলাম তাই।’

‘কি ব্যাপার, কিছু ঘটেছে নাকি?’

‘ঘটেছে মানে? একেবারে মহাদুর্ঘটনা! উপারিক উগ্রসেন হত হয়েছেন বিগত চতুর্থী তিথিতে।’

‘আজ নবমী, তার মানে পাঁচ দিন কেটে গেছে! এতদিনে সংবাদ পেলেন আপনারা?’

‘ঘটনা ঘটে সেদিন সন্ধ্যায়, পরিস্থিতি বিশৃংখল হয়ে ওঠে কান্যকুব্জে। উগ্রসেন ক্ষমতার কেন্দ্রীকরনে বিশ্বাসী ছিলেন, ফলে সেখানে সিদ্ধান্ত নেবার লোকের অভাব, তার উপরে শুনতে পেলাম ভদ্র শ্রীদামও কারারূদ্ধ হয়েছেন। গোলমাল কাটিয়ে দণ্ডাধিকারিক মথুরায় সংবাদ পাঠানোর ব্যবস্থা করেন, এরমধ্যে প্রায় তিন দিন কেটে গেছে। দিবারাত্রি অশ্বচালনা করে দুইদিনের মধ্যে সংবাদ এনেছে দূত।’

‘মৃত্যুর কারণ কিছু জানা গেছে? তিনি তো যুবাপুরুষ, রোগজনিত নয় নিশ্চয়ই?’

‘বিষপ্রয়োগে মৃত্যু হয়েছে তাঁর’, কথাটি জানাতে গিয়ে কণ্ঠস্বর গম্ভীর হয়ে ওঠে আধিকারিকের।

‘তাহলে তো বিষয় গুরুতর; উল্মুক আমাদের বোধহয় যাওয়া উচিৎ অকুস্থলে। সবকিছু জেনে এখানে নিশ্চুপে বসে থাকা যায় না। ভদ্র, আপনি দণ্ডাধিকারিক মহাশয়কে বলে সত্ত্বর আমাদের যাবার ব্যবস্থা করুন।’

‘কতশীঘ্র যেতে চান আপনারা?’

‘সম্ভব হলে আজই।’

‘আজ তো হবে না, তবে কাল প্রাতে যাত্রা করতে পারেন যেন, সে ব্যবস্থা আমরা করব।’ এরপর বিদায় নেন আধিকারিক, ভোজনে আর রুচি হয় না কারোরই। অর্ধভুক্ত থালি ছেড়ে উঠে পড়েন দুজনে।

***

পরের দিন প্রথম প্রহরেই যাত্রা শুরু হয়, পুষ্পকেতু ও উল্মুক চলেছেন অশ্ব শকটে, আর একটি রথে আছেন দণ্ডাধিকারিকের অধিনস্ত এক প্রবীন কর্মচারী, তাঁর সাথে রয়েছে পথে প্রয়োজনীয় কিছু শুকনো খাদ্য ও পানীয় জলের কুম্ভিকা। সুরক্ষার জন্য সঙ্গী হয়েছে দশ জন অশ্বারোহী সেনা। অশ্বযানে দিন চারেক লাগবে কান্যকুব্জ যেতে, মহাসড়ক ধরে এগোতে কষ্ট নেই, পথে ধর্মশালা, কিছু দূরে দূরে জলসত্র এ সব কিছুরই ব্যবস্থা রয়েছে মগধ সাম্রাজ্যে।

মধ্যাহ্নভোজন সারতে একখানি পান্থশালায় ক্ষণিকের বিশ্রাম, বেশ মনোরম পরিবেশ; অনেকখানি জায়গা জুড়ে তৈরী এই অতিথি নিবাসটি। এর কাছাকাছির মধ্যেই রয়েছে গ্রামাঞ্চল, আর কিছুদূরে বয়ে চলেছে ছোট একটি শাখানদী। সম্মানীয় অতিথিদের অভ্যর্থনা করতে অধিপতি নিজেই এগিয়ে আসেন, ভিতরে নিয়ে গিয়ে বিশ্রাম ও শীতল পানীয়ের বন্দোবস্ত করেন তৎক্ষণাৎ। বাকি কর্মচারী ও সৈন্যদের ব্যবস্থা হয় লাগোয়া একটি অশ্বত্থ বনের ছায়ায়।

‘আপনাদের আহারের ব্যবস্থা তেমন উপযুক্ত হল না, আসলে ভাঁড়ারের সঞ্চয় বাড়ন্ত, আজ লোক পাঠিয়েছি গঞ্জ থেকে চাল, ডাল, তরি সংগ্রহ করতে।’ পান্থস্বামী দুঃখপ্রকাশ করেন ভোজনের সময়।

‘আমরা দিব্য আহার করছি, আপনি ক্ষেদ রাখবেন না মনে, আপনার পাচকটির হাতযশ আছে। অলাবুর ঘন্টটি আর একটু দিতে বলুন দেখি!’ উল্মুক বলে ওঠেন, যতটা খাদ্যগুনে, তার চেয়ে বেশী গৃহস্বামীর গ্লানি দূর করতে। আহারে প্রকৃতই তেমন বিশদ ব্যবস্থা কিছু ছিল না।

‘আজ বোধহয় আপনার সাপ্তাহিক গঞ্জের দিন?’ পুষ্পকেতু প্রশ্ন করেন।

‘ঠিক তা নয়, পান্থশালার খরিদারি ভাণ্ডার শূণ্য হবার আগেই করতে হয়, নাহলে অতিথি সেবায় ব্যাঘাত ঘটবে যে। আসলে, কাল সন্ধ্যায় মাগধী সেনার একটি বড় দল হঠাতই এসে পড়েছিল। সেনানায়কদের খাদ্যের বন্দোবস্ত এখানেই হয়েছিল, সৈনিকদের জন্য রসদ জোগাড় হয়েছিল কিছুটা পাশের গ্রাম থেকে, বাকিটা আমার ভাঁড়ার থেকে। তাতেই এই বিপত্তি।’

‘মাগধী সৈনিক? কোথা থেকে এসেছিল তারা? গন্তব্যই বা কোথায়, কিছু জানেন এ বিষয়ে?’

‘আমি সামান্য মানুষ, প্রশ্ন করিনি কিছু, তবে কথায় মনে হল কান্যকুব্জ থেকে এসেছেন, গন্তব্যস্থল জানা নেই, তবে উত্তর দিশায় গেছেন বলেই মনে হল।’

‘উল্মুক, শীঘ্র আহার শেষ কর, বিশ্রামের সময় নেই, এখনই কান্যকুব্জে রওয়ানা দেওয়া প্রয়োজন।’

***

‘ভদ্র অভিলাষ, রথে নয়, বাকি পথ আমরা দুজন অশ্বেই যাব, আপনি সাথে শুধু চারজন সেনা দিন‘; আহারান্তে পুষ্পকেতু মথুরার আধিকারিককে জানান।

‘কিন্তু কুমার, আপনাদের এভাবে যেতে দিতে পারিনা আমি, আপনাদের সুরক্ষা আমার দায়িত্ব!’

‘আপাততঃ মগধের সুরক্ষা নিয়ে ভাবুন ভদ্র, আমরা আত্মরক্ষায় সমর্থ। আমি আপনার হাতে দণ্ডাধিকারিকের উদ্দেশ্যে পত্র লিখে দিচ্ছি অবস্থা বুঝিয়ে, আপনি দায়ী হবেননা আমাদের কিছু হলে।’ পুষ্পকেতুর দৃঢ় উত্তর শুনে অভিলাষ আর আপত্তি করতে সাহস করেননা, অতএব যাত্রার ব্যবস্থা হয় অবিলম্বে।

‘পথে যতটা সম্ভব অলক্ষিত থাকার প্রয়োজন, আভুষন খুলে থলিকায় রাখো’, উল্মুককে যাত্রায় আগে নির্দেশ দেন পুষ্পকেতু। বিস্মিত হলেও প্রশ্ন করেননা উল্মুক, বাল্যবন্ধুর চরিত্র জানেন তিনি, অকারণে কিছু বলার মানুষ তিনি নন।

এরপর কান্যকুব্জ যাবার বাকী পথ নির্বিঘ্নেই কাটে, আড়াই দিন পরে কৃষ্ণপক্ষের দ্বাদশী তিথির সন্ধ্যায় দণ্ডাধিকারিকের কার্যালয়ে গিয়ে পৌঁছান কুমার তাঁর ছোট দলটি নিয়ে। ধুলি ধুসরিত বসন, আচমকা আবির্ভাব, এসব মিলিয়ে প্রথমে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন দণ্ডাধিকারিক চন্দ্রবর্মা। তবে, পরিচয় পত্র ও নামাঙ্কিত অঙ্গুরীয় দেখে কুমারের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হন তিনি, পুষ্পকেতু মথুরায় অবস্থান করছেন হরিষেণের প্রতিভূরূপে, এ সংবাদ তিনি জানতেন আগেই।

দ্রুত স্নানাহার সেরে, অতিথিশালারই একটি বিশ্রাম কক্ষে আলোচনায় বসেন পুষ্পকেতু, উল্মুক ও চন্দ্রবর্মা। দীপের আলোয় ছায়াময় পরিবেশ, সকলেরই মুখভাব থমথমে।

‘সবকিছু এমন দ্রুত ঘটে গেলো, বড় অসহায় বোধ করছি কুমার, তবু আপনি এসেছেন, এতে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাচ্ছি।’ চন্দ্রবর্মা পুষ্পকেতুকে উদ্দেশ্য করে বলেন।

‘পরিস্থিতি জটিল এ বিষয়ে সন্দেহ নেই; উগ্রসেনের মৃত্যু, উত্তর সীমান্তে শত্রুর আক্রমণ… আমি কেন যেন বিষয়গুলিকে আলাদা করে ভাবতে পারছি না। আপনি দয়া করে বিশদে বর্ণনা করুন সব কথা।’

‘সেদিন কৃষ্ণপক্ষের চতুর্থী তিথি, কার্যালয়ের কর্ম শেষ করে উপারিক গিয়েছেন গণিকালয়ে, বসন্তমল্লিকার গৃহে। সেখানে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে নিজ বাসস্থানে ফেরেন তিনি, কিছুদিন যাবৎ গৃহিনী পিত্রালয়ে, তাই একাই বাস করছিলেন সেখানে। ফিরে এসে আহার সেরে শুতে যান উগ্রসেন, এরপরে তাঁকে আর কেউ জীবিত দেখেনি। ভোরবেলায় গৃহসেবক তাঁর কক্ষে কোনও সাড়া না পেয়ে দ্বার ভাঙার ব্যবস্থা করে, ভিতরে প্রবেশ করে সে দেখে তিনি ভূতলে পরে আছেন, চারিপাশে বমন, চক্ষুদুটি বিস্ফারিত, মুখভাব যন্ত্রনায় বিকৃত। এরপর, ভৃত্যদের চিৎকারে রক্ষীরা ছুটে আসে কক্ষে, বৈদ্যরাজকেও ডেকে আনে তাদের একজন, কিন্তু তিনি এসে জানান মৃত্যু ঘটেছে রাত্রিকালেই, তাঁর কিছু করার নেই আর।’ ঘটনা বর্ণনা করেন চন্দ্রবর্মা।

‘বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে এই কি মত বৈদ্যের?’

‘হ্যাঁ, লক্ষণ দেখে সেরকমই জানিয়েছেন মার্তণ্ডদেব।’

‘গৃহ ভৃত্য, পাচক এদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে নিশ্চয়?’

‘তাদের প্রত্যেককে কারাগৃহে বন্দী করা হয়েছে, তবে অপরাধ স্বীকার করেনি কেউই। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তাঁর ব্যক্তিগত সেবক জটাধরকে দিয়ে পরীক্ষা না করিয়ে উপারিক কিছু খেতেন না, সেদিনও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। অথচ জটাধর দিব্য সুস্থ আছে এখনও।’

‘কি জাতীয় বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল, সে বিষয়ে কিছু বলতে পেরেছেন বৈদ্য?’

‘না, সঠিক করে কিছু বলতে পারেননি।’

‘বিষ পানাহার ব্যতীত অন্যভাবেও তো প্রয়োগ করা যেতে পারে, আপনারা সে সম্ভবনার কথা ভেবেছেন কি?’ পুষ্পকেতুর এই প্রশ্নে হতচকিত হয়ে পড়েন চন্দ্রবর্মা।

‘না এ কথা ভেবে দেখিনি আমরা কেউই।’

‘শব পরীক্ষা করেছেন যে আধিকারিক, আমি তাঁর সাথে একবার কথা বলতে চাই, আপনি ব্যবস্থা করুন। উপারিকের পরিবারে কে কে আছেন? তাঁদের সাথেও সাক্ষাৎ করা প্রয়োজন, আর গৃহকর্মীদের আমি নিজে একবার জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাই।’

পরদিন সকালে আধিকারিক সুস্মিতের সাথে দেখা করেন পুষ্পকেতু দণ্ডাধিকারিকের কার্যালয়ে, সেখানেই কথাবার্তা শুরু হয় দুজনের।

‘মৃত্যুর কারন বিষপ্রয়োগ, এই আপনার মত?’

‘হ্যাঁ, বৈদ্যরাজ মার্তণ্ডদেবও তাই মনে করেন।’

‘শব পরীক্ষার কালে কোনও আঘাতের চিহ্ন লক্ষ্য করেছিলেন কি?’

‘মাটিতে পড়ে গিয়ে কপালে আঘাত লেগেছিল।’

‘ঠিক সেরকম আঘাতের কথা বলছি না, ধরুন ছুরিকাঘাত বা সূচীছিদ্র জাতীয়।’ পুষ্পকেতুর কথায় কিছুটা বিস্মিত হলেও বুঝতে দেন না সুস্মিত।

‘না সে ধরণের কিছু চোখে পড়ে নি। কিন্তু হঠাৎ এরকম প্রশ্ন করছেন কেন?’

‘বিষক্রিয়া পানাহারের মাধ্যমে না হয়ে অন্য প্রকারেও তো হয়ে থাকতে পারে, আমি সেই সম্ভাবনার কথা ভাবছি।’

‘তাঁর গ্রীবায় কিছু নখর চিহ্ন ছিল, তবে সেগুলি দু এক দিনের পুরোনো। আর সে চিহ্ন খুবই অগভীর, বিষক্রিয়া নয় রতিক্রিয়ার প্রতীক সেগুলি‘; সুস্মিতের কথায় হেসে ফেলেন উল্মুক গম্ভীর আলোচনার মাঝেও।

‘ঠিক কি ধরনের বিষ প্রয়োগ হয়েছে, আন্দাজ করেছেন কিছু?’

‘সঠিক করে বলতে পারিনা, তবে লক্ষণ দেখে দুটি বিষের কথাই মনে হয়েছে, ধুতুরা অথবা শঙ্খবিষ। বমন, শরীরে খিঁচ ধরা, অক্ষিপটল ঘোলাটে, এগুলি থেকে সেরকম ধারণাই জন্মাচ্ছে।’

‘বুঝলাম। মৃত্যুর সময় সম্পর্কে আপনার কি ধারনা?’

‘রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরের মধ্যে মৃত্যু ঘটেছে, মৃতদেহের অবস্থা দেখে সেরকমই আন্দাজ হয়।’

‘ধুতুরা থেকে বিষক্রিয়া হতে এক থেকে দুই ঘন্টা সময় লাগে, বিষের মাত্রা বেশী হলে ঘন্টা খানেকের মধ্যেই প্রাণনাশ। শঙ্খবিষের ক্ষেত্রে কিরূপ সময় লাগতে পারে?’

‘একথা বলা শক্ত, এটি ধাতব বিষ, স্বল্প মাত্রায় প্রয়োগ করলে লক্ষণ প্রকাশ পেতে কয়েকদিনও লাগতে পারে, প্রাণঘাতী হয় না এটি বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই। তবে বেশীমাত্রায় সেবন করলে সেক্ষেত্রেও দু এক ঘন্টা।’

***

এরপর সুস্মিতের কাছে বিদায় নিয়ে উপারিকের গৃহে উপস্থিত হন দুই বন্ধু, উদ্দেশ্য তাঁর পত্নী রাজশ্রীর সাথে আলাপ করা। এছাড়া গৃহসেবকদেরও সেখানেই নিয়ে আসবে কারা প্রতীহারী।

সদ্যবিধবা রাজশ্রীর কান্নাভেজা মুখখানি শ্রান্ত, মলিন, ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা বিহ্বলও। জটিলা তার পাশটিতে দাঁড়িয়ে থেকে সাহস জোগায়।

‘আপনি পিত্রালয়ে কতদিন আগে গিয়েছিলেন?’

‘মাসাধিক কাল হবে; ওঁর শরীর বিশেষ ভাল যাচ্ছিল না, কর্তা বললেন ঘুরে এসো, পিতা মাতার সান্নিধ্যে স্বাস্থ্য ফিরবে‘; জটিলা জবাব দেয় তড়িঘড়ি।

‘সে সময় আপনার স্বামীর যাতায়াত ছিল কি আপনার পিতৃগৃহে?’ জটিলাকে উপেক্ষা করে প্রশ্ন করেন পুষ্পকেতু।

‘অবশ্যই, সপ্তাহান্তে অন্ততঃ একবার তো যেতেনই, স্ত্রী কন্যার প্রতি বড় স্নেহশীল ছিলেন তিনি’, আবার নিজে থেকে উত্তর দেয় জটিলা।

‘ভদ্রে, আমি আপনার সাথে আলাপ করতে এসেছি; আপনার স্বামী্র হত্যা শুধু আপনার পরিবার নয়, সমগ্র মগধের জন্য বড় ক্ষতি। আশা রাখব সে কথা মনে রেখে সাহায্য করবেন আপনি‘; পুষ্পকেতুর কথায় বিরক্তির সুর স্পষ্ট হয়। রাজশ্রী এতক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছেন, তিনি দৃঢ়স্বরে জটিলাকে কক্ষ ত্যাগ করতে আদেশ করেন, ক্ষুব্ধ হলেও মনিবপত্নীকে চটাতে সাহস করে না জটিলা।

‘ক্ষমা করবেন আর্য, বহূকালের পুরানো দাসী, আমাকে আগলাতে চায় কঠিন পরিস্থিতি থেকে‘; কথাটি বলতে গিয়ে চোখ ভিজে আসে রাজশ্রীর।

‘দেখুন, আমাদের হাতে সময় অল্প, তাই স্পষ্ট প্রশ্ন করছি, স্বামীর সাথে আপনার সম্পর্ক কিরূপ ছিল? তিনি যে গণিকাগৃহে যাতায়াত করেন আপনি জানতেন?’ পুষ্পকেতুর প্রশ্ন শুনে কিছুটা সময় নেন রাজশ্রী, তারপরে ধীরে কিন্তু দ্বিধাহীন স্বরে জানান নিজের বক্তব্য।

‘আমার স্বামী যে শুদ্ধ চরিত্রের পুরুষ ছিলেন না সে কথা আমি জানি; এখন বসন্তমল্লিকা, এরপূর্বে অন্য নারী, আমাদের দাম্পত্যজীবনের ধারাই ছিল এই। আমি ভবিতব্যকে মেনে নিতে পারিনি, আপ্রান চেষ্টা চালিয়েছিলাম তাঁর মন ফেরাতে, তাতে ফল উল্টোই হয়েছে ক্রমাগত। শেষে গুরুদেবের পরামর্শে কিছুদিন ধরে পিত্রালয়ে ছিলাম, আশা ছিল তিনি খোঁজ রাখবেন, বা নিজে থেকে উদ্যোগ নেবেন আমাদের ফিরিয়ে আনার। কিন্তু সেসব কিছুই হয়নি, উপোরন্তু গণিকাগৃহে তাঁর যাতায়াত বেড়েছে।’

‘গৃহসেবকদের কাউকে সন্দেহ হয় আপনার?’

‘এরা প্রত্যেকেই পুরাতন ভৃত্য, তাছাড়া আমার স্বামী অত্যন্ত সন্দিগ্ধ ব্যক্তি ছিলেন, আমাকে পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন না তিনি নিজের সুরক্ষার ব্যাপারে। তবে তাঁর আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে কেউ যদি জিঘাংসা পোষন করে থাকে, সে কথা অন্য।’

এরপর রাজশ্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভৃত্যদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন পুষ্পকেতু। পাচক ও তার সহকারী জানায়, রোজকার মতই রন্ধন শেষ হতে তারা প্রভুর ফেরার অপেক্ষায় রন্ধনশালেই ছিল। তিনি ফিরে এলে জটাধর এসে আহার্য নিয়ে যায়। সেদিনের খাদ্যতালিকায় ছিল ঘৃত তণ্ডুল, পর্পট, কুষ্মাণ্ডের ঘন্ট, মুদ্গয়ুষ আর ক্ষীর। এরপর জটাধরের সাথে শুরু হয় কথোপকথন। জটাধর যুবাপুরুষ, শক্তসমর্থ চেহারা, চোখেমুখে বুদ্ধির ছাপ।

‘কতদিন হল এই কর্মে নিযুক্ত আছ?’

‘আমার পিতা উপারিকের কার্যালয়ে কর্ম করতেন, সেই সূত্রে আমি কর্ম পাই; প্রথমে কার্যালয়ের সেবক ছিলাম, পরে আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে ব্যক্তিগত সেবক নিযুক্ত করেন প্রভু। সেও আজ পাঁচ বৎসর হবে।’

‘তুমি কি শুধু গৃহেই তাঁর দেখাশোনা করতে?’

‘আজ্ঞে না, প্রভুর সাথে সকল সময় থাকতাম, গৃহ, কার্যালয়, এমনকি নগরীর বাইরে গেলে সেখানেও।’

‘বেশ, তাহলে সেদিন সন্ধ্যায় ঠিক কি ঘটেছিল বর্ণনা কর।’

‘কিছুদিন যাবৎ প্রভু গৃহে ফিরতেন সায়াহ্নে, প্রায় প্রথম প্রহর গভীর হতে; সেদিনও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। গৃহে ফিরে আমাকে জানান তিনি ক্ষুধার্ত নন, আহার্য না আনতে। কিন্তু আমি বারংবার অনুরোধ করায় সামান্য আহার্য মুখে দেন। এরপর আমাকে ছুটি দিয়ে কক্ষদ্বার বন্ধ করে শুতে যান তিনি।’

‘ক্ষুধার্ত ছিলেন না কেন?’ এ প্রশ্ন শুনে জটাধরকে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত দেখায়, একটু সময় নিয়ে সে উত্তর দেয়।

‘বসন্তমল্লিকার গৃহে সুরাপানের মাত্রা বেশী হলে, গৃহে সামান্যই ভোজন করতেন; সেদিনও সম্ভবতঃ তাই হয়েছিল, নেশাগ্রস্ত ছিলেন প্রভু।’

‘সম্ভবতঃ বলছ কেন, তুমি উপস্থিত ছিলে না সেখানে?’

‘না, গণিকাগৃহে আমাকে নিয়ে যেতেন না তিনি, সঙ্গে রক্ষীরা থাকত তখন।’

‘রাত্রে তুমি প্রভুর কক্ষের বাইরে শয়ন করতে কি?’

‘না, প্রভুপত্নী পছন্দ করতেন না এই ব্যবস্থা, দ্বিতলে প্রভুর পরিবার আর তাদের দেখাশোনার জন্য জটিলা থাকত রাত্রে; আমি অন্দরের অলিন্দে শয়ন করতাম একতলায়।’

‘কিন্তু প্রভুপত্নীর অনুপস্থিতিতেও ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়নি?’

‘না, রাত্রে বাড়ী ফিরে প্রভু নির্জনতা পছন্দ করতেন, অনেক সময় গণিকাগৃহেই রাত্রিবাস করেছেন এর মাঝে।’

‘উপারিক সেদিন রাতে আহার অল্পই করেছিলেন, আর পানীয়?’

‘জল পান করেছিলেন; নেশা হলে তৃষ্ণা বাড়ে, আমি দুটি জলের কুম্ভিকা রেখে গিয়েছিলাম সেকারণে। সকালে দুটিই খালি পড়েছিল।’

‘কুম্ভিকার জলও কি তোমাকে দিয়ে পরীক্ষা করাতেন উপারিক?’

‘হ্যাঁ, করাতেন।’

‘সেদিনও করিয়েছিলেন কি?’

‘আগেই বলেছি তিনি নেশাগ্রস্ত ছিলেন, তবে আমি নিজহতেই পান করেছিলাম পরীক্ষার জন্য।’

***

‘রহস্য জটিল হয়ে উঠছে ক্রমশঃ, পানীয় জলে বিষ ছিল কিনা এখন আর পরীক্ষার উপায় নেই, জটাধরের মুখের কথাই মেনে নিতে হবে।’ উপারিকের গৃহ থেকে বেরিয়ে দণ্ডাধিকারিকের সাথে দেখা করেন পুষ্পকেতু, সেখানেই পরিস্থিতি পর্যালোচনা শুরু হয় নতুন করে।

‘আপনি কি জটাধরকেই সন্দেহ করছেন কুমার?’

‘সুযোগ তারই সবচেয়ে বেশী ছিল পানাহারে বিষ মেশানোর। উত্তর সীমান্ত থেকে কোনও সংবাদ পেয়েছেন কি আর?’

‘না, হিসেব মত সেনা পৌছে থাকবে গতকাল রাতের মধ্যে, এরপর দূত এখানে আসতে অন্ততঃ আরও তিনদিন, শুক্লপক্ষের আগে কিছু জানা সম্ভব নয়। তবে দূর্গপতি বলভদ্র বিচক্ষণ সেনানায়ক, আমাদের সাহায্য পেয়ে প্রতিরোধে সক্ষম হবেন, এ আমি নিশ্চিত।’

‘আমরা মথুরায় কোনও সংবাদ পেলাম না সীমা শত্রুর, এটা কি একটি আশ্চর্যের বিষয় নয়?’

‘বলভদ্রের প্রহরীবাহিনী একটি সীমান্তবর্তী গ্রামে কিছু অচেনা মানুষের জটলা লক্ষ্য করেছিল, আর তারপর দূরস্থ বনপ্রান্তরে রাত্রিকালে আগুনের শিখা লক্ষিত হয়, সেই থেকেই সাবধান হয়ে সাহায্য চেয়ে পাঠান তিনি। গোপনীয়তা রক্ষার্থে এই তথ্য পাঁচকান হতে দেননি দূর্গপতি।’

‘শ্রীদামের সাথে একবার কথা বলতে চাই ভদ্র, আপনি ব্যবস্থা করুন। স্বীকারোক্তি না পেলেও, অন্ততঃ কিছু আভাস যদি পাওয়া যায় তার সাথে আলাপ করে, সেই চেষ্টা করা দরকার।’ পুষ্পকেতুর কপালে চিন্তার ভাঁজ, সমস্ত ঘটনাক্রম তাঁকে গভীর অস্বস্তিতে ফেলেছে বোঝা যায়।

***

শ্রীদামের কারাকক্ষে মুখোমুখি পুষ্পকেতু ও শ্রীদাম, সাথে আছেন উল্মুকও। বাল্যবন্ধুকে সঙ্গে রাখা পরিবেশ কিছুটা লঘু করতে; প্রথাগত জিজ্ঞাসাবাদে কাজ হবে না বিশেষ এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত।

‘ভদ্র শ্রীদাম, আমাকে আপনার শত্রু মনে করবেন না, কান্যকুব্জের পরিস্থিতি কিছু জটিল, সেকারণে আপনার সাহায্য চাইছি আমি। আপনি এতকালের কর্মচারী, যদি এতটুকু আনুগত্য থেকে থাকে নিজ কার্যালয়ের প্রতি, অবশ্যই সব কথা খুলে বলবেন আপনি।’ পুষ্পকেতুর অনিন্দ্যকান্তি ও পরিশীলিত ব্যবহারে কিছুটা হলেও নমনীয় হয়েছেন শ্রীদাম বোঝা যায়।

‘পরিস্থিতি জটিল কিরকম?’ কৌতুহলী মনে হয় তাকে।

‘আপনি বোধকরি জানেননা, সম্প্রতি উপারিক উগ্রসেনের মৃত্যু ঘটেছে বিষক্রিয়ায়।’ সংবাদটি আচমকা পরিবেশন করে শ্রীদামের মুখভাব পর্যবেক্ষন করেন পুষ্পকেতু। সেখানে ফুটে ওঠে বিস্ময় ও শোকের ছায়া।

‘এখন খুলে বলবেন কি আপনার সব কথা? আপনার মৌনতা আমাদের ভাবতে বাধ্য করবে যে এই মৃত্যুর সাথে আপনার যোগ আছে।’

‘না, এ মিথ্যা! সর্বৈব মিথ্যা! যে অপরাধই করে থাকি আমি, প্রভুর প্রাননাশের কোনও চেষ্টা তাতে ছিল না।’

‘তাহলে দয়া করে খুলে বলুন সব কথা।’

দীর্ঘক্ষণ মৌন থেকে, বোধকরি নিজের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে সিদ্ধান্ত নেন শ্রীদাম, এরপর ধীরে ধীরে নিজের বক্তব্য জানান; তাঁর কণ্ঠস্বর আবেগে মৃদু, কিছুটা স্বগোক্তির মত শোনায়; মনযোগ দিয়ে শুনতে চেষ্টা করেন দুইবন্ধু।

‘অপত্য স্নেহ বড় ভীষণ বস্তু। আমার কনিষ্ঠপুত্র প্রিয়ংকর শিশুকাল থেকেই বড় দামাল, একরোখা, বিদ্যাশিক্ষার চেয়ে খেলাধুলা আর দুষ্টুমিতেই ছিল মনযোগী। তার ছোটখাটো অপরাধগুলি আমার পত্নী লুকিয়ে যেতেন আমার কাছে, কিন্তু বড় হতে মিথ্যাভাষণ, গৃহ থেকে মুল্যবান বস্তু চুরি এজাতীয় ঘটনা ঘটতেই থাকে, অনেক শাসন করেও উপায় হয় নি কিছু। শেষে, পাঁচ বৎসর পূর্বে নিজের মাতার সমস্ত অলংকার চুরি করে দেশান্তরী হয় সে। আমরা লোকলজ্জার বশে রটিয়ে দিই সে সন্ন্যাস নিতে গৃহত্যাগী হয়েছে। দীর্ঘদিন সংবাদ ছিল না তার, আমিও তল্লাস করার চেষ্টা করিনি বিশেষ। অবশেষে বছর তিনেক আগে এক পত্র পাই তার কাছ থেকে, সেটি নিয়ে এসেছিল এক ভৃগুকচ্ছের বণিক। সেই পত্রে জানতে পারি পুত্র সেই দেশেই স্থিতু হয়েছে, পশুপতি নামের এক বিত্তবান মণিকারের সাথে কাজ করছে। এরপর নিয়মিত পত্র আদান প্রদান চলেছে, পশুপতির কর্মচারী নগরে এলে নিয়ে আসত পুত্রের সংবাদ। এরপর জানতে পারি সে পশুপতির একটি কন্যাকে বিবাহ করেছে। হঠাৎ গত ভাদ্রে পশুপতি নিজে এসে হাজির হন আমার গৃহে, তিনি জানান, এক রোমক বণিক প্রিয়ংকরের বিরুদ্ধে প্রতারনার অভিযোগ এনেছে, নকল রত্ন আসল বলে বিক্রয় করেছে সে উচ্চমূল্যে। বিদেশী বণিককে প্রতারণা ঘৃণ্য অপরাধ, এর শাস্তি অত্যন্ত কঠিন সে দেশে, কারাবন্দী হয়েছে পুত্র আমার। এদিকে তার পত্নী সন্তানসম্ভবা, স্বামীর চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে সেও। পশুপতি বিহ্বল হয়ে ছুটে এসেছিলেন আমার কাছে। তিনি রোমক বণিকের অর্থ ফেরৎ দিতে চেয়েছিলেন, বণিক মানতে চায় নি, দণ্ডাধিকারিকের কাছেও আবেদন জানান এ নিয়ে। অনেক মিনতির পরে জরিমানা ধার্য হয় রোমক বণিকের প্রতারিত অর্থ ও তার সাথে এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা । পশুপতির সধ্যাতীত ছিল সে জরিমানা, তাই আমার কাছে ছুটে আসেন তিনি। আমি সামান্য প্রশাসনিক কর্মচারী, এত অর্থ আমিই বা পাই কিরূপে। এদিকে বিচারের দিন এগিয়ে আসছে ক্রমশঃ, মুল্য ধরে দিতে না পারলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অবধারিত। এর পরে আর স্থির থাকতে পারিনি আমি, বাধ্য হয়ে তহবিল তছরূপ করি, কিন্তু তাতেও একসাথে অত স্বর্ণমুদ্রা সংগ্রহ আমার ক্ষমতার বাইরে। গত কয়েকমাসে কিছু কিছু করে পাঁচশত দিনার দিতে পেরেছিলাম, আশা ছিল হয়তো প্রিয়ংকরের তরুণী ভার্যার কথা চিন্তা করে অন্ততঃ দণ্ডাধিকারিকের মন গলবে। হা হতোস্মি! দণ্ডাধিকারিক জানতে পেরে যান প্রিয়ংকর মগধের নাগরিক, পশ্চিমা ক্ষত্রপদের সাথে আমাদের শীতল সম্পর্ক বাধা হয়ে দাঁড়ায় এ ক্ষেত্রে। পশুপতি সেকারণেই আবার ছুটে এসেছিলেন আমার কাছে, যেভাবেই হোক আরও কিছু অর্থ জোগাড় করে দিতেই হবে তাঁকে। এই কমাসে তাঁরও অর্থদণ্ড গেছে যথেষ্ট, উপরোন্তু ভৃগুকচ্ছে ব্যবসা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে তাঁর পক্ষে। লোকলজ্জা ও অসম্মানের ভয়ে গোপন সাক্ষাৎ ভিন্ন উপায় ছিল না। জানি না পশুপতির সম্পর্কে উপারিক কিভাবে জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু নিজমুখে নিজের কলঙ্কের কথা স্বীকার করতে পারিনি আমি! বড় বিশ্বাস করতেন আমাকে প্রভু‘; বক্তব্য শেষ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন শ্রীদাম।

স্তব্ধ হয়ে থাকেন পুষ্পকেতু ও উল্মুক কয়েক মুহূর্ত, এই নতুন কাহিনী তাঁদের কাছে আকস্মিক।

‘আপনাকে আরও একটি সংবাদ জানানো আমার কর্তব্য, কারাবাসকালে পশুপতির মৃত্যু ঘটেছে।’ কক্ষত্যাগের আগে পুষ্পকেতু কথাটি বলে যান। সংবাদ শুনে শ্রীদামের চক্ষুদুটি জ্বলে ওঠে না জানি কোন রূদ্ধ আবেগে।

***

‘শ্রীদামের স্বীকারোক্তি কি বিশ্বাসযোগ্য, তোমার কি মনে হয় কেতু?’ কারাগৃহ থেকে ফেরার পথে প্রশ্ন করেন উল্মুক।

‘সে যতটুকু বলেছে তা সত্য, তবে সম্পূর্ণ সত্য কিনা বলা শক্ত।’

‘তুমি ঠিক কি বলতে চাইছ?’

‘ধর যদি ভৃগুকচ্ছের দণ্ডাধিকারিক, শ্রীদামের পরিচয় জেনে শুধু অর্থ নয়, গুরুত্বপূর্ণ সামরিক তথ্য দাবী করে থাকেন, সে বিষয়ে আমরা এখনও অন্ধকারে।’

‘এখন কি করবে ভাবছ তাহলে?’

‘আপাততঃ একবার বসন্তমল্লিকার সাথে সাক্ষাৎ করা প্রয়োজন, সে যদি কোনও নতুন তথ্য দিতে পারে!’

*** ***

অধ্যায় ৭

পশ্চিমাকাশে অপরাহ্নের রক্তিমাভা ছড়িয়েছে ইতিমধ্যেই, পুষ্পকেতু ও উল্মুক উপস্থিত হন বসন্তমল্লিকার আলয়ে, কিছু আগে তাঁদের আগমন বার্তা দিয়ে গেছে রক্ষী, তাই নটী অপেক্ষা করছিল রাজপুরুষদের জন্য, তার সাথে মাতৃসমা গুণধরীও উপস্থিত পরিস্থিতির গাম্ভীর্য বুঝে। হাতে সময় অল্প, বসন্তমল্লিকাকে লোকিকতার সুযোগ না দিয়ে সরাসরি জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন পুষ্পকেতু।

‘উপারিক কি রোজই আসতেন এখানে?’

‘হ্যাঁ প্রায় রোজই, অবশ্য যদি না কর্ম উপলক্ষে বাইরে যান।’

‘কতদিন হল তিনি আসছেন এই গৃহে?’

‘প্রায় বৎসর খানেক।’

‘আপনি কতদিন হল এই কাজ করছেন?’

‘আমার এই গৃহ অতিথিদের জন্য নূতন করে উন্মুক্ত হয় বিগত বসন্ত পূর্ণিমায়, সেদিন মল্লিকার নৃত্য দেখে ধন্য ধন্য পড়ে যায় অতিথিদের মাঝে, উপারিকও উপস্থিত ছিলেন উৎসবে, তার পর থেকেই তাঁর যাতায়াত এই গৃহে।’এবারে উত্তর দেয় গুণধরী।

‘ইনি কি আপনার কন্যা?’ পুষ্পকেতু গুণধরীকে প্রশ্ন করেন।

‘জন্ম দিইনি ওকে, তবে আমার পালিতা কন্যা অবশ্যই।’

‘ভদ্রে, দুর্ঘটনার দিন উপারিক আপনার গৃহে আসার পরবর্তী ঘটনাবলী একটু ভালো করে ভেবে আমাকে বর্ণনা করুন, সামান্য কথাও বাদ দেবেন না দয়া করে।’ বসন্তমল্লিকাকে অনুরোধ করেন পুষ্পকেতু।

‘সেদিন রোজকার মতই কার্যালয় থেকে এখানে আসেন উপারিক, তখনও দিনের আলো ছিল অল্প। এরপর নৃত্য-বাদ্য চলে বেশ কিছুক্ষণ, একটি নূতন নৃত্যাভিনয় তৈরি করেছিলাম কয়েকদিনের পরিশ্রমে, সেটি ওইদিন পরিবেশন করি। প্রভু খুশী হয়ে পারিতোষিক দেন, দেখতে দেখতে রাত্রি হয়ে আসে, তিনি থেকে যেতে চেয়েছিলেন, আমিই বারণ করি। অবশেষে রাত্রির প্রথম প্রহর গভীর হতে বিদায় নেন তিনি। এখন মনে হচ্ছে, কেন যেতে দিলাম সেদিন, এখানে থাকলে প্রাণসংশয় হতো না তাঁর।’ নটীর স্বর রূদ্ধ হয়ে আসে কান্নায়।

‘আপনি থেকে যেতে বাধা দিলেন কেন সেদিন?’

‘আমার কারনে তাঁর পরিবারে অশান্তি, দুর্নাম ছড়াচ্ছে গণিকালয়ে রাত্রিবাসের ফলে, তাঁর পত্নীর কাছ থেকে সেরকমই বার্তা নিয়ে এসেছিল এক দাসী। তার বাক্যযন্ত্রণা কাতর করেছিল আমায়, গণিকারও হৃদয় থাকে আর্য, কেন ভুলে যায় গৃহবাসী মানুষ কে জানে!’ কথাকটি বলতে গিয়ে চোখের কোল বেয়ে জলের ধারা নামে, দিনান্তের ম্লান আলোয় এই মুখখানি কোনও নটীশ্রেষ্ঠার নয়, যেন এক অসহায় তরুণীর। নিস্তব্ধতা নেমে আসে কক্ষে কিছুক্ষণের জন্য, পুষ্পকেতু আবার শুরু করেন তারপর।

‘সেদিন উপারিক পানাহার করেছিলেন কিছ এখানে?’

‘হ্যাঁ, রোজকার মতই সুরাপান করেছিলেন, সাথে ছিল মৎস্যাণ্ড ভাজা আর পর্পট।’

‘কে পরিবেশন করেছিল সেসব?’

‘আপনি জানেন বোধহয়, তিনি পরীক্ষা বিনা কিছু গ্রহণ করতেন না। আমিই নিজে আস্বাদন করে তার পর দিয়েছিলাম পানাহার; যতবার সুরাপাত্রে তরল ঢেলেছি, আমাকে চুমুক দিতে হয়েছে পরিবেষনের আগে। সেদিন সুরাপান মাত্রা ছাড়িয়েছিল, ওঁর কারনে আমারও ঘোর লেগে গিয়েছিল।’

বার্তালাপ শেষ করে অতিথিশালার পথ ধরেন দুইবন্ধু, পুষ্পকেতু গভীর চিন্তায় অন্যমনস্ক, উল্মুক পরিবেশ হালকা করতে বাক্যালাপ শুরু করেন।

‘নটী ভারি সুন্দরী, একথা কিন্তু মানতেই হয় কি বল? এমন মুখশ্রী, দেহসৌষ্ঠব রাজ পরিবারেও সহসা চোখে পড়েনা। স্বাভাবিক ভাবেই উপারিক আকর্ষিত হয়েছিলেন তার প্রতি। নগরীর শ্রেষ্ঠ গণিকা, সে তো উপারিকের করায়ত্ব হবেই।’

‘কি বললে?’ চমকে ওঠেন পুষ্পকেতু। ‘শকট ঘোরাও, অতিথিশালা নয় দণ্ডাধিকারিকের কার্যালয়ে যাব’, সারথীকে নির্দেশ দেন তিনি।

‘হঠাৎ হল কি তোমার, অমন ক্ষেপে উঠলে যে?’

‘আজ কি তিথি?’

‘কেন, ত্রয়োদশী।’

‘মানে কাল অমাবস্যা!’

‘সেরকমই তো হওয়ার কথা জানি’, উল্মুক পরিহাস করার চেষ্টা করেন।

‘এতক্ষনে কিছুটা পরিষ্কার হয়ে আসছে অন্ধকার।’

‘বল কি হে! অমাবস্যায় আলোর দিশা! দিনে দিনে হেঁয়ালী হয়ে উঠছ তুমি।’

***

দণ্ডাধিকারিক গৃহে ফেরার উদ্যোগ করছিলেন, এর মধ্যে পুষ্পকেতুকে কার্যালয়ে ব্যস্তপায়ে আসতে দেখে অবাক হয়ে পড়েন।

‘কি ব্যাপার কুমার, আবার কিছু অঘটন ঘটল নাকি?’

‘এখনও ঘটে নি, তবে আমার ধারণা ঘটতে চলেছে খুব শীঘ্রই।’

‘একটু খুলে বলবেন কি?’

‘তার আগে আধিকারিক সুস্মিতকে এখানে আনানোর ব্যবস্থা করুন।’ পুষ্পকেতুর কথায় সুস্মিতকে আনতে তাঁর গৃহে লোক যায় তক্ষুণি।

‘উত্তর সীমায় কি পরিমাণ সেনা পাঠিয়েছেন আপনারা?’

‘অর্ধেকের অধিক সেনা গেছে সেখানে; দেড় সহস্র অশ্বারোহী, তিন সহস্র পদাতিক ও পঞ্চাশজন ধনুর্বিদ।’

‘বলভদ্রের পত্র নিয়ে কে এসেছিল এখানে?’

‘দূর্গের এক অশ্বারোহী, পত্রে বলভদ্রের নামাঙ্কিত শীলমোহর ছিল; পত্রের শীলও অক্ষত ছিল, আমি নিজে পরীক্ষা করেছি।’

‘শুধুমাত্র পত্রের ভরসায় এতবড় সেনা পাঠিয়ে দিলেন আপনারা? সাধারণতঃ সত্যতা পরীক্ষার জন্য গোপন সঙ্কেত বাক্যের ব্যবস্থা থাকে।’

‘আসলে, ঠিক তার আগের দিনই মৃত্যু ঘটেছে উপারিকের, শ্রীদামও চরবৃত্তির কারণে কারারূদ্ধ। এসকল বিষয় উপারিক নিজেই পরিচালনা করতেন, অন্য কারুকে বিশ্বাস করতেন না তিনি। আপনি কি কোনও শঠতার আভাস পাচ্ছেন এর মধ্যে? কিন্তু এরূপ পরিহাস করে কার কি লাভ?’

‘এ এক গভীর ষঢ়যন্ত্র, বুঝতে পারছেন না আপনি? আজ ত্রয়োদশী, কাল অমাবস্যা, কান্যকুব্জ শিবিরে সেনাবল অর্ধেকেরও কম; এদিকে নগরে বিশৃংখলা।’

‘সেনা শিবিরে শত্রুর আক্রমণের আশঙ্কা করছেন আপনি?’

‘তার চেয়েও বেশী কিছু।’ কথাবার্তার মাঝেই আধিকারিক সুস্মিত এসে পড়েন।

‘ভদ্র সুস্মিত, আপনার কাছে কিছু জিজ্ঞাস্য ছিল আমার।’

‘বলুন?’ আচমকা ডাক পেয়ে অবাক হয়েছেন সুস্মিত বোঝা যায়, তবে পুষ্পকেতুর গম্ভীর মুখভাব দেখে পরিস্থিতি অনুমান করে নেন তিনি।

‘শঙ্খবিষের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে বিষক্রিয়া বিলম্বিত করা সম্ভব কি?’

‘হ্যাঁ, সম্ভব, সেকারনেই তিলে তিলে বিষক্রীয়া ঘটাতে এই বিষ ব্যবহৃত হয়। তবে ঠিক কী পরিমাণে ও কত সময় পূর্বে এই বিষ প্রয়োগ করলে কাঙ্ক্ষিত সময়ে মৃত্যু ঘটবে তা এক অতি বিচক্ষণ বিষবিজ্ঞানী ভিন্ন নির্ধারন করা শক্ত।’

‘আপনি কি সন্দেহ করছেন একটু খুলে বলবেন কুমার’ চন্দ্রবর্মা বিহ্বল বোধ করেন অবস্থার গতিকে।

‘সব কিছুই বুঝিয়ে বলব আপনাকে, কিন্তু তার আগে বজ্রবাহূকে সংবাদ পাঠান যেন যত শীঘ্র সম্ভব দক্ষিণ সীমান্তে সেনা পাঠানোর ব্যবস্থা করেন তিনি। আমার ধারনা আসল বিপদ এরাকন্যার সীমান্তে। শ্রীদামের কারাবাস, তার কয়েকদিনের মধ্যে উপারিকের হত্যা, আর ঠিক তার পরের দিনই উত্তর সীমান্ত থেকে সাহায্যের বার্তা, ঘটনাগুলি কেমন পরস্পর যুক্ত নয়? কোনও বৃহত্তর স্বার্থে যদি এই ঘটনা গুলি পরপর ঘটানো হয়ে থাকে, তবে তার উদ্দেশ্য কি হতে পারে? শ্রীদামের কারাবাস হলে, উপারিক একা হয়ে পড়বেন, উপারিকের মৃত্যু ঘটলে, প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়বে, আর সেই সুযোগে উত্তরে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলে দক্ষিণসীমা অবহেলিত হবে।’

‘কিন্তু এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নেব শুধুমাত্র অনুমানের উপর ভিত্তি করে?’ চন্দ্রবর্মা তখনও দ্বিধাগ্রস্ত।

‘বেশ তবে অপেক্ষা করে থাকুন; পরবর্তী ঘটনাবলী আমি বলে যাচ্ছি, সময় হলে মিলিয়ে নেবেন। কাল অমাবস্যার রাত্রে কান্যকুব্জ শিবিরে অগ্নিকাণ্ড জাতীয় কিছু গোলমাল সৃষ্টি হবে, তাতে ছত্রভঙ্গ হবে শিবির, এই সুযোগে বজ্রবাহূর প্রাণনাশের চেষ্টাও হতে পারে। একই রাত্রে এরাকন্যা দুর্গে বিদিশার সেনা আক্রমণ করবে আতর্কিতে, দুর্গ থেকে সংবাদ পাঠালেও সেই রাত্রের মধ্যে সাহায্য পৌঁছানো অসম্ভব হবে। দিবাকাল শুরু হতে হতে এরাকন্যা চলে যাবে বিদিশার দখলে। এরপর পাটলীপুত্রে সংবাদ প্রেরণ, পুনরায় যুদ্ধ এতকিছু দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি, নানা বিষয়ে ব্যস্ত সম্রাট ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের জন্য আবার যুদ্ধে আগ্রহী না হতেও পারেন। অতএব, এরাকন্যা পুনর্দখল করতে পারলে সবমিলিয়ে লাভবান হবে বিদিশাই, বুঝতে পারছেন তো?’

পুষ্পকেতুর ব্যাখ্যা শুনে শীতের রাতেও ঘামতে শুরু করেন চন্দ্রবর্মা, এত কঠিন পরিস্থিতিতে এর আগে কখনও পরেননি তিনি। অবশেষে বজ্রবাহূকে সবকথা বিস্তারে জানিয়ে পত্র পাঠানো স্থির হয়, পত্র নিয়ে যাবেন কান্যকুব্জের মহাপ্রতিহারী স্বয়ং।

‘উপারিকের হত্যা কি তবে জটাধরই করেছে বলে আপনার সন্দেহ? জটাধর খাদ্য পরীক্ষা করেছে কিনা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় লক্ষ্য করেননি উপারিক, সে তো বোঝাই যাচ্ছে।’ পত্রপ্রেরণ শেষে কার্যালয়েই রাত্রির আহারের বন্দোবস্ত হয়েছে, আহার করতে করতে প্রশ্ন করেন চন্দ্রবর্মা।

‘দেখুন আমার মতে বিষ প্রয়োগ যেই করে থাকুক, হত্যার জন্য দায়ী বিদিশার রাজসিংহাসন। হ্যাঁ, তবে জটাধর এর মধ্যে যুক্ত নয়।’

‘সে ছাড়া আর কারই বা সুযোগ ছিল?’ প্রশ্ন করেন উল্মুক।

‘বসন্তমল্লিকা। হ্যাঁ বিষপ্রয়োগ সেই করেছিল সুরাভাণ্ডে।’

‘কি বলছ কেতু! সে নিজে প্রতিবার পান করেছে সেই সুরা পরিবেশনের আগে।’

‘গুপ্তচরতন্ত্রের বড় হাতিয়ার গুপ্তহত্যা, আর গুপ্তহত্যার গুরুত্বপূর্ণ সেনানী বিষকন্যা, শোননি সেকথা?’

‘বসন্তমল্লিকা বিষকন্যা?’ চন্দ্রবর্মা ও উল্মুক সমস্বরে বিস্ময় প্রকাশ করেন।

‘দরিদ্র ঘরের সুন্দরী কন্যাদের শিশুকালেই সংগ্রহ করে অল্পমাত্রায় বিষপ্রয়োগের মাধ্যমে বিষে অভেদ্য করে তোলা হয়, এদের বেশীরভাগই সইতে পারেনা এই প্রক্রিয়া, অকালেই প্রাণ যায় তাদের। কিন্তু যারা উত্তীর্ণ হয়, নৃত্য, বাদ্য, লাস্য এবং রতিশাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে তারা হয়ে ওঠে এক একটি ভীষণ অস্ত্র। জানি এদের সম্পর্কে অনেক রকম উপকথা শোনা যায়, যে এদের নিঃশ্বাসে বিষ, অঙ্গ স্পর্শ করলেও মৃত্যু; কিন্তু সেসব কল্পকথা। আসলে এরা বিষবিজ্ঞানে অভিজ্ঞ এবং এদের শরীর সাধারণ মানুষের তুলনায় অধিক মাত্রায় সহ্য করতে পারে বিষের প্রকোপ। সেইদিন রাত্রে উগ্রসেন নেশাগ্রস্ত নয়, বিষগ্রস্ত ছিলেন, সেকারনেই স্বাভাবিক বুদ্ধিদৃত্তি কাজ করছিল না গৃহে ফিরে, অতিরিক্ত তৃষ্ণার কারণও ওই শঙ্খবিষ। বসন্তমল্লিকাও পান করেছিল সুরাপাত্র থেকে, তারও ঘোর লেগেছিল বিষ থেকে।’

‘এখন তাহলে কি কর্তব্য কুমার? রক্ষী পাঠাই নটীকে গ্রেপ্তার করতে?’

‘এখনই নয়, আমরা ষঢ়যন্ত্র ধরে ফেলেছি জানলে, হয়তো শত্রুপক্ষ কালকের পরিবর্তে আজকেই আক্রমণ করবে। আগে বজ্রবাহূকে প্রস্তুত হতে দিন, আমরা ভোর রাত্রে যাব গণিকাগৃহে।’

*** ***

অধ্যায় ৮

রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর গত প্রায়, বাইরে শৃগাল ও পেচকের ডাক ভিন্ন আর কোনও শব্দ নেই। তনুশ্রীর শয়নকক্ষের জানালায় করাঘাত, মৃদু অথচ স্পষ্ট।

‘কে? কে ওখানে?’ সচকিত হয়ে প্রশ্ন করে ওঠে সে।

‘আমি চারুদত্ত, চিৎকার করোনা, জানালার কপাট খোল।’

‘আপনি? এপথ দিয়ে!’ জানালার লাগোয়া একটি আম্রবৃক্ষ, সেটির সাহায্যে উপরে এসেছেন শ্রেষ্ঠী সন্দেহ থাকে না। তনুশ্রী তাড়াতাড়ি কপাট খুলে ভিতরে নিয়ে আসে তাঁকে। কালো চাদরের ভিতরে বসুদত্তের যোদ্ধার সাজ আজকে, বুকে বর্ম, কোমরে তরবারি। বিস্ময় মাত্রা ছাড়ায় তনুশ্রীর।

‘সকল কথা বলার সময় নেই এখন, শুধু জানতে চাই আমার সাথে যাবে তুমি শ্রী?’

‘কোথায়?’

‘এই দেশ ছেড়ে অন্য কোনখানে, যেখানে মগধ সাম্রাজ্যের ছায়া পড়বে না।’

‘কিন্তু কেন? দেশান্তরী হতে চান কেন প্রভু?’

‘যদি বলি এই দেশ আমার নয়, তবে?’ তনুশ্রীর মুখভাবে পরিবর্তন দেখা দেয় ধীরে, যেন কিছু বুঝতে চেষ্টা করছে সে।

‘আপনি বিদেশী! তবে কি গুপ্তচর? ব্যবহার করেছিলেন আমায়?’

‘হ্যাঁ গুপ্তচর একথা ঠিক, বসন্তমল্লিকার সাথে যোগাযোগ রাখতেই এই গৃহে আমার যাতায়াতের শুরু। কিন্তু বিশ্বাস কর, তোমাকে সত্যিই ভালবেসেছি আমি, যেমনটি আর কাউকে কখনও বাসিনি। বল প্রিয়ে যাবে আমার সাথে?’

‘না! চলে যান আপনি এই মূহূর্তে, আর কখনও যোগাযোগের চেষ্টা করবেন না’, অবরূদ্ধ কন্ঠে বলে ওঠে তনুশ্রী।

‘তবে কি তুমি বিশ্বাস করোনা আমার অকপট প্রেমে? ভালোবাসনা আমায়?’ মধ্যবয়সী প্রেমিকের কণ্ঠস্বরে নবযুবকের আকুলতা; কয়েক মূহুর্তের জন্য বুঝিবা নিজেকে হারিয়ে ফেলে গণিকা।

‘আপনাকে বিশ্বাস করি, জানি আপনি হৃদয়বান, মহৎপুরুষ। কিন্তু আমাদের পথ আর কোনোদিনই এক হতে পারে না। আপনাকে ভালোবাসি ভদ্র, কিন্তু তার চেয়েও বেশী ভালোবাসি আমার মগধকে; চলে যান আপনি‘; কান্নায় ভেঙে পরে সে।

‘তুমি অসামান্যা, নারীশ্রেষ্ঠা, আশীর্বাদ করি জীবনে সুখী হও।’ কথাগুলি ধীরে উচ্চারণ করে আবার জানালা পথে অদৃশ্য হন বিদিশার গুপ্তবাহিনীর সেনানায়ক চন্দ্রচূড়।

ভোর হয়ে আসে, পূবের আকাশ গৈরিক আচ্ছাদনে ধ্যানগম্ভীর; স্তব্ধ তনুশ্রী দূরপানে চেয়ে বসে থাকে জানালার প্রান্তে। এই পথ চাওয়া বুঝি আর শেষ হবে না তার কোনোদিন।

***

কয়েকজন রক্ষী সাথে নিয়ে ভোর হতেই বসন্তমল্লিকার গৃহে হানা দিয়েছেন চন্দ্রবর্মা; সাথে আছেন পুষ্পকেতু ও উল্মুক। গৃহরক্ষী ও দাসীদের বাধা উপেক্ষা করে নটীর শয়নকক্ষে প্রবেশ করেন সকলে। এত ভোরেও বসন্তমল্লিকা জেগেই ছিল, বসন ভূষন দেখে মনে হয় সে অপেক্ষায় ছিল কারও।

‘আপনারা?’ চমকে ওঠে সে দণ্ডাধিকারিকের ক্ষুদ্র দলটিকে দেখে।

‘উপারিককে হত্যা ও দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বন্দী করতে এসেছি তোমাকে, স্বপক্ষে কিছু বলার থাকলে তুমি বলতে পার।’

‘ওঃ, এই ব্যাপার। আপনাকে কাল দেখেই ভয় হয়েছিল আর্য, বুঝিবা সব বৃথা গেলো শেষ অবধি’, পুষ্পকেতুর দিকে চেয়ে ম্লান হেসে বলে ওঠে নটী।

‘তোমাকে যেতে হবে আমাদের সাথে’, কথাটি বলে এক রক্ষীর দিকে ইঙ্গিত করেন চন্দ্রবর্মা। সে হাত বাঁধতে যেতেই ছিটকে সরে যায় বসন্তমল্লিকা, আর সেই সাথে চকিতে কোমর থেকে বের করে আনে একটি ক্ষুদ্রছুরিকা, সেটি আমূল বসিয়ে দেয় সে নিজের বক্ষে।

‘এ কি করলে?’ পুষ্পকেতু ছুটে যান তার ভূপতিত দেহটিকে তুলে ধরতে।

‘আমাদের মত রমনীর জীবনে সমাপতন এ ভাবেই আসে দেব। আপনাকে দেখে বড় ভালো লেগেছিল, জানি আপনি মহৎপ্রাণ, কথা রাখবেন।’এটুকু বলেই হাঁপাতে থাকে বসন্তমল্লিকা, তার নাক মুখ থেকে রক্ত ছলকে ওঠে।

‘যদি দেশদ্রোহীতা না হয়, অবশ্যই রাখব তোমার অনুরোধ, তুমি বল।’

‘গুণধরী আর তনুশ্রী আমার সত্যকার পরিচয় জানে না, বেশ কিছুকাল আগে তীর্থ থেকে ফিরছিল গুণধরী, আমি পথে তার পায়ে পড়ে আশ্রয়ভিক্ষা করি। সরল বিশ্বাসে আমায় কাছে টেনে নিয়েছিল সে, মেয়ে বলে পরিচয় দিয়েছিল সমাজে। ওদের আপনারা শাস্তি দেবেন না দয়া করে।’ নিজের হাতদুটি জোড় করার চেষ্টা করে সে, অশ্রু ঝরে পড়ে চোখের কোন বেয়ে।

‘বেশ, কথা দিলাম; প্রমাণ না পেলে তাদের বন্দী করা হবে না। তুমি নিশ্চিন্ত হও।’ পুষ্পকেতুর আশ্বাসবাণী শুনে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে তার ঠোঁটের কোণে, আর সেই সাথে স্থির হয়ে যায় আঁখি পল্লব।

***

‘ভদ্র শ্রীদাম, আপনার অপরাধ গম্ভীর, কিন্তু তা দেশদ্রোহিতা নয়, একথা জেনেছি আমরা। আর সেকারনেই একটি সাহায্য চাইছি আপনার কাছে।’ কারাকক্ষে শ্রীদামের সাথে আবার দেখা করতে গেছেন পুষ্পকেতু।

‘বলুন কি জানতে চান?’

‘পশুপতির সম্পর্কে উগ্রসেনকে কে সংবাদ দিয়েছিল, অনুমান করতে পারেন কি?’

‘অনুমান নয়, দৃঢ় ভাবেই বলতে পারি কে সে।’

‘কে সে?’

‘স্বর্ণকার ধনঞ্জয়। এর আগেও দু একটি বিদেশী চরের সংবাদ সে এনেছিল, কিন্তু ধরা পড়েনি তারা কেউই, এমনকি অকাট্য প্রমানও কিছু মেলেনি তাদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি উপারিক তাকে বেশ কিছু অর্থ দেবার নির্দেশ দেন, এখন আমার ধারণা সে-ই পশুপতির ব্যাপারে তাঁকে জানিয়েছিল, আর সেকারনেই এই পারিশ্রমিক।’

***

ধনঞ্জয়ের গৃহে হানা দিয়ে দেখা গেলো বাইরে থেকে কপাট বন্ধ, গৃহ শূন্য। পরিবার পরিজন কেউ থাকত না তার সাথে, শয্যা দেখে মনে হয় ভোর রাত্রেই গৃহ ত্যাগ করেছে সে।

‘আমার মনে হয়, বসন্তমল্লিকা তার জন্যেই অপেক্ষা করছিল, দুজনে নগর ত্যাগ করত লোক চলাচল শুরু হবার আগেই। তবে আমাদের গণিকালয়ে ঢুকতে দেখে ধনঞ্জয় একাই পলায়ন করেছে‘; পুষ্পকেতু মন্তব্য করেন।

‘এখন বজ্রবাহূর কাছ থেকে সংবাদের অপেক্ষা, আপনার অনুমানের উপর ভিত্তি করে অনেক বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছি কুমার।’

‘পশ্চাতাপ হচ্ছে কি এর জন্যে?’

‘না, তবে উদ্বেগ হচ্ছে কিছুটা বলতে দ্বিধা নেই।’

চন্দ্রবর্মার উদ্বেগ দীর্ঘস্থায়ী হয়না, মধ্যরাত্রে সংবাদ আসে, এরাকন্যা দুর্গ আক্রমণ করতে গিয়ে পরাজিত হয়ে পিছু হঠেছে বিদিশার সেনা। তাদের পিছু নিয়ে সেনাপতি সত্যনাগকে বন্দী করেছেন বজ্রবাহূ। দুইদিন পরে উত্তর সীমান্ত থেকে দূত মুখে সংবাদ আসে, ভুয়ো লিপি পেয়ে অযথা সেনা পাঠানো হয়েছিল উত্তরে, তারা এখন ফিরতি পথে দিন দুয়েকের মধ্যেই কান্যকুব্জে পৌঁছবে।

***

দুইমাস কেটে গেছে, পাটলীপুত্রে ফিরেছেন দুইবন্ধু। হরিষেণের গৃহে একান্ত সাক্ষাতে পুষ্পকেতুর সাথে আলাপ করছেন মহামন্ত্রী।

‘তোমাকে নতুন করে আর কি অভিবাদন জানাব বৎস! শ্রীধরবর্মন বিনাশর্তে বশ্যতা স্বীকার করেছেন, পরিবর্তে তাঁকে মগধ রাজছত্রের হয়ে নিজ রাজ্য শাসনের অনুমতি দিয়েছেন সম্রাট, সত্যনাগও মুক্তি পেয়েছেন, তবে তিনি সেনাপতি পদ থেকে অব্যহতি নিয়েছেন। শ্রীধরবর্মনের দ্বিতীয়া কন্যাটির সাথে কুমার মকরগুপ্তের বিবাহ স্থির হয়েছে। এই উপলক্ষে সম্রাট আগামী পূর্ণিমা তিথিতে রাজসভায় তোমাকে সম্মানিত করতে চান, প্রস্তুত থেক।’

‘এ আমার পরম সৌভাগ্য দেব, আপনার কাছে আমি চির ঋণী।’

‘ও কথা বোল না পুত্র, নিজের আলোকেই তুমি উজ্জ্বল, বুদ্ধিমত্তার সাথে, যে কোমল হৃদয়টি তোমার আছে, ধরে রেখো তা চিরকাল। কল্যাণ হোক।’

***

পায়ে হাঁটা গ্রাম্যপথ, তার একপাশে বয়ে যাচ্ছে বেত্রবতী নদী, ছায়াঘেরা বন পেরিয়ে যতদূর চোখ যায় উন্মুক্ত প্রান্তর। শ্বেত শুভ্র পোশাক, পক্ককেশ, হাতে যষ্ঠী, কিন্তু ঋজু দেহ; দৃঢ় পায়ে হেঁটে চলেছেন এক বৃদ্ধ। যুদ্ধ, ক্ষমতার পরিবর্তন, ষঢ়যন্ত্র, শত্রু-মিত্র, বিজেতা- পরাজিত, সকল ঘটনা ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবে ঐতিহাসিকের পরিপ্রেক্ষিতে; কিন্তু এসবের আড়ালে রয়েছে কতজনের আদর্শ, আত্মত্যাগ, আকিঞ্চন, তার খবর কে রাখে? শঙ্কুদেব চলেছেন প্রয়াগের উদ্দেশ্যে, একা; এই তীর্থযাত্রা তাঁর পশ্চাতাপ, না আত্মানুসন্ধান কে বলতে পারে?

*** ***

লেখকের টিকা:

সাঁচীর কনকেঢ়া শিলালিপি ও এরান বা এরাকন্যার একটি প্রস্তরলিপি থেকে রাজা শ্রীধরবর্মন ও তাঁর নাগবংশীয় সেনাপতি সত্যনাগের উল্লেখ পাওয়া যায়, সত্যনাগ মথুরার রাজা গণপতি নাগের শ্যালক ছিলেন। এরাকন্যায় সমুদ্রগুপ্তের নামাঙ্কিত একটি শিলালিপি ও বিজয়স্তম্ভ থেকে ধারণা করা যায় যে পরবর্তীকালে শ্রীধরবর্মন সমুদ্রগুপ্তের কাছে পরাজিত হয়ে বশ্যতা স্বীকার করেন। এই উপন্যাসিকায় যে সব ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ আছে অর্থাৎ মথুরার নাগবংশের উচ্ছেদ, এরাকন্যার দখল এবং পরে যুদ্ধে পরাজিত শ্রীধরবর্মনের কন্যার সাথে গুপ্ত রাজবংশের বৈবাহিক সম্পর্ক, পশ্চিমা ক্ষত্রপদের সাথে সমুদ্রগুপ্তের শীতল সম্পর্ক এগুলি সবই প্রমাণিত তথ্য। বাকি গল্প আমার কল্পনা প্রসূত, তবে কোথাও আমার কল্পনা যুক্তিকে লঙ্ঘণ করেনি।

দুরূহ শব্দের অর্থ:

কিংশুক – কৃষ্ণচূড়া, মন্দার – পলাশ, উপারিক – রাজ্যপাল, পাচক – রাঁধুনি, পরিবস্ত্র – পর্দা, মন্দুরা – নীচু ডিভান, গুরুরত্ন – পোখরাজ, মরকত – পান্না, নিধানিকা – তাক, উরুবেলা – বর্তমান বুদ্ধগয়া, শঙ্খবিষ – সেঁকোবিষ বা আর্সেনিক

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *