ধূমকেতু

ধূমকেতু

মুহূর্তে বনহুরের সুন্দর মুখে একটা বিব্রত ভাব ফুটে উঠে, বলে সে-মনিরা!

হাঁ, অমন চমকে উঠলে কেন?

মনিরা?

বলো এখানে কি করছিলে?

ঘরে চলো, সব তোমাকে বলবো।

না, আমি এখানেই জানতে চাই, তুমি একটা দাসীর দরজায় এভাবে কেন, গোপনে আঘাত করছিলে?

বনহুর এমনভাবে অপদস্থ হবে ভাবতে পারেনি, মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে সে অপরাধীর মত।

মনিরা স্বামীর জামার আস্তিন ধরে সজোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে–জবাব দাও, এখানে তোমার কি প্রয়োজন? এ ঘরে কি আছে–টাকা-পয়সা ধন-রত্ন যা তুমি হরণ করতে এসেছো? জবাব দাও? জবাব দাও, নইলে আমি চিৎকার করে সবাইকে ডাকবো। ধরিয়ে দেবো তোমাকে পুলিশের হাতে–

মনিরা শান্ত হও–চলো তোমার ঘরে, সব বলবো।

না, আমার ঘরে তোমাকে যেতে হবে না, চাই না আর তোমাকে।

 মনিরা!

 আমার নাম তুমি উচ্চারণ করো না, করো না বলছি।

 বনহুর মনিরার হাত দু’খানা মুঠায় চেপে ধরে আমাকে মাফ করো মনিরা।

 না, আমি তোমাকে কিছুতেই মাফ করবো না।

কি করবে আমাকে?

পুলিশের হাতে তোমাকে তুলে দেবো।

তাই দাও, তবু তুমি নূর আর আম্মার কাছে আমাকে অপদস্থ করো না। আমাকে—

কোনো কথা বলো না তুমি, কিছুই আমি শুনতেই চাই না।

মনিরা!

 একবার বলেছি ও নাম তুমি উচ্চারণ করো না।

 বেশ, আমি চলে যাচ্ছি।

হাঁ,তাই যাও। তোমাকে আমি আর চাই না, কারণ তোমার মত চরিত্রহীন—

মনিরা!

 তুমি এতো ঘৃণ্য, এত নীচ তুষি ছিঃ ছিঃ ছিঃ একটা দাসীর সঙ্গে তোমার প্রেম—

 মনিরা—

না, চুপ করো, চুপ করো তুমি। তুমি শুধু দস্যুই নও–তুমি লম্পট, তুমি মাতাল, তুমি ব্যভিচারী–

গম্ভীর কঠিন হয়ে উঠে এবার বনহুরের মুখমণ্ডল। দৃঢ় চাপা কণ্ঠে বলে মিথ্যা অপবাদ দিও না মনিরা।

 আমার কাছে গোপন করতে চাইলেও গোপন নেই কোনো কথা। বলো, এর আগে ফুলের কক্ষে রাত কাটিয়ে যাওনি?

বনহুর এতোক্ষণে সব বুঝতে পারে, ব্যাপারটা তাহলে মনিরার কানেও গিয়েছিলো। ভুল তারই হয়েছিলো সেদিন। এবার বনহুর হেসে উঠে–লোকের কথা শুনে তুমি আমাকে অবিশ্বাস করেছো? মনিরা, ফুল শুধু দাসী নয়–সে আমার একজন—

বনহুরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠে মনিরা–একজন বান্ধবী, তাই না?

মনিরা, অযথা তুমি আমাকে দোষারোপ করছে বা আমার উপর রাগান্বিত হচ্ছে।

বলো ফুলের সঙ্গে তোমার কি সম্বন্ধ?

কিছু না, আমার বিশিষ্ট অনুচরদের মধ্যে সেও একজন। তার কক্ষে আমার প্রয়োজন ছিলো, কারণ সে আমাকে অনেক ব্যাপারে সহায়তা করে থাকে।

 বনহুরের কথায় মনিরার মনে চিন্তার ছাপ পড়ে, অনেকটা নরম হয়ে আসে সে, বলে মনিরা– ফুল তোমাকে কি ব্যাপারে সহায়তা করে শুনি?

 আমাকে বিভিন্ন খোঁজ-খবর দিয়ে থাকে সে–ধরো তোমার কাছে আসার ব্যাপারেও সে আমাকে সহায়তা করে। আজও আমি তোমার ঘরে যাবো বলেই ওকে ডাকছিলাম, কারণ জানতে চাইছিলাম নূর তোমার ঘরে আছে, না মায়ের ঘরে?

সত্যি বলছো?

মৃদু হাসে বনহুর মিথ্যা কোনোদিন বলেছি তোমার কাছে?

 মনিরা অস্ফুট কণ্ঠে বলে না।

চলো মনিরা, ঘরে চলো।

চলো।

স্বামীসহ মনিরা নিজের ঘরে ফিরে আসে।

আজ কতদিন থেকে মনিরার চোখে ঘুম ছিলো না, সব সময় দগ্ধীভূত হচ্ছিলো সে অন্তরে অন্তরে। প্রতিদিন সে স্বামীর প্রতীক্ষায় প্রহর গুণতো। কখনও বা শুয়ে শুয়ে ভাবতো, কখনও বা মুক্ত জানালায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকতো জমাট অন্ধকারের দিকে। ব্যথা-বেদনায় গুমরে মরতো, অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতো সে।

অন্যান্য দিনের মত আজও মনিরা মুক্ত জানালায় উন্মুখ হৃদয় নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, অশ্ব পদশব্দ তার কানে পৌঁছেছিলো। এ শব্দ যে তার অতি পরিচিত।

 আশায়-আনন্দে বুকটা তার যেমন স্ফীত হয়ে উঠেছিলো, তেমনি রাগে-অভিমানে ভরে উঠেছিলো মনটা–যেমন করে হোক, আজ তার কাছে জেনে নেবে সেদিনের ব্যাপারখানা।

মুক্ত জানালায় দাঁড়িয়ে তাকিয়েছিলো অনেকক্ষণ কিন্তু কই সে তো এলো না—-তবে কি কোনো ভুল শব্দ তার কানে এসে পৌঁছেছে। হয়তো তাই হবে, নইলে এতোক্ষণ বিলম্ব করবে কেন?

এমন সময়ে হঠাৎ তার কানে গেলো নিচের তলায় ঠক্ ঠক্ শব্দ; অতি ধীরে মৃদু মৃদু শব্দ। মনিরার মনে সন্দেহের দোলা লাগলো। তবে কি তারই স্বামী আজ আবার ফুলের শূন্য কক্ষে আঘাত করছে। পা টিপে টিপে নিচে নেমে এলো মনিরা। সমস্ত চৌধুরী বাড়ি তখন ঘুমে অচেতন।

মনিরা নিচে নেমে এসে ফুলের দরজার দিকে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো, এ যে তার প্রতীক্ষিত জনতার স্বামী। ধীরে ধীরে লঘু পদক্ষেপে ওর পিছনে এসে দাঁড়ালো।

তখনও বনহুর ফুলের বদ্ধ দরজায় টোকা দিয়ে চলেছে।

 পিঠে হাত রাখলো মনিরা, রাগে-ক্ষোভে মনের মধ্যে তখন দাহ হচ্ছিলো তার।

বনহুর ফিরে তাকাতেই মনিরা দাঁত পিষে বলেছিলো–চমকে উঠলে কেন? কি করছিলে তুমি এখানে?

 বনহুর জবাব দিতে পারেনি, বলেছিলো–চলো ঘরে চলো, সব বলবো তোমাকে। হয়তো বা বলতো তখন সব কথা কিন্তু বনহুর সামলে নিলো অল্পক্ষণে, মনিরার কাছে সে গোপন করে নিলো নূরী সম্বন্ধে আসল কথাটা। বললো, ফুল তার অনুচরদেরই মত একজন, কাজেই তার কাছে নানা রকম সহায়তা সে পেয়ে থাকে।

 মনিরা সরল মনে বিশ্বাস করলো স্বামীর কথা। মনে যে সন্দেহের ছাপ পড়েছিলো, ধীরে ধীরে তা মুছে গেলো পরিস্কার হয়ে। ভাবলোতাইতো এমন কখনও হতে পারে না। এ তার মনের ভুল।

*

স্বামীর বুকে মাথা রেখে মনিরা শুয়েছিলো।

ধীরে ধীরে ওর চুলে হাত বুলাচ্ছিলো বনহুর।

নির্জন কক্ষে জাগ্রত দুটি প্রাণী।

বললো বনহুর–মনিরা, আমাকে একবার মাধবপুর যেতে হবে। হয়তো অনেকদিন তোমার সঙ্গে দেখা করবার সুযোগ হবে না।

মনিরা বললো–বাংলার অদূরে সেই মাধবপুর?

—হা মনিরা, বাংলাদেশের কাছাকাছি মাধবপুর। আমার পুরানো আস্তানার সন্নিকটে।

কিন্তু কেন সেখানে যাবে বলো তো?

সে কথা আজ নয়, আর একদিন বলবো।

 কবে বলবে বলো তো?

মাধবপুর থেকে ফিরে এসে।

 মনিরা?

বলো?

অনেকদিন হলো মায়ের সঙ্গে দেখা হয়নি। দেখা হয়নি নূরের সঙ্গে।

 তুমি যদি বলো তবে মামীমাকে ডেকে আনি? আর নূরকে?

না না, নূরের সাক্ষাতে আমি যাবো না, বরং যদি পারো আমাকে নিয়ে চলো–নূরকে একবার দেখবো, দেখবো আম্মাকে।

নিজের জননী আর নিজ সন্তানকে তুমি চোরের মত চুপি চুপি দেখতে চাও?

মনিরা, আমাকে আর লজ্জা দিওনা। তুমি তো জানো, আমি তাদের কাছে কত বড় অপরাধী? কোন্ মুখ নিয়ে আমি তাদের সম্মুখে আত্মপরিচয় দেবো বলো?

তাহলে কাজ নেই দেখে।

ভাবছি যদি ফিরে না আসি আর—

মনিরা স্বামীর মুখে হাত চাপা দেয়–সব সময় তুমি অমঙ্গল কথা বলো। ওসব বললে আমি তোমাকে কিছুতেই মাধবপুরে যেতে দেবো না।

লক্ষীটি বাধা দিও না আমাকে। বনহুর স্ত্রীকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে ফেললো।

মনিরা স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে বলে–যদি কথা দাও শীঘ্র ফিরে আসবে তাহলে তোমাকে ছেড়ে দেবো।

হাঁ, তাই আসবো। মনিরা আম্মা আর নূরকে একবার দেখতাম।

এসো! মনিরা স্বামীকে সঙ্গে করে মায়ের কক্ষের দিকে এগোয়।

 কক্ষের মাঝখানের দরজা মুক্তই ছিলো, সেইপথে কক্ষে প্রবেশ করে মনিরা, তার পেছনে বনহুর।

মনিরা অতি লঘু হস্তে মশারী তুলে ধরে, নিদ্রিতা জননীর মুখের দিকে নির্নিমেশ নয়নে তাকিয়ে থাকে বনহুর, পাশেই ঘুমিয়ে আছে নূর-সুন্দর ফুলের মত ছোট্ট একটা বালক।

বনহুর মায়ের পায়ের কাছে বসে পড়ে, মায়ের চরণে চুম্বন করে, তারপর বলে–চলো মনিরা।

মনিরা আর বনহুর বেরিয়ে আসে কক্ষ হতে।

বনহুর বলেনূরের চেহারাটা রোগা রোগা লাগলো যেন, ওর তো কোনো অসুখ করেনি?

না, অসুখ করেনি তবে ফুলের জন্য সব সময় কাদাকাটি করতো তাই

অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করে বনহুরফুলের জন্য–তার মানে? চলতে চলতে দাঁড়িয়ে পড়ে বনহুর, তীক্ষ্ণ নজরে তাকায় মনিরার মুখের দিকে।

মনিরাও দাঁড়িয়ে পড়েছিলো, গম্ভীর গলায় বললো–ফুলকে আমি তাড়িয়ে দিয়েছি বাড়ি থেকে।

অকস্মাৎ অস্ফুট শব্দ করে উঠে বনহুর-কি বললে?

ফুলকে আমি তাড়িয়ে দিয়েছি!

ভ্র কুঞ্চিত হয়ে আসে বনহুরের ফুলকে তুমি তাড়িয়ে দিয়েছো?

হাঁ।

এ তুমি কি বলছো মনিরা।

আমি ভুল করে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছি। আমার সন্দেহ হয়েছিলো সে দুষ্টচরিত্রা মেয়ে। আলীর মা আমাকে বলেছিলো, তুমি নাকি তার ঘরে—

মনিরা!

তাই তো আজও আমার সন্দেহ জেগেছিলো তোমার আচরণে। আমাকে তুমি মাফ করো।

এ তুমি কি করেছো মনিরা? কান্দাই শহরে সে কিছু চেনে না। কোথায় গেছে কে জানে! কতদিন আগে তাকে তুমি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছো?

প্রায় তিন সপ্তাহ হবে।

বলো কি? একটু থেমে বলে আবার বনহুর-একটা নিরীহ নিষ্পাপ মেয়েকে তুমি এভাবে তাড়িয়ে দিতে পারলে?

আমি নিজেকে কিছুতেই সংযত রাখতে পারিনি।

বনহুর কক্ষে প্রবেশ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লো, দক্ষিণ হস্তে নিজের মাথার চুলগুলো টানতে লাগলো জোরে জোরে। অধর দংশন করতে লাগলো আপন মনে।

 মনিরা বললো-একটা সাঁপুড়ে মেয়ের জন্য তুমি এতোখানি উতলা হবে ভাবতে পারিনি। গেলোই বা সে, তাতে ক্ষতি কি তোমার?

বনহুর কোনো জবাব দেয় না, উঠে দাঁড়ায় সে বলে–ফুল যদি ফিরে আসে আশ্রয় দিও মনিরা।

 মনিরা কিছু বলবার পূর্বেই বেরিয়ে যায় বনহুর। অল্পক্ষণ পরই মনিরা শুনতে পায় দ্রুত অশ্ব পদশব্দ খট খট খট—ক্রমান্বয়ে শব্দটা ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে আসে–মুক্ত জানালার পাশ। থেকে ফিরে আসে মনিরা।

*

আস্তানায় ফিরে তাজের পিঠে থেকে নেমেই বনহুর নিজ কক্ষে প্রবেশ করে। দু’জন অনুচর তাজকে ধরে নিয়ে যায় অশ্বশালার দিকে। আর দু’জন অনুচর বনহুরের সঙ্গে এগিয়ে চলে সূতীক্ষ্ণ অস্ত্র উদ্যত করে।

বনহুর অনুচরদ্বয়কে লক্ষ্য করে বলে-রহমানকে আমার বিশ্রামাগারে পাঠিয়ে দাও।

 অনুচরদ্বয় চলে যায় নতমস্তকে কুর্ণিশ জানিয়ে।

বনহুর এগিয়ে চলে।

আস্তানায় প্রবেশ করার পরও তিনটি কঠিন গেট পেরিয়ে তবেই বনহুরের বিশ্রামাগার। প্রথম গেটের সম্মুখে আসতেই গেটটা দু’পাশে ফাঁক হয়ে গেলো, ঠিক যেন সূতীক্ষ্ণ কাঁটাখচিত দুটি দেয়াল সরে গেলো দু’পাশে।

বনহুর প্রবেশ করতেই পুনরায় বন্ধ হয়ে গেলো গেটটা

দ্বিতীয় গেট কুমীরের হা-এর মত। বনহুর এগুতেই কুমীরের মুখ-গহ্বর দুদিকে ফাঁক হলে গেলো, ভিতরে প্রবেশ করলো বনহুর। তৃতীয় গেটের সম্মুখে দু’জন উদ্যত রাইফেলধারী নিগ্রো পাহারা দিচ্ছে। সেকি ভীষণ চেহারা নিগ্রো অনুচরদ্বয়ের যেন এক একটা যমদূত! বনহুর এগুতেই নত মস্তকে সসম্মানে সরে দাঁড়ালো।

বনহুর গেট পেরিয়ে নিজের বিশ্রামাগারে প্রবেশ করলো। এ কক্ষ এককালে দস্যু কালু খার বিশ্রামকক্ষ ছিলো। এ কক্ষেই একদিন কালু খ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলো। সেদিন বনহুর নিজের পরিচয় লাভ করেছিলো–সে কালু খাঁর সন্তান নয়—কালু খাঁ তার হস্তে একটি লকেটযুক্ত মালা দিয়ে বলেছিলো, এর মধ্যেই পাবে তুমি তোমার পরিচয়।

 কালু খাঁর মৃত্যু ঘটেছিলো, বনহুর কেঁদেছিলো ভীষণভাবে। জীবনে বুঝি এমন করে সে কোনো দিন কাঁদেনি।

সেদিন একটি কোমল হাত তার মাথায় এসে পড়েছিলো।

 চমকে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখেছিলো সে ঐ নূরীকে।

বলেছিলো নূরী–কেঁদো না হুর, বাপু চলে গেছে, আমি তো আছি তোমার পাশে—

 বনহুর শয্যায় বসে পড়ে, চোখের সামনে ভেসে উঠে গত জীবনের প্রতিচ্ছবিগুলো।

রহমান প্রবেশ করে দাঁড়ায় একপাশে সর্দার!

মুখ তোলে বনহুর।

রহমান বনহুরের মুখচোখের ভাব দেখে বুঝতে পারে, নিশ্চয়ই কোনো ঘটনা ঘটে গেছে, যার জন্য তাদের সর্দার বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছে।

বনহুর বললো– রহমান, নূরী মনিরার কাছেই চৌধুরী বাড়িতে ছিলো–এ কথা তুমি জানো?

জানি সর্দার।

মনিরা কোনো কারণবশতঃ তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। জানি না সে এখন কোথায়। রহমান, কান্দাই শহরে সে সম্পূর্ণ অপরিচিত। তাকে সন্ধান করে খুঁজে বের করবার জন্য। কয়েকজনকে পাঠিয়ে দাও।

সর্দার, অন্যান্যের সঙ্গে আমি নিজেও যাবো তার সন্ধানে।

যা ভাল বুঝ করো। আজ প্রায় তিন সপ্তাহ পূর্বে সে চৌধুরী বাড়ি ত্যাগ করেছে।

 তাহলে কোথায় গেলো সে? কান্দাই শহরের পথঘাট তো তার চেনা নেই।

হাঁ, সে কারণে আমি অত্যন্ত চিন্তিত আছি। রহমান, বিলম্ব করো না, এক্ষুণি তোমরা নূরীর সন্ধানে বেরিয়ে পড়ো। যতদিন নূরীকে খুঁজে না পাওয়া যাবে ততদিন আমি মাধবপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে পারছি না।

আচ্ছা সর্দার, আপনার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ হবে।

রহমান বেরিয়ে গেলো।

 বনহুর পায়চারি শুরু করলো কক্ষমধ্যে। নূরীর চিন্তা তাকে বেশ ভাবিয়ে তুললো। না জানি এখন সে কোথায় কেমন অবস্থায় আছে। যেমন করে হোক তাকে খুঁজে বের করতেই হবে।

বনহুর একজন ফেরিওয়ালার বেশে সজ্জিত হয়ে নিলো। গোপনে সে আস্তানা ত্যাগ করে রওয়ানা দিলো কান্দাই শহর অভিমুখে।

 শহরে পৌঁছে টাকা দিয়ে নানারকম খেলনা কিনে নিলো, তারপর অলিগলি, পথে পথে ফেরী করে বিক্রি করতে লাগলো–চাই খেলনা চাই–চুড়ি, ফিতা মাথার কাটা সব আছে–চাই খেলনা চাই-পুতুল, গাড়ি, চুড়ি, কাচি যা নেবেন সব পাবেন, চাই খেলনা চাই

আপন মনে খেলনার ঝুড়িটি নিয়ে এগুচ্ছে বনহুর নজর তার পথের চারদিকে। ছেলেমেয়ে সবাই ভিড় করে কিনছে, যে যা চায় তাই দিচ্ছে বনহুর নিজ হাতে। পয়সা যে দিচ্ছে নিচ্ছে, দেবার কথা যে ভুলে যাচ্ছে তার কাছে পয়সা চায় না সে, শুধু আপন মনে বলে চলেছে–চাই খেলনা চাই–চুড়ি, ফিতা, মাথার কাটা যা নেবেন সৰ পাবেন। চাই খেলনা চাই—

সারাদিন পথে পথে ঘুরে হয়রান-পেরেশান হলো বনহুর, পা ব্যথা হলো, শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছে দর দর করে, সুন্দর মুখমণ্ডল রক্তাভ হয়ে উঠেছে।

হতাশ হয়ে একটা গাছের নিচে বসে পড়লো বনহুর। অদূরে কতগুলো ছেলেমেয়ে খেলা করছে স্কুল টিফিন হয়েছে তাই আপন মনে ছুটোছুটি করছে ওরা মাঠের মধ্যে।

হঠাৎ ওদিকে নজর পড়তেই চমকে উঠলো বনহুর–একটা মোটরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ফুলমিয়া গাড়িতে হেলান দিয়ে, অদূরে ছেলেমেয়েদের খেলা দেখে হাসছে।

এমন সময় একটা ছেলে ছুটে আসে বনহুরের পাশে, এই, বল আছে তোমার কাছে?

চমকে উঠে বনহুর–এ যে তারই সন্তান নূর।

 অবাক হয়ে তাকায় বনহুর নিজ সন্তানের মুখের দিকে। আনন্দে স্ফীত হয়ে উঠে তার মুখ, নিজেকে সংযত রাখতে পারে না, অন্যান্য ছেলের মধ্য হতে ওকে কোলে তুলে নেয়, গালে একটা চুমু দিয়ে বলে–খোকা বল নেবে?

 নূর অস্বস্তি বোধ করে, ফেরিওয়ালার আচরণ তার খারাপ লাগে। হঠাৎ ফেরিওয়ালা তাকে। কোলে তুলে নিলো কেন? বলে সে আমাকে নামিয়ে দাও।

বলো কি নেবে তুমি?

দূর থেকে ফুলমিয়া লক্ষ্য করছিলো, এগিয়ে আসে দ্রুত সে, বনহুরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে রাগতকণ্ঠে বলে ওকে কোলে করেছে কোন্ সাহসে?

বনহুর নিজের মুখের দাড়িতে ভালভাবে হাত বুলিয়ে বলে–কেন, দোষ কি বাবু?

তোমার সাহস তো মন্দ নয় ফেরিওয়ালা?

কেন বাবু, আমরা কি মানুষ না?

মানুষ তো সবাই, তা বলে তুমি একজন ভদ্রলোকের ছেলেকে কোলে নেবে? ঠাই করে একটা চড় বসিয়ে দেয় ফুলমিয়া ফেরিওয়ালার গালে।

নূরকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে হাসে ফেরিওয়ালা, তারপর বলে–যাও মাফ করে দিলাম। খোকা, কোন্ বলটা নেবে বলোতো?

নূর অবাক হয়ে গেছে–ফুলমিয়ার চড় খেয়েও ফেরিওয়ালার রাগ হলো না বরং তাকে বল নেবার জন্য অনুরোধ করছে। তার সম্মুখে ফেরিওয়ালার প্রসারিত হাত দু’টিতে কয়েকটা বল।

বললো আবার ফেরিওয়ালা–কোন্‌টা তোমার পছন্দ খোকা?

 নূর আস্তে একটা বল তুলে নিলো হাতে।

 হেসে বললো ফেরিওয়ালা–সাবাস!

ফুলমিয়া পকেট থেকে রুমাল বের করে রুমালের খুট থেকে পয়সা বের করতে করতে বললো–কত দিতে হবে বলের দাম?

ফেরিওয়ালা ফুলমিয়ার কথার কোনো জবাব না দিয়ে ঝুড়িটি কাঁধে তুলে নিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে।

অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ফুলমিয়া ফেরিওয়ালার চলে যাওয়া পথের দিকে।

নূর বল পেয়ে তো অনেক খুশি। বাড়ি এসে নূর মাকে বললো–মাম্মি, দেখো কি সুন্দর বল!

মনিরা সন্তানকে কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে বলে–এ বল তুমি কোথায় পেলে বাবা?

 মাম্মি, এ বল আমাকে একটা ফেরিওয়ালা দিয়েছে।

 দাম দিয়েছো?

ফুলমিয়া দিতে চাইলে সে নেয়নি। জানো মাম্মি, ফেরিওয়ালা আমাকে দেখেই আদর করে কোলে তুলে নিয়েছিলো, চুমু দিয়ে বলেছিলো, খোকা বল নেবে? অমনি ফুলমিয়া দৌড়ে গিয়ে খুব করে বকে দিয়েছিলো, ঠাই করে চড় বসিয়ে দিয়েছিলো একটা তার গালে।.

কি বললে, ফুলমিয়া ফেরিওয়ালাকে চড় মেরেছিলো?

হাঁ খুব কষে মেরেছিলো–জানো মাম্মি, তবু ফেরিওয়ালা একটু কিছু বললো না, বরং হেসে বললো–যাও মা করে দিলাম। আর আমাকে এ বলটা দিলো সে–পয়সা নেয়নি।

মনিরা অবাক হয়, তক্ষুণি ফুলমিয়াকে ডেকে জিজ্ঞেস করে।

 ফুলমিয়া স্বীকার করে হাঁ আপামণি, নূর মনি যা বলেছেন সত্যি কথা–লোকটা আশ্চর্য– আমার কঠিন হাতের চড় খেয়েও সে এতোটুকু ভড়কে গেলো না, হাসতে লাগলো যেন কিছু হয়নি।

মনিরা বললো–চড় দেওয়া তোমার অন্যায় হয়েছে ফুলমিয়া, কারণ সে যে তোমাকে পাল্টা জবাব দেয়নি তাই ভাগ্য। বরং সে বলটার মূল্য না নিয়ে মহৎ হৃদয়ের পরিচয় দিয়েছে।

ফুলমিয়া নিজের ভুলের জন্য অনুতাপ বোধ করতে লাগলো, একপাশে দাঁড়িয়ে রইলো নত মস্তকে।

বললো মনিরা–এরপর দেখা হলে ক্ষমা চেয়ে নিও ফেরিওয়ালার কাছে।

আচ্ছা আপামণি।

কথাটা বলে বেরিয়ে গেলো ফুলমিয়া।

মনিরা ভাবতে লাগলো, কে সে ফেরিওয়ালা যার এমন অদ্ভুত আচরণ!

ওদিকে বনহুর ফেরিওয়ালারবেশে এগিয়ে যাচ্ছে রাজপথ ধরে–চাই খেলনা চাই, চুড়ি ফিতা মাথার কাঁটা চাই—

*

রওশান রিজভীর প্রচেষ্টায় নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে একদিন জেল থেকে ছাড়া পেলো নূরী।

যখন নূরীকে মুক্তি দেওয়া হলো তখন নুরী অসহায়ার মত পথে এসে দাঁড়ালো, কোথায় যাবে সে। অসংখ্য জনতার ভিড়ে সে যেন সম্পূর্ণ একা।

নূরী যখন দুশ্চিন্তায় অস্থির তখন রওশান রিজভী এসে দাঁড়ালেন তার পাশে কোথায় যাবে?

ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বললো নূরী–জানি না।

অবাক হয়ে বললেন রওশান রিজভী–সে কি, কোথায় যাবে জানো না?

শহরে তো আমার কোনো আত্মীয় নেই।

একটু চিন্তা করে বললেন রওশান রিজভী–তোমার যদি আপত্তি না থাকে তবে আমার বাসায় যেতে পারো?

অবিশ্বাস-ভরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকালো নূরী রওশান রিজভীর মুখের দিকে।

বুঝতে পারলেন রওশান রিজভী, মনে পড়লো তার নূরীর কেসের ঘটনাটা–বিশ্বাস করে সে গিয়েছিলো এক দ্ৰসন্তানের সঙ্গে কিন্তু তার পরিণাম কি ঘটেছিলো যার জন্য নূরী বাধ্য হয়েছিলো তাকে নির্মমভাবে হত্যা করতে। নূরী তাকেও অবিশ্বাস করছে। এটা স্বাভাবিক তার মন মানুষের প্রতি বিষিয়ে উঠেছে ঘৃণায়। রওশান রিজভী বললেন–তুমি যে ভয় বা আশঙ্কা করছে তা সম্পূর্ণ ভুল, আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে পারো নূরী।

 নূরী পুলিশ বিভাগের নিকটে নিজের নাম নূরী বলেই প্রকাশ করেছিলো। নাম গোপন করবার কোনোই দরকার বোধ করেনি সে। নূরী জানতে পেরেছিলো এ লোকটার জন্যই সে আজ ফাসীর মঞ্চ থেকে ফিরে এলো। রওশান রিজভীর প্রচেস্টায় সে নবজীবন লাভে সক্ষম হয়েছে তাতে কোনো ভুল নেই।

 রওশান রিজভীর সুন্দর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছিলো নূরী–আজ তাই সে ফেলতে পারলো না তার কথাটা, রিজভীর গাড়িতে চেপে বসলো।

রওশান রিজভী তরুণ পুলিশ ইন্সপেক্টর, অবিবাহিত ভদ্র লোক। বাসায় তার একমাত্র মা আর দু’টি ঝি-চাকর ছাড়া আর কেউ নেই। কাজেই কোনো অসুবিধা হলো না তার নূরীকে নিয়ে।

 বাসায় এসে মাকে ডেকে বললেন রওশান রিজভী –মা, এ মেয়েটি বড় অসহায়, একে তোমার স্নেহ দিয়ে গ্রহণ করো।

রওশান রিজভীর জননী প্রবীণা ভদ্রমহিলা-দয়ামায়ায় মন তার পরিপূর্ণ। নূরীর সৌন্দর্য আর নম্রতা তাকে আকৃষ্ট করলো। তিনি নূরীকে সাদরে গ্রহণ করলেন–এই নির্জন অন্দর মহলে কন্যাসম একজন সঙ্গী পেয়ে বরং খুশিই হলেন তিনি।

 মোহসিনা বেগমের স্নেহ-মাখা কথায় নূরীর মনে শান্তি এলো, একটা দুশ্চিন্তা ছিলো তার অন্তরে সেটা দূর হলো–যাক তবু একটা আশ্রয় হলো তার। এখন সে এ আশ্রয়ে থেকে অন্বেষণ করবে তার হুরকে। নিশ্চয়ই সে যখন জানতে পারবে নূরী চলে গেছে তখন খোঁজ করবে বনহুর তার।

একটা উদ্যম বাসনা নিয়ে নূরী রওশান রিজভীর বাড়িতে স্থান লাভ করলো।

নূরী চিরদিনই চঞ্চলা, মনিরা যেমন গম্ভীর শান্ত প্রকৃতির মেয়ে, নূরী ঠিক তার বিপরীত। শত দুশ্চিন্তা মনে দানা বেঁধে থাকলেও সে চুপচাপ থাকতে পারতো না। মোহসিনা বেগম যে কাজ করতে যেতেন, নূরী তার হাতের কাজ কেড়ে নিয়ে করতো। অবশ্য সব কাজ সে পারতো না, কারণ সে তো কোনোদিন সংসার করেনি, তবে যেটুকু শিখেছিলো তা মনিরাদের ওখানে। সেখানে সব কাজ তাকে করতেও হতো না, নানারকম চাকর-বাকর ছিলো তারাই সব করতো, নূরী থাকতো নূরকে নিয়ে। নূরের সঙ্গে খেলাধুলো করে কেটে যেতো সময়গুলো তার।

একদিন মোহসিনা বেগম পুত্রের জন্য চা-নাস্তা নিয়ে ঘরে যাচ্ছিলেন, নূরী মাঝপথে ধরে ফেলে–আম্মা, আমাকে দিন, আমি সাহেবের ঘরে পৌঁছে দিচ্ছি।

মোহসিনা বেগম খুশি হয়ে বললেন–যাও নিয়ে যাও মা, দিয়ে এসো।

রওশান রিজভী ভোরের মিষ্টি রোদে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দৈনিক পত্রিকাখানা পড়ছিলেন। পাশের জানালাটি দিয়ে সূর্যের রশ্মি এসে পড়ছিলো তার দেহের উপর।

নূরী খাবারের ট্রে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করতেই হঠাৎ মেঝের কার্পেটে পা লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে খাবারের ট্রেটা ছিটকে পড়ে কাঁচের জিনিসগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।

 রওশান রিজভী চমকে ফিরে তাকান, নূরীকে পড়ে যেতে দেখে দ্রুত পেপারটাকে ছুঁড়ে দিয়ে উঠে আসেন নূরীর পাশে, তাড়াতাড়ি তুলে দাঁড় করিয়ে দেন তাকে–আহা চোট লেগেছে বুঝি?

নূরীর হাতখানা রওশান রিজভীর হাতের মধ্যে।

নূরীর হাত কেটে গিয়েছে কাঁচের ভাঙা টুকরো লেগে, রক্তে রাঙা হয়ে গেছে রওশান রিজভীর হাতখানাও।

ততক্ষণে ছুটে আসেন মোহসিনা বেগম, নূরীর রক্তমাখা হাতখানার দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলেন –কি সর্বনাশ–কেটে গেছে।

রওশান রিজভী নূরীর হাতখানার ক্ষতস্থান চেপে ধরে শীঘ্র ঔষধ আনার জন্য নির্দেশ দিলেন।

একটা বয় ঔষধ নিয়ে এলে রওশান রিজভী নিজ হস্তে নূরীর হাতে পট্টি বেঁধে দিলেন।

কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলো নূরীর মন–তাকে কোনোরকম ভৎর্সনা না করে বরং এতো আদর যত্ন তাকে আরও অভিভূত করে ফেললো। কিন্তু সেদিনের পর থেকে রওশান রিজভীর মনে নূরী অন্য এক রূপ নিয়ে আভির্ভূত হলো। শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলেন, সত্যি নূরী অপূর্ব এক তরুণী। এমন রূপসী মেয়ে তিনি এর পূর্বে আর দেখেছেন কিনা সন্দেহ।

নূরী যখন মায়ের সঙ্গে বসে গল্প করতো তখন রওশান রিজভী অনতিদূরে এসে বসতেন, যোগ দিতেন তাদের গল্পের সঙ্গে। কখনও বা নূরীকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে বের হতেন, নূরী সরল মনে যেতো তার সঙ্গে। কোনো কোনোদিন লেকের ধারে এসে বসতেন রওশান রিজভী আর নূরী। নূরী এসব কোনোদিন দেখেনি–তন্ময় হয়ে দেখতো। লেকে নৌকাযোগে কোনো কোনো তরুণ তরুণী বিচরণ করে ফিরছে, কোথাও বা পানির ধারে বসে হাত দিয়ে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে তরুণের দেহে। কোথাও বা বয়স্ক ভদ্রলোক তার গিন্নীর সঙ্গে বসে গল্প করছেন–অদূরে খেলা করছে। তাদের বাচ্চা-কাচ্চার দল।

 নূরী এসব দেখতো আর ভাবতো নূরের কথা, ভাবতো মনিরা আর মরিয়ম বেগমের কথা। মনে পড়তো ফুলমিয়ার কথা, আসবার সময় তাকে একটি বার বলে আসার সুযোগটাও সে পায়নি।

রওশান রিজভী জিজ্ঞাসা করতেন–কি ভাবছো নুরী?

নূরী জবাব দিতো–কিছু না। চলুন বাসায় যাই বাবুজি?

উঠে পড়তেন রওশান রিজভী, বলতেন চলো।

ড্রাইভ আসনের পাশেই বসতো নুরী।

 রওশান রিজভী ড্রাইভ করতেন আপন মনে। নূরী সম্বন্ধে তাঁর মনে ভাবের উদ্বেগ হলেও তিনি কোনো সময় মুখে কিছু প্রকাশ করতেন না। হাজার হলেও তিনি শিক্ষিত জ্ঞানী বুদ্ধিমান ব্যক্তি, নিজেকে সংযত করে রাখতেন।

 বিশেষ করে নূরীর সরলতায় রওশান রিজভী কোনো মতেই হস্তক্ষেপ করতে চান না।

একদিন রওশান রিজভী অফিস থেকে ফিরলে নূরী তার শরীর থেকে জামা খুলে নিচ্ছিলো– এ কাজ নূরী নিজেই গ্রহণ করেছিলো তার মায়ের কাছ থেকে।

রওশান রিজভী যখন অফিস থেকে কর্মক্লান্ত ঘর্মাক্ত দেহ নিয়ে ফিরে আসতেন তখন জননী মোহসিনা বেগম নিজ হস্তে সন্তানের দেহের জামা কাপড় খুলে নিতে সহায়তা করতেন। এমনকি একমাত্র সন্তান রওশানের চুলটাও তিনি নিজে আঁচড়ে দিতেন।

অবশ্য মায়ের এ সবে আপত্তি করতেন রওশান রিজভী। কিন্তু মা মোহসিনা ছিলেন অত্যন্ত জেদী মেয়ে-সন্তানকে তিনি কিছুতেই এসব থেকে রেহাই দিতেন না। আসল কথা পুত্রকে তিনি অত্যন্ত বেশি স্নেহ করতেন।

বৃদ্ধা জননীর পরিশ্রম কমানোর জন্যই নূরী বেছে নিয়েছিলো তার কাজগুলো, তাই সে নিজ হস্তে রওশান রিজভীর সেবা-যত্ন করতো। তাছাড়াও নূরী জানে, এ লোকটার জন্যই আজ তার মুক্তি হয়েছে। না হলে তাকে হয়তো নরহত্যার দায়ে ফাসীকাষ্ঠে ঝুলতে হতো।

অন্যান্য দিনের মত রওশান রিজভী বাইরে থেকে ফিরে ড্রেস পরিবর্তন করছিলেন।

নূরী এসে দাঁড়ালো, রওশান রিজভীর গা থেকে কোটটা খুলে নিয়ে আলনায় রাখলো, তার জামার বোতামগুলো খুলে দিচ্ছিলো আপন মনে।

রওশান রিজভী বললেন–নূরী, আমার জন্য তুমি যথেষ্ট পরিশ্রম করো–কিন্তু এতো কেন করো বলো তো?

ফিক করে হেসে বললো নূরী–আপনি আমার জন্য কত করেছেন আর আমি আপনার জন্য এটুকু পারবো না বাবুজি? আম্মা বুড়ো মানুষ, তিনি খেয়ে একটু ঘুমিয়েছেন—

রওশান রিজভী হেসে বললেন–আর তুমি জেগে আছো আমার জন্য, সত্যি নূরী তোমাকে যত দেখি ততই আমি মুগ্ধ হয়ে যাই।

কেন বাবুজি?

তুমি কি কিছুই বুঝ না?

না। আসুন বাবুজি, চুলটা আঁচড়ে দি। নূরী চিরুণী দিয়ে রওশান রিজভীর চুল আঁচড়ে দেয়।

 অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকেন রওশান রিজভী নূরীর সুন্দর মুখমণ্ডলের দিকে।

চুল আঁচড়ে হেসে বললো নূরী–কি দেখছেন অমন করে বাবুজি?

 তোমাকে–নূরী, তুমি এতো সুন্দর!

নূরী ফিক করে হেসে বেরিয়ে যায় কক্ষ থেকে।

*

রওশান রিজভী দিন দিন বেশি করে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছেন নূরীর দিকে। কর্মব্যস্ততার মধ্যেই তিনি গড়ে উঠেছেন ছোটবেলা হতে। লেখাপড়ায় রওশান রিজভী ছিলেন অত্যন্ত ভাল, তাছাড়াও খেলাধুলায় তিনি ফাষ্টবয় ছিলেন। লেখাপড়া আর খেলাধুলো শেষ হতে না হতেই চাকরীর বোঝা এসে পড়েছে তার মাথায়। জীবন তার কর্মমুখর, ফুরসৎ নেই কোনো মুহূর্তে। এসব কারণেই রওশান রিজভী কোনো নারীর সঙ্গে মিশবার সুযোগ পায়নি তেমন করে। নারী সংশ্রব তাকে করেনি তাই আকৃষ্ট। নূরীকে তিনি দেখলেন নতুন এক দৃষ্টি নিয়ে, ভালবেসে ফেললেন তিনি সমস্ত অন্তর দিয়ে ওকে।

রওশান রিজভী জানেন না, নূরীর জীবনে আছে আর একজন–যার জন্য নূরী অহঃরহ প্রতীক্ষা করছে, যার চিন্তায় সে সদাসর্বদা মগ্ন। মনের গোপন বেদনাকে চাপা দিয়ে নূরী সবসময় হাসিমুখে কাটায়। জানায় না সে তার প্রিয়জনের পরিচয়–জানাবার উপায়ই বা কোথায়? সে তো আর অন্যান্যের মত স্বাভাবিক জন নয়।

তবু মাঝে মাঝে নূরী আনমনা হয়ে যায়–এই কি তার জীবনের শেষ পরিণতি! কোনোদিনই কি আর দেখা পাবে না তার হুরের? না জানি সে এখন কোথায় কি করছে। নিশ্চয়ই সে এতোদিন জানতে পেরেছে, চৌধুরী বাড়ি থেকে সে চলে গেছে। হয়তো বা সন্ধান করে ফিরছে, না কি করছে কে জানে।

একদিন শরীর অসুস্থ বোধ করায় রওশান রিজভী নিজের ঘরে শুয়েছিলেন, পাশের ঘরে মা নামায পড়ছেন।

 নির্জন দুপুর।

মাথার যন্ত্রণায় উঃ আঃ শব্দ করছিলেন রওশান রিজভী।

নামায শেষে মোহসিনা বেগম বললেন–মা নূরী, যাও না বাছা রওশান যন্ত্রণায় ছটফট করছে, একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে।

 নূরী, কোনোদিন কারো অবাধ্য হয়নি, আজও সে পারলো না মোহসিনা বেগমের কথা অমান্য করতে। বললো–আচ্ছা যাচ্ছি আম্মা।

নূরী রওশান-জননীকে আম্মা বলে ডাকতো। তিনিও ওকে নিজ কন্যার মতই স্নেহ করতেন।

মোহসিনা বেগমের কথায় নূরী রওশান রিজভীর কক্ষে প্রবেশ করলো। অতি লঘু পদক্ষেপে এসে দাঁড়ালো রওশান রিজভীর শিয়রে।

রওশান রিজভী তখন চোখ বন্ধ করে নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছিলেন।

নূরী তার কোমল হাতখানা রাখলো রওশান রিজভীর মাথায়।

ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন রওশান রিজভী-নূরী তুমি?

হাঁ বাবুজি?

আবার চোখ বন্ধ করলেন রওশান রিজভী।

নূরী শিয়রে বসে আস্তে আস্তে তার মাথায় হাত বুলিয়ে চললো।

 এক সময় বললেন রওশান রিজভী-নূরী, তোমার কষ্ট হচ্ছে?

না তো।

 কতক্ষণ হলো বসে আছো।

কিছু হচ্ছে না আমার। আপনি ঘুমান একটু, মাথাটা ছেড়ে যাবে বাবুজি।

নূরী?

বলুন?

নূরী, তোমার বাড়ি কোথায় জিজ্ঞাসা করায় তুমি কিছু বলেনি। তোমার কে আছে জিজ্ঞাসা করায় কোনো জবাব দাওনি। চিরদিন কি তোমার এমনি করে কাটবে? নূরী, আজ তুমি নীরব থেকো না–জবাব দাও, চিরদিন তুমি এমনি পাষাণ প্রতিমার মত নীরবে–

 এতোক্ষণে মুখ খুললো নূরী–আমি তো বলেছি এ শহরে আমার কেউ নেই। এ শহরের কাউকে আমি চিনি না বাবুজি।

 কোথায় তুমি থাকতে, কোথায় তোমার জন্ম বলো? যদি পারি তোমাকে পৌঁছে দিতে চেষ্টা করবো।

নূরী পূর্বের ন্যায় স্থির কণ্ঠে বললো–আপনি আমার জীবন রক্ষা করেছেন, আপনার কাছে আমি কিছুই লুকাব না।

তবে বলো।

গভীর জঙ্গলে আমার জন্ম, জঙ্গলেই আমি বড় হয়েছি। বাবা-মা এদের দেখিনি, জ্ঞান হবার পূর্বেই হারিয়েছি বাবা মাকে। আমি বড় হতভাগিনী বাবুজি, আমি বড় হত ভাগিনী–

নূরী, আমার মায়ের কাছে তুমি তোমার হারানো মায়ের স্নেহ পাবে।

হাঁ, তার চেয়েও আমি বেশি পেয়েছি। সত্যি, আম্মা আমাকে বড়ই আদর করেন। নিজের মেয়ের মত ভালবাসেন তিনি আমাকে। বাবুজি, আপনার মায়ের মত মা আর হয় না।

নূরী, চিরদিন কি তুমি আমার মায়ের স্নেহ পেলে সন্তুষ্ট হও না?

সে তো আমার সৌভাগ্য বাবুজি।

তবে কেন তুমি অমন করে আমার কাছ থেকে দূরে সরে থাকো? নূরী—রওশান রিজভী নূরীর হাতখানা দক্ষিণ হস্তের মুঠায় চেপে ধরেন–জবাব দাও নূরী?

 নূরী গোপন করে এসেছে তার হুরের কথা, কারণ তার হুর দস্যু আর রওশান রিজভী পুলিশ ইন্সপেক্টর কোনো ক্রমেই উচিত হবে না তার কথা ব্যক্ত করা। আজও নূরী অতি কষ্টে গোপন করে নেয়, নিজেকে সংযত রেখে বলে–বাবুজি, আমি এক অজ্ঞাত জংলী মেয়ে, আর আপনি ভদ্র সমাজের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি?

হলোই বা, তাতে ক্ষতি কি বলো নূরী? তুমি মানুষ, আমি মানুষ–এই তো পরিচয়! নূরী, এসো আমরা দুজন দুজনাকে গ্রহণ করি?

বাবুজি, আমি নাচার।

 নূরী, আমাকে বাঁচাও নূরী।

বাবুজি!

রওশান রিজভী নূরীকে ধরতে যান কিন্তু পর মুহূর্তে তিনি নিজেই হাতখানা সরিয়ে নেন না, তোমার অমতে আমি তোমাকে স্পর্শ করবো না।

বাবুজি, আপনি ভুল করবেন না বাবুজি।

 নূরী, তোমাকে না পেলে আমি মরে যাবো।

 সেকি? এ আপনি কি বলছেন?

তোমাকে জোর করে কোনোদিনই গ্রহণ করবে না, কারণ আমি অমানুষ নই। তাছাড়া শক্তি দ্বারা কেউ কোনোদিন ভালবাসা আদায় করতে পারে না। নূরী, তোমার পক্ষ থেকে সাড়া না পেলে আমি চিরদিনই নীরব থাকবো।

 বাবুজি আপনি মহৎ জন, এমন কথা আমি কারো মুখে কোনোদিন শুনিনি। আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি।

শ্রদ্ধা করো কিন্তু ভালবাসো না? বলো, বলো নূরী?

অস্ফুট কণ্ঠে বললো নূরী–বাসি।

 নুরী, ইস কি আনন্দ হচ্ছে আমার! তুমি আমাকে ভালবাসো স্নেহ করো, যত্ন করো—

হাঁ, ও তোকে খুব ভালবাসেরে রওশান। তোর জন্য ওর কত চিন্তা। কথাগুলো বলতে বলতে ঘরে এসে দাঁড়ালেন মোহসিনা বেগম।

নূরীর হাত ছেড়ে দিয়ে রওশান রিজভী চোখ বন্ধ করলেন।

 নূরী তার মাথার চুলে আংগুল চালাতে লাগলো।

মোহসিনা বেগম এসে পুত্রের ললাটে হাত রাখলেন –মাথাটা এখন বেশ ঠাণ্ডাই মনে হচ্ছে। বাবা, তুমি এবার ঘুমাও। মা নূরী, যাও একটু বিশ্রাম করাগে, আমি বসছি।

মোহসিনা বেগম পুত্রের শিয়রে বসলেন, নূরী চলে গেলো নিজের ঘরে।

 কিন্তু এরপর থেকে রওশান রিজভী নূরীর জন্য সব সময় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কেমন করে নূরীকে লাভ করবেন–এই তার চিন্তা। রওশান রিজভী ছিলেন সংযমশীল পুরুষ, তাই তিনি কোনো সময় অসংযত কিছু করতেন না।

কয়েকদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠলেন রওশান রিজভী, পুনরায় তিনি অফিসে যাওয়া-আসা করতে লাগলেন।

একদিন বিকেলে রওশান রিজভী নূরীকে বললেন–চলো বেড়িয়ে আসি।

 নূরী কোনো আপত্তি করলো না, বরং সে খুশি হয়ে বললো–চলুন বাবুজি।

রওশান রিজভী স্যুট-প্যান্ট পরে নিলেন।

নূরীও আজ সুন্দর একখানা শাড়ি পরে সজ্জিত হয়ে নিলো। এ শাড়িখানা তাকে রওশান-জননী ক্রয় করে এনে দিয়েছিলেন। গাঢ় আকাশী রঙ-এর শাড়ি খানা নূরীর গোলাপী দেহটা অপূর্ব মননামুগ্ধকর করে তুলেছিলো।

চঞ্চল হরিণীর মত কক্ষে প্রবেশ করে নূরী-বাবুজি, দেখুন কেমন লাগছে?

অপূর্ব।

 চলুন।

 চলা নূরী।

 রওশান রিজভী গাড়ির ড্রাইভিং আসনে বসে পড়তেই নুরী উঠে বসলো তার পাশে। গাড়িতে বসলে নূরীর আনন্দ আর ধরতো না, উচ্ছল কণ্ঠে হেসে লুটোপুটি খেতো সে। আজও খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠলো সে।

সমস্ত বিকেলটা লেকের ধারে, পার্কে ফিরে সন্ধ্যার পূর্বে ফিরে চললেন রওশান রিজভী আর নূরী।

 নূরীর মুখে উচ্ছ্বসিত হাসির আভাস। ফুরফুরে বাতাসে চুলগুলো তার উড়ছে। শাড়ির আঁচলখানা গাড়ির গবাক্ষ পথে পত্ পত্ করে উড়ছে।

 গাড়িখানা তখন পশ্চিম দিকে মুখ করে শিরীন রোড ধরে ছুটছিলো। সূর্যাস্তের সোনালী আলোকরশ্মি গাড়ির সম্মুখস্থ কাঁচের শাশীর মধ্য দিয়ে এসে পড়ছিলো নূরী আর রওশান রিজভীর মুখের উপর।

নুরীর এবং রওশান রিজভীর মুখ সুর্যাস্তের সোনালী আভায় অপূর্ব লাগছিলো।

ঠিক ঐ মুহূর্তে খেলনার ঝুড়ি নিয়ে সে পথে এগিয়ে আসছিলো ফেরিওয়ালা–চাই খেলনা চাই–মাথার ফিতা, কাটা, আর চুড়ি চাই—

তার পাশ কেটে চলে যায় গাড়িখানা।

চমকে উঠে ফেরিওয়ালাবেশী বনহুর, মুহূর্তের জন্য হলেও নূরীকে চিনতে তার ভুল হয় না। থ’ মেরে দাঁড়িয়ে থাকে সে পথের পাশে। গাড়িখানা তখন অদৃশ্য হয়ে গেছে।

বনহুরের পা থেকে মাথা অবধি একটা বিদ্যুৎ চমকে যায়, সে স্পষ্ট দেখেছে–একটি যুবকের পাশে তার নূরী উপবিষ্ট। উচ্ছল খুশি-ভরা নূরীর দীপ্ত মুখ–কোথায় সেই ঘাগড়া আর ওড়না একখানা শাড়ির আঁচল চলে গেলো তার মুখের পাশ ছুঁয়ে।

 কিছুক্ষণ নিশ্চল পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বনহুর, তারপর সম্বিত ফিরে আসে তার মধ্যে। ভাবে হয়তো বা ভূল দেখেছে সে। কিন্তু সে যে স্পষ্ট দেখেছে, সেই মুখ, সেই চোখ-না না, ভুল তার হয়নি। তবে কি নূরী অন্য কোনো যুবককে ভালবেসে তাকে গ্রহণ করে বসেছে! সন্ধান যখন পেয়েছে তখন আর চিন্তা কি।

 আজ সন্ধ্যা বয়ে গেছে, কাজেই নূরীকে খুঁজে পাওয়া মুস্কিল হবে। রাতের অন্ধকারে কিছুতেই সম্ভব হবে না, কোন্ বাড়িতে গাড়িখানা প্রবেশ করেছে কে জানে।

বনহুর ফিরে এলো শহরের আস্তানায়। এখান থেকেই তাকে রোজ শহরে ফেরিওয়ালা বেশে বেরুতে হয়। অবশ্য সে আস্তানার ড্রেসিংরুম থেকেই ছদ্মবেশ ধারণ করে এবং ফিরেও ড্রেসিংরুমে এসে ড্রেস পরিবর্তন করে।

তার বিশিষ্ট অনুচরগণ ছাড়া আর কেউ জানে না তার এ ছদ্মবেশ ধারণের কথা।

বনহুর যখন তার বিশ্রামকক্ষে প্রবেশ করে তখন সে স্বাভাবিক ড্রেসেই থাকে, দস্যু ড্রেসেও নয়।

 আজ বনহুরকে অত্যন্ত বিচলিত মনে হচ্ছিলো।

শয্যা গ্রহণ তার কাছে অসহ্য লাগছিলো আজ। এ ক’দিন রহমানও আছে তার কাজে। সেও এক ভিখারীর বেশে অন্বেষণ করে ফিরছে শহরের পথে ঘাটে নূরীকে। বনহুর আর রহমান ছাড়াও আরও কয়েকজন বিশিষ্ট অনুচর গোপনে এখানে-সেখানে ছড়িয়ে ছিলো। সবাই খুঁজে ফিরছে নূরীকে।

গোটা রাতটা বনহুরের নানা দুশ্চিন্তায় কাটলো।

পরদিন ঠিক পূর্বের ফেরিওয়ালার বেশে বনহুর পৌঁছে গেলো সেই অঞ্চলে, যে অঞ্চলে সে। দেখেছিলো নূরীকে এক যুবকের পাশে গাড়িতে। বনহুর পথ ধরে এগিয়ে চলেছে–চাই খেলনা চাই–চুড়ি, ফিতা আর মাথার কাঁটা চাই– হুরবালা চাই, হুরবালা—

 প্রতিটি বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে বনহুর এভাবে উচ্চকণ্ঠে হাঁকতে লাগলো। হুরবালা, মানে সুন্দর বালা চাই। বনহুর ভাবলো, নিশ্চয়ই নূরী এ নাম শুনলে বেরিয়ে আসবে।

 কিন্তু মিথ্যা তার আশাবনহুর সারাটা দিন পথে পথে ঘুরেও নূরীর কোনো সন্ধান পেলো না। হতাশ হয়ে পড়লো সে। ক্লান্ত অবশ পা দু’খানা টেনে টেনে পথ চলছিলো। বেলা প্রায় গড়িয়ে এসেছে, এমন সময় তার দৃষ্টি চলে গেলো একটা বাড়ির গাড়ি-বারান্দায়। চমকে উঠলো বনহুর এক নজর দেখলেও গাড়িখানাকে সে ভালভাবেই চিনে নিয়েছিলো। এ যে সেই গাড়ি, যে গাড়ির মধ্যে একটি সম্পূর্ণ অপরিচিত যুবকের পাশে কাল দেখেছিলো তার নূরীকে।

বনহুর থমকে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো গাড়িখানার দিকে, কাঁধে তার খেলনার ঝুড়ি।

গেটের পাহারাদার রুখে উঠললাইধার কিয়া দেখতা তুম?

 হাম্ এইছা একঠো গাড়ি লেঙ্গে, সম্ঝা?

কিয়া তুম গাড়ি লেঙ্গে। ফেরিওয়ালা হোকে এতনা বড়াবাৎ বলনেকে শরম নেহি আতা?

নেহি ভাই, হাম্‌ তো বহুৎ পয়সা কামাতা হর রোজ—

 পয়সার কথা শুনে অনেকটা ঠাণ্ডা হয়ে আসে পাহারাদার। দু’পা সরে আসে–এধার আও।

ভাই, গোরা পানি পিলাও গে?

পানি পিও গে, তব হিয়া বৈঠো। দারোয়ান পয়সার নাম শুনেছে, তাই খুশিতে ডগমগ, নিজেই ছুটলো পানি আনতে।

একটু পরে এক ঘটি পানি নিয়ে ফিরে এলো দারোয়ান।

বনহুর তখন গেটের পাশে সানবাধা জায়গাটায় খেলনার ঝুড়ি রেখে বসে পড়েছে। মিথ্যা নয়, পানির পিপাসা তার খুব পেয়েছিলো। ঘটি নিয়ে ঢ ঢক্‌ করে খানিকটা পানি সে গলধঃকরণ করলো। তারপর বললো –এ কিসকা ঘর?

অবাক হয়ে বললো দারোয়ান –তুম লোক এ ঘর নেহি সামঝা?

 নেহি ভাই, মাইতো এ শহর মে আভি ক’রোজ আয়া। কই কা ঘর নেহি সামাঝতা।

এ ঘর পুলিশ ইন্সপেক্টর রওশান রিজভী সাহেবকা।

ও আভি হাম সাম্ঝা। আচ্ছা ভাই, তোমরা মেম সাহেব হ্যায় না? বললো বনহুর।

দারোয়ান বললো–নেহি ভাই, মেরা সাহেব তো শাদি নেহি কিয়া।

শাদি নেহি কিয়া? তব এক মেম সাহাব কো সাথ তোমহারা সাহাব কো গাড়ি মে দেখা, ও কোন্‌?

হাসলো এবার দারোয়ান–ও তো সাহাব কো বিবি নেহি, ভিন লাড়কী হ্যায়।

ভিন্ লাড়কী তব হিয়া রাহতা কাহে?

এতনা খবর তো হাম সামাঝতা নেহি।

বনহুর বুঝলো এর বেশি কিছু আর দারোয়ানের কাছে জানা যাবে না, এবার অন্য কৌশল অবলম্বন করতে হবে। বনহুর এবার খেলনার ঝুড়ি খুলে ফেললো–ভাই তোরা.সাহাব কো : বোলো বহুৎ আচ্ছা চুড়ি, ফিতা আর হুর বালা হ্যায়।

সাহাব তো লাড়কী আদমী নেহি…..

আরে ভাই সাহাব তো নেহি পহেনেগা, ওতো ওহি আদমী কি লিয়ে, যো মেম সাহাব উঁকি পাছ রাহে…..

হাঁ আভি হ্যাঁম্ পুছুকে আতা।

যাও ভাই।

দারোয়ান চলে গেলো, একটু পরেই ফিরে এলো, খুশি-ভরা তার মুখ, বললো–আপ ভাই অন্দরে মে যাও।

বনহুর তাড়াতাড়ি ঝুড়ি গুটিয়ে দারোয়ানকে অনুসরণ করলো

সম্মুখের বাগান পেরিয়ে গাড়ি-বারান্দা, তারপরই অন্দর বাড়ির গেট।

 দারোয়ান গেটের পাশে এসে বললো–হিয়া বইঠো।

 বনহুর ঝুড়ি খুলে বসলো, একবার দাড়ি-গোঁফে হাত বুলিয়ে দেখে নিলো।

এক বৃদ্ধার সঙ্গে বেরিয়ে এলো নূরী।

বনহুর আড়নয়নে তাকিয়ে দেখে নিলো নূরীকে। তার চিনতে একটুও ভুল হয়নি। নূরীর মুখে হাসি–ঠিক পূর্বের মতই চঞ্চলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে তার মধ্যে।

বৃদ্ধা মোহসিনা বেগম বললেন–এই ফেরিওয়ালা, তোমার কাছে কি আছে?

বনহুর গলার স্বর একটু পাল্টে নিয়ে বললো–জো চিজ আপুলোক মাঙ্গতা ঐ চিজ মেরা পাশ হ্যায় মাইজী।

দেখি কেমন চুড়ি আছে তোমার কাছে? বললো নূরী।

এক জোড়া বালা হ্যায় মেরা পাশ, উছি বালা কি নাম হুরবালা।

 হুরবালা! নূরীর চোখ দুটো যেন খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, বললো– কই দেখি?

বনহুর খুঁজে খুঁজে বের করলো একজোড়া বালা। অতি সুন্দর ঝকঝকে পাথর বসানো বালাগাছা।

নূরীর সন্ধানের জন্য এ বালাগাছা বনহুর কারিগরের নিকট হতে তৈরি করে নিয়েছিলো, উদ্দেশ্য ছিলো এ বালার পেছনে।

 বালাগাছা হাতে নিয়ে নূরী মুগ্ধ হয়ে গেলো, এতো সুন্দর বালা সে ইতিপূর্বে দেখেনি, খুশি হয়ে বললো–কত দাম এ বালার?

আপ কো পছন্দ হুই?

হাঁ, আমার খুব পছন্দ হয়েছে।

মোহসিনা বেগম বললেন–দাম বলো, এটা আমি ওকে কিনে দেবো।

বনহুর বললো–দাম পিছে লেগি মাই, আপকো লাড়কীকি হাত মে হুই তব তো।

নূরী বালাগাছা নিজের হাতে পরতে চেষ্টা করলো কিন্তু কিছুতেই পরতে পারছিলো না। মোহসিনা বেগম বললেন–এসো মা, আমি পরিয়ে দিচ্ছি।

 মোহসিনা বেগম চেষ্টা করলেন কিন্তু কিছুতেই হাতে উঠাতে পারলেন না। হতাশ কণ্ঠে বললেন তিনি–সুন্দর বালাটা, কিন্তু তোমার হাতে উঠবে না মা।

নূরীর মুখ বিমর্ষ হলো, ব্যথা-ভরা কণ্ঠে বললে-তাবে ফিরিয়ে নাও।

বনহুর বললো-আপ আইয়ে, মাই পিনানে সাকতা।

পারবে তো? বললেন মোহসিনা বেগম।

 নৃরী সরল মনে হাতখানা এগিয়ে দিলো ফেরিওয়ালার দিকে।

ফেরিওয়ালা নূরীর হাতখানা হাতের মুঠায় চেপে ধরে বালাটা হাতে তুলতে চেষ্টা করলো, অল্প চেষ্টায় বালাটা পরিয়ে দিলো সে নূরীর হাতে।

নূরীর পাশে তখন পূর্বদিনের সেই যুবক এসে দাঁড়িয়েছে। হেসে বললো-বাঃ চমৎকার বালা

হাঁ, বাবুজি। বললো নূরী।

 এবার যুবক তাকালো বনহুরের দিকে–এই ফেরিওয়ালা, ইসকা দাম কেতনা?

বাবুজি, আপ জো খুশি হামকো দে দিজে।

 এ তো বহুত খুবসুরাত বালা হ্যায়।

আপ পছন্দ কিয়া হাম উছিছে বহুৎ খোশ্য হুই, আপ লে লিজে। জো খুশি দাম দে দিজে বাবু সাব।

নূরীর মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হলো।

রওশান রিজভী ব্যাগ খুলে বালার জন্য টাকা মিটিয়ে দিলেন। ফেরীওয়ালাবেশী বনহুর ঝুড়ি গুটিয়ে উঠে দাঁড়ালো–চাই খেলনা চাই–চুড়ি, ফিতা, মাথার কাঁটা চাই…..

 বনহুর আস্তানায় ফিরে ফেরিওয়ালার ড্রেস আজ থেকে ত্যাগ করলো। কারণ এ ড্রেস সে পরেছিলো শুধু নূরীকে খুঁজে বের করার জন্য, এখন এ ড্রেসের প্রয়োজন তার শেষ হয়েছে।

*

স্যার, কোথায় যাবেন? ড্রাইভ আসন থেকে বললো ড্রাইভার।

পিছন আসনে বসেছিলো রওশান রিজভী আর নূরী। ড্রাইভারের কথায় বললেন রওশান রিজভীসুরমাবাগ মার্কেটে চলো।

আচ্ছা স্যার। ড্রাইভার গাড়িতে ষ্টার্ট দিলো।

গাড়ি ছুটে চললো উল্কা বেগে।

কান্দাই শহরের জনমুখর রাজপথ–গাড়ি এগিয়ে চলেছে।

ড্রাইভারের দৃষ্টি সম্মুখে থাকলেও কান ছিলো তার পিছনে। রওশান রিজভী এবং নূরীর মধ্যে যে আলোচনা হচ্ছিলো, সব মনোযোগ সহকারে শুনছিলো সে।

রওশান রিজভী বললেন–নূরী, কাল যে বালা তুমি কিনেছো ওটা অতি মূল্যবান।

হা বাবুজি, আমার খুব পছন্দ হয়েছে বালাটা।

 লোকটা সত্যি ভাল, কোনো দামদর করলো না!

 নূরী কোনো জবাব দিলো না।

কিছুক্ষণ নীরব, কোনো কথা নেই পিছন আসনে।

পুনরায় শোনা গেলো রওশান রিজভীর গলা–নূরী।

বলুন বাবুজি?

আজ তুমি কি চাও আমার কাছে? শাড়ি, গহনা, না টাকা?

সবুর করেন, আমি বলছি।

 বলো কি চাও?

ড্রাইভারের মুখমণ্ডল কঠিন হয়ে উঠেছে, চোখ দুটো সামনের দিকে থাকলেও জ্বলে উঠলো অগ্নিশিখার মত দপ করে। নূরীর জবাব শোনার জন্য সেও উদগ্রীব রইলো।

নূরীর কণ্ঠ–শাড়ী,গহনা, অর্থ কিছুই চাই না আমি।

 তবে কি চাও, কি পেলে খুশি হবে বলো নূরী?

 আপনার দয়া, আপনার দয়া পেলে আমি অনেক খুশি হবো, বাবুজি।

ড্রাইভার বাঁকা চোখে একবার পিছনে লক্ষ্য করলো, সমস্ত দেহ যেন জ্বালা করে উঠলো তার। নূরীর কথাগুলো তার কানে যেন গরম সীসা ঢেলে দিলো।

হাসলেন রওশান রিজভী–কিন্তু তুমি তো আমার দয়া কামনা করো না নূরী?

আপনি আমার জন্য যা করেছেন তা যে অনেক দয়া বাবুজি। আপনি আমাকে ফাঁসী থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছেন। আশ্রয়হীন হয়ে যখন পথে এসে দাঁড়িয়েছিলাম তখন আপনি আমাকে আশ্রয় দিয়ে রক্ষা করেছেন। তারপর বাবুজি, আপনি আমাকে একা পেয়েও কোনোদিন মন্দ কথা বলেননি। আপনি আমার ইজ্জৎ রক্ষা করেছেন বাবুজি……

নূরী, আমি তোমাকে একদিন বলেছি, তোমার অমতে আমি কোনোদিন তোমাকে স্পর্শ করবো না। আমি শুধু তোমার বলার অপেক্ষায় রয়েছি নূরী। তুমি কি চাও, বোনের ভালবাসা না প্রিয়ার প্রেম?

বাবুজি, আমাকে মাফ করবেন বাবুজি! আমি আপনার ছোট বোন। আমি আপনার ছোট বোন বাবুজি….

 ড্রাইভার এতোক্ষণ ভাবছিলো, গাড়িখানাকে এমনভাবে উল্টে দেবে যাতে দু’টোই একসঙ্গে শেষ হয়ে যায়, নূরীর অস্তিত্ব লুপ্ত করে দেবে রওশান রিজভীর সঙ্গে। কিন্তু একি, এ যে নির্মল পবিত্র সম্বোধন!

নূরীর সংগে রওশান রিজভীর তবে কোনো কুৎসিত সম্বন্ধ গড়ে উঠেনি–ছিঃ ছিঃ কেন সে এই ভুল ধারণা করেছিলো, আর একটু হলেই এদের জীবন বিনষ্ট করে দিতো সে! ড্রাইভার অন্য কেউ নয়–সে স্বয়ং দস্যু বনহুর।

বনহুর আজ কদিন হলো অবিরত ভেবেছেনূরী আর ঐ ইন্সপেক্টরের জীবনলীলা সাঙ্গ করে দেবে, তবেই শান্তি পাবে সে, নইলে অহঃরহ দগ্ধীভূত হবে। বনহুর আজ সে উদ্দেশ্য নিয়েই গাড়ি চালাচ্ছিলো–গাড়িখানা যখন ব্রীজের উপর দিয়ে চলতে থাকবে তখন বনহুর লাফিয়ে পড়বে নিচে আর গাড়িখানা ব্রীজের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়ে যাবে গভীর পানির মধ্যে। সব শেষ হয়ে যাবে, মুছে যাবে নূরীর চিহ্ন,

 বনহুরের মন সচ্ছ হয়ে এলো, আর একটু হলেই সে সর্বনাশ করে ফেলেছিলো। নূরী আর রওশান রিজভীকে নিঃশেষ করে ফেলতো, তারপর সে হতো আশ্বস্ত কিন্তু যে ভুল সে আজ করতো। কোনোদিনই তা আর সংশোধন হতো না। বনহুরের মনে নূরীর সম্বন্ধে যে সন্দেহের বীজ রোপণ হয়েছিলো তা কোনোদিনই মুছে যেতো না। বনহুর তৃপ্তির নিশ্বাস ত্যাগ করলোনূরী তাহলে অসতী নয়।

মার্কেটিং শেষ করে বাসায় ফিরে এলেন রওশান রিজভী নূরীসহ, অনেক শাড়ি-জামা-জুতো যা প্রয়োজন কিনে দিয়েছেন তিনি নূরীকে। ড্রাইভার অবশ্য তাদের সঙ্গে সঙ্গেই ছিলো।

রওশান রিজভী যখন জিনিসগুলো কিনছিলেন তখন নূরীকে তিনি পছন্দ করতে অনুরোধ করছিলেন বার বার এবং বোন বলে সম্বোধন করছিলেন।

 ড্রাইভারবেশী বনহুর পিছনে থেকে সব লক্ষ্য করছিলো। নূরীকে রওশান রিজভী যে আশ্রয় দিয়ে অত্যন্ত ভাল কাজ করেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। না হলে সে কোথায় যেতো কে জানে। মনে মনে বনহুর রওশান রিজভীকে ধন্যবাদ জানায়।

রওশান রিজভী জিনিসপত্রগুলো ড্রাইভারের হাতে দেন–গাড়িতে নিয়ে চলো।

এগোয় নূরী আর রওশান রিজভী, পিছনে এগিয়ে আসে ড্রাইভারবেশী বনহুর, হাতে তার ক্রয় করা জিনিসপত্রগুলো। ড্রাইভার জিনিসগুলো গাড়ির ভিতরে রেখে পিছন আসনের দরজা খুলে ধরে।

উঠে বসে নূরী, তারপর উঠেন রওশান রিজভী।

ড্রাইভ আসনে বসে গাড়িতে স্টার্ট দেয় ড্রাইভার।

এ ঘটনার পরও ড্রাইভার বেশে বনহুর রয়ে গেছে পুলিশ ইন্সপেক্টর রওশান রিজভীর বাড়িতে। অনেক চেষ্টা করে তবে সে এখানে ড্রাইভারের কাজ পেয়েছিলো, উদ্দেশ্য নূরীর চরিত্র সম্বন্ধে। নিঃসন্দেহ হওয়া। সত্যিই যদি নূরী দুষ্টচরিত্রা হয়ে থাকে তাহলে ওকে খতম করে দেবে সে, আর যদি নূরী পূর্বের মত সচ্ছ-পবিত্র থাকে তবে তাকে অন্তর দিয়ে গ্রহণ করবে।

 বনহুর নূরীকে পরীক্ষা করে চলেছে–শুধু একদিন নয়, কয়েকদিন ধরে। রওশান রিজভীর আচরণে বনহুর মুগ্ধ হয়েছে। তরুণ অবিবাহিত পুলিশ ইন্সপেক্টর অথচ সে এতো সৎ চরিত্র। বনহুর যদি তার মধ্যে কোনোরকম কলুষিত ভাব দেখতো তাহলে এতোদিন তার জীবনলীলা সাঙ্গ করে দিতো।

কিন্তু অদ্ভুত মহৎ ব্যক্তি এই রওশান রিজভী-নূরীকে সে অনেক সময় ঘনিষ্ঠভাবে পেয়েও কোনোরকম অসংযত উক্তি উচ্চারণ করে না বা তার প্রতি কোনো খারাপ আচরণ করে না। বনহুর যেখানেই থাক সব সময় খেয়াল করতো এ ব্যাপারে।

একদিন নূরী বাগানে বসে ফুল দিয়ে মালা গাঁথছিলো, নির্জন বিকেল, রওশান রিজভী গেছেন কাজে। মা মোহসিনা বেগম ঘরে শুয়ে শুয়ে বই পড়ছেন। নূরীর পূর্বের অভ্যাস এখন–তেমনি রয়েছে। ফুল সে অত্যন্ত ভালবাসে, সময় পেলেই নূরী ফুল নিয়ে খেলা করতো–আজও অবসর মুহূর্তে সে ফুল দিয়ে মালা গাঁথছিলো।

রওশান রিজভী আজ নিজেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছেন। এটা তার সখ, ড্রাইভার থাকাকালেও তিনি নিজ হস্তে গাড়ি চালিয়ে আনন্দ পান।

রওশান রিজভী বাইরে গেছেন, ড্রাইভার তাই বাসাতেই আছে। নিস্তদ্ধ দুপুরটা পাহারাদারের সঙ্গে গল্প করে কেটেছে তার, এখন পাহারাদার কোনো কাজে কোথায় যেন গেছে।

ড্রাইভার বসে ছিলো, হঠাৎ তার নজর চলে যায় বাগানে–ঐ তো নূরী একটা হাস্না হেনার ঝোঁপের আড়ালে বসে ফুলের মালা গাঁথছে। একটু হাসি ফুটে উঠে ড্রাইভারের ঠোঁটে, উঠে দাঁড়ায়

লঘু পদক্ষেপে নূরীর পিছনে এসে দাঁড়ায়, আস্তে চোখ দুটো ধরে ফেলে ওর।

চমকে উঠে নূরী, বিদ্যুৎ গতিতে হাত দু’খানা সরিয়ে দিতে দিতে বলেছিঃ বাবুজি এই আপনার কাজ…..কিন্তু ফিরে তাকাতেই আড়ষ্ট হয়ে যায়। কিছুক্ষণ কোনো কথা বের হয় না নূরীর মুখ থেকে। প্রথমে ভেবেছিলো, তার চোখ দুটি বোধ হয় রওশান রিজভীই ধরেছেন তাই সে বলেছিলো, ছিঃ বাবুজি এই আপনার কাজ। কিন্তু যখনই নূরী বাবুজির স্থানে ড্রাইভারকে দেখলো তখনই বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো, ড্রাইভার এত সাহস পেলো কি করে!

 ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো নূরী, তারপর রাগতকণ্ঠে বললো–ড্রাইভার, তোমার এত স্পর্ধা? আজই তোমার চাকরী খতম মনে রেখো।

ড্রাইভার নূরীর উচ্চকণ্ঠে ভড়কে গেলো, এই বুঝি এসে পড়েন ইন্সপেক্টার জননী, তাহলেই সব প্ল্যান নষ্ট হয়ে যাবে।

 তাড়াতাড়ি মুখের নকল ফ্রেঞ্চ কাটা দাড়ি খুলে ফেললো, সঙ্গে সঙ্গে গোঁফ জোড়াও খুলে নিলো সে হাতের মধ্যে।

নূরী তাকাতেই অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো–হুর! সঙ্গে সঙ্গে নূরী ঝাঁপিয়ে পড়লো ড্রাইভারবেশী বনহুরের বুকে।

বনহুর নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করলো, চিবুকখানা তুলে ধরলো নিজের মুখের কাছে।

 ঠিক সে মুহূর্তে অদূরে এসে দাঁড়ালেন রওশান রিজভী। একি, এ যে অপরিচিত এক যুবকের সঙ্গে নূরী! কঠিন কণ্ঠে গর্জে উঠলেন-নূরী!

বনহুর নূরীকে মুক্ত করে দেয়।

 নূরী লজ্জিতভাবে সরে দাঁড়ায়।

কখন যে রওশান রিজভী এসে পড়েছেন তারা জানতেই পারেনি। হঠাৎ তার কণ্ঠস্বরে উভয়ে চমকে উঠে।

নূরী লজ্জা-ভরা দৃষ্টি তুলে ধরে–বাবুজি!

ততক্ষণে রওশান রিজভী বনহুরের জামার কলার মুঠায় চেপে ধরে ভীষণ জোরে ঝাঁকুনি দেন–কে তুমি?

বনহুর কোনো জবাব দেবার পূর্বেই রওশান রিজভী প্রচণ্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিতে যান তার নাকের উপর কিন্তু বনহুর বাম হস্তে খপ করে ধরে ফেলে রওশান রিজভীর দক্ষিণ হাতখানা।

 অবাক হন রওশান রিজভী কে এই যুবক যে তার হাতখানা এমন সহজে ধরে ফেললো। অদ্ভুত শক্তি লোকটার দেহে, এক চুল হাত নড়াতে পারলেন না রওশান রিজভী।

বনহুর হাসলো, ছেড়ে দিলো রওশান রিজভীর হাতখানা।

নূরী বললো-বাবুজি, এ আমার স্বামী।

বিস্ময়-ভরা কণ্ঠে বললেন রওশন রিজভী–তোমার স্বামী! তুমি বিবাহিতা নূরী?

হাঁ বাবুজি! লজ্জায় মাথাটা নিচু করে নিলো নূরী।

রওশান রিজভী বললেন–এতোদিন বলেনি কেন যে তোমার কেউ আছে? আমি তাহলে তার সন্ধান করতাম।

আমি ভুল করেছি বাবুজি। আমাকে মাফ করবেন।

 বনহুর হেসে বললোস্যার, আপনি ওকে রক্ষা করেছেন সেজন্য অনেক অনেক শুকরিয়া।

রওশান রিজভী তাকালেন বনহুরের মুখের দিকে, তার পৌরুষদীপ্ত সুন্দর চেহারা আর গাম্ভীর্যপূর্ণ কণ্ঠস্বরে অভিভূত হলেন তিনি। কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলেন না তিনি, অবাক হয়ে ভাবছেন–কে এই যুবক?

বনহুর বললো–স্যার, নূরীকে আমি এবার নিয়ে যেতে চাই।

একটা দীর্ঘশ্বাস গোপনে চেপে নিলেন রওশান রিজভী। তারপর বললেন–নূরীর ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা, কাজেই সে যা চায় তাই করবে।

নূরী বললো–বাবুজি, আপনি আমাকে রক্ষা করেছেন। আপনি জীবনদাতা, চিরদিন আপনার কথা মনে থাকবে।

মাকে বলে যাবে না নূরী? বললেন রওশান রিজভী।

 আম্মাকে না বলে আমি যাবো না বাবুজি।

 রওশান রিজভী বনহুরকে লক্ষ্য করে বললেন–এসো আমার বৈঠকখানায়, নূরী আমার মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে আসুক।

 মোহসিনা বেগম নূরীর চলে যাওয়ার কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন, তিনি ভাবতেও পারেননি নূরীকে কোনোদিন বিদায় দিতে হবে।

 অশ্রু বিসর্জন করে বললেন মোহসিনা বেগম–কেন তবে মায়া বাড়াতে এসেছিলে মা? যাও, দোয়া করি চিরদিন সুখে থেকো।

রওশান রিজভীর চোখ দুটোও ছলছল করচ্ছিলো, তিসি বললেন-নূরী, তোমার ভাইকে– ভুলে যেও না যেন?

নূরী রওশান রিজভীর পায়ে কদমবুসী করে বললো–ভাইয়া, কোনোদিন ভুলবো না আপনার দয়ার কথা।

বনহুর নূরীকে নিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে বেরিয়ে পড়লো।

মোহসিনা বেগম আর রওশান রিজভী তাদের গেট অবধি এগিয়ে দিলেন।

পথের বাঁকে বনহুর বনহুর আর নূরীর ঘোড়ার গাড়িখানা অদৃশ্য হলো; রওশান রিজভী ফিরে তাকালেন মায়ের দিকে–মায়ের গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা।

রওশান রিজভী বললেন–আম্মা চলো। মায়ের অজ্ঞাতে তিনিও রুমালে চোখ মুছলেন।

*

কান্দাই আস্তানা।

বনহুর নূরীকে নিয়ে ফিরে এলো তাজের পিঠে। আজ নুরীর মনে অফুরন্ত আনন্দ। কতদিন পর সে ফিরে এসেছে আস্তানায়, উচ্ছল ঝরণার মতই চঞ্চল হয়ে উঠেছে সে। আজ সব যেন তার কাছে নতুন মনে হচ্ছে।

 তাজের পিঠ থেকে নেমে দ্রুত ছুটে গেলো সে দাইমার কাছে। বৃদ্ধা দাইমা এখনও বেঁচে আছে কিন্তু নড়াচড়া করতে পারে না সে তেমন করে, বসে বসেই সব দেখাশোনা করে। খোঁজখবর রাখে সব দিকে।

নূরী দাইমার গলা জড়িয়ে ধরে আনন্দে অশ্রু বিসর্জন করলো। ছুটে চললো অন্যান্য সঙ্গীনির। কাছে। সবার সঙ্গে দেখা হলো কিন্তু নাসরিন কইনাসরিনকে না দেখে অত্যন্ত চিন্তিত হলো। বনহুরের নিকটে এসে জিজ্ঞাসা করলোবলো হুর, নাসরিন কই?

সে আছে, আসবে পরে।

কোথায় বলো?

কান্দাই শহরে।

 সেখানে কেন?

বনহুর সুভাষিণী সম্বন্ধে নূরীর কাছে সম্পূর্ণ চেপে যায়। আবার হয়তো সে জেদ ধরে বসতো, তাকেও নিয়ে যেতে হবে সেখানে। তাই বললো বনহুর রহমানের সঙ্গে নাসরিনের বিয়ে হয়েছে, তাই রহমান তাকে সখ করে সেখানে নিয়ে গেছে। তাদের বিরক্ত করা ঠিক নয়।

 রহমানের সঙ্গে নাসরিনের বিয়ে হওয়ার কথা শুনে খুশি হলো নূরী, আনন্দে আপ্লুত হলো সে। বনহুরের কণ্ঠ বেষ্টন করে বললো–রহমানকে নিজের করে পেয়ে নাসরিন বুঝি খুব খুশি হয়েছে। হুর?

নিজের মনকে জিজ্ঞাসা করলেই পারো।

নুরী বনহুরের নাকটা ধরে একটু টেনে দিয়ে ফিক করে হাসে।

বনহুর ওকে ধরতে যায় খপ করে, কিন্তু পারে না–ছুটে বেরিয়ে যায় নূরী সেখান থেকে। বনহুর ওকে অনুসরণ করে, নূরী আড়ালে লুকিয়ে পড়ে–খোঁজে সে।

বনহুর আর নূরীতে মিলে যেন লুকোচুরি চলে।

এক সময় ধরে ফেলে ওকে বনহুর।

নূরী হেসে লুটিয়ে পড়ে।

আবার আস্তানা আনন্দে মুখর হয়ে উঠে।

বনহুর তাজকে ঘাস খাওয়ায়; দক্ষিণ হস্তে তার তাজের লাগাম। বাম হস্তখানা নূরীর হাতের মুঠায়; নূরী এগিয়ে চলেছে আগে আগে, পিছনে বনহুর। তাজ ঘাস খেতে খেতে ধীরে ধীরে এগুচ্ছে।

ঝরণার পাশে এসে বসে পড়ে বনহুর।

তাজ ছাড়া পেয়ে অদূরে ঘাস খেতে শুরু করে।

নূরী শুয়ে পড়ে বনহুরের কোলে মাথা রেখে সবুজ দুর্বা ঘাসের উপর। কতদিন এমন করে। বনহুরের কোলে মাথা রেখে শোয়নি নূরী। কতদিন গান শোনায়নি সে তাকে।

বললো নূরীর, গান শুনবে না?

 যদি ইচ্ছে করো একটা গান শোনাও নূরী।

 নূরী বনহুরের হাতখানা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে। বলে সে–কোন গানটা শুনবে বলো?

 যে গান তোমার ভালো লাগে।

নূরী গান গায়।

তন্ময় হয়ে যায় বনহুর। ঝরণার কুলকুল জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে নূরীর কণ্ঠের সুর মিলে অপূর্ব শোনায়!

আকাশে চাঁদ ভেসে উঠে, জোছনার আলোতে উচ্ছল হয়ে উঠে বনভূমি। ঝরণার জলে রূপালী রঙ-এর ঢেউ জাগে।

নূরীর গান একসময় শেষ হয়।

বনহুর নূরীর কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললো–সূরী, আমাকে পুনরায় বাংলা অঞ্চলে যেতে হবে।

 চমকে উঠলো নুরী, বাংলাদেশের মাটিতে সেও গিয়ে পড়েছিলো। কত না নাকানি-চুবানি তাকে খেতে হয়েছে। কতই না বিপদ এসেছে তার মাথার উপরে। বাংলায় বনহুরের জীবনেও এসেছে নানা দুর্যোগের ঘনঘটা। বার বার মৃত্যুর কবল থেকে কোনো রকমে বেঁচে গেছে–আবার সেই বাংলাদেশ! নূরীর মুখমণ্ডল মুহূর্তে বিষণ্ণ হলো, বললো সেনা, কিছুতেই তোমাকে বাংলাদেশে যেতে দেবো না, যেতে দেবো না হুর।

জরুরি প্রয়োজনে আমাকে যেতে হবে নূরী।

 সব কাজই তো তোমার জরুরি। যত কাজই থাক এবার তোমাকে ছাড়ছি না আমি।

নূরী, আমাকে বাধা দিও না।

নূরী ওড়না দিয়ে বনহুরের গলা বেষ্টন করে বললো–ছাড়লে তো তুমি যাবে? আমি তোমাকে কিছুতেই ছাড়বো না।

হেসে বলে বনহুর-পাগলী মেয়ে!

আর তুমি আস্ত পাগল।

 চলো আস্তানায় ফেরা যাক।

আর একটু বসো না, কতদিন ঝরণার ধারে আসিনি। দেখছো না তাজ কেমন নিশ্চিন্ত মনে ঘাস খাচ্ছে।

নূরী, আমি বুঝতে পারি না কেন তোমরা এতো স্বার্থপর হও?

 তার মানে?

 মানে তোমরা সব সময় নিজের ভালটা চাও, কিসে পরের মঙ্গল হবে বা উপকার হবে, একথা তোমরা ভাব না। বাংলাদেশে যাওয়ার পিছনে আমার উদ্দেশ্য আছে নূরী।

 সেদিন আর বেশি কথা হয় না; বনহুর উঠে পড়ে, তাজকে উদ্দেশ্য করে শিস দেয় সে। সঙ্গে সঙ্গে তাজ এগিয়ে আসে; নূরীকে বনহুর সহায়তা করে ঘোড়ায় চড়ে বসতে, তারপর বনহুর নিজেও চেপে বসে। বাম হস্তে নূরীকে আঁকড়ে ধরে দক্ষিণ হস্তে তাজের লাগাম টেনে ধরে।

তাজ ছুটতে শুরু করে।

 আস্তানা অভিমুখে চললো তারা। বনহুর আর নূরী যেন কোনো রাজপুরীর রাজপুত্র আর। রাজকন্যা, তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে যেন ওরা চলেছে অজানার দেশে।

*

নূরী বনহুরকে ভুলিয়ে রাখার নানারকম চেষ্টা করে। যেন সে আর তাকে ত্যাগ করে কোথাও চলে না যায়।

কিন্তু নূরী ব্যর্থ হয়।

বনহুর যা করে বা করবে কেউ তাকে রুখতে পারবে না। নূরীও পারে না তাকে ধরে রাখতে। একদিন রহমান এবং অন্যান্য বিশ্বস্ত অনুচরের কাছে বিদায় নিয়ে বনহুর রওয়ানা দেয় সুভাষিণীকে নিয়ে মাধবপুর অভিমুখে।

কান্দাই এরোড্রামে প্লেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে বনহুর আর সুভাষিণী। বনহুরের দেহে স্যুট, চোখে গগলস্।

এ মুহূর্তে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না–এই সুদর্শন যুবক একজন প্রখ্যাত দস্যু।

সুভাষিণীর সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করছিলো বনহুর।

আজ সুভাষিণীর মনে অফুরন্ত আনন্দ–ওকে এমন করে পাশে পেয়েছে, এ যেন তার পরম সৌভাগ্য। কিন্তু একটা ব্যথা তার মনে গুমড়ে কেঁদে ফিরছিলো, সমাজ তাকে আশ্রয় দেবে কিনা!

 প্লেন এসে পৌঁছতেই বনহুর আর সুভাষিণী অন্যান্য যাত্রীর সঙ্গে নিজ নিজ আসনে উঠে বসলো।

 এমন সময় একটি শিখ তরুণ যুবক হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এসে প্লেনে উঠে বসলো। ঠিক বনহুর আর সুভাষিণীর পিছন আসনে বসলো শিখ তরুণটি। বয়স বিশ-বাইশ হবে, সরু গোঁফের কৃষ্ণরেখা সবেমাত্র ফুটে উঠেছে ওষ্ঠদ্বয়ের উপরে। গায়ে ঢিলা কুচিওয়ালা পা-জামা আর জামা। মাথায় পাগড়ি, পায়ে নাগড়া, দক্ষিণহস্তে লোহার সরুবালা। শিখ তরুণটির হাতে একটি সুটকেস।

শিখ তরুণ প্লেনে উঠে বসে। প্লেনের মধ্যে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে তাকাতে লাগলো। মনে হলো, পরিচিত কাউকে সে অন্বেষণ করছে।

প্লেন আকাশে উড়ে চললো।

 দু’পাশে সাদা সাদা মেঘগুলো ছুটে যাচ্ছে পেঁজা তুলার মত।

সিটের সঙ্গে বেল্টগুলো বাঁধা হয়েছিলো প্লেন উঠবার সময়, এখন সবাই নিজ নিজ কোমর থেকে বেল্ট খুলে ভাল হয়ে বসলো। এয়ার হোেসূট্রেস্ ট্রের উপরে চকলেট আর গরম কফি নিয়ে হাজির হলো।

 প্রত্যেক যাত্রীর সম্মুখে এগিয়ে ধরছিলো কফি আর চকলেটগুলো।

শিখ তরুণ চকলেট আর কফির কাপ হাতে তুলে নিলো। গরম কফির কাপে চুমুক দিতেই কাপটা তার হাত থেকে পড়ে গেলো প্লেনের মেঝেয়।

তরুণ বিব্রতভাবে তাকাতে লাগলো, তার মুখ দেখে মনে হলো সে অত্যন্ত লজ্জিত হয়েছে। কফি খাওয়া বোধ হয় তার অভ্যাস ছিলো না, হঠাৎ গরম কফি মুখে দেওয়ায় জিভ পুড়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে খসে পড়ে কাপটা মেঝেতে।

সবাই শব্দ শুনে তাকালো সে দিকে।

 শিখ তরুণ জড়োসড়ো হয়ে সঙ্কোচিতভাবে বসে রইলো।

সুভাষিণী যুবকটির বিব্রতভাব লক্ষ্য করে হাসছিলো মুখে রুমাল চাপা দিয়ে।

বনহুর কিন্তু গম্ভীর হয়ে বসেছিলো, একবার মাত্র তাকিয়ে দেখে নিয়েছিলো সে শিখ তরুণটিকে। বনহুরের মনে তখন নানা চিন্তার জাল ছড়িয়ে পড়েছে। আজে সে যে-দেশে চলেছে একদিন সে দেশের আশেপাশেই ছিলো তার আস্তানা, তার অগণিত অনুচরও ছিলো সেখানে। এ আস্তানায় থাকাকালেই বনহুরে সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল সুভাষিণীর। মাধবপুরের জমিদার ব্রজবিহারী রায়ের কন্যা সুভাষিণী। যদিও কান্দাই আস্তানা থেকে অশ্বযোগেও মাধবপুর আসাটা তার অসম্ভব নয় তবু বনহুর সময় অল্প করে নেওয়ার জন্যই আজ প্লেনে উঠে বসেছে।

*

ভগবৎগঞ্জ এরোড্রামে প্লেন পৌঁছে গেলো। মাঝখানে আরও একটি এরোড্রামে তাদের প্লেন। অবতরণ করেছিলো। ভগবগঞ্জ বাংলার প্রায় কাছাকাছি–পুরোন এ শহর।

বনহুর আর সুভাষিণী নেমে পড়লো ভগবগঞ্জ এরোড্রামে।

 বনহুর লক্ষ্য করেছে, শিখ তরুণটি আগের এরোড্রামে নেমে গেছে। ওর চালচলন বনহুরের কাছে বেশ সন্দেহজনক মনে হয়েছিলো, ভেবেছিলো সে কেউ তাকে ফলো করছে কিনা কিন্তু তরুণটা যখন আগের এরোড্রামে নেমে গেলো তখন আর সন্দেহের কিছু রইলো না।

ভগবগঞ্জে নেমে বনহুর ট্যাক্সি ডেকে উঠে বসলো, সঙ্গে তার সুভাষিণী। একটা হোটেলে এসে উঠলো তারা। ভগবগঞ্জের অদূরে গঙ্গা নদী, কাজেই এ হোটেলে অসম্ভব ভিড়। গঙ্গাস্নান উপলক্ষে যাত্রিগণ নারী-পুরুষ অনেকেই এ হোটেলে আশ্রয় নিয়েছেন।

দু’খানা ঘর ভাড়া নেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও বনহুর বাধ্য হলো একখানা কামরা ভাড়া নিতে, কারণ এই একটি কামরাই খালি ছিলো।

অন্যান্য হোটেলে আরও ভিড়, বছরের পূণ্যিমাস এটা, কাজেই কোনো হোটেলে তিল ঠাই নেই। হিন্দু স্নানযাত্রীদের ভিড়ে সমস্ত শহর গগস করছে। পথেঘাটে চলা মুস্কিল। কাশীতীর্থ স্থানের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় গভবগঞ্জ গঙ্গা স্থান।

বনহুর সুভাষিণীকে হোটেলে রেখে শহরে চলে গেলো প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়ের জন্য।

ফিরে এলো একগাদা জিনিসপত্র নিয়ে।

সুভাষিণীকে বললো–সুভা, নাও এর মধ্যে তোমার দরকারী জিনিসপত্র সব পাবে, গুছিয়ে নাও।

 বনহুর সুভাষিনীর কাছে সব বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলো বাইরে। গাড়িতে উঠে বসলো বনহুর, উদ্দেশ্য শহরটা একবার পরিদর্শন করে ফিরে আসবে।

 গাড়িতে উঠে বসতেই একটি বয় এগিয়ে এলো, যে একটু পূর্বে তার মালপত্রগুলো বয়ে এনেছিলো হোটেলে। বললো–বাবু আমার পয়সা?

ওঃ মস্ত ভুল হয়েছে বনহুরের, মনে ছিলো না কুলি বয়টার পয়সা মিটিয়ে দেওয়ার কথা। বনহুর ব্যাগ খুলে কুলির পাওনা মিটিয়ে দিলো।

সালাম দিয়ে চলে গেলো কুলিটা অন্য বাবুর পিছনে।

 বনহুর যখন ফিরে এলো তখন সুভাষিণী একটি ঘরের মধ্যেই যেন সংসার গুছিয়ে নিয়েছে। কক্ষমধ্যে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো; সুভাষিণীর পাশে সেই ছোকরা বয়টাকে দেখে বললো–ওকেই বুঝি খুঁজে নিয়েছো?

হাঁ ওকে সঙ্গে করেই সব গোছালাম। কেমন হয়েছে?

চমৎকার! বয়টার দিকে তাকিয়ে বললো বনহুর–কিরে, পয়সা চাই?

 বয় মাথা নিচু করে রইলো।

সুভাষিণী বললো–দুটি খাবে তাই…..

বনহুর গা থেকে জামা খুলতে খুলতে বললো–ওঃ বেশ, ওকে আমাদের খাবার থেকে। ভালভাবে খাইয়ে দিও।

বনহুর জামাটা খুলতেই এগিয়ে গেলো ছোকরা–দিন, আমি রাখছি।

 হেসে বললো বনহুর–সুভা, আমাদের একজন সঙ্গী পাওয়া গেলো।

ছোকরার হাতে জামাটা খুলে দিতেই সে জামাটা সুন্দর করে গুছিয়ে রাখলো।

 বনহুর বললো–তোর নাম কিরে?

ছোকরা চট করে বললো–হরিনাথ।

বাঃ চমৎকার নাম তোর। আচ্ছা হরি?

 বলুন বাবু?

 তুই এখানে কাজ করবি? আমি তোকে মাইনে দেবো। আচ্ছা, কত কামাস তুই দিনে?

বাবু, কোনোদিন পাঁচ টাকা হয় কোনোদিন পাঁচ সিকাও পাই না। আপনি যদি রাখেন যা দেন নেবো।

তবু কত পেলে তুই খুশি হবি?

আমি কি বলবো বাবু, আপনার যা দয়া হয় দেবেন।

 যদি মাসে এক শো দেই?

 বাবু! এতো টাকার কথা শুনে ছোকরার চোখ খুশিতে চকচক করে উঠে।

 বেশ, একশো করেই তোকে দেবো?

 আচ্ছা, বাবু।

কে আছে তোর?

 কেউ নেই। দেশে এক বুড়ো মা ছাড়া।

আচ্ছা, আমরা যতদিন এখানে থাকি তুই আমাদের সঙ্গে থাকবি?

থাকবো।

সুভা, একে তুমি তোমার কাজে চালিয়ে নেবে। ধরো আমি তো সব সময় তোমার কাছে থাকতে পারবো না, তখন ও তোমাকে…

থাক আর বলতে হবে না, সে আমি ওকে বলে ঠিক করে নেবো।

বনহুর হেসে বাথরুমে চলে গেলো।

হোটেলে অত্যন্ত ভিড়, কাজেই বনহুর ষ্টোভ এবং হাড়ি-পাতিল সব এনে দিয়েছিলো, সুভা হাড়ির সাহায্যে রান্নাবান্না করে নিলো।

বনহুর বাথরুম থেকে আসতেই সুভা বললো–খেয়ে নাও তুমি।

বনহুর কোনো প্রতিবাদ করলো না, খেতে বসলো।

 অদূরে হরিকে একটা পাতায় খেতে দিলো, সুভা নিজেও বসলো। খাওয়া শেষ করে গল্প নিয়ে। মেতে উঠলো সুভা আর বনহুর, দরজার পাশে বসে রইলো হরি।

সুভা ধরে বসলো বিকেলে বেড়াতে বের হবে তারা।

 হরি থাকবে হোটেলে, তাদের রান্নাটা করে রাখবে।

সুভা আর বনহুর বিকেলে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লো, হরি তাদের গাড়ি অবধি এগিয়ে দিলো গরম দুধের ফ্লাক্সটা নিয়ে।

 ভাগবগঞ্জের দক্ষিণ অঞ্চল জুড়ে শ্যামলীয়া পাহাড়। নীল আকাশের গায়ে পাহাড়টা যেন মিশে রয়েছে। শ্যামলীয়ার রঙও গাঢ় নীল। শ্যামলীয়ার পাদমূল বেয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা নদী।

বনহুরের ইচ্ছা ভগবগঞ্জে দু’ একদিন কাটিয়ে সুভাকে নিয়ে রওয়ানা দেবে মাধবপুরে, পৌঁছে দেবে তার বাড়িতে। এ শহরটা তার দেখা নিতান্ত প্রয়োজন। অবশ্য বনহুরের উদ্দেশ্য, হঠাৎ যদি এখানে সুভাষিণীর স্বামীর সাক্ষাৎ ঘটে যায় তাহলে তার বাসনা সিদ্ধ হবে, সুভাকে অর্পণ করবে স্বামীহস্তে।

বনহুর ড্রাইভারকে বললো-শ্যামলীয়া পাহাড়ে চলো।

শুনেছিলো বনহুর, এ পাহাড়টা নাকি দেখার মত একটা জিনিস। পাহাড় হলেও এর উপরে অনেক সুন্দর সুন্দর বাগান আছে, বিকেলে অনেক লোকজন এখানে বেড়াতে আসে। গঙ্গা স্নানের সময় তো কথাই নেই। ভগবগঞ্জ শহর যখন লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে তখন অনেকে এ পাহাড়ের উপর এসেও আস্তানা গাড়ে। ছোট ছোট তাবু ফেলে বাস করে তারা যাযাবরের মত। তারপর তীর্থস্নান শেষ করে ফিরে যায় সে যার দেশ অভিমুখে। কাশীতে যেমন সর্বসময় তীর্থস্নান। চলে, ভগবগঞ্জে ঠিক তা নয়–এখানে বছরে একবার। দূর্গোৎসবের পর বিসর্জন শেষে এ স্নান শুরু হয়।

 গঙ্গায় মাকে বিসর্জন দেবার পর ভক্তগণ মাতৃদেহ ধৌত জলে স্নান করে পুণ্যিলাভে মেতে উঠে। এ সময়ে শহরের অবস্থা অবর্ণনীয়। নারী-পুরুষ কোনো ভেদাভেদ নেই। পথে প্রান্তে শহরে বিভিন্ন বাড়িতে শুধু নারী আর পুরুষ।

 বনহুর এখানে পৌঁছবার পূর্বেও জানতো না ভগবগঞ্জের অবস্থা এখন এরকম। একমাস চলবে এ স্নান উৎসব।

বনহুর আর সুভাষিণীকে নিয়ে গাড়ি পৌঁছে গেলো গঙ্গাতীরে। গঙ্গায় অসংখ্য নৌকা অপেক্ষা করছে। এসব নৌকাযোগে যাত্রিগণ গঙ্গার ওপারে শ্যামলীয়া পাহাড় দর্শন করে এবং সেখানে যায়।

ড্রাইভার বললো–বাবু, আপনারা ঐ নৌকা একটি ভাড়া করে ওপারে চলে যান।

হাঁ, তুমি এখানে অপেক্ষা করো যতক্ষণ আমরা ফিরে না আসি।

আচ্ছা বাবু। বললো ড্রাইভার।

 বনহুর সুভাষিণীকে নিয়ে গঙ্গাতীরে এসে দাঁড়ালো।

একসঙ্গে চার-পাঁচখানা নৌকা এগিয়ে এলো দাঁড় বেয়ে। সবাই চায় তাদের নৌকায় উঠাতে। এতো লোক পারাপার হচ্ছে তবু মাঝিদের আরও লোভ।

সবাই চেঁচাচ্ছে–বাবু আসুন। বাবু আসুন। বাবু আসুন।

বনহুর একটা নৌকায় উঠে সুভাষিণীর দিকে হাত বাড়ালো–এসো।

 সুভাষিণী হাত রাখলো বনহুরের হাতে।

 টেনে তুলে নিলো বনহুর সুভাষিণীকে নৌকায়।

তাকালো বনহুর গঙ্গার দিকে, অসংখ্য নর-নারী গঙ্গার জলে স্নান করছে। জল নয় যেন কাদা গোলা জলস্রোত। লজ্জায় বনহুরের মাথা নত হয়ে এলো-পুরুষ নারী সবাই এক সঙ্গে স্নান। করছে, লজ্জা-শরম বলতে তাদের আছে বলে মনে হয় না। সব রকম বয়সেরই নারী-পুরুষ একসঙ্গে মিলিত হয়ে স্নান করছে। বৃদ্ধ, বয়স্ক, যুবক-যুবতী–সব রকম বয়সই আছে। স্নানের সময় যুবতী নারীদের দেহে বসন আছে কিনা বোঝা মুশকিল, পুণ্যির নামে যৌবন অঙ্গ অপর পুরুষদের দেখানোই হয়তো এদের উদ্দেশ্য।

বনহুরের সামনে সুভাষিণী লজ্জাবোধ করছিলো।

বনহুর বললো–সুভা, তুমিও কিছু পুণ্যি অর্জন করে নাও? বলো তো ব্যবস্থা করেদি?

সুভাষিণী বললো–হিন্দু হলেও আমি ওসবের পক্ষপাতী নই।

তাহলে তোমাকে ধন্যবাদ দিতে হয়। দেখো দেখি ওরা কি মানুষ না মেষ? কর্দমাক্ত জলে কিভাবে ডুব দিচ্ছে?

ছিঃ আমার ওসব পছন্দ হয় না।

এর নামই তোমাদের হিন্দু ধর্ম, তাই না?

 হাঁ। কিন্তু আমার জন্য নয়।

 মাঝির কণ্ঠ—-বাবু, তীরে এসে গেছে।

বনহুর উঠে দাঁড়ালো এবং নৌকার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সুভাষিণীসহ নেমে পড়লো।

 বেশ উঁচু জায়গাটা, যেখানে ওরা নেমে দাঁড়ালো সেখানে একটু সমতল। তীরে এমনি আরও অনেক সমতল জায়গা আছে।

বনহুর সুভাষিণীকে নিয়ে পাহাড়ে উঠতে লাগলো।

শ্যামলীয়া পাহাড় সত্যি শ্যামল বটে। পাথর আর ইটের বালাই নেই। শুধু উঁচুনীচু মাটির টিলা ও সমতলভূমি।

বনহুর আর সুভা এগুচ্ছিলো।

মাঝে মাঝে সমতল ভূমিতে সুন্দর সুন্দর বাগান আর পানির ফোয়ারা। কৌশলে গঙ্গার। জলদ্বারা ফোয়ারা তৈরি করা হয়েছে। বনহুর আরও দেখলো, পাহাড়ের স্থানে স্থানে ছোট ছোট দোকান রয়েছে। এসব দোকানে সামান্য খাবার এবং পান-বিড়ি-সিগারেট বিক্রি হচ্ছে।

বনহুর একটা দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে নিলো।

যতই উপরে উঠছে ততই নিচে আরও সুন্দর লাগছে। গঙ্গাতীরের মানুষগুলোকে ক্ষুদে মানুষ বলে মনে হচ্ছে যেন। আর গঙ্গা জলে অসংখ্য কালো বলের মতই লাগছে মান-যাত্রীদের মাথাগুলোকে।

অনেক উঁচুতে উঠে বনহুর আর সুভাষিণী একটা পাথরাসনে উপবেশন করলো।

বনহুর সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করে বললো–অদ্ভুত পাহাড় পাথরের নাম গন্ধ নেই, শুধু সবুজের ছড়াছড়ি। কি সুন্দর বাগানগুলো!

 বনহুর আর সুভাষিণী যেখানে বসেছিলো সে স্থানের অদূরে কয়েকটা গোলাকার বাগান। বাগানে নানা বর্ণের ফুল ফুটে আছে। বেলাশেষের অস্তগামী সূর্যের আলোতে লাল-হলুদ-গোলাপী ফুলে ফুলে যেন রঙ-এর রামধনু খেলা করছে।

বনহুর ফুলের গাছগুলোর দিকে নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে ছিলো। ফুরফুরে বাতাসে তার পাতলা চুলগুলো উড়ছিলো। গভীরভাবে কিছু চিন্তা করছিলো সে।

বনহুরের একখানা হাত পাথরাসনের উপরে ছিলো।

অন্য একটি হাতের স্পর্শে চমকে উঠলো বনহুর। আলগোছে তাকালো বনহুর নিজের হাতখানার দিকে। দেখতে পেলো, সুভাষিণীর একখানা হাত তার হাতের উপর এসে পড়েছে।

 বনহুর হাত থেকে দৃষ্টি ফেরালো সুভাষিণীর মুখের দিকে। একটু বিস্মিত হবার ভান করে বললো কিছু বলবে সুভা?

সুভাষিণী হাতখানা সরিয়ে নিয়ে বললো কিছু না।

 বনহুর উঠে দাঁড়ালো–চলো এবার ফেরা যাক।

এমন সময় হঠাৎ একটা চিৎকার শোনা গেলো-বাবা গো, মেরে ফেললো গো।

বনহুর আর সুভা চমকে ফিরে তাকাতেই দেখলো, তাদের থেকে হাতকয়েক নিচে একটা সমতল জায়গায় দুটো লোক ধস্তাধস্তি করছে। একজনের হাতে সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরা, লোকটা চেষ্টা করছে দ্বিতীয় ব্যক্তির বুকে ছোরাখানা বসিয়ে দিতে।

তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে একটি প্রৌঢ় মহিলা আর্ত চিৎকার করছে–বাবা গো, মেরে ফেললো গো, কে আছো বাঁচাও……বাঁচাও..

যেখানে লোক দুটো ধস্তাধস্তি করছে সেখানে চারপাশে কতগুলো লোক ভিড় করে দেখছে কিন্তু কেউ সাহসী হচ্ছে না তাকে উদ্ধার করে নেয় বা ওদের ঝগড়া থামিয়ে দেয়।

বনহুর হাতের অর্ধদগ্ধ সিগারেট দূরে নিক্ষেপ করে পা বাড়ালো, সঙ্গে সঙ্গে সুভা পথ আগলে দাঁড়ালো কোথায় যাচ্ছো?

দেখছোনা, লোকটাকে এক্ষুণি হত্যা করে ফেলবে।

হঠাৎ যদি পাল্টা তোমাকে আক্রমণ করে বসে?

দেখা যাবে। বলে বনহুর দ্রুত এগিয়ে গেলো উঁচু-নীচু টিলার উপর দিয়ে। ভিড় ঠেলে যুদ্ধরত লোক দু’টোর পাশে এসে দাঁড়ালো।

লোকটা তখন দ্বিতীয় জনের বুকে ছোরা বিদ্ধ করতে উদ্যত হয়েছে। আর এক মুহূর্ত চারদিকে গেলো গেলো রব উঠছে, খপ করে বনহুর ধরে ফেললো ছোরাসহ ক্রোধান্ধ লোকটার দক্ষিণ হাতখানা।

হাতে ভীষণভাবে চাপ দিলো বনহুর, সঙ্গে সঙ্গে লোকটির হাত থেকে খসে পড়লো সূতীক্ষ্ণধার ছোরাটা।

চারদিকে একটা আনন্দধ্বনি ফুটে উঠলো।

ক্রোধান্ধ লোকটা বনহুরের আচরণে গর্জন করে উঠলো। আক্রমণ করলো এবার সে বনহুরকে।

বনহুর প্রচণ্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিতেই হুমড়ি খেয়ে পড়লো লোকটা কয়েক হাত নিচে।

আবার একটা আনন্দ ধ্বনি জাগলো জায়গাটাতে। বনহুরকে বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা জড়িয়ে ধরলো আবেগভরে–কে তুমি বাবা, আমার সন্তানকে তুমি বাঁচিয়ে নিলে? আশীর্বাদ করি তুমি চিরসুখী হও।

বনহুর ফিরে এলো সুভাষিণীর কাছে চলো সুভা সন্ধ্যা হয়ে এলো।

সুভাষিণী বনহুরকে দেখেছে–তার পৌরুষভরা চেহারা দেখেই সে মুগ্ধ হয়েছিলো। আজ স্বচক্ষে তার তেজোদ্দীপ্ত বীরত্বপূর্ণ কার্যকলাপ লক্ষ্য করে অভিভূত হয়ে পড়লো সে। সত্যি এ লোকটি অদ্ভুত মানুষ।

সুভাষিণীর মুখে কোনো কথা নেই, চিত্রার্পিতের মত সে উঠে দাঁড়ালো, তারপর অনুসরণ করলো ওকে।

হোটেলে ফিরে দেখলো, হরি রান্নাবান্না করে বসে আছে।

সুভা ভেবেছিলো বেটা পালিয়েছে, কিন্তু ফিরে এসেও যখন তাকে হোটেলকক্ষে বসে বসে ঝিমুতে দেখলো তখন একটা বিশ্বাস এলো তার মনে।

বনহুর আর সুভাষিণী হরির রান্না-করা ভাত-তরকারী খেয়ে খুশিই হলো।

 খেতে খেতে বললো সুভা-সত্যি আমার বড় ভয় হয়েছিল।

 কেন? বললো বনহুর।

সুভাষিণী বললো–লোকটা যেমন বলিষ্ঠ আর জোয়ান তারপর হাতে সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরা, আশ্চর্য তোমার শক্তির কাছে লোকটা যেন কেঁচো বনে গেলো একেবারে।

 হরি ভাতের গ্রাস মুখে তুলছিলো, মাঝপথে ওর হাতখানা থেমে গেলো–কি বললেন আপামণি, সাহেব মারামারি করেছেন?

হেসে বললো বনহুর-নারে ও সব বাজে কথা, তুই খেয়ে নে।

হরি ভাবলো, তাই তো, এসব বাবুদের ব্যাপার–তার এতো মাথা ঘামানোর প্রয়োজন কি– খেতে শুরু করলো হরি।

খাওয়া-দাওয়া শেষে এবার ঘুমোবার পালা।

হরি বললো–আপামণি এবার আমি যাই?

ওকে পেয়ে সুভাষিণীর অনেকটা উপকার হয়েছে, বিদেশ বিভুঁই-হরিটা ছিলো বলেই না এতোটা নিশ্চিন্তভাবে বেড়াতে পারলো সে। আজ রাতে গিয়ে হরি যদি কাল আর ফিরে না আসে তাহলে খুব মুস্কিল হবে। তাই ওর চলে যাওয়ার কথা শুনে বললো–কাল আসবি তো?

আসবো, কিন্তু আমাকে রাতে অনেক দূর যেতে হবে, ফিরতে পারলে তো?

সেকি, হোটেলে জায়গা নেই?

ওরে বাবা, হোটেলে যত ভিড় কোথাও পিঁপড়ে শোবার জো-টি নেই।

 তাহলে কি করবি? চিন্তিত কণ্ঠে বললো সুভাষিণী।

বনহুর বললো–যেতে দাও, যদি পারে আসবে, না পারে না আসবে। লোকের অভাব হবে না।

না, হরির মত ছেলে হয় না, একদিনেই দেখ কত আপন জন বনে গেছে। হরি, এখানে মেঝেতে শুণে পারবি?

তা পারবো। বললো হরি।

বনহুর বললো–শুধু মেঝেতে শোবে কি করে?

সুভাষিণী বললো–টাকা দিচ্ছি, একটা মাদুর কিনে আনতে পারবি?

 খুব পারবো। দিদি, টাকা দিন।

সুভাষিণী টাকা দিলে চলে গেলো হরি, একটু পরে মাদুর নিয়ে ফিরে এলো–দিদিমণি দেখুন পাঁচসিকায় কত সুন্দর একটা মাদুর কিনে এনেছি।

বাঃ খুব সুন্দর তো? সুভাষিণী বললো।

বনহুর তখন নিজ শয্যায় দেহটা এলিয়ে একটা বই মেলে ধরলো চোখের সম্মুখে।

 সুভাষিণী দরজার পাশে হরির মাদুরটা বিছিয়ে দিলো। একটা শাড়ি ভাঁজ করে বালিশ তৈরি করে দিয়ে বললো-তুই এখানে শো, কেমন?

হরি শুয়ে পড়লো নীরবে।

সুভাষিণী ওপাশের চৌকিটায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলো। সারাটাদিন অত্যন্ত ক্লান্ত বোধ হওয়ায় অল্পক্ষণে ঘুমিয়ে পড়লো সুভাষিণী।

রাত বেড়ে আসছে।

বনহুরের শিয়রে লণ্ঠনটা দপদপ করে জ্বলছে, বই-এর পাতা উল্টে চলেছে সে।

ওদিকের খাটে সুভাষিণীর মৃদু নাসিকাধ্বনি হচ্ছে। সমস্ত হোটেল নীরব নিস্পন্দ। পথ থেকে দু’চার জন পথচারীর কণ্ঠ ভেসে আসছে। হয়তো বা দূরের কোনো পথিক ফিরে চলেছে গৃহে।

বনহুর বই বন্ধ করে টেবিলে রাখলো, তারপর হাত বাড়িয়ে আলোটা ডিম করে দিলো। এপাশ-ওপাশ করছে সে,–এক সময় শয্যা ত্যাগ করে নেমে দাঁড়ালো বনহুর।

হরিও ঘুমায়নি, সে চোখ খুলে পিটপিট করে তাকালো। বনহুর যখন শয্যা ত্যাগ করে নেমে দাঁড়ালো তখন তার নিশ্বাস দ্রুত বইছিলো।

 বনহুর বাথরুমে প্রবেশ করলো; একটু পরে ফিরে এলো–সমস্ত দেহে তার জমকালো ড্রেস। সুটকেসটা খুলে বের করলো রিভলভারখানা; পকেটে লুকিয়ে ফেললো দ্রুতহস্তে। তারপর বেরিয়ে গেলো সে।

হরি উঠে পড়লো, ধীর পদক্ষেপে অনুসরণ করলো তাকে।

বনহুর সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো নিচে।

হরি রেলিং এর পাশে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে দেখলো, তারপর ফিরে এলো নিজের শয্যায়।

 বনহুর যখন ফিরলো তখন ভোরের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আলগোছে এসে শয্যা গ্রহণ করলো।

অনেক বেলা হলো বনহুরের ঘুম ভাঙছে না।

 সুভাষিণী চা জল খাবার তৈরি করে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।

এক সময় ঘুম ভাঙলো বনহুরের।

হেসে বললো সুভাষিণী–সমস্ত রাত জেগে ছিলে বুঝি?

 বনহুর ভ্রু কুঁচকে বললো–গোটা রাত বই পড়ে কেটে গেছে সুভা।

ওঃ তাই বলি এতো ঘুম কেন? নাও, চা-জলখাবার খেয়ে নাও।

হরি শুধু মৃদু হাসলো।

 পর পর কয়েকদিন হরি অবাক হলো, সুভাষিণী সেই যে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, গোটা রাত তার চেতনা হয় না। আর বনহুর প্রতি রাতেই বেরিয়ে যায় তার কালো ড্রেস পরে, ফিরে আসে রাত্রি শেষকালে।

 হরি আজ রাতে খেতে বসে আড়নয়নে সব দেখছিলো। সুভাষিণী আর বনহুর পাশাপাশি খাচ্ছে। বনহুর খাওয়া শেষ করে পকেট থেকে একটু মসলা বের করে সুভাষিণীর হাতে দেয়– নাও।

যে কোন মেয়েই পান মসলা ভালবাসে, সুভাষিণীও ভালবাসে মসলা চিবুতে; খাওয়ার পর সে রোজ মসলা চিবোয়। হরি লক্ষ্য করেছে, প্রতিদিন খাওয়ার পরে বনহুর রুমালে মুখ মুছে নিজের পকেট থেকে একটা ছোট্ট কৌটা বের করে মসলা বের করতো তারপর একটু দিতো সুভাষিণীর হাতে।

সুভাষিণী মসলা মুখে ফেলে চিবুতে শুরু করতো।

 বনহুর নিজেও একটু মুখে ফেলতো কিন্তু ভাল করে লক্ষ্য করতেই হরি বুঝতে পারলো বনহুর। মসলা মুখে দেয়নি শুধু শুধু চিবুনোর ভান করেছে মাত্র।

মসলার সঙ্গে কোনো ঘুমের ঔষধ মেশানো আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সে কারণেই। সুভাষিণী প্রতি রাতে অঘোরে ঘুমিয়ে থাকে একটিবার তার ঘুম ভাঙে না।

সুভাষিণী যখন নীরবে ঘুমায় তখন বনহুর বেরিয়ে যায় কক্ষ ত্যাগ করে কোথায় যায়, কি করে–সেই জানে।

হরি কিন্তু প্রতিদিন লক্ষ্য করে বনহুরের এই অদ্ভুত আচরণ। একদিন গভীর রাতে বনহুর বেরিয়ে গেলো, ফিরে এলো ভোরবেলায়। সুভাষিণী না জানলেও হরির মনে সন্দেহ জাগে, লোকটা রোজ কোথায় যায়, কি করে সে?

*

আজ কদিন হলো যাদবগঞ্জের অদূরে নারুন্দি জঙ্গলের মধ্যে গভীর রাতে এক সন্ন্যাসীর। আবির্ভাব ঘটে থাকে। সম্মুখে অগ্নিকুণ্ড দাউ দাউ করে জ্বলছে। মাথায় জটা, মুখে দাড়ি, চোখের পাতার লোমগুলোও পেকে সাদা হয়ে গেছে। বাঘের চামড়ায় উপবিষ্ট বাবাজী; চোখ মুদ্রিত। অবস্থায় বসে যজ্ঞমন্ত্র আবৃত্তি করে চলেছেন। জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের আলোকে আলোকিত বনভূমি। সন্ন্যাসী বাবাজীর জটাজুট-আবৃত ললাটে সিন্দুর আর চন্দনের তিলক। কণ্ঠে রুদ্রাক্ষের মালা, হাত এবং কজীতেও রুদ্রাক্ষের মালার ছড়া। অদ্ভুত দীপ্তময় সন্ন্যাসী বাবাজী শুধু সাধকই নয়, জ্যোতিষীও বটে।

 যাদবগঞ্জ এবং আশে-পাশের গ্রামাঞ্চলের লোকজনের মধ্যে এক সাড়া পড়ে গেছে। গভীর রাতে এ সন্ন্যাসীর অলৌকিক আবির্ভাব সকলের মনে জাগিয়ে তুলেছে এক বিস্ময়।

ধূমকেতুর মতই আবির্ভাব ঘটেছে এ সন্ন্যাসীর, তাই সবাই এ সন্ন্যাসীকে ধূমকেতু বাবাজী বলতে শুরু করেছে। অদ্ভুত গণনাশক্তি ধূমকেতু সন্ন্যাসীর। এ অঞ্চলের লোকজন ছাড়াও দূর দূর স্থান হতেও লোকজন আগমন শুরু করেছে তার চরণসেবায়।

কিন্তু দিনে এ সন্ন্যাসীকে দেখতে পায় না, গভীর রাতে হয় তার আগমন। সন্ধ্যা হতেই বনভূমি: মুখর হয়ে উঠে, দূর দূরান্ত থেকে আসে সব ভক্তগণ। যার যা মনোবাসনা ব্যক্ত করে ধূমকেতু বাবাজীর সম্মুখে।

সন্ন্যাসী বাবাজী যোগাসনে বসে মন্ত্র উচ্চারণ করেন এবং বলে দেন সকলের মনের কথা। রাজা-প্রজা সবাই এখানে সমান, সকলকেই মৃত্তিকা আসনে উপবিষ্ট হয়ে সন্ন্যাসী বাবাজীর হস্ত চুম্বন করতে হয়। সন্ন্যাসী বাবাজী কিছুক্ষণ ধ্যানগ্রস্তের মত তাকিয়ে থাকেন তাঁর সম্মুখস্থ ব্যক্তির দিকে, তারপর বলেন কি জন্য আগমন হয়েছে তার।

 কেউ আসে তার অসুস্থতার আরোগ্য কারণে, কেউ আসে নিঃসন্তান হয়ে সন্তান কামনায়, কেউ আসে মামলা-মোকদ্দমা ব্যাপার নিয়ে, কেউ আসে স্ত্রীর ভালবাসার জন্য তাবিজ গ্রহণে। নানা জনের নানারকম মনোবাঞ্ছনা, কিন্তু সবাইকে সন্ন্যাসী বাবাজী হাসিমুখে ঔষধ বিতরণ করে চলেছেন। কেউ চির অসহায় আসে ধনবান হওয়ার আশায়। সন্ন্যাসী বাবাজী কাউকে বিমুখ করেন না। প্রচুর অর্থদান করেন তিনি সেই অনাথ দুঃস্থ জনগণকে। দেশব্যাপী ধূমকেতু বাবাজীর সুনাম। মাত্র কদিন তাঁর আগমন, তাতেই নারুন্দী জঙ্গল লোকালয়ে পরিণত হয়েছে।

 যাদবগঞ্জের তরুণ জমিদার মধুসেনও একদিন জানতে পারলেন, তাঁর অঞ্চলের অনতিদূরে নারুন্দী জঙ্গলে এক মহান সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটেছে। সন্ন্যাসীর অদ্ভুত ক্ষমতা, যে-কোনো ব্যক্তি যে-কোনো বাসনা নিয়ে সন্ন্যাসী বাবাজীর কাছে হাজির হলে তার সে বাসনা সিদ্ধ হয়।

 মধূসেন একদিন রাতে হাজির হলেন একশত স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে সন্ন্যাসী বাবাজীর চরণতলে। সুভাষিণীকে হারানোর পর থেকে তার সংসারে শৈথিল্য এসেছে। বৃদ্ধা মা ছিলেন–তাকেও হত্যা করেছিলো নরপিশাচ মঙ্গল ডাকু। পিতা সমতুল্য শ্বশুড় মহাশয় বজ্রবিহারী রায় এবং তার স্ত্রীকেও হত্যা করেছিলো শয়তান, তাছাড়াও হত্যা করেছিলো আরও কর্মচারিগণকে। তারপর থেকে মধুসেন কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়েছিলেন।

মঙ্গল ডাকু যখন সুভাষিণী ও তাকে বেঁধে নৌকাযোগে নিয়ে যাচ্ছিলো তখন সে নৌকা থেকে নদীপথে পালিয়ে প্রাণরক্ষা করেছিলো কিন্তু বাড়ি ফিরে অনুশোচনায় মুষড়ে পড়েছিলো মধুসেন। এ বেঁচে থাকার চেয়ে না থাকাই বুঝি ছিলো শ্রেয়। কারণ তার জীবনসঙ্গিনী সুভাষিণী ডাকাত কর্তৃক লুণ্ঠিতা। যার স্ত্রী গৃহচ্যুতা তার মত কলঙ্কময় জীবন বুঝি আর কারো নেই।

 মধুসেন সুভাষিণীকে হারানোর পর অনেক সন্ধান করেছে কিন্তু কোথাও মঙ্গল ডাকুর খোঁজ পায়নি। মাধবপুরের পুলিশ বিভাগ এ ডাকুর সন্ধানে বিভিন্ন দেশে সি-আই-ডি পুলিশ নিযুক্ত করেছিলো কিন্তু শেষ অবধি ব্যর্থ হয়েছে তারা।

মধুসেন সুভাষিণীর আশা একরকম ত্যাগই করেছে, কিন্তু যতই তাকে ভুলতে চেয়েছে ততই গভীরভাবে মনে আলোড়ন জেগেছে, অসহ্য যন্ত্রণা বোধ করেছে মনে সে।

 প্রিয়ার বিরহে পৃথিবীটা যেন তার কাছে একেবারে নিরানন্দময় মনে হয়েছে, সহচরগণ বলেছে পুনরায় বিয়ে করতে। আত্মীয়-স্বজন বলেছেন ডাকাত-হরণ করা বৌ-এর চিন্তা দূর করে নতুন একজনকে গৃহলক্ষ্মী করে ঘরে আনতে। প্রজাগণ বলেছে নতুন রাণীমা এনে তাদের মনে আনন্দ দিতে। কিন্তু মধুসেন পারেনি কারো কথা রাখতে, আজও সে সুভাষিণীর প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছে। তার মন বলছে, তার সুভা ভাল আছে, বেঁচে আছে–আবার ফিরে আসবে।

কিন্তু ফিরে এলে সমাজ তাকে গ্রহণ করবে না, মধুসেন তার মহান হৃদয়ের পরিচয়ে গ্রহণ করতে পারে, সে জানে—সুভাষিণী তার এ কলঙ্কময় জীবনের জন্য দায়ী নয়। নিষ্পাপ সে, কেন তাকে বঞ্চিত করবে তার ভবিষ্যৎ জীবন থেকে।

কত কি না ভেবেছে মধুসেন কিন্তু সমাধান খুঁজে পায় নি। আজ মধুসেন একশত স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে হাজির হলো ধূমকেতু সন্ন্যাসী বাবাজীর নিকটে।

অগ্নিকুণ্ডের আলোতে মধুসেনের মুখমণ্ডল বড়ই করুণ লাগছিলো, একশত স্বর্ণমুদ্রা সন্ন্যাসী বাবার পাদমূলে স্থাপন করে করজোড়ে বললো-বাবাজী, আমার বাসনা পূর্ণ হবে কি?

 সন্ন্যাসী বাবাজী তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন মধুসেনের মুখে। দীপ্ত উজ্জ্বল হলো তার চোখ দুটো, কিছুক্ষণ চক্ষুদ্বয় মুদিত রেখে অস্ফুট গম্ভীর কণ্ঠে বললো–বৎস, তোমার বাসনা পূর্ণ হবে।

 পূর্ণ হবে? বাবাজী আমি যাকে চাই তাকে আবার ফিরে পাব?

পাবে। কিন্তু সে যেখানে আছে সেখানে কোনো মানুষ প্রবেশ করতে পারে না। কঠিন দুর্গম স্থানে তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে।

বাবাজী, তাকে কি করে পাবো তাহলে, বলুন?

বললাম তো, তাকে পাবে কিন্তু সাধনা করতে হবে তোমাকে।

যে সাধনা আমাকে করতে বলবেন তাই করবো। বাবাজী, গ্রহণ করুণ এ একশত স্বর্ণমুদ্রা।

 বৎস, আমার যোগ নষ্ট করো না। কোনো জিনিসই আমি গ্রহণ করি না।

 আমার এ স্বর্ণমুদ্রাগুলো শুধু নিন বাবাজী

সম্ভব নয় বৎস, তুমি ওগুলো ফেরত নিয়ে যাও।

তাহলে আমার বাসনা সিদ্ধ—-

 হবে।

বাবাজী—বাবাজী—

 কিন্তু তোমাকে সাধনা করতে হবে।

বলুন কি করবো?

তিন দিন, তিন রাত্রি তুমি তোমার স্ত্রীর নাম জপ করবে–আমি একটা ঔষধ দেবো, সে ঔষধ তিন দিন, তিন রাত্রির শেষ রাত্রিতে সেবন করবে।

তাহলে কি হবে বাবাজী?

ঐদিন নির্জন ঘরে তুমি একা শয়ন করবে–মনে রেখো দরজা বন্ধ করো না।

বাবাজী, আমি যদি আপনার উপদেশ পালন করি তাহলে কি আমার সুভাষিণীকে পাবো।

হ বৎস পাবে। যাও আজ থেকে সাধনা শুরু করবে, যাও। এই নাও এ বড়িটা তিন দিন, তিন রাত্রির শেষ রাতে ভক্ষণ করবে।

মধুসেন বড়িটা হাতে নিয়ে কপালে ঠেকালো।

*

 প্রতিদিনের মত আজও বনহুর শয্যা ত্যাগ করে নেমে দাঁড়ালো। বাথরুমে প্রবেশ করে ড্রেস পরিবর্তন করে নিলো, জমকালো ড্রেসে সজ্জিত হয়ে বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে।

 হরি মাথা উঁচু করে একটু দেখে নিলো। বাবুকে সে প্রতিদিন গভীর রাতে হোটেল থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছে, কোথায় যায়, আবার ভোর রাতে ফিরে আসে।

আজ হরি দেখলো, বাবু বাথরুম থেকে বেরিয়ে এগিয়ে গেলো সুভাষিণীর বিছানার দিকে। একটা রুমাল বের করলো পকেট থেকে। সুভাষিণীর নাকে রুমালটা চেপে ধরলো বাবু। তারপর সুভাষিণীর নিস্তব্ধ দেহটা তুলে নিলো হাতের উপর।

হরি শিউরে উঠলো।

বাবু তখন সুভাষিণীর সংজ্ঞাহীন দেহটা হাতের উপর নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো নিচে।

হরি আজ অপেক্ষা করতে পারলো না, সেও তার পেছনে নেমে এলো। বাবু সুভাষিণীর দেহটাকে শুইয়ে দিলো অদূরে অন্ধকারে থেমে থাকা একটা গাড়ির পিছন আসনে। তারপর সে চেপে বসলো ড্রাইভ আসনে। যেমন গাড়িতে ষ্টার্ট দিতে যাবে অমনি হরি বলে উঠলো–বাবু।

চমকে উঠলো বনহুর–কি রে হরি তুই?

 হাঁ, বাবু আমাকে সঙ্গে নিন, নইলে চেঁচাবো।

 বনহুর কি যেন ভাবলো তারপর বললো–আমার সঙ্গে গেলে তুই বিপদে পড়রি।

বয়েই গেলো, আমি বিপদকে ভয় করি নাকি?

এই নে বখশীস, তবু চেঁচাবি না, বুঝলি? বাবু পকেট থেকে এক তাড়া নোট বের করে দিতে গেলো ওর হাতে।

হরি হাত গুটিয়ে নিয়ে বললো–আমাকে সঙ্গে না নিলে আমি চেঁচাবোই—

 তা হলে ছাড়বি না?

না বাবু, আমি যাবোই—

 তবে উঠে আয়, কাজ নেই চিৎকার করে, কিন্তু মনে রাখিস্ একটু এদিক ওদিক হলেই মরবি।

বনহুরের পাশে উঠে বসলো হরি, যেন সে খুশি হয়েছে।

গাড়ি এবার উল্কাবেগে ছুটতে শুরু করলো।

 ভগবগঞ্জের জনমুখর রাজপথ এখন নির্জন নিস্তব্ধ। কে মনে করবে দিনের বেলায় এ পথে পিপীলিকা প্রবেশেও অক্ষম হয়।

বনহুর গাড়ি নিয়ে ছুটে চলেছে, হরি তার পাশে। পিছন আসনে সুভাষিণীর জ্ঞানহীন দেহ।

এত বেগে গাড়িখানা চলছিলো, অল্পক্ষণেই ভগবৎগঞ্জ শহর পেরিয়ে বাইরে এসে পড়লো তারা। হরি ঘুমে ঝিমুচ্ছিলো, ঝাঁকুনি খেয়ে সজাগ হয়ে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে গাড়ির বাইরে ছুটে চলা অস্পশয়িমান বৃক্ষলতাগুলোর দিকে।

না জানি কোথায় চলেছে বাবু কে জানে।

এক সময় বললো হরি-বাবু, দিদিমণিকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?

তার স্বামীর কাছে।

বাবু!

 হ হরি।

কোথায় যাবেন? কোথায় দিদিমণির স্বামীর বাড়ি?

এখান থেকে মাইল কয়েক দূরে মাধবপুরে।

মাধবপুর?

 হাঁ, তুই এলি কেন বলতো?

বাবু, আপনাকে ছাড়া কোথায় যাবো, আপনি আমাকে একশত করে টাকা দেন, এতো টাকা আর তো কেউ দেবে না বাবু।

পারবি আমার সঙ্গে থাকতে?

কেন পারবো না বাবু? সব পারবো।

আমার সঙ্গে থাকবি কিন্তু একটি কথাও কাউকে বলবি না।

না না, এই যে কান ধরে বলছি, বলবো না–বলবো না বাবু।

 বেশ তবে চুপ চাপ বসে থাক।

 বাবু, এ গাড়িখানা কার?

বেশি প্রশ্ন করবি না।

আচ্ছা বাবু।

গাড়িখানা নানারকম উঁচু নীচু পথে এখন চলেছে। শহর ছেড়ে নির্জন পথ, তারপর প্রান্তর, প্রান্তরের পর গ্রাম।.।

বনহুর বললো-এটাই হলো মাধবপুর গ্রাম, এর পরেই যাদবগঞ্জ।

 হরি অবাক হয়ে বললো যাদবগঞ্জ সে কোন গ্রাম?

তোর সুভা দিদির স্বামীর বাড়ি।

 এক সময় যাদবগঞ্জে পৌঁছে গেলো গাড়িখানা। একটা পুরোন জমিদার বাড়ির সম্মুখে গাড়ি রাখলো বনহুর। তখন শেষ প্রহর রাত।

বনহুর সুভাষিণীর দেহটা হাতের উপর তুলে নিলো, তারপর সদর গেট পেরিয়ে প্রবেশ করলো অন্তঃপুরে।

হরিকে গাড়িতে বসে থাকতে বললো বনহুর।

হরি কিন্তু বনহুরের কথা না শুনে চুপি চুপি অনুসরণ করলো বনহুরকে।

বনহুর সুভাষিণীর সংজ্ঞাহীন দেহটা নিয়ে এগিয়ে চলেছে–পরপর কয়েকটা গেট পেরিয়ে অন্তঃপুরে প্রবেশ করলো সে। চারদিক নিস্তব্ধ, সমস্ত বাড়িটা নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছে যেন ঘুমন্ত রাজপুরী।

জমকালো ড্রেসে সজ্জিত বনহুর এগুচ্ছে, তার হস্তদ্বয়ের উপর সুভাষিণীর সংজ্ঞাহারা দেহ। ওদিকের বড় ঘরটার দরজায় দাঁড়িয়ে পা দিয়ে ঠেলে দিলো, সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেলো। বনহুর প্রবেশ করলো ভিতরে।

সুন্দর সুসজ্জিত কক্ষ।

দুগ্ধ-ফেননিভ শুভ্র বিছানায় অঘোরে ঘুমাচ্ছে মধুসেন। সন্ন্যাসীর দেওয়া ঔষধ সে আজ ভক্ষণ করেছে। তাই সে ঘুমে অচেতন।

বনহুর সুভাষিণীর সংজ্ঞাহীন দেহটা নিয়ে মধুসেনের খাটের পাশে এসে দাঁড়ালো, আলগোছে শুইয়ে দিলো সে তার স্বামীর পাশে।

আড়ালে আত্মগোপন করে সব দেখলো হরি, বাবুর প্রতি শ্রদ্ধায় নত হয়ে এলো তার মাথাটা। বাবু বেরিয়ে আসার পূর্বেই সে গাড়িতে গিয়ে বসলো, মিছামিছি আসনে ঠেস দিয়ে বসে ঝিমুতে, লাগলো।

ফিরে এলো বনহুর, হরিকে গাড়ির মধ্যে দেখে বললো-হরি!

চমকে জেগে উঠার ভান করে সোজা হয়ে বসলো হরি–বাবু আপনি ডাকছেন?

 ঘুমিয়ে পড়েছিস্?’,

না বাবু, একটু ঝিমুচ্ছিলাম।

 চল্।

কাজ শেষ হয়েছে? মানে দিদিমণিকে তার স্বামীর কাছে—

 হাঁ পৌঁছে দিয়েছি।

কিন্তু আমি কিছু বুঝতে পারছি না বাবু?

অতো বুঝে তোর কাজ নেই, চুপ চাপ শুধু দেখে যা।

*

বনহুর ফিরে এলো হোটেলে তখন ভোর হয়ে গেছে।

শূন্য কক্ষে প্রবেশ করে বনহুর মাথার পাগড়িটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিলো বিছানার উপর, তারপর বসে পড়লো শয্যায়। তার মুখে ফুটে উঠেছে এক তৃপ্তির ভাব, কাজ শেষে ক্লান্ত শ্রমিক যেমন মুক্তির নিশ্বাস ত্যাগ করে তেমনি।

হরি বললো–বাবু, চা তৈরি করবো?

অন্যান্যদিন এতোক্ষণ সুভাষিণী চা, জলখাবার তৈরি করে ডাকাডাকি শুরু করে দেয়, আজ সুভা নেই–বনহুরের চোখ দুটো তার অজ্ঞাতেই ছলছল করে উঠলো। মুখটা ফিরিয়ে হরির কাছে আত্মগোপন করে নিয়ে বললো–চা করতে পারবি হরি?

পারবো বাবু।

তবে কর, আমি কাপড়-চোপড় পাল্টে ফেলি।

 হরি স্টোভ ধরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

 বনহুর জামা-কাপড় পাল্টে, হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় এসে বসে।

হরি চা আর এক থালা গরম পুরি-তরকারী এনে সম্মুখে রাখে–বাবু, খেয়ে নিন।

বনহুর সম্মুখস্থ টেবিলে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে–এতো করলি কখন?

হাতের মধ্যে হাত কচলায় হরিবাবু, ঘরে সব ছিলো-ময়দা, ধি, আলু, পোটল চটপট করে নিয়েছি। এবার খেয়ে নিয়ে ঘুমান।

 হাঁ, ঘুমাবো। বনহুর নাস্তার থালা টেনে নিয়ে খেতে শুরু করে। সারা রাত্রির পরিশ্রান্ত বনহুর তৃপ্তি সহকারে খায়। খাঁটি ঘিয়ে টাকা ভাজা গরম পুরি আর আলু পটলের ভাজি বড় খাসা লাগে তার কাছে। খেতে খেতে বলে বনহুর-হরি, সত্যি তুই এতো সুন্দর রান্না করতে পারিস আগে জানতাম না। |

 বাবু, মায়ের কাছে সব শিখে নিয়েছি। বিদেশ বিভুয়ে থাকি, পরের বাড়ি খেটে খেতে হয়। সব না জানলে লোকে মাইনে দেবে কেন?

হরি টাকার প্রয়োজন হলে বলবি? মাকে টাকা পাঠিয়ে দিবি, বুঝলি?

আচ্ছা বাবু।

বনহুরের নাস্তা খাওয়া হয়ে গিয়েছিলো, হরি ততক্ষণে এককাপ গরম চা এনে তার সম্মুখে রাখে।

বনহুর চায়ের কাপ তুলে নেয় হাতে।

 বাবুকে চা-নাস্তা খাইয়ে হরি বাজারের থলে হাতে এসে দাঁড়ালোবাবু, টাকা দিন, আমি এ বেলা বাজার সেরে আসি।

হেসে বললো বনহুর–তুই দেখছি সংসার পেতে বসলি। কি দরকার ছিলো রান্না করার হোটেল থেকে আনলেই পারতিস্?

 তা হয় না বাবু, আপনি তো জানেন না তীর্থস্থানের হোটেলের পাক কেমন–একেবারে বিশ্রী, খাবারগুলো যেন গরুর জাবর। মাছি উড়ছে বন বন করে, দেখলেই ঘেন্না হয়। হঠাৎ কি অসুখ বিসুখ করে বসবে কে জানে। রোজ তো কলেরা আর বসন্ত লেগেই আছে এসব শহরে—

 হরি যেন পাকা গিন্নীর মত কথাগুলো বলে চলেছে। বনহুর পকেট থেকে কয়েকটা টাকা বের করে হাতে দেয়–যা, খুশিমত দরকারী জিনিসপত্র নিয়ে আয়।

বাজারের থলে হাতে বেরিয়ে যায় হরি।

বাজার করে ফিরে আসতে একটু বিলম্ব হয়ে যায় হরির, কারণ তীর্থযাত্রীদের ভিড়ে বাজার করাটা একটা সমস্যা। অনেক কষ্টে দরকারী জিনিসগুলো কিনে নিয়েই চলে এসেছে সে–আজ। সুভা দিদিমণি নেই, পাক করতে হবে তাকেই।

ঘরে ঢুকেই অবাক হলো হরি, দেখলো বাবু খাটে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে, তার কোলের উপর বইখানা খোলা পড়ে আছে।

 হরি বুঝতে পারলো গোটারাতের অনিদ্রায় বাবুর চোখে ঘুম জেকে বসেছে। বাজারের থলেটা রেখে হরি সরে এলো। বাবুর মাথার নিচে বালিশটা ঠিক করে দিয়ে একটা চাদর চাপা দিলো তার দেহে। বইখানা বন্ধ করে টেবিলে রাখলো।

হরি ব্যস্ত হয়ে পড়লো রান্নার কাজে হাত পুড়ে ফেললো, কেটেও গেলো মাছ কুটতে খানিকটা, তবু সে ক্ষান্ত হলো না, দ্রুত হাত চালিয়ে পাক শেষ করে নিলো।

 রান্না প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, এমন সময় পাশ ফিরতে গিয়ে ঘুম ভেঙে গেলো বনহুরের, সোজা হয়ে বসলো ধড়ফড় কিন্তু একি, তার মাথার তলায় বালিশ দিলো কে, চাদরখানাই বা গায়ে এলো কি করে। বনহুর তাকালো–ঘরের ওপাশে হরি তখন রান্না নিয়ে মেতে উঠেছে।

 বনহুর চাদর সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো, বুঝতে পারলো এ সব হরির কাজ। একটা মায়ার উদ্বেগ হলো বনহুরের মনে, ছোকরা তাহলে তাকে শুধু শ্রদ্ধাই করে না–ভালও বাসে।

বনহুর হরির পিছনে এসে দাঁড়ালো–কি করছিস হরি?

চোখেমুখে কালি লেগেছে, হাতে মরিচ-বাটা, ফিরে তাকালো বাবু, সব হয়ে গেছে, আপনি স্নান করে আসুন,শুধু বড়াটা ভাজবো।

সে কিরে, এরি মধ্যে সব বেঁধে ফেলেছিস? তুই তো দেখছি বড় কাজের লোক। আরে! আংগুলে কি হয়েছে?

হরির আংগুল কেটে গিয়েছিলো, খানিকটা ন্যাকড়া দিয়ে বেঁধে নিয়েছিলো সে আংগুলটাকে। হাতখানা লুকাতে চেষ্টা করে বললো–কিছু না।

দেখি দেখি—- বনহুর ওর হাতখানা ধরে ফেললো।

হরি লজ্জিত হয়ে বললোগরিব মানুষ আমরা, অমন কত কেটে থাকে।

বনহুর আংগুলে ঔষধ লাগিয়ে বেঁধে দিলো যত্ন সহকারে।

 বাথরুমে স্নান করতে প্রবেশ করলো বনহুর।

হরি ততক্ষণে খাবার তৈরি করে টেবিলে সাজিয়ে রাখলো।

খেতে বসে বললো বনহুরহরি, এখানে আর মাত্র কটাদিন আছি, তারপর চলে যাবো সত্যি মনে থাকবে তোর কথা।

বাবু, আমার তো কেউ নেই, আমাকে সঙ্গে নিলে হয় না?

কেন রে, তোর মা আছে না? মাকে ছেড়ে আমার সঙ্গে যাবি?

বাবু মিছে কথা।

 মিছে কথা? তার মানে?

বাবু আমার কেউ নেই।

তবে যে বলিস দেশে তোর মা আছে?

ও কথা না বললে লোকে আমাকে মাইনে দেয় না। বলে কি জানেন বাবু?

কি বলে?

বলে মাইনে নিয়ে কি করবি? চিরদিন আমাদের এখানে থাক–তোকে বিয়েথা করিয়ে সংসারী করবো। শুধু খাটবি, আর খাবি, পারবি-বাস্। বলুন তো বাবু, আমার পয়সার দরকার হয় না?

ওঃ তাই বুঝি মায়ের কথা বলে—

 হাঁ বাবু, আপনি তো আমাকে ঠকাবেন না, তাই সত্যি কথা বললাম।

সত্যি কথা বললি–এখন থেকে আমি যদি তোকে মাইনে না দেই?

আপনি আমাকে ফাঁকি দেবেন না জানি বাবু।

তার উপরে হরির বিশ্বাস দেখে মুখ টিপে হাসলো বনহুর। মনে মনে ভাবলো, যে ক’দিন। এখানে আছে থাক তারপর কিছু টাকা দিয়ে সরে পড়তে হবে, না হলে এদেশে একে নিয়ে কি করবে সে।

হরি কিন্তু একেবারে নিজের মত মনোযোগ দিয়ে কাজকর্ম করতে লাগলো–কিসে বাবু সন্তুষ্ট থাকবে, কিসে তার কোনো অসুবিধা হবে না, এ দিকে সর্বদা খেয়াল তার।

বাইরে যাবার সময় হরি তাকে জামা-কাপড় এগিয়ে দেয়, জুতো ব্রাশ করে দেয়, সিগারেট বাক্সটা পর্যন্ত এগিয়ে দেয় সে তার হাতে। আবার বাইরে থেকে ফিরে এলে নিজের হাতে বাবুর জামা-কোট খুলে নেয়, এমনকি জুতোটাও সে খুলে নেয়।

বনহুর হেসে বলে–এতো করিস হরি তুই আমার জন্য! তোর মায়া দেখছি ছাড়া মুস্কিল।

হরি শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।

*

মধুসেন জেগে উঠতেই পাশে সুভাষিণীকে নিদ্রিত অবস্থায় দেখে শুধু বিস্মিতই হলো না, আনন্দে আপ্লুত হয়ে উঠলো, তার সাধনা তাহলে ব্যর্থ হয়নি। মধুসেন তার প্রিয়তমা পত্নীকে জড়িয়ে ধরলেন বুকে–সুভা, সুভা—

 ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো সুভাষিণী, প্রথমে সে মনে করলো স্বপ্ন দেখছে কিন্তু পরক্ষণেই সে বুঝতে পারলো স্বপ্ন নয় সত্য। একি, তার স্বামীর বাহুবন্ধনে সে এলো কি করে! অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সুভাষিণী।

মধুসেন আবেগভরা কণ্ঠে বললো–সুভা, অমন করে তাকিয়ে আছে কেন? আমাকে চিনতে পারছো না?

হাঁ পারছি, কিন্তু আমি কোথায় এখন?

 তোমার স্বামীর বাড়ি যাদবগঞ্জে।

আমি যাদবগঞ্জে? কি করে এলাম আমি এখানে?

সব সেই ধূমকেতু সন্ন্যাসী বাবাজীর কৃপায়। সুভা, তোমাকে যে ফিরে পাবো সে আশা আমার ছিলো না। ভগবানের দয়া আর সন্ন্যাসী বাবাজীর সাধনায় তোমাকে লাভ করলাম।

কিন্তু আমি এখানে এলাম কি করে?

বললাম তো, সব সেই সন্ন্যাসী বাবাজীর দয়া। সুভাষিণী–আমার সুভা, তোমাকে হারিয়ে আমি বিশ্ব অন্ধকার দেখছিলাম।

সুভাষিণী বললো–আমাকে তুমি-গ্রহণ করেছো এ যে আমার পরম সৌভাগ্য।

সুভা, ভুলে যাও সব কথা, আমার কাছে তুমি অপবিত্র নও কারণ তুমি নিজের দোষে নয়, দৃষ্কৃতি শয়তানের দোষে কুলহারা গৃহত্যাগী হয়েছিলে–তোমাকে আমি কোনোদিন অবহেলা করবো না।

সুভাষিণীর কাছে সন্ন্যাসীর সব কথা ব্যক্ত করে মধুসেন, বলে, আমি তাকে একশত স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করতে চেয়েছিলাম কিন্তু তিনি গ্রহণ করেননি। সুভা, তিনি মানুষ না–দেবতা।

 সব বুঝতে পারে সুভাষিণী, সন্ন্যাসী বেশে দেবতা কে তা তার কাছে অজ্ঞাত থাকে না।

মধুসেন বলে–সুভা, তোমাকে পেয়েছি–এ যে আমার কত বড় আনন্দ! আজ রাতে আমি, আর তুমি যাবো তার চরণ দর্শনে। যাবে সুভা?

যাবো, যার দয়ায় আমাদের এ মিলন তার চরণে প্রণাম না করে আমি যে স্বস্তি পাবো না।

সমস্ত দিন ধরে সুভাষিণী ভাবলো, কত কথাই না মনে পড়লো তার। সেই ঝাঁম জঙ্গলের ভূগর্ভস্থ আস্তানা–তার বন্দী অবস্থা–মঙ্গল ডাকুর নির্মম অকথ্য অত্যাচার-হঠাৎ একদিন তার রক্ষাকারী বেশে বনহুরের আবির্ভাব-অন্যান্যের সঙ্গে তাকেও উদ্ধার–তারপর ঝাঁম শহরে নতুন করে পরিচয় লাভ বনহুরের সঙ্গে পরে তাকে নিয়ে ভগবগঞ্জে আগমন-হোটেলে আশ্রয় সেখানের দিনগুলো আজ গভীরভাবে তার মনে উদয় হতে লাগলো।

 গভীর রাতে নারুন্দী জঙ্গলের অভ্যন্তরে জ্বলে উঠলো অগ্নিকুণ্ড দপ দপ করে। অগ্নিকুণ্ডের পাশে ব্যাঘ্র চামড়ায় উপবিষ্ট এক তেজোদ্দীপ্ত জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ।

অগণিত ভক্ত পরিবেষ্টিত সন্ন্যাসী বাবাজী চক্ষুদ্বয় মুদিত করে মহামন্ত্র উচ্চারণ করে চলেছে।

মধুসেন আর সুভাষিণী করজোড়ে সন্ন্যাসী বাবাজীর চরণতলে উপস্থিত হলো।

মধুসেন বললো–বাবাজী, চক্ষুদ্বয় মুক্ত করুন, দেখুন আমি সুভাষিনীকে ফিরে পেয়েছি।

সন্ন্যাসী বাবাজীর চক্ষুদ্বয় উন্মোচিত হলো, তাকালেন তিনি সম্মুখস্থ ভক্তদের দিকে। মধুসেনের পাশে উপবিষ্টা শুভ্রবসনা ললাটে সিঁদুরের আলপনা দু’চোখ মুদিত সুভাষিণীকে দেখতে পেলেন। সুভাষিণীর গণ্ড বেয়ে অশ্রুর বন্যা বয়ে চলেছে। করজোড়ে বসে আছে সে সন্ন্যাসী বাবাজীর সম্মুখে।

সন্ন্যাসী বাবাজী বললেন–বৎস, আশীর্বাদ করি তোমাদের বাসনা পূর্ণ হউক।

মধুসেন এবার বললো—চলো সুভা ফিরে যাই?

সুভা সন্ন্যাসীর চরণধুলি মাথায় নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মদুসেনের সঙ্গে ফিরে যায় সে নিজ বাড়িতে।

শয্যায় শয়ন করেও ঘুমাতে পারে না সুভা।

মধুসেন ঘুমিয়ে পড়েছে তার পাশে।

নিঝুম হয়ে পড়েছে এখন সমস্ত বাড়িখানা। প্রহরীরাও ঘুমিয়ে পড়েছে নিজ নিজ খাটিয়ায়।

সুভাষিণী শয্যা ত্যাগ করে নেমে দাঁড়ায়, এলায়িত কেশরাশি, বেরিয়ে আসে বাইরে, মন্দিরের দরজা খুলে ফুলের ডালা তুলে নেয় হাতে, তারপর দ্রুত এগিয়ে চলে তাদের বাড়ির অনতিদূরে নারুন্দী জঙ্গল অভিমুখে।

সন্ন্যাসী তখনও ধ্যানমগ্ন।

 সম্মুখে তার অর্ধ-নির্বাপিত অগ্নিকুণ্ড।

ভক্তের দল চলে গেছে নিজ নিজ আবাসে।

এলায়িত চুল, শুভ্র বসন হস্তে ফুলের ডালা সন্ন্যাসীর পাদমূলে এসে করজোড়ে বসলো।

 চমকে উঠলো সন্ন্যাসী, কিন্তু কোনো মন্ত্র উচ্চারণ করলো না। সুভাষিণী ফুলগুলো সন্ন্যাসীর চরণতলে ঢেলে দিয়ে বললো– নিষ্ঠুর দেবতা, কাজ তো শেষ করেছো, কেন আবার ছলনা? অনেক ব্যথা দিয়েছে, আর সহ্য করতে পারি না দেব।

সন্ন্যাসীর কণ্ঠ গম্ভীর–সুভা।

না না, আর তুমি এসো না।

সুভা, তোমার মঙ্গল কামনাই যে আমার ব্রত, আমার ধর্ম।

বেশ, তোমার ধর্ম তুমি পালন করেছে আমাকে তুমি শাস্তি দিতে পারবে না।

 শাস্তি?

হাঁ, নারুন্দী বনে আর তুমি আসবে না। তোমার আগমনে আমি উন্মাদিনী হয়ে উঠি। মনকে আমি কিছুতেই ধরে রাখতে পারি না।

সুভা, ভুলে যাও সব কথা ভুলে যাও।

না না, আমি কোনোদিন তোমাকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারবো না।

ছিঃ তুমি বড় অবুঝ হচ্ছো সুভা, দস্যু বনহুরকে কেউ কোনো দিন মনে স্থান দিতে পারে না, যারা তাকে ভালবেসেছে তারাই ভুল করেছে। যাও, যাও সুভা, স্বামীকে ভালবেসে নারীধর্ম সার্থক করো।

সুভাষিণী আঁচলে অশ্রু মুছে উঠে দাঁড়ালো।

*

হরি, সব গুছিয়ে নে, এবার যেতে হবে।

 কেন বাবু, কাজ শেষ হয়েছে?

হা রে, কাজ শেষ হয়েছে।

বাবু, আমিও যাবো আপনার সঙ্গে।

আমার সঙ্গে তোর খুব কষ্ট হবে কিন্তু।

সব আমি সইতে পারি।

 বনহুর ভাবলো, এমন একটা ছেলে তার সঙ্গে থাকলে মন্দ হয় না। তাছাড়া হরি বেশ চাপা ছেলে, আজ পর্যন্ত তার কত বিস্ময়কর কার্যকলাপ লক্ষ্য করেছে কিন্তু একটি কথাও সে কারো কাছে প্রকাশ করেনি।

সত্যিই হরি ছিলো অত্যন্ত বিশ্বাসী আর প্রভুভক্ত।

শেষ পর্যন্ত বনহুর হরিকে সঙ্গে নিতে বাধ্য হলো।

জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নিয়ে বললো হরিবাবু, এবার কোথায় যাবেন?

বনহুর একটু চিন্তা করে বললো-পূর্ব পাকিস্তানে।

অবাক হয়ে বললো হরিবার, পূর্ব পাকিস্তান সেতো মুসলমানের দেশ?

 হাঁ, পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্রই বটে। বললো বনহুর।

*

একদিন বনহুর আর হরি ঢাকা তেজগা বিমান বন্দরে এসে পৌঁছলো। চাকা বনহুরের কাছে সম্পূর্ণ নতুন দেশ। এখানের লোকজন সবাই তার অপরিচিত, কাউকে সে চেনে না, কেউ তাকেও জানে না।

বনহুরের হস্তে এ্যাটাচী ব্যাগ আর হরির হস্তে স্যুটকেস।

এরোড্রাম থেকে বেরিয়ে এলো বনহুর আর হরি। নতুন শহরটা নিপুণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। বনহুরের দেহে স্যুট, চোখে গগলস্। পথের ধারে এসে দাঁড়ালো, অগণিত ট্যাক্সি, বাস, ট্রাক, বেবী ট্যাক্সি ছুটে চলেছে।

একটা ট্যাক্সি নিয়ে বনহুর ও হরি ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে এসে উঠলো। ঢাকা শহরের প্রখ্যাত হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। ম্যানেজার বনহুরের চেহারা দেখে তাকে মস্ত বড় একজন অফিসার মনে করলেন। এখানে সমাদরের কোনো অভাব ছিলো না, কাজেই বনহুরের অসুবিধা হলো না কিছু।

 পরিচ্ছন্ন সুন্দর মডার্ণ প্যাটার্ণের হোটেল, আগন্তুকদের রিসেপশন কারণে শিক্ষিত মার্জিত যুবকগণ সদা ব্যস্ত রয়েছেন। বয়-দারওয়ান–এ সবেরও অভাব নেই। সুন্দর সুসজ্জিত কামরাগুলো আগন্তুকদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে যার-যার নাম্বার অনুযায়ী কক্ষ উন্মোচন করে দেওয়া হচ্ছে।

বনহুর পৌঁছতেই রিসেপশনিষ্ট তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে তার কামরায় নিয়ে গেলো।

 কক্ষে প্রবেশ করে বনহুর তৃপ্তির নিশ্বাস ত্যাগ করলো। ঢাকায় এসে এমন একটা সুন্দর হোটেল পাবে, ভাবতে পারেনি সে।

 প্রথম দিনই বনহুর হোটেলের ম্যানেজারের সঙ্গে ভালভাবে পরিচয় করে ভাব জমিয়ে নিলো। ম্যানেজার অত্যন্ত সৎ ব্যক্তি। তিনি বনহুরের ব্যবহারে মুগ্ধ হলেন। হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে, বিদেশ থেকে কত লোকই আসেন, চলে যান, তেমন করে কারো সঙ্গে আলাপ করার সময় হয় না তাঁদের।

বনহুর গায়ে পড়ে ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ করে নিলো। ম্যানেজারও প্রীতি বোধ করলেন বনহুরের সঙ্গে পরিচিত হয়ে।

প্রথম দিন বনহুর ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে এলো একবার। অবশ্য হরিও ছিলো তার সঙ্গে। ম্যানেজারের সহায়তায় একখানা গাড়ি কিনে ফেললো সে, নতুন ওপেল কার।

বনহুর প্রথম দিনই ঢাকা শহরের ভাবধারা বুঝে নিলো। বড় বড় নামকরা রাজপথ ছাড়াও সে। প্রতিটি অলিগলিও ঘুরেফিরে দেখে নিলো তার ওপেল কার নিয়ে। মস্তবড় অট্টালিকার পিছনে যে। নিকৃষ্ট কুড়েঘর আছে সেগুলোও তার চোখে বাদ পড়লো না। বাদ পড়লো না পথের ধারে ধুকে মরা জীব নামের মানুষগুলো। হসপিটালের সম্মুখ দিয়ে যাওয়ার সময় তার নজরে পড়লো, ফুটপাতের উপর পড়ে আছে একটি কঙ্কালসার অসুস্থ যুবক। গাড়ির স্পীড কমিয়ে দিয়ে লক্ষ্য করলো বনহুর, লোকটার মাথার নিচে একটি ছেঁড়া কাথা জড়ানো, পাশেই পড়ে আছে একটা ধানকাটা কাচি আর ঘাস তোলার খুরপাই। বনহুর বুঝতে পারলো, লোকটা একজন মজুর। এই শস্য-শ্যামলা পূর্ব পাকিস্তানেও মজুরের এ অবস্থা? এক মুঠি অন্নের জন্য সে তিলতিল করে ধুকে মরছে, হয়তো বা কাজের অন্বেষণে দ্বারে দ্বারে ফিরে কোনো কাজ পায়নি, কেউ দেখেনি, সে কদিন না খেয়ে আছে। ভিখারী নয় সে, তাই চেয়ে নেবার মত মনোবল ছিলো না। হয়তো চেয়েও ছিলো-ধমকে দিয়েছেন স্বনামধন্য বাবুর দল, বেটা খেটে খেতে পারিসনে। কেউ বা বলেছেন জোয়ান ছোকরা ভিক্ষা চাস, লজ্জা করে না? কিন্তু কেউ কি ভেবে দেখেছে কাজ সে সারাদিন খুঁজেও পায়নি।

হয়তো পথের ধারে কলের পানি পান করে ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করেছে, কিন্তু অগণিত কলসীর ভিড়ে সে পৌঁছতে পারেনি কলটার পাশে। হোটেলের পাশে ডাষ্টবিনে উচ্ছিষ্ট খাদ্যের অন্বেষণে হয়তো বা হাতড়ে ফিরেছে, কিন্তু অসংখ্য ক্ষুধার্ত কুকুরের জ্বালায় ভয়ে পালিয়ে এসেছে। একদিন নয়, দু’দিন নয় ক’দিন মানুষ উপোস করে কাটাতে পারে। ক্ষুধা নিবারণে অখাদ্য ভক্ষণ করেছে, যার জন্য সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে কিংবা ক্ষুধার জ্বালায় দিন দিন দুর্বল শক্তিহীন হয়ে মরণের পথে এগিয়ে গেছে। ভেবেছে হসপিটালে ভর্তি হয়ে জীবনে বেঁচে যাবে, কিন্তু চিরদুঃখী অসহায়ের জন্য হসপিটাল নয়। হসপিটালে সিটের অভাবে তাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। চলৎশক্তি রোহিত তখন সে, কাজেই কোথায় যাবে–ফুটপাতে পড়ে রয়েছে জ্ঞানশূন্য অবস্থায়। বন্ বন্ করে মাছি উড়ছে, কতগুলো মাছি প্রবেশ করছে লোকটার হা করা মুখ-গহ্বরে। বনহুর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে দিলো।

হরি কি যেন বললো কানে গেলোনা বনহুরের, কারণ তখন সে তার মনের মধ্যে চিন্তার জাল বুনে চলেছে। সে ভেবেছিলো শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় ধুকে ধুকে মরে না কিন্তু সে ভুল তার ভেঙে গেছে। প্রথম যেবার বনহুর বাংলাদেশের মাটি কলকাতায় পদার্পণ করেছিলো, দেখেছিলো ইট পাথরের ইমারতের পাশে এক ভয়ংঙ্কর পরিবেশের নির্মম পরিণতি। যেখানে মানুষ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। দেখেছিলো মানুষ হয়ে মানুষের বুকের রক্ত কেমন করে শুষে নেয়। দেখেছিলো মানুষনামী কতগুলো প্রাণী রাজভোগে ক্ষুধা নিবারণ করে, আর তাদের উচ্ছিষ্ট নিয়ে ডাষ্টবিনের পাশে কাড়াকাড়ি করে কতগুলো জীব।

বনহুর আজ ঢাকা শহরের বুকেও লক্ষ্য করে তারই প্রতিচ্ছবি।

এই বুঝি সোনার পূর্ব পাকিস্তান?

ওয়াইজঘাটে নদীর ধারে গাড়ি রেখে নেমে এলো বনহুর। হরি তার পিছনে, এগিয়ে চলেছে বনহুর সদরঘাটের দিকে। অসংখ্য জনতা ভিড় করে জিনিসপত্র বেচা-কেনা করছে। কেউ কারোদিকে তাকিয়ে দেখার অবসর নেই।

বনহুর প্রতিটি দোকানের দিকে লক্ষ্য করে, লক্ষ্য করে কেমনভাবে এরা বেচা-কেনা করছে। বনহুরের দীপ্ত সুন্দর চেহারা প্রায় জনেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলো, দোকানিগণ উচ্চকণ্ঠে তাকে, আহ্বান জানাচ্ছিলো–সাহেব, আসুন ভাল শাড়ি আছে। কোনো দোকানী বা তাকে দেখে এগিয়ে দিচ্ছিলো মূল্যবান প্যান্টের কাপড়–নিন সাহেব, আসল দামেই দেবো, লাভ রাখবো নাঃ এক পয়সা।

বনহুর মাথা নাড়লো-ওসব প্রয়োজন নেই।

 ভিতরে প্রবেশ করে দেখলো নানা রকম শাড়ি-জামা-ব্লাউজের দোকান। জুতোর দোকান, মনোহারী দোকান–এগিয়ে চললো বনহুর আরও ভিতরে অনেকগুলো দর্জি সেলাই মেসিন চালিয়ে অনবরত কাজ করে চলেছে। বনহুরকে দেখে ক্ষণিকের জন্য তারা অবাক হয়ে তাকালো। বনহুর আরও ভিতরে প্রবেশ করলো, কতগুলো হোটেলের পিছনভাগ সেটা। কি ভয়ঙ্কর নোংরা, কর্দমযুক্ত জায়গা। এদিকটা এতো নোংরা প্রথমে ভাবতেই পারেনি বনহুর। একটা হোটেলের পিছনে কতগুলো উচ্ছিষ্ট হাড় নিয়ে কয়েকটা নেংটা বালক কাড়াকাড়ি মারামারি করছে। মাছি উড়ছে বন বন করে। কুকুর গুলোও যোগ দিয়েছে বালকগুলোর সঙ্গে।

 বনহুরকে দেখে এসব অঞ্চলবাসী নিকৃষ্ট মানুষগুলো অবাক হলো। এদিকে তো বড়লোক সাহেব বাবুরা বড় একটা আসেন না। তাই ওদের মনে এতো বিস্ময়।

 হরি বললো–বাবু, দুর্গন্ধে আমার পেটের নাড়ীভুড়ি বেরিয়ে আসছে।

 বনহুরের অবস্থাও তাই, কিন্তু সে দেখতে চায়–ঢাকা শহরের চাকচিক্যময়ের পিছনে অন্ধকারের রূপ কেমন।

এদিকে তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।

বনহুর বেরিয়ে আসে সদরঘাটের ভিতর অংশ থেকে।

সরু নোংরা গলির মধ্যদিয়ে বনহুর যখন ঘাটের দিকে এগুচ্ছিলো তখন হঠাৎ নজরে পড়লো দু’জন লোক একটি বালককে হাত ধরে দ্রুত নিয়ে চলেছে। বনহুর থমকে দাঁড়ালো। লোক দুটো ঠিক তার পাশ কেটেই চলে যাচ্ছে সন্ধ্যার ঝাপসা অন্ধকারে। ওদিকে থেমে থাকা একটা মালবাহী ষ্টীমারের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলোলোক দুটো বালকটিকে নিয়ে।

 বনহুরের মনে সন্দেহ জাগলো, নিশ্চয়ই ওরা ভাল মানুষ নয়। কোনো ভদ্রলোকের সন্তান ওরা। চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। ছেলে ধরা, ঠিক ছেলে ধরাই হবে।

প্রতিদিন রেডিও ঘোষণায় শোনা যায় অসংখ্য ছেলে হারানো সংবাদ।

বনহুর মুহূর্ত ভেবে নেয়, এক্ষুণি ছেলেটিকে বাঁচিয়ে নিতে হবে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়, যদি ওরা ছেলে ধরা না হয় তাহলে অপদস্ত হবে। আচ্ছা, ওরা যদি সৎ ব্যক্তিই হবে তাহলে অমন করে চোরের মত পালাবে কেন, বনহুর ইচ্ছা করলেই ছেলেটিকে উদ্ধার করে নিতে পারে কিন্তু তা করলো না, সে চায় দেখতে সত্যিই ওরা ছেলে ধরা কিনা এবং এক জনকে নয়, ওদের সমস্ত দলকে ধরতে। হয়তো বা ওদের কবলে আছে এমনি আরও অনেক ছেলেমেয়ে।

বনহুর হরিকে গাড়ির চাবি দিয়ে বললো–হরি, আমি ওদের ফলো করবো, নিশ্চয়ই ওরা ছেলে ধরা।

আর আমি?

তুই গাড়ি খুলে ওর মধ্যে বসে থাকবি।

বাবু, একা একা আমি থাকবো—

আমি ওদের সন্ধান নিয়ে এক্ষুণি ফিরে আসছি, ষ্টীমারখানা ছাড়তে বিলম্ব আছে কিনা দেখে আসবো শুধু।

আচ্ছা বাবু। হরি বনহুরের হাত থেকে চাবি নিয়ে এগিয়ে যায় গাড়ির দিকে। কেমন যেন একটা আশঙ্কায় কেঁপে উঠে হরির বুক।

 বনহুর ততক্ষণে এগিয়ে যায় ওদিকে অন্ধকারে থেমে থাকা ষ্টীমারখানার দিকে। একটু পরে ফিরে আসে বনহুর-হরি, ষ্টীমারখানা ছাড়তে বিলম্ব হবে বলে মনে হলো। আমি ততক্ষণে তোকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসতে পারবো।

হরি চট করে কোনো জবাব দিতে পারলো না। আর কিই বা জবাব দেবে বোবা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো।

বনহুর দ্রুত ড্রাইভিং আসনে চেপে বসলো। তারপর গাড়ির মুখ বুলবুল একাডেমীর রাস্তার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি পাটুয়াটুলী রোড হয়ে লিয়াকত এভিনিউ ধরে ছুটতে শুরু করলো।

 এতো ভিড়ের মধ্যে স্পীডে গাড়ি ছুটে চলেছে, বার বার সে তাকাচ্ছে তার হাতের রেডিয়াম হাতঘড়িটার দিকে। অন্ধকারে বনহুরের কাজ–এ ঘড়িটা তাকে সর্বক্ষণ সাহায্য করে থাকে।

অল্পক্ষণেই বনহুর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পৌঁছে গেলো। গাড়ি রেখে বনহুর প্রবেশ। করলো ভিতরে, হরি তাকে অনুসরণ করলো। হরির্কে রেখে বনহুর যখন ফিরে এলো পুনরায় সদরঘাটে তখন বনহুরকে চিনবার জো নেই। তাকে দেখলে একজন খালাসী বা কুলি ছাড়া কিছু মনে হবে না।..

বনহুর নদীর তীরে এসে দাঁড়াতেই দেখতে পেলো ষ্টীমারখানা সবে ঘাট ত্যাগ করে মাঝনদীর। দিকে এগুচ্ছে। আর একটু আগে এলেই তার কাজ সমাধা হতো। এখন কি করা যায়–বনহুর মুহূর্ত ভেবে নিয়ে নেমে পড়লো নদীর পানিতে। যেমন করে হোক ষ্টীমারখানাতে তাকে উঠতেই হবে। ছেলে ধরার দলকে শাস্তি না দিয়ে সে কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারবে না। কত অসহায় শিশুকে ওরা এভাবে রোজ নিখোঁজ করে দিচ্ছে।

এখানের পানিগুলো নির্মল সচ্ছ নয়, ষ্টীমার আর অগণিত নৌকা চলাচলে ঘাটের পানি তৈলাক্ত হয়ে উঠেছে। বনহুর সাঁতার কেটে দ্রুত এগিয়ে চললো, সম্মুখে ষ্টীমারখানা তখনও স্পীডে চলতে শুরু করে।

বনহুর ধরে ফেললো ষ্টীমারের পিছন অংশটা, কাটা তক্তা বেয়ে উঠে পড়লো উপরে। ভাগ্যিস পিছন দিকে কেউ ছিলো না, তাই তাকে কেউ দেখতে পেলোনা। ষ্টীমারের মধ্যে শুধু পাকার নারিকেল। বনহুর বুঝতে পারলো, নারিকেলের ব্যবসার নাম করে এরা ছেলে চুরির ব্যবসা ফেঁদে। বসেছে। নারিকেলের স্কুপের আড়ালে আত্মগোপন করে রইলো বনহুর, ভিজে চুপসে গেছে তার। জামা-কাপড়, সেদিকে তার খেয়াল নেই। লক্ষ্য করছে সে ষ্টীমারের লোকজনের কার্যকলাপ।

সন্ধ্যার অন্ধকার এখন.জমাট বেঁধে উঠেছে। ষ্টীমারের উপরে শুধু নারিকেলের স্তূপ ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়ছে না। বনহুর অত্যন্ত সন্তর্পণে আর একটু এগিয়ে গেলো, দেখলো কয়েকটা লোক বসে খোস গল্প জুড়ে দিয়েছে।

প্রত্যেকের চেহারা কদাকার ঠিক শয়তানের মত দেখতে। বিড়ি খাচ্ছিলো আর আলাপ আলোচনা করছিলো। লোকগুলোর কথাবার্তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো না, ষ্টীমারের শব্দে অস্পষ্ট কানে আসছিলো; কে যেন বলছে–মাল পৌঁছে দিয়েই আমরা ফিরে আসবো তো হুজুর?

অন্য একটি গলা-বাদলা আর হাবলু মাল নিয়ে চলে যাবি, ঘাটিতে মাল পৌঁছে দিয়ে আসবি তোরা। আমরা তোদের নামিয়ে দিয়েই আবার ঢাকায় ফিরে আসবো।

হুজুর টাকা?

টাকা অগ্রিম নিয়ে নিয়েছি, কিছু বাকী আছে–মাল হাতে হাতে পেলেই তোদের কাছে ওরা টাকাটা দিয়ে দেবে।

এমন সময় একটা লোক অন্য কামরা থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ায়–হুজুর, ওকে কিছুতেই। থামানো যাচ্ছে না।

মোটা লোকটা বলে উঠলো–গোটা কয়েক চাপড় লাগিয়ে দেগে, চুপ হয়ে যাবে।

গোটা কয়েক চাপড় দিয়েছিলো হুজুর কিন্তু আরও বেশি করে কাঁদছে।

আর একটি গলা শোনা গেলো–গলা টিপে শেষ করে দে ওটাকে।

পূর্বের গলা–একটা মাল নষ্ট করলে অনেক ক্ষতি হবে যে হুজুর।

তা হলে আমার কাছে প্যান প্যান করতে এসেছিস কেন বেটা? ভাগ যে করে হোক থামিয়ে। নে গে।

এতক্ষণ মনোযোগ সহকারে লোকগুলোর আলাপ-আলোচনা শোনার চেষ্টা করছিলো বনহুর, এবার ষ্টীমারের ঝক ঝক শব্দ এড়িয়ে কানে আসে কোনো বালক বা বালিকার কান্নার সুর। ক্ষীণ করুণ আওয়াজ।

বনহুরের মুখমণ্ডল কঠিন হয়ে উঠে, ক্রুদ্ধভাবে অধর দংশন করে সে। হঠাৎ সদরঘাটের অলিগলি সন্ধান করতে গিয়ে খোঁজ পেয়ে গেলো শয়তান দলের। ভাগ্যিস বনহুর আজ ঠিক সময়। এসে পড়েছিলো তাই নজরে পড়ে গেছে, নাহলে ছেলেটাকে নিয়ে কোথায় চলে যেতো ওরা ওক। জানে।

ভালভাবে কান পাতলো বনহুর, আবার শোনা যায় একটি কণ্ঠ–ছেলেটাকে কোথায় পেলি হাবলু?

দ্বিতীয় কণ্ঠ–স্কুল থেকে বাড়ি যাচ্ছিলো, হাতে বই-পুস্তক ছিলো।

তা কেমন করে হাতে পেলি? অন্য আর একটি গলার আওয়াজ এটা।

 দ্বিতীয় গলার স্বর–ছেলেটা এগিয়ে যাচ্ছে, চেয়ে দেখলাম তার সঙ্গীরা এগিয়ে গেছে অনেক দূর। আমি ডাকলাম খোকা, ও খোকা—ছেলেটা ফিরে তাকালো আমার দিকে। আমি বললাম আমাকে চিনতে পারছো না? খোকা আমার দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো, বললো—না তো! কে তুমি? আমি তখন আরও সরে এলাম ছেলেটার দিকে, কাঁধে হাত রেখে বললাম, আমি তোমাদের সেই পুরানো চাকর। আমাকে চিনতে পারছো না? তা চিনবে কেমন করে, তুমি তখন খুব ছোট ছিলে কিনা?

তৃতীয় কণ্ঠ–বাঃ চমৎকার বুদ্ধির প্যাঁচ জানিস্ তুই।

প্রথম কণ্ঠ–তাই তো ওকে আমি এতো খাতির করি, বুঝলি?

 দ্বিতীয় কণ্ঠ—-আজকাল বুদ্ধি না থাকলে চলবে কেন? দেখিস তো আমি মাসে একটা দুটো, কোনো মাসে তিনটে পর্যন্ত জোগাড় করি। আর তোরা দু’তিন মাসে একটা।

 হাঁ, ঠিক বলেছে হাবলু, ওর মত কেউ জোগাড় করতে পারে না। ব্যবসা তো চলছে ওর জন্যই। গলার স্বরটা প্রথম ব্যক্তির বলে মনে হলো।

বনহুরের চোখ দুটো দিয়ে যেন অগ্নিশিখা নির্গত হচ্ছে। দক্ষিণ হস্ত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে আসছে বার বার। এই মুহূর্তে লোকগুলোর টুটি ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। কিন্তু বনহুর এতো সহজে ওদের ধ্বংস করতে চায় না, সমস্ত উঘাটন করে সমূলে বিনষ্ট করবে। ধৈর্য সহকারে শোনে সে। শোনা যায় তখন হাবলুর গলা–ছেলেটা আমার কথা শুনে বললো, তোমার নাম রাজু বুঝি? হেসে বললাম–ঠিক বলেছো। এবার তাহলে চিনতে পেরেছো তোমার রাজুকে? সব সময় তুমি আমার কোলে থাকতে; আম্মার কাছেও যেতে চাইতে না। চলো আম্মার সঙ্গে দেখা করে আসি—কথাটা শুনে খুশি হয়ে উঠলো, বললো–চলো না রাজু। আমি তখন পকেট থেকে চকলেটের প্যাকেটটা বের করে ওর হাতে দিলাম–খাও। প্রথমে কিছুতেই হাতে নিতে চাইছিলো না, অনেক করে বুঝলাম, নাও আমি তোমাদের রাজু সখ করে তোমার জন্য চকলেট এনেছি।

তারপর কি করলো খোকা?

আমি ওর হাতখানা ধরে গুড়ে দিলাম চকলেটের প্যাকেটটা ওর হাতের মধ্যে, বললাম-খাও খোকা, খুব ভাল চকলেট। চকলেটের লোভ সামলানো ছোট্ট খোকার পক্ষে সম্ভব হলো না, সে টুপ করে একটা মুখে ফেললো।

বাঃ বাঃ তারপর?

পর পর আমি আরও দুটো কাগজ ছাড়িয়ে ওর মুখে তুলে দিলাম–খাও খোকা, আরও খাও। খোকা চিবিয়ে খেতে শুরু করলো। আমার তখন আর তর সইছে না, হঠাৎ যদি কেউ এসে পড়ে তাহলে সব যাবে মাটি হয়ে। গলিটা ছিলো নীরব তাই না রক্ষে—

 আর একজনের গলা–আমি ঐ রুনু ছেলেটাকে কেমন করে হাত করে ছিলাম শুনলে অবাক। হবি।

 থাম, হাবলু আজ কেমন করে বাবলুকে এনেছে তাই আগে শুনতে দে। পরে তোর কথা শুনবে।

হাত ধরে বললাম চলো খোকা, তোমার আম্মার সঙ্গে দেখা করে আসি। খোকা তখন ঝিমুচ্ছে, কারণ চকলেটের ঔষধের গুণ ধরে গেছে তার দেহে। খোকা নীরবে অনুসরণ করলো আমাকে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার নাম কি খোকা? বললো ও–বাবলু। ততক্ষণে খোকাসহ আমি এসে পড়েছি–তখন বাদলার সঙ্গে দেখা। আমরা দু’জন ওকে দোকানগুলোর পিছন দিক্ করে ষ্টীমারে এসে হাজির হলাম।

বনহুর বুঝতে পারলো সন্ধ্যায় যে ছেলেটিকে এরা ধরে নিয়ে এলো, এ ছেলেটিকে নিয়েই ওদের আলোচনা চলছে।

 কি ব্যাপার নিয়ে হাসলো ওরা বিদঘুটে হো হো হাসি।

ষ্টীমারের ঝক ঝক শব্দের সঙ্গে এ হাসির শব্দগুলো যেন আষাঢ়ে মেঘের গুড়গুড়ে আওয়াজের মত শোনালো। ভেসে এলো আর একটি গলার স্বর–বলরে ভোলা, রুনুকে কেমন করে পেলি?.

সে, এক তামাসা, আমি আরও সহজে পেয়েছি।

বল না শুনি।

পরশু সন্ধ্যাবেলা নিউ মার্কেটে ঘুরছি, ভাবছি এ মাসটা আমার মিস গেলো। কয়েকটা পকেট মেরে পেয়েছিলাম শ’দুই টাকা–তা তো মালিকের গাঁজার দাম হয়নি, আমাকে দিয়েছিলো মোটে পচাত্তর টাকা। কদিন সিনেমা দেখেছি আর ক’বোতল দেশী মদ খেয়েছি, তাছাড়া ভেদীর মাকে এক পয়সা এ মাসে দেইনি।

যাক, তোর সংসারের কথা শুনতে চাইছি না বল না রুনুকে পেলি কোথায় বেটা? মেয়েটা খাসা কিন্তু বড় হলে মেলা দাম হবে। মালিক তোকে কত দেবে–শ’দুই কিংবা তিন তার বেশি নয়।

প্রথম ব্যক্তির গলা-রুনুকে আমার কাছে বেচে দে, আমি তোকে সাড়ে তিনশ দেবো।

সাড়ে তিনশ কেন চারশ তেও দেবো না, খাসা মাল।

যাক, বল ওকে কেমন করে পেলি?

হাঁ শোন তবে, নিউ মার্কেটে খুব ভিড়কদিন পর ঈদ কিনা। ছেলেমেয়ে নিয়ে সবাই এসেছে–কেউ জামা কিনছে, কেউ জুতো কিনছে, কেউ শাড়ি নিয়ে ব্যস্ত। কোনো কোনো মহিলা গহনার দোকানে কি রকম মালা ঈদের জন্য নেবে পছন্দ করে দেখছেন, ছেলেমেয়ের দিকে লক্ষ্য নেবার সময় নেই তাদের। সঙ্গে বয় আছে বাচ্চাদের সামলাচ্ছে। আরে ভাই, চাকর-বাকরদের কতই বা দায়িত্ব। মা-বাবা যখন জিনিসপত্র কেনা নিয়ে মাতোয়ারা তখন বয় বেটা মার্কেটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দোকানের মন ভুলানো ঝকঝকে চাকচিক্যময় রং চং দেখছে, আর দেখছে টেডি মেয়েগুলো কেমন করে হাঁটছে। রুণুকে নিয়ে একটা বড় দাঁড়িয়েছিলো বারান্দায় ওর মা বাবা তখন শাড়ি কেনা নিয়ে ব্যস্ত। বয় বেটা হা করে তাকিয়ে আছে দুটো টেডি পোশাক পরা মেয়ে। তখন চলে যাচ্ছিলো তার সম্মুখ দিয়ে সেদিকে। রুণু তখন একটা খেলনা গাড়ি দেখে সরে এসেছে। বয়টার কাছ থেকে কিছুটা দূরে। বাস্, আমি আনেকক্ষণ থেকে মেয়েটাকে লক্ষ্য করছিলাম — পেয়ে গেলাম সুযোগ। পাশের দোকান থেকে চট করে একটা পুতুল কিনে নিয়ে রুণুর সামনে ধরলাম–চোখ কিন্তু আমার রুনুর বাবা-মা আর বয়টার দিকে। বাবা-মা তখন শাড়িখানা মানাবে কিনা এই নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। বয় বেটা তো তখনও টেডি গার্ল দুটির যৌবন ঢল ঢল রূপসুধা পান করে চলেছে—

 অন্য একজন বলে উঠলো–খুবতো বড় বড় বুলি আওড়াচ্ছিস, ইংলিশ বলতে শিখেছিস দেখছি। আসল কথা বল তারপর কি করলি?

 ষ্টীমারের শব্দে কান ঝালাপালা হলেও বনহুর তীক্ষ্ণভাবে লক্ষ্য রেখে ওদের কথাবার্তা শুনে যাচ্ছিলো। আশ্চর্য, হচ্ছিলো সে মনে মনে। ছেলেধরাদের ছেলে ধরার কৌশলাদির শলা পরামর্শ তাকে বিস্ময়াহত করে তুলছিলো।

বল বেটা, তারপর কি করলি? এটা প্রথম ব্যক্তির কণ্ঠস্বর বলে মনে হলো।

আবার লোকটা বলতে আরম্ভ করলো–আমি মেয়েটার সামনে পুতুল ধরতেই সে খুশি হয়ে হাত বাড়ালো, আমি তখন চট করে তুলে নিলাম কোলে, পুতুলটা ওর হাতে গুঁজে দিয়ে ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হলাম। দেখলি তো কেমন সহজে কাজ হাসিল করলাম? বাবা-মা-চাকর-সবার চোখেই ধূলো দিয়ে দিব্য নিয়ে এলাম রুনকি।

 ওরা নাম যে রুনু জানলি কি করে? অন্য একজন বললো।

বাঃ এই সামান্য কথাটা জানবো না। রুনুকে চুরি করার কয়েক ঘন্টা আগে থেকে ওকে লক্ষ্য করছি। দূরে ভিড়ের মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে দেখছিলাম, বয়টার কোলে যখন মেয়েটা ছিলো তখন, ওর বাবা মাঝে মাঝে রুনু, রুনু বলে ডাকছিলো। তা ছাড়া মেয়েটি তো ওর নাম বলতে পারে।

 খুব একটা দাও মেরেছিস্ বেটা, মোটা টাকা মারবি।

আরে ভাগ্য মন্দ নইলে এবার শুধু একটা; এর আগেরবার দু’টো ছেলে আর একটা মেয়ে-তিন। তিনটে মাল জোগাড় করেছিলাম।

বনহুরের দস্যপ্রাণও শিউরে উঠলো, কি সর্বনাশা কথা শুনছে সে। পূর্ব পাকিস্তানেও এ রকম ছেলে-মেয়ে চুরির হিড়িক আছে। সে ভেবেছিলো শস্য শ্যামলা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষগুলোও বোধ হয় সুন্দর স্বচ্ছ সরল আর স্বাভাবিক, নেই তাদের মধ্যে কোনো দুষিত কূটপ্রাণ। কিন্তু একদিনেই বনহুর যা দেখলো আর জানলো তাতেই তার মন বিষিয়ে উঠেছে। পূর্ব পাকিস্তানের শ্যামল স্বচ্ছ রূপের পিছনেও যে আছে একটা কঠিন কালো রূপ তা প্রকাশ পেয়েছে বনহুরের কাছে।

বনহুর নারকেলের স্তূপের আড়ালে আত্মগোপন করে এগিয়ে গেলো ওদিকে। একটা ফাঁক। দিয়ে লক্ষ্য করলো সে নিচের ক্যাবিনটা। বিস্মিত হলো বনহুর–তিনটা ছোট ছোট শিশুকে ক্যাবিনটার মধ্যে বন্দী করে রাখা হয়েছে। একটি মেয়ে আর দুটি বালক। একটি বালক চোখ। রগড়াচ্ছে আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আর দুটি বালক-বালিকা অবাক হয়ে দেখছে তাকিয়ে তাকিয়ে। তাদেরও মুখ শুকনো, চোখ দুটো লাল, বোধ হয় অনেক কেঁদেছে। মায়া হলো বনহুরের, আহা বেচারী না জানি কাদের সন্তান। হয়তো তারা সন্তানদের হারিয়ে পাগল হয়ে পড়েছেন। বনহুর দেখবে এদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কোথায় এদের আস্তানা?

বনহুর এক সময় বুঝতে পারলো, ষ্টীমারখানা নারকেল বোঝাই হয়ে খুলনা অভিমুখে চলেছে।

*

গভীর রাতে ষ্টীমারখানা কোনো এক বন্দরে নোঙর করলো। বনহুর একটু ঝিমিয়ে পড়েছিলো, তন্দ্রা এসেছিলো তার চোখে। ষ্টীমার থেমে পড়ায় জেগে উঠলো, সজাগ হয়ে তাকালো সে।

বনহুর লক্ষ্য করলো, ষ্টীমারে কয়েকজন লোক উঠে এলো অন্ধকারে, বেশ মোটা মোটা বলিষ্ঠ চেহারার লোকগুলো, তাড়াতাড়ি ক্যাবিনের জানালা দিয়ে ভিতরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।

 ষ্টীমারের লোকগুলোর সঙ্গে আরও কয়েকজন এসে দাঁড়িয়েছে সেই ক্যাবিনটার মধ্যে। এখন বালক দুটি আর বালিকাটি ঘুমোচ্ছে।

 লোকগুলো কিছু বলাবলি করে নিলো, তারপর তিনজন বলিষ্ঠ লোক তিনটি শিশুকে ঘুমন্ত অবস্থায় তুলে নিলো কাঁধে।

বনহুর বিলম্ব না করে ষ্টীমারের পিছন অংশ দিয়ে একটা দড়ি বেয়ে নেমে এলো নিচে, অতি সাবধানে ঘাটে এসে দাঁড়ালো। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করলো, তিনটি শিশুকে নিয়ে লোকগুলো ষ্টীমার থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো নিচে।

আশে পাশে কোনো লোজন নেই, ছোট্ট বন্দর।

কোন বন্দর এটা অন্ধকারে ঠিক বুঝা গেলো না। বন্দরের খালাসী আর কুলি-মজুর সবাই এখন নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। অন্ধকারের আড়ালে কত বড় সর্বনাশ ঘটে যাচ্ছে কে তার হিসেব রাখে!

লোকগুলো ফিস ফিস করে কথাবার্তা বলছে, কি সব আলোচনা করে নিলো ঠিক সব শুনতে না পেলেও বনহুরের কানে এলো দুচারটে চাপা শব্দ–মালিক বলেছে মাল পৌঁছে দিয়ে দাম নিতে।

বাকী হবে না কিন্তু—

না না, সব কথা পাকা হয়েছে—

চল তবে বেটা—

বাদলা, হুশিয়ার মত যাবি—-

সে কথা আর বলতে হবে না—-

 একটা সিগারেট ধরা হাবলু—

ম্যাচ জ্বাললে লোকে দেখে ফেলতে পারে—

এগিয়ে চল—

 হাঁ, সরে গিয়ে বিড়ি-সিগারেট যা খুশি খাবি—

অন্ধকারে ছায়ার মত এগিয়ে চললো ওরা।

 বনহুর অনুসরণ করলো দূর থেকে।

গাঢ় অন্ধকারে লোকগুলো তর তর করে এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে শিশুগুলোকে কাঁধ পাল্টে নিচ্ছে ওরা। জায়গাটা ঠিক কোথায় বুঝা না গেলেও বনহুর বুঝতে পারলো, ঠিক শহর নয় একটা সাধারণ বন্দর বা হাটুরে মত স্থান এটা।

বেশ কিছু জমি-জায়গা পেরিয়ে, মাঠ পেরিয়ে একটা পোডড়া বাড়ির মত জায়গায় এসে থামলো ওরা। বনহুর তখন তাদের কাছ থেকে অনেক দূরে একটা গাছের গুঁড়ির আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে চুপ করে দেখতে লাগলো।

লোকগুলো পোড়া বাড়িটার ভিতরে প্রবেশ করলো।

বনহুর কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলো গাছটার আড়াল থেকে। দ্রুত পোড়ো বাড়িটার দিকে এগুলো। সদর গেট বন্ধ, বাড়িটার সম্মুখে দাঁড়িয়ে ভেবে নিলো বনহুর কি করবে এখন। অন্ধকার হলেও বাড়িটার রূপ কিছু কিছু অনুমান করে নিলো, ভাঙাচুরো ইট খসে-পড়া বাড়িটা। বাইরে থেকে কোনো গরিব বেচারীর বাড়ি বলেই মনে হয়। বনহুর ওদিকের প্রাচীর টপকে প্রবেশ করলো ভিতরে। বাঃ চমৎকার, ভিতরে একেবারে রাজ বাড়ির মত শাহানশাহী ব্যাপার।

বাড়িখানা কোনো কালের পুরোনো জমিদার বাড়ি ছিলো বলে মনে হয়। কয়েক পা এগুতেই বনহুর শুনতে পেলো হেঁড়ে গলা–তিন সপ্তাহে মাত্র তিনটি মাল এনেছিস বেটারা? দিন দিন দেখছি তোরা সব অকেজো হয়ে পড়ছিস।

বনহুর তার পিছনে পদশব্দ শুনতে পেয়ে তড়িৎ গতিতে সরে দাঁড়ালো একটা দেয়ালের আড়ালে। একটা লোক চলে গেলো বনহুরের সম্মুখ দিয়ে। লোকটা সামনের ঘরটার মধ্যে প্রবেশ করলো।

কান পাতলো বনহুর, লোকটার চলা দেখেই সে বুঝতে পেরেছিলো, কোনো দরকারী সংবাদ নিয়েই লোকটা দ্রুত যাচ্ছে, নিশ্চয়ই কোন জরুরি খবর নিয়ে এসেছে। শুনতে পেলো বনহুর সেই হেঁড়ে গলার স্বর–কিরে, ফিরে এলি যে?

মালিক, গাড়ি এসে গেছে, মাল নিয়ে আমাকেই যেতে হবে।

গাড়ি এসে গেছে?

হাঁ মালিক।

তুই থেকে যা খালেক, আমি গফুরকে পাঠাচ্ছি।

 গফুর নতুন মানুষ, তাছাড়া মহাজন তাকে চেনে না।

আমি চিঠি দিয়ে দিচ্ছি, তাতে সব লেখা থাকবে। গাড়ি তো সে-ই পাঠিয়েছে, কাজেই পথ চিনে যেতে হবে না। গফুর শুধু মাল পৌঁছে দিয়ে টাকা নিয়ে চলে আসবে।

আচ্ছা মালিক।

যাও, গফুরকে এক্ষুণি পাঠিয়ে দাও। এই নাও চিঠি, এটা ওকে দিও।

আচ্ছা।

লোকটা ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো।

বনহুরের কানে এলো-বাদলা, মাল তিনটা গাড়িতে উঠিয়ে দে। গফুর যাবে সঙ্গে।

বনহুর বিলম্ব না করে অন্ধকারে যে লোকটা গফুরকে চিঠি দেওয়ার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিলো তাকে অনুসরণ করলো। কয়েকটা ঘর পেরিয়ে একটা বড় ঘরে এসে ঢুকলো।

 মেঝেতে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিলো একটা লোক।

যে লোকটা কক্ষে প্রবেশ করলো সে ঘুমন্ত লোকটার দেহে পা দিয়ে আঘাত করলো– গফুর-গফুর-জলদি ওঠ।

ধড়ফড় চোখ রগড়ে উঠে বসলো গফুর-এ্যা, কি বলছো দাদা?

এই চিঠি নিয়ে মালের সঙ্গে যাবি, গাড়ি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।

 চিঠি হাতে নিয়ে বলে গফুর–আমি কিছু চিনি নাকি, না বুঝি কিছু?

তোকে কিছু বলতে হবে না, বুঝতেও হবে না; চিঠি নিয়ে গাড়িতে উঠে বসবি চোখ বন্ধ করে, পৌঁছে যাবি আসল জায়গায়। ঠিক জায়গায় গাড়ি তোকে পৌঁছে দেবে, মাল নামিয়ে দিয়ে চিঠি, হাতে দিবি, কিছু বলতে হবে না-বাস্।

 কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেলো লোকটা।

 চিঠি হাতে গফুর, ঝিমুতে ঝিমুতে উঠে দাঁড়ালো।

 এমন সময় বনহুর কক্ষে প্রবেশ করে টিপে ধরলো তার গলা, একটু টু শব্দ করতে দিলো না, গলায় চাপ দিয়ে শেষ করে ফেললো ওকে। লোকটাকে হত্যা করতে বাধ্য হলো বনহুর, কারণ ছেলেধরার দলকে পাকড়াও করতে হলে এবং শত শত ছেলেকে রক্ষা করতে হলে এমন অনেক হত্যাই তাকে করতে হবে। লোকটার নিস্পন্দ দেহটা পাশের চৌকির নিচে ঠেলে লুকিয়ে রেখে চিঠিখানা পকেটে রাখলো তারপর বেরিয়ে এলো বাইরে। দেখতে পেলো, একটা নারকেল বোঝাই গরুর গাড়ি অপেক্ষা করছে।

বনহুর এগিয়ে আসতেই গাড়োয়ান বললো–চট করে উঠে পড়, দেখছি না ভোর হয়ে এলো?

বনহুর কোনো কথা না বলে গাড়িতে উঠে বসলো। পিছনে এবং সামনে বোঝাই নারিকেলের স্তূপ। ভাবলো মাল তবে কি নারিকেল না ঐ শিশুগুলো। গাড়োয়ান গাড়ি ছাড়লো। দু’জন লোক দাঁড়িয়ে ছিলো গাড়িখানার পাশে, একজন বললো সাবধানে নিয়ে যাস্ গফুর। গাড়ির ভিতরে মাল রইলো।

বনহুর এতক্ষণে অনুভব করলো, শুধু নারকেল বোঝাই গাড়িখানাই নয়, এর ভিতরে আছে। আসল মাল ছেলে-মেয়েগুলো। গাড়োয়ান বললো-কিরে গফুর, ঝিমুচ্ছি নাকি?

না তো!

 তবে অমন চুপচাপ রয়েছিস কেন? নে সিগারেট বের কর। এবার হাসলো নতুন নতুন যে আসে সে এমনই হয়। তোর নাম তো বাদলার কাছে জেনে নিলাম, আমার নামটা তোকে বলে রাখি, না হলে ডাকবি কি করে–আমার নাম গয়া দত্ত।

বনহুর বললো এবার খুব ভাল, আমার নাম গফুর আর তোমার নাম গয়া–খাসা। দুজনারই নামের প্রথম অক্ষর গ দিয়ে বেশ কিন্তু।

বাঃ চমৎকার, এমনি করে কথা বলতে হয়, না হলে এতোটা পথ মুখ বুজে যাওয়া যায়? আচ্ছা, তোকে আমি গফুরা করে ডাকবো? ..

হাঁ, গফরাই ভাল, ঐ নামেই ডেকো। আমার বাবা আমাকে সখ করে গফরা বলতো।

 বেশ বেশ। তুই গান জানিস্ গফরা?

গান? তা জানি একটু আধটু।

গা না একখানা ভাল দেখে।

 সর্বনাশ, গান গাইতে গিয়ে ধরা পড়ি আর কি? কথাটা বলে জবাবের প্রতীক্ষায় রইলো বনহুর।

গয়া হেসে বললো–কোন বেটা ধরবে আমাদের? সবাই জানে, আমরা নারিকেলের ব্যবসা করি। রোজ কত মাল আসে যায়, আজ পর্যন্ত কোনো বেটা সন্দেহ করেছে, না করতে পেরেছে।

ভাই, আমি নতুন কিনা তাই বড় ভয় করছে।

ভয় কি রে দুদিন আমাদের সঙ্গে কাজ করলেই সব ভয় দূর হয়ে যাবে।

কোথায় যেতে হবে এখন আমাদের?

 ভেড়ামারা গ্রাম, ওখানে আমাদের ঘাটি।

সে আরও কতদূর ভাই?

বেলা দশটা বাজবে।

বনহুর আশ্বস্ত হলো, ভাগ্যিস গফুর নতুন লোক ছিলো তাই রক্ষে, না হলে সব যেতো গুলিয়ে। কাজটা যত সহজ হচ্ছে এতোটা সহজ হতো না এ কথা সত্য। বনহুর বুঝতে পারলো, শিশুগুলোকে অজ্ঞান করে রাখা হয়েছে। নারিকেলের স্কুপের আড়ালে ঘুমিয়ে আছে তারা। মাঝখানে ছই বা চালা, দু’পাশে নারিকেলের স্তূপ।

বনহুর যখন ভাবছে তখন গয়া গলা ছেড়ে গান জুড়ে দিয়েছে।

 ঘাটিতে পৌঁছতে দশটা বেজে এগারোটা পেরিয়ে বারোটা বাজলো।

 পৌঁছে যেতেই টিনের বড় ফটক খুলে গাড়িটা ঘেরাও জায়গার ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো। বনহুর অবাক হলো, জায়গাটা বহুদূর নিয়ে ঘেরাও করা, মস্তবড় একটা টিনের ফাটক, যার মধ্যে অনায়াসে গাড়ি প্রবেশ করতে পারে। ঘেরাও করা জায়গাটার উঠানে শুধু নারকেলের স্তূপ আর স্তূপ।

 হাসি পেলো বনহুরের, কি সুন্দর ছেলেচুরির ব্যবসা এরা নারকেল ব্যবসার মাধ্যমে চালিয়ে যাচ্ছে।

গাড়িখানাকে ঘেরাও জায়গার মধ্যে নিয়ে আসার পর কয়েকজন মানুষ এসে দ্রুত নারিকেল নামাতে শুরু করলো।

আর দু-তিনজন লোকা নামিয়ে নিলো সংজ্ঞাহীন তিনটি শিশুর দেহ।

বনহুর আর শিশু তিনটিসহ লোকগুলো প্রবেশ করলো গুদামঘরের মধ্যে। কি ভয়ঙ্কর স্থান সেই গুদামঘর, চারদিকে নারিকেলের পাহাড়, তারই মাঝখানে একস্টা চেয়ারে বসে আছে যমদূতের মত একটা ভীষণ চেহারার মানুষ।

বনহুর আর শিশু তিনটিসহ লোকগুলো এসে সেই ভীষণ চেহারার লোকটার সম্মুখে দাঁড়ালো।

গাড়োয়ান গয়া দত্তও ছিলো তাদের সঙ্গে, সে-ই প্রথম কথা বললো–মালিক, এই তিনটা মাল এসেছে।

মালের সঙ্গে কে এসেছে?

 বনহুর তাড়াতাড়ি চিঠিখানা লোকটার হাতে দিয়ে সালাম করলো।

লোকটা চিঠিখানা পড়ে নিয়ে বললো তোর নামই গফুর আলী।

হাঁ মালিক।

গাড়োয়ানকে মালিক বলতে শুনেছিলো তাই লোকটাকে মালিক বলে সম্বোধন করলো।

 লোকটা পুনরায় চিঠিখানা পড়ে নিয়ে বললো–মাল, তো পৌঁছালো কিন্তু এতো কম হলে চলবে কি করে? এ মাসে চালান যাবে কমপক্ষে বারোটা কিন্তু মোটে নয়টা জোগাড় হয়েছে। উঠো দাঁড়ালো লোকটা, এগিয়ে চললো সামনের দিকে নারকেল স্কুপের পিছনে।

শিশু তিনটিসহ তিন ব্যক্তি এগুলো তার পিছনে।

 বনহুরও অনুসরণ করলো।

এখানে কেউ তাকে চেনে না, কাজেই বনহুরকে রীতিমত দাড়ি গোফ পরতে হয়নি। একটু ধুলো-কালির ছাপ ছাড়া তার চেহারা স্বাভাবিক রয়েছে। শুধু ড্রেস পরিবর্তন করেছে সে, ছেঁড়া রং জ্বলে যাওয়া রুফুলপ্যান্ট, গায়েও তেমনি একটা ধূসর রঙ-এর ছেঁড়া তালিযুক্ত জামা, মাথায় ময়লা একটা গামছা জড়ানো।

নারিকেলের স্তূপের পিছনে এসে হতবাক হলো বনহুর।

অনেকগুলো ছেলেমেয়েকে সেখানে বন্দী করে রাখা হয়েছে–ছয়-সাত-দশ-বারো বছরের বালক-বালিকা আছে সেখানে। সবাই তখন বসে ছিলো, সকালের নাস্তা খেতে দেওয়া হয়েছে তাদের। শুকনো রুটী আর গুড় খাচ্ছে ওরা। সকলেরই মুখ মলিন বিষণ্ণ করুণ। ক্ষুধায় কাতর তাই শুকনো রুটী চিবুচ্ছে ওরা। হয়তো বা এসব খাওয়া তাদের অভ্যাস নেই। সকলেরই চেহারা। সুন্দর, দ্রঘরের সন্তান তাতে কোনো ভুল নেই। বনহুর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে, মনে মনে ফুলছে সে ক্রুদ্ধ সিংহের মত।

লোকটার ইংগিতে শিশু তিনটিকে শুইয়ে দেওয়া হলো।

ছেলেটির সংজ্ঞা ফিরে এসেছিলো, ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো। মেয়েটি তখনও সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে আছে। বনহুরের শরীরের রক্ত উষ্ণ হয়ে উঠলো, এইদণ্ডে এদের সবাইকে খতম করতে ইচ্ছে করছিলো তার কিন্তু অতি কষ্টে সংযত হয়ে রইলো, দেখতে লাগলো এরা কি করে?

এমন সময় বালকদের মধ্যে একজন কেঁদে উঠলো–আমি কোথায়, আমাকে তোমরা কেন। ধরে আনলে?

সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ যমদূতের মত লোকটা বালকটির গলা টিপে ধরলো। পরক্ষণেই ঠাই করে বসিয়ে দিলো একটা চড় ওর গালে।

 ছেলেটা চিৎকার করে কেঁদে উঠলো, তৎক্ষণাৎ ভয়ে কুঁকড়ে গেলো যেন গলাটা তার। কাঁদা। বন্ধ হলো, অসহায় চোখে তাকিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো।

যমদূতটা এবার আর একটা বালকের চুল ধরে একটা হেচকা টান মারলো।

 যে ছেলেটা কাঁদা বন্ধ করেছিলো সে আবার ভয়ে কেঁদে উঠলো। যার চুল ধরে টান দিলো সে যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করলো কিন্তু কাঁদবার সাহস পেলো না।

 মালগুলোকে দেখে নিয়ে বললো– জলিল, এদের আজ রাতেই চালান দিতে হবে, সবাইকে সন্ধ্যার আগেই ঠিক করে নিবি। এবার বনহুরকে লক্ষ্য করে বললো–আর তোর পাওনাটা, মিটিয়ে দি, চলে যা। হাঁ, বলবি নতুন মাল যেন শীঘ্র করে পাঠায়।

 যমদূতের মত ভীষণ চেহারার লোকটা তার অনুচরদের মাল চালান দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে ফিরে চললো, বনহুর তাকে অনুসরণ করলো।

পুনরায় ফিরে এলো বনহুর সেই কক্ষে, যে কক্ষে প্রবেশ করে সে দেখতে পেয়েছিলো ছেলেধরাদের সর্দার বা মালিককে। এবার লোকটা একটা থলে বনহুরের হাতে দিয়ে বললো এতে টাকা আছে, তোদের মালিককে পৌঁছে দিবি।

আচ্ছা মালিক।

টাকার থলে হাতে বেরিয়ে যায় গফুরের বেশে বনহুর। কি ভয়ঙ্কর নির্দয় নর শয়তানের দল এরা। বনহুরের এখন কি করা কর্তব্য ভেবে নিলো, এর শেষ না দেখে সে এদেরকে পুলিশের হাতে তুলে দেবে না।

ছেলেধরার ঘাটি থেকে বনহুর বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো বটে কিন্তু ফিরে গেলো না ঢাকা শহরে, সে একটা গোপন স্থানে আত্মগোপন করে ড্রেস পাল্টে চাষী সেজে নিলো।

আজ রাতে চালান যাবে ছেলেগুলো, কোথায় চালান যাবে না দেখে না জেনে শান্তি নেই : বনহুরের। কিন্তু সারাটা দিন তাকে আত্মগোপন করে কাটাতে হবে।

বনহুর একজন লোকের কাছে জেনে নিলো এ গ্রামটির নাম বাঘহাটা। মনে মনে বললো সে, বাঘহাটাই বটে। যে একবার এ গ্রামে আসে সে আর ফিরে যায় না। বিশেষ করে হারানো ছেলেমেয়েগুলোর কথাই স্মরণ হলো তার।

বাঘের কবলে জীব পড়লে যেমন তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না, তেমনি ছেলেধরার কবলে পড়লে আর তাদের কোনোদিনই ফিরে যাবার সম্ভাবনা থাকে না। বনহুর তাই এই ছেলেধরা সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করলো।

বনহুর একটি চাষার ছদ্মবেশে প্রবেশ করলো গ্রামটার মধ্যে। এখন তার হাতে প্রচুর অবসর আছে। রাত্রি ছাড়া চালান যাবে না। কাজেই সমস্ত দিনটা বনহুর হাতে পাচ্ছে।

এ গ্রামে বনহুর সম্পূর্ণ নতুন, কাজেই তাকে বেশি করে ছদ্মবেশ ধারণ করতে হলো না। সাধারণ চাষীবেশে সে প্রবেশ করলো গ্রামের মধ্যে।

ছায়াঘন শ্যামল পল্লীজননীর স্নিগ্ধরূপ বনহুরের চোখে সৃষ্টি করলো এক নতুন পরিবেশ। দু’পাশে শস্যক্ষেত, মাঝখান দিয়ে আইল। আইলের উপর দিয়ে তোক চলাচল করে থাকে। ধান গাছের সবুজ পাতাগুলো ঝিরঝিরে বাতাসে দোল খাচ্ছে যেন চঞ্চল পল্লী, বালিকার বিক্ষিপ্ত আঁচলখানা লুটোপুটি খাচ্ছে।

বনহুর মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আর এগুচ্ছে।

 শীতল বাতাস তার সমস্ত শরীরে যেন এক মধুর পরশ বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।

 এগুচ্ছে বনহুর।

ক্ষেত ছাড়িয়ে গ্রাম।

ধূলো ছড়ানো সরুপথ দু’পাশে গাছপালা আর লোকজনের বাড়িঘর। টিনের আর খড়ের চালাঘরই বেশি; ইট পাথরে গড়া দালান কোঠার বালাই নেই একেবারে।

বনহুর নিপুণ দৃষ্টি মেলে চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আর এগুচ্ছে। কোথাও বা চাষী লাঙ্গল কাঁধে জমির দিকে চলেছে। আগে আগে এগুচ্ছে গরু দুটো, পেছনে চাষী।

দুটো রাখাল বালক একপাল গরু নিয়ে চলেছে। ছোট বড় অনেকগুলো গরু, কোনোটা মোটা-.. সোটা কোনোটা বা হাড়জিরজিরে কঙ্কালসার। বাছুরগুলো গাভীগুলোর পাশ কেটে কেটে এগুচ্ছে। একটা বাছুর একটু পিছিয়ে পড়েছিলো, হাম্বা হাম্বা শব্দ করে ছুটে এলো মায়ের পাশে। গাভী সন্তানকে না দেখে একটু চঞ্চল হয়ে পড়েছিলো। এতোক্ষণে যেন শান্ত হলো জননী সন্তানকে। কাছে পেয়ে।

 গাভী আর বাছুরটির কার্যকলাপ লক্ষ্য করে বনহুরের মনে উদয় হলো ছেলেধরার কবলে আটকা পড়া শিশুগুলোর কথা। মা-হারা সন্তানগুলোর অবস্থা ঠিক এমনিই হয়েছে। মাকে না পেয়ে এরাও উতলা হয়ে উঠেছে ভীষণভাবে।

হঠাৎ নারী কন্ঠের হাসির শব্দে বনহুর ফিরে তাকালো–ওদিকে নজর পড়তেই দেখলো, একটি পুকুরঘাটে কয়েকটি যুবতী স্নান করছে আর নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে। অর্ধবসনা সিক্ত নারীমূর্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে সহসা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারলো না বনহুর। নিস্পলক নয়নে তাকিয়ে আছে, জীবনে বনহুর বহু নারী দেখেছে কিন্তু এমন সরল স্বাভাবিক গ্রাম্য নারী সে দেখেনি। ঠিক যেন দীঘির নীল জলে সদ্য ফোঁটা কয়েকটি পদ্মফুল।

 বনহুর স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভুলে গেছে সে,–এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা তার মোটই উচিত নয়। তন্ময় হয়ে দেখছে বনহুর যুবতীগণের স্বচ্ছ ভাবধারা।

 একজনকে লক্ষ্য করেই যুবতীগণ হাসাহাসি করছে। কেউ বা তার দেহে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে, কেউ বা মৃদু চাপ দিচ্ছে ওর গণ্ডদ্বয়ে, কেউ বা গানের সুর তুলে টিপ্পনী কাটছে।

হঠাৎ একটা ছায়া এসে পড়লো দীঘির বুকে।

 যুবতীগণ মুহূর্তে ভীত হরিণীর মত তটস্থ হয়ে উঠলো। তাড়াতাড়ি সিক্ত বসনগুলো জড়িয়ে নিচ্ছে দেহে। নিমিশে ওদের মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে, অন্ধকার কালো হয়ে উঠেছে প্রতিটি যুবতীর মুখ।

দীঘির বুকে এতক্ষণ যে উচ্ছ্বসিত হাসির উচ্ছ্বাস এক মোহময় পরিবেশের সৃষ্টি করে চলেছিলো সহসা তা স্তব্ধ হয়ে যায়। জোছনা-প্লাবিত বসুন্ধরা যেমন চন্দ্রগ্রহণের অন্তরালে ঢাকা পড়ে যায় ঠিক তেমনি অবস্থা হয়েছে ওদের।

বনহুর ঘাটের ওপাশে তাকাতেই আড়ষ্ট হয়ে পড়লো, ওপারে এসে দাঁড়িয়েছে সেই যমদূত ছেলেধরাদের মালিক লোকটা। তার দু’পাশে দুটি বলিষ্ঠ লোক।

মুহূর্ত বিলম্ব না করে বনহুর লুকিয়ে পড়লো দীঘির পাড়েই একটা ঘন গাছের আড়ালে। সে লুকিয়ে পড়লেও তার দৃষ্টি রইলো ঘাটের ওপারে যমদূতের মত লোকটি ও তার সঙ্গীদ্বয়ের দিকে। বনহুর লক্ষ্য করলো, যুবতীগণ ভিজে কাপড় যতদূর সম্ভব দ্রুত দেহে জড়িয়ে নিয়ে কলসীগুলো কাখে তুলে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।

ততক্ষণে শয়তান তিনজন এসে দাঁড়িয়েছে, যুবতীগণের পথ আগলে বিশ্রী কুৎসিত হাসি হাসছে ওরা।

একজন লোক বললো–মালিক এই মেয়েটির কথাই আপনাকে বলেছিলাম।

মাঝখানের যুবতীটিকে দেখিয়ে দেয় লোকটা।

এবার মালিক বিদঘুটে হাসি হেসে বলে–চমৎকার তোমার পছন্দ হারান। এবার মালিক বেটা খপ করে হাত ধরে ফেলে মাঝের যুবতীর।

এতক্ষণ ভয়ে যুবতীগণ কুঁকড়ে গিয়েছিলো, হাজার হলেও এরা পল্লীর সরল-সহজ বালা, চট করে কিছু বলতেও পারছে না, চিৎকার করে কাঁদবে তাও হচ্ছে না। অসহায় চোখে ফ্যাল ফ্যাল। করে তাকিয়ে বলির ছাগলের মত কাঁপছে।

 যমদূত যখন যুবতীর হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে শুরু করলো তখন সবগুলো যুবতী হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো। কেউ বা চিৎকার করে উঠলো– বাবা গোমা গো, নিয়ে গেলো বাঁচাও…………..বাঁচাও—

চিৎকার শুনে ছুটে এলো কয়েকজন গ্রাম্য লোক। কিন্তু যেমনি মালিক ও তার সঙ্গীদ্বয়ের উপর দৃষ্টি পতিত হলো অমনি পিছু হটে যে যেদিকে পারলো সরে পড়লো।

 বনহুর আড়ালে থেকে সব লক্ষ্য করছিলো, সে গ্রামবাসীদের ভীতু ভাব দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো। একজনও এগুনোর সাহস পাচ্ছে না, সবাই যেন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে পড়েছে কেঁচোর মত। কিন্তু এতো ভয় কেন বুঝতে পারে না বনহুর।

 যুবতীটিকে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে পুকুরঘাটের দিকে।

বনহুর এবার স্থির থাকতে পারলো না, আড়াল থেকে বেরিয়ে দ্রুত শয়তান তিনজনের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো।

হঠাৎ পথ রোধ হওয়ার মালিক ও তার সঙ্গীদ্বয় দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিলো। একজন বলে উঠলো–কে তুই?

বনহুর ওর কথার জবাব না দিয়ে মালিকের মুখ লক্ষ্য করে প্রচণ্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিলো।

 সঙ্গে সঙ্গে যুবতীটিসহ মালিক বিরাট বপু নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো।

 ছাড়া পেয়ে যুবতী উঠে দাঁড়ালো দ্রুত গতিতে। এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগলো সে।

অদূরে ভয়বিহ্বল চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে অন্যান্য যুবতী বধূগণ। সঙ্গিনীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে তাই ওরা কেঁদে আকুল হচ্ছে, কেউ পালাচ্ছে না তাকে ছেড়ে। সবাই দেখছে কি হয় সঙ্গিনীর।

আচমকা একটি লোককে তাদের আক্রমণকারীর উপর আক্রমণ চালাতে দেখে ওরা হকচকিয়ে গেলো, সবাই বিস্ময়ে থ’ মেরে দেখছে কে এই লোক, একে তো ইতিপূর্বে কেউ এখানে দেখেনি।

 এতোক্ষণ যে সব গ্রামবাসিগণ যুবতীদের চিৎকারে এসে পড়ে পুনরায় পালানোর চেষ্টা নিচ্ছিলো তারা দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো। অবাক তারাও কত হয়নি কে এই যুবক!

 বনহুরের ঘুষি খেয়ে লোকটা ফুলে উঠলো সিংহের মত; হড়মুড় করে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।

শয়তানের সঙ্গীদ্বয়ও রুখে দাঁড়িয়েছে ভীষণভাবে। এই মুহূর্তে যেন বনহুকে ওরা নিঃশেষ করে ফেলবে।

যমদূতের মত লোকটা হুঙ্কার ছাড়ালো কে তুই?

বনহুর জামার হাতাটা আরও কিছুটা গুটিয়ে নিয়ে দাঁত পিষে বললো–এ গ্রামের লোক।

ওঃ খুব তো সাহস! জানি আমি কে?

তুমি কে জানার কোনো দরকার নেই। কিন্তু কোন সাহসে মেয়েদের গায়ে হাত দিয়েছ?

কি বললি? জানিস্ এ গায়ে আমি মাতব্বর। এরা সবাই আমার চাকর।

 আর একজন বললো–এ বেটা এতোদিন ছিলো কোথায় তাই জানে না। নিশ্চয়ই এ বাইরে থেকে এসেছে।

এবার আর একজন বলে–মালিক, ওর কথা শুনবেন না, চলন, ওকে নিয়ে চলুন।

মালিক ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে একবার বনহুরের দিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে পুনরায় যুবতীর হাত ধরে ফেলে।

সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে বনহুর, পর পর কয়েকটা ঘুষি তার নাকে মুখে এসে পড়ে। লোকটাও আক্রমণ করে এবার বনহুরকে। ওর সঙ্গের অনুচরদ্বয়ও ঝাঁপিয়ে পড়ে ভীষণভাবে।

কিন্তু বনহুরের কাছে ওরা বেশিক্ষণ টিকতে পারে না। কারো নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে, কারো দাঁত ভেঙে যায়, কারো ঠোঁট কেঁটে দুর্ফাক হয়ে পড়ে। বনহুরের এক এক মুষ্ঠিঘাতের আঘাতে নাজেহাল হয়ে পড়ে শয়তান তিনজন। বহু লোককে ওরা কাবু করেছে এতোদিন, আজ সামান্য একজন চাষীর কাছে এমনভাবে পরাজয়! চাচা আপন জান বাঁচা অবস্থা হয়ে পড়লো তাদের। বনহুর ক্ষেপে গেছে, সে আর থামতে চায় না; ওরা পালাতে চেষ্টা করছিলো কিন্তু বনহুর পালাতে দিলে তো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই কাবু হয়ে পড়লো তিন শয়তান। সর্দার লোকটাই বেশি কাবু হলো, ওর নাক দিয়ে যেভাবে রক্ত গড়াতে শুরু করেছে তাতে তার অবস্থা কাহিল। শেষ পর্যন্ত কোনো রকমে পালিয়ে গেলো তিনজন।

 বনহুর সোজা হয়ে দাঁড়ালো, তার কপালেও এক জায়গা কেটে গিয়েছিলো, রক্ত গড়িয়ে পড়ছিলো কপাল বেয়ে।

 এতোক্ষণ অবাক বিস্ময়ে দূরে দাঁড়িয়ে গ্রামবাসী এই অদ্ভুত দৃশ্য লক্ষ্য করছিলো। এতোদিন ঐ শয়তান মাতব্বর লোকটাকে মেনে এলেও মনে মনে তাকে ঘৃণা করতো ওরা সর্বান্তকরণে। মাতব্বর সেজে গ্রামবাসীদের সর্বনাশ করাই ছিলো তার কাজ। কেউ কোনো প্রতিবাদ করতে পারতো না বা সাহসী হতো না। যেদিন যাকে খুশি স্ত্রী-কন্যা-বধূকে জোরপূর্বক নিয়ে যেতো, তাদের নিয়ে চালাতে নানারকম আমোদ-প্রমোদ। গ্রামবাসিগণ টু শব্দ উচ্চারণ করতে সাহসী হতো না কারণ এ গ্রামের মাতব্বর ও চেয়ারম্যান হলো এই যমদূত। নারিকেল ব্যবসার জাল বিছিয়ে সে ভিতরে ভিতরে ছেলেচুরির ব্যবসা ফেঁদে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করে চলেছে।

 অন্যান্য গ্রামাঞ্চলের মত এ গ্রামটা এখনও শিক্ষার আলোতে আলোকিত হয়নি, বাই এখানে অশিক্ষিত-মূর্খ, বুদ্ধিহীন। অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এরা গরিবও বটে, জমি চাষ করে কিন্তু পেট পুরে খাবার সংস্থা জোটে না। পরনে জামা-কাপড় নেই, মাথায় তেল নেই–তবু সর্বদা খেটে চলেছে, আর কিসে গ্রামের মাতব্বর খুশি থাকবে, সেই চিন্তা করে সর্বদা।

শয়তান মাতব্বর তার সঙ্গীদ্বয়সহ উধাও হতেই গ্রামবাসিগণ এগিয়ে এলো, ঘিরে দাঁড়ালো। বনহুরকে। যুবতীটি এখনও থরথর করে কাঁপছে, সে নির্বাক ভয়াতুর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে বনহুরের দিকে, ভাবছে কে এই লোক যে তাকে বাঁচিয়ে নিলো! যুবতী গ্রাম্যবালা হলেও সে মানুষ, বনহুরের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলো তার নারী হৃদয়।

 সেই মুহূর্তে একটি বৃদ্ধ লোক হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এলো, সমস্ত শরীর তার ঘামে ভিজে গেছে, রোদে দেহটা যেন পুড়ে কালো হয়ে উঠেছে পোড়া কয়লার মত।

হন্তদন্ত হয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসতেই যুবতী ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে বাপজান…..বাপজান…..।

মা, তোরে নাকি বদমাইশ মাতব্বর ধইরা নিয়া যাইতে লইছিলো।

হাঁ বাপজান, আমারে মাতব্বর তার গুদামে লইয়া যাইতে লইছিলো। উনি আমারে বাঁচাইয়া লইছেন। বনহুরকে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যুবতী।

বুড়ো ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বনহুরকে বাপ তুমি কেডা আমার মাইয়ারে বাঁচাইলা সইছো?

বনহুর হাতের পিঠ দিয়ে কপালে গড়িয়ে পড়া রক্ত মুছতে মুছতে বললো-আমি তোমাদের দেশেরই একজন। তোমাদের মতই মানুষ। যাও, তোমার মেয়েকে ঘরে নিয়ে যাও।

বুড়ো বনহুরের মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলো, খুশি যেন ধরছে না কিন্তু মুখে কোনো কথা বের হচ্ছে না তার। এমন কথা এ গায়ে কেউ তো বলে না, আহা কি শান্ত গম্ভীর পৌরুষরা কণ্ঠ! বুড়োর অন্তর আনন্দে পরিপূর্ণ হলো, মন যেন গলে গেলো কিন্তু ভাষা প্রকাশের ক্ষমতা নেই, তার। কন্যাকে বললো–চ সখিনা, ঘরে চল্।

সখিনা বললো-বাপজান, লোকডারে আমাগো ঘরে যাইতে কইলা না? আহা মাথাডা কাইট্যা গেছে, ওষুধ লাগাইয়া দিবা না?

তাই তো, কে তুমি বাপধন কই যাইব্যা, চলো আমাগো ঘরে চলো।

 বনহুর না গিয়ে পারলো না।

*

একখানা কাঁসার থালার চিড়া-গুড় আর দুধ এনে সম্মুখে দাঁড়ালো সখিনা-খাও! কি আর দিমু, চিড়া-গুড় আছিলো তাই দিলাম।

 বনহুর তাকালো যুবতীর মুখের দিকে, সরল-সুন্দর একখানা মুখ। হায়, তখন যদি বনহুর এসে না পড়তো তাহলে এতোক্ষণ এই যুবতীর সর্বস্ব লুটে নিতো ঐ শয়তান লম্পট দূরাচার পাষণ্ড। দৃষ্টি নেমে এলো ধীরে ধীরে যুবতীর সুডোম কোমল হস্তখানার উপর। একটু পূর্বেই নিষ্পেষিত হয়েছিলো এই পবিত্র হাতখানা অপবিত্র এক নরপিশাচের হস্তস্পর্শে। বনহুরের বুকখানা ব্যথায় টনটন করে উঠলো। হাত বাড়িয়ে যুবতীর হাত থেকে চিড়া-গুড়ের থালা আর দুধের বাটিটা নিয়ে নিজের সামনে রাখলো।

 বেশ ক্ষুধা বোধ করছিলো বনহুর, খেতে শুরু করলো। একটা ঝকঝকে কাঁসার গেলাসে ঠাণ্ডা পানি রাখলো সখিনা–পানি খাইও।

বনহুর খেতে খেতে বললো–আচ্ছা।

সখিনা বনহুরের পাশে একটা পিড়া টেনে বসে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছিলো, মনে হচ্ছিলো সখিনা যেন ওকে কতদিন থেকে চেনে।

বনহুর বললো তোমার নাম সখিনা বুঝি?

 হাঁ, আমার নাম সখিনা।

এ বাড়িতে কে কে থাকো তোমরা?

 বাপজান আর আমি, মা মইরা গেছে অনেকদিন।

তোমার ভাই-বোন বা আর কেউ নেই?

না, আমাগো আর কেউ নাই। থাকলে আর অতো চিন্তা অইতো না।

তাহলে তোমার বাপজান যখন বাইরে যান, কে তোমার কাছে থাকবে?

একাই থাকতে হয়, কে আর থাকবো কও?

এখন তোমার একা থাকা নিরাপদ নয় সখিনা। আবার ঐ শয়তান হামলা চালাতে পারে।

তা ঠিক কইছো তুমি, কিন্তু কি করমু কও, আমাগো নিয়া বাপ থাকলে পেট ভরবো কেমনে? কথাগুলো বেশ দুঃখভরা করুণ কণ্ঠে বললো সখিনা।

বনহুর বললো-তোমাদের কেউ আত্নীয়-স্বজন নেই?

থাকলি কি অইবো, মাতব্বরের ভয়ে কেউ আমাগো আগলাবি না। সবাই তারে ভয় পায় কিনা। তা আজ থ্যাইকা আমার কি অইবো, আমার বুড়া বাপেরে মাইরা ফেলবো। হায় কি অইবো……

 আঁচলে চোখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো সখিনা।

বনহুরের খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিলো, সান্ত্বনা দিয়ে বললো–সখিনা, তুমি ভয় পেও না, আমি তোমাকে দেখবো।

এমন সময় বুড়ো দুটো ডাব নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে বাপ, তোমারে কি কইয়্যা দোয়া দিমু ভাইবা পাইতেছি না। আমার মাইয়ার ইজ্জৎ বাঁচাইছো, আবার তুমি দেখব্যা কইতেছে?

হাঁ, যতক্ষণ ঐ শয়তান মাতব্বরের জান শেষ না করেছি ততক্ষণ আমি তোমাদের দিকে নজর রাখবো।

আস্তে, কও বাপ কোথা থাইক্যা কে শুইন্যা ফেলবো আমাগো জান নিয়া নিবো।

 বনহুর ভাবলো, মিথ্যা নয়, চাষী যা বলছে তা সম্পূর্ণ সত্য। এ গ্রামের হর্তাকর্তা ঐ নর পিশাচ শয়তান, ছেলেধরার সর্দার। কি সুন্দর একটা জায়গা বেছে নিয়েছে সে তার ব্যবসা চালানোর জন্য।

বনহুর যখন চিন্তা করছিলো বুড়ো তখন ডাব দুটো কেটে গেলাস ভর্তি করে কন্যার হাতে দেয়–দেও, ওরে খাইতে দেও। আচ্ছা বাপ, তোমার নাম ডা কি এতোহন শোনা অয়নি?

বনহুর হেসে বললো–আমার নাম আলম।

কি কইল্যা–আলম? ওই নাম তো আমাগো দেশে ধানের অয়। তারে কয় আমন ধান।

না না আমন নয়–আলম।

ও আলম?

হ।

তোমারে আমি আলম আলী কইমু?

 একটু হেসে বললো বনহুর-আলম আলী না বলে খালি আলম বল।

 ক্যান? তবে আলম মিয়া কইমু?

 আচ্ছ, যা ভাল লাগে তাই বলো।

সখিনা ডাবের পানিসহ গেলাসটা বাড়িয়ে ধরে–নেও।

না, আর খেতে পারবো না।

সেকি কও বাপ, ডারে মিঠা পানি খাইয়া লও। সুন্দরবন দেশের লগে আইছো, এহন এত ডাব খাইব্যা।

তাতো খেতেই হবে। বনহুর ডাবের পানির গেলাসটা হাতে নিলো সখিনার হাত থেকে।

কথায় কথায় বনহুর জানতে পারলো, এ গ্রামটা প্রায় খুলনার কাছাকাছি সুন্দরবন অঞ্চলের অদূরে কোনো এক জায়গা।

 এখানে বেশিক্ষণ বিলম্ব করার সময় নেই বনহুরের, যেমন করে হোক ছেলেধরার দলে যোগ দিয়ে মালের সঙ্গে যেতে হবে। কিন্তু এদিকে এই অসহায় যুবতী আর তার পিতা–এদের কি করে রক্ষা করবে?

বনহুর এক মুহূর্ত চিন্তা করে নিয়ে বললো সখিনা, তুমি তৈরি হয়ে নাও, আমার সঙ্গে তোমাকে এক জায়গায় যেতে হবে।

বুড়ো তাকালো, কেমন যেন একটু অবিশ্বাসের আভাস তার মুখে।

বনহুর হেসে বললো–ভয় করো না, তোমার মেয়েকে শয়তান মাতবরের কবল থেকে বাঁচানোর জন্যই বলছি।

কই নিয়া যাইবা আমার মাইয়া?

 আমি যেখানে যাবো সেখানে?

 কই যাইবা?

তোমাদের মাতব্বরের বাড়িতে।

সেকি কও বাপ? বুড়োর চোখখানা বড় হয়ে উঠে।

 বনহুর বলে–তুমি যদি আমার উপর ভরসা রাখো তবে ওকে আমার সঙ্গে যেতে দাও।

কি আর কইমু, তুমি ওরে বাঁচাইছে, আবার তুমি যদি ওরে গলা টিইপ্যা মারতি চাও, আমি কি কইমু কও, যা ভাল হয় করো।

বনহুর বলে উঠে শীঘ্র করে একটা ছেঁড়া কাপড় পরে নাও।

 সখিনা তাই করে।

একটা ছেঁড়া কাপড় পরে বনহুরের সমুখে এসে দাঁড়ায়।

 বনহুর ওর আঁচলখানা মাথায় তুলে দিয়ে ঘোমটা টেনে দেয়।

বুড়ো অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে বনহুরের মুখের দিকে। কোনো কথা বলতে পারে না।

বনহুর সখিনার হাত ধরে দ্রুত বেরিয়ে যায় কক্ষ থেকে।

[পরবর্তী বই — সুন্দরবনে দস্যু বনহুর ]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ধূমকেতু

ধূমকেতু

 আমি     যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু
           এই     স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!
সাত      সাতশো নরক-জ্বালা জলে মম ললাটে,
মম       ধূম-কুণ্ডুলি করেছে শিবের ত্রিনয়ন ঘর ঘোলাটে!
আমি     অশিব তিক্ত অভিশাপ,
আমি     স্রষ্টার বুকে সৃষ্টি-পাপের অনুতাপ-তাপ-হাহাকার–
           আর    মর্তে সাহারা-গোবি-ছাপ,
           আমি   অশিব তিক্ত অভিশাপ!

আমি     সর্বনাশের ঝাণ্ডা উড়ায়ে বোঁও বোঁও ঘুরি শূন্যে,
আমি     বিষ-ধূম-বাণ হানি একা ঘিরে ভগবান-অভিমুন্যে।
           শোঁও    শন-নন-নন-শন-নন-নন শাঁই শাঁই,
           ঘুর্       পাক্ খাই, ধাই পাঁই পাঁই
           মম       পুচ্ছে জড়ায়ে সৃষ্টি;
           করি      উল্কা-অশনি-বৃষ্টি,–
আমি   একটা বিশ্ব গ্রাসিয়াছি, পারি গ্রাসিতে এখনো ত্রিশটি।
আমি   অপঘাত দুর্দৈব রে আমি সৃষ্টির অনাসৃষ্টি!

আমি   আপনার বিষ-জ্বালা-মদ-পিয়া মোচড় খাইয়া খাইয়া
জোর   বুঁদ হয়ে আমি চলেছি ধাইয়া ভাইয়া!
শুনি    মম বিষাক্ত 'রিরিরিরি'-নাদ
         শোনায় দ্বিরেফ-গুঞ্জন সম বিশ্ব-ঘোরার প্রণব-নিনাদ!
         ধূর্জটি-শিখ করাল পুচ্ছে
         দশ অবতারে বেঁধে ঝ্যাঁটা করে ঘুরাই উচ্চে, ঘুরাই–
আমি   অগ্নি-কেতন উড়াই!–
আমি   যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু
এই    স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!

ঐ     বামন বিধি সে আমারে ধরিতে বাড়ায়েছিল রে হাত
মম    অগ্নি-দাহনে জ্বলে পুড়ে তাই ঠুঁটো সে জগন্নাথ!
আমি   জানি জানি ঐ স্রষ্টার ফাঁকি, সৃষ্টির ঐ চাতুরী,
তাই   বিধি ও নিয়মে লাথি মেরে, ঠুকি বিধাতার বুকে হাতুড়ি।
আমি   জানি জানি ঐ ভুয়ো ঈশ্বর দিয়ে যা হয়নি হবে তাও!
তাই   বিপ্লব আনি বিদ্রোহ করি, নেচে নেচে দিই গোঁফে তাও!
তোর   নিযুত নরকে ফুঁ দিয়ে নিবাই, মৃত্যুর মুখে থুথু দি!
আর   যে যত রাগে রে তারে তত কাল্-আগুনের কাতুকুতু দি।
মম    তূরীয় লোকের তির্যক্ গতি তূর্য গাজন বাজায়
মম    বিষ নিশ্বাসে মারীভয় হানে অরাজক যত রাজায়!

কচি   শিশু-রসনায় ধানি-লঙ্কার পোড়া ঝাল
আর   বন্ধ কারায় গন্ধক ধোঁয়া, এসিড, পটাশ, মোন্‌ছাল,
আর   কাঁচা কলিজায় পচা ঘা'র সম সৃষ্টিরে আমি দাহ করি
                      আর স্রষ্টারে আমি চুষে খাই!
পেলে   বাহান্ন-শও জাহান্নমেও আধা চুমুকে সে শুষে যাই!

আমি   যুগে যুগে আসি আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু–
এই     স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!
আমি   শি শি শি প্রলয়-শিশ্ দিয়ে ঘুরি কৃতঘ্নী ঐ বিশ্বমাতার শোকাগ্নি,
আমি   ত্রিভুবন তার পোড়ায়ে মারিয়া আমিই করিব মুখাগ্নি!
তাই আমি ঘোর তিক্ত সুখে রে, একপাক ঘুরে বোঁও করে ফের দু'পাক নি!
         কৃতঘ্নী আমি কৃতঘ্নী ঐ বিশ্বমাতার শোকাগ্নি!

         পঞ্জর মম খর্পরে জ্বলে নিদারুণ যেই বৈশ্বানর–
                  শোন্ রে মর, শোন্ অমর!–
                  সে যে তোদের ঐ বিশ্বপিতার চিতা!
        এ চিতাগ্নিতে জগদীশ্বর পুড়ে ছাই হবে, হে সৃষ্টি জানো কি তা?
        কি বলো? কি বলো? ফের বলো ভাই আমি শয়তান-মিতা!
হো হো  ভগবানে আমি পোড়াব বলিয়া জ্বালায়েছি বুকে চিতা!
ছোট   শন শন শন ঘর ঘর সাঁই সাঁই!
ছোট         পাঁই পাঁই!
তুই    অভিশাপ তুই শয়তান তোর অনন্তকাল পরমাই!
ওরে   ভয় নাই তোর মার নাই!!
তুই    প্রলয়ঙ্কর ধূমকেতু,
তুই    উগ্র ক্ষিপ্ত তেজ-মরীচিকা ন'স্ অমরার ঘুম-সেতু
                    তুই     ভৈরব ভয় ধূমকেতু!
আমি    যুগে যুগে আসি আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু
এই      স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু !

ঐ       ঈশ্বর-শির উল্লজ্ঘিতে আমি আগুনের সিঁড়ি,
আমি   বসিব বলিয়া পেতেছে ভবানী ব্রহ্মার বুকে পিঁড়ি !
খ্যাপা  মহেশের বিক্ষিপ্ত পিনাক, দেবরাজ-দম্ভোলি
লোকে  বলে মোরে, শুনে হাসি আমি আর নাচি বব-বম্ বলি !
এই    শিখায় আমার নিযুত ত্রিশূল বাশুলি বজ্র-ছড়ি
ওরে   ছড়ানো রয়েছে, কত যায় গড়াগড়ি !
মহা    সিংহাসনে সে কাঁপিছে বিশ্ব-সম্রাট নিরবধি,
তার    ললাট তপ্ত অভিশাপ-ছাপ এঁকে দিই আমি যদি !
তাই   টিটকিরি দিয়ে হাহা হেসে উঠি,

আমি   বাজাই আকাশে তালি দিয়া 'তাতা-উর্-তাক্'
আর   সোঁও সোঁও করে প্যাঁচ দিয়ে খাই চিলে-ঘুড়ি সম ঘুরপাক!
মম    নিশাস আভাসে অগ্নি-গিরির বুক ফেটে ওঠে ঘুৎকার
আর   পুচ্ছে আমার কোটি নাগ-শিশু উদ্গারে বিষ-ফুৎকার!

কাল            বাঘিনী যেমন ধরিয়া শিকার
                 তখনি রক্ত শোষে না রে তার,
          দৃষ্টি-সীমায় রাখিয়া তাহারে উগ্রচণ্ড-সুখে
          পুচ্ছ সাপটি খেলা করে আর শিকার মরে সে ধুঁকে!
                 তেমনি করিয়া ভগবানে আমি
                 দৃষ্টি-সীমায় রাখি দিবাযামী
ঘিরিয়া  ঘিরিয়া খেলিতেছি খেলা, হাসি পিশাচের হাসি
         এই অগ্নি-বাঘিনী আমি যে সর্বনাশী!

আজ   রক্ত-মাতাল উল্লাসে মাতি রে–
মম    পুচ্ছে ঠিকরে দশগুণ ভাতি,
         রক্ত রুদ্র উল্লাসে মাতি রে!
ভগবান? সে তো হাতের শিকার!– মুখে ফেনা উঠে মরে!
ভয়ে   কাঁপিছে, কখন পড়ি গিয়া তার আহত বুকের 'পরে!
        অথবা যেন রে অসহায় এক শিশুরে ঘিরিয়া

অজগর কাল-কেউটে সে কোন ফিরিয়া ফিরিয়া
চায়, আর ঘোরে শন্‌ শন্ শন্,
ভয়-বিহ্বল শিশু তার মাঝে কাঁপে রে যেমন–
      তেমনি করিয়া ভগবানে ঘিরে
ধূমকেতু-কালনাগ অভিশাপ ছুটে চলেছি রে,
      আর সাপে-ঘেরা অসহায় শিশু সম
বিধাতা তাদের কাঁপিছে রুদ্র ঘূর্ণির মাঝে মম!

আজিও ব্যথিত সৃষ্টির বুকে ভগবান কাঁদে ত্রাসে,
স্রষ্টার চেয়ে সৃষ্টি পাছে বা বড় হয়ে তারে গ্রাসে! 
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *