ধুলোবালির জীবন – ৮

ফোন কেউ ধরছে না। ভিতরে নারী কণ্ঠে একটানা গান হয়ে চলেছে,

‘আকাশ হতে খসল তারা/‌আঁধার রাতে পথহারা.‌.‌.‌’

ফোন কেটে একটু অপেক্ষা করে, ঝুমুর আবার নম্বর টিপল। একই অবস্থা। গান হয়ে যাচ্ছে।

গান শুনে মনে হচ্ছে, ফোনের মালিক একজন শিক্ষিত, রুচিশীল মানুষ। সেই কারণে কলার টিউনে এই ধরনের গান রেখেছে। ঝুমুরের অভিজ্ঞতা বলছে, এই ধরনের লোক বেশি ঝামেলা করে। দরজা বন্ধ হলে প্রথমে প্রেমের ভান করে। নরম-নরম কথা বলে। গান গাইতে বলে। ইনিয়ে-বিনিয়ে নিজের দুঃখের কাহিনি শোনায়। বউ কত খারাপ, সে কত একা। তারপরেই বিছানায় উঠে নিজেদের নখ দাঁত বের করে। তখন আঁচড়ায়, কামড়ায়। নোংরা কথা বলে। সমস্যা হল, তার কারবার বেশির ভাগই এই ধরনের ‘ভদ্রলোক’-এর সঙ্গে। সে সতর্ক থাকে। যতটা সম্ভব নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে।

ঝুমুর দাঁড়িয়ে আছে উঁচু একটা ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে। এই ফ্ল্যাটের ৪/২ নম্বর ফ্ল্যাটে তার যাওয়ার কথা। ফ্ল্যাট মালিকের একটা ফোন নম্বর তাকে দেওয়া হয়েছে। ফোন করে তাকে বলতে হবে ‘সন্তোষ পাঠিয়েছে’। তখন সেই লোক তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে এবং লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দেবে। কিন্তু কেউ ফোন ধরছে না। যদিও ঝুমুর লেট করেছে। একটু লেট নয়, পাক্কা চল্লিশ মিনিট লেট। বিকেলে আবার হাসপাতালে যাওয়ার জন্য দেরি, তার উপর জ্যাম। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ছুটতে-ছুটতে ট্যাক্সি নিয়েও লাভ হয়নি। পথে আটকে পড়তে হয়েছে। ঝুমুর ট্যাক্সিতে উঠে ফোন করবে ভেবেও থমকে গিয়েছিল। ইনস্ট্রাকশনের বাইরে গিয়ে পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় না। তাকে বলা আছে, বাড়ির সামনে গিয়ে ফোন করতে হবে। সুতরাং বাড়ির সামনে গিয়েই করতে হবে। আগে নয়। এরকম ইনস্ট্রাকশন প্রায়ই আসে। দরজায় একবারের বেশি নক করা যাবে না। ‘ভদ্রলোক’-দের ভয় অনেক বেশি।

একজন মোটামতো লোক ফ্ল্যাটবাড়ির গেট খুলে বেরিয়ে এল। ঘাড় ঘুরিয়ে ঝুমুরের দিকে কয়েকবার তাকাল। ঝুমুর একটু অন্ধকারে সরে গেল। এই কি সেই লোক? ঝুমুর আবার ফোন করল। যদি এই লোক হয়, পকেটে ফোন বেজে উঠবে। ফোন বেজে উঠল না। লোকটা রাস্তা পেরিয়ে চলে গেল।

সন্তোষের ফোন এল, “আপনি কোথায়?”

ঝুমুর বলল, “পার্টির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি সন্তোষদা।”

সন্তোষ চাপা গলায় বলল, “এত দেরি কেন?”

ঝুমুর বলল, “রাস্তায় জ্যাম ছিল।”

সন্তোষ রাগের গলায় বলল, “এতক্ষণ জ্যাম !‌‌ কোন রাস্তায় জ্যাম পেলেন আপনি?”

ঝুমুর বুঝতে পারল এই লোককে মিথ্যে বলে লাভ নেই। এই লাইনে অনেকদিন হয়ে গিয়েছে। মেয়েদের মিথ্যে শুনে অভ্যস্ত। হাঁ করলে বুঝতে পারে। তা ছাড়া লোকটা তাকে ‘কাজ’ দেয়। আর পাঁচটা মেয়েকে যেভাবে ‘কাজ’ দেয়, সেভাবে দেয় না। ভেবেচিন্তে, বুঝেশুনে দেয়। খুব রেগে না গেলে কথাও বলে ভদ্রভাবে। অথচ এই পেশায় দালালদের মুখে খিস্তিটাই স্বাভাবিক। সন্তোষ কোনওদিন তাকে ‘আপনি’ সম্বোধন ছাড়া কথা বলেনি। এই লোককে মিথ্যে বললে মনের ভিতরে খচখচ করে। ঝুমুর বলল, “আসলে একটা জায়গায় আটকে গিয়েছিলাম। হুট করে যেতে হল।’

সন্তোষ চাপা গলায় বলল, “এই কথার মানে কী? দেরি দেখে‌ পার্টি আমাকে ফোন করেছিল। আপনাকে আমি ফোনে ধরার চেষ্টা করলাম। দেখি, নট রিচেবল বলেছে।”

ঝুমুর কাঁচুমাচু গলায় বলল, “হতে পারে। হাসপাতালের ভিতরে ছিলাম। অনেক সময় মোবাইলে নেটওয়র্ক থাকে না।”

‌সন্তোষ কঠিন গলায় বলল, “এভাবে কাজ করা যাবে না। পার্টির হাতে ওই এক ঘণ্টাই টাইম ছিল। ভাল পেমেন্ট ছিল। তার চেয়ে বড় কথা, এই লাইনে কথা দিয়ে ফেল করা যায় না। এরা আমার চেনা কাস্টমার।”

ঝুমুর বলল, “সরি। আর হবে না। আসলে এমন একটা বিচ্ছিরি কেসে জড়িয়ে পড়েছিলাম। সকালে একটা লোক চোখের সামনে বাস থেকে পড়ে গেল …”

‌‌সন্তোষ আরও রেগে গেল, “এসব কাঁদুনি আমার কাছে গাইতে আসবেন না। যা খুশি করুন। আমি আপনাকে কাজ দিতে পারব না। মনে রাখবেন, ইনকাম শুধু আপনার নয়, আমারও। কোনও ক্ষতি আমি মেনে নেব না।”

‌‌‌সন্তোষ ফোন কেটে দিলে ঝুমুর অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগল। বিধাননগর রেলস্টেশন এখান থেকে কতটা দূর? হেঁটে যাওয়া যাবে না? বাসে-ট্রামে উঠতে ইচ্ছে করছে না। একটু হাঁটার পর ক্লান্ত লাগল। সকাল থেকে অনেক দৌড়ঝাঁপ গিয়েছে। হাত দেখিয়ে একটা অটোয় উঠে পড়ল ঝুমুর।

স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠার পর ঝুমুরের নিজের উপর রাগ হতে লাগল। ওই ধীমান না নিধান লোকটা যত নষ্টের গোড়া। এই লোকের জন্য আজ সকালে অফিসে ঢুকতেও দেরি হয়েছে। অফিস নামেই। একটা ঘরে মালিক ছাড়া তিনটে লোক। মাইনে খুব সামান্য। কাজ সবসময় থাকে না। ব্যাবসা ভাল যাচ্ছে না। ক্লিয়ারিং-এর কাজে যে টাকাপয়সা দরকার, বেশিরভাগ সময়েই থাকে না। বাজারে বকেয়াও পড়ে আছে প্রচুর। টানা কাজ না করতে পারলে কেউ চট করে পুরনো টাকা দিতে চায় না। প্রথমদিকে হাল এতটা খারাপ ছিল না। দেরি হলেও মাইনে পাওয়া যেত। এখন দু’-তিন মাস আটকে থাকে। মাঝবয়সি মালিক সারাক্ষণ বেজার মুখে থাকে আর বলে, “এবার বন্ধ করে দেব। অফিসঘরের ভাড়াটাই লোকসান হয়ে যাচ্ছে।”

কর্মচারীরা বলেছিল, “আমরা কী করব?”

“অন্য চাকরি খুঁজে নিন। যতদিন না পান, এখানে থাকুন।”

“আমাদের বকেয়া বেতনের কী হবে?”

মালিক হতাশ গলায় বলেছিল, “আমার ঘরে ‌টাকা এলে, আপনারাও পাবেন।”

মাঝে-মাঝে হয়তো ব্যাবসা একটু নড়েচড়ে বসে। বকেয়া বেতনের খানিকটা মেটে। সবাই উৎসাহ নিয়ে কাজ করে। কিছুদিন পরে আবার যেই কে সেই। সকলেই অন্য কাজকর্ম খুঁজে চলেছে। ঝুমুরের অবস্থা দিন-দিন খারাপ হতে থাকে। ছোটখাটো কাজও নেই। এদিকে বাড়ির দায়িত্ব ঘাড়ের ওপর। বাবা নেই, মা অসুস্থ, ভাই ছোট। বাড়িভাড়া বাকি। ভাই মুদির দোকানে যেতে চায় না। গেলেই বাকি থাকা টাকার কথা বলে। পাঁচজনের সামনে অপমান করে। একদিন মৌলালির কাছে স্বর্ণার সঙ্গে দেখা হল। পুরনো পাড়ার থাকত। তারপর দীর্ঘদিন দেখা নেই। স্বর্ণাকে দেখে চিনতেই পারছিল না ঝুমুর। একসময়ে খেতে না পাওয়া শুকনো চেহারার মেয়ে একেবারে ঝলমল করছে! পোশাক দামি। হাতের মোবাইলটাও লম্বা চওড়া।‌ ঝুমুরকে জোর করে রেস্তরাঁয় নিয়ে গিয়ে পেটপুরে খাওয়াল। হেসে-হেসে গল্প করল। পুরনো দিনের গল্প।

ঝুমুর বলেছিল, “মনে হচ্ছে, খুব ভাল আছিস। ব্যাপারটা কী?”

স্বর্ণা ভুরু তুলে বলেছিল, “ভাল রোজগার করছি।”

ঝুমুর বলেছিল, “আমাকেও টাকাপয়সার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবি? অবস্থা আউট অব কন্ট্রোল।‌”

‌স্বর্ণা ঝুঁকে পড়ে নিচু গলায় বলেছিল, “সত্যি করবি?”

“ওমা, মিথ্যে হবে কেন!‌ আমার অবস্থা দেখছিস না? ট্রেনের মান্থলি ফুরিয়ে গেলে নতুন মান্থলি করার টাকা থাকে না। কলেজ পর্যন্ত পড়েছি, কিন্তু যা নম্বর, তাতে ভদ্রস্থ চাকরি পাওয়া যায় না। আয়ার কাজও তো জানি না। এদিকে বাবা চলে যাওয়ার পর বাড়ির সব দায়িত্ব ঘাড়ে। আত্মীয়স্বজন কেটে পড়েছে। হাবুডুবু খাচ্ছি। অন্য কেউ হলে সুইসাইড করে নিত এতদিনে। আমাকেও মনে হয় করতে হবে।”

‌‌স্বর্ণা বন্ধুর চোখের দিকে কিছুক্ষণ স্থিরভাবে তাকিয়ে থেকে বলেছিল, “রোজগারের ব্যবস্থা আমি করে দেব। রাজি হবি?”

“কী ব্যবস্থা?”

‌‌স্বর্ণা একইভাবে চোখে চোখ রেখে নিচু গলায় বলেছিল, “আমি যেভাবে রোজগার করছি।”

‌‌‌স্বর্ণার কথা বলার ভঙ্গিতে ঝুমুরের কেমন সন্দেহ হয়েছিল।

‘তুই কী করিস?”

‌‌‌“ঘরের দরজা বন্ধ করে এক ঘণ্টা পুরুষমানুষের সঙ্গে থাকি। তারপর টাকা গুনে নিয়ে বেরিয়ে আসি। কেউ জানতেও পারে না। তোর বেলাতেও জানতে পারবে না।”

ঝুমুর শিউরে উঠে বলেছিল, “কী বলছিস যা-তা!‌”

‌‌‌স্বর্ণা চোখ সরু করে বলেছিল, “কেন? মালিকের লাথি ঝাঁটা খাই না বলে? বসের হাত পেটে বুকে পড়ে না তাই? যেখানে কাজ করতে যাই, সেখানে হাফ মাইনে দিয়ে বা না দিয়ে তাড়িয়ে দেয় না বলে? তাই যা তা? আমাদের মতো মেয়েরা তো‌ না পারি বড় চাকরি বাকরি করতে, না পারি লোকের বাড়ি বাসন মাজতে। তার চেয়ে এই ভাল। নিজের মালিক নিজে। রোজগারও ভাল।”

“ছি-ছি!”

‌‌‌স্বর্ণা মলিন হেসে বলেছিল, “ঝুমুর, এই বয়েসেই বুঝেছি, ছি-ছি জিনিসটা খুব কঠিন। চারপাশে প্রতিদিন কত ছি-ছি করার ঘটনা হাততালি পেয়ে চলেছে, তার ঠিক নেই। আমাদের ছি-ছি বলা খুব সহজ। আমাদের শরীর যখন আমাদের অনুমতি ছাড়া অন্যরা ব্যবহার করে, তখন ঠিক আছে। আমরা ব্যবহার করলে ছি-ছি? যাক, তুই ‌ছি-ছি করতে-করতে ভেবে দেখিস। আমার ফোন নম্বরটা রাখ। সুইসাইড করার আগে ফোন করিস।”

এর তিনদিন বাদে বাড়িওয়ালা এসে যখন দু’ মাসের বাকি থাকা ভাড়া চাইল, সেদিন রাতে স্বর্ণাকে ফোন করে বসল ঝুমুর।

সকালে ঝুমুর কলকাতায় এসেছিল মায়ের ওষুধ খুঁজতে। ডাক্তারের লিখে দেওয়া একটা ওষুধ কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। পার্ক সার্কাসের একটা দোকানে বলেছিল, “কাল সকালে একবার আসুন। ওষুধটা আসার কথা। সাপ্লাই কম আছে, একটা–দুটো করে আসছে।”

ঝুমুর ঝুঁকি নিতে চায়নি। সকালেই চলে গিয়েছিল। পার্থকে বলে লাভ হত না। তার সামনে উচ্চ মাধ্যমিক। পরীক্ষা না থাকলেও, কিছু হত না। পার্থ বাড়ির কোনও কাজ করতে চায় না। তিন বছর ধরে হার্টের অসুখ নিয়ে মা শুয়ে আছে। প্রথমদিকে একটু আধটু দেখাশোনা করত। এখন সেটাও করে না। বাড়িতে বিশেষ কথাবার্তা বলে না। কিছু বললে, বেশির ভাগ সময় জবাব না দিয়ে চলে যায়। যত দিন যাচ্ছে, দিদির উপর যেন একধরনের রাগ বাড়ছে ওর। তবে ছেলেটা লেখাপড়ায় ভাল। মাধ্যমিকে ভাল নম্বর পেয়েছিল। সায়েন্স পড়ছে। বাড়িতে থাকলে বেশির ভাগ সময়ে ঘরে দরজা আটকে পড়ে। পার্থ যতই তার দিদিকে দেখতে না পারুক, ভাইকে নিয়ে ঝুমুরের অনেক আশা। কষ্ট হলেও, দুটো টিউশনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। পার্থ অসুবিধে বুঝতে চায় না। গজগজ করে। ঝুমুরের উপর মাঝে-মাঝে রেগে যায়।

“সবাই বড় জায়গায় কোচিং নিচ্ছে।”

ঝুমুর বলে, “তুইও তো নিচ্ছিস।”

পার্থ বলে, “ওই টিউশন তো হায়ার সেকেন্ডারির জন্য। জয়েন্ট এন্ট্রান্সে বসতে গেলে আলাদা কোচিং লাগে। অনেক টাকা লাগে।”

ঝুমুর বলে, “অত টাকা কোথা থেকে পাব?”

“সেই জন্যই তো আমার হবে না। এমন একটা বাড়িতে জন্মালে কিছু হওয়ার থাকে না।”

ঝুমুর রেগে গিয়ে বলে, “গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরাও আজকাল লেখাপড়ায় কত ভাল করছে।”

পার্থ ঝাঁঝিয়ে ওঠে। বলে, “ওসব গল্পকথা আমাকে শোনাতে এসো না। তোমরা আমার পিছনে খরচ করতে পারবে না, সেটা বলো।”

“এর বেশি কী করে পারব!‌ তোর বাবা ছেলের লেখাপড়ার জন্য ব্যাঙ্কে ক’টা টাকা রেখে যেতে পেরেছে? ডাল–ভাতের টাকাই রাখতে পারেনি, তো পড়ার খরচ রাখবে! তার উপর মা এতদিন বিছানায় পড়ে আছে। ডাক্তার-ওষুধের তো খরচ রয়েছে। সবটাই আমার ওই নড়বড়ে কাজ থেকে রোজগার করতে হয়। সেটা একবারও ভাববি না?”

পার্থ দিদির চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “কেন ভাবব? আমার লেখাপড়া জানাটা অন্যায়? আমি যে আরও বেশি-বেশি পড়ে জীবনে দাঁড়াতে চাই সেটা অন্যায়?”

“অন্যায় কেন হবে!‌ ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করলে কি বাড়ির দায়িত্ব কিছু নিতে নেই?”

“না নিতে নেই। বাড়ি আমাকে কী দিচ্ছে? দুটো টিউশনের মাইনে দাও বলে কি আমার মাথা কিনে নিয়েছ? হিসেব সব লিখে রাখো, একদিন মিটিয়ে দেব।”

ভাইয়ের এই কথা শুনে ঝুমুরের যেমন রাগ হয়, তেমন দুঃখও হয়। তারপরেও সে নিজেকে বোঝায়, ছেলেমানুষ। মাথা গরম হলে তো হাবিজাবি বলবেই। এই ছেলেকে মায়ের ওষুধ খোঁজার কথা বলার কোনও মানে হয় না। আজ সকালে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে কলকাতায় মায়ের ওষুধ কেনে ঝুমুর। এবার অফিসে যাওয়া। কিছু টাকা পাওয়ার কথা আছে। হাতে সময় ছিল। ফুটপাথ ধরে অলস ভাবেই হাঁটছিল। কী অদ্ভুত এই কলকাতা শহর! কখনও মনে হয় উদাসীন, কখনও মনে হয়ে মায়ায় ভরা। কখনও সে-ই মায়া ছুড়ে ফেলে নিষ্ঠুর হয়ে যায়। এই শহর পেটের ভাত কেড়ে নিতে জানে, আবার ভাতের ব্যবস্থাও করে দেয়। ক্লিয়ারিং-এর অফিস থেকে প্রথম মাসের বেতন পেয়ে মনে হয়েছিল, ভাগ্যিস কলকাতা ছিল। না হলে তো বাড়ির সবাইকে নিয়ে ভেসে যেতে হত। তবে কলকাতা কি ভাসিয়ে দেয়নি? এখন যা করে ঝুমুর দুটো পয়সা রোজগার করে, সে তো ভেসেই যাওয়া। তবে সেদিন যদি স্বর্ণার সঙ্গে দেখা না হত, তা হলে আজ কী হত?

সন্তোষের কাছে ‘কাজ’ মাসচারেক হয়ে গেল। চাপ নেই। সপ্তাহে দুটোর বেশি ‘কাজ’ দেয় না। খুব বেশি হলে তিনটে। এই কাস্টমাররা বেশি সময় নেয় না। রাতে থাকার ব্যাপার নেই বললেই চলে। বেশির ভাগের ঘরসংসার আছে। বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকে। মধুচক্র, মাসাজ পার্লার, রিসর্টে যাওয়ার মনে-মনে ইচ্ছে, কিন্তু সাহসে কুলোয়নি। তাই বেশি খরচ করে একা ব্যবস্থা করে। এর ফ্ল্যাট, তার কোয়ার্টার‌ ফাঁকা পেল তো ঘণ্টাখানেকের মজা। নিজের বাড়ি ফাঁকা থাকলেও ডাকে। বেশির ভাগই আনকোরা। বিছানায় বউ ছাড়া কাউকে কখনও দেখেনি। এটা ঝুমুরের জন্য বিরাট সুবিধে… অল্প সময়ের মধ্যেই কবজা করে ফেলে। কেউ আবার কিছুই করে না। দেখেই সুখ পায়। সন্তোষ ঠিকই বলেছে, পেমেন্টে সমস্যা হয় না। বরং ‘ফ্রেশ’ জেনে বেশিও দেয়। সন্তোষের নিয়ম হল, সবার কাছে নতুন নামে যেতে হবে।

বাস স্টপের কাছে ব্যাগের ভিতর ফোন বাজল ঝুমুরের। সন্তোষদা। রিং টোন আলাদা করা আছে।

“কী হয়েছে?”

“আজ ইভনিং-এ কাজ নিতে পারবেন? সাতটা থেকে ম্যাক্সিমাম ন’টা।”

ঝুমুর জিজ্ঞেস করে, “কোথায়?”’

“কাঁকুড়গাছির কাছে। ফ্ল্যাটে যেতে হবে।”

ঝুমুর বলল, “দেরি হবে না তো? মায়ের ওষুধ আছে। রাতে খাওয়াতে হবে।”

সন্তোষ ওপাশ থেকে বলল, “আরে বাবা না। বউ বাড়িতে নেই, হঠাৎ ইচ্ছে হয়েছে.‌.‌. ‌নইলে এই ঝুঁকি কেউ নেয়? ধরা পড়ার ভয় নেই?”

ঝু্মুর বলল, “ঠিক আছে।”

সন্তোষ একটু চুপ করে থেকে নিচু গলায় বলল, “সঙ্গে বইটই কিছু আছে?”

“বই দিয়ে কী হবে?”

সন্তোষ বলল, “না, তা হলে বলতাম লাইব্রেরিতে লেখাপড়া করছে। দেখছি ম্যানেজ করা যায় কি না। এই কাস্টমার এরকম চায়।”

ঝুমুর বিরক্ত হয়ে বলল, “না, আমার কাছে বইটই নেই। লেখাপড়া করা মেয়েদের অপমান করার দরকার কী?”

সন্তোষ চকিতে জবাব দিল, “আপনিও তো লেখাপড়া করেছেন, যতটা আপনার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। কী সম্মান জুটেছে?‌ যাক, সময়মতো চলে যাবেন। ঠিকানা ফোন নম্বর দিয়ে দিচ্ছি। বাড়ির সামনে গিয়ে ফোন করবেন। মনে রাখবেন, ওখানে আপনার নাম ছন্দা।”

“ঠিক আছে।”

ফোন কেটে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল ঝুমুর। ততক্ষণে বেলা খানিকটা চড়ে গিয়েছে। ভাবছিল, ভালই হল। ওষুধের জন্য অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। পার্থ অনেকদিন ধরে ক’টা রেফারেন্স বইয়ের জন্য রাগারাগি করছে।

বাস আসছে দেখে ফুটপাথ থেকে নেমে এগিয়ে গিয়েছিল ঝুমুর। আর তখনই ঘটনা ঘটল। উসকো খুসকো চেহারার একটা লোক দু’ হাতে একটা টব ধরে বাস থেকে নামতে গেল। ভিড় বাস তখনও পুরো থামেনি। লোকটা বাসের শেষ সিঁড়ি থেকে ছিটকে পড়ল পথে। পথের ও বাসের দু’–একজন হইহই করে উঠল! বাস কোনও ভ্রূক্ষেপ না করে নিজের মতো স্পিড বাড়িয়ে ছুটল। লোকটা মুখ থুবড়ে পড়ে রইল পথেই। হাতের টব ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। কিছু লোক দেখছে, কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছে না। ঝুমুর নিজেকে সামলাতে পারল না। এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে লোকটাকে তুলতে গেল। একটা মেয়েকে এগিয়ে যেতে দেখে কয়েকজনের বোধহয় প্রেস্টিজে লাগল। এগিয়ে গেল। একটা ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে লোকটাকে তোলা হল ধরাধরি করে। সে কথা বলার অবস্থায় নেই। ঝুমুরের সঙ্গে আরও দু’জন উঠল ট্যাক্সিতে। কাছেই হাসপাতাল। রক্তাক্ত লোকটাকে এমার্জেন্সিতে শুইয়ে দেওয়ার পরেই ঝুমুর বুঝতে পারল, তার সঙ্গে আরও যে দু’জন এসেছিল, তারা পালিয়েছে।

ঝুমুরও ভেবেছিল, আর হাসপাতালমুখো হবে না। তারপরেও বিকেলে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল। লোকটার কি জ্ঞান ফিরেছে? নিজের ঠিকানা, আত্মীয়স্বজনের যোগাযোগের নম্বর হাসপাতালকে জানাতে পেরেছে? হাসপাতালে পৌঁছে জানতে পারল, পেশেন্ট ভাল আছে। কাল হয়তো ছুটি হয়ে যাবে।‌

বেলঘরিয়া স্টেশনে ট্রেন ঢুকছে। সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ঝুমুর। বড় অদ্ভুত মানুষ। ঝামেলায় ফেলেছে, তারপরেও কেমন একটা মায়া আদায় করে নেওয়ার ক্ষমতা আছে। কিছু মানুষ বোধহয় এরকমই হয়। সঙ্গে থাকা যায় না, আবার ফেলাও যায় না। সত্যি লোকটার কেউ নেই!‌ হতেই পারে। কত মানুষেরই তো কেউ নেই। তার নিজেরই বা কে আছে? মা অপেক্ষা করে থাকে, কখন মেয়ে রোজগার করে ফিরবে, আর ভাই থাকে বিরক্ত হয়ে। ভাবে, যতটা তার পাওয়া উচিত, দিদি দিচ্ছে না। এই মানুষটা সংকুচিত, কুণ্ঠিত। ভিতরে কোথায় যেন এক ধরনের ভালমানুষি আছে। নিজে যে মরে যেতে পারত, তাই নিয়ে কোনও উদ্বেগ নেই। একটা সামান্য গাছের টব নিয়ে ভাবছে!‌ কেউ কখনও টব জড়িয়ে বাস থেকে নামে? লোকটা আসলে পাগলাটে। যাক, সুস্থ হয়ে এবার নিজেই বাড়ি যাবে। ঘাড় থেকে নেমেছে। বাঁচা গিয়েছে।

ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফর্ম ধরে কয়েক পা এগোতেই মোবাইল বেজে উঠল।

“কী হয়েছে সন্তোষদা?”

“খুব ভাল পার্টি। রাতে থাকতে হবে।”

ঝুমুর বলল, “অসম্ভব। আমি বেলঘরিয়া চলে এসেছি।”

সন্তোষ বলল, “তাতে কী? ওখান থেকে কলকাতায় আসার গাড়ি নেই? ক’টা বাজে? এগারোটায় ঢুকলেও চলবে। বালিগঞ্জের গেস্ট হাউস। বাইরে থেকে এসেছে, এখানে কোথায় লেকচার দেবে। রাতে বাঙালি মেয়ের সঙ্গে গল্প করতে চায়। তবে আজেবাজে হলে চলবে না।”

ঝুমুর বলল, “পারব না।”

সন্তোষ চাপা গলায় বলল, “তিনগুণ পেমেন্ট। নাইট চার্জ আলাদা। ভেবে বলুন। এখনও হাতে সময় আছে।”

‌ঝুমুর বলল, “পারব না সন্তোষদা। আমি টায়ার্ড।”

সন্তোষ একটু চুপ করে থেকে বলল, “ঠিক আছে। মনে রাখবেন, বেছে কাজের ঝক্কি আছে। সামলাতে হয়। তা ছাড়া ভাবলাম আজকের সন্ধেটা যখন মিস করেছেন, তখন এটায় যদি মেকআপ হয়। আপনার জন্যই ভেবেছিলাম। থাক, আপনি যখন রাজি নন।”

‌ঝুমুর বলল, “না, আমি রাজি নই।”

স্টেশন থেকে রিকশায় ওঠার আগে ঝুমুর সন্তোষকে ফোন করল।

“আমি বাড়ি ঘুরে যাচ্ছি। ঠিকানা মেসেজ করুন।”

সন্তোষ বলল, “ঠিকানা লাগবে না। বিধাননগর স্টেশনে গাড়ি থাকবে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *