ধূপ-ছায়া

ধূপছায়া

জাহাজে শেষ রাত্রি। পরদিন ভেনিস পৌঁছব।

তিনদিন ধরে কারো মুখে আর কোনো কথা নেই।—শেষ রাত্রে যে জব্বর ফ্যান্সি বল হবে তাই নিয়ে সুবো-শ্যাম জল্পনা-কল্পনা! মহিলারা কে কি পরবেন। তাই ভেবে ভেবে আকুল হয়ে উঠেছেন। কিন্তু কে কোন বেশ ধরবেন। সে কথা একে অন্যের কাছ থেকে একদম চেপে যাচ্ছেন। নিতান্ত বিপদে পড়লে তবু বরঞ্চ কোনো পুরুষের শরণাপন্ন হওয়া যায়। কিন্তু স্ত্রীলোক?-নৈব নৈব চ। বুঝলুম, আমাদের দেশে ভুল বলে না, বরঞ্চ যমের হাতে স্বামীকে তুলে দেব। তবু সতীনের কোলে নয়।’ এস্থলে বরঞ্চ অপরিচিত, অর্ধপরিচিত হুলোর সাহায্য কবুল, তবু কোনো মেনির ছায়া মাড়াব না।

আমি নিৰ্বাঞ্চাট মানুষ,বয়সে চ্যাংড়া, চব্বিশ হয় কি না হয়। ভয়ে কারোর সঙ্গে কথা কইনে, পাছে এটিকেটের ব্যাকরণ-ভুল হয়ে যায়। আমার কেবিনে—বিবেচনা করুন খুদ কেবিনে, ‘ডেকে’ না, লাউঞ্জে’ না—এক গরবিনী ফরাসিনী ভামিনী এসে উপস্থিত, ‘মসিয়ো, তিন সত্যি দাও, কাউকে বলবে না, তোমাকে যা বলতে যাচ্ছি।’

বাপ মা আদর করে বলতেন। আমার নাকি উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। আমি বিলক্ষণ জানি, আমার বর্ণ কি? আমারই এক বন্ধু আমার রঙ দেখিয়ে দোকানদারকে বলেছিলেন, ঐ রঙের বুট-পালিশ দিতে। লজ্জায় সেই বর্ণটিকেয় আগুন ধরার রঙ চড়ালো। সাত বার খাবি খেয়ে বললুম, ‘ইয়েস, ইয়েস, উই, উই, উই; বিলক্ষণ, বিলক্ষণ!’

বললেন, ‘আপনার সিস্কের পাগড়িটা এক রাত্রের মত ধার দিন।’ আমার মত কালো কুচ্ছিৎকে তিনি প্রেমানিবেদন করবেন। সে দুরাশা আমি করি নি। কিন্তু নিতান্ত গদ্যময়ী পাগড়ি! কে বলে ফরাসিনী সুরসিক?

তা যাক গে—এইটে আসল বক্তব্য নয়। মোদ্দা কথা, এই করে করে ফ্যান্সি বল। ‘রূপায়িত’ হল।

ইলাহি ব্যাপার, পেন্নাই কাণ্ড। শিখের বাচ্চা দাড়িমাড়ি বাগিয়ে ভলগা-মাঝির পোশাক পরে নাচছে চীনা পাজামা-কুর্ত পরা নধরা ভিয়েনা-সুন্দরীর সঙ্গে, বগলে ঝাড়ু দেবে মেথরানীর বেশ পরে ফরাসিনী ধেই ধেই করছেন স্প্যানীয় রাজপুত্রের বেশে মিশকালো নিগ্রের সঙ্গে, রেড় ইন্ডিয়ানের রঙ মেখে জাপানী তুর্কী-নাচন নাচছেন এক পাসী। নারীর সঙ্গে-তীর সর্বাঙ্গ প্যাকিঙের ব্রাউন-পেপারে মোড়া, তদুপরি কালো হরফে লেখা ‘রেজাইল, উইথ কেয়ার’–কঁচের বস্তু, ভঙ্গুর, সাবধানে নাড়াচাড়া করো।’

এ সব বস্তু রপ্ত হতে বাঙালি ছেলের সময় লাগে।

 

আমি কি পরে গিয়েছিলুম তা আর বলব না। একেই তো মার্কটের মত চেহারা, তাকে ‘ফিনসি’ করলে বড়ি শুকনোর সময় কাগ তাড়াবার জন্য পাড়ায় ডাক পড়বে।

বারে গিয়ে দাঁড়ালুম।

উঃ! চ্যাংড়া-চিংড়ীরা কী বেদম ফুর্তিটাই না করতে জানে। হোলির দিনে যেমন মানুষ গায়ে রঙ মাখে এঁরা ঠিক তেমনি দুপাত্তর রঙিন জল গিলে মনে রঙ লাগিয়ে নিয়েছেন। চোখ অল্প অল্প গোলাপী হয়ে গিয়েছে-বিশ্বসংসার গোলাপী রঙে ছোপানো বলে মনে আমেজ লাগছে। না হয় খর্চ হয়েই গেল শেষ কড়ি-খৰ্চা না করলে খুদা আরো পয়সা দেবেন কি করে? না হয় নাচলই লক্ষ্মীছাড়া মেরিটা ঐ খাটাশ-মুখো সেপাইটার সঙ্গে তোমাকে ছোলাগাছি দেখিয়ে-ভয় কি, আরো মেলা মেরি ফেনী রয়েছে। মনে আরেক পোঁচ রঙ লাগিয়ে লাও হে লাটুবাবু, বাবুরা যখন অত করে কইচোন। বেবাক বাৎ ভুলে যাবে। অত সিরিয়স হয়ো না মাইরি, এই শেষ পরবের রাত্তিরে।

তার সঙ্গে এ কোণে ও কোণে, হেথা-হোথা, একে অন্যের কানে কানে কত মৃদু মর্মর গানে মর্মের বাণী বলা’, কত ‘বেদনার পেয়ালা’ ভরে গেল কত হিয়ায়, কত গান উঠলো। বুকে বুকে, পিয়ো হে পিয়ো’।

অরকেস্ট্রা কিন্তু ঢাক ঢোল কত্তাল বাজিয়ে হুঙ্কার দিচ্ছে–

‘ওগো, ডন ক্লারা, তোমাকে আমি নাচতে দেখেছি
ওগো, ডন ক্লারা, তোমার সোনার ছবি বুকে এঁকেছি।’

***

বাইরে এসে ডেকের সুদূরতম প্রান্তে একখানা চেয়ার টেনে একলাটি চুপ করে বসলুম। সিগার সিগারেটের অত্যাচারে সমুদ্রের লোনা হাওয়া জলসাঘরে নাক গলাতে পারে নি; আমাকে পেয়ে খুশি হয়ে আমার সর্বাঙ্গে আদর করে হাত বুলিয়ে গেল।

আজ কি অমাবস্যা? এরকম অন্ধকার শ্রাবণ-ভান্দ্রের মেগাচ্ছন্ন অমা-যামিনীতেও দেশে কখনো দেখি নি। গাছপালা, বাড়িঘরদের যেন অন্ধকারের খানিকটে শুষে নেয় বলে ডাঙার অন্ধকার সমুদ্রের অন্ধকারের চেয়ে অনেকখানি হাস্কা। এখানে দিনের বেলাকার নীল সমুদ্র আর নীল আকাশ রাত্ৰিবেলায় যেন এক হয়ে মিশে গিয়ে জমে উঠে গড়ে তুলেছে এক ঘনকৃষ্ণ অন্ধপ্রাচীর, না-আরো কাছে এসে আমার চোখে মাখিয়ে দিয়ে গেছে কৃষ্ণাঞ্জন।

শুধু চিলিক মেরে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে প্রপেলারের তাড়ায় ভেসে-ওঠা ফেনা আর বুদ্বুদ। ঐ ফেনাটুকু মাঝে মাঝে না দেখতে পেলে মনে ভয় জগত অন্ধ হয়ে গিয়েছি, জলসাঘরের দিকে ছুটে গিয়ে আলো দেখে সেখান থেকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনতে হত। জাহাজের হৃৎপিণ্ড যেন ধপধপ করছে—তাই অষ্টপ্রহর একটা একটানা মৃদু শিহরণ জাহাজের সর্বাঙ্গে লেগেই আছে। সে শিহরণ এমনিতে দেহেমনে অস্বস্তি জাগায় কিন্তু আজ এই মৃত্যু-অন্ধকারে সে স্পন্দন যেন আমার চৈতন্যবোধকে গভীরতম। শুষুপ্তি থেকে বাঁচিয়ে রাখল।

কান্নার শব্দ?

তাজা হাওয়া পাওয়ার জন্য কে যেন সুদূর জলসাঘরের একখানি জানালা খুলে দিয়েছে। তারই ক্ষীণ আলোতে দেখি একটি মেয়ে রেলিঙে মাথা রেখে কাঁদিছে।

এ মেয়ে সিঙ্গাপুর গিয়েছিল তার স্বামীর সঙ্গে হনি-মুন যাপন করতে। সেখানে স্বামী হঠাৎ মারা যায়। দেশে ফিরে যাচ্ছে একা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *