ধুলোবালির জীবন – ৭

চোখ খুলল বিধান। একটু অপেক্ষা করে মাথাও তুলতে গেল।

কেউ একজন পাশ থেকে বলে উঠল, “উঠবেন না, উঠবেন না! প্লিজ়, শুয়ে থাকুন।”

বিধান গলা চিনতে পারল না। কিন্তু বুঝতে পারল, মেয়ের গলা। কোনও মেয়ে তার সঙ্গে কথা বলছে? সে কোথায় ?

গোটা শরীর জুড়ে ব্যথা। মনে হচ্ছে কোনও ভারী পাথরের নীচে শুয়ে আছে। ফের চোখ বুজল বিধান এবং দ্রুত একটা আচ্ছন্নভাবের মধ্যে চলে গেল। খানিকটা ঘুম, খানিকটা জেগে থাকা। এই অবস্থাতেই স্বপ্ন দেখল বিধান। সে একটা গোলাপ বাগানের মধ্য দিয়ে হাঁটছে। বাগান দিগন্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। শুধু ফুল আর ফুল। সমস্যা একটাই, সব ফুলই সাদা-কালো। বিধান দেখল, তার পাশে একটা মেয়ে‌ হাঁটছে। বিধান ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটির মুখ দেখার চেষ্টা করল। একবার নয়, বেশ কয়েকবার। কিন্তু পারল না। মেয়েটি রিনরিনে গলায় কথা বলল, “বাগানটা কী সুন্দর না?”

বিধান বিরক্ত হয়ে বলল, “সুন্দর কোথায়? সব ফুলই তো সাদা–কালো।”

মেয়েটি হাসল। বলল, “বোকা একটা। ‌স্বপ্ন তো সাদা–কালোই হয়। বইতে পড়েননি?”

বিধান বলল, “তাই নাকি!‌ ‌আমি জানতাম না। কিন্তু ফুলে গন্ধ নেই কেন?”

মেয়েটি আবার হাসল। বলল, “আবার বোকার মতো কথা! স্বপ্নে রঙের মতো গন্ধও থাকে না।”

বিধান খুব অবাক হল। রং, গন্ধ থাকে না! তারপরেও সবাই কেন স্বপ্ন দেখতে চায়!‌ একটা সময় বিধান ছুটতে শুরু করল। এই বাগানে তার দমবন্ধ হয়ে আসছে। এখান থেকে বেরোতে হবে। মেয়েটিও পাশে ছুটতে শুরু করল। বলতে লাগল, “আরও জোরে বিধান! আরও জোরে!”

বিধান জোরে দৌড়োতে গেল এবং হুমড়ি খেয়ে পড়ল। হাতে পায়ে ব্যথাও পেল। উঠতে গেলে মেয়েটি বলল, “উঠবেন না, উঠবেন না। প্লিজ়, শুয়ে থাকুন।”

বিধান অবাক হয়ে বলল, “সে কী!‌ আমি ধুলোবালির মধ্যে পড়ে থাকব?”

মেয়েটি রিনরিনে গলায় হেসে বলল, “আপনি তো ধুলোবালির মানুষ। আমরা সবাই তা-ই। আমাদের ধুলোবালিতে পড়ে থাকতে অসুবিধে কী!‌”

বিধান মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকা অবস্থাতেই বলল, “সে আবার কী!‌ ধুলোবালির মানুষ কাকে বলে?”

মেয়েটি গম্ভীর গলায় বলল, “অতি তুচ্ছ, সামান্য। এত বড় বিশ্বে যার কোনও মূল্য নেই।”

বিধান রেগে গিয়ে বলল, “আপনি আজেবাজে কথা বলছেন। আমার দাম আছে। আমার মেয়ে তোয়ার কাছে আমার দাম আছে।”

মেয়েটি আবার রিনরিনে গলায় হেসে উঠল, “বোকা একটা।”

বিধানের ঘুম ভাঙল। সে চোখ খুলল। আবার দু’ হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করল। পারল না। মাথার পিছনটা চিনচিন করছে। একটা পায়েও খুব ব্যথা। কোন পায়ে বোঝা যাচ্ছে না। দুটো পায়েই হতে পারে। কোমরের নীচ থেকে নাড়াতে সমস্যা হচ্ছে।

আধশোওয়া অবস্থাতেই এবার চারপাশে তাকাল বিধান। বুঝতে পারল, হাসপাতাল ধরনের কোনও একটা জায়গায় সে রয়েছে। হ্যাঁ, হাসপাতালই হবে। দু’ পাশে সারি দিয়ে অনেকে শুয়ে রয়েছে। লোহার খাট, সবুজ চাদর পাতা। খাটের পাশে-পাশে স্যালাইনের বোতল ঝুলছে। হাত তুলতে গিয়ে পারল না বিধান, বাঁ হাতে সুচ ফোটানো। তার খাটের পাশেও রড। রডের মাথায় স্যালাইনের বোতল আটকানো। সেখান থেকে নল দিয়ে হাতে স্যালাইন ঢুকেছে।

বিধান অস্ফুটে বলল, “আমি কোথায়?”

সেই মেয়েটির গলা ভেসে এল, “আপনি হাসপাতালে। চিন্তা করবেন না। এখন ভাল আছেন।”

বিধান ডান দিকে ঘাড় ফিরিয়ে এবার মেয়েটিকে দেখতে পেল। হালকা নীল রঙের শাড়ি পরেছে। নাকি কচি কলাপাতা রং? মেয়েটির বয়স বোঝা যাচ্ছে না। ছাব্বিশ-সাতাশ হতে পারে। আবার ত্রিশ-বত্রিশ হতে পারে। বিধান মেয়েদের বয়স বুঝতে পারে না। পরিচয় একটু ঘনিষ্ঠ হলে শ্রীজিতা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আচ্ছা, বলুন তো আমার বয়স কত?”

বিধান মাথা চুলকে বলেছিল, “আমি বুঝতে পারি না।”

শ্রীজিতা ঘাড় কাত করে বলেছিল, “তাও গেস করুন।”

বিধান বলেছিল, “বাইশ হতে পারে।”

শ্রীজিতা মুখে হাত দিয়ে ‘হি হি’ আওয়াজে হেসেছিল।

খাটের পাশে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে, তার গায়ের রং ফরসা হলেও ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া ধরনের সাধারণ দেখতে। শুধু ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। লিপস্টিকের রংও বুঝতে পারল না বিধান। তার কি চোখেও কোনও রকম সমস্যা হল? রং চিনতে বারবার অসুবিধে হচ্ছে কেন? গোটা মাথাটাই এবার দপদপ করে উঠল। ডান হাত কপালে রাখতে গিয়ে বুঝল, সেখানে ব্যান্ডেজ করা। বলল, “আমি হাসপাতালে কেন? আমার কী হয়েছে?”

মেয়েটি বলল, “আপনার একটা ছোট অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। এখন সব ঠিক আছে। এই বোতলের স্যালাইন শেষ হয়ে গেলেই অনেকটা ঠিক হয়ে যাবেন। আপনাকে কড়া ঘুম আর ব্যথার ইনজেকশন দেওয়া আছে। তাই এরকম লাগছে।”

এবার বিধানের আবছাভাবে সব মনে পড়তে লাগল। বাস থেকে রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়ার পর প্রথমে একটি মেয়ে এসে তাকে ধরে। মেয়েটিকে দেখে আশপাশ থেকে আরও কয়েকজন এগিয়ে আসে। ধরাধরি করে তাকে ট্যাক্সিতে তোলা হয়। মনে পড়ছে, ব্যথা-‌যন্ত্রণায় চোখ খুলে রাখতে পারছিল না বিধান। ট্যাক্সিতে উঠে কারও একটা কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়েছিল। এই মেয়েটির কাঁধে নয় তো? তা হলে খুব লজ্জার হবে। মনে পড়ছে, তখন কে যেন ফিসফিস করে বলছিল, “রক্তে ভেসে যাচ্ছে.‌.‌.‌রক্তে ভেসে যাচ্ছে।”

সেই ট্যাক্সি নিশ্চয়ই এই হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। ট্যাক্সি থেকে নামিয়ে একটা কোথাও শোওয়ানো হয়েছিল। স্ট্রেচারে? মাটিতেও হতে পারে।‌ ঘোরের মধ্যে সে দেখেছিল, একজন কমবয়সি ছেলে এসে বলছে, “মাথায় ডিপ ইনজুরি আছে। স্টিচ করতে হবে। ব্লাড লাগতে পারে। রেজিস্ট্রি খাতায় নাম–ঠিকানা লিখে আসুন।” মনে হয় ছেলেটি ডাক্তার। কেউ একজন কানের কাছে মুখ নিয়ে জোরে জোরে বলেছিল, “আপনার নাম কী? কোথায় থাকেন?”

বিধান বিড়বিড় করে নাম বলেছিল। একজন কেউ বলেছিল, “ইনজেকশনগুলো দিয়ে ওটিতে নিয়ে এসো।”

ব্যস, আর কিছু মনে পড়ছে না।

বিধান ঘাড় ঘোরাল। ‌খাটের পাশে একটা টুল থাকা সত্ত্বেও মেয়েটি বসেনি। সে ঝুঁকে পড়ে নরম গলায় বলল, “আপনি বাস থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। মাথা আর পায়ে লেগেছে। পায়ের চোট তেমন কিছু না। ডাক্তার বলেছেন, ক’দিন রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে। ব্লাড বেরিয়েছে বলে, আপনি দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তবে রক্ষে ব্লাড দিতে হয়নি। বাড়িতে গিয়ে রেস্ট নিলে আর বেশি করে খেলেই চাঙ্গা হয়ে যাবেন।”

কথা শেষ করে মেয়েটি টুলটা টেনে নিয়ে বসল। এবার তাকে পরিষ্কার দেখতে পায় বিধান। শাড়ির রং নীল নয়, কচি কলাপাতা।

“আমি কবে এখানে এসেছি ?”

মেয়েটি বলে, “আজ সকালে।”

বিধান বলে, “ও। এখন ক’টা বাজে?”

মেয়েটি বাঁ হাতের কবজি উলটে ঘড়ি দেখে। বলে, “বেশি নয়, সন্ধে ছ’টা।”

বিধানের এবার মনে পড়ে, আজ তোয়ার জন্মদিন। তাকে উপহার দেওয়ার জন্য একটা গোলাপ গাছের চারা নিয়ে সে-ই কলকাতায় আসছিল। ভিড় বাস থেকে নামার সময় পড়ে যায়। পড়ে যায় ? না তাকে পিছন থেকে কেউ ঠেলা মেরেছিল?

মেয়েটির হাতে একটা বড় সাইজ়ের ব্যাগ। ব্যাগটা কোলের উপর নিয়ে চেপে ধরে আছে। “বিধানবাবু, আমি আপনার ঘুম ভাঙার অপেক্ষা করছিলাম। এখন আপনাকে বেশি কথা বলানো উচিত নয়। কিন্তু কয়েকটা কথা না জিজ্ঞেস করলেই নয়। আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি।”

বিধান চুপ করে রইল। সাধারণ দেখতে হলেও মেয়েটার চোখে মুখে এক ধরনের শ্রী আছে। চোখ দুটো বড় আর মায়াকাড়া। বলল, “বলুন।”

মেয়েটি বলল, “বিধানবাবু, আপনাকে যখন আমরা কয়েকজন আজ সকালে এই হাসপাতালে নিয়ে আসি, আপনি কোনও রকমে আপনার নামটা বলতে পেরেছিলেন। বিধান সেনগুপ্ত। ঠিকানাটা পুরো বলতে পারেননি। বজবজটুকু শোনা গিয়েছে শুধু। আপনার কাছে কোনও ব্যাগও ছিল না। ব্যাগে কাগজপত্র দেখে অনেক সময় বাড়ির হদিশ পাওয়া যায়। মানিব্যাগে খুচরো টুচরো মিলিয়ে বাহান্ন টাকা পাওয়া গিয়েছে। আপনার বাড়ির ঠিকানা, অফিসের ঠিকানা যদি এবার বলেন। ফোন নম্বর থাকলে তা-ও বলতে পারেন। আপনার বাড়িতে খবর দিতে হবে। হাসপাতালও চাইছে বাড়ির কেউ আসুক। কারণ এবার তো তাঁদের দরকার।”

বিধান অবাক হল, মেয়েটিকে দেখে বোঝা যায়নি, সে এমন গুছিয়ে কথা বলতে পারে।

মেয়েটি বলল, “ভেবেছিলাম হাসপাতালে ঢুকিয়ে দিয়েই আমার ডিউটি শেষ হবে। আপনার বাড়ির খোঁজ আপনি দিয়ে দেবেন। তা না হওয়ায়, আমাকে আবার এবেলাও আসতে হয়েছে।”

বিধান ল‌জ্জিত গলায় বলল, “‘কী বলে আপনাকে ধন্যবাদ জানাব জানি না। খুবই বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলেছি।”

মেয়েটির সায় দেওয়া ধরনের হেসে বলল, “না-না। আপনি তো ইচ্ছে করে পড়ে যাননি। রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখলে মুখ ফিরিয়ে চলে যাওয়া উচিত হয়তো। কিন্তু কোনও কারণে, আজ পারিনি। হয়তো হাতে যেভাবে ফুল গাছের একটা টব আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন, তাই দেখে.‌.‌.‌যাক সে কথা।

বিধান বলল, “আপনি না থাকলে রাস্তায় পড়েই থাকতাম‌।”

মেয়েটি কথাটার কোনও প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে কোলের ব্যাগ খুলে হাতড়ে এক চিলতে কাগজ আর একটা পেন বের করল, “‘নিন বাড়ির পুরো ঠিকানা আর ফোন নম্বর বলুন। আমি হাসপাতাল থেকে ফোন করতে বলে দিই।”

বিধানের জল তেষ্টা পাচ্ছে। হাসপাতালে জল কার কাছ থেকে চাইতে হয়?

“আমি বজবজের কাছে কিশোরীপুর নামে এক জায়গায় থাকি। বাড়িতে কেউ নেই। একাই থাকি।”

মেয়েটি বলল, “অফিস? আপনার স্ত্রী? বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন কেউ?”

বিধান ঢোঁক গিলে বলল, “না। আমার সেরকম কেউ নেই।”

মেয়েটির কপালে ভাঁজ পড়ল, “সে কী! ‌কেউ নেই?”

বিধান মুখ ঘুরিয়ে বলল, “না, কেউ নেই। আমি তেমন কোনও কাজকর্মও করি না। একটু খাবার জল পাওয়া যাবে?”

মেয়েটি ব্যস্ত হয়ে চারপাশে তাকাল। সম্ভবত নার্স গোছের কাউকে খুঁজল। পেল না। মেয়েটি নিজের ব্যাগ খুলে একটা ছোট জলের বোতল বের করল।

বিধান বলল, “ছি-ছি, আপনার জল.‌.‌.‌‌”

মেয়েটি হালকা বিরক্ত গলায় বলল, “কী করব? এখানে তো আর কারও জল পাচ্ছেন না। নিন ধরুন, নিজে খেতে পারবেন? আচ্ছা ছাড়ুন, মাথাটা একটু তুলুন, আমি ঢেলে দিচ্ছি।”

মাথা উঁচু করতে বিধানের যত না কষ্ট হল, তার চেয়ে অনেক বেশি অস্বস্তি হল মেয়েটি তার মাথা ধরল বলে। কিছু করার নেই। মেয়েটি বোতল বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে।

“আমার মোবাইল ফোনটা কোথায় বলতে পারেন?” এক ঢোঁক জল খাওয়ার পর বলল বিধান।‌

মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, “আপনার সঙ্গে মোবাইল ফোন ছিল বুঝি?”

বিধান বলল, “যাক গে, নিশ্চয়ই পকেট থেকে পড়ে গিয়েছে।”

মেয়েটি বলল, “ইস্‌। কেউ তুলে নিয়েছে বোধহয়।”

বিধান শুকনো হেসে বলল, “ভাববেন না। খুব সামান্য ফোন। কম দাম।”

মেয়েটি জলের বোতল ব্যাগে ভরে বলল, “তা ঠিক, ‌প্রাণে বেঁচেছেন এই অনেক, বাসের চাকা আপনার গায়ের উপর দিয়ে চলে যেতে পারত।”

একজন মোটা চেহারার লোক এসে ঘরের ভিতর ঘুরতে-ঘুরতে উঁচু গলায় বলতে লাগল, “ভিজ়িটিং আওয়ার শেষ! ভিজ়িটররা বেরিয়ে যান।”

মেয়েটি চিন্তিত মুখে ব্যাগ গুছিয়ে উঠে দাঁড়াল, “কী মুশকিল হল বলুন দেখি। আপনার পরিচিত কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলাম না। কাল বা পরশু আপনাকে এখান থেকে ছুটি দেবে। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে তাই মনে হল। কে আপনাকে নিয়ে যাবে?”

বিধান নিচু গলায় বলল, “আপনি চিন্তা করবেন না। আমি নিজেই চলে যাব। আপনি আমার জন্য অনেক করলেন। হয়তো রাস্তায় পড়ে থেকে মরেই যেতাম।”

“ওসব কথা রাখুন। আমাকে আপনি বিপদে ফেলে দিলেন। একা বাড়ি যেতে পারবেন?”

বিধান কিছু বলার আগেই সেই হুমদো চেহারার লোকটা এসে সামনে দাঁড়াল। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলল, “টাইম হয়ে গিয়েছে দিদি। ‌এবার চলে যান।”

বিধান বলল, “বিপদের কিছু নেই, আপনি চিন্তা করবেন না ম্যাডাম।”

মেয়েটি বিরক্তভাবে বলল,“ম্যাডাম বলছেন কেন? আমার নাম ঝুমুর। ঝুমুর গঙ্গোপাধ্যায়।”

বিধান বলল, “ও আচ্ছা। ‌আপনি চিন্তা করবেন না। এরা একটা ট্যাক্সি ধরিয়ে দিলে আমি একা বাড়ি ফিরে যেতে পারব।”

ঝুমুর বলল, “পারলে ভাল। তবে সরি, এর চেয়ে বেশি কিছু করার ক্ষমতা আমার নেই।”

ঝুমুর পিছন ফিরলে বিধান বলল, “একটা কথা।”

ঝুমুর ঘুরে দাঁড়াল, “কী?”

বিধান অস্ফুটে বলল, “আমার সঙ্গে একটা টব ছিল। সেটার কী হল, বলতে পারেন?”

ঝুমুর ভুরু কুঁচকে বলল, “যে টবটা নিয়ে আপনি বাস থেকে পড়ে গিয়েছিলেন? সরি, আপনাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, আপনার টবের খেয়াল করতে পারিনি। কিছু মনে করবেন না, ওই টবের জন্যই আপনার অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। বাস থেকে নামার সময় গেটের রড ধরবার বদলে আপনি টব আঁকড়ে ছিলেন। আর তাতেই…”

বিধান লজ্জা পেয়ে বলল, “তাই নাকি!‌”

ঝুমুর রাগ-রাগ গলায় বলল, “হ্যাঁ, আমি চললাম। সাবধানে থাকবেন। কিছু মেডিসিন এরা কিনে দিতে বলেছিল, দিয়ে গেলাম। আর পারব না। হাতে টাকা নেই। আপনার পার্স এখানে জমা রইল, ছুটি পেলে নিয়ে যাবেন।”

কয়েক পা গিয়ে ঝুমুর আবার ঘুরে দাঁড়াল। ব্যাগ খুলে দুটো একশো টাকার নোট বের করল, “নিন রাখুন। ট্যাক্সি ভাড়া দেবেন।”

বিধান বলল, “না-না, লাগবে না।”

ঝুমুর বিরক্ত গলায় বলল, “না লাগলে ফেলে দেবেন। আমাকে মুক্তি দিন।”

টাকাটা বিধানের বালিশের তলায় গুঁজে রেখে চলে গেল।

বিধান চোখ বুজল। এতক্ষণ কথা বলে তার ক্লান্ত লাগছে। ঝুমুর নামটা বেশ। মেয়েটার মতোই নরমসরম। তবে মেয়েটার কথা বলার মধ্যে এক ধরনের জোর আছে। রাগও আছে। তার কাছে এলে কি সব মেয়েই বিরক্ত হয়?

তবে মনে-মনে হাসল। তার আবার ঠিকানা!‌ যে মানুষটা একটার পর একটা ঠিকানা থেকে উচ্ছেদ হয়েছে, তার কখনও ঠিকানা থাকতে পারে? ঝুমুরকে সে কোন ঠিকানা দিত? কিশোরীপুরে যে বেশিদিন থাকবে, তারও তো কোনও নিশ্চয়তা নেই। আসলে অল্পদিনের ব্যবধানে বাবা–মা মারা গেলে কলকাতার পাততাড়ি গোটাতে হয়েছিল বালক বিধানকে। চলে যেতে হয়েছিল বর্ধমানে বড়মামার বাড়ি। বাবার রোজগারপাতির অবস্থা ভাল ছিল না। মায়ের বাড়ির দিকের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে সাহায্য আসত। মায়ের মৃত্যুর পর সেই সাহায্যও গেল কমে। ফলে বড়মামার বাড়িতে আশ্রিত হওয়া ছাড়া অন্য কোনও পথ ছিল না বিধানের। সেখানে থেকেই স্কুল, কলেজে লেখাপড়া। কলেজ পরীক্ষা শেষ হলে বড়মামা একদিন ডেকে পাঠালেন, “এত পর্যন্ত টেনে দিলাম বিধান। এবার নিজেরটা নিজে বুঝে নাও। এতে আমাদের সুবিধে হবে, এমনটা ভেবো না। অতিরিক্ত একজন মানুষের থাকা খাওয়া যে এবাড়িতে কোনও সমস্যার নয়, সেটা নিশ্চয়ই এতদিনে বুঝতে পেরেছ। তোমার নিজের সম্মানটাই বড় কথা। আমি চাই, তুমি নিজের জোরে বাকি জীবনটা কাটাও।”

শুরু হল কষ্ট করে বেঁচে থাকার লড়াই। দু’–একটা টিউশন, এখানে-ওখানে রাইস মিলের গদিতে খাতা লিখে কিছু রোজগার করার পাশাপাশি চাকরির খোঁজ শুরু হল। কিছুদিন পর একটা কাজ পেয়ে কলকাতায় চলে এল বিধান। শিয়ালদার কাছে একটা মেসে ঘর নিল। মাস কয়েক পরে আর একটু ভাল চাকরি জুটল। মেস ছেড়ে বেহালার এক কামরার ঘরে ঠিকানা হল। সে ঠিকানাও ছাড়তে হল একদিন। বিয়ের পর শ্রীজিতা বলত, “এক কামরা বড্ড ছোট। আর একটু বড় ঘর চাই।”

বিধান বলত, “বড় বাড়ির জন্য তো ভাড়াও অনেকটা হবে।”

শ্রীজিতা বিরক্ত হয়ে বলেছিল, “সে তো‌ হবেই। এখন তো ব্যাচেলরের বাড়ি নয়। আমার কাপড় বদলানোর জন্যও তো একটা জায়গা চাই।”

বিধান জানত, বাড়ির সঙ্গে জেদ করে অতি সাধারণ, নিম্নবিত্ত একটি ছেলেকে বিয়ে করেছে শ্রীজিতা, ফলে পদে-পদে তার অসুবিধে হচ্ছে। যত দিন যাবে টাকাপয়সার অভাব তাকে অনেক বেশি সমস্যায় ফেলবে। তার উপর বাপের বাড়ি থেকে বেরিয়েছে খালি হাতে। না বেরিয়ে উপায়ও ছিল না। রেজিস্ট্রি অফিসে জমা দেওয়া নোটিশ পিরিয়ড শেষ হওয়ার দু’দিন পরেই বিয়ে হয়ে যায়। সাক্ষী শ্রীজিতার দু’জন বন্ধু। আশ্চর্যের হলেও তার মধ্যে পূর্বা ছিল না। সে বিয়ের কথা শুনে ভীষণ রেগে গিয়েছিল, “এ কী বলছিস!‌ লোকটাকে তো আমরাও ভাল করে চিনি না। শুনেছি, একটা ছোটখাটো চাকরি করে। তোর মতো মেয়ে এ কী বোকামি করলি? কত ভাল বিয়ে হতে পারে তোর‌।”

কথার মাঝখানেই শ্রীজিতা ফোন কেটে দিয়েছিল।

এদিকে শ্রীজিতা বাড়িতে ঘোষণা করে দিয়েছিল, “আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ক’দিনের মধ্যেই আমি চলে যাব।”

কথাটা শুনে জয়া একটু চুপ করে থেকে বলেছিলেন, “তুই ঠাট্টা করছিস?”

শ্রীজিতা বলেছিল, “একরকম ঠাট্টাই বলতে পারো মা। যার সঙ্গে সংসার করতে চলেছি, সে কোনওভাবেই আমাদের পরিবারের সঙ্গে মানায় না। একটাই প্লাস পয়েন্ট, মানুষটা ভাল। বেশি ভাল। আমাকে কন্ট্রোল করতে চাইবে না। এই জন্যই তাকে বেছেছি। খুব ছোট চাকরি করে। এত ছোট যে, আমি যদি এখনই কাজকর্ম কিছু না পাই, চলা কঠিন হবে।”

জয়া চোখমুখ লাল করে বলেছিলেন, “টাকাপয়সা ছাড়া ভালমানুষের সঙ্গে বেশিদিন থাকতে ভাল লাগবে?”

শ্রীজিতা সামান্য হেসেছিল। বলেছিল, “মনে হয় না লাগবে। কিন্তু আমার উপায় ছিল না মা। জীবনের খুব দামি একটা সময়ে পায়ে তোমাদের টাকাপয়সার বেড়ি নিয়ে চললাম। সেই বেড়ি আমি আর সহ্য করতে পারছি না। বড় চাকুরে, উচ্চ পরিবারের কাউকে বিয়ের করার ঝুঁকি আর নিতে পারছি না। তোমাদের জন্যই পারছি না। যদি এতে ভুল হয় তার জন্য তোমরা, বিশেষ করে বাবা দায়ী থাকবে।”

জয়া রাগে গরগর করে বলেছিলেন, “লম্বা চওড়া লেকচার দিতে শিখেছিস জানতাম। কিন্তু বাবা–মাকে লুকিয়ে রাস্তার ভিখিরি ছেলেকে বিয়ে করতে শিখেছিস, এটা জানতাম না।”

“তোমরাই শিখতে বাধ্য করেছ।”

অনিমেষ বসু তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে খবর শোনার পর একটা কথাই বলেছিলেন, “তোমার মেয়েকে বলে দিয়ো, সে যেন আর একদিন এ বাড়িতে না আসে। এতদিন তো আমার প্রোটেকশনে থাকল, এবার জগৎটা ঘুরে দেখুক।”

শ্রীজিতার জন্যই বেহালার শিকড় উপড়ে কসবার কাছে অপেক্ষাকৃত বড় একটা ফ্ল্যাট নিতে হয়েছিল বিধানকে। একতলায়, রাস্তার উপর দেড় কামরার সেই ফ্ল্যাট। দিনের বেলাতেও ভাল করে আলো ঢুকত না। তবে আগেরটার চেয়ে ভাল। শ্রীজিতা বাড়িটাকে মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছিল।

শ্রীজিতা ভেবেছিল, বিয়ের পর লেখাপড়া চালিয়ে যাবে। রিসার্চ করবে। কিন্তু যেহেতু তার স্কলারশিপ ছিল না, তাই খরচের ব্যাপার ছিল। তা ছাড়া একেবারে খালি হাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসায় সে ছিল প্রায় নিঃস্ব। ফলে টানাটানির সংসারে গাদাখানেক খরচ করে আর লেখাপড়া চালানো হল না। ফলে গবেষণার পরিকল্পনা মুলতুবি রেখে বাড়িতেই টিউশন শুরু করল শ্রীজিতা। বিধানও অফিস থেকে ফেরার পথে দুটো ছেলেকে পড়িয়ে ফিরত। কলেজে অঙ্ক নিয়ে পড়াশোনা করায় টিউশন পেতে অসুবিধে হয়নি। এর মধ্যেই কনসিভ করে বসল শ্রীজিতা। একেবারে অকস্মাৎ। এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা চায়নি সে। তার উপর টাকাপয়সার বিচ্ছিরি অবস্থা। আর বিধানের এই বিষয়ে তো কোনও ভাবনাচিন্তাই ছিল না।

শ্রীজিতার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপারে বিধান গোড়া থেকেই ছিল আড়ষ্ট। শ্রীজিতা ভেবেছিল, এই আড়ষ্টতা স্বাভাবিক। শ্রীজিতা যতই বউ হোক, তার রূপ, ব্যক্তিত্ব, পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড বিধান ভুলতে পারছে না। এই জড়তা কাটতে সময় লাগবে। শ্রীজিতা নিজেই এগিয়ে গিয়েছিল। তার শরীর পুরুষমানুষকে প্রলুব্ধ করার পক্ষে যথেষ্ট।

রাতে শোওয়ার পর বিধানকে কাছে টানত শ্রীজিতা। বেশির ভাগ দিনই জোর করে টানত। তাতেও যে খুব লাভ হত এমনটা নয়। প্রথম-প্রথম চিন্তা হত। কেন এমন হবে? বিধানের শরীরে কি কোনও সমস্যা রয়েছে? তা তো মনে হয় না! তা হলে? প্রথমদিকের ভয় কাটলে শ্রীজিতা একদিন রেগে গেল।

বিছানায় ওঠার পর বিধান বলত, “আলো নেভালে না?”

“আলো নেভানোর কী আছে?”

সংকুচিত বিধান বলত, “না, তা নয়। রাত হয়েছে তো…”

শ্রীজিতা বলত, “আমাকে দেখতে ‌ইচ্ছে করে না তোমার?”

বিধান জোর করে হাসত। বলত, “তোমাকে তো সারাক্ষণই দেখছি। ইচ্ছে করবে না কেন?”

শ্রীজিতা বিধানের গায়ে হাত বুলিয়ে গাঢ় স্বরে বলত, “এই ভাবে নয়, যেভাবে এই রাতে তোমার আমাকে দেখা উচিত, সেইভাবে দেখতে ইচ্ছে করে না?”

বিধান আমতা-আমতা করত। বলত, “করবে না কেন?”

শ্রীজিতা তার হাত টেনে ধরে নিজের বুকে রাখত। বলত, “তা হলে নাও, আমার জামাটা খুলে দাও।”

বিধান খানিকটা যেন মিনতির গলায় বলত, “আলোটা নিভিয়ে আসি ‌শ্রী?”

শ্রীজিতা চাপা গলায় ধমক দিয়েছিল, “খালি আলো নিভিয়ে আসি… তুমি কি মেয়ে? তোমার লজ্জা করছে? নাকি আমাকে চাইছ না?”

বিধান আরও থতমত খেয়ে গিয়েছিল, “তোমার জন্যই তো বলছিলাম।”

শ্রীজিতা দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল, “আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। তুমি আমার কাপড় খুলে দাও। তারপর আমাকে দেখো ভাল করে। দেখে বলো, তোমার বউ সুন্দরী কি না! তার শরীর পেতে তোমার ইচ্ছে করে কি না!”

এত রাগারাগি, এত আহ্বানেও বিধান গড়িমসি করত। পায়ের কাছে গুটিয়ে থাকা চাদর টানতে চাইত। কোনও-কোনওদিন এমনও হয়েছে, এই সব সময় শ্রীজিতা নিজেকে আর সামলাতে পারেনি। ফুঁসে উঠেছে। বিছানার উপর হাঁটু গেড়ে বসেছে। নাইটি খুলে ফেলে দিয়েছে ছুড়ে। হাত দু’পাশে ছড়িয়ে বলত, “এবার বলো, এবার আমার এই শরীরটা পেতে ইচ্ছে করছে না তোমার? আমার বুক দুটো দেখো। আমার পেট দেখো, কোমর দেখো, দেখো আমার এই পা দুটো। ভাল নয়? মনে হয় না, কেড়ে নিই?‌”

এই সময়ে বিধান তাড়াতাড়ি উঠে তার হাত ধরে নিজের উপর টেনে নিত শ্রীজিতাকে। আদরে নয়, কথা থামানোর জন্য। স্বামীর বুকের উপর শুয়ে পড়েও শ্রীজিতা বুঝতে পারত কোথাও একটা ফাঁক রয়ে যাচ্ছে।

মিলনের সময়ও নানা ভঙ্গিমায় স্বামীর উৎসাহ বাড়ানোর চেষ্টা করেছে শ্রীজিতা। বিধানের শরীর সাড়া দিলেও, মন দেয়নি। স্ত্রীর সঙ্গে মিলনকে সে যেন সংসারের একটা ‘কাজ’ হিসেবেই দেখছে। বিয়ের বহুবছর কেটে যাওয়ার পর অভ্যস্ত দম্পতিকে যা মানায়। কিছুদিনের মধ্যে শ্রীজিতা বুঝতে পেরেছিল, আড়ষ্টতা নয়। বিধান আসলে তার শরীরের প্রতি নিস্পৃহ। শুধু স্ত্রীর শরীর নয়, গোটা জীবনের প্রতিই তার একধরনের উদাসীনতা রয়েছে। সে যেন এই জগতের মধ্যে নেই। উন্নতি করার উদ্যমটুকুও নেই। এদিক-ওদিক থেকে রোজগার করে যে সংসারে দুটো বেশি টাকা আনবে, তা-ও পারে না। অফিস ফেরত টিউশনটাও একদিন ছেড়ে দিল দুম করে। বিয়ের বছরদেড়েক ঘুরতে না ঘুরতে শ্রীজিতার মনে হয়েছিল, বিধান তাকে গ্রহণ করতে পারছে না। এর মধ্যে কনসিভ করার খবর তাকে চিন্তার মধ্যে ফেলল। নিজের উপর রাগও হল। বিধানের সঙ্গে বিছানায় যাওয়ার আগে প্রোটেকশন নেওয়ার কাজটা নিজে করেছে। বিধান অফিস থেকে ফেরার সময় কন্ডোম কিনে পকেটে ঢোকাবে, এটা ভাবাও কঠিন। শ্রীজিতা বুঝতে পারল, এই ভুল তার। দেরি না করে ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করেছিল।

মহিলা ডাক্তার, রাশভারী। ইউরিন রিপোর্ট হাতে নিয়ে বলেছিলেন, “কনগ্র্যাচুলেশনস। আপনি মা হতে চলেছেন।”

শ্রীজিতা বলেছিল, “ধন্যবাদ। কিন্তু আমি এখনই বেবি চাইছি না।”

ডাক্তার বলেছিলেন, “আপনি ভেবেচিন্তে ঠিক করুন। হাজ়ব্যান্ডের সঙ্গে কথা বলুন। ফার্স্ট চাইল্ড অ্যাবর্ট করা হলে নানারকম কমপ্লিকেশনস তৈরি হতে পারে।”

শ্রীজিতা বলেছিল, “হোক। আমি তারপরেও করব ডক্টর।”

“খুব কমপ্লিকেশন না হলে তো আমি নিজে এ কাজ করি না।‌”

“তা হলে ব্যবস্থা করে দিন প্লিজ়।”

ডাক্তার বলেছিলেন, “তাও আমি আপনাকে দুটো দিন ভাবতে বলব। আপনি বাড়িতে কথা বলে দু’দিন পরে আসুন।”

শ্রীজিতা বিধানকে জিজ্ঞেস করেছিল। বিধান উত্তর দিয়েছিল, “তুমি যেটা ভাল বুঝবে।”

শ্রীজিতা উত্তেজিত হয়ে বলেছিল, “কেন!‌ আমি একা বুঝব কেন? বাচ্চা কি একা আমার?”

বিধান একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, “বাচ্চা একা তোমার, এটা বলিনি শ্রী। বলেছি এই ঝামেলা তুমি নিতে পারবে কি না।”

শ্রীজিতা আরও রেগে গিয়েছিল। পুরো মতটাই হঠাৎ পালটে গেল যেন, “বাচ্চা হওয়া কীসের ঝামেলা? হতদরিদ্রের ঘরেও ছেলেপুলে হয়। আমরা তো হতদরিদ্র নই! তুমি একটা অফিসে চাকর। আমি টিউশন করি। যে-কোনও সময়ে একটা ভাল চাকরি পেয়ে যাব। আর যদি ঝামেলা হয়েই থাকে, তার দায় তুমিও নেবে।”

বিধান বেতের চেয়ারে বসে পুরনো ম্যাগাজ়িনের পাতা দেখছিল। ম্যাগাজ়িন সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। পায়ে চটি গলাতে-গলাতে নিচু গলায় বলল, “তুমি ভাল করেই জানো শ্রী, আমি পারব না। আমার এসব ভাল লাগে না। তুমি চেয়েছিলে, তাই সংসারে জড়িয়ে পড়েছি। আমি যে সংসারে মিসফিট‌, সেকথা তুমিও বুঝতে পারো।”

কথা শেষ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল বিধান। সেই সময়টা সে এমনই করত। বাড়িতে থাকতে চাইত না। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ত। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরত।

শ্রীজিতা কান্নাকাটি করার মেয়ে নয়। তারপরেও সেদিন অনেকটা সময় নিয়ে কেঁদেছিল। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, বাচ্চা নষ্ট করবে না।

ওই ক’টা মাস শ্রীজিতার বাবা–মা খুব চেষ্টা করেছিলেন, মেয়েকে বাড়ি নিয়ে যেতে। মায়ের ফোন ধরা বন্ধ করে দিল শ্রীজিতা। অনিমেষ বসু গাড়ি নিয়ে নিজে এলেন। বাড়িতে তখন বিধান রয়েছে। তার সামনে বসেই তার উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করে তাঁরা মেয়েকে বোঝাতে থাকেন।

“অনেক হয়েছে, এবার বাড়ি চলো। বাচ্চা হয়ে গেলে ক’দিন থেকে শরীর ঠিক করে ফিরে আসবে।”

জয়া বলেছিলেন, “এখন হেলদি খাবার খেতে হবে, সাবধানে থাকতে হবে। নইলে বাচ্চার ক্ষতি হবে। এখানে তো কিছুই জুটবে না। আমরা না হয় তোর বিয়ে না মেনে দোষ করেছি। কিন্তু যে-বাচ্চাটা আসছে, সে তো কোনও দোষ করেনি।”

শ্রীজিতা মা বাবাকে চা করে দিয়ে বলেছিল, “সব বাচ্চার কপালে সব কিছু জোটে না। আমার সন্তানও না হয় কিছু অভাবের মধ্যে জন্মাবে। আমি এখানেই থাকব। এইসব ফলটল যা এনেছ, হয় তোমরা গাড়িতে চাপিয়ে ফেরত নিয়ে যাও। নয়তো আমাকে গাড়ি ভাড়া করে ফেরত দিয়ে আসতে হবে।”

অনিমেষ বসু উত্তেজিত হয়ে বলেছিলেন, “এটা কি একটু বেশি নাটকীয় হয়ে যাচ্ছে না শ্রী? তুই কি চাইছিস, তোর কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইব? যদি তাই চাস তো বল। ওই তো বিধান বসে আছে, তার কাছেও ক্ষমা চাইছি।”

শ্রীজিতা বলেছিল, “বাবা, নাটক কিন্তু তুমি করছ। তুমি ভাল করেই জানো আমি যাব না।”

এই অশান্তির মাঝপথে সেদিনও বিধান নিঃশব্দে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। একসময়ে অনিমেষ বসুও রাগে ফুঁসতে-ফুঁসতে বেরিয়ে আসেন।

তোয়া জন্মানোর কিছু বছর পর আবার বিধানের ঠিকানা বদল হল। সেটা শ্রীজিতার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর। তার আগে চাকরিটাও চলে গিয়েছিল। আবছা ঘুমের মধ্যে বিধান শুনতে পেল কে যেন ডাক ছেড়ে কাঁদছে। হাসপাতালে ডাক ছেড়ে কান্না অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিধান চোখ খুলল। একজন নার্স এসে স্যালাইনের ফাঁকা বোতল খুললেন। হাত থেকে নল, সুচ খুললেন। যাওয়ার আগে বিধান তাকে বলল, “দিদি, ক’টা বাজে বলতে পারেন?”

“সাতটা দশ। আর একটু পরেই খেতে দেবে।”

খাবার এলেও, বিধান মুখে দিল না কিছুই। হাসপাতালে সাধ্য-সাধনা করে খাওয়ানোর মতো কেউ থাকে না। ডাক্তারবাবু রাউন্ডে এসে দেখে গেলেন। বললেন পরশু ছাড়বেন।

একটু রাতে চোখ জড়িয়ে এল বিধানের। মাথার ভিতরে নানা চিন্তা ঘুরছে। তোয়া কি তার জন্য অপেক্ষা করে আছে? তার কি মনে আছে, বাবা তার জন্মদিনে লাল গোলাপের একটা গাছ দেবে বলেছে? ওই মেয়েটিকে শ্রীজিতার মোবাইল নম্বরটা দেওয়া কি উচিত ছিল? বিধানের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে শুনলে শ্রীজিতা কী করবে? আচ্ছা, ওই মেয়েটার কী নাম যেন? ঝুমা? ঝুলন? মনে পড়ছে না.‌.‌.‌ ঘুমে ডুবে যাওয়ার সময় বিধান শুনতে পেল কে যেন তার কানে ফিসফিস করে বলেছে, “আপনার নাম কী? কোথায় থাকেন.‌.‌.‌‌ আপনার নাম কী? কোথায় থাকেন…”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *